০৭. আথিনা এবং সংস্কৃতি

৭. আথিনা এবং সংস্কৃতি

৪৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং ৪৮০-৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত দুটি পারসিক যুদ্ধের সময় থেকে আথিনার মহত্ত্বের শুরু। এর আগে ইওনীয় এবং মাগনা গ্রায়েকিয়া (Magna Graecia-দক্ষিণ ইতালি এবং সিসিলির নগরগুলো)-তে মহান ব্যক্তির জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পারস্য সম্রাট দারিয়সের সঙ্গে ম্যারাথনের যুদ্ধে জয়লাভের (৪৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী ক্লারক্সেস (Xerxes-৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)-এর বিরুদ্ধে আথিনীয় নেতৃত্বে গ্রিক নৌবাহিনীর জয়লাভে আথিনার মর্যাদা বিরাটভাবে বৃদ্ধি পায়। দ্বীপবাসী ইওনীয়রা এবং এশিয়া মাইনরের মূল ভূখণ্ডের কোনো কোনো অংশের বসবাসকারীরা পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে পারসিকদের বিতাড়িত করে আথিনা তাদের মুক্ত করে। স্পার্তানরা নিজের রাজ্যের বাইরে আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামাত না, এ সংগ্রামে তারা অংশগ্রহণ করেনি। সুতরাং পারস্য বিরোধী মৈত্রীতে আথিনাই প্রধান অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। এই মৈত্রীর সংবিধান অনুসারে অংশীদার যে কোনো রাষ্ট্র একটি বিশেষ সংখ্যক জাহাজ কিংবা তার মূল্য দিতে বাধ্য ছিল। অধিকাংশ রাষ্ট্রই শেষেরটি বেছে নিত, এভাবে আথিনা তার মিত্রদের উপরে নৌশক্তিতে প্রাধান্য লাভ করে এবং ধীরে ধীরে এই মৈত্রী পরিণত হয় আথিনীয় সাম্রাজ্যে। আথিনা সম্পদশালী হয়ে ওঠে এবং পেরিক্লেসের বিচক্ষণ নেতৃত্বে তার সমৃদ্ধি বাড়াতে থাকে। পেরিফ্রেস (Pericles) নাগরিকদের দ্বারা স্বাধীনভাবে নির্বাচিত হয়ে প্রায় ত্রিশ বছর আথিনা শাসন করেন, তাঁর পতন হয় ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।

পেরিক্লেসের যুগই আথিনার ইতিহাসে সবচাইতে সুখী এবং গৌরবময়। পারসিক যুদ্ধের যোদ্ধা আয়েসখুলস (Aeschylus) গ্রিক বিয়োগান্ত নাটক শুরু করেন। পার্সোয়ে (Parsae) নামক একটি বিয়োগান্ত নাটকে তিনি চিরাচরিত প্রথায় হোমেরীয় বিষয় গ্রহণ না করে ক্লারক্সেস এর পরাজয়কে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। তার পরে পরেই আসেন। সফক্লেস এবং সফক্লেসের পরে এউরিপিদেস। উভয়েরই কর্মকাল ছিল পেলোপনেশীয় যুদ্ধের পরবর্তী সেই অন্ধকার যুগ পর্যন্ত পেরিক্রেসের পতন ও মৃত্যুর পর যা আরম্ভ হয়েছিল। এউরিপিদেসের নাটকে পরবর্তী যুগের সংশয় লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সমসাময়িক ছিলেন আরিস্তফানেস (Aristophanes), তিনি ছিলেন হাস্যরসের কবি এবং সবল ও সীমিত কাণ্ডজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্ত মতবাদ নিয়ে রসিকতা করতেন। তিনি, বিশেষ করে, সক্রাতেসকে নিন্দা করেছেন, কারণ, সাতেস জিউসের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন এবং অপবিত্র মেকী-বৈজ্ঞানিক রহস্য নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন।

আক্রপলিস (Acropolis)-এর মন্দিরগুলো আগুনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল- ক্সারক্সেস আথিনা দখলের সময়। পেরিসে সেগুলোর পুনর্নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। পার্থেনন এবং অন্যান্য মন্দিরগুলোর ধ্বংসাবশেষ আজও আমাদের চমৎকৃত করে। সেই মন্দিরগুলো তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। দেব-দেবীর সুবিশাল মূর্তি তৈরি করার জন্য স্থপতি ফেইদিয়স (Pheidias) রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত হন। এই যুগের শেষে আথিনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল হেলেনীয় জগতের সুন্দরতম ও দীপ্ততম শহর।

ইতিহাসের জনক হেরোদতস (Herodotus) এশিয়া মাইনরের হালিকার্নাসসস (Halicarnassus)-এর লোক হলেও থাকতেন আথিনাতে। আথিনীয় রাষ্ট্রের উৎসাহে তিনি আথিনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পারসিক যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেন।

পেরিক্লেসের যুগে আথিনার কৃতিত্ব বোধ হয় সারা ইতিহাসে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা। এই যুগের পূর্ব পর্যন্ত আথিনা গ্রিক নগরীর তুলনায় পশ্চাৎপদ ছিল, শিল্প কিংবা সাহিত্য-কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিরাট পুরুষ সৃষ্টি করতে পারেনি। সিলন (Solon) বাদে, তিনি ছিলেন প্রধানত আইন প্রণয়নকারী]। সহসা বিজয় এবং সম্পদের প্রভাবে ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে স্থপতি, ভাস্কর এবং নাট্যকাররা এমন সমস্ত সৃষ্টি করে গিয়েছেন যা আজও অনতিক্রমনীয়। সেগুলো আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করেছে। ব্যাপারটা আরও আশ্চর্যজনক মনে হয় যখন আমরা এই কর্মের সঙ্গে জড়িত জনসংখ্যার ক্ষুদ্রতা বিচার করি। ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি আথিনার জনসংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ, সেটা বড়জোর ২,৩০,০০০ (ক্রীতদাস সমেত) এবং একে ঘিরে গ্রাম্য আত্তিকার জনসংখ্যা ছিল সম্ভবত আরও অনেক কম। এর আগে কিংবা পরে কখনোই কোনো দেশ এইরকম জনসংখ্যার কাছাকাছি অনুপাতে কর্মের উচ্চতম উৎকর্ষের ক্ষমতা দেখাতে পারেনি।

দর্শনে আথিনা দান করেছে দুজন মাত্র বিরাট পুরুষ–সক্রাতেস এবং প্লাতন। প্লাতন একটু পরবর্তী যুগের কিন্তু সক্রাতেস তার যৌবন এবং পরিণত বয়সের প্রথম ভাগ কাটিয়েছেন পেরিক্লেসের যুগে। অন্য নগর থেকে আগত শিক্ষকদের দর্শন সাগ্রহে শোনার মতো দর্শনশাস্ত্রে আকর্ষণ আথিনাবাসীদের ছিল। বিতকানুশীলনে উৎসুক যুবকদের কাছে সফিস্টদের খুব মূল্য ছিল। ছাত্ররা কীভাবে বিখ্যাত আগন্তুকদের বাক্য আঁকড়ে ধরত সে সম্পর্কে প্রতাগরস (Protagoras)-এ প্লাতনীয় সক্রাতেস ব্যঙ্গোক্তিমূলক মজার বিবরণ দিয়েছেন। আমরা দেখতে পাব পেরিক্লেস আনাক্সাগরস (Anaxagoras)-কে আমদানি করেছেন। সক্রাতেস বলেছেন, সৃষ্টিতে মনের প্রাক প্রাধান্য সম্পর্কে তিনি শিক্ষালাভ করেছেন আনাক্সাগরসের কাছ থেকে।

প্লাতনের ধারণা অনুসারে তাঁর কথোপকথনের বেশির ভাগই হয়েছিল পেরিক্লেসের আমলে, তা থেকে ধনীদের জীবনযাত্রার একটা সুন্দর ছবি আমরা দেখতে পাই। প্লাতন ছিলেন আথিনীয় অভিজাত বংশের মানুষ, তিনি বড় হয়েছিলেন পূর্ববর্তী যুগের ঐতিহ্যে। যুদ্ধ ও গণতন্ত্র তখনো উচ্চশ্রেণির সম্পদ এবং নিরাপত্তা ধ্বংস করেনি। তার তরুণদের কাজ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অবসরের বেশির ভাগ সময়ই তারা ব্যয় করতেন বিজ্ঞান, গণিত এবং দর্শন চর্চায়। হোমের তাঁদের প্রায় মুখস্থ ছিল এবং তাঁরা কবিতা আবৃত্তিকারদের গুণাগুণের সমালোচক ছিলেন। অবরোহী যুক্তিবিদ্যা তখন সদ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, এ থেকে সম্পূর্ণ জ্ঞানের জগৎ সম্পর্কে সত্য ও মিথ্যা নানা নতুন তত্ত্বের উত্তেজনা পাওয়া যেত। যে যুগে বুদ্ধিমান এবং সুখী হওয়া সম্ভব ছিল এবং সম্ভব ছিল বুদ্ধির মাধ্যমে সুখী হওয়া। এমনটি খুব কম যুগেই সম্ভব হয়েছিল।

কিন্তু শক্তির যে ভারসাম্য এই স্বর্ণযুগ প্রসব করেছিল সে ভারসাম্য ছিল অনিশ্চিত। ভিতরে এবং বাহিরে-দুদিক থেকেই এর বিপদ ছিল। ভিতরের বিপদ ছিল গণতন্ত্র এবং বাইরের বিপদ ছিল স্পার্তা। পেরিক্রেসের পরে কী ঘটেছিল সেটা বুঝতে হলে আমাদের আত্তিকা (Attica)-র ইতিহাস বিচার করতে হবে।

ঐতিহাসিক যুগের শুরুতে আত্তিকা ছিল একটি ক্ষুদ্র, স্বয়ম্ভর, কৃষিভিত্তিক এলাকা। রাজধানী আথিনাও (Athens) খুব বড় ছিল না কিন্তু সেখানে ছিল সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান কিছু কারিগর ও কুশলী শিল্প, তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজেদের উৎপাদন বাইরে বিক্রি করা। ক্রমশ দেখা গেল দানাশস্য চাষ করার চাইতে আঙুর এবং জলপাই চাষ করা ও প্রধানত কৃষ্ণসাগরের উপকূল থেকে দানাশস্য আমদানি করা অনেক বেশি লাভজনক। এই ধরনের কৃষিকর্মে দানাশস্য উৎপাদনের তুলনায় পুঁজির প্রয়োজন বেশি, ফলে ক্ষুদ্র কৃষিজীবীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। হোমেরীয় যুগে অন্যান্য গ্রিক রাষ্ট্রের মতো আত্তিকাতেও ছিল রাজতন্ত্র কিন্তু রাজার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা রইল না, তিনি হয়ে দাঁড়ালেন ধর্মীয় কর্মকর্তা। শাসনক্ষমতা এসে পড়ল আভিজাত শ্রেণির হাতে, তাঁরা গ্রামের চাষি এবং শহরের কারিগর- উভয়কেই শোষণ করতেন। মৃষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে সলন (Solon) গণতন্ত্র অভিমুখী একটি আপোস করেন। তাঁর কীর্তির অনেকটাই পরবর্তীকালে পেইসিস্রাতস (Peisistrasus) এবং তাঁর পুত্রদের স্বৈরতান্ত্রিক যুগেও টিকে থাকে। এই যুগের শেষে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী অভিজাতরা নিজেদের জন্য গণতন্ত্র গ্রহণীয় মনে করেন। পেরিক্লেসের পতনের আগে পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অভিজাতরাই ক্ষমতার অধিকারী হতেন-যেমন হতো ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ দিকে আথিনীয় গণতন্ত্রের নেতারা ক্ষমতার বৃহত্তর অংশ দাবি করতে লাগলেন। একই সময় তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল আথিনার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সেটাই স্পার্তার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত পেলপনেশীয় যুদ্ধে (৪৩১-৪০৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পরিণত হয়। এই যুদ্ধে আথিনার সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটে।

রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস হলেও আথিনার গৌরব বেঁচে রইল এবং তার পরে প্রায় এক হাজার বছর দর্শনের কেন্দ্র ছিল আথিনা। গণিত এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আথিনার গৌরব গ্রাস করে আলেকজান্দ্রিয়া (Alexandria)। দর্শনে প্রাতন এবং আরিস্ততেলেস আথিনাকে করে তোলেন শ্রেষ্ঠতম। যে আকাঁদেমিতে প্লাতন শিক্ষাদান করতেন অন্যান্য সমস্ত বিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ার পরও সেই আকাঁদেমির অস্তিত্ব ছিল। রোমক সাম্রাজ্য খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর দুই শতাব্দী পর্যন্ত সে আকাঁদেমি পৌত্তলিকতার দ্বীপরূপে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল। শেষ পর্যন্ত ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মান্ধতার কারণে সম্রাট জাস্টিনিয়ান (Justinian) আকাঁদেমি বন্ধ করে দেন এবং ইউরোপে অন্ধকার যুগ নেমে আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *