০১. সভ্যতার আলোয় গ্রিক

১. সভ্যতার আলোয় গ্রিক

 গ্রিসের সহসা সভ্যতার আলোর স্পর্শে আসার মতো আশ্চর্যজনক কিংবা ব্যাখ্যার অতিত ঘটনা সমগ্র ইতিহাসে বিরল। হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার অনেক উপাদানই মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায় ছিল এবং সেখান থেকে প্রতিবেশি দেশগুলোতে প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু গ্রিক অবদানের পূর্ব পর্যন্ত কয়েকটি উপাদানের অভাব ছিল। শিল্প এবং সাহিত্যে তাঁদের কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত কিন্তু শুদ্ধ বৌদ্ধিক জগতে তাঁদের কীর্তি আরও অসাধারণ। তারা আবিষ্কার করেছিলেন গণিত, বিজ্ঞান এবং দর্শন; তাঁরাই প্রথম ইতিহাস লেখেন, সেই ইতিহাস শুধুমাত্র বর্ষপঞ্জি নয়; তারা পৃথিবীর চরিত্র এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বাধীন দূরকল্পন (speculation) করেছেন কোনোও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গোঁড়ামির শৃঙ্খল ছাড়াই। এই ঘটনা এতই আশ্চর্যজনক যে, আধুনিককাল পর্যন্ত লোকে শুধু অবাক হতো এবং গ্রিক প্রতিভার অলৌকিকত্ব (mystic) সম্পর্কে আলোচনা করে তৃপ্তি লাভ করত। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বাগ্বিধিতে (terms) গ্রিসের বিকাশ বোঝা সম্ভব এবং কাজটা লাভজনক।

থালেস (Thales) থেকেই দর্শনশাস্ত্রের শুরু। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর কার্যকাল গণনা করা যায় একটি গ্রহণ সম্পর্কে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার থেকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সে গ্রহণ হয়েছিল ৫৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। দর্শন এবং বিজ্ঞান আদিতে পৃথক ছিল না, সুতরাং বলা যায় একসঙ্গে এদের জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। এর আগে গ্রিস এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে কী ঘটছিল? এ প্রশ্নের যে কোনো উত্তরই আংশিকভাবে অনুমাননির্ভর, কিন্তু এই শতাব্দীতে প্রত্নবিদ্যার (archaeology) দৌলতে আমাদের জ্ঞান এ ব্যাপারে আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে সমৃদ্ধতর।

৪,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি লিপিশিল্প আবিষ্কৃত হয়েছিল মিশরে এবং মেসোপটেমিয়াতে তার অনতিপরেই। সব দেশেই লেখা শুরু হয়েছিল ইঙ্গিত বস্তুর ছবি দিয়ে, এই ছবিগুলো অতি শীঘ্র প্রথাগত (conventionalized) চিত্রে পরিণত হয়। সুতরাং শব্দের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায় কতগুলো ভাবলেখ (ideogram), চীনে এ প্রথা এখনও বর্তমান। হাজার হাজার বছর ধরে বিকাশলাভ করে এই জটিল পদ্ধতি (cumbrous system) থেকে বর্ণমালা গড়ে ওঠে।

মিশর এবং মেসোপটেমিয়াতে প্রাথমিক সভ্যতা বিকাশের কারণ ছিল মূলত নীল, টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদীগুলো-এদের অস্তিত্বের ফলে কৃষিকর্ম খুব সহজ এবং উৎপাদনশীল হয়। স্পেনীয়রা মেক্সিকো এবং পেরুর সভ্যতাকে যে অবস্থায় দেখেছিল মিশর ইত্যাদির সভ্যতা তখন অনেকটা সেই অবস্থায় ছিল। মিশরের রাজা ছিলেন ঐশ্বরিক, তাঁর ক্ষমতা ছিল স্বৈরতন্ত্রী-সমস্ত জমির মালিক ছিলেন তিনি। বহুদেবতাভিত্তিক একটি ধর্ম ছিল, একজন দেবতা ছিলেন সর্বোচ্চ (supreme), তাঁর সঙ্গে রাজার ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। একটি সামরিক অভিজাত সম্প্রদায় ছিল, আর ছিল একটি অভিজাত যাজক সম্প্রদায়। রাজা যদি দুর্বল হতেন কিংবা কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন তাহলে যাজক সম্প্রদায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আংশিকভাবে আত্মসাৎ করতে সমর্থ হতো। কৃষকরা ছিল ভূমিদাস (serfs), তারা ছিল হয় রাজার, নয় পুরোহিত সম্প্রদায়ের, নয়তো অভিজাত সম্প্রদায়ের দাস।

মিশর এবং ব্যালিবনিয়ার ধর্মতত্ত্বে (theologky) অনেক পার্থক্য ছিল। মৃত্যুচিন্তা ছিল মিশরীয়দের প্রধান মাথাব্যথা, তাঁরা বিশ্বাস করতেন মৃতের আত্মা পাতালে (underworld) চলে যায়-সেখানে তাদের পার্থিব জীবনের ধরনকে ভিত্তি করে ওসিরিস (Osiris) তাদের বিচার করেন। তাঁরা ভাবতেন আত্মা শেষ পর্যন্ত দেহে প্রত্যাবর্তন করবে-এই বিশ্বাসের দরুনই তাঁরা মমি তৈরি করেছেন এবং তৈরি করেছেন অপূর্ব সব সমাধিমন্দির। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগ পর্যন্ত পিরামিডগুলো নানা রাজা তৈরি করেছেন। এরপর মিশরীয় সভ্যতা ক্রমশই বাধা ছকে পড়ে যায় এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে প্রগতি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। খ্রিষ্টপূর্ব আঠারো শতকের (১৮০০ বি.সি) কাছাকাছি হিকসস (Hyksos) নামক সেমীয়রা (Semites) মিশর জয় করে, তারা প্রায় ২০০ বছর মিশর শাসন করেছিল। তারা মিশরের উপর কোনো স্থায়ী চিহ্ন রেখে যেতে পারেনি, তবে তাদের উপস্থিতি নিশ্চয়ই সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনে মিশরীয় সভ্যতা বিস্তারে সাহায্য করেছে।

মিশরের তুলনায় ব্যাবিলনীয় বিকাশ ছিল অধিকতর সামাজিক ভাবাপন্ন প্রথমে, শাসকগোষ্ঠী সেমীয় ছিল না, ছিল সুমেরীয় (Sumerians), এদের উৎপত্তি অজানা। কীলকাকার (cuneiform) বর্ণমালা তারাই আবিষ্কার করেছিল, বিজয়ী সেমীয়রা সেই বর্ণমালা গ্রহণ করে। একটা যুগে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত অনেক স্বাধীন নগর ছিল, শেষ পর্যন্ত ব্যাবিলনই সার্বভৌম হয় এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অন্যান্য নগরের দেবতারা অধস্তন হলেন এবং ব্যাবিলনের দেবতা মারদুক (Marduk) পরবর্তীকালে গ্রিক দেবসমাজের জিউসের (Zeus) মতো একটি স্থান অধিকার করেন। একই রকম ঘটনা ঘটেছিল মিশরে, তবে অনেক প্রাচীনকালে।

মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় ধর্ম ছিল অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের মতো প্রথমত উর্বরতা শক্তির পূজাভিত্তিক ধর্ম। পৃথিবী ছিল স্ত্রী, সূর্য পুরুষ। সাধারণত বঁড়কে পুরুষ উর্বরতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। ষণ্ড দেবতা ছিলেন বহুল প্রচলিত। ব্যাবিলনে ধরিত্রীর দেবী ইশতার (Ishtar) ছিলেন দেবীদের ভিতর সর্বোচ্চ। সমগ্র পশ্চিম এশিয়াতে নানা নামে মহিয়সী মাতা পূজিতা হতেন। যখন এশিয়া মাইনরে গ্রিক ঔপনিবেশিকরা মাতৃদেবীর মন্দির দেখলেন, তাঁরা দেবীর নামকরণ করেছিলেন আর্তেমিস (Artemis) এবং প্রচলিত ধর্মকেই গ্রহণ করেন। এফেসীয়দের ডায়ানার উৎপত্তি এভাবেই হয়। খ্রিষ্টধর্ম তাঁকে কুমারী মেরীতে রূপান্তরিত করেছে। এফেসাসের মন্ত্রণাপরিষদে (Council at Ephesus) তাঁর ঈশ্বরের মা (Mother of God) উপাধি আইনসিদ্ধ হয়, যে উপাধি আমাদের দেবীর উপর আরোপ করা হয়।

ধর্ম যেখানে সাম্রাজ্য শাসকদের সঙ্গে জড়িত হয় সেখানে ধর্মের আদিম অবয়ব পরিবর্তনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করে। দেব অথবা দেবী রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত হলে তাঁকে শুধু প্রচুর ফসলই দিতে হয় এমন নয়, যুদ্ধে জয়লাভও তাঁকে নিশ্চিত করতে হয়। ধনী একটি পুরোহিত সম্প্রদায় ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম এবং ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টি করেন এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের দেবতাদের একত্র করে একটি দেবসমাজ সৃষ্টি করেন।

সরকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে দেবতারা নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত হন। আইন প্রণেতারা তাঁদের বিধিগুলো পেতেন একজন বেতার কাছ থেকে, সুতরাং আইন ভঙ্গ অধর্ম হয়ে ওঠে। প্রাচীনতম আইনের সংকলন ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি-র (Hammurabi) (২০৬৭-২০২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ); রাজার সুদৃঢ় বক্তব্য- এই সংকলন তিনি পেয়েছেন মারদুকের কাছ থেকে। সমগ্র প্রাচীন যুগ জুড়ে ধর্ম এবং নীতিশাস্ত্রের সম্পর্ক নিরবচ্ছিন্নভাবে নিকটতম হয়।

ব্যাবিলনের ধর্মের সঙ্গে মিশরের ধর্মের পার্থক্য ছিল; ব্যাবিলনের ধর্ম মৃত্যুর পরবর্তীকালে সুখের চাইতে পার্থিব সমৃদ্ধি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকত। জাদুবিদ্যা, ভবিষ্যদ্বাণী, জ্যোতিষবিদ্যা-এগুলো যদিও শুধু ব্যাবিলনেরই বিশেষত্ব ছিল না, তবুও অনান্য স্থানের তুলনায় এখানে এগুলো বেশি বিকাশ লাভ করে এবং ব্যাবিলনের মাধ্যমেই পরবর্তীকালে এই বিদ্যাগুলো নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। বিজ্ঞানের অন্তর্গত কিছু বিদ্যা এসেছে ব্যাবিলন থেকে যেমন দিনকে চব্বিশ ঘণ্টায় এবং বৃত্তকে ৩৬০° ডিগ্রিতে ভাগ করা। তাছাড়া তারা আবিষ্কার করেছিলেন গ্রহণের কালচক্র-যার ফলে চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন এবং সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে সম্ভাব্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। আমরা দেখতে পাব, থালেস এই ব্যাবিলনীয় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক এবং এদের চারপাশের জাতিগুলোর সভ্যতার ভিত্তি প্রথম দিকে ছিল পশুপালন বাণিজ্যের বিকাশ একটি নতুন উপাদান যোগ করে প্রথমদিকে বাণিজ্যটা ছিল পুরোপুরি উপকূলভিত্তিক। ১,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অস্ত্রশস্ত্রগুলো ব্রোঞ্জের তৈরি ছিল, যে সমস্ত জাতির নিজ দেশে এই ধাতুগুলো পাওয়া যেত না তারা হয় বাণিজ্যের মাধ্যমে নয় জলদস্যুবৃত্তি করে এইগুলো সংগ্রহ করত। উপায় হিসেবে জলদস্যুতা ছিল অস্থায়ী, রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে বাণিজ্যতেই লাভ হতো বেশি। মনে হয়, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রিতি (Creat) দ্বীপই ছিল পথিকৃৎ। ২,৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১,৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই এগারো শতক ধরে ক্রিতিতে একটা শিল্পসমৃদ্ধ অগ্রসর সংস্কৃতিরও অস্তিত্ব ছিল- তার নাম ছিল মিনোয়ী সংস্কৃতি (Minoan culture) ক্ৰিতীয় শিল্পে ছিল আনন্দ উচ্ছলতা এবং প্রায় ক্ষয়িষ্ণু বিলাস। মিশরীয় মন্দিরগুলোর ভয়ংকর বিষাদ আর হতাশার সঙ্গে এ শিল্পের পার্থক্য ছিল বিরাট।

স্যার আর্থার ইভানস (Sir Arthur Evans) এবং অন্যান্যদের খননকার্য সম্পন্ন। হওয়ার আগে এই গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। এই সভ্যতা ছিল উপকূল বাণিজ্যভিত্তিক, এদের সঙ্গে মিশরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল (হিকসসের যুগি বাদে)। মিশরীয় চিত্রগুলো থেকে বোঝা যায় ক্ৰিতি (Crete) এবং মিশরের মধ্যে অধিকাংশ বাণিজ্য পরিচালনা করত ক্ৰিতীয় নাবিকেরা, ১,৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি এ বাণিজ্য সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। মনে হয় ক্রিতির ধর্মের সঙ্গে এশিয়া মাইনর এবং সিরিয়ার ধর্মের কিছুটা সাদৃশ্য ছিল কিন্তু শিল্পে বেশি সাদৃশ্য ছিল মিশরের সঙ্গে, অবশ্য ক্রিতির শিল্প ছিল খুবই মৌলিক এবং অদ্ভুত রকম প্রাণবন্ত। ক্ৰিতীয় সভ্যতার কেন্দ্র ছিল ক্লসস্ (Knossos) এর তথাকথিত মিনস এর প্রাসাদ (Palace of Minos) যার স্মৃতির রেশ চিরায়ত (classical) গ্রিসের ঐতিহ্যের ছিল। ক্রিতির প্রাসাদগুলো ছিল দারুণ জমকালো। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দির শেষাশেষি এ প্রাসাদগুলো ধ্বংস হয়ে যায় সম্ভবত গ্রিস থেকে আগত আক্রমণকারীদের দ্বারা। ক্রিতির ইতহাসের কালনির্ঘণ্ট (chronology) আহরণ করা হয়েছে ক্রিতিতে প্রাপ্ত মিশরীয় বস্তু এবং মিশরে প্রাপ্ত ক্ৰিতীয় বস্তু থেকে প্রথম থেকে শেষ অবধি এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণই প্রত্নতত্ত্বনির্ভর।

ক্রিতির অধিবাসীরা একজন দেবী বা হয়তো একাধিক দেবীর পূজা করতেন। যার অস্তিত্ব সন্দেহাতীত তিনি পশুদের রানী (Misress of Animals), তিনি ছিলেন শিকারি এবং চিরায়ত যুগের আর্তেমিসের (Artemis) উৎস বোধ হয় তিনিই। আপাতভাবে তিনি এক মা-ও বটেন; পশুদের প্রভু ছাড়া তাঁর তরুণ পুত্রই ছিলেন একমাত্র পুরুষ দেবতা। পরকাল সম্পর্কে তাদের বিশ্বাসের কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় মিশরীয়দের মতোই সে বিশ্বাস অনুসারে পার্থিব কর্ম পরকালে পুরস্কৃত হয়। মোটের উপর, ক্ৰিতীয় শিল্প থেকে বোঝা যায় জাতি হিসেবে তাঁরা ছিলেন সার্বিকভাবে খোশমেজাজী, ভয়াবহ কুসংস্কার তাঁদের দমিয়ে রাখত না। ষাঁড়ের লড়াই তারা পছন্দ করতেন, এই লড়াইয়ে পুরুষ এবং মহিলা উভয় রকম টোরিয়েডর (toreador-যারা ষাঁড়ের লড়াই পরিচালনা করে) থাকত এবং তারা আশ্চর্যরকম কসরৎ দেখত। স্যার আর্থার ইভনস-এর মতে ষাঁড়ের লড়াই ছিল ধর্মীয় উৎসব এবং যোদ্ধাবৃন্দ সাধারণত ছিলেন উচ্চতম অভিজাত ঘরের কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণভাবে গৃহীত হয়নি। যে ছবিগুলো টিকে আছে সেগুলো বাস্তব এবং গতিময়।

ক্রিতির অধিবাসীদের একটি রৈখিক বর্ণমালা ছিল কিন্তু তার পাঠোদ্ধার হয়নি। দেশে শান্তি ছিল, নগরের কোনো প্রাচীর ছিল না, নিঃসন্দেহে নৌশক্তির সাহায্যেই তাঁরা আত্মরক্ষা করতেন।

ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার আগে প্রায় ১,৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি মিনোয়ী সংস্কৃতি গ্রিসের মূল ভূখন্ডে বিস্তার লাভ করে। সেখানে ক্রমবিবর্তিত হয়ে প্রায় ৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এ সংস্কৃতি টিকেছিল। মূল ভূখন্ডের এই সভ্যতার নাম মিকেনীয় (Mycenaean) সভ্যতা। রাজাদের সমাধি এবং পর্বতশীর্ষের দুর্গ থেকে এ সভ্যতা বিষয়ে জানা যায় এবং এরা সাক্ষ্য দেয় ক্রিতির চেয়ে তাদের যুদ্ধভীতি বেশি ছিল। এই অবশিষ্ট সমাধি এবং দুর্গগুলো গৌরবময় যুগের গ্রিসের কল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাসাদগুলোর প্রাচীনতর শিল্প সামগ্রী হয় ক্রিতির শিল্পীদের কর্ম নয়তো তাদের সমগোত্রীয়দের। হোমেরের কাব্যে আমরা নানা উপকথার মাধ্যমে মিকেনীয় সভ্যতার ছায়া দেখতে পাই।

মিকেনীয়দের সম্পর্ক যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। ক্রিতীয়দের দ্বারা বিজিত হওয়ার ফলেই কি তারা এই সভ্যতা পেয়েছিলেন? তারা কি গ্রিক ভাষা বলতেন, না কি তারা পূর্বতন কোনো দেশজ জাতি ছিলেন? এ সমস্ত প্রশ্নের কোনো নির্দিষ্ট উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যা থেকে মনে হয়, তাঁরা ছিলেন গ্রিকভাষী বিজেতা; অন্ততপক্ষে অভিজাত শ্রেণির ছিল হাল্কা রঙের চুল এবং তারা এসেছিলেন উত্তর দিক থেকে- গ্রিক ভাষা তাঁরাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। গ্রিসে গ্রিকদের আগমন ঘটেছিল পরপর তিনটি তরঙ্গে- প্রথমে ইওনীয়রা তারপর আখীয়রা, সবচেয়ে শেষে দরীয়রা। মনে হয়, বিজেতা হলেও ইওনীয়রা ক্ৰিতীয় সভ্যতা প্রায় সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছিলেন, যেমন-পরে রোমকরা গ্রহণ করেছিলেন গ্রিক সভ্যতা। তাঁদের পরবর্তী আখীয়রা ইওনীয়দের স্থিরত্ব নষ্ট করেছেন এবং প্রায় অধিকারচ্যুতও করেছেন। বোগাসকিউই (Boghaz-keui) তে প্রাপ্ত হিট্টীদের (Hittite) ফলক থেকে জানা যায় চতুর্দশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আখীয়দের একট বিরাট সুসংগঠিত সাম্রাজ্য ছিল। ইওনীয় এবং আখীয়দের পারস্পরিক যুদ্ধে মিকেনীয় সভ্যতা দুর্বল হয়ে পরে এসেছিল, শেষ গ্রিক আক্রমণকারীরা দরীয়রা সে সভ্যতাকে প্রায় ধ্বংসই করে দেন। পূর্ব আক্রমণকারীরা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই মিনোয়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, দরীয়রা কিন্তু পূর্বপুরুষদের ইন্দো ইউরোপীয় ধর্ম রক্ষা করে চললেন। কিন্তু মিকেনীয় যুগের ধর্ম লুপ্ত হয়নি, বিশেষ করে নিম্নশ্রেণির ভিতরে এ ধর্ম বেঁচেছিল, চিরায়ত (classical) গ্রিসের ধর্ম ছিল এই দুটি ধর্মের সংমিশ্রণ। আসলে চিরায়ত যুগের কোনো কোনো দেবী আদিতে ছিলেন মিকেনীয়।

যদিও এ কাহিনী সম্ভবপর তবুও মনে রাখা উচিত মিকেনীয়রা আদৌ গ্রিক ছিলেন কিনা তা অজানা। আমরা শুধু জানি তাদের সভ্যতার অবক্ষয় হয়েছিল এবং তা ঘটেছিল ব্রোঞ্জের বদলে লৌহের প্রাধান্য প্রাপ্তির সমসাময়িক কালে এবং কিছুকালের জন্য সমুদ্রের উপরে ফিনিসীয়দের প্রভুত্ব স্থাপিত হয়েছিল।

মিকেনীয় যুগের শেষে এবং সে যুগ শেষ হওয়ার পর কোনো কোনো বিজেতা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং কৃষিজীবী হয়ে ওঠেন। কিন্তু কেউ কেউ আরও এগিয়ে চলেন। তাঁরা যান দ্বীপগুলোতে এবং এশিয়া মাইনরে- তারপর তারা যান সিসিলি এবং দক্ষিণ ইতালিতে, সেখানে তাঁরা বহু নগর পত্তন করেন- সে নগরগুলোরও প্রধান জীবিকা ছিল উপকূল বাণিজ্য এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য, এই সমস্ত উপকূলবর্তী নগরগুলোতেই গ্রিকরা প্রথম মানব সভ্যতার ভাণ্ডারে গুণগতভাবে নবতর অবদান রাখেন; আথিনার শ্রেষ্ঠত্ব এল তার পরে এবং এ অভ্যুদয়ের সঙ্গেও নৌশক্তি সমভাবে জড়িত।

গ্রিসের মূল ভূখণ্ড পার্বত্য এবং বহুলাংশে অনুর্বর। অবশ্য অনেক উর্বর উপত্যকা রয়েছে, সেগুলো থেকে সহজেই সমুদ্রে যাতায়াত করা যায় কিন্তু স্থলপথে পারস্পরিক সংযোগে পাহাড়গুলো বাধা সৃষ্টি করে। সাধারণত এই সমস্ত উপকূলবর্তী উপত্যকায় কৃষিভিত্তিক নগরকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এ অবস্থায় যখনই কোনো গোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে যেত যে অভ্যন্তরীণ সম্পদে তাঁদের জীবনধারণ সম্ভব হতো না, তখন তো যারা ভূমির উপর নির্ভর করতে পারতেন না তাঁরা সমুদ্রজীবী হতেন। মূল ভূখণ্ডের নগরগুলো উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে, উপনিবেশগুলো প্রায়শ এমন জায়গায় হতো যেখানে জীবনধারণ মূল ভূখন্ডের তুলনায় সহজতর ছিল। এই জন্য ইতিহাসের প্রাচীনতম যুগে এশিয়া মাইনর, সিসিলি এবং ইতালির অধিবাসীরা গ্রিকদের মূল ভূখণ্ডের গ্রিকদের চাইতে ধনী ছিলেন।

গ্রিসের বিভিন্ন অংশের সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন ছিল। স্পার্তাতে ক্ষুদ্র একটি অভিজাত সম্প্রদায় অন্য জাতির পদানত ভূমিদাসদের শ্রমে নিজেদের ভরণপোষণ চালাতেন; দরিদ্রতর কৃষি অঞ্চলে জনসাধারণ ছিলেন প্রধানত কৃষক- তাঁরা সপরিবারে নিজেদের জমি চাষ করতেন। কিন্তু যেখানে শিল্প বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে সেখানে ক্রীতদাস নিয়োগ করে স্বাধীন নাগরিকরা ধনী হয়েছেন- খনিতে পুরুষ এবং বস্তুশিল্পে মহিলা ক্রীতদাস নিয়োগ করা হতো। ইওনীয়তে এই দাসরা ছিলেন আশপাশের বর্বর জাতির (barbarian) মানুষ এবং বিধি অনুসারে ক্রীতদাসদের প্রথমে সংগ্রহ করা হতো যুদ্ধ থেকে। ক্রমবর্ধমান সম্পদের সঙ্গে আসে সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, শেষের দিকে স্পার্তা (Sparta) এবং লেস্বস্ (Lesbos) ছাড়া গ্রিসের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তারা যৎসামান্য অংশগ্রহণ করতেন।

সার্বিক একটা বিকাশ দেখা গিয়েছিল প্রথমে রাজতন্ত্র থেকে অভিজাততন্ত্রে, তারপর স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের পালাক্রমে উত্থানপতনে। রাজারা মিশর এবং ব্যাবিলনের রাজাদের মতো একচ্ছত্র ছিলেন না, বয়স্ক নাগরিক সংস্থা (Council of Elders) তাদের উপদেষ্টা ছিলেন এবং তাঁরা বল্গাহীনভাবে প্রচলিত রীতি ভাঙতে পারতেন না। স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) সবসময় কুশাসনের সমার্থক ছিল তা নয়, স্বৈরতন্ত্রের অর্থ ছিল এমন একজন ব্যক্তির শাসন-শাসনক্ষমতার উপর তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো দাবি থাকত না। গণতন্ত্রের অর্থ হলো নারী এবং ক্রীতদাস ব্যতীত সমস্ত নাগরিক দ্বারা শাসন। মেদিচি-র মতো আদি স্বৈরতন্ত্রীরা ক্ষমতা দখল করেছিলেন নিজ নিজ ধনিক সমাজে (plutcracies) ধনীশ্রেষ্ঠ হওয়ার সুবাদে। প্রায়শই তাঁদের সম্পদের উৎস ছিল সোনা ও রূপার খনির মালিকানা, মুদ্রা প্রচলন হওয়ার ফলে সোনা-রূপা আরও লাভজনক হয়। ইওনীয়র পার্শ্ববর্তী লুদিয়া (Lydia) রাজ্য থেকে মুদ্রা প্রচলন শুরু হয়। মনে হয় খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর সামান্য কিছু আগে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল।

প্রথম দিকে গ্রিকদের ক্ষেত্রে বাণিজ্য এবং জলদস্যুবৃত্তির- দুটোই সমার্থক ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো লিখনপ্রণালী অর্জন করা। যদিও ব্যাবিলনিয়া এবং মিশরে হাজার হাজার বছর ধরে লেখার প্রচলন ছিল এবং মিনোয়ার ক্রিতীয়দেরও বর্ণমালা ছিল, অধুনা সেগুলো এক ধরনের গ্রিক বর্ণমালা বলে পরিচিত। গ্রিকদের বর্ণমালা লিখনপ্রণালী অর্জন করার তারিখটা অনিশ্চিত। গ্রিকরা লেখা শিখেছেন ফিনিসীয়দের কাছে। সিরিয়ানিবাসী অন্যান্যদের মতোই ফিনিসীয়দের উপরেও মিশর এবং ব্যাবিলন উভয়েরই প্রভাব ছিল। ইওনীয়, ইতালি এবং সিসিলির গ্রিক নগরগুলোর উত্থানের আগে পর্যন্ত সামুদ্রিক বাণিজ্য ফিনিসীয়দেরই প্রাধান্য ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইখনাতন (Ikhnaton-প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস বিরোধী মিশরীয় রাজা)-কে লেখার সময়ও সিরীয়রা ব্যাবিলনীয়দের কীলকাকৃতি বর্ণমালা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তুরের হিরাম (Hiram of Tyre, ৯৬৯-৯৩৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ফিনিসীয় বর্ণমালা ব্যবহার করেছেন, খুব সম্ভব এ বর্ণমালা বিকাশ লাভ করেছিল মিশরীয় বর্ণমালা থেকে। মিশরীয়রা প্রথমে চিত্রলিপি (picture) ব্যবহার করতেন, ক্রমশ ছবিগুলো প্রথাসিদ্ধ হয়ে একস্বরভিত্তিক শব্দে পরিণত হয় (যে বস্তুর চিত্র তার নামের প্রথম স্বর), তারপর পরিণত হয় একক অক্ষরে। যেমন-A ছিলেন একজন তীরন্দাজ (archer)- (অর্থাৎ অ-এ অজগর আসছে তেড়ে-অনুবাদক), তিনি একটি ব্যাঙকে তীর মেরেছিলেন। এই শেষের ধাপ, মিশরীয়রা যা সম্পূর্ণ করতে পারেননি কিন্তু ফিনিসীয়রা করেছিলেন, ফলে ফিনিসীয়রা বর্ণমালাকে সমস্ত সুযোগসুবিধা দান করেন। ফিনিসীয়দের কাছে বর্ণমালা গ্রহণ করে গ্রিকরা নিজেদের ভাষার উপযুক্ত করে সেই বর্ণমালার পরিবর্তন করেন, তাঁদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল শুধুমাত্র ব্যঞ্জনবর্ণ না রেখে সঙ্গে স্বরবর্ণ যোগ করা। লেখার এই সুবিধাজনক পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে গ্রিক সভ্যতার উত্থান যে ত্বরান্বিত হয়েছিল-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

হেলেনীয় সভ্যতার প্রথম উল্লেখযোগ্য অবদান হোমের (Homer)। হোমের সম্পর্কে সবকিছুই আনুমানিক তবে বহুল প্রচলিত ধারণা হলো হোমের একক কোনো ব্যক্তি ছিলেন না, পারস্পরিক বহু কবি হোমেরের নামে পরিচিত ছিলেন। যারা এ মত পোষণ করেন, তাঁদের বক্তব্য-ইলিয়াড এবং অদিসি সম্পূর্ণ হতে প্রায় দুই শত বছর লেগেছিল, কারও কারও মতে ৭৫০-৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পর্যন্ত, আবার অনেকে মনে করেন খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর পূর্বেই হোমের প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছিল। হোমেরের কবিতা আধুনিকরূপে আথিনাতে এসেছিলেন পেইসিস্রাতস, তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৫৬০ ৫২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ (মধ্যে মধ্যে বিরতি দিয়ে)। তাঁর সময় থেকে আথিনীয় যুবকরা হোমের কণ্ঠস্থ করতেন-এটাই ছিল তাঁদের শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রিসের কোনো কোনো অংশে বিশেষ করে স্পার্তাতে হোমের এই সম্মান পেয়েছেন অনেক পরে।

হোমেরের কবিতাও মধ্যযুগের রাজসভায় বিভিন্ন রোমেন্সের মতোই (রোমান্স বীরত্ব, প্রেম ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন কাল্পনিক কাহিনী- অনুবাদক) সুসভ্য অভিজাত সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। যে সব কুসংস্কার আজও সাধারণ মানুষের ভিতরে প্রচলিত সেগুলোকে তারা প্রাকৃতজনোচিত (plebian) বলে অগ্রাহ্য করেছেন। বহু যুগ পরে এই কুসংস্কারের অনেকগুলো পুনরায় জনমানসে আসন পায়। নৃতত্ত্ব অনুসরণকারী অনেক আধুনিক লেখক এখন এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, হোমের মোটেই আদিম (primitive) ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক- অনেকটা অষ্টাদশ শতাব্দীতে যারা প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করেছেন তাঁদের মতো। হোমের আলোকপ্রাপ্ত (enlightenment) উচ্চশ্রেণির নাগরিক আদর্শ তুলে ধরেছেন। অলিম্পীয় দেবতারা ছিলেন হোমের কাছে ধর্মের প্রতীক কিন্তু তাঁর সময়ে কিংবা তাঁর পরেও গ্রিকদের ভিতরে এই দেবতারাই একমাত্র পূজ্য ছিলেন না। লোকসাধারণের ধর্মে আরও অন্ধকারময়, বর্বরতর অন্য বহু উপাদান ছিল। সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রিক বৌদ্ধিক চিন্তা এই প্রাকৃত ধর্মকে বাধা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে কিন্তু দুর্বল মুহূর্তে কিংবা আতঙ্কের সময় এই ধর্ম আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অবক্ষয়ের সময় দেখা গেল হোমেরের পরিত্যক্ত বিশ্বাসগুলো অর্ধমৃত অবস্থায় চিরায়ত যুগ জুড়ে বেঁচে ছিল। এই তথ্য অনেক আশ্চর্যজনক আপাত অসঙ্গত ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে।

আদিতে সর্বত্রই ধর্ম ছিল গোষ্ঠীগত, ব্যক্তিগত নয়। বিশেষ কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা হতো-তার উদ্দেশ্য ছিল কিছু সমব্যথী জাদুর (sympathetic magic) সাহায্যে গোষ্ঠীর স্বার্থ বৃদ্ধি, বিশেষত উর্বরতা বৃদ্ধি করা মানুষের, পশুর এবং উদ্ভিদের। মানুষ দক্ষিণ অয়নান্তের (winter solstice) সময় সূর্যকে উৎসাহ দিতে আর তেজ ক্ষয় না করতে; বসন্তকাল এবং ফসল কাটার সময়ও উপযুক্ত উৎসবের প্রয়োজন। হতো। এইসব অনুষ্ঠানে বিরাট সমষ্টিগত উত্তেজনা সৃষ্টি হতো এবং ব্যক্তিমানুষ বিচ্ছিন্নতা ভুলে সমগ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম বোধ করত। সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের বিবর্তনের একটা বিশেষ স্তরে পবিত্র জন্তু এবং মানুষকে অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে হত্যা করা হতো এবং ভক্ষণ করা হতো। বিভিন্ন অঞ্চলে এই স্তরের আবির্ভাব হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। নরমাংস ভোজনের তুলনায় নরবলি প্রথা অধিক দিন প্রচলিত ছিল; ঐতিহাসিক যুগের শুরুতে গ্রিসে এ প্রথা লুপ্ত হয়নি। উর্বরতা সহায়ক ধর্মীয় অনুষ্ঠান-যার মধ্যে এরকম নিষ্ঠুরতা নেই-সমস্ত গ্রিসেই প্রচলিত ছিল; বিশেষত এলেউসিনীয় (Eleusinian) রহস্যগুলোর প্রতীক চিহ্ন ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক।

এ কথা অনস্বীকার্য, হোমেরের ধর্ম ধার্মিক নয়। দেবতারা সম্পূর্ণ মানবিক, মানুষের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য অমরত্বে এবং অতিমানবিক ক্ষমতায়। নৈতিক দিক দিয়ে তাঁদের সপক্ষে বলার কিছুই নেই, কেন যে তাঁরা মানুষের অত সম্ভ্রমের (awe) পাত্র হলেন সেটা বোঝা শক্ত। কতকগুলো ছত্রে- পরবর্তীকালে সংযোজিত বলে অনুমান তাদের প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ভলতেরীর অশ্রদ্ধা। হোমেরে নির্ভেজাল ধর্মভাব দেখা যায় অলিম্পীয় দেবতাদের সম্পর্কে ততটা নয় যতটা ভাগ্য বা প্রয়োজন কিংবা ভবিতব্যের মতো রহস্যময় জীব সম্পর্কে, এমনকি জিউস (Zeus) ও তাদের অধীন। গ্রিক চিন্তনে ভাগ্যের প্রভাব ছিল অপরিসীম, যে সমস্ত উৎস থেকে প্রাকৃতিক বিধিতে বিজ্ঞানের বিশ্বাস আহরিত হয়েছে ভাগ্যও তার ভিতরে সম্ভবত একটি।

বিজয়ী অভিজাত সম্প্রদায়ের দেবতা ছিলেন হোমেরের দেবতারা। তাঁরা সত্যিকারের ভূমি কর্ষকদের কাছে অতি প্রয়োজনীয় উর্বরা শক্তির দেবতা নন। গিলবার্ট মারে বলেছেনঃ

‘অধিকাংশ জাতির দেবতারাই নিজেদের বিশ্বের স্রষ্টা বলে দাবি করে থাকেন। অলিম্পীয় দেবতাদের সেরকম কোনো দাবি নেই। তাদের সর্বোচ্চ দাবি হলো বিশ্বজয় করা।…..রাজ্য জয় করার পর তাঁরা কি করেছিলেন? তারা কি শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন? তারা কী কৃষিকর্মের উন্নতিসাধন করেছেন? তারা কি শিল্প-বাণিজ্যে রত? এ সমস্তের বিন্দুমাত্র নয়। তারা কেন সভাবে পরিশ্রম করবেন? তাঁদের পক্ষে সহজতর ছিল খাজনা নির্ভর হয়ে বেঁচে থাকা এবং সহজে যাঁরা খাজনা দেন না তাদের বজ্রাঘাতে বিনষ্ট করা। তাঁরা ছিলেন বিজয়ী দলপতি, রাজকীয় বোম্বেটে (buccaneers)। তাঁরা যুদ্ধ করেন, পানভোজন করেন, খেলাধুলা করেন, গানবাজনাও করেন; তাঁরা গভীর নেশা করেন এবং তাঁদের কাউকেই ভয় পান না। যুদ্ধ ও প্রেমের ব্যাপারে তারা কখনো মিথ্যাভাষণ করেন না।’

হোমের নায়করাও তেমন একটা মানবিক ও সদাচারী ছিলেন না। পেলপরা (Pelops) ছিলেন নেতৃস্থানীয় বংশ কিন্তু তারাও সুখী পারিবারিক জীবনের আদর্শ স্থাপন করতে পারেন নি।

দেবতাদের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধাচরণ করে কর্মজীবন শুরু করেন এ বংশের এশীয় প্রতিষ্ঠাতা আন্তালস (Tantalos); কেউ কেউ বলেন, তিনি দেবতাদের ঠকিয়ে মানুষের মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং সেই মাংস ছিল তার আপন পুত্র পেলপের। অলৌকিক উপায়ে জীবন ফিরে পেয়ে পেলপও দেবতাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। তিনি পিসা (Pisa)-র রাজা অইনমাওস (Orinomaos)-এর সঙ্গে বিখ্যাত রথ প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষের সারথি মীরতিলস (Myrtilos)-এর পরোক্ষ সাহায্যে জয়লাভ করেন। সহষড়যন্ত্রীকে তিনি পুরস্কৃত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন কিন্তু পরে তাঁকে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করেন। এই অভিশাপ তার ছেলে আত্রেয়স (Atreus) এবং থুয়েন্তেস (Thyestes)-এর উপর নেমে আসে। গ্রিক ভাষায় সে অভিশাপের নাম আতে (ate), যার অর্থ শক্তিশালী এবং বাস্তবে দুর্দমনীয় অপরাধপ্রবণতা। একটি সুবর্ণ কেশরযুক্ত মেষ ছিল পরিবারের সৌভাগ্যের কারণ- থুয়েন্তেস নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে কলুষিত করে ভেড়াটি চুরি করেছিলেন, সুতরাং পরিবারের সৌভাগ্যটা তাঁর দখলে চলে যায়। এবার আত্রেয়সের পালা, তিনি তাঁর ভাইয়ের নির্বাসনের ব্যবস্থা করেন এবং পুনর্মিলনের অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে এনে ভোজ খাওয়ান তার আপন সন্তানদের মাংসেই। এবার অভিশাপের উত্তরাধিকারী আত্রেয়সের পুত্র অ্যাগামেন (Agamemmon), তিনি একটি পবিত্র হরিণকে হত্যা করে আর্তেমিসকে অসন্তুষ্ট করেন, তারপর তাঁর নিজের নৌবাহিনীর জয়যাত্রার পথ নিরাপদ করার জন্য আপন কন্যা ইফিজেনিয়া (Iphigenia)-কে বলি দেন দেবীকে খুশি করতে। অ্যাগামেমনকে আবার হত্যা করেন তাঁর বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রী কুতাইমেস্ত্রা (Klytaimnestra) এবং তাঁর উপপতি আয়গিসথস। আয়গিসথস (Aigisthos) আবার ছিলেন গুয়েন্তেস-এর তখনও জীবিত পুত্র। পরে আবার অ্যাগামেন-এর পুত্র অরেস্তেস (Orestes) মা-কে এবং আয়গিসথসকে হত্যা করে পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেন।

নিখুঁত কাব্য হিসেবে হোমের ইওনীয়র সৃষ্টি অর্থাৎ হেলেনীয় এশিয়া মাইনরের একটা অংশের এবং নিকটবর্তী দ্বীপগুলোর। বড়জোর ষষ্ঠ শতাব্দীর কোনো এক সময় হোমেরের কবিতাগুলো তার আধুনিক রূপে স্থিতিলাভ করে। এই শতাব্দীতেই গ্রিক দর্শন, বিজ্ঞান এবং গণিতের শুরু হয়েছিল। একই সময়ে পৃথিবীর অন্য অংশে মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন কিছু ঘটনা ঘটছিল। কনফুসিয়াস (Confucious), বুদ্ধ (Buddha), জরাথ্রষ্ট (Zoroaster) এই শতাব্দীর মানুষ ছিলেন-অবশ্য এঁরা বাস্তব হলে। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি কুরুস (Cyrus) পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন; শতাব্দীর শেষ দিকে পারসিকদের কাছ থেকে আংশিক স্বাধীনতা প্রাপ্ত ইওনীয় গ্রিক নগরগুলো একটি নিষ্ফল বিদ্রোহ করে যা দারিয়াস (Darious) দমন করেন, এই বিদ্রোহের পর ইওনীয়র শ্রেষ্ঠ মানুষরা নির্বাসিত হন এই যুগের অনেকটা দার্শনিকই ছিলেন বাস্তুহারা, তাঁরা হেলেনীয় জগতের যে অংশ তখনও স্বাধীন ছিল সে অংশের নগরে নগরে ভ্রমণ করতেন। যে সভ্যতা প্রধানত ইওনীয়তেই সীমাবদ্ধ ছিল সে সভ্যতা এভাবেই বিস্তার লাভ করে। এই ভ্রাম্যমাণ জীবনে তারা সহৃদয় ব্যবহার পেয়েছেন। ক্সেনোফানেসের (Xenophanes) আবির্ভাব খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে, তিনিও একজন উদ্বাস্তু ছিলেন। ক্সেনোফানে বলেন, শীতকালে ভালো ভোজের পর নরম কোচে বসে মিষ্টি মদ খেতে খেতে এবং মটর চিবোতে চিবোতে (crunching chickpeas) আমাদের বলা উচিতঃ দ্র, আপনি কোত্থেকে এসেছেন? আপনার বয়স কত? যখন মদ (Mede) রা। প্রথম এসেছিলেন তখন আপনার বয়স কত ছিল? গ্রিসের অবশিষ্ট অংশ, সালামিস (salamies) এবং প্লাতায়ে (Plataea)-এ যুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়, পরে কিছুকালের জন্য ইওনীয় মুক্ত হয়।

গ্রিস ছিল বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত, প্রতিটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রে একটি নগর এবং তাকে বেষ্টন করেছিল খানিকটা চাষের জমি; গ্রিক জগতের বিভিন্ন অংশে সভ্যতার স্তর ছিল বিভিন্ন এবং সমগ্র গ্রিক কৃতিত্বে অবদান ছিল স্বল্পসংখ্যক নগরেরই। স্পার্তা, যার সম্বন্ধে পরে বিশদ করে বলব, সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তবে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নয়। কোরিন্থ (Corinth) ছিল ধনী, সমৃদ্ধ একটি বিরাট বাণিজ্যকেন্দ্র কিন্তু মহাপুরুষদের জন্মদাতা নয়।

তাছাড়া ছিল অবিমিশ্র কৃষিজীবী গ্রাম্য সমাজ। একটা প্রবাদ প্রতিম উদাহরণ আর্কাদিয়া (Arcadia) রাজ্য। শহরের লোকেরা ভাবতেন দেশটা কাব্যিক (idyllic) কিন্তু আসলে রাজ্যটা বহু এমন প্রথায় পূর্ণ ছিল যা প্রাচীন, বর্বর এবং ভয়ংকর।

অধিবাসীরা হেরমেস (Hermes) ও পান (Pan)-এর পূজা করতেন এবং তাদের নানারকম উর্বরতা বিষয়ক ধর্মানুষ্ঠান (fertility cult) ছিল, সে ধর্মে অনেক সময় একটা চতুষ্কোণ স্তম্ভই দেবমূর্তির কাজ করত। ছাগল ছিল উর্বরতার প্রতীক, কারণ চাষীরা এতই দরিদ্র ছিলেন যে ষাঁড় কেনার ক্ষমতা তাদের ছিল না। খাদ্য সুষ্প্রাপ্য হলে পানের মূর্তিকে মারধোর করা হতো। (চীনের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের ব্যাপার আজও ঘটে। একটা গোষ্ঠী (clan) ছিল তথাকথিত নেকড়ে-মানুষ। (সাময়িকভাবে নেকড়ে বাঘের ক্ষমতা অর্জন করেছে were-wolves), সম্ভবত এ বিশ্বাস নরবলি ও নরমাংস ভোজনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভাবা হতো যে, বলিপ্রদত্ত নরমাংসের স্বাদ যে গ্রহণ করবে, সেই হবে নেকড়ে-মানুষ। একটা গুহা জিউস লুকায়স (Zeus Lykaios-Wolif-Zeus-নেকড়ে জিউস)-এর কাছে পবিত্র ছিল, সে গুহায় কারও ছায়া পড়ত না এবং ঐ গুহায় প্রবেশ করলে এক বছরের মধ্যে মৃত্যু হতো। চিরায়ত যুগেও এ সমস্ত কুসংস্কার বহুল প্রচলিত ছিল।

পান-এর আসল নাম (অনেকের মতে) ছিল পায়ন (Paon) অর্থ অন্নদাতা বা মেষপালক, তার অধিক প্রচলিত এবং গৃহীত উপাধির অর্থ ছিল সর্বদেবতা। পারসিক যুদ্ধের পর পঞ্চম শতাব্দীতে যখন আথিনা পানের উপাসনা শুরু করে তখন এই নাম গৃহীত হয়।

প্রাচীন গ্রিসে কিন্তু এমন অনেক কিছু ছিল যাকে আমরা আমাদের কাছে প্রচলিত অর্থে আজ ধর্ম বলে বোধ করি। এর সঙ্গে অলিম্পীয়দের কোনো সম্পর্ক ছিল না, সম্পর্ক ছিল দিওনিসিয়স (Dionysus) কিংবা বাকখস (Bacchus)-এর-আমাদের চিন্তায় যার স্বাভাবিক দুর্নাম মদিরা এবং মাদকতার নিন্দনীয় দেবতা হিসেবে। এর অর্চনা থেকে কি উপায়ে গভীর রহস্যবাদের উদ্ভব হল এবং সেই রহস্যবাদ বহু দার্শনিককে প্রভাবিত করল, এমনকি খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব নির্মাণে প্রভাব ফেলল-সেটা সত্যিই উল্লেখযোগ্য। যারা গ্রিক চিন্তাধারার বিকাশ অনুধাবন করতে আগ্রহী তাদের কাছে এটা বোঝা আবশ্যিক।

প্রথমত দিওনিসিয়স কিংবা বাকখস ছিলেন গ্ৰাকীয় (Thracian) দেবতা। এঁদের সভ্যতার দৌড় গ্রিকদের তুলনায় অনেক কম ছিল, গ্রিকরা এঁদের বর্বর মনে করতেন। সমস্ত আদিম কৃষিজীবীদের মতোই গ্ৰাকীয়দের উর্বরাভিত্তিক আদিম ধর্মানুষ্ঠান ছিল এবং উর্বরতা বৃদ্ধিকারী একজন দেবতা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল বাকখস্ তাঁর মূর্তি মানুষের ছিল না যন্ডের ছিল সেটা কখনই পরিষ্কার হয়নি। বিয়ার (beer) তৈরি করতে শিখে তাঁরা ভাবলেন নেশাটা স্বর্গীয় ব্যাপার এবং এই সম্মান তারা বাকখসকেই দিয়ে দিলেন। আঙুরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে এবং মদিরা (wine) পান করতে শিখে বাকখসের সম্পর্কে তাদের ধারণা উচচতর হয়। আঙুর এবং মদিরা থেকে উৎপন্ন স্বর্গীয় উন্মাদনায় তাঁর কাজ উর্বরতা বৃদ্ধির সধারণ কাজে চেয়ে বড় হয়ে উঠল।

ঠিক কখন তাঁর পূজা গ্রাকি (Thrace) থেকে এসে গ্রিসে প্রচলিত হয় এটা জানা যায়নি কিন্তু মনে হয় ঐতিহাসিক যুগ শুরু হওয়ার ঠিক আগেই। কট্টর প্রাচীনপন্থীরা বাকখসের পূজার বিরোধিতা করেন, তবুও এটা পূজা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই পূজায় বহু বর্বর প্রথা প্রচলিত ছিল, যেমন- বন্য পশু টেনে, ছিঁড়ে, টুকরো টুকরো করে সম্পূর্ণ অপকৃ ভক্ষণ করা। এই ধর্মে একটা আশ্চার্য নারীবাদী (feminism) উপাদানও ছিল। সম্মানিত মা এবং কুমারী মেয়েরা বিরাট দল বেঁধে খোলা পাহাড়ে সমস্ত রাত নৃত্য করে কাটাতেন, তাতে চরম উল্লাস উদ্দীপিত হতো এবং মাদকতা কিছুটা মদিরাস্যুত হলে খানিকটা রহস্যবাদী ছিল। স্বামীরা এই প্রথায় বিরক্ত হতেন কিন্তু ধর্মবিরোধী হতে সাহস পেতেন না। এই ধর্মীয় প্রথার সৌন্দর্য এবং বর্বরতা ধরা আছে এউরিপিদেস (Euripides)-47 TP C4 (Bacchae)-601

গ্রিসে দিওনিসিয়স-এর সাফল্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে সমস্ত গোষ্ঠী দ্রুত সভ্য হয়েছেন তাঁদেরই মতো গ্রিকদেরও অথবা অন্তত গ্রিকদের একটা অংশের আদিম যুগের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল এবং প্রচলিত নীতিসম্মত আচার-আচরণের চেয়ে সহজাত এবং অনবদমিত ইন্দ্রিয়াসক্তির প্রতি তাঁদের গোপন আকর্ষণ ছিল। মানসিকভাবে ততটা সভ্য না হয়েও যে পুরুষ অথবা মহিলার আচরণ সভ্য হতে বাধ্য হয়, যুক্তিসঙ্গত আচরণ তাঁর কাছে বিরক্তিকর এবং নীতিসম্মত জীবন একটা বোঝা-ক্রীতদাসবৃত্তি। এটা চিন্তন, বোধ এবং আচরণে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানসিক প্রতিক্রিয়াই আমাদের বিশেষ বিবেচ্য কিন্তু অনুভব এবং আচরণগত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রথমে কিছু বলা উচিত।

সভ্য মানুষের সঙ্গে অসভ্য মানুষের পার্থক্য শুধু বিচক্ষণতায়, আরও একটু বিস্তৃত অর্থে বলা যায় দূরদর্শিতায়। সে ভবিষ্যৎ আনন্দের জন্য বর্তমান কষ্ট সহ্য করে ভবিষ্যতে আনন্দের সম্ভাবনা বহু দূর হলেও। কৃষির অভ্যুত্থানের সঙ্গে এই অভ্যাসের গুরুত্ব বাড়ল; কোনো পশু কিংবা অসভ্য মানুষ পরের শীতে খাদ্যের জন্য আজকের বসন্তে পরিশ্রম করবে না, অবশ্য কাঠবিড়ালীর বাদাম জমিয়ে রাখার মতো কিংবা মৌমাছির মধু তৈরি করার মতো কয়েকটি বিশুদ্ধ, স্বভাবজ কর্ম ছাড়া। এসব ক্ষেত্রে কোনো ভবিষ্যদৃষ্টি নেই, আছে শুধু একটি কাজ করার প্রত্যক্ষ আবেগ যা মানব দর্শকের কাছে, স্পষ্টতই পরবর্তীকালে প্রয়োজনীয় মনে হয়। সত্যিকারের ভবিষ্যদৃষ্টি তখনই হয় যখন কোনো মানুষ আবেগ তাড়িত না হয়ে কাজ করে, কারণ যুক্তি তাকে বলে এই কর্মের ফলে ভবিষ্যতে সে লাভবান হবে। মৃগয়া করতে কোনো ভবিষ্যদৃষ্টির দরকার হয় না, কারণ ব্যাপারটা আনন্দের কিন্তু জমি চাষ করা শ্রমসাধ্য, স্বতঃস্ফুর্ত আবেগে সেটা করা অসম্ভব।

সভ্যতা শুধুমাত্র দূরদৃষ্টির মতো একটি স্বআরোপিত বাধা দিয়েই মনের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে না, আরও নিয়ন্ত্রণ করে আইন, রীতি এবং ধর্মের মাধ্যমে। এই বাধা বর্বরতা যুগের উত্তরাধিকার, ফলে এ বাধা কম আবেগতাড়িত এবং সুষ্ঠু নিয়মানুসারী। কোনো কোনো আচরণকে অপরাধ আখ্যা দেওয়া হয় এবং সেগুলো শাস্তি পায়, আবার কিছু আচরণ আইনত দণ্ডনীয় হয় না কিন্তু অন্যায় আখ্যা পায় এবং অপরাধীরা সামাজিক অনুমোদনে বঞ্চিত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির হাত ধরে আসে নারীর অবদমন আর ক্রীতদাস শ্রেণির উদ্ভব। একদিকে সমাজের উদ্দেশ্য ব্যক্তির উপরে আরোপিত হয় এবং অন্যদিকে ব্যক্তি তার জীবনকে অখণ্ডভাবে দেখতে অভ্যস্ত হওয়ায় ভবিষ্যতের জন্য ক্রমশই অধিক পরিমাণে তার বর্তমানকে বলি দেয়।

এটা স্পষ্ট যে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায় যেতে পারে, যেমন কৃপণের ধনসঞ্চয়। কিন্তু এই চরম পন্থা গ্রহণ না করলেও দূরদর্শিতার ফলে জীবনের অনেক শ্রেষ্ঠ জিনিসই পরিত্যাগ করতে হয়। দিওনিসিয়সের পূজারীরা দূরদর্শিতার বিরুদ্ধে। দূরদৃষ্টির ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত তীব্র আবেগের অনুভূতি উন্মোচিত হয় মাদকতায় শারীরিক অথবা মানসিক। এই পৃথিবী হয়ে ওঠে সৌন্দর্যপূর্ণ ও আনন্দময়, নিত্যকর্মের কারাগার থেকে কল্পনা সহজে মুক্তি পায়। বাকখীয় (Bacchic) আচার অনুষ্ঠানে একটি প্রেরণার (enthusiasm) সৃষ্টি হয়। যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পূজারীর অন্দরে ঈশ্বরের প্রবেশ-পূজারীর বিশ্বাস হয় তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম। মানুষের মহত্তম কীর্তিগুলোর অনেকটা অংশেই জড়িত কোনো না কোনো মাদকতার উপাদান, কিছুটা আবেগ দিয়ে দূরদৃষ্টিকে ঝেড়ে ফেলা। বাকশীয় উপাদান না থাকলে জীবনটা রহীন, থাকলে বিপদসঙ্কুল। সমগ্র ইতিহাস জুড়েই ভাবাবেগের সঙ্গে দূরদৃষ্টির দ্বন্দ্ব। এমনই এ দ্বন্দ্ব যার কোনো পক্ষকেই আমাদের পূর্ণ সমর্থন করা সমীচিন নয়।

চিন্তাজগতে সংযত সভ্যতা ও বিজ্ঞান প্রায় সমার্থক। কিন্তু অবিমিশ্র বিজ্ঞান তৃপ্তিদায়ক নয়, মানুষের আরও প্রয়োজন আবেগ, শিল্প ও ধর্ম। বিজ্ঞান জ্ঞানের সীমা নির্দেশ করতে পারে কিন্তু কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করা তার অনুচিত। গ্রিক দার্শনিকরা এবং পরবর্তী যুগের দার্শনিকরাও কেউ কেউ ছিলেন মূলত বিজ্ঞাননির্ভর, কেউ কেউ মূলত ধর্মনির্ভর। শেষোক্তরা প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে বাকশীয় ধর্মের কাছে বিশেষভাবে ঋণি- এ তথ্য প্লাতনের পক্ষে বিশেষভাবে প্রযোজ্য এবং তার মাধ্যমে পরবর্তী বিকাশগুলো সম্পর্কে প্রযোজ্য, সেগুলো শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টিয় ধর্মতত্ত্বের অন্তর্গত হয়।

দিওনিসিয়সের অর্চনা আদিতে ছিল অনেকাংশে বর্বর এবং অনেকদিক দিয়ে বিতৃষ্ণা উদ্রেককারী। ধর্মটির এই রূপ দার্শনিকদের প্রভাবিত করেনি, প্রভাবিত করেছে তার আধ্যাত্মিক (spiritual) রূপ-সেটা অর্ফেয়স (Orpheus)-এর। এই রূপ তাপসিক এবং মানসিক মত্ততা প্রতিস্থাপিত করেছিল দৈহিক মত্ততাকে।

অর্ফেয়স একটি অস্পষ্ট কিন্তু আকর্ষণীয় চরিত্র। অনেকের ধারণা তিনি একজন বাস্তব মানুষ ছিলেন, অনেকের মতে তিনি ছিলেন একজন দেবতা কিংবা একজন কাল্পনিক বীর। ঐতিহ্য অনুসারে বাকখসের মতো তাঁর আগমন ঘ্রাকি (Trace) থেকে, তবে এই সম্ভাবনাই বেশি যে, তিনি ক্রিতি থেকে এসেছিলেন (তাঁর নামের সঙ্গে জড়িত আন্দোলনের মতোই।) এটা নিশ্চিত যে, অফীয় মতবাদের বহুলাংশের প্রাথমিক সূত্র মিশর এবং প্রধানত ক্রিতির মাধ্যমে মিশর গ্রিসকে প্রভাবিত করে। কথিত আছে, অর্ফেয়স (Orpheus) ছিলেন একজন সংস্কারক এবং বাকশীয় গোঁড়ামির উন্মাদনায় মেনাদরা (Maenads-অফেয়সের উপাসিকা) তাঁকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলেন। সঙ্গীতে তাঁর আসক্তি প্রথম দিকের লৌকিক উপাখ্যানে স্পষ্ট ছিল না, পরবর্তীকালের কাহিনীতে তা স্পষ্ট হয়েছে। প্রধানত তিনি ছিলেন একজন পুরোহিত ও দার্শনিক।

অর্ফেয়স (যদি সত্যিই তাঁর কোনো অস্তিত্ব থেকে থাকে)-এর উপদেশ যাই হোক না কেন, অফীয়দের উপদেশ সুবিদিত। তারা আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁরা শিখিয়েছিলেন আত্মা মৃত্যুর পর অনন্ত সুখশান্তি লাভ করতে পারে কিংবা অস্থায়ী অথবা চিরস্থায়ী দুঃখকষ্ট ভোগ করতে পারে-এই পৃথিবীতে তার জীবনযাপনের ধরনের উপর সেটা নির্ভরশীল। তারা চেষ্টা করতেন শুদ্ধ হতে, কিছুটা শুদ্ধ হওয়ার অনুষ্ঠান করে এবং কিছুটা দূষণ এড়িয়ে চলে। সর্বাপেক্ষা গোঁড়ারা আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সময় ছাড়া কোনোরকম জান্তব খাদ্য গ্রহণ করতেন না। তাঁদের মতে মানুষ আংশিক পার্থিব এবং আংশিক স্বর্গীয়; শুদ্ধ জীবনের দ্বারা স্বর্গীয় অংশ বৃদ্ধি পায় এবং পার্থিব অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এইভাবে মানুষ শেষ পর্যন্ত বাকখসের সঙ্গে একাত্ব হতে পারে এবং তাকে বাকখস নামেই ডাকা হয়। একটা বিস্তারিত ধর্মতত্ত্ব অনুসারে বাকখস দ্বিজ এক জন্ম মা সেমেলে (Semele) থেকে এবং অপর জন্ম তার বাবা জিউসের ঊরু থেকে।

দিওনিসিয়সীয় পুরাণের নানা রূপ রয়েছে। একটি রূপ অনুসারে দিওনিসিয়স জিউস এবং পেসেফনে (Persephone)-এর সন্তান, বালক বয়সে তিতানরা (Titan-দানব) তাঁকে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেলে তাঁর মাংস খায় কিন্তু হৃৎপিণ্ডটা রেখে। অনেকে বলেন জিউস হৃৎপিণ্ডটা সেমেলেকে দেন, অন্যরা বলেন জিউস ওটা ভক্ষণ করেন। যাই হোক না কেন, এর ফল দিওনিসিয়সের দ্বিতীয় জন্ম। মনে করা হতো বাকখীয়দের বন্য পশুকে ছিঁড়ে তার অপকৃ মাংস ভক্ষণ হলো তিতানদের দিওনিসিয়সকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলার পুনরাভিনয় এবং পশুটি এক অর্থে দেবতাটির অবতার। তিতানরা ধরিত্রীর সন্তান কিন্তু দেবতা ভক্ষণ করায় তারা কিছুটা দেবত্ব লাভ করে। এই কারণেই মানুষ অংশত পার্থিব, অংশত দিব্য এবং বাকশীয় ধর্মাচারণ মানুষকে পূর্ণ দেবত্বের আরও কাছে নিয়ে আসে।

একজন অফীয় পুরোহিতের মুখ দিয়ে এউরিপিদেস একটি স্বীকৃতি করিয়েছেন, এটা শিক্ষামূলকঃ

ইউরোপার তুরীয় বংশের প্রভু,
জিউসজাত, পদতলে তোমার ক্রি
তির মত নগরী,
সেই অস্পষ্ট মন্দিরে আমি তোমার শরণ নিলাম।
সে মন্দিরের ছাদটা বাঁকানো ও খোদাই করা কড়ি দিয়ে তৈরি,
চ্যালিব-এর তৈরি ইস্পাত আর বুনো ষাঁড়ের রক্ত দিয়ে
 সাইপ্রেস কাঠের নিখুঁত জোড়ে
দৃঢ়ভাবে স্থাপিত। যেখানে আছে একটি বিশুদ্ধ স্রোত।
সেই স্রোতে আমার দিন গেল। ভৃত্য আমি
ঈদীয় জোভের শিষ্য।
 সেখানে বিহার করে মাঝরাতে জাগ্রিউস্, বিহার করি আমি
আমি সহ্য করেছি তার বজ্রকণ্ঠ

পূর্ণ করেছি তার রক্তবর্ণ রক্তাক্ত ভোজ,
মহান মাতার পার্বত্য বহ্নি ধারণ করেছি,
 আমি মুক্ত হয়েছি, নামে ভূষিত হয়েছি,
সুরক্ষিত পুরোহিতদের একজন বাকখীয়।

শুভ্র শুদ্ধ আবরণে আমি নিজেকে নির্মলভাবে বহন করেছি,
মনুষ্যজন্মের কালিমা আর কফনের মৃত্তিকা থেকে,
এবং আমার ওষ্ঠ থেকে চির নির্বাসন দিয়েছি।
সব মাংসকে- কখনো জীবন ছিল এমন মাংসে।

বিভিন্ন সামাধিতে অফীয় ফলক পাওয়া গেছে, সেই সমস্ত ফলকে মৃত ব্যক্তির আত্মার প্রতি পরলোক পথ খুঁজে পাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে উপদেশ আছে এবং নিজেকে মুক্তির উপযুক্ত প্রমাণ করার জন্য কি বলতে হবে তাও বলা হয়েছে। ফলকগুলো ভগ্ন এবং অসম্পূর্ণ, তারই মধ্যে সবচেয়ে প্রায় সম্পূর্ণ ফলকে (Petelia-পলি ফলক) লেখা আছেঃ

হাদেস-এর গৃহের বাঁয়ে তুমি একটা ঝর্না-কুপ দেখতে পাবে,
তার পাশে দেখতে পাবে একটা সাদা সাইপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে।
 এই ঝর্না কূপের কাছে যেও না।
কিন্তু স্মৃতি হ্রদের পাশে তুমি দেখতে পাবে আর একটি কূপ,
 সে কূপ থেকে শীতল জল বহমান এবং তার প্রহরী সামনে,
তুমি বলোঃ আমি তারকাখচিত স্বর্গ আর পৃথিবীর সন্তান,
কিন্তু জাতিতে শুধুই স্বর্গীয়-এ কথা তোমাদের জানা।
দেখ, তৃষ্ণায় আমার কণ্ঠ শুষ্ক এবং আমি লয়প্রাপ্ত হব।
ত্বরা করে আমাকে দাও স্মৃতির হ্রদ থেকে বহমান শীতল জল।
তারা নিজেরাই তোমাকে পবিত্র ঝর্না-কূপের জল পান করতে দেবে,
তারপর অন্য বীরদের ভিতরে তুমিও একজন হবে–।

আর একটি ফলকে আছেঃ বেঁচে থাকো তোমরা যারা কষ্ট পেয়েছ, দুঃখ পেয়েছ তোমরা মানুষ থেকে দেবতা হয়েছ।

অপর একটি ফলকে আছেঃ সুখী এবং আশীর্বাদধন্য মানুষ, তোমরা মরণশীল না হয়ে, দেবতা হবে।

যে ঝর্না-কূপ থেকে আত্মার জল খাওয়া নিষেধ সেটার নাম লেথে (Lethe), এই জল খেয়ে বিস্মরণ হয়; অন্য ঝর্না-কূপের নাম মেমসীনে (Mnemosyne) অর্থাৎ স্মরণ। মুক্তি পেতে হলে আত্মাকে পরলোকে গিয়ে বিস্মৃত হলে চলবে না, বরং তাকে স্বাভাবিকের চাইতে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে হবে।

অর্ফীয়রা কৃচ্ছৃসাধনপরায়ণ ছিলেন, তাঁদের কাছে মদিরা ছিল একটা প্রতীক মাত্র, পরবর্তী যুগে খ্রিষ্টিয়দের ধর্মীয় সংস্কারের মতো। যে মাদকতা তাদের কাম্য ছিল তা প্রেরণা বা উৎসাহের অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এভাবেই রহস্যবাদী জ্ঞান লাভ করবেন-যা সাধারণ উপায়ে অসম্ভব। গ্রিক দর্শনে এই রহস্যবাদী উপাদান প্রবেম করে পুথাগরসের সঙ্গে, তিনি ছিলেন অফীয় ধর্মের একজন সংস্কারক, যেমন অর্ফেয়স ছিলেন দিওনিসিয়সীয় ধর্মের সংস্কারক। পুথাগরস থেকে প্লাতনের দর্শনে অফীয় উপাদান প্রবেশ করে এবং প্লাতন থেকে অধিকাংশ পরবর্তী সেই সব দর্শনে যাদের সঙ্গে ধর্মের সামান্যতম সম্পর্ক ছিল।

সেখানে নিশ্চিতরূপে কিছু বাকখীয় উপাদান জীবন্ত থেকেছে যেখানেই ছিল অফীয় ধর্মের প্রভাব। তার একটি হলো নারীবাদ (feminism) পুথাগরসে এটা অত্যধিক ছিল। প্লাতন এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তাঁর দাবি ছিল স্ত্রী-পুরুষে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সাম্য। পুথগরস বলেছেন, লিঙ্গ হিসাবে স্ত্রীলোকেরা স্বভাবত ধার্মিক। আর একটি বাকখীয় উপাদান ছিল তীব্র, হিংস্র আবেগ সম্পর্কে শ্রদ্ধা। গ্রিক বিয়োগান্ত নাটক (tragedy) দিওনিসিয়সীয় আচার থেকে বিকাশলাভ করে। এউরিপিদেস অফীয়দের দুই প্রধান দেবতা দিওনিসিয়স এবং এরস (Eros)-কে বিশেষ করে সম্মান করতেন। নিরুত্তাপ, ধার্মিক, সদাচারী মানুষ সম্পর্কে তাঁর কোনো শ্রদ্ধা নেই। তাঁর ট্র্যাজেডিতে এই চরিত্রগুলো হয় উন্মাদে পর্যবসিত হয়, না হয় বিরোধিতার অপরাধে দেবতারা তাদের দুঃখের শাস্তি দেন।

গ্রিকদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হলো তাদের শান্ত স্বভাব দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাঁরা আবেগ পর্যবেক্ষণ করেছেন দূরত্ব রেখে এবং আবেগের সকল সৌন্দর্য অনুভব করতে সক্ষম ছিলেন- যদিও নিজেরা থাকতেন আত্মস্থ এবং অলিম্পীয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি একদেশদর্শী। হয়তো হোমের, সফক্লেস এবং আরিস্ততেলেস সম্পর্কে এটা সত্য কিন্তু যে সমস্ত গ্রিককে বাকশীয় কিংবা অফীয় প্রভাব স্পর্শ করেছে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে, তাঁদের ক্ষেত্রে এ তথ্য কিছুতেই সত্য নয়। এলেউসিস (Eleusis)-এর আথিনীয় রাষ্ট্রীয় ধর্মে পবিত্রতম অংশ ছিল এলেউসিনীয় রহস্য, সেখানে একটা স্তোত্র গাওয়া হতো, তার বক্তব্যঃ

উচ্চে দুলিয়ে তোমার পানপাত্র,
সঙ্গে নিয়ে তোমার উন্মত্ত উল্লাস,
এলেউসিসের পুষ্পিত উপত্যকায়,
এসো হে বাকখস-পিয়ান, স্বাগতম!

এউরিপিসেদের বাকখায়েতে মেনাদ-এর কোরাসে কাব্য এবং বর্বরতার সমন্বয় দেখা যায়-এটা শান্ত স্বভাবের একেবারেই বিপরীত। বন্য পশুদের অঙ্গ খণ্ডচ্ছিন্ন করার আনন্দ এবং তৎক্ষণাৎ অপকৃ ভক্ষণ করার খুশি তারা উৎসব করে পালন করতেনঃ

যখন পবিত্র ছাগশিশুর চামড়া লেগে থাকে
আর সবই ভেসে যায় উড়ে যায়,
 তখন ধাবনের ক্লান্তিতে বেহুশ হয়ে পড়া
তখন কি আনন্দ, কি আনন্দ পাহাড়ে,
স্রোতস্বিনী রক্তপ্রবাহের আনন্দে
ছিঁড়ে ফেলা পাহাড়ী ছাগলের রক্তে
 বন্য পশুর ভয়ংকর ক্ষুধার গৌরবে
যেখানে পাহাড়ের চূড়া
ধরে ফেলে দিনকে
সেই ফ্ৰিগীয়-এর লুদীয় পাহাড়ে
ব্রোমিওস, তুমি সর্বত্র পথ দেখাও।

(দিওনিসিয়সের বহু নামের ভিতরে ব্রোমিওস একটি নাম)। পাহাড়ের উপরে মেনাদদের নৃত্য শুধু হিংস্রই ছিল না, সে নৃত্য ছিল সভ্যতার হস্তধৃত সতর্কতা এবং ভার থেকে মানব সম্পর্কহীন সৌন্দর্যের জগতে মুক্তি এবং বায়ু ও তারকার স্বাধীনতায় অপসারণ। উন্মাদনা কমার মেজাকে তারা গান করেনঃ

সে দীর্ঘ অতি দীর্ঘ নৃত্য
অন্ধকার রাত জুড়ে,
অস্পষ্ট তারারা না মেলানো পর্যন্ত দীর্ঘ নৃত্য?
সে কি আবার আসবে ফিরে? আমার কাছে?
 আমার গলায় কি আবার
শিশির স্পর্শ করবে?
আমার মাথার চুলে আবার কি হাওয়ার স্রোত বইবে?
 আবছা ময়দানে।
আমাদের সাদা পা কি ঝলমলিয়ে উঠবে?
হায়, হরিণছানার পাগুলো সবুজ বনে হারিয়ে গেল,
একাই হারাল সবুজে আর সৌন্দর্যে।
 শিকার করা পশুর উল্লম্ফন, আর তার ভয় নেই,
ফাঁদ আর মারাত্মক চাপ থেকে সে মুক্ত।
তবুও দূর থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
একটা কণ্ঠস্বর, একটা ভয় আর কুকুরের ছুট,
আরণ্যক শ্রম আর ভয়ংকর দ্রুতি,
এগিয়ে যাওয়া নদী আর উপত্যকা দিয়ে
হে তুফান চঞ্চল পদসমষ্টি-এ কি আনন্দ না ভীতি?
 প্রিয় জনহীন দেশে
যেখানে নেই মানুষের অত্যাচার
সেখানেই কোনো কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয় না,
 ছায়াময় সবুজে বনাঞ্চলের ক্ষুদ্র প্রাণী
বেঁচে থাকে অদৃশ্য হয়ে।

গ্রিকরা ধীর স্থির ছিলেন- একথা পুনরুচ্চারণ করার আগে কল্পনা করার চেষ্টা করুন ফিলাডেলফিয়ার মাঝবয়সী মহিলাদের এই আচরণ, না হয় বাস্তবে ইউজিন ও নীল (Eugene O Neill)-এর একটি নাটকে।

অসংস্কৃত দিওনিসিয়সের পূজারীদের চেয়ে অফীয়রা এমন কিছু ধীর স্থির (serene) নয়। অর্ফীয়দের কাছে এই পার্থিব জীবন শুধুমাত্র বেদনার এবং ক্লান্তির। অনন্ত জীবন মৃত্যুর চক্রে আমরা বদ্ধ, আমাদের আসল জীবন ঐ তারকামণ্ডলী কিন্তু আমরা বদ্ধ রয়েছি পৃথিবীতে। শুধুমাত্র শুদ্ধি, ত্যাগ এবং তপশ্চর্যার দ্বারাই আমরা এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর মিলনের পরম হর্ষ লাভ করতে পারি। এই দৃষ্টিভঙ্গি তো তাঁদের নয় যাদের জীবন সহজ ও আনন্দময়। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই নিগ্রো আত্মিক বাণীর মতোঃ

আমি যখন ঘরে ফিরব।
তখন ঈশ্বরকে বলব আমার সব দুঃখের কথা।

 সবাই না হলেও অধিকাংশ গ্রিকই ছিলেন আবেগপ্রবণ, অসুখী এবং আত্মদ্বন্দ্বে পূর্ণ বৃদ্ধি তাদের এক দিকে টানে, অন্যদিকে টানে তাদের ভাবাবেগ। তাঁদের কল্পনা স্বর্গের ধারণা করে আর তাদের স্বেচ্ছাচারী আত্মপ্রতিষ্ঠা সৃষ্টি করে নরক। তাদের একটা নীতিবাক্য ছিল- কোনও কিছুই অত্যধিক নয় আসলে কিন্তু তাঁদের সব ব্যাপারই ছিল অত্যধিক- শুদ্ধ চিন্তায়, কবিতায়, ধর্মে এবং পাপে। তাঁদের মহত্ত্ব শিরোধার্য করেই বলছি, ভাবাবেগ এবং বুদ্ধির সংমিশ্রণ তাঁদের মহান করেছে। তাঁরা সমস্ত অনাগত ভবিষ্যতের জন্য পৃথিবীকে যেভাবে পরিবর্তিত করেছেন-এ দুটি গুণের যে কোনো একটিমাত্রের সাহায্যে সেটা সম্ভব হতো না। তাঁদের পৌরাণিক আদিরূপ অলিম্পীয় জিউস নয়, তাঁদের আদিরূপ প্রমেথিয়স (Prometheus), তিনি স্বর্গ থেকে আগুন নিয়ে এসেছিলেন এবং প্রতিদানে পুরস্কার পেয়েছিলেন অনন্ত যন্ত্রণা।

সমস্ত গ্রিকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে হলে এখন যা বলা হলো তা গ্রিকদের ধীর স্থির বলে বর্ণনা করার মতোই একপেশে। আসলে গ্রিকদের ভিতরে দুটি ধারা ছিল একটি ধারায় ছিল ভাবাবেগ, ধর্ম, অলৌকিকত্ব এবং অন্য জাগতিক চিন্তা, অন্য ধারায় ছিল উফুল্লতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যুক্তি এবং নানা ঘটনা সম্পর্কিত জ্ঞানলাভের ইচ্ছা। হেরোদতস (Herodotus) শেষোক্ত ধারার প্রতিনিধি। আদিমতম ইওনীয় দার্শনিকরাও এই ধারার প্রতিনিধি ছিলেন এবং আরিস্ততেলেসও খানিকটা এই পথেরই পথিক ছিলেন। অর্ফীয় ধর্মের বিবরণ দেওয়ার পর বেলক (Beloch) (বিপরীত দৃষ্টান্ত (op. cit), 1, 1, পৃষ্ঠা ৪৩৪ দ্রষ্টব্য] বলেছেনঃ

গ্রিকদের পক্ষে এই পৃথিবীকে অস্বীকার করে আসল জীবনকে পরলোকে স্থাপন করার বিশ্বাস গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল কারণ গ্রিকজাতি তারুণ্যশক্তিতে ছিল পরিপূর্ণ। সুতরাং অফীয় মতবাদে দীক্ষিতরা অপেক্ষকৃত ক্ষুদ্র ভক্তগোষ্ঠীর ভিতর আবদ্ধ ছিল, রাষ্ট্রীয় ধর্মের উপর এর সামান্যতম প্রভাবও ছিল না, এমনকি আথিনাতেও নয়-যেখানে রহস্যবাদী উৎসব পালনকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানরূপে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং আইন করে রক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। এই সমস্ত চিন্তাধারা একেবারে অন্যরকম ধর্মীয় পোশাকে সম্পূর্ণ এক হাজার বছর পর গ্রিক জগতে সত্যিই বিজয়লাভ করেছিল।

এটাকে একটা অত্যুক্তি মনে হবে, বিশেষ করে এলেউসিনীয় অলৌকিকত্ব সম্পর্কে-যাতে অন্তর্নিহিত ছিল অফীয় বীজ। মোটামুটি বলা যায়- যাদের মানসিকতা ছিল ধর্মীয় তাঁরা ঝুঁকেছিলেন অফীয় মতবাদের দিকে, যুক্তিবাদীরা এ মতবাদকে ঘৃণা করতেন। এর অবস্থানকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডের মেথোডিস্ট (Methodist) চার্চের অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

শিক্ষিত গ্রিকরা পিতার কাছে কী শিক্ষা করতেন সেটা আমরা মোটামুটি জানি কিন্তু জীবনের প্রারম্ভে তাঁরা মায়ের কাছে শিখতেন সেই সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুব স্বল্প। সংস্কৃতি ছিল পুরুষদের আনন্দক্ষেত্র, নারীরা অধিকাংশই তার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সম্ভবত শিক্ষিত আর্থিনীয়রা তাদের সুসময়েও নিজেদের দৃশ্যত সচেতন মানসিক প্রক্রিয়াতে যতই যুক্তিবাদী হোন না কেন, অকৈশোর ঐতিহ্যবাহী আদিম চিন্তাধারা ও অনুভব বহন করতেন। সঙ্কট মুহূর্তে সেই চিন্তাধারাই জয়লাভ করত। এই জন্য গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো সরল বিশ্লেষণ পর্যাপ্ত নয়।

গ্রিক চিন্তাধারায় ধর্মের প্রভাব, বিশেষ করে, অন-অলিম্পীয় ধর্মের প্রভাব পর্যাপ্ত পরিমাণে উপলব্ধি করা যায়নি যতক্ষণ না মানুষের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারা প্রবেশ করেছে। জেন হ্যারিসন (Jane Harrison)-এর প্রোলেগোমনা টু দ্য স্টাডি অব গ্রিক রিলিজিয়ন (Prolegomena to the Study of Greek Religion-গ্রিক ধর্ম অনুশীলনের ভূমিকা) একটি বৈপ্লবিক বই। সাধারণ গ্রিকদের উপর আদিম ধর্মের এবং দিওনিসিয়সীয় ধর্মের প্রভাব- দুইয়ের উপরেই এতে জোর দেওয়া হয়েছে। এফ. এম. কর্ণফোর্ড (F. M. Cornford)-এর বই রিলিজিয়ান টু ফিলছফি (Religion to Philosophy-ধর্ম থেকে দর্শন)-তে দর্শনের উপর ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে গ্রিক দর্শনের ছাত্রদের সচেতন করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তার অনেক ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য নয়, বিশেষ করে নৃতত্ত্ব।২৪ আমার জানা সবচেয়ে সুষম বিবরণ আছে জন বার্গেট (John Burnet)-এর আদি গ্রিক দর্শন-এ (Early Greek Philosophy), বিশেষ করে এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে, তার নাম বিজ্ঞান ও ধর্ম (Science & Religion)। তিনি বলেন, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে যে ধর্মীয় পুনর্জাগরণ গ্রিক ভূমিতে ভাসিয়ে দিয়ে যায়, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব তারই ফলে, একই সঙ্গে দৃশ্যপট ইওনীয় থেকে পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়। তিনি বলেন, মহাদেশীয় হেল্লাস (Hellas-গ্রিস)-এর ধর্মের (The Religion of Continental Hellas) বিকাশের সঙ্গে ইওনীয়র ধর্মের বিকাশে বিরাট পার্থক্য ছিল- এ পার্থক্য বিশেষ করে ছিল প্রাকি থেকে আগত দিওনিসিয়স-এর পূজার ব্যাপারে এবং এ ব্যাপারটি হোমেরে প্রায় অনুচ্চারিত। দিওনিসিয়স-এর পূজার ভিতরে মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি বীজরূপে ছিল। থ্রাকীয়দের সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চমার্গের চিন্তার অধিকারী ভাবাটা ভুল হবে। নিঃসন্দেহে গ্রিকদের কাছে উল্লাস (ecstasy) এর অর্থ ছিল- আত্মা শুধুমাত্র সত্তার একটি দুর্বল প্রতিরূপ নয়, তার চেয়ে বেশি এবং দেহাতীত হলেই তার সত্য রূপ প্রকাশিত হয়…….।

মনে হয়েছিল প্রাচ্য ধর্মগুলো যে স্তরে ছিল গ্রিক ধর্মও যেন সেই স্তরে পৌঁছাতে উদ্যত হয়েছিল এবং বিজ্ঞানের উদ্ভব না হলে এই প্রবণতা কী করে রূদ্ধ হতো বোঝা শক্ত। সাধারণত বলা হয় পুরোহিত প্রথা না থাকাতেই গ্রিকরা প্রাচ্য ধরনের ধর্ম থেকে রক্ষা পেয়েছেন কিন্তু এ প্রথা বললে কার্যকে কারণ বলে ভুল করা হয়। পুরোহিত শ্রেণি গোঁড়া মতবাদ সৃষ্টি করেন না, মতবাদটা সৃষ্ট হলে তাঁরা সেই মতবাদ রক্ষা করেন; বিকাশের আদি স্তরে প্রাচ্যবাসীদের কোনো পুরোহিত শ্রেণি সে অর্থে ছিল না। পুরোহিত শ্রেণির অনুপস্থিতি নয়, গ্রিসকে রক্ষা করেছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অস্তিত্ব।

এই নতুন ধর্মটি-এক অর্থে নতুন, অন্য অর্থে মানবজাতির মতোই প্রাচীন-অফীয় গোষ্ঠীগুলো প্রতিষ্ঠার পর বিকাশের চরম স্তরে পৌঁছেছিল। যতদূর দেখা যায়, তা থেকে মনে হয় এগুলোর আদি নিবাস ছিল আত্তিকা (Attica) কিন্তু এ ধর্ম অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে, দক্ষিণ ইতালি এবং সিসিলিতে। প্রথমত তারা ছিলেন দিওনিসিয়সের পূজার জন্য গঠিত সমিতি কিন্তু তাঁদের দুটি বিশেষ অবয়ব ছিল দুটিই হেলেনীয়দের ভিতর নতুন। তাঁরা দৈবী জ্ঞানকে কর্তৃত্বের উৎস মানতেন এবং তাঁরা কৃত্রিম কতকগুলো গোষ্ঠীতে সজ্ঞবদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত কবিতাকে প্ৰাকীয় অফেয়সের রচনা বলে মনে করা হতো। তিনি নিজেই হাদেস-এ অবতর করেছিলেন, সুতরাং পরলোকের নানা বিপদে বিদেহী আত্মা একজন নির্ভরশীল পথপ্রদর্শক ছিলেন।

বার্ণেট আরও বলেন, অর্ফীয়দের বিশ্বাসের সঙ্গে ভারতের তদানীন্তন বিশ্বাসের একটা অদ্ভুত মিল দেখা যায়, অবশ্য কোনোরকম যোগাযোগের সম্ভাবনাকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। তারপর তিনি আলোচনা করেছেন উন্মাদনা (orgy) শব্দের মূল অর্থ নিয়ে। অফীয়রা এই শব্দের দ্বারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান (sacrament) বোঝাতে চেয়েছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বাসীর আত্মার শুদ্ধি- যার ফল আত্মার জন্মচক্র থেকে মুক্তি। অলিম্পীয় ধর্মের সঙ্গে অফীয় ধর্মের একটা পার্থক্য ছিল সেটা এই যে-আমরা যাকে চার্চ বলি সেই রকম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ এমন ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করা যেখানে জাতি এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ দীক্ষান্তে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। জীবনযাত্রার একটি পদ্ধতি দর্শন- এই ধারণার উদ্ভব তাদের প্রভাব থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *