৮. সেন্ট ফুমেনথিয়াসের মঠ

সেন্ট ফুমেনথিয়াসের মঠ খালি হয়ে গেছে। গিরিখাদের নিচে তুমুল : যুদ্ধের আওয়াজ শুনে সন্ন্যাসীরা নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়েছেন।

তোরণশোভিত খালি উদ্যান ধরে ছুটলো নিকোলাস, দম নেয়ার জন্য থামলো সিঁড়ির মাথায় এসে। এ সিঁড়ি নীলনদের লেভেল পর্যন্ত নেমে গেছে, ওখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে বোটগুলো। হাঁপাচ্ছে নিকোলাস, ওর নিচের গভীর বেসিনে চোখ বুলাচ্ছে, যেখানে সূর্যকিরণ প্রায় সময় পৌঁছতেই পারে না। জোড়া জলপ্রপাত থেকে ছড়িয়ে পড়া রূপোলি জলকনা সচল মেঘের মতো খাদের গভীরতা ঢেকে রেখেছে, জানার কোনো উপায় নেই রোয়েন আর ড্যানিয়েল ওর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছে কিনা, নাকি ট্রেইল ধরে মঠে পৌঁছুবার সময় তারা কোনো বিপদে পড়েছে।

তারপর হঠাৎ রোয়েনের গলা ভেসে এলো নিচে থেকে, ওর নাম ধরে ডাকছে। ঘন কুয়াশার মতো সচল জলকণার নিচ থেকে আসছে ডাকটা।

নিকোলাস, ওহ, নিকোলাস। তারপর সিঁড়ির ধাপে দেখা গেল ওকে, দ্রুত উঠে আসছে। থ্যাঙ্ক গড! ধরেই নিয়েছিলাম আপনাকে আর পাব না! ছুটে এসে নিকোলাসের গায়ে আছাড় খেলো ও। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ওরা, রোয়েন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বাকি সবাই কোথায়? খানিক পর নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

নিকোলাসের হাত ধরে সিঁড়ির ধাপে পা রাখলো রোয়েন। নিচে আসুন। সবাই ওরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ড্যানিয়েল আর মেক বোটে বাতাস ভরেছেন। ক্রেটগুলো তোলা হচ্ছে এখন।

টিসে?

ভালো আছে।

সিঁড়ির শেষ কটা ধাপ টপকে এলো ওরা। শেষবার যখন দেখেছিল নিকোলাস, তারচেয়ে দশ ফুট উঁচু হয়েছে এখানে নীলনদ। নদী এখন উন্মত্ত, গতিও তীব্র। সচল জলকণার ভেতর দিয়ে কোনোরকমে পাহাড়-প্রাচীরের গা দেখা যায়।

সাতটা রাবার বোট কিনারায় টেনে আনা হয়েছে। এরই মধ্যে চারটেতে বাতাস ভরা হয়েছে, কমপ্রেসড এয়ার সিলিন্ডারের সাহায্যে বাকিগুলোতেও বাতাস ভরার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাতাস ভরা চারটে বোটে ক্রেটগুলো তোলার পর এ মুহূর্তে সেগুলো নাইলন কার্গো নেট দিয়ে সুরক্ষিত করা হচ্ছে। এগিয়ে এসে মেকের কাঁধে হাত রাখলো নিকোলাস, বলল, ধন্যবাদ, বন্ধু। তোমার গেরিলারা বীরের মতো লড়েছে। তুমি আমার জন্য অপেক্ষাও করেছ। পাহাড়-প্রাচীরের সরু কার্নিসে শুয়ে-বসে থাকা গেরিলাদের দিকে তাকালো ও। কয়জনকে হারিয়েছ তুমি, মেক?

তিনজন মারা গেছে, ছয় জন আহত হয়েছে, বলল মেক। আরো বেশি ক্ষতি হতে পারত, কর্নেল ন যদি আরো জোরে ধাওয়া করতেন।

তবু এ-ও অপূরণীয় ক্ষতি, বলল নিকোলাস।

হ্যাঁ, কোনো মৃত্যুরই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়, সায় দিল মেক।

মেক, তোমার বাকি লোকজন কোথায়?

সীমান্তের দিকে রওনা হয়ে গেছে। শুধু বোটগুলো হ্যাঁন্ডেল করার জন্য কয়েকজনকে রেখে দিয়েছি। নিকোলাসের হাত ধরে কয়েক পা হেঁটে এলো মেক, গলা খাদে নামিয়ে বলল, বিপদ এখনো কাটে নি, নিকোলাস।

জানি, মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। কর্নেল নগু এখনো বেঁচে আছে।

শুধু তাই নয়, বলল মেক। অন্তত পুরো একটা কোম্পানি নিয়ে নদীর ভাটি পাহারা দিচ্ছে। আমার স্কাউটরা রিপোর্ট করেছে, দুই পাড়ের ট্রেইলের পজিশন নিয়ে আছে তারা।

আমাদের বোটের কথা কর্নেল জানে না, জানে কি? নিকোলাসের চোখে কঠিন দৃষ্টি।

জানার তো কথা নয়, বলল মেক। কিন্তু আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক কথাই তার জানার কথা ছিল না, অথচ জেনে ফেলেছে। আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে তার হয়তো কোনো ইনফর্মার ছিল। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলো সে, তারপর আবার বলল, কর্নেলের কাছে এখনো হেলিকপ্টার আছে, নিকোলাস। মেঘ কেটে গেলেই নদীতে আমাদেরকে দেখতে পাবে।

নদীই আমাদের একমাত্র এস্কেপ রুট। আশা করা যাক আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।

সবগুলো বেটে বাতাস ভরার কাজ শেষ হলো। একটা বোটে তোলা হলো টিসেকে, স্ট্রেচার সহ। তারপর ধরাধরি করে বোটের কাছে নিয়ে আসা হলো আহত দু জন গেরিলাকে, বাকি সবাই হাঁটতে পারছে। কাজটা শেষ হতে আবার নিকোলাসের কাছে ফিরে এলো মেক। তোমার রেডিও দেখছি ফিরে পেয়েছ, ক্যারিয়ার স্ট্র্যাপের সঙ্গে ফাইবার গ্লাস কেসটা নিকোলাসের কাঁধে ঝুলতে দেখে বলল সে।

এটা ছাড়া বিপদ এড়ানো যাবে না, জবাব দিল নিকোলাস। মেক, তুমি টিসেরবোটে থাকো। সামনের বোটে আমি রোয়েনকে নিয়ে থাকব।

আমাকে সামনে থাকতে দিলে ভালো হত, বলল মেক।

নদী সম্পর্কে কী জানো তুমি? নিকোলাস হাসছে না। এই নদী পথে একমাত্র আমিই আসা-যাওয়া করেছি।

সে তো বহু বছর আগের কথা, বলল মেক।

তখন আরো অনভিজ্ঞ ছিলাম। মেক, তর্ক করো না। আমার পেছনে থাকবে তুমি, তোমার পেছনে ড্যানিয়েল। তোমার গেরিলাদের মধ্যে আর কেউ আছে, এ নদী সম্পর্কে ধারণা রাখে?

আমার সব লোকই ধারণা রাখে, বলে নিজের লোকদের উদ্দেশে তাঁক-ডাক শুরু করলো মেক। চারজন গেরিলা ছুটে এসে বাকি চারটে বোটে উঠে পড়লো। সবাই যার যার বোটে চড়েছে কিনা দেখে নিয়ে, সবার শেষে নিজের বোটে উঠলো নিকোলাস। ওর নির্দেশ প্রত্যেকে বৈঠা হাতে নিল, টিসে আর আহত গেরিলা দু জন। বাদে।

মেক মিছে গর্ব করে নি, গেরিলারা সত্যি সত্যি দক্ষ হাতে বৈঠা চালাচ্ছে। দেখতে না দেখতে নীলনদের মূল স্রোতে গিয়ে পড়লো সাত বোটের ছোট্ট বহরটা।

প্রতিটি বোটে ষোলোজন লোকের জায়গা হবার কথা, সে তুলনায় লোক বা কার্গো কমই তোলা হয়েছে। কোনো বোটেই নয়জনের বেশি লোক নেই। তবে গুপ্তধন ভর্তি ক্রেটগুলো কম ভারী নয়।

সামনে বিপজ্জনক পানি, রোয়েনকে গম্ভীর সুরে বলল নিকোলাস। সেই সুদান সীমান্ত পর্যন্ত। বোটের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ও, হাতে হাল, সামনেটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। ওর পায়ের কাছে খুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে রোয়েন, ঝুলে আছে একটা সেফটি স্ট্র্যাপ ধরে।

জলপ্রপাতের নিচে জোরালো স্রোতটাকে আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে এলো ওরা, সরু একটা ফাঁক বরাবর বহরটাকে এক লাইন নিয়ে এলো, ওই পথে পশ্চিম দিকে ছুটছে নদী। আকাশের দিকে তাকালো ও, দেখলো পানি ভর্তি কালো মেঘ খুব নিচে নেমে এসেছে যেনো পাহাড়-প্রাচীনের চূড়াগুলোকে ছুঁয়ে দেবে।

ভাগ্য বোধহয় আমাদেরকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোয়েনকে বলল ও। এই আবহাওয়ায় হেলিকপ্টার নিয়ে বের হলেও ওরা আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।

হাতে বাধা রোলেক্সের দিকে তাকালো নিকোলাস, পানির ছিটা লেগে ঝাপসা হয়ে আছে কাঁচ। সন্ধ্যে হতে আরো দু ঘণ্টা। পেছন দিকে তাকালো ও। বাকি বোটগুলো ডুবুডুবু হয়ে অনুসরণ করছে ওদেরকে। বোটগুলো হলুদ রঙের, গিরিখাদের ঘাঢ় ছায়া আর কুয়াশার ভেতরও পরিষ্কার দেখা যায়। একটা হাত তুলে নাড়লো নিকোলাস, উত্তরে দ্বিতীয় বোট থেকে মেকও তাই করলো। দাড়ির ভেতর তার হাসি দেখতে পেল নিকোলাস।

নদী এরপর এঁকেবেঁকে, মোচড় খেয়ে এগিয়েছে। কোথাও কোথাও বোল্ডারের মাঝখান দিয়ে সরু পথ ধরে এগুতে হলো ওদেরকে। স্রোত এতো তীব্র, বৈঠা না চালালেও বোট ছুটছে। গিরিখাদের ভেতর বর্ষার পানি ঢোকায় নদীর উপর জেগে থাকা অনেক ক্ষুদে দ্বীপ বা বড় আকারের বোন্ডার ডুবে গেছে, তবে সারফেসের ঠিক নিচেই রয়েছে ওগুলো, বোঝা যাচ্ছে স্রোত বাধা পেয়ে ফেনা তৈরি হতে দেখে। বন্যার পানি দু দিকের পাড় ধরেই অনেক উপরে উঠে গেছে, উপ-খাদের প্রাচীর ছুঁই-ছুই করছে। একটা বোট যদি উল্টে যায়, বা বোট থেকে কেউ যদি পড়ে যায়, পিছিয়ে গিয়ে বোট বা আরোহীকে উদ্ধার করা অন্তত এ নদীতে সম্ভব নয়।

বোটের পেছনে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। মনে মনে শিউরে উঠলো, কারণ খানিক দূর থেকে শুরু হয়েছে নদীর উন্মত্ততা। ওর গোটা জগৎ উপ খাদের আকাশ ছোঁয়া প্রাচীরের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়লো। মুখে পানির ছিটা লাগছে, নাকি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, খেয়াল থাকলো না। নদীর নিচে প্রায় খাড়া ঢাল রয়েছে, ফলে তীব্র স্রোত বোটগুলোকে উল্টে দিতে চাইছে। ঢালের নিচে সমতল সারফেসে নামার সময় একটা বোট থেকে দু জন ছিটকে পড়লো। একজন লোককে দ্রুত ধরে ফেলায় বেঁচে গেল সে, কিন্তু চৌচির হয়ে গেল খুলি। ডুব দেওয়ার পর আর সে উঠলো না। কেউ কথা বলল না বা শোক প্রকাশ করলো না। সবাই যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।

নদীর গর্জনে কান পাতা দায়। সেই শব্দকে ছাপিয়ে উঠলো রোয়েনের চিৎকার, নিকোলাস, হেলিকপ্টার!

পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় নেমে আসা কালো মেঘের দিকে তাকালো নিকোলাস, দেখতে না পেলেও এঞ্জিলের আওয়াজ ঢুকলো কানে। মেঘের আড়ালে! পাল্টা চিৎকার করলো ও, হাতের উল্টোপিঠি দিয়ে পানির ছিটা আর বৃষ্টির ফোঁটা মুছলো চোখ থেকে। এই মেঘ-বৃষ্টির মধ্যে ওরা আমাদেরকে দেখতে পাবে না।

আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় ওদের উপর দ্রুত নেমে এলো আফ্রিকান রাত্রি। ঘনায়মান সন্ধ্যায় কোনো রকম সতর্ক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আরেকটা বিপদ লাফ দিয়ে পড়লো ওদের উপর। এক মুহূর্ত আগে নদীর মর্পণ বিস্তৃতি ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছিল বোট, পর মুহূর্তে ওদের সামনে উন্মুক্ত হলো পানি, নদী ওদেরকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। তারপর মনে হলো অনন্তকাল ধরে খসে পড়ছে ওরা, অথচ পতনটা ত্রিশ ফুটের বেশি নয়। জলপ্রপাতের নিচে পড়ে ডুবে গেল ওরা, বোট, কার্গো আর আরোহী জট পাকিয়ে একাকার। নদী এখানে স্রোতবিহীন, বিরাট একটা জায়গা জুড়ে ফুঁসছে, আবার বিপুল বেগে ধাবিত হওয়ার জন্য এক করছে যেনো সমস্ত শক্তি।

একটা বোট উল্টো হয়ে ভাসছে। বাকি বোটগুলোর আরোহিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে দ্রুত বৈঠা চালিয়ে ছুটে গেল সেদিকে। পানি থেকে তুলে নিল ডুবন্ত আরোহিদের, উদ্ধার করলো ভাসমান বৈঠা আর ইকুইপমেন্ট। সবার মিলিত চেষ্টায় বোটটাকেও সোজা করা সম্ভব হলো। ইতোমধ্যে গিরিখাদ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে।

ক্রেটগুলো গুনতে হয়, নির্দেশ দিল নিকোলাস। কয়টা হারালাম?

খানিকপর ড্যানিয়েলের চিৎকার শুনে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে হলো নিকোলাসের। সব মিলিয়ে তেরোটা ক্রেট! কোনো বাক্সই পানিতে পড়ে নি, কৃতিত্বটা আসলে কার্গো নেটের। তবে সবাই ওরা সাংঘাতিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ভেজা শরীরে কাঁপছে। এ অন্ধকারে এগোনোর চেস্টা আত্মহত্যা করতে চাওয়ার নামান্তর। কাছাকাছি বোটের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে মেকের চোখে তাকালো নিকোলাস।  

মেক বলল, পাহাড়ের ওদিকটার একটা ভাজে পানি খানিকটা শান্ত। হ্রদের লেজের নিকটা হাত তুলে দেখালো সে। রাত কাটানোর জন্য কার্নিস পাওয়া যেতে পারে।

ঠিক ভাঁজ নয়, পাহাড়ের গায়ে সরু একটা ফাটল দেখলো ওরা। ফাটলটার মুখেই অ্যাবস্ট্রাক্ট শিল্পকর্মের মতো উদ্ভট আকৃতির একটা গাছ, বেশ অনেকগুলো শাখা, তবে একটাতেও কোনো পাতা নেই। ওটায় বোটের রশি বাঁধল ওরা। রশির দৈর্ঘ্য কমবেশি রাখা হলো, ফলে বোটগুলো পাশাপাশি বেসে থাকছে। গরম খাবার বা পানীয় কল্পনাও করা যায় না, বেয়নেটের ডগা দিয়ে টিনের কৌটা খুলে শুকনো কিছু খাবার মুখে দিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হলো।

নিজের বোট থেকে লাফ দিয়ে নিকোলাসের বোটে চলে এলো মেক, বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে কথা বলল কানে কানে। এই মাত্র রোল কল করলাম। জলপ্রপাত থেকে পড়ার সময় আরো একজনকে হারিয়েছি আমরা। এখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

লীডার হিসেবে আমি বোধহয় ভালো করছি না, বলল নিকোলাস। কাল সকাল থেকে তুমি সামনে থাকবে।

তুমি দায়ী নও। নিকোলাসের কাঁধে চাপ দিল মেক। এরচেয়ে ভাল করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। দায়ী আসলে শেষ ওয়াটারফলটা… থেমে গেল সে, দু জনই ওরা অন্ধকারে কান পেতে জলপ্রপাতের গর্জন শুনছে।

কতদূর এলাম আমরা? জানতে চাইলো নিকোলাস। আর কতদূর যেতে হবে?

বলা প্রায় অসম্ভব, তবে আমার ধারণা অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছি। কাল দুপুরের মধ্যে সীমান্তে পৌঁছে যাব।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মেক জিজ্ঞেস করলো, ক তারিখ আজ?

ভুলে গেছি। রোলেক্সটা চোখের সামনে তুলে আলোকিত ডায়ালে তাকালো নিকোলাস। গুড গড! আজ ত্রিশ তারিখ!

তোমার পিক-আপ এয়ারক্রাফট পরশু রোজিরেস এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছবে, মনে করিয়ে দিল মেক।

হ্যাঁ, পয়লা এপ্রিলে, বলল নিকোলাস। আমরা সময় মতো পৌঁছতে পারব তো?

উত্তরটা তোমার কাছ থেকে চাই আমি, বলল মেক, কিন্তু হাসছে না।

তোমার পাইলট কতটুকু বিশ্বস্ত? পৌঁছতে দেরি করার আশঙ্কা কতটুকু?

জেনি প্রফেশন্যাল, পৌঁছতে কখনোই দেরি করেন না, জোর দিয়ে বলল নিকোলাস। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো। খানিক পর জিজ্ঞেস করলো, রোজিরেস পৌঁছে তোমাকে যদি ট্রেজারের ভাগ দিয়ে দিই, ওগুলো নিয়ে কী করবে তুমি? একটা ক্রেটে জুতোর ডগা ঠেকালো নিকোলাস। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে?

তোমাদেরকে প্লেনে তুলে দেওয়ার পর কর্নেল নগুকে পেছনে ফেলার জন্য আরো কিছুদূর ছুটতে হবে আমাদের, কাজেই অতিরিক্ত বোঝা বইতে রাজি নই। আমার ভাগ তোমার সঙ্গে থাকবে। বিক্রিও করবে তুমি এখানে যুদ্ধ চালাবার জন্য নগদ টাকা দরকার আমার।

তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?

বিশ্বাস না করলে বন্ধু কিসের!

বন্ধুদের ঠকানো সবচেয়ে সহজ-ওরা বেঈমানী আশা করে না, বলল নিকোলাস, শুনে ওর কাঁধে হালকা ঘুসি মারলো মেক।

খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। কাল হয়তো বিকেল পর্যন্ত একটানা বৈঠা চালাতে হবে। বোটের উপর দাঁড়ালো মেক। লাফ দিয়ে পাশের বোটে চলে গেল। টিসেতার জন্য অপেক্ষা করছে ওখানে।

রোয়েনের দিকে ঝুঁকে হাত বাড়াল নিকোলাস। টেনে এনে ওর দুই হাঁটুর মাঝখানে বসাল, রোয়েন বাধা না দিয়ে হেলান দিল ওর বুকে, ভেজা কাপড়ে একটু একটু কাঁপছে। খানিক পর কাঁপুনিটা বন্ধ হয়ে গেল। রোয়েন ফিসফিস করে বলল, দেখা যাচ্ছে আপনি একটা হটওয়াটার বটল।

আমাকে খুব কাছে সবসময় থাকতে দেওয়ার এটা একটা মস্ত সুবিধে, নিঃশব্দে হাসছে নিকোলাস, রোয়েনের মাথায় আদর করে হাত বুলাচ্ছে। জবাবে রোয়েন আর কিছু বলল না, তবে নিতম্ব ঘষে আরো একটা কাছে সরে এলো। আরো খানিক পর ঢিল পড়লো ওর পেশীতে, ঘুমিয়ে পড়লো নিকোলাসের বুকে মাথা রেখে।

নিকোলাসও সাংঘাতিক ক্লান্ত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাল ধরে থাকার তালুতে ফোস্কা পড়ে গেছে, তবু রোয়েনের মতো এতো সহজে ঘুমিয়ে পড়তে পারলো না। রোজিরেস এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছতে পারার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, কাজেই নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে এগোনো আর কর্নেল নগুকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা উঁকি দিচ্ছে ওর মনে। নদী আর কর্নেল নগু পরিচিত শক্ত, কাজেই কীভাবে লড়তে হবে জানে। কিন্তু পরিচিত শক্র ছাড়াও অন্য অনেক কিছু বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে, অচিরেই সে সবের মুখোমুখি হতে হবে ওকে।

ওর বাহুবন্ধনে বিড়বিড় করে কী যেনো বলল রোয়েন, বুঝতে পারলো না নিকোলাস। স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা, ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। আদর করে আবার ওর মাথায় হাত বুলাল নিকোলাস, স্থির হয়ে গেল রোয়েন। কিন্তু খানিক পর আবার কথা বলল ও, এবার কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পেল নিকোলাস। সত্যি আমি দুঃখিত, নিকোলাস। আমাকে ঘৃণা করবেন না। কীভাবে আপনাকে আমি এ-সব… শেষ দিকে কথাগুলো জড়িয়ে গেল, কী বলতে চায় বোঝা গেল না।

নিকোলাসের স্নায়ু টানটান হয়ে উঠেছে, রোয়েনের কথাগুলো মনের সন্দেহ আর আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। বাকি রাতটুকু প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিল ও, ঘুম এলেও খানিক পরপর ভেঙে যাচ্ছে।

*

ভোরের আলো ফুটতে একটু ধাক্কা দিয়ে রোয়েনের ঘুম ভাঙালো নিকোলাস। গত রাতের বাড়তি খাবার থেকে ঠাণ্ডা কয়েক টুকরো মুখে পুড়লো।

আবার নদীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলো। মাথার উপর মেঘ এখনো নিচে নেমে আছে, কোথাও এতোটুকু ভাঙনও ধরে নি; খানিক পর পর এক পশলা করে বৃষ্টিও হচ্ছে। সারাটা সকাল ধরে বিরতিহীন টলো বোট, ধীরে ধীরে নদীর মেজাজ শান্ত হয়ে আসছে। স্রোত এখন আর আগের মতো তীব্র নয়, পাড়গুলো নয় দুর্গম বা খাড়া।

দুপুরের দিকেও মাথার উপর মেঘ জমাট বেঁধে থাকলো। নদীর এমন একটা বিস্তৃতিতে পৌঁছল ওরা, পানি এখানে প্রবাহিত হচ্ছে অসংখ্য ব্লাফ আর হেডল্যান্ডের ভেতর দিয়ে। ইতোমধ্যে নিরাপদ পথ চিনতে দক্ষ হয়ে, উঠেছে নিকোলাস, বোধহয় সেজন্যই কোনো রকম বিপদের মধ্যে না পড়ে বিস্তৃতিটুকু পার হয়ে এলো বোটগুলো। সম্ভবত সুদানের সমতল প্রান্তরে পৌঁছতে যাচ্ছি আমরা, নদী তাই চওড়া হয়ে যাচ্ছে, রোয়েনকে বলল নিকোলাস।

রোজারিস আর কত দূরে? জানতে চাইলো রোয়েন।

তা বলতে পারব না, তবে সীমান্তের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।

নদী শান্ত হওয়ায় নিকোলাস আর মেকের বোট এখন পাশাপাশি চলে এসেছে। একটা বাঁক ঘুরলো ওরা, সামনে আরো চওড়া দেখালো নদীকে, কোথাও কোনো আলোড়ন নেই।

একটু শান্ত হলো নিকোলাস। রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলল, আগামি রবিবারে উরচেস্টারের গ্রীলে লাঞ্চ করলে কেমন হয়? লন্ডনের সেরা।

একটু হাসার আগে রোয়েনের চোখে ছায়া খেলে গেল–লক্ষ্য করলো নিকি।

শুনতে তো ভালোই লাগছে। রোয়েন বলে।

লাঞ্চের পরে বাড়ি ফিরে টিভিতে প্রোগ্রাম দেখতে পারি। অথবা, আমাদের প্রিয় একটা খেলাও খেলতে পারি!

আপনি একটা বাজে লোক! হেসে ফেললো রোয়েন। তবে শুনতে কিন্তু ভালো লাগছে।

ঝুঁকে চুমো খেতে চাইলো নিকোলাস, রোয়েনের লাজনম্র চেহারাটা পরখ করতে চাইলো–কিন্তু পরবর্তী বাঁক গুরতেই নাক বরাবর সামনে নদীর মাঝখান থেকে উথলে উঠতে দেখলো একটা ফোয়ারাকে। সচল ফোয়ারা, ওদের দিকে ছুটে আসছে। পরমুহূর্তে অটোমেটিক ফায়ারের আওয়াজ ভেসে এলো, একটা রুশ আরপিডি থেকে আসছে।

লাফ দিয়ে রোয়েনের গায়ে পড়লো নিকোলাস, নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে ফেললো ওকে, শুনতে পেল পাশের বোট থেকে গেরিলাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করছে মেক। রিটার্ন ফায়ার! মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করো ওদের।

গেরিলারা বৈঠা ফেলে দিয়ে অস্ত্র তুলে নিল হাতে। নদীর পাড় সামান্য মোচড় খেয়েছে সেই মোচড়ের ভেতরের কোণ থেকে হামলা করা হয়েছে, গেরিলারা পাল্টা গুলি করছে সে দিকে।

শত্রুপক্ষ পাথর আর ঝোঁপের আড়ালে রয়েছে, গেরিলাদের সামনে নির্দিষ্ট কোনো টার্গেট নেই। তবে এ ধরনের অ্যামবুশে পড়লে বিরতিহীন পাল্টা গুলি করার কোনো বিকল্প নেই, আক্রমণকারীরা যাতে মাথা নিচু রাখতে বাধ্য হয়, যাতে লক্ষ্যস্থির করতে না পারে।

রোয়েনের মাথার কাছে বোটের নাইলন স্কিন ভেদ করলো একটা বুলেট, মেটাল অ্যামুনিশন ক্রেটে লাগলো। বৃষ্টির মতো বুলেট ছুটে আসছে, বোটগুলোর ফুটো হওয়া ঠেকানোর উপায় নাই। একজন গেরিলার মাথায় লাগলো একটা বুলেট, খুলির উপর একটা গভীর খাল কেটে বেরিয়ে গেল, ছিটকে পানিতে পড়ে গেল লোকটা। যতটা না ভয়ে, তার চেয়ে বীভৎস দৃশ্যটা অসুস্থ করে তুললাম রোয়েনকে। নিহত লোকটার রাইফেল ঘেঁ দিয়ে তুলে নিল নিকোলাস, পাড় লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে খালি করে ফেললো ম্যাগাজিন।

বোটগুলো এখনো স্রোতের সঙ্গে ভাটির দিকে ছুটছে, কেউ হাল ধরে না থাকায় অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। অ্যামবুশকে পাশ কাটিয়ে পরবর্তী বাঁক ঘুরতে এক মিনিটের বেশি লাগলো না। খালি রাইফেল ফেলে দিয়ে মেকের দিকে তাকালো নিকোলাস। রিপোর্ট করো, মেক।

আমার বোটে একজন মারা গেছে, বলল মেক।

প্রতিটি বোট থেকে রিপোর্ট চাইলো নিকোলাস। মারা গেছে ওই একজনহ, আহত হয়েছে তিনজন। তবে আহত কারো অবস্থা গুরুতর নয়। তিনটে বোট ফুটো হয়েছে, তবে প্রতিটি খোল আলাদা আলাদা ওয়াটারপ্রুফ কমপাটমেন্ট জোড়া লাগিয়ে তৈরি হওয়ায় এখনো ভেসে আছে পানির উপর।

বোট নিয়ে নিকোলাসের পাশে চলে এলো মেক। অথচ আমি ভাবছিলাম কর্নেল নগুকে ফাঁকি দিতে পেরেছি।

প্রথম হামলাটা হালকার উপর দিয়ে গেছে. বলল নিকোলাস। নদীতে ওরা আমাদেরকে আশা করে নি, ফলে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, কর্নেল গুকে আর চমকে দেওয়া যাবে না। বাজি ধরতে পারো, রেডিওতে কথা বলছে ওরা। নগু এখন জানে কোথায় রয়েছি আমরা, যাচ্ছিই বা কোনদিকে। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো মেক। মেঘ কেটে গেলে বিপদ হবে।

সুদান সীমান্ত আর কত দূরে?

আর বোধহয় দুঘণ্টার পথ।

বর্ডার ক্রসিঙে গার্ড থাকে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

না। দু দিকেই ফাঁকা ঝোঁপ।

ফাঁকা থাকলেই হয়, বিড়বিড় করলো নিকোলাস।

গোলাগুলি থেকে যাবার ত্রিশ মিনিট পর আবার ওরা হেলিকপ্টারের আওয়াজ পেল। মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে ভাটির দিকে। বিশ মিনিট পর আবার শোনা গেল রোরের আওয়াজ, তবে এবারও মেঘের আড়ালে থাকায় দেখা গেল ণা। উজানের দিক থেকে এলো, খানিক পর আবার ভাটির দিকে গেল। নগুর মতবলটা কী বলো তো? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মেক। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে নদীর উপর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মেঘের নিচে আমাদেরকে তো দেখতে পাচ্ছে না।

নিজের লোকজনকে ভাটির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বলল নিকোলাস। আমাদের সঙ্গে বোট আছে, কোনদিকে যাচ্ছি আন্দাজ করে নিয়েছে। হয়তো রোজারিস এয়ারস্ট্রিপ সম্পর্কেও তার জানা আছে। নদীর কাছাকাছি ওটাই একমাত্র পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ। পৌঁছে হয়তো দেখবো ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

নিজের বোট আরো কাছে সরিয়ে আনল মেক, তারপর বলল, আমার ভালো ঠেকছে না, নিকোলাস। সরাসরি ওদের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছি। কিছু একটা পরামর্শ দাও।

কিছুক্ষণ চিন্তা করলো নিকোলাস। তারপর জিজ্ঞেস করলো, নদীর এ অংশটা তুমি চিনতে পারছ না? এখনো বুঝতে পারছ না ঠিক কোথায় আমরা রয়েছি?

মাথা নাড়লো মেক। সীমান্ত পার হবার সময় নদীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকি আমরা। তবে পুরানো সুগার মিলটা চিনতে পারব, ওখানে পৌঁছবার পর। এয়ারস্ট্রিপ থেকে তিন মাইল উজানে ওটা।

পরিত্যক্ত?

হ্যাঁ, বলল মেক। বিশ বছর আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই খালি।

আকাশে মেঘ থাকায় এক ঘণ্টার মধ্যে সন্ধে হয়ে যাবে, বলল নিকোলাস। নদী শান্ত, কাজেই রাতেও আমরা বোট চালাতে পারি। গুমা হয়তো তা আশা করছে না। অন্ধকারে তাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হতে পারে।

এই তোমার পরামর্শ? মেকের গলায় ক্ষোভ। এ যেনো চোখ বুজে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়া।

আরো ভালো প্ল্যান পেতে হলে তথ্য দাও আমাকে, বলল নিকোলাস। জেনি কাল কখন পৌঁছবেন জানাও। এখন ঠিক কোথায় রয়েছি বলো।

মেক কথা বলল না।

ওদের মতো গেরিলারাও খুব টেনশনে ভুগছে। সন্ধ্যে হয়ে এলেও, হাতের অস্ত্র দুই পারের দিকে তাক করে রেখেছে তারা। আরো অনেকক্ষণ পর মেক বলল, আমরা সম্ভবত এক ঘণ্টা আগেই সীমান্ত পেরিয়ে এসেছি। সুগার মিলটা আর বেশি দূরে হতে পারে না।

অন্ধকারে ওটাকে তুমি খুঁজে পাবে কীভাবে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

নদীর পারে পাথরের তৈরি একটা জেটি আছে, বলল মেক। ওখান থেকে কার্গো বোটগুলো খার্তুমে চিনি নিয়ে যেত।

ঝপ করে রাত নেমে এসে অন্ধকারে ঢেকে দিল ওদের জগৎ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিকোলাস, পাড় থেকে এখন আর ওদেরকে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার আরো একটু গাঢ় হতে বোটগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে নাইলন রশি দিয়ে বেঁধে নিল ওরা, কোনটা যাতে আলাদা হয়ে না যায়। বৈঠা চালাতে নিষেধ করলো নিকোলাস, কোনো রকম শব্দ না করাই ভালো। স্রোতের টানে নিঃশব্দে ছুটে চলছে বোটগুলো। ডানদিকের তীর ঘেঁষে যাচ্ছে ওরা, মাঝে-মধ্যেই নদীর তলায় ঘষা খেয়ে আটকে যাচ্ছে ওরা, মাঝে-মধ্যেই নদীর তলায় ঘষা খেয়ে আটকে যাচ্ছে বোট, তখন পানিতে নেমে ঠেলে গভীর জলে আনতে হচ্ছে।

অকস্মাৎ রোজিরেস-এর পাথুরে জেটি ওদের সামনে যেনো লাফ দিয়ে উদয় হলো, সময় মতো দেখতে না পাওয়ায় নিকোলাসের বোট ধাক্কা খেলো ওটার সঙ্গে। বোট থেকে কয়েকজন আরোহী ছিটকে পড়লেও, কেউ আহত হলো না। পানি এখানে কোমর সমান, বোট টেনে পাড়ে তুলতে কোনো অসুবিধে হলো না, বিশজন গেরিলাকে আখ খেতের ভেতর ছড়িয়ে দিল মেক, কর্নেল নগুর আকস্মিক হামলা যাতে ঠেকানো সহজ হয়।

রোয়েনকে, বোট থেকে নামতে সাহায্য করলো নিকোলাস, তারপর টিসেকে–নিতে এলো। হেসে উঠে নিকোলাসের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলো টিসে, জানালো নিজেই নামতে পারবে। দীর্ঘ বিশ্রামে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। তবে নিকোলাসকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না।

টিসে তীরে নামতেই নিকি তাকে জিজ্ঞেস করলো, একটা কথা, টিসে। জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি। ডেবরা মারিয়াম থেকে রোয়েন আপনাকে যে মেসেজটা পাঠাতে বলেছিলেন, সেটার কি হলো?

ও, হ্যাঁ, বলল টিসে। মিশরীয় দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাশে মুসাদকে মেসেজটা আমি জানিয়ে দিয়েছি। ফিরে এসে আপনার বান্ধবীকে বলেওছি কথাটা, উনি আপনাকে বলেন নি?

ওঁর হয়তো মনে নেই, বলে এড়িয়ে যাবার চেস্টা করলো নিকোলাস। তাছাড়া, ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু, ধন্যবাদ, টিসে।

অ্যামুনিশন ক্রেটগুলো বোট থেকে দ্রুত নামানো হলো। খালি বোট পানি থেকে তুলে লুকিয়ে রাখা হলো আখ খেতের ভেতর। অন্ধকারে কাজ চলছে, আলো জ্বালতে নিষেধ করে দিয়েছে নিকোলাস। গেরিলাদের মধ্যে ক্রেটগুলো ভাগ করে দেওয়া হলো। নিজের কাঁধে ড্যানিয়েলও একটা বাক্স তুললাম। নিকোলাসের এক কাঁধে রেডিও, অপর কাঁধে ইমার্জেন্সি প্যাক জ্বলছে, মাথায় নিয়েছে একা কেট, ফারাও-এর সোনার ডেথ-মাস্ক আর টাইটার উশব তি আছে ওটায়।

প্রথমেই স্কাউটদের ছোট একটা দলকে এয়ারস্ট্রিপে পাঠিয়ে দিল মেক, ওরা যাতে অ্যামবুশের মধ্যে না পড়ে। তারপর আগাচায় ঢাকা ট্রেইল ধরে এক লাইনে রওনা হলো মূল দল। এক মাইলও এগুনি, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিল কাস্তে আকৃতির চাঁদ। তারপর একটা দুটো করে তারাও দেখা গেল। রাতের কালো আকাশের গায়ে সুগার মিলের চিমনিটা চিনতে পারলো ওরা।

কোনো অঘটন ছাড়াই রাত তিনটের দিকে এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছল ওরা। ইতোমধ্যে চাঁদ ডুবে গেছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর অ্যামুনিশন ক্রেটগুলো সাজিয়ে রাখা হলো, পাহারায় থাকলে কয়েকজন গেরিলা। রোয়েন আর টিসে আহত গেরিলাদের দেখাশোনা করছে।

মেকের মেডিকেল কিটটা সাংঘাতিক কাজে লাগলো। ছোট্ট একটা আগুন জ্বালা হয়েছে, পর্দার ভেতর, তারই আভায় আহতদের সেবা করছে ওরা। এক পাশে সরে এসে রেডিওর এরিয়াল লম্বা করলো নিকোলাস, রেডিও নাইরোবি ধরে চাকা-চাকার গান শুনলো কিছুক্ষণ। আগেও শুনেছে, মেয়েটার গলা ওর ভালোই লাগে। তবে একটু পরই রেডিও বন্ধ করে দিল, ব্যাটারি অপচয় করতে চায় না। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজল নিকোলাস, ভোর হওয়ার আগে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়। কিন্তু ঘুম এলো না-বেঈমানীর আভাস পেয়ে বড় বেশি রেগে আছে ও।

*

বিগ ডলি! সাড়া দাও, বিগ ডলি! আমি ফারাও তোমাকে ডাকছি। আমার কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ? সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগে রেডিওর সাহায্যে ডাকাডাকি শুরু করছে নিকোলাস।

তারপর মেককে বলল, জেনিকে আমি চিনি, সময়ের হিসেব করেই রওনা হবেন, যাতে খুব ভোরে ল্যান্ড করতে পারেন এখানে।

যদি আদৌ রওনা হন আর কি, মেকের গলায় সংশয়।

জেনি? ওঁকে তুমি চেনো না, তাই এ-কথা বলছ। জেনি কখনোই হতাশ করেন নি আমাকে। মাইক্রোফোনের বোতামে চাপ দিয়ে আবার ডাকলো নিকোলাস, বিগ ডলি! বিগ ডলি। সাড়া দাও!

হঠাৎ দাঁড়াতে শুরু করলো রোয়েন, বলল, ইঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। শুনুন!

নিকোলাস ও মেক ঝেপের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে উত্তর আকাশের দিকে তাকালো।

ওটা হারকিউলিস নয়, হঠাৎ বলল নিকোলাস, বিস্মিত দেখালো ওকে। ঘুরে দক্ষিণে তাকালো, নদীর দিকে। তাছাড়া, শব্দটা আসছে উল্টোদিক থেকে।

ঠিক, সায় দিল মেক।

সিঙ্গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ। রোরের শব্দও পাচ্ছি। আমি।

পেগাসাস হেলিকপ্টার! বলল নিকোলাস। হামলা করতে আসছে।

তবে না, আওয়াজটা ক্রমশ দূরে মিলিয়ে গেল। ঢিল পড়লো নিকোলাসের পেশীতে। ওরা আমাদের দেখতে পায় নি। বোটগুলো লুকিয়ে রাখার লাভ হয়েছে।

ঝোঁপের আগালে ফিরে এলো ওরা। রেডিওটা আমার অন করলো নিকোলাস। কিন্তু জেনি বাদেনহোর্সটের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ মিনিট পর জেট রেঞ্জারের ফিরে আসার আওয়াজ পেল ওরা। খানিকক্ষণ কান পেতে সোনার পর নিকোলাস বলল, ফিরে যাচ্ছে আবার। কিন্তু দশ মিনিট পর আবার ভেসে এলো রোরের শব্দ।

নগু কিছু একটা করছে ওদিকে, বলল মেক, চেহারায় অস্বস্তি।

কি? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

হয়তো বোটগুলো দেখতে পেয়েছে, বলল মেক। হামলা করার আগে আরো লোকজন এনে জড়ো করছে। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে কান পাতলো সে। খানিক পর ফিরে এলো নিকোলাসের পাশে। নিকোলাস রেডিওতে কথা বলছে।

তুমি ডাকতে থাকো। আমি যাই, গেরিলাদের সাবধান করে দিই।

পরবর্তী তিন ঘণ্টা নীলনদের উপর দিয়ে বারবার আসা-যাওয়া করলো পেগাসাসের জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। তবে নতুন কিছু ঘটছে না। রোনের আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ওরা, শব্দটা হলে রেডিও থেকে এক-আধবার শুধু মুখ তুলছে নিকোলাস। তারপর হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠলো রেডিও, জেনি বাদেনহোর্সটের গলা ভেসে এলো। ফারাও! বিগ ডলি বলছি। আমার কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ?

সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল নিকোলাস, আমি ফারাও। মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনাও, বিগ ডলি।

পৌঁছতে আরো এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট লাগবে, জেনি বাদেনহোর্সটেরই গলা, কোনো সন্দেহ নেই।

মাইক্রোফোন রেখে দিয়ে রোয়েন আর টিসের দিকে তাকালো নিকোলাস। জেনি রওয়া হয়ে গেয়েছেন, ওঁ….

মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল, নদীর দিক থেকে ভেসে এলো একে ফরটিসেভেনের বিরতিহীন গর্জন। কয়েক সেকেন্ড পর দুটো গ্রেনেডও বিস্ফোরিত হলো। গুঙিয়ে উঠলো নিকোলাস, সর্বনাশ! নগু হামলা করেছে।

কোনো চিন্তা করবেন না, জবাব দিল জেনি। আপনি মুকুট পরে থাকুন, মনিব আমার। আমি ঠিকই পৌঁছব, আগুন থেকে তুলেও নিব আপনাদের।

পরবর্তী আধ ঘণ্টা নদীর কিনারা বরাবর গোলাগুলির আওয়াজ ক্রমশ বাড়লো, একে-ফরটিসেভেনের শব্দ মুহূর্তের জন্যও থামছে না। ধীরে ধীরে কাছে সরে আসছে যুদ্ধটা। পরিষ্কার বোঝা গেল, ছড়িয়ে থাকা গেরিলারা পিছু হটছে। বিশ মিনিট পরপর ব্রেনের আওয়াজও পেল ওরা, প্রতিবার আরো সৈন্য এনে নিজের শক্তি বাড়িয়ে নিচ্ছে কর্নেল নগু।

এয়ারস্ট্রিপের কাছাকাছি ঝোঁপের ভেতর সুস্থ ও সমর্থ পুরুষ বলতে শুধু নিকোলাস আর ড্যানিয়েল, বাকি সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছে। ক্রেটগুলো গুরুত্ব অনুসারে নতুন করে সাজালো ওরা দু জন, প্লেন ল্যান্ড করলে তাড়াহুড়ো করে লোড করা হবে। যুদ্ধক্ষেত্রের চারটা মডেল প্রথমে ভোলা হবে প্লেনে। তারপর ডেথ-মাস্ক আর টাইটার পুতুল আছে যে ক্রেটে, সেটা। তৃতীয় দফায় তোলা হবে তিনটি মুকুট-লাল, সাদা আর নীল ক্রাউন। এ তিনটের দাম সম্ভবত বাকি সমস্ত ট্রেজারের চেয়েও বেশি। কাজটা শেষ করে আহত গেরিলাদের সঙ্গে কথা বলল নিকোলাস, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ দিল, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো আত্মত্যাগের জন্য। ওদেরকে প্লেনে ওঠার প্রস্তাব দিল নিকোলাস, এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়।

আহতদের মধ্যে থেকে সাতজন ওর প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলো, কমান্ডার মেককে ছেড়ে কোথাও তারা যাবে না। বাকি সবাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলো, বিশেষ করে টিসের যুক্তি এড়াতে না পেরে। যারা প্লেনে উঠবে তাদেরকে এয়রস্ট্রিপের আরো কাছাকাছি তুলে আনা হলো। ক্রেটগুলো আগেই সরিয়ে আনা হয়েছে।

আপনি কী করবেন? টিসেকে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। আপনিও কি আমাদের সঙ্গে আসছেন? পুরোপুরি সুস্থ এখনো আপনাকে বলা যায় না।

হেসে উঠলো টিসে। যতোক্ষণ দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব, আপনারা আমাকে মেকের পাশেই দেখতে পাবেন।

আপনি কী জানেন, নিজের ভাগের শেয়ার মেক আমাকে নিয়ে যেতে বলেছে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। অতিরিক্ত বোঝা সঙ্গে নিতে রাজি নয়?

জানব না কেন। মেক আমার সঙ্গে আলোচনা করেছে। এখানে যুদ্ধ চালাতে হলে আমাদের টাকা দরকার।

নিজের অজান্তেই ঝট করে মাথাটা নিচু করে নিল টিসে, অকস্মাৎ একটা বিস্ফোরণ ঘটার পরপরই। ঝোঁপের কিনারা থেকে ধুলোর লম্বা একটা স্তম্ভ আকাশের দিকে খাড়া হলো। বাতাসে শিস কেটে ওদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল শ্যাপনেল। সুইট মেরি! কী ওটা? আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে টিসের চেহারা।

দু ইঞ্চি মর্টার, বলল নিকোলাস। নড়েনি ও, আড়াল পাবারও চেষ্টা করে নি। যতো গর্জে ততো বর্ষে না।নগু শেষবার কপ্টারে করে ওগুলো এনেছে বলে মনে হয়।

হারকিউলিস এখানে পৌঁছচ্ছে কখন?

জেনিকে ডেকে জিজ্ঞেস করছি। রেডিওর উপর ঝুঁকলো নিকোলাস।

রোয়েন আর টিসে পরস্পরের হাত ধরে ফিসফিস শুরু করলো। টিসে বলল, আপনারা, ইংরেজরা সবাই এতো চালু নাকি?

আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি মূলত মিশরীয়। এবং আতঙ্কিতও বটে। সহজ হেসে টিসের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো রোয়েন। আমি তোমাকে মিস করব, হে নারী সূর্য!

হ্যাঁ। আশা করি, এর পরের বার ভালো পরিবেশে দেখা হবে।

তাই কামনা করি।

মাইক্রোফোনে কথা বলছে নিকোলাস, বিগ ডলি, দিস ইজ নিকোলাস। আপনার পজিশন জানান।

ফারাও, আমরা বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাব। আপনারা কী চিনে বাদাম ভাজছেন, নাকি আমি মর্টারের আওয়াজ শুনছি?

 এতো যার রসবোধ, তার মঞ্চে থাকা উচিত ছিল, বলল নিকোলাস। শত্ররা এয়ারস্ট্রিপের দক্ষিণ প্রান্ত দখল করে নিয়েছে। আপনাকে উত্তর দিক থেকে আসতে হবে। বাতাস বইছে পশ্চিম দিক থেকে, গতি পাঁচ নট।

ধন্যবাদ, স্যার। প্যাসেঞ্জার আর কার্গো সম্পর্কে বলুন।

প্যাসেঞ্জার ছয় আর তিন নয়জন। ক্রেটের সংখ্যা বাহান্ন, প্রায় দেড় টন ওজন।

এতো কম লোক আর কার্গোর জন্য আসতে বলেছেন আমাকে? জেনি হেসে উঠলো।

বিগ ডলি, সাবধান। এলাকায় আরেকটা এয়ারক্রাফট আছে। জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। সবুজ আর লাল। মতিগতি সুবিধের নয়, তবে আন আর্মড।

রজার, ফারাও। শেষ একবার যোগাযোগ করব।

রেডিও ছেড়ে আহত গেরিলাদের কাছে চলে এলো নিকোলাস, এখানে রোয়েন আর টিসেও রয়েছে। প্লেন আসতে আর বেশি দেরি নেই, গোলাগুলির আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠলো ওর গলা। শুধু এক কাপ চা খাওয়ার সময় আছে।

বলতে হলো না, নিজেই চা বানাতে বসে গেল ড্যানিয়েল।

হাতে চায়ের কাপ, রোয়েন হঠাৎ বলল, আপনার হারকিউলিস পৌঁছে গেছে, ইঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছি আমি।

পাঁচ মিনিট পর ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, ফারাও, জবাব দিল জেনি।

লম্বা এয়ারস্ট্রিপের দিকে তাকালো নিকোলাস। মেকের গেরিলারা পিছু হটছে এখনো, কাঁটাঝেপের ভেতর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, পিছু হটার সময়ও অনবরত গুলি করছে তারা। কর্নেল নগু খুব জোরে তাড়া করেছে।

তাড়াতাড়ি, জেনি, তাড়াতাড়ি, বিড়বিড় করছে নিকোলাস। তবে রোয়েন আর টিসের দিকে ফেরার আগে চেহারায় হাসি ফুটিয়ে তুললাম। কাপে আস্তে ধীরে চুমুক দিন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই।

গোলাগুলির চেয়ে প্লেনের আওয়াজ বেড়ে গেছে। তারপর হঠাৎ ওটাকে দেখা গেল। এতো নিচু দিয়ে আসছে, মনে হলো কাঁটাগাছগুলোয় ঘষা খাবে। দুই ডানা এতো বড়, আগাছায় চাপা পড়ে সরু হয়ে থাকা এয়ারস্ট্রিপের দুই প্রান্ত ছুঁই ছুঁই করছে। জমিন স্পর্শ করলো প্লেন, ধুলোর মেঘ পাক খেতে শুরু করলো পেছনে, ইঞ্জিন রিভার্স করে দিল পাইলট।

ঝোঁপগুলোকে পাম কাটিয়ে এগুলো হারকিউলিস, ককপিট থেকে ওদেরকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো জেনি। স্পীড যথেষ্ট কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফুটব্রেক আর রাডার বার-এর উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। ঘুরে যাচ্ছে প্লেন, স্ট্রিপ ধরে ফিরে আসছে ওদের দিকে, কাছাকাছি আসার আগেই লোডিং র‍্যাম্প খুলে গেল।

খোলা হ্যাঁচওয়েতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্রেড, জেনি বাদেনহোর্সটের ছেলে। লাফ দিয়ে নিচে নামলো সে, আহত লোকগুলোকে স্ট্রেচারে তুলতে সাহায্য করলো নিকোলাস আর ড্যানিয়েলকে। র‍্যাম্প বেয়ে ওদেরকে তুলতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগলো। তার পরই শুরু হয়ে গেল অ্যামুনিশন ক্রেট লোড করার কাজ। ওদের সঙ্গে রোয়েনও হাত লাগালো কাজে, হালকা ক্রেটগুলো একাই বয়ে নিয়ে এলো। একটা ক্রেটও ফেলে যেতে রাজি নয় ও।

দাঁড়ানো হারকিউলিসের দেড়শো গজ দূরে বিস্ফোরিত হলো একটা মর্টার। দ্বিতীয় শেলটা পড়লো মাত্র একশো গজ দূরে।

ক্রেট কাঁধে ছুটছে নিকোলাস, চিৎকার করে বলল, রেঞ্জিং শট!

ওরা আমাদেরকে সাইটে পেয়ে গেছে, ফ্রেডও চেঁচাচ্ছে। এক্ষুনি কেটে পড়তে হয়। বাকি কার্গো তোলার সময় নেই। লেটস গো! গো….গো…গো….!

আর মাত্র চারটে ক্রেট ঝোঁপের ভেতর পড়ে রয়েছে। ফ্রেডের তাগাদায় কান না দিয়ে ড্যানিয়েল আর নিকোলাস র‍্যাম্প বেয়ে ছুটলো। ঝোঁপের ভেতর ঢুকে দুটো করে বাক্স মাথায় তুললাম ওরা, ছুটে ফিরে আসছে আবার। র‍্যাম্প ইতোমধ্যে উঠতে শুরু করেছে, প্লেলে ইঞ্জিন গর্জে উঠলো, গড়াতে শুরু করেছে চাকা। টেইলবোর্ডের উপর দিয়ে ক্রেইগুলো ছুঁড়ে দিল ওরা, তারপর লাফিয়ে ধরে ফেললো দরজার কিনারা। প্লেনের ভেতর ঢুকে ড্যানিয়েলকে টেনে নিল নিকোলাস।

আবার যখন পেছনে তাকালো ও, ঝোঁপের পাশে নিঃসঙ্গ আর একা লাগলো টিসেকে। মেককে আমার ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানাবেন! চিৎকার করে বলল ও।

টিসেও চিৎকার করলো, আমাদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে আপনি জানেন।

গুডবাই, টিসে, রোয়েনের চিৎকার ইঞ্জিনের গর্জনে চাপা পড়ে গেল, ধুলোর সচল মেঘে ঢাকাও পড়ে গেল টিসে। হিসহিস শব্দ তুলে পুরোপুরি উঠে এলো র‍্যাম্প।

রোয়েনের কাঁধে হাত রেখে বিশাল গুহার মতো কার্গো হোল্ড হয়ে ককপিটের কাছাকাছি একটা জাম্প সিটের পাশে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস। রোয়েনকে সিটে বসিয়ে দিয়ে বলল, স্ট্র্যাপ বাধুন। তারপর ছুটলো ককপিটের দিকে।

ভাব দেখে মনে হচ্ছিল আপনি বোধহয় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হেসে উঠে নিকোলাসকে বলল জেনি, কন্ট্রোল থেকে চোখ না তুলেই। শক্ত হোন! আকাশে ডানা মেলছি!

পাইলটের সিটের পেছনটা আঁকড়ে ধরল নিকোলাস, জেনি আর ফ্রেড কন্ট্রোল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। থ্রটল লিভার ঠেলে দিয়ে ফুল পাওয়ার দিল ওরা, প্লেনের গতি ক্রমশ বাড়ছে।

জেনি বাদেনহোর্সটের কাঁধের উপর দিয়ে সামনে তাকালো নিকোলাস, রানওয়ের শেষ মাথায় ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর ক্রামোফ্লেজ ড্রেস পরা অস্পষ্ট ছায়া। ছায়া আকৃতি দেখা যাচ্ছে। ওদিকেই ছুটছে প্লেন, ঝোঁপের ভেতর থেকে সৈনিকরা গুলি করছে এদিকে।

এসব ক্ষুদে বুলেটে আমার হারকিউলিসের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না, জেনি বলল। হারকিউলিস খুব শক্ত বুড়ি। তারপর প্লেনটাকে আকাশে তুলে ফেললো সে।

জমিনে ছড়িয়ে থাকা সরকারি সৈন্যদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে এলো প্লেন, আকাশের দিকে নাক উঁচু করে আরো ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড, ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড। বাপ-বেটা, জেনি ও ফ্রেডের উপর ভরসা রাখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তারপর মাত্র পাঁচ সেকেন্ড পর বেলুনের মতো চুপসে গেল জেনি, প্রায় কাতরে উঠে, বলল, ওই ফড়িং আবার কোত্থেকে এলো?

নীলনদের পাড় ঘেঁষা ঝোঁপ থেকে সরাসরি প্লেনের সামনে আকাশে উঠে আসছে পেগাসাস কোম্পানির জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। এমন তির্যক একটা কোণ ধরে ওপরে উঠছে ওটা, বোঝাই যায় যে দ্রুতগতি হারকিউলিস এখনো পাইলটের দৃষ্টি পথের বাইরে রয়েছে, তা না হলে প্লেনের পথ থেকে সরে যাবার চেষ্টা করত।

মাত্র পাঁচশো ফুট ওপরে উঠেছি আমরা, স্পীঢ় একশো দশ নট, ডান দিকের সিট থেকে চিৎকার করে বাপকে সাবধান করলো ফ্রেড। এই অবস্থায় দিক বদল সম্ভব নয়।

জেট রেঞ্জার এতো কাছে যে ফ্রন্ট সীটে বসা কর্নেল নগুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তার চশমায় লেগে প্রতিফলিত হচ্ছে রোদ। পাইলটের আগে সেই প্রথম হারকিউলিসকে দেখতে পেল। নিকোলাস তার চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠতে দেখলো। সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে কপ্টারটাকে ঘুড়ির মতো গোত্তা খাওয়াতে চেষ্টা করলো পাইলট, বিশাল হারকিউলিসের পথ থেকে সরে যাবার চেষ্টায়। সংঘর্ষ এড়ানো অসম্ভব বলে মনে হলো, তবে দক্ষতার সঙ্গেই কপ্টারটাকে পাক খাওয়াতে শুরু করলো সে, ডিগবাজি খাওয়ানোর ভঙ্গিতে হারকিউলিসের পেটের নিচে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওটা, প্লেনের আরোহীরা অনুভব করলো দুটো আকাশযানের ফিউজিলাজ পরস্পরকে আলতো চুমো খেলো।

ছোঁয়াটুকু যতই সামান্য হোক, কপ্টারের নাক জমিনের দিকে ঘুরে গেল, সেটা মাত্র চারশো ফুট নিচে। হারকিউলিস ফুল স্পীডে ছুটছে, ওপরে উঠছে ক্রমশ, কিন্তু হেলিকপ্টারের পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কপ্টার যখন জমিন থেকে দুশো ফুট ওপরে, হারকিউলিস টার্বোপ্রপ ইঞ্জিনগুলো, প্রতিটি চার হাজার নয়শো হর্সপাওয়ার, বাতাসে তীব্র আলোড়ন তুললাম, সেই আলোড়ন প্রচণ্ড পাথরধসের মতো আঘাত করলে, ওটাকে।

বাতাসে ভেসে থাকা ঝরা পাতার মতো লাগছে এখন। কপ্টারটাকে, ডিগবাজি খাচ্ছে বিরতিহীন। ইঞ্জিন ফুল পাওয়ারে চালু, জমিনের উপর পড়লো সেটা। ফিউজিলাজ অ্যালুমিনিয়াম ফুয়েলের মতো দুমড়ে মুচড়ে গেল, কর্নেল নগু মারা গেল এমন কী ফুলের ট্যাংক বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই। আগুনে বিশাল একটা কুণ্ডলি গ্রাস করলো জেট রেঞ্জারকে।

*

উত্তরের কোর্স ধরে ছুটছে হারকিউলিস। নিচে সুদান। দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেইন কেবিনে ফিরে এলো নিকোলাস।

আহতদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা যাক, ড্যানিয়েলকে বলল ও। স্যাপারের সঙ্গে রোয়েনও সেফটি বেল্ট খুলে হাত লাগালো বলল ও। ড্যানিয়েলের সঙ্গে রোয়েনও সেফটি বেল্ট খুলে হাত লাগালো কাজে। তাড়াহুড়োর মধ্যে স্ট্রেচারগুলো প্লেনের দরজার কাছাকাছি রাখা হয়েছিল, সেগুলো সরিয়ে আরো ভেতর দিকে আনা হলো। জেনি কিছু ওষুধ-পত্র নিয়ে এসেছে, সঙ্গে অল্প কিছু খাবারও, সে সব বিলি-বণ্টন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওরা। খানিক পর রোয়েন আর ড্যানিয়েলকে ওখানে রেখে ফ্লাইট-ডেকের পেছনে, গ্যালিতে চলে এলো নিকোলাস। ফ্রিজ খুলে টিনের কৌটা থেকে সুপ আর তাজা পাউরুটি বের করলো ও, চুলোয় আগেই চায়ের পানি চড়িয়েছে।

চায়ের পানি ফুটছে, নিজের ইমার্জেন্সি প্যাক থেকে একটা নাইলন ওয়ালেট বের করলো নিকোলাস, ভেতরে কিছু ওষুধপত্র আছে। একটা শিশি থেকে পাঁচটা ট্যাবলেট বের করলো, গুড়ো করে ফেলে দিল দুটো মগে। মগ দুটোর চা ঢেলে চিনি আর দুধ মেশালো, ভালো করে নাড়লো চামচ দিয়ে। আরব দেশের মেয়ে, গরম এক মগ চায়ের লোভ সামলতে পারবে না।

আহত গেরিলাদের খাওয়ানো হয়ে গেছে, গ্যালি থেকে ফিরে এসে ড্যানিয়েল আর রোয়েনকে মাখন লাগানো রুটি আর সুপ খেতে দিল নিকোলাস, সঙ্গে মগ ভর্তি চা। ওরা দু জন চা খাচ্ছে, ফ্লাইট ডেকে ফিরে এলো নিকোলাস, হেলাল দিল জেনি বাদেনহোর্সটের সিটের পিঠে। মিশরীয় সীমান্তে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে আপনার? জানতে চাইলো ও।

চার ঘণ্টা বিশ মিনিট, বলল জেনি।

মিশরীয় এয়ার স্পেস এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় আছে? আবার প্রশ্ন করলো নিকোলাস।

সিটে ঘুরে গিয়ে নিকোলাসের দিকে অবাক হয়ে তাকালো জেনি। লিবিয়ার উপর দিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তবে গাদ্দাফির এয়ারফোর্স বিনা নোটিশে গুলি করে ফেলে দিলে কিছু করার নেই। আরো সমস্যা আছে। ওদিকে গেলে সাত ঘণ্টা বেশি। থাকতে হবে আকাশে, ফুয়েলে কুলাবে না-সাহারার কোথাও ফোর্স ল্যান্ডিং করতে হবে। একটা ভুরু কপালে তুললাম সে। কী ব্যাপার, নিকোলাস, এ ধরনের প্রশ্ন করার অর্থ কি?

কোনো অর্থ নেই, হঠাৎ উঁকি দিল মনে, বলল নিকোলাস।

এ ধরনের প্রশ্ন আমাকে ঘাবড়ে দেয়, জোর করে হাসলো জেনি।

তার কাঁধ চাড়ে দিল নিকোলাস। ভুলে যান।

মেইন হোল্ডে ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো দুটো ফোল্ড-ডাউন বাঙ্কে বসে রয়েছে রোয়েন ও মাটিন। রোয়েনের খালি মগটা ওর পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। পাশে বসলো নিকোলাস; একটা হাত তুলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রোয়েন।

ভাগ্য ভালো যে আপনার মাথার ক্ষতটা প্রায় শুকিয়ে গেছে, ফিসফিস করে বলল নিকোলাসকে।

প্রথমে ঘুমিয়ে পড়লো ড্যানিয়েল। শুয়ে পড়লো সে, চোখ বুজল, খানিক পরই নাক ডাকতে শুরু করলো। কয়েক মিনিট পর নিকোলাসের গায়ে ঢলে পড়লো রোয়েন, সাবধানে ওর পা দুটো বাঙ্কের উপর তুলে ভালো করে শুইয়ে দিল নিকোলাস, একটা চাদর গলা পর্যন্ত টেনে দিল। তারপর ঝুঁকে আলতো একটা চুমো খেলো রোয়েনের কপালে। যাই তুমি করে থাকো, তোমাকে কীভাবে আমি ঘৃণা করতে পারি!

ল্যাবেটোরিতে ঢুকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল নিকোলাস। হাতে প্রচুর সময় আছে। অন্তত তিন-চার ঘণ্টার আগে রোয়েন আর ড্যানিয়েলের ঘুম ভাঙবে না। আর জেনি ও ফ্রেডকে ককপিটে ব্যস্ত থাকতে হবে সারাক্ষণ, প্লেনের কোথায় কী ঘটছে জানার সুযোগ হবে না ওদের।

কাজটা শেষ হতে হাতঘড়ি দেখলো নিকোলাস। দু ঘণ্টা লেগেছে। টয়লেট সিট বন্ধ করে হাত ধুলো ও। ক্ষুদে কেবিনে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দরজার তালা খুলল।

ফোল্ড ডাউন বাঙ্কে এখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে রোয়েন আর ড্যানিয়েল। মেইন হোল্ড থেকে আবার ফ্লাইট ডেকে চলে এলো নিকোলাস। কান থেকে এয়ারফোন খুলে ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো ফ্রেড। সামনে নীলনদ। এতো সময় ধরে টয়লেটে ছিলেন, আমি তো ভাবলাম আপনার কিছু অবশিষ্ট থাকে কি না!

তার বাপের সিটের উপর ঝুঁকে নিকোলাস জানতে চাইলো, ঠিক কোথায় রয়েছি আমরা?

উরুর ওর মেলা চার্টটায় মোটা তর্জনী রাখলো জেনি। এখানে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে মিশরীয় সীমান্তে পৌঁছে যাব।

জবাব না দিয়ে রেডিও সেট অন করলো জেনি। এবারে আমার কাজ দেখাবার পালা।

মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মাউথপিসে কথা বলছে, হ্যালো, আবু সিমবেল দিস ইজ জুলু হুইস্কি ইউনিফর্ম ফাইভ জিরো জিরো।

তৃতীয়বার ডাকার পর আবু সিমবেল কন্ট্রোল সাড়া দিল। রুটিন অনুসারে নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলো জেনি। পাঁচ মিনিট পর আবু সিমবেল কন্ট্রোল টাওয়ার উত্তরে গতি বজায় রাখার অনুমতি দিল তাকে।

আরো এক ঘণ্টা নির্বিঘ্নে উড়লো ওরা, তবে প্রতি মিনিটে স্নায়ুর উপর চাপ আরো বাড়ছে নিকোলাসের।

অকস্মাৎ, কোনো রকম আভাস না দিয়ে, একটা ফাইটার ইন্টারসেপটরের রূপালি ঝলক দেখা গেল সরাসরি সামনে। ওদের নিচ থেকে উঠে এলো সেটা, হারকিউলিসের বো-র সামনে। ওদের নিচ থেকে উঠে এলো সেটা, হারকিউলিসের বো-র সামনে। রাগে ও বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো জেনি, পর মুহূর্তে দেখলো রকেট বেগে আরো দুটো ফাইটার ওদের প্লেনের নিচ থেকে উঠে আসছে, এতো কাছে মনে হলো যে কোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ ঘটতে পারে।

সবাই ওরা ফাইটার প্লেনগুলোর টাইপ চিনতে পারল। মিগ টোয়েনটি ওয়ান, মিশরীয় এয়ারফোর্সের মুল শক্তি। ডানার নিচে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এয়ার-টু এয়ার মিসাইল, পড় থেকে ঝলছে। আনআইডেনটিফায়েড এয়ারক্রাফট! মাউথপিসে চিৎকার করছে জেনি। স্টেট ইওর কল সাইন!

ইতোমধ্যে দুটো ফাইটার হারকিউলিসের দু পাশে চলে এসেছে, অপরটা উঠে এসেছে ওদের মাথার উপর আকাশে।

জবাব এলো, জেড-ডব্লিউ-ইউ ফাইভ হানড্রেড, মিশরীয় বিমান বাহিনীর রেড লিডার। ইউ উইল কনফার্ম টু মাই অর্ডারস।

ঘাড় ফিরিয়ে নিকির দিকে তাকালো জেনি। কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। কী ব্যাপার?

ঠিক কী ঘটছে আমিও বুঝতে পারছি না।

রেড লীডার যা বলছে শোনো, ড্যাড, বাপকে পরামর্শ দিল ফ্রেড। তা না হলে মিসাইল ছুঁড়ে উড়িয়ে দেবে আমাদের।

অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো জেনি, তারপর মাইক্রোফোনে বলল, দিস ইজ জেডডব্লিউইউ ফাইভহানড্রেড। আমরা সহযোগিতা করব। প্লিজ আপনাদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করুন।

আপনার নতুন হেডিং জিরো ফাইভ থ্রী। নির্দেশ এখুনি পালন করুন।

প্লেনটাকে পুব দিকে ঘুরিয়ে নিল জেনি, তারপর চার্টের দিকে তাকালো। আসওয়ান! সবিস্ময়ে বলল। ওরা আমাদেরকে আসওয়ানে পাঠাচ্ছে! তাহলে তো এখুনি আসওয়ানকে জানাতে হয় যে আমাদের সঙ্গে আহত লোকজন আছে।

মেইন হোল্ডে ফিরে এসে রোয়েনের ঘুম ভাঙালো নিকোলাস, লক্ষ্য করলো ল্যাভেটোরির দিকে যাবার সময় সামান্য একটু টলছে। তবে দশ মিনিট পর যখন ফিরে এলো, পুরোপুরি তাজা ও সচেতন দেখালো ওকে, মুখ ধুয়ে চুল আঁচড়েছে।

*

ওদের সামনে এখন আবার নীলনদকে দেখা যাচ্ছে, দুই পাড়েই ছড়িয়ে পড়েছে আসওান শহর। আসওয়ানের কন্ট্রোল টাওয়ার নির্দেশ দিতে ল্যান্ড করার জন্য রানওয়ে বরাবর সোজা হলো হারকিউলিস। মরুভূমি থেকে ওদেরকে পথ দেখিয়ে এদিকে এনেছে মিশরীয় এয়ারফোর্সের ফাইটারগুলো, এখন আর ওগুলোকে দেখা যাচ্ছে না, তবে টাওয়ারের সঙ্গে তাদের রেড লীডারের কথাবার্তা শোনা গেল। বন্দি হারকিউলিসকে আসওয়ান টাওয়ারের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে তিন ফাইটারের বহরটা।

পেরিমিটার বেড়া পেরিয়ে এসেরানওয়েতে ল্যান্ড করলো হারকিউলিস। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে নির্দেশ এলো, ডান দিকে ঘুরে যান। মেইন রানওয়ে থেকে বাঁক ঘুরতেই সামনে ছোট একটা ভেহিকেল দেখা গেল, ছাদের সাইনবোর্ডে লেখা, ইংরেজি ও আরবিতে, আমাকে অনুসরণ করুন।

ভেহিকেলটা ওদেরকে পথ দেখিয়ে একটা হ্যাঁঙ্গারের সামনে নিয়ে এলো। প্লেন স্থির হতেই হ্যাঁঙ্গারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো পাঁচটনী পাঁচটা ট্রাক, দ্রুত এগিয়ে এসে ঘিরে ফেললো হারকিউলিসকে সাদা কাপড় পরা সশস্ত্র কিছু লোক লাফ দিয়ে নিচে না এলো, হাতের অটোমেটিক রাইফেল প্লেনের দিকে তাক করা।

টাওয়ারের নির্দেশ পেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করলো জেনি। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না, বলে নিকোলাসের দিকে তাকালো সে। আপনি পারছেন, নিকি?

কথা না বলে মাথা নাড়লো নিকোলাস, খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে আবার নির্দেশ এলো। টেইল র‍্যাম্প নামাতে বলছে।

ককপিটে ওরা কেউ কথা বলছে না, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, চেহারায় বিস্ময় ও উদ্বেগ।

হঠাৎ পেরিমিটার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সাদা একটা ক্যাডিলাক, সরাসরি ছুটে এসে হারকিউলিসের কার্গো র‍্যাম্পের সামনে ব্রেক কষল। লাফ দিয়ে নিচে নেমে দরজা খুলল শোফার, শেষ বিকেলে রোদে বেরিয়ে এলেন বিশাল বপু আরোহী। চেহারায় বলে দেয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিজাত মানুষ, ধীর-স্থির ও দৃঢ়চেতা। হালকা রঙের ট্রপিক্যাল স্যুট পরে আছেন, জুতো জোড়া সাদা, মাথায় পানামা হা, চোখে গাঢ় চশমা। র‍্যাম্প বেয়ে প্লেনে চড়ছেন তিনি, সঙ্গে দু জন পুরুষ সেক্রেটারি।

প্লেনের ভেতর ওরা পাঁচজন অপেক্ষা করছে।

কর্তা ব্যক্তি চোখ থেকে গাঢ় চশমা খুলে ব্রেস্ট পকেটে খুঁজলেন। রোয়েনকে চিনতে পেরে হ্যাট মাথা থেকে খুলে হাসলেন। ডক্টর আল সিমা–রোয়েন! আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন! কংগ্রাচুলেশন্স। রোয়েনের হাতটা ধরে ঝাঁকালেন, নিকোলাসের দিকে তাকাবার সময়ও সেটা ছাড়লেন না।

আপনি নিশ্চয়ই স্যার নিকোলাস কুয়েটন-হারপার। সত্যি কথা বলতে কি, আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। ডক্টর রোয়েন, আপনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন না?

কথা বলার সময় নিকোলাসের সরু চোখের দিকে তাকাতে পারলো না রোয়েন, উনি আমাদের মাননীয় সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী আতালান আবু সিন।

সত্যি কথা বলতে কী, নিকোলাসের গলায় ক্ষীণ ব্যঙ্গ, আমিও আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে অপ্রত্যাশিত উল্লাস অনুভব করছি, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়।

আমাদের প্রাচীন ও গৌরবময় অতীত ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া বিপুল প্রত্ন সম্পদ মিশরে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার ও মিশরীয় জনগণের তরফ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার নিকোলাস। সাজিয়ে রাখা অ্যামুনিশন ক্রেটগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালেন মন্ত্রী আতালান আবু সিন।

প্লিজ, এটাকে খুব বড় করে দেখবেন না, বলল নিকোলাস, তবে রোয়েনের উপর থেকে পলকের জন্যও সরাতে পারছে না। যদিও রোয়েন ওর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না।

কী যে বলেন, স্যার, মন্ত্রী অমায়িক হাসি হাসলেন।এই অভিযানে আপনার অনেক টাকা খরচ হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। কাজেই আমরা চাই না আপনি খালি পকেটে ফিরে যান। ড. রোয়েন আমাকে জানিয়েছেন, আপনার পকেট প্রায় আড়াই লাখ স্টার্লিং বেরিয়ে গেছে। কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করলেন তিনি, বাড়িয়ে দিলেন নিকোলাসের দিকে।

এতে মিশরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা চেক আছে, দু লাখ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের। চেকটা নিয়ে আপনি আমাদেরকে ঋণমুক্ত করুন, স্যার নিকোলাস, প্লিজ।

আপনি সত্যি খুব উদার মানুষ, মিনিস্টার, এনভেলাপটা পকেটে ভরার সময় বলল নিকোলাস, ভাব দেখে মনে হলো হাসি চেপে রেখেছে। এটাও বোধহয় ড. আল সিমার পরামর্শ?

অবশ্যই, সহাস্যে বললেন। আপনার সম্পর্কে ড. রোয়েনের খুব উঁচু ধারণা…

তাই কী? বিড়বিড় করলো নিকোলাস, এখনো রোয়েনের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

মন্ত্রীর হাতের ইশারায় একজন সেক্রেটারি এগিয়ে আসে। হাতের ট্রেতে লাল ভেলভেট কাপড়ের উপর শুয়ে আছে একটা রাজকীয় তারা–মাঝখানে সিংহের ছবি।

তারাটা হাতে তুলে নিকোলাসের দিকে এগুলেন আবু সিন। মিশরের সাহসী সিংহ, প্রথম ক্লাস মর্যাদা বলে নিকোলাসের গলায় লাল ফিতে জড়ানো মেডালটা পরিয়ে দিলেন। ওর নীলে কাদা-মাটি চৰ্চিত শার্টে ঝুলে রইলো ওটা।

আহত লোকজনকে একটা ট্রাকে তোলা যেতে পারে। পেছন ফিরে কাকে যেনো ইঙ্গিত দিলেন তিনি, প্লেনের ভেতর সশস্ত্র লোকজন ঢুকে পড়লো। তাদের মধ্যে পাঁচজন লোক পাহারায় থাকলো, বাকি দশ-বারোজন হাত লাগালো . ক্রেটগুলো নামানোর কাজে।

দশ মিনিটের মধ্যে খালি হয়ে গেল বিগ ডলি। বাহান্নটা ক্রেট চারটে চাচ চনী ট্রাকে তোলা হলো, ট্রাকগুলো ঢেকে দেওয়া হলো তারপুলিন দিয়ে। সময় নষ্ট না করে কনভয়টা রওনা হয়ে গেল তখুনি। বাকি একটা ট্রাকে আহত গেরিলাদের তোলা হয়েছে, তবে এখনো সেটা দাঁড়িয়ে আছে।

বিদায়, স্যার নিকোলাস, মিটিমিটি হেসে নিকোলাসের দিকে ডান হাতটা বাড়ালেন। আবু সিমবেল থেকে এদিকে সরিয়ে আনার জন্য সত্যি দুঃখিত। তবে কী জানেন, সব ভালো যার শেষ ভালো। আমি জানি, নিজের পথে রওনা হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন আপনি। কাজেই আপনাকে আর আটকে রাখব না। বিদায়ের আগে আপনার জন্য আর কিছু করতে পারি আমি? আপনাদের সঙ্গে যথেষ্ট ফুয়েল আছে তো?

জেনি বাদেনহোর্সটের দিকে তাকালো নিকোলাস, জেনি তিক্ত সুরে বলল, আছে।

নিকোলাসের দিকে ফিরে আতালান আবু সিন বললেন, লুক্সরের যাদুঘরে আপনার উদ্ধার করে আনা ফারাও মামোসের ট্রেজার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছি আমরা। খুব শীঘ্রই আমাদের প্রেসিডেন্ট মুবারক আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে। ডক্টর আল সিমা যে আমাদের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যান্টিকুইটিজ এর ডিরেক্টর হয়েছেন–এতো আশা করি আপনি জানেন। নতুন মিউজিয়ামের দায়িত্বে তিনিই থাকবেন। নিশ্চই আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন উনি।

ড্যানি স্যাপার আর দু জন পাইলটকে মাতা নুইয়ে সম্মান দেখালেন মন্ত্রী।

আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন, বলে র‍্যাম্প বেয়ে নামতে শুরু করলেন।

রোয়েন তাকে অনুসরণ করতে যাবে, পেছন থেকে নরম সুরে ডাক দিল নিকোলাস, রোয়েন।

পাথর হয়ে গেল রোয়েন। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধীরে ধীরে নিকোলাসের দিকে ঘুরলো, ওরা ল্যান্ড করার পর এ প্রথম ওর চোখের দিকে তাকালো।

এ আমার পাওনা ছিল না, বলল নিকোলাস, আর তারপরই আবেগের একটা ধাক্কা খেয়ে উপলব্ধি করলো নিঃশব্দে কাঁদছে রোয়েন। ওর ঠোঁট জোড়া, কাঁপছে, চোখের পানি গড়াচ্ছে গাল বেয়ে।

আমি দুঃখিত, নিকি ফিসফিস করে বলল রোয়েন। কিন্তু আপনার জানার কথা যে আমি চোর নই। মামোসের গুপ্তধন মিশরের প্রাপ্য, আমাদের নয়।

তাহলে আমাদের মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল, সেটা মিথ্যে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

না! বলল রোয়েন। আমি… ভাষা হারিয়ে ফেলে থরথর করে কেঁপে উঠলো রোয়েন, ঝট করে ঘুরে এস্তা হরিণীর মতো ছুটে নেমে গেল র‍্যাম্প বেয়ে। ওখানে, রোদের মধ্যে, ক্যাডিলাকের দরজা খুলে অপেক্ষা করছে শোফার। মন্ত্রী আগেই গাড়িতে উঠে পড়েছেন। বাকি ট্রাকটায়ও সশস্ত্র লোকগুলো উঠে পড়ছে।

এই ব্যাটা মিশরীয়রা এ পাল্টে ফেলার আগেই, চলুন ভাগি এখান থেকে! জেনি বলল।

দারুণ আইডিয়া, তিক্ত স্বরে বলল নিকোলাস।

*

আবার আকাশে ওঠার পর মেডিটারেনিয়ান কোর্স ধরে সেই উত্তর দিকেই রওনা হলো হারকিউলিস। নিকোলাস, ড্যানিয়েল, জেনি আর ফ্রেড-চারজনই ককপিটে রয়েছে। দীর্ঘ সবুজ সাপের মতো নীলনদ ওদের পাশাপাশি এঁকেবেঁকে পেছন দিকে ছুটছে।

দীর্ঘ যাত্রা পথে খুব কম কথা বলছে ওরা। তিক্ত প্রসঙ্গটা একবার শুধু জেনি তুললাম। এ যাত্রা ফি ছাড়াই কাজ করতে হলো, কী বলেন?

আমি ঠিক টাকার লোভে আসিনি, মন্ত্রব্য করলো ড্যানিয়েল। তবে পারিশ্রমিক পেলে ভালো লাগত। বাচ্চাকাচ্চাদের নতুন জুতো দরকার।

কেউ চা খাবে নাকি? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, ওদের কথা যেনো শুনতে পায় নি।

মন্দ হয় না, বলল জেনি। আপনি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন পাওনা ষাট হাজার ডলার এক কাপ চা খাইয়ে পরিশোধ করবেন, আমার বলার কিছু নেই।

গ্যালিতে চলে এলো নিকোলাস, সবার জন্য চা বানালো। ককপিটে ফিরে এসে পরিবেশনও করলো নিজ হাতে। সবাই আশা করছে কিছু না কিছু বলবে ও। কিন্তু মিশরীয় সীমান্ত পার না হওয়া পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে রাখলো নিকোলাস

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ খুলল, ঋণশোধ করি নি, এমন রেকর্ড কি আমার আছে? নেই। যার যা পাপ্য সবাই তা পাবে, বোনাসসহ।

সবাই ওরা কঠিন দৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নিকোলাসের দিকে। সবার মনের সন্দেহ প্রকাশ পেল জেনি বাদেনহোর্সটের একটা মাত্র শব্দে। কীভাবে?

আমাকে একটু সাহায্য করো, স্যাপার, বলল নিকোলাস, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে কন্ট্রোল ফ্রেডের হতে দিয়ে ওদেরকে অনুসরণ করলো জেনি। মেইন ডেকে বেরিয়ে এসে ল্যাভেটোরতে ঢুকলো ওরা। জেনি আর স্যাপার দোরগোড়া থেকে দেখছে, পকেট থেকে একটা টুল বের করে কেমিকেল টয়লেটের ঢাকনি খুলে ফেললো নিকোলাস। স্কুগুলো খুলছে নিকোলাস, পেছনে নিঃশব্দে হাসছে জেনি। স্কুগুলো গোপন প্যানেলটাকে জায়গা মতো বসিয়ে রেখেছে। হারকিইলস স্মাগলারদের প্লেন, কাজেই করিগরি ফলিয়ে ভেতর দিতে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। জেনি আলফ্রেড শুধু পরিশ্রম করে নি, বাপ-বেটাকে অনেক মাথা খাঁটিয়ে পরিবর্তনগুলো গোপন রাখারও ব্যবস্তা করতে হয়েছে। এ রকম গোপন হোল্ড শুধু ল্যাভেটোরিতেই নয়, ইঞ্জিন হাইজিং আর ফিউজিলাজের অন্যান্য অংশেও আছে।

প্যানেল খোলা হতে ভেতরে হাত গলিয়ে একটা জিনিস বের করলো নিকোলাস। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠলো জেনি। গড! কি ওটা?

প্রাচীন মিশরের নীল যুদ্ধ মুকুট, বলল নিকোলাস। মুকুটটা ড্যানিয়েলের হাতে তুলে দিল ও। বাঙ্কের উপর রাখো, তবে খুব সাবধানে।

কমপার্টমেন্টের ভেতর আবার হাত গলালো নিকোলাস, আরেকটা, মুকুট বের করে আনলো। আর এটা হলো নেমেস ক্রাউন। জেনি বাদেনহোর্সটের হাতে ধরিয়ে দিল।

আর এটা কী? এটা হলো একত্রিত দুই রাজ্যের লার আর সাদা ক্রাউন। আর এটা? ফারাও মামোসের ডেথ-মাস্ক। এটা? এটাই কিন্তু শেষ নয়-লিপিকা টাইটার উশব তি।

কিন্তু, হতভম্ব দেখাচ্ছে ড্যানিয়েলকে, মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক, আসওয়ানে ওরা যে ক্রেটগুলো নামিয়ে নিয়ে গেল, ড. রোয়েন গোনেন নি?

গুনেছেন কিনা জানি না, বলল নিকোলাস। তবে গুনলেও বাহান্নটা ক্রেট হত।

তাহলে তো অন্তত তিনটে লম্বা ক্রেট হালকা হয়ে গেছে, মাথায় করে নিয়ে যাবার সময় টের পায় নি ওরা যে ওগুলো খালি?

টয়লেটের জন্য এক গ্যালনের প্রচুর কেমিকেল বোতল ছিল এখানে, আরো ছিল বিশ-পঁচিশটা স্পেয়ার অক্সিজেন সিলিন্ডার, বলল নিকোলাস। ওজন ঠিক রাখার জন্য ওগুলো ক্রেটে ভরে দিয়েছি।

ড্যানিয়েলের হাসি দেখে কে! তবে তার প্রশ্ন শেষ হয় নি এখনো। আপনি জানলেন কীভাবে ড. রোয়েন আমাদেরকে ধোঁকা দেবেন?

আমার জানা উচিত যে ও চোর নয়, ওর ওই কথাটা মিথ্যে ছিল না। রোয়েন সত্যি সৎ একটা মেয়ে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত, সর্ব অর্থে। আমি বলতে চাইছি, আমাদের ঠিক বিপরীত চরিত্র।

খোঁচা মেরে বলা হলেও প্রশংসা করার জন্য ধন্যবাদ, মি. নিকোলাস, শুকনো গলায় বলল জেনি। কিন্তু আপনাকে সন্দিহান করে তোলার জন্য নিশ্চয়ই আরো কারণ ছিল।

হ্যাঁ, অবশ্যই ছিল, তার দিকে ঘুরলো নিকোলাস। প্রথম সন্দেহ জাগে আমরা যখন ইথিওপিয়া থেকে ফিরে আসি, এসেই মিশনে যাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন রোয়েন। বুঝতে পারি কিছু একটা করছেন। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হই রোয়েন যখন টিসের মাধ্যমে আদিসের মিশরীয় দূতাবাসে একটা মেসেজ পাঠালেন। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমাদের রিটার্ন ফ্লাইট সম্পর্কে মিশরের কাউকে সতর্ক করে দিয়েছেন উনি।

আরে, একটা জঘন্য মেয়ে!

সাবধান! হুঙ্কার দিয়ে উঠলো নিকোলাস। সে অত্যন্ত সভ্রান্ত একজন মেয়ে। সৎ, দেশপ্রেমিক, তরুণী। মনের মধ্যে তার এতোটুকু কলুষতা নেই

আচ্ছা, আচ্ছা! ড্যানি স্যাপারকে চোখ মারলো জেনি। ভুল হয়েছে। মাপ চাই!

*

প্রাচীন মিশরের মাত্র দুটো মুকুট রাখা হয়েছে পালিশ করা ওয়ালনাট কনফারেন্স টেবিলে। কনফারেন্স রুমটা জুরিখের একটা ফাইভ স্টার হোটেলের দশতলায়। সবগুলো জানালোর পর্দা টেনে দিয়েছে নিকোলাস, সিলিঙে লুকানো উৎস থেকে আলো পড়ছে মুকুট জোড়ার উপর। হোটেলটার একটা স্যুইট ভাড়া নিয়েছে নিকোলাস, সেই সঙ্গে প্রাইভেট কনফারেন্স রুমটাও।

আমন্ত্রীত অতিথির জন্য একা অপেক্ষা করার সময় চারদিকে তাকিয়ে প্রস্তুতিতে কোনো খুঁত আছে কিনা দেখে নিল নিকোলাস, তারপর আয়নার সামনে হেঁটে এসে স্যান্ডহার্সট টাইয়ের নটটা অ্যাডজাস্ট করলো। চিবুকের কাটাটা শুকিয়ে গেছে। ওর পরনের ডোরাকাটা স্যুটটা সেভাইল রো থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করা।

কোমল শব্দে ইন্টারকম বেজে উঠলো। হ্যান্ডসেট তুললাম নিকোলাস।

পিটার ওয়ালশ, আপনার অতিথি, নিচের লবিতে পৌঁছেছেন, স্যার নিকোলাস।

প্লিজ, ভদ্রলোককে ওপরে পাঠিয়ে দিন, বলল নিকোলাস।

কলিংবেল বাজতেই কনফারেন্স রুমের দরজা খুলে দিল ও। দরজার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন পিটার ওয়ালশ। স্যার নিকোলাস, বললেন তিনি, আশা করি আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন না। আপনার মেসেজ পেয়ে ব্যক্তিগত প্লেন নিয়ে সেই ফোর্ট ও অর্থ থেকে ছুটে আসতে হয়েছে আমাকে। নিকোলাস তাঁকে টেলিফোন করেছিল ত্রিশ ঘন্টা আগে। এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবার অর্থ হলো, ফোন পেয়েই প্লেনে চড়ে বসেন ভদ্রলোক।

ভেতরে আসুন, মি, ওয়ালশ, সহাস্যে বলল নিকোলাস। বলুন কী খাবেন।

এসব প্যাচাল বাদ দিন তো, ভেতরে ঢুকে বললেন ওয়ালশ। আগে বলুন কী দেখাতে চান। তাঁর পিছু দিয়ে আরো দুই জ্বলোক ভেতরে ঢুকলেন, দু জনকেই চেনে নিকোলাস।

দরজা বন্ধ করে কনফারেন্স টেবিলের দিকে তাকালো নিকোলাস। আসুন আমার সঙ্গে।

ধনকুবের পিটার ওয়ালশের বয়স সত্তর হলেও, দেখে মনে হয় পঞ্চাশ। পাকানো, তেল চকচকে খুঁটির মতো কাঠামো। ফর্বস ম্যাগাজিন-এর ধনকুবেরদের তালিকায় সাত নম্বরে আছেন তিনি, বলা হয়েছে এক দশমিক সাত বিলিয়ন নগদ মার্কিন ডলারের মালিক ভদ্রলোক।

অ্যান্টিকুয়ারিয়ান জগত্তা খুব ছোটই বলতে হবে, এ জগতে অল্প কিছু লোক চলাফেরা করেন, কাজেই তাদের প্রায় সবাইকেই চেনে নিকোলাস। ওয়ালশের একজন সঙ্গী ডালাস ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, প্রাচীন ইতিহাস পড়ান। ওই ভার্সিটিতে নিয়মিত চাঁদা দেন ওয়ালশ। অপর ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে নাম করা ও শ্রদ্ধেয় আন্টিকস ডিলার।

ওয়ালশ অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন, ফলে পেছনের ওঁরা দু জন তার সঙ্গে ধাক্কা খেলেন, যদিও ওয়ালশ তা খেয়ালই করলেন না।

এ আমি কী দেখছি? বিড়বিড় করলেন তিনি, তারপর নিকোলাসের দিকে চট করে একবার তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললেন, এগুলো কি নকল?

প্রথমে কিছু না বলে হাসলো নিকোলাস। তারপর বলল, পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

কনফারেন্স টেবিলের দিকে পা টিপে টিপে এগুলেন ওয়ালশ, যেনো ভয় পাচ্ছেন দ্রুত হাঁটলে চোখের সামনে থেকে মুকুট দুটো গায়েব হয়ে যাবে। এগুলো একদম নতুন, ফিসফিস করলেন তিনি। তা না হলে অন্তত অস্তিত্ব সম্পর্কে খবর পেতাম।

বলতে পারেন সদ্য মাটির নিচে থেকে তোলা হয়েছে, বলল নিকোলাস। আপনিই প্রথম দেখছেন।

মামোস! নেমেস মুকুটের খোদাই করা লিপির উপর চোখ বুলালেন ওয়ালশ। গুজবটা তাহলে মিথ্যে নয়! আপনি নতুন একটা সমাধি খুলেছেন।

প্রায় চার হাজার বছরে পুরানো একটা সমাধিকে আপনি যদি নতুন বলেন, আমার আপত্তি নেই।

ওয়ালশ আর তাঁর উপদেষ্টারা টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়ালেন। কারো মুখে কথা নেই, সবার চোখ চকচক করছে।

শুধু আমরা নিজেরা এখানে থাকব। কিছুক্ষণ, বললেন ওয়ালশ, নিকোলাসকে সরে যেতে বলছেন। কথা বলার সময় হলে আপনাকে ডাকব আমি। প্লিজ!

এক ঘণ্টা পর আবার কনফারেন্স রুমে ফিরে এলো নিকোলাস। তিন ভদ্রলোক টেবিলের তিন দিকে এমন ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেনো মুকুট দুটোর অবিচ্ছেদ্য অংশ পরিণত হয়েছেন তাঁরা। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন ওয়ালশ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কনফারেন্স রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তারা।

দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালশ কর্কশ সুরে জানতে চাইলেন, কত?

পনেরো মিলিয়ন মার্কিন ডলার, জবাব দিল নিকোলাস।

তার মানে প্রতিটি সাড়ে সাত মিলিয়ন।

না, প্রতিটি পনেরো মিলিয়ন। দুটো ত্রিশ মিলিয়ন।

ওয়ালশ এমনভাবে দুলে উঠলেন, মনে হলো চেয়ার থেকে সরে যাবেন। আপনি পাগল, না অন্য কিছু?

আসুন পার্থক্য কমিয়ে আনি, বললেন ওয়ালশ। সাড়ে বাইশ মিলিয়ন।

মাথা নাড়লো নিকোলাস। এক দর।

এ আপনার সাংঘাতিক অন্যায়, হারপার! আপনি ডাকাতি করতে চাইছেন।

উত্তর না দিয়ে হাতঘড়ি দেখলো নিকোলাস। তারপর ছোট্ট করে বলল, দুঃখিত।

চেয়ার ছাড়লেন ওয়ালশ। দুঃখিত আমিও। ঠিক আছে, আমি তাহলে গেলাম। পরে হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে, নতুন কিছু পেলে আমাকে খবর পাঠাবেন।

পেছনে হাত বেঁধে দরজার দিকে এগুলেন তিনি। দরজাটা খুলছেন, পেছন থেকে ডাকলো নিকোলাস, মি. ওয়ালশ!

ব্যঙ্গভঙ্গিতে ওর দিকে ঘুরলেন ওয়ালশ। ইয়েস?

পরের বার আপনি আমাকে শুধু নিকোলাস বলে ডাকবেন, আর আমি আপনাকে শুধু পিটার বলে, ঠিক আছে? আমরা তো পুরানো বন্ধুই, তাই না?

শুধু এটুকুই বলার আছে আপনার?

হ্যাঁ! আর কি? নিকোলাসকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।

আপনি আমাকে টরচার করছেন, অভিযোগ করলেন ওয়ালশ, ফিরে এলেন টেবিলের কাছে। চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়লেন। আপনি নরকে পচবেন।

নিকোলাস কথা বলছে না।

ঠিক আছে, টাকাটা আপনি কীভাবে চান?

দুটো ব্যাংক ড্রাফটে, প্রতিটি পনেরো মিলিয়ন ডলার।

ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়ালেন ওয়ালশ, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মসিউ মন্টিফ্লেরিকে ডাকুন।

*

কুয়েনটন পার্কে, নিজের স্টাডিরুমের ডেস্কে বসে সামনের দেয়াল ঢাকা প্যানেলিং-এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে নিকোলাস। ডেস্কের তলায় হাত গলিয়ে ইলেট্রনিক কন্ট্রোল-এর গোপন বোতামে চাপ দিল, প্যানেলের একটা অংশ নিঃশব্দে সরে গেল একপাশে বেরিয়ে পড়লো ডিসপ্লে কেবিনেটের আর্মারড প্লেট গ্লাস। একই সঙ্গে আপনা থেকে জ্বলে উঠলো সিলিঙের স্পটলাইট, চোখ ধাঁধানো রশ্মিগুলো পড়লো কেবিনেটে রাখা জিনিসগুলোর উপর। ফারাও মামোসের মৃত্যু মুখোশ আর দ্বৈত মুকুটের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো কী যেনো নেই ওখানে। তারপর ডেস্ক থেকে টাইটার উশব তি তুলে নিল ও, মুখের সামনে ধরে এমন সুরে কথা বলল, যেনো নিজের সঙ্গেই আলাপ করছে। নিঃসঙ্গতা কী জিনিস, তুমি তা ভালোই বোঝে, তাই না? এ ও বোঝ যে কাউকে ভালোবেসে না পাওয়াটা কী যন্ত্রণাময় একটা অভিজ্ঞতা!

স্ট্রাচুটা রেখে দিয়ে ফোনের দিকে হাত বাড়ালো নিকোলাস। আন্তর্জাতিক একটা নাম্বারে ফোন করে তিন বার রিঙ হতে আরবি কণ্ঠস্বর উত্তর দিল।

মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালকের অফিস। আপনার জন্য কী করতে পারি?

ডক্টর আল সিমা আছেন? আরবিতেই জানতে চাইলো নিকোলাস।

একটু ধরুন। আমি ওনাকে লাইনে দিচ্ছি।

ডক্টর আল সিমা বলছি। রোয়েনের গলা শুনে নিকোলাসের শিরদাঁড়া বেয়ে রোমাঞ্চকর একা শিহরণ নেমে এলো।

রোয়েন?

আপনি! ফিসফিস করে বলল রোয়েন। জীবনেও ভাবিনি আবার কথা হবে!

ডিরেক্টর হয়েছেন, কংগ্রাচুলেট করার জন্য ফোন করলাম।

আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন, বলল রোয়েন।

তিনটা ক্রেট কম পেয়েছি। আমরা।

জ্ঞানী এক লোক যেমন বলেছিল, বন্ধুদের ঠকানো সবচেয়ে সহজ-ওরা বেঈমানী আশা করে না। আপনিও করেন নি, আমিও না। কথাটার সত্যতা আপনার অন্তত বোঝা উচিত, রোয়েন।

তিন সেকেন্ড চুপ করে থাকলো রোয়েন। আপনি ওগুলো বিক্রি করেছেন, শুনেছি আমি। মুকুটগুলোর জন্য পিটার ওয়ালশ বিশ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন।

ত্রিশ মিলিয়ন, শুধরে নিল নিকোলাস। তবে শুধু নীল আর নেমেস মুকুটের বিনিময়ে। এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে লাল আর সাদা ক্রাউন সহ ডেথ-মাস্ক কেবিনেটে সাজানো রয়েছে।

এখন তবে লয়েডস্ ব্যাঙ্কে সমস্ত দেনা শোধ করতে পারবেন। আপনি উঠে দাঁড়িয়েছেন আবার।

আরে, মজার ব্যাপার। লয়েডস্ সিন্ডিকেট ভালো খবর দিয়েছে। এখনো একেবারে শেষ হই নি বলা যায়।

আমার মা যেমন বলে–বিড়ালের অনেক জীবন।

অর্ধেক অবশ্য টিসে আর মেক নিমুরের ভাগে গেছে।

অন্তত, একটা ভালো কাজে গেছে। দাঁত দাঁত ঘষলো রোয়েন। কণ্ঠস্বরে আক্রমণাত্মক ভাব। এসব জানাতে আপনি ফোন করেছেন?

না। আরো একটা মজার খবর আছে। আপনার প্রিয় লেখক, উইলবার স্মিথ সমাধি আবিষ্কারের কাহিনী নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে সম্মত হয়েছেন। তিনি ওটার নাম দিয়েছেন দ্য সেভেন্থ স্ক্রোল। আগামী বছরের শুরুর দিকে প্রকাশ পাচ্ছে। বইটা। তাঁর অটোগ্রাফ সহ একটা কপি আমি পাঠিয়ে দিব আপনার কাছে।

আশা করি, এবার অন্তত ভদ্রলোক সব সত্যি কথা লিখেছেন, শুষ্ক স্বরে রোয়েন বলে।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকলো। এরপর রোয়েন বলল, আমার সামনে পর্বতসমান কাজ। যদি আর কিছু বলার না থাকে, মানে

বলার আছে যে!।

বলুন?

আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।

রোয়েনের দম আটকানোর আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পেল নিকোলাস।

খুব নরম সুরে, বেশ খানিকটা পরে ও প্রশ্ন করলো, এরকম একটা অসম্ভব কথা কেন আপনি ভাবছেন?

কারণ আমি উপলব্ধি করেছি আপনাকে আমি ভালোবাসি, জবাব দিল নিকোলাস।

আবার নীরবতা। কিছুসময় পর রোয়েন বলল, ঠিক আছে।

ঠিক আছে মানে কী?

ঠিক আছে, মানে আমি রাজি। এ বিয়েতে আমার মতো আছে।

এ রকম একটা অসম্ভব কথা কেন আপনি ভাবছেন? এবারে, নিকির পালা।

কারণ, আমি উপলব্ধি করেছি। সবকিছুর পরেও, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আজ বিকেলে, ৫:৩০ মিনিটে হিথরো থেকে মিশরের উদ্দেশ্যে একটা বিমান ছেড়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো গাড়ি চালালে হয়তো প্লেনটা ধরতে পারবো আমি। কিন্তু কায়রো পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

যতে দেরিই হোক আমি এয়ারপোর্টে আসবো।

তবে, আর দেরি নয়। আমি আসছি! তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দরজার উদ্দেশ্যে ছুটলো নিকোলাস। হঠাৎ কী মনে হতে থমকে দাঁড়ালো সে, দ্রুত ফিরে এসে ডেস্ক থেকে তুলে নিল টাইটার উশ তি।

এসো, ব্যাটা বুড়ো বর্বর, দরাজ হাসি হেসে বলল নিকি। বাড়ি ফিরে যাচ্ছ তুমি–বিয়ের উপহার হিসেবে!

*

শেষ কথা

রক্ত-বেগুনি সন্ধ্যার আলোয় গলিপথ ধরে হেঁটে ফিরছিল ওরা। ওদের নিচে চির-প্রবাহমান নীল নদ তার শান্ত, সবুজ জলরাশি নিয়ে বয়ে চলেছে, ধারণ করে রেখেছে কতো না পুরাতন গোপন কানাকানি। লুক্সরে, রামেসিস-এর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে নদী তীরে একদিন যেখানে ফারাও মামোসের রাজকীয় জলযান নোঙর ফেলেছিল, পাটাতনে বসে ছিল গর্বিত ক্রীতদাস টাইটা আর তার ভালোবাসা, কত্রী লসট্রিস; সেখানটায় এসে একটু থেমে দাঁড়ালো কপোত কপোতি। নদীর ওপারে সন্ধ্যার ছায়া নেমে গেছে, দূর-দূরান্তের পাহাড়শ্রেণী ধারণ করে আছে বিগত জীবনের যতো স্মৃতি।

মামোসের সমাধি মন্দিরের গলিপথগুলো কবেই ঢাকা পরে গেছে তাঁর পরে জন্মানো ফারাওদের নিজস্ব স্থাপনার কারণে। কোনো মানুষ আজো পারে নি তার সমাধি মন্দির আবিষ্কার করতে, যে সমাধিতে কখনো শোয়া হয় নি মামোসের। ডুরেঈদ ইবনে আল সিমা যে প্রস্তরখন্ডের আড়ালে পরে থাকা সুড়ঙপথে খুঁজে পেয়েছিলেন বিস্মৃত রানি লসট্রিসের সমাধি এবং সেই সঙ্গে টাইটার লেখা স্ক্রোল, ধারণা করা হয়, তারই সন্নিকটে কোথায়ও অনাবিষ্কৃত রয়েছে ফারাও মামোসের সমাধির গুপ্তপ্রবেশ পথ।

ঘনায়মান সাঁঝের আলোয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওরা চারজন। নিজেদের মধ্যকার অটুট বন্ধুত্ত ওরা পবিত্র নিস্তব্ধতার মধ্যেই যেনো উপভোগ করতে চায়। একটা দ্রুতগতির নৌকা পার হয়ে যায় ওদের। নদীর উজান থেকে এসেছে ওটা, অনেক ট্যুরিস্টে বোঝাই, দশ দিনের জলপথ ভ্রমনে এতোটুকু ক্লান্ত নয়, উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত দিয়ে দেখাচ্ছে রামেসিসের সমাধি মন্দিরের থাম আর মূর্তি। সন্ধ্যার পবিত্রতা যেনো তাদেরও ছুঁয়ে গেছে, ফিসফিস করে কথা বলছে তারা।

টিসের হাতে হাত ধরে আছে রোয়েন। একসঙ্গে হাঁটছে দুই বান্ধবী। ওদের হালকা-পাতলা গড়ন, মধু-রঙা ত্বক আর মিষ্টি হাসির রিনিঝিনি শব্দ সাহারা মরু থেকে আসা তপ্ত বাতাসেও শান্তির পরশ বুলায়। নিকোলাস এবং মেক নিমুর আসছে ওদের পেছন পেছন। কোমল চোখে দেখছে নিজেদের জীবনসঙ্গিনীকে।

তো, তুমি তাহলে এখন আদ্দিসের বড়ো হর্তাকর্তা, মেক নিমুর। শেষমেষ যোদ্ধা থেকে রাজনীতিবিদ। বিশ্বাসই হয় না।

সবকিছুরই একটা সময় আছে। যুদ্ধ বলো বা শান্তি, এক মুহূর্তের জন্য সিরিয়াস হয়ে উঠে মেক। নিকি হাসে।

ওহ হো, রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে তোমার কথাবার্তার ধরনও পাল্টে গেছে দেখছি, হালকা করে মেকের হাতে ঘুসি মারে নিকোলাস। এক ধাক্কায় শক্তিশালী শুফতা দস্যু থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী!

নীল মুকটের বিক্রির টাকা কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মেক স্বীকার করে। তবে ওরা জানতো, আমি ছ তা ইথিওপিয়ায় কোনো গণতান্ত্রীক ইলেকশন কেউ মেনে নেবে না। শেষ মেষ তো আমিই জিতলাম।

একটাই দুঃখ, সমস্ত টাকা তুমি ওদের দিয়ে দিলে। পনেরো মিলিয়ন পাউন্ড। অনেক টাকা! নি োলাস বলল।

সরাসরি তো আর দিই নি, মেক সংশোধন করে বলে, রাজস্ব খাতে দিয়েছি। এখন নজরদারী করছি, কী করা হয় ওই টাকা দিয়ে।

যাই বলো, পনেরো মিলিয়ন বহু টাকা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে নিকোলাস।

এমন অতি উদারতা ঠিক হজম হচ্ছে না। কিন্তু সামনের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে যাকে রানিং মেট করেছে, তার সম্পর্কে প্রশংসা না করে উপায় নেই!

ওরা দু জনেই টিসের ছোট্ট গোল নিতম্ব আর পিঠে ছড়িয়ে থাকা কোঁকড়া কালো চুলে চোখ বোলায়। স্কার্টের নিচে থেকে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে একজোড়া সুগঠিত বাদামি পা।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে তোমাকে ঠিক মানায় না, কিন্তু টিসে অবশ্য সংস্কৃতি এবং পর্যটন মন্ত্রী হিসেবে দারুণ উতরে যাবে।

আগামি আগস্টে আমরা যখন ইলেকশন জিতবো, ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওকে আরো ভালো মানাবে।

এই সময়ে ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকালো রোয়েন।

রাস্তার ওপারে যাই এসো, কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে কখন যে ওরা লুক্সরের জাদুঘরের নতুন অংশের কাছে চলে এসেছে, টেরই পায় নি নিকোলাস। রাস্তা পার হয়ে মিউজিয়ামের প্রবেশ পথে যার যার স্বামীর হাত ধরলো ওরা।

চওড়া বুলেভার্দ অতিক্রমের সময় ঘোড়ায় টানা ছোট্ট রথের পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলো ওরা, মুখ নামিয়ে রোয়েনের গালে ঠোঁট বুলালো নিকোলাস। তুমি সত্যি খুব সুস্বাদু–লেডি কুয়েনটন-হারপার।

আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন, স্যার নিকি! খিলখিল হাসিতে ফেটে পরে

রোয়েন বলে। জানেনই তো, ও রকম করে আমাকে কেউ ডাকে না।

যাদুঘরের প্রবেশমুখে এসে থমকে দাঁড়ায় ওরা দু জনা। কারনাকের মতোই লম্বা, হাইপোস্টাইল থাম তৈরি করা হয়েছে এখানে। তবে আকৃতিতে ছোট্ট। হলুদ স্যান্ডস্টোনে তৈরি দেয়াল, ভবনের সারিগুলো পরিষ্কার এবং সাধারণ। খুবই আকর্ষণীয়।

মিউজিয়ামের প্রবেশপথে ওদের আমন্ত্রণ জানায় রোয়েন। এখনো পাবলিকের জন্য খোলা হয় নি যাদুঘরটা। সোমবারে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী প্রেসিডেন্ট মুবারক আসছেন। ইথিওপিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে থাকছে টিসে এবং মেক। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরী দু জন রোয়েনকে সালাম দিয়ে গেট খুলে দিল।

যাদুঘরের ভেতরটা মৌন আর শীতল। এয়ার কন্ডিশনিং করা হয়েছে এমনভাবে, যেনো প্রাচীন সম্পদের কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। মামোসের দারুণ ট্রেজারের চমৎকার প্রদর্শনী করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং সৌন্দর্যের উপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে সব সম্পদ; রাজকীয় নীল আলোয় যেনো জ্বলছে ওগুলো।

চার সদস্য শান্ত এবং সমাহিত ভঙ্গিতে সমস্ত ট্রেজার পেরিয়ে হেঁটে চলে, নরমস্বরে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয় রোয়েন। অবাক বিস্ময় ওদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চূড়ান্ত প্রকোষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে এখন সবাই, এখানেই রয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান সংগ্রহ।

মামোসের সম্পদের বেশির ভাগটাই এখনো ডানডেরা নদীর নিচের সমাধিতে আটকে রয়েছে–ভেবে দেখুন, ফিসফিসায় টিসে। আরেকবার ওই অভিযান শুরু করতে ইচ্ছে করছে আমার।

আরে, বলতে ভুলে গেছি। মেক হাসে। স্মিথসোনিয়ান কোম্পানি বিরাট একটা অঙ্ক ঘোষণা করেছে, এ প্রজেক্টে ডানডেরা নদী থেকে আবার সমাধি সম্পদ উত্তোলনের কাজ হবে। মিশর আর ইথিওপিয়া–দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে।

দারুণ খবর! খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে রোয়েন। এই সমাধি নিজেই পৃথিবী শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হয়ে উঠবে, ইথিওপিয়া বহু টাকা কামাবে ট্যুরিজম থেকে।

এতো দ্রুত নয়, মেক নিমুর বাধা দেয়। একটা শর্ত আছে তাদের।

মুখ মলিন হয়ে যায় রোয়েনের। কি শর্ত?

তাদের দাবি–আপনি, রোয়েন, প্রজেক্টের পরিচালক হবেন।

খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো রোয়েন। এরপর, কপট ভাগম্ভিরতার সাথে বলল, আমারও একটা শর্ত আছে।

সেটা আবার কী? মেক জানতে চায়।

আমি নিজে প্রজেক্টের জন্য সহকারী নির্বাচিত করব।

হাসিতে ফেটে পরে মেক নিমুর। আমরা সবাই জানি, কে সেটা। নিকোলাসের পিঠে চাপড়ে দেয় সে। শুধু লক্ষ্য রেখো, সমস্ত আর্টিফ্যাক্ট যেনো ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারো!

নিকির কোমর ধরে কাছে টানে রোয়েন। ও বদলে গেছে একেবারে। এবারে তার প্রমাণ দিব। স্বামীর কোমর ধরে রেখে সবাইকে শেষ প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেল রোয়েন।

প্রবেশমুখে এসে থমকে দাঁড়ায় মেক এবং টিসে। কক্ষের মধ্যখানে আর্মারড কাঁচে মোরা ডিসপ্লে কেস দেখতে থাকে। লাল-সাদা উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যের মুকুট আর ফারাও মামোসের মৃত্যু-মুখোশ বসে আছে তীব্র স্পটলাইটের নিচে।

মেক নিমুর সবার আগে এ শক থেকে মুক্তি পায়। ডিসপ্লে কেসের সামনের প্যানেলে এসে প্লেটটা ভালো করে পড়ে সে–স্যার নিকোলাস এবং লেডি কুয়েনটন-হারপারের উপহার।

অবাক বিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিকোলাসকে দেখে সে। আর তুমি কিনা আমাকে তিরষ্কার করছিলে নীল মুকুটের টাকা সমস্তটা দিয়ে দেওয়ায়। নিজেই দেখছি লুটের শেয়ার দিয়ে দিয়েছ!

 কাজটা কঠিন হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বীকার করে নিকোলাস। কিন্তু অত্যন্ত নাজুক একটা আলটিমেটাম দিয়েছিল একজন–সে এ মুহূর্তে আমার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে!

খুব বেশি দুঃখ করো না, খোকা, হাসতে হাসতে বলল রোয়েন। নেমেস মুকুট পিটার ওয়ালশের কাছে বেঁচে ইতোমধ্যে সুইটজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রেখেছে ও। বলেও ওটা আদায় করতে পারি নি।

দ্যাখো, আমার ব্যক্তিজীবনের এতো কিছু প্রকাশ করে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, নিকোলাস বলে ঘার গোঁজ করে। অনেক আগেই সূর্য অস্ত গেছে, এখন পানাহারের সময়। মনে হয়, হোটেলের বারে ভালো কিছু পানীয় দেখেছি আসার সময়। চলো গিয়ে দেখি, ঠিক দেখলাম কি না।

রোয়েনের হাত ধরে হেঁটে চলে নিকোলাস। মেক আর টিসে ওদের পিছু পিছু হেঁটে আসে, নিকোলাসের অস্বস্তিতে যার-পর-নাই আনন্দিত দু জনেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *