৮. পূজা এসে পড়লো

পূজা এসে পড়লো। বাংলার আকাশ আনন্দের আর গানে পরিপূর্ণ, শুধু দেবেন্দ্রের ভাঙ্গা বাড়িখানা প্রতীক্ষা করছে মৃত্যুর। দিন দিন অবসন্ন হয়ে আসছে মহেন্দ্র, শেষ হয়ে আসছে আয়ু দীপ। প্রথম উপন্যাস ছাপা হয়ে এসেছে অনেকদিন দ্বিতীয়টাও এল সপ্তমীর দিন নাগাদ, তার সঙ্গে কয়েকটা সমালোচনা আর বেশ কিছু টাকাও। কিন্তু দেবেন্দ্র নোটের বাণ্ডিলটা হাতে নিতে পারলেন না। তৃতীয় উপন্যাসখানাও শীঘ্র বেরিয়ে যাবে। ব্যাস। মহেন্দ্রের সাহিত্য জীবনের ইতি। কে জানে বাংলার পাঠকের অন্তরে কোন গ্রন্থাগারের বইয়ের তাকে কোন পুস্তকের দোকানে সে বেঁচে আছে দেখবার জন্য মহেন্দ্র কিছু মাত্র মাথাব্যথা থাকবে না, তাকে ভুলে গেলেই ভালো। মানুষ আরো উন্নততর সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে যা মহেন্দ্র করতে পারল না। শেষ বইয়ের নাম দিয়েছে ক্রন্দসী। অসীম আকাশ জুড়ে তার পটভূমি আলো জগতের নায়ক নায়িকা কে জানে, ওটা পড়ে কি ভাববে মাধুরী?

মাধুরী নিশ্চয় পড়বে, কিন্তু উপায় কি? পড়ে কিন্তু কিছুই বুঝবে না, কিছুই জানবে না মহেন্দ্র সম্বন্ধে। মহেন্দ্র এ জীবনে আর তাকে বিড়ম্বিত করতে যাবে না, হয়ত জন্মান্তরেও না। মাধুরী যেখানকার, সেখানেই থাক। আকাশের চাঁদকে মাটিতে নামাবার সাধনা শুধু নির্বুদ্ধিতা নয় অন্যায়। তাতে গোটা পৃথিবীকে চাঁদের আলো থেকে বঞ্চিত করা হয়।

আজ বিজয়া দশমী। কত স্মৃতি বুক জুড়ে জাগছে মহেন্দ্রের। রাত্রিতে গঙ্গার কুলের উপর রাত কাটানো, পার্কে বসে খিচুড়ি খাওয়া, তারপর উমেশবাবুর বাড়িতে মাধুরীর দেখা, না এসব ভেবে লাভ নেই।

চিঠি আছে বাবু, বলে সাগর পিয়ন একখানা খাম দিল তার খাটে ছুঁড়ে। নীল রং এর খাম কোথাও ফিকে, কোথাও গাঢ় নীল বর্ণ সুন্দর। খুলে ভিতরে ঐ একই রং এর কাগজ বেরুলো সুন্দর হস্তাক্ষর, মাধুরী লিখেছে, প্রিয় কিন্তু শব্দটা লিখেই এমন কেটেছে যে, পড়া যায়। কাগজটা বদলে দিলেই পারতে ইচ্ছে করে বদলায়নি, অতঃপর ওর নীচে লিখেছে।

শ্রীচরণেষু,

আজ বিজয়া দশমী, তুমি এসেছিলে এই পূণ্য দিনে, আজ তোমাকে প্রণাম না জানিয়ে পারলাম না মহীনদা। জানি তুমি যেখানে থাক, তোমাকে খোকনের স্নেহে তোমাকে টেনে আনবে অন্ততঃ এই দিন তোমার বাড়িতে, তাই বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দিলাম আশা করি যথাসময়ে পাবে।

অকস্মাৎ অতর্কিত ভাবে তোমার চলে যাওয়ার পিছনে যাই থাক আমি অনুসন্ধান করবো পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের বন্ধন রজ্জুটা চোখে দেখা না গেলেও ওদের প্রেমের সত্যটা মলিন হয় না মহীনদা। সূর্যের কত তাপ আছে আর সূর্য কত দূরে আছে, পৃথিবী নাইবা জানলো ওর আলোতে উত্তাপে তো পৃথিবী ফলে ফুলে জীবনে পরিপূর্ণ হচ্ছে, এই কি যথেষ্ট নয়?

দাদা বৌদিকে বিজয়ার সহস্র প্রণাম জানাই। ইতি তোমার মাধু–

লিখেই তোমার মাধু কথাটা কেটে নীচে লিখেছে প্রণেতা মাধু অথচ অনায়াসে কাগজখানা বদলে এই কটা লাইন আমার জন্য কাগজে লিখে পাঠাতে পারতো। কেন সেটা। করেনি, জানে মহেন্দ্র। ছেলেমানুষী। না তার অন্তর।

স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে যা কিছু লিখেছে, তাকে নষ্ট করেনি মাধুরী শুধু ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু কোনো ঠিকানা নাই চিঠিতে। ঠিকানা অবশ্য জানে মহেন্দ্র কিন্তু জেনে কি হবে। এ চিঠির জবাব দেওয়া হবে না।

নীরবে চিঠিখানা বুকের উপর রাখলো মহেন্দ্র রেখে চোখ বুজলো। জল আসছে চোখে ওর কিন্তু সামলাচ্ছে। অকস্মাৎ অর্পণা এসে ঢুকলো। ভাবলো হয়তো ঘুমাচ্ছে মহীন।

নীরবে অর্পণা বুক থেকে চিঠিখানা তুলে নিল। আধা মিনিটে পড়ে ফেললো কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। কে মাধুরী চেয়ে দেখলে মহেন্দ্র ঘুমায়নি, জেগে রয়েছে। বলল কে মেয়েটি?

ওর কথা আজ থাক বৌদি সেতার দাও একবার।

চিঠির জবাব?

না দিতে হবে না, চিঠিখানা ঐ কুলুঙ্গীতে রেখে দাও বৌদি মহেন্দ্র উদগত অশ্রুতে ভেঙ্গে পড়ছে বারবার, অর্পনা সবই বুঝল বলল–

সে অভাগী তোমার অসুখের কথা জানে না মহীন।

না না জানানো চলবে না বৌদি, তাকে কিছুতেই জানাতে হবে না।

কুমারী মেয়ে সে ভুলে যাক মহীনকে। চিঠিখানা ঐখানে রেখে দাও। যেন আমি শুয়ে শুয়ে দেখতে পাই বৌদি।

মহীন। উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে উঠলো অৰ্পণা। দুর্ভাগী অর্পণা সন্তান স্নেহে মানুষ করেছে মহীনকে, খোকনের চেয়ে মহীন তার কাছে এতটুকু কম নয়, কিন্তু মানুষের কিছুই করবার নাই। নিজেকে সামলে যত্ন করে রেখে দিল চিঠিখানা খামের ভিতর ঐ কুলঙ্গীতে মহীনের শয্যার বা দিকে।

মহেন্দ্র অতিকণ্ঠে আঙ্গুল বুলিয়ে চলেছে সেতারে সন্ধ্যা আসন্ন।

বিসর্জনের বাদ্য কোলাহল, প্রতিমার গ্রাম পরিক্রমণ এবং বিসর্জন শেষ হলো। মহেন্দ্র তখনো বাজাচ্ছে সেতার। কি মধুর ঝঙ্কার, কি করুণ সে রাগিনী। বিশ্বমার বিরহে যেন ধরিত্রী গুমরে উঠছে। অকস্মাৎ খোকনকে নিয়ে অর্পণা এল। খোকন প্রণাম করবে কাকুকে।

ওকে কেন আনলে বৌদি এখানে?

তা হোক। বড় কাঁদছিল। তোমার অত ভাবতে হবে না, নে প্রণাম কর।

খোকন প্রণাম করে নির্নিমেষ চেয়ে রইল কাকুর পানে যেন চেনাই যায় না। কিন্তু কাকু বললো আস্তে

বেঁচে থাক, এই বংশের গৌরব হয়ে বেঁচে থাক মানিক

কিন্তু খোকনকে ওর বুকে নিতে পারল না, জড়িয়ে ধরলো না, এ যে কত বড় দুঃখ তা জানে ওর অন্ত  র‍্যামী। অসহ্য বেদনায় মহেন্দ্র উঃ বলে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।

খোকন আস্তে ডাক দিল কাকু। মহেন্দ্র শুধু চাইল, কথা বলতে পারল না।

ক্লান্তিতে সর্বাঙ্গ অবসন্ন ওর। অর্পণা খোকনকে সরিরে দেখলো মহীন নির্জীব ক্ষীণ হয়ে আসছে। ও ঘরে দেবেন্দ্রকে জানালো গিয়ে, দেবেন্দ্র উঠে এসে দেখলেন নাড়ি–তারপর। নিঃশব্দে ও ঘরে ফিরে গেলেন মহীনের কোল থেকে সেতারখানা নিয়ে। শোন মহীন–ও ঘর থেকেই বললেন এবং আরম্ভ করলেন বাজাতে। ওঃ। মানুষ যে এমন পাথর গলান সুর জাগাতে পারে, জানতো না কেউ। বিজয়ার প্রনাম করতে আসছে গ্রামবাসিগণ সবাই স্তব্ধ। দাঁড়িয়ে গেছে। ভেতরের ঘরে মৃত্যু পথযাত্রী মহীন–কাছে একা অর্পণা আর বাইরের ঘরে দেবেন্দ্র সেতার বাজাচ্ছেন চোখে জল ভেসে আসছে। মধ্যরাত্রির মহা নীরবতা বিদীর্ণ করে বেজে চলেছে সুরলহরী তরংগে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন এক অশরীরী আত্মাকে কোন দ্যুলোকের পথে কে জানে।

মহীন? অর্পণা আর্ত কণ্ঠে ডেকেই চুপ হয়ে গেল। আর ঐ আর্তকণ্ঠের আঘাতেই যেন সুর সাধক দেবেন্দ্রের হাতের সেতারটার একটা তার  ছিঁড়ে যন্ত্রটা ও আর্তনাধ করে উঠলো। মহীন নাই। ও ঘর অর্পণা মূৰ্ছিতা হয়ে পড়েছে আর এ ঘরে দেবেন্দ্র নিঃশব্দে বসে রইলেন ছেঁড়া সেতারটা হাতে নিয়ে। তখন সুরের পরীরা যেন নৃত্য করে বেড়াচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে ক্রন্দন ধ্বনি তুলে কেউ এই সমাধি মন্দিরকে বিচলিত করতে সাহস করলো না। খোকনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি–সে বাইরে দাঁড়িয়ে তুলসী তলার প্রদীপটার বুক জ্বলছে–অমঙ্গল হয়। জলভরা চোখে দেখেছে খোকন অকস্মাৎ দমকা হাওয়ায় প্রদীপটা নিবে গেল–অন্ধকারে খোকন একা।

নানা কাজে ব্যস্ত মাধুরী সমস্ত দিন। আজ বিজয়া দশমী। কাজের মধ্যে যতবার মনে হচ্ছে মহীন এতক্ষণ চিঠিখানা পেয়েছে, ততবারই ওর মুখখানা হাসি মাখা হয়ে উঠেছে। চিঠিতে যদিও কিছু নাই, তবু কত যে আছে ওর অন্তরের সৌরভ।

সকাল থেকে আজ বিনামুল্যে ফুল আর দুধ বিতরণ করছে ও পাড়ায় ছেলেমেয়েদের আর একটু করে মিঠাই। গরু। ছাগলগুলোকে নিজের হাতে কাঁচা ঘাস খাইয়েছে। কর্মচারীদের বকশিস দিয়েছে। ওপাড়ার পূজা মণ্ডপে পাঠিয়েছে ওর প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুত ননী ক্ষীর। রাত দশটা পর্যন্ত সব শেষ। বিসর্জন দেখতে দেখতে শ্যামবাজারে বাড়িতে ফিরছে মাধুরী।

সারা মনখানি জুড়ে কেমন একটা বিশেষ আনন্দানুভূতি আজ যেন জেগে আছে, আঁচলে আছে একরাশ ফুল ওর বাগানের ফুল। নিজের হাতে একটা মালা গাঁথতে গেটে ঢুকার সময় একটু লাফিয়ে উঠতেই। আংগুলে সূচ ফুটে গের, উঃ। অব্যক্ত শব্দ করে উঠলো মাধুরা। বাড়িতে ঢুকলো। গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে যাচ্ছে আঁচলের ‘সাক্ষী’ ফুলগুলি তুলে নিয়ে

সটান ওপরে চলে গেল। ওখানেই খেয়েছে তাই বড় বৌদিকে ডাক দিয়ে জানিয়ে দিল যে, খাবে না।

নিজের ঘরে এসে মাধুরী দরজা বন্ধ করলো দেরাজ টেনে মহীনের ফটোখানা বের করলো অত্যন্ত গোপনে এ ফটো সে রাখে, তাই বাঁধানো হয়নি টিপয়ে সেটা সাজিয়ে নিজের গলার মালা তাকে পরাতে গিয়ে মাধুরী দেখতে পেল–সুচ ফোঁটা আংগুলে কখন একবিন্দু। রক্ত এসেছিল, তাই লেগে গেছে ফটোর বুকেঃ সাদা পাঞ্জাবী পরা বুকখানা দাগি হয়ে গেছে।

কেন এমন হচ্ছে? বার বার কেন হচ্ছে এরকম? মাধুরী নিমিষে চোখে রক্তের দাগটা দেখতে দেখতে ভাবলো–আঁচল দিয়ে মুছবার চেষ্ট করলো। সে আধুনিক সমাজের শহুরে মেয়ে কোন কুসংস্কার ওকে আচ্ছন্ন করে না, তবু যেন কি এক অমঙ্গল আশংকায় মলিন হয়ে। উঠলো মাধুরী কিন্তু তখনি দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে ফটোটাকে লক্ষ্য করে আপন মনে।

না না এসব কিছু না হয়তো তোমার পল্লীবধু নিয়ে রাত জাগছো বাড়িতে তাই আমার মালা নিতে চাইছ না, কিন্তু আমি তো ব্যাঘাত করিনি, বাধা দিইনি আমার গোপন পূজা গোপনেই থাকবে। মালাটা পরিয়ে দিল মাধুরী ধুপ জ্বেলে দিল তারপর প্রণাম করলো গলায় আঁচল দিয়ে।

রাত অনেক হয়ে গিয়েছে ঘড়িটা দেখলো একবার, কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি। গ্রামোফোনটা খুললো মাধুরী, দম দিল তারপর একখানা নতুন বোর্ড ভাল করে মুছে চোখ। বুজে বললো মনে মনে, তোমার গাওয়া গান শুনতে শুনতে আজ ঘুমোব–বড় ঘুম। পেয়েছে।

রের্কড খানায় পিন লাগিয়েই মাধুরী শুয়ে পড়লো পালঙ্কে। সুর ছড়িয়ে পড়ছে–গড়িয়ে পড়ছে যেন, আকাশচুম্বী পাহাড় থেকে অলকানন্দ ঝরছে মিষ্টি হাসি ফুটলো ওর মুখে নীল আলোটা জ্বেলে দিয়েছে। রেকর্ড বাজছে। অকস্মাৎ কড় কড় আওয়াজ। হলো কি? মাধুরী ত্বরিত উঠে আলো জেলে দেখলো থেমে গেছে মেশিনটা। এ রকম তো হয় না? রেকর্ড খানা হাতে তুলতেই দু’খানা হয়ে গেল। মাধুরীর দুচোখ দিয়ে জল ঝরে পড়লো–না কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না আর। বার বার এমন অমঙ্গল কেন? অন্তর জুড়ে এই প্রশ্ন জাগলো।

সারা রাত কিভাবে কাটলো, জানে না মাধুরী, ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল মার্বেলের মেঝেতে, ঘুম ভাঙল মেজদির আহবানে। তাড়াতাড়ি উঠে আলোটা নেভালো, ফটোখানা লুকিয়ে ফেললো এবং ভাঙা রেকর্ডটা আলমারীর তলায় ভরে দিল তারপর দরজা খুলে বললো কি বৌদি?

আজ আমাদের স্টীমার পার্টি আর তুই এখানে ঘুমুচ্ছিস। যাবি বলেছিলি যে?

বৌদি, আমার যাওয়া হবে না। অনেক কাজ পড়ে আছে বজ্রধামে এখুনি বেরুতে হবে। কাল রাত্রে ফিরতে অনেক দেরী হয়েছিল আমার।

কুমার বরুণবাবু তাছাড়া আরো অনেকে যাচ্ছেন। ওস্তাদ হিমায়েত খাঁও আসবেন। তুই না গেলে সব ফাঁকা লাগবে ছোটনি চল।

না বৌদি মাফ চাচ্ছি। মাধুরী স্নান করার জন্য চলে যাচ্ছে।

সোসাইটি তুই ছেড়ে দিলি মাধু? মেজবৌদি করুণ স্বরে বললো আবার।

হ্যাঁ, ও সোসাইটি ছেড়েছি, অতকম জলে আমার মত মাছ খেলতে পারে না, বাংলার যে বিরাট বিস্তার সমাজ, সেখানে আমার ঠাঁই করে নিতে চাই। তাদের দুঃখ দৈন্য আনন্দ বিলাসের অগাধ জলে সাঁতরে বেড়াবো বৌদি, তোমার ইঙ্গ বঙ্গ সোসাইটিতে আমার পোষাবে না হাসলে মাধুরী।

ওঁরা সবাই আশা করে আছেন।

ওদের জানিও, গঙ্গাকে ঐরাবত আটকাতে পারে না, হোক না সে ইন্দ্রের বাহন, গঙ্গা সাগরে পড়বেই সাত কোটি সন্তানকে উদ্ধার করতে হবে তার। চলে গেল মাধুরী বাথরুমে। মেজবৌ তবু আধ মিনিট থেকে দেখলো ওর ঘরখানা খোলা গ্রামোফোনটা গলায় ছেঁড়া মালা, পুড়ে যাওয়া ধুপ কিন্তু কৈ?

কোথাও মহেন্দ্রের স্মৃতিচিহ্ন নেই তো? না মহেন্দ্র এখানে কি জন্য আসবে। মাধুরীর মনের মত কেউ এখানে আসেনি তাই মেয়েটা এরকম করছে কিন্তু সমাজে যদি না বেরোয়  তো মনের মত বর জুটবে কি করে। মেজদা বলছে মাধুরীকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে, কিন্তু যা মেয়ে। ও কি যাবে। স্নান সেরে বেরুক, আরেকবার বলবে মেজবৌ ভেবে চলে গেল।

মাধুরী বেরুলো বাথরুম থেকে। মনটা খুব হাল্কা হয়ে গেছে। গত রাত্রের ব্যাপারগুলো কিছু নয় ও নিয়ে মন খারাপ করবার কিছুই নাই মা পূজার ঘরে গিয়ে প্রণাম করলো ঠাকুরকে তারপর চা খেল বাবার সঙ্গে উমেশবাবু প্রশ্ন করলেন। তুই যাবিনে ওদের পার্টিতে।

না বাবা ওতে আমি আনন্দ পাইনে।

কেন মা? সবাই খাবি দাবি, গান গল্প করবি, বেশ তো ব্যাপার।

ওতে মন শুধু ভোগের দিকে থাকে বাবা, ভাবের দিকে যায় না, এগুলো এতো বহির্মুখো যে নিজেকে খুঁজতে আবার নির্জনে গিয়ে বাসা নিতে হয়।

উমেশবাবু জানেন তাঁর এই মেয়েটির অসাধারণত্ব, চিন্তায় এবং কাজে সে চিরদিনই স্বতন্ত্র এবং এই জন্য তার ভয়, আর পাঁচটা মেয়ের মত নয় মাধুরী হলে ভাল হতো, কিন্তু হয়নি এখন যখন উপায় কি? তবু হেসে বললেন তোরা ছেলেমানুষ এখন তো বাইরে খেলাধুলা নিয়েই থাকা উচিত।

খেলাধুলাকে উল্টে দাও, ধুলাখেলা হয়ে যাবে, ওগুলো সব খেলাধুলা গায়ে দাগ লাগে, মনকে বিরক্ত করে হাসলো মাধুরী, বললো মানুষ ততক্ষণ ছেলে মানুষ থাকে বাবা যতক্ষণ সে জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না, দু’পাঁচ বছরের জীবনের উদ্দেশ্যে বুঝেছিলেন, ঈশ্বর লাভ তিনি তখনি করেছিলেন আর ছেলেমানুষ ছিলেন বুঝলেন বাবা?

হ্যাঁ মা, করুণ হাসলেন উমেশবাবু।

তুমি আমার সব থেকে ভাল ছাত্র বাবা বলে উঠে চলে গেল।

এরপর গাড়িতে চড়ে বেরুলো মাধুরী বাজারে যাবে রেকর্ড ভেঙ্গে গেছে সেটা কিনতে হবে ওকে। দু’পাশে সারি সারি দোকান সাজানো, পূজার বাজারের ভিড় তখনো রয়েছে, দেখছে মাধুরী গাড়িতে বসে, বড় বড় পোষ্টার মারা রয়েছে দেয়ালে।

মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অমর উপন্যাস, ‘মরণ যমুনা’ বের হলো।

একখানা বইয়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মাধুরী দোকানীকে বললো–‘মরণ যমুনা’ আছে? দিন একখানা।

দোকানদার দিল বই খানা ওর হাতে এনে। চমৎকার বাঁধানো বই, খুলেই দেখতে পেল উৎসর্গ পত্রটা শ্রীমতি মাধুরী করকমলেষু–

বুকে ঠেকালো বইখানা মাধুরী, প্রশ্ন করলো দোকানদারকে আবার– বইটা কেমন হয়েছে? কি রকম বিক্রি হচ্ছে–

অসাধারণ বই রেকর্ড সেল যাচ্ছে।

খান পাঁচেক দিন আমার, মাধুরী বললো।

আপনার কি কেউ হন উনি? দোকানদার অকস্মাৎ প্রশ্ন করলো বইগুলো হাতেই।

না, হ্যাঁ, আমার– মাধুরীর মুখে হাসি, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।

পাঁচ টাকা বইয়ের। টাকা পাঁচটা দিয়েই মাধুরী চলে গেল ক্যাশ মেমো নেবার জন্যে অপেক্ষা করলো না।

বইগুলো অতি যত্নে বাধলো একটা তোয়ালে দিয়ে। পড়বে, পড়ে দেখবে তার ‘মরণ যমুনা’ কোথায় কেমন সে। মাধুরীই কি ‘মরণ যমুনা’ নাকি। দূর। মাধুরী ছেড়ে হাওয়ার জন্যেই ঐ নাম দিয়েছে মাধুরী যেন বুঝতে না পারে। অম্লান হাসি ওর মুখে, অমলিন ওর হৃদয়, ভাবলো বিয়ে না হলে কি বাঁচে না মানুষ? খুব বাঁচে, আরো ভালভাবে বাঁচে। এই যে স্মৃতি অমৃত, এই যে আলো স্পর্শ এ কি তুচ্ছ, মুল্যহীন।

গ্রামোফোনের দোকানে এলো মাধুরী, নামলো গাড়ি থেকে। চেনা দোকানী আসুন আসুন বলে অভ্যর্থনা করলো। মাধুরী গিয়ে বসতে বসতে বললো–

মহীনদার, মহীন মুখুজ্যের কি রেকর্ড বেরিয়েছে দিন।

অসম্ভব সেল ওর খান তিনেক মাত্র আছে আর বলে দোকানী রেকর্ড বের করে বললো, বাজিয়ে দিই?

 হ্যাঁ বাজান, দেখে নিই ঠিক আছে কিনা।

দোকানদার রেকর্ড চালিয়ে দিল গ্রামোফোনে শুনছে। মাধুরী শুনছে তন্ময় হয়ে। কোথায় আছে মাধুরী? মাটিতে না আকাশে ও জানে না কলকাতা শহরের দোকান, অজস্র লোক, অসংখ্যা শ্রোতা এবং খরিদ্দার, সবাই দেখছে–নির্বাক নিস্পন্দ মাধুরী বসে আছে ঠিক পাথরের মূর্তির মত। দুই চোখের কোল বেয়ে দুটি ধারা নেমে এসেছে, একি সুখ। একি বেদনার অমৃত মন্থন।

অকস্মাৎ সিন্ধুলব্ধ মাধুরী রেকর্ড কয়খানা বাক্সে ভরে সটান দমদমার বাগানে চলে গেল বুকটা তখন ফুলে উঠেছে কি এক আনন্দ বেদনায়।

সারা বাড়ীটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেছে, কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না, মনেই হয় না যে ওখানে মানুষ আছে, যেন বহু প্রাচীন একটা সামাধিস্তূপ।

সকালে খোকন হাত মুখ ধুয়ে বাগানে ফুল তুলে আঁচল ভর্তি করে, তারপর নিঃশব্দে এসে জানালা গলিয়ে ছড়িয়ে দেয় মহেন্দ্রের বিছানার উপর। বিছানায় মহেন্দ্রের ফটো আর সেই সেতারখানা, সাজানো আছে। কুঠুরীর দরজায় একটা প্রকান্ড তালা, খোকন ঢুকতে পারে না। বন্ধ দরজার সম্মুখে হেঁট হয়ে প্রণাম করে, চোখে জল আসে ওর মুছে নিঃশব্দে পড়তে বসে গিয়ে।

তারপর সমস্ত দিন নিঝুম বাড়ীখানা, বাইরে দেবেন্দ্র তার চৌকিতে শুয়ে বসে ভেতরে অর্পণা নীরবে গৃহকাজে রত, স্কুল থেকে ফিরে খোকন নীরবেই কিছু জল যোগ করে তারপর বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় আসে সঙ্গীত সাধকের দল ঐ সময়টা একটু যা লোকসমাগম বোঝ যায়, কিন্তু এতো সাবধান যেন এখনি ঘুম ভেঙে যাবে এমনি ভয়ে ভয়ে। টোলের ছাত্রগুলি আছে কিন্তু তারা জানতেই চায় না যে, তারা আছে এমনি নিঃশব্দে তারা পাঠ অভ্যাস করে। শ্মশানের স্তব্ধতা যেন জেগে আছে বাড়িখানায় অহরহ।

কিন্তু তথাপি দিন চলে যাচ্ছে, মাস গেল, বৎসর পূর্ণ হতে চলল। আবার সেই বিজয়া দশমী। এর মধ্যে মহেন্দ্রর প্রথম উপন্যাস মরণ যমুনার প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে, অন্য বই দুটিও ভালো বিক্রি হয়েছে। বেশ কিছু টাকা দিয়ে আবার ছাপার স্বত্বঃ কিনে নিয়ে গেছেন পাবলিশার্স। দেবেন্দ্র কথাও কইলেন না। শুধু সই করে দিলেন খোকনের অভিভাবক হিসাবে। টাকাও ছুলেন না তিনি।

মরণের পরেও তার খোকনের জন্য রোজগার করেছে, অর্পণা কেঁদে ভাসালো টাকাটাকে।

অন্ধ তাই দেখি না, কানটাও গেলে ভাল হতো অর্পণা, এসব শুনতে পেতাম না।

নিঃশব্দে অর্পণা টাকাগুলো নিয়ে ভেতরে গেল। দেবেন্দ্র সহ্য করতে পারেন না এই অর্থাগম। মহীন নেই, তার টাকা আসে। মহীনের অর্জিত এ যে ওঁর বুকে কতবড় বজ্র জানেন তিনিই। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ থেকে বললেন বুকখানা তো ফেটে যাচ্ছে।

শুনতে পায় অর্পণা। গড় গড় করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। অভাগী নারী অশ্রু সম্বল করে বেঁচে আছে শুধু খোকনের মুখ চেয়ে। সন্ধ্যায় ধুপ ধাপ জ্বেলে দিতে আসে মহেন্দ্রের ঘরখানায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে বিছানার কাছে তারপর তালা দিয়ে চলে যায়।

আজ আবার বিজয়া দশমী, ঘরখানা ভালো করে পরিস্কার করলো অর্পণা। বিছানাটা ঝেড়ে পাতলো ফটোটি সযত্নে মুছে রাখলো, সেতারটি ঝেড়ে মুছে আবার রেখে দিচ্ছে। সাগর পিওন এসে বললো, চিঠি বৌদি ঠাকুরণ।

দাও, অর্পণা হাতে করে নিল। সাগর, নীল রংগের খাম আর সেই রং এর কাগজ উজ্জ্বল লাল কালিতে লেখা ঠিকানা, যেন বুকের রক্ত দিয়ে লিখেছে নামটা শ্ৰীযুক্ত মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

অতি সাবধানে পড়লো যেন খামটা নষ্ট না হয় এমনি ভাবে চিঠিটা খুলল অর্পণা। পড়লো–শ্রীচরণেষু
       আজ আবার বিজয়া দশমী মহীনদা, সারা বছরের প্রণাম গ্রহণ কর। যত দূরেই থাক, তোমার সঙ্গ আমি সর্বক্ষণ পাই, সঙ্গীতে সঙ্গীতে আর তোমার দেওয়া কাজে। সে কাজ এত সুন্দর মহান, তা জানতাম না।
        জীবন শুধু সুন্দর নয় মহীনদা, সে জীবন মহীময়, কিন্তু সে জীবন হবে তপঃ ক্লিষ্ট ঋষির জীবন, কর্মময় ত্যাগের জীবন। তোমার প্রেমের বলে আমি জৈব জীবনের গণ্ডী পার হয়ে যেতে পারবো মহীনদা, ভয় নাই।
         দাদা বৌদিকে আমার অনন্ত প্রণাম আর খোকনকে অন্তরের শুভাশীষ জানালাম।
         তোমাকে কি জানাবো ভেবে পাচ্ছি না, সবই জানালাম, প্রণাম নমস্কার প্রীতি, ভালবাসা।
         ইতি–মধু।

আহা! কে এই অভাগী। আপন মনে বলে উঠলো অর্পণা। চিঠিতে কোথাও ঠিকানা নাই। নীচের দিকে পুনশ্চ দিয়ে লেখা হয়েছে–

রেকর্ড আর রেডিওতে আমার অরুচি ছিল, ওতে তোমার গান বাজে, তাই ও দুটো আজ আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমার সেতার তোমার হাতে কেমন বাজে শুনতে বড় ইচ্ছে হয়, এ স্বপ্ন কবে সফল হবে মহীনদা?

অর্পণার চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। পিছনে খোকন নিজের হাতে মালা গেঁথে এসে দাঁড়িয়েছে কাকুর ফটোতে পরাবে। প্রশ্ন করলো–

কার চিঠি মা, কি লিখেছে?

আরো বড় হয়ে দেখিস মানিক, অর্পণা খামে ভরে চিঠিখানা সযত্নে তুলে রাখলো সেই কুলুঙ্গীতে, খোকন ফটোতে মালা দিলো প্রণাম করলো।

মহীনের ঘর খুলে ওর মাথার কাছে বসিয়ে দাও অর্পণা। আর সেতারখানা দাও ওকে শোনাতে হবে আজ।

জল তো পড়ছে না দৃষ্টিহীন চোখ। হাসছেন দেবেন্দ্র, অর্পণা একটু ভয় পেল কিন্তু স্বামীকে সে চেনে, বললো,

আজ একখানা চিঠি এসেছে। আবার সেই নীল খাম, লাল কালির ঠিকানা। কে লিখেছে? দেবেন্দ্র প্রশ্ন করলেন।

সেই মাধুরী, ওর ডাক নাম হয়তো মাধু। ওরই হয়তো ঐ সেতারখানা ওটাই বাজাও।

অর্পণা স্বামীকে ধরে এনে বসিয়ে দিল মহেন্দ্রর বিছানায়। হাত তুলে দিল মাধুরীর সেতারখানা। দেবেন্দ্র আধ মিনিট স্তব্ধ থেকে বললেন। সঞ্চিত পাষাণে তাঁর পূজার ইতিহাস, আর বিশুস্ক ফুল বিশ্বদলে তার মাধু বাতা ঋতায়তে মধুক্ষন্তি সিন্ধুর নবুবৎ পার্থিব রাজঃমধু ওঁ মধুওঁ—

প্রতি বিজয়া দশমীর ডাকে আসে ঐ চিঠি, নীল খাম লালকালিতে লেখা নাম। অর্পণ নিঃশব্দে খুঁলে পড়ে, চোখের জলে ভাসে, তারপর রেখে দেয় আলমারীতে। সন্ধ্যায় দেবেন্দ্র বাজান মাধুরীর সেতারখানা। এমনি চলেছে, আট বছরের খোকন ষোল বছরে পড়েছে, ম্যাট্রিক দিচ্ছে এবার, কিন্তু অর্থাভাবে আর পড়া হবে না বোধ হয়। মহেন্দ্রের বই–এর রয়েলটির টাকা বেশি আর নাই, কতদিনই বা আসবে আর! কিন্তু অর্পণার দাদা কলকাতায়। ভালো চাকুরি, করেন, তিনি কতদিনই এসে বললেন ছেলেটাকে তিনি কলকাতায় নিয়ে পড়াবে?

কলকাতায় ছেলে পাঠাতে আমার ইচ্ছে নেই দাদা। কলকাতায় পাঠিয়ে আমি মহীনকে হারিয়েছি, অর্পণা চোখের জল ফেলে বললো।

কলকাতায় না গেলে চলে না অর্পণার দাদা বললো, ওখানে যেতে হয়। যার যার নিয়তি, কলকাতা কি দোষ করলো? ছেলেটাকে দে আমার, মানুষ করি।

সব শুনে দেবেন্দ্র চুপ করে থাকলেন অনেকক্ষণ। খোকনের মামার কথায় বললেন

যাও যেখানে খুশি নিয়ে ওকে মানুষ করতে, আমি যাকে মানুষ করেছিলুম, সে আমার ঘুমিয়ে গেছে, তাকে জাগিয়ে দিও না, নিঃশব্দে নিয়ে যাও, সে যেন জানতে না পারে, এই বংশ আর কারো সাহায্য নিচ্ছে। উঠে চলে গেল অন্যত্র।

অতঃপর মামার সঙ্গে খোকন এল কলকাতায়। মামার নাম অসিত বাবু ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মধ্য কলকাতা, চাকুরী করেন গভর্ণমেন্ট অফিসে। রোজগার ভালই, তার নিজের ছেলেমেয়ে দুতিনটি। খোকন তাদের সঙ্গেই পড়াশুনা করছে। কলেজেও যাচ্ছে। কিন্তু গরীবের ছেলের পড়ার যে কত অসুবিধা, তা ভুক্তভোগীই জানে, সব বই কেনা হয়নি, মাইনেও সব মাসে যথাকালে দেওয়া হয় না, তাছাড়া কলেজের কত রকম আগডুম বাগডুম, চাঁদা তো লেগেই আছে। তবু খোকন পড়া চালিয়ে যাচ্ছে তাকে মানুষ হতে হবে। গানবাজনাও ভাল শিখেছে। দু’একটা আসরে গায় এমন করে নিজের একটু ঠাই করে নিল সঙ্গীত মহলে। কিছু রোজগারও হচ্ছে।

পূজার বন্ধে বাড়ী এল খোকন। সেই বিজয়া দশমী, সেই নীল খাম অর্পণা খুলে পড়ে রেখে দিচ্ছে। খোকন বললো–

এবার বড় হয়েছি মা দাও চিঠিগুলো পড়ে দেখি।

না খোকন, ও কি দেখবি।

দেখতেই হবে, দেখার জন্যে কাকু আমার রেখে গেছে। ঝর ঝর জল ওর চোখে। ন’খানা চিঠি সবশুদ্ধ, সবগুলোই সালের পর সাল ঠিক করে সাজিয়ে পড়লো, কোনটায় ঠিকানা নাই। অতি ভদ্ৰভাষায় অতি সংক্ষিপ্ত চিঠি। কিন্তু প্রতি অক্ষরে অন্তর নিংড়ে লেখিকা নিজেকে সমর্পণ করেছে কাকুর কাছে। কল্পনা প্রবণ কবি খোকন বেশ বুঝতে পারল, এই মাধুরী কাকুর প্রিয়তমা। সযত্নে চিঠিগুলি আবার সাজিয়ে রেখে দিল ঠিক করলো যেই হোন মাধুরী তাকে খুঁজে খোকন বের করবে। শেষের চিঠিখানায় সামান্য ইঙ্গিত রয়েছে–

ব্রজধামে আভীর, নারী গোপ–বালক এবং ধেনুদলের অভাব নেই, নেই শুধু রাখালরাজ কৃষ্ণ। কিন্তু বৃন্দাবনে নিত্য প্রেম তাকে আবার আনবেই ফিরিয়ে।

কলকাতায় ফিরলো খোকন। কাকুর প্রিয়তমার খোঁজ করতেই হবে, দেখা করতে হবে। তার সঙ্গে। অবসর সময় পরে কাজ হলো ওর প্রতি বাড়ির নাম খুঁজে ফেরা। বড় বড় রাস্তা খেকে গলি পর্যন্ত নেম প্লেট দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে, না ব্রজধাম নয়। তবু নিরাশ হয় না খোকন। সংকল্প, খুঁজে বার করতেই হবে ব্রজধাম তার কাকুর প্রিয়তমার নিবাস।

বিজয়া দশমী আসছে। প্রতি বছর এই দিনে উৎসব হয় ব্রজধামে। এ দিনেই মাধুরীর জীবনের এক পরম দিন। এ দিনই মহীন এসেছিল তাদের বাড়ীতে আজ মহীনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছে মাধুরী। গরীব দুঃখী কাঙ্গালদের মুখে হাসি ফোঁটানের কাজে অনেকটা সফল হয়েছে সে। বিরাট আয়োজন চলছে এদিনের জন্য। ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরীব ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় বিতরণের, রোগীও শিশুদের দুগ্ধ দেওয়ার।

খোকনদের কলেজ বন্ধ হয়েছে। পূজা উপলক্ষে তার মামাও ছুটি পেয়েছেন, সবাই বাড়িতে গেলেন। খোকনকেও নিতে চেয়েছিলেন সঙ্গে কিন্তু গেল না খোকন। কারণ এই সময়টাতে খোঁজ করা যাবে ব্রজধাম।

মামা বিদায়ের পর বেরিয়ে পড়ল খোকন। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল দক্ষিণ কোলকাতায়, পরিশ্রান্ত হয়ে একটা গাছের নীচে বসল খোকন। জিজ্ঞেস করল তাদের কাছে কোথায় যায়। তার জবাবে তারা ব্রজধামের কথা বলল। চমকে উঠল খোকন এবং তাদের সঙ্গে পথ ধরল। যেতে যেতে একজনকে জিজ্ঞেস করল কে থাকেন সেখানে।

তাও জান না মা লক্ষী থাকেন।

কে মা লক্ষ্মী?

কে আবার মা, লক্ষী, তাকে কে না চেনে এই কলকাতায়?

ব্রজধামে শুনে খুশীই হয়েছিল, কিন্তু তার অধিবাসিনী মা লক্ষ্মী, কে এই মা লক্ষ্মী তার কাকুর মাধুরী, না অন্য কেউ? গিয়েই দেখা যাক না।

ব্রজধামে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল খোকন। কত আয়োজন কত ব্যবস্থা। কিন্তু কে, যার জন্যে সে এতটা দূরে এসেছে, তাকে কোথায় পাওয়া যাবে জিজ্ঞাসা করল খোকন। লক্ষ্মী দেখা দেন না কাউকে

 হ্যাঁ দেখা দেন তিনি সন্তানদের। তবে এই সময় বড় ব্যস্ত। দশমীর দিন এসে সেদিন তিনি স্বহস্তে কাপড় বিতরণ করবেন, দুগ্ধ বিলাবেন। বিজয়া দশমীর দিন আসবে সে, দেখবে মা লক্ষ্মীকে, চলে যাচ্ছিল? হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা গাড়ী ছুটে গেল। খোকন সেদিকে চাইতেই আরোহীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই অন্তর তার শ্রদ্ধায় ভরে উঠল সত্যিই লক্ষ্মী এই মহিলা। খোকনের দৃষ্টি অনুসরণ করল কোথায় যান তিনি। গাড়ীটা রাস্তার পাশে থামল ডাক বাক্সটার কাছে। খোকন চেয়ে দেখলো মহিলা সেখানে নামলেন। হাতে তার একটা নীল খাম, হ্যাঁ হ্যাঁ সে খামই ত যে খাম পর পর ৯ খানা সাজানো রয়েছে তাদের বাড়ীতে। আজ অষ্টমী  হ্যাঁ আজইত ডাক করতে হবে বিজয়ার দিন পৌঁছাবার জন্যে। এই দিনই ত কাকুর নামে উপস্থিত হয় এই নীল খাম। অস্থির হয়ে পড়ল খোকন, দৌড়ে গিয়ে পায়ে লুটিয়ে কিন্তু ততক্ষণে মহিলা গাড়িতে উঠে ছেড়ে দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে খোকনকে ফিরতে হল বাড়ী।

আজ বিজয়ার দিন, খোকন আগে থাকতেই তৈরী হয়েছিল, ভোরে উঠেই ব্রজধাম গিয়ে হাজির হল। আশ্চর্য হয়ে সে আয়োজনের সমারোহ দেখে,

অষ্টমীর দিন স্বহস্তে চিঠিখানা ডাকে দিয়েছে মাধুরী। প্রতি বৎসর দেয় আজ দশমী, মহেন্দ্র আজ পাবে চিঠিটা। মুখখানা হাসিতে অনুরঞ্চিত হয়ে উঠলো সকাল থেকে অকারণ পূলকে মনটা স্পন্দিত হচ্ছে, না মস্ত বড় কারণ আছে, আজ বিজয়া দশমী মাধুরীর জীবনের বিশেষ দিন।

স্নান সেরে মহেন্দ্রের ফটোখানা সাজালো মাধুরী ফুল পাতা দিয়ে। ধুপ জ্বেলে দিল, প্রণাম করলো, তারপর বারান্দায় এসে দেখলো। লোকারণ্য, বিনামুল্যে আজ দুধ আর মিষ্টি বিতরণ করবে সে পাড়ার সব ছেলেমেয়েকে। বিকালে প্রত্যেক মেয়েকে মালা আর ফুলগুচ্ছ দেয়, আর দেয় নতুন জামা কাপড় গরীব ছেলেমেয়কে। এ পোষাক পরে তারা বিসর্জন দেখতে যায় এ পাড়ায়। দেখলো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দুধ নিচ্ছে, সবাই হাসি মুখ হৈ হুল্লার মধ্যেও আনন্দ। তৃপ্তির হাসি ফুটলো মাধুরীর মুখে। এই গরীবদের মুখে যদি হাসি না ফুটতো আজ, তবে মিছে মঙ্গল কলস হোত তার। মনে পড়লো, গাড়ীতে বসে মহীন আর মাধুরীর, দু’পয়সার বার্লি কিনতে এসে ছিল একটি মেয়ে, মেসই সুত্রপাত মহীন যদি একবার এসে দেখতো এইসব।

না, মহীনের এসে কাজ নেই, বিয়ে, বৌ, ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে আছে, তাকে তার অশক্ত দুর্বল শরীর সেবা যত্নে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠেছে, পল্লী বধুর নিপূণ পরিচর্যায় হয়তো মোটা হয়ে উঠেছে। মাধুরী ভাবতে লাগলো, তার চিঠি খানা আজ পাবে, পেয়ে কি ভাববে মহীন। নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে মাধুরীর অন্তরে সে অক্ষয়, তার স্বাক্ষর তেমনি উজ্জ্বল আছে, কিন্তু তার পল্লীবধু দেখে যদি চিঠিগুলো কি ভাববে? নিশ্চয়ই সে মাধুরীকে শত্রু ভাববে । মাধুরী তার মঙ্গলই কামনা করে ।

দশ বছরে দশখানা চিঠি লিখেছে মাধুরী। মহীনের বাঁধানো ফটোতে নয়টি দাগ রক্তের। আজ আর একটি দেবে, তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে ডান হাতের অনামিকা বিদ্ধ করলো। রক্ত পড়ছে, ফটোতে ফোঁটা দিতে দিতে বললো—

এই একবিন্দু মধু তোমায় দিলাম, রক্ত চোখের জলটা মুছে ফেললো। মাধুরী হাসছে। নিজের সিঁথিতে ঠেকালো আঙ্গুলটা। রক্ত লাগলো। প্রণাম করলো আবার। এই চিহ্নটা ওর এয়োতির। আঙ্গুলটা তুলো দিয়ে বেঁধে নিল, তারপর বেরিয়ে গেল কাজ দেখতে।

বিরাট বিস্তর আয়োজন। স্তুপাকার করা হচ্ছে। জামাকাপড় বিতরণ করা হবে। সদ্যজাত শিশু থেকে বারো বছরের ছেলেমেয়ের জন্যে নানা রকম পোশাক এ পল্লীর দরিদ্র অধিবাসীদের জন্যই। তাদের হিসাব করে টিকিট দেওয়া হয়েছে। ক’খানা লাইন দিয়ে দাড়ালো এসে, বাচ্চারা তাহাদের মার কোলে আলাদা জায়গায়। পাড়ার কোন বয়স্ক বা শ্রদ্ধা ভাজন ব্যক্তি এই পৌরহিত্য করেন, জজ ম্যাজিট্রেট, কাউকে ডাকে না মাধুরী, কিন্তু আরো কাজ আছে। ব্রজধামের বিদ্যার্থীগণ খেলাধুলা দেখাবে, আবৃত্তি করবে গান শোনাবে, ছোট মেয়েরা ফুলের মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা দেখাবে এবং আরো কত কি তার জন্যেও পুরস্কার দেবে মাধুরী। ব্যাপারটা সমারোহের তাই বিস্তর লোক দেখতে আসে।

প্রকান্ড প্যান্ডেল, অসংখ্য লোক দেখছে এই দীপ্তময়ী দেবীকে, গান হোল আবৃত্তি হলো, খেলাও হলো, পুরস্কার বিতরণ চললো, অতঃপর সারি দিয়ে দাঁড়ালা বালক বালিকাদের পোশাক বিতরণ চলছে, কতক্ষণ লাগাবে কে জানে। হয়তো রাত হয়ে যাবে, যাক তবু খোকন দেখা করবেই ওর সঙ্গে। কিন্তু তার কাছে যাবে কি করে? যা ভিড়। আর উনি যে মাধুরী দেবী, তাও তো জানা নেই। ওঁর নাম কি লক্ষ্মী দেবী? আপন মনে ভাবছে খোকন এক কোনে দাঁড়িয়ে। যা হয় হবে, ওকে গিয়েই শুধোবে খোকন মাধুরী দেবী কে?

কিন্তু এই ভিড়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সে অপেক্ষা করতে লাগলো।

জিজ্ঞেস করে জানলো, ইনি চিরকুমারী। মানব সেবাই এর ব্রত, গরীবের মা বাপ ইনি। লোকে একে পূজা করে বললেই হয়।

একটা বাচ্চা মেয়ে লাইনে, এগুতে পারছে না ভয়ে দেখে উনি বলছেন আয়, চলে আয় মা, ভয় কি? নিজেই এসে কোলে নিলেন মেয়েটাকে, তারপর তার ময়লা ছেঁড়া ফ্রকখানা খুলে নতুন রঙিন ফ্রক আর ইজের পরিয়ে চুমা খেলেন, বললেন, তোমরাই সব আমার খোকা খুকু।

সমবেত জনতা জয়ধ্বনি করে উঠলো, লক্ষীমার জয় হোক। হাত ইশারায় থামতে বললেন দেবী, আবার চললো বিতরণ। অতঃপর দুঃখী মেয়েদের শাড়ী দিয়ে সিন্দুর দিয়ে, চিবুক ছুয়ে আদর করলেন। সবাই প্রণাম করছে ওকে।

খোকনের মনে হচ্ছে, নিশ্চয় উনি মাধুরী দেবী? ছুটে গিয়ে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে ওর।

অপরাহ্ন হয়ে গেল এসব শেষ হতে, অভুক্ত ক্লান্ত লক্ষীমা ভেতরে ঢুকলেন, আর জয়গান করতে করতে ঘরে ফিরলো অন্য সকলে। শূন্য প্যান্ডেলটায় খোকন একা। লাজুকে খোকন দেখা করতে পারলো না। সেও ক্লান্ত অভুক্ত অসুস্থ বোধ করছে, ফিরে যাবে নাকি খোকন? চোখের সামনে ফটকটা বন্ধ হয়ে গেল।

শূন্য প্যান্ডেল ছেড়ে খোকন বাগানের পাশে গলি রাস্তাটায় এসে আনমনে চলতে লাগলো। শুনতে পেল, ভেতরে রেকর্ড বাজছে, তার কাকুর গলা, দোতলার পানে চাইল খোকন, না কিছু দেখা যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে গানখানা, খোকন আবার তাকালো দোতলার পানে। নিজের গলাটাও ওর সঙ্গে মিশিয়ে দিল—

তোমার আমার মিলন হবে ঐ খানে ঐ সন্ধ্যারাতে—
        বিরহিনী বসুন্ধরা আলোর লাগি যেথায় জাগে।
        ঐখানে ঐ সাগর বেলায়,
        আকাশ যেথায় আবেশ ভরে অসীমতার পরশ লাগে।
        জীবন সেথায় জেগে থাকে অতন্দ্র ঐ তারা পারা সঙ্গীতে আর সৌরভে যার বিরাম বিহীন প্রেমের ধারা—
        লীলা কমল নিত্যা হেথায় গন্ধ মধু বিলায়ে যায়, মরণ হারা সেই যমুনার কুলে মিলন তরী।

খোকন গাইছে রেকর্ডটার সুরের সঙ্গে—

মরণহারা সেই যমুনার চির রাধাশ্যাম জাগে।

কে? কে ওখানে?

প্রশ্ন করেছেন জানালায় দাঁড়িয়ে সেই করুণারূপিণী দেবী। মুখ বাড়িয়ে দেখলেন খোকনকে, আবার সন্দেহ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো—

কোখেকে কে আসছে? কি তোমার নাম?

আগ্রহ যে অতিরিক্ত বেড়ে গেছে তাঁর। কী এক প্রত্যাশায় চোখ মুখ দীপ্ত হয়ে উঠেছে। কথা বলতে বলতে ছুটে নেমে এসে ওদিকার ছোট দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন–খোকন তার অবয়ব দেখতে পায়। হ্যাঁ বস্ত্র বিতরণ করছিলেন ইনি লক্ষ্মী মা। দেবী আবার বললেন—

 তোমাকে যেন খুব চেনা মনে হচ্ছে, কাকে চাইছো? কেন এখানে দাঁড়িয়ে?

মাধুরী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। তিনি কি থাকেন এখানে?

হ্যাঁ, আমার নাম। এসোঁ। তা কে তুমি? তুমি কে, যেন চিনেই ফেলেছে ওকে, এমনি তার মুখের ভাব।

হ্যাঁ মহেন্দ্র মুখোজ্যের ভাইপো আমি, বলে খোকন প্রণাম করতে যাবে—

কোলে মাধুরী ওকে টেনে নিল। এসো মানিক, এসো আজ বিজয়া দশমী। মহীনদা ভাল আছে তো খোকন? তোমাকে পাঠিয়ে—

মাধুরী টেনে বাগানের ভিতরে আনছেন খোকনকে, এ অবস্থাতে বলল তোমাকে মুখ দেখেই চিনতে পেরেছিলাম তোমার কাকুর মতন গড়ন কিনা, আর গলাটও তেমনি মিষ্টি। এস, সবাই ভাল আছে তো খোকন তোমার মা বাবা আর? কথাটা শেষ করলো না, হয়তো মহীনের স্বীয় কথা শুধাতে চায়। একেবারে ঝিলের ধারে নিয়ে এল খোকনকে, কথা বলে। চলছে মাধুরী তুমি তো ওর ভাইপো, মহীনের ক’টি ছেলেমেয়ে খোকন?

বিয়ে তো করেননি, কাকু। ছেলেমেয়ে নেই।

অ্যাঁ, বলে আকস্মাৎ মাধুরী যেন অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো, পর মুহূর্তেই সুন্দর হাসিতে মুখ স্নিগ্ধ সুন্দর হয়ে উঠলো, সে মুখ এতো সুন্দর আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন বিয়ের কনে, অনুরূপ–সে মূর্তি।

দেখলো খোকন, তার অনুভূতিময় অন্তর দিয়ে অনুভব করলো মাধুরীকে আপনার প্রেমে আপনি পরিপূর্ণ এক গরীয়সী রাধা যেন।

ভাবছে খোকন, কাকুর বিষয় কিছুই ইনি জানেন না, এর লেখা চিঠিতেই সেটা বোঝা যায় কাকুর কথাটা জানাবার জন্যেই খোকন এখানে এসেছে আজ কিন্তু কেমন করে জানাবে খোকন। আরেকবার চেয়ে দেখলো ঐ দীপ্তিময়ী কে। মাধুরী বলছে

বিয়েই করলো না? আশ্চর্য। ভেবেছিলাম ওকে হারিয়ে। আচ্ছা থাক ও কথা। হাসিটা চাপাতে পারছে না মাধুরী, কিন্তু স্নেহের উজ্জ্বলতা ওকে নবোঢ়া বধু থেকে সন্তানের জননী পর্যায়ে উন্নীত করে দিল, ঝিলের ঘাটে আনলো খোকনকে। বলল

এই যে ছেলে, এখানে দাঁড়াও আমার কোল ঘেঁষে। হ্যাঁ তোমার কাকু বলে, বিশ্বে যত মা সবার চেহারা এক রকম দেখতে। আমার চেহারাটা এই রকম হয়েছে কিনা? হাসছে মাধুরী, হাসছে খোকনের মুখ পানে চেয়ে। একি উচ্ছাস এক দুকুলপ্লাবী স্নেহের স্রোতস্বিনি। কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে খোকনের। কি করে সামলাবে খোকন।

চল ঐ নৌকায় বসে, তোমার কাকু এখানে আমায় প্রণব নাদ শোনাতঃ টেনে আনলো খোকনকে। জীর্ণ সেই নৌকাটা সযত্নে বাধা আছে।

ডুববে না, বসো এখানে কোথায় থাক খোকন?

লেবুতলায়, খোকন কথাটা শেষ করবার পূর্বেই মাধুরী, আবার বললো–

তুমি আজ আমার কাছে থাকবে। কাকুকে বলবে আমার কাছে ছিলে এই বিজয়া দশমীতে। বসো তোমার জন্যে খাবার আনতে বলি, বলেই মাধুরী ডাক দিল জোরে–

যত রকম ভাল খাবার আছে, নিয়ে আয় এখানে। খোকনকে বললো–ঝিলের জলেই হাত মুখ ধোবে নাকি বাথরুম যাবে?

না, এখানেই ধুই, বেচে গেল খোকন। চোখের জলটা ধুয়ে ফেলো। ঝিলের জলে মাধুরী লক্ষ্য করে নাই, কি এক স্বর্গীয় আনন্দে ও ভরপুর। তোমার কাকুর স্বাস্থ্যটা এখন নিশ্চয় ভাল হয়েছে, না খোকন?

আরেক আঁজলা জল চোখমুখে দিয়ে খোকন কান্না চাপলো। রাশীকৃত খাবার নিয়ে এল ঝি সন্দেশ রাবড়ি রসগোল্লা, দৈ কিন্তু মাধুরী খোকনকে বলল কাকু তোমার দুধ খাওয়াতে পারেনি ছোটবেলায়, সে কি দুঃখ তার। তাই আমি এখানে সব খোকা খুকুদের দুধ খাওয়াই, মা তো দুধই খাওয়াবে কি বল?

হ্যাঁ খোকন আরেক আঁজলা জল ছুঁড়ে দিল চোখে মুখে।

এখন তো দুধ খেতে পাও খোকন?

 হ্যাঁ, গাই আছে আমাদের বাড়িতে। কথাটা বলে শেষ করবার আগে আগেই মাধুরী বললো তোমার কাকু তাহলে ভালই রোজগার করে। ঘর সংসার শ্রী ফিরিয়েছে কেমন? তোমাকে তো কলকাতায় রেখে পড়াচ্ছে তোমায় ছেড়ে সে থাকতে পারে তো? দিনের মধ্যে কতবার যে তোমার নাম করতো–হাসছে মাধুরী।

আর সামলাতে পারছে না খোকন। কান্নায় ফেটে পড়ছে চোখ দুটো ওর। পকেট থেকে আধা ময়লা রুমালটা বের করে কড়কড়ে মুখ মুছছে, প্রকাশ হয়ে যাবে হয়তো কাকুর মৃত্যুর সংবাদ। না, কান্না ওকে রোধ করতেই হবে, খোকন অতি কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছে। কাকু যে এর মাঝে আজো জীবিত, কি করে খোকন জানাবে এঁকে মৃত্যু সংবাদ, না জানাতে পারবে না খোকন এই স্বপ্নময়ীর ঘুম ভাঙাবে না সে।

এসো, মাধুরী একটা সন্দেশ তুলে ওর মুখে দিচ্ছে– স্নেহশীতল মাতৃহস্ত বললো–বাজারের নয়, আমি নিজে তৈরী করেছি, দুধ ছানা সব এখানে তৈরি করি। তোমার কাকুকে বলো, তার খোকনের মত হাজার খোকন নিত্য দুধ খায়। খাও, মুখে দিয়ে বললো–

এতো মিষ্টি গলা তোমার। গান শিখছো খোকন?

হ্যাঁ অল্প, কথা খোকন বলতে পারছে না, অসহ্য আর্ততায় স্বরটা গলায় আটকে যাচ্ছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায় সর্বাঙ্গ। কিন্তু আবার বললো মাধুরী তোমার কাকুর সেই সেতারটা বাজায় তো খোকন? এখনো সেটা বাজে?

 হ্যাঁ খুব ভাল বাজে! অত ভাল সেতার আর নেই ওখানে।

আচ্ছা, তোমাকে আরেকটা কিনে দিব আমি। খাও সবগুলো খাও লক্ষ্মী ছেলেটি, খেয়ে নাও। শেষে দুধ খাবে, ওর সর্বাঙ্গে হাত বুলুচ্ছে মাধুরী, পুত্র বিরহিনী মা যেন।

তোমার আর তো ভাই বোন নেই।

না, ওগুলো কি ফুল? খোকন নিজেই সামলাবার জন্যে কথা পালটাতে চায়।

ওগুলো? তোমার কাকুর ভাষাতেই বলি, ও নিজেই ওর পরিচয় যেমন তোমায় দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম হাসলো মাধুরী অম্লান সুন্দর হাসি গিলতে পারছে না, অশ্রুবাষ্প আটকে আছে গলায়, বললো–

আর খেলে হাঁটতে পারবো না, দুধটা খাই চোখের জল আবার সামলালো গেলাসের আড়ালে।

সে কি তোমাদের সবই অমনি। তোমার কাকুও খুব কম খায়, খাবে ভালো করে।  

হ্যাঁ, খোকন চোঁ চোঁ করে দুধ গিলছে।

আস্তে আস্তে খাও। চল, তোমায় ভেতরে নিয়ে যাই।

আমি কাউকে কিছু বলে আসিনি, সবাই খুঁজবে বলে খোকন দুধের গ্লাসটা নামিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে যাবার আগেই মাধুরী আঁচল দিয়ে মুছে দিল বললো–

নাইবা গেলে আজ। আমার সঙ্গে গাড়ীতে বসে প্রতিমা বিসর্জন দেখবে। তোমার কাকুর সঙ্গে এই কথা আছে আমার তারপর সারারাত তোমাদের বাড়ির গল্প শুনবো।

হ্যাঁ, কিন্তু না আমার মামাতো বোনকে সঙ্গে নিয়ে বিসর্জন দেখতে যাব, না গেলে সে কাঁদবে। তাছাড়া বিজয়ায় প্রণাম করতে হবে, মিথ্যাই বললো খোকন। মানুষের যে মিথ্যা বলার কত দরকার আর সামলাতে পারছে না। পালাতে পারলে বাঁচে সে। মাধুরী বললো

বেশ যাবে, হাসলে মাধুরী, হাতটা ধরে টেনে বললো, বলেই চলেছে–

তোমার কাকুকে একবার আসতে বলো খোকন, বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। বলো যে পথিবীর আদিম দিন আর নেই সে এখন ফলে ফুলে ভর্তি, অগণ্য তার সন্তান সন্তান এখন মেঘের আড়াল থেকে বেরুতে পারে।

হাসলে মাধুরী, হেসে বললো

তোমার কাকুর চিন্তা আর ভাষা অসাধারণ কিনা তারই ভাষায় বললাম কথাগুলো। এসো–

খোকন নত হয়ে প্রণাম করবার ছলে চোখের জলটা সামলে নিল আবার কিন্তু মাধবী সস্নেহে ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলছে–

বলো যে “মধু জমলে মোম হয় তখন আর গড়িয়ে যায় না” হাসছে মাধুরী

ওটা তোমার কাকুর জন্য, ও তোমার বুঝে কাজ নেই। আসতে বললো তাকে একবার

খোকন আর কথা কইতে চাইছে না, কইতে পারছে না।

ওকে এগিয়ে দেবার জন্যে মাধুরী সেই ছোট দরজাটার কাছে এলো। খোকন আবার প্রণাম করলো ওকে। মাথায় হাত দিয়ে বললো–

বেঁচে থাকো। বংশের গৌরব হয়ে বেঁচে থাকো।

ঠিক কাকুরই শেষ কথাটা,খোকন গট গট করে হাঁটছে।

ওকে একটিবার আসতে বলো খোকন মাধুরীর কণ্ঠ ঝংকার দিল আবার।

খোকন চলতে চলতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দ্রুত হেঁটে চলছে। পালিয়ে যেতে হবে, যত শীঘ্র পারে ওর কাছ থেকে পালাবে খোকন।

না, বলা হলো না বলতে পারলো না খোকন, কাকু নেই। কাকু যে ওর কাছে আছেন, ওর অন্তরে কাকু যে আজো জীবিত।

মোড়ের মাথায় এসে খোকন তাকালো একবার মাধুরী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাত তুলে বললেন–কাকুর সঙ্গে আবার এসো খোকন।

দ্রুত সরে গেল খোকন সেই ডাক বাক্সটার কাছে। দু’হাতের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়লো অসহ্য বেদনায় ওর সারা অংগ কাঁপছে– চোখের জলের বন্যা নেমেছে দুই গণ্ডে। ডাকবাক্সে মাথা রাখলো।

তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে।

5 Comments
Collapse Comments
মোঃ আনোয়ার April 6, 2021 at 12:21 pm

উপন্যাসটা কি এখানেই শেষ?

Mostafizur Rahman July 15, 2022 at 10:48 am

এই উপন্যাসটা এত বার পড়েছি তবু ক্লান্ত হইনা ।শেষ অংশে এসে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে !

হয়তো ভেবেছিলাম মাধুরী আর মহীন এক হয়ে যাবে।খুব সুন্দর লাগল উপন্যাস টি।

এই উপন্যাসের নাম জেনেছিলাম আমার শিক্ষকের কাছে, তাও বছর দশেক আগে। তার কয়েকমাস পরেই পড়েছিলাম। এক নিশ্বাসে পড়া এ উপন্যাস আজও আমার জীবনে পঠিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বহু বছর পর আজ আরও একবার শেষ পরিচ্ছদের এই দুখানুভূতি কন্ঠটা কেমন শক্ত করে দিলো।

উপন্যাসের শেষে এত ভয়ংকর ভালোবাসা থাকবে বুঝতে পারি নিই!!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *