৮. দুই দিন গত হইয়াছে

দুই দিন গত হইয়াছে।

বেলা দ্বিপ্রহর। শহরের পথে লোকারণ্য। সকলেই যেন একটা কিছুর প্রতীক্ষা করিতেছে। এই জনতার মধ্যে একস্থানে নানাভাইকে দেখা গেল, বহিরাগত গ্রাম্য-দর্শকের মত সে কৌতূহলভরে এদিক-ওদিক তাকাইতেছে। অন্যত্র একটি পানের দোকানের পাশে ভীমভাই চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহার চোখে দুঃস্বপ্ন দেখার বিভীষিকা। ইহাদের দেখিয়া অনুমান হয়, প্রতাপের দল শহরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।

সহসা জনতার চাঞ্চল্য স্তব্ধ হইল। সকলে দেখিল, একদল সিপাহী কুচকাওয়াজ করিয়া আসিতেছে; তাহাদের পিছনে একটি অশ্ববাহিত শকট। শকটের পিছনে আবার একদল সিপাহী।

শকটের আকৃতি বাঘের খাঁচার মত, উপরের ছাদ ও চারিদিক মোটা মোটা লোহার গরাদ দিয়া ঘেরা। এই শকটের মধ্যে চিন্তা ও প্রতাপ দাঁড়াইয়া আছে; তাহাদের বাহু পরস্পর শৃঙ্খল দিয়া বদ্ধ।

জনসঙ্ঘ ক্ষুব্ধমুখে বিদ্রোহভরা চোখে দেখিতে লাগিল। সেনা রক্ষিত কারাগারের শকট বন্দীদের লইয়া চলিয়া গেল।

নানাভাই গ্রামিক-সুলভ সরলতায় পাশের একটি নাগরিককে জিজ্ঞাসা করিল,

বাবুজী, ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

নাগরিক তিক্তস্বরে বলিল,–

আদালতে। সাহুকারেরা আইন ভঙ্গ করবে না, রীতিমত বিচার করে ওদের ফাঁসি দেবে।

.

বিচারভবনের সম্মুখের বিস্তৃত মাঠে বিপুল জনতা সমবেত হইয়াছে। কোতোয়ালীর অগণ্য সিপাহী বিচারগৃহ রক্ষা করিতেছে। মাঝে মাঝে জনতরঙ্গ বিচারগৃহের দিকে ঝুঁকিতেছে আবার সিপাহীদের দ্বারা প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসিতেছে। ইহারা বিদ্রোহী নয়, উত্তেজিত নাগরিক জনমণ্ডলী; ইহারা কেবল দেখিতে চায় শুনিতে চায় কীভাবে প্রতাপ বারবটিয়ার বিচার হইতেছে।

বিচারগৃহের মধ্যেও তিল ফেলিবার ঠাঁই নাই। গোকুলদাস প্রমুখ মহাজনগণ আগে হইতেই বিচারকক্ষ জুড়িয়া বসিয়াছেন। বিচারকের আসন যিনি অলঙ্কৃত করিয়াছেন তিনি একটি শীর্ণকায় তির্যকচক্ষু বৃদ্ধ, শেঠগণের দিকে একচক্ষু রাখিয়া তিনি বিচারের অভিনয় করিতেছেন। তিনি জানেন, আসামীদের ফাঁসির হুকুম তাঁহাকে দিতেই হইবে; অথচ দেশের বিপুল জনমত কাহার প্রতি সহানুভূতিশীল তাহাও তাঁহার অজ্ঞাত নহে। তাই বিচারাসনে বসিয়া তাঁহার ক্ষীণ-দেহ থাকিয়া থাকিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে।

আসামীর কাঠগড়ায় প্রতাপ ও চিন্তা পাশাপাশি দাঁড়াইয়া। বিচারের অভিনয় দেখিয়া প্রতাপের মুখে মাঝে মাঝে চকিতে বিদ্রূপের হাসি খেলিয়া যাইতেছে।

.

শহরের দরিদ্র-অঞ্চলে একটি জীর্ণ কুটির। ইহা লছমনের বাসস্থান; সম্প্রতি প্রতাপের দস্যুদল এই গৃহেই আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে।

কুটিরের দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ; কিন্তু পাশের একটি ক্ষুদ্র চতুষ্কোণ জানালায় দাঁড়াইয়া তিলু উৎকণ্ঠিতভাবে বাহিরের পানে তাকাইয়া আছে।

এই সময় বৃদ্ধ লছমনকে আসিতে দেখা গেল। তিলু তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিল।

কী খবর লছমনভাই?

লছমনের ক্লান্ত দেহ যষ্টি নুইয়া পড়িতেছিল; সে দরজা ভেজাইয়া দিয়া ঘরের মধ্যস্থলে মেঝের উপর বসিয়া পড়িল। ঘরের এককোণে কেবল ভীম জানু বাহুবদ্ধ করিয়া বসিয়াছিল, সে মুখ তুলিয়া চাহিল।

তিলু লছমনের সম্মুখে বসিয়া ব্যগ্রস্বরে আবার প্রশ্ন করিল,–

লছমনভাই, কিছু খবর পেলে?

লছমন বলিল,—কী আর খবর পাব বেন? আমি বুড়োমানুষ, ভিড়ের মধ্যে তো ঢুকতে পারিনি, বাইরে থেকে যেটুকু খবর পেলাম—

কী খবর পেলে?

শয়তানেরা শুধু প্রতাপ আর চিন্তাকে ধরেই সন্তুষ্ট নয়, দলের আর সবাইকে ধরতে চায়।

ভীমভাই উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল।

তিলু সংহতকণ্ঠে বলিল,-তারপর?

লছমন বলিল,-প্রতাপকে হাকিম হুকুম করেছিল—তোমাদের দলে কে কে লোক আছে তাদের নাম কর। প্রতাপ তার মুখের মত জবাব দিয়েছে, বলেছে কত নাম করব, দেশের সমস্ত লোক আমার দলে। বাইরে জনসমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছ না? ওরা সব আমার দলে। আজ শুধু ওদের গর্জন শুনছ, একদিন ওরাই বন্যা হয়ে তোমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

বলিতে বলিতে লছমনের নিষ্প্রভ চক্ষু চকচক করিয়া উঠিল, তিলু রুদ্ধ নিশ্বাস ত্যাগ করিল। ভীমভাইয়ের মুখে কিন্তু কোনই প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না, সে যেন কিছুই ভাল করিয়া বুঝিতে পারে নাই, এমনিভাবে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া রহিল।

.

ওদিকে আদালতের সম্মুখে অসংখ্য নরমুণ্ড পূর্ববৎ ভিড় করিয়া আছে।

বিচারকক্ষের অলিন্দে একজন তকমা-পরা রাজপুরুষ দেখা দিল। সে হাত তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিল,-

প্রতাপ বারবটিয়ার বিচার আজ মুলতুবি রইল। কাল আবার বিচার হবে এবং রায় বেরুবে।

জনতা সংক্ষুব্ধ হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল।

.

কুটিরের কক্ষে তিলু ভীমভাইয়ের পাশে দাঁড়াইয়া তাহার কাঁধে নাড়া দিতেছিল আর বলিতেছিল—

কী হয়েছে তোমার? সবাই বাইরে গেছেন আর তুমি ঘরে বসে আছ? প্রতাপভাইয়ের এই বিপদে তোমার কি কিছুই করবার নেই?

ভীমভাই বলিল,-কি করব?

তিলু বলিল,-কি করবে তা কি আমি মেয়েমানুষ তোমাকে বলে দেব? মরদ হয়ে তুমি এমন ভেঙে পড়েছ ছি ছি ছি

বিরক্ত করো না—আমাকে আর বিরক্ত করো না। বলিয়া ভীমভাই জানুর মধ্যে মুখ গুজিল।

এই সময়ে নানাভাই, প্রভু ও পুরন্দর ফিরিয়া আসিল। সকলেরই মুখ গম্ভীর বিষণ্ণ। নানাভাই লছমনের কাছে বসিয়া সনিশ্বাসে বলিল,-

ওদের ছাড়বে না সাহুকারেরা–ফাঁসি দেবে।

প্রভু বলিল,-আজ মোকদ্দমা মুলতুবি রাখবার কারণ কি জানো? ওদের ভয় হয়েছে, ফাঁসির হুকুম দেবার পর বেশী দিন দেরি করলে দেশের লোক ক্ষেপে গিয়ে প্রতাপকে জোর করে ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে। তাই কাল ফাঁসির রায় দেবে আর সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি দেবে। আজ রাত্রেই ওরা ফাঁসির আয়োজন ঠিক করে রাখবে, তারপর শহরের লোক তৈরি হবার আগেই কাজ শেষ করে ফেলবে।

ভীমভাই তড়িৎপৃষ্ঠের মত উঠিয়া দাঁড়াইল; তাহার দুই চোখ যেন ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে।

কাল ফাঁসি দেবে? কাল?

পুরন্দর বলিল,-আমারও তাই মনে হয়। ফেরবার সময় দেখলাম, গরুর গাড়ি বোঝাই করা বড় বড় তক্তা আর শালের খুটি নিয়ে গিয়ে আদালতের সামনে মাঠে ফেলছে—বোধ হয় ঐখানেই ফাঁসির মঞ্চ খাড়া করবে।

ভীমভাইয়ের কণ্ঠ হইতে একটা অবরুদ্ধ শব্দ বাহির হইল। সে কাহাকেও কিছু না বলিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল। তিলু চেঁচাইয়া উঠিল,

কোথায় যাচ্ছ তুমি?

এখানে আর নয় বাইরে। শহরের বাইরে— বলিতে বলিতে ভীম দ্বারের বাহিরে অদৃশ্য হইল। সকলে নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। প্রতাপ-চিন্তা ধরা পড়িবার পর হইতে ভীমভাইয়ের অদ্ভুত আচরণে সকলের মনেই খটকা লাগিয়াছিল, তবু ভীমভাইকে প্রাণভয়ে ভীত কাপুরুষ মনে করিতে সকলেরই মনে সঙ্কোচ বোধ হইতেছিল। কিন্তু এখন আর কাহারও সন্দেহ রহিল না। সকলে লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া রহিল। তিলু মুখে আঁচল ঢাকা দিয়া কাঁদিয়া উঠিল,-

ছি ছি ছি—আমার অদৃষ্টে এই ছিল। কাপুরুষ—আমার স্বামী কাপুরুষ

.

আদালতের সম্মুখস্থ ময়দানে ছুতারমিস্ত্রিরা কাজ করিতেছে; তক্তা ও খুঁটির সাহায্যে একটি চতুষ্কোণ-মঞ্চ গড়িয়া উঠিতেছে। মঞ্চটি দুই হাত উচ্চ, লম্বায়-চওড়ায় প্রায় দশ হাত। মঞ্চের মধ্যস্থলে দুইটি মজবুত খুটি খাড়া করিবার চেষ্টা হইতেছে।

ছুতারদের হাতুড়ির ঠকাঠক্ আওয়াজ বহুদূর পর্যন্ত সঞ্চারিত হইতেছে।

ময়দানের প্রান্তে দাঁড়াইয়া একটি গাছের আড়াল হইতে ভীমভাই এই দৃশ্য দেখিল, তারপর পিছু ফিরিয়া দৌড়িতে আরম্ভ করিল।

.

সন্ধ্যা হয় হয়। শহরের উপকণ্ঠে রাজপথের পাশে একটি অর্ধশুষ্ক পল্বল। একদল ধোপা এই পল্বলে কাপড় কাচিতেছে। পথিপার্শ্বস্থ তরুমূলে তাহাদের গর্দভগুলি একটি বৃক্ষকাণ্ডে হেলান দিয়া দণ্ডায়মান অবস্থায় নিদ্রাসুখ উপভোগ করিতেছে।

শহরের দিক হইতে ভীমভাইকে আসিতে দেখা গেল। সে এখনও দৌড়াইতেছে, কিন্তু তাহার গতি তেমন দ্রুত নয়।

গর্দভদের নিকটবর্তী হইয়া ভীমভাই থামিল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল রজকেরা আপনমনে কাপড় কাচিতেছে। সে তখন পথ হইতে একটি কঞ্চি তুলিয়া লইয়া সন্তর্পণে একটি গাধার নিকটবর্তী হইল।

নিদ্রালু গাধাটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট। ভীমভাই বিনা আয়াসে তাহার পিঠে উঠিয়া বসিল। গাধা আপত্তি করিল না। ভীমভাই তাহার পশ্চাদ্দেশে কঞ্চির আঘাত করিতেই গাধা দুলকি চালে চলিতে আরম্ভ করিল।

ধোপারা কিছুই লক্ষ্য করিল না।

.

পরদিন মধ্যাহ্ন। বিচারগৃহের সম্মুখে তেমনি বিপুল জনসমাগম হইয়াছে। আজ সরকারী প্রহরীর সংখ্যা অনেক বেশী; ফৌজী কুর্তাপরা বন্দুকধারী সান্ত্রীর দল বিচারগৃহটিকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে।

যে মঞ্চটি কাল প্রস্তুত হইতে দেখা গিয়াছিল তাহা যে সত্যই ফাঁসির মঞ্চ তাহাতে সন্দেহ নাই। মঞ্চের উপর যুগল খুঁটির শীর্ষে আড়া লাগিয়াছে, আড়া হইতে পাশাপাশি দুইটি দড়ি ঝুলিতেছে। একজন যমদূতাকৃতি ঘাতক মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া দড়ি দুটিকে টানিয়া-টানিয়া তাহাদের ভারসহন ক্ষমতা পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছে।

কিন্তু পরিহাস এই যে বিচার এখনও শেষ হয় নাই। বিচারকক্ষে হাকিম মহোদয় রায় দিবার পূর্বে বিলক্ষণ বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন। কখনও নথিপত্র উল্টাইয়া দেখিতেছেন, কখনও কলম লইয়া কাগজে কিছু লিখিতেছেন। মামলার সমস্ত কার্য শেষ হইয়াছে, এখন কেবল দণ্ডাদেশ দেওয়া বাকি। ঘরসুদ্ধ লোক রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করিয়া আছে। আসামীর কাঠগড়ায় প্রতাপ ও চিন্তা নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়াইয়া। হাকিমের আদেশ কি হইবে তাহা তাহারা জানে, তাই সে বিষয়ে তাহাদের কোনও ঔৎসুক্য নাই।

অবশেষে বিচারক মহাশয় প্রতাপ ও চিন্তার প্রতি তির্য-দৃষ্টিপাত করিয়া গলাখাঁকারি দিলেন,

প্রতাপ বারবটিয়া, চিন্তা পানিহারিন, গুরুতর অভিযোগে তোমাদের বিচার হয়েছে—তোমরা রাজদ্রোহিতা এবং নরহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত। বিচারে তোমাদের অপরাধ সম্পূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। আমি তাই ধর্মাসনে বসে দণ্ডাজ্ঞা প্রচার করছি—তোমাদের শাস্তি প্রাণদণ্ড।

.

নগরের উপকণ্ঠে একদল অশ্বারোহী-সৈনিক অতিদ্রুত ছুটিয়া আসিতেছে। তাহারা কে, লক্ষ্য করিবার পূর্বেই ক্ষুরোদ্ধৃত ধূলিতে চারিদিক আচ্ছন্ন করিয়া তাহারা চলিয়া গেল।

.

বিচারালয়ের সম্মুখে মঞ্চ ঘিরিয়া জনসমুদ্র আবর্তিত হইতেছে। এই জনাবর্তে নানাভাই আছে, প্রভু পুরন্দর আছে, লছমন ও তিলু আছে; তাহারা ঘুর্ণিচক্রের উপর খড়কুটার মত মঞ্চের আশপাশে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। তিন সারি সিপাহী মঞ্চকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং ঘূর্ণমান জনতাকে মঞ্চ হইতে পৃথক রাখিয়াছে।

কোতোয়ালের অধীনে একদল বন্দুক-কিরিচধারী সান্ত্রী বিচারকক্ষ হইতে বাহির হইয়া আসিল; তাহাদের মধ্যস্থলে চিন্তা ও প্রতাপ। তাহারা সদলবলে জনতাকে বিভিন্ন করিয়া মঞ্চের নিকট উপস্থিত হইল। কোতোয়াল প্রতাপ ও চিন্তাকে লইয়া মঞ্চের উপর উঠিলেন—আর সকলে নীচে রহিল।

আবর্তনশীল জনতা সহসা নিশ্চল ঊর্ধ্বমুখে মঞ্চের পানে চাহিয়া রহিল। সমস্ত জনসঙ্ঘের মিলিত নিশ্বাসে একটা মর্মরধ্বনি উঠিল।

তিলু মঞ্চের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল; প্রতাপ ও চিন্তাকে ফাঁসির মঞ্চের উপর দেখিয়া তাহার আত্মগোপনের প্রবৃত্তি আর রহিল না, সে কাঁদিয়া ডাকিল,

প্রতাপভাই। চিন্তাবেন।

তিলুকে দেখিয়া প্রতাপ ও চিন্তার মুখে কোমল স্নেহার্দ্র হাসি ফুটিয়া উঠিল; তাহারা অন্যান্য সঙ্গীদের দেখিবার আশায় জনতার মধ্যে চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল। নানা, প্রভু, লছমন ও পুরন্দরের সঙ্গে চোখাচোখি হইল। চোখের ইশারায় সকলে বিদায় লইল।

ইতিমধ্যে জনতা সংক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতেছিল। সজ্ঞান কোনও চেষ্টা না থাকিলেও জোয়ারের তরঙ্গের মত জনতার উচ্ছাস মঞ্চের প্রান্ত পর্যন্ত আসিয়া পড়িতেছিল, আবার প্রহরীদের বাধা পাইয়া পিছু হটিতেছিল। দেখিয়া কোতোয়াল মহাশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। বিলম্ব করিলে অনর্থ ঘটিতে পারে। তিনি জল্লাদকে ইঙ্গিত করিলেন।

প্রতাপ ও চিন্তার গলায় জল্লাদ দড়ির ফাঁস পরাইল। জনারণ্য নিশ্বাস লইতে ভুলিয়া গেল, কেবল সহস্রচক্ষু হইয়া চাহিয়া রহিল।

সহসা বিশাল জনসঙ্ঘের রুদ্ধশ্বাস নীরবতা বিদীর্ণ করিয়া ঘোর তুর্যধ্বনি হইল। সকলে চমকিয়া দেখিল, একদল অশ্বারোহী সিপাহী জনব্যুহ ভেদ করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতেছে, তাহাদের অগ্রে সর্দার তেজ সিং ও ভীমভাই।

তেজ সিং ও ভীম ঘোড়া হইতে লাফাইয়া মঞ্চের উপর উঠিলেন। ভীম কোনও দিকে দৃকপাত না করিয়া ছুটিয়া গিয়া প্রতাপকে জড়াইয়া ধরিল।

ওদিকে তিলু মঞ্চের নিম্নে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে মঞ্চের উপর উঠিবার চেষ্টা করিতেছিল, তেজ সিং চিনিতে পারিয়া তাহাকে হাত ধরিয়া তুলিয়া লইলেন। তিলু দরবিগলিত নেত্রে গিয়া চিন্তার কণ্ঠলগ্না হইল।

তেজ সিংয়ের হাতে একখণ্ড কাগজ ছিল; সেই কাগজ উর্ধে আন্দোলিত করিয়া তিনি জনতাকে সম্বোধন করিলেন,

আমি সর্দার তেজ সিং রাজার পরোয়ানা এনেছি। আমাদের মহানুভব রাজা চিন্তাবাঈ এবং প্রতাপ সিংয়ের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে তাদের মুক্তি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই পরোয়ানার দ্বারা মহামহিম রাজা সর্দার প্রতাপ সিংকে তাঁর রাজ্যের প্রধান কোতোয়াল নিযুক্ত করেছেন। আজ থেকে এ রাজ্যের রাজশক্তি এবং প্রজাশক্তির মিলন হল। যিনি প্রজার পরম বন্ধু ছিলেন, তিনি রাজার প্রতিভূ হলেন; যিনি এতদিন গোপনে গোপনে অসহায়কে সাহায্য করেছেন, দরিদ্রকে ধনীর উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করেছেন, তিনি আজ প্রকাশ্যে রাজার দক্ষিণহস্তস্বরূপ হয়ে সেই মহাকর্তব্য পালন করবেন। আজ থেকে আমাদের নবজীবনের আরম্ভ হল। জয় হোক—সর্দার প্রতাপ সিংয়ের জয় হোক।

বিরাট জয়ধ্বনিতে আকাশ বিদীর্ণ হইয়া গেল। প্রতাপ ও চিন্তা তেজ সিংয়ের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা যুক্তকরে গণদেবতাকে অভিবাদন করিল।

.

উপসংহারে দেখা গেল, তিলু ও ভীমভাই ফাঁসির রজ্জুদুটির প্রান্ত একত্র করিয়া গ্রন্থি দিয়া উহাকে ঝুলায় পরিণত করিয়াছে এবং তাহার উপর বসিয়া পরমানন্দে দোল খাইতেছে।

1 Comment
Collapse Comments

Shardindu was a great novelist.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *