৭. মার্স আলটর

৩১. মার্স আলটর

সোমবার সারাদিন অবিশ্রান্তভাবে দাঁড় বেয়ে চলল দাঁড়িরা। ক্যাপিটানা প্রসপেরাকে সবার পিছনে রেখে এক সারিতে পানি কেটে এগিয়ে চলেছে ফ্লিট। ক্যাপিটানার সামনে রয়েছে অত্যন্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটা আন্দালুসিয়ান গ্যালিয়ন। ভাসমান একটা দুর্গ বলা যায় এটাকে। চারটা গ্যালি টেনে নিয়ে চলেছে। এটাকে। প্রিন্স অভ অরেঞ্জের সঙ্গে রীতিমত তর্ক-বিতর্ক করে অত্যন্ত ভারী এই গ্যালিয়নটা ফ্লিটের সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্রসপেরো। প্রিন্স প্রথমে রাজি হতে চায়নি। কারণ, এই ভীমকায় জাহাজটা দ্রুত নড়তে পারে না। প্রিন্স এই যুক্তি দিয়েই বলেছিল, যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে লেজ গুটিয়ে পালানো দরকার, তখন অনুকূল বাতাসের সহায়তা না পেলে এই জাহাজটা কেবল দেরিই করিয়ে দেবে।

কিন্তু প্রসপেরোর মাথায় তখন একটাই চিন্তা, যদি অতগুলো গ্যালির বিরুদ্ধে সত্যিই লড়তে হয় তাহলে নিজের পাল্লা যতটা সম্ভব ভারী করতেই হবে। নইলে লড়াই থেকে ফিরতে হবে না। কাজেই প্রিন্সের সামনে ও তুলে ধরল রাউণ্ডশিপ চালানোয় কারবাজালের দক্ষতার কথা। এবং কারবাজালও ওকে সমর্থন দিয়ে বলল এই গ্যালিয়নটা দরকারের সময় তিনটা গ্যালির সমান লড়তে পারবে। ফলে অনিচ্ছা থাকলেও ভাসমান দুর্গ ইমাকুলাটা নামের গ্যালিয়ন দিতে রাজি হলো প্রিন্স। প্রয়োজনীয় লোক লস্করও সরবরাহ করল। দ্রাগুতের কাছ থেকে পাওয়া তুর্কি গ্যালিটাকেও ফ্লিটে নিয়ে নিল প্রসপেরো। চুক্তিভুক্ত বোনেভোগলেদের নেয়া হলো এর মাল্লা আর নাবিক হিসেবে। এখন ওরা দাঁড় বাইছে বটে, কিন্তু দরকারের সময় দাঁড় ফেলে আরাকুইবাস আর ক্রসবো তুলে নিতে একটুও দেরি করবে না। প্রসপেরোর ইচ্ছানুযায়ী ফ্লিটে মুসলিম আর খ্রিস্টান দাঁড়িদের আলাদা আলাদাভাবে গ্যালিতে তোলা হয়েছে। এদের ভাগ করা হলে দেখা গেল আসাদ সহ ফ্লিটের পাঁচটা গ্যালিতেই উঠেছে। খ্রিস্টান দাসেরা। এদের কেউ যুদ্ধবন্দি, কেউ ধর্মদ্রোহী, ইহুদি বা অপরিচিত ধর্মাবলম্বী। এদের অনেককে রোমের হোলি অফিস থেকে শাস্তি হিসেবে দাঁড় বাইতে পাঠানো হয়েছে। এরা ছাড়াও ইটালি আর স্পেন থেকে আসা সাধারণ কিছু অপরাধীও আছে। অপরাধের শাস্তি হিসেবে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ওদেরকে জাহাজের দাঁড় বাইতে হবে। মুসলিম ব্যতীত এসকল দাস কাম মাল্লাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যুদ্ধ শুরু হলে ওদেরকে শেকলমুক্ত করে হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। জান বাজি রেখে লড়াইয়ে নামতে হবে সবাইকে। এবং লড়াই থেকে যারা জীবিত ফিরবে, পুরস্কার হিসেবে বন্দরে পৌঁছে তাদের সবাইকে দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয়া হবে।

খবরটা ভীষণ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে দাসেরা। এখন ওরা জান বাঁচানোর জন্য লড়বে না, বরং স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য জীবন দিয়ে দেবে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এতে করে এক লাফে নিয়াপলিটান ফ্লিটের সৈন্যসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

পরদিন সকাল। একদম কাঁচের মত শান্ত হয়ে আছে সাগরের জল। বাতাস না থাকায় এক ইঞ্চিও আগে বাড়ছে না ফ্লিট। ওদিকে সারা রাত ধরে একাধারে দাঁড় বেয়েছে দাঁড়িরা।–ওদের ক্লান্ত শরীর আর চলছে না। আধ ঘণ্টার ভিতর ওদেরকে সরিয়ে দিয়ে দাঁড় বাইতে বসবে নতুন একদল দাস। ওই দলের দাসেরা বিশ্রাম পেয়েছে। তাই খুব একটা ক্লান্ত নয়। কিন্তু তারপরও ওদের কাছ থেকেও খুব বেশি কিছু আশা করা যায় না। কারণ ওয়ার্ডেনরা বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব জানে। তাই দাসদের দিয়ে ওরা প্রতি মিনিটে চব্বিশবার দাঁড় টানাচ্ছে। এটাই ওদের দাঁড় টানার সর্বোচ্চ ক্ষমতা।

পুপ কেবিন থেকে দাসদের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে প্রসপেরো। ব্যাপারটা চোখে পড়ল এক ওয়ার্ডেনের। কাজ দেখাতে গিয়ে দাসদের পিঠে মারার জন্য চাবুক তুলল সে। সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে লোকটাকে থামার হুকুম করল প্রসপেরো। বলল, থামো। এরা যন্ত্র নয়, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত একদল মানুষ। চাবুক নয়, ওয়াইন দাও ওদের।

ওয়াইন সরবরাহ করা হলো। বেঞ্চ থেকে বেঞ্চে ঘুরতে থাকল কাপ। কৃতজ্ঞ চিত্তে কাপে চুমুক দিল ক্লান্ত দাসরা। আর ঠিক তখনি পুব থেকে এল হাওয়ার দমক। এ যেন প্রসপেরোর মানবিক আচরণের পুরস্কার হিসেবে খোদ ঈশ্বরের পাঠানো উপহার!

অভিজ্ঞ নাবিক মাত্রই জানে, লেভান্তে থেকে আসা এই বায়ুপ্রবাহকে বলে হারবিঞ্জার। অস্থিরমতি কিন্তু স্থায়ী এই বাতাস প্রবাহ। জাহাজের মাস্তুলে তুলে দেয়া হলো ত্রিকোনাকার পাল, এখন একটু ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিতে পারবে পরিশ্রান্ত দাঁড়িরা।

সকালের পর থেকে বাতাসের গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকল। শেষে এমন অবস্থা হলো যে প্রতিটা ঢেউ কাটার সময় ফোয়ারার মত পানি ছিটাতে শুরু করল প্রসপেরার বো। মানে ভয়াবহ গতি। কিন্তু তবুও পাল নামাতে বা গতি কমাতে রাজি হলো না প্রসপেরো। একইভাবে ক্যাপিটানাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলো ফ্লিটের অন্য জাহাজগুলোও। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফর্মেশন তৈরি করে এগুতে শুরু করেছে ফ্লিট। পাশাপাশি চলছে জাহাজগুলো। দলের মাঝখানে আছে ক্যাপিটানা প্রসপেরা। আর গ্যালিয়নটা আছে সর্ব ডানপ্রান্তে। পালে পর্যাপ্ত বাতাস পেয়ে নিজে নিজেই চলছে এখন গ্যালিয়ন ইমাকুলাটা। তবে এটার সবগুলো মাস্তুলে এখনো পাল তোলা হয়নি। তুললে ফ্লিট ছেড়ে এর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিকেল নাগাদ মূল ভূখণ্ড নজরে এল। স্ট্রেইট অভ বোনিফেসে প্রবেশ করছে ফ্লিট। ক্যাপিটানার টিবারনাকলে খেতে বসেছে প্রসপেরো। সঙ্গে কারবাজাল আর ওর সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড জেনোয়ার বাসিন্দা আদ্রিয়ানো আলোরি। ফ্লিটের গতি এখন মোটামুটি ঘণ্টা প্রতি তিন থেকে চার লিগ।

কেপ ফেরো ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় একটা ফ্রেঞ্চ ব্রিগেন্টাইনের সঙ্গে কথা হয় ওদের। ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেন ওদেরকে জানায় যে দুই দিন আগে মিনোরকার মাইল পঞ্চাশেক পুবে কোর্সেয়ার ফ্লিটের দেখা পেয়েছে সে। তখনও ওই ফ্লিট পশ্চিম দিকে চলছিল। তখন আলভারো আর প্রসপেরো, দুজনেই বুঝে নেয় দ্রাগুতের গন্তব্য অবশ্যই বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ।

আলভারো বলল, স্পেনের দোরগোড়ায় আক্রমণ করতে যাচ্ছে দ্রাগুত। অথচ বাধা দেয়া দূর, ওর ধারে-কাছেও এখনও কেউ আমরা নেই। সম্রাটের কানে খবরটা যখন যাবে, ডোরিয়াকে যেন ঈশ্বর রক্ষা করে।

কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরের কাছে প্রসপেরো প্রার্থনা করে যাচ্ছে যাতে বাতাসটা পড়ে না যায়। তাতে যদি-বা দ্বীপ রক্ষা করতে না-ও পারে অন্তত প্রতিশোধ নিতে পারবে। ঈশ্বর যেন প্রসপেরোর প্রার্থনা শুনল। বাতাস শুধু যে রইল তা-ই নয় বরং দিনভর বাতাসের গতি বেড়েই চলল। কিন্তু এমন ভয়াবহ গতি ওঠার পরও একটা পাল নামাতেও রাজি হলো না প্রসপেরো। ওই প্রবল বাতাসের মুখেও সবগুলো পাল তুলে ঝড়ের গতিতে ফ্লিট নিয়ে এগিয়ে চলল ও। রাত নামার পর বাতাসের তোড় কমে এল। ধীর গতিতে বইতে থাকল বাতাস। সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড় নামানো হলো, যাতে ধীর গতির বাতাসের সঙ্গে দাঁড়ের শক্তিতেও এগিয়ে যাওয়ার গতি ধরে রাখা যায়। পুরো রাত ধরে এভাবেই পশ্চিমমুখী কোর্সে এগিয়ে চলল ওরা। পরদিন সকালে আবার বাতাস উঠল। প্রসপেরোর দমে যাওয়া মন বাতাসের গতি দেখে আবার চাঙা হয়ে উঠল। গতকালের মতই আবার গতির ঝড় তুলে ভীষণ বিপজ্জনকভাবে ছুটতে থাকল নিয়াপলিটান ফ্লিট।

শেষ বিকেল নাগাদ দেখা গেল পশ্চিমাকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার একটু আগে দিয়ে সাগরে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকা কিছু একটা দেখা গেল। স্বভাবতই একটা নৌকা সেটা। পাল তুলে ওটার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল ইমাকুলাটা। সন্ধ্যা নাগাদ নৌকাটাকে বেঁধে টো করে নিয়ে এল ইমাকুলাটা। পাঁচ কু-অলা ফেলুকা টাইপের মাছ ধরা নৌকা ওটা। মিনোরকা থেকে স্পেনের দিকে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছিল নৌকাটা। নৌকার মালিক যে গল্পটা শোনাল তাতে চুল খাড়া হয়ে গেল সবার।

কাতালান টানে কথা বলছে লোকটা। ভাষাটা প্রসপেরোর জানা নেই। তবে সৌভাগ্যবশত কারবাজালের জানা আছে এই ভাষা। দুই দিন আগে সারাসেন (মানে মুসলিম) ফ্লিট কীভাবে পালমা ডি মালোরকার উপর হিংস্র শ্বাপব্দের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার রোমহর্ষক বর্ণনা দিল ফেলুকার মালিক।

পুরো ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে পালমায় তাণ্ডব চালায় সারাসেনরা। শেষে ওরা যখন চলে যায় স্রেফ নরকের মত চেহারা নিয়েছে। পুরো শহর। বন্দরে থাকা প্রতিটা জাহাজ হয় ডুবিয়ে দিয়েছে। নয়তো তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা। বার্সেলোনা থেকে আসা দুটি গ্যালিয়নেরও একই দশা করেছে। বন্দরে হামলা করে প্রথমেই তারা দুর্গ দখল করে নেয়। তারপর বন্দি করে গ্যারিসনের সবাইকে। পরে তাদের সবাইকেই নৃশংসভাবে হত্যা করেছে সারাসেনরা। এরপর ধীরে সুস্থে হামলা চালায় শহরে। ক্যাথেড্রালের যেখানে যত স্বর্ণ আর রৌপ্যের তৈরি যা কিছু পেয়েছে লুটে নিয়েছে। খুন করেছে বিশপকে আর রীতিমত ধ্বংস করে দিয়ে গেছে এপিসকোপাল প্রাসাদ। পুরো একটা দিন আর একটা রাত ধরে শহরময় লুটপাট চালিয়েছে ওরা! যারাই ওদের বাধা দিতে গেছে নির্বিচারে খুন করেছে তাদের। সবশেষে গণহত্যা আর গণধর্ষণ শেষে ওদের অভিশপ্ত জাহাজে তুলে নিয়ে গেছে হাজারখানেক তরুণ-তরুণীকে। এরপর মিনোরকার দিকে রওনা হয়ে গেছে ওরা। সন্দেহ নেই পালোরমার ভাগ্য বরণ করতে হবে-মিনোরকাবাসীদেরও।

যারা পালমা থেকে খোলা নৌকায় করে পালাতে পেরেছে তারা এই খবরগুলো মিনোরকাবাসীদের কাছে নিয়ে এসেছে। ফেলুকার মালিকও মিনোরকার অধিবাসী। সারাসেন ফ্লিট অ্যাহন বন্দরের কাছাকাছি আসতেই মরিয়া হয়ে বার্সেলোনার দিকে রওনা হয়েছিল সে, যাতে ওখান থেকে কোন সহায়তা আনতে পারে। সারাসেনদের যদি বাধা দেয়া না-ও যায়, স্প্যানিশরা যেন অন্তত এই হতভাগাদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে। ঈশ্বর আর সন্ন্যাসীদের ধন্যবাদ দিয়ে সে বলল যে অপ্রত্যাশিতভাবে এই ফ্লিটের দেখা পেয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ঈশ্বর পাঠিয়েছেন তাদের। প্রসপেরোদের সতর্ক করে দিয়ে সে বলল সারাসেন ফ্লিট খুবই শক্তিশালী। ওদের অন্তত দ্বিগুণ হবে ওরা সংখ্যায়। তবে তার বিশ্বাস, ঈশ্বর ওদের সঙ্গে আছেন, নয়তো ঠিক সময়মত এখানে কীভাবে ওরা উদয় হলো। কাজেই শয়তান সারাসেনদের সংখ্যা যা-ই হোক, জয় ওদেরই হবে।

আমরাও একই প্রার্থনা করি, লোকটার সুরে সুর মিলিয়ে বলল প্রসপেরো। রাগে ওর সারা শরীর কাঁপছে। সঙ্গে সঙ্গেই হুকুম করল সবগুলো পাল তুলে যেন রওনা হয় ফ্লিট। হলোও তাই। কিন্তু গতদিনের মতই সন্ধ্যায় পড়ে গেল বাতাসের গতি। শান্ত গতিতে বইতে থাকল বাতাস।

আলভারো আর আলোরিকে নিয়ে জরুরি সভা ডাকল প্রসপেরো। এলাকাটা আলোরির পরিচিত। সে জানাল দ্বীপটার উত্তরদিকে একটা পেনিনসুলা আছে। আর শহরটা বেশ উঁচু জায়গায় অবস্থিত। বেশ ভাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আছে এর। আচমকা আক্রমণ করে নগর দখল করা সম্ভব। তবে পালমা আক্রমণের খরর মিনোরকায় যেহেতু আগেই পৌঁছেছে, তাই হঠাৎ আক্রমণ করে ওদের বেসামাল করে দেয়ার সুযোগ এখন আর দ্রাগুতের নেই।

তখন একটা প্রস্তাব করল কারবাজাল। বলল দ্বীপের উত্তরদিকে সবার অজান্তে ল্যাণ্ড করা যায়। তারপর দ্বীপে দ্রাগুতের ল্যাণ্ড করার অপেক্ষায় থাকবে ওরা। মুসলিম বাহিনী দ্বীপে নামা মাত্রই আক্রমণে যাবে নিয়াপলিটান ফ্লিট। আচমকা আক্রমণ করে শত্রুপক্ষকে টালমাটাল করে দেয়ার সুযোগও থাকবে তাতে। আরেকটা ব্যাপারও মাথায় রাখতে বলল যে, দ্রাগুত আরো সাপ্লাই জোগাড় করার আগ পর্যন্ত তার আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের সংখ্যাও এখন কম থাকতে বাধ্য।

কিন্তু আলভারোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল প্রসপেরো। কারণ হিসেবে বলল দ্রাগুতকে ল্যাণ্ড করার সময় দিলে পালমায় যা ঘটেছে পোর্ট অ্যাহনেও তা-ই ঘটবে। ও বলল, আমাদের প্রথম দায়িত্ব শহরটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।

তখন ডন বলল, হ্যাঁ, তা-ই। কিন্তু, যদি সেটা আমাদের দ্বারা সম্ভব হয় তাহলেই। কিন্তু আদৌ কি আমাদের পক্ষে এখন শহরটাকে রক্ষা করা সম্ভব?

আমাদের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। প্রথমত, এখানে কেউ আমাদের আশা করছে না। দ্বিতীয়ত, এখন রাত। এই সময় এগিয়ে গেলে কারো চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম, বলল প্রসপেরো।

কিন্তু প্রণালীর প্রবেশমুখে অবশ্যই পাহারাদার রাখবে দ্রাগুত। তাদের এড়ানো কি সম্ভব? প্রশ্ন করল কারবাজাল।

জবাবে প্রসপেরো বলল, তারপরও ভিতরে ঢোকার আগ পর্যন্ত ওরা আমাদের দেখতে পাবে না। আর পেলেও অনেক দেরি হয়ে যাবে। একটা বিষয় আপনি ঠিকই বলেছেন, দ্রাগুতের হাতে গানপাউডার এখন কমই আছে। এটাও আমাদের পক্ষে যাবে। ওর সঙ্গে ক্লোজ-কোয়ার্টার যুদ্ধ (সম্মুখ যুদ্ধ) এড়িয়ে যাব আমরা।

তখন কথা বলল আলোরি। বলল, এই ব্যাপারটা খোলা সাগরের জন্য বেশি উপযুক্ত। কিন্তু এখানে জায়গা কম। অল্প পানিতে এমন লড়াই হলে বিপরীত প্রভাবে পড়ব আমরা।~

ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে খোলা সাগরে লড়তে গেলে এলিমেন্ট অভ সারপ্রাইজ হারাচ্ছি আমরা, বলতে বলতে চিন্তিত ভঙ্গিতে কেবিনের এমাথা-ওমাথা পর্যন্ত পায়চারি করতে লাগল প্রসপেরো। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ও। আলভারো বলল, সবগুলো পথই ঝুঁকিপূর্ণ। ভাবার বিষয় হচ্ছে কোটায় ঝুঁকি সবচেয়ে কম।

ফিরে এসে চেয়ারে বসল প্রসপেরো। চার্টের উপর নজর বোলাতে শুরু করল ও। শেষে সিদ্ধান্ত নিল সবাইকে নিয়ে কথা বলতে হবে। কারণ ওর মাথায় একটা পরিকল্পনা উঁকি দিতে শুরু করেছে। পুরো স্কোয়াড্রনকে তিন ভাগে ভাগ করবে। প্রত্যেক ডিভিশনের একজন কমাণ্ডার থাকবে। আলভারোকে নিতে হবে ইমাকুলাটার দায়িত্ব। নিজের তিনজন সেরা ক্যাপ্টেনকে ডেকে আনাল ও। সেইসঙ্গে হুকুম দিল কোন গ্যালিতেই যেন আলো জ্বালানো না হয়। এবং গ্যালিগুলো যতটা সম্ভব পরস্পরের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে।

প্রসপেরোর ডাক পাওয়া, তিন ক্যাপ্টেন হচ্ছে আলোলারি; সে ইতিমধ্যেই ওদের সঙ্গে আছে, ক্যাপরানিকা নামের একজন জেনোয়িস ক্যাপ্টেন আর অপরজন নিয়াপলিটানের বাসিন্দা সার্ডি। প্রসিডার লড়াইয়ে প্রসপেরোর একটা গ্যালির কমাণ্ডে ছিল এই সার্ডি।

দ্বীপের সঙ্গে পাঁচ মাইল দূরত্ব বজায় রেখেছে প্রসপেরোর ফ্লিট। সাগরের মৃদু স্রোতের সঙ্গে ভেসে আগামী পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে মিনোরকার প্রবেশমুখের কাছে পৌঁছে যাবে ওরা।

ওদের এক ঘণ্টার আলাপ-আলোচনা পুরোপুরি নিষ্ফল প্রমাণিত হলো। একের পর পরিকল্পনা এল, কোন না কোন খুঁতের কারণে সেটা বাতিল করতে বাধ্য হলো সবাই। শেষে মনে হতে লাগল আলভারোর প্রস্তাবৃটাই বুঝি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তাই সব বাদ দিয়ে ওদিকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল প্রসপেরো। কিন্তু কথাবার্তায় যে সময়টুকু নষ্ট হয়েছে সেটা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছে ও। তারপরও উত্তরে গালফ অভ আনফোঁস-এর দিকে রওনা হতে হুকুম করল। আর কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া আপাতত স্থগিত রেখে ক্যাপ্টেনদেরকে যার-যার ডিভিশনের কমাণ্ড নিতে বলল ও। সেইসঙ্গে জানিয়ে দিল, কখন কী করতে হবে, সেই বিষয়ে যথাসময়ে তাদের কাছে হুকুম পাঠানো হবে।

সার্ডি আর ক্যাপরানিকা-দুজনকেই পাঁচটা করে গ্যালির কমাণ্ড দেয়া হয়েছে। ওরা চলে যাওয়ার পর কীভাবে কী করবে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করল প্রসপেরো। পরের আরো প্রায় এক ঘণ্টা গ্যাং ডেকের উপর পায়চারি করে বেড়াল ও।

গ্যাং ডেকের মাঝ বরাবর এক ডেক নিচেই জাহাজের রান্নাঘর। ওখানে বসে এক গোলন্দাজের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে কুক। ভেসে আসছে গ্যাং ডেকের নিচে ঘুমন্ত দাসদের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। কামানগুলোর সামনে থেকে কাঠের পাল্লা তুলে রাখা হয়েছে। যদি আচম্বিতে লড়াই বেঁধে যায় সেজন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে গানাররা। আরাকুইবাসিয়াররাও প্রস্তুত হয়ে বসে আছে তাঁদের আরাকুইবাস নিয়ে। পালা করে ডিউটি দিচ্ছে তারা। ওদের ফিসিফিসানিও শোনা যাচ্ছে।

এত কিছু ঘটছে, কিন্তু এসবের কিছুই প্রসপেরোর নজরে আসেনি। আসবে কী করে, ওর মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে পোর্ট অ্যাহনের প্রবেশমুখের কাল্পনিক চিত্র। দুপাশের উঁচু ক্লিফের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু জলপথটাই বন্দরের প্রবেশমুখ। এর ভিতর ঢুকে বসে আছে কোর্সেয়ার ফ্লিট। বন্দরের এক মাইলের মধ্যে বসে আছে তারা। কল্পনায় ওই ফ্লিটের উপর অন্তত বারোবার হামলে পড়েছে ও। প্রতিবার ভিন্ন কৌশল চিন্তা করেছে। কল্পনায় প্রাথমিকভাবে ও জিততে পারলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিবারই তিক্ততার সঙ্গে হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে ও। সেইসঙ্গে ফ্লিটটাও খোয়াতে হয়েছে। তবে কল্পনায় দ্রাগুতকেও প্রায় পঙ্গু বানিয়ে ছেড়েছে ও। শেষ পর্যন্ত দ্রাগুতের যা টিকে যায় তা নিয়ে বাড়ির পথ ধরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তার। তবে শেষ কথা হচ্ছে হেরেছে প্রসপেরো। যদিও এমন হার নিয়ে গর্ব করা যায়। আর এর দ্বারাই হয়তো জেবরার কাজের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত হবে ওর। এরপর হয়তো ইস্তফা দিতে হবে এই লড়াকু পেশা থেকে।

জিয়ান্নার চিন্তা মাথা থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলেছে প্রসপেরো। নইলে হয়তো ভয় জেঁকে বসতে পারে ওর মনে। অনেক চিন্তাভাবনা করে প্রসপেরো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, নিজের নিশ্চিত ধ্বংস মেনে নিয়েই দ্রাগুতকে এলাকাছাড়া করতে হবে। আর কোন বিকল্প আপাতত ওর হাতে নেই।

এসব চিন্তা করতে করতে গ্যাং ডেকের মাথা থেকে পুপ কেবিনের দিকে ফিরছে, এমন সময় অন্ধকারে একটা লোককে কিছু একটা করতে দেখে থমকে দাঁড়াল ও। ভাল করে খেয়াল করে দেখল লোকটা ওর মাস্টার গানার। ছোটখাট, বয়স্ক, প্রায় বনমানুষের মত দেখতে এই গ্রিক লোকটার নাম ডায়োমিডাস। আগুনের কাজ-কারবারে এই লোকের জুড়ি মেলা ভার। পাইরোটেকনিক (বারুদ নিয়ে কাজ করার বিদ্যা) আর। ব্যালেস্টিকসের (ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত কাজ) মহাওস্তাদ এই লোক। অন্যরা চুপচাপ বসে থাকলেও এই লোকটা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। বালতিতে কিছু একটা ঢালছে সে।

কী করছ? জানত চাইল প্রসপেরো।

প্রসপেরোর গলা শুনে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। বলল, সলতে বানাচ্ছি, মাই লর্ড।

সলতে? বিদ্যুৎ চমকের মত একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর মাথায়। আমার সঙ্গে এসো, বলে লোকটাকে পুপ কেবিনে নিয়ে গেল প্রসপেরো। পুপ কেবিনে ঢুকে মৃদু আলো জ্বালল প্রসপেরো। ডিভানে হেলান দিয়ে আছে আলভারো। তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল তার। প্রসপেরোর ঢোকার আওয়াজে উঠে বসল সে। বলল, আমার এখন ইমাকুলাটায় গিয়ে ওঠা দরকার। কোন সিদ্ধান্তে এলে আমাকে জানিয়ে দেবেন, তাহলেই হবে।

একটু অপেক্ষা করুন, বলে গ্রিক লোকটার দিকে ফিরল প্রসপেরো। জিজ্ঞেস করল, সবচেয়ে ধীরগতিতে জ্বলে এমন সলতে দরকার আমার। কতটা ধীরে জ্বলা সুলতে তুমি বানাতে পারবে?

ধীর সলতে? বলে আনমনে মাথা চুলকাল লোকটা। কিছুক্ষণ পর বলল, এক গজ সলতে পুরো এক মিনিট সময় নিয়ে জ্বলবে, এমন বানাতে পারব।

অমন দশটা বানাতে পারবে যেগুলো দুই মিনিট ধরে জ্বলবে? জানতে চাইল প্রসপেরো।

আরো লম্বা হলেও পারব, লর্ড। কিন্তু জ্বলার গতি একই থাকবে। এর চেয়ে আর কমানো সম্ভব না।

এর উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারব? একটুও তাড়াতাড়ি জ্বলবে না তো? বুঝে শুনে হিসেব করে উত্তর দিয়ো।

একমুহূর্ত চিন্তা করে ডায়োমিডাস বলল, নিশ্চিন্ত থাকুন, লর্ড। সলতে ঠিকঠাক কাজ করবে।

একশ গজ লম্বা সলতে বানাতে কেমন সময় চাও?

কয়েক মুহূর্ত হিসেব করে লোকটি বলল, তিন ঘণ্টা লাগবে, মাই লর্ড, যদি সঙ্গে সাহায্য করার মত একজন লোক পাই।

যে কয়জন লোক লাগে নাও। কিন্তু আগামী চার ঘণ্টার মধ্যে সলতে তৈরি হওয়া চাই। যেমনটা বলেছ ঠিক তেমনই যেন হয়। হেরফের হলে চলবে না। ধীরে জ্বলা সলতে চাই আমি। আর সময় চার ঘণ্টার একমুহূর্তও বেশি লাগানো যাবে না।

প্রসপেরোকে ওর বেঁধে দেয়া সময়ের ভিতরই সলতে বানিয়ে দেবে কথা দিয়ে চলে গেল গ্রিক মাস্টার গানার। রহস্যাবৃত আলভারো জানতে চাইল কী পরিকল্পনা করেছে প্রসপেরো।

খানিকটা উত্তেজিত প্রসপেরো রহস্যময় হাসি হেসে জবাব দিল, রাউণ্ডশিপ ইমাকুলাটা চালাব আমি। ওটা নিয়েই আমি অ্যাকশনে নামব। আর আমার অনুপস্থিতিতে আপনি নেবেন ফ্লিটের কমাণ্ড।

.

৩২.

কেপ মোলার যুদ্ধ

 ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে। ঠিক তখনই মুসলিম নৌবাহিনীর নজরে এল লা মোলার প্রবেশমুখের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে নিয়াপলিটান ফ্লিট। ফ্লিটটা যেন আকাশ থেকে পড়েছে। প্রহরী লোকটা ভীষণ অবাক হয়েছে। দাঁড়িয়ে চোখ কচলে নিল দুবার। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আল্লাহর নাম জপতে জপতে নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছে যে, আস্ত একটা ফ্লিট ভূত হতে পারে না। কিন্তু ভূত না হলে এমন নিঃশব্দে কীভাবে ওটা উদয় হলো! কোন ব্যাখ্যাও তো সে পাচ্ছে না। তবে ফ্লিটের প্রথমে থাকা ভীমকায় স্প্যানিশ গ্যালিয়নটাকে দৃষ্টিবিভ্রম ভাবার কোন অবকাশই নেই।

আলো বাড়ছে। প্রহরী লোকটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়েই আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বোধোদয় হলো তার। আগুনের সঙ্কেত দেয়ার জন্য ম্যাচ তুলতে শুরু করেছে সে।

ভোরের ধূসর আলো কেটে গেছে ইতিমধ্যেই। লালিমা ছড়িয়ে পড়ছে। ভেসে এল মুসলিম নৌবাহিনীর গ্যালিগুলোর দাঁড় ঝপাঝপ পানিতে পড়ার শব্দ। ওদিকে একই সময় গ্যালিয়নটাও তুলে দিল তার সবগুলো পাল। ফলে দ্রুত এগুতে শুরু করেছে ওটাও। পোর্টের সরু প্রবেশপথের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে গ্যালিয়ন।

ওদিকে প্রহরী লোকটা একটা আরাকুইবাস তুলে নিয়েছে হাতে। আর ঠিক তখনই কামানের গোলার বিস্ফোরণের শব্দে খানখান হয়ে গেল ভোরের নীরবতা।

ঘটনা হচ্ছে, পেনিনসুলার ভিতর পোর্ট অ্যাহনের কাছেই রয়েছে দ্রাগুত। নিয়াপলিটান ফ্লিটের উদয় হওয়া সম্বন্ধে এখনো সম্পূর্ণ অনবগত সে। পোর্ট দখল করতে তার নিজের একটা পরিকল্পনা রয়েছে। সেটা ধরেই এগুচ্ছে সে। সন্তর্পণে এগুতে এগুতে অ্যাহনের দুর্গকে কামানের পাল্লার মধ্যে পেয়ে তখনই দুর্গ লক্ষ্য করে কামান দেগেছে দ্রাগুত। কামানের গোলার বিস্ফোরণে ধুলোর ঝড় উঠেছে দুর্গের বেলে পাথরের দেয়ালে। ধুলো কমার পর দেখা গেল দুর্গ থেকে তাদের গ্যালির প্রতি পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রচেষ্টা খুবই দুর্বল। গ্যালির ক্ষতি করতে ব্যর্থ লক্ষ্যভ্রষ্ট কিছু গোলা কাছাকাছি আসায় গ্যালিগুলোকে ওদের কামানের পাল্লার বাইরে সরিয়ে আনল দ্রাগুত।

এই দৃশ্য দেখেই দুর্গের ওরা খুব খুশি। এত দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাদের উল্লাস ধ্বনি। ওদের উল্লাসের জবাবে আবার গোলাবর্ষণ শুরু করল দ্রাগুত।

ওদিকে কেপ মোলায় দ্রাগুতের সেই প্রহরী কামানের গোলাবর্ষণের শব্দে আরো বেশি ভাঁড়কে গেছে। পাশের প্রহরা পোস্টকে সতর্ক করতে আরাকুইবাস ফেলে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে ছুটল সে।

তবে তার আসলে দরকার ছিল না। বিশাল বড় গ্যালিয়নটাকে ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছে দ্রাগুত। দেখছে গ্যালিয়নটা বন্দরের প্রবেশপথের মুখে পৌঁছে মুখটাকেই একরকম বন্ধ করে ফেলল। ট্রাম্পেটের মাধ্যমে সঙ্কেত দেয়া হলো। সর্বোচ্চ গতি তুলে মূল ফ্লিট ছেড়ে বেরিয়ে এল দ্রাগুতের বারোটা গ্যালি।

সিনান আল শানিম (সিনান রেইজ নয়) রয়েছে এই বারোটা গ্যালির কমাণ্ডে। প্রসপেরো অনুমান করল, সিনানকে হুকুম দেয়া হয়েছে, যে-কোন মূল্যে গ্যালিয়নটাকে দখল করতে হবে। বহির্বিশ্ব থেকে আসা একটা পুরস্কার হিসেবে এটাকে দেখছে ধাওয়াকারীরা।

পোর্ট অ্যাহনের দুর্গের পাল্লার বাইরে মূল ফ্লিটের সঙ্গে নিরাপদে বসে আছে দ্রাগুত। ওদিকে অগ্রসরমাণ কোর্সেয়ার ফ্লিটের গতি দেখেও গ্যালিয়ন থেকে প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না দেখে ওদের সাহস বেড়ে গেছে। হইচই করে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে তারা। ভেবে নিয়েছে। গ্যালিয়নটা তাদের হয়েই গেছে। শুধু ওটায় পা দেয়া বাকি। ভুলেও কেউ ভাবেনি এভাবে ওদেরকে ফাঁদের দিকে টেনে আনা হতে পারে।

ওদিকে গ্যালিয়নের সমস্ত কাজ করে রেখে একটা লং বোটে করে এর সব ক্রুরা চলে গেছে। এই ব্যাপারটা কোর্সেয়াররা কেউ খেয়াল করেনি। গ্যালিয়নে এখন আছে কেবল তিনজন। এক, হেলম সামলাচ্ছে গ্যাস্টন নামে এক কু (হেলম: জাহাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের মত কিন্তু আকারে বড় হুইল)। দুই, ডেকে সলতে নিয়ে কাজ করছে মাস্টার গানার ডায়োমিডাস। আর তিন, সলতেয় আগুন ধরানোর জন্য একটা লাঠির মাথায় আগুন নিয়ে গ্যালিগুলো জায়গামত আসার অপেক্ষায় বসে আছে প্রসপেরো।

পাশাপাশি এগিয়ে আসছে গ্যালিগুলো। কিন্তু ওই সরু জায়গাটায় গ্যালিয়ন ঘুরিয়ে কোর্সেয়ারদের মুখোমুখি হবার কোন উপায় নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কোর্সেয়াররা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। গ্যালিয়নের পাশে চলে এসেছে একটা গ্যালি। হিংস্র উল্লাস করতে করতে ইমাকুলাটায় নামতে শুরু কবল পাগড়ি পরিহিত কোর্সেয়ার নাবিক আর ক্রুরা।

প্রসপেরোর পাশে হঠাৎ হাজির হলো ডায়োমিডাস। জানাল সব প্রস্তুত। একবার মাথা নেড়ে লোকটার হাতে আগুনসহ লাঠিটা দিল ও। একমুহূর্ত মাত্র সময় নিল ডায়োমিডাস। তারপর একটা সলতে তুলে নিয়ে আগুন দিল তাতে। প্রথম বিস্ফোরণটা হলো দুটো গ্যালির মাঝখানে। নির্বিষ সেই বিস্ফোরণে কিছু পানি ছলকে ওঠা ছাড়া আর কারো কোন ক্ষতি হলো না। কিন্তু দ্বিতীয়বারের বিস্ফোরণটা বড়সড়। গ্যালিয়নে চড়ার জন্য তক্তা ফেলেছিল কোর্সেয়ার নাবিকরা। ওই তক্তাগুলোকে হাজার টুকরো করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে এই বিস্ফোরণ। সঙ্গে গ্যালিয়নে চড়তে যাওঁয়া এক কু উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়েছে পাথুরে তীরে। অলৌকিকভাবে ও ব্যাটা তখনও বেঁচে আছে। প্রবল আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে সাহায্যের জন্য ছুটতে শুরু করেছে সে।

ডায়োমিডাসকে হুকুম করল প্রসপেরো, গ্যাস্টনকে বলো হেলমটা বেঁধে রাখতে। তারপর ওকে নিয়ে নেমে যাও। কিন্তু ইতস্তত করতে লাগল ডায়োমিডাস। আবার তাকে প্রসপেরো বলল, দেরি কোরো না, যাও। কী করতে হবে তোমার জানা আছে, যাও।

আপনি বেশি দেরি করবেন না তো? শঙ্কাযুক্ত গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল ডায়োমিডাস।

নিশ্চিত থাকো, অমন কিছু হবে না। যাও।

উঠে গেল ডায়োমিডাস। হেলমে দড়ি বেঁধে পিছনের একটা জানালা দিয়ে নিচে নেমে এল দুজনে। ওখানে একটা সুপ বাঁধা আছে। ওটায় চড়ে দড়িটা শুধু কেটে দিল একজন। ওরা হাতে দাঁড় তোলেনি। শুধু তাকিয়ে থেকে দেখল, স্রোতের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল জাহাজটা।

ডায়োমিডাস চলে যাওয়ার পর মাত্র একমুহূর্ত ওখানে বসে রইল প্রসপেরো। গ্যালিয়নের গতি থেকে ওবুঝে নিল আর পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে ধাওয়াকারী গ্যালিগুলোর কাছে পৌঁছে যাবে ইমাকুলাটা। কী করতে হবে আগেই ছকে রেখেছে প্রসপেরো।

দুই ডেক মিলিয়ে ইমাকুলাটায় বিশটা কামান আছে। বারোটা মেইন ডেকে, আটটা জাহাজের মিড ডেকে। এরমধ্যে জাহাজের ডানদিকের চারটা কামানে ভিন্ন ভিন্ন সময় জ্বলবে এমন সলতে বেঁধে দিয়ে গেছে ডায়োমিডাস। বামদিকেও আছে। তবে ওই দিকে যেহেতু ভূমি, তাই ওদিকের কামানগুলো স্রেফ প্রদর্শনী করা ছাড়া আর কোন কাজে আসবে না। তবে ওগুলো থেকে গোলাবর্ষণ হলে অন্তত আশা করা যায়, শত্রুরা ধরে নেবে জাহাজে পর্যাপ্ত লোক আছে।

যা হোক, দৌড়াতে দৌড়াতে কয়েকটা সলতেয় আগুন দিল প্রসপেরো। দিয়েই নিচে গিয়ে অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল ও। তখনই ভেসে এল কামানের প্রথম গোলা বিস্ফোরণের শব্দ। মিনিটখানেক পরই আরো দুটো গোলা ফাটল।

নিচের তিনটা ডেকেই গানপাউডার ভরা ব্যারেল জড়ো করে বিশাল স্তূপ করা হয়েছে। ওগুলোতে সলতে বসানো নিয়েই রাতের বেশ কয়েক ঘণ্টা অতি ব্যস্ত ছিল ডায়োমিডাস। এমন ব্যবস্থা ও করেছে যে, কোন কারণে দুটো স্তূপও যদি মিসফায়ার করে তবুও তৃতীয় স্তূপটা অবশ্যই বিস্ফোরিত হবে। স্তূপগুলোর প্রতিটায় বিশ গজ লম্বা সলতে বসিয়ে গেছে ডায়োমিডাস। দ্রুত সলতেয় আগুন দিল প্রসপেরো। একমুহূর্ত অপেক্ষা করল সলতে ঠিক মত জ্বলছে কিনা দেখার জন্য। নিশ্চিত হয়েই দিল ছুট। ডেকে এসে দেখল পালে হাওয়া নিয়ে স্থির গতিতে এগিয়ে চলেছে ইমাকুলাটা। আর দেরি করল না ও। ডায়োমিডাসদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। অত উঁচু থেকে পড়ায় ভেসে উঠতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। যখন মাথা তুলল দেখতে পেল প্রায় পঞ্চাশ গজ এগিয়ে গেছে গ্যালিয়ন। ওদিকে ওর অপেক্ষায় সুপ নিয়ে আগের জায়গাতেই বসে আছে হেলমসম্যান ও মাস্টার গানার ডায়োমিডাস।

কয়েক মুহূর্ত পরই বিপক্ষের গ্যালিগুলোও এগুতে শুরু করল। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেল গ্যালিয়নের পাশে। ওগুলোর দাঁড় তুলে ফেলা হয়েছে। দেখতে লাগছে পাখির গোটানো পাখার মত। গ্যালি থেকে গ্র্যাপনেল ছুঁড়ে দেয়া হলো গ্যালিয়নের রেইলিং লক্ষ্য করে। কাছাকাছি হতেই পাশের গ্যালিগুলো শক্ত করে নিজেদেরকে ওটার সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তবে গ্যালিয়নের গতি তাতে রূদ্ধ হলো না। গ্যালিগুলো পাশে বাঁধিয়ে এগিয়ে চলেছে বিশাল জাহাজটা।

ডানপাশে তিনটা আর বামপাশে তিনটা মিলে একে স্থির করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তখন সপ্তম একটা গ্যালি এগিয়ে এল। ওটা গিয়ে এ্যাপনেল দিয়ে নিজেকে আটকে নিল পেছন দিকে। বাকি গ্যালিগুলো খানিকটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে না বলে বলা ভাল ওগুলো চেষ্টা করছে পেছন থেকে গ্যালিয়নটাকে টেনে ধরতে। একইসঙ্গে কোর্সেয়ার গ্যালিগুলোর ক্রুরা চেষ্টা করছে দ্রুত ওটায় চড়তে।

প্রথমে গ্যালিয়নে চড়ল আরাকুইবাসিয়াররা। এরপরই গেল তীরন্দাজদ্রের বড়সড় একটা দল। নেমেই চোখ বন্ধ করে তীর আর গুলিবর্ষণ শুরু করল ওরা। আরাকুইবাসের গুলি আর তীরের আঘাতে প্রায় আঁঝরা হয়ে গেল প্রথম ডেক। কিন্তু ডেকে কোন প্রতিরোধকারীই নেই। তখনই ওরা অনুভব করল কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। নইলে ডেক এমন খালি থাকতে পারে না।

খবরটা ওদের অফিসারদের কাছে পৌঁছেও সারতে পারেনি। প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস। যেন একসঙ্গে গর্জে উঠেছে শত নয়, হাজারটা কামান।

দেখার মত একটা দৃশ্য বটে! বিস্ফোরণে গ্যালিয়নটা চতুর্দিকে ফুলে উঠল। তীব্র গতিতে উপর দিকে ছুটল পুরো আপার ডেক। নিচ্ছিদ্র দেয়ালের মত চারদিকে ছুটে গেল আগুনের শিখা। আর গ্যালিয়নে ধরে যাওয়া আগুন যেন আকাশ ছোঁয়ার জোগাড় করেছে।

বিস্ফোরণের ধাক্কা পানিতেও ভীষণ ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া করেছে। বিস্ফোরণের শকওয়েভের ফলে তৈরি হওয়া বিশাল ঢেউ জলোচ্ছ্বাসের মত ছুটে গেল সরু তীরের দিকে। ঢেউয়ের ধাক্কায় পোর্ট অ্যাহনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দ্রাগুতের মূল ফ্লিটের জাহাজগুলোও পরস্পরের সঙ্গে ভয়ানকভাবে ধাক্কা খেতে থাকল।

ওদিকে এই বিস্ফোরণস্থল থেকে মাত্র দুইশ গজ দূরে আছে প্রসপেরো। পানি কুশনের মত কাজ করায় বিস্ফোরণের প্রথম ধাক্কা ওর উপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু এর পরপরই ছুটে এল পাহাড়ের মত বিশাল এক ঢেউ। প্রথমে ঢেউটা ওকে পাহাড়ের মতই উঁচুতে তুলে নিল। তারপর আছড়ে ফেলল ঢেউয়ের নিচে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শোচনীয় অবস্থা ওর। আর ওর কাছ থেকে একশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুপটাকে নিয়ে খোলামকুচির মত লোফালুফি করছে পাহাড়ের মত উঁচু উন্মত্ত জলোচ্ছ্বাস। প্রসপেরো যতক্ষণে মাথা তুলতে পেরেছে ততক্ষণে আশপাশে আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নেই। গ্যালিয়ন। আর কোর্সেয়ার গ্যালিগুলোর অবশিষ্টাংশ আবর্জনা হয়ে ভেসে যাচ্ছে ওর পাশ দিয়ে।

এ-ই শেষ নয়। কী ঘটল দেখতে তীর ঘেঁষে এগিয়ে আসছিল কোর্সেয়ার ফ্লিটের বিশাল একটা গ্যালিসে। ওটার লাল-সাদার উপর নীল কাস্তে আকৃতির চাঁদ আঁকা পতাকা দেখে বোঝা গেল ওটা দ্রাগুতের নিজের ফ্ল্যাগশিপ বা কোর্সেয়ার ফ্লিটের ক্যাপিটানা। পাহাড়প্রমাণ বিশাল একটা ঢেউ ওটাকেও তুলে নিয়ে ছুটে চলল পাথুরে তীরের দিকে। কিন্তু গ্যালিসেটার কিছুই করার নেই, জাহাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। নিয়তির হাতে আত্মসমর্পণ করেছে ওটার ক্রুরা। মুহূর্তের মধ্যে ওটাকে পাথুরে তীরে আছড়ে ফেলল পর্বতপ্রমাণ ঢেউ।

এগিয়ে এল প্রসপেরোকে নেয়ার জন্য অপেক্ষারত সুপ। ওকে টেনে তুলল দুজন মিলে। ক্লান্ত প্রসপেরো গড়িয়ে পড়ল সুপের খোলে জমে থাকা পানির মধ্যে। একমুহূর্ত পর উঠে বসল ও। মুখে বিজয়ীর হাসি। ক্লান্ত কণ্ঠে কিন্তু হাসি মুখেই ও বলল, একটু হলেও ওদের ছাঁটতে পেরেছি। এখন তাড়াতাড়ি জায়গামত পৌঁছতে না পারলে আমাদের আর কোন সুবিধা থাকবে না।

কোর্সেয়াররা যে ওদের সুপটাকে দেখতে পাবে সেটা প্রসপেরোর মাথায় আছে। এগারোটা গ্যালি হারাবার পর সবকিছুকেই অত্যন্ত সন্দেহের দৃষ্টিতে ওরা দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। এবং বাস্তবে হলোও তা-ই। ছোট্ট নৌকাটাকে ওরা দেখতে পেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই হা-হা করে ওটার দিকে ধেয়ে এল ছয়টা গ্যালি। কয়েক মুহূর্ত পর অবশ্য দুটো গ্যালি দাঁড়িয়ে পড়ল। সিনানের গ্যালির ধ্বংসাবশেষ থেকে কাউকে উদ্ধার করা যায় কিনা খুঁজে দেখছে ওই দুটো গ্যালি। বাকি চার গ্যালি অবশ্য একটুও গতি কমাল না। ব্লাডহাউণ্ডের মত ধেয়ে আসছে।

আতঙ্কিত ডায়োমিডাস আর গ্যাস্টন পাগলের মত দাঁড় বাইছে। ওদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করল প্রসপেরো। আস্তে দাঁড় বাইতে বলল।

জবাবে গ্যাস্টন বলল, সব শয়তানের নামে কসম করে বলতে পারি, ধরতে পারলে সারাসেন বদমাশগুলো জীবন্ত অবস্থায় আমাদের চামড়া ছিলে নেবে। আলেপ্পোতে একবার এমন করতে দেখেছি ওদের। ওই বেচারার নারকীয় যন্ত্রণা নিজের চোখে দেখেছি। ওর ভাগ্য আমি বরণ করতে চাই না।

একবার পিছনে তাকিয়ে প্রসপেরো বলল, ওই অবস্থায় তুমি এখনও পড়োনি।

ধাওয়ারত গ্যালিগুলো ওদের থেকে আর মাত্র চারশ গজ পিছনে। আর পেনিনসুলার প্রবেশমুখ দুইশ গজ দূরে। ওদিকে কোর্সেয়ার ফ্লিটের মূল অংশ সিনান যেখানে আকস্মিক হামলার শিকার হয়েছে সেদিকে এগুতে শুরু করেছে। ফ্লিট ছেড়ে সামনে এগিয়ে এসেছে একটা বিশাল গ্যালিসে। বুম করে গর্জে উঠল একটা কামান। ওখান থেকে পাগলের মত পতাকা নেড়ে চলেছে এক লোক। আসলে ধাওয়াকারী গ্যালিগুলোকে আর এগুতে নিষেধ করে সঙ্কেত দিচ্ছে সে। কিন্তু গ্যালির দায়িত্বে থাকা লোকেরা তার সঙ্কেতের ভুল অর্থ করল। তারা ভাবল ওখান থেকে হয়তো সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। ফলে ধাবমান চারটা গ্যালিই এড়িয়ে গেল তার সঙ্কেত।

ওদিকে ক্রিকের বাইরে চলে এসেছে প্রসপেরেরা। দেখল সার্ডির স্কোয়াড্রন আর ওর নিজের গ্যালিগুলোও জায়গামত অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। ক্যাপরানিকা অবস্থা নিয়েছে ইনলেটের ভিতর কিন্তু ওদের বিপরীত পাশে।

গ্যালিতে উঠেও সারতে পারল না প্রসপেরো, ভালুকের মত বিশাল এক লোক জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল ওকে। সে আর কেউ না, আমাদের কারবাজাল। হোক না প্রসপেরোর গা ভিজে চুপচুপে, কিন্তু ও আস্ত ফিরে আসতে পারায় যারপরনাই আনন্দিত হয়েছে ডন। তারই বহিপ্রকাশ এই আলিঙ্গন। ওদিকে ধাওয়াকারী চার গ্যালি ক্রিকের মুখ পার হয়ে ভোলা পানিতে চলে এসেছে। এসেই ওরা বুঝতে পারল দারুণ এক অ্যাম্বুশের ভিতর পড়ে গেছে তারা।

বাঁচতে হলে গ্যালিগুলোর উচিত ছিল সর্বোচ্চ গতিতে প্রসপেরোর ফাঁদ পার হবার চেষ্টা করা। তাতে একটা গ্যালি হারাতে হলেও বাকিগুলোকে অন্তত কোর্সেয়ার ফ্লিটের মূল অংশ উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু গতি তুলে এগুবার চেষ্টা না করে বোকার মত ওরা প্রবৃত্তির দাবি শুনল। চাইল, যেদিক থেকে এসেছে লেজ গুটিয়ে সেদিকেই পালাতে।

পালানোর জন্য গতি তুলতে গিয়ে গ্যালিগুলোর অতিরিক্ত দাসরাও দাঁড়ে বসে গেছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সবাই। কিন্তু ইনলেটে ওদের ঢোকার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে গেছে সার্ডির ইউনিট। সার্ডির গ্যালিগুলো থেকে একসঙ্গে গর্জে উঠল দশটা কামান। কোর্সেয়ার গ্যালির খোল ভেঙে জাহাজ ডোবানোর জন্য ওরা ব্যবহার করেছে পাথরের গোলা। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে সার্ভির ছোঁড়া গোলাগুলোর দুটো গিয়ে সরাসরি আঘাত করেছে। একটা কোর্সেয়ার গ্যালির ওয়াটার লাইনের একটু নিচে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই গ্যালিটাকে আর বাঁচানোর উপায় নেই। ডুবে যাচ্ছে গ্যালিটা। আরো দুটো গ্যালিও হজম করেছে পাথুরে গোলার আঘাত। ভাঙা মাস্তুল আর ভেঙে যাওয়া দাঁড় নিয়ে ধুকে ধুকে কোনরকমে তখনো ভেসে আছে জাহাজ দুটো। দুটোরই ডেকের উপর পড়ে আছে মৃত আর মারাত্মক আহত নাবিক যোদ্ধারা। এদের সিংহভাগেরই বাঁচার সম্ভাবনা নেই।

তবে গোলাবর্ষণে চতুর্থ গ্যালিটার কিছুই হয়নি। প্রচণ্ড রাগে অন্ধের মত জাহাজটা ছুটে এল গোলাবর্ষণকারী সার্ডির ইউনিটের দিকে। ক্রোধোন্মত্ত মহিষের মত সোজা চড়ে বসল স্বয়ং সার্ডির গ্যালির উপর। ওরা ক্রোধে এতই অন্ধ হয়ে গেছে যে গোলাবর্ষণের মত অবস্থাও রাখেনি। এমনকী বন্দুক তুলে নেবার কথাও ভুলে গেছে। সার্ডির বাহিনীর বিরুদ্ধে স্রেফ সিমিটার নিয়ে হাতাহাতি লড়াইয়ে নেমে গেছে ওরা।

ওদিকে সার্ডির লোকেরা প্রস্তুত হয়ে বসেই ছিল। কোর্সেয়ার গ্যালি থেকে নেমে আসা প্রথম দল পড়ল সার্ডির আরাকুইবাসিয়ারদের গুলির মুখে। ওদের পিছুপিছু ধেয়ে আসা আরেকদল সিমিটারধারী গিয়ে পড়ল আরাকুইবাসিয়ার ও পাশের আরেকটা ফ্ল্যাঙ্কের গুলির মুখে। লড়াই পাঁচ মিনিটও স্থায়ী হলো না। অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য হলো কোর্সেয়াররা।

ওদিকে লেংচে লেংচে চলতে থাকা দুই কোর্সেয়ার গ্যালির আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করেছে ক্যাপরানিকা। ডুবন্ত জাহাজ দুটো থেকে তুর্কি সেনাদের তুলে আনল সে।

দ্রুতই ছাড়িয়ে ফেলা হলো কোর্সেয়ার গ্যালির সঙ্গে আটকে যাওয়া সার্ডির গ্যালি। একই সময় স্প্যানিশ ফ্লিটের খ্রিস্টান দাসদের পাড় থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। তুর্কি গ্যালিগুলো থেকে উদ্ধার করা আরাকুইবাস ও অন্যান্য অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে তাদের হাতে। ওরা সবাই স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য উন্মুখ। মুখিয়ে আছে লড়াইয়ে নামার জন্য। অপরদিকে কোর্সেয়ার ফ্লিট থেকে বন্দি করা নাবিক ও সৈন্যদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে দাঁড় বাইবার বেঞ্চে।

বলাই বাহুল্য, সবাইকে ওখানে জায়গা দেয়া সম্ভব না। কাজেই ওখানে যাদের জায়গা হয়নি তাদেরকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে গ্যালিগুলোর ডেক পরিষ্কার করার কাজে। ক্ষণিক আগের লড়াইয়ে ডেকের এখানে-ওখানে জমে আছে রক্তের ছোটখাট পুকুর। সেগুলোই পরিষ্কার করছে ওরা। একইসঙ্গে গ্যালিগুলোর যেখানে যা ক্ষতি হয়েছে সেগুলো সারানোর কাজও ধরা হয়েছে। মানে, লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে যতটুকু সারাই করা সম্ভব আরকী।

ওদিকে নিজের গ্যালিসে হারানোর পর অপর একটা গ্যালিতে গিয়ে উঠেছে দ্রাগুত। ওটায় বসেই অবশিষ্ট ফ্লিটকে কমাণ্ড করছে সে। এতগুলো গ্যালি হারিয়ে রাগে তার মাথা খারাপ হওয়ার দশা। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রণক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে।

দূর থেকেই দেখতে পেল ছোট্ট সুপটাকে ধাওয়াকারী চার গ্যালির করুণ দশা। তখনই আরো সাত গ্যালির উপস্থিতি লক্ষ করেছে দ্রাগুত। ধরে নিয়েছে ওই সাত গ্যালির সঙ্গেই তার মোকাবেলা হবে। মনে মনে নবীর নামে দ্রাগুত শপথ নিল যে, এমন মোকাবেলা করবে যা সারা পৃথিবী মনে রাখবে। শয়তানরা ওর যা ক্ষতি করেছে তার জন্য ওই বদমাশের দলকে অবশ্যই মূল্য চুকাতে, হবে, অনেক বড় মূল্য। এতদিনের এতগুলো রেইডের ফসল ওরা কেড়ে নিয়েছে, প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে ওর এত সাধের ফ্লিটটাকে। শয়তানগুলোকে ধরে ধরে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারবে। এরমধ্যেও কেউ বেঁচে গেলে আস্ত চামড়া তুলে আনবে গা থেকে।

রাগে দ্রাগুতের রক্ত ফুটতে থাকলেও করণীয় ভুলে যায়নি সে। তেরোটা গ্যালি নিয়ে শত্রুর দ্বিগুণ শক্তি ওর। কাজেই ধরে নিল, দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ওদের সাধারণদর্শন গ্যালিগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ওগুলো দখল করে নেয়া কঠিন হবে না। এতে অন্তত হারানো গ্যালিগুলোর কিছুটা ক্ষতিপূরণ হবে। তাই নিজের লোকদের কাছে হুঁশিয়ারি পাঠিয়ে দিল যে, তার ভবিষ্যৎ সম্পদগুলোর যেন বেশি ক্ষতি করা না হয়। হুকুম করা হলো, কামান ব্যবহার করা যাবে না। ওই গ্যালিগুলোতে চড়ে মুখোমুখি হাতাহাতি লড়াই করবে কোর্সেয়াররা।

দ্রাগুতের গ্যালিটার নাম রাখাম। ওটা নিয়ে ক্রিকের বাইরে বেরিয়ে এসে শত্রুর পুরো শক্তি দেখতে পেল দ্রাগুত। বুঝল, কেবল নৌযান সংখ্যায়ই নয়, সবদিক থেকেই শত্রুদের থেকে পিছিয়ে গেছে সে। শত্রুপক্ষ সাতটা গ্যালি দেখিয়ে তাকে প্রলুব্ধ করলেও তাদের আসল শক্তি ওর দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে রেখেছিল। আর যখন শত্রু ফ্লিটের ক্যাপিটানায় উড়তে থাকা পতাকায় দুই মাথাঅলা রাজহাঁসের ছবি দেখল, বুঝল সেটা প্রসপেরোর ফ্লিট। প্রথমে হতভম্ব হলেও পরে প্রচণ্ড রাগে দিশাহারা হয়ে গেল সে।

পরমুহূর্তেই ওদিক থেকে ছুটে এল ছত্রিশ পাউণ্ডের একটা গোলা। ওটা সরাসরি এসে বিস্ফোরিত হলো দ্রাগুতের গ্যালি রাখামের ডেকের উপর। র‍্যামবেডকে গুড়ো করে ফেলল গোলাটা, একইসঙ্গে ডেকে থাকা ক্রসবোধারীদের স্রেফ পিষে ফেলল। সংবিৎ ফিরল দ্রাগুতের।

পুপ রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দ্রাগুত। হুঁশ ফিরতেই অন্ধ ক্রোধ দখল করে নিল তার সমগ্র অস্তিত্ব। হাতের তলোয়ার ঝাঁকিয়ে ক্রোধান্ধ মোষের মত হুকুম জারি করল শত্রুপক্ষের সবচেয়ে কাছের গ্যালিটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। পড়লও তাই। ওরা সরাসরি গিয়ে চড়াও হলো ক্যাপরানিকার গ্যালির উপর। অপ্রতিরোধ্য জলস্রোতের মত ক্যাপরানিকার গ্যালিতে উঠে পড়ল সিমিটারধারী কোর্সেয়ার যোদ্ধারা। প্রতিরোধকারীদের হাওয়ায় উড়িয়ে দিল ওরা। কিন্তু তারপরই ওরা গিয়ে পুড়ল একসারিতে অবস্থান নেয়া আরাকুইবাসিয়ারদের বন্দুকের মুখে। এখানে বেশ লড়াই হলো। দুই পক্ষই ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করল। কিন্তু কোর্সেয়ার বাহিনীকে পেছন থেকে সামলে রেখেছে স্বয়ং দ্রাগুত। অসমসাহসী এই লোকটার নিরন্তর উৎসাহ আর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরাকুইবাসিয়ারদের লাইনটাকেও হটতে বাধ্য করল। এমনকী পুপ কেবিনের দখলও নিয়ে নিল তারা। প্রতিরোধকারীদের স্রেফ কচুকাটা করা হলো। মারা পড়ল ক্যাপ্টেন ক্যাপরানিকা।

চারপাশে গর্জন করছে কামান-বন্দুক, ধোঁয়া যেন কুয়াশার চাদরের মত ঢেকে ফেলেছে গ্যালির ডেক। বারুদের কটুগন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া দায়। কিন্তু এরমধ্যেই টিবারনাকলের দখল চলে এসেছে দ্রাগুতের হাতে। রক্তের তৃষ্ণায় পাগলের মত এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে চলল রক্তাক্ত সিমিটারধারী দ্রাগুত। কিন্তু খুন করার মত আর কেউ অবশিষ্ট নেই। ওর হিংস্র আক্রমণ কাউকেই রেহাই দেয়নি। দ্রাগুত ধরে নিল বিজয় পেয়ে গেছে। রক্তাক্ত সিমিটার মাথার উপর তুলে ধরে বুনো উল্লাসে হিংস্র চিৎকার ছাড়ল সে।

তখনই ধোয়ার পর্দা ভেদ করে বাইরে নজর গেল তার। এবং যে দৃশ্যটা দেখল তাতে রক্ত শীতল হয়ে গেল দ্রাগুতের। মাত্র দশ গজ দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল ওর চমৎকার রণসজ্জিত একটা গ্যালি। ডুবে যাচ্ছে ওটা। এদিকে ওর গ্যালি রাখামে আর সৈন্য নেই বললেই চলে। সেটাও প্রসপেরোরা দখল করেই নিয়েছে প্রায়।

ওদিকে ক্যাপরানিকার গ্যালি থেকে দখলকারী কোর্সেয়ারদের তাড়াতে ভলপি নামে ক্যাপরানিকার এক ক্যাপ্টেন আরাকুইবাসিয়ারদের শক্তিশালী একটা দল নিয়ে এগিয়ে আসছে। ভেঙে পড়া র‍্যামবেডের আড়াল ব্যবহার করে আরাকুইবাসিয়ারদের এক-একটা দল ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ল দ্রাগুতের বাহিনীর উপর। ওদের নির্দয় গুলির মুখে দ্রাগুতের প্রতিরক্ষাহীন ক্রসবোধারীরা ডেড ওয়ার্কের পিছনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। ওখানে বসেই ক্রসবো ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে লাগল ওরা। কিন্তু ক্রসবো দিয়ে কি আর বন্দুকের সঙ্গে পাল্লা, দেয়া যায়।

যা হোক, শুরু হলো হাতাহাতি লড়াই। আক্রমণকারী ও আক্রান্ত সৈন্যদের বকাবাদ্য, ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের হুঙ্কার, তলোয়ারের ঝনঝনানি, ক্রসবোর টঙ্কার, ভেঙে পড়তে থাকা কাঠের মড়মড়ানি আর খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় দলের কামানের গর্জনে কেঁপে উঠতে লাগল আকাশ-বাতাস।

দ্রাগুত ভেবেছিল খ্রিস্টান ফ্লিটকে বাগে পেয়ে গেছে সে। নিজের দ্বিগুণ শক্তি ব্যবহার করে সহজেই খ্রিস্টান গ্যালিগুলো দখল করে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোর্সেয়ারদের হতভম্ব করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে প্রসপেরোর বাহিনী। ফলে লড়াইয়ের পাল্লা ওদের দিকেই ঝুঁকতে শুরু করেছে। খ্রিস্টানদের গ্যালিগুলো দখল করার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। জান দিয়ে লড়ছে কোর্সেয়াররা। জয়ের জন্য লড়ছে না ওরা। শত্রুদের মারছে যাতে নিজেদের মরতে না হয়।

ছোট্ট একটা লড়াই জিতেই দ্রাগুত ভেবেছিল যুদ্ধ জিতে গেছে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে ওর দখল করা ক্যাপরানিকার গ্যালির অর্ধেক ইতিমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে। এখন এটার জন্য লড়তে থাকলেও এটা বাঁচানোর সম্ভাবনা কম। উপরন্তু ভলপির বাহিনীর বল্লম আর বন্দুকের মুখে থাকা ওর নিজের গ্যালি রাখামও খ্রিস্টানদের দখলে চলে যাচ্ছে।

পুপ রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল দ্রাগুত, মহান আল্লাহতায়ালার ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারোরই নেই। অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল যে, ওর লোকেরা কেউ হাল ছেড়ে দিচ্ছে, কেউ বা আহত বা নিহত হয়ে লুটিয়ে পড়ছে। লড়াই ক্রমে সরে আসছে ওর দিকে। স্পষ্ট বুঝতে পারল হেরে গেছে দ্রাগুত। প্রস্তুতি নিল ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়তে লড়তেই আত্মাহুতি দেবে বলে। ঠিক তখনই জামিল নামে একটা গ্যালি এসে ভিড়ল এই গ্যালিটার বামপাশে। এটা সিনান রেইজের গ্যালি। শুনতে পেল, নিজের লোকদের দ্রুত এই গ্যালিতে আসার নির্দেশ দিচ্ছে সিনান। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্রাগুতের বাহিনীতে উদ্ধার করার মত খুব বেশি আর বেঁচে নেই। যে দুয়েকজন বেঁচে আছে বা তখনও লড়ছে, সিনানের বাহিনীকে দেখে ওরা বুঝে নিল, এতে লড়াইটা একটু প্রলম্বিত হবে কেবল। কিন্তু পরাজয় এড়ানোর উপায় নেই। অযথাই নিজের লোকদের গালাগাল করল দ্রাগুত যে, শয়তানের চ্যালাদের সামনে আত্মসমর্পণ করছে ওরা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত লোকগুলো তারপরও যতক্ষণ সম্ভব গ্যালির একটা অংশের দখল ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেল।

এরমধ্যে সিনানের নির্দেশে ওর লোকেরা ক্যাপরানিকার গ্যালির দাঁড়গুলোর দখল নেয়ার চেষ্টা করল। উদ্দেশ্য, তাতে অন্তত ওর সৈন্যরা এই গ্যালিতে উঠতে পারবে। তখন আবার লড়ার সুযোগ পাবে তারা। বৃথা চেষ্টা। ভলপির আরাকুইবাসিয়ারদের বৃষ্টির মত গুলির মুখে এই চেষ্টায় ক্ষান্ত দিতে বাধ্য হলো তারা।

জামিলের ডেক থেকে চিৎকার করে দ্রাগুতকে সিনান বলল ওখানে লাফিয়ে পড়তে। দ্রাগুতও দেখতে পেল এছাড়া আর কোন পথ তার সামনে খোলা নেই। অনেক আগেই যুদ্ধ জেতার আশা ত্যাগ করেছে দ্রাগুত। শেষ কয়েকটা লোক ওর জন্য পথ ধরে রাখল। গ্যালির প্রান্তে চলে এল দ্রাগুত। শেষ একবার ক্রুদের দেখল সে, তারপর লাফিয়ে-পড়ল জামিলের ডেকে। হুকুম করল খোলা সাগরের দিকে রওনা হতে। ওখান থেকেই যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে পরবর্তী কর্তব্য ঠিক করা যাবে।

ওখান থেকে গ্যালি জামিল নিয়ে একশ গজের মত দূরে সরে এল দ্রাগুত। দেখতে পেল, চারশ গজ দূরে দুটো জাহাজ পরস্পরের সঙ্গে জান-প্রাণ দিয়ে লড়ছে। জাহাজ দুটোর মধ্যে দূরত্ব পঞ্চাশ গজও হবে না। এত কম দূরত্বে ভারী কামান তেমন কাজ করবে না বলে উভয় দলই কামান ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছে। কিন্তু স্বল্প পাল্লার হালকা ফায়ার-লকগুলো অনবরত গর্জে চলেছে। উগরে দিচ্ছে কমলা আগুনের হলকা। দুই জাহাজের মধ্যে ঝুলে রয়েছে পাতলা ধোয়ার পর্দা।

পশ্চিমে শত্রুপক্ষের তিনটা গ্যালির উপর চড়াও হয়েছে দ্রাগুতের চারটা গ্যালি। শত্রুপক্ষের একটা গ্যালি ছেয়ে আছে ওর নিজের পাগড়িধারী সৈন্য দিয়ে। বোঝা যাচ্ছে ওটার দখল পেতে যাচ্ছে কোর্সেয়াররা। কিন্তু আরেকটু দূরে পাঁচটা কোর্সেয়ার গ্যালি লড়ছে ছয়টা স্প্যানিশ গ্যালির সঙ্গে। দ্রাগুতের দৃষ্টিতে এই লড়াইয়ের পাল্লা উভয় পক্ষেই ঝুঁকতে পারে। ঠিক তখনই অত্যন্ত হতাশ হয়ে দ্রাগুত খেয়াল করল ওর ফ্লিট থেকে তিনটা গ্যালি গায়েব হয়েছে কিন্তু শত্রুপক্ষ হারিয়েছে মাত্র একটা গ্যালি।

লড়াইরত ওই দুই দল থেকে মোটামুটি আশি গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রসপেরোর ক্যাপিটানা প্রসপেরা। ঘঁাড়িয়ে থেকে দেখছে, নির্দেশনা দিচ্ছে, আবার প্রয়োজন পড়লে লড়াইয়ে যোগ দিয়ে সাহায্যও করছে।

পশ্চিম রণক্ষেত্র থেকে হঠাৎ একটা স্প্যানিশ রণতরী লড়াইয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে সাহায্য চেয়ে সঙ্কেত দিল। সঙ্গে সঙ্গেই নড়তে শুরু করল প্রসপেরা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার থমকে দাঁড়িয়েও পড়ল সেটা। কারণ ভলপি ইতোমধ্যেই সেদিকে রওনা হয়ে গেছে। রাখামের দখল নিয়ে নিয়েছে সে। এখন বিপদগ্রস্ত স্প্যানিশ গ্যালির ডাকে সাড়া দিতে এগিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে রাখামের দাঁড় বাইবার বেঞ্চে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দিকৃত মুসলিম সৈন্যদের। ওই গ্যালিটাকেও সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে সে। এভাবেই চারটা কোর্সেয়ার গ্যালির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল তিনটার জায়গায় ছয়টা স্প্যানিশ গ্যালি। একের পর লড়াইয়ের ফল কোর্সেয়ারদের বিপক্ষে চলে গেল।

অবস্থা দেখে দ্রাগুত চাইল তখনই ওই লড়াইয়ে যোগ দিতে। কিন্তু তাকে বাধা দিল সিনান। পুব দিকের লড়াই দেখিয়ে বলল ওখানে যোগ দিলে ওদের ভাগ্যে হয়তো ভাল কিছু জুটতেও পারে। ওই লড়াই জিতলে তখন দল একটু ভারী করে এদিকে আবার মনোযোগ দেয়া যাবে। সিনানের পরামর্শের গভীরতা বুঝতে পারল দ্রাগুত। আর ঠিক তখনই দ্রাগুতকে অবাক করে দিয়ে উদয় হলো তিনটা কোর্সেয়ার গ্যালি। উল্লসিত হয়ে উঠল দ্রাগুত। কারণ ও ভেবেছিল ওই গ্যালি তিনটা ডুবে গেছে। উফুল্ল হয়ে বলল, সব প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লাহর। আল্লাহ তাঁর বিশ্বাসী বিপদগ্রস্ত বান্দাদের জন্য সাহায্য পাঠিয়েছেন। আমরা এখনো হারিনি, সিনান। এবার লড়াইয়ের পাল্লা আমাদের দিকে হেলবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য অবশ্যই বিজয় দেবেন।

তখন তাকে বাস্তবতা সম্বন্ধে অবহিত করল সিনান। বলল, ওই গ্যালিগুলো অবিশ্বাসীরা দখল করে নিয়েছে। দাঁড় বাইবার বেঞ্চে বসিয়ে দিয়েছে আমাদেরই মুসলিম ভাইদের। আর ওদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে সাবেক খ্রিস্টান বন্দিরা!

প্রচণ্ড রাগে সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল.দ্রাগুত। ক্ষিপ্ত কণ্ঠেই সিনানকে গালি দিয়ে বলল, আল্লাহ তুলে নিক তোমাকে, ওই গ্যালিগুলো ওদের হাতে পড়ল কেমন করে? তখন তুমি কী করছিলে?

ওগুলো যখন ওদের হাতে পড়ে তখন ওই লড়াইয়ে আমি ছিলাম না।

ব্যঙ্গ করে দ্রাগুত বলল, থাকবে কেমন করে, তখন তো তোমার কফিনে গ্রিজ মাখাচ্ছিলে। যেখানে দরকার সেখানে কখনোই তোমাকে পাওয়া যায় না।

সব প্রশংসা আল্লাহর, আপনার দরকারের সময় তিনিই আমাকে আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাহলে কেন আমাকে নিয়ে কটুক্তি করছেন? জবাব দিল সিনান।

এসব এখন আর দ্রাগুতের চোখে পড়ছে না। সে বলল, আল্লাহ সাক্ষী, যখন তলোয়ারে তলোয়ারে লড়াই বাধে, তার ধারে-কাছেও তুমি থাকো না, বলে পূর্বদিকে লড়াইরত গ্যালিগুলোর দিকে সিমিটার তুলে ইশারা করে বলল দ্রাগুত।

দ্রাগুতের বাড়ানো হাত ধরে মৃদু কণ্ঠে সিনান বলল, লড়াই নয়, ওখানে আমাদের নিশ্চিত মৃত্যু লেখা আছে।

যা হওয়ার তা হবেই। সবার ভাগ্যই পূর্ব নির্ধারিত। তুমি মরতে ভয় পাও, সিনান?

পাই, যদি আমার মৃত্যু আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়। আর ওখানে যারা অসম শক্তি নিয়ে নতুন করে লড়তে যাবে, আল্লাহর দয়ায় প্রাপ্ত প্রাণের প্রতি তাদের আত্মদানের কোন অর্থই থাকবে না, বলল সিনান।

রাগে চোখ বড়-বড় করে মুহূর্তখানেক সিনানের দিকে তাকিয়ে রইল দ্রাগুত। তারপর বলল, তোমার অজুহাতের অভাব নেই।

কথাটা সিনানের গায়ে লাগল। খেপে গিয়ে ও বলল, বেশ, যা ইচ্ছে করুন। ক্ষুদ্র একটা মুহূর্তের রাগ সামলাতে পারছেন না আপনি? আজকের ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বেঁচে থাকার বদলে ইসলামের উন্মুক্ত তরবারি কিনা চাইছে লড়াইয়ের নামে আত্মহত্যা করতে। বাহ…।

কথাগুলো দ্রাগুতকে নাড়া দিয়ে গেল। সত্যিই তো, আজকের যুদ্ধ সে সত্যিই হেরে গেছে। এখান থেকে কিছুই আর ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। পুব দিকে চারটা কোর্সেয়ার গ্যালি লড়ছে বটে। কিন্তু বিপক্ষ অনেক ভারী। খ্রিস্টানদের পক্ষে ওখানে লড়ছে ছয়টা গ্যালি। পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আরেক জায়গায় ছয়টা কোর্সেয়ার গ্যালির বিপক্ষে লড়ছে আটটা খ্রিস্টান গ্যালি। এর উপর ব্যাপক সামরিক সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে প্রসপেরোর বিশাল গ্যালিসে প্রসপেরা। ওটার ক্রু আর যোদ্ধারা এখনও লড়াইয়ে নামেইনি। ওটা যে-কোন লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

বাস্তবতা-দৃষ্টে একবার গুঙিয়ে উঠে তীব্র হতাশায় মুখ ঢাকল দ্রাগুত। তারপর গিয়ে ঢুকল জামিলের টিবারনাকলে। তলোয়ারটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। মুখ ঢেকে ডিভানে বসে তার এই দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে অভিশাপ দিতে থাকল সে। মাত্র দুই ঘণ্টা আগেও সে ছিল শক্তিশালী এক ফ্লিটের সম্মানিত কমাণ্ডার। তার জাহাজের হোল্ড ভরা ছিল অজস্র রত্ন আর সম্পদে।. আর ছিল পালমা থেকে ধরে আনা যুবক-যুবতীরা। এমনকী পোর্ট অ্যাহন থেকেও একইরকম লাভ করার আশা করেছিল সে। কিন্তু খোদার গজবের মত কোত্থেকে এই খ্রিস্টান ফ্লিট উঠে এসে ধ্বংস করে দিল সব। ওর নিজের গ্যালিসেটা কেপ মোলার পাথুরে তীরে আছড়ে পড়েছে। ওটার হোল্ডেই ছিল ওই সমস্ত ধনরত্ন আর বন্দিরা। সুন্দরী মেয়েগুলোকে হয়তো সুলতানের হারেমে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু বাকিদের ভাগ্যে ছিল। সৌক আল আবিদ-এর দাসবাজার। অতগুলো বন্দি থেকে বিপুল পয়সার মুখ দেখত দ্রাগুত। কিন্তু মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে সবকিছুই এখন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। এর জন্য দায়ী কেবল এক শয়তানের চ্যালা, যে কিনা শয়তানেরই ছত্রচ্ছায়ায় ওকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর শপথ, এক মাঘে শীত যায় না। একদিন এর জন্য ওই লোকটাকে ওর কাছে হিসেব দিতে হবে।

টিবারনাকলের প্রবেশমুখে এসে দাঁড়িয়েছে সিনান। নীরবে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখল ইস্পাতের মত শক্ত, গর্বিত দ্রাগুতের দর্প চূর্ণ হওয়া। কিন্তু ওকেও নিজেদের চামড়া বাঁচানোর কথা ভাবতে হচ্ছে। মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল, সময় থাকতে থাকতেই এখান থেকে সরে যাওয়ার হুকুম করবেন?

শোকার্ত দ্রাগুত মাথা তুলে বলল, পালানোর জন্য অস্থির হয়ে গেছ, না? ঠিক আছে, যাও, হুকুম করো।

কথা না বাড়িয়ে নীরবে চলে গেল সিনান। কোথাও কোন ভেরী বাজল না বা সঙ্কেতসূচক পতাকাও তোলা হলো না, কোথাও। নীরবে পানিতে নেমে এল জামিলের দাঁড়গুলো। সর্বোচ্চ গতি তুলে দক্ষিণ সাগরের দিকে রওনা হয়ে গেল জামিল। কেউ ধাওয়া করল না গ্যালিটাকে। করবে কী করে, স্প্যানিশ বাহিনী তখন লড়াইয়ের মিষ্টি ফল ঘরে তুলতে ব্যস্ত। অর্থাৎ কেপ মোলার এই মহান লড়াইয়ে কোর্সেয়ার ফ্লিটের বেঁচে যাওয়া গ্যালিগুলো দখল করছে তারা।

আরেকটা বিষয়, জামিলের সঙ্গে দ্রাগুতও যে পালিয়ে গেছে সেটা কারো নজরেই আসেনি। তবে তারপরও জামিলের পালিয়ে যাওয়াটা মুসলিম সেনাদের জন্য একটা সঙ্কেত যে, এবার আত্মসমর্পণ করতে পারো।

.

৩৩.

 সম্রাটের স্বস্তি

স্মরণীয় এই যুদ্ধের লাভক্ষতির হিসাব নিল প্রসপেরো। চোদ্দটা গ্যালি নিয়ে এখানে এসেছিল ও, এখন ছাব্বিশটা গ্যালি নিয়ে ফিরবে। দ্রাগুতের তেরোটা গ্যালি দখল করতে গিয়ে প্রসপেরো কেবল ওর নিজের একটা গ্যালি হারিয়েছে। এই ছাব্বিশটা গ্যালির মধ্যে দ্রাগুতের ক্যাপিটানা, যেটা ঢেউয়ের ধাক্কায় তীরে আছড়ে পড়ে প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল, সেটাকে গোনায়ই ধরেনি। তবে ওটার ক্রুদের বন্দি করে দাঁড় বাইবার কাজে লাগানো হয়েছে। পক্ষান্তরে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে খ্রিস্টান দাসদের। দ্রাগুতের ব্যবহৃত দ্বিতীয় ক্যাপিটানাকেও আনা হয়নি। কেপ মোলার পাড়ে ফেলে আসা হয়েছে ওই জাহাজটাকে। তবে এটার ক্রুদের তুলে আনা হয়েছে। মুক্তি দেয়া হয়েছে বন্দিদের। উপরন্তু এর হোল্ডে পাওয়া গেছে পালমা ও অন্যান্য জায়গা থেকে লুট করে আনা বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা, প্রচুর রত্ন আর মেজরকা থেকে ধরে আনা প্রায় তিনশ যুবক-যুবতাঁকে। এদের ভাগ্যে প্রায় নির্ধারিতই হয়ে গিয়েছিল যে, দাসবাজারে বিক্রি করা হবে। বেঁচে গেছে ওরা। মুক্ত করা দাসের সংখ্যা হিসেব করতে গিয়ে প্রসপেরো দেখল যে প্রায় তিন হাজার খ্রিস্টান দাস মুক্তি পেয়েছে। একইসঙ্গে দুই হাজার মুসলিম যোদ্ধা ও নাবিককে বন্দি করে স্প্যানিশ বাহিনীর নৌযানগুলোয় দাঁড় বাইবার কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

গতকাল যারা দাসদের পিঠে চাবুক চালিয়েছে, আজ তারাই বাধ্য হয়েছে ওই দাসদের বেঞ্চে বসতে। আর ওদের পিঠে চাবুক-নির্দেশ দিয়ে চলেছে সেই সাবেক দাসেরাই। কী ভাগ্য! যা হোক, পতাকা নেড়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রসপেরোদের সাদরে বরণ করে নিল পোর্ট অ্যাহনবাসীরা। মিনোরকার অধিবাসীরা তীরে দাঁড়িয়ে কোর্সেয়ারদের সঙ্গে প্রসপেরোদের লড়তে দেখেছে। তাই জানে ওরা এখনো স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে পারছে কেবল এই স্প্যানিশ যোদ্ধাদের কল্যাণে। কাজেই তাদেরকে বীরের মত স্বাগত জানাল নগরবাসীরা।

নাবিক আর যোদ্ধারা ব্যস্ত নগরবাসীদের দেয়া উপহার সংগ্রহ ও তাদের পাঠানো ওয়াইনের কাপে চুমুক দিতে। শুক্রবার ক্যাথেড্রালে ওদের সৌজন্যে বিশেষ সারমনের আয়োজন করা হলো। মেজরকা থেকে এলেন আর্চবিশপ। সারমনের বক্তৃতার সময় নগণ্য সংখ্যক গ্যালি নিয়ে অত বড় কোর্সেয়ার ফ্লিটের বিরুদ্ধে জয় পাওয়াকে তিনি তুলনা করলেন গোলিয়থের বিরুদ্ধে নবী ডেভিডের জয়ের সঙ্গে। লড়াইয়ে নিহত চারশ স্প্যানিশ সেনাদের আত্মার কল্যাণে চার্চে বিশেষ প্রার্থনা করা হলো।

পোর্ট অ্যাহনে তিনদিন অবস্থান করল নিয়াপলিটান ফ্লিট। এই কয়দিনে ক্ষতিগ্রস্ত গ্যালিগুলো আবার সাগরে নামাবার জন্য যথাসম্ভব মেরামত করা হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, লড়াইয়ে সবগুলো গ্যালিই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ওগুলোতে প্রয়োজনীয় সাপ্লাই তোলা হলো আর দাস ও নাবিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজটাও করতে হলো। শৃঙ্খলা বলতে, নাবিকরা আসলে মাটিতে নামার সুযোগ পায় খুব কম। ফলে যখনই তারা এই সুযোগ পায়, চেষ্টা করে সুদে-আসলে সবটা পুষিয়ে নিতে। কিন্তু এই করতে গিয়ে নৌবাহিনীর সাধারণ শৃঙ্খলা ও দায়িত্বের কথা ভুলে যায় তারা। তখন তাদেরকে শুড়িখানা থেকে তুলে এনে, যার জন্য যেমন দরকার তেমন-নরম হয়ে, গরম হয়ে, শাস্তি দিয়ে, পুরস্কার দিয়ে তাদের মধ্যে আবার শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনা হয়।

যা হোক, পরদিন, সোমবার সকাল। মিনোরকার পোর্ট অভ অ্যাহন থেকে নোঙর তুলল নিয়াপলিটান ফ্লিট। গন্তব্য স্পেনের বার্সেলোনা। অবশ্য পরিচর্যার জন্য মিনোরকানদের জিম্মায় রেখে যাওয়া হচ্ছে প্রায় তিনশ মারাত্মক আহত সেনাকে। এরা এতই অসুস্থ যে সমুদ্রযাত্রার ঝক্কি সহ্য করতে পারবে না।

এদিকে মিনোরকা রক্ষায় নিয়াপলিটান ফ্লিট পাঠানোয় স্পেনের সম্রাটকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে আর্চবিশপ আর গভর্নর। চিঠিটা পাঠানো হয়েছে একটা ফ্রিগেটে করে। চিঠিতে কেপ মেলায় নিয়াপলিটান ফ্লিটের বীরত্ব ও তাদের মহান বিজয়ের নাটকীয় বর্ণনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে প্রসপেরোদের। সত্য বলতে, ঘটনা যেভাবে ঘটেছে। তার চেয়েও নাটকীয় বর্ণনা করা হয়েছে চিঠিটায়।

লড়াইয়ের পর কারবাজাল ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে যে, তার আর প্রসপেরোর রক্তটাই শুধু আলাদা, কিন্তু এছাড়া ওরা দুজন আপন ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। ডন চাইছে–সম্রাটের কাছ থেকে রাজকীয় ধন্যবাদ নেয়ার জন্য প্রসপেরো নিজে যেন ফ্লিট নিয়ে বার্সেলোনার দিকে রওনা হয়।

কিন্তু প্রসপেরো তাতে সম্মত হয়নি। ও বলেছে, নেপলসে একটা মেয়ে আমার ভাল-মন্দের চিন্তায় উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে আছে। দুশ্চিন্তায় হয়তো পাগল হওয়ার দশা হয়েছে তার। দুনিয়ার সব সম্রাটের কাছ থেকে ধন্যবাদ পাবার চেয়ে আমার কাছে বরং তাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করাটা বেশি জরুরি। সামনাসামনি দেখা করতে না পারলে অন্তত তাকে চিঠি লিখে হলেও সব জানাতে হবে, বলে চিঠি লেখার জন্য গেল প্রসপেরো।

তবে চিঠি লেখার আসলে দরকার ছিল না। কারণ সেই কাজ ইতিমধ্যেই গভর্নর আর আর্চবিশপ করে ফেলেছেন। তবে প্রসপেরোর চিঠির উদ্দেশ্য ভিন্ন। আসলে ও জিয়ান্নার কাছে প্রমাণ করতে চাইছে যে, প্রতিশোধের সুযোগ পেলেই তার সদ্ব্যবহার করা ওর অভ্যাস নয়। তাছাড়া ও এখানে এসেছে জেবরায় ওর হাতে ঘটে যাওয়া অঘটনের ফলে খ্রিস্টানদের যে ক্ষতি হয়েছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে। মানে ওর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যতটুকু সম্ভব তা-ই করতে। এখন সাফল্য ওর হাতে ধরা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত খ্রিস্টানদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও হয়েছে। তাই, প্রসপেরোর মতে এখন ওর দায়িত্ব হচ্ছে ডোরিয়ার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। এই মানসিকতা নিয়ে সম্রাটকে চিঠি লিখতে বসল প্রসপেরো:

ইয়োর ম্যাজেস্টি এতদিনে নিশ্চয়ই অবগত হয়েছেন যে কোর্সেয়ার দ্রাগুতকে ধরার জন্য জেবরায় ফাঁদ পেতেছিল ডিউক অভ মেলফি, লর্ড ডোরিয়া। কিন্তু স্বর্গের নির্ধারিত নিয়তি অনুসারে তাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল দ্রাগুত। লর্ড, ডোরিয়া পুবের সাগরে টহল দিচ্ছিলেন। তাই আমার উপর বর্তায় পশ্চিম সাগর টহল দেয়ার দায়িত্ব। আর আমার সৌভাগ্য যে, পোর্ট অ্যাহনেই দ্রাগুতকে পেয়ে যাই আমি। তখনই ওর ফ্লিটের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো কোর্সেয়ার ফ্লিট ধ্বংস করে দিই। তবে এই কাজের মূল পরিকল্পনা ডিউক অভ মেলফি লর্ড ডোরিয়ারই ছিল।

আলভারোও সম্রাটকে কোন চিঠি লিখে বসতে পারে, তাই তাকে নিজের চিঠিটা দেখাল প্রসপেরো। চিঠি পড়েই আপত্তি করল আলভারো। বলল, এটা তো সত্যি নয়!

কিন্তু এরমধ্যে মিথ্যে কী পেলেন, বলুন তো? আলভারোকে প্রশ্ন করল প্রসপেরো।

আবার চিঠিটা পড়ল আলভারো। বলল, নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না কোন্ কথাটা মিথ্যে। কিন্তু বক্তব্যটায় সত্যতা নেই। এই লড়াইয়ে ডোরিয়া কোথায় কী করল যে, ওকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন?

জবাবে প্রসপেরো বলল, ডোরিয়ার পরিকল্পনা ছিল দ্রাগুতকে ধ্বংস করা। ওই পরিকল্পনাটাই তো বাস্তবায়িত হলো, তাই না? এখন বলুন, ডোরিয়া কী পুব সাগরে চষে বেড়াচ্ছিল না? আর নিয়াপলিটান ফ্লিট তো তারই অধীন স্প্যানিশ নৌবাহিনীর অংশ।ভুল বলেছি?

তখন আলভারো বলল, এই মহান অর্জনকে পায়ে ঠেলে দিয়ে আসলে কী পেতে চাইছেন আপনি?

ঋণের দায় থেকে মুক্তি পেতে চাইছি, সম্মানের ঋণ।

কিন্তু আমার দৃষ্টিতে ডোরিয়ার কাছে আপনার কোন ঋণ নেই, বরং উনিই আপনার কাছে ঋণী।

পুরো বিষয়টা আপনি জানেন না। তাই একথা বলছেন। কিন্তু এই বিজয়ের কৃতিত্ব আমি ডোরিয়াকেই দিতে চাই, বলল প্রসপেরো।

প্রসপেরোকে খুশি করার জন্য ওর কথায় আপাত সম্মতি দিল আলভারো। কিন্তু মহান এই যুদ্ধের জয় যে কেবলমাত্র প্রসপেরোর কুশলী রণনৈপুণ্যের জন্যই হয়েছে তাতে আলভারোর মনে। কোনরকম সন্দেহ নেই। প্রসপেরোর বুদ্ধিতেই বিশাল গ্যালিয়নটাকে বিরাট একটা বোমায় রূপান্তর করা হয়েছে। আর সেটা ব্যবহার করেই এক ধাক্কায় হেঁটে ফেলা গেছে কোর্সেয়ার ফ্লিটের তিন ভাগের একভাগ। আলভারোর তখন মনে হচ্ছিল আসলেই অজেয় এক যোদ্ধা প্রসপেরো।

শেষ কথাটা খানিকটা বাড়িয়ে বলা হলেও চিন্তাটা কেবল আলভারোর একার না। আরো অনেকেই প্রসপেরোর ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করে। কারণ এত অল্প শক্তি নিয়ে জয় ছিনিয়ে আনার ইতিহাস কেবল এই লা মোলারই নয়, বরং প্রসিডার বিজয়ও ছিল একইরকম বীরত্বপূর্ণ। এসব জয়ের ফলে জনমনে প্রসপেরোরকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস আছে তা ভুল বলার বা অস্বীকার করার খুব একটা সুযোগ নেই। তবে, খানিকটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, স্পেন সম্রাট পঞ্চম চার্লস ওকে নিয়ে বা ওর সাফল্য নিয়ে ততটা উচ্ছ্বসিত নন।

.

পনেরো দিন আগের কথা। খবর পৌঁছেছে জেবরায় দ্রাগুতকে ফ্লিট সমেত ফাঁদে ফেলেছে ডোরিয়া। এখন ওকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করার জন্য স্থলবাহিনীর সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে ডোরিয়া।

খবর শুনে দারুণ উচ্ছ্বসিত সম্রাট। নিয়াপলিটান ফ্লিটের সঙ্গে জেবরায় যাবার জন্য তিনি নিজেও চলে আসেন বার্সেলোনায়। ইচ্ছা, দ্রাগুতের ধ্বংস নিজের চোখে দেখবেন। ডোরিয়ার জেবরা সাফল্যকে সম্রাট নিজের সাফল্য বলেই মনে করছেন। কারণ রাজসভার অনেক গণ্যমান্য সভাসদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ডোরিয়াকে তার নৌবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। সুতরাং ডোরিয়া সফল হলে সম্রাটের বিরোধিতাকারীদের খোতা মুখ ভোতা হয়।

কিন্তু তারপরই খবর আসে, ডোরিয়ার ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে দ্রাগুত। এমনকী যে-কোন সময়ের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর রূপে খ্রিস্টান নগর-বন্দরগুলোর উপর হামলে পড়ছে সে। শুনে যারপরনাই মুষড়ে পড়লেন সম্রাট। ডোরিয়ার সামর্থ্য নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠল নিজের মনেই। যদিও অতীতে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে সে, কিন্তু এবারের ব্যর্থতা সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। সবাই প্রশ্ন তুলছে, ওই সাফল্যগুলোর কতটা আসলেই তার নিজের অর্জিত, কতটা শত্রুদের দুর্বলতার কারণে প্রাপ্ত আর কতটাই বা ডোরিয়ার নিজের অধীনস্থদের বুদ্ধি ও দক্ষতার মাধ্যমে অর্জিত।

এই অবস্থায় সম্রাটের রাগের আগুনে ঘি ঢালতে উপস্থিত হয়ে যায় অনেকেই। এদের মধ্যে একটা দল হচ্ছে, যাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্রাট ডোরিয়াকে নিয়োগ দিয়েছেন, তারা। আরেকটা দল হচ্ছে যারা ডোরিয়ার আসনটা পেতে চেয়েছিল। বলাই বাহুল্য, উভয় দলই ডোরিয়ার ধ্বংস দেখতে উদ্গ্রীব। কিন্তু এদের বিষোদ্গার মোটেও কানে তুললেন না সম্রাট। বরং ওদের সবার উপরই তেতে উঠতে লাগলেন তিনি।

ডোরিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগারকারীদের মধ্যে প্রসপেরোর সুবন্ধু মারকুইস ডেল ভাস্টোও আছে। শোকাহত ডেল ভাস্টো বিশ্বাস করে ডোরিয়ার অবিবেচনা আর ভুল রণকৌশলের কারণেই সে তার বন্ধু প্রসপেরোকে হারিয়েছে। গোইয়ালাতার লড়াইয়ে প্রসপেরোর সাফল্যের কথা সরাসরিই তুলল সে। বলল, ডোরিয়ার অধীন এক ক্যাপ্টেনের নিপুণ রণকৌশল আর চরম সাহসিকতার জন্যই আজও হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে ডোরিয়া। সেই ক্যাপ্টেনের নাম প্রসপেরো। প্রথমে জেনোয়ায়, পরে স্প্যানিশ বাহিনীতেও ডোরিয়ার অধীনে কাজ করেছে সে। শেষ পর্যন্ত শার্শেলে সম্রাটেরই পাঠানো মিশনে সেই ডোরিয়ারই অধীনে কাজ করতে গিয়ে বীরত্বের সঙ্গে আত্মত্যাগ করেছে প্রসপেরো। মারকুইস অভিযোগ করল, গোইয়ালাতার লড়াইয়ে ডোরিয়াকে বাঁচিয়েছিল প্রসপেরো। কিন্তু শার্শেলে প্রসপেরোকে সে সাহায্য তো করেইনি, উল্টো ওকে মৃত্যুর মুখে ফেলে চলে এসেছে অ্যাডমিরাল ডোরিয়া।

কথাগুলো শুনে হতাশার সঙ্গে মাথা নাড়ল সম্রাটের সভার গণ্যমান্য সভাসদবৃন্দ। ডোরিয়ার এই রূপ উন্মোচিত হওয়ায় নাবিক হিসেবে তার প্রকৃত মূল্য কতটুকু তা নিয়েও এখন তারা সন্দিহান। তবে নিজেদের মনোভাব এর বেশি আর কেউ প্রকাশ করল না। কারণ এ-ই যথেষ্ট। ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট লজ্জিত রোধ করছেন সম্রাট। বিদেশি এক অ্যাডমিরালের ব্যর্থতার দায়ে সভাসদদের কথা শুনতে হচ্ছে তাকে।

ঠিক এই সময়ই সম্রাটের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে খবর পৌঁছুল মেজরকায় আক্রমণ করেছে দ্রাগুত। স্প্যানিশ রাজত্বের দোরগোড়ায় আঘাত হেনেছে সে। খবরটা শুনে সম্রাট এতই রেগে গেলেন যে, তার মুখ দিয়ে কথাই সরছে না। কিন্তু অন্যদের মুখ তো আর বাধা নেই। এবার প্রকাশ্যেই তারা ডোরিয়ার বড়-বড় কথা বলা আর কাজ না করার সমালোচনা করতে শুরু করল।

যা হোক, ভীষণ হতাশ মনে নৌযাত্রার চিন্তা বাদ দিয়ে বার্সেলোনা থেকে মাদ্রিদে ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন সম্রাট। আর ঠিক তখন আঁধারের বুক চিরে ছুটে আসা প্রথম আলোর মত দারুণ আশাপ্রদ একটা খবর পৌঁছুল সম্রাটের কানে। অসম শক্তি নিয়ে লড়েও লা মেলায় বিশাল জয় পেয়েছে নিয়াপলিটান ফ্লিট, ধ্বংস হয়ে গেছে দ্রাগুতের বহর, মেজরকার দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়েছে আর মুক্তি পেয়েছে অসংখ্য খ্রস্টান বন্দি দাস।

খবরগুলো এসেছে প্রসপেরোর চিঠির মাধ্যমে। এবং এর সত্যতার নিশ্চয়তা দিয়েছে লা মোলার স্প্যানিশ গভর্নরের পাঠানো চিঠি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন: ইয়োর ম্যাজেস্টির ক্যাপ্টেন জেনারেলের অধীন ক্যাপ্টেন মেসার প্রসপেরোর নেতৃত্বে দারুণ বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে দ্রাগুতের ফ্লিটকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিয়েছে নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন। আমরা দ্বীপবাসীরা আপনার মাধ্যমে আপনার বাহিনীর ক্যাপ্টেন জেনারেল, তার অধীন ক্যাপ্টেন ও অন্য সবাইকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তাদের সময়োচিত ও অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপের ফলেই আমরা আজও স্বাধীন আছি। এটা তাদেরই কৃতিত্ব যে, মিনোরকাবাসীদের মেজরকার মত দুর্ভাগ্যবরণ করতে হয়নি।

চিঠিটা স্বস্তির সাগরে ভাসিয়ে দিল সম্রাটকে। ডোরিয়ার জন্য ব্যাপারটা অবশ্যই স্বস্তিকর। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই বিজয়ে সবচেয়ে বড় স্বস্তি পেয়েছেন স্বয়ং সম্রাট। এবার যারা ডোরিয়ার সমালোচনার নামে কার্যত তাঁরই সমালোচনা করেছে। তাদের টুটি চেপে ধরবেন তিনি। সমালোচকদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চিঠি দুটোর ব্যাপক প্রচার করলেন সম্রাট। সমালোচকদের বললেন অযথাই তারা ডোরিয়ার সমালোচনা করেছে। জেবরা থেকে যে কারণেই দ্রাগুত ছুটে গিয়ে থাকুক, এবার লা মোলায় সে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই জেবরার ঘটনায় ডোরিয়া অবশ্যই ক্ষমার যোগ্য। আর লা মোলায় বিজয় অর্জিত হয়েছে। ডোরিয়ার অধীন এক ক্যাপ্টেনের মাধ্যমে। কাজেই এই বিজয় ডোরিয়ার বিজয়ও বটে। একইসঙ্গে এটা তাঁরও বিজয়। কারণ ডোরিয়াকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।

সম্রাটের মুখে এমন স্পষ্ট কথা শুনে এমনকী ডেল ভাস্টোও আর কথা বাড়াবার সাহস পেল না। নিজের অবস্থান সে ভাল মতই জানে। আর সম্রাটের মনও খানিকটা বোঝে। তাই সে ভাল করেই বুঝতে পারছে, এখন প্রসপেরোকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রসপেরোর প্রতি সম্রাটের মনই কেবল বিষিয়ে তোলা হবে। উপকার কিছুই হবে না। যদিও ডেল ভাস্টো খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে, ডোরিয়ার কারণে নয়, বরং যুদ্ধক্ষেত্রে ডোরিয়া অনুপস্থিত থাকার ফলেই এই অসম লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছে প্রসপেরো।

.

৩৪.

 প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন

ঠিক যেদিন কেপ লা মোলায় দ্রাগুতের সঙ্গে লড়াই করছে প্রসপেরো, সেদিনই জেবরায় পৌঁছুল নেপলস থেকে আসা একটা গ্যালিয়ট। ওটায় করে ভাইসরয়ের পাঠানো সংবাদ নিয়ে এসেছে মেসার পাওলো কারাসসোলো।

কারাসসোলো বয়সে তরুণ, লম্বা ও সুদর্শন। মাথায় লালচে সোনালি চুল। সবসময় ক্ৰিপাত্মক একটা ভাব লটকে থাকে তা ঠোঁটের কোণে। নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে কখনো একটুও দ্বিধা করে না সে। তবে অন্যদের মনোভাবের থোড়াই পরোয়া করে। এক কথায় উদ্ধত একটা লোক।

ভাইসরয় প্রিন্স অভ অরেঞ্জের পাঠানো সংবাদটা সে জেবরা। নিয়ে এসেছে, কারণ পুরো ব্যাপারটা তার কাছে কৌতুককর বলে মনে হয়েছে। অ্যাডমিরালের গ্যালিতে যখন সে পা রাখল, ভাতিজাদ্বয়কে নিয়ে ডিনার করছে ডোরিয়া।

সরাসরি ডোরিয়ার কাছে চলে এল লোকটা। এসেই বলল, হিজ হাইনেস, দ্য প্রিন্স অভ অরেঞ্জ আপনাকে অভিবাদন জানিয়েছে। জানতে চেয়েছে এই মুহূর্তে এখানে ঠিক কী করছেন আপনি।

তিন জোড়া চোখ একসঙ্গে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল। তিনজনই ভাবছে, লোকটা পাগল নাকি। ডোরিয়ার মুখে প্রতিধ্বনিত হলো তারই প্রশ্ন, কী করছি আমি?

হ্যাঁ, সেটাই ভাইসরয়ের প্রশ্ন, এখানে কী করছেন আপনি?

দ্বিধায় পড়ে গেছে ডোরিয়া, কিন্তু…কিন্তু…নেপলসে কি আমার বার্তা পৌঁছেনি? আমি সৈন্য চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছি। জেবরায় সৈন্য মোতায়েন করতে হবে।

ওহ্, ওই বার্তা। কিন্তু সে তো জেবরা উপসাগর ছেড়ে দাগুতের বেরিয়ে যাওয়ার অনেক আগের কথা, বলল কারাসসোলো।

বেরিয়ে যাওয়ার আগের কথা! বিস্ময়ে ডোরিয়ার চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা।

মুখ খুলল ফিলিপ্পিনো, আপনি হয়তো বলতে পারবেন, এই মুহূর্তে কোথায় আছে দ্রাগুত।

কোথায় আছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে কোথায় নেই তা নিশ্চিতভাবে জানি। জেবরা উপসাগরে সে নেই, বলল কারাসসোলো।

জেবরায় নেই? হাহ্! নির্ঘাত আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।

ওদের কথা শুনে একটু অস্বাভাবিক আচরণ করল জিয়ানেটিনো। হেসে উঠল সে। হাত তুলল যেন কিছু একটা বলবে, কিন্তু আবার নিজেকে সামলে নিল। ওর মুখ দিয়ে শুধু বের হলো, বোঝো এবার…।

তখন রীতিমত হুঙ্কার দিয়ে উঠল ফিলিপ্পিনো, আসলেই কি আপনি ভাইসরয়ের কাছ থেকে এসেছেন? নাকি ধাপ্পাবাজি করতে এসেছেন এখানে?

কথাটা গায়ে লাগল কারাসসোলোর। ব্যঙ্গ করে সে বলল, এভাবে কথা বলা সভ্য আচরণ নয়। এখানে আসার জন্য লিখিতভাবে আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে। লেখাটা পড়ে ক্ষমা চাইবেন আপনি। আর ওই একই চিঠিতে দেখবেন, দশ দিন আগে কর্সিকার উপকূলে আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়িয়েছে দ্রাগুত।

তা হতে পারে না, এ স্রেফ মিথ্যাচার, অবিশ্বাসী কণ্ঠে আপত্তি জানিয়ে বলল ডোরিয়া।

এটাই সত্য।

হয়তো অন্য কেউ দ্রাগুতের নাম ভাঙিয়ে এমনটা করছে, বলল ফিলিপ্পিনো।

কিন্তু কারাসসোলো নিশ্চিত করল যে উপকূলে হামলাকারীদের পরিচয় নিয়ে কোন সংশয় নেই! বলল, অন্তত, দশ দিন ধরে দ্রাগুত এখানে নেই। আমার তো সন্দেহ, আদৌ,সে এখানে এসেছিল কিনা।

কথাটা শুনে রাগে রক্ত উঠে এল অ্যাডমিরালের চেহারায়। হুঙ্কার দিয়ে সে বলল, দ্রাগুতের পুরো ফ্লিটকে ধাওয়া করে এখানে এনে ঢুকিয়েছি আমি। তারপর থেকেই তো জেবরা প্রণালী একমাত্র প্রবেশমুখে বসে আছি আমি। তাহলে সে পালাবে কোথা দিয়ে?

মেসার কারাসসোলো বিড়বিড় করে বলল, মুসলিমরা বলে৷ আল্লাহর দ্বারা সবই সম্ভব। তাই বলছি, আপনারা যদি বিশ্বাস করেন দ্রাগুত এখানে বন্দি, তাহলে আমি বলব, সে যে এখান থেকে পালিয়ে গেছে সেই বিষয়েও কোন অনিশ্চয়তা নেই। তাই…পরের কথাগুলো বলল সে বিদ্রুপাত্মক দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে, …কোন সন্দেহ নেই, সম্রাটের রোষ হজম করতে হবে আপনাকে।

দেখি, আপনার চিঠিটা দেখান, বলল ডোরিয়া। চিঠিটা বাড়িয়ে ধরতেই থাবা দিয়ে কারাসসোলোর হাত থেকে সেটা নিয়ে নিল সে।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে মাথার হ্যাট খুলে ফেলল কারাসসোলো। ওটা দিয়েই নিজেকে বাতাস করতে লাগল সে। বলল, আগেও শুনেছি, কিন্তু আজকের আগে কখনো বিশ্বাস করিনি যে জেনোয়িসরা আসলেই সৌজন্যবোধের পরোয়া করে না। কিন্তু তার বিদ্রূপ তিনজনের কারো কানে যায়নি বা গেলেও কেউ গ্রাহ্য করল না। ওদের বরং ভাবার মত আরো বড় বিষয় দিয়েছে সে।

দুই ভাতিজাকে দুই পাশে নিয়ে চিঠিটা পড়ছে ডোরিয়া। অক্ষরগুলোর উপর ঝড়ের গতিতে তার দৃষ্টি ছুটে যাচ্ছে। স্তম্ভিত ফিলিপ্পিনোকে দেখে মনে হচ্ছে ওর হৃৎস্পন্দনও বুঝি থেমে গেছে। অপরদিকে জিয়ানেট্টিনোর মেয়েলি মুখে লটকে আছে একটা তিক্ত হাসি। কারণ গত এক সপ্তাহ ধরে ও ক্রমাগত চেঁচিয়ে যাচ্ছে যে দ্রাগুতের দুর্গের সবকিছু ভীষণ ঠাণ্ডা মেরে আছে। কিছুই নড়ছে না। তাই ও চাইছিল একটু সামনে গিয়ে দুর্গের কামানের সামনে বড়সড় একটা টোপ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে।

কিন্তু ওর চাচা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, কোন অবস্থাতেই অমন কিছু করা যাবে না। তার ভাষ্য ছিল, হ্যাঁ, নিজেকে টোপ বানাও আর ওই ডাকাতটার ইচ্ছে পূরণ হোক। বদমাশটা শেয়ালের মত ওত পেতে লুকিয়ে আছে। চাইছে আমরা যেন বোকা হাঁসের মত ওর সামনে গিয়ে ধরা দিই। খবরদার, স্থলবাহিনী এখানে পৌঁছানোর আগে কিছুই করবে না। ততদিনে ডাকাতটা ওখানে বসে থেকে নিজেকে শেয়াল ভাবতে থাকুক। ওর ভণ্ডামিতে আমি ভুলছি না।

জবাবে জিয়ানেট্টিনো বলে, আচ্ছা ঝুঁকি নেয়ার চিন্তা বাদ দিলাম, কিন্তু ওরা কী করছে তা তো খবর নেয়া দরকার।

ওর আর কী করার ক্ষমতা আছে! ডোরিয়ার নিস্পৃহ জবাব।

জিয়ানেট্টিনোর মন্তব্য, জানি না কী করছে, কিন্তু আমার মন বলছে কিছু একটা গণ্ডগোল অবশ্যই আছে।

মনে হলে হোক। তোমার মনের চেয়ে আমি বরং আমার যুক্তি-বুদ্ধির উপরই বেশি নির্ভর করব, জবাব দিয়েছিল ডোরিয়া।

এখন চিঠিটা হাতে নিয়ে সবাই দেখছে, ডোরিয়ার যুক্তি-বুদ্ধির চেয়ে জিয়ানেট্টিনোর বোকা মনই বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। রীতিমত আর্তনাদ করে জিয়ানেট্রিনো বলল, দেখেছেন, আগেই বলেছিলাম, এখানে কোথাও একটা ঘাপলা আছে।

অ্যাডমিরালের রাগের আগুনে ঘি ঢালার জন্য এটাই বাকি ছিল। এমন রাগত দৃষ্টিতে জিয়ানেট্টিনোর দিকে সে তাকাল, যেমনটা জিয়ানেট্রিনো আগে কখনো দেখেনি। ডোরিয়া বলল, বোকার অনুমান কখনো এমন সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে যায় যা জ্ঞানীর দৃষ্টি থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু বোকার অনুমান নিয়ে কে মাথা ঘামায়? তারপর বার্তাবাহকের দিকে ফিরে সংযত কণ্ঠে বলল, চিঠিটা পড়ে সব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এ সত্যি হতে পারে না, ঈশ্বরের শপথ, এ কেমন করে সত্যি হয়? ডোরিয়ার হাঁটু কাঁপছে। পাশের একটা টুলে বসে পড়ল সে। ভাবছে, এই ষাট বছর বয়সে এসে এভাবে আছাড় খেতে হবে তা কল্পনাও করেনি কখনো।

তখনই এগিয়ে এল জিয়ানেট্টিনো। বলল, মাই লর্ড, এতদিন যা করতে নিষেধ করেছেন, তা-ই করতে যাচ্ছি এখন। জেবরায় নামব, সব সন্দেহ নিরসন করে তবেই ফিরে আসব, বলে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল জিয়ানেট্টিনো।

সূর্য ডোবার পর ফিরে এল জিয়ানেট্রিনো। এসে দেখল ফিলিপ্পিনো আর সকালের সেই লোকটাকে নিয়ে বসে আছে অ্যাডমিরাল। যে গল্প নিয়ে ও ফিরেছে, ভাইসরয়ের পাঠানো চিঠির সঙ্গে তার কোনরকম দ্বন্দ্ব নেই। বরং চিঠির বক্তব্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিয়ে ফিরেছে ও। জেনে এসেছে যে, ওরা যখন জেবরার প্রবেশমুখ পাহারা দিচ্ছে, দ্রাগুত তখন পিছনে দরজা বানিয়ে সেটা দিয়ে ভেগেছে। জিয়ানেট্টিনোকে ওদের কাটা খালও দেখিয়েছে জেবরার শেখ।

অ্যাডমিরালের কাছে রিপোর্ট করছে জিয়ানেট্টিনো, শেখ লোকটা বলেছে, একজন ফ্র্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে ওই খাল কাটা হয়েছে। ফ্র্যাঙ্ক লোকটার নাম প্রসপেরো। তিক্ত হেসে সে বলল, আমাদের বন্ধুর ধূর্ততায় আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। ওর মেধা আর বুদ্ধি ঠিকঠাক মত ব্যবহার করা গেলে আমরা আরো অনেক উন্নতি করতে পারতাম। উল্টো এখন আমাদের সর্বনাশ করেছে। প্রসপেরো। এভাবেই প্রতিশোধ নেয়ার গোপন ইচ্ছা পূরণ করেছে ও।

তারপর সবকিছু খুলে বলল জিয়ানেট্টিনো। তখন জেবরায় জিয়ান্নার উপস্থিতির ব্যাপারে আরো কিছু যোগ করল মেসার কারাসসোলো। জানাল ঘটনাচক্রে কীভাবে এখানে উপস্থিত ছিল জিয়ান্না। অন্য কোন অবস্থায় হলে হয়তো জিয়ান্নার উপস্থিতিকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখত ডোরিয়া। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কথা ডোরিয়ার মনে কেবল বিতৃষ্ণাই জন্মাল।

স্তম্ভিত ডোরিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল ফিলিপ্পিনো। বলল, আসলে আমাদের ভাগ্যে এমনই হওয়ার কথা। আমাকে যদি আমার নিজের মত করে ওই প্রতারক শয়তানটাকে সামলাতে দিতেন তাহলে আজ এই অবস্থা তৈরিই হত না। আগেই আপনাকে সতর্ক করেছিলাম, লর্ড।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমরা সবাই আমাকে সতর্ক করেছিলে, আমিই তোমাদের কথা শুনিনি, দোষ সব আমার, তাই আমাকেই এখন সম্রাটের রাগ দেখতে হবে। এতদিন আমি যা যা করেছি তার সবই এখন বিফল হয়ে যাবে। সবাই এখন আমাকে নিয়ে হাসবে।

জিয়ানেট্টিনোকে ফিলিপ্পিনো জিজ্ঞেস করল, শেখকে জিজ্ঞেস করেছিলে, এতদিনেও আমাদের কাছে কোন খবর কেন পৌঁছল না?

হা, করেছি। হয়তো প্রসপেরোরই পরামর্শে, দ্রাগুত জেবরার সমস্ত নৌকায় হয় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, নয়তো ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন কি এতে কিছু আসে যায়?

এবার কথা বলল মেসার কারাসসোলো, আসলেই। এখন তাতে কী আসে যায়? মূল কথা হচ্ছে, চিঠির বক্তব্য প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই আপনারা নোঙর তুলছেন। এবং সেটা এখনই।

কোথায় যাব? জানতে চাইল ডোরিয়া।

কেন, নেপসে যাবেন, কারাসসোলোর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

লোকের হাসির পাত্র হতে?

আরে নাহ্, ভাইসরয়ের কাছ থেকে নতুন অর্ডার নিতে যে, নতুন করে দ্রাগুতকে কোথায় ধাওয়া করবেন।

রাগত চোখে কারাসসোলোকে জরিপ করছে ডোরিয়া। দেখছে, লোকটা তাকে নিয়ে মস্করা করার মত দুঃসাহস করছে কিনা। কারণ ডোরিয়ার এখন মনে হচ্ছে সবাই-ই তাকে তামাশার পাত্র ভাবছে। কারণ যে ডাকাতকে বন্দি করে ফেলেছে বলে সম্রাটকে চিঠি লিখে জানিয়েছে সে, তাকেই আবার কোথা থেকে ধাওয়া করতে হবে সেই নির্দেশনা নিতে নেপলসে যেতে বলা হচ্ছে ওকে!

.

৩৫.

 শেষ ভরসা

 দ্রাগুতকে ধাওয়া করে কেপ মেলায় আসার সময় প্রসপেরোকে দারুণ সাহায্য করেছিল পুবালী বাতাস। কিন্তু সেই পুবালী বাতাসই এখন নেপলসে যাওয়ার পথে প্রবল বাধা দিচ্ছে ওকে। পাল তোলা হলে প্রচণ্ড বাতাস আবার ওদেরকে ঠেলে ফেরত নিয়ে যাবে কেপ মোলার দিকে। কাজেই দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলল ওরা।

দাঁড় বেয়ে ঘণ্টায় তিন মাইল গতিতে এগুতে পারছে। এ হিসেবে দিনে ষোলো ঘণ্টা দাঁড় বেয়ে মাত্র আটচল্লিশ মাইল পাড়ি দিতে পারছে প্রসপেরোরা। বাকি আট ঘণ্টা দাসদের বিশ্রাম দিতে হচ্ছে। যদি পশ্চিমা বাতাস না আসে তাহলে নেপলসে পৌঁছতে ওদের আরো তিন সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে।

অথচ আসার সময় অনুকূল বাতাস পেয়ে এই পথ মাত্র তিন দিনে পাড়ি দিয়েছিল ওরা। এদিকে জিয়ান্নাকে দেখতে আর তর সইছে না প্রসপেরোর। তাই এই শম্বুক গতিতে অস্থির হয়ে ও সিদ্ধান্ত নিল উত্তরে গালফ অভ লিয়নস-এর দিকে ফ্লিটের মুখ ঘুরিয়ে নেবে। মার্সেই-এ ভিড়ে জিয়ান্নাকে চিঠি লিখল ও। এবং সেটা স্থলপথে নেপলসে পাঠিয়ে দিল। চিঠিটায় ও জিয়ান্নাকে অনুরোধ করল জেনোয়ায় চলে যেতে। কারণ ও নিজেও এখন ওদিকেই রওনা হয়েছে।

প্রসপেরো লিখেছে:

প্রিয় জিয়ান্না, আমাদের দেশ থেকে নিজেদেরকে আমি বিতাড়িত ভাবতে চাই না। আমার দৃষ্টিতে এখনই দেশে ফেরার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রসিডায় বিজয়ের পর জেনোয়াবাসীরা আমাকে কেমন সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল? আর ওই সময় আমার শত্রুরা কেমন চুপসে গিয়েছিল তাও নিশ্চয়ই মনে আছে? ছুরি-তলোয়ার খাপে ঢুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল তারা। সেকথা মাথায় রেখেই বলছি, কেপ মোলায় প্রায় তিন হাজার মুসলিম কোর্সেয়ার সৈন্য বন্দি হয়েছে আমার হাতে। একইসঙ্গে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে প্রায় সমসংখ্যক খ্রিস্টান। এদের মধ্যে প্রায় এক হাজারই জেনোয়িস। সেইসঙ্গে দখল করেছি চোদ্দটি মুসলিম গ্যালি আর দ্রাগুতকে ধ্বংস করার সুখবর তো আছেই। এসব নিয়ে জেনোয়ার বন্দরে হাজির হলে আমার সবচেয়ে বড় শত্রুও তখন জনমতের বিপক্ষে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে কিছু করার দুঃসাহস দেখাবে না। সুতরাং বুঝতেই পারছ, জেনোয়ায় যাওয়ার এখনই সময়। চলে এসো, জেনোয়ায় আমরা মিলিত হব। ওখানে যাওয়ার জন্য তোমার যা-যা লাগে তার ব্যবস্থা করে দেবেন হিজ হাইনেস, প্রিন্স অভ অরেঞ্জ।

.

এই চিঠিটার সঙ্গেই পোর্ট অভ অ্যাহনের অবস্থা সবিস্তারে জানিয়ে প্রিন্স অভ অরেঞ্জকে আরেকটি চিঠি লিখল প্রসপেরো। তবে সেটায় ওর নিজের কৃতিত্ব গোপন রাখল। তবে এই ব্যাপারটা পুষিয়ে গেল একই সময়ে প্রিন্সকে লেখা আলভারোর কাব্যিক চিঠির কল্যাণে। যদিও প্রসপেরো তা জানল না। একই চিঠিতে জিয়ান্নার জেনোয়ায় যাবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিতেও প্রিন্সকে অনুরোধ করল প্রসপেরো।

প্রসপেরোর চিঠি জিয়ান্নার জন্য স্বস্তির সুবাতাস হয়ে এসেছে। তবে মৃদু বাতাসের পিছনে ঘনাতে থাকা মেঘরাশি যে নতুন একটা ঝড় ডেকে আনতে পারে তাও ওর দৃষ্টির আড়ালে থাকেনি।

চিঠিতে প্রসপেরো যেমন আত্মবিশ্বাস আর জেনোয়িসদের উপর ভরসা দেখিয়েছে, বাস্তবে তা কতটুকু সত্যি হবে তা নিয়ে জিয়ান্নার মনে সন্দেহ রয়েই গেছে। সন্দেহের কারণ অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা। কাজেই ও সিদ্ধান্ত নিল যত দ্রুত সম্ভব জেনোয়ার পথে রওনা হবে। যাতে বিপদ এলে তখন যেন অন্তত প্রসপেরোর পাশে থাকতে পারে ও।

প্রসপেরোর জেনোয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনাটাকে কোনভাবেই ভুল বলা যাবে না। সুযোগটা ও ভালই চিনতে পেরেছে। সুযোগ দেখামাত্রই চিনতে পারা ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারার গুণই ওকে ওর সময়ের সেরা নেতা বানিয়েছে। যা হোক, একটা সময় পর্যন্ত অন্য অনেকের মত প্রসপেরোও বিশ্বাস করত দ্রাগুত আসলেই লা মোলার যুদ্ধে মারা পড়েছে। তবে সেটা ভিন্ন গল্প।

মূল কথা হচ্ছে, জেনোয়ায় প্রসপেরোর নৌবহর আসার অনেক আগেই দ্রাগুতকে পরাজিত ও তার নৌবহর ধ্বংস করে দেয়ার গল্প সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। সত্যি বলতে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এমন কোন খ্রিস্টান অধ্যুষিত উপকূল শহর ছিল না যার অধিবাসীরা এই খবর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেনি।

জেনোয়ায় অবতরণ করেই বীরের সংবর্ধনা পেল প্রসপেরো। প্রসপেরোর মহান ও প্রায় অসম্ভব অর্জনকে স্বীকৃতি জানাতে বিশাল আয়োজন করেছে জেনোয়াবাসীরা। তার সম্মানে বন্দরে বিশাল এক তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। জাহাজ থেকে অবতরণের জায়গায় প্রচুর ফুল আর লতাপাতা ফেলে প্রাকৃতিক এক কার্পেট তৈরি করেছে জেনোয়াবাসীরা। ফুলের কার্পেটে প্রসপেরোর পা পড়া মাত্রই রূপার ভেরীতে বেজে উঠল স্বাগত সুর।

ওকে স্বাগত জানাতে সিনেটর আর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে হাজির হয়েছে স্বয়ং ডজ। প্রতিটা সম্ভ্রান্ত ঘরের মাথা হাজির হয়েছে এখানে। গ্রিমানী পরিবারের একটা বাচ্চা মেয়েকে হাজির করা হয়েছে স্বাগত কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। ওই অনুষ্ঠানে কিছু লোককে দেখে মনে মনে খুব একচোট হেসে নিয়েছে প্রসপেরো। কারণ মাত্র দুই মাস আগেই ওর রক্তে গোসল করার জন্য খোলা তলোয়ার হাতে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে এরা। ওদের বেশিরভাগই আবার ডোরিয়া ঘরের লোকজন। ডজের হুকুমে ডিউকাল গার্ড এসকর্ট করে নিয়ে গেল ওকে। অন্তত এখন ওর সঙ্গে শত্রুতা করার সাহস কারোরই নেই। এমনকী ডোরিয়া ঘরেরনিয়োগকৃত পুতুল শাসক বর্তমান ডজেরও না।

.

প্রায় একই সময়ে নেপলসের বন্দরে এসে ভিড়ছে অ্যাডমিরাল ডোরিয়ার বহর। তবে সেখানে ডিউক অভ মেলফিকে স্বাগত জানানোর জন্য কোন রূপার ভেরী বাজেনি, ফুলের কার্পেট বা কবিতা আবৃত্তির আয়োজনও করেনি কেউ। এক আছে সম্রাটের প্রতিনিধি ভাইসরয়। কিন্তু সে এমনকী নওভো দুর্গের তোরণ পর্যন্ত আসার দরকারও বোধ করেনি। বরং তার নিজের অফিসে বসেই অ্যাডমিরালের জন্য অপেক্ষা করছে।

গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে ওরা দেখেছে, দ্রাগুত পালানোয় ওদের ক্ষতি হয়েছে বটে, তবে তা অপূরণীয় নয়। ডোরিয়াকে ডাকা হয়েছে দ্রাগুতের অবস্থান অবহিত করে নতুনভাবে তাকে ধাওয়া করার সুযোগ দিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একবার দ্রাগুতকে ধরতে পারলে নেপলস তো বটেই ডোরিয়াদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবে পুরো ইটালি। জেবরায় ওদেরকে বোকা বানানোর ঘটনা সবাই ভুলে যাবে। ওরা আরো ভেবেছে জেবরা থেকে দ্রাগুতের পালানোর ঘটনায় প্রসপেরোর প্রতারণামূলক আচরণের কথাও ফাঁস করে দেবে। তখন কর্সিকায় দ্রাগুতের তাণ্ডব চালানোর দোষ ওদের উপর আর পড়বে না। সমস্ত দায় চলে যাবে প্রসপেরোর কাঁধে। সবাই তখন ওকেই ধরবে।

কিন্তু ভাতিজাদের চিন্তাভাবনায় অতি উৎসাহী না হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ডোরিয়া বলল, আমি দেখেছি, প্রসপেরোর বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে কেন যেন সেটা শেষ পর্যন্ত আমাদের ঘাড়েই এসে পড়ে।

জিয়ানেট্টিনো তখন বলল, এবার আর আমরা কিছু করব না। যা করার সম্রাট করবেন। বদমাশটার এবার বিচার হবেই।

হয়তো। কিন্তু খুব আঘাত পাবে জিয়ান্না, বলল ডোরিয়া।

ওই অবাধ্য মেয়ের জন্যই তো এতকিছু হলো। এবার বুঝবে অবাধ্যতার ফল কী হয়, তিক্ত মন্তব্য করল ফিলিপ্পিনো।

তোমার মাথা সবসময় বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসার চিন্তায় ঠাসা থাকে কেন, ফিলিপ্পিনো? কখনো খেয়াল করেছ যে, এসব থেকে আজ পর্যন্তও আমরা ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই পাইনি?

তাই বলে কি ওদের ছেড়ে দেব? আপনি হয়তো দয়াপরবশ হয়ে প্রসপেরোকে ক্ষমা করতে পারেন, জেবরার জন্য সমস্ত দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে লোকের ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহ্য করতে পারবেন। কিন্তু আমি পারব না, ফিলিপ্পিনোর রাগত মন্তব্য।

ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারঙ্গম জিয়ানেট্টিনো তখন তার চাচার ক্ষতে আরো জোরে দাবিয়ে ধরল কথার ছুরি। প্রশ্ন করল, প্রসপেরো আমাদেরকে লোকের চোখে যেভাবে ছোট করেছে তার থেকে কি আমরা কোনভাবে মুক্তি পাচ্ছি?

অ্যাডেলিয়ন সিংহের মত হুঙ্কার দিতে উদ্যত হলো ডোরিয়া। তবে সামলে নিয়ে মুখে কেবল বলল, পুরো বহরসহ দ্রাগুত যখন পানির তলে চলে যাবে তখন আর কেউ উপহাস করার সাহস পাবে না।

যা হোক, আত্মবিশ্বাস নিয়ে নেপলসের বন্দরে এসে ভিড়েছে ডোরিয়ার বহর। কিন্তু তাকে স্বাগত জানাতে ভাইসরয় আসেনি দেখে মনে মনে বেশ একটা ধাক্কা খেয়েছে ডোরিয়া। একজন অফিসার কেবল এসেছে তাদেরকে ভাইসরয়ের ঘরে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ওরা প্রিন্সের অফিস কক্ষে ঢুকে দেখল মাথা নিচু করে মনোযোগ সহকারে একটা চিঠি লিখছে প্রিন্স। লেখা থামিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তবে এগিয়ে এল না। এমনকী করমর্দনের জন্য হাতও বাড়াল না। তার চাহনি বরফশীতল, একইরকম শীতল তার অভিব্যক্তি। বলল, আহ, এসেছেন শেষ পর্যন্ত। অনেকটা সময় নিয়েছেন আপনারা।

ভাইসরয়ের শীতল অভিব্যক্তি দেখে তিক্ততা গিলে ফেলল ডোরিয়া। তবে প্রিন্সের মন্তব্যের জবাবে বলল, আপনারা যারা সবসময় মাটির উপর থাকেন তারা সাগরের মতিগতির কিছুই বোঝেন না, অথচ সাগরগামীদের নিয়ে কটু মন্তব্য করতে একমুহূর্তও দেরি করেন না। পুরো পথে আমরা সরাসরি সামনে থেকে বাতাস পেয়েছি। ফলে পাল তোলার উপায় ছিল না। কেবল দাঁড় বেয়ে এত লম্বা পথ আসতে হয়েছে। তবু আমি বলব বেশ ভাল গতিতেই এসেছি।

শুষ্ক কণ্ঠে প্রিন্স বলল, তাই? বলে নিজে সে বসল বটে, তবে ডোরিয়াকে বসতে বলতে ভুলে গেল।

বসে বলল, আর জেবরার ঘটনার কী ব্যাখ্যা আপনি দেবেন?

প্রতারণা করা হয়েছে আমার সঙ্গে। আমাদেরই এক নির্লজ্জ সৈনিক আমার ফাঁদ থেকে দ্রাগুতকে বের হবার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সেই লোকটি হচ্ছে প্রসপেরো। নিজের কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে এই অপকর্মটি করেছে সে। আশা করি স্পেন রাজ এই অপকর্মের সঠিক বিচার করবেন, জবাব দিল ডোরিয়া।

প্রসপেরোর প্রতি তীব্র উম্মা প্রকাশ করায়, নাকি প্রসপেরোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে, না ঘটনা সম্বন্ধে পূর্ণ অবগত থাকায়; ডোরিয়ার ব্যাখ্যা ও অভিযোগ শুনে বিরক্ত হলো প্রিন্স। বলল, আপনার বক্তব্যের প্রমাণ?

প্রিন্সের দিকে খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডোরিয়া বলল, প্রমাণ! মুখ লাল হয়ে গেছে তার। বলল, আমার বক্তব্যই আমার প্রমাণ।

মাথা নেড়ে প্রিন্স বলল, আপনার বক্তব্য? সে তো মন্তব্য বা বড়জোর একটা অভিযোগ। আপনি তো জেবরায় ছিলেন, তাহলে শপথ করে বলতে পারেন প্রসপেরোর কৌশলের কাছেই আপনি পরাজিত হয়েছেন? স্বীকার করছি, ও দ্রাগুতের কাছে ছিল। কিন্তু ছিল তো তার বন্দি। কাজেই বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, আমার মতে, ওর বন্দিত্বের কথাটাই কেবল আপনি শপথ করে বলতে পারবেন।

ফুঁসে উঠল জিয়ানেট্টিনো। কিন্তু, ইয়োর হাইনেস, আমি জেবরার মাটিতে নেমেছি। কথা বলেছি ওখানকার শেখের সঙ্গে। সে-ই আমাকে সব তথ্য দিয়েছে।

শেখ? একজন মূল্যবান খ্রিস্টান অফিসারের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান আদালতে একজন মুসলিম শেখের বক্তব্য বা সাক্ষ্যের কি আদৌ কোন মূল্য আছে? প্রশ্ন করল ভাইসরয়।

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না ফিলিপ্পিনো। এগিয়ে এসে রাগত কণ্ঠে সে বলল, একজন প্রমাণিত প্রতারকের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান সাক্ষীরই যদি দরকার হয়, তো তারও অভাব নেই। অসংখ্য খ্রিস্টান দাস ওর সরাসরি হুকুমে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।

ওদের খুঁজে বের করতে পারবেন? নিস্পৃহ কণ্ঠে প্রশ্ন করল প্রিন্স।

হুমকির স্বরে জিয়ানেট্টিনো প্রশ্ন করল, ইয়োর হাইনেস কি আমাদের অবিশ্বাস করছেন? নাকি প্রসপেরোর হয়েই কথা বলছেন আপনি?

ভুরু কুঁচকে গেল ভাইসরয়ের। আমি? আমি আপনাদেরকে সাবধান করছি যে, কী ধরনের জেরার মুখে আপনারা পড়বেন। যদি ভেবে থাকেন প্রসপেরোর নামে অভিযোগ করেই খালাস পেয়ে যাবেন, তাহলে ভুল ভাবছেন। তাতে এমনকী আপনাদের কৃতকর্মের একবিন্দুও ঢাকা পুড়বে না। প্রসপেরো বা দ্রাগুত যে-ই কৌশল খাটাক, বোকা আপনারাই হয়েছেন। আর এটাই হচ্ছে আসল কথা।

ডোরিয়ার বুকে শেলের মত বিঁধল কথাটা। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল, আমার যা বলার, সরাসরি সম্রাটকে বলব।

অবশ্যই। তবে কীসের মুখে পড়তে পারেন সে সম্বন্ধে বন্ধু হিসেবে একটু সাবধান করে দিলাম আরকী।

উপদেশের জন্য ধন্যবাদ, ইয়োর হাইনেস। একটু যেন কৌতুকের আভাস প্রকাশ পেল কথাটায়।

বাউ করে প্রিন্স বলল, ঠিক আছে। ইচ্ছে হলে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থাকতে পারেন, এছাড়া আপনার আর নেপলসে থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

ইচ্ছে হলে?! নষ্ট করার মত সময় কোথায় আমার? এখন আমার কেবল জানা দরকার দ্রাগুতের সর্বশেষ অবস্থান কোথায়, বলল ডোরিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ফিলিপ্পিনের মুখ থেকে ফোয়ারার মত বের হলো, ওদের হাতে পড়লে দ্রাগুতের কী হাল হবে তার সবিস্তার বর্ণনা। জেবরার ঘটনার জন্য ওকে কতটা ভুগতে হবে সেটা বলতেও ভুলল না সে।

নিস্পৃহ ভাইসরয়ের মুখে কোন ভাব ফুটল না। নিস্পৃহ কণ্ঠেই সে বলল, দ্রাগুতের অবস্থানের খবর জানতে চাইছেন, জানবেন। কিন্তু তার আগে শুনুন, বেলিয়ারিকসে ম্রাটের রাজ্যের পায়ের ঠিক সামনে পৌঁছে গেছিল সে। এই খবর সম্রাটের কানে পৌঁছে ঠিক যখন আপনি খবর পাঠিয়েছেন-দ্রাগুতকে আপনি ফাঁদে ফেলেছেন এবং ওর ধ্বংস নিশ্চিত, তখনই। কাজেই সম্রাটের সুনজর আপনার উপর পড়েছে, মাই লর্ড ডিউক।

প্রিন্সের কথায় বজ্রাহতের মত নিস্তব্ধ হয়ে গেল ডোরিয়া। আতঙ্কে বড়-বড় চোখে তাকিয়ে আছে ডোরিয়ার দুই ভাতিজা। ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছে যেন দুজনে।

সামলে নিয়ে প্রত্যয়ী কণ্ঠে ডোরিয়া বলল, প্রতিশোধের আরো বড় উপলক্ষ এটা। প্রতিশোধ, আমি নেবই। তাতে যদি আমার জানও যায়, তা-ই সই। কথাটা বলার কারণ, ডোরিয়া খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছে দ্রাগুতকে এবার ওর ধরতেই হবে। নয়তো নৌ-কমাণ্ডার হিসেবে তার আর কোন মূল্যই থাকবে না। তাই জানতে চাইল দ্রাগুতের বর্তমান অবস্থান কোথায়।

জবাবে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে ভাইসরয় বলল, সঠিক অবস্থান বলতে পারব না। তবে এটা নিশ্চিত যে নরকের কোন চুলায় সিদ্ধ হচ্ছে সে।

ভাইসরয়ের কৌতুকে রেগে গেল ডোরিয়া। ইয়োর হাইনেস, আমি কৌতুক করছি না।

আমিও না। পোর্ট অ্যাহনে পুরো বহর নিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে মেসার দ্রাগুত। এটা তিন সপ্তাহ আগের ঘটনা। মুসলিমদের শক্তির অর্ধেক সংখ্যক গ্যালি নিয়ে দ্রাগুতের পুরো বহরকে ধ্বংস করে দিয়েছে মেসার প্রসপেরোর নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন।

ঘরে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তিন ডোরিয়ারই একসঙ্গে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। ডোরিয়ার মুখ থেকে রক্ত নেমে যেতে শুরু করল। ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা। মনে হতে লাগল ওর মুখটা বুঝি স্রেফ মোমের তৈরি।

এটা সত্যি হলে… আর কিছু অ্যাডমিরালের মুখ দিয়ে বের হলো না।

নিশ্চিত থাকুন, এটাই সত্যি। তারপর ভাইসরয় বিস্তারিত বলল পালমার লড়াই, মেজরকার নাগরিকদের বন্দিত্ব, কেপ মোলার লড়াইয়ের পর তাদের মুক্তি, মুসলিমদের হাত থেকে কয়েক হাজার খ্রিস্টানদের মুক্তি পাওয়া আর সবশেষে দ্রাগুতের গ্যালি দখল করে সম্রাটের বহরে সেগুলো যুক্ত করার কথা।

কিন্তু ডোরিয়ার কানে কিছুই ঢুকছে না। সে কেবল অপেক্ষা করছে ভাইসরয়ের কথা শেষ হওয়ার জন্য। তারপর নিজেকে সামলে নিল সে। ভাইসরয়কে একবার বাউ করে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল, তাহলে, নেপলসে বসে থেকে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই। আমি চলে যাচ্ছি, লর্ড প্রিন্স।

ডোরিয়ার এমন বিধ্বস্ত রূপ দেখে খারাপ লেগে উঠল ভাইসরয়ের। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সহানুভূতির সঙ্গে করমর্দন করল সে। চাইল তাকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু সান্ত্বনাসূচক কিছু তার মাথায় এল না। কেবল বলল, কামনা করি, আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।

ভাতিজাদের নিয়ে বেরিয়ে এল ডোরিয়া। বেরুতে বেরুতে আন্দ্রের কানে ফিসফিস করে ফিলিপ্পিনো বলল, এই সাপটার কামড়ে আপনার অবস্থা এখন মৃতসম। এখন নিশ্চয়ই চরম আঘাত হানতে অনুমতি দেবেন আমায়।

.

৩৬.

অভিষেক

ফ্ল্যাগশিপ বা ক্যাপিটানায় গিয়ে উঠেছে ডোরিয়া। নিজেকেই সে প্রশ্ন করল কোথায় যাবে এখন। পাশে বসে থাকা ভাতিজাকেও একই প্রশ্ন করল। এবাবে জিয়ানেট্টিনো বলল, ধাঁধাটার জবাব লুকিয়ে আছে, এখন আমরা কী করতে চাই তার উপর।

দ্রাগুতের খবরটা শোনার পর ডোরিয়া হতবিহ্বল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। এখন তা কাটিয়ে উঠেছে। বলল, ধাঁধা কোথায় দেখলে? সবই পরিষ্কার। প্রসপেরোর সঙ্গে আমাদের লম্বা এই ডুয়েলে শেষ পর্যন্ত ও-ই জিতেছে।

প্রতারণা করে লড়েছে, প্রতারণা করেই জিতেছে, মন্তব্য করল জিয়ানেট্টিনো।

মাথা নাড়ল অ্যাডমিরাল। বলল, অভিযোগ করে স্বস্তি পেলে অভিযোগ তুমি করতেই পার। কিন্তু যুদ্ধে সবই হালাল। যখন আমাদের কূটকৌশল সফল হয়েছিল, আমরা বলেছিলাম এটা কৌশলগত জয়। কিন্তু কৌশল করে শক্র সফল হলে ঘৃণা করে সেটাকে প্রতারণা বলা ঠিক না।

তখন ফিলিপ্পিনের মুখে উচ্চারিত হলো, ঈশ্বরের হাতে আমার প্রাণ, তাঁর নামেই শপথ করে বলছি, আমি এখনো হার মানিনি।

কেন? হারার কী বাকি আছে আর?

সুবিচার। জেবরায় ওর কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে ম্রাট যখন জানবেন, নিশ্চয়ই পুরো ব্যাপারটা তখন অন্য চেহারা নেবে।

তোমার বুদ্ধি কবে খুলবে, ফিলিপ্পিনো? এমনিতেই কি আমরা যথেষ্ট অপমানিত হইনি? এখন সবার সামনে আবার ঘোষণা দিতে হবে যে স্রেফ বুদ্ধির জোরে আমাদের পরাজিত করেছে প্রসপেরো? এতে কি আমার লজ্জা একটুও কমবে বা আমার সম্মান ফিরে আসবে? তাছাড়া, বুঝতে পারছ না কেন, লা মোলার বিজয় দিয়ে প্রসপেরো কেবল আমার সম্মান পুনরুদ্ধারের পথই রুদ্ধ করেনি, বরং যারা ওর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারত তাদের মুখও বন্ধ করে দিয়েছে।

দাঁতে দাঁত ঘষে ফিলিপ্পিনো বলল, কার মুখ বন্ধ হয়েছে তা সময় হলেই দেখা যাবে।

হ্যাঁ, যেহেতু আমাদের হারানোর কিছু নেই, তাই এই পরীক্ষাও করা হবে, বলল ডোরিয়া।

ফিলিপ্পিনো আবার বলল, এই চেষ্টাও যদি ব্যর্থ হয় তবুও প্রসপেরো নামের ভিক্ষুকের সামনে আমি মাথা নোয়াব না।

ঈশ্বরের শপথ, আমিও নোয়াব না। যেভাবেই হোক না কেন, আমাদের এই দুরবস্থার জন্য প্রসপেরোকে ভুগতেই হবে, বলল জিয়ানেট্রিনো।

এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা আর পরিকল্পনা করতে করতেই জেনোয়ায় এসে পৌঁছুল ডোরিয়া। তবে জেনোয়ার সদর বন্দরে না গিয়ে লেরিকির বন্দরে ঢুকল তারা। ওখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে স্থলপথে জেনোয়ার দিকে রওনা হয়ে গেল। আগস্টের এক শান্ত সন্ধ্যায় জেনোয়ায় গিয়ে পৌঁছুল তারা। ফলসালু প্রাসাদে ডিউকের নীরব পদার্পণ কেবল তার ভৃত্যদেরই নয়, ডাচেসকেও ভীষণ বিস্মিত করল। সে ততক্ষণে বিছানায় যাবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। এমন সময় আচানক ডিউককে উপস্থিত হতে দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেল ডাচেস। সামলে নিয়ে, ও, ঈশ্বর, আন্দ্রে! বলেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ডোরিয়াকে। অনুভব করল, এ কদিনে দুর্গের মত অভেদ্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ডোরিয়া যেন বেশ দুর্বল হয়ে গেছে।

প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটতেই সচেতন হয়ে উঠল ডাচেস। বলল, লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছ, নিশ্চয়ই তুমি খুব ক্লান্ত, বলে ছুটে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এল।

ডোরিয়া বলল, হ্যাঁ, খুব ক্লান্ত। ক্লান্তি আর বয়সের ছাপ দুটোই যেন প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে তার পুরো অবয়বে।

কোথা থেকে এসেছ, আন্দ্রে? প্রশ্ন করল ডাচেস।

লেরিকি থেকে ঘোড়ায় করে এসেছি। গ্যালিগুলোও ওখানেই রেখে এসেছি।

দুষ্টু হাসি দিয়ে লেডি বলল, কেন? দ্রুত আমার কাছে আসার জন্য?

মৃদু হাসি ফুটল ডোরিয়ার মুখে। বলল, লজ্জিত, পরাজিত চেহারাটা লোকের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে লুকিয়ে এসেছি। নিজেকে সাহসী বলেই মনে করি আমি। কিন্তু এতটা সাহসী নই যে লোকের কটু দৃষ্টি আর সমালোচনা খুব সহজে গ্রহণ করতে পারব।

কাঁধে ধরে ডোরিয়াকে নিজের দিকে ফেরাল ডাচেস। জিজ্ঞেস করল, লজ্জা! কেন, কী হয়েছে?

তুমি কিছু শোনোনি?

কী শুনব? আমি শুধু জানি সম্রাটের চিঠি নিয়ে মারকুইস ডেল ভাস্টো এখন জেনোয়ায় আছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সে।

আঁ, এত তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে?

হা। সবাই বলে সম্রাট কখনোই কাউকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে দেরি করেন না।

প্রাপ্য সম্মান! হ্যাঁ, তা ঠিক বটে। ডেল ভাস্টো কোথায় উঠেছে?

অ্যাডর্নো প্রাসাদে, তার বন্ধু প্রসপেরোর কাছে।

ক্রুর হাসি ফুটে উঠল অ্যাডমিরালের মুখে। বলল, অবশ্যই। তা-ই তো হবার কথা। আর জিয়ান্না কোথায়?

আমার সঙ্গে। তুমি হয়তো শুনেছ, কী ভীষণ দুর্ভাগ্যের স্বীকার হয়ে সাগরে ভাসতে হয়েছিল ওকে। তার ফল কী হতে যাচ্ছিল তাও নিশ্চয়ই শুনেছ। অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সব অঘটনের ইতি হয়েছে। ওরা বিয়ের পিড়িতে বসবে, শুধু তোমার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিল। তোমার আশীর্বাদ ছাড়া বিয়ে হয় কী করে? বলল ডাচেস।

জবাবে তিক্ত কণ্ঠে ডোরিয়া বলল, বিয়েটা এখন আর আনুষ্ঠানিকতা নয়, ওদের জন্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলে দুঃখের হাসি হাসল সে।

কথাটা শালীন শোনাল না। অবশ্য সত্য কথাটা তুমি জানবে কোত্থেকে…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি সব সত্য কথা। এখন আর ওসবের কোন গুরুত্ব নেই, বলল ডোরিয়া।

কেন নয়? আমি খুশি যে, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে জয় নিয়ে ঘরে ফিরেছে প্রসপেরো। আর ওর জয়যাত্রা দেখতে সময়মত জিয়ান্না হাজির হতে পারায়ও আমি খুশি হয়েছি, বলল ডাচেস।

আরো গম্ভীর হয়ে গেল ডোরিয়া। বলল, সব তাহলে খুশি আনন্দের সঙ্গেই শেষ হয়েছে। মহান বিজয় পেয়েছে প্রসপেরো, আর ওর ফিরে আসাটা একটা জয়যাত্রা? ভাল।

এরপর খাওয়া-দাওয়া সারল ডোরিয়া। অবশ্য খুব কমই খেল সে। তবে ভীষণ তৃষ্ণার্তের মত পান করল সুস্বাদু গ্রিক ওয়াইন।

আবার আগের কথা তুলল ডাচেস। বলল, মেহেদিয়ায় তুমি বিরাট বিজয় পেয়েছ শুনেছি। দ্রাগুতকে ধরে ফেলেছ সেটাও শুনেছি। কিন্তু এরপর আর কোন খবরই পাইনি। কী হয়েছিল?

অন্ধকার হয়ে গেল ডোরিয়ার মুখ। শুধু বলল, এখন না হয় থাক ওসব। আগামীকাল ডেল ভাস্টোর মুখ থেকেই সব শুনবে। এখন তার কাছে খবর পৌঁছনোর ব্যবস্থা করো যে, তার সঙ্গে দেখা করে সম্মানিত হতে চাই আমি।

.

প্রসপেরো জেনোয়ায় পৌঁছনোর দুই দিনের মাথায় এখানে অবতরণ করেছে ডেল ভাস্টো। সম্রাটের চিঠি নিয়ে এসেছে সে। চিঠির বক্তব্য তার জানাই আছে। সেটা প্রসপেরোকেও জানিয়েছে। ওই সময় তাদের সঙ্গেই ছিল কারবাজাল। যা হোক, চিঠির বক্তব্য শুনে হা-হা করে হেসে ফেলল আলভারো।

ডেল ভাস্টো বলল, আপনার কৌতুকবোধের কারণ বুঝতে পারছি আমি।

জবাবে হাসতে হাসতেই সে বলল, অর্ধেকও বোঝেননি। হাসির চোটে চোখে পানি চলে এসেছে তার। পানি মুছতে মুছতে বলল, বুঝলে আমার মতই হাসিতে ফেটে পড়তেন।

ঘটনা হচ্ছে, প্রসপেরোর অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ মূল্যবান পদক পাঠিয়েছে সম্রাট। আর ডোরিয়াকে হুকুম করেছে, অ্যাডমিরাল হিসেবে সম্রাটের পাঠানো পদকটি যেন সে নিজে প্রসপেরোর হাতে তুলে দেয়। এই ঘটনার কৌতুককর দিকটা দেখতে পেয়েই এভাবে হা-হা করে হেসে উঠেছে আলভারো।

সহাস্যে ডেল ভাস্টোও বলল, জানি, কিন্তু সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারছি না। কারণ সম্রাট ভাবছেন, তাঁর নিয়োজিত অ্যাডমিরালের ব্যর্থতা মানে তাঁর নিজের ব্যর্থতা। তাই লা মোলায় নিয়াপলিটান ফ্লিট জয় পাওয়ায় যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন তিনি। সেজন্য জয়ের কৃতিত্ব ডোরিয়াকেই দিয়েছেন সম্রাট। অছিলা দিয়েছেন যে, নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন ডোরিয়ার অধীন একটা বহর। কাজেই এই জয় ডোরিয়ারই জয়। আসলে ডোরিয়ার গলায় জয়মাল্য দেয়ার অছিলায় প্রসপেরোর জয়ের কৃতিত্ব নিজেই নিয়েছেন। আর অ্যাডমিরালকে স্বস্তি দেয়ার নামে নিজে ডুব দিয়েছেন স্বস্তির সাগরে।

আলভারো বলল, অর্থাৎ প্রসপেরোর কপালে লবডঙ্কা?

অতি ভদ্রতা করে নিজের কপালে লবডঙ্কা টেনে এনেছে প্রসপেরো। রিপোর্টে সব কৃতিত্ব ও ডোরিয়াকে দিয়ে দিয়েছে। এখন তার প্রতিবাদ করবে কে? বলল ডেল ভাস্টো।

কেন, আমিও তো ওর সঙ্গে পোর্ট অ্যাহনে ছিলাম। ওখানে কী হয়েছে আমার চেয়ে ভাল কে জানে? আর আমাদের ক্যাপ্টেনরা, যারা ওখানে লড়াই করেছে, তারাও সত্যি কথাটাই বলবে। আমরা সবাই শপথ করে সত্যি কথাটা বলতে পারি। ঈশ্বরের শপথ, আমরা তা করবও। সময় হয়েছে, সম্রাটকে এবার চোখ খুলে তাকাতেই হবে। প্রসপেরোর প্রকৃত মূল্য ওঁকে দিতেই হবে।

এবার মুখ খুলল প্রসপেরো। বলল, সমুদ্রে সমরনেতা হিসেবে ডোরিয়া কিন্তু মোটেও খারাপ নয়।

শুনে আলভারো বলল, মানলাম; সত্যি। কিন্তু আমরা লড়াইয়ে জিতেছি প্রসপেরোর নেতৃত্ব আর চতুর কৌশলের বদৌলতে। অথচ তার কৃতিত্ব নেবে এমন একজন, যে কিনা জানেই না যে পোর্ট অ্যাহনে দ্রাগুতের সঙ্গে একটা লড়াই হয়েছে!

কিন্তু এতে তার সামর্থ্যের তো হেরফের হচ্ছে না, বলল প্রসপেরো।

তর্ক থামান। আমি এসেছি ডিউক অভ মেলফিকে নিশ্চিত করতে যে, সম্রাটের হুকুম, তিনি নিজে তোমার হাতে সেইন্ট জেমস অভ কম্পোস্টেলা পদক তুলে দেবেন। তবে অতীতের বিভিন্ন ঘটনার জের হিসেবে তাঁর হাত থেকে পদক নিতে তুমি অস্বীকার করতে পারো, বলল ডেল ভাস্টো।

সঙ্গে সঙ্গে শেষ কথাটায় সম্মতি দিল আলভারো। বলল, ঠিক, এটাই করো। এতে সত্য প্রকাশের পথ সুগম হবে। আর তোমার সম্মানও বজায় থাকবে।

সম্মান আদায় করতে চাইলে কি এই রিপোের্ট লিখতাম? তাছাড়া সম্রাট যেটাকে তাঁর নিজের আর ডোরিয়ার জয় বলে ভাবছেন, তাতে বাগড়া দেয়া কি আমার পোষাবে? আমার তো মনে হয় লা মোলার ঘটনায় ডোরিয়ার হাত না থাকায় ওই জয়ের ভাগই নিতে চাইবে না সে, বলল প্রসপেরো।

হাসতে হাসতে আলভারো বলল ব্যাপারটার ফয়সালা তাহলে ডিউক অভ মেলফির মর্জি মাফিকই হোক।

.

ডোরিয়ার মর্জি জানার সময় হয়েছে। এসে গেছে তার দূত। ডেল ভাস্টো তাকে জানিয়েছে এক ঘণ্টার ভিতর ফসলীলু প্রাসাদে পৌঁছুবে সে।

ডেল ভাস্টো রওনা হবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, তখন চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকে প্রসপেরো বলল, আলফোলো, আপনি অনুমতি দিলে আপনার সঙ্গে যেতে চাই আমি।

যাবে, এতে আবার অনুমতির কী আছে? জবাব দিল ডেল ভাস্টো।

আলভারো বলল, আমিও আপনার সঙ্গী হতে চাই, মেসার প্রসপেরো।

আপনাকে সঙ্গে না নেবার কোন কারণ নেই, ডন। আপনিও যাবেন।

ডেল ভাস্টোকে অভ্যর্থনা জানাতে ফলসালু প্রাসাদের গ্রেট গ্যালারি অভ ফাইভ আর্কেডসে উপস্থিত হয়েছে ডিউক। দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ফায়ারপ্লেসের পাশে। ফায়ারপ্লেসের দেয়ালে ঝুলছে গুইলিয়ালমো ডেল্লা পোর্টা-র আঁকা একদম জীবন্ত একটা ছবি। চাচার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফিলিপ্পিনো আর জিয়ানেট্টিনো।

ডেল স্টোকে স্বাগত জানাতে গর্বিত পদক্ষেপে এগিয়ে এল ডোরিয়া। কিন্তু তার চেহারা আর অভিব্যক্তি এতটাই শীতল যে মনে হচ্ছে সেটাও বুঝি গুইলিয়ালমোর আঁকা ছবি। তবে তার দুই ভাতিজা তাদের অভিব্যক্তি লুকাতে পারেনি। তাদের আমসি হয়ে থাকা চেহারাতেই স্পষ্ট যে, শাস্তির রায় শোনার অপেক্ষা করছে তারা।

ডেল স্টোকে এগিয়ে নিয়ে এল চেম্বারলিন। আর ডেল ভাস্টোর ঠিক পিছনেই উদয় হলো প্রসপেরো। ওকে দেখেই কুঁকড়ে গেল ডোরিয়া। গলা বাড়িয়ে দিল জিয়ানেট্টিনো। নিশ্চিত হতে চায় ডেল ভাস্টোর পিছনের লোকটা কে। প্রসপেরোকে দেখেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। ডানহাতটা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল কোমরে ঝোলানো তলোয়ারের হাতলে। চাচা-ভাতিজাদের মনে কোন সন্দেহই রইল না যে তাদের অপমান দেখে মজা পেতে এসেছে প্রসপেরো।

ডিউককে বাউ করে ডেল ভাস্টো বলল, সম্রাটের নামে অভিবাদন জানাচ্ছি, মাই লর্ড ডিউক। তাঁর তরফ থেকে আপনার জন্য এটা এনেছি আমি। বলে ডিউকের হাতে তুলে দিল রাজকীয় সিল সমৃদ্ধ সিল্কের কাপড়ে মোড়া একটা প্যাকেট।

প্যাকেটটার দিকে তো নয়ই, এমনকী ডেল স্টোর দিকেও তাকাল না ডিউক। সে তাকিয়ে আছে আলভারোর বিশাল বপুর পাশে দাঁড়ানো প্রসপেরোর দিকে। ডেল স্টোকে সে বলল, ইয়োর এক্সিলেন্সি কাউকে সঙ্গে আনবেন আশা করিনি। অন্তত মেসার প্রসপেরোকে তো নয়ই।

জবাবে অত্যন্ত দ্র সুরে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে ডেল ভাস্টো বলল, সম্রাটের পাঠানো চিঠিটা একবার পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন মেসার প্রসপেরো এখানে এসেছে।

প্যাকেটের সিলটা ভেঙে ফেলল ডোরিয়া। সঙ্গে সঙ্গেই প্যাকেটের ভিতর থেকে পিছলে বেরিয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়ল অত্যন্ত সুন্দর একটা ড্যাগার। ওটার হাতলের পুরোটা রুবি-খচিত। আর হাতলের গোড়ায় বাধা আছে লাল রঙের সিল্কের একটা ফিতে। জিনিসটা তুলতে গিয়েও চাচার বিহাল চেহারার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল জিয়ানেট্টিনো।

চিঠিটা পড়তে পড়তে ক্ষীণ হয়ে গেছে.ডোরিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস। চেহারা থেকে রক্ত নেমে গেছে। চকিতে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ল সে। তারপর মাথা তুলে তাকাল। ডেল ভাস্টোকে জিজ্ঞেস করল, এতে কী লেখা আছে আপনি জানেন?

হিজ ম্যাজেস্টি আমাকে বিশ্বাস করে এর ভাষ্য জানিয়েছেন।

আর…আর…আপনি তা বিশ্বাস করলেন? দ্বিধাগ্রস্ত ডোরিয়া ততোধিক দ্বিধান্বিত হয়ে প্রশ্ন করল।

হিজ ম্যাজেস্টি যা বলেন, আমি তাতে কেমন করে দ্বিমত প্রকাশ করি? উত্তর দিল ডেল ভাস্টো।

কিন্তু…কিন্তু…হিজ ম্যাজেস্টি বিশ্বাস করেছেন? কিন্তু কেন?

বিশ্বাস না করলে নিজ হাতে এই চিঠি তিনি লিখবেন কেন?

অনুমতি দিন, বলে চিঠিটা দুই ভাতিজার দিকে বাড়িয়ে দিল ডোরিয়া। ওরাও চিঠিটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

হতভম্ব ডোরিয়া প্রশ্ন করল, এমন অবিশ্বাস্য কথা চিঠিটায় লেখা আছে যে, কী বলব, মনে হচ্ছে আমাকে নিয়ে উপহাস করা হয়েছে।

ডোরিয়ার মুখ দিয়ে হয়তো আরো কিছু বের হত, কিন্তু তার আগেই মুখ খুলল প্রসপেরো। ডেল স্টোকে উদ্দেশ্য করে বলল, অনুমতি দিলে আন্দ্রের সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলতে চাই আমি।

আমার সঙ্গে তোমার এমন কী কথা থাকতে পারে যা গোপন রাখতে হবে? অসন্তুষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করল ডোরিয়া।

তারপরও, আলফোসো, আপনি যদি অনুমতি দেন তো লর্ডের সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলতে চাই আমি, আবার বলল প্রসপেরো।

ঠিক আছে, দিলাম অনুমতি। কিন্তু বলে রাখছি, আমাকে বিরাট একটা আনন্দ থেকে বঞ্চিত করলেন আপনি, বলে হাসতে হাসতে কপট অভিযোগ করল ডেল ভাস্টো।

বলল, কী বলার আছে তোমার। নাকি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমাকে পরিহাস করার করাই তোমার উদ্দেশ্য? প্রশ্ন করল ডোরিয়া।

পরিহাসের কথা বলছেন, লর্ড? কিন্তু ওই চিঠিটার কোথাও একবিন্দু পরিহাস দেখেছেন?

অধৈর্য ডিউক ধমকে উঠে বলল, ঘটনার ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা দেয়া আছে ওতে।

ভুল বোঝাবুঝি আর ভুল ব্যাখ্যার কারণে অতীতে আমাদের মধ্যে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, মাই লর্ড।

জবাবে তেতে গিয়ে ফিলিপ্পিনো বলল, কিন্তু তোমার একের পর এক প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করিনি।

তোমার কর্মকাণ্ডেরও শোধ আমি নিইনি, ফিলিপ্পিনো। কিন্তু এখন আমি তোমার চাচার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমাদের দুই ঘরের লড়াই বহুদিন ধরে চলে এসেছে…।

প্রসপেরোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ডোরিয়া বলল, …কিন্তু এখন তুমি ভাবছ, তুমিই এতে জয়ী হয়েছ তাই তো?

আপনারা চাইলে তাও ভাবতে পারেন। বাবা মারা যাবার সময়ই একটা শপথ নিয়েছিলাম আমি। ঠিক যখন সেটা ভুলে যেতে বসেছি তখনই আমাকে দাঁড়ে বসিয়ে শপথটার কথা আবার মনে করিয়ে দেয় ফিলিপ্পিনো। কিন্তু ওসব এখন অতীত। ওসব পিছনে ফেলে এসেছি আমি।

এখন তো তোমার শপথ পূরণ হয়েছে। সারা দুনিয়ার পরিহাসের পাত্র বানিয়েছ আমাকে। এত বছরের সমস্ত অর্জন। ধূলিসাৎ করে দিয়েছ তুমি। সময় থাকতেই জয়ের অনুভূতিটা উপভোগ করে নাও। কারণ এই পরিহাসটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে।

 খুব বেশি লম্বা, ফোড়ন কাটল ফিলিপ্পিনো।একই সুর ফুটল জিয়ানেট্টিনোর কণ্ঠেও।

হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিল প্রসপেরো। তারপর বলল, আগে আমার কথা শুনুন। যা হয়েছে, তা আপনার আর আমার মধ্যে হয়েছে। সারা দুনিয়া তো আর তা জানে না। হিজ ম্যাজেস্টির পাঠানো চিঠিই এর প্রমাণ। সম্রাটের প্রিয়পাত্র অ্যাডমিরালকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে সারা জেনোয়া। কে ওদেরকে বলতে যাবে যে পোর্ট অভ অ্যাহনে আমি আপনার হুকুমে কাজ করছিলাম না? আপত্তি করার মত আছে কেবল এক কারবাজাল আর রয়েছে প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। তারা তাদের নিজস্ব জানাশোনা থেকে কথা বলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ভাবুন একবার, তারা কি সম্রাটকে শেখাতে যাবে যে, সম্রাট ভুল করেছেন? অন্তত আমি যদি তা প্রকাশ না করি তাহলে তো কোনভাবেই তারা কিছু বলবে না।

বিস্ময়ে রীতিমত হতভম্ব হয়ে একে অপরের মুখ চাইল ডোরিয়ারা। তারপর চটক ভেঙে জিয়ানেডিনো প্রশ্ন করল, তুমি কি কোন চুক্তির ইঙ্গিত দিতে চাইছ?

ঠিক, নিশ্চয়ই কিছু একটা গেলাতে চাইছ আমাদেরকে, ভাইয়ের সুরে সুর মিলিয়ে বলল ফিলিপ্পিনো।

কিছু দিতে চাইছি। এমন কিছু, যা আমার আছে, অবশ্য আরেক অর্থে বললে সেটা তোমাদের দেয়া হয়ে গেছে। লর্ড বোধহয় চিঠিটা ভাল করে পড়েননি। ওতে বলা আছে, সম্রাট তার এক ক্যাপ্টেন মেসার প্রসপেরোর কাছ থেকে জেনেছেন, দ্রাগুতের ফ্লিট ধ্বংস হয়ে গেছে, মারা পড়েছে সে। চিন্তা করুন, সম্রাট এটা কোথা থেকে জেনেছেন? উত্তরটা হচ্ছে, এভাবে আমিই তাকে জানিয়েছি। ধরে নিন, মাই লর্ড, এটাই আমার শান্তি প্রস্তাব।

চাচা-ভাতিজারা বিস্মিত হলেও তাদের রাগ পড়ে যায়নি। তবে চিঠিটার ওই অংশটা আবার পড়তে শুরু করল তারা। ওখানে লেখা, মিনোরকার গভর্নরের পাঠানো চিঠি আর পরবর্তীতে আপনার অধীন নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের কমাণ্ডার মেসার অ্যাডর্নোর বিস্তারিত প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হয়ে জানাচ্ছি, আপনার পরিকল্পনা খুব ভালভাবে বাস্তবায়ন করেছে। মেসার প্রসপেরো…

আর পড়ার দরকার নেই। হুঙ্কার ছেড়ে ডোরিয়া বলল, তোমার এই ভ্রান্ত রিপোর্টের পিছনে লুকাতে বলছ আমাকে? বলছ, ভণ্ডামির আশ্রয় নিতে? প্রশংসা নিতে বলছ যা আমি করিনি তার জন্য? এ-ই তোমার শান্তি প্রস্তাব? এই প্রস্তাব করে আমাকে ভীষণ ছোট করেছ তুমি। এর কোন ক্ষমা নেই। তারপরই অবশ্য তার সুর পরিবর্তন হলো। বলল, সম্রাটের চিঠির জবাব তৈরি করা আছে। গতরাতেই সেটা লিখে রেখেছি। সম্রাটের সেবাসহ সবকিছু থেকেই ইস্তফা দিচ্ছি আমি। ওতে জেবরার ঘটনাও সবিস্তারে তুলে ধরেছি। একটা সফল কর্মজীবনের অনুল্লেখযোগ্য ইতি ঘটিয়েছি। আর তুলে ধরেছি, কীভাবে তুমি বদমাশ দ্রাগুতকে আমার জাল কেটে পালাতে সাহায্য করেছ।

আপনার ধারণা, আপনার উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ওসব করেছি আমি?

সাহস থাকলে বলো, করোনি?

একথা বলতে সাহসের প্রয়োজন নেই। যে অবস্থায় ওসব করেছি তাতে আপনার উপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা একবারও ভাবিনি। বা ভাবার সুযোগও পাইনি। এমনকী ওই কাজের ফলে আমার নিজের কী হবে তা ভাবতেও ভুলে গেছিলাম। ভুলে গেছেন বোধহয়, তখন জিয়ান্নাও ছিল দ্রাগুতের কবজায়? ওকে রক্ষার সুযোগও আপনি পেয়েছিলেন। কিন্তু তা আপনি নেননি।

দারুণ বলেছ। এখন নিশ্চয়ই বলবে, ওকে রক্ষা করেছ তুমি? ধরলাম; করেছ। কিন্তু তার জন্য মূল্য চুকিয়েছে কারা? কর্সিকানরা, মেজরকানরা। এক জিয়ান্নার প্রাণের বিনিময়ে কত শত লোককে প্রাণ হারাতে হয়েছে? এমনটা হবে তা কি একবারও তোমার মাথায় আসেনি? এই মূল্য জানা সত্ত্বেও কী করে ওকে বাঁচাতে যেতাম আমি?

আপনার কাছে আর আমার কাছে জিয়ান্নার মূল্য একরকম নয়। আপনাদের মধ্যে এমনকী রক্তের বন্ধনও নেই। তাই আপনি যাননি। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্যরকম। তাছাড়া ওকে বাঁচালে ভবিষ্যতে কী হবে তা ভাবার সময়ও তখন ছিল না। আরেকটা কথা, দ্রাগুত আমাকে বলেছিল, গোল্ডেন হর্নে গিয়ে বারবারোসার সঙ্গে যোগ দেবে সে। খ্রিস্টান উপকূলে হামলে পড়ার কথা তার ছিল না। হয় সে আমাকে মিথ্যা বলেছিল, নয়তো পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। এমনকী তা না করলেও দ্রাগুতকে আপনি ধরতে পারতেন না। কারণ ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুরো ফ্লিট আগুনে জ্বালিয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে, স্থলপথে জেবরা থেকে চলে যাবে। শেকলে বাঁধা অবস্থায় আমাকেও ওর সঙ্গে যেতে হত। আর জিয়ান্নাকে যেতে হত ওর হারেমে। ওই স্মৃতি মনে হতেই কেঁপে উঠল প্রসপেরোর গলা। ভাবুন একবার, শয়তানটার কাছে ধর্ষিত হত আপনার ধর্মকন্যা ও অতিজি। এটা সহ্য করা কি আমার পক্ষে সম্ভব ছিল? ওকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে কীভাবে থাকতাম আমি? আর ওকে বাঁচালে দুনিয়াকে তার জন্য কী মূল্য চুকাতে হবে তা নিয়ে তখন মাথা ঘামানোর সময় কি আমার ছিল? মন থেকে সৎ উত্তর দিন, লর্ড। নিজেকে আমার জায়গায় একবার ভেবে দেখুন। আর প্যারেট্টাকে ভাবুন জিয়ান্নার জায়গায়। দুনিয়ার সমস্ত খ্রিস্টান বা সম্রাটের প্রতি আপনার কর্তব্য কি তখন আপনাকে করণীয় থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারত?

জবাবের জন্য একমুহূর্ত থামল প্রসপেরো। কিন্তু কোন ডোরিয়ার মুখেই রা নেই। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজনেই। আর অ্যাডমিরালের চোখ দুটোয় ফুটে আছে ভয়ের ছাপ।

আবার শুরু করল প্রসপেরো, অথচ আপনি কিনা ভাবছেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সম্রাটের প্রতি কর্তব্য ভুলে দ্রাগুতকে ছেড়ে দিয়েছি! সত্যি হচ্ছে, আমার ওই কাজের ফলে আপনাকে যে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তা তখন অনুমানও করতে পারিনি আমি। নিয়তি আপনাকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেলেছে। তাই আশা করি, আরেকবার আমার শান্তি প্রস্তাব বিবেচনা করবেন। আর ইস্তফাপত্রটি ছিঁড়ে সম্রাট ও খ্রিস্টানদের সেবায় নিয়োজিত থাকবেন আপনি। সেইসঙ্গে সম্রাটের দেয়া সম্মানও গ্রহণ করবেন।

কিন্তু ডোরিয়ার মনের বরফ তখনও গলেনি। আবারও আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করল সে। বলল সম্রাট একটা ঘটনা সম্বন্ধে ভুলভাবে অবগত হয়েছেন বলেই সেই অবস্থার সুযোগ নেয়ার মত ছোটলোক সে নয়। অভিযোগ করল, কুবুদ্ধিটা সুন্দর কথা দিয়ে সাজানো মালার মত। কিন্তু সেটার অন্তর্নিহিত অসম্মানের কাঁটাগুলো, বোলতার হুলের মত তীক্ষ্ণ খোঁচা দিচ্ছে তাকে।

জবাবে প্রসপেরো বলল, সম্রাটের দেয়া সম্মান পায়ে ঠেললে ব্যাপারটার অর্থ দাঁড়ায় তাঁকে অপমান করা। তার উপর আমার জানামতে তুর্কি সুলতানের হাত শক্তিশালী করতে কনস্ট্যান্টিনোপলে বসে আরেকটা শক্তিশালী ফ্লিট দাঁড় করাচ্ছে বারবারোসা। এর উদ্দেশ্য কী বলার অপেক্ষা রাখে না। স্প্যানিশদের মধ্যে খায়ের-আদ-দীনকে মোকাবেলার সামর্থ্য রাখেন কেবল আপনি। এখন আপনাকেই সম্রাটের সবচেয়ে বেশি দরকার। এই দুঃসময়ে মিথ্যা অহমিকার বশে তাকে ফিরিয়ে দেবেন?

যা আমি অর্জন করিনি তার কৃতিত্ব নেয়ার মধ্যে গর্ব কোথায় বুলতে পারো? তাছাড়া এই ঘটনা কখনো না কখনো অবশ্যই প্রকাশ পাবে। তখন মান-সম্মান সব হারাব আমি। তাছাড়া পোর্ট অ্যাহনে যা হয়েছে সেসব বহু লোকের জানা আছে, বলল ডোরিয়া।

জানা আছে না, অনেকে সন্দেহ করে। কেবল প্রিন্স অভ অরেঞ্জ আর আলভারো নিশ্চিতভাবে জানে আসল সত্য কী। কিন্তু সম্রাটের মুখের উপর ওসব বলার সাহস কি তাদের কোনদিন হবে? আর আমি যদি তা স্বীকার না-ই করি তাহলে তারা ওসব বলতে যাবে কোন দুঃখে? আর সম্রাটকে ওই লড়াইয়ের প্রতিবেদন তো আমি নিজেই পাঠিয়েছি। এখন সেটা বাতিল করে সম্রাটকে অন্য কিছু বলতে যাব কেন?

তোমার উদ্দেশ্য ভাল বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বলছি, এটা সম্ভব নয়। যে-কোন মূল্যে প্রকৃত সত্য প্রকাশ পেতেই হবে, বলল ডোরিয়া।

প্রসপেরো বলল, খ্রিস্টানরা তার মূল্য চুকাবে। আপনি কি কেবল আপনার গর্ব নিয়েই ভাববেন, বারবারোসা আক্রমণ করলে তাদের কী হবে সেকথা একবারও চিন্তা করবেন না?

কেবল গর্ব নয়, এতে আমার মান-সম্মানের প্রশ্নও জড়িত, গম্ভীর মুখে বলল ডোরিয়া।

তাহলে বরং ব্যাপারটাকে এভাবে দেখুন: জেবরায় দ্রাগুতকে ছেড়ে দিয়ে কেবল খ্রিস্টানদেরই ক্ষতি করিনি, অজান্তে হলেও আপনারও ক্ষতি করেছি আমি। এখন, নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন যেহেতু আপনারই অধীন আর আমি যা করেছি, ওই স্কোয়াড্রন ব্যবহার করেই করেছি, তাই ঘটনা দুটোর দায় আর বিজয়-দুটোই আপনার প্রাপ্য। কারণ আগেই বলেছি স্প্যানিশ নৌবাহিনীর প্রধান আপনি। আর সম্রাটও ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখেছেন।

ঠিক তখন মুখ খুলল জিয়ানেট্টিনো। বলল, প্রসপেরো মুখ না খুললে আসলেই কেউ কিছু বলতে পারবে না, মাই লর্ড।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ বলে সত্যিই খুশি হয়েছি আমি, বলল প্রসপেরো।

কিন্তু সেটাকে ভালভাবে নিল না ডোরিয়া, কী ব্যাপার, আমার ঘরের একজন প্রসপেরোর হয়ে কথা বলছে কেন?

একজন নয়, মাই লর্ড, দুজন। আমিও জিয়ানেট্টিনোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত। আমারও মনে হচ্ছে সতোর সঙ্গে কথা বলছে প্রসপেরো, বলল ফিলিপ্পিনো।

অবশ্যই আমি সতোর সঙ্গে কথা বলছি। দরকার হলে আমার দেয়া কথার জামিনদার হবে জিয়ান্না। আর যেহেতু আপনি, আমি-আমরা দুজনই জেনোয়িস, তাই আমাদের অবশ্যই উচিত পাশাপাশি দাঁড়ানো, মুখোমুখি নয়। আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলে পুরো ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পারিবারিক মামলা। পরিবারকে কি কেউ অবহেলা করে?

নীরবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ডোরিয়া। ভাবুল, এখন প্রসপেরোকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ হবে এতদিন ধরে এত কষ্টে গড়া সবকিছুর নিশ্চিত ধ্বংস। স্রেফ বুদ্বুদের মত হাওয়ায় উবে যাবে সব।

লম্বা সময় ধরে তাকে চিন্তাভাবনা করতে দেখে আর ধৈর্য ধরতে পারল না জিয়ানেটিনো। বলল, সিদ্ধান্ত খুব সহজ, মাই লর্ড।

সহজ? হা, ঈশ্বর! কীভাবে?

মাত্রই প্রসপেরো বলল, কনস্টান্টিনোপলে বসে আরেকটা সোর্ড অভ ইসলাম বানানোর পাঁয়তারা কষছে খায়ের-আদ দীন। এখন আপনার পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে এই পরিকল্পনা যেন বাস্তবের মুখ না দেখে সেই ব্যবস্থা নেয়া।

সঙ্গে ফিলিপ্পিনো যোগ করল, অন্যথায়, আপনার আর কিছুই পাওয়ার আশা থাকবে না।

চোখ গরম করে ভাতিজাদ্বয়ের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ডোরিয়া। তারপর ধীর পদক্ষেপে বারান্দা থেকে ঘরে এসে ঢুকল। প্রসপেরোকে বলল, পোর্ট অ্যাহনে বিজয়ের কৃতিত্ব পুরোপুরি তোমার।

জবাবে প্রসপেরো বলল, জেবরার লজ্জাও তেমন আমার, লর্ড। জেবরায় আপনাকে প্রতারণা করে থাকলে পোর্ট অ্যাহনকে না হয় তার ক্ষতিপূরণ হিসেবেই দেখুন। আর ফিলিপ্পিনোর সঙ্গে অন্তত এবার আমি একমত যে, আপনি ইস্তফা দিলে কারোই কোন লাভ হচ্ছে না। আর আমার রিপোর্টের ব্যাপারটা ফাঁস করে দিলে কেবল আপনারই নয়, আমারও সর্বনাশ হয়ে যাবে। আসলে এইবার আমরা একে অন্যকে সাপোর্ট দেয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকারান্তরে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। কাজেই, মাই লর্ড, সম্রাটের বিচার মেনে নেয়ার মধ্যেই আমাদের সবার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির সুযোগ রয়েছে।

বাম্পায়িত হয়ে উঠেছে ডোরিয়ার চোখ জোড়া। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, ফ্রান্সের হয়ে জেনোয়া দখল করার সময় একবারের জন্যও মনে আসেনি যে তোমার বা তোমার বাবার বিশ্বাস ভঙ্গ করব আমি।

শার্শেলে রওনা হবার আগেই আমি সেটা বিশ্বাস করেছি, বলল প্রসপেরো।

আহ, শার্শেল! সম্ভবত শার্শেলের জন্যও তুমি আমাকে দোষী ভাববা। কিন্তু সত্যি বলছি, আমার আর কোন উপায় ছিল না। অমন পরিস্থিতিতে পড়লে আবারও হয়তো আমাকে একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ পরিস্থিতি একজন অ্যাডমিরালের কাছ থেকে তেমন কঠিন সিদ্ধান্তই দাবি করে। অনেককে বাঁচাতে গিয়ে কয়েকজনকে বলি দিতে হলে আসলে কিছুই আর করার থাকে না, গম্ভীর আর ভারাক্রান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলল ডোরিয়া।

বুঝতে পেরেছি। কিন্তু শার্শেল নয়, শার্শেলের পরে ঘটা কিছু ঘটনা নিয়ে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ ছিলাম আমি। তবে এখন আমি জানি, ওই দোষ আপনার ছিল না। ওটা ছিল অন্য কারো অপকর্ম, বলল প্রসপেরো।

কী সেটা? সাগ্রহে জানতে চাইল ডোরিয়া।

মুখ কালো হয়ে গেছে ডোরিয়ার দুই ভাতিজার। চেহারায় শঙ্কার ছাপ।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রসপেরো-বলল, বাদ দিন, এখন আর সেসব কোন ব্যাপার নয়। বহুবারই আমরা একে অপরের নানাভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করেছি। এখন সেসব অতীত।

হ্যাঁ, আমরা যার-যার তলোয়ার তুলে রাখলাম কিনা সেটাই হচ্ছে আসল কথা।

এক কদম সামনে বেড়ে প্রসপেরো বলল, আমার তলোয়ার খাপে পুরে রেখেছি, মাই লর্ড, বলে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

প্রসপেরোর বাড়ানো হাতখানা ধরল ডোরিয়া, লম্বা কয়েকটা মুহূর্ত সেটা ধরেই রাখল সে। তারপর ফিরল টেবিলে রাখা সেই ড্যাগারটা নিতে। বলল, সমাটের হয়ে সেইন্ট জেমস অভ কম্পোস্টেলা পদক তোমার হাতে আমি গর্বের সঙ্গে তুলে দেব, বলেই থমকে দাঁড়াল। না, এই কাজ এমন গোপনে করা ঠিক হবে না। এটা দিতে হবে প্রকাশ্যে।

একমত পোষণ করে প্রসপেরো প্রস্তাব দিল, ঠিক। আমাদের দুই পরিবারের মিলন দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে জিয়ান্না আর প্যারেট্টা। আর আমার বন্ধু ডেল ভাস্টো আর কারবাজাল। ওরা জানলেই যথেষ্ট। ডাকুন ওদের। ওদের সামনেই আমার হাতে তুলে দেবেন এটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *