৭. ভোরবেলা যুঁইয়ের ডাকে

ভোরবেলা যুঁইয়ের ডাকে ভজনের ঘুম ভাঙল। পুলিশ এসেছে খানাতল্লাসির পোয়ানা নিয়ে এসেছে মহকুমা এস. ডি. ও. সাহেব। বিলিতি সাহেব।

সারা বাড়িটা অনুসন্ধান করে পাওয়া গেল শুধু একখানা বই। নজরুলের একখানি কবিতার বই। তারপর জিজ্ঞাসাবাদের পালা। হালদারমশাই থেকে শুরু করে ছেলে নিতাইকে পর্যন্ত।

যুঁই শুধু জানাল, রাত্রেও সে তার ভাসুরকে খেতে দিয়েছে, তিনি খেয়ে শুয়েছিলেন।

তারপর শ্রীমতী কাফের পালা। ভোর থেকে ঘেরাও হয়েছিল প্রহরী দিয়ে। ভজনকে নিয়ে সদলবলে এস. লি. ও. এল খানাতল্লাসির জন্য। পুলিশ অফিসাররা এসেছে প্রায় সারা মহকুমা ঝেটিয়ে। যে সে কথা নয়, স্বয়ং এস. ডি. ও. এসেছে।

অন্যান্য এলাকার অফিসারদের চক্ষুশূল হয়ে এখানকার ছোকরা অফিসার সাহেবের পাশে পাশে ঘুরে সব দেখাচ্ছে, বোঝাচ্ছে স্যার, এটা একটা সাংঘাতিক ঘাঁটি। কাফে নাম দিয়ে আসলে এটা একটা রাজনৈতিক দলগুলির কেন্দ্র। যদি কিছু মনে না করেন স্যার, এই রেস্টুরেন্টটা আপনি উঠিয়ে দিন।

সাহেব পাইপ কামড়ে ধরে একবার বাইরের দিকে তাকাল। রাস্তায় অনেক লোক জমে গিয়েছে। রাস্তায়, স্টেশনের রকে। স্টেশনের ছাদে ভিড় করেছে স্টাফ, এ. এস. এম., টিকেট কলেক্টর, কেরানিরা। কিন্তু সাহেবকে বাইরের দিকে তাকাতে দেখেই অনেকে মুখ নামাল, মুখ ফেরাল, পাশ ফিরে চলতে আরম্ভ করল।

কিন্তু সাহেব সে সব ভাবছিল না। সে ভেবে দেখছিল ছোকরা অফিসারটির কথা। মনে মনে ভেবে দেখল সে, ঠিক বলেনি অফিসারটি। কাফেটা থাকুক। এটা যদি কেন্দ্রই হয় তা হলেপুলিশের কাজের সুবিধাই হবে। সে কাফের পেছন দিকে গেল।

লোকের ভিড় হটিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। চেঁচাচ্ছে সেই ডালপুরীওয়ালাটা। পুলিশের সঙ্গে কুটে পাগলা লোকজনকে ঠেলা দিয়ে বলছে, যাও, সব বাড়ি যাও। নইলে সাহেব শশুরবাড়ি চালান দেবে।

কে একজন খবরের কাগজ পড়ছে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত। গান্ধীজির পুনরায় সংগ্রামের আহ্বান। সুভাষ বসুর পালটা সরকার গঠনের প্রস্তাব টিকল না।

আর একজন বলল, একটা কিছু হবে।

শ্ৰীমতী কাফের দোকান দেখিয়ে জবাবে বলল একজন, তারই শুরু হল দেখছি। বেরিয়ে এল এস.ডি.ও. সদলবলে। কিছুই পাওয়া যায়নি। লোকে বলাবলি করছে, ই ই, ভজুলাট ঘুঘু ছেলে বাবা।

কিন্তু সত্যি, শুরু হল দেশময় একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার। এ অঞ্চলে তল্লাসির একটা হিড়িক পড়ে গেল।

তিন মাসের মধ্যে আরও দুবার তল্লাসি হয়ে গেল ভজনের দোকানে। শ্রীমতী কাফে যেন নিষিদ্ধ এলাকা বলে গণ্য হয়ে গেল। খদ্দের নেই, বেচা কেনা নেই।

কিন্তু প্রত্যহ স্টেশনের দেওয়ালে আর গাছে সর্বত্র পোস্টার পড়তে লাগল।

সত্যাগ্রহী প্রস্তুত হও। স্বায়ত্তশাসনে আমাদের জন্মগত অধিকার। বিলিতি কাপড় আর মদ ছেড়ে দাও। লবণ আইন ভাঙো। স্কুল কলেজ ছাড়ো, ছাড়ো সরকারি চাকরি।

কাগজে কাগজে গান্ধীজির ছবি। মনের মতো দলবল নিয়ে দণ্ডি সত্যাগ্রহ করে তিনি চলেছেন সমুদ্রোপকূলে।

চাপা পড়ে গেল এখানকার স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশন। মহকুমা কংগ্রেস কমিটি প্রায় প্রত্যহ একবার করে সমবেত হতে আরম্ভ করল।

প্রিয়নাথকে বাড়িতে অন্তরীণ হতে হল। রথীন, সুনির্মলও বৈঠকে বসে গেল শঙ্কর ঘোষের সঙ্গে।

সে মাসে গান্ধীজিকে প্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার অবস্থা একেবারে বদলে গেল। হরতাল হল সমস্ত দোকানে। কৃপাল আর শঙ্কর ঘোষ সভা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রপ্তার হলেন।

আশ্চর্য! শ্রীমতী কাফের প্রতি মানুষের ভয় যেন জাদুবলে কেটে গেল। নিষিদ্ধ এলাকা হল প্রসিদ্ধ অবারিত। নিষিদ্ধ কিছু করার জন্য যেন সবাই সুযোগের সন্ধানে লেগে গেল। এমন কী অনেকে ঠাট্টা করে হলেও বলতে লাগল, এটা স্বদেশী রেস্টুরেন্ট।

বাঁকা কথাটাকে সোজা মনে করে নিলে বলা যায় অবস্থাটাও স্বদেশী হয়ে দাঁড়াল। ঘর বার একাকার শতছিদ্র ও শতছিন্ন। আয় কমে গেল আশাতীত রকম।

সমস্ত দেশসুদ্ধ মাতামাতিতে মাততে পরল না ভজন। সে একটা নিছক বোকার মতো সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে লাগল। তার নিয়মিত পানের সঙ্গী ভুনু ও বাঙালির সঙ্গে রোজ শস্তা দামের মদ গিলতে লাগল। অনেক রাত্রের এই আসরে তারা দেশের কথাই বলাবলি করে। তারা যেন একটা মস্ত রঙ্গমঞ্চের অদ্ভুত নাটকের তিনজন দর্শক।

বাঙালির ভেতরে ভেতরে কী রকম একটা অস্থিরতা। একটা বোবা অস্থিরতা। থেকে থেকে তার চোখ দুটো জ্বলতে থাকে। হাতের মুঠি পাকিয়ে ভাবে, ভয়ঙ্কর কিছু একটা করা দরকার। প্রত্যহ-ই পুলিশের নিদারুণ অত্যাচারের কাহিনী সে শোনে অথচ একটা বিহিতের কথা কেউ বলে না। সে নিজেও জানে না, কোথায় যেতে হবে, কী করলে নিরসর হবে প্রাণের এ যন্ত্রণা, জুড়োবে জ্বালা।

ভুনুরও অবস্থা তাই। তার মনে হচ্ছিল, এ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে একটা খেলাও রয়েছে। এক ছাদের কার্নিশ থেকে আর ছাদের কার্নিশে লাফিয়ে যাওয়ার মতো ছেলেমানুষি খেলা। হাসি ও আনন্দের মাঝে একটা বিপদের উত্তেজনা, অথচ জেদে পরিপূর্ণ। কেউ ভীত নয়, সবাই যেন উল্লাস ভরে হাসছে। এমন কী, বাবুদের জেনানারাও রাস্তায় এসে দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়াচ্ছে পুলিশের মুখোমুখি। তাদের গাড়োয়ানদের মধ্যে অনেকে বলাবলি করে এ-সব বিষয়ে। একটা গল্পের আলোচনার মতো।

কিন্তু তাদের কিছুই করবার নেই। কিছু করার নেই অথচ এ দর্শকের ভূমিকাও যেন সহ্য করা যায়।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সংবাদ পড়তে পড়তে ভজনের চোখে ভেসে ওঠে দাদার মুখ। হয়তো তিনি সেখানে নেই। তবু ভজনের মনে হয়, দাদা-ই যেন সেখানে লড়াই করছেন।

বোম্বাই শহরের শোলাপুরের মজুরদের লড়াইয়ের কাহিনী একটা অদ্ভুত রূপকথার মতো মনে হল তাদের। সে কথা শুনতে শুনতে বাঙালির চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলতে থাকে। এসব কথা তারা বলে, কিন্তু তিনজনে বসে যখন মদ খায়, তখন মনে হয় অসহ্য অবসাদে তারা মাথা গুজে পড়ে আছে। উদ্দীপনা ও অবসাদের একটা যুগপৎ লীলা খেলা যেন তাদের ন যযৌ ন তস্থে করে দিয়েছে।

চরণেরও যেন কী হয়েছে। তার মুখে কেন যেন ভাতও রোচে না। সে মদ খায় না। এমনিতেই সে মাতাল হয়ে আছে। তারও ইচ্ছে করে সে সভা সমিতিতে চলে যাবে, পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে তাকে। সে চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে বলবে বন্দেমাতরম্।

গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। বন্দেমাতরম্! মানে কী কথাটার? জানে না সে। তবুও পেছনের রান্নাঘরের অন্ধকারে একলা বসে সে আপন মনে বারবার বলে বন্দেমাতরম্! বন্দেমাতরম! মনশ্চক্ষে দেখতে পায়, তার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ বাহিনী। তাকে শাসাচ্ছে, গালাগাল দিচ্ছে, ধাক্কা দিচ্ছে, পিটছে সেই ছোকরা পুলিশ অফিসার। আর তার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে, গলার শির ফুলে ওঠে, তবু তার ঠোঁট নড়তে থাকে। বলতে থাকে, বন্দেমাতরম্!

এই ভাবনার ঘোরে সে যখন আচ্ছন্ন থাকে তখন মনে হয়, একটা ভূত বসে আছে অন্ধকার ঘরটাতে। মন্ত্র আওড়াচ্ছে বিড়বিড় করে। কিন্তু কেন, সে জানে না। তারপরে তার মনে হয়, সে এবার চিৎকার করে উঠবে। জন্তুর মতো, হিংস্র ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে করারও উপরে। যে তার পথে সামনে দাঁড়াবে, তাকেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে সে।

যুঁই রাত্রে অপেক্ষা করে থাকে রোজ ভজুর জন্য। যুঁইয়ের একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে। সে অভাব অনটনের কথা বলে না, বলে না সংসারের কথা। সে ভজনের কাছে দাঁড়িয়েছে নতুন রূপে। সে ভজনকে চায়। চায় পরিপূর্ণরূপে, নিজের মতো করে। ভজনের ব্যক্তিত্বকে মাড়িয়ে, তিরস্কার করে সে নিজের প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। তার তিনটি সন্তান হয়েছে, আট কাগজ হতে মঙ্গভবনগুয়েটে বছর তার বিয়ে হয়েছে, নিজের অন্তরের বিরুদ্ধে সে আত্মসমর্পণ করেছে ভজুর কাছে। কখনও কখনও প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু তার তীব্রতা ছিল না। আচমকা তার হৃদয়ের মোড় ফিরেছে। এতদিন বাদে হঠাৎ সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতদিন তার হৃদয়ের অপূর্ণতায় শুধু বাজছিল বেদনার ধীর লয়। পেয়েও না পাওয়ার বেদনার মাঝে সান্ত্বনার সন্ধান। আজ বেজেছে দীপক রাগিণী। এ বড় অদ্ভুত, বড় বিচিত্র। আজ সে ভজুর কাছে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বুকের মধ্যে তার পুড়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে কোনও খালি ঘর আর সে রাখবে না। হয় সে সবটুকু পাবে, পাবে তার কৈশোরের স্বপ্নকে, নয় তো সে পুড়ে মরবে নিজেরই বিদ্রোহের আগুনে।

এ কথা ভাবতে তার মনের মধ্যে কোথায় একটু লজ্জা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, উঁকি দিয়েছিল একটু বা ভয়। কিন্তু সে সব পুড়ে গেল এক হলকায়। একবার মনে হয়েছিল, সত্যি, কী তার চাই। কিন্তু সে ধন্দও সে উড়িয়ে দিয়েছে। কিছু চাই, যা পাইনি। যা পাইনি, যা না পেলে আর চলে না। মনের মধ্যে আগুন জ্বলেছে তার।

এ আগুন জ্বলার সঙ্গে দেশের বর্তমান আবহাওয়ার কোথাও একটা যোগাযোগ ছিল কিনা বলা যায় না। কিন্তু যুঁই এরকম একটা কথাও চিন্তা করেছে। সেও যাবে স্বদেশী করতে, যাবে জেলে।

কিন্তু সেখানে ভজন নেই। জেল তুচ্ছ, মৃত্যুও কিছুই নয়। কিন্তু ভজন যদি নির্বিকারভাবে তার পথ ছেড়ে দেয়, সে অপমানও যে সহ্য করা যাবে না।

ভজুকে দেখাল সে অপরিসীম অবহেলা। চলতে ফিরতে প্রকট হয়ে উঠল তার অশ্রদ্ধা। তার মৌনতা অপমানকর। নিয়ত তার চোখে জ্বলে বিদ্রূপবহ্নি, ঠোঁটের কোণে কঠিন নির্বিকারভাব। ভজনও মনে মনে অবাক হল। কথা বলে জবাব পেল না। যা পেল তা জবাব নয়। এ রূপ সে কোনওদিন যুঁইয়ের দেখেনি। অনভ্যস্ত হৃদয় তারও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সে যে জীবনে কতখানি ব্যর্থ সেটা খানিকটা জানলেও মাথা নোয়ানো তার চরিত্রেও নেই। তবু তার বুকের কয়েকটা হাড় বেঁকে মুচড়ে অষ্টপ্রহর একটা অসহ্য টনটনানি লেগে রইল।

তারা কেউ কাউকে মুখে ফুটে কিছু বলল না। কিছুদিন ধরে চলল অমীমাংসিত রক্তক্ষয়ের পালা। মাঝখান থেকে লাভ হল, ভজুর যেন জেদের বশে নেশা গেল বেড়ে। বাড়ি আসতে লাগল অর্ধেকের বেশি রাত কাবার করে।

.

এসময়ে এখানকার স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রে স্তিমিত ভাবটা কাটিয়ে একটা প্রচণ্ড ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়ল। এ জেলার শ্রেষ্ঠ নেতা নবীনগাঙ্গুলির প্রেফতার হওয়ার সংবাদ এল।

সকালবেলার দিকে হীরেন একশো চুয়াল্লিশ ধারা অগ্রাহ্য করে বেরুল একটা ছোটখাটো মিছিল নিয়ে। গন্তব্য তাদের ডায়মণ্ডহারবার। যত সময় ও দিনই লাগুক, তারা পায়ে হেঁটে যাবে বি. টি. রোড ধরে, কলকাতা পেরিয়ে দক্ষিণের সমুদ্রোপকূলে। লবণ তৈরি করতে।

গরমের জন্য স্কুল বসেছে সকালবেলা। সেখানে এমনিতেই ছাত্রদের আসা যাওয়া অনিয়মিত হয়ে উঠেছে।

সকালবেলার দিকেই রথীন হাইস্কুলের ছাত্রদের ধর্মঘট করিয়ে বার করে নিয়ে এল। ও-দিকে সুনির্মল মেয়ে স্কুলে ধমর্ঘট করলে।

সকালবেলার সদ্য জমে ওঠা বাজার ভেঙে গেল। দোকানগুলি ঝাঁপ বন্ধ করতে আরম্ভ করল।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অবস্থাটা এমন হয়ে উঠল যেন, জাদুবলে সমস্ত অঞ্চলটা মেতে উঠল এক নতুন উৎসবে। রাস্তায় রাস্তায় লোক, মোড়ে মোড়ে ভিড়, হাসি, হল্লা আর চিৎকার।

ছাত্র ছাত্রীরা মিছিল করে বেরিয়ে পড়েছে পথে। কাপড়ের দোকানগুলির সামনে এসে তারা বিলাতি কাপড় বয়কটের শ্লোগান দিতে আরম্ভ করল।

ও-দিক থেকে আসছে হীরেনের ধীর ও শান্ত মিছিল। তার দলে রয়েছেন সন্তোষ মাসিমা। আরও কয়েকজন মহিলা। একজন মহিলা, হীরেনেরই পাশে পাশে চলেছেন। অপূর্ব সুন্দরী, অল্প বয়স, বিধবা। হীরেনের ভ্রাতৃবধূ। শ্বশুরবাড়ির সমস্ত অনুশাসনকে ভেঙে তিনি বেরিয়ে এসেছেন দেওরের সঙ্গে। ভাঙতে চলেছেন বিদেশি সরকারের অনুশাসন। ঘরের আইনকে ভেঙে, রাস্তায় এসে অমান্য করেছেন আর এক আইন। তাঁর সারা চোখে আলোর ছড়াছড়ি। বাইরের শতশত দৃষ্টির সামনে তাঁর মুখে লজ্জার ছাপ পড়েছে। লজ্জা আর হাসির দৃপ্তিতে তিনি অপরূপ হয়ে উঠেছেন। চোখের দৃষ্টি তাঁর অন্তরাবদ্ধ। থেকে থেকে তাকাচ্ছেন হীরেনের দিকে। তাকাতে গিয়ে তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠছে। একটা বিচিত্র আবেগে বুক ভরে উঠছে তাঁর। অত্যন্ত নিচুগলায় বলছেন বন্দেমাতরম! মনে মনে বলছেন, হে ভগবান, আমি যেন এমনি চিরকাল ধরে চলি। এ পথ যেন কোনওদিন শেষ না হয়। আমি আর কোনওদিন ফিরব না। ফিরব না।

হীরেন ব্যাকুল চোখে রাস্তার প্রতিটি মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তাকে কি দেখা যাবে। পথের ভিড় ঠেলে আচমকা সেও কি এসে ভিড়বে তার দলে। চলবে সামনের সারিতে।

ঝাড়দার বস্তির সেই ঘটনার পরেও সে প্রায় রোজই এসেছে ভজনের দোকানে। অবশ্য আগের চেয়ে অনিয়মিত। কিন্তু রামা আর কোনওদিন আসেনি।

এসেছে। দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। যেন হীরেন দেখতে না পায়। কিন্তু হীরেন দেখেছে। বুকের মধ্যে নিশ্বাস আটকে আড়ষ্ট হয়ে বসে থেকেছে সে। হয় তো আসবে রামা। এখুনি হয় তো তার কানে ঢুকবে সেই মিঠে গলার, নমস্তে বাবুজি ধ্বনি। আসুক। এলে সহজ হতে পারবে হীরেন। তার সেই দুর্দশার এবং অপমানের ব্যাপারটাকে সে একটা জ্বলন্ত ধারালো ছুরির মতো গ্রাস করেছে। তাতে তার দেহের ভিতর ও অন্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। হরণ করেছে তার শরীরের কমনীয়তা, তার বয়স। সে যেন বুড়িয়ে গিয়েছে।

তবু, সে আসুক। হীরেন তার পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। ত্রুটি করবে না তাকে অভ্যর্থনা করতে। কিন্তু রামা আসতে পারেনি। তার ভয় ছিল, এমন কী তার চাকরির ও আশ্রয়ের আশঙ্কা পর্যন্ত ছিল। সেই ছোকরা ঝাড়দারকে সে ভালবেসেছে। কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান না করেও তার মিলন হয়েছে। কিন্তু একটা অস্বস্তি তাকে অষ্টপ্রহর পীড়ন করছে। সে অস্বস্তি তার বাবুজিকে নিয়ে। সে চেয়েছিল, বাবুজির কাছে আবার আসবে আগেরই মতো। তার প্রাণ চাইছিল, বাবুজিকে বুঝতে, একটা কিছু করতে কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা মাঝপথেই ভেঙে গেল। সত্যি, সে নেশা করে মাঝে মাঝে। ওই মরদ ঝাড়দারের জন্য প্রাণ তার উন্মুখ হয়েছিল কিন্তু তার সঙ্গে ঝাড়দারনির যেন সামান্য হলেও অল্প একটু পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে উঠছে। সে পুরোপুরি এদিকে আসতে পারল না, না পারল পুরোপুরি অন্যদিকে যেতে। অস্বীকার করবার উপায় নেই, হরেন তার মনে একটা নতুন ক্ষুধার উদ্রেক করেছিল। সে ক্ষুধা কীসের, কেন, তা সে জানে না।

সত্যি, সে ভিড়ের আড়াল থেকে দেখছিল তার বাবুজিকে। তার ইচ্ছে করছিল, সেও গিয়ে ভিড়ে পড়ে ওই দলে, কিন্তু অত সাহস হল না তার। ভয় হল, বাবুজিকে আর ওই দলের অন্যান্য মেয়েপুরুষকে। মেয়েরা হয় তো সিঁটিয়ে গিয়ে দূরে সরে যাবেন, ঘৃণা করবেন। ছেলেরা হাসবে। বাবুজি কঠিন মুখটা থাকবেন ফিরিয়ে।

ভাবতে ভাবতে তার চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে উঠল। ঝাপসা হয়ে গেল রাস্তা ও জনতা। কেন সে কাঁদছে, সে জানে না। বাবুজিকে হারিয়েছে সে, শুধু সে জন্য নয়। তার মনে হচ্ছে, সে যেন আরও কিছু হারিয়েছেন যা আর কোনও দিন তার কাছে আসবে না। ওর মরদ নর্দমা সাফ করার বুরুশটা ক্রাচের মতো বগলে চেপে খালি বলল, নমক বানানে যাতা হ্যায় লোগ।

বন্দেমাতরম….

হীরেনরা এগিয়ে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে।

ওদিকে রথীন ও সুনির্মলেরা কাপড় ও সিগারেটের দোকানে পিকেটিং করছে। বিলাতি কাপড়ের বহূৎসব চলেছে রাস্তার উপর। কিছু কাপড় দোকান থেকে এসেছে। জোর করে ছিনিয়ে এনেছে। কেউ কেউ বাড়ি থেকে বোন বউদি ও মায়ের বিলাতি সায়া ব্লাউজ আর শাড়ি নিয়ে এসেছে। ছুড়ে ফেলছে রাস্তার আগুনে। কেউ কেউ রাস্তার শুকনো রাবিশও ছুড়ে ফেলছে। যেন আগুন নিয়ে খেলায় মেতেছে সবাই। হাসছে, চিৎকার করছে, বিলিতি কাপড়, পুড়িয়ে দাও। বিলিতি মাল, ধ্বংস করো।

বড় রাস্তা থেকে পশ্চিমের রাস্তা ধরে ছাত্র-ছাত্রী যুবক-যুবতীরা ভিড় করছে।

গলি থেকে বড় রাস্তায় এসে পড়েছে দেহোপজীবিনীর দল। তারাও হাসছে, চিৎকার করে বলছে, বন্দেমাতরম! তারাও তাদের বিলাতি জামাকাপড় ছুড়ে ফেলছে রাস্তার আগুনে। তাদের পাশ ঘেঁষে একদল লোক হাসতে হাসতে রসালো খিস্তি জুড়েছে।

ভজন দাঁড়িয়ে আছে বাজারের কাছে, রাস্তার উপর। স্থাণুর মতো, বোবার মতো, বোধ করি জড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না, অথচ তার বুকের মধ্যে একটা জ্বালা ধরে গিয়েছে। তার চোখের কোলের অনেকটা জুড়ে কালো দাগ পড়েছে। মুখটা লাল টকটকে। কপালের শিরাগুলি ফুলে উঠেছে।

ভুনু তার গাড়ির চালকের গদির উপর বসে আছে। মস্ত শক্ত লোমশ শরীরটা তার খালি। গোঁফের দুপাশ ছুঁচলো করে পাকানো। গাড়োয়ান হিসেবে তার কিছু করণীয় আছে কিনা, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ একটা কিছু আজ জরুর ঘটতে চলেছে! জরুর। হয় তো স্বরাজ হয়ে যাবে আজ। স্বরাজ, মানে থানা বারিক বিলকুল সাফ হয়ে যাবে। সেপাইগুলির বে-ফজুল জুলম, পাঁচ আইন আদায় বন্ধ হয়ে যাবে।

তার গাড়ির কাছে এসে ভিড় করেছে অন্যান্য গাড়োয়ানরা। তারা ভুনুকে জিজ্ঞেস করছে, সে কিছু বলতে পারে কিনা। সে ওস্তাদ মানুষ, লাটবাবুর সঙ্গে দারু খায়, তার জানা উচিত।

কিন্তু ভুনু কিছুই জানে না। সে গদি থেকে নেমে এল। আফজল বলল, ক্যায়া, হমলোগ গাড়ি লেকে ঘর চলা যায়েগা?

ভুনু একমুহূর্ত চুপ থেকে বলল, নহি। মগর, হরতাল হো গিয়া তো হামরা ভি হরতাল হ্যায়। সোয়ারি হমলোগ নহি চড়ায়েগা।

সওয়ারি। একটা বুড়ো গাড়োয়ান ভেংচে উঠল। সওয়ারি কা ক্যায়া ফোকোট কা পয়সা যায়? উলোগ কাঁহে নিকালেগা ঘর সে। এ হুজ্জোত মে কৌন নিকলাতা!

হাঁ সচ, কৌন নিকলগা?

আর একজন বলে উঠল, শালা, ইয়ে হুজ্জোত গাড়ি কো বেকার কর দিয়া। না আপনা, না ঘোড়াকা দানাপানি। ক্যায়া, ভুখ রহনে হোগা হমলোগকো?

যেন ভুনুকেই তারা কথাটা জিজ্ঞেস করছে। ভুনু নির্বাক। কী বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না। সত্যি, তারও ট্যাঁক শুন্য। সওয়ারি আসবে না। যদি আসে তবে হরতাল করা কী করে চলবে। সবাই খাবে কী?

গাড়োয়ানেরা একযোগে সবাই খিস্তি খেউড় আরম্ভ করল এ মাতামাতিকে।

ভুনু বলল, তব ক্যায়া তুলোগ মাংতা সিপাই জুলুম? বিনা পয়সা মে উলোগকো গাড়িমে চড়ানে মাংতা? মাংতা পাঁচাইন দেনেকে?

নহি মাংতা। সকলেই বলল।

ভুনু বলল, তব? ইয়ে হ্যায় স্বরাজি কা লড়াই।হম শুনা, স্বরাজি হেনেসে হামরা তখলিফ মিট জায়েগা।

সকলেই চুপচাপ। স্বরাজি আর লড়াই দুটো দুর্বোধ্য কথা। তার সঙ্গে একটা আশা। এ কথার কোনও জবাব তাদের কারওরই জানা নেই। এমন কী ভুনুরও নয়।

ভগন আর মনোহর রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গী নেই। তারা দুজনে দুটো ছাড়া গরুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কিছুই করার নেই, উপরন্তু নেই পেটে দানা।

লোকাল আর রেলওয়ে পুলিশ একযোগে বেরিয়ে পড়েছে পথে। যে-সব এলাকায় গণ্ডগোল নেই, সেখানকার পুলিশও এসেছে। মহকুমা সদর থেকে এসেছে দুজন গোরা সার্জন।

সেই ছোকরা আফিসার সেপাইদের দাঁড় করাচ্ছে। স্টেশনের সামনে, তেরাস্তার মোড়ে। যেখানে এসে মিশেছে গঙ্গার পশ্চিমের রাস্তাটা।

এদিকে বহ্ন্যুৎসব লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। কয়েকজন তাদের গায়ের জামা পুড়িয়ে দিল। এমনকী মেয়েরা বিলিতি কাপড়ের জামা ছেড়ে দিচ্ছে পোড়াবার জন্য। আস্তে আস্তে একটা ক্ষিপ্রতা দেখা দিল। ছাত্ররা অন্যান্য কাপড়ের দোকানে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল। মনিহারি দোকানের বিলিতি মালগুলি তাদের দিকে নজর পড়তে তারা চিৎকার জুড়ে দিল। কয়েকজন ছেলে একটা সিগারেটের দোকান থেকে টেনে নামিয়ে নিল কতকগুলি প্যাকেট। ছুড়ে দিল কাপড়ের আগুনে। কিছু ছড়িয়ে পড়ল। সেগুলি কুড়িয়ে নেবার কথা হুমড়ি খেয়ে পড়ল কতকগুলি হা-ভাতে ছেলে।

সিগারেটওয়ালা চিৎকার আর কান্না জুড়ে দিল।

মনিহারি দোকানের মাথায় টাঙানো একরাশ বিলিতি খেলনা ছিঁড়ে নিয়ে ফেলে দিল আগুনে।

দোকানদার হাত জোড় করছে, পায়ে পড়ছে। কেঁদে উঠে মিনতি করছে।

এদিক দিয়ে বেশ্যাপল্লীতে যাওয়ার গলির মোড়ে ওত পেতে আছে কতকগুলি ওঁচা বদমায়েশের দল। লুটের সন্ধানে ঘুরছে তারা।

ভজন হঠাৎ মাথা তুলল। সিগারেটওয়ালার কান্না শুনে চোখ দুটো জ্বলে উঠল তার। মনে হল, অন্যায় করেছে এরা। মনে হতেই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সেখানে ছুটে এল। এসেই একটা ছেলের হাত চেপে ধরল, একী করছিস? কে বলেছে তোকে এ-সব ছিনিয়ে নিতে?

খ্যাপা ছেলের দল থমকে দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখল ভজুলাটকে। লাল টকটকে মুখ, আগুনের মতো ধ্বকধ্বকে বাঘের মতো কটা চোখ। নারানদার ভাই। রগচটা আর মাতাল ভজুলাট। মানুষ নয়, একটা খেপা সিংহ যেন।

ছেলেটা কান্না জুড়ে দিল ভয়ে। বড় বড় কয়েকটি ছেলে বলল, বিলিতি মাল যে।

বিলিতি মাল যে? তীক্ষ্ণ গলায় ভজু বলে উঠল, কিনিসনে বিলিতি মাল। কে তোকে মাথার দিব্যি দিয়েছে। গরিবের মাল তোরা নষ্ট করবি কেন? নষ্ট করতে হয় পয়সা দিয়ে কর। বলে সে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল।

তারপর সিগারেটওয়ালাকে বলল, বন্ধ করে দোকান। ঘুমুচ্ছিলে চাঁদ?

দোকান বন্ধ হতে লাগল। ছেলেরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য! ভজুদার মতো মানুষ এ ব্যাপারে কী করে বাধা দিল। তারা জানত, ভজুলাট এরকমভাবে তাদেরই দলে। এমনকী ওঁর দোকানে পুলিশের হানা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু তাদের সাহস ছিল না ভজুলাটের কথার প্রতিবাদ করার। তারা সবাই সরে পড়তে আরম্ভ করল। ভিড়ের মাঝখান থেকে কে একটা ছেলে বলে উঠল, ভজুলাট, লাটের বাট।

ভজুলাট মাথা তুলে তাকাল। চকিতের জন্য তার চোখ জোড়া জ্বলে উঠল। পরমুহূর্তেই হা-হা করে হেসে উঠল সে। মনে মনে বলল, লাটের বাট নই রে, চাটওয়ালা। কিন্তু বুকের মধ্যে একটা ফিক ব্যথা চাড়া দিয়ে উঠল তার।

ইতিমধ্যে রথীন, সুনির্মলেরা এগিয়ে চলেছে বড় রাস্তার দিকে। ওদের পেছনে একটা মস্ত দল। কিন্তু অনেকেই পেছিয়ে পড়েছে। ভীত চোখে দেখছে সামনের দিকে। লাল মুখ আর লাল পাপড়ি।

সুনির্মল যতবার চোখ ফিরিয়েছে, ততবারই একজনের সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রীদের দলের মধ্যে এক যুবতী। সে শুধু তাকিয়ে দেখছে সুনির্মলকে। কেন? সুনির্মলের মুখ লাল হয়ে উঠছে কিন্তু আবার মন ঘুরে যাচ্ছে অন্যদিকে।

রথীন চিৎকার করে বলছে, বন্দেমাতরম।

উত্তরদিক থেকে আসছে হীরেনের দল। তারাও দেখছে পুলিশ। তবু তারা এগুচ্ছে। তারা এগুবে, তারা পথ পাওয়ার জন্য বসে থাকবে চিরদিন। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে। কিন্তু তারা যাবে।

বিধবা ভ্রাতৃবধূ আরও ঘন হয়ে এসেছেন হীরেনের গায়ে গায়ে। তিনি বলছিলেন মনে মনে, কী করবে ওরা আমাদের। আমাদের মেরে ফেলবে? ফেলুক। তবু ঠাকুরপো, আমি পেছু না। কিন্তু ভগবান, যদি মরতে হয়, আগে যেন আমি মরি।

অবস্থাটা পরিবর্তন হয়ে গেল। উত্তেজনা আর ভয় ছড়িয়ে চারিদিকে। থমথমিয়ে উঠছে আবহাওয়া। একটা বিস্ফোরণের পূর্বমুহূর্তের থমথমানি।

বন্দেমাতরম্! গান্ধীজিকি জয়। স্বরাজ চাই…

থরথর করে কাঁপছে চরণের বুকের মধ্যে। কী করবে সে। সে কী নেমে যাবে। সে কী চিৎকার করে উঠবে বন্দেমাতরম বলে। একলা থাকতে পারছে না সে আর। এই ঘরটা কী ভীষণ নিঃশব্দ। কী বিশ্রী রকম জনহীন। কর্তা আসছে না কেন?

কুটে পাগলা পেছনদিকে নর্দমার ধারে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে আর বলছে, কইরে শালা, গেলি কোথা? কাল রাত্তিরে খুব ফাঁকি দেওয়া হয়েছিল। আজ না দিলে আর ছাড়ছিনে।

সাড়া শব্দ না পেয়ে বলল, শালা না আমার শালী। হারামজাদী ভয় পেয়েছে। বলে হা হা করে হাসতে লাগল।

স্টেশনের রকে একটি ভীত উৎকণ্ঠিত লোকের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে ভিক্ষে চাইছে একটা ছেলে, বাবু, একটা আদলা পয়সা দিন। দিন বাবু। আজকের দিনটাতে একটা আদলা পসা দিন।

পুলিশের সমারোহ দেখে আশেপাশের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে মরছে।

প্রথমেই একজন গোরা সার্জন হীরেনকে ধাক্কা দিল, গেট ব্যাক। ডোঞ্চ উনো হানড্রেড ফরটিফোর? আই ওয়ার্ন ইউ, গেট ব্যাক।

বউদির চোখে আগুন জ্বলে উঠল। তিনি একটা হাত ধরলেন হীরেনের। হীরেন হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বলল, বন্দেমাতরম। সবাই বলে উঠল, বন্দেমাতরম।

পশ্চিম দিক থেকে একটা ভীষণ চাপ প্রায় হুড়মুড় করে এসে পড়ল সেখানে?

বন্দেমাতরম।

গোরা সার্জন চিৎকার করে উঠল, আই সে গেট ব্যাক।

আরও জোরে শব্দ উঠল, বন্দেমাতরম। পশ্চিমের ধাক্কাটা এল আরও জোরে। অর্থাৎ যুবক ছাত্রদের ধাক্কা।

হীরেন আবার এগুবার চেষ্টা করতেই, সার্জন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেদিল।

বউদি দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য, মারমুখ হয়ে চিৎকার করে উঠলেন, খবরদার গোরা শুয়ার কোথাকার।

হীরেন ধুলোয় বসেই বলল, ছি ছি বউদি, কোনও কথা বলল না, রাগ করো না।

কেন করব না। বউদি চোখে জল নিয়েই বেঁজে উঠলেন, শয়তানটা তোমাকে মারবে?

কিন্তু রথীন সুনির্মলের দল একেবারে পুলিশের গায়ে এসে পড়ল। তারা বসে পড়বার আগেই গোরা সার্জন দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের উপর। এক সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশজন সেপাইয়ের লাঠি পড়ল তাদের উপর। একটা বিকট চিৎকার গোলমাল, হল্লা আর মার চলল।

পশ্চিমের রাস্তা থেকে ঢিল পাটকেল এসে পড়তে লাগল। চিৎকার উঠছে, রথীনদা! সুনির্মলদা!চিৎকার, বন্দেমাতরম!

এবার পুলিশবাহিনী দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লাঠি চালাল। হীরেনের দল শান্ত থাকলেও, তাদের উপরেও লাঠি চলল।

একটা হুড়োহুড়ি ধস্তাধস্তি ছুটোছুটি পড়ে গেল। বউদি জড়িয়ে ধরে আছেন হীরেনকে। জীবনে এই তিনি প্রথম লাঠির আঘাত হয়েছেন তাঁর দেহে। জীবনে এই প্রথম হীরেনকে দু-হাতে সাপটে ধরেছেন। জীবনে এই প্রথম পুরুষের জন্য অসহ্য পীড়ন গা পেতে নিয়েছেন। কিন্তু হীরেনকে আগলে রেখেছেন। হীরেন ছাড়াবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি ছাড়ছেন না।

একদল লোক হুড়মুড় করে শ্রীমতী কাফেতে ঢুকে পড়ল। সেই ছোকরা অফিসার এবং পুলিশও তার ভেতরে ঢুকেই লাঠি চার্জ করল, কারও মাথা ফাটল, হাত ভাঙল। কান্না আর চিৎকার।

ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল শ্রীমতী কাফের সামনের কাচের দরজা। উলটে ফেলে দিল টেবিল চেয়ার। দেয়াল থেকে ভেঙে পড়ল ছবিগুলি লাঠির আঘাতে।

ছোকরা অফিসারের পায়ের কাছে ভেঙে পড়েছে সি. আর. দাশের ছবিটা। সে বিড়বিড় করে পড়ল, এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। তার চোখের সামনে ভাসছে একটা কালো কাপড়ের উপর সাদা সুতো দিয়ে ওই কথাগুলি বড় বড় করে লেখা। এমব্রয়ডারি করেছে তার স্ত্রী। তার বউ লিখেছে, তোমাকে পুলিশের পোশাকে ভাবলে আমার বড়। ভয়…। বিরক্ত হল সে। এসব কী ভাবছে।

আজকে সে মাথা তুলে ঢুকেছে এখানে। হঠাৎ হাতের ছোট লাঠিটা দিয়ে সে ঘড়িটার কাচ ভেঙে ফেলল। একটা জখমী লোককে আর এক ঘা কষিয়ে পায়ের ধাক্কায় ফেলে দিল ভজুর চেয়াটা। ওই চেয়ারটার উপর তার বড় রাগ।

একদল লোক পেছনে ঢুকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়বার চেষ্টা করছিল। সেপাইরা সেখানে ঢুকেও লাঠি চালাল। ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল কাপ আর ডিস। জলের জালা ভেঙে ভেসে গেল রান্নাঘরের কাঁচা মেঝে।

কুটে পাগলা নর্দমায় পড়ে গিয়েছে আরও দুজনের সঙ্গে। সারা গায়ে তাদের পাঁক আর দুর্গন্ধ। তবু কুটে দেখতে চেষ্টা করছিল চরণকে। তার পাগলা চোখে উৎকণ্ঠা, ব্যাকুলতা। ওই ছোঁড়াটা মার খায়নি তো!

খেয়েছে। চরণ ঘাড়ে আর হাঁটুতে লাঠি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জলে আর কাদায়। ওঠবার চেষ্টা করছে, পারছে না।

গাড়ির ঘোড়াগুলি ভয়ে চিৎকার করছে চি হি হি করে। গাড়োয়ানেরা সব উঠে পড়েছে স্টেশনের রকের উপর! কিন্তু ভুনু নেই সেখানে।

ভুনু মোড়ের ময়রার দোকানের নর্দমার পাশ থেকে মাথা ফাটা অবস্থায় অচৈতন্য সুনির্মলকে তুলে নিয়েছে কোলে। ঢুকে পড়েছে পশ্চিমের রাস্তায়, বাজারের মধ্যে।

ছড়িয়ে পড়ছে লোকজন এ-দিকে ও-দিকে। পুলিশ দলে দলে গ্রেপ্তার করে সবাইকে গাড়িতে তুলছে। সুস্থ আর আহত কেউ বাদ যাচ্ছে না। হীরেন, বউদি, সন্তোষ, মাসিমা, রথীন, আরও অনেকে অগুণতি। অসংখ্য। এমন কী দুজন বেশ্যাও বাদ যায়নি। তবু পশ্চিমদিকের হিংস্র আক্রমণটা বন্ধ হচ্ছে না। এখনও ঢিল পাটকেল এসে পড়ছে পুলিশের উপর। এসে পড়ছে কোন অদৃশ্য জায়গা থেকে।

আহত হীরেন চিৎকার করে বলবার চেষ্টা করছে, কেউ ঢিল মেরো না, আঘাত করো না। এ পথ আমাদের নয়!

বউদি বলছেন,ছেলেগুলোকে মেরে হাড্ডি ভেঙে দিল। জোয়ান ছেলে ওরা, কী করে সইবে?

হীরেন তাকিয়ে দেখল, বউদির চোখ জ্বলছে একটা বাঘিনীর মতো। রাস্তার। সমস্ত কিছু ভেস্তে গেল। কান্না পেল হীরেনের। বুলেটের মতো চিল এসে পড়ছে পশ্চিমের রাস্তাটা থেকে।

এবার পুলিশ তাড়া করল এই রাস্তায়। একদল ছাত্রকে ধাওয়া করে চলল গঙ্গার ধারের দিকে।

একদল পুলিশ গোরা সার্জনের হুকুমে একটা দীর্ঘ নারকেল গাছে উঠবার চেষ্টা করছে। কোন এক অজানা দুঃসাহসী ওই সুউচ্চ নারকেল গাছের মাথায় পতাকা বেঁধে দিয়েছে। গ্রীষ্মের পোড়া আকাশের গায়ে উড়ছে পতাকা। অধৈর্য হয়ে উড়ছে কোন এক অসীমে ছুটে যাওয়ার জন্য। সেই পতাকা নামাতে হবে। কিন্তু কোনও সেপাই গাছে উঠতে পারছে না। খেপে উঠছে গোরা সার্জন। রাস্তার লোক ধরে গাছে ওঠাতে চাইছে, কেউ উঠছে না।

.

একটি মহিলা, বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে, এসে দাঁড়াল ভুনুর পাশে। সুনির্মলকে দেখিয়ে বলল, ইনি কে? বাড়ি কোথায়?

ছাত্রীরা বলে উঠল, সুনির্মলদা। আমরা চিনি দিদিমণি। বাড়ি অনেকটা দূরে।

দিদিমণি বলল, ওকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দাও, কাছে হবে।

ভুনু বলল, বহুত আচ্ছা দিদিমণি।

পুলিশ সরে গিয়েছে। ফাঁকা হয়ে গিয়েছে রাস্তাটা। গাড়োয়ানেরা সব গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছে। কেবল ভুনুর রাজারানী পরস্পর নাকে নাক ঠেকিয়ে বোধ হয় তাদের অসহায় মনের কথা আদান-প্রদান করছে।

ভজন এসে দাঁড়াল দোকানের বারান্দায়। তাকানো যায় না তার মুখের দিকে। মনে হচ্ছে। গনগনে আগুনের গোলা দিয়ে একটা মুখের অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। সে মুখটা ভজনের। পৃথিবীর কোনও দুঃসাহসী বোধ করি এখন তার ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

সে তেমনি দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর সামনে বড় দরজার পাল্লাটা ধরল সে। ঠাণ্ডা হয়ে এল তার চোখ মুখ। একটা অসহ্য যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠল সে। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল।

সামনের দরজার বড় পাল্লার কাচ নেই। নেই সেই আমন্ত্রণের কথা, শ্রীমতী কাফে, ভিতরে আসুন। জ্যৈষ্ঠ মাসের খবরা হাওয়া বইছে তার ফাঁক দিয়ে। ভেঙে পড়ে আছে কয়েকটা চেয়ার। উলটো সোজা হয়ে পড়ে আছে ছবিগুলি। ফেটে গিয়েছে পাথরের টেবিল একটা। ঘড়িটা চলছে। টক টক করে। ভাঙা কাচের এক চিলতে ঝুলছে তার এক পাশে।

ভজন ঘরের মধ্যে ঢুকল। যেন একটা পাগল ঢুকেছে, বহুদিনের পোড়ড়া বাড়ির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে। সে ডাকল, চরোণ। সাড়া নেই। হয় তো পালিয়েছে। বিশের কথা মনে পড়ে গেল তার।

মাঝের ঘরে ঢুকল সে। বোতল আর কাপ ডিস ভাঙা ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘরটায়। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, কাদার উপরে চরণ বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে। উনুন জ্বলছে। কেতলির ঢাকনাটা ফুটন্ত জলের ধাক্কায় ঠকঠক করে নড়ছে। একটা ক্ষিপ্ত তেজে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাষ্পের গোলা।

ভজু ডাকল, চরোণ!

চরণ ভজুর দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

ভজু বলল, কীরে, মার খেয়েছিস? সবাইকে নিয়ে গেল, তোকে নিল না?

তাকিয়ে দেখল চরণের হাঁটুটা ফুলে কালো হয়ে উঠেছে। ফুলে উঠেছে কাঁধটা। কান্না মারের ব্যথার জন্য না কি, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি বলে বোঝা গেল না।

ভজন তাকে তুলে এনে শেয়াল বেঞ্চির পরে। নরম গলায় স্নেহভরে বলল কাঁদিসনে হারামজাদা। দোকানটা গেলে তোর হাত ধরে যে আমাকে রাস্তায় বেরুতে হবে। ও-বেলা থেকেই দোকান চালু করতে হবে। কুটে পাগলাকে বলে দিচ্ছি দোকানটা সাফ করার জন্য। ডাক্তারের কাছ থেকে এনে দিচ্ছি তোর ওষুধ। বলে সে সামনের ঘরটায় এসে আবার থমকে দাঁড়াল। দু একজন ছুটে পালাল দোকানের সামনে থেকে। আশেপাশের কয়েকজন লুকিয়ে দেখতে এসেছিল ব্যাপারটা। স্টেশনের রকে কয়েকজন হাঁ করে এদিকে তাকিয়ে আছে।

ভজু বসে পড়ল। ভাঙা চেয়ারের তলা থেকে টেনে টেনে বার করল ছবিগুলি। মুক্ত বাউলের উদাস গভীর চোখ রবীন্দ্রনাথের কিশোর নবাব সিরাজদ্দৌলার তীব্র কটাক্ষ, ভুবনমোহন যীশু, যুবতী ধরিত্রীর কোলে মানব শিশু র‍্যাফেলের আঁকা। সি. আর. দাশ, নারায়ণ, কচি কচি সবুজ ঘাসে মুখ ঠেকানো রাঙা সাদা গাই।

চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল ভজনের। হঠাৎ কানে এল কচি গলার ডাক, বাবা।

চমকে উঠল ভজন। ফিরে তাকাল। দেখল গৌরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুঁই! যুঁই এসেছে শ্রীমতী কাফেতে, উয়ে উৎকণ্ঠায় ব্যাকুল হয়ে। ভাঙা শ্রীমতী কাফে।

যুঁই ভেতরে এসে দাঁড়াল। কোনওদিকে তাকাল না। কথা ফুটছে না তার গলায়। তবু বলল, বাড়ি চলো।

ভজন তাকাল যুঁইয়ের মুখের দিকে। এখনও যুঁইয়ের মুখে সেই কাঠিন্য। তবু নিজে না এসে পারেনি। এখনও তার মুখে মনান্তরের উদাসীনতা।

তবু যুঁই দাঁড়িয়ে রইল। আশপাশের লোকেরা আর কৌতূহল চাপতে পারল না। কেউ কেউ সমবেদনা জানাবার জন্যও রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

যুঁই বলল, তোমাকে ডাকতে এসেছি আমি।

বুঝেছি। ভজু বলল, আমি পরে যাব, তুমি যাও। সে উঠে দাঁড়াল।

যুঁইয়ের বুক ফুলে উঠল। বাধা মানল না চোখের জল। গলা ভেঙে এল তার। বু বলল, তুমি বাড়ি চলো!

ভজু তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, যুঁই। আবার ফিরে বলল, নিতাইয়ের মা, তুমি বাড়ি যাও। আমার অনেক কাজ রয়েছে, সেগুলো শেষ করে যাব।

যুঁই জলভরা চোখে তাকাল ভজুর দিকে। ভজুও তাকিয়েছিল। তারও চোখ আর শুষ্ক থাকতে চাইছে না। বলল, যাও। আমি ধরা পড়িনি, মার খাইনি, ভাল আছি। দোকানটা ঠিক না করে আমি কেমন করে যাই?

গৌর মাতৃভক্ত। বাবাকে তার নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল। তার কান্না পাচ্ছিল। তাই সে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছে। যুঁই ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে বেরিয়ে গেল গৌরের হাত ধরে। বৃথাই ব্যাকুলতা, কান্না আর মাথা কোটা। পাথর যে কিছুতেই টলতে চায় না।

পতাকা উড়ছে। অনমনীয়, অজেয় ভাবে এক দুরন্ত দুষ্ট শিশুর মতো হা হা করে, উড়ছে আকাশের গায়ে। পারেনি নামাতে পুলিশ।

.

সুনির্মলের জ্ঞান হল। চোখ চাইল। চোখের সামনেই একখানি মুখ! যেন চেনা, চেনা, দেখা দেখা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখে ব্যাকুলতা। সারা মুখে উৎকণ্ঠা। রুপবতী নয় তবু রূপসী।

সুনির্মল বলল, কার বাড়ি?

জবাব এল, আমার।

আমার। সুনির্মল শুনল, মিষ্টি পরিষ্কার গলা। বলল, পুলিশ কোথায়?

চলে গিয়েছে। ধরা পড়েছে অনেকে।

রথীন?

চিনিনে। বোধহয় ধরা পড়েছেন।

আপনি কে?

হাসি ফুটল সেই মুখে। বুদ্ধি ও হৃদয়দীপ্ত হাসি। বলল, সরসী রায়। মেয়ে স্কুলে মাস্টারি করি।

সুনির্মল একমুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর চোখ বুজল। হৃদয়ের তালে তালে বাজতে লাগল, সরসী রায়, সরসী রায়।

এর কয়েকদিন পরেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করল।

কিন্তু সারা দেশের উদ্দীপনার জোয়ার কাটল না। তবে আঞ্চলিক ভাবে এখানকার আবহাওয়ার ঝড়ো বেগটা অনেকখানি প্রশমিত হয়ে এসেছে। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে গিয়েছে।

প্রিয়নাথ বাড়িতে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছে। সে পালিয়ে গিয়েছে।

কদিন ধরে এখানে ভয়ানক ঝড় জল শুরু হয়েছে। সারাদিনে শুধু জল, রাত্রের দিকে সামুদ্রিক ঝড়ের দক্ষিণ হাওয়া যেন গোটা দেশকে উত্তরদিকে মুখ আছড়ে ফেলতে চাইছে।

এখনও কাটেনি শ্ৰীমতী কাফের সেই ভগ্নদশা। সামনের দরজার কাচের ভাঙা টুকরোগুলিকে আঠা দিয়ে কাগজে জোড়া লাগানো হয়েছে। সেই জোড়া তালি দেওয়া কাচ লাগানো হয়েছে দরজায়। মনে হয়, লেখাগুলি মাঝখান দিয়ে ফেটে ফেটে গিয়েছে। ভাঙা চেয়ার কটা জড়ো করা রয়েছে এক কোণে। ছবিগুলি বাঁধানো হয়েছে আবার। ঠিক তেমনি ভাবে টাঙানো হয়েছে দেয়ালে। ঘড়িটা রয়েছে তেমন। এমন কী এক চিলতে কাচের টুকরোটুকুও।

ভজন পড়ে আছে টেবিলে মাথা এলিয়ে। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব। একটা খদ্দেরও আসেনি সন্ধ্যাবেলা থেকে। আসেনি রোজকার সাথী বাঙালি। গাড়ি বের করেনি ভুনু।

কিছুক্ষণ আগেও ভজু দুর্যোগময়ী আকাশের দিকে তাকিয়ে মত্ত-চিত্তে একটা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবছিল। দোকানের মাল পড়ে আছে যেমন তেমনি। চরণ মাঝের ঘরের বেঞ্চিতে বসে আছে হাঁটুতে মাথা দিয়ে।

এমন সময় পেছনের দরজা দিয়ে এলেন নারায়ণ। কাঁধে সেই ঘরছাড়া বাউন্ডুলে ব্যাগ। চরণ দপ করে জ্বলে ওঠা একটা আগুনের শিখার মতো লাফিয়ে উঠল।

নারায়ণ কোনওদিকে না তাকিয়ে একেবারে সামনের ঘরে এসে ভজনের মাথায় হাত রেখে ডাকলেন, ভজু, ভজন, আমার পেছনে পুলিশ রয়েছে ভাই। এখনও গঙ্গার ও-পার। আমাকে এখুনি হাড়মুণ্ডি পুলের ধারে পৌঁছে দিতে হবে।

ভজুর প্রতিহিংসা নেওয়া দুরের কথা, নেশাটাই যায় আর কী। একে এই দুর্যোগ, তায় হাড়মুণ্ডি পুল? দিনের বেলাই যেখানকার নাম শুনলে গা ছমছ করে?

সে তার স্বাভাবিক জড়ানো গলায় বলল, কে হে ভদ্রবেশী ঠ্যাঙাড়ে, হাড়-মুণ্ডি-পুলের ধারে নিয়ে প্রাণে মারতে চাইছ?

শত্রুতাড়িত সন্ত্রস্ত নারায়ণ চকিতে একবার হতাশ হয়ে ফের দৃঢ় গলায় বললেন, ভজু যেমন করে হোক, পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা একটা ভোকে করতেই হবে। তোর প্রাণের ভার আমার।

আমার প্রাণের ভার? মুহূর্তে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভজু যেন এতক্ষণে দাদাকে চিনতে পেরে রক্তচক্ষু মেলে তাকাল। হেসে বলল, দাদা তুমি? ভজু কাউকে তার প্রাণের ভার দেয় না, নেয়। তুমি একটু বসো, এলুম বলে।

বলেই সে চকিতে বেরিয়ে গেল বাইরের ঝড় বাদলের মধ্যে। এমনভাবে গেল যেন, এ ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুতই ছিল, একটু বোঝার বাকি ছিল, এই যা।

নারায়ণ একবার চমকালেন, তাঁর আকাশের মতো একটা চিন্তার রেখা দিল। ভয় হল ভজনকে এই ঝড়ের মধ্যে বাইরে পাঠিয়ে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার স্বাভাবিকভাবে তাকালেন বাইরের দিকে। নিজের ছায়া দেখলেন একবার শ্রীমতী নামাঙ্কিত ভাঙা আয়নায়। তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন শ্রীমতী কাফের অবস্থা।

এমন সময় চরণ এসে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল।

চরণের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন নারায়ণ, কেমন আছ চরণ?

ভাল আছি।

আমাদের বাড়ির সব ভাল?

চরণ একটু থেমে বলল, ভাল।

নারায়ণও একটু থেমে বললেন, তোমার বাবুর দোকান কেমন চলছে?

চরণ এবার অনেকক্ষণ থেমে রইল। তারপর সমস্ত ভাঙাচোরা জিনিসগুলি দেখিয়ে বলে গেল সেই ঘটনা।

নারায়ণ শুনতে শুনতে ভাবছিলেন খালি ভজুর কথা।

চরণ হঠাৎ ব্যাকুল গলায় বলল, আপনি একটু বাবুকে মদ খেতে বারণ করুন।

কেন রে?

নইলে বাবু বাঁচবেন না।

চরণের চোখে জল দেখা দিল। নারায়ণ নিশ্বাস বন্ধ করে বাইরের ঝড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একটু পরে বললেন, চরণ জীবনে তুমি কী চাও ভাই?

চরণের মনে হল বুঝি দেবতার বর দেবে। সে বোকার মতো বলল, জানিনে।

নারায়ণ বললেন, না জানলে কি চলে। কিছু চেয়ো যা চাইলে তুমি মুক্তি পাবে। মুক্তির সাধনা-ই জীবন।

ভজু ততক্ষণে ভুনুর আস্তাবলে গিয়ে হাজির। অতিরিক্ত মাতাল হওয়ার জন্য ভুনুর বউ সেদিন ভুনুকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। সে আস্তাবলের মধ্যেই, গাড়ির ভিতর দরজা বন্ধ করে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল। ভজুর চেঁচামেচি ও অন্ধকারে সন্ত্রস্ত ঘোড়াগুলোর ফোঁসানি ও পা ঠোকাঠুকিতে ভুনুর নেশাচ্ছন্ন ঘুম কেটে গেল। সে গাড়ির দরজা খুলে খিঁচিয়ে উঠল, এটা তোমার বাড়ির দরজা লয় লাটঠাকুর। এগিয়ে যাও।

ভজু তার স্বাভাবিক মাতাল আবেগে বলে উঠল, সে কি ভুনু সারথি, এই তো আমার ছিরি বেন্দাবন। তোমাকে এখুনি একবার উঠতে হবে।

ভুনু ভাবছে, ভজুলাট মাতলামো করছে। সে বলল, বউ আনতে যাবে তো লাটবাবু? কাল যেয়ো, এখন ঘরে যাও অনেক রাত হয়েছে।

তোর মাথা হয়েছে। বলে ভজু একেবারে এগিয়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বউ নয় সারথি, নতুন মহাভারতের ব্যাপার। রথে ঘোড়া জুড়তে হবে, যেতে হবে হাড়মুণ্ডি পুল।

হাড়মুণ্ডি পুল? ভুনুর মাতাল চোখ গোল হয়ে উঠল।

অন্ধকারে ঘোড়াদুটের চোখ, এমনভাবে চকচক করে উঠল যেন তারাও ওই নামে আতঙ্ক বোধ করছে।

ভুনুর মুখ থেকে স্ব-ভাষা বেরিয়ে এল, এ ঝড়বরসাত মে হাড়মুণ্ডি পুল? কেয়া, তুমহরা দিমাক। বিলকুল খারাপ হো গয়া?

ভজু প্রায় বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল, দুনিয়াতে এখন, এ-সময়ে কেবল আমার দিমাকই ঠিক আছে। হ্যাঁ, তোকে এখুনি যেতে হবে হাড়মুণ্ডি পুল। না পারিস ঘোড়া জুড়ে দে। নিজে চালিয়ে যাব।

মনে হল ভজুর নেশা-জড়ানো গলা হঠাৎ অনেকখানি গম্ভীর ও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। বোধ করি এ মুহূর্তে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় বেদনাকে নিজের মুখে স্বীকার করে ফেলল সে, দ্যাখ ভুনু, পয়সা আমার না-ই থাক, পেছনের ঘরে নিজের মাল বানিয়ে যতই কেন না কাউন্টারে কোচা লুটিয়ে বসি, আর মাল বিক্রি না তোক কেবল মাতাল হয়েই পড়ে থাকি, তবু মাঝে মাঝে এ প্রাণের জ্বালা দাউ দাউ করে ওঠে বুঝলি? আজ আমি প্রাণ দিতে পারি। আর প্রাণ দেওয়ারই অভিসারে যাব আজ। দাদাকে পৌঁছে দিতে হবে হাড়মুণ্ডি পুল, পেছনে তার পুলিশের তাড়া। আমার কাছে এসেছে বিপদে। আমি কি চুপ করে থাকতে পারি। আজ যে দেবতা আমাকে বর দিতে এসেছে রে ভুনু। সময় নেই, ঘোড়া জুড়ে দে।

গলায় তার কিছুটা হুকুমের সুর ফুটল।

ভুনু ফিফিস্ করে বলল, কে, লারাইন ঠাকুর? আরে বাপ্‌রে।

কথার স্বরে তার যত শ্রদ্ধা ও বিস্ময়, তত ভয়। ওই নামটার সঙ্গে পরিচয় সকলের এবং সেটা মানুষের নাম নয়, মহামানুষের। এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে আবার বলল, লাট ঠাকুর, তা হলে তুমি বলছ তোমার সঙ্গে জানটা দিয়ে আসতে?

হ্যাঁ!

ভুনু নেমে এল গাড়ি থেকে। দুজনেই মাতাল, কিন্তু হঠাৎ তারা ভীষণ গম্ভীর ও কর্মতৎপর হয়ে উঠল। অবশ্য পায়ের তলায় মাটি তাদের অস্থির।

বাইরে দুরন্ত ঝড়ের শাসানি, মেঘ গর্জন, অবিশ্রান্ত বর্ষণ ও গাঢ় অন্ধকারকে তীব্র বিদ্যুৎ ঝলক ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলছে।

ট্যাক থেকে দেশলাই বার করে গাড়ির বাতি জ্বেলে ভুনু অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে ঘোড়া দুটোর উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। গায়ে চাপড় মারল, কান ধরে টানল। ঘাড়ের ঝুটিতে রদ্দা মারল, কয়েকটা হি হিস্ শব্দ করল বিচিত্র ভাবে। তারপর টেনে এনে জুতল গাড়িতে। দেখা গেল তার পঙ্খীরাজ ও রানীও কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সারাদিনটা তাদের ঝিমিয়ে আর খেয়ে কেটেছে। এখন তারা তৈরি।

সব ঠিক করে গাড়ি বার করতে যাবে, এমন সময় দেখা গেল, আস্তাবল থেকে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার গলিপথটায় একটা টিমটিমে লক্ষ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ভুনুর বউ। এ ঝড় বাদলের রাতে মাতাল সোয়ামিকে আস্তাবলে ঠেলে রাখলেও ফাঁকা বিছানায় তার ঘুম ছিল না। তার উপরে এত রাতে গাড়ি বের করার শব্দে সে এসেছে মনের উৎকণ্ঠা চেপে, কপট রাগে মুখ ভার করে।

ভজু দেখল, তার ভুনু সারথির রাধিকা যাকে বলে রীতিমতো রূপসী। সত্যি বলতে কী, এ সঙ্কট মুহূর্তেও ভজুর মনে হল, আলো আঁধারিতে ভুনু কোচোয়ানের কোচোয়ানি যেন দা ভিঞ্চির ক্যানভাসে জ্যান্ত মোনালিসা।

বউ নির্ভীক ও গম্ভীর গলায় বলল, অব ক্যা, মাতোয়ালেকা দু খেল শুরু হোতা? কঁহা নিকল্‌তা তু এ তুফান বরসাত মে?

ভুনু ঘোড়ার লাগামে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বলল, লাট ঠাকুর বাতায়া, দেওতা আয়া হ্যায়। বর লেনে যাতা। সচ্।

ঠাণ্ডা গলায় বলেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, মেরা সোয়ারি আয়া যায়, কাম মে যাতা, মুঝে মাতোয়ালে মত্ বলল। চালো লাটবাবু।

বলেই সে ঘোড়ার পিঠে কষে এক চাপড় দিতেই, গাড়ি বেরিয়ে পড়ল। মুহূর্তে গাড়িটা যেন দুরন্ত বর্ষণে নেয়ে উঠল, ঘোড়া দুটো কান নেড়ে ঝাড়তে লাগল জল।

ভুনু আবার ফিরে বলল তার বউকে, কোই পুছনে আয়ে তো বোল দে, মরদানা তোহার মাতোয়াল বকে, রাত ভর ফুর্তি মাচানে গয়া রেন্ডিখানা মে।

ভজু তার ঘাড়ে চাপড় মেরে বলল, ঠিক বলেছিস।

ভুনু আস্তাবলের টিনের ঝাঁপ ঠেলে দিয়ে উঠল তার গদিতে। তারপর ভজু উঠতেই, ওই আকাশের বিদ্যুতের মতই মাথার উপর তার চাবুক শিস্ দিয়ে উঠল।

চোখের পলক না পড়তে গাড়ি এসে দাঁড়াল শ্রীমতী কাফের দরজায়। নারায়ণ হালদার বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ির ভিতর ঢুকে খালি বললেন, গাড়ির মাথার বাতিটা নিভিয়ে দাও।

ঘোড়ার গাড়ির হাল দেখে তাঁর মনে আবার একটা হতাশার ভাব চেপে এল।

ভজু চরণকে সব ভার দিয়ে বলল, ঘুরে আসছি, দোকান বন্ধ করবি দেরি হলে। তারপর ছুটল ভুনুর পঙ্খীরাজ। ততক্ষণে নারায়ণ আড়ষ্ট শরীরে থ মেরে গিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এ ছাকরা গাড়িটা এত দ্রুতবেগে চলছে কী করে। বাইরে দুরন্ত ঝড় জলের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছে গাড়ি ও ঘোড়ার পায়ের আঘাতে।

বাইরে অন্ধকারে তীক্ষ্ণ চোখের সামনে চেয়ে আছে ভুনু। আজকে এ রাত্রের নায়ক যেন ভজু বা নারায়ণ নন, ভুনু নিজে। ঝড়ের ঝাপটা, জলের তোড় ভেঙে গুঁড়িয়ে চলেছে উত্তরের সড়কে, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে। চাবুকটা কেবল পাক খাচ্ছে মাথার উপর। ঘোড়ার পিঠে নয়, চাবুকের কষাঘাত পড়ছে ঝড়ের পিঠে। বিদ্যুতের চমকানিতে হকচকিয়ে উঠেছে পৃথিবী। কিন্তু ভুনুর রাজা ও রানীর ভূক্ষেপ নেই। কেবল তাদের বিস্ফারিত চোখ বিদ্যুৎ ধাঁধিয়ে যাওগার মুহূর্তে যেন জ্বলে উঠেছে আরও। নারায়ণ হালদার দেখলেন ভজু নিশ্চিন্তে ঝিমোচ্ছে। তিনি একবার কাঁধের ব্যাগটা হাতালেন, ডাকলেন, ভজু।

কোনও জবাব নেই।

এক মুহূর্তের জন্য সন্ত্রাসবাদী নেতার মুখের সমস্ত কাঠিন্য কোথায় অদৃশ্য হয়ে এক বিচিত্র বেদনায় ভরে উঠল। মাতাল ভজুকে ঘুমন্ত ভেবে তার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে আপন মনে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, এ সংসার মানুষকে সবই তৈরি করতে পারে, প্রাণের জ্বালায় মানুষ কী না হতে পারে।

সে মুহূর্তে মনে হল যেন গাড়িটার উপরেই একটা বাজ পড়ল। গাড়ির অন্ধ কক্ষের ফুটোফাটা দিয়ে উঁকি বিদ্যুতের রেখার। নারায়ণ বলে উঠলেন আবেগভরা অপরিস্ফুট গলায় তুমি তাকে পথ দেখাও, ছিঁড়ে ফেলো এ অন্ধকার, ভাঙো এ পথের বাধা।

কিন্তু ভজু ঘুমোয়নি। অন্ধকারে তার দুই বন্ধ চোখের পাতা ভিজিয়ে জল গড়িয়ে এল। তা বুঝি সে নিজেই টের পেল না। কাকে বলছেন এ কথা তার দাদা? তাকে না, তার ঈশ্বরকে! কেন বলছেন?

কেন, সে কথা বুঝেছে ভজু। বুঝেছে, সংসার বলতে শুধু ঘরের কথা বোঝেনি। তিনি বলেছেন এ পৃথিবীর কথা, ভজনের ব্যর্থতাও বোধকরি তার বিশ্বাসহীনতার কথা। বলেছেন, ভজুর এ মাতাল ও ভাঙা জীবনের জন্য, তাকেই পথ দেখাবার জন্য।

বাইরে ভুনু পাথর হয়ে গিয়েছে যেন। শুধু তার হাতটা দম দেওয়া মেশিনের মতো চাবুক ঘোরাচ্ছে। আর বিড়বিড় করে বলছে হে ব্ৰহমদেও! হামারা রাজা-রানীকো আশমান মে উঠা লো। ই-লোককো কৃপাসে পঙ্খা দে দেও! ব্রহ্মদেও! এ অন্ধেরা মিটা দো, বাত্তি বাঢ়াও চারা তরফ মে। লাটবাবু বাতায়া, আজ হ্যায় মওকা জান দেনে কা।

সত্যি, ঝড় বিক্ষুদ্ধ কালো আকাশের পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা বিরাট বাঁকা তলোয়ারের মতো রূপালি রেখা দেখা গিয়েছে। সে আলোর রেখায় ঘন বৃষ্টির ছাট ফুড়ে অদুরেই মাথা জেগে উঠেছে কিস্তৃতাকৃতি হাড়মুণ্ডি পুলের। সেখানে নিয়ত ঘাপটি মেরে থাকে গুপ্তঘাতক ডাকাত খুনি ঠ্যাঙাড়ে। সেখানে কত অসহায় পথিকের ছিন্ন মুণ্ড ও হাড় ছড়িয়ে আছে। অন্ধকার যেন জীবন্ত মৃত্যু।

হাড়মুণ্ডি পুল!

ভুনুর নজরে পড়তে সে আরও শক্ত হয়ে উঠল। তার চাবুক আরও জোরে শিস্ দিয়ে উঠল। সে বারবার বলে উঠল, মত রোখো রাজা রানী আগে বাঢ়ো…আগে বাঢ়ো!…

নারান দরজা খুলে ফেললেন গাড়ির। সঙ্গে সঙ্গে জলের ঘাটে ভিজে উঠলেন।

ভজু আর একদিকে দরজা খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাইরে তাকাল। হাত পা শক্ত হয়ে উঠেছে তার।

গাড়ি ঠেলে উঠেছে পুলের উপর এঁটেল কাদা মাড়িয়ে।

মোরগের ডাকের মতো তিন বার স্তিমিত শব্দ ভেসে এল। নারায়ণ হালদারও তেমনি শব্দ করে উঠলেন।

একটু পরেই দুজন লোক এসে দাঁড়াল গাড়িটার সামনে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের মধ্যে শোনা গেল।

নারানদা?

হ্যাঁ, জবাব দিলেন নারায়ণ।

গাড়ি থেমে পড়ল। নারায়ণের পেছন পেছন ভজুও নেমে এল দাদাকে আগলাতে। নেমে এল ভুনু। কিন্তু সে আতিপাতি করে দেখছে হাড়মুণ্ডি পুল। যেন পৃথিবী ছাড়িয়ে চলে এসেছে। এসেছে বুঝি ব্ৰহমদেওয়ের রাজত্বে, যেখানে ঠাসা আছে ভয় ও বিস্ময়।

নারান প্রথমে নেমেই ঘোড়া দুটোর গায়ে হাত রেখে বললেন, জীবনে এই প্রথম জানলুম জানোয়ারও মানুষের কতখানি।

তারপর ভুনুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি কী চাও ভাই?

ভুনু নিঃসঙ্কোচে জবাব দিল, এক ভাঁড় তাড়ি।

এই হাড়মুণ্ডি পুলের উপরে ঝড়জলের মধ্যে নারান ও তার অপেক্ষমান সঙ্গীরা হেসে ফেললেন। কেবল হাসল না, সবচেয়ে বকবকে মানুষ ভজু। নারান বললেন, তাড়ি তো এখানে নেই। আর টাকাও নেই, তোমাকে আমি অনেকটা সোনা দিতে পারি।

ভুনু বলল, বাবু-থেমে আবার বলল, লারাইন ঠাকুর, তুমার কাছে তাড়ি মেঙ্গেছি পিয়াসের জন্যে। না পারেন কথা নেই। মগর রূপেয়া আর সোনা। সে তো বহুত ছোট। আজ জান দেনে আয়া রহা। এ আঁখসে তুমাকে তো দেখে লিয়েছেন। আর কুছু চায় না ভুনু।

নারানের সঙ্গে যেন হাড়মুণ্ডি পুলটাই একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বিদায়ের স্বরে নারান ডাকলেন, ভজু।

ভজু বলল তার স্বাভাবিক গলায়, তোমাকে তা হলে এখানেই রেখে যাব?

হ্যাঁ, ভজন, তুই এবার যা।বলে তিনি সঙ্গীদের বললেন, ওদের একটু এগিয়ে দিয়ে এসো।

ভুনু ততক্ষণে ঘোড়ার লাগাম ধরে গাড়ির মোড় ফিরিয়ে দিয়েছে। ভজু বলল, এগিয়ে দেবার দরকার নেই। বলে আপন মনে পাগলের মতো বলে উঠল,

ভয়ের মূঢ় অন্ধকারকে ছিঁড়েছি আজ আলোর তলোয়ারে
দেখি নি যা, দেখেছি তা, আমার অন্ধ ঘরের বন্ধ দ্বারে।

চলি দাদা! চরে ভুনু সারথি।

ফিরে এসে তারা দুজনেই মদ খেয়ে ঘরে ফিরল। কেবল চরণ জিজ্ঞেস করল, কোনও বিপদ আপদ হয়নি তো?

ভজন জবাব দিল, আজ্ঞে না।

তারপর ঝড়ের রাতকে তারা আরও মাতিয়ে তুলল প্রচণ্ড হল্লায়। কেবল ছাড়াছাড়ির সময় ভজু বলল, ভুনু তোর রথ, আর আমার শ্রীমতী কাফে, এই নিয়ে আমরা। জীবনে কতকগুলি দিন আসে, ওগুলো বোধহয় আমাদের জমায় পড়বে না যেমন আজকের রাতটা। ..এবার তুই যা তোর মোনালিসার কাছে, আর আমি..আমি যাই আমার যুঁইয়ের কাছে।

তারপর একলাই বলতে বলতে গেল–

দুয়ার খোল হে পুরবাসী
এসেছি রুদ্র সন্ন্যাসী
তোমার ঘুমন্ত ঝড়ো কালো রাতে
জ্বাল আগুন, হানব বাজ, হৃদয় পাতে।

তারপর যেন কান্নাভরা গলায় বলে উঠল—

প্রেয়সী তোর উন্নত বুকে মরণ দেখি কার,
ঠোঁটে তোর খুনের হাসি দেখেছি আমার।

এর সাতাশ দিন পরে ভুনুর রাজা ও দুমাস তিনদিন পরে রানী ভাগাড়ের শেষ শয্যায় শুয়ে, শকুনের ঠোঁটে হেঁড়া পেটের নাড়িভুড়ি বার করে, স্থির অপলক চোখে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। আর একজোড়া কিনতে হল তাকে ঘটিবাটি বেচে।

তারপর অবসাদ। আপাতচক্ষে মনে হয় না শ্রীমতী কাফেতে কোনও অবসাদ চেপে বসেছে। তার নিয়মিত খদ্দেরের সংখ্যা অসম্ভব রকম বেড়েছে। রকমারি সব লোক। এক-একদিন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে এখানে। যত রাজ্যের সংবাদ পরিবেশিত হয় এখানে। কোন্ পাড়ায় কী ঘটেছে, কোন ঘরের কী সংবাদ, তারই ন্যক্করজনক কাহিনী। তবে ভজুকে লুকিয়ে, না শুনিয়ে। কয়েকদিন কয়েকজনকে ভজু ঘাড় ধরে বার করে দিয়েছে দোকান থেকে।

তবুও অবসাদ। যেমন বেড়েছে ভজুর মাতলামি, তেমনি বেড়েছে পাগলামি। আগে তবু ভাল কথা কিছু বলত। আজকাল হাসে, কবিতা বলে, গান গায়। কখনও কখনও জ্বলে ওঠে। অকারণ। কেউ তার মানেও বুঝতে পারে না।

বাঙালি আসে মাঝে মাঝে। থেকে থেকে সে খালি বলে, এ জীবনটা আর ধরে রাখতে প্রাণ চায় না গো ঠাকুর। ভাবি, শালা জন্মালুম-ই বা কেন, কেন বা রইচি বেঁচে।

বোধ হয় অন্যরকম ভাবে এ প্রশ্নটা ভজুর নিজেরও। মাঝে মাঝে আসে ভাগন আর মনোহর। তারা দুজনে অন্য এলাকায় চটকলে চাকরি পেয়েছে। তারা আসে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে নারায়ণের সংবাদ। মনে হয়, তারা প্রতীক্ষা করে আছে কোনও কিছুর জন্য। কখনও বা জিজ্ঞেস করে প্রিয়নাথের কথা।

গোলক চাটুজ্যে মশাই আসেন তেমনি। কিন্তু গল্প করেন অনেক রকম। তাঁর পুরনো বন্ধুদের কথা তিনি ভুলতে পারেন না।

সেই ছোকরা পুলিশ অফিসারটিকে আর কখনও দেখা যায় না। সে বদলি হয়ে গিয়েছে এখান থেকে। কুটে পাগলার বেড়েছে পাগলামি। রেলের মাল বইতে গিয়ে গঙ্গার খেয়া ঘাটের কাছে নিয়ে লোককে ভয় দেখায়, পয়সা আদায় করে। এজন্য কদিন হাজতবাসও করেছিল। কিন্তু চরণের নিষ্কৃতি নেই তার হাত থেকে। আশেপাশের দোকানি আর বাজারের লোক কুটে পাগলার চরণ-প্রেম নিয়ে হাসাহাসি করে।

কৃপাল, শঙ্কর, হীরেন, রথীন, সুনির্মল এরা সকলেই জেলে। কয়েকদিন আগেই মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন হয়ে গিয়েছে। স্বদেশী করতে গিয়ে সারদা চৌধুরী জেলে গিয়েছিল।

ভজুর বাবা হালদার মশাই দোকানের ক্ষতিপূরণের জন্য একটা মামলা করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন তিনি নিজেই সব বন্দোবস্ত করবেন। ভজু বলেছে, কার কাছে মামলা? এ সরকারের বিরুদ্ধে, এ সরকারেরই কোর্টে? ওসব ধোঁকাবাজিতে যাচ্ছিনে আমি।

একটা মানুষ একেবারে ভাবলেশহীন বোবা হয়ে যায় কী করে হালদার মশাই তার একটা প্রমাণ। উনি সারাদিন সেই বাড়ির ধারে বারান্দায় ইজিচেয়ারটাতে বসে থাকেন। কিছু ভাবেন কিনা তাও বোঝা যায় না। লোকে বলাবলি করে, পাগল হয়ে গেছে নেকো হালদার।তবুও আশ্চর্য! ভজুর দেরাজ থেকে বোতল চুরি করা ওঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

যুঁই শান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু তার দুশ্চিন্তা সার হয়েছে। ভজুর জন্য। সাধারণভাবে সে ভজুর ভালবাসার কাঙালিনী হয়েছে। দিনরাত ছেলে মেরে শাসন করে, করে উপোস আর পার্বণ। তার একটি মেয়ে হয়েছে।

বকুলমা শুধু ঘুরে বেড়ান। আজ কাশী, কাল বৃন্দাবন।

একটা অবসাদ এসেছে।

সন্ধ্যাবেলা-ই টলতে টলতে একটি যুবকের কামিজ চেপে ধরেছে ভজু। যুবক একেবারে ফিটফাট বাবু। কাচির ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে গ্লেসকিডের জুতো। মাথায় বাবরি চুল।

যুবক শ্রীমতী কাফের রীতিমতো খদ্দের।

ভজু বলল, তুই আন্দু ভট্টচাযের ছেলে না?

যুবক অপমানে লজ্জায়, হঠাৎ আক্রমণের ভয়ে প্রায় ড়ুকরে উঠল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

কবার ম্যাট্রিক ফেল করেছিস?

আজ্ঞে চারবার। যুবকের চোখে প্রায় জল এসে পড়েছে।

গঙ্গায় মেয়েদের ঘাটে বসে থাকিস?

যুবক একেবারে চুপ। কেউ হাসছে। কেউ বলছে ছেড়ে দিতে। ভজু বলল, ছেড়ে দিলুম আজ। আর কোনওদিন আসিনে শ্রীমতী কাফেতে, যা বাড়ি যা।

কোনওদিন কিছু নয়, আজকেই হঠাৎ কেন ভজুলাটের এ আক্রমণ, কেউ বুঝতে পারল না। একটা বিশ্রী স্তব্ধতা ভর করে এল সন্ধ্যাকালীন আসরে। বাকি কয়েকজন যুবক টুকটাক সরে পড়ে।

ভজু বলে, কই হে নরসিং, পড়ে যাও।

নরসিং একজন খদ্দের। সে পড়তে থাকে কয়েকমাস আগের একটা মাসিক বসুমতী, বাঙালার রাজনীতি। বাঙ্গালার রাজনীতি ক্ষেত্রে অধুনা যে ভূতের নৃত্য দেখা যাইতেছে–যে স্বেচ্ছাচার ও পরমত অসহিষ্ণুতার জন্য আমরা বুরোক্রেসিকে দায়ী করিয়া গালি পাড়ি-রাজ্যদলের দলপতিদের মধ্যে এ দোষ দেখা দিয়েছে। তারই ফলে বাংলা কংগ্রেসে দলাদলি-পরন্তু তরুণ রাজনীতিক বিজ্ঞের মতো বুঝাইয়াছেন যে, গতানুগতিক শান্তি ও আরামের জীবন, জীবন নহে, উহা মৃত্যুরই লক্ষণ, বিবাদ বিতণ্ডাই জীবন।–যেদিন বাঙ্গালা সংবাদপত্রসেবীদের সভায় সম্পাদক শ্রীযুক্ত মৃণালকান্তি বাবুর উপরে স্বাধীনতাকামী তরুণ লেখকের আক্রমণ প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম..অদৃষ্টের পরিহাসের মহো.ডাক্তার বিধানচন্দ্রকে অপমান ও প্রহারবাঙ্গালী তুমি ভাবিয়া দেখ, আজ তুমি কোথায়…

কুটে পাগলা হা হা করে হেসে উঠল স্টেশনের রক থেকে। ভজু হেসে উঠে বলল, বুঝেছ নরসিং।

কী দাদা?

বাঙালি কোথায় দাঁড়িয়েছে?

নরসিং অবাক হয়ে চুপ করে রইল। ভজু বলল, বুঝলে না? বাঙালি কুটে পাগলা হয়েছে।

তারপর আবার বলল, আন্দু ভট্টচাযের ছেলেও বাঙালি।

সবাই হাসতে লাগল তার কথা শুনে। ভজু আবার বলল, নরসিং, আমিও বাঙালি। কিন্তু, নারায়ণ হালদার কি বাঙালি নয়? নেকড়ের মুখের শিকারের মতো লুকিয়ে ফিরছে প্রিয়নাথ, সেও যে বাঙালি, সেটা তোদের সম্পাদক সতীশবাবুকে লিখে পাঠিয়ে দে।

হাসতে হাসতে কপাল ব্যথার মতো সবাই চুপ করে রইল। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ভজনের কী বিচিত্র রূপান্তর। সে আর একটি কথাও না বলে মাথা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রইল।

.

রাত্রি বাড়তে থাকে। ভজন চলে যায়। চরণ একলা ঘরে একটা বন্দি আত্মার মতো ছটফট করে। এ ঘরটা যে খোলা আকাশের তলায় পর্বতের গুহার মতো। এখানে নির্জনে অজান্তে লাফিয়ে লাফিয়ে তার বয়স বেড়ে উঠেছে। নতুন ও বিচিত্র সব চেতনায় ভরে উঠছে তার বুক। সারা শরীর জুড়ে তার অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষার উন্মাদনা। এতদিনের দেখা সমস্ত ছবি ও ঘটনা তার মাঝে নবরূপে প্রকাশ পেতে চাইছে। নিজের মধ্যে কী খুঁজে পেয়ে বেদনায় বুক ভরে উঠছে তার। আত্মহারা হয়ে উঠছে আনন্দে।

এ একাকীত্ব সে আর সহ্য করতে পারছে না। তার কাউকে চাই। কিছু চাই। সে ভালবেসে মুক্ত হতে চায়। কিন্তু জীবনটা অভিশপ্ত। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। দেখেও না তার আত্মহারানো, তার বেদনা।

সে অন্ধকারে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। রাস্তাটা এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গিয়েছে। কাছেই পি ডব্লিউ ডির শ্রমিকেরা আস্তানা পেতেছে। জ্বলছে লাল বাতি। রাস্তাটাতে পীচ ঢালা হচ্ছে।

চরণের সারা গায়ে অগ্নিস্রোতের জোয়ার বইছে। অন্ধকারে সাপের গায়ের মতো চোখ কচক করছে তার। পা টিপে টিপে সন্তর্পণে সে এসে উঠল নাড় পুরোতের গলিতে। বারবনিতাদের আজ্ঞায়। ঢুকে পড়ল তার একটা বাড়ির উঠোনে। ঢুকেই নির্বোধের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

এক ঝাঁক মেয়েমানুষ একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। পরমুহূর্তেই তার একাকীত্ব, তার বেদনা, আনন্দ, প্রেম, সুখ সমস্ত কিছুকে উড়িয়ে দিয়ে ধেয়ে এল বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ হাসি, কুৎসিত সম্বোধন, জোড়া জোড়া শিকারি চোখের বিলোল কটাক্ষ।

চরণের মনে হল, যেন তার সম্মায়েরা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। হসি ও বিদ্রূপের মাঝে চরণ পাগলের মতো, বোবা আর কালার মতো দাঁড়িয়ে রইল।

একটা মেয়ে বলে উঠল, ছোঁড়া যে কথাই বলে না। পছন্দ হচ্ছে না বুঝি?

আর একজন বলল, ওমা। এ যে ভজন ঠাকুরের দোকানের বাবুর্চি গো। কই লো গোলাপী, তোর বড় নোলা। এই নাগরকে নে, খুব মাংস খেতে পাবি।

অশ্লীল কথার ঝড় বইল। কুৎসিত অঙ্গভঙ্গিতে মেতে উঠল উঠোনটা।

তবু অসহ্য বেদনা ও আনন্দে আগুন হয়ে উঠল চরণ। সে হাঁ করে তাকিয়েছিল একটা মেয়ের দিকে।দোহারা গড়ন, মাজা রং, শান্ত চোখ।

মেয়েটা এগিয়ে এসে ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে বলল, আমাকে মনে ধরেছে বুঝি?

চরণ ঘাড় নাড়ল। মেয়েটা তার হাত ধরে গায়ে টেনে নিয়ে বলল, তবে চলো।

কিন্তু চরণ তাকে আমন্ত্রণ জানাল তার পেছনের অন্ধকার ঘরটাতে। শুনে আবার একটা হাসির রোল পড়ল।

গৃহকর্ত্রীর অনুমতি নিয়ে মেয়েটি এল চরণের সঙ্গে তার পিছনের ঘরে। কিন্তু তার শান্ত চোখের চাউনি হয়ে উঠেছে বাঁকা। ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের, তাচ্ছিল্যের হাসি। দরিদ্র ভক্ত যেন তার দেবতাকে পেয়েছে, এমনি ভাবে চরণ তাকে আদর করে বসতে দেয়। দেয় চেয়ার পেতে। ব্যাকুলভাবে তাকে খেতে দেয়। ডিসে করে সাজিয়ে দেয় চপ, কাটলেট, মাংস। কাছে বসে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম?

তাচ্ছিল্য ভরে খেতে খেতেই জবাব দেয় মেয়েটি, নাম-টাম নেই। নামের মধ্যে এক নাম, বেবুশ্যে।

বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে। তবু এই হাসিই যেন এ ঘরটার মুক্তি এনে দিল। চরণ গল্প আরম্ভ করে, ইচ্ছে করে হৃদয়কে উজাড় করে দিয়ে নিবেদন করে তার বেদনা, দুঃখের কাহিনী। বুঝি কেঁদে ফেলবে এখুনি ওর কোলে মুখে রেখে।

কিন্তু মেয়েটা ডিস সরিয়ে রেখে তীব্র গলায় ঝনঝনিয়ে উঠল, কাজ সেরে বিদেয় দেও বাপু, আর দেরি করতে পারব না।

চকিতে সমস্ত আলো নিভে গেল। কোনও কিছুর প্রতীক্ষা নেই, সময় নেই হাসি কান্নার।

জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হল আজ পাশবিকতার মধ্যে। বাঙালি কিশোরের যৌবনের প্রথম পদক্ষেপ।

উৎকট লজ্জাহীনার মতো মেয়েটি গোছমাছ করল বেশবাস। কিন্তু চরণ তেমনি ব্যাকুল। ব্যাকুল ভাবে পাওনার বেশি পয়সা দিয়ে হাত ধরে বলে, আবার এসো। আসবে তো?

মেয়েটা আঁচলে পয়সা বাঁধতে বাঁধতে, হেসে বলল, তা হলে কিন্তু আরও বেশি দিতে হবে বাপু।

চরণ বলে, সব দেব। যা আছে, সব দেব।

তার পর মেয়েটা চলে যেতে দু হাতে মুখ ঢেকে সে বসে থাকে। তার লজ্জা ছিল, ঘৃণা ছিল, ছিল মান অপমান, তবু বারবার মনে মনে বলল, আমার যা আছে সব দেব। তবু এসো।

কেবল একটা অসহ্য যন্ত্রণার কান্না সে কিছুতেই আটকাতে পারল না।

চরণের এ ব্যাপার ভজন জানতে পারল না।

মেয়েটি প্রায়ই আসতে লাগল। আস্তে আস্তে তার ঝাঁজ কমে আসে। ঠাণ্ডা হয়ে আসে তপ্ত মন।

চরণ নেশাচ্ছন্ন। ভালবাসার নেশা। কিন্তু ভালবেসে সে যে মুক্তি চেয়েছিল, সেই মুক্তি আসেনি। সে বাঁধা পড়েছে নতুন করে! মনে মনে বলে, আগুনে পুড়তে পারি, মরতে পারি, তবু ওকে ছাড়তে পারিনে। মেয়েটি তার নাম বলেনি। না-ই বা বলল। সে নিজেই তার নাম। ভাবে, মানুষ যখন প্রথম বিয়ে করে, তখন তার কেমন হয়। জীবনে বিয়ে বাসর সে দু-একটা দেখেছে। দেখেছে বর কনে, এয়ো আত্মীয়-স্বজন, হাসি গান, ঢোলক, কাঁশির তাল আর শানাইয়ের গান।

বাপের বিয়ে দেখতে নেই বলে তাকে গাঁয়ের কাছেপিঠের এক বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সে শানাইয়ের সুর শুনেছিল। শোনা কথা, তার গর্ভধারিণী মাকে বিয়ের সময় খরচ হয়েছিল চার কুড়ি টাকা। সৎ-মাকে বিয়ের সময় খরচ হয়েছিল একশো দু কুড়ি টাকা। বাজনা বেজেছিল। ঢোলক আর শানাই। কিন্তু বড় আশ্চর্য। সেদিনের শিশু-মনে এখনও তার সেই সুর বাজছে যেন কান্নার মতো! মনে আছে, ঘুমন্ত বিষ্ণুপ্রিয়াকে চিরজন্মের মতো ফাঁকি দিয়ে যাবার বেলা নিমাই যে গান গেয়েছিল, সে সুরই বেজেছিল সেদিন শানাইয়ে।

মায়ার বাঁধন ছাড়া কিগো যায়।
যাই যাই মনে করি, যাইতে না পারি,
মহামায়া আমার পিছনে ধায়।

কিন্তু চরণের মিলন রাত্রে সুর বেজেছে। সে সুরের নাম জানে না সে। কিন্তু সুর বিদায়ের নয়। সে সুরে বেদনা ও আনন্দ দুই-ই ছিল। মনে মনে ভাবে, হোক সে বেশ্যা, হোক সে পাপিষ্ঠা, তবু চরণের জীবনে সে প্রথম নারী। বহু বীভৎস দৃশ্য দেখে তার মনের মধ্যে একটা বিকৃতি বাসা বেঁধেছিল। বিকৃতি একটা অস্বাভাবিক তৃষ্ণার মতো। আবার বিতৃষ্ণাও বটে। সে বিকৃতি মেয়ে দেহ নিয়ে।

কিন্তু এই মেয়েটি তার সেই বিকৃতি কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল! মন তার সহজ হয়ে এল। তার অস্বাভাবিক তৃষ্ণা ও বিতৃষ্ণা দুই-ই মিটে গেল। দেহকে ভালবাসতে শিখল।

কোনও কোনওদিন মেয়েটি চরণের মন না বুঝে অকারণ উকট ভঙ্গি করে। মুখে কিছু বলতে পারে না, মনে মনে তার কষ্ট হয়, অপমান বোধ হয়। কী করে ওকে বোঝাবে, এ ভঙ্গির আমার প্রয়োজন নেই। এত সুন্দর যার শরীর, যার সবটাই এত ভরাট, তার কোনখানটা এত শুন্য যে, তাকে এ-সব করতে হয়।

এক একদিন ভাবে, ওকে বলে ফেলি তোমাকে আর ছাড়তে রাজি নই। রেখে দেব তোমাকে আমার কাছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে তুমি আমাকে গালি পেড়, বকো, যা খুশি তাই করো। কিন্তু আর যেয়ো না সেখানে।

কিন্তু সে কথা বলতে তার ভয় হয়। মনে হয় একথা বললে সে বুঝি আর কোনওদিন আসবে। এমন কি হতেও পারে না। একদিন এই মেয়েই বলবে, তোমাকে ছেড়ে আর যাব না।

এরই সঙ্গে মনে পড়ে বার্মা ফেরার পথে জাহাজের সেই সঙ্গীর কথা, আর মনে পড়ে যায় নারায়ণের কথা। মনের ভেতর কে যেন বলে ওঠে, এই দেবতার মতো মানুষদের ভালোবাসা পেয়েছিস তুই, বিশ্বাস ও স্নেহ পেয়েছিস মাতাল ভজুলাটের মতো মনিবের। আর তুই কিনা বিকিয়ে দিলি নিজেকে বেশ্যার পায়ে।

কিন্তু হে দেবতা, বিশ্বাস করো, আমার পাপ নিয়ো না, মেয়েটাও আমার ভগবান হয়ে উঠেছে। আমি ভাবি, জাহাজে সেদিন তোমার ওই হাড়সার বুক থেকে প্রাণটুকু বেরিয়ে কোথায় গেল? সেই অসীমের সন্ধানে কোথায় ঘুরছে তোমার অতৃপ্ত আত্মা। আমি ভাবি, আর একজনের কথা। এই সেদিন তুমি ঝড় জলের রাতে ভুনুর গাড়িতে করে কোথায় ছুটে গেলে। শক্র তোমাকে ধরতে পারেনি তো! ভাবি, মনিববাবু, আমাকে তুমি যত খুশি চড়-চাপড় মারো। আবার যত খুশি খাওয়াও আর ভাল জামা কাপড় কিনে দাও, তোমার শরীরটাকে তুমি আর ক্ষয় করো না। ভাবি, শ্ৰীমতী কাফের এই ঘর, তার দেওয়ালের কোথাও একটু দাগ পড়েছে কিনা। কত তার আজকের বিক্রি, কত সে দিয়েছে, কত জনা খেয়েছে বাকি কোন রান্নাটা লোকে ভাল নও মন্দ বলেছে, তার প্রতিটি খুঁটিনাটির বিষয় আমার না জানলে মুখে ভাত রোচে না।

আর ভাবি, এ মেয়েটার আর আমার কথা। ঘৃণায় ও অপমানে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে যখন ভাবি, সন্ধ্যাবেলা ওর ঘরে একটা পুরুষ ঢুকছে। আমার সারা গায়ে ছুঁচ ফুটতে থাকে, যেন ম্যালেরিয়া জ্বরে হাঁপাতে থাকি, যখন ভাবি ওর দেহের উপর একটা মানুষ চেপেছে। ভাবি, এ তো আর সইতে পারিনে। জীবনের এ বিধান কি বদলে যেতে পারে না কোনও রকমে। সামনে যে কেবলি অন্ধকার। অন্ধকারে থেকে থেকে দেখছি, অন্ধকারেও সব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ জীবনে তা পরিষ্কার হবে কবে।

অবসন্ন ভজু। কী অভূতপূর্ব কান্তি।

রামা এল একদিন। লাট বাবুজি! নমস্তে!

আদব ভোলনি। ভোলেনি নমস্তে বলতে। এখন ও ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে মুলকি ভাষা বলে না। এখনও তার চাউনি চলনে বলনে একটা পরিচ্ছন্নতা ও নম্রতার ছাপ আছে।

ভজু যেন ঘুমঘোরে চোখের পাতা খুলল। তাকিয়ে দেখল রামাকে। বেশভূষা আগের চেয়ে নোংরা হয়েছে। মাথার চুলে জট ধরেছে একটু একটু করে। চেহারা রোগা হয়েছে। চোখের কোল বসা। কোলে একটা কালো কুকুতে কয়েক মাসের বাচ্চা।

ভজু বলল,কে, রজকিনী রামী?

রামা কথাটার মানে জানে না। বলল, হাঁ।

তোর কোলে ওটা কে রে?

রামার সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে হাসি লজ্জার, ব্যথার, আনন্দের, গৌরবের। বুঝি এই সি দেখতে চেয়েছিল হীরেন বার বার। কিন্তু এ হাসি ছিল না রামার মুখে। বলল, বাবুজি, মেরি বাচ্চা।

বটে! ভজু একটু অবাক হয়ে বলল, তোর শাদি হল কবে রে? রামা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, শাদি নহি হুয়া বাবু। সরপঞ্চকে রায় মোতাবিক বিশ রূপেয়া পঞ্চায়েত্ কো হাত মে দিয়া। এক মরদ হম্‌সে মহব্বত করতা রাহা।

বলতে বলতে লজ্জায় সে মুখটা ফিরিয়ে নিল।

মহব্বত! ভজুর চোখে ভেসে উঠল হীরেনের মুখটা। কেন সেদিন হীরেন অমন করে কেঁদেছিল। মদ খেয়েছিল। সে বাচ্চাটার দিকে তাকাল। স্নেহ ভরে দেখল। তারপর হেসে দেরাজ খুলে একটা টাকা রামার কোলে ফেলে দিয়ে বলল, তোর ছেলের মুখ দেখে দিলুম।

রামা সেই টাকাটি বাচ্চার শিথিল মুঠোয় ভরে দিয়ে সোহাগ ভরে বলল, লে, লাটবাবু দিয়া। চুহ কাহিকা, মেরে কালালাল।

বলে সে হেসে উঠল। ভজুও হাসতে লাগল।

তাদের এই যুগল গলার হাসি শুনে আশেপাশের লোকেরা সবাই অবাক হয়। মুখ চাওয়াচায়ি করে হাসাহাসি করে।

তারপর হঠাৎ রামা জিজ্ঞেস করে, লাটবাবু, বাবুজিকো জেল সে কব ছোড়ড়গা?

তা তো বলতে পারিনে।

রামার চোখে জল ভরে আসে! হীরেনের বসবার জায়গাটির দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ ধরে।…আজ আর সে সুতো কাটে না। প্রায় রোজ নেশা করে, মরদের মার খায়। মার দেয়ও। আবার দুজনে জড়াজড়ি করে কাঁদে। কিন্তু এই একটি মানুষ বাবুজি, যাকে কোনওদিন সে ভুলতে পারবে না। সে আজও বোঝে না বাবুজি তার কাছে কী চেয়েছিল। বাবুজিকেও সে বুঝতে পারেনি। তবু তাকে অদেয় তার কিছু নেই। আজও যখন সে চোখ বুজে ভাবে, তখন অনুভব করে, বাবুজি তার হৃদয়ের অন্ধকুঠরির দরজায় একটা ভয়ানক আঘাত করেছিল। কিন্তু সে দরজা তার খোলেনি।

বাচ্চা বুকে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সে বিদায় নিল।

এই পথের উপর দিয়ে মাঝে মাঝে সরসী হেঁটে যায়। একলা। লোকেরা তাকিয়ে থাকে। ভাবে সাহস আছে। ভদ্র মেয়েমানুষকে সেজেগুজে একলা চলতে এখানে দেখা যায় না। তাই কিছুটা বিস্ময়ও আছে।

সরসী যাওয়ার সময় একবার করে শ্রীমতী কাফের দিকে তাকিয়ে যায়, আর দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে। এখনও তার সবটুকু পরিচয় পড়া হয়নি সুনির্মলের কাছে।

হীরেনের বউদি কয়েকদিন জেলে ছিলেন। আবার তিনি ঠিক আগেই মতো অন্দরবাসিনী হয়েছেন। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে কোথাও যাওয়ার সময়ে খড়খড়ি তুলে শ্ৰীমতী কাফের দিকে তাকিয়ে যান। তাকিয়ে দেখেন এই রাস্তাটা। তাঁর জীবনে একটা অদ্ভুত ব্যাপার এইখানে ঘটেছিল।

নমদনাখ্‌ অয়গুল ও রিন্দিকুন্ ও খুশ্ববাশ,
বাশ্‌ তৌরে অজবলজিমে ঐয়ম-ইশবাহস্ত্‌।

টেবিলে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে ভজন। তার আধা কর্কশ আধা মিঠে নেশামত্ত গলায় আচমকা ফুটল আরবি কাব্যের বো। তার পর গলার স্বর তলিয়ে গেল যেন লৌহ দরজার ককিয়ে ওঠার মতো।

এ সময়ে স্টেশনের জনহীন এলাককাটা চৈত্রের ভর দুপুরে ঝিম মারা উদাসীনতায় মুসাফিরের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। ভজুর জড়ানো গলার কাব্যে মনে হল, মেতে উঠল বুঝি আরবের কোনও কুঞ্জবীথি।

দক্ষিণ হাওয়ার গরমের আভাস। সূর্যের প্রখরতায়, মেঘমুক্ত নীল আকাশটাকে দেখাচ্ছে যেন কাচের আবরণ লাগানো।

স্টেশনের রকে একটা পশ্চিমা কুলি কানে আঙুল দিয়ে গান ধরেছে। সরু গলায় ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না মত। সুরের পরদার সঙ্গে পরদা মেলানোর মতো এ গানের কোনও আলাদা সুর নেই। এই ক্লান্ত চৈত্র দুপুরের সঙ্গে সুরটা মিশে গিয়েছে। কান পেতে সে গান শুনছে একটা পশ্চিমা সেপাই।

কুটে পাগলা রকের ধুলোয় শুয়ে আছে যেন পালঙ্কে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়েছে কোনও রাজার ব্যক্তি।

এ সময়টাতে ট্রেন কম, তাই কম কোলাহল। শেডের তলায় ঘুমুচ্ছে কয়েকটা কুলি, যাত্রী আর ভবঘুরে ভিক্ষুকেরা।

ইয়ার্ড থেকে ভেসে আসছে লুজ শাটিং-এর গুম গুম শব্দ। থেকে থেকে ভেসে আসছে বসন্ত পাখির বিরহের গান।

ঝিমোচ্ছে চরণ। একরাশ আলুসেদ্ধ চাপিয়ে, হাঁটুতে মুখ গুজে বসে ঝিমোচ্ছ।

ঘড়িতে টং টং করে দুটো বাজল। ভজু মাথা তুলে বসল, কে? কেউ নয়। ভজু আদর করে তার এ ঘড়ি বাজাকে বলতো, এ ঘণ্টা নয়, যেন কোনও রহস্যময়ীর চটুল হাসি। জলের তলা থেকে হাসে মৃন্ময়ী।

এক মুহূর্ত সে তার রক্তকটা চোখে ঘড়িটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খুক খুক করে হেসে জড়ানো গলায় বলল,

তোমার পায়ে নুপুর বাজে–
এখন এত কাজের মাঝে,
নয়ন মেলি এমন সময় কোথা?
জান নাকি কাজের মানুষ সব সময়ে ভোঁতা।

গলা ছেড়ে হেসে বলল,

সাকী তবে পিয়ালা ভর,
কটাক্ষে মোর জানটি হর্‌র্‌।

তার পর হঠাৎ সে থামল। মনে হল একটা মেয়ে তার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে, আড় চোখে চেয়ে চেয়ে হাসছে। কে মেয়েটি। শ্যামলা রং মাথায় একরাশ চুল, শক্ত গড়ন। মেয়েটা কে হে?..কিন্তু মেয়েটা এবার কাঁদছে। কাঁদছে আর কয়েকটা ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে।

ও! যুঁই। ওরা গৌর নিতাই।

তার পরে আর একজন। দাদা নারায়ণ। প্রিয়নাথ বাঙালি, হীরেন, রামা। মাথাটা তার খারাপ হয়ে উঠল হঠাৎ। এ-সব কী? এরা তাকে এমন ঘিরে ধরেছে কেন? যেন গত জন্মের পাওনাদারেরা সব।

সে চিৎকার করে উঠল চরণ!

চরণ চমকে উঠে ছুটে এল। কিন্তু কোথায় কে। ভজন তেমনি টেবিলে মুখ দিয়ে পড়ে আছে। কেবল বুকের মধ্যে ধক ধক করছে তার।

হঠাৎ রাগ হয় চরণের। আজকাল তার মাঝে মাঝে এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা মনে হয়। এমন কী আশেপাশের অনেক হোটেলওয়ালা তার রান্নার খ্যাতির জন্য বেশি মাইনেতে তাকে ডেকেছে।

কিন্তু সেযায় না। সেই নিমাইয়ের গানের মতো, যাই যাই মনে করি, যাইতে না পারি। কেমন করে যাবে। সে যে ভালবেসেছে এ দোকানটাকে, তার মনিবকে।

আবার হাঁক দিল ভজু, অ্যাই হারামজাদা।

আঁজ্ঞে এই তো।

কোথায় থাকো ল্যাটের ব্যাটা।বলে এমন ভাবে সে উঠল বুঝি মারবে চরণকে। কিন্তু চরণকে পেরিয়ে কোঁচা লুটিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে এল বারান্দার ধারে। হাঁকল, অ্যাই ভুনু সারথি, শুনতা নেই যে ডাকছি।

সে চিৎকারে ঘুম-ভাঙা কুলি আর যাত্রীরা বিরক্ত মুখে এদিকে তাকিয়ে মনে মনে গালাগাল দিয়ে আবার ঝিমোতে লাগল। মনে মনে গালাগাল দিল কেউ। নির্জীব ঘোড়াগুলি বার কয়েক পিচুটি ভরা চোখ পিটপিট করল কান নাড়ল, একটু টান করে নিল যা গায়ের চামড়া।

ভুনু আধমাতাল হয়ে তার গাড়ির মধ্যে দুদিকের সিটের মাঝখানে পেটটা দিয়ে শুয়ে আছে। তার নতুন ঘোড়া দুটো বেঁটে আর লোমশ। একটা মরদা আর মাদী। এদেরও সে নাম দিয়েছে। রাজা-রানী।

কিন্তু এখন এ ভর দুপুরে যখন যাত্রী নেই, রোজগার নেই, তখন এ-সব ডাকাডাকি তার ভাল লাগল না। সে ভারী গলায় খিঁচিয়ে উঠল, ক্যা, ক্যায়া বোলতা।

ভজু হাত ঝাপটা দিয়ে বলল, চালিয়ে দে।

চালিয়ে দে। এতদিন ধরে ভজুকে সে দেখছে, কিন্তু লোকটার কথার মানে সে আজও বুঝতে পারে না। কেউ-ই বুঝতে পারে না। অনেকেই নেশা করে কিন্তু ওর মতো দুর্বোধ্য কেউ নয়! এমন কী লারাইন ঠাকুরকে সে বুঝতে পারে। বাঙালিকে তার নিজের ভাইয়ের মতো মনে হয়। মাঝে মাঝে বাঙালি তার প্রাণের মধ্যে কী রকম একটা অন্ধ রাগ জাগিয়ে তোলে। কার ওপর যে রাগ, সেটা ওর ঠাহর হয় না।

স্বরাজীর লড়াইয়ে যেদিন সে সুনির্মলকে নর্দমার ধার থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, যেদিন জান দেবার জন্য গিয়েছিল হাড়মুণ্ডি পুল সেইদিন তার রাগের একটা সুস্পষ্ট ধারা ছিল। সে রাগটা পুলিশের উপর। বাঙালি চাকরি করে, ওর জেদ থাকতে পারে মালিকের কাছে পেট ভরানোর দাবিতে। তার তো মালিক ভগবান। যাত্রী এলে রোজগার, নয় তো সবই ফকিকাড়। সে কার পরে রাগ করবে? তবু রাগ হয়।

কিন্তু সে লাটঠাকুরকে বোঝে না। নাই-ই বুঝুক। কিন্তু এখন এ ভর দুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে ডাকাডাকিতে তার মেজাজ বিগড়ে গেল। খদ্দের এলে, নগদ রোজগারের আশা থাকলে না হয় মেজাজটা চেপে রাখা যেত। গতকাল তাকে ঘোড়ার বকলেশের চল্লিশটা ঘুঙুরু ও শিরস্ত্রাণ বিক্রি করে দিতে হয়েছে অভাবের তাড়নায়। মনিয়া তাকে বিদ্রূপ করেছে। দিন রাত খোটা দেয়, আগের ঘোড়া দুটোকে সে ইচ্ছা করে নাকি মেরে ফেলেছে।

এ-সব ভেবে সে আবার দুই সিটের মাঝখানে পেটটা দিয়ে শোবার উদ্যোগ করতেই ভজু চিৎকার করে উঠল, অ্যাই ভুনু সারথি, হাঁকাও। দেখোনি কি দ্রোণাচার্য রণে মত্ত। মহামৃত্যুর হাসি হাসিতেছে বুড়া। পার্থের হস্তে—

শালা মাতালকাঁহিকা। মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে গাড়ির ভেতর থেকেই হাত বাড়িয়ে, মুখে নানান শব্দ করে ঘোড়া দুটোকে কী ইঙ্গিত করল। অমনি ঘোড়া দুটো নড়ে নড়ে দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে সোজা আস্তাবলের দিকে চলল।

স্টেশনের রকে চেঁচামেচিতে সদ্য ঘুমভাঙা এক হতভম্ব যাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল ভজু, যুদ্ধ শেষ।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *