৬. তখন অজয় নিদ্রিত

তখন অজয় নিদ্রিত। সুটকেসটা তুলে নিয়ে সমর উঠে দাঁড়াল। চুপি চুপি মায়াকে বলল, চলুন, আমরা বেরিয়ে পড়ি।

প্রায় দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, এই সময় ছুটতে ছুটতে লীলা এসে ঘরে ঢুকল। সে যে চলে যাচ্ছে, বুঝেই একখানা হাত চেপে ধরল তার। কিন্তু কি যে বলবে, সেটা বুঝে উঠতে না পেরে নীরবে তাকিয়ে রইল।

সমরের চোখে ফুটে উঠল কঠিনশীতল দৃষ্টি। এক মুহূর্ত সেটা বদ্ধ হয়ে রইল লীলার মুখের ওপর। পরমুহূর্তে পরুষ কণ্ঠে বলল, আচ্ছা, নমস্কার।—তারপরই মায়ার একখানা হাত চেপে ধরে তাকে একরকম টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পাকদণ্ডীর পথ বেয়ে নামছিল তারা। সমর কি ভাবছিল কে জানে, অকস্মাৎ এক সময় সে হো হো করে হেসে উঠল। মায়া চলছিল পাশে পাশে, যদিও এখন আর হাতে হাত ধরা নয়। ভ্রূকুঞ্চিত করে সে তাকাল সঙ্গীর মুখের দিকে।

সমর কৌতুকের সুরে বলল, বড় বিচিত্র এই জগৎ, বুঝলেন, মিস দে? ওই ভদ্রমহিলাটিকে, আপনি হয়তো জানেন না, আমি একদিন ভালবেসেছিলাম। আর আমার বন্ধুটি ওকে আমার কাছ থেকে অপহরণ হ্যাঁ, অপহরণই করেছিল।

মায়া কোন জবাব দিল না। তবে তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, সে কি যেন একটা কৌতুক উপভোগ করছিল।

সমর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কি জবাব দিচ্ছেন না যে?

আমি ভাবছি।

ভাবছেন? কি?

এমন কিছু নয়—এই এলোমেলো!

সমর চটে উঠল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, এলোমেলো নয়। আমি জানি আপনি ভাবছেন, আমি কেন বন্ধুকে বাঁচিয়ে তুললুম। মেরে ফেলাটা অবশ্য কিছুই কঠিন ছিল না। মস্তিষ্কের মেডালায় ছোট্ট একটি খোঁচা আর তাতেই

আপনি সেটা করতে পারতেন না, ডাক্তার রায়।

পারতাম না? কিসে বুঝলেন?

মায়া হেসে ফেলল। আর ফেলেই মুখখানা ঘুরিয়ে নিল তার দিক থেকে।

এতে সমর আরো চটল। তীব্র কণ্ঠে বলল, হাসছেন কেন?

কই, না তো!

নিশ্চয়ই হাসছেন। হুঁ! কোন স্ত্রীলোকই সোজাসুজি কথা বলতে জানেন না। কিছু টিপে কিছু ঘুরিয়ে—আপনি কি বলতে চান লীলাকে আমি কোনদিন সত্যকার ভালবাসিনি?

না, না ডাক্তার রায়, এমন কথা আমি বলতেই পারি না। তবে—। একটু থেমে সে ভীরু কণ্ঠে বলল, তবে অজয়বাবুকেও তো আপনি ভালবাসেন?

সমর রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠল, বাসতুম। ওকে ভাবতুম, জগতের একমাত্র বন্ধু। কিন্তু সেসব অনেকদিন চুকে গেছে, মন থেকে মুছে ফেলেছি সব, বুঝলেন?

মায়া নিরীহের ভঙ্গিতে বলল, আপনি যখন বললেন, তখন মেনেই নিচ্ছি।

সমর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল, দাঁত কড়মড় করে বোধ করি দুনিয়ার স্ত্রীজাতটাকেই মনে মনে অভিসম্পাত দিল।

.

আরো দিন পনেরো কেটে গেছে। অজয় অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন সে বিছানায় উঠে বসে কথাবার্তাও বলে। সমর দিনে দুবার তাকে দেখতে আসে। অবশ্য একান্তভাবে চিকিৎসক হিসেবে। অজয় যদি কখনো ঘনিষ্ঠভাবে পুরনো দিনের প্রসঙ্গ তোলে, সমর ধীর শান্তভাবে বন্ধুকে কিছু বুঝতে না দিয়েই সে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়।

সেদিনও সে এসেছিল। খাটের ওপর বসে ছিল অজয়। মাথার গোড়ায় দাঁড়িয়ে লীলা। সে গম্ভীরভাবে বলল, আমার দেখতে আসার আর কোন দরকার নেই। ইচ্ছে হলে আপনারা ফিরে যেতে পারেন।

সে উঠে দাঁড়াল। অজয় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, লীলা, তুমি একটু পাশের ঘরে যাবে? আমি সমরকে গোটাকয়েক কথা বলব।

লীলা নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অজয় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, সমর, আয়, এখানে এসে বোস।

বিছানার পাশের চেয়ারটা সে আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল। সমর কিন্তু বসল না, দাঁড়িয়ে রইল। অজয় মৃদু হেসে বলল, এতখানি দুর্বল না হয়ে পড়লে ঘাড় ধরে তোকে ওখানে বসিয়ে দিতুম।

সমর কোন কথা না বলে পাশের চেয়ারখানায় এসে বসল। তার কাঁধে একখানা হাত রেখে অজয় গাঢ় কণ্ঠে বলল, আমি অপরাধী, তা জানি রে, সমর। তোর সঙ্গে ছল-চাতুরী করার কোন প্রয়োজন ছিল না, সোজসুজি তোকে খুলে বলতে পারতুম। কিন্তু বিশ্বাস কর, তুই যে লীলাকে ভালবাসিস, আমি আগে তা জানতুম না। পারবি বিশ্বাস করতে?

সমর কোন জবাব দিল না। বুকের ভেতর একটা বাষ্প যেন তার ঠেলে ঠেলে উঠতে চাইল।

অজয় বলে চলল, লীলাকে আমি ভালবেসেছিলুম-পাগলের মত ভালবেসেছিলুম। আর কোন দিকে তাকাবার ফুরসৎ পাইনি। যদি ঘুণাক্ষরেও জানতুম তুই তাকে চাস, তাহলে তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করার আগে নিজের জিভটা উপড়ে ফেলতুম।

সমর কি যেন ভাবছিল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমি জানি, অজয়—অন্তত বোঝা উচিত ছিল।

অজয় বন্ধুর একখানা হাত চেপে ধরে উৎসাহ ভরে বলে উঠল, বল তাহলে, আজও আমরা সেই বন্ধুই আছি—যেমন আগে ছিলাম?

সমর বন্ধুর দিকে ফিরে তাকাল। তখন আর তার সেই অন্যমনস্কতাটা নেই। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছিল অমলিন হাসি। অজয়ের একখানা হাত চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিত বলল, ভুল আমিই করেছি রে। কিন্তু উনি করেননি, ঠিকই বুঝেছিল।

উনি? মানে লীলা?

সমর শুধু আর-একদফা হাসল। মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কবে নাগাদ যেতে চাস তাহলে?

তোদের ওপরই তো সেটা নির্ভর করছে। তোর আর লীলার।

তাহলে ওঁর ওপরই ছেড়ে দে। আচ্ছা— উঠে দাঁড়াল সমর।

অজয় ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলে, তুই কি এখানেই থাকতে চাস?

হ্যাঁ। আচ্ছা, আজ চলি। আর দেরি করব না, হঠাৎ এক জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেল। যাবার জন্যে সে পা বাড়াল।

অজয় ডাকল, সমর, শোন—

সমর ফিরে তাকাল। অজয় মিনতি করুণ কণ্ঠে বলল, লীলুর সঙ্গে বোঝাপড়াটা শেষ করে নিবি না? ওকে ভালবাসাটা যে কি, সেটা আমি বুঝি রে! যদি বিদায় নিতে গিয়ে একবার ওকে বুকেও টেনে নিস, আমি কিছু মনে করব না।

বা! স্বামী হিসেবে আদর্শ তুই? হা হা করে হেসে উঠল সমর। পরক্ষণে হেঁট হয়ে চুপি চুপি বন্ধুর কানে কানে বলল, আমি আর একজনকে বুকে টেনে নিতে চাইরে! যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভাল। এখন যাচ্ছি, আবার বিকেলে দেখা হবে।

ঘূর্ণী হাওয়ার মতই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর অজয় তাকিয়ে রইল বন্ধুর গমনপথের দিকে।

.

এ কটা দিন মায়া অনেক ব্যথাই পেয়েছে। অকারণেই যেন সমর বার বার রূঢ় হয়ে উঠেছে তার ওপর। আর বুঝি সে সহ্য করতে পারে না। তাই মনে মনে সে স্থির করেছিল ভাগ্যের পাশা নিয়ে শেষবারের মত সে খেলতে বসবে। যদি দান দিতে ভুল হয়, জীবনে আশা করার মত আর কিছু থাকবে না। কিন্তু যদি সে ভুল না করে

সমর এসে ঘরে ঢুকল। দেখল মায়ার জিনিসপত্র সব বাঁধাছাঁদা। বড় সুটকেসটার ওপর সে বসে।

ধীর পায়ে মায়া উঠে দাঁড়াল। কিছু একটা হয়তো সে বলতে গেল, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা ফুটল। শুধু ঠোঁট দুটো বারকয়েক কেঁপে উঠল।

অসহ্য বিস্ময়ে সমর বলে উঠল, কি ব্যাপার? হঠাৎ

আমি চলে যাচ্ছি, ডাক্তার রায়।

চলে যাচ্ছেন? সমরের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল,কেন? কোথায়?

হাতব্যাগটা তুলে নিতে নিতে মায়া ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল, শহরে। এক বন্ধু চিঠি লিখেছে। হয়তো হাসপাতালে চাকরিটা পতে পারি।

কথাশেষে একখানা খাম সে সমরের দিকে বাড়িয়ে ধরল।

খামে লেখা নামটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে, সমর সেখানা প্রায় ছিনিয়ে নিল মায়ার হাত থেকে। তারপর সেখানা পকেটে ভরতে ভরতে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ভগবানকে ধন্যবাদ দিন যে, চিঠি যিনি লিখেছেন, তিনি আপনারই মত একটি মেয়ে—পুরুষ নন। আসুন না এদিকে

মায়া ধীর পদে এগিয়ে এল। মুখোমুখি দাঁড়াল দুজনে। যেন এখুনি একটা কলহের ঝড় উঠবে। মায়ার চোখে উদ্ধত দৃষ্টি।

দেখেও ভ্রূক্ষেপ করল না সমর। কৈফিয়ৎ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমায় বেঁধে দেবে কে, খাওয়াবে কে, সেবা যত্ন করবে কে?

মায়া ঢোক গিলল। সমরের যে দৃষ্টিতে ছিল বজ্রগর্ভ বিদ্যুৎ, তাতেই ফুটে উঠল হাসির রূপালি রেখা। তার প্রতিক্রিয়া বুঝি দেখা দিল মায়ার মুখেও। সে হেসে ফেলল।

সমর অকস্মাৎ দুহাত বাড়িয়ে তাকে শুন্যে তুলে নিল, তারপর মুখখানা নামিয়ে আনল নিজের মুখের ওপর। অস্ফুট কণ্ঠে বলতে লাগল বারবার, চলে যাবে? যাও তো!

মায়ার একখানা হাত স্বতঃই উঠে এসে সময়ের কণ্ঠ বেষ্টন করল।

সমর তাকে নিয়ে কি ভাবে যে আদর করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার বুকে মুখ গুঁজে ছেলেমানুষের মত বলে চলল, লীলাকে আমি সত্যিকার ভাল কোনদিনই বাসিনি-আমার সব ভালবাসা ছিল অজয়ের ওপর, তাই আমি ভুল বুঝে তার ওপর রাগ করেছিলুম, ভেবেছিলুম ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই আমার মন ভেঙে গিয়েছিল।

বিচিত্র এক মোহময় আনন্দে মায়ার সর্বাঙ্গ যেন অবশ হয়ে আসছিল। কাঁপা গলায় সে বলল, কিন্তু তোমাদের মধ্যে আমার ঠাঁই কোথায়?

তোমার ঠাঁই এই অন্তরে—যেখানে তুমি একমাত্র সম্রাজ্ঞী।

আর একবার সে তার মুখখানা নামিয়ে আনল মায়ার মুখের ওপর। ঠিক সেই সময় বাইরের কড়া নড়ে উঠল। ভেসে এল পাণ্ডে সাহেবের গলা : ডাংদার সাব!

মায়াকে বাহুবেষ্টনে বেঁধেই সমর ছুটতে ছুটতে গিয়ে পেছনের ঘরে ঢুকল।

সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন পাণ্ডে। বললেন, একটা মেটারনিটি কেস

কিন্তু ঘরে কাউকে না দেখে মাঝপথেই তিনি থেমে গেলেন। একজন দেহাতী লোক সঙ্কুচিত পায়ে তাঁর পেছনে পেছনে ঘরে এসে দাঁড়াল।

সমর তখন পেছনের ঘরে মায়ার কানে বলছে, তোমাকে যে ভালবাসি, সেটা টের পেয়েছিলুম কবে জান, মায়া? যেদিন কলকাতায় নিজের চেম্বারে ফিরে এসে তোমাকে দেখেছিলুম ঠিক এমনিভাবেই নিজের সুটকেসের ওপর চুপচাপ বসে থাকতে।

কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে পাণ্ডে তখন দেহাতী লোকটিকে বলছেন, আশ্চর্য! পাঁচ মিনিটও হয়নি, ডাংদার সাবকে আমি কোঠিতে ঢুকতে দেখিয়েসি—। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে তিনি এবার উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন, ডাংদার সাব।

হয়তো ভেতরের ঘরের দিকেই এগিয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু মেঝেয় পড়ে থাকা সুটকেসটায় হোঁচট খেলেন।

সমর তখন মায়ার হাত ধরে টানতে টানতে পেছনের দরজা দিয়ে একফালি বারান্দাটায় এসে পড়েছে। একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে মায়াকে সে বললে, তোমাকে বলতেই হবে– বল আমাকে কখন ভালবেসেছিলে?

মায়া সলজ্জ জবাব দিল, যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলুম, সেই হাসপাতালে।

মুখ দিয়ে একটা শীৎকার ধ্বনি করেই সমর তাকে বুকে টেনে নিল। আবার মুখের ওপর মুখ।

দূর থেকে তখন পাণ্ডের ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে আসছে : ডাংদার সাব! কোথায় আপনারা?

চোখ বন্ধ করে সমর ধ্যানমগ্নের মতই দাঁড়িয়ে ছিল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, স্বর্গে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *