৬. কয়েক দিনের মধ্যে নারায়ণও

কয়েক দিনের মধ্যে নারায়ণও শ্রীমতী কাফের প্রাত্যহিক শরিক হয়ে উঠলেন। অবশ্যই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত। যতক্ষণ তাঁর সরকারি অনুমতি আছে। তাঁকে কেন্দ্র করে শ্রীমতী কাফের আসরের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রিয়নারের সঙ্গে কৃপালদের যে বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছিল কিছুদিন থেকে, সেটা একটা চরম আকার ধারণ করল। প্রায় প্রত্যহই একই তর্কের অবতারণা হয়। এমনকী দু-চারজন প্রবীণ কংগ্রেস কর্মীরাও যাতায়াত আরম্ভ করলেন নারায়ণের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কেন না, নারায়ণ বয়সে তাঁদের চেয়ে নবীন হলেও কাজের বেলায় প্রবীণ। এ অঞ্চলে স্বদেশী আন্দোলনের গোড়াপত্তন নারায়ণের দ্বারাই হয়েছে বলা চলে। অথচ, নারায়ণ পথ পরিবর্তন করে আজকে এমন একটা মোড় নিয়েছে, যে আদর্শকে গ্রহণ করেছে, তা প্রকৃতপক্ষে গান্ধীজির পথের ও মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রিয়নাথকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু নারায়ণও সেই আদর্শেই বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। দেশবন্ধু যেভাবে শ্রমিকদের কথা বলতে চেয়েছিলেন, তার মূলে ছিল একটা স্বাভাবিক উদারতাবাদ। অর্থাৎ শ্রমিক-মঙ্গলের জন্য মালিকদের বলা। কিন্তু প্রিয়নাথের বক্তব্য অনুযায়ী শ্রমিক বিপ্লবটা শুধু অহিংস নয়, অনেকের কাছে ব্যাপারটা কিছু দুর্বোধ্য ও ভয়ঙ্কর।

কিন্তু এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। প্রিয়নাথের সঙ্গেও নারায়ণের বিরোধ দেখা দিয়েছে। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পথে সন্ত্রাবাদ কীসে অন্তরায় সেইটার বোৰাপড় নিয়ে তাদের মধ্যে গণ্ডগোল। অথচ প্রিয়নাথ সশস্ত্র বিদ্রোহকে অস্বীকার করতে চায় না। কিন্তু ওদের এ বিরোধটা প্রকাশ্য ছিল না। আলোচনা তাদের নিজেদের কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

আজকে সকালবেলা এ ব্যাপারটাও অমে দাঁড়াল। নারায়ণ, প্রিয়নাথ, রথীন আর সুনির্মল পিছনের ঘরে তাদের বৈঠক বসিয়েছে। চরণকে নিয়ে ভজন গিয়েছে বাজারে।

হীরেন বসে আছে বাইরে। সে জানে পিছনের ঘরে বৈঠক বসিয়েছেন নারায়ণ। একদিন নারায়ণকে কেন্দ্র করেই সে দেশোদ্ধারের নেশায় পাগল হয়েছিল। সেদিন নারায়ণের কথায় প্রাণ দেওয়া কিছু অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আজ, মতাদর্শের বিরোধে সে সম্পর্ক শুধু স্তিমিত হয়নি, তাদের আলোচনায় যোগদানের অধিকারও তার নেই। সেজন্য তার প্রাণে একটা বেদনা ছিল। তার মতো কৃপালও একদিন এইভাবেই রাজনীতির মধ্যে ঢুকেছিল। কিন্তু কৃপাল আজ নারায়ণকে শুধু বিদ্রূপ করে না, আক্রমণ পর্যন্ত করে। কিন্তু হীরেনের এমন মতিভ্রম হয়নি। তার বিশ্বাস নেই, কিন্তু সে শ্রদ্ধা করে তাঁর সাহসকে। সমীহ করে নারায়ণকে। প্রশংসা করে সহিষ্ণুতাকে।

ছোকরা পুলিশ অফিসারটি তার স্টেশন এলাকা ছেড়ে কোথাও এক পা নড়তে ভুলে গিয়েছে। তার বিশ্বাস, শ্রীমতী কাফের ভিতরে একটা ভীষণ গুপ্ত ষড়যন্ত্রের মহড়া চলছে দিনরাত। যত দিন নারায়ণ আসেননি, ততদিন তার এতটা ভয় ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি প্রায় অনুক্ষণই শ্রীমতী কাফেতে বিপ্লবীদের আড্ডা বসতে আরম্ভ করেছে। একটা কোনও গণ্ডগোল ঘটলে কর্তৃপক্ষের কাছে তাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। স্থানীয় গুপ্তচরেরা এমন কোনও সংবাদ সরবরাহ করতে পারেনি, যার ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ একটা সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। কিন্তু সেকথা বিশ্বাস করে না সে। প্রায় প্রত্যহই হাতে লেখা ইস্তাহার দেওয়ালে গাছে দেখা যাচ্ছে এবং সেগুলো রীতিমতো ভীতিজনক। তার নিয়মিত গানের মজলিশ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেমন একটা প্রাণের ভয় দেখা দিয়েছে তার। থানা পাহারা দেওয়ার কায়দা পর্যন্ত বদলে দিয়েছে সে। কয়েকদিন আগে একজন সেপাইকে ফাইন করেছে তার অসতর্ক প্রহরার জন্য।

মাঝের ঘরে সকলেই চুপচাপ বসে আছে। যেন ঝড়ের পূর্ব মুহূর্তের একটা গুমোট ভাব। প্রিয়নাথের কোলের উপর একটা ভোলা বই। দুটো ছবি দেখা যাচ্ছে বইটার পাতায়। একটা চক্রধারী নারায়ণ, আর একটা দাড়িওয়ালা মুখ। সে মুখের মাথায় বড় বড় উসকো-খুসকো চুল, খানিকটা সাধু-সন্তদের মতো। অথচ গায়ে কোট। নারায়ণের মতো এ মুখ হাসিদীপ্ত নয়। এ মুখ গম্ভীর, যেন কোনও ভাবনার ঘোরে ড়ুবে রয়েছেন। চোখের দৃষ্টি গভীর। নীচে লেখা রয়েছে আমি কার্ল মার্ক্স।

কিছুক্ষণ আগে বইটা পড়া হয়েছে। নারায়ণ বললেন, প্রিয়নাথ, সাসবাদ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ জানি না। কিন্তু, এর সঙ্গে আমাদের মতের বিরোধ কোথায়?

প্রিয়নাথ অবাক হয়ে বলল, আমাদের সমিতিগুলোর আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক বিবের কোনও মিল আছে তুমি বলতে চাও? শ্রমিক অ্যুখান সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।

আবার সেই একই দুর্বোধ্যতা দেখা দিল। রথীনের চোখে ফুটে উঠল ক্রোধ। নারানাকে বোঝাবার ক্ষমতা যে প্রিয়নাথের নেই এবং ব্যাপারটা যে অবাস্তব, তাই ভেবেই তার রাগ হচ্ছে।

নারায়ণ বললেন, একটু বুঝিয়ে বলো ভাই।

প্রিয়নাথ বলল, শিবহীন যজ্ঞ হতে পারে না। শ্রমিক বিপ্লব যদি করতে চাও, তবে শ্রমিকদের তুমি বাদ দিতে পারো না।

নারায়ণ বললেন, বাদ দিতে তো চাইনে। শ্রমিকদেরও নিয়ে এসে আমাদের সমিতিতে টেনে। তাদেরও আমরা অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত করব।

প্রিয়নাথ বিস্মিত হয়ে বলল, সবাইকে?

সবাই কি লড়াই করবে?

নিশ্চয়ই। সমস্ত শ্রমিকই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করবে।

এবার নারায়ণেঅবাক হওয়ার পালা। বললেন, তা হলে দেশের সবাইকেই যে বিপ্লবী হতে হয় প্রিয়নাথ। আমার বিশ্বাস আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকরা আপনিই সরকারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবে। তারা এসে আমাদের সঙ্গী হবে।

তা হয় না নারায়ণ। বলতে পারো, তারা কেন এসে আমাদের সঙ্গী হবে? আমরা যদি তাদের জীবনের সঙ্গী না হই–

রথীন বাধা দিয়ে বলে উঠল, ইয়ার্ড ম্যানেজারকে খুন করলেই তো শ্রমিকদের হয়ে আমরা শোধ নিতে পারি।

প্রিয়নাথ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠল। রথীনের ঔদ্ধত্য তার আর সহ্য হচ্ছিল না। বলল, ইয়ার্ড ম্যানেজার হয়ে কি আর একজন সাহেব আসতে পারবে না?

রথীন দৃঢ় গলায় বলল, ব্যাপারটা সেখানেই শেষ নয়। তারপরে খোলাখুলি পুলিশ মিলিটারির আক্রমণের কথাটা ভেবে দেখো। তখন? তখন তুমি আবার আত্মগোপন করবে। তাতে শ্রমিক বিপ্লবটা কি হল?

নারায়ণ বললেন, প্রিয়নাথ, চটিসনে ভাই। তুই যেরকম বলছিস, তাতে মনে হচ্ছে আপাতত আমাদের সমিতি-টমিতি তুলে দিয়ে, ইয়ার্ডে গিয়ে শ্রমিকদের ডেকে সত্যাগ্রহ করতে হবে। তাই নয় কি?

প্রিয়নাথ বলল, তা মোটেই নয়। তবে শ্রমিকদের বিপ্লব বোঝাতে হবে।

নারায়ণ হতাশ হয়ে চুপ করে রইলেন। বিপ্লব বোঝনোটা তাঁর কাছে পরিষ্কার নয়। অথচ প্রিয়নাথের কথা সরাসরি উড়িয়ে দিতে কোথায় যেন বাধছে। বললেন, কী করে বোঝাবে?

প্রিয়নাথ খানিকটা চুপ করে থেকে বলল, আমার মনে হয়, তাদের সঙ্গে মিশে, তাদের সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

নারায়ণ হঠাৎ বললেন, তোমার সঙ্গে কি পার্টির যোগাযোগ আছে? প্রিয়নাথ তেমনি উত্তেজিত গলায় বলল, না। তা যদি হতে পারত, তা হলে তোমাকে আমি আরও পরিষ্কার করে বোঝাতে পারতুম মনে হয়। আমি আরও জানবার, বোঝবার অপেক্ষাতেই আছি।

তবে এসব কথা তুমি কী করে বলছ?

বলছি, যতটা জানছি ততটা আর আমার ধারণা থেকে।

নারায়ণ দেখলেন, প্রিয়নাথ ছটফট করছে। সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেটা রাগ নয়। তার বিশ্বাসকে সে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না বলে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাই কষ্ট হচ্ছে। তিনি প্রিয়নাথের একটি হাত টেনে নিয়ে বললেন, আমি ভাই তোর কথা বুঝতে পারলুম না। তবু, আমি স্বীকার করি, শ্রমিক বিপ্লবই আমার লক্ষ্য। আমরা সকলেই আসল পথটা জানবার চেষ্টা করব। সোস্যালিজম-ই আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই কিন্তু সমিতি আর তার সমূহ কাজগুলোকে বাদ দিয়ে নয়। তাকে আমরা বিশ্বাস করি কিন্তু, এ সময়ে সমিতিতে তোর ঠাঁই না হওয়াই উচিত। মতের টানাপোড়েনে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। রাগ করিসনে যেন।

মনে হল প্রিয়নাথের মুখে যেন কে কালি ঢেলে দিয়েছে। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পারল না। নারায়ণের কাছ থেকে তার এতখানি মর্মান্তিক নির্দেশ সে আশা করেনি। এমনিতেই কিছুদিন থেকে তার মনের অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিল। তার আর্থিক অবস্থা বর্তমানে চরমে পৌঁছেছে। বাড়িতে ঢোকা তার পক্ষে রীতিমতো অপমানকর। দরখাস্ত অনেকবার করেও সরকার কোনও প্রকার ভাতা দিতে রাজি হয়নি। সন্তোষ মাসিমা বলে এক মহিলা তাকে মাঝে মাঝে সাহায্য করে থাকেন। এমনকী হীরেনও।

এইসব নানান ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়তম বন্ধু নারায়ণের কাছ থেকে একথা শুনে তার মুখে প্রথমে কোনও কথাই সরল না। শুধু তাই নয়, তার মতো বলিষ্ঠ প্রকৃতির পুরুষ চোখের জল রোধ করতে পারল না। সে উঠে যাওয়ার মুখে নারায়ণ খপ করে তার একটা হাত টেনে ধরলেন। তিনিও বুঝতে পারছিলেন, কত বড় কথা তিনি বলেছেন। এই সমিতি গড়তে প্রিয়নাথও কম চেষ্টা করেনি। সমিতির ছেলেরা প্রিয়নাথকেও কম ভালবাসে না কিন্তু তাঁর আশঙ্কা হচ্ছে, প্রিয়নাথের জন্য সমিতির মনে সংশয় দেখা দেবে, দোদুল্যমানতা দেখা দেবে।

প্রিয়নাথের চোখে জল দেখে নারায়ণের বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল। কিন্তু সমিতির ব্যাপারে দুর্বলতা প্রকাশ করা মৃত্যুর সামিল। সেখানে নরম হাওয়া চলে না। বললেন, কোথায় যাচ্ছিস প্রিয়, বস। আমার কথাটা একবার ভেবে দেখ ভাই।

প্রিয়নাথ দেখল রথীনের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। মুহূর্তে মাথা নাড়া দিয়ে দাঁড়াল সে। চোখের জলের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সে বলল নারায়ণকে, নারায়ণ আজ আমাদের রাগের দিন নয় আলোচনার দিন ছিল। তাই বলছি, সমিতির এ আদর্শ নিয়ে আমাদের পা বেশিদূর যেতে পারে না। দেশের বৃহত্তম শ্রমজীবী জনসাধারণই আমাদের সমিতি। আমার কিস তাদের পরেই। শ্রমিক বিপ্লব যদি তুমি চাও, তোমাকে একদিন আমার কথা বিশাস করতে হবে।

বলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে প্রিয়নাথ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

নারায়ণ শুধু বলে উঠলেন, বিশ্বাস করি ভাই…বিশ্বাস করি… বলতে করতে থেমে গেলেন। যেন খানিকটা অবাক বিস্ময়ে তিনি শুন্যে তাকিয়ে রইলেন। সকলেই চুপচাপ। তারপরে হঠাৎ তিনি আপন মনে ফিসফিস করে বললেন, জনসাধারণই সমিতি। অদ্ভুত কথা বলেহে প্রিয়নাথ। ওর কথায় যেন কোথায় চরম সত্য লুকিয়ে রয়েছে।

রথীনের দিকে ফিরে বললে, রথী, তুমি পরশু বলছিলে, প্রিয়নাথ বুঝি ভয় পেয়েছে। তা নয়। ওর মতো সাহসী আমাদের সারা জেলার মধ্যে কেউ ছিল না, আজও আছে কিনা জানি না। ওকে শত্রু ভেবো না। আজকে শুধু কথায় বলছি শ্রমিক বিপ্লব, আমার বিশ্বাস একদিন হয়তো, প্রিয়নাথকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে!

.

এই একই ব্যাপার নিয়ে নারায়ণের সঙ্গে কৃপালদের প্রায় প্রত্যহ বিতর্ক। তাদের কাছেও সে শ্রমিক বিপ্লবের কথা বলেছে। মুখে সে প্রিয়নাথকে যাই বলুক তার একটা অখণ্ড বিশ্বাস আছে। আজকের সন্ধ্যাবেলার আসরে ঘটনার একটা অভিনবত্ব দেখা গেল।

প্রৌঢ়বয়স্ক শঙ্কর ঘোষ এসেছেন। ইনি মহকুমা কংগ্রেস কমিটির সভ্য। পর পর কয়েকদিনই ইনি আসছেন। বোধ হয় তাঁর একটা বিশ্বাস আছে, নারায়ণকে তিনি স্বমতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি একদিনও রথীনের মতো উগ্রদের সঙ্গে কথা বলেননি। এমনকী প্রিয়নাথের সঙ্গেও নয়।

বিকালের আসর বসেছে তেমনি। তবে অস্বীকার করা যায় না, খদ্দেরের সংখ্যা খুবই কম। এ আসরে আশ্চর্যরকম ভাবে জমিয়ে নিয়েছেন গোলক চাটুজ্যে মশাই। যখন সবাই রাজনীতির বাকবিতণ্ডা ছেড়ে একটু হাঁফ ছাড়বার জন্য মুখ ফিরিয়ে বসে, তখনই চাটুজ্যেমশাই যেন বিচলিত শিশুর কাছে রূপকথার ঝাঁপিটি পেড়ে বসেন, তারপর জানলে ভায়া।…

চরণ মাঝে মাঝে বলে ফেলে ভজনকে, দোকানটা বসে যাবার গতিক দেখছি। ভজন অমনি তাকে খ্যাঁক করে ওঠে, এ হারামজাদার দেখছি মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। তোর দু বেলার পিণ্ডিতে কম পড়েছে র‍্যা? পড়েনি ঠিকই। আর চরণ এদের ভালও বাসে। কিন্তু…। হ্যাঁ সে কিন্তু আছে ভজনের মনেও। মনে মনে দায়িত্ববোধকে উসকে তুলতে গিয়েও হেসে বলে নিজে নিজে, আমি বুঝি ওদের প্রেমে পড়েছি। সর্বনাশ হলেও কী আশ্চর্য, আমি বোধ হয় ওদের ছাড়া বাঁচব না। তার মত, পথ ও বিশ্বাসহীনতার মতো এ প্রশ্রয় দানেরও যেন কোনও ভিত্তি ছিল না। অথচ ভজনের ব্যক্তিত্ব নেই, এমন কথাও বলা চলে না। এখানকার সকলের সঙ্গে নারায়ণ পর্যন্ত জানেন, সময় হলে ভজনের একটিবার অঙ্গুলিসঙ্কেতে সবাইকে সুড়সুড় করে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ভজন এদের কটু কথা বলে, গালাগালও দেয়, তবু তাড়িয়ে দেয় না। আর এও বড় অদ্ভুত, এ-সব কথা সে যত ভাবে তত তার নেশা বেড়ে যায়।

শঙ্কর ঘোষ বললেন, যাই বলল নারায়ণ, যুক্তি তোমার কাঁচা ভাই।

বোঝা গেল তর্কটা আজ অনেকক্ষণ থেকেই জমেছে। কিন্তু আজকের মতো নারায়ণ যুক্তি তুলে নিয়ে দৃঢ়তা দেখাবার পদ্ধতি কোনও দিন নেননি। বললেন, শঙ্করদা, যুক্তি কি সব সময়েই বড়?

শঙ্কর হাসলেন। বললেন, তুমিই বলেছ, বিনা যুক্তিতে কোনও কথা প্রমাণ করা যায় না। যুক্তি তো তোমার কাছেই বড়।

এ আসরে প্রিয়নাথ আসতে ভুল করেনি। সে অত্যন্ত উৎসুক মুখে নারায়ণের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন নারায়ণের মুখে কোনও কথা আটকে গেলে সে জুগিয়ে দেবে। নারায়ণ বললেন, শঙ্করদা, যা সত্য, তার যুক্তি সব সময়েই আছে। সে যুক্তি তো সকলে দেখাতে পারে না। মিছে বলব না। আমার যুক্তি আমি দেখাতে পারলুম না। কিন্তু শ্রমিকদের উপর আমার বিশ্বাস কেউ টলাতে পারবে না। জগতে ঋতু বদলায়, কেন তা সবাই কি বলতে পারে?

শঙ্কর বললেন, তুমি যদি বলতে না পারে, তবে তোমার বিশ্বাসের কি মূল্য আছে নারায়ণ।

আপাতত মূল্য নেই। কিন্তু শ্রমিকরা যেদিন সচেতন হয়ে উঠবে, সেদিন তারা চাইবে নাগপাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে।

কৃপাল হেসে উঠে বলল, নাগপাশ কীসের, স্বরাজ এলে কি তারাও মুক্ত হবে না?

উত্তর দিল প্রিয়নাথ, স্বরাজ করতে হলে আপসের পথ ধরলে হয় না। শ্রমিক চায় তার শ্রেণীর মুক্তি। কথাটা শুনে নারায়ণের চোখের সামনে একটা আলোর রেখা ঝকঝক করে উঠল। শ্রেণীর মুক্তি! হঠাৎ একটা অর্থহীন কথা শুনেছেন বলে মনে হল। অথচ অর্থময়। একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কথা।

শঙ্কর আবার হেসে উঠে বললেন, বুঝেছি তোমাদের কথা। একটা বালুচরে তোমরা দাঁড়িয়ে আছ। একটা রক্তের নেশা তোমাদের পাগল করেছে। এই রক্তপাতের ভয়ে গান্ধীজি বারবার উৎকণ্ঠিত। একদল অশিক্ষিত বুদ্ধিহীনদের খেপামিটাকে তুমি মস্ত বড় মনে করেছ। যার পরিণতি একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছাড়া আর কিছুই নয়।

নারায়ণ হঠাৎ তাঁর স্বমূর্তিতে জ্বলে উঠলেন। তাঁর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল একটা বিজাতীয় ঘৃণার আগুন। সে মুখ দেখলে আজকেও অনেকের বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। বললেন, ইংরেজ সরকারকে আপনারা যতই বোঝাতে চান, সে অবলীলাক্রমে রক্তপাত চালিয়ে যাবে। সে কি আপনিও ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন শঙ্করদা? না পেরেছেন কোনও দিন। সেই রক্ত-খেগো বাঘটাকে শায়েস্তা করতে হলে, বল্লম দিয়ে তাকে এ-ফোঁড় ওফোঁড় না করলে তার মৃত্যু নেই।

হীরেন যেন শিউরে উঠল। সে মাথা তুলল কিন্তু বলতে পারল না। অবশ্য শঙ্করদার বক্তব্যও তার ঠিক মনে হচ্ছে না। তিনি ঠিক বোঝাতে পারছেন না। জাতি তার নিজস্ব চারিত্রিক অনাচার থেকে যতক্ষণ মুক্ত শুদ্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ এই তর্ক আসে কী করে।

কিন্তু ঠিক সময়েই কয়েকজন লোক এসে শ্রীমতী কাফের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এ আবহাওয়ার তুলনায় এদের লোক আখ্যা দেওয়াও যেন মুশকিল। সকলেই বিস্মিত হয়ে প্রথমে মনে করল একদল ধাঙড় এসেছে বোধহয় হীরেনের সঙ্গে দেখা করতে।

কিন্তু এরা ঠিক ধাঙড় নয়। তুলনায় আর একটু সপ্রতিভ মনে হল। কালো কালো মুখগুলোতে শ্রদ্ধা লজ্জা ভয়, সব কিছু মিশিয়ে বড় অদ্ভুত হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন বারান্দায় উঠে এসে নারায়ণের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল।

প্রিয়নাথের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রথীন তাড়াতাড়ি নারায়ণকে বলল, এরা এখানকার চটকলের মজুর! এ দুজন গত বছর জেল খেটে এসেছে, মনোহর আর ভাগন। আপনার সঙ্গে ওরা দেখা করতে চেয়েছিল নারানদা।

নারায়ণ শশব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন, আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

ব্যাপারটাতে শঙ্কর ও কৃপালরা না হেসে পারল না। বিশেষ নারায়ণের অভ্যর্থনা দেখে তাদের মনে হল, ব্যাপারটা একটা ঠাট্টা হচ্ছে।

নারায়ণ হিন্দি বলতে পারেন না। কিন্তু মনোহর আর ভাগন বাংলা কথা বুঝেছে। বুঝেও তারা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। বোধহয় এতখানি ভদ্র আহ্বানের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। যদিও বা পা বাড়ানো যেত শঙ্কর কৃপালের মুখে উকট নীরব হাসি দেখে তারা কেমন ঘাবড়ে গেল।

এতক্ষণে ভজন মাথা তুলে তাকাল। বারান্দার মূর্তিগুলো দেখে প্রথমটা সে কিছুই বুঝতে পারল না। কোঁচকানো ভ্রূর তলা থেকে সে তার রক্তচোখ মেলে জিজ্ঞেস করল, কী চাই বাবা?

এতক্ষণ মনোহর আর ভাগন বিব্রত মুখে খানিকটা বোকাটে হাসি হাসছিল। এবার ভয় পেয়ে গেল। কী বলবে, ভেবে পেল না।

নারায়ণ তাড়াতাড়ি বললেন, এরা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ভজন। এরা মজুর।

ভজন হা হা করে হেসে উঠল। বলল, একেবারে শ্রীমতী কাফেতে এসেছ বাবা। এসো আর দাঁড়িয়ে কেন? খোদ কর্তার হুকুম হয়ে গিয়েছে।

বলে সে নিজেই এগিয়ে গিয়ে মনোহরের হাত ধরল। মনোহর ও ভাগনের মুখে ভয় মিশ্রিত হাসি। তারা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ভজুলাটবাবুকে তারাও খানিকটা চেনে। কিন্তু সেই চেনাটাই সব নয়। একে বাবু, তায় মাতাল। বিশ্বাস আছে কিছু?

রথীন বলে উঠল, ভেতর এসো ভাগন।

মনোহর আর ভাগন এবার একটু বোধ হয় ভরসা পেয়ে ভেতরে ঢুকে নারায়ণের চেয়ারের কাছেই মাটিতে বসতে যাচ্ছিল। ভজন দুজনেরই হাত ধরে বলল, উঁ হুঁহুঁ, করো কী। তোমাদের আজ নীচে আসন দিলে শ্রীমতী কাফের ইজ্জত ঢিলে হয়ে যাবে যে বাবা। কুরশিতে বসো।

কথাটা শুনে কৃপাল আর তার অট্টহাসি চাপতে পারল না। সকলে ভাবল, ভজন এটা একটা নেহাত ক্যারিকেচার করছে।

কিন্তু ভজন খ্যাঁক করে উঠল কৃপালকে, থাক, আর দাঁত বার করে হাসতে হবে না। আমার কাছে স্বদেশীওয়ালার কোনও জাত নেই। ভুনু গাড়োয়ান আমার সারথী, বাঙালি আমার ইয়ার, আর এ জেলখাটা স্বদেশীওয়ালাদের আমি মাটিতে বসাব?

বলে মজুর দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে তোমরা আমার অতিথি। কুরশিতে না বসলে চলবে না। মনোহর হাত জোড় করে হেসে বলল, বাবু কুরশিমে বৈঠনা হমলোগ নাহি জানতা।

তা হলে আজ জানতে হবে বাবা। বলে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিল তাদের দুটো চেয়ারে।

প্রিয়নাথ নারায়ণ কেউই এ বিষয়ে ভজনের সততার মাপকাঠিটা ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না। কিন্তু বোঝা গেল, চেয়ারে না বসলেও ভজন ছাড়বে না।

অগত্যা মনোহর আর নারায়ণ বসল। বসল চেয়ারে পাছাটা কোনও রকমে ঠেকিয়ে, গা হাত পা সিঁটিয়ে, শক্ত করে। লজ্জায় ও সংশয় ভরা মনে। যেন এত বড় বিড়ম্বনা তাদের জীবনে আর কোনও দিন ঘটেনি।

তাদের সঙ্গে যে কয়েকজন মজুর এসেছিল তারা বাইরে দোকানের কোণে দাঁড়িয়ে এ অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখছিল। এতক্ষণ তাদের মুখেও একটা ভয়ের ভাব ছিল সঙ্গী দুইজনের জন্য। এবার খুব ধীরে ধীরে তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। পরস্পরের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চোখের ইশারায় নিজেদের মধ্যে এক দফা বোঝাপড়া করে নিল তারা। তারা গর্বিত তাদের সঙ্গীদের সম্মানে।

শুধু তাই নয়, একজন দুজন করে লোক জমতে আরম্ভ করেহে আশপাশের দোকানি, গাড়োয়ান, রেলের কুলি। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা মজার কাণ্ড কিছু ঘটছে, এ-বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ ছিল না। বিশেষ ভজুলাট যখন এখানে রয়েছে।

বিকালের আসরে শ্রীমতী কাফে যেন একটা বিচিত্র নাট্যের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। আর রাস্তায় ভিড় করছে দর্শকেরা।

নারায়ণ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছেন। হয়তো বেচারাদের নিয়ে সমস্তটাই একটা নিষ্ঠুর প্রহসন হয়ে যাবে। প্রিয়নাথের অস্বস্তি হচ্ছে। এ মানুষগুলো কবে মাথা তুলে বসতে পারবে দশজনের সভায়।

শঙ্কর ভাবছিলেন, স্বরাজের আন্দোলনকে নিয়ে একটা শস্তা খেলার আসর জমেছে। হীরেন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে আছে মজুর দুজনের দিকে। সেই নিরন্ন ভারতবাসী যারা অভাবে আর অনাচারে আজ কারখানার পশু বনেছে। এদেরই একদিন আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ফসলের খেতে, অনাচার থেকে মুক্ত করে নিস্পাপ ধার্মিক করে তুলতে হবে এদের।

সকলের এ স্তব্ধতার মাঝখানে ভজন হাঁক ছিল, চরোণ।

আজ্ঞে। চরণ এসে দাঁড়াল গোমরা মুখে। যেন সে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছে হুকুমের কথাটা।

এদের চা দে। বলে আবার ফিরে বলল, চপ দে, কাটলেট দে।

ভাগন একটু বয়স্ক। সে ব্ৰস্তে একবার মনোহরের দিকে দেখে বলল, মাফ কিজিয়ে বাবুজি, উসব চিজ খানা হমলোগকা মানা হ্যায়।

কৃপাল বলে ফেলল, হিন্দু কুলতিলক।

প্রিয়নাথের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। নারায়ণ বললেন, জোর করিসনে ভজু। না খায় তো থাক। ভজন আর দ্বিরুক্তি করল না। নারায়ণ ফিরে বললেন, ভাগনের দিকে তাকিয়ে, আপনারা থাকেন কোথায়?

ভাগন হাত জোড় করে জবাব দিল, কালোবাবুকা বস্তিমে। কেতনাদিন সোচা বাবু আপকো সাথ মোলাকাত করেগা, মগর টাইম নহি মিলতা।

কৃপালের একটা ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। শঙ্কর মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাসছেন।

মনোহর বলল, বাবু, আপ দেওতা হ্যায়।

নারায়ণের মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। বললেন, ছি ছি এ-সব কী বলছেন। আমি আপনাদের মতোই মানুষ।

ভাগন বলল, এ বাত বোলনেসে হম নহি শুনেগা বাবু। হমলোগ শুনা, আপ গান্ধীবাবাকো সাথ জেহল মে রাহা। সওরাজ ঔর মজদুর কে বারে উননে আপকো ক্যায়া বাতায়া, হমলোগকা শুনাইয়ে।

কৃপালের সঙ্গে এবার শঙ্করও না হেসে পারলেন না। কিন্তু হাসল না হীরেন।

নারায়ণ অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ। লজ্জায় ও ক্ষোভে তিনি যেন কালো হয়ে উঠলেন। পর মুহূর্তেই মাথা তুলে বললেন, কে বলেছে আপনাদের একথা। মিছে কথা। আমি গান্ধীজির সঙ্গে জেলে ছিলুম না। দেখিনি কোনও দিন তাঁকে।

মনোহর আর ভাগন ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। ভাবল, বাবুর এটা বিনয় মাত্র। তারা দুজনে হাসল, পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অর্থাৎ বড়ে বড়ে আদমির এট্টাই আদত।

কথাটা শুনে প্রিয়নাথ, রথীনও কীরকম অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

মনোহর তেমনি ভাবে, যেন দেবতার কাছে হাত জোড় করে বলল, যো ভি হো বাবুজি, হম মজদুর ভি সওরাজ মাংতা। বাবুজি, হম দুনোকো নোকরি ছিন লিয়া মালিক, লাইনসে বাহার নিকাল দিয়া। হমলোগকা খানা নহি মিলতা। ঔর দেখিয়ে, কারখানামে শালা দিনকে দিন সাহাবলোককা জুলুম বাড়তে যাতা। এ শালা বিলাইতি কোম্পানি হমলোগকো মারডালতা। ইসকা জবাব দেনে মাংতা হমলোগ।

বলতে বলতে মনোহরের অত্যন্ত ভালোমানুষি মুখটা যেন রাগে স্ফীত হয়ে উঠল।

ভাগনও উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, হাঁ বাবু, ইসকা জবাব দেনে হোগা। হমলোগকা জানবার সমঝতা মালিক লোগ। জেনানা বাচ্চা পর ভি হাত উঠা দেতা।

শুনতে শুনতে নারায়ণের প্রাণেও আগুন জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, জবাব দিতে হবে। বিলাতি কোম্পানি এ দেশের মানুষকে জানোয়ার ভাবে, মেয়ে শিশুরাও তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায় না। জবাব দিতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? আগুন জ্বালতে হবে। এ-দেশের প্রত্যেকটি সাদা চামড়ার মানুষকে ধরে ধরে আগুনে পুড়িয়ে মারতে হবে। সারা দেশটার কোণে কোণে ইংরেজের কবরখানা তৈরি করতে হবে।

ভাগনের গুঁফো এবড়ো-খেবড়ো মুখটার চামড়া টান টান হয়ে উঠল। কোটরাগত চোখ দুটো কপালে তুলে সে ফিসফিস করে বলল, বাবুজি, মজদুরলোগ শালা বুদ্ধ হ্যায়। ইলোগ খালি মার খাতা। মগর বাবুজি, আপ হমারা সাথ দিজিয়ে, হম লড়েঙ্গে।

আপনারা লড়াই করবেন? নারায়ণ বললেন, চাপা উত্তেজিত গলায়। তাঁর আলো ভরা চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বললেন, আমি সাথ দেব আপনাদের সঙ্গে, লড়াই করব, যতদিন একটা ইংরেজও এ-দেশে থাকবে…

প্রিয়নাথ ভুলে গিয়েছে সকালবেলার সব অপমান। তার সারা মুখে আলো ফুটে উঠল।

শঙ্কর অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। তাঁর মনে হল যেন, একটা ষড়যন্ত্রের আসর বসেছে এখানে। একটা গুণ্ডামির ষড়যন্ত্র। কতকগুলি মূখ খেপা লোকের সঙ্গে নারায়ণ কেমন করে এ ভাবে কথা বলছে যে তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।

হীরেনও কীরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। অথচ এই মনোহরকে সে গতকাল দেখেছে মদ খেতে, খিস্তি করতে। এরা লড়াই বলতে কী বোঝাতে চাইছে?

শুধু হাসছিল কৃপাল। কেবল মাথাটা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে ভজনের। এ ন্যাংটো মজুর দুটো বলছে কী! লড়াই করবে? বিশ্বাস ও সাহস আছে ওদের। নেশাটা এত মাটি করে দিলে তার। কী করবে ওরা। পিস্তল ছুড়বে না কামান দাগবে।

এমন সময় দোকানের বাইরের জমায়েতে একটা গুলতানি উঠল।

দেখা গেল সরে পড়ছে সব একে একে। খালি হয়ে যাচ্ছে দোকানের সামনেটা।

কে যেন ফিসফিস করে ডাকছে, এ ভাগন বুড্ডা, চলা আও জলদি…জলদি।

দেখা গেল রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে সেই ছোকরা পুলিশ অফিসার। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে সকলের দিকে।

এমন সময় আর একটা কাণ্ড ঘটল। স্টেশনের রকের উপর থেকে মত্ত জড়ানো গলায় একটা অদ্ভুত গান ভেসে এল। সবাই তাকিয়ে দেখল বাঙালি চিৎকার করে গান ধরেছে। গান গাইছে,

পা টলে টলে খানায় পড়ে ওই তো বড় মজা
চার আনার মদ কিনেছি চাট করেছি গাঁজা।
তারা মায়ের এই করুণা,
মাতাল যেন মদ ছাড়ে না
জাহাজে মাস্তুলে উঠে খাচ্ছি পাঁপড় ভাজা।

সারা রাস্তাটায় একটা হাসির রোল পড়ে গেল।

কিন্তু শ্রীমতী কাফের ভিতরে একটা অস্বস্তি দেখা দিল। একটা বিশ্রী স্তব্ধতা।

শঙ্কর হেসে উঠে বললেন, নাও, দিগ্বিজয় করে ফিরেছেন আর এক মজুর। নারান, চেয়ে দেখো ভাই তোমার মজুরের হাল।

এ বিদ্রূপের কোনও প্রতিবাদের ভাষা জানা ছিল না নারায়ণের। প্রিয়নাথেরও নয়। তাদের মুখগুলি কালো হয়ে গেল। লজ্জায় মাথা নুইয়ে পড়ল তাদের।

ভাগন মনোহরও উঠে পড়ল। তাদের সঙ্গীরা সব চলে গিয়েছে। তাদেরও কী রকম অস্বস্তি হচ্ছে। বিশেষ ওই পুলিশ অফিসারটা এসে সব যেন গণ্ডগোল করে দিয়েছে। তারা মাথা নুইয়ে নারায়ণকে নমস্কার করে বলল, আজ হমলোগ চলতা বাবুজি, ফিন আয়েগা।

চায়ের কাপে তাদের চা পড়ে রইল।

শঙ্কর বলে উঠলেন, তোমার ওই বিপ্লবী মজুর দুজনও তাই। রোজগার করবে দু পয়সা, মদ খাবে এক আনার। বিপ্লব মানে কি মুখের খেপামি? এদের নিয়ে তুমি বিপ্লব করবে? এদের দিয়ে তুমি সব করতে পারো, স্বরাজের সংগ্রামের এরা জঞ্জাল। এদের তুমি বিশ্বাস করো?

আশ্চর্য! নারায়ণ মাথা তুলে বললেন, করি শঙ্করদা। কিছু না বুঝলেও এটা বুঝি, যারা চিরকাল পড়ে পড়ে মার খায়, তারা একদিন না মেরে ছাড়বে না। আজও বুঝেছি যতই মদ খাক, আমরা পথ দেখাই বা না দেখাই, ওরা একদিন শোধ তুলবেই। না হলে বুঝব, এ সংসারে সবটাই মিথ্যে।

সে শোধ তোলার নাম কি বিপ্লব?

তা জানি নে, কিন্তু ছেলে বউ নিয়ে চিরকাল কেউ মার খায় না।

বলে তিনি তাকিয়ে দেখলেন ঘড়িতে পৌনে ছটা বেজেছে। দেখে উঠলেন। তাঁর চোখ দুটোতে বেদনা ও রাগের আলো ছায়া। মনটা যেন কোথায় তলিয়ে গিয়েছে। মন যেন কী খুঁজছে। খুঁজছে এক বস্তু। নাম না জানা এক পরম বস্তু। ফিরে তাকালেন ঘড়ির উপরে নারায়ণের মূর্তির দিকে। মনে মনে বললেন, পাব তাকে পাব। আজ যিনি মেঘের আড়ালে, কাল তাঁর হাসির আলো ছড়িয়ে পড়বে সারা আকাশে। অন্তর্যামী তো জানেন, এই উপপাসী মাতাল মানুষগুলি, ওই বাঙালি, ওদের বুকে কী অসহ্য বেদনা। অপমানে মাথা নোয়ানো ভগবান কী দারুণ ক্রোধে ওদের বুকের মধ্যে গজাচ্ছে। পিশাচের পায়ে চাপা মাথার শিরা উপশিরা ছিঁড়ে পড়তে চাইছে তাদের মাথা তোলার জন্য।…বল বীর, বল চির উন্নত মম শির।

বাঙালি এসে পায়ে পড়ে প্রণাম করল নারায়ণকে। বলল, চলে যাচ্ছ বট্‌ঠাকুর। এট্টা গান শুনে যাও মাইরি!

আবার একদফা হাসির রোল পড়ে গেল। তবুও নারায়ণ হার স্বীকার করলেন না। বললেন, গান তো শুনব। তা হ্যাঁরে, বাড়িতে হাঁড়ি চড়েছিল আজ?

বাঙালি মাতাল চোখ দুটো তুলে বলল, তুমি বুঝি রাগ করেছ বঠাকুর, নইলে বউ ব্যাটার কথা বলে এমন নেশাটা ভাঙিয়ে দেয় গো! আর, চাকরি করি কোম্পানির রেলে। হাঁড়ি চড়েনি শুনলে লোকে যে হাসবে গো। আসলে আমাদের হাঁড়িই ফুটো। তলা দে সব গলে যায়।

বলে সে হা হা করে হেসে উঠল। হাসি নয়, নারায়ণের মনে হল দরাজ গলায় কান্নার একটা হা হা রবের রূপান্তর মাত্র। তিনি নেমে এলেন রাস্তায়। সময় হয়েছে, যেতে হবে। আপাতত বাড়িতে, কিন্তু তাঁকে যেতে হবে বাড়ি ছেড়ে। ডাক এসেছে তাঁর। যেতে হবে ঢাকা, পূর্ববঙ্গে। দু-একদিনের মধ্যেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বসবে। একটা কিছু স্থির করবেন গান্ধীজি। না করে উপায় নেই। একটা কিছু চাইছে দেশের মানুষ। অস্থির হয়ে উঠছে দেশ। অস্থির হয়ে উঠছে ভাগন, মনোহরের দল, বাঙালির মতো হাজার হাজার মানুষগুলি। তাকে তুমি, যা-ই বলল, মাতাল, মুখ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কিন্তু কেউ আর মানতে চাইছে না। মানবে না।

প্রিয়নাথও উঠে পড়ল। বাঙালির সঙ্গে কিছু কথা ছিল তার, কিন্তু হল না। উঠে পড়লেন শঙ্কর, সঙ্গে কৃপাল। হাসতে হাসতে শঙ্কর বললেন, সবটাই একটা পাগলামি।

কৃপাল বলল, শুধু পাগলামি নয়। কংগ্রেসের মধ্যে এ-সব এলিমেন্ট বিষের মতো কাজ করছে শঙ্করদা।

শঙ্কর বললেন, দ্যাখ এবার ওয়ার্কিং কমিটি কী সিদ্ধান্ত দেয়। গান্ধীজি রয়েছেন, এ-সব এলিমেন্টের জন্য আমরা ভয় পাইনে।

হীরেন বসে রইল। সে ভাবছিল, ভয় নয়, গান্ধীজির সমস্ত বাসনা হয়তো এবারও অতৃপ্ত থেকে যাবে। কেন না, দেশের জন্য যারা প্রাণ দেবে, তারা যদি সুস্থ মনে এক মত না হয়, তবে তো ব্যর্থতাই আসবে। ব্যর্থতা আসবে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। তাই তো এসেছিল একদিন। একুশ সালের হিংসাত্মক ব্যর্থতা থেকেই তো নারায়ণ মোড় নিলেন। কিন্তু হীরেন মোড় নেয়নি। সে বিশ্বাস করে গান্ধীজির দর্শনকে, তাঁর আদর্শকে।

সে ডাকল, ভজন।

ভজন মাথা তুলল। তার মাথাটা কেমন গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছে। এখানকার সমস্ত কথাগুলো তার দুর্বোধ্য মগজে যেন পেরেকের মতো ফুটছে। আর ড্রয়ারটা প্রায় খালি হয়ে পড়ে আছে। দু-চার আনা পড়ে আছে মা লক্ষ্মীর প্যাঁচার মতো মুখ লুকিয়ে। ধারের খদ্দেররা কেউ শোধ করতে আসেনি পয়সা। স্টেশনের রক ঘেঁসে একজনকে চলে যেতেও দেখেছে চুপি চুপি; কিন্তু কিছু বলেনি।

সে মাথা তুলল। তার চোখের দৃষ্টি অস্থির। অথচ যেন জ্বলছে ধ্বক ধ্বক করে। বলল, বল।

হীরেন মুহূর্তের জন্য মুষড়ে পড়ল। পরে বলল, বলছিলুম, নারায়ণদা যা বলছে, তা ঠিক নয়।

যথা?

নারায়ণদা যা বলছে তাতে মজুরের কোনও সুরাহা হবে না। এই সব অশিক্ষিত মানুষগুলোকে দিতে হবে আক্ষরিক শিক্ষা, আর একদিকে সত্যাগ্রহের প্রকৃত সৈনিক করে গড়ে তুলতে হবে এদের। অহিংসার মর্মবাণী পৌঁছে দিতে হবে ওদের বিক্ষুব্ধ অন্তরে।

ভজন চোখ দুটো কুঁচকে প্রায় ভেংচি কাটার মতো করে বলল, দ্যাখ হীরেন, তোর থেকে আমি বেশি লেখাপড়া করেছি তো?

হীরেন অবাক হল। তা তত করেছ।

তবে তুইও শালা আমাকে বোকা বোঝাচ্ছিস?

শালা শুনে লজ্জায় কান দুটো গরম হয়ে উঠল হীরেনের। বলল, কেন?

কেন? ভজন বলল, শিক্ষা দিবি, আর সত্যাগ্রহ করবে, ওদিকে ইংরেজের ঠ্যাঙানিতে যে সব পটল তুলবে বাবা। সত্যাগ্রহ বনাম কামান?

বলে সে হা হা করে হেসে উঠে বলল, আমার চেয়ে তোদের মাথা খারাপ দেখছি।

হতাশ হল হীরেন। বৃথাই বোঝাতে গিয়েছিল সে ভজনকে। মাতালটাকে। সে উঠে রাস্তায় নেমে এল। বুঝবে না। এরা কেউ বুঝবে না। কত কামান ছুড়বে ইংরেজ? একজন নির্ভীক সত্যাগ্রহী যে কামানের চেয়েও কঠিন। শত্রু যে সে তো মানুষ। কামান সে কতক্ষণ ছুড়তে পারে। ভগবান কি একবার ওর হৃদয়ে এসে ওই কামান ছোড়া হাতকে জড়িয়ে ধরবেন না। প্রেম জাগাবেন না তার মনে।

কিন্তু এরা কেউ বুঝবে না। এরা চায় রক্তের বদলে রক্ত। যার ফল হল শূন্য। কিন্তু বুঝতে হবে মানুষকে। এমনকী ধাঙড় বস্তির মানুষগুলোও বুঝতে আরম্ভ করেছে। তারাও স্বীকার করেছে। তাই আজ হীরেনও বিশ্বাস করে, ঠিক প্রিয়নাথেরই মতো, এই সব অশিক্ষিত নিরন্ন দেশবাসী থেকেও বেরিয়ে আসবে নেতা। যেমন বেরিয়ে আসছে রামা। রামা ঝাড়দারনী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নট মেয়ে। তার স্তুল মুখে আজ বুদ্ধির দীপ্তি। অদূর ভবিষ্যতে রামার তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হবে। সে হবে প্রকৃত সত্যাগ্রহী।

তবু হায়! রামার চোখে বিচিত্র স্বপ্নের ছায়া কাটতে চায় না। মনের তলায় বুঝি রামারই অজান্তে রয়েছে এক তীব্র আগুনের ঝাঁজ। সে আগুনের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে পথে আর বস্তিতে তার চলায় ফেরায় হাসিতে।

একটা নিশ্বাস পড়ে হীরেনের। আগামী পরশুই তার ধাঙড় বস্তিতে যাওয়ার কথা। তার নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ সার্বজনীন চড়ইভাতির। তারপরে, ওরা একটা জৌলুস বের করবে। জৌলুসের পুরোভাগে থাকবে হীরেন। হয়তো অনেক লোক হাসবে। এমনকী কৃপালরাও হাসবে সে জানে। কারণ, তারা এ ব্যাপারটাকে কেউ আমল দেয়নি। উপরন্তু হেসে উড়িয়েছে। ওড়াক, তবু এদের মনুষ্যত্ব, এদের দুঃখকে ছেড়ে যাবে না হীরেন। অস্পৃশ্যের হৃদয়কে সে স্পর্শ করতে চায়।

তারপর দিন আসছে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বসতে যাচ্ছে আজ কালের মধ্যেই। ভবিষ্যৎকে দেখবার জন্যই হীরেন তাকাল আকাশের দিকে। আকাশ নেই। তারা নেই। অন্ধকার আর কুয়াশা। কী আছে তার ভবিষ্যৎ জীবনে। কী আছে পথে…সে চলতে আরম্ভ করে।

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে কুটে পাগলা। আর স্টেশনের মকের ভবঘুরে মধ্যবয়সী অধিবাসিনীকে। অকারণ ঘুরে ঘুরে গালাগাল দিচ্ছে।

শ্ৰীমতী কাফে প্রায় শূন্য! গোলক চাটুজ্যেমশাই বসে বসে ঝিমুচ্ছেন।

ভজন ডাকল, বাঙালি!

বাঙালি কিছুক্ষণ পর এলিয়ে পড়া মাথাটা তুলে বলল, লাটঠাকুর, একটা কথা বলব?

বল শুনি।

তোমার বউ তোমাকে গাল দেয়?

ভজন হেসে বলল, দিলে বাঁচতুম। কিছুই তো বলে না। কেন বল দেখি।

আমার বউ আমাকে বড় গাল দেয় ঠাকুর। খালি বলে, বাড়ি থেকে বেইরে যাব। বেশ, আমি হয় যাব না, ও-ই থাক বাড়িতে। কি বলো ঠাকুর।

চরণ সরু গলায় হেসে উঠল খিলখিল করে। হাসি পেয়েছে বাঙালির কথা শুনে।

ভজন খেঁকিয়ে উঠল, আ মলো, হারামজাদা হেসে মরে কেন?

অমনি চরণ আড়ালে সরে পড়ল। বাঙালি আবার বলল, আমার পরে সবার রাগ। বটুঠাকুরও আজ রাগ করেছে আমার পরে। পাননাথ দাদা কথাটি কাটলে না মুখে। ঠাকুর, এ বিশ্ববেহ্মাণ্ডের আমি ভার। পাননাথ মানে প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথ তার আসে না মুখে।

ভজন বলল, তুই যে দর্শন আওড়াতে আরম্ভ করলি বাঙালি। বঠাকুরের শরীরে কোনও দিন রাগ দেখেছিস? ব্যাটা খালি পেটে তাড়ি গিলেছিস। কিছু খাবি?

এত শীতেও বুক খোলা নীল কুর্তার ভিতর দিয়ে বাঙালির পিঠে ঠেকা পেটটা দেখা যায়। সেই ভোরবেলা কিছু ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল। খাওয়ার কথা শুনে, পেটের নাড়ি থেকে যেন একটা রসের ধারা তার চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। বলল, খাব ঠাকুর। ভেবেছিলাম, মেয়ে পাড়ায় যাব লবার বউয়ের কাছে। তাও ওর দেয়া খাবার গিলতে বড় গলায় লাগে। পারিনে।

ভুনু এল। যেন গন্ধে গন্ধে আসে। এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে। গাড়ির মনে গাড়ি পড়ে আছে, ঘোড়ার মনে ঘোড়া। কোনও কোনও দিন দেখা যায় ভুনু মোটেই আসে না। ঘোড়া দুটো আপনি আপনি ট্যাকস ট্যাকস করে আস্তাবলের কাছে গিয়ে নাকের ভেতর দিয়ে সড়সড় করে ডাকে, ঠুক টুক করে পা ঠোকে। অর্থাৎ, রাজারানী আমরা এসেছি, আমাদের ঘরে তোল। ভুনু না থাকলে মনিয়া ঘরে তুলে নিয়ে যায়।

ভজন বলল, এসেছ, বাবা সারথি। এবার ওই ভগবানের জীব রাজারানীকে ছেড়ে কেটে পড়ো না কোথাও। এমনি করে আর কতদিন চালাবে?

ভুনু হাসে না ভেংচায় ঠিক বোঝা যায় না। একটা হুঁ দিয়ে সে বসে পড়ে বাঙালির পাশে। তারপর রাত হয়। তারা তিনজনে বসে শেষবারের মতো নেশা করে। চরণ মনে মনে রাগ করে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে থাকে মাঝের ঘরটায়। রাগের থেকে কখন তার মনে অন্যান্য নানান কথা এসে ভিড় করে। তখন সে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে থাকে।

যাওয়ার আগে বাঙালি বলল, ঠাকুর, গান্ধীজি নাকি আবার নড়াইয়ে নাববে?

ভজু জবাব দিল, নড়াই কি ওয়ার তা জানিনে। তবে, একটা কিছু ঘটতে পারে। কেন বল তো?

না, বলছিলুম, আমাদের রুজি টুজির কিছু…

তুই ব্যাটা গাড়োল। রুজির বাড়া স্বরাজ। তা না ব্যাটা রুজির কথা ভাবছে।…

পুলিশ অফিসার সাইকেলে যেতে যেতে একবার দেখে নিল তিনজনকে। অন্যমনস্কভাবে হ্যান্ডেলে ঠোকা দিতে দিতে সে গজলের সুর আওড়াচ্ছিল। বন্ধ হয়ে গেল। ওই বাঙালি লোকটাকে এখানে আসা বন্ধ না করলে চলছে না। আর ওই গাড়োয়ানটার লাইসেন্সটা বাতিল করতে হবে কোনও অজুহাতে। আর তার কথা মতো কর্তৃপক্ষ যদি শ্রীমতী কাফেটা উঠিয়ে দেয়, তবে তো কথাই নেই। তবু কথা আছে। কথা দু চারদিন বাদেই শোনা যাবে। কে জানে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গান্ধীজি কী সিদ্ধান্ত নেবেন। আবার মারামারি আর হট্টগোল।…গান্ধীজি! মনে হলেই দেশ থেকে আসা স্ত্রীর অভিযোগপূর্ণ আদরের এবং ভালোবাসার চিঠিগুলির কথা মনে পড়ে যায়, বিশ্রী তোমার চাকরি। মানুষকে মার দেওয়া আর জেল খাটানো তোমার কাজ। হ্যাট কোট পরা তোমার চেহারাটা ভাবলে আমার কী রকম ভয় হয়। আমার সইয়েরা আমাকে ঠাট্টা করে। তোমার জন্য রুমালে একটা ফুল তুলেছি। লিখেছি, ভালোবাসা।কবে তুমি আসবে।..

মনে হল সাইকেলের চেনটা ঢিলে হয়ে গিয়েছে। চলতে চাইছে না। সত্যি করে সে যাবে। যা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে আগামী একটা বছরে ছুটির কথা হয় তো তোলাই যাবে না।

.

পরের দিন শেষ রাত্রি। একটু হাওয়া বইছে। শীত কমে আসছে। আসছে বসন্ত। আকাশে একখণ্ড চাঁদ। যেন হিমে ভিজে গিয়েছে।

ভজনের শোবার ঘরের দরজায় করাঘাত পড়ল। ভজু…ভজন।

এক ডাকেই হকচকিয়ে উঠে বসল যুঁই। ভাসুর ঠাকুর ডাকছেন। ডাকছেন ওকে। পুলিশ এল নাকি? সে ভজনকে ডেকে উঠিয়ে দিল, শুনছ। ওঠো, তোমাকে ডাকছেন ভাসুরঠাকুর।

ভাসুরঠাকুর। মানে দাদা। ভজন এসে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। পেছনে যুঁই।

সামনে দাঁড়িয়ে নারায়ণ। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগের ঝোলা। পশ্চিমে হেলে পড়া চাঁদের মান আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। পড়েছে ভজনের মুখেও। অন্ধকারে যুঁইয়ের মুখ। তাই ঘোমটা দেওয়ার দরকার হয়নি।

নারায়ণের মুখে সেই হাসি। অনাবিল অথচ সম্পূর্ণ। বেদনা ও মধুরতা। পিতৃত্ব ও বন্ধুত্ব। বললেন, ভজু যাচ্ছি ভাই। আধ-ঘুম-ভাঙা ভজন হাঁ করে তাকিয়ে রইল, যেন বুঝতেই পারেনি

এখনও ব্যাপারটা। বলল, যাচ্ছ, কিন্তু কই, রাত্রেও তো একবার বলোনি।

নারায়ণ বললেন, বলা যায়নি, এখন বলে গেলুম।

বলে অন্ধকারে যুঁইয়ের দিকে তাকানে। বললেন, বউমা, এ সংসারের কোনও ভার আমি নিতে পারিনি। তার জন্য আমার উপর তুমি যেন রাগ করো না। আমি আর পারিনে এ পথ ছাড়তে।

কথা বলতে পারছে না যুঁই। বলতে নেই। কিন্তু তার যে চিৎকার করে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছ, আপনি এমন করে বলবেন না। ছাড়তে হবে না আপনাকে এ-পথ, ছাড়তে দিতে চাইনে আমরা।

অন্ধকার থেকে, নারায়ণের পায়ের কাছে চাঁদের আলোয় এসে ঠেকল যুঁইয়ের মাথা। ঘোমটা টানা হয়নি। ঘাড়ের কাছে ভাঙা খোঁপা।

নারায়ণ একটু নড়লেন। চোখের মুহূর্তের জন্য ছায়া ঘনিয়ে এল। বললেন, থাক থাক, ওঠে। বলছিলুম, এ বাড়িতে তুমি মেয়ের মতো। নিজেকে একটু দেখো। গৌর নিতাইয়ের ভার তোমারই। বাবা…

থামলেন নারায়ণ। ভজন চোখ বুজে আছে চোয়াল চেপে। যুঁইয়ের গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। নারায়ণ আবার বললেন হেসে, বাবাকে তোমাকেই দেখতে হবে যতদিন বেঁচে থাকেন। আয় ভজু আর তুমি, তোমরা পরস্পরকে বুঝে চলো, বউমা। জানিনে এত ভার নিলর্জের মতো তোমাকে কেমন করে দিয়ে যাব, কিন্তু ভজনের জন্য দুশ্চিন্তা আমি ছাড়তে পারিনে। আবার এক মুহূর্ত চুপচাপ। নারায়ণ ডাকলেন, ভজু।

ভজু চোখ খুলল না, কথা বলল না। খালি শব্দ করল, উঁ!

নারায়ণ বললেন, বাবাকে আর ডাকলুম না। তুই ভাই আর যাই করিস, বেঁচে থাকাটাকে অচ্ছেদ করিসূনে।

তারপর হাত দিয়ে ভজনের হাতটা একবার পর্শ করে নেমে গেলেন উঠোনে। পাতকোর ধার দিয়ে গিয়ে খিড়কির দরজা খুলেন। সেই অল্প শব্দে ভজন চমকে উঠে তাড়াতাড়ি খিড়কির দরজার কাছে এসে বলল, কোথা যাবে এখন দাদা?

ভজনের ব্যাকুলতা দেখে নারায়ণ মনে মনে ব্যথায় চমকে উঠলেন। বললেন, সেকথা পারলে আগেই বলতুম ভজু। যাচ্ছি দরজাটা বন্ধ করে দে।

আর একজনের কথা এ-সময়ে মনে পড়ছিল। যার টাকা ও সোনার অভাব নেই, যার স্বামীও আর দশজনের মতোই ভাল, যার আছে নবীনের মতো ছেলে, সেই প্রমীলা। জীবনে, মরণের আগে একদিন যে একবার যাবার আমন্ত্রণ করেছে।

তিনি বাইরের আলো আঁধারিতে উধাও হয়ে গেলেন। যুঁই এসে দাঁড়াল ভজনের পাশে। সেও তাকিয়ে রইল খোলা দরজা দিয়ে। খানিকক্ষণ পর তাকিয়ে দেখল ভজন তেমনি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল সারা মুখে রুদ্ধ যন্ত্রণা যেন থমথম করছে।

যুঁই ডাকল, ঘরে চলো, বাইরে হিম পড়ছে।

ভজন খালি বলল, চলো।

তবু সে দাঁড়িয়ে রইল। যুঁই দরজাটা বন্ধ করে দিতে গিয়ে যেন একটা অনর্থক কান্নার বেগ কিছুতেই রোধ করতে পারল না।

.

বিকালবেলা। সারাটা দিন ভজন মদ খেয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা রোদের তৃষ্ণায় ঢেকে ঢোকে জল খাওয়ার মতো মদ খেয়েছে। এখন সে উত্থানশক্তি রহিত হয়ে পড়ে আছে টেবিলে মাথা দিয়ে। চরণ কয়েকবার বলেছে বাড়ি যাবার জন্য। ধমকানি খেয়ে পেছিয়ে এসেছে। বারকয়েক টেবিলের থেকে ঝুলে পড়া মাথাটা তুলে দিয়েছে।

এমন সময় এল হীরেন। সে যথেষ্ট চাপা মানুষ। তবু তার সারা চোখে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। সে যাচ্ছে ঝাড়দার বস্তিতে। কথাটা ভজনকে বলা ছিল। আর একবার বলে যাওয়ার জন্য এসেছিল। দেখল একেবারে মাতাল হয়ে পড়ে আছে।

রাগ হল না। হাসল হীরেন! ভালবাসার হাসি। সে পথ দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। সে যেন কোনও মহতী সভায় চলেছে, যেন যুদ্ধ জয় করতে চলেছে এমনি একটা মনের ভাব। তার আনন্দ হচ্ছে।

পথে কত লোক। এ-দেশেরই লোক। নানান ধান্দায় এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন কেউ কাউকে চেনে না। কিন্তু সবাই সবাইকে চনে। হীরেন চেনে। নাম জানে না, মুখ চেনে না, তবু চেনে। সে ভালবেসেছে সবাইকে। দেশের সব মানুষকে। সে জন্য সে প্রাণটাও দিতে পারে। প্রাণটা হাতের মুঠোয় এনে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে। সে আজ সবই পারে।

সে চলেছে ঝাড়ুদার বস্তিতে। সেখানে আছে অনেকে। অনেকে আর রামা। আজ সকালেও সে এসেছিল। জানিয়ে গিয়েছে, সব আয়োজনের ভার নিয়েছে সে। একদিন এ দেশের ভার নেবে সে। হীরেন তারই সৃষ্টির পেছনে পেছনে, তারই হাত ধরে এগুবে। দ্বিধা নেই, লজ্জা নেই সে কথা মনের কাছে স্বীকার করতে। গঙ্গার ধার থেকে অনেকটা উঁচুতে মাঠ। দীর্ঘ মাঠের এক প্রান্তে ওই যে দেখা যায়, পুবে পশ্চিমে লম্বালম্বি খোলার চালা। কালচে খোয়া, গঙ্গা মাটির প্রলেপ দেওয়া ছিটেবেড়ার দেওয়াল। মানুষের মূর্তি দেখা যাচ্ছে কতগুলি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। হীরেন এসে দাঁড়াল সেখানে। দু তিনটে কুকুর একসঙ্গে ঢেউ ঢেউ করে উঠল। কয়েকবার দেখলেও আজও ওরা ঠিক চিনে উঠতে পারেনি হীরেনকে।

ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা শুয়োরের ছানা বাড়ির পেছনে পেছনে। বাঁশের কঞ্চির আঁশ ছড়িয়ে আছে পিটুলি গাছটার তলা জুড়ে।

হীরেনকে দেখে প্রায় সবাই বেরিয়ে এল। একটা কোলাহল পড়ে গেল, আগিয়া বাবুজি, আগিয়া। চলিয়ে বাবু, অন্দর মে।

অর্থাৎ ভেতরের উঠোনে। কিন্তু থমকে গেল হীরেন। যেন মনে হচ্ছে এরা কম বেশি সকলেই বেসামাল। সকলেই ইতিমধ্যে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে। মুখে তারই গন্ধ বেরুচ্ছে।

এমন সময় ভেতরে ঢোকার গলির মুখের কাছে এসে দাঁড়াল রামা। ডাকল, বাবুজি।

বাতাস লাগল হীরেনের বদ্ধ প্রাণে। সে সাহস পেল। দেখল, রামা হাসছে। তার সারা চোখে মুখে উদ্দীপনা, উত্তেজনা। উচ্ছ্বাস উজ্জ্বল চোখ একটু লালচে আভায় চমকানো ছুরির মতো ধারালো। ফরসা মোটা কাপড় পরেছে ঘাগরার মতো কুঁচিয়ে। আঁচল বুকের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে বেঁধেছে কোমরে। গায়ে দিয়েছে শস্তা ছিটের নীল জামা। তাতে নক্ষত্রের মতো হলদে রঙের বিন্দু। তেল দেওয়া আঁচড়ানো চুল চকচক করছে মুখ।

রামা ডাকল, আইয়ে বাবুজি।

সমস্বরে ধ্বনি উঠল, আইয়ে বাবুজি।

ঝাড়ুদার বস্তির সদর সকলের আগে হীরেনের পাশে পাশে এসে ঢুকল।

দেখা গেল উঠোনটি গোময় দিয়ে লেপা। চারদিক ঝকমক করছে। মাঝখানে কলাপাতার উপর খাবারে ঢাকা দেওয়া রয়েছে, শালপাতা। কেবল হীরেনের জন্য রয়েছে একখানি আসন পাতা।

ঘরের থেকে বেরিয়ে এল মেয়ে, পুরুষ, বাচ্চা। যারা বসেছিল উঠোনে, তারা সবাই সরে বসল। সকলেই বলাবলি করছে, হাসাহাসি করছে। হাসি কলরব, সবই উৎসবের।

ন্যাংটো কালো কালো কতগুলি ছেলেমেয়ে গোল গোল চোখে একবার দেখছে খাবারের দিকে, আর একবার হীরেনের দিকে। বোধহয়, ভাবছে এতগুলি খাবার এই আজব লোকটার পক্ষে কী করে খাওয়া সম্ভব।

রামা ব্যস্ত হয়ে এ-দিকে ও-দিকে ঘোরাঘুরি করছে। লক্ষ খুঁজছে, বাতি জ্বালতে হবে। তার পেছনে পেছনে ঘুরছে সেই ছোকরা ঝাড়দার। আর থেকে থেকে খিলখিল করে হেসে উঠছে রামা। সে হাসি যত তীব্র, তত মধুর। যত ভয়ের, তত সুখের।

এক জায়গায় বসেছে মেয়েরা দল বেঁধে গোল হয়ে বসেছে পুরুষেরা। এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে বাচ্চাগুলি। কিন্তু কী আশ্চর্য। সালের চোখগুলি ঘোলাটে। সকলেরই কেমন একটা দোলানি। সকলেই যা তা বলাবলি করছে। বলছে, বাবু গান্ধী বাবা কা চেলা। দেওতা হুকুম দিয়া বাবুকো, অচ্ছুত কো উঠা লেও আপনা গদিমে। বাবুজি ব্রাহ্মণ হ্যায়, একদম খাঁটি। তাই নিয়ে বিতর্ক, বিবাদ, কোলাহল। একটা শুয়োর ঢুকেছিল উঠোনে। কে তাড়া করে গেল।

হীরেন বসেছে আসনে। তার পাশে বসেছে সদার। বাতি জ্বলছে কয়েকটা। কিন্তু তার মনের আনন্দ যেন অনেকখানি থতিয়ে গিয়েছে। সে দেখল, রামা তার পাশে এসেছে আর কেবলি হাসছে। হাসিতে ঢলে ঢলে পড়ছে। কয়েকবার তার হাত ধরে টেনেছে ওই ছোকরা ঝাড়দার।

হীরেন অনেক কিছু বলবে ভেবেছিল। কিন্তু কাকে বলবে। শোনবার মতো অবস্থা কারও আর আছে বলে মনে হল না।

সদার হাত তুলে গোলমাল থামাল। ঢাকনা খুলে দিল খাবারের। সবই প্রায় দোকানের কেনা খাবার। কেবল হাতে তৈরি কিছু মোটা আটার রুটি, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ আর লঙ্কার আচার। এক কোণে কিছু ভাত।

সর্দার হাত জোড় করে বলল, বাবুজি হামরা গোস্তাফি না লিজিয়ে। কিরপা করকে আপ ভোজন কিজিয়ে।

হীরেন সকলের দিকে তাকাল। সকলেই তার দিকে উদগ্র চোখে তাকিয়ে আছে। যেন কী এক অসম্ভব ঘটনা ঘটতে চলেছে। না, একটুও ঘৃণা করছে না হীরেনের। তবু আনন্দের থেকে বেদনার ভার বেশি হয়েছে। তার চোখের সামনে ভাসছে একজনের মুখ। বিষয়, ব্যথিত, চিন্তিত সে মুখ গান্ধীজির। তার চোখের সামনে ভাসছে বিশ্বমানবের মুক্তিদাতা গৌতম বুদ্ধের করুণ হাসি-ভরা মুখ।

সামনে কতগুলি কালো কালো ধুলো মাথা মুখ। ঘোলাটে বোকাটে চাউনি লক্ষর আলোয় দেখা যাচ্ছে আধ ল্যাংটো কতগুলি আধা মানুষ।

হীরেন সদারের কাঁধে হাত রেখে বলল, খাব ভাই। গান্ধীজি তোমাদের নমস্কার দিয়েছেন, আমিও দিই। বলে সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, দরিদ্র নারায়ণগা কো চরণে মে।

এসো ভাই আমরা সকলে একত্র খাই।

বলে সে হাত বাড়াল। কিন্তু আর সবাই দ্বিধা করছে। সকলেই বসে আছে আড়ষ্ট হয়ে। মুখ চাওয়াচায়ি করছে পরস্পরের।

হীরেন বলল, কই, এসো সব।

সবাই একটু একটু এগিয়ে এল। সদার বলল, হাত লাগাও খাও সব বাবুকো সাথ।

বলে সে নিজেও হাত দিতেই সকলের হাত এসে পড়ল। খাওয়া শুরু হল, ব্যস্ততা দেখা দিল, একটা ঠেলাঠেলি লাগল খাবারের দিকে এগুবার জন্য।

সকলেই হাসাহাসি করছে, কথা বলছে।

হীরেনের পাশ থেকে রামা হেসে উঠল খিলখিল করে, সর্বাঙ্গ দুলিয়ে। হীরেন তাকিয়ে দেখল, চোখ জ্বলছে রামার। রামার চোখ লাল। খসে পড়ছে আঁচল, এলিয়ে পড়ছে চুল। আর হাসছে তীব্র মধুর গলায়।

ভয়ে কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেল হীরেনের। ধড়াস ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। তাড়ি খেয়েছে, নেশা করেছে আজকে রামা। সে দেখল, হাসির দমকে জ্বলছে এক খণ্ড অঙ্গারের মতে, এ তার সেই রামা নয়। এ যে নটজাতীয় উছুঙ্খলা এক মেয়ে। যার রক্তের ধমনীতে, কোষে কোষে বেদিয়া নটদের সর্বনেশে রক্তধারা টগবগ করে ফুটছে। ভার বইতে পারছে না শরীরের, টলে টলে পড়ছে। বাঁধন মানছে না দেহের, সে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে আর পেছনে যেন সেঁটে আছে সেই কেরা। ছোকরা মত্ত, উন্মত্ত।

ভয়ে ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে গেল হীরেন। সে দেখল, একটা হট্টগোল লেগে গিয়েছে সারা উঠোনময়। আশ্চর্য। দেখা গেল, সেখানে হঠাৎ কয়েকটা ভাঁড় দেখা যাচ্ছে। নির্বিবাদে পান করছে সবাই। পান করছে মেয়েরা। একেবারে বেমালুম হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ আধবয়সী একজন উঠে দাঁড়িয়ে রক্ত-চোখে হীরেনের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবুজি, ভগবান আকা ভালা করে। গান্ধীবাবাকো পাশ আপ হামরা আপিল লে যাইয়ে, উনকো বাতাইয়ে, হামারা মিনপিল কি কমোশনার বাবুলোগ চুতিয়া হ্যায়। উ চুতিয়ানন্দন হ্যায়।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে পুরুষদের মধ্যে অনেক চেঁচিয়ে উঠল, হাঁ উ লোগ ডাকু হ্যায়। হমারা তখা কাট লিতা। জায়দা খাটাতা আইন নাহি মাৰ্তা লোগ।

হীরেনের চেতনা অবশ হয়ে এল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সে। হঠাৎ এ প্রসঙ্গে পেড়ে বসছে কেন লোকগুলি। পরমুহূর্তেই মনে হল বলবেই তো। কিন্তু এ ক্ষিপ্ততা কেন, এ কুৎসিত গালাগাল কেন?

সে তাকাল সদারের দিকে। সদার দাঁড়িয়ে চীৎকার করে ধমকে উঠল, এই, চুপ রহো সব। তু লোগকো শরম নাহি লাগতা। খানা পিনাকা আসর মে তু লোগ্ চিল্লাতা।

একজন বলে উঠল, গলতি হো গিয়া সদার। হম বাবুকো পাশ আপিল করতা। মগর…কে একজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ঝগড়া লেগে গেল হঠাৎ মেয়েদের মধ্যে কী একটা কারণে।

রামা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, চুপ রহো সব।

চুপ হল সব। তাকিয়ে দেখল, আলুথালু বেশে, জ্বলন্ত চোখে বাঘিনীর মতো ওত পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে রামা।

সে মূর্তি দেখে একটু আশ্বস্ত হল হীরেন কিন্তু সারা অন্তর তার যেন অপমানে পুড়ে গেল। সর্বনেশে নট মেয়ের এ আর এক রূপ। কিন্তু হিংস্রতা সে দেখতে চায়নি। এ যে বীভংস, ভয়াবহ।

সেই ছোকরা উঠে হঠাৎ এ স্তব্ধতার মধ্যে বলে উঠল, বাবুজি আপ হুকুম দিজিয়ে, হম রামাকো শাদি করেগা।

শাদি? কেউ বলল হাঁ, কেউ বলল না। আবার গণ্ডগোল। হীরেনের বুকের মধ্যে যেন বাজ ভেঙে পড়ল। কথা কিছুতেই সরছে না তার মুখ থেকে। আর আশ্চর্য, রামা আবার হাসছে। বুঝি বিয়ের কথা শুনেই হাসছে।

একজন টলতে টলতে এগিয়ে এল হীরেনের দিকে। হাতে তাড়ির ভাঁড়। বসে পড়ে বলল, বাবুজি আপ পিলিয়ে। ইলোগকো বাত ছছড়িয়ে।

তার পেছনে আর একজন এল। আরও একজন। হীরেন আতঙ্কবোধ করল। এ কোথায় এসে পড়েছে সে। এরা কারা? এরা তো সেই শান্ত ঝাড়দারও নয়। সে উৎকণ্ঠায় ত্রাসে রাগে বলে উঠল, এ-সব কী বলছ তোমরা।

লোকগুলি অচেতন উন্মাদ। চোখ বুজে ঘাড় দুলিয়ে বলল, হাঁ বাবু, এ হ্যায় আদত। হমারা জাতকে আদত, সচ্ মহারাজ। রাজা হে, পরধান হো, হমারা সাথ পিতা বলে, একজন ভাঁড়টা তুলে ধরল হীরেনের মুখের কাছে। ঠিক এই মুহূর্তে রামা বাঘিনীর মতোই লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিল চড় ঘুষি বসাল পাগলিনীর মতো। কমিনা শুয়ার কো বাচ্চা, বাবুজি কো বে-ইজ্জত করতা তু।

কিন্তু নেশায় মত্ত লোকটা সে মার গ্রাহ্যই করল না। হড়হড় করে ঢেলে দিল তাড়ি হীরেনের সর্বাঙ্গে।

হীরেন প্রায় প্রাণভয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে উঠে পড়ল। কিন্তু তাকে কেউ-ই লক্ষ করল না। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বস্তির ভিতর থেকে বাইরে এসে পড়ল। অপমানে বেদনায় সে পাগলের মতো মাঠের উপর দিয়ে চলল। অসহ্য কান্নায় তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল। সামনে অন্ধকার, চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছে। মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল তার দেবতার মূর্তি। এ কী করলে তুমি? এ কী হল! আমাকে মরতে হবে, আমাকে আত্মঘাতী হতে হবে। ভগবান আমাকে মৃত্যু দাও।

পেছন থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসছে, বাবুজি…বাবুজি…।

না আর কোনওদিন ওই ডাকে সাড়া দেওয়া যাবে না। এ মুখ দেখানো যাবে না। সে অক্ষম, সে দুর্বল, সে ভীরু, সে ভিক্ষুক, সে অপমানিত। তবু, হে ভগবান, আমি চাইনি পাপ করতে। তবে কোথায় আমি ভুল করেছিলুম, আমি কি বোঝাতে পারিনি।

বাবুজি…বা–বুজি! প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে রামা। একলা আলুথালু বেশে, চোখের জলে অন্ধ হয়ে।

না না, ডেকো না। হীরেন ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে সে। মরণ, আমাকে তুমি নাও, আমাকে নাও।

বাবুজি…বাবুজি।…ছুটতে ছুটতে এসে রামা আছড়ে পড়ল হীরেনের পায়ের কাছে। দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তার হাঁটু। পায়ে মুখ চেপে বার বার বলতে লাগল, বাবুজি..বাবুজি…হমার বাবুজি।…।

গতিরুদ্ধ হয়ে হীরেন দুহাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠল।

অন্ধকার মাঠ। ওই দূরে গঙ্গা। আকাশে ঝিকমিক করছে তারা।

বাবুজি। নির্ভয়ে অসঙ্কোচে হীরেনকে লতার মতো জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়াল রামা। কেঁদে উঠল হা হা করে। বাবুজি হমারা গোস্তাকি..হমারা। হমকে পিটিয়ে, গালি বকিয়ে। বাবুজি হমকো লে চলিয়ে আপকো সাথ। হম এঁহা নহি রহেগা…নহি..।

হীরেনের বুকের মধ্যে থরথর করে কাঁপছে। রামার তপ্ত আলিঙ্গন, নিশ্বাসের আগুন পুড়িয়ে দিল তার সর্বাঙ্গ। সে ভয়ে বিস্ময়ে চোখ নামাল। অন্ধকারেও দেখতে পেল, তার মুখের সামনে রামার ঠোঁট, জলে ভেজা চোখ, রামার সর্বাঙ্গ।

শিউরে উঠল হীরেন। এই তো মৃত্যু। মৃত্যু তার বক্ষলগ্ন। কিন্তু সে এত ভীষণ, এত ভয়ঙ্কর। না না, মরতে সে চায় না। মরতে সে পারবে না।

দু হাতে সে নিজেকে মুক্ত করে নিল। ছেলে দাও, ছেড়ে দাও রামা। যেতে দাও, আমাকে মুক্তি দাও।…নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল।

রামা ড়ুকরে উঠল, বাবুজি!…

তারপর সেইখানে বসে পড়ে মাটিতে মুখ দিয়ে কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।

একটু পরেই অন্ধকারে একটা জোয়ান মূর্তি এসে দাঁড়াল সেখানে। সেই ছোকরা ঝাড়দার। হাঁটু গেড়ে বসে দু-হাতে টেনে তুলল রামাকে। রামা জোর করল না। সে তাকে টেনে তুলে দাঁড় করাল। কোনও কথা না বলে তাকে আস্তে নিয়ে চলল বস্তির দিকে। কেবল একবার সে ফিরে তাকাল পিছন থেকে। চোখদুটো জ্বলছে বন্য শ্বাপদের মতো।

.

হীরেন রাবিশ মাড়িয়ে নর্দমা পেরিয়ে শ্রীমতী কাফের পেছন দরজা দিয়ে ঢুকল। সামনে দিয়ে আসতে পারেনি সে। এ মুখ সে দেখাতে পারেনি।

চরণ উনুনের পাশে চা তৈরি করতে করতে চমকে উঠল। চলকে গেল গরম জল। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ সে। হীরেনের এলোমেলো চুল, বুক খোলা জামা, যেন ঝোড়ো পাখি। সারা গায়ের থেকে ভকভক করে বেরুচ্ছ টকো তাড়ির গন্ধ! এসে উদ্ভ্রান্তের মতো চরণ, ভজুকে একবার ডেকে দাও। চরণ তাড়াতাড়ি ভজনকে ডেকে নিয়ে এল। ভজন এখনও নেশায় টলমল করছে। এসে বলল, কি বাবা, তুমি টেররিস্টের দলে ভিড়ল?

কিন্তু কথা তার শেষ হওগার আগেই হীরেনের দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল। জোর করে চোখ মেলে বলল, কীরে কী হয়েছে তোর?

লজ্জা, অপমান, ঘৃণা, হীরেন কিছুই মানল না। সে ভজুর দু হাত ধরে ছেলেমানুষের মতো হু হু করে আবার কেঁদে উঠল। টেনে নিয়ে এল ভজুকে মাঝেরঘরে। হ্যাঁ ভজনের কাছেই একমাত্র এমনি করে কাঁদা যায়। কৃপাল নয় শঙ্করদা নয়, কেউ নয়।

ভজু উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, কীরে, মারধোর খেয়েছিস নাকি কোথায়?

হীরেন বলে উঠল, না, না।

তবে?

হীরেন বলল, ভজু, মদ খেলে কী হয়?

ভজন বলল, কেন রে?

হীরেন বলল, বুক জ্বলে? বুদ্ধি হারায়?

বিস্মিত হয়ে ভজু বলল, বুদ্ধি হারায় কি জানিনে। তবে বুক জ্বলে, তারপর নেশা হয়। কিন্তু কেন রে?

হীরেন ব্যাকুল গলায় বলে উঠল, কিছু নয়। আমাকে একটু মদ দে ভাই…দে আমাকে। আমি একটু নেশা করব।

আমাকে দেখছি ফ্যাসাদে ফেলবি।

না, না, ভজু ভাই একটু দে।

ভজন তার সেই কটা চোখের তীব্র চাউনি দিয়ে একবার হীরেনের সর্বাঙ্গ দেখল। হীরেন কেঁপে উঠল সে চাউনি দেখে।

হুঁ! আচ্ছা দিচ্ছি। বলে ভজন তার ভোলা বোতল থেকে মদ ঢেলে দিল গ্লাসে।

হীরেন এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বিকৃত মুখে চোঁ চোঁ করে গিলে ফেলল মদ। তারপর দুহাতে মাথাটা ধরে বসে পড়ল সেখানেই।

ভজন খালি বলল, অবাক করলি হীরেন।

বাইরে ট্যাং ট্যাং করে ক্যানেস্তারা বেজে উঠল। কৃপাল বেরিয়েছে সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে। চেঁচাচ্ছে, ভোট ফর সারদা চৌধুরী।

একদল খদ্দের মেতে উঠেছে গোলক চাটুজ্যে মশাইকে নিয়ে।

বিস্ময়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটোছুটিকরছে ছোকরা পুলিশ অফিসার। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে শ্ৰীমতী কাফের দিকে। এখানে সেখানে ঘাপটি মেরে রয়েছে গুপ্তচরেরা। কোথায় সে। সেই পাখি কোথায় উড়ে গেল। কোনদিকে। অর্থাৎ নারায়ণকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ আসেনি প্রিয়নাথ, রথীন, সুনির্মলেরা।

রাত্রি এগারোটার পর হীরেন বেরিয়ে এল পেছনের ঘর থেকে। ভজনের কথামতো ভুনু তুলে নিল তাকে গাড়িতে, বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এখন যেমন ভুনুর অবস্থা, তেমনি তার রাজা রানীর। চলেছে টুক টুক করে। আর বিস্মিত বিরক্ত হয়ে ভুনু ভাবছে, এ শালা বাবুগুলোর কী হয়। কেতাব পড়ে, সুতো কাটে আর সারাদিন বসে থাকে চা খানায়। মাঝে মাঝে আপদের মতো সরাপের সোকানে সরাপ বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। জেল খাটে। জোয়ান বয়সের মরদ, বাপের পয়সা আছে, বাপু বিয়ে শাদি কর। ঘর আগলাও। তা নয়, জিন্দিগি ফালতু কাটাচ্ছে।

বৃথাই সব করেছে জীবনে? সে কথাই ভাবলি হীরেন গাড়ীর গায়ে মাথাটা এলিয়ে। তবে কি সবই শেষ হল। এখন লজ্জায় সে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কেন সে মদ খেতে গেল? অবিবেচকের মতো সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়েছিল, তার শাস্তি তাকে পেতে হয়েছে। সে অনুভব করছে, ওই ঝাড়দার মানুষগুলির চরিত্র সে মোটেই বুঝতে পারেনি। সে বুঝতে পারেনি রামার মতো মেয়ে-চরিত্রকে। এখনও পারছে না।

তা বলে বিশ্বাস হারাতে হবে? মাথা তুলে বসল হীরেন। না, সে বিশ্বাস হারাবে না। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। গান্ধীজির কথা মনে পড়ছে তার। অসহিষ্ণু হলে তার চলবে না। আজ যারা তাকে লাঞ্ছিত করেছে, তারা ভুল করেছে। এমনি করেই তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে অনাচারের পথ থেকে, দিতে হবে শিক্ষা।

তবে এ লাঞ্ছনার উপর আবার সে কেন মদ খেয়ে তা বাড়াতে গেল। ছি ছি, ভজন না জানি মনে মনে কত কী ভাবছে আর হাসছে। হাসছে চরণ আর ভুনু গাড়োয়ান।

কিন্তু রামার মুখটা যতবার মনে আসছে, ততবার কচি শিশুর মতো তার কান্না পাচ্ছে। সে চলে আসতে চেয়েছিল তার সঙ্গে। কোথায় নিয়ে আসবে তাকে হীরেন। তা তো সম্ভব নয়। কিন্তু রামা যদি অনাচারের পথে পাপের পথে ভেসে যায়, দু-চোখ দিয়ে হীরেন তা কেমন করে দেখবে।

মস্তবড় পুরনো বাড়ির ফটকের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়াল। বাড়ি তো নয়, অন্ধকারে যেন একটা ভুতুড়ে পুরী। নিঃশব্দ। বাইরে থেকে মনহেয়, তোক নেই। কিন্তু লোক ঠাসা।

হীরেন নেমে বলল, ভুনু কাল তোমার ভাড়াটা নিয়ো।

যব্‌ আপ কা মরজি। গাড়ি আলস্যভরে মোড় ঘুরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *