৬. এ খাতাটি ১৯৬৭ সালে লেখা

[এ খাতাটি ১৯৬৭ সালে লেখা। ১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা দায়ের করেছে আইয়ুব-মোনায়েম সরকার। একটি ছোট্ট বাঁধানো খাতা। ২৪০ পৃষ্ঠার। তাঁর কারাগারের জীবনযাপন, ব্যক্তিগত ভাবনা, পারিবারিক কথা ছাড়াও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক কথাই এ খাতায় লিখেছেন।]

১লা জানুয়ারি২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭

শরীরটা খারাপ নিয়ে নতুন বৎসর শুরু। চোখের অসুখে ভুগছিলাম, এখন একটু আরামের দিকে। পায়ে একটা ফোড়া হয়েছিল। এখন এটা কারবানক্যল হয়ে গেছে। ৬/৭ তারিখে জেলগেটে মামলা হবে। হাঁটতে পারি না, তবুও যেতে হবে। কারণ ডাক্তার সাহেব ও সিভিল সার্জন সাহস পায় না আমাকে অসুস্থ ঘোষণা করতে। যদি সরকার রাগ হয়, বদলি করে দেয়। বললাম, স্ট্রেচার নিয়ে আসুন, যাবো। স্ট্রেচার প্রস্তুত, হাকিম শুনে তো অস্থির। স্ট্রেচারে এনে মামলা করলে হৈ চৈ হয়ে যাবে। তাই হাকিম সাহেব আমার এডভোকেট সালাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে মামলার শুনানি বন্ধ করে দিলেন। আমাকে আর গেটে নেওয়া হলো না। কারবানক্যল সারতে বেশ কয়েকদিন লাগল। ৭/৮ দিন প্রায় শুয়েই কাটালাম।

১১ তারিখে রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নিবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদ্যাপন কর।

এই ঈদটা আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার আব্বা ও মায়ের কাছে বাড়িতেই করে থাকি। ছোট ভাই খুলনা থেকে এসেছিল আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। কারণ কারও কাছে শুনেছিল ঈদের পূর্বেই আমাকে ছেড়ে দিবে। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নাই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট তাই এখনও বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভাল না, কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এলে রাসেল আমাকে মাঝে মাঝে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। আমিও বেশি আলাপ করতে পারলাম না শুধু বললাম, “চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে। ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রেণুকে বললাম, বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে।

রাত্র ১০টায় হৈ চৈ, আগামীকাল ঈদ হবে।

১২ই সকালবেলা জেলের মধ্যে ঈদ হবে, কারণ সরকারের হুকুম। অনেক সিপাহি ও জেল কর্মচারী রোজা ভাঙতে রাজি হয় নাই। তবে কয়েদিদের নামাজ পড়তেই হবে, ঈদ করতেই হবে। শুনলাম পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি লোক চাঁদ দেখেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নতি হলে পূর্ব বাংলার উন্নতি হয়! হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে চাঁদ দেখেছে, এখানে নামাজ পড়তেই হবে। আমাদের আবার নামাজ কি! তবুও নামাজে গেলাম, কারণ সহকর্মীদের সাথে দেখা হবে। এক জেলে থেকেও আমার নিজের দলের নেতা ও কর্মীদের সাথে দেখা করার উপায় নাই। আমি এক পার্শ্বে আর অন্যান্যরা অন্য পার্শ্বে। রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা করে রাখা হয়।

২ নম্বর ব্লকে শ্রমিক কর্মীদেরই বেশি রাখা হয়েছে। নামাজের আগে রুহুল আমিন, সহিদ (তেজগাঁও), আদমজীর সফি আরও অনেকে ছুটে এল আমার কাছে। শাহজাহানপুরে আমার সহকর্মী আবদুল কাদের ব্যাপারীর ছেলেকেও ধরে এনেছে। তার নাম সিদ্দিক। প্রেসে নাকি কি কাগজ ছাপাইয়াছে। ন্যাপের হালিম, ভাগ্নে মণি পুরানা হাজত থেকে তারা এসেছে। এক জেলে থাকি আমার ভাগ্নে আমার সাথে দেখা করতে পারে না। কি বিচার।

১০ সেল থেকে শামসুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল, মহীউদ্দিন (খোকা), সিরাজ, হারুন, সুলতান এসেছে। দেখা হয়ে গেল, কিছু সময় আলাপও হলো। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী। রফিকুল ইসলাম, বজলুর রহমান ও শাহ মোয়াজ্জেম নামাজে আসে নাই।

আমার কাছাকাছিই থাকে ছাত্রলীগ কর্মী নূরে আলম সিদ্দিকী ও খুলনার কামরুজ্জামান, ছাত্র ইউনিয়নের রাশেদ খান মেনন এবং আওয়ামী লীগের নূরুল ইসলাম। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতারও আছেন। আমার পায়ে ব্যথা, তাই বসে বসেই মিললাম সকলের সাথে। কারাগার থেকেই দেশবাসী ও সহকর্মীদের জানাই ঈদ মোবারক। পূর্ব বাংলার লোক সেইদিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে, এবং দেশের সত্যিকারের নাগরিক হতে পারবে।

নামাজ আমাদের আজই পড়তে হয়েছে। বাড়ির থেকে খাওয়া-দাওয়া কিছুই আসে নাই। কারণ বাইরের লোক তো আমাদের মত বন্দি না, তারা ১৩ তারিখেই ঈদ করবে। ১৩ তারিখেই শতকরা ৯০ জন লোক ঈদ করেছে। কিন্তু কারাগারে খাওয়ার বন্দোবস্তও ১২ তারিখেই হয়েছে।

আজ ১৩ তারিখ খবর পেলাম ঢাকায়ও আজ নামাজ হয়েছে। অনেকেই নামাজ পড়েছে। জেল কর্মচারীরা আজই দেখা করতে এসেছে। তাদের কথা হলো চাকরি করে বলে নামাজও সরকারের ইচ্ছায় পড়বে নাকি?

আজ ১০ সেল থেকে খাবার এসেছে আমাদের জন্য, ২৬ সেলের নিরাপত্তা বন্দিরাও পাঠাইয়াছেন। আমার তো কিছু করার উপায় নাই, একলা মানুষ, এক জায়গায় থাকি। রোজ পাঁচ টাকা দেয়, ৪/৫ জন লোক নিয়ে খেতে হয়, টাকা বাঁচাব কি করে? তাই কিছুই করি নাই। দেখি ১১টার সময় বেগম সাহেবা খাবার পাঠাইয়াছে। কিছু কিছু অন্যান্য জায়গায় পাঠাইলাম। যার যা ছিল পুরানা ২০ সেলের রাজবন্দিদের নিয়ে আজ এক জায়গায় বসে খাব, বলে দিলাম। আইন আজ আর মানি না। তাই সকলকে নিয়ে আমার জেলখানার ঘরে বিছানা পেতে এক সাথে খেলাম। যে ৬০/৭০ জন কয়েদি সেল এলাকায় ছিল তাদেরও কিছু কিছু দিলাম। পান সিগারেট আনাইয়া রেখেছিলাম। কয়েদিরা আমার সাথে যারা দেখা করতে এসেছিল তাদেরও দিলাম। ৪০ সেলের পাগল ভাইদের কিছুই দিতে পারলাম না, সংখ্যায় তারা প্রায় ৭০ জন। সরকার টাকা আনতে দেয় না রাজবন্দিদের। ফল ফলাদিও বন্ধ। তবুও ঠিক করেছি ওদের কিছু আনাইয়া খাওয়াতে হবে। কয়েদিদের ‘পোলাও দিয়েছিল। মুখে দিয়ে দেখলাম পোলাও না, একটু ভাল করে রান্না ভাত। অনেক দিন ধরে কয়েদির খাবার খরচের থেকে টাকা বাঁচাইয়া একদিন ভাল খাওয়াবে। কি আর বলব, চোরের টাকা চুরি করে খায় আজকাল আমাদের মেসের কিছু কিছু কর্মচারী। পূর্বেও জেলে ছিলাম একটা চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন তার বালাই নাই। লুট চলেছে, কেউই দেখার নাই। এক কয়েদি আমাকে বলল, “দেখুন স্যার আমরা চোর, পেটের দায়ে চুরি করে জেলে এসেছি, আর আমাদের খাবার থেকে চুরি করে খেয়ে কেমন মোটা হয়েছে জেলের কিছু কর্মচারী।” আমি বললাম, “সকলে তো চুরি করে না। সে বলল, “যার হাতে আছে সেই চুরি করে খায়।” আমার বুঝতে বাকি রইল না কাকে বলছে।

১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে। বাইরে সকলেই ১৩ তারিখে ঈদ করেছে। ঈদের আনন্দ তো বন্দিদের থাকতে পারে না। তারপর আবার রেণু এক দুঃখের সংবাদ আমাকে জানাল। আমার ফুফাতো ভাই, ক্যান্সার হয়েছিল, মারা গিয়াছে। মাদারীপুরে বাড়ি—ছোট বেলায় আমার ফুফা ও ফুফু মারা যান, আমার আব্বাই ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমরা এক সাথেই ছিলাম। সিভিল সাপ্লাই অফিসে সামান্য চাকরি করত। কয়েকটা ছেলেমেয়ে রেখে গিয়াছে, জমিজমা যা ছিল প্রায়ই আড়িয়াল খাঁ নদী গ্রাস করে নিয়েছে। কি করে এদের চলবে? ছেলেমেয়েগুলি ছোট ছোট।

সময় কেটে গেল, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি এসে শুয়ে পড়লাম, আর ভাবলাম এই তো দুনিয়া! রাত কেটে গেল, খাওয়া-দাওয়া ভাল লাগল না। ছোট বেলায় আমি আর আমার ফুফাতো ভাই ৭/৮ বৎসর এক ঘরেই থেকেছি। ওর ডাকনাম ছিল তারা মিয়া।

১৫ তারিখে ৪০ সেলের পাগলা গারদের পাগল ভাইদের জন্য নিজেই মুরগি পাক করে পাঠাইয়া দিলাম। আমি না খেয়ে জমাইয়া ছিলাম। আমার যাওয়ার হুকুম নাই ওদের কাছে—যদিও খুবই কাছে আমি থাকি। জমাদার সাহেবকে ডেকে বললাম, আপনি দাঁড়াইয়া থেকে ওদের মধ্যে ভাগ করে দিবেন। তিনি তাই করলেন। ওরা যে আমার বহুদিনের সাথী, ওদের কি আমি ভুলতে পারি? ভুলতে চেষ্টা করলেও সন্ধ্যার পরে ওরা আমাকে মনে করাইয়া দেয়যখন ওরা আপন মনে চিৎকার করে আবার কেউ অদ্ভুত স্বরে গানও গায়।

মহা হৈ চৈ জেলের ভিতর। কারণ জেলের আইজি সাহেব ঢাকা জেল দেখতে আসবেন আগামীকাল। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে কয়েদিদের। চুনা লাগানো হবে। জনাব নিয়ামতুল্লা আইজি হবার পূর্বে এই জেলেই সুপারিনটেনডেন্ট এবং ডিআইজি ছিলেন। তিনি ময়লা আবর্জনা দেখলে ক্ষেপে যান—সকলেই জানে। চমৎকার ব্যবহার, অমায়িক, ভদ্র, কোনো কয়েদি কষ্ট পাক এ তিনি চান না। আমি নিজেই দু’বার তার সময়ে এই জেলে এসেছি। আমার সাথে তার পরিচয় ছিল। এবারও যখন জেলে এসেছি তিনি খবর পেয়েই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি সকল কয়েদিদেরই সুবিধা অসুবিধা দেখতেন। আমার দিকে তিনি ব্যক্তিগত নজর দিতেন। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয়ও করে এবং ভক্তিও করে। কাহাকেও তিনি অন্যায়ভাবে কষ্ট দিতেন না। কয়েদিদের খাওয়া ও কাপড়ের দিকে নজর দিতেন। তিনি জেল দেখতে এসে আমার কাছে এলেন, বসলেন। আমার কিছু বলার আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি সাধারণত কিছু বলি না, কারণ নিজের ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারলেই বেঁচে যাই। আমি বললাম, ভালই আছি। ডিপিআরের রাজনৈতিক বন্দিদের অসুবিধার কথা বললাম। ’এ’ ‘বি’ ‘সি’ ভাগ না করে এক ক্লাশই করলে ভাল হয়। প্রায় সকলকেই সি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। দেড় টাকায় কি করে চলতে পারে খাবার, নাস্তা, চা ইত্যাদি। আবার কিছুই বাড়ি থেকে আনতে দিবে না। মাসে পাঁচ টাকা দেয় কাগজ, দাঁতন, সাবান, তোয়ালে ইত্যাদি কিনতে। একটা খবরের কাগজ কিনতে তো ছয় টাকা লাগে মাসে। তার সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও কিছু করার নাই, কারণ সরকারের হুকুম।

পাগলদের ৪০ সেল দেখাইয়া বললাম, দেখেন জেলের মধ্যে কি অবস্থা, আমাদের মত হতভাগাদের কি অসুবিধা হয়। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, কি করা যাবে, এতগুলি পাগল কোথায় রাখব? ব্যবস্থা তো নাই। আমি বললাম, চিন্তা করবেন না, প্রথম বেশ কষ্ট হয়েছিল। এখন সয়ে গেছে। সেলগুলির কথা বললাম। দশ সেল, পুরানা বিশ সেল, নূতন বিশ সেলে রাজনৈতিক বন্দিদের অসুবিধার কথাও বললাম। সাধারণ কয়েদিদের বিষয় আলোচনা হলো। তিনি বললেন, আপনাকে তো একলাই রাখা হয়েছে। বললাম, আপনারা কি করবেন, উপায় নাই যে। বড়কর্তারা’ হুকুম দিয়েছে একাই থাকতে হবে। তিনি বললেন, ‘দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কিনা। তাঁর সহানুভূতি থাকলেই বা কি হবে! পূর্ব বাংলার মোতয়াল্লি সাহেবের নজর বড় খারাপ আমার ও আমার পার্টির কর্মীদের উপর। জেলের ভিতরও যাতে কষ্ট পাই তার চেষ্টা তিনি করেন। আইজি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি আমার বইপড়ার কাজে মন দিলাম।

 

২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ ৮ই ফাল্গুন

আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীর সন্তান : ১। আবদুস সালাম, ২। আবদুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিকউদ্দিন। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। ঠিক পনের বৎসর পূর্বে এইদিনে আমিও জেলে রাজবন্দি ছিলাম ফরিদপুর জেলে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করব আর ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে বলে স্থির হয়। আমাকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসা না করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুর জেলে চালান দেওয়া হলো। মহিউদ্দিনও আমার সাথে অনশন করবে স্থির করে দরখাস্ত দিয়েছিল।

আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।

প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেব সহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।

১৫ই মার্চ জনাব নাজিমুদ্দীন (তখন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টার ছিলেন) সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করে ঘোষণা করলেন, পূর্ব পাকিস্তান আইন সভা হতে প্রস্তাব পাশ করাইবেন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে। সকল বন্দিকে মুক্তি দিবেন এবং নিজেই পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত করবেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি পাই।

১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইন সভার সামনে লাঠি চার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে। ২১শে মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। ছাত্ররা তার সামনেই কনভোকেশনে প্রতিবাদ করল। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনোদিন ভাষার ব্যাপারে কোনো কথা বলেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রত্যেক বৎসর ১১ই মার্চকে ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ (এখন আওয়ামী লীগ) এই একই দিনে ভাষা দিবস পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি। পরে ইয়ুথ লীগও আন্দোলনে শরীক হয়েছে।

১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইনসভায় করেছিলেন, ১৯৫২ সালে ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করলেন, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ ২১শে থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরো অনেকে গোপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।

তখন জনাব নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হলো। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল।

এইদিন আমাদের কাছে পবিত্র দিন। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে। শহীদ মিনার করার জন্য পরিকল্পনা করে বাজেটে টাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে এই দিনটি সরকারি ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ল, আর মিনারটা চুনকাম করেই শেষ করে দেওয়া হলো।

আমি কারাগারের এই ছোট্ট ঘরটি থেকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই বাংলার যুব সমাজ ও জনসাধারণকে, আর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি।

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মজহারুল হক (বাকী) জামিন পেয়ে এতদিন জেলের বাহিরে যেতে পারে নাই। আজ সকালে তাকে কোর্টে পাঠাইয়া দিয়েছে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেয়ে শহীদ দিবস পালন করছে।

 

২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ শনিবার

আজ আমার ১১টি মামলার একটা মামলা জেলগেটে, যার বিচার চলছে জনাব আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে; তার আরগুমেন্ট হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হতে পারে নাই। কারণ আমার এডভোকেট জনাব সালাম খান সাহেব এবং জহিরুদ্দিন সাহেব উপস্থিত হতে পারেন নাই। জনাব মাহমুদুল্লা সাহেব হাজির হয়ে দরখাস্ত করেছিলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম। ডিএসপি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার আর একটি মামলা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হবার কথা, কখন শুরু হবে? তিনি বললেন, সরকার নতুন এডিএম নিযুক্ত করেছেন, শীঘ্রই জেলগেটেই শুরু হবে। আমার এডভোকেট মাহমুদুল্লা সাহেব নোটিশ পেয়েছেন আমাকে হাজির করাবার জন্য। তিনি বলেছেন, আসামি কারাগারে সরকারের তত্ত্বাবধানে আছেন। সরকার ইচ্ছা করলেই হাজির করতে পারেন।

আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে মামলার দিন ঠিক হয়েছে মার্চ মাসের ১৮ তারিখে। যাহা হউক, এই মামলা দুই মাসের মধ্যেই যা হয় একটা হয়ে যাবে। আবার নতুন মামলা শুরু হবে। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বললাম, চিন্তা করি না; ১১টা মামলা, চিন্তা করে কি হবে? গা ভাসাইয়া দিয়াছি। ‘সাগরে শয়ন যার শিশিরে কি ভয় তার।‘

ভেবেছিলাম বড় ছেলেটি আসবে, বাসার খবর পাব। বোধ হয় আসতে পারে নাই। এ সপ্তাহে বাড়ির থেকে দেখাও’ আসে নাই। বোধ হয় অনুমতি পায় নাই।

 

১লা মার্চ ১৯৬৭ বুধবার

গতকল্য মোলাকাত হয়েছে ছেলেমেয়েদের সাথে। শরীরটা যে ভাল যেতেছে না একথা বললাম না—গোপন করলাম যাতে চিন্তা না করে। কারাগারে দিনগুলি কেটে যেতেছে। বই পড়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় নাই। খবরের কাগজ আর বই। খবরের কাগজগুলি খুললে শুধু আইয়ুব খান সাহেব ও মোনায়েম খান সাহেবের বক্তৃতা ! মোনায়েম খান সাহেব তো রোজই একটা করে বিবৃতি অথবা বক্তৃতা দেন। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী সাহেবকে পরাজিত হতে হয়েছে মোনায়েম খান সাহেবের কাছে। এককালে খবরের কাগজে ভাসানী সাহেবকে পাওয়া যেত এখন খান সাহেবকে পাওয়া যায়। পূর্ব বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি যিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবের কাছ থেকে নিয়োগ পত্র পেয়েছেন।

 

১৬ই মার্চ ১৯৬৭ বৃহস্পতিবার

পাবনায় ভুট্টা খাওয়া নিয়ে ভীষণ গোলমাল চলেছে। প্রায় তিনশত লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। একজন লোক মারা গিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ভূতপূর্ব মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ভূতপূর্ব এমএনএ জনাব আমজাদ হোসেন, জনাব আমিনউদ্দিন, আওয়ামী লীগ শ্রমিক নেতা আমজাদ হোসেন উকিল আরও বহুনেতা ও ছাত্র কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ত্রাসের রাজত্ব চলেছে সেখানে। অত্যাচার চরমে উঠেছে। ঘরে ঘরে যেয়ে অত্যাচার করছে। পূর্ণ সঠিক খবর এখনও পাই নাই।

 

১৭ই মার্চ ১৯৬৭ শুক্রবার

আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’! দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সাথে দেখা করতে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম—আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি শাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।

 

আমি থাকি দেওয়ানী ওয়ার্ডে আর এরা থাকেন পুরানা বিশ সেলে। মাঝে মাঝে দেখা হয় আমি যখন বেড়াই আর তারা যখন হাঁটাচলা করেন স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য।

খবরের কাগজ পড়া শেষ করতে চারটা বেজে গেল। ভাবলাম দেখা আসতেও পারে। ২৬ সেলে থাকেন সন্তোষ বাবু, ফরিদপুরে বাড়ি। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী দলে ছিলেন, বহুদিন জেলে ছিলেন। এবারে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে জেলে এসেছেন, ৮ বৎসর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রায় ১৭ বৎসর জেল খেটেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল হাসপাতালে প্রায়ই আসেন, আমার সাথে পরিচয় পূর্বে ছিল না। তবে একই জেলে বহুদিন রয়েছি। আমাকে তো জেলে একলাই অনেকদিন থাকতে হয়েছে। আমার কাছে কোনো রাজবন্দিকে দেওয়া হয় না। কারণ ভয় তাদের আমি খারাপ করে ফেলব, নতুবা আমাকে খারাপ করে ফেলবে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ২৬ সেলে যাবেন। দরজা থেকে আমার কাছে বিদায় নিতে চান। আমি একটু এগিয়ে আদাব করলাম। তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।

আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না। আমার ছেলেমেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও’।

ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না।

ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।

 

১৮ই মার্চ, ১৯৬৭ শনিবার

জেলগেটে আমার দ্বিতীয় মামলার সওয়াল জবাব হবে। ১০ ঘটিকা হতে বসে আছি প্রস্তুত হয়ে। ১২টার সময় আমাকে জেলগেটের কোর্টে নিতে এসেছে। যেয়ে দেখি জহির সাহেব, রব সাহেব, মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন, জোহা চৌধুরী প্রমুখ এডভোকেট সাহেবরা এসে বসে আছেন হাকিমের সামনে।

আমার আত্মীয়স্বজন ছাড়াও মোস্তফা আনোয়ার, চৌধুরী নিজাম, আলি হোসেন ও কর্মীরাও এসেছে। ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা রেজাও এসেছে। ছাত্রলীগের নির্বাচন নিয়ে খুবই গোলমাল।

শুধু অনুরোধ করলাম, ‘তোমরা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিও। ছাত্রলীগকে ভেঙে ফেলে দিও না। সকলকে আমার সালাম দিও। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান আমি গড়েছিলাম কয়েকজন নিঃস্বার্থ ছাত্রকর্মী নিয়ে। প্রত্যেকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, রাজবন্দিদের মুক্তি আন্দোলন, ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বহু জেল-জুলুম সহ্য করেছে এই কর্মীরা। পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পুরাভাগে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলমাল হলে আমার বুকে খুব আঘাত লাগে। তাই রেজাকে বললাম, ‘প্রতিষ্ঠান রক্ষা করিও’।

মামলা আজ আর চলবে না। কারণ সরকার পক্ষের উকিল সাহেব অসুস্থ উপস্থিত হতে পারেন নাই। কোর্টে শুনলাম আমার বিরুদ্ধে ঢাকার পাঁচটি মামলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় ছয়টি মামলা দায়ের করেছে সরকার-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা ও যশোরে। চার্জ শীটও নাকি দিয়েছে। যাহা হউক, প্রস্তুত আছি। হাইকোর্ট থেকে শাহ মোয়াজ্জেমকে ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্রকর্মী, কোর্টের থেকে খবর নিয়ে এসেছে হাইকোর্টে তাকেও ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়েছে। এডভোকেট রব সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন, হাইকোর্ট এখনও ওর মামলার রায় দেয় নাই। ছেলেটা বাইরে যাবে বলে কত খুশি হয়েছে। আট মাস মিছামিছি ওকে ডিপিআর আইনে বন্দি করে রেখেছে। ওর ধারণা একটা মামলা ঢাকা কোর্টে আছে, জামিন পেলেই বাইরে যেতে পারবে। আমাকে বলেছিল, ওর বাবা বসে আছেন ঢাকায়, মুক্তির পরে ওকে নিয়ে বাড়ি যাবেন ঈদ করতে। আগামী ২২ তারিখ ঈদ। কি বলব ওকে ভিতরে যেয়ে। ভাবলাম, ধোঁকা দেওয়া ভাল হবে না। বলেই দেই সত্য কথা। জেলের ভিতরে যেয়ে ওকে খবর দিলাম, তুমি ভুল শুনেছ, তোমার মামলার রায় হয় নাই, ঈদের পরে হবে। মুখটা ওর কালো হয়ে গেল। মনে হলো খুবই আঘাত পেয়েছে। দিন কেটে গেল। রাত্র আটটায় হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে, ‘মুজিব ভাই’, ‘মুজিব ভাই’ বলে। জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি শাহ মোয়াজ্জেম। বললাম, কি ব্যাপার তুমি এখানে? ‘ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়েছি এখন-বিচারাধীন আসামি তাই ১০ সেল থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে। ডিপিআরদের কাছে আমাকে রাখবে না। জমাদার সাহেবকে বললাম, কোথায় রাখবেন? বলল, রাতে আর কোথায় রাখব ২০ সেলে আমার কাছাকাছি। বললাম, কাপড় চোপড় বিছানা আছে?’ বলল, যা আছে চলে যাবে, খাবারও ১০ সেল থেকে রাতের জন্য আসবে। আমার সাথে কথা বলা নিষেধ, তবু রাস্তা যখন পড়েছে আমার ঘরের কাছ দিয়ে তখন মুখে হাত দিয়ে তো বন্ধ করতে পারে না। বললাম, আর চিন্তা কি! মামলা দুইটি আছে, জামিন পেয়েছ, আর দুই একদিন দেরি হতে পারে।

 

২২শে মার্চ ১৯৬৭ বুধবার

আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দি জীবনে ঈদ উদযাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে। বার বার আপনজন বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে।

ইচ্ছা ছিল না নামাজে যাই। কিইবা হবে যেয়ে, কয়েদিদের কি নামাজ হয়। আমি তো একলা থাকি। আমার সাথে কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে থাকতে দেয় না। একাকী কি ঈদ উদযাপন করা যায়? জেলার সাহেব নামাজ বন্ধ করে রেখে আমাকে নিতে আসেন। তাই যেতে বাধ্য হলাম।

মোশতাককে আনা হয়েছে রাজশাহী জেল হতে গত মে মাসে। ঢাকা থেকে পাবনা জেলে বদলি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাজউদ্দীন এখনও ময়মনসিংহ জেলে আটক আছে। মোশতাক, জালাল, মোমিন সাহেব, ওবায়দুর রহমান, সিরাজ, সুলতান নামাজ পড়তে এসেছে ১০ সেল থেকে। মিজানুর রহমান ও নারায়ণগঞ্জের মহিউদ্দিন নামাজে আসে নাই। পুরানা হাজত থেকে মণি, হালিম আরও অনেকে এসেছে।

১/২ ওয়ার্ড থেকে রুহুল আমিন, প্রতাপউদ্দিন সাহেব, আবদুস সালাম খান ও অনেকে এসেছে। সকলের সাথেই দেখা হয়ে গেল। মোশতাকের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। ১০ সেল থেকে নূরুল ইসলাম আমার সাথেই নামাজে যায়। তাকে সিলেট জেল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার টিবি ভাল হয়ে গিয়েছে।

শাহ মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে হেবিয়াস কর্পাস করে মুক্তি পেয়ে হাজতে আছে। তার বিরুদ্ধে দুইটা মামলা আছে। একটি জামিন পেয়েছে আর একটি জজকোর্ট থেকে জামিন পায় নাই। এখন হাইকোর্টে যেতে হবে। শাহ মোয়াজ্জেম একজন এডভোকেট, তার জামিন না দেওয়ার কি কারণ বুঝতে পারলাম না। বাড়ি থেকে খাবার পাঠাইয়াছিল। আমি শাহ মোয়াজ্জেম, নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীকে নিয়ে খেলাম। হ্যাঁ খেতে হবে। রেণু বোধ হয় ভোর রাত থেকেই পাক করেছে, না হলে কি করে ১২টার মধ্যে পাঠাল!

নামাজ পড়ার পরে শত শত কয়েদি আমাকে ঘিরে ফেলল। সকলের সাথে হাত মিলাতে আমার প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগেছিল।

 

২৩শে মার্চ ১৯৬৭৭ই এপ্রিল ১৯৬৭

আজও কারাগারের কয়েদিদের ছুটি। পাকিস্তান দিবস আজ। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস করে। মরহুম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এইদিনে পাকিস্তানকে রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এই দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র তৈয়ার না করার জন্য দুই পাকিস্তানে আজও ভুল বুঝাবুঝি চলছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে। আমি যে ৬ দফা প্রস্তাব করেছি, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তি করে, সে প্রস্তাব করার জন্য আমি ও আমার সহকর্মীরা কারাগারে বন্দি। ইত্তেফাক কাগজ ও প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং মালিক ও সম্পাদক মানিক ভাই কারাগারে বন্দি। এই দাবির জন্যই ৭ই জুন ৭ শত লোক গ্রেপ্তার হয় এবং ১১ জন জীবন দেয় পুলিশের গুলিতে। আমি দিব্যচোখে দেখতে পারছি দাবি আদায় হবে, তবে কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হবে। আজকাল আবার রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন লাহোর প্রস্তাবের দাম নাই। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। এর অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি লোককে বাজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যদি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। চিরদিন কাহাকেও শাসন করা যায় না, যতই দিন যাবে তিক্ততা আরও বাড়বে এবং তিক্ততার ভিতর দিয়ে দাবি আদায় হলে পরিণতি ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে। লাহোর প্রস্তাব আমি তুলে দিলাম : ‘Resolved that it is the considered view of this session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to Muslims unless it is designed on the following basic principle, namely, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted, with such territorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority, as in the North-Western and Eastern Zones of India, should be grouped to constitute Independent States in which constituent units shall be autonomous and sovereign.’

March 23, 1940
Moved by Late A. K. Fazlul Haque

 

আজ ২৫ দিন চটকল শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে এদের ধর্মঘট চলেছে। টঙ্গিতে গোলমাল সৃষ্টি করে আজ শত শত শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়েছে। চারজনকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। ২৫/৩০ জনকে ডিপিআর আইনে বন্দি করেছে আর সবাইকে মামলা দিয়ে হাজতে রেখেছে। চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সম্পাদক আবদুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। কিছুদিন পূর্বেও খাদ্য আন্দোলন করার অপরাধে ন্যাপ সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ দানেশ, সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, সিরাজুল হোসেন খান ও কৃষক নেতা হাতেম আলি খানকে ধরে এনেছে। নতুন বিশ সেলে রাখা হয়েছে। ডিপিআর করে দিয়েছে, বিনা বিচারে বন্দি। জেল-জুলুম, অত্যাচার, গুলি সমানে পূর্ব বাংলায় চলেছে। আইয়ুব খান সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন ২৭শে মার্চ। এপ্রিল মাসের তিন তারিখে ঢাকা থেকে রাজধানীতে ফিরে গিয়াছেন। স্বায়ত্তশাসনের অর্থ তিনি করেছেন পূর্ব বাংলাকে নাকি আলাদা করার ষড়যন্ত্র। তিনি যাহাই বলুন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতেই হবে একদিন। না দিলে ফলাফল খুবই খারাপ হবে। ইতিহাস এই শিক্ষাই দিয়েছে। যখনই জনাব পূর্ব বাংলায় আসেন তখনই তাকে বিরাট অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় লাখ লাখ টাকা খরচ করে। দেখে মনে হয় তিনি বাদশা হয়ে প্রজাদের দেখতে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তান তার দেশ আর পূর্ব বাংলা তার কলোনী। কারণ লাহোর করাচী গেলে তো গেট করা হয় না, মালা কিনে বিলি করা হয় না। ট্রাক, বাস ভরে ভাড়াটিয়া লোক নেওয়া হয় না। তিনি দুনিয়াকে দেখাতে চান তাঁর জনপ্রিয়তা। কিন্তু জনগণের ভোটে ইলেকশন হলে পূর্ব বাংলায় তার জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হত একথা তিনি বুঝেও বুঝতে চান না।

পূর্ব বাংলার মাটিতে বিশ্বাসঘাতক অনেক পয়দা হয়েছে, আরও হবে, এদের সংখ্যাও কম না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের স্থান কোথায় এরা দেখেও দেখে না! বিশেষ করে একদল বুদ্ধিজীবী যেভাবে পূর্ব বাংলার সাথে বেঈমানী করছে তা দেখে আশ্চর্য হতে হয়।

সামান্য পদের বা অর্থের লোভে পূর্ব বাংলাকে যেভাবে শোষণ করার সুযোগ দিতেছে দুনিয়ার অন্য কোথাও এটা দেখা যায় না। ছয় কোটি লোক আজ আস্তে আস্তে ভিখারি হতে চলেছে। এরা এদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথাও চিন্তা করে না।

কয়েকদিন পূর্বে খবর পেয়েছিলাম আব্বা খুবই অসুস্থ। আমার ভাই তাঁকে খুলনায় নিয়ে এসেছে চিকিৎসা করাতে। একটু আরোগ্যের দিকে চলেছে। আমার ভাই সরকারকে টেলিগ্রাম করেছে আমাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে ছেড়ে দিতে, কারণ আব্বা আমাকে দেখতে চান। ৮০ বৎসরের উপরে বয়স। আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন। আমি জানি না আমার মত এত স্নেহ অন্য কোনো ছেলে পেয়েছে কিনা! আমার কথা বলতে আমার আব্বা অন্ধ। আমরা ছয় ভাই বোেন। সকলে একদিকে, আমি একদিকে। খোদা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে, কিন্তু আমার আব্বা-মার অসুস্থতার কথা শুনলে আমি পাগল হয়ে যাই, কিছুই ভাল লাগে না। খেতেও পারি না, ঘুমাতেও পারি না। তারপর আবার কারাগারে বন্দি। আমি কারাগারে বন্দি অবস্থায় যদি আমার বাবা বা মায়ের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে সহ্য করতে পারব কিনা জানি না। এখন আমার ৪৭ বত্সর বয়স, আজও আব্বা ও মায়ের গলা ধরে আমি আদর করি, আর আমাকেও তারা আদর করেন। খোদাকে ডাকা ছাড়া কি উপায় আছে।

৬ই এপ্রিল থেকে আমার বড় ছেলে কামাল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিল।

আমি সরকার বা আইজির কাছে কোনো দরখাস্ত সচরাচর করি না। আব্বার খবর জানবার জন্য একটা বিশেষ দেখার অনুমতি চেয়েছিলাম আমার স্ত্রীর সাথে। আজ সাত তারিখ, কোনো খবর নাই।

১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকবার এবং অনেকদিন জেল খেটেছি। এবার জনাব মোনায়েম খান যে ব্যবহার করেছেন এরূপ ব্যবহার আগে কেহই করেন নাই। রীতিমত অপমান করেছেন আমাদের। মার্শাল ল’এর সময়ও এ ব্যবহার পাই নাই। খোদা করলে বেঁচে আমি থাকব এবং মোনায়েম খান। সাহেবের সাথে নিশ্চয়ই ‘দেখা’ হবে।

আজ কয়েকদিন পর্যন্ত পাগলের উৎপাতে ঘুমাতে পারি না। যেখানে থাকি তার থেকে মাত্র ৪০ হাত দূরে ৪০ জন পাগল রাখা হয়েছে। আর আমার খাটের থেকে তিন হাত ও ছয় হাত দূরে নিউ বিশ সেলে দুইটা লোহার টিন দিয়ে ঘেরা বড় কপাট। রাতে দুই ঘণ্টা পর পর সিপাহি বদলী হয় আর বিকট শব্দ করে আমার ঘুম ভেঙে দেয়। অনেকদিন সারারাত ঘুমাতে পারি না। আবার কোনো কোনো দিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এ জন্য প্রায়ই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়। জেল কর্তৃপক্ষকে বলেছি সিপাহিরা যাতে শব্দ না করে তার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাগল নিয়ে কি করবেন? তারা তো ভয় পায় না।

 

৮ই এপ্রিল১০ই এপ্রিল ১৯৬৭

আজ জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তৃতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জহিরউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। সরকারি উকিল জনাব মেজবাহউদ্দিন সরকারের পক্ষে করেন। প্রায় চার ঘণ্টা চলে। ৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তার উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশরক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেককিছু।

আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমার বুকে ব্যথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে না! আমার সম্পদ ছলে বলে কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা-বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি এখন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।

দেশরক্ষা আইনে বিচার হয়েছে। এই একই ধরনের বক্তৃতার জন্য ডজন খানেক মামলা দায়ের করা হতেছে। মামলার কিছুই নাই, আমাকে জেল দিতে পারে না। যদি নিচের দিকে জেল দিতে বাধ্য হয় তবে জজকোর্ট ও হাইকোর্টে টিকবে না। সহকর্মী অনেকে এসেছিল, দেখা হলো। কামাল এসেছিল। বলল, পরীক্ষা ভাল দিয়েছে। আব্বা খুলনায় আমার ভাইয়ের বাসায় চিকিৎসাধীনে আছেন। একটু ভালর দিকে। এখনও আরোগ্য লাভ করেন নাই। মাও সাথে আছেন।

সালাম সাহেবের সাথে আরো দুইটা মামলা ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। পাবনায় জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর চরম অত্যাচার চলছে। আওয়ামী লীগের সকল নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। জামিন দেওয়া হয় নাই। সালাম সাহেব নিজে গিয়েছিলেন জামিন নিতে। তাঁকে দেখা করতে দেয় নাই বন্দিদের সাথে।

 

১১ই এপ্রিল১৩ই এপ্রিল ১৯৬৭

শাহ মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে ডিপিআর আইনে মুক্তি পেলেও একটা মামলায় জামিন না পাওয়ার জন্য জেলে সাধারণ কয়েদি হয়ে কষ্ট পেতেছে। বক্তৃতার মামলায় সেশন জজ সাহেবও জামিন দেন নাই। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আর্জি পেশ করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত শুনানি হয় নাই। বড় দুঃখ করছিল, বলছিল সহকর্মীরা একটু চেষ্টা করলেই জামিন হয়ে যেত। পুরানা বিশ সেলে আছে। আমার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। সে নিজেও একজন এডভোকেট। তার অন্যান্য এডভোকেটদের উপর দাবি বেশি।

আমার ওয়ার্ডটার নাম সিভিল ওয়ার্ড। ৪০ হাত দূরের পুরানা ৪০ সেলকে পাগলা গারদ বলা হয়। দিনে প্রায় ৭০ জন আর রাত্রে ৩৭ জন পাগল থাকে। ৩৭টা সেলের তিনটা সেল নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন ধরে পাগলরা রাতে খুব চিৎকার করতে শুরু করেছে। দিনের বেলায় আমি ঘুমাই না, রাতে যাতে ঘুম হয়। কিন্তু পাগলদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যাই। রাতে মাঝে মাঝে বসেও থাকতে হয়। জেল কর্তৃপক্ষকে কি বলব? পাগল রাখবার জায়গা আর নাই।

সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আম গাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। আবার কোথায় দিবে ঠিক কি? রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকবো না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়। আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।

১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাখি দুইটা আসত। এবার এসে তাদের কথা আমার মনে আসে, আমি খুঁজতে শুরু করি। এবারও ঠিক একই সময় দু’টা হলদে পাখি এখানে আসত। মনে হয় ওদেরই বংশধর ওরা। তারা বোধ হয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও চলে গিয়াছে। ১০টা-১১টার মধ্যে ওদের কথা এমনি ভাবেই আমার মনে এসে যায়। চক্ষু দুইটা অমনি গাছের ভিতর নিয়া ওদের খুঁজতে থাকি। কয়েকদিন ওদের দেখতে পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল? আর কি ওদের আমি দেখতে পাব না? বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে। যে কয়েকটা কবুতর আমার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখানে বাচ্চা দেয়। কাউকেও আমি ওদের ধরতে দেই না। সিপাহি জমাদার সাহেবরাও ওদের কিছু বলে না। আর বাচ্চাদেরও ধরে নিয়ে খায় না। বড় হয়ে উড়ে যায়। কিছুদিন ওদের মা-বাবা মুখ দিয়ে খাওয়ায়। তারপর যখন আপন পায়ের উপর দাঁড়াতে শিখে এবং মা-পায়রার নতুন ডিম দেওয়ার সময় হয় তখন ওই বাচ্চাদের মেরে তাড়াইয়া দেয়। আমি অবাক হয়ে ওদের কীর্তিকলাপ দেখি।

কাকের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। আমার সামনের আম গাছ কয়টাতে কাক বাসা করতে আরম্ভ করে। আমি বাসা করতে দেব না ওদের। কারণ ওরা পায়খানা করে আমার বাগান নষ্ট করে, আর ভীষণভাবে চিৎকার করে। আমার শান্তি ভঙ্গ হয়। আমি একটা বাঁশের ধনুক তৈয়ার করে মাটি দিয়ে গুলি তৈয়ার করে নিয়েছি। ধনুক মেরেও যখন কুলাতে পারলাম না তখন আমার বাগানী কাদের মিয়াকে দিয়ে বার বার বাসা ভেঙে ফেলি। বার বারই ওরা বাসা করে। লোহার তার কি সুন্দরভাবে গাছের সাথে পেঁচাইয়া ওরা বাসা করে। মনে হয় ওরা এক এক জন দক্ষ কারিগর, কোথা থেকে সব উপকরণ যোগাড় করে আনে আল্লাহ জানে! পাঁচটা আম গাছ থেকে ৫/৭ বার করে বাসা ভেঙে ফেলি, আর ওরা আবার তৈরি করে। ওদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখে মনে মনে ওদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হই। তিনটা গাছ ওদের ছেড়ে দিলাম—ওরা বাসা করল। আর একটা গাছ ওরা জবর দখল করে নিল। আমি কাদেরকে বললাম, “ছেড়ে দেও। করুক ওরা বাসা। দিক ওরা ডিম। এখন ওদের ডিম দেওয়ার সময়-যাবে কোথায়?”

এই সমস্ত বাসা ভাঙবার সময় আমি নিজে ধনুক নিয়ে দাঁড়াতাম আর গুলি ছুঁড়তাম। ভয় পেয়ে একটু দূরে যেয়ে চিৎকার করে আরো কিছু সঙ্গী সাথী যোগাড় করে কাদেরকে গাছেই আক্রমণ করত। দুই একদিন শত শত কাক যোগাড় করে প্রতিবাদ করত। ওদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি।

এখন চারটা বাসায় ডিম দিয়েছে। একটা বাসায় বসে থাকে আর একটা পাহারা দেয়। দাঁড়কাক ওদের শত্রু। দুই পক্ষের যুদ্ধও দেখেছি। তুমুল কাণ্ড! ছোট কাকদের সাথে শেষ পর্যন্ত পারে না। দাঁড় কাক যুদ্ধ ভঙ্গ করে পালাইয়া যায়। বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে যদি দাঁড়কাকদের মত শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তবে নিশ্চয়ই তারাও জয়লাভ করত। তাই কাকের অধ্যবসায়ের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখে আমার মনে দুঃখও হয়েছে, কারণ আমার ঘর ভেঙেই তো আমাকে কারাগারে বন্দি করে রেখে দিয়েছে।

কিছুদিন পর্যন্ত কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত, ভাবত আমি বুঝি ওদের ঘর ভাঙবো। এখন আর আমাকে দেখলে ওরা চিষ্কার করে প্রতিবাদ করে না, আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।

১৩ তারিখে আমার ১৯৬৪ সালের আর একটা মামলা শুরু হয়েছে জেলগেটে। এটাও পল্টনের বক্তৃতার মামলা। ঢাকার এডিসি মিঃ খানকে সরকার স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিয়োেগ দিয়েছে। এটা ১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা। জেলগেটে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসেছিলেন। আমিও হাজির হয়েছিলাম। শুধু এডভোকেট মাহমুদুল্লা সাহেব এসেছিলেন। জহির, আবুল কেহই প্রথমে আসতে পারে নাই। আমি দরখাস্ত করতে বললাম। মামলা আজ হতে পারবে না কারণ আমার এডভোকেট সাহেবরা আজ আসতে পারবেন না।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আগামী ২২/৪/৬৭ তারিখে দিন ঠিক করে চলে গেলেন, ঠিক তার দুই মিনিট পরে জহির সাহেব এলেন।

নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোস্তফা, কামাল এসেছিল। কামাল পরীক্ষা ভালই দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। আব্বা একটু ভালর দিকে চলেছেন। কিছু সময় কথাবার্তা বলে আমার পুরানা জায়গায় ফিরে এলাম। খোন্দকার মোশতাক জেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার শরীর খুবই খারাপ। আমার জায়গা থেকে আমি দেখলাম মোশতাক হাসপাতালের বারান্দায় চেয়ারে বসে রয়েছে। চেনাই কষ্টকর। বেচারাকে কি কষ্টই না দিয়েছে! একবার পাবনা, একবার রাজশাহী একবার ঢাকা জেল।

 

১৪ই এপ্রিল১৫ই এপ্রিল ১৯৬৭

১৪ তারিখে ১৫ দিন পরে ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎ পেলাম। একটা দরখাস্ত করেছিলাম বিশেষ দেখার অনুমতি চেয়ে, ডিআইজি সাহেব অনুমতি তো দেনই নাই, জবাব দেওয়াও দরকার মনে করেন নাই। কারও কাছে দরখাস্ত আমি খুব একটা করি না, কারণ উত্তর না দিলে আত্মসম্মানে বাধে। আব্বা অসুস্থ তার সংবাদ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। সেকথাও লিখেছিলাম। বহু জেল খেটেছি এ অবস্থা কোনোদিন দেখি নাই। সকলেই বলে কি করব? উপরের চাপ। অর্থাৎ লাট সাহেবেরা নিষেধ করে দিয়েছেন। লাট সাহেব দেখার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন এ কথা কে বিশ্বাস করবে?

আজকাল শাসন ব্যবস্থা যা হয়েছে, হলে হতেও পারে। জানি না সত্য কি মিথ্যা তবে কানে এসেছে জনাব মোনেম খান সাহেব নাকি হুকুম দিয়েছেন আওয়ামী লীগ বিশেষ করে আমার কোনো ব্যাপার হলে তাকে খবর দিতে হবে এবং অনুমতি নিতে হবে। চীফ সেক্রেটারী বা সেক্রেটারী সাহেবও কোনো কিছুর অনুমতি দিতে পারেন না। ১৪ দিন পরে একদিন দেখা আইনে আছে, তাই বোধ হয় তিনি বন্ধ করেন নাই মেহেরবানি করে। হুকুম দিলেই বন্ধ হয়ে যেত, বড়ই দয়া করেছেন! টাকা আনা, খাবার আনা, সকল কিছুই তো বন্ধ করে দিয়েছেন যাতে কারাগারের রাজনৈতিক বন্দিরা কষ্ট পায় এবং আদর্শচ্যুত হয়ে যায়, বন্ড দিয়ে বের হয়ে যায়। ভুল করেছেন তিনি-এঁরা ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু বাঁকা হবে না। নীতির জন্য, আদর্শের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য যারা ছেলেমেয়ে সংসার ত্যাগ করে কারাগারে থাকতে পারে, যে কোনো কষ্ট স্বীকার করবার জন্য তারা প্রস্তুত হয়েই এসেছে।

জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে আব্বা আব্বা করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে আব্বা আব্বা করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে।” রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, তুমি আমার আব্বা। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।

এক ঘণ্টা সময়। সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা মার শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানী আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি-চারমাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, “জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাঙ্কেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, “চিন্তা তোমার করতে হবে না। সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি’।

সরকারের এক বিশেষ দফতরের একজন কর্মচারী যার সাথে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় কলকাতায় পরিচয় ছিল—তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরও ভক্ত ছিলেন এবং চাকরি করতেন। কলকাতায় বাড়ি। আমাকে কিছু মিষ্টি পাঠাইয়াছেন এই কথা বলে আমি যেন তার এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করি। এর সাথে বহুদিন আমার দেখা হয় নাই। তিনি আরো বলেছেন, ছয় দফা দাবি সমর্থন প্রায়ই সকলে করে তবে বলতে পারে না। এঁর পরিচয় আজ দেওয়া উচিত হবে না, কারণ সে এক বিশেষ দফতরে আছে। সরকার খবর পেলে শুধু চাকরিই নিবে না, জেলেও দিতে পারে।

আজ বাংলা নববর্ষ, ১৫ই এপ্রিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দি কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানীতে এসে হাজির। আমাকে কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল। ২৬ সেল হাসপাতাল থেকে বন্ধু খোন্দকার মোশতাক আহমদও আমাকে ফুল পাঠাইয়াছিল। আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলি খান, সিরাজুল হোসেন খান ও মৌলানা সৈয়াদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক সাহেবকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে। শুধু পাঠাতে পারলাম না পুরানা হাজতে, যেখানে রণেশ দাশগুপ্ত, শেখ ফজলুল হক (মণি)—আমার ভাগনে, হালিম, আবদুল মান্নান ও অন্যরা থাকে—এবং ১/২ খাতায় যেখানে শ্রমিক নেতারা, ওয়াপদার কর্মচারী ও কয়েকজন ছাত্র থাকে। তাদের মুখে খবর পাঠাইলাম আমার শুভেচ্ছা দিয়ে। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল; কারও সাথে কারও দেখা হয় না-বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। এরা তো রাষ্ট্রের শত্রু’! বিকালে পুরানা বিশ সেলের সামনে নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেম আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দি জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাবার হুকুম নাই তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল। শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলে, প্রেম করে একজনকে বিবাহ করেছিল। পরে মামলা হয়। মেয়েটা বাবা মায়ের চাপে উল্টা সাক্ষী দেয় এবং নারীহরণ মামলায় ৭ বৎসরের জেল নিয়ে এসেছে। ছোট হলেও জলসাটা সুন্দর করেছিল ছেলেরা।

আমি কারাগার থেকে আমার দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।

১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইয়া একটা টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটা লিখে পাঠায়,

‘আজিকের নূতন প্রভাতে নূতন বরষের আগমনে
– মুজিব ভাইকে’

‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেউ রও,
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে,
পুরাতন অপরাধ হতে।‘

নববর্ষের শ্রদ্ধাসহ মিজান
১লা বৈশাখ ১৩৭৪ সাল।

১৩৭৩ সালের বৈশাখ হতেই আমার উপর সরকারের জুলুম পুরাদমে শুরু হয়। এর পূর্বেও পঁচটা মামলা ঢাকা কোর্টে দায়ের করা হয়। একটি মামলায় আমাকে ঢাকার এডিসি জনাব বদিউল আলম এক বৎসরের জেল দেয়, হাইকোর্ট আমাকে জামিনে মুক্তি দেয়। অন্য মামলাগুলি চলছিল। ৩রা বৈশাখ খুলনায় মিটিং করে ঢাকায় মোটরে ফেরার পথে ৪ঠা বৈশাখ আমাকে যশোরে গ্রেপ্তার করে এবং জামিনে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসি।

৭ই বৈশাখ আবার আমাকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে সিলেটে পাঠায়।

৮ই বৈশাখ আমার জামিনের আবেদন মহকুমা হাকিম অগ্রাহ্য করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। ৯ই বৈশাখ জেলা জজ বাহাদুর আমাকে জামিনে মুক্তি দেন। পুনরায় জেল গেটে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ জেলে প্রেরণ করে।

১০ই বৈশাখ আমার জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে আমাকে জেলে পাঠাইয়া দেয়।

১১ই বৈশাখ জেলা জজ আমাকে জামিনে মুক্তি দেন আমি মোটরে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি।

২৪শে বৈশাখ তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) ও আমাকে ডিপিআর হিসাবে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে বন্দি করে এবং চট্টগ্রামে জনাব এম, এ আজিজকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম জেলে বন্দি করে। ২৪শে বৈশাখ থেকে আজ পর্যন্ত কারাগারেই বন্দি আছি।

 

১৬ই এপ্রিল২২শে এপ্রিল ১৯৬৭

শরীর কেন যেন আবার কিছুটা খারাপ হয়েছে। কয়েকদিন পর্যন্ত মাথার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্যারিডন খাই। খাওয়ার পরে কিছু সময় ভাল থাকি, আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, আবার খাই। এইভাবে তিন দিন চলে। মাথার যন্ত্রণা হলে লেখাপড়া করতে পারি না, লেখাপড়া না করলে সময় কাটাই কি করে?

কিছু সময় আজকাল শাহ মোয়াজ্জেমের সাথে আলাপ করতে সুযোগ পাই। ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়ে ও বন্দি আছে কয়েদি হয়ে, এখনও জামিন পায় নাই, কয়েকদিনের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে।পুরানা ২০ সেলে রেখেছে। প্রায় একমাস সাধারণ কয়েদি থেকে দুই তিন দিন হলো ডিভিশন পেয়েছে। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও আবদুল মোমিন সাহেব হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোশতাক সাহেবের শরীর খুবই খারাপ, অনেক ওজন কম হয়ে গেছে। মোমিন সাহেব এখন ভাল। তাদের সাথে দেখা হয়েছিল হাসপাতালের দরজায়। তারা সব দলের ঐক্য চায়, তবে পূর্ব বাংলার দাবি ছেড়ে নয়, ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে। মোমিন সাহেব নতুন জেলে এসেছেন কিন্তু একটুও ঘাবড়ান নাই। খুবই শক্ত। আদর্শনিষ্ঠা আছে, পূর্ব বাংলাকে ভালবাসে, সংগ্রাম চালাইয়া যেতে পারবে। মোশতাক সাহেব তো পুরানা পাপী। অত্যন্ত সহ্য শক্তি, আদর্শে অটল। এবার জেলে তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। একবার পাবনা জেলে, একবার রাজশাহী জেলে আবার ঢাকা জেলে নিয়ে। কিন্তু সেই অতি পরিচিত হাসি খুশি মুখ।

নূরুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকী পুরানা ২০ সেলে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই ছুটে আমার কাছে চলে আসে, সিপাহিদের মুখ শুকাইয়া যায়। জমাদার সাহেবরা কি বলবে? ছেলে মানুষ এরা, জেলের আইন টাইন বেশি মানতে চায় না। আমি বুঝাইয়া রাখি। নূরুল ইসলাম পুরানা কর্মী। যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। মাঝে মাঝে ওর সাথে আমি পরামর্শ করি। বড় শান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও, জানার ও পড়ার আগ্রহ আছে। আমি ওকে খুবই স্নেহ করি। আজ প্রায় ১০ বৎসর আমার সাথেই আছে। যাহা হুকুম করি হাসিমুখে পালন করে। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না।

নূরে আলম সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভাল লেখাপড়া জানে, এমএ প্রথম ভাগ জেল থেকেই দিয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাশ করেছে। বয়স খুবই অল্প। বাংলা ভাষার উপর অধিকার আছে। চমৎকার বক্তৃতাও করে। দেশের প্রতি ভালবাসা আছে। বাংলার মানুষকে ভালবাসে। কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির। তাই একটু বেশি কথা বলে, বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। রক্ত কপোত’ নামে একটা বই লেখার জন্য একটা মামলার আসামি আছে, মাঝে মাঝে কোর্টে যায়। ছাত্রদের সাথে কোর্টে গেলে দেখা হয় তাতে খুব আনন্দ পায়। তার মা মারা গেছেন। বাবার একমাত্র ছেলে। খুবই আদরের। মাঝে মাঝে বাবা মার কথা বলে। তাকে আমি খুবই স্নেহ করি। প্রথম প্রথম ভেবেছিল ছেড়ে দিবে এখন সহজে ছাড়া পাবে না বুঝতে পেরেছে। কতদিন থাকতে হয় তাই মাঝে মাঝে ভাবে। একদিন আমাকে বলে, “বস, আপনাকে যদি ছেড়ে দেয় আর আমাকে রেখে দেয় তবে আমার দশাটা কি হবে?” ওকে অন্য জায়গায় নিতে চেয়েছিল, আমার কাছ থেকে যেতে চায় না। আমি বললাম, “তুমি পাগল, আমার মুক্তির অনেক দেরি কত বত্সর থাকতে হয় ঠিক নাই। আর আমি যখন মুক্তি পাব তার অনেক পূর্বেই তোমরা ছাড়া পাবা। মনে রেখ থরোর কথা-

“Under a government which imprisons any unjustly, the place for a just man is also a Prison.’

আমি ভালই আছি। যেখানে বিচার নাই, ইনসাফ নাই, সেখানে কারাগারে বাস করাই শ্রেয়।

আবার সর্বদলীয় ঐক্য নিয়ে তাড়াহুড়া শুরু হয়েছে। বিরোধী দলগুলি এক হয়ে আইয়ুব সাহেবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে গণতন্ত্র কায়েম করার জন্য। সংগ্রাম কে করবে জানি না, তবে পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি যখন চারিদিক থেকে উঠতে শুরু করেছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, সরকার সমর্থক বা বিরুদ্ধদল চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পূর্ব বাংলার লোকদের ধোঁকা দেওয়ার আর একটা ষড়যন্ত্র কিনা কে জানে?

আজ ২২ তারিখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁ, মালিক গোলাম জিলানী, গোলাম মহম্মদ খান লুন্দােের, মালিক সরফরাজ ও জনাব আকতার আহম্মদ খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, নজরুল ইসলাম, এম এ আজিজ, আবুল হোসেন এবং আরো অনেকে জেল গেটে কোর্টে আমার সাথে দেখা করতে আসে। যশোের থেকে আবদুর রশিদ, খুলনা থেকে আবদুল মোমেন এসেছিল। অনেক আলাপ হলো। যুক্তফ্রন্ট করা যায় কিনা? নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট করার আপত্তি অনেকেরই নাই তবে ৬ দফা দাবি ছাড়তে কেহই রাজি নয়। এটা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হলেও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, জেল খাটছে। এই দাবি পূরণ না হলে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচবার কোনো পথ নাই। আমি আমার মতামত দেই নাই কারণ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা নিজেরাই আলোচনা করে তাদের পথ ঠিক করুক। আমি আমার মত চাপাইয়া দিতে যাবো কেন? আমি বন্দি। বাইরের অবস্থা তারাই ভাল জানে। তবে ৬ দফা দাবি দরকার হলে একলাই করে যাবো।

 

২৩শে এপ্রিল-২৭শে এপ্রিল ১৯৬৭

বিরোধীদলগুলি নিমতম কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যজোট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় সকল দলের নেতৃবৃন্দই এসেছেন। শুধু ন্যাপ নেতারা আসেন নাই। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটি ও পূর্ব বাংলার ওয়ার্কিং কমিটির সভা একসাথে ডাকা হয়েছে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ঐক্যজোটের পক্ষে মত দিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভিতরে তীব্র মতভেদ হয়েছে শুনলাম। যতবারই আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্যজোট করতে চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন ধরেছে। আমি, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন, বিশিষ্ট নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ জেলে আছি। আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। আজও প্রচার সম্পাদক আব্দুল মোমিন, কালচারাল সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রভাবশালী নেতা শাহ মোয়াজ্জেম, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মোল্লা জালালউদ্দিন, মহীউদ্দিন আহম্মদ সিটি আওয়ামী লীগ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা সিটির অফিস সেক্রেটারি মোহাম্মদ সুলতান এবং ঢাকা জেলা অফিস সেক্রেটারি সিরাজউদ্দিন জেলে।

পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটা প্রস্তাবও পাশ করে নাই আমাদের মুক্তির জন্য।

মোল্লা জালাল ও সিরাজউদ্দিনকে কুমিল্লা জেলে হঠাৎ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাপার বুঝলাম না। এই সময় এদের বদলি করার অর্থ কি? এতদিন জেলে রাখার পরেও সরকারের রাগ মেটে নাই। জালালের ফ্যামিলি ঢাকায়। সিরাজের বাবা মা কেহই নাই। ঢাকায় দুই একজন বন্ধু-বান্ধব আছে। জেলের ভিতর আমার কাছে একটা প্রস্তাব পাঠান হয়েছে। আমি পড়ে দেখলাম একটা ‘শুভঙ্করীর ফাঁকি’ ছাড়া আর কিছুই না। ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন না মানলে ঐক্য হয় কি করে ? নিয়ে প্রস্তাবটা উঠাইয়া রাখলাম ভবিষ্যতের জন্য।

Nawabjada Nasrulla’s Draft

  1. The constitution shall provide for a federation of Pakistan with Parliamentary form of government, supremacy of legislature, directly elected on the basis of universal adult franchise, complete and full fundamental rights, unfettered freedom of the press and independence of the judiciary.
  2. The federal government shall deal with the following subject–

(I) Defence

(II) Foreign Affairs

(III) Currency and Federal Finance

(IV) Inter wing communication and trade and such other subject as may be agreed upon.

  1. There shall be full regional Autonomy and residuary powers in regard to all other subjects shall vest in the govt. as enmisiged by the constitution in the two wings.
  2. It shall be the constitutional responsibility of the government of Pakistan to remove economic disparity between the two wings of the country in the course of ten years and within this period to spend all the foreign exchange earned by East Pakistan exclusively in that wing. The Foreign exchange acquired by the provinces shall be at the absolute disposal of the provincial governments, after allowing for East Pakistan’s proportionate share of the defence, foreign expenditure and the central liabilities. The government of Pakistan shall also give priority in foreign aid and loan to East Pakistan till economic disparity is removed and shall adopt such fiscal and monetary policies as would stop the flight of capital from the Eastern wing. For this purpose appropriate legislation shall be enacted from time to time with regard to bank deposit and profits insurance premium and industrial profits in particular.
  3. Currency, Foreign Exchange and Central Banking.

(1) Inter Wing Trade.

(II) Inter Wing Communication.

(III) Foreign Trade Should each be managed by a board consisting of an equal number of members from East and West Pakistan.

  1. The Supreme Court and all departments of central services including diplomatic services and autonomous bodies shall consist of an equal number of persons from East and West Pakistan. To achieve this parity future appointments should be made in a manner so that the total strength of such officers be brought at par within a period of ten years.
  2. It shall be the constitutional responsibility of the Government of Pakistan to bring at par the effecting fighting and fire power in the armed services in the two wings of the country and to that end to establish a Military Academy, Ordnance Factories, Cadet Colleges and School, raise recruits for the three services from East Pakistan and shift the Headquarters of the Pakistan Navy to East Pakistan to ensure implementation of the above, a Defence Council consisting of equal number of members from East and West Pakistan shall be established.
  3. The Constitution in this declaration means the constitution of 1956 which shall be promulgated immediately. Within six months of the promulgation of the constitution, General Election shall be held to the Central and Provincial Assemblies. The foremost business transacts by the National Parliament shall be The Incorporation of the changes as spelt out in the Preceding clauses into the constitution.

আমাদের দলের অনেক নেতা এটা গ্রহণ করেছেন; এর মধ্যে যে কত ফাঁক রেখেছে যারা একটু চিন্তা করে দেখবে তারা সহজেই বুঝতে পারবে। আমার মত জানবার চেষ্টা করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিরোধী দলের ঐক্য চাই, কিন্তু জনগণের দাবি জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রস্তাব দিয়েছে আমার মত নিয়ে কাজে অগ্রসর হতে। কোর্টে জহির সাহেব আমার কাছে মত জিজ্ঞাসা করেছেন আর বলেছেন অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেছে-পিছান কষ্টকর। আমি আমেনা, আজিজ, মোস্তফা ও জহির সাহেবকে বলে দিয়েছি ঐক্যে আমার আপত্তি নাই তবে সকল বিরোধী দলকে নিতে হবে, ন্যাপকে বাদ দেওয়া চলবে না; দ্বিতীয় পার্টির কাজ বন্ধ হবে না-৬ দফার আন্দোলন চালাইয়া যাবে পার্টি। আমি ও আমার সহকর্মী যারা জেলে আছি বিশেষ করে খোন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন ও আমাকে কোনো সর্বদলীয় কমিটিতে রাখবা না। আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে, অনেক কর্মী জেল খাটছে তাদের ত্যাগের দাম আমাকে দিতেই হবে। তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারব না। তবে ঐক্য হউক, এই সমস্ত নেতারা কি করে দেখি? এরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে কিনা আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ আছে! আমি তোমাদের বাধা দিতে চাই না, তবে উপরে উল্লেখিত দাবি না মানলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যোগদান করবে না। যদি করে তাতে আমি আর কি করতে পারি! আমিতো জেলেই আছি।

২৭ তারিখে আমার একটা মামলার রায়, ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত সভায় বক্তৃতা দানের অভিযোগে। জনাব আফসার উদ্দিন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জেলগেটের অভ্যন্তরে কোর্ট করে আমার বিচার করেন এবং আমাকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ ধারা বলে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।

এই দণ্ড দেওয়ার পরেই জহিরের সাথে আমার আলাপ হয়। আমি তাকে বললাম আমাকে জেল দিয়েছে আমি বিনা বিচারে বন্দি আছি। কতকাল থাকতে হয় জানি না, আমার পক্ষে পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে বেঈমানী করা সম্ভব নয়। যাহা ভাল বোঝ কর। আমি জানি ৬ দফা দাবি পূরণ হওয়া ছাড়া এদের বাঁচবার উপায় নাই। আজ আমি এক বৎসর দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারে জেলে আছি। আমার সহকর্মীরাও আছে। আমি দেখলাম আমার অবর্তমানে দুই গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। একদল ৬ দফা ছাড়া আপোষ করবে না আর একদল নিম্নতম কর্মসূচিতেই রাজি।

আমাকে প্রথম শ্রেণীর কয়েদি করা হয়েছে। রোজ খাবার আড়াই টাকার মত এখন পাব। একলা থাকি একলাই পাক করাইয়া খাই। কি করে চলবে! যারা আমার খানা পাক করে আর যারা আমার দেখাশোনা করে তাদের রেখে তো কোনোদিন কিছু খাই না।

জামিন দিল না। আজ থেকে আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। তবে দেশরক্ষা আইনে বিনা-বিচারের আদেশও থাকবে যদি জামিন পাই। জজকোর্টে আপীল করার পরে আবার দেশরক্ষা আইনে বিনাবিচারে জেলে থাকতে হবে। আমার পক্ষে সবই সমান। আর একটা মামলায়ও আমার জেল আছে আড়াই বৎসর। সেটাও বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্টে পড়ে আছে। কনফার্ম করেছে এক বৎসর খাটতে হবে যদি হাইকোর্ট থেকে মুক্তি না পাই। বুঝতে পারলাম আরও যে ছয়-সাতটা বক্তৃতার মামলা আছে সব মামলাই নিচের কোর্টে আমাকে সাজা দিবে। শুধু মনে মনে বললাম :

‘বিপদে মোরে রক্ষা কর
এ নহে মোর প্রার্থনা।
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।‘

কবিগুরুর এই কথাটা আমার মনে পড়ল।

আজ ২৭ শে এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। পাঁচ বৎসর পূর্বে (১৯৬২) যখন তিনি ঢাকায় মারা যান সেদিনও আমি জেলে ছিলাম। হক সাহেব ছিলেন পূর্ব বাংলার মাটির মানুষ এবং পূর্ব বাংলার মনের মানুষ। মানুষ তাঁহাকে ভালবাসতো ও ভালবাসে। যতদিন বাংলার মাটি থাকবে বাঙালি তাকে ভালবাসবে। শেরে বাংলার মতো নেতা যুগ যুগ পরে দুই একজন জন্মগ্রহণ করে।

শেরে বাংলা হক সাহেব ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন এবং সেই প্রস্তাবের জন্যই আজ আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। লাহোর প্রস্তাবে যে কথাগুলি ছিল আমি তুলে দিলাম-নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এ দেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করিতেছে যে সব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল, প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানার বদল করিয়া ঐ সকল এলাকাকে ভৌগোলিক দিক দিয়া এরূপভাবে পুনর্গঠিত করা হউক যাহাতে উহারা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্টেটস্-এর রূপ পরিগ্রহণ করিয়া সংশ্লিষ্ট ইউনিটদ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা লাভ করিতে পারে। …

এই লাহোর প্রস্তাবের কথা বললে আজ অনেক তথাকথিত নেতারা ক্ষেপে যান এবং আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে শুধু গালি দেন বা কারাগারেও বৎসরের পর বৎসর বন্দি করে রাখেন। যে দিন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গঠন করা যাবে সেইদিনই শেরে বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা দেখান হবে এবং তাঁর আত্মা শান্তি পাবে।

শেরে বাংলা তাঁর নিজের সম্বন্ধে যা নিজেই লেখে রেখে গেছেন তা হলো :

Self Analysis

“In my stormy and chequered life chance has played more than her fair part. The fault has been my own. Never at any time have I tried to be the complete master of my own fate. The strongest impulse of the moment has governed all my actions. When chance has raised me to dazzling heights, I have received her gifts without-stretched hands. When she has cast me down from my high pinnacle, I have accepted her buffets without complaint. I have my hours of pinnacle and regret. I am introspective enough to take an interest in the examination of my own conscience. But this self-analysis has always been ditched. It has never been morbid. It has neither aided nor impeded the fluctuations of my varied career. It has availed me nothing in the external struggle which man wages on behalf of himself against himself. Disappointments have not cured me of ineradicable romanticism. If at times I am sorry for something I have done, remorse assails me only for the things I have left undone.’

Fazlul Haq

শেরে বাংলার এই সামান্য কথা থেকে আমরা তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারি।

আজ লাহোর প্রস্তাবের মালিকের মৃত্যুবার্ষিকী। আর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি করে আমি যে ৬ দফা দাবি পেশ করেছি তার উপর বক্তৃতা করার জন্য এ দিনটিতে আমাকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। আল্লার মহিমা বোঝা কষ্টকর।

 

২৮শে এপ্রিল৩০শে এপ্রিল ১৯৬৭

কারাদণ্ড হওয়ার পরে জেলের ভিতরে যখন আমি ফিরে এলাম। এসেই শুনলাম আমার ভিতরে আসার পূর্বেই সাধারণ কয়েদিরা খবর পেয়েছে যে, আমাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করল এই জুলুমের কি কোনো প্রতিকার নাই? এদের চোখে মুখে বেদনা ভরা। দুই একজন তো কেঁদেই দিল। আমি ওদের হাসতে হাসতে বললাম, দুঃখ করবেন না। আমি তো এই পথে জেনে শুনেই নেমেছি। দুঃখ তো আমার কপালে আছেই। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে, কষ্ট ও জুলুম স্বীকার করতে হয়। আমার কাছে কোনো কয়েদির দেখা করা বা কথা বলা নিষেধ। তবুও সিপাহি জমাদারদের বলে এরা ফাঁকে ফাঁকে পালাইয়া আসে। কত দরদ ভরা এদের মন। কেন যে এরা আমাকে ভালবাসে আজও বুঝতে পারলাম না। পাষাণ প্রাচীর ঘেরা এই কারাগারের বন্দি কয়েদিরাও আজ চায় নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে। তারাও বুঝতে শুরু করেছে তাদের শোষণ করছে কোনো এক অঞ্চলের এক শোষকগোষ্ঠী। দিন ভরেই কয়েদিরা আসছে আর আফসোস করছে। হায়রে বাঙালি শুধু কাঁদতেই শিখেছে আর কিছুই করার ক্ষমতা তোমাদের নাই!

আজ ১৪ দিন হয়ে গেছে, রেণু তার ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে আসবে বিকাল সাড়ে চারটায়। চারটার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম। পৌনে পাঁচটায় সিপাহি আসলো আমাকে নিতে। আজ তো আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, আইবি অফিসার আইনতভাবে আমরা যখন আলাপ করবো তখন থাকতে পারবে না। যেয়ে দেখলাম আইবি অফিসার ঠিকই এসেছে তবে কিছু দূরে বসে আছে। আমরা যে রুমে বসে আলাপ করবো সে রুমে বসে নাই। রুমে এলে আমি বাধ্য হতাম তাকে বের করে দিতে। আর দিতামও। বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সাথে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা। ঘর সংসার, বাড়ির কথা আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটুও ভীত হয় নাই, মনে হলো পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দিবে। দেখে খুশিই হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে অনেকদিন আরও থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।’ ছোট মেয়েটা বলল, ‘আব্বা এক বৎসর হয়ে গেল।‘ আমি ওকে আদর করলাম, চুমা দিলাম। আর বললাম, ‘আরও কত বৎসর যায় ঠিক কি?’ আপীল করবার কথা বললাম। আর নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও পাবনার মামলাগুলির কাগজপত্র আনাতে এবং হাইকোর্টে মামলা করতে বললাম যাতে সকল মামলা ঢাকায় আনা হয়। জেলে বসেই নিম্ন আদালতের বিচারগুলি হয়ে যায়। সবই বক্তৃতার মামলা।

রেণু শুনল। এখন যাহা পাই একলার পাক করে খাওয়া কষ্টকর। আমাকে বলল, কিছু প্রয়োজন আছে কিনা? বললাম, দেখা যাক কি হয় তারপর দরকার হলে জানাব। রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিক ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, ‘আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে। আমি ওকে বললাম, তুমি রেহানাকে মার? রাসেল বলল, হ্যাঁ মারি। বললাম, না আব্বা আর মেরো না। উত্তর দিল, মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না। জামাল বলল, ‘আব্বা আমি এখন লেখাপড়া করি।’ বললাম, ‘তুমি আমার ভাল ছেলে মন দিয়ে পড়িও। সন্ধ্যা হয়ে এলে ছেলেমেয়েদের চুমা দিয়ে ও রেণুকে বিদায় দিলাম। বললাম, ভাবিও না অনেক কষ্ট আছে। প্রস্তুত হয়ে থাকিও।

ফিরে এলাম। একটু পরেই তালাবন্ধ হয়ে গেল। আমিও বই নিয়ে বসলাম। রাত্র দশটা পর্যন্ত লেখাপড়া করি আজকাল। তারপর খেয়ে শুয়ে পড়ি। কোনো দিন শুয়েই ঘুম এসে যায় আবার কোনোদিন পাগল ভাইদের চিঙ্কার শুনি মশারির ভিতরে শুয়ে।

২৯ তারিখ সকালে বসে কাগজ পড়ছি, ডাক্তার সাহেব আমাকে দেখতে আসলেন। বললাম, রোগ ও শোক এই দুইটাতো কারাগারের সাথী-কি আর দেখবেন? সকালে ১০টা-১১টা পর্যন্ত কাগজ অথবা বই পড়ি। ১২টার সময় দেখি রেণু কয়েক সের চাউল, কিছু ডাউল, তেল, ঘি, তরকারি, চা, চিনি, লবণ, পিয়াজ ও মরিচ ইত্যাদি পাঠাইয়াছে। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ডিভিশন ক’ কয়েদিরা বাড়ির থেকে এসব আনতে পারে ডিআইজি প্রিজনের অনুমতি নিয়ে। অনুমতি নিয়েই পাঠাইয়াছে দেখলাম। ভালই হয়েছে। কিছুদিন ধরে পুরানা বিশ সেলে যে কয়েকজন ছাত্র বন্দি আছে তারা খিচুড়ি খেতে চায়। বহুদিন আমাকে বলেছে কিন্তু কুলাতে পারব না বলে নড়াচড়া করি না। কিছু কিছু বাঁচাইয়াছি, কয়েকটা মুরগি, কিছু ডিমও জোগাড় করেছি। নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আরও কয়েকজন মিলে খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছে। খিচুড়ি আদায় করতেই হবে। একদিন হঠাৎ আমার পাকের ঘরের কাছে একটা কাঁঠাল গাছ আছে, সেখানে খবরের কাগজে কালি দিয়ে লিখে কাঁঠাল গাছে টানাইয়া রেখেছে কোনো কয়েদিকে দিয়ে। তাতে লেখা আছে আমাদের দাবি মানতে হবে, খিচুড়ি দিতে হবে। নীচে লেখা ‘খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ’। আমি তো নূরুল ইসলামের হাতের লেখা চিনি। বাইরে ও পোস্টার লেখতো। তারই হাতে লেখা। আমি তাদের ডেকে বললাম, এসব দাবি টাবি চলবে না। দরকার হলে জনাব মোনেম খানের পন্থা অবলম্বন করব। খুব হাসাহাসি চললো। মাঝে দুই একজনে দুই একবার শ্লোগানও দিয়েছে-খিচুড়ি দিতে হবে।

আজ সুযোগ হয়ে গেল। মালপত্র পাওয়া গেল। বিকালে তাদের বললাম যাহা হউক তোমাদের ভাবির দৌলতে তোমাদের খিচুড়ি মঞ্জুর করা গেল। আগামীকাল খিচুড়ি হবে।

যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিমও পাঠাইয়াছে। কয়েকদিন না খেয়ে কয়েকটা ছোট ছোট মুরগির বাচ্চাও জোগাড় করা হয়েছে। আমি তো জেলখানার বাবুর্চি, আন্দাজ করে বললাম কি করে পাকাতে হবে এবং আমার কয়েদি বাবুর্চিকে দেখাইয়া দিলাম। পানি একটু বেশি হওয়ার জন্য একদম দলা দলা হয়ে গেছে। কিছু ঘি দিয়ে খাওয়ার মত কোনোমতে করা গেল। পুরানা বিশ সেলে আট জন ডিপিআর, তাদের ফালতু, পাহারা, মেট চারজন করে দেওয়া হলো। আমার আশে পাশেও ৮/১০ জন আছে সকলকেই কিছু কিছু দেওয়া হলো। ডিম ভাজা, ঘি ও অল্প অল্প মুরগির গোস্তও দেওয়া হলো। গোসল করে যখন খেতে বসলাম তখন মনে হলো খিচুড়ি তো হয় নাই তবে একে ডাউল চাউলের ঘণ্ট বলা যেতে পারে। উপায় নাই খেতেই হবে কারণ আমিই তো এর বাবুর্চি। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম বলল, মন্দ হয় নাই। একটু হেসে বললাম, যাক আর আমার মন রাখতে হবে না। আমিই তো খেয়েছি। যাহা হউক খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদের দাবি আদায় হলো, আমিও বাঁচলাম।

বিকালে শুনলাম মণিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, শরীর খারাপ করেছে। দুইদিন পরে আইন পরীক্ষা দিবে। একটু চিন্তাযুক্ত হলাম। খবর নিয়ে জানলাম, চিন্তার কোনো কারণ নাই।

 

১লা মে২রা মে ১৯৬৭

খবরের কাগজের মারফতে দেখতে পেলাম কয়েকটি বিরোধী দল ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে একটা ঐক্য জোট গঠন করেছে। ঐক্য জোটের নাম দেওয়া হয়েছে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন। কর্মসূচি পূর্বেই আমি পেয়েছি।

ঐক্যজোটের চুক্তিতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আবদুস সালাম খান এবং গোলাম মোহাম্মদ খান লুখোর, কাউন্সিল মোছলেম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা, খাজা খয়ের উদ্দিন এবং তোফাজ্জল আলি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের জনাব নূরুল আমীন, জনাব আতাউর রহমান খান এবং হামিদুল হক চৌধুরী, জামাতে ইসলামী পার্টির জনাব তোফায়েল মোহাম্মদ, জনাব আবদুর রহিম এবং জনাব গোলাম আজম, নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মহম্মদ আলি, জনাব ফরিদ আহম্মদ এবং এম আর খান স্বাক্ষর করেন।

৮ দফা কর্মসূচী

(১) পার্লামেন্টারী পদ্ধতির ফেডারেল সরকার।

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্য। পূর্ণাঙ্গ মৌলিক অধিকার, সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।

(২) কেন্দ্রীয় সরকার নিম্নলিখিত বিষয়গুলির দায়িত্ব গ্রহণ করিবে :

(ক) দেশক্ষা, (খ) বৈদেশিক বিষয়, (গ) মুদ্রা ও কেন্দ্রীয় অর্থনীতি, (ঘ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য এবং অন্যান্য যে বিষয়গুলি স্বীকৃত হইবে।

(৩) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হইবে, এবং অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত রেসিডিউয়ারী ক্ষমতা শাসনতন্ত্রের মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত সরকারের নিকট অর্পিত হইবে।

(৪) দশ বৎসরের মধ্যে উভয় প্রদেশের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণ করা সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকিবে। দেশরক্ষা, বৈদেশিক ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি পূর্ব পাকিস্তানের আনুপাতিক ভাগ বাদ দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানেই ব্যয় হইবে। এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বাধীনে থাকিবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য বলবৎ থাকা পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে অগ্রাধিকার প্রদান করিবে। এবং এমন অর্থনীতি গ্রহণ করিবে যাহাতে পূর্বাঞ্চল হইতে মূলধন পাচার বন্ধ হইয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্কের মওজুদ ও মুনাফা বীমা প্রিমিয়াম ও শিল্প ক্ষেত্রে মুনাফা সম্পর্কে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হইবে।

(৫) (ক) মুদ্রা, বৈদেশিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কিং, (খ) আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য, (গ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয়গুলির ভার জাতীয় পরিষদের সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক সদস্য সম্বলিত বোর্ডের উপর অর্পণ করা হইবে।

(৬) সুপ্রিম কোর্ট এবং কূটনীতিক সার্ভিস সহ কেন্দ্রীয় সরকারের সকল বিভাগের ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সম-সংখ্যক ব্যক্তি গ্রহণ করা হইবে। এই সংখ্যা সাম্য লাভের জন্য ভবিষ্যতের নিয়োেগ এমনভাবে করা হইবে যাহাতে দশ বৎসরের মধ্যে বৈষম্য দূর হয়।

(৭) পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকিবে। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারী একাডেমী, অস্ত্র নির্মাণ কারখানা, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল নির্মাণ করা হইবে। দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটা শাখায় তোক নিয়োগ করা হইবে এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হইবে। ইহা বাস্তবায়িত করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সমসংখ্যক সদস্য লইয়া একটা প্রতিরক্ষা কাউন্সিল গঠিত হইবে।

(৮) এই শাসনতন্ত্রের অর্থ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র। এই শাসনতন্ত্র অবিলম্বে ক্ষমতায় আসীন হইবার পর জারি করা হইবে এবং জারি করার ৬ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে কর্মসূচীর দুই ও সাত নম্বর ধারা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হইবে। সকল অঙ্গ দল ও সংস্থা এই উদ্দেশ্য সাধনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

 

২রা মে৩রা মে ১৯৬৭

হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মিসেস আমেনা বেগম, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতি দেন ঐক্যফ্রন্টের চুক্তিতে স্বাক্ষর সম্বন্ধে। তারা বিবৃতিতে বলেন, ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে আওয়ামী লীগের শামিল হওয়া এবং ঐক্যফ্রন্ট গঠনের চুক্তিতে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর দানের বৈধতা সম্পর্কে।

আবার জহির সাহেবেরও একটি বিবৃতি দেখলাম। মহা চিন্তায় পড়লাম। অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম। তারপর কলম ধরলাম। আমার মতামত দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যাহা চেয়েছিল তাহাই হলো। আওয়ামী লীগ ভাঙতে। এখন দুই দলের ইজ্জতের প্রশ্ন হয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রস্তাব দেখে। পাকিস্তান অবজারভারের ২রা মে-র কাগজে এই প্রস্তাবটি উঠেছে তাতে লেখা আছে :

‘The All Pakistan Awami League Working Committee at its meeting in Dacca on April 23 discussed Six-Point Programme of East Pakistan Awami League. On the basis of this programme it evolved a formula in which besides the restoration of complete democracy in the country the genuine demands of East Pakistan People were incorporated. This formula was unanimously adopted by the East Pakistan Awami League also as the basis for negotiations with other political Parties. Says press release’.

আমি বুঝতে পারলাম না কেমন করে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে এই আট দফা দাবির মধ্যে।

 

৩রা মে২৩শে মে ১৯৬৭

কিছুদিন থেকে শরীরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। প্রায় ৭ সের ওজন কমে গেছে। অর্শ রোগ হওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রক্ত পড়ে পায়খানার দ্বার দিয়ে। শরীরের প্রতি যত্ন নিয়েও কিছু হচ্ছে না। দুর্বল হয়ে পড়েছি। ৩রা মে দেশরক্ষা আইনে (বিনা বিচারে) শেষ তিন মাসের সরকারি হুকুমনামা আমাকে দেওয়া হয় নাই। এক বৎসর শেষ হয়ে গেছে ৩রা মে তারিখে। ৪ তারিখে হুকুম পাব আশা করেছিলাম। বুঝতে পারলাম আমার ১৫ মাস জেল হয়েছে। আমি দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি তাই হুকুম নামা দেওয়া হয় নাই। এখন আমি শুধু দণ্ডভোগ করছি। আপীল দায়ের করা হয়েছে সাজার বিরুদ্ধে। আপীল মঞ্জুরও হয়েছে। আগামী ২৯ তারিখে জামিন সম্বন্ধে শুনানি হবে ঢাকা জেলা জজের কাছে। যদি জামিন পেয়ে যাই তবে সরকার আবারও আমাকে ডিপিআর-এ বিনা বিচার আইনে বন্দি করে রাখবেন। ১৯শে জুন তারিখে মামলার শুনানি হবে বলে জজ সাহেব বলে দিয়েছেন।

হাইকোর্ট থেকে একটা হুকুম পেয়েছি যে বক্তৃতার মামলায় জনাব মালেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকার হাইকোর্টে আপীল করেছেন। আগামী ২৯ তারিখে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি হবে বলে নোটিশ পেয়েছি। কাগজটা পাঠাইয়া দিয়েছি রেণু’র কাছে এডভোকেটদের সাথে পরামর্শ করে যে কোনো একজন ভাল এডভোকেট দিয়ে মামলা পরিচালনা করতে। এতগুলি বক্তৃতার মামলা দিয়েছে। দুইটায় সাজা হয়েছে, একটায় খালাস পেয়েছি, তার বিরুদ্ধেও আপীল করতে সরকারের কত উৎসাহ। যদিও এডভোকেট সাহেবরা টাকা নেয় না, তথাপি নকল ও অন্যান্য খরচ বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। জেলে আছি উপার্জন নাই। ছেলেমেয়েদের খুবই অসুবিধা হবে। লড়তে হবে, উপায় কি? রাজনৈতিক কারণে মানুষ মানুষকে অত্যাচার করে তবে তার একটা সীমা আছে ও লজ্জা আছে। নিশ্চয়ই জনগণ বুঝতে পারে যে একটা লোককে ধ্বংস করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার নিশ্চয়ই জানে যার কিছুই নাই তার আবার কিছু নষ্ট হবার ভয় কি?’ একটা দোষ’ বোধ হয় আমার আছে। সেটা হলো জনগণ আমাকে ভালবাসে এবং যে ৬ দফা দাবি করেছি তাহা সমর্থন করে, তাই বোধ হয় এই অত্যাচার। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোনো ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভাল করে জানেন। জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।

মণি জেল হাসপাতাল থেকেই ল’ পরীক্ষা দিতেছে, ভালই দিয়েছে খবর পেলাম। শাহ মোয়াজ্জেম আমার পাশেই পুরানা বিশ সেলে আছে। হাইকোর্ট ডিপিআর থেকে খালাস দিয়েছে কিন্তু একটা মামলায় জামিন না হওয়ার জন্য জেলে পড়ে আছে। নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীও পুরানা বিশে থাকার জন্য একটু আরামেই আছি। কারণ ওদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে পারি মাঝে মাঝে, ফাঁকে ফাঁকে তাসও খেলে থাকি। যদিও তাস খেলা ভাল জানি না। ব্রীজ খেলতে গেলে উল্টা-পাল্টা খেলে বসি। মোয়াজ্জেম আমার সাথী, মুখ কালা করে ফেলে, কিছু বলতেও পারে না আর সইতেও পারে না।

দুপুর বেলা বিছানায় শুয়ে থাকলে রাতে আর ঘুম হতে চায় না। তাই দুপুর বেলা খাওয়ার পরে কিছু সময় নষ্ট করি। আমি তো একাকীই থাকি, কোনো দেওয়াল ভিতরে না থাকায় ওরা চলে আসে। আর আমি তো কয়েদি হয়েছি, রাজনৈতিক বন্দি তো নই। আর মোয়াজ্জেমও বিচারাধীন আসামি। আর মোয়াজ্জেম কাছে থাকায় অনেক সময় গল্প করে কাটাতে পারি। মোয়াজ্জেম বলে, ‘মুজিব ভাই কিছু লেখেন।‘ আমি বলি, ‘কি লিখব, বল, লেখার অভ্যাস তো কোনোদিন করি নাই।‘

নূরুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকীর দুষ্টামী খুব ভাল লাগে। ব্রীজ খেলতে যখন পারি না তখন ব্রে খেলা শুরু করলাম। পরপর কয়েকদিন আমাকেই ব্রে হতে হলো কারণ ও খেলাটাও আমি ভাল জানি না। আমাকে নিয়ে ওরা মহা বিপদে পড়েছে। আস্তে আস্তে শিখে নিয়ে ওদেরও ব্রে করতে শুরু করলাম। পূর্বের মত আর একচেটিয়া অবস্থা নাই। তবে শাহ মোয়াজ্জেমকে ব্রে করা খুব কঠিন, দুই একবার ছাড়া করা যায় নাই। এখন ৱে খেলা চলছে। সকালে লেখাপড়া, দুপুরে খাওয়ার পরে কাগজপড়া ও ব্রে খেলা। সন্ধ্যার পরে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় যার যার সেলে। আর আমাকে দেওয়ানী ওয়ার্ডে। সন্ধ্যা হলেই বই নিয়ে বসে পড়ি। দশটায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি, ঘুম হলেও শুয়ে থাকতে হবে আর না হলেও শুয়ে থাকতে হবে। বাইরে যেয়ে একটুও হাওয়া খাওয়ার উপায় নাই।

১৭ তারিখে রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। হাচিনা আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, “আব্বা প্রথম বিভাগে বোধ হয় পাশ করতে পারব না তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাবো।” বললাম, “দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে মন দিয়ে পড়। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হব না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমত করতে পার নাই।”

রাসেল আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। এক বৎসর হয়ে গেছে জেলে এসেছি। রাসেল একটু বড় হয়ে গেছে। জামাল আসে নাই, খুলনায় গিয়াছে। শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহকুমার প্রেসিডেন্ট ও সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে একটিং সভাপতি ও একটিং সম্পাদক রেণুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই।

আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। তাজউদ্দীন, মোমিন সাহেব, ওবায়দুর, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে রাজি নয়। খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সেও পিডিএমএর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে। তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নূরে আলম, নূরুল ইসলাম-আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিক নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএম এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএম দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নূরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের মানস পুত্র’ বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই-তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লোকেদের ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী। ৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না তা আমার জানা আছে।

মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি পিডিএম এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া কোনো আপোষ হবে না। অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন। আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই। এও বলেছি এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা যেন সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোনো আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা হয়েছে। দেখলাম কাগজে আমার কথা মতই প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে :

‘The meeting of the E.P.A., League Working Committee discussed the 8-point programme of the PDM and resolved that the matter be referred to East Pakistan Awami League Council for final decision.

It is further resolved that pending decisions by the council the East Pakistan Awami League will extend it responsive cooperation to any movement of the PDM for the restoration of democratic rights of the peoples of Pakistan.

The meeting of the East Pakistan Awami League working committee reiterates its faith in the six-points programme and will continue the movement for its realization.’

ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রশিদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তারাও সভায় যোগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়। ৬ দফার আর প্রয়োজন নাই তাদের কাছে।

পিন্ডি থেকে জনাব কামরুজ্জামান এমএনএ, জনাব ইউসুফ আলী এমএনএ, জনাব নূরুল ইসলাম এমএনএ আওয়ামী লীগের এই তিন সদস্য পিডিএম সম্মেলনে যোগদান করেছেন। ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে এদের নিষেধ করা হয়েছে।

ন্যাপও পিডিএম এ যোগদান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিলে আন্দোলন কে করবে? সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কর্মী ছাড়া অন্য দলের একটি কর্মীও জেলে নাই। ত্যাগ করলে এই দুই দলের নেতা ও কর্মীরা করছে। ঘরে বসে বিবৃতি দিয়ে এই দলের কর্মীরা রাজনীতি করে না। কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে এই পিডিএম করার পিছনে বিরাট ষড়যন্ত্র আছে।

লাহোরের সভায় পিডিএম কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাতে নবাবজাদা নসরুল্লাহকে সভাপতি আর মাহমুদ আলীকে সম্পাদক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিকে প্রেসিডেন্ট করার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এটা পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধোঁকা দেওয়ার ষড়যন্ত্র। কিছুতেই পারবে না—এ বিশ্বাস আমার আছে।

 

২৪শে মে ১৯৬৭ বুধবার

আজ ২৪শে মে সকালে সিভিল সার্জন সাহেব আমাকে দেখতে এসেছেন। কারণ আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার জন্য সরকার বোধ হয় জানতে চেয়েছেন আমার শরীরের অবস্থা। ওজন নিলেন, পাইলসের অবস্থা শুনলেন, মাথার যন্ত্রণা, পিঠে বেদনা ও গ্যাসট্রিক নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছি আমি। কয়েকদিন পূর্বে, বোধ হয় ১০/১২ দিন হয়ে গেছে মেডিকেল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এনে দেখার জন্য নোট দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত কেহই আসেন নাই বা আনা হয় নাই। মুক্তি তো আমাকে দেবে না। চিকিৎসাও ভালভাবে করবে না। আমার স্বাস্থ্য ভালই ছিল। খুবই পরিশ্রম করতে পারতাম, আজ আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। হাঁটতেও ইচ্ছা হয় না। বসে বসে কাটাই অথবা শুয়ে থাকি। একদিন সকালে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গিয়াছিলাম, পাশেই একটা বসার জায়গা থাকায় ধরে নিজকে সামলাইয়া নিয়েছিলাম। এত দুর্বল কেন যে হয়ে পড়লাম বুঝতে পারি নাই। রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বেশি কিছু বলি না কারণ ওরা চিন্তা করবে। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়লে জেল খাটব কেমন করে? জেলের ভিতর সামান্য অসুখ হলেই মন খারাপ হয়, মনে হয় কত বড় ব্যারামই না হয়েছে। বিশেষ করে আপনজনের কথা মনে পড়ে। আপনজনের সেবা চায় মন বার বার, বোধহয় এটাই নিয়ম, যা পাওয়া যায় না বা পাওয়া যাবে না তারই উপর আগ্রহ হয় বেশি। তাই ভাবি, জীবনের কত হাজার হাজার দিন এই কারাগারে একাকী কাটাইয়া দিলাম আর কতকাল কাটাতে হয় কেইবা জানে! তবুও দুঃখ আমার নাই, নীতি ও আদর্শের জন্য অত্যাচার সহ্য করছি। যুগে যুগে অনেক নেতা ও মনীষী নিজের আদর্শ এবং সত্যের জন্য জীবন দিয়েছে। কারাগারে বসে ধুকে ধুকে মারা গিয়েছে। তাদের কথা কেউই তো আজ মনে করে না। এই বাংলাদেশের কত ছেলে ইংরেজের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে জীবন দিয়েছে-তাদের নাম কেউ মনে করে না। কেহ যদিও মনে করে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হয়। এই বাংলাদেশের যুবকদের গলায় বাঙালিরাই তো ইংরেজের হুকুমে ফাঁসির দড়ি পরাইয়া দিয়েছে। একটু দুঃখ তো করে নাই, অনুতাপ তো দূরের কথা। বাংলার মাটির দোষই বোধহয়! যে বাঙালিরা আমাকে আসামি করছে, আটকাইয়া রাখছে, জেল দিতেছে—তারাও তো এই মাটিরই মানুষ এবং উচ্চ শিক্ষিত। এদের ছেলেমেয়ে ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যই তো আমি ও আমার মত শত শত কর্মীরা কারাবরণ করেছি। আরও কত লোকই না জীবন দিল তারই ভাইয়ের গুলিতে। এরাও একদিন বুঝবে, তবে সময় থাকতে না।

সিভিল সার্জন ও জেলের ডাক্তার সাহেবকে বললাম, যদি পারেন ভাল চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত করুন। এই অত্যাচারীদের কাছে মাথা নত করব না, মরতে হয় কারাগারেই মরব। পাপ আর পুণ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। মৃত্যু যদি জেলেই থাকে, হবে। একদিন তো মরতেই হবে। সন্ধ্যায় ঘরের ভিতর বন্ধ করে দেয়, আর ভোরবেলা তালা খুলে দেয়। কি করে স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে পারে!

 

২৫শে মে ১৯৬৭ বৃহস্পতিবার

আজ জেলের ডিআইজি মওলানা ওবায়দুল্লা সাহেব সেল এলাকায় এসেছেন। কয়েদিদের নালিশ শুনতে। প্রায় আধাঘণ্টা আমার কাছে ছিলেন, অনেক বিষয় আলাপ আলোচনা হলো। বললাম, আমি তো এখন রাজনৈতিক বন্দি নই, এখন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। পুরাপুরি জেল কর্মচারীদের অধীনে। আইবির হুকুম বোধ হয় এখন নিতে হয় না। মওলানা সাহেব বললেন, “চিঠিপত্র আইবির মাধ্যমে যাওয়া আসা করবে এটা আইনে আছে। আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করার সময় সাদা পোশাকে পুলিশ কর্মচারী থাকতে পারে না।”

 

“আমাদের সূর্য অস্তের সময় যে তালাবন্ধের নিয়ম আছে সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য তা একঘণ্টা বাড়িয়ে দিবার নিয়ম করেছিলেন সেটা আপনারা অনুসরণ করুন, কারণ এই গরমে সূর্যাস্তের সময় তালাবন্ধ হয়ে ঘরের মধ্যে থাকা সম্ভবপর নয়।” অনেক আইন নিয়ে আলোচনা হলো। তারপর বললেন, আমি সরকারকে লেখব অনুমতির জন্য। এই সরকার রাজনৈতিক কর্মীদের বন্দি করে কষ্ট দেবার সকল পন্থাই অবলম্বন করেছে। এখানেও যাহা হবে বুঝতেই পারি।

দৈনিক সংবাদ কাগজটাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। শুধু প্রকাশকের নাম বদলাবার অনুমতি না দিয়ে ১৬ বৎসরের কাগজটা বন্ধ করে দিতে পারে কোনো সভ্য সরকার? আবার বলে বেড়ায় গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এদেশে নাকি খুবই আছে। যে ভাবে ও যে পথে সরকার চলছে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে তাহা আমি দিব্য চোখে দেখতে পারি।

আজ পিডিএম এর সভা শেষ হয়েছে, কয়েকটা প্রস্তাবও নিয়েছে।

 

২৭শে মে২৮শে মে ১৯৬৭

ডিপুটি জেলার সাহেব খবর দিলেন ২৭ তারিখে জেলগেট কোর্টে আমার ১২৪ক ধারার মামলা শুরু হবে। আরও বললেন, আপনার ছেলেমেয়েদের সাথেও কাল দেখা করার অনুমতি পেয়েছেন। শরীর ও মন দুটোই খারাপ। অসহ্য গরম পড়েছে—যাকে বলা হয় ভ্যাপসা গরম। জেলের ভিতর এমনিই গরম থাকে। ১৪ ফিট দেওয়াল ঘেরা, বাতাস চেষ্টা করলেও আসতে কষ্ট হয়।

ভোর থেকে প্রস্তুত হয়ে আছি, কখন ডাক পড়বে ঠিক নাই। প্রথম খবর পেলাম হাকিম ১০টায় আসবেন। আবার খবর পেলাম ১১টায় আসবেন। আসতে আসতে প্রায় ১২টা বেজে গেছে। সিপাহি এসে বলল, “চলুন স্যার হাকিম এসেছেন সকলে বসে আছে।” তাড়াতাড়ি রওয়ানা হয়ে গেলাম।

জেলগেট নাজিমুদ্দীন রোডে, আর আমি থাকি ডিক্রি এলাকায় উর্দু রোডের পাশে। জেলটা ছোট না। যেয়ে দেখি জনাব সালাম সাহেব, জহিরুদ্দিন সাহেব, মশিয়ুর রহমান সাহেব, মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন এডভোকেট এসেছেন। এদিকে একটু পরেই আমেনা, মোস্তফাও এসেছে। খুলনা থেকে আলি ও অন্যান্য কর্মীরা এসেছে। মামলা শুরু হলো। সরকারি উকিল জনাব আলীম সাহেব এসেছেন সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে। ভদ্রলোক এতবড় বেহায়া যাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা, না জানে ভদ্রলোকদের সাথে আলাপ করতে। সরকারের নেমক খেয়েছে তার কর্তব্য পালনে একটু ত্রুটি নাই। তার নাকি একমাত্র গুণ হলো সাক্ষীদের ভাল করে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াতে পারে। তিনটা সাক্ষী হলো। জেরা পরে করা হবে। এটাও আমার পল্টন ময়দানের ১৯৬৪ সালের বক্তৃতার মামলা। দেড় ঘণ্টা সাক্ষী হলো, তারপর হাকিম চলে গেল। এডভোকেট সাহেবরা বসলেন আমাকে নিয়ে আলাপ করতে।

জহিরুদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম কমিটিতে যোগদান করতে পারবে না। কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে। যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তো নাই। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শোষক ও শাসকগোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের নেতারা বুঝেও বুঝতে চায় না। নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেব বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান না করলে তার সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যখন তিনি সভাপতি হয়েছেন পিডিএম-এর তখন তো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করে নাই। দেখলাম, জহির সাহেব ও সালাম সাহেব অসম্ভষ্ট হয়েছেন। মশিয়ুর ভাই আমাকে গোপনে বললেন, “লাহোর যেয়ে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছে এর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র আছে।“ আমাকে আরও বললেন, আমি যদি যোগদান না করি তবে তিনিও পিডিএম থেকে পদত্যাগ করবেন।

আমেনাকে বললাম, “৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শোভাযাত্রা পথসভা করবা।” সকলেই তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা ও অসুবিধার কথা বলল।

আড়াইটার সময় ফিরে এলাম। গোসল করে খাবার খেয়ে কাগজ নিয়ে বসলাম। পাঁচটায় আবার গেটে যেতে হলো। রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হাচিনা পরীক্ষা ভালই দিতেছে। রেণুর শরীর ভাল না। পায়ে বেদনা, হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ৬ দফা মানতে হবে-সংগ্রাম, সংগ্রাম–চলবে চলবে-পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, “ও শিখলো কোথা থেকে?” রেণু বলল, “বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।” বললাম, “আব্বা, আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক।” জামাল খুলনা থেকে ফিরে এসেছে। রেহানা খুলনায় যাবার জন্য অনুমতি চায়। বললাম, স্কুল বন্ধ হলে যাইও। কামালও বাড়ি যেতে চায় আব্বাকে দেখতে। বললাম, “যেও। কোথা থেকে যে সময় কেটে যায় কি বলব? জেলে সময় কাটতে চায় না, কেবল দেখা করার সময় এক ঘণ্টা দেখতে দেখতে কেটে যায়। ছেলেমেয়েরা বিদায় নিয়ে চলে গেল, আমিও আমার চির পরিচিত দেওয়ানী ওয়ার্ডের দিকে চললাম। ওবায়েদ কোর্টে গিয়াছিল দেখা হয়ে গেল পথে। বললাম, “খবর কি?” ওবায়েদ বলল, আপনার যাহা মত আমাদেরও সেই মত।

শাহ মোয়াজ্জেম ও নূরে আলম মাঠের মধ্যে বেড়াইতেছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এল। জিজ্ঞাসা করল, ভাবি কেমন আছে। বললাম, আমার শরীর খারাপ হওয়াতে বোধ হয় তারও শরীর খারাপ হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুতে হলো। দরজা বন্ধ করতে আসবে। জমাদার চাবি নিয়ে হাজির। সব বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও ভিতরে চলে গেলাম। খট করে বন্ধ হয়ে গেল বাইরের তালা। আমিও চা খেয়ে বই নিয়ে বসলাম।

২৮ তারিখের কাগজে দেখলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে—যাতে ৭ই জুন ৬ দফা দাবি দিবস’ পালন করতে না পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলো না।

সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়েও আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটাকে দমাতে হবে। এটাই হলো সরকারের উদ্দেশ্য।

আর একটা আশ্চর্য জিনিস আজ কাগজে দেখলাম, কলেজগুলির অনুমোদন নিতে হবে সরকারের থেকে। ইংরেজকেও হার মানাইয়া দিয়েছে এই সরকার। কলেজের অনুমোদন দিত বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজ আমল থেকে এ পর্যন্ত চলছিল এই নীতি। হঠাৎ সরকারের হাতে এই ক্ষমতা নেওয়ার অর্থ বুঝতে কারই বা কষ্ট হয়! ভুল করছেন, বুঝতে পারছেন না! বাঁধন শক্ত হলে ছিড়েও তাড়াতাড়ি।

শাহ মোয়াজ্জেম একটা বই লিখেছে, আমায় পড়ে শোনাল। ভালই লিখেছে, অনেকক্ষণ ওর সাথে আলাপ হলো আজ। বোধ হয় ৫/৭ দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে জেল থেকে চলে যাবে। আবার একলা পড়ে যাবো। মাঝে মাঝে ২০ সেল ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি চাই ওর মুক্তি হউক। আমার এই জীবনটাই একাকী কাটাতে হবে এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরে।

 

২৯শে মে৩১শে মে ১৯৬৭

যে মামলায় আমাকে ১৫ মাস জেল দিয়েছে জনাব আফসার উদ্দিন আহম্মেদ জেল গেটে কোর্ট করে, সেই মামলায় আমাকে জেলা জজ বাহাদুর জামিন দিয়েছে খবরের কাগজে দেখলাম। জামানতের কাগজ আজও জেল গেটে আসে নাই। দুই একদিনের মধ্যেই আসবে বলে মনে হয়। আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে যাবো। এক মাসের বেশি বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করলাম। রেণু এসেছিল জেল গেটে মণিকে দেখতে। ছেলেমেয়েরা ভালই আছে। মাংস মাছ পাকাইয়া নিয়ে এসেছিল, গেট থেকে পাঠাইয়া দিয়েছে। গরম করে করে দুইদিন এগুলিই খেলাম। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম ও চিত্ত বাবুকে রেখে তো খেতে পারি না, তাদেরও ভাগ দিলাম। আজ দিলাম অন্যান্য সকলকে। বড় ভাল লাগে সকলকে দিয়ে খেতে। কয়েদিদের একঘেয়ে পাক খেতে খেতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে একটু পরিবর্তন হলে ভালই হয়। রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে ঘরের জিনিস আনার হুকুম নাই। তবে কয়েদি হলে আনতে পারে। বিচিত্র দেশ, বিচিত্র আইন! রাজনৈতিক বন্দিদের ফল ফলাদি আনারও হুকুম নাই। আজ কাগজ দেখে ভীষণ আঘাত পেলাম। খবরটা পেয়ে আমার কথা বলাও বন্ধ হয়ে গিয়াছিল। ভাবতেও কষ্ট হয় বন্ধু সহকর্মী ডা. গোলাম মওলা ইহজগৎ ছেড়ে চলে গিয়াছেন। ডা. মওলা এমএসসি এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার ছিল। আমার সাথে পরামর্শ করে মাদারীপুরে প্র্যাকটিস করত। যেমন চেহারা তেমনি স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিল। মাত্র ৪৩ বৎসর বয়স হয়েছিল। এত ভাল স্বভাব ও মধুর ব্যবহার খুব অল্প লোকেরই আমি দেখেছি। মাদারীপুরের নড়িয়া থেকে ১৯৫৬ সালে এমএনএ হয়। ১৯৬২ সালে আবার আইয়ুব সাহেবদের পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। একদিনের জন্যও দলত্যাগ করে নাই। দেশের লোক তাকে ভালবাসতো। দলমত নির্বিশেষে সকলেই তাকে তার ব্যবহারের জন্য সম্মান করত ও ভালবাসতো। ডাক্তার হিসেবে তার যথেষ্ট নাম ছিল। দেশ একজন নিঃস্বার্থ নেতাকে হারাল। আর আমি হারালাম আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মীকে। কিছুই করতে পারব না শুধু খোদাকে ডাকা ছাড়া। বন্দি জীবনে এই সমস্ত খবর খুব কষ্ট দেয়। ডা, মওলার চেহারা বার বার ভেসে উঠছিল আমার চোখের সামনে। আমাদের সকলকেই তোমার পথের সাথী একদিন হতে হবে মওলা। দুই দিন আগে আর পরে। তোমার আত্মা শান্তি পাক এই দোয়াই খোদার দরবারে করি।

 

২২শে জুন ১৯৬৭ বৃহস্পতিবার

২২শে জুন খবরের কাগজে দেখলাম নারায়ণগঞ্জের বজলুর রহমান, ঢাকার হারুনুর রশিদ, তেজগাঁর মাজেদুল হক, রাজশাহী থেকে মুজিবুর রহমান, সিলেট থেকে জালালউদ্দিন সাহেব, দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সিরাজউদ্দিন, টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ আলি, খুলনার শেখ মোহাম্মদ আলি, চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরীকে মুক্তি দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতা। যাহা হউক সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, ছাড়তে যখন শুরু করেছে কিছু কিছু লোককে ছাড়বে।

২৫ তারিখে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হকও মুক্তি পেয়েছে। বেগম সাহেবা এসেছিলেন আমার বড় বোনকে সাথে নিয়ে। আমাকে দেখেতো কেঁদেই অস্থির। বললাম, “বুজি, তুমি কাঁদ কেন? আমার সত্যই কোনো কষ্ট হয় না। আর ভিতর বাইরে সবই সমান। যারা দেশ চালায় তাদের অনেকের মধ্যে দয়া মায়া তো দূরের কথা মনুষ্যত্বও নাই। চিন্তা করিও না।”

আমার বড় বোন ১৯ বৎসর বয়সে বিধবা হয়েছে। একটা মেয়ে কোলে আর একটা ছেলে পেটে ছিল যখন ভগ্নিপতি মারা যান। আমার ভাগ্নে আজ বড় হয়ে অর্থশালী হয়েছে, তিনটা ছেলেমেয়ে হয়েছে। আজও আমার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলে না। দেখা করতে এসে একদিন ছোট বাচ্চার মত কেঁদেছিল আর বলেছিল, “মামা ভাববেন না। মামী ও বাচ্চাদের যত টাকা লাগবে আমি দিব।” ওর টাকাও আছে, প্রাণও আছে।

৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!

দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *