৫.৪ মঙ্গল নাই আর

মঙ্গল নাই, মঙ্গল নাই।–ঘাড় নেড়ে বললে বনওয়ারী। সঙ্গে সঙ্গে গোটা কাহারপাড়া ঘাড় নাড়লে, ঠিক বনওয়ারীর মত করে। মঙ্গল নাই আর।

মাথলার ছেলেটা মরল। মুখে গাজলা ভেঙে কালো ছেলেটাও কেমন কালচে হয়ে গিয়েছে; হাতের তালু কালচে, ঠোট কালচে, নখগুলো পর্যন্ত নীল হয়ে গিয়েছে। বাবাঠাকুরের বাহনের জাতের দংশন নয়, এ সম্ভবত খরিস অর্থাৎ গোখুর বা কালকেউটের দংশন। কালকেউটে হওয়াই সম্ভব।

রতনের ছোট ছেলে টেব খুব টাটোয়ার’ অর্থাৎ চতুর বুদ্ধিমান, দিগম্বর ছেলেটা নিজের ঘুনসী টানতে টানতে বললেহেঁ গো! কালোপারা নিস্কেলে এই এতু বড়ি। সে দুই হাত মেলে। দেখালে মধ্যম আকারের এবং নিস্কেলে অর্থাৎ ঘোর কৃষ্ণ তার রঙ।

রতন বুক চাপড়ে কাঁদল। নাতিটির জন্য তার গভীর স্নেহ ছিল। ছেলে অর্থাৎ মাথলা তার সঙ্গে পৃথক হলেও ছেলেটা তার কাছেই প্রায় থাকত।

টেবা বললে—যেই গত্তের ভেতরে হাত ভরাল্ছে, অমনি কামুড়ে ধরেছে। ভাইপো বললে—কাকা রে, মোটা কাঁকুড়ি। খুব কামড়ান্ছে, তা কামড়াক; আমিও ছাড়ব না শালোকে। বলে বেশ জুত করে ধরে টেনে বার করে নিয়ে এল তো সাপ! হাতে ঝরঝর করে অক্ত পড়ছে। ছেড়ে দিলে ছাড়ে না শালা। তা’পরেতে জলে পড়ে শুষিয়ে চলে যেল শোঁ করে।

না হোক বাবাঠাকুরের বাহনের জাত। তবু সর্পাঘাত। ওই মিথলার ছেলেকে সর্পাঘাত সাবধান করে দিয়ে গেল। প্রথমে পানার ছেলে, তারপর মাথলার ছেলে। যার চোখ আছে সে দেখুক, যার জ্ঞান আছে সে বুঝুক। যার কান আছে সে শুনুক, বাবাঠাকুর বলছেন—সাবধান! সাবধান!

নইলে সাপের ভয় হাঁসুলী বাঁকে বড় ভয় নয়। এখানে সাপ প্রচুর। মনসার কথায় আছে। ‘লাগে-লরে’ অর্থাৎ নাগে-নরে একত্রে বাস করা সম্ভবপর নয়। কিন্তু হাঁসুলী বাঁকে সম্ভবপর।

আদাড়ে সাপ, পাদাড়ে সাপ, ঘরে সাপ, মাঠে সাপ, গাছের ডালে সাপ-সাপ নাই কোথা, সাপ নাই কবে? সুদ বলেহাঁসুলী বাঁকের পিতিপুরুষ বলে গিয়েছে, উনি সব্বত্ৰ আছেন— মা-বসুমতীকে ধরে অয়েছেন মাথায় করে।

সুচাঁদ পিসি বলেছেরকাল, ছেরকাল আছেন ওরা। মা-মনসার পল্লব ছড়িয়ে আছেন। পিথিমীময়। বনে বাদাড়ে, ঘরে পাদাড়ে, ঘাটে মাঠে, ঝোপে ঝাড়ে, জলেস্থলে সব্বত্ত। লাগ আর লর ইনি ওকে এড়িয়ে চলেন, উনি ওকে এড়িয়ে চলেন। মাঝে মাঝে ছামু-ছামু পড়ে এ বলে—গেলাম, ও বলেগেলাম। সেই সময় ‘ধৰ্য্য ধরো বাবা। হাতে তালি দিয়ে বলো— চলে যা, চলে যা। আর পেন্নাম করো। এঁরা সামানিতে অনিষ্ট করেন না; মাথায় পা, লেজে পা দিলে তবে ওরা চন্দ সুয্যিকে সাক্ষী এখে ছোবল মারবেন। আর মারেন কালের হুকুমে-বাবার হুকুমে, লইলে ওঁরা মন্দ লন। মানুষের উপকার করেন ইদুর ধরে। বাস্তু হয়ে কল্যাণ করেন। ভিটের।

খুব মিথ্যে কথা বলে না পিসি। নইলে মানুষ যত সাপ মারে, সাপে কি তত মানুষ মারে? মারে না। এই সেদিন নয়ানের মা ঘাস কাটতে গিয়ে ঘাসের সঙ্গে একটা কালো সাপের বাচ্চার মুণ্ড কেটে নিয়েছে। একেই বলে—‘নেকন’। ঘাসের মধ্যে মুখ লুকিয়ে, নয়ানের মা ঘাসের সঙ্গে মুঠো করে ঠিক ধরেছে মাথাটি। চারিদিকে ঘাস, মধ্যখানে ছিল মাথাটি—তাই কামড়াতে পারে নাই। তারপর ঘ্যাস করে কাস্তে দিয়ে কেটে ঝুড়িতে ফেলেছে। তখন বেরিয়ে পড়ে কাটা মুখটা; তখনও সেটা কামড়াবার জন্য হাঁ করছিল; ওদিকে মুণ্ডু-কাটা ধড়টা এঁকেবেঁকে আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছিল। হতভাগী বলেই সে বেঁচেছে, নইলে মরলে যে খালাস পেত; কিন্তু তা হবে কেন?

বনওয়ারীর নিজের বাড়িতে তো একটা বুড়ো খরিস প্রায় কুটুম্বিতে পাতিয়েছেন। প্রায়ই দেখা দেন। আসেন যান, ইঁদুর ধরেন, ব্যাঙ খান, পেট ফুলিয়ে মাঝ উঠানে পড়ে থাকেন। বনওয়ারী তাকে মারে না, মারবেও না। আবার নিজেও একটু সতর্ক হয়ে থাকে, গোপালী এবং সুবাসীকেও সতর্ক করে দিয়েছে, হাতে তালি না দিয়ে যেন ঘরে না ঢেকে, বাইরে না বের হয়। হাতে তালি দাও তুমি, উনি সরে যাবেন, যদি এগে’ থাকেন তবে গুঙিয়ে সাড়া দেবেন, বলবেনসাবোধান, আমি এগেছি। কাহারদের এ শিক্ষা আছে। ধৈর্য তাদের অপরিসীম। বনওয়ারীর ছেলেবেলায়, পরম আটপৌরের বাবার ধৈর্যের গল্প এ চাকলায় সবাই জানে। বর্ষার সময় কোপাইয়ে হয়েছিল বড় বান, চারিদিক ‘জলাম্পয়’ অর্থাৎ জলময়; পরমের বাপ শুয়ে ছিল ঘরের বারান্দায়। হঠাৎ মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল কিসের ঠাণ্ডা পরশে। কিন্তু নড়ল না সে। প্রথমটা বুঝে নিলে—কার পরশের ঠাণ্ডা এটা। যাঁরা মরে গিয়ে ‘বা-বাওড়’ অর্থাৎ ভূত হয়েছেন, তাঁদের কেউ ঠাণ্ডা হাত দিয়ে তাকে ডাকছে, না ‘লতাট’ কিছু? রাত্রে সাপের নাম করতে নাই, বলতে হয় লতা। ততক্ষণে ঠাণ্ডা হিম একগাছা মোটা রশি তার কোমরের উপরে পেটের উপর দিয়ে কাঁধের কাছ বরাবর চলেছে। কাঠ হয়ে পড়ে রইলে পরমের বাপ। আস্তে আস্তে তিনি চলে গেলেন পরমের বাপকে পার হয়ে। একবার পরমের বাপের একটা নিশ্বাস জোরে পড়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর যেই বুঝলেন, পরমের বাপ তার অনিষ্ট করতে চাইছে না—তখন আবার চলে গেলেন সরসর শব্দে পার হয়ে। বনওয়ারী নিজেই একবার বাড়ির দোরে ‘মাঝলা’ অর্থাৎ মাঝারি আকারের খরিসের ঠিক মাথার উপর পা দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাপটা পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল পায়ে। সে কি পাকের ‘কষণ’ অর্থাৎ পেষণ! তবু বনওয়ারী মাথার উপর পায়ের চাপ আলগা করে নাই। আলগা করলেই কামড়াত। শেষে কাস্তে দিয়ে সাপটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে প্ৰাণ বাঁচিয়েছিল। সাপকে ভয় নাই, ভয় বাবাঠাকুরের রোষকে আর কালের আদেশকে। ও দুটো মাথায় নিয়ে যখন সাপ বার হয়, তখন তাকে কেউ আটকাতে পারে না।

বাবার রোষ এবার ওঁরা যেন পেয়েছেন মনে হচ্ছে। ঢালাও হুকুম দিলেন নাকি বাবা? একটা অমঙ্গলের আঁচ যেন সকলের মনেই লেগেছে।

কাহারপাড়ায় একটা আতঙ্ক দেখা দিল। সাপের ভয় কাহারেরা করে না। কিন্তু এ যে বাবার কোপ বলে মনে হচ্ছে। বাবার কোপ কোনো সময়ের বাঁধ মানে না। বলছ, বছর ঘুরেছে? কিন্তু তোমার বছর আর বাবার বছর তো এক নয়।

প্ৰহ্লাদ রতন গুপী বললে—বনওয়ারী, রুপায় তোমাকেই করতে হবে। তোমার মুনিব নিউনাইন-বোডের হাকিম; তুমি ধরে পেড়ে এক লম্প করে কেরাচিনির ব্যবস্থা কর। আতবিরেতে–মাথার গোড়ায় নিবানো অইল, জেসলাই অইল। সন্দ হলেই ফস করে জ্বেলে ফেললাম।

যুদ্ধের জন্য কেরোসিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাবুদের পর্যন্ত টিকিট হয়েছে। যে যেমন ট্যাক্স দেয় ‘নিউনিয়ন-বোডে’—সে তেমন কেরাচিনি পায়। কাহারপাড়ায় ‘নিউনাইনবোডের কাজও নাই কৰ্মও নাই, রাস্তাঘাটও নাই, কাহারেরাও নগদ ট্যাক্স দেয় না, একদিন গতরে খেটে বেগার ট্যাক্স দেয় অন্য ‘গেরামের পথঘাট মেরামত করে। তাদের জন্য টিকিটও নাই। লুকিয়ে চুরিয়ে তেল পাওয়া যায়, কিন্তু সে দাম পাঁচগুণ। চোরাই বিক্রি। করালী বলে ওর নাম হল—‘বেলাক মারকাটি’। কে জানে কি নাম। ও নাম তাদের জেনেও কাজ নাই, ও দাম দিয়ে তেল কিনবার তাদের ক্ষমতাও নাই। করালী দু-একজনকে তেল দিচ্ছে। যুদ্ধের খাতায় নাম লিখিয়েছে, ‘ধরমকে বেচেছে, কুলকর্মকে ছেড়েছে, সে তেল পাচ্ছে। তেল পায়, চিনি পায়, আটা পায়, ঘি পায়, কাপড় পায়—পায় জলের দামে—বাজারে চালের দর ষোল টাকা উঠেছে—করালী পায় পাঁচ টাকায়। পায়, পেতে দাও। আর কেউ পাবার জন্য হাত পেতো না, মনে মনে আশও কোরো না। সাবোধান! সাবোধান! তবে বনওয়ারীর কর্তব্য বনওয়ারী করবে। যাবে সে বড় ঘোষের কাছে। কাহারপাড়াকে বাঁচাতে হবে, বাবাঠাকুরের বাহনের রোষ থেকে বাঁচাতে হবে মনে মনে তিন সন্ধে তাকে ডাক, মাথার গোড়ায় ‘লম্প’ও রাখ। তার উপর পড়েছে বর্ষা-আরম্ভ হবে ‘মালোয়ারী’, ‘কুনিয়ান’ চাই, সাবু চাই, চিনি চাই। সাবু-চিনিও বাজারে পাওয়া যায় না। পেলেও ওই আগুনের দর; যুদূর বাজার যে! এ বাজারে ‘নিউনাইনবোডের’ হাকিমের হুকুমে কাজ হবে।

বিকেলবেলায় মাঠের কাজ ফেলেই সে গেল ঘোষ মশায়ের কাছে। সন্ধের পর, কি রাত্রে মদ খেয়ে এসব কথা ঠিক গুছিয়ে বলা হয় না।

বড়কর্তা শুনে একটু হাসলেন। বললেন—কেরোসিন! পেলে আমি নিই।

বনওয়ারী কাতরকণ্ঠে বললে—আজ্ঞে তা হলে আমরা কি করব? সপ্যভয়, আর কিছু নয়। সাধারণ সপ্যভয় হলেও হত আজ্ঞে, এ হল দেবকোপ।

দেবকোপ?—বড়কর্তা একটু হেসেই প্রশ্ন করলেন। কাহারকুলের কৌতুকজনক কুসংস্কারের কথা শুনে আনন্দ আছে।

আজ্ঞে বড়বাবু, বাবাঠাকুর দণ্ড দেবেন বলে মনে হচ্ছে। করালী মারলে বাবার বাহনকে, পানার কারণে খুঁতো পাঁঠা বলি হল ওঁর কাছে, করালী বাবার শিমুলগাছে চড়ে নিদ্যেভঙ্গ করল বাবার

খুব সহৃদয় এবং গভীর উপলব্ধির ভান করে বড়কর্তা বারবার ঘাড় নাড়লেন হুঁ, তা বটে, কথাটা তুমি বাজে বল নি বনওয়ারীচরণ

বনওয়ারীর চোখে জল এল তার সহানুভূতিতে। চোখ মুছে বললে—বড়বাবু, চরম খ্যানত হয়ে গেল বাবার বিশ্ববিক্ষটি পড়ে গিয়ে। অ্যানেক কষ্টে তুললাম, গোড়া বাধিয়ে খাড়াও একেছি, কিন্তু বাবা তো ইশারা দিলেন যে, বিমুখ হয়েছি আমি। চললাম আমি তোমাদের থান থেকে।

বনওয়ারীর সঙ্গে কৌতুক বড়কর্তার বেশিক্ষণ ভাল লাগার কথা নয়, তার ওপর বনওয়ারী চোখ মুছতে শুরু করেছে, এর পর যদি হাউমাউ করে কাদে তখন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠবে; সময়ে সাবধান হয়ে তিনি গম্ভীর হলেন, বললেন হ্যাঁ। তা একটু সাবধানে থাকবে তোমরা।

আবার এক ঝলক রসিকতা ঠেলে যেন বেরিয়ে এল, বললেন—এবার আর মাঠ থেকে ধানপান চুরি করো-রো না যেন। বুঝেছ?

–আজ্ঞে না। এবার বাবাঠাকুরের থানে হলপ করার সব্বাইকে।

—ভাল। খুব ভাল। এখন বাড়ি যাও।

—আজ্ঞে, কেরাচিনি?

—কেরাচিনি তো নাই বনওয়ারী। গভীর দরদের সঙ্গে বড়কর্তা বললেন, ভদ্রলোকের ছেলেরা পড়তে তেল পাচ্ছে না। এবার বুঝলে, চন্ননপুরের বড়বাবু মাথা ঠুকে দু টিন কেরোসিন পেলেন না, শেষে বহু কষ্টে এক টিন। তা বুঝেছ, কোথায় পাব আমি বল?

বনওয়ারী একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠল। তা হলে আর কি হবে? যুদ্ধের ঢেউ এমনভাবে কখনও বোধহয় হাঁসুলী বঁকে আছাড় খেয়ে পড়ে নাই।

বড়কর্তা বললেন আর আলো জ্বেলেই বা কি করবে বনওয়ারী? বলছ বাবাঠাকুরের কোপ। তাই, হ্যাঁ, যা শুনলাম তাতে তা-ই বটে। তা হলে আলোই বল আর অন্ধকারই বল, সে কোপ কি এড়ানো যায়? একটু আধ্যাত্মিক হাসি হাসলেন বড়কর্তা, কপালে হাত দিয়ে বললেন—সব এই, বনওয়ারী, সব এই। লোহার বাসরঘরে লখাইকে কালনাগিনী দংশন করেছিল। দেবকোপ, ও কিছুতেই আটকায় না।

ঠিক কথা বলছেন বড়কর্তা। বনওয়ারী ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়েই উঠে এল। পথে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল সে। তবু আলো—একটু আলো না হলে কিভাবে চলবে? দেবকোপ বটে। কিন্তু মরণের আগে একটুখানি জল মুখে দেওয়া, একবার শেষ নজরের দেখা-আলো না হলে সেটুকু কি করে হবে?

সে বাবাঠাকুরের থানে এসে দাঁড়াল। হে বাবাঠাকুর! বহুক্ষণ সে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

তার সে তন্ময়তা হঠাৎ এক সময়ে একটা লালচে আভায় ঢেকে গেল। চোখে লাগল লাল ছটা। মাঠ ঘাট আকাশ সব লাল হয়ে উঠেছে হুই দূরে দেখা যাচ্ছে কোপাইয়ের বাঁকের জলে লালচে ছটা ঢেউয়ের মাথায় স্রোতের টানে যেন নাচছে।

প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়; একে বলে—‘ঝিকিমিকি বেলা’। মেঘ কেটে গিয়ে লাল আলোয় ভরে গেল আকাশ। ‘চাকি’ অৰ্থাৎ অস্তোনুখ সূর্য এখনও ডোবে নাই; পাটে বসে লালবরন রূপ নিয়ে হিলহিল করে কঁপতে কাঁপতে ঘুরছে। আকাশের মেঘে লাল রঙ ধরেছে। আকাশের দিকে। তাকিয়ে বনওয়ারী একটু চিন্তিত হল। কাল আবার জল নামবে। সকালবেলায় পশ্চিম দিকে ‘কড়’ অর্থাৎ রামধনু উঠেছিল, সন্ধ্যাবেলা রক্তসন্ধ্যা। জল নিৰ্ঘাত নামবে। এর উপরে জল হলে কিন্তু চাষের ক্ষতি হবে।

পশ্চিম আকাশের দিকে মুখ তুলে সে ভাবছিল। পিছন থেকে কে তাকে ডাকলে। — ব্যানোমামা!

কে ডাকে? মামা’ বলে কে ডাকে? গায়ের কন্যের কোনো ছেলে তো নাই গেরামে। সে ভঙ্গি করে মুখ ফেরাল। এ্যা; সেই করালীই বটে। গায়ের কন্যে বসনের কন্যে পাখীর সম্বন্ধ ধরে হারামজাদা বনওয়ারীকে মামা বলে আজকাল। ডাক শোনবামাত্র এই সন্দেহই তার হয়েছিল। সে কোনো উত্তর দিলে না; গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করে রইল।

করালী হেঁকে বললেপাড়ায় গিয়েছিলাম আমি, বলে এলাম সকলকে। আজকালের মধ্যে খুব জোর বিষ্টি হবে। পবল বিষ্টি! চন্ননপুরে তারে খবর এসেছে।

বনওয়ারীর হাসি পেল। তারে খবর এসেছে বৃষ্টি নামবে! চন্ননপুর থেকে করালীচরণ বিষ্টি বলছেন আজকাল! বল, বাবাধন বল। তারে খবর এসেছে! বনওয়ারীর তারের খবরে প্রয়োজন নাই বাবা কারকুলের পেল্লাদ। বনওয়ারীর কাছে বাবাঠাকুর আকাশময় খবর ছড়িয়ে দিয়েছেন। ঝড়, বাদল এর খবর কাহারেরা পিতিপুরুষ থেকে পেয়ে আসছে আকাশের কাছ থেকে, পিঁপড়ের কাছ থেকে, কাক-পক্ষীর কাছ থেকে, রামধনুর কাছ থেকে, বাতাসের গতিক থেকে; তুমি কাহারকুলের জাত হারিয়ে মেলেচ্ছ হয়েছ; তুমি চন্ননপুরে টেলিগেরাপের খুঁটিতে কান লাগিয়ে শোন গিয়ে এসব খবর।

করালী প্রশ্ন করলে—শুনছ?

বনওয়ারী তাচ্ছিল্যভরে বললেসে আমি জানি হে, সে আমি জানি।

করালী ঠোটটা ওল্টালে, ভুরু কেঁচকালে, তারপর ফিরল। কিন্তু আবার ফিরে বললে— মাথলার ছেলেটা সাপে খেয়ে মরল। যদি কেউ কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে যেত।

বনওয়ারী কি বলবে এ বেহায়াকে! মাথলার ছেলেটা মরল! আরে, মরল তো তোরই পাপে, তোরই শয়তানির কারণে।

করালী বললে—এবার যদি এমন হয় তো সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেয়ো মিলিটারি হাসপাতালে। সাপের বিষের ইনজেকশন আছে।

এবার বিরক্তিভরে বনওয়ারী বললে—ওরে, তু যা, যেখানে যেছিস যা, বুঝেছিস? যা, আপন পথে সোজা চলে যা।

—যাব, যাব! কেরাসিনের কি হল সেই কথাটা শুনে যাই। কি বললে তোমার বড়কর্তা? চোরের একশেষ উটি।

হুঙ্কার দিয়ে উঠল বনওয়ারী–করালী!

করালী গ্রাহ্য করলে না। হনহন করে চলে গেল। যাবার সময় বললে—পাও নাই তা আমি জানি।

 

জল নামল। বনওয়ারীর পাওয়া খবরও সত্যি, তারের খবরও সত্যি! মিলে গেল। সকালবেলা থেকেই নামল—রিমিঝিমি রিমিঝিমি। মেঘ যেন নেমে এল বাবার শিমুলগাছের মাথার গায়ে। মেঘের পর মেঘ, হু-হু করে চলে যাচ্ছে। পাতলা কালচে কুণ্ডলী পাকানো মেঘ। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে ত্ৰিভুবন।

বনওয়ারী হালের মুঠো চেপে ধরে বলদ দুটোকে থামালে। ব্যাপার তো ভাল নয়। এ যেন। প্রলয়ের মেঘ। দূরে হাল বইছিল প্ৰহাদ, সে তাকে হাঁকল।

প্রহ্লাদ থমকে দাঁড়িয়েছে। সে বললে–হুঁ।

–নামবে নাকি? পেললাদ?

প্ৰহ্লাদ একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। নামবার লক্ষণ যেন মিলে যাচ্ছে, নামবে হাতি। আকাশ থেকে হাতি নেমে থাকে। দু-দশ বছর অন্তর নেমে থাকেন দেবরাজের হাতি। কাল সন্ধ্যাতে যেন তার লক্ষণ ছিল। বনওয়ারীর বুঝতে পারা উচিত ছিল। সন্ধেকালের সেই লাল ছটামাখা আকাশভরা মেঘের মধ্যে সিঁদুরের মত লাল গোল মেঘখানি বারবার ঠেলা দিয়ে উঠছিল। সে তো মেঘ নয়। দেবহস্তীর সিঁদুর-মাখানো গোল মাথা সেটি। দেবরাজও তবে এবার ক্ষেপলেন। ক্ষেপবেনই তো। বাবাঠাকুরের কোপ হয়েছে, ঊনপঞ্চাশ সালে পবন মেতেছেন, দেবরাজের কি না ক্ষেপে, না মেতে উপায় আছে? হাতি নামবে! নামবে কি? নামল। ওইওই দেখা যাচ্ছে, পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে, সায়েবডাঙার মাঠের ওপারে বরমপালির খোয়াইয়ের পারে আকাশ থেকে নেমেছে—দেবহস্তীর প্রবল গঁড়। মেঘ থেকে দশটা তালবৃক্ষের মত—মোটা গোল একটা থাম শো-শো করে নামছে—মাটির দিকে। থাম নয়, হাতি! হাতির শুড়! মাঠের মধ্যে রব উঠল—পালাপালাপালা।

—গরু খুলে দে, হাল থেকে গরু খুলে দে। গোবধ হবে।

খোলা পেতেই ভয়ার্ত গরুগুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে লেজ তুলে ছুটল, ডাকছে–হাম্বা–হাম্বা।

গাই ডাকছে বাছুরকে। বাছুর ডাকছে গাইকে। ছাগলগুলো চেঁচাচ্ছে। ভেড়াগুলো নীরবে ছুটছে। হাঁসগুলো প্যাক প্যাঁক শব্দ করে জল থেকে উঠে ঘরে গিয়ে ঢুকছে। চকিত হয়ে ভয়াৰ্ত পাখিগুলো একসঙ্গে কলরব করে ডাকছে। গাছের শাখায় হনুমানগুলো ডাল আঁকড়ে ধরে ভয়ে কাঁপছে।

পশ্চিমদিকে চেয়ে দেখে বনওয়ারীর বুকের ভেতরটাও গুরগুর করে উঠল। চারিদিক জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। তারই মধ্যে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত লম্বা কালো প্ৰলয়স্তম্ভের মত বিরাট এবং গোল—দেবহস্তীর সে গঁড় ঘুরপাক খেতে খেতে এক ভীষণ শো-শো-শে ডাক ছেড়ে চলে আসছে—পালাও পালাও। ওর মধ্যে পড়লে রক্ষে নাই। আছড়ে পড়বে মাটিতে, দম বন্ধ করে। মেরে মাটিকে কাদার মত ঘেঁটে তার মধ্যে আধ-পোতা করে দিয়ে যাবে। মাঠসুদ্ধ লোক ছুটে পালিয়ে গেল উত্তর মুখে; বনওয়ারীও ছুটে গিয়ে দাঁড়াল জাঙলের আমবনের আশ্রয়ে।

দেবলোকের হাতি ইন্দ্ররাজার বাহন। জল দেন ইন্দ্ররাজা। হাতিতে চড়ে মহারাজ মেঘের সাত সমুদ্র ঘুরে বেড়ান, তার বাহন মেঘের সাত সমুদ্র থেকে শুঁড়ে জল টেনে নিয়ে ছিটিয়ে দেয়। চারিধারেঝরো-ঝরো-ঝরো-ঝরো-ঝরো-ঝরো। মধ্যে মধ্যে ইন্দ্ররাজা হাতের ‘ডণ্ড’ তার নাম ‘বজ্জডণ্ড’ অর্থাৎ বজ্ৰদণ্ড, সেই ‘ডণ্ড’ দিয়ে মেঘের সমুদ্রে আঘাত করেন। তা থেকে ঝলকে ওঠে আগুনের লকলকানি। কড়কড় কড়কড় শব্দে বাজ ডেকে ওঠে। কখনও কখনও পাপী-তাপীর উপর এসে পড়ে সেই বাজ। পাপী শুধু মানুষই নয়, গাছপালা পশুপাখি কীতপতঙ্গ সবার মধ্যেই পাপী আছে। কখনও কখনও ইন্দ্ররাজার ভাই পবনদেবও তার সঙ্গে। বার হন—এই ছিল নিয়ম। কিন্তু মধ্যে মধ্যে ইন্দ্ররাজার হাতিটা ক্ষেপে উঠে পিলখানা থেকে। শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মেঘের সাত সমুদ্রে। তখন মেঘ কালো হয়ে তোলপাড় করতে থাকে। মনে হয়, দিন বুঝি রাত হয়ে গেল। তখন সেই ক্ষ্যাপা হাতি নামিয়ে দেয় তার লম্বা গঁড় মাটি পর্যন্ত, দোলাতে দোলাতে চলতে থাকে। যেদিকে যায়, সেদিকে এমন জল দিয়ে। যায় যে, মাঠঘাট ভেসে সে এক প্ৰলয় কাণ্ড বেধে যায়। ধুয়ে মুছে ধান উপড়ে আল ভেঙে তাণ্ডব করে তোলে। মাইতো ঘোষ বলেন–জলস্তম্ভ। হে বাবাঠাকুর, হে কালরুদ্র, মাইতো ঘোষের অপরাধ নিয়ো না।

হঠাৎ প্ৰহ্লাদ তার হাত ধরে টানলে। সে প্রহ্লাদের দিকে তাকাতেই প্রহ্লাদ বললে—কি হল কি তোমার? আসছে যে!

এসে পড়েছে সেই প্ৰলয় জলস্তম্ভ। গোঁ-গোঁ গর্জন করে আসছে। সমস্ত লোক মাটিতে শুয়ে প্ৰণিপাত জানাচ্ছে। বনওয়ারীর খেয়াল হল, সে উপুড় হয়ে শুয়ে প্ৰণাম জানালেনমো নমো নমো, হে দেবতার বাহন! তুমি কি এসেছ প্রভু বাবাঠাকুরের বাহনের মৃত্যুর শোধ নিতে? আগুন জ্বালিয়ে তাকে মেরেছে—তুমি জল ঢেলে তার শোধ নিতে এলে? সে ধীরে ধীরে শুধু মাথাটি তুললে।

হাতিটা আসছিল পশ্চিম দিক থেকে পুবমুখে। আকাশ আর মাটিতে একাকার করে গঁড়। দুলিয়ে দেবতার ক্ষ্যাপা হাতি মাঠে উঁইয়ে জল ঢেলে, ঠেসে মেরে চলে গেল জাঙলের কোল ঘেঁষেবাবাঠাকুরের থানটিকে বায়ে রেখে, সোজা পুবমুখে হুই চলে গেল নদীর ধারে। ওঃ, মহাশব্দে ধসিয়ে দিলে খানিকটা পাড়! ওই ওপারে গিয়ে ঘুরছে—ঘুরছে। ওই গিয়ে পড়ল মহিষডহরীর ডডামপাড়ার ধারে। ডোমপাড়ার শেষ প্রান্তে রামকালী ডোমের ওই ঘর। ক্ষ্যাপা হাতির ক্ষেপামির কথা কে বলতে পারে? রামকালীর অপরাধের কথাই বা কে জানে? রামকালী ডোমের ঘরের উপর পড়ল আক্রোশ। চাপালে সেই ঘরের উপর তার ‘পেল্লায়’ শুঁড়। হুড়হুড়। করে ঢাললে জল, দুড়দুড় করে ভেঙে পড়ল ঘরখানা, ঘরের লাগোয়া ছিল একটা তালের গাছ, গাছটার গোড়া খুলে উপড়ে ফেলে দিলে সেটাকে। তারপর ওই চলল, ওই। কি হল? থামল? হ্যাঁ হাতিকে থামতে হয়েছে, শুঁড় গুটাচ্ছে। বোধহয় ক্ষ্যাপা হাতির সন্ধানে বেরিয়ে ‘ইন্দরাজা ধরেছেন তার নাগাল; মাথায় মেরেছেন ‘ডাঙশ’। ওই যে-কড়কড় করে বাজ ডেকে উঠল। হাতি শুড় গুটিয়ে ওই চলে গেল স্বস্থানে।

যাক। বনওয়ারী এর মধ্যে একটা ভরসা পেলে। বাঁশবাঁদির কোনো অনিষ্ট হয় নি। বাবাঠাকুর আছেন। যান নি। ‘যাব’ বললেই যেতে দেবে কে? কাহারপাড়া বিবৃক্ষটিকে যেমন আঁকড়ে ধরে টেনে তুলেছে, তেমনিভাবে আঁকড়ে ধরবে। বনওয়ারী কেঁদে ফেললে।

হে বাবা, তুমিই ভরসা কাহারপাড়ার, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। যদিই নামে আবার ক্ষ্যাপা হাতি, তবে রক্ষে কোনো তুমি। আঙুল দেখিয়ে বোলো-ইধার নেহি, উধার যাও। বলে দিয়ো, দেখিয়ে দিয়ো—এই চন্ননপুরের কারখানাকে। আর ওই আকাশে উড়ে যাচ্ছে—দিন নাই, রাত নাই, বর্ষা বাদল নাই, ঝড় ঝাপটা নাই, ওই উড়োজাহাজগুলোকে। মাথার উপর দিয়ে গো-গো করে আসছে যাচ্ছে, ওইগুলোকে খুঁড়ে ধরে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলতে হুকুম দিয়ো।

ওঃ, হ-হ-হ-হ! কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে মেঘের ভেতরে ভেতরে যাচ্ছে বুঝবার উপায় নাই; কেবল গোঙানি শোনা যাচ্ছে।

আঃ, ছি-ছিছি! কাহারপাড়ায় আবার ‘ল্যাই’ অর্থাৎ কলহ লাগালে কারা? তার তীব্রস্বর এরোপ্লেনের গোঙানিকেও ছাপিয়ে কানে এসে পৌছল বনওয়ারীর। মেঘের দিকে চেয়ে উড়োজাহাজটিকে দেখা আর তার হল না। পাড়ায় ছুটতে হল।

পাড়াতেও আর যাওয়া হল না। বড়ঘোষের ডাক নিয়ে চাকরের সঙ্গে দেখা মাঝপথে। এক্ষুনি। বড়কা রাগে কাঁপছে।

সত্যিই রাগে কাঁপছেন বড়কর্তা। বড়কর্তার রাগই স্বভাব। ওই অমনি কেঁপেই থাকেন। সামান্য কারণেই ক্ষেপে যান।

চিৎকার করে উঠলেন বড়কর্তা—আমার উপরে নালিশ!

–নালিশ। আপনার উপরে? আমি?

–হ্যাঁ। কিছু জান না তুমি? করালীকে দিয়ে নালিশ করাও নি?

–আজ্ঞে? আপনার পায়ে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমি কিছু জানি না। মিছে বুলি তো বজ্ৰাঘাত হবে মাথায়। অঙ্গ খসে যাবে।

করালী চন্ননপুরে ইউনিয়ন-বোর্ডের আপিসে নালিশ করেছে, দরখাস্ত করেছে—কাহারদের কেরোসিন দেওয়া হয় না কেন? যদি হয়, তবে সে তেল নেয় কে? তার খোজ করা হোক। এবং তাদের বরাদ্দ তেল দেওয়ার হুকুমনামা এই খোদ আপিস থেকে দেওয়া হোক।

বনওয়ারী মাথায় হাত দিলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে উঠল। বললে—এর পিতিবিধান আমি করব। চরণে হাত দিয়ে বলে গেলাম আপনাকে।

ফিরল সে পাড়ায়। ঝগড়া তখনও চলছে—তুমুল ঝগড়া।

আজ ঝগড়া বেধেছে সুচাঁদ এবং নয়ানের মায়ের মধ্যে। সর্বনাশ!

সুচাঁদ ধেই-ধেই করে লাফিয়ে নাচছে, আর মোটা গলায় চিৎকার করছে—বেটার মাথা। খেয়েছিল, এইবার চোখের মাথা খাবি। ভাতে হাত দিতে ছাইয়ের গাদায় হাত দিবি। ভূত হয়। নাই বলছিস? দেখবি লো, দেখবি। সে এই মাগীর ঘাড় ভাঙবে, ওই মিনসের ঘাড় ভাঙবে, তা’পরে তোর ঘাড়ে চাপবে। তু ঘাড় নাড়বি, চুল দোলাবি, আর বলবি“আমি কালোশশী। কথার শেষে সঁচাদ সর্বাঙ্গ দুলিয়ে দুই হাত নাড়া দেয় বারকয়েক।

ওদিকে নয়ানের মা তীব্ৰস্বরে বলে যাচ্ছে—সুচাঁদের বলার সঙ্গেই বলে যাচ্ছে—হে বাবাঠাকুর, তুমি ধ্বংস কোরো বাবা, যে তোমার বাহনকে মারলে, যে পরের ঘর ভাঙলে, গাঁয়ের বিধান না মেনে যে উঁচু ঘর বাঁধলে, তাকে ধ্বংস কোরো—তাকে ধ্বংস কোরো। যেমন করে উড়োজাহাজ পেড়ে ফেললে আজ, তেমনি করে পেড়ে ফেলো।

চমকে উঠল বনওয়ারী। উড়োজাহাজ পেড়ে ফেললে কি?

নসুবালা সংবাদ এনেছে—সাঁইথিয়ার ময়ূরাক্ষীর ধারে একখানা উড়োজাহাজ আজ মুখ থুবড়ে আছাড় খেয়ে পড়েছে। নিচে নামছিল, হাতির খুঁড়ে জড়িয়ে তাকে মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলেছে। করালী গেল সাঁইথিয়া সেই ‘ম্যান’দের সঙ্গে। বসনকে খবর দিয়েই সে বিলাপ করতে করতে ফিরছে চন্ননপুর।

জয় বাবাঠাকুর! জয় দেবরাজার হস্তী! জয় ধর্মের! বনওয়ারীর অন্তর অপরূপ শান্তিতে ভরে উঠল। বুকে বল পেলে।

সদৰ্পেই সে অগ্রসর হল। কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হল তাকে। ওদিকেও একটা ঝগড়া বেধেছে যেন। গোপালীবালার গলা মনে হচ্ছে। আর একটা সুবাসীর। পানাও নিজের ঘরে বসে গাল দিচ্ছে। কি হল?

হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় ঝগড়ার কারণ যত জটিল, তত বিচিত্র। আজ দুটো ঝগড়া একসঙ্গে পাকিয়েছে। একদিকে নসু খবর এনেছে উড়োজাহাজ ভেঙেছে। নয়ানের মা সেই শুনে উল্লাসে নাচছে। ওদিকে আজ বিকালে অর্থাৎ বনওয়ারী যখন মনিব-বাড়িতে ছিল, তখন আর এক কাণ্ড ঘটে গিয়েছে রমণ আটপৌরের ঘরে; রমণের স্ত্রী—সুবাসীর মাসি, কালোশশীর বোন—হঠাৎ পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জ্ঞান অবশ্য হয়েছে, কিন্তু এখন সে ঘোরের মধ্যেই পড়ে রয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হয় নাই লোকের। এলোচুলে লঙ্কা নুন পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে বসেছিল সে আজই ভরা দুপুরবেলায়, সেই সময়। আজ শনিবার অমাবস্যে। ক্ষণের মুখে এই লোভনীয় খাদ্য খেতে বসায় এঁটো হাতের সুযোগ এবং এলোচুলের অপরাধে তাকে পেয়েছে কোনো অশান্ত প্রেতলোকবাসী। এবং সে প্রেতলোকবাসী যে কে, বাবাঠাকুরের কৃপায়, হাঁসুলী বাঁকের উপকথার শিক্ষায় তাও কাহারদের জানতে বাকি নাই, সে আর কেউ নয়, সে হল কালোশশীর প্রেতাত্মা। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে তার ‘অঙের খেলার সাধ। মেটে নাই তার, অঙের খেলায় লঘু-গুরু জ্ঞান হারিয়ে নিজের স্পর্শে ‘বাম্ভন’ তুল্য ছত্রী জাতের ভূপসিং মহাশয়ের জাতিপাত করার পাপ নিয়ে সে মরেছে, সে ওই দশা পাবে বৈকি!

পানা তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে আজও পুত্ৰশোক ভুলতে পারে না। সে যোগ দিচ্ছে। বাবার থানের ধূপ পিদিম অপবিত্ত করে দিয়েছে। হবে না। আমি সাজা পেয়েছি, আরও কত জনকে পেতে হবে।

ওদিকে মৃত কালোশশীর সম্বন্ধে এই সকল তথ্যের প্রতিবাদ করেছে তার বোনঝি সুবাসী। সে ঘরে এসে কাঁদতে বসেছিল। কান্নার মধ্যে সে মাসির প্রেতাত্মাকে ডেকে বলেছিল—তুমি যদি তাই হয়ে থাক, তবে নাও-লাও; শত্তুদিগে লাও।

এই কান্নার প্রতিবাদ করেছিল বনওয়ারীর বড়বউ। বলেছিল-ভরাভর্তি বেলায় এমন করে কেঁদো না তুমি।

এই প্রতিবাদে সুবাসী কেঁদে বলেছিল মৃত মাসিকে উদ্দেশ করেওগো, কত ভালবাসতে গো আমাকে তুমি, আমার রুপকার কর। লাও লাও, আমার শত্তুকে লাও, তোমার শত্তুকে লাও। আমার কাঁটা তুলে দাও।

‘কাঁটা’ মানে সতীন-কাঁটা। সতীন মানেও শত্রু। সতীনের চেয়ে বড় শক্ৰ কে? এই লেগেছে ঝগড়া গোপালীবালা এবং সুবাসীর মধ্যে। পাড়ার সকলেই গিয়েছে দেখতে। এর মধ্যে সুবাসীর সঙ্গে পাখীর ভাব আছে বলে এবং কালোশশী বনওয়ারীর প্রিয়তমা বলে নয়ানের মা গোপালীর পক্ষ নিয়েছে। ঠিক সেই কারণেই সুচাঁদ নিয়েছে সুবাসীর পক্ষ। করালী এবং পাখীর উপর আর সুষ্ঠাদের রাগ নাই। করালী তাকে পাকী মদ খাইয়েছে, কাপড় দিয়েছে, পায়ে ধরেছে, কোলে করে নেটেছে। নয়ানের মা সুবাসীকে বলেছে—মরলে যদি ভূত হয়, আর ভূত যদি কথা শুনত, তবে স্বামী-পুতু, শ্বশুর-শাশুড়ি একঘর ভূত থাকত আমার। আর যার ঘাড় ভাঙতে বলতাম তারই ঘাড় ভাঙত। মরণ!

তার প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গে করেছে সুচাঁদ—মরলে ভূত হয় না? তোর ঘাড়ে যখন চাপবে তখন বুঝবি।

এই আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সুবাসী প্রতিবাদ করতে গিয়েছে তার মাসি কালোশশীর প্রেতত্ব বা পেত্নীত্ব প্রাপ্তির। কিন্তু তারই পক্ষ নিয়ে সুচাঁদ তীব্র প্রতিবাদে প্রমাণ করতে আরম্ভ করেছে। কালোশশী নিশ্চয় পেত্নী হয়েছে এবং সুবাসীর শত্রুদের সে নিপাত করবে।

বনওয়ারীর নিজের বাড়ি অবশ্য এখন স্তব্ধ। গোপালীবালা, সুবাসী দুজনেই চুপচাপ শুয়ে আছে আপন আপন ঘরের দাওয়ায়। ভাত পর্যন্ত হয় নাই। বনওয়ারীর সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ল নিজের স্ত্রীদের উপর। সুবাসীর উপরেই রাগটা বেশি হল। আজ সে জানতে পারলে, সুবাসীর সঙ্গে পাখীর নাকি ভাব আছে; তার উপর কালোশশীর প্রেতাত্মাকে ডেকেছে। একটা লাঠি টেনে নিয়ে তার চুলের মুঠো ধরে সে তাকে ঠেঙাতে আরম্ভ করলে। তাকে ঠেঙিয়ে সে ঠেঙালে গোপালীবালাকে। তাকেও দিলে অল্প কয়েক ঘা। তারপর সে লাঠি হাতে এসে দাঁড়াল সুচাঁদ এবং নয়ানের মায়ের মাঝখানে। সঙ্গে সঙ্গে সুচাঁদ পিছু হঠতে লাগল। কয়েক পা পিছু হঠে সে হনহন করে চলে গেল মাঠের দিকে। সেখানে কোথাও বসে সে গাল দেবে, পরিশেষে সে কাঁদবে মৃত বাপকে স্মরণ করে, কারণ বনওয়ারী ভাইপো হয়ে তাকে লাঠি দেখিয়েছে। নয়ানের মা কিন্তু পালাল না। সে বিড়ালীর মত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

পানার উদ্দেশ নাই। সে ঘরে খিল দিয়েছে। তার বউ বললে—জ্বর হয়েছে, শুয়েছে।

–দাদা! ঠিক এই সময় কে পিছন থেকে ডাকল।

–কে?

–আমি বসন।

হ্যাঁ, বসন। বসনের কোনো অপরাধ নাই; তবুও করালী-পাখীর কারণে তাকে দেখে বনওয়ারী প্রসন্ন হতে পারলে না। গম্ভীর মুখে বনওয়ারী বললে–কি?

একখানা কাগজ তার হাতে দিয়ে বসন বললে–তোমার কাড।

—কাড?

–হ্যাঁ। কেরাচিনি, চিনি—এই সবের ছাড়। নেওনাইন বোড থেকে দিয়েছে, নসু দিয়ে গেল আমাকে। সেকেটারি করালীকে দিয়েছিল। জাঙলের হেদো মণ্ডলের ছেলে আইছিল, সে সবারই দেখে সবাইকে দিয়েছে, এইটি তোমার।

কাৰ্ডখানা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল বনওয়ারী। তারপর সে বার হল পাড়ায়। নিউনাইন-বোডে এমন কথা বলতে করালীকে কোন্ কাহার বলেছে?

কেউ বলে নাই।

সকলে চুপ করে রইল।

—ফেলে দাও কাড।

প্ৰহ্লাদ বললে-ব্যানোভাই!

–না।

—না লয়।একটু শক্ত হয়েই সে বললে—সে ভাই অল্যায় হবে। ভেবে দেখ তুমি? কাড দিয়েছে নিউনাইন-বোড। আমরা বেগার দি। আমাদের কাড কেন ফেলে দেব?

—হুঁ। কিন্তু যদি কেউ শুধায়, ঘোষ মশায় তোমাদের কেরাচিনি মেরে দিত কি না?

–তা কেন বলব? সে বলব কেন?

–করালীকেও বলতে তোমরা বল নাই?

–না, কেউ বলে নাই। মুখ থাকতে নাকে ভাত কেউ খায় নাকি? বললে তোমাকে বলতাম আমরা।

বাস্। বাস্। প্রহ্লাদ বনওয়ারীর ঘেঁড়া কাৰ্ডখানি এনে জুড়তে বসল।

বনওয়ারী বাড়ি এসে বিছানায় শুয়ে মনে মনে বাবাঠাকুরকে ডাকতে লাগল।

ঝমঝম করে জল নেমেছে আকাশ ভেঙে। আবার হাতি নামবে নাকি?

কে ডাকছে এর মধ্যে! কে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে! সুবাসী দরজা খুলতে গেল, কিন্তু ধমক। দিয়ে বনওয়ারী বললে–অ্যা-ই!

কে জানে কে! মানুষ কি না তাই বা কে জানে! কালোশশী নয়, কে বলবে! আজ আবার কালোশশী সাড়া দিয়েছে।

—কে—কে তুমি?

কাঙাল, কাঙাল আমি। অমনকাকার বউ মারা গেল, খবর দিতে এসেছি।

মারলে তবে কালোশশী! বনওয়ারী বাবার নাম করে বেরিয়ে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *