৫.১ বিবাহিত নারী

বিবাহিত নারী
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৫ –পরিস্থিতি। 
পরিচ্ছেদ ১

সমাজের দেয়া নারীর প্রথাগত নিয়তি হচ্ছে বিয়ে। এতা এখনো সত্য যে অধিকাংশ নারীই বিবাহিত, বা বিবাহিত ছিলো, বা বিয়ের পরিকল্পনা করছে, বা বিয়ে না হওয়ায় কষ্ট পাচ্ছে। কুমারীব্রতী নারীদের ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞায়িত করতে হয় বিয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, সে কি নিরাশ, না কি বিদ্রোহী, না কি ওই প্রথার প্রতি উদাসীন। আমাদের তাই বিয়ে বিশ্লেষণ করেই এ-বিষয়ে অগ্রসর হতে হবে।

নারীর পরিস্থিতিতে যে-আর্থনীতিক বিবর্তন ঘটছে, তাতে বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে বিবাহপ্রথা : এটা হয়ে উঠছে দুটি স্বাধীন মানুষের নিজেদের সানন্দ সম্মতিতে উপনীত মিলন; চুক্তিকারী দু-পক্ষের বাধ্যবাধকতা ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক; ব্যভিচার উভয়ের জন্যেই একটা চুক্তিভঙ্গ, একই কারণে একজন বা অপরজন বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। নারী আর প্রজননের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নয়, যা তার প্রাকৃতিক দাসীতুের চরিত্র অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে এবং এখন প্রজনন গণ্য হচ্ছে একটি স্বেচ্ছাপালিত ভূমিকা হিশেবে; এবং এটি উৎপাদনশীল শ্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কেননা, অনেক ক্ষেত্রে, গর্ভধারণের জন্যে মা যে-সময়টা অবকাশ হিশেবে নেয়, তার ব্যয় বহন করে রাষ্ট্র বা নিয়োগকারী। তবুও আমরা বাস করছি যে-পর্বে, নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি। একটি ক্রান্তিকাল। নারীজনসংখ্যার একটি অংশমাত্র নিয়োজিত উৎপাদনে, এবং এমনকি যারা নিয়োজিত, তারা অন্তর্ভুক্ত এমন সমাজের, যাতে প্রাচীন রীতিনীতি ও প্রাচীন কালের মূল্যবোেধ আজো টিকে আছে। আধুনিক বিয়েকে বোঝা যাবে শুধু। অতীতের আলোকে, যা নিজেকে স্থায়ী করতে চায়।

বিয়ে সব সময়ই নারী ও পুরুষের জন্যে খুবই ভিন্ন জিনিশ। দুটি লিঙ্গ পরস্পরের কাছে প্রয়োজনীয়, কিন্তু এ-প্রয়োজন তাদের মধ্যে কখনোই পারস্পরিকতার অবস্থা সৃষ্টি করে নি; আমরা দেখেছি যে নারী কখনোই এমন একটি জাত হয়ে ওঠে নি, যারা সমান অবস্থানে থেকে পুরুষজাতের সাথে দেয়ানেয়া বা চুক্তি করেছে। পুরুষ। সামাজিকভাবে এক স্বাধীন ও পরিপূর্ণ মানুষ; সর্বপ্রথম তাকে গণ্য করা হয় একজন উৎপাদনকারীরূপে, গোত্রের জন্য সে যে-কাজ করে, যা দিয়ে প্রতিপন্ন হয় তার অস্তিত্বের যাথার্থ : আমরা দেখেছি প্রজননের ও গৃহস্থালির যে-ভূমিকায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে নারীকে, সেটা কেননা তাকে সমমর্যাদার নিশ্চয়তা দেয় নি। নারী, দাসী বা। প্রজা হিশেবে, বিন্যস্ত হয়েছে পরিবারের মধ্যে, যাতে আধিপত্য করে পিতারা বা ভ্রাতারা, এবং তাকে সব সময়ই কোনো পুরুষ বিয়ে দিয়েছে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে। আদিম সমাজে পিতার গোত্র বস্তুর মতোই বর্জন করতে নারীদের : দু-গোত্রের চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হতো নারী। বিবর্তনের ফলে বিয়ে যখন চুক্তির রূপ নেয়, তখনও পরিস্থিতির বিশেষ বদল ঘটে নি। দীর্ঘকাল ধরে চুক্তি সম্পন্ন হয় শ্বশুর ও জামাতার, মধ্যে, স্ত্রী ও স্বামীর মধ্যে নয়; একমাত্র বিধবাই তখন ভোগ করতো আর্থস্বাধীনতা। তরুণীর পছন্দের স্বাধীনতা সব সময়ই ছিলো খুবই সীমিত; আর কুমারীত্ৰত–এটা যখন পবিত্ররূপ ধারণ করতো, সেগুলো ছাড়া তাকে পরিণত করতে পরগাছা ও অস্পৃশ্য সমাজচ্যুত মানুষে; বিয়েই তার ভরণপোষণের ও তার অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রতিপাদনের একমাত্র উপায়। দু-কারণে তার ওপর দেয়া হতো এ-আদেশ।

প্রথম কারণ হচ্ছে সমাজকে নারীর দিতে হবে সন্তান, খুব কম সময়ই–যেমন স্পার্টায় ও কিছুটা নাটশিদের শাসনকালে রাষ্ট্র নারীকে সরাসরি নিয়েছে নিজের অভিভাবকত্বে এবং তার কাছে চেয়েছে সে শুধু হবে মা। কিন্তু এমনকি আদিম সমাজগুলোও, যারা জানতো না প্রজননে পিতার ভূমিকা, তারাও দাবি করতো নারীর থাকতে হবে একটি স্বামী, এবং দ্বিতীয় যে কারণে নারীর ওপর বিয়ের আদেশ দেয়া হয়, তা হচ্ছে পুরুষের কামক্ষুধা মেটানা এবং ঘরকন্নাও নারীর দায়িত্ব। সমাজ কর্তৃক নারীর ওপর অর্পিত এসব দায়িত্বকে ধরা হয় তার স্বামীর প্রতি সেবাকর্ম বলে : বিনিময়ে পুরুষটির নারীকে দিতে হবে উপহার, বা তাকে বিয়ে করতে হবে, এবং তার ভরণপোষণ করতে ভাবে। পুরুষের বহুবিবাহ সব সময়ই কম-বেশি অনুমোদন করা হয়েছে : পুরুষ সঙ্গম করতে পারে দাসী, উপপত্নী, রক্ষিতা, বেশ্যার সঙ্গে, কিন্তু তার বৈধ স্ত্রীর কিছু অধিকার তাকে মেনে নিতে হয়। যদি পীড়ন করা হয় স্ত্রীকে বা অন্যায় করা হয় তার প্রতি, তাহলে স্ত্রীর অধিকার আছে–কম-বেশি স্পষ্টভাবে যার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। নিজের পরিবারে ফিরে যাওয়ার এবং পৃথক বাসের বা বিবাহবিচ্ছেদ লাভের।

তাই উভয় পক্ষের জন্যেই বিয়ে একই সময়ে ভার ও সুবিধা; কিন্তু দুটি লিঙ্গের পরিস্থিতির মধ্যে কোনো প্রতিসাম্য নেই; মেয়েদের সমাজে বিন্যস্ত হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিয়ে, এবং যদি তারা থাকে অবাঞ্ছিত, তাহলে সামাজিকভাবে তাদের গণ্য করা হয় অপচয় বলে। এজন্যেই মায়েরা মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্যে সব সময়ই উদ্বিগ্ন থাকে। গত শতকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে বিয়ের ব্যাপারে নারীদের সঙ্গে আদৌ কোনো আলাপ করা হতোনা।

এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটি থাকে চূড়ান্তভাবে অক্রিয়; তাকে বিয়ে দেয়া হয়, পিতামাতারা তার বিয়ে দেয়। ছেলেরা বিয়ে করে, তারা পত্নী গ্রহণ করে। বিয়ের। মধ্যে তারা চায় বৃদ্ধি, তাদের অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রতিপাদন, শুধু টিকে থাকার অধিকার নয়; এটা একটি দায়িত্ব, যা তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে।

বিয়ে বসে নারী নিজের বলে কিছুটা ভাগ পায় বিশ্বের; আইনগত অঙ্গীকার তাকে রক্ষা করে পুরুষের খামখেয়ালি কাজ থেকে; তবে সে হয়ে ওঠে পুরুষের ক্রীতদাসী। পুরুষটি এ-যৌথ উদ্যোগের আর্থনীতিক প্রধান; এবং এর পর থেকে সমাজের চোখে পুরুষটিই এ-উদ্যোগের প্রতিনিধিত্ব করে। নারীটি গ্রহণ করে পুরুষটির নাম; নারীটি অন্তর্ভুক্ত হয় পুরুষটির ধর্মে, তার শ্রেণীতে, তার সমাজে নারীটি যোগ দেয় পুরুষটির পরিবারে, নারীটি হয়েওঠে পুরুষটির ‘অর্ধেক’। পুরুষটি তার কাজের জন্যে যেখানে যায়, নারীটি সেখানে অনুসরণ করে তাকে এবং পুরুষটিই ঠিক করে তাদের বাসস্থান; নারীটি কম-বেশি চূড়ান্তভাবে ছিন্ন করে অতীতের সাথে সম্পর্ক, সে তার স্বামীর জগতের অন্তর্ভুক্ত হয়; নারীটি পুরুষটিকে দেয় তার দেহ, কুমারীত্ব এবং তাকে পালন করতে হয় কঠোর সতীত্ব। অবিবাহিত নারী আইনগতভাবে যা-কিছু অধিকার পায়, সে তা হারিয়ে ফেলে। রোমান আইন স্বামীর হাতে স্ত্রীকে ন্যস্ত করেছে লোকো ফিলিয়ায়ে, কন্যার স্থানে; উনিশ শতকের শুরুর দিকে রক্ষণশীল লেখক ঝের্নী ঘোষণা করেছিলেন শিশু যেমন মায়ের কাছে তেমনি স্ত্রী তার স্বামীর কাছে, ১৯৪২-এর আগে পর্যন্ত ফরাশি আইন দাবি করতে যে স্ত্রীকে হতে হবে স্বামীর অনুগত; আইন ও প্রথা আজো স্বামীকে দেয় মহাকর্তৃত্ব।

স্বামীটিই যেহেতু উৎপাদনশীল কর্মী, তাই সে-ই পারিবারিক স্বার্থ পেরিয়ে ঢেকে সমাজের স্বার্থে, সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথ ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য উন্মুক্ত করে নিজের জন্যে একটি ভবিষ্যৎ; সে হয় সীমাতিক্রমণতার প্রতিমূর্তি। নারী নষ্ট হয় প্রজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষার এবং গৃহস্থালির কাজে- অর্থাৎ বলা যায়, সীমাবদ্ধতায়।

বিয়েতে আজো অনেকাংশে টিকে আছে এ-প্রথাগত রূপ। প্রথমত, যুবকের থেকে অনেক বেশি স্বৈরাচারিতার সাথে এটা চাপিয়ে দেয়া হয় যুবতীর ওপর। সমাজে আজো আছে অনেক গুরিত্বপূর্ণ স্তর, যেগুলোতে তরুণীর জন্যে আর কোনো ঘটনাপরম্পরা খোল নেই; পল্লীর শ্রমিকদের মধ্যে অবিবাহিত নারী এক অস্পৃশ্য ব্রাত্য মানুষ; সে হয়ে থাকে তার পিতার, বা তার ভাইদের, বা তার দুলাভাইয়ের দাসী; যারা নগরে চলে যায়, সে তাদের সঙ্গে যেতে পারে না; বিয়ে তাকে একটি পুরুষের দাসী করে তোলে, তবে এটা তাকে একটা গৃহের গৃহিণীও করে। মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু কিছু বৃত্তে তরুণী আজো নিজের জীবিকা অর্জনে অসমর্থ; সে পারে শুধু তার বাপের বাড়িতে একটা পরগাছা হয়ে থাকতে বা কোনো অচেনা মানুষের বাড়িতে নিতে পারে কায়িক শ্রমের কাজ। এমনকি যখন সে অনেকটা মুক্তও, তখনও পুরুষের আর্থিক সুবিধার কারণে সে কোনো কাজ করার থেকে বিয়েকেই বেশি পছন্দ করে : সে এমন একটি স্বামী খোঁজে, যে মর্যাদায় তার থেকে ওপরে বা যে তার থেকে দ্রুত বা বেশি সাফল্য লাভ করবে বলে সে আশা করে।

এখনো মেনে নেয়া হয় যে কামের ব্যাপারটি হচ্ছে, আমরা দেখেছি, পুরুষের প্রতি একটি সেবামূলক কর্ম; পুরুষ সম্ভোগ করে এবং নারীকে কিছুটা অর্থ পরিশোধ করে। নারীর দেহ একটা জিনিশ, যা সে ক্রয় করে নারীর কাছে পুরুষটি হচ্ছে পুঁজি, যা সে শশাষণ করতে পারে। অনেক সময় নারীটি পণ নিয়ে আসতে পারে; বা প্রায়ই নারীটি দায়িত্ব নেয় কিছু গৃহস্থালির কাজের : ঘর দেখাশোনার, সন্তান লালনপালনের। তা যাই হোক, তার ভরণপোষণ লাভের অধিকার আছে এবং প্রথাগত নৈতিকতা এরই বিধান দেয়। স্বাভাবিকভাবেই সে প্ররোচিত হয় এ-সহজ উপায় দিয়ে, আরো অনেক বেশি প্ররোচিত হয় এ-কারণে যে নারীর জন্যে যে-সব পেশা খোলা আছে, সেগুলো অনুপযোগী ও সেগুলোতে বেতন খুবই কম; বিয়ে, এককথায়, আর সমস্ত থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক পেশা।

সামাজিক প্রথা অবিবাহিত নারীর যৌন স্বাধীনতা অর্জনকে আরো কঠিন করে তোলে। ফ্রান্সে স্ত্রীর ব্যভিচারকে, আজ পর্যন্ত, গণ্য করা হয় আইনগত অপরাধ বলে, কিন্তু নারীর অবাধ যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে কোনোআইন নেই; তবুও অবিবাহিত নারী যদি প্রেমিক নিতে চায়, তাহলে প্রথমে তাকে বিয়ে বসতে হয়। এমনকি আজো অনেক সঠিক-আচরণশীল মধ্যবিত্ত তরুণী বিয়ে বসে ‘শুধু স্বাধীন হওয়ার জন্যে’। বেশ কিছু মার্কিন তরুণী যৌন স্বাধীনতা লাভ করেছে; তবে সাদের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা অনেকটা ম্যালিনোস্কির দি সেক্সুয়াল লাইফ অফ দি সাভেজেজ-এ বর্ণিত তরুণীদের মতো, যারা ‘অবিবাহিত পুরুষদের গৃহ’-এ চর্চা করে অকিঞ্চিৎকর শৃঙ্গার : বোঝা যায় তারা পরে বিয়ে করবে যখন প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য হবে। আমেরিকায় কোনো একলা নারী নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন করলেও সে একটি অসম্পূর্ণ সত্তা; যদি সে একজন মানুষের সম্পূর্ণ মর্যাদা অর্জন করতে চায় এবং লাভ করতে চায় তার পূর্ণ-অধিকার, তাকে পরতে হবে একটি বিয়ের আংটি। মাতৃত্ব সম্মানজনক শুধু বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রেই; অবিবাহিত মা জনমতের কাছে এক অপরাধী, এবং সারাজীবন তার শিশু তার জন্যে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা।

এসব কারণে বহু কিশোরীই যেমন নতুন বিশ্বে তেমনি পুরোনোটিতে–যখন তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তারা আগের দিনের মতোই উত্তর দেয় : ‘আমি বিয়ে করতে চাই’। কিন্তু কোনো যুবকই বিয়েকে তার মূল লক্ষ্য মনে করে না। আর্থিক সাফল্যই তাকে দেবে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মর্যাদা; এ-সাফল্যের মধ্যে বিয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে কৃষকদের জন্যে। তবে এটা তাকে বিয়ে থেকে নিবৃত্তও করতে পারে। আধুনিক জীবনের অবস্থা–যা অতীত কালের থেকে কম সুস্থিত, অনেক বেশি অস্থির–যুবকের জন্যে বিয়ের শর্তগুলোকে বিশেষভাবে গুরুভার করে তোলে। অন্য দিকে এর উপকারিতা অনেক কমে গেছে, কেননা এখন তার পক্ষে আহার ও বাসস্থান পাওয়া অনেক বেশি সহজ এবং যৌনপরিতৃপ্তি সাধারণভাবে সুলভ। সন্দেহ নেই বিয়ে দিতে পারে কিছু বস্তুগত ও যৌন সুবিধা : এটি ব্যক্তিকে মুক্তি দেয় নিঃসঙ্গতা থেকে, তাকে গৃহ ও সন্তান দিয়ে নিরাপত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে স্থানে ও কালে; এটা তার অস্তিত্বের চূড়ান্ত চরিতার্থতা। তবে মোটের ওপর পুরুষদের চাহিদা নারীদের সরবরাহের থেকে কম। বলা যেতে পারে পিতারা কন্যা দান করে না, বরং মুক্তি পায় কন্যার ভার থেকে; স্বামীর খোঁজে থাকা মেয়ে পুরুষের চাহিদা অনুসারে সাড়া দেয় না, সে চেষ্টা করে একটা চাহিদা সৃষ্টি করতে।

ফ্রান্সে ঠিক-করা বিয়ে আজো অতীতের ব্যাপার নয়; একটা বিশাল সুদৃঢ় বুর্জোয়া শ্ৰেণী আজো এটি টিকিয়ে রেখেছে। নেপলিয়নের সমাধির চারপাশে, অপেরায়, বলনাচে, সৈকতে, চায়ের নিমন্ত্রণে বিবাহার্থী তরুণীটি, তার প্রতিটি চুল ঠিক জায়গায় রেখে ও নতুন গাউন পরে, ভীরুতার সাথে প্রদর্শন করে তার দেহের সৌন্দর্য ও বি আলাপচারিতা; পিতামাতা তাকে বলতে থাকে। ‘নানাজনকে দেখে ইতিমধ্যেই তুমি আমার অনেক খরচ করিয়েছো; তুমি মন ঠিক করো। পরেরবার দেখানো হবে তোমার বোনকে’। অসুখী প্রার্থী বুঝতে পারে সে যতোই আইবড়ো হবে, ততোই। কমতে থাকবে তার সুযোগ; তাকে বিয়ে করার প্রার্থীর সংখ্যা কম : একপাল মেষের বিনিময়ে দান করা হয় যে-বেদুয়িন মেয়েটিকে, সে-মেয়েটির থেকে বেশি পছন্দের স্বাধীনতা তার নেই। কলেৎ এটা প্রকাশ করেছেন এভাবে : ‘যে-মেয়ের কোনো ধনসম্পত্তি নেই বা নেই অর্থকরী পেশা… সে পারে শুধু সুযোগ এলে মুখ বুজে সেটি ধরে ফেলতে এবং বিধাতাকে ধন্যবাদ দিতে!’

তবে বিয়ের বাসনা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা প্রায়ই ভয় পায় বিয়েকে। তার জন্যে বিয়ে অনেক বেশি উপকারি পুরুষটির থেকে, তাই পুরুষটির থেকে মেয়েটি বেশি আগ্রহী হয় বিয়ের প্রতি; তবে এটা তার জন্য অধিকতর আত্মবিসর্জনও, বিশেষ করে এ-কারণে যে এর ফলে অতীতের সাথে তার সম্পর্কই ছিন্ন হয় প্রচণ্ডভাবে। আমরা দেখেছি বহু তরুণী বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে; দিন যতই ঘনিয়ে আসে যন্ত্রণা ততোই বাড়তে থাকে। এ-সময়েই অনেকের মানসিক ব্যাধি দেখা দেয়; সে-যুবকেরা বেলাও একই ব্যাপার ঘটতে পারে, যে নতুন দায়িত্ব নিতে ভয় পায়; কিন্তু এটা অনেক বেশি ঘটে তরুণীদের ক্ষেত্রে, এটা ঘটার কারণ ইতিমধ্যেই আলোচিত হয়েছে তবে এ-সংকট মুহূর্তে ওই কারণগুলো হয়ে ওঠে গুরুভার।

অনেক সময় বিয়েভীতি উদ্ভব ঘটে আগের কোনো অবিস্মরণীয় দুঃখজনক যৌন অভিজ্ঞতা থেকে, এবং প্রায়ই দেখা দেয় যে তার কুমারীত্বহানির ব্যাপারটি ধরা পড়ে যাবে, এ-ভয় থেকে। তবে একটি অচেনা পুরুষের কাছে নিজেকে দান করার ভাবনা যে প্রায়ই দুর্বহ হয়ে ওঠে, তার কারণ হচ্ছে বাপের বাড়ি ও পরিবারের সাথে মেয়েটির নিবিড় সম্পর্ক। এবং যারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের অনেকে কেননা এটা এমন কাজ, যা করতেই হবে, কেননা তাদের ওপর চাপ দেয়া হয়, কেননা এটাই একমাত্র কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সমাধান, কেননা স্ত্রী ও মা হিশেবে তারা চায় একটি স্বাভাবিক জীবন–তবুও তাদের মধ্যে থাকে একটা গোপন ও গভীরে-প্রোথিত প্রতিরোধেরবোধ, যা বিবাহিত জীবনের শুরুর সময়টাকে কঠিন করে তোলে, যা সুখকর ভারসাম্য অর্জনে চিরকাল বাধা দিতে পারে।

বিয়ে, তাই, সাধারণত প্রেমের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ফ্রয়েড এটা প্রকাশ করেছেন এভাবে : ‘স্বামীটি, বলতে গেলে, কখনোই প্রিয় পুরুষটির বিকল্প ছাড়া আর কিছু নয়, সে নিজে ওই পুরুষটি নয়’। এবং এ-পৃথকীকরণ কোনোভাবেই আকস্মিক ব্যাপার নয়। এ-প্রথার বিশেষ প্রকৃতির মধ্যে এটা দ্যোতিত রয়েছে, যার লক্ষ্য পুরুষ ও নারীর আর্থিক ও যৌন মিলনের ফলে সমাজের স্বার্থ রক্ষা, তাদের ব্যক্তিগত সুখ নিশ্চিত করা নয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন আজো কিছু মুসলমানের মধ্যে এমন হতে পারে যে পিতামাতারা যাদের বিয়ে ঠিক করেছে বিয়ের দিনের আগে তারা এমনকি পরস্পরের মুখও দেখে নি। সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবালুতা বা কামজকল্পনা ভিত্তি করে একটা আজীবনের কর্মোদ্যোগ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না।

যেহেতু পুরুষটিই ‘গ্রহণ করে’ নারীটিকে, তাই তার পছন্দ-অপছন্দ করার কিছুটা বেশি সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে যখন পাত্রীরা সংখ্যায় অজস্র। কিন্তু যৌনকর্মকে যেহেতু নারীর ওপর ন্যস্ত একটি সেবামূলক দায়িত্ব বলে গণ্য করা হয়, যার ভিত্তিতে তাকে দেয়া হয় সুযোগসুবিধা, তাই এটা যুক্তিসঙ্গত যে সে উপেক্ষা করবে তার ব্যক্তিগত বিশেষ অনুরাগগুলো। বিয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ হিশেবে নারীর স্বাধীনতা অস্বীকার করা; কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া যেহেতু প্রেমও থাকতে পারে না ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও থাকতে পারে না, তাই নিজের জন্যে আজীবন কোনো একটি পুরুষের রক্ষণাবেক্ষণ লাভের ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্যে তাকে ছেড়ে দিতে হয় একটি বিশেষ ব্যক্তিকে ভালোবাসা। আমি এক পরিবারের এক ধার্মিক মাতাকে তার কন্যাদের বলতে শুনেছি প্রেম হচ্ছে পুরুষদের একটা স্কুল আবেগ এবং সাধ্বী নারীদের কাছে এটা অজানা। নারীর সম্পর্কগুলো তার ব্যক্তিগত অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে সর্বজনীন অনুভূতির ভিত্তিতে; তাই তার পক্ষে পুরুষের মতো প্রাতিস্বিক কামনা পোষণ করা হচ্ছে তার জীবনবিধানকে দূষিত করা।

অর্থাৎ, একটি মনোনীত সঙ্গীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন নারীর কাজ নয়, তার কাজ হচ্ছে সাধারণভাবে নারীধর্মী ভূমিকাগুলো পালন করা; তাকে কামসুখ লাভ করতে হবে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট একটি রূপে সেটা ব্যক্তিগত স্বভাবের হবে না। তার কামনিয়তির আছে দুটি অপরিহার্য পরিণতি। প্রথমত, বিবাহবহির্ভূত কোনো যৌন কর্মকাণ্ডের অধিকার তার নেই; যৌনসঙ্গম এভাবে হয়ে ওঠে একটি সংস্থা, সমাজের স্বার্থের কাছে গৌণ হয়েওঠে দুটি লিঙ্গেরই কামনা ও পরিতৃপ্তি; তবে কর্মী ও নাগরিক হিশেবে পুরুষ যেহেতু সর্বজনীনতার দিকে প্রসারিত, তাই সে বিয়ের আগে ও বিয়ের বাইরে উপভোগ করতে পারে আকস্মিক প্রমোদ।

নারীর কামহতাশাবোধকে পুরুষেরা সুচিন্তিতভাবে মেনে নিয়েছে; প্রকৃতিই দায়ীএ-আশাবাদী দর্শন নির্ভর করে তারা সহজেই মেনে নিয়েছে নারীর দুঃখকষ্ট : এটা তার ভাগ্য; বাইবেলের অভিশাপ তাদের এ-সুবিধাজনক মতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। গর্ভধারণের যন্ত্রণাদায়ক ভার–একটা ক্ষণিক ও অনিশ্চিত সুখের বিনিময়ে নারীর কাছে থেকে গুরুমূল্য আদায় করে নেয়া–বিষয় হয়েছে বহু অশালীন ঠাট্টাদ্রিপের। ‘পাঁচ মিনিটের সুখ : নয় মাসের কষ্ট’, এবং বেরোনোর থেকে এটা ঢোকে সহজেএটা এক কৌতুককর প্রতিতুলনা। তবে এ-দর্শনের ভেতরে আছে ধর্ষকাম। অনেক পুরুষ উপভোগ করে নারীর কষ্ট এবং ভাবতেই অস্বীকার করে যে এটা দূর করা দরকার। তাইবোঝা যায় তাদের সঙ্গিনীদের কামসুখ অস্বীকার করতে পুরুষেরা বিবেকের অস্বস্তিও বোধ করে না।

একথা খুবই সত্য যে স্বামীটি যদি জাগিয়ে তোলে নারীর কাম, সে তা জাগায় সর্বজনীন রূপে, কেননা তাকে একজন ব্যক্তি হিশেবে পছন্দ করে নেয়া হয় নি; তাই সে তার স্ত্রীকে প্রস্তুত করছে অন্যের বাহুর ভেতরে সুখখোজার জন্যে। মতেইন এর সাথে একমত, তবে তিনি একথা স্বীকার করে নেয়ার মতো সৎ যে পুরুষের পরিণামদর্শিতা নারীকে ফেলে দেয় এমন একটা পরিস্থিতিতে, যার জন্যে কোনো প্রশংসা মেলে না : ‘আমরা তাদের চাই স্বাস্থ্যবতী, তীব্র, সুডৌল, ও সতীরূপে, সব কিছু এক সাথে–অর্থাৎ, গরম ও ঠাণ্ডা উভয়ই’। প্রধো অনেকটা কম অকপট : তার মতে, বিয়ে থেকে প্রেম বর্জন করা হচ্ছে ‘ন্যায়নিষ্ঠা’র ব্যাপার; ‘সমস্ত প্রণয়ালাপ অশালীন, এমনকি যাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে বা যারা বিবাহিত, তাদের মধ্যেও; এটা গার্হস্থ্য শ্রদ্ধাবোধ, কর্মানুরাগ, ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যে ধ্বংসাত্মক’।

তবে উনিশশতক ভরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ধারণাগুলো কিছুটা সংশোধিত হয়; একটা ব্যগ্র প্রচেষ্টা দেখা দেয় বিয়েকে সমর্থন ও সংরক্ষণের জন্যে; এবং, অন্য দিকে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের অগ্রগতির ফলে নারীর দাবি সহজেরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে; সৎ-সিমো, ফুরিয়ের, জর্জ সাঁ, এবং সব বোম্যান্টিক প্রচণ্ডভাবে দাবি করেন প্রেমের অধিকার। প্রশ্নটি ওঠে বিয়ের সাথে ব্যক্তিগত আবেগ জড়ানো সম্বন্ধে, যা তখন পর্যন্ত ধীরস্থিরভাবে বর্জন করা হয়েছে। এ-সময়ই উদ্ভাবন করা হয় ‘দাম্পত্য প্রেম’-এর সন্দেহজনক ধারণাটি, প্রথাগত সুবিধাজনক বিয়ের সে-অলৌকিক ফলটি। বালজাক প্রকাশ করেন রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমস্ত যুক্তিরহিত ধ্যানধারণাগুলো। তিনি স্বীকার করেন যে নীতিগতভাবে বিয়ে ও প্রেমের মধ্যে কোনো মিল নেই; তবে একটি শ্রদ্ধেয় সংস্থাকে একটা ব্যবসায়িক চুক্তির সাথে সমীকরণ করা, যাতে নারীকে গণ্য করা হয় বস্তু হিশেবে, তাঁর কাছে ঘৃণ্য মনে হয়। এভাবে তিনি পৌছেন তার ফিজিয়লজি দি মারিয়াজ-এর বিব্রতকর অসম্বন্ধতার, যাতে তিনি বলেন বিয়ে একটি চুক্তি, অধিকাংশ মানুষ যা সম্পন্ন করে সন্তানদের বৈধ করার জন্যে, এবং তাতে প্রেম একটা বাজেকথা, এবং তারপর বলতে থাকেন ‘আত্মার বিশুদ্ধ মিল’ আর ‘সুখ’-এর কথা, যা অর্জিত হয় মানুষের ‘সম্মান ও শালীনতার বিধিবিধান’ পালনের মাধ্যমে। ‘প্রকৃতির গোপন সূত্র, যা পুষ্পিত করে অনুভূতি’, তার প্রতি অনুগত থাকার জন্যে তিনি ডাক দেন, এবং প্রয়োজন বোধ করেন ‘আন্তরিক প্রেম’-এর, এবং দাবি করেন এভাবে চর্চা করলে স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ চিরস্থায়ী হতে পারে।

বিয়ে ও প্রেমের মধ্যে বিরোধ মেটানো এমন এক তুর দ্য ফর্স, যা সফল হতে পারে শুধু স্বর্গীয় হস্তক্ষেপই; নানা চাতুর্যপূর্ণ উপায়ে এ-সমাধানেই পৌচেছিলেন। কিয়ের্কেগার্দ। তিনি বলেন, প্রেম স্বতস্ফূর্ত; বিয়ে একটি সিদ্ধান্ত; তবে সকাম আকর্ষণ জাগাতে হবে বিয়ের মাধ্যমে বা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একজন প্রকৃত স্বামী, তিনি বলেন, ‘এক অলৌকিক ব্যাপার’। আর স্ত্রীর কথা বলতে গেলে, যুক্তিশীলতা তার জন্যে নয়, সে ‘চিন্তাশূন্য’; ‘সে প্রেমের সদ্যতা থেকে চলে যায় ধর্মের সদ্যস্কতায়’। সরল ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে প্রেমে পড়েছে এমন একটি পুরুষ বিধাতায় বিশ্বাসবশত বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, ওই সিদ্ধান্তেরই নিশ্চয়তা দেয়ার কথা। অনুভূতি ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে সঙ্গতিবিধানের; এবং কোনো নারী প্রেমে পড়লে সে বিয়ে করতে চায়। আমি এক সময় চিনতাম ক্যাথলিক বিশ্বাসের এক মহিলাকে, যে সরলভাবে বিশ্বাস করতো ‘স্বর্গীয় বজ্ৰকরতালি’তে; সে ঘোষণা করেছিলো যখন দম্পতিটি বেদির পাদমূলে দাঁড়িয়ে বলে চরম শেষকথাটি যে ‘আমি করি’, তখন তারা অনুভব করে যে তাদের হৃদয়ে অলৌকিকভাবে জ্বলে উঠেছে পারস্পরিক প্রেমের শিখা। কিয়ের্কেগার্দ পুরোপুরি স্বীকার করেন যে থাকতে হবে একটা পূর্ব-‘অনুরাগ’; তবে এটা যে সারাজীবন স্থায়ী হবে, তা কম অলৌকিক ব্যাপার নয়।

তবে ফ্রান্সে ফ্য দ্য স্যিকল ঔপনাসিক ও নাট্যকারেরা, যারা স্বর্গীয় চুক্তির গুণাবলি সম্পর্কে ছিলেন একটু কম নিশ্চিত, তারা দাম্পত্য সুখ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন অনেক বেশি খাঁটি মানবিক পদ্ধতিতে; বালজাকের থেকে অনেক বেশি সাহসের সাথে তারা ভেবেছিলেন কামের সাথে বৈধ প্রেমের মিলন ঘটানোর সম্ভাবনার কথা। মার্সেল ভিস্ত তরুণ স্বামীকে পরামর্শ দেন নিজের স্ত্রীকে রক্ষিতার মতো দেখতে, এবং সতর্কতার। সাথে তিনি আঁকেন বিবাহিত জীবনের সুখের ছবি। বার্নস্তেইন নিজেকে করে তোলেন বৈধ প্রেমের নাট্যকার : অনৈতিক, মিথ্যাভাষী, ইন্দ্রিয়কাতর, চৌর্যবৃত্তিপরায়ণ, স্বেচ্ছাচারী স্ত্রীর তুলনায় তাঁর স্বামীকে মনে হয় একজন জ্ঞানী ও উদার মানুষ; এবং বোঝা যায় সে একজন শক্তিশালী ও দক্ষ প্রেমিক। ব্যভিচারের উপন্যাসের প্রতিক্রিয়ায় বিয়ের যথার্থতা প্রতিপাদন করে বেরোয় অজস্র রোম্যান্টিক উপন্যাস। এমনকি কলেৎও নতি স্বীকার করেছিলেন নীতিবাক্য আওড়ানোর ঢলের কাছে, তার এজেনি লিব্যরততে, এক তরুণী স্ত্রী, যার সতীত্বমোচন করা হয়েছিলো অপরিণত বয়সে, তার দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর যখন তিনি ঠিক করেন যে তিনি তাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন স্বামীর বাহুবন্ধনে কামসুখ লাভের সঙ্গে। মার্টিন মরিসের একটি উপন্যাসে তরুণী স্ত্রী কামকলা শেখে এক প্রেমিকের কাছে, তারপর সে ফিরে এসে স্বামীকে উপহার দেয় তার অভিজ্ঞতার সুফল।

অন্য কারণে এবং ভিন্ন এক উপায়ে আজকের মার্কিনিরা, যারা একই সাথে বিয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীবাদী, কাম ও বিয়ের মধ্যে সংহতিসাধনের জন্যে বহু গুণে বাড়িয়ে চলছে তাদের প্রচেষ্টা। দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে বেরোচ্ছে বিপুল সংখ্যক বই, যেগুলোর উদ্দেশ্য দম্পতিকে পরস্পরের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল শেখানো; বিশেষ করে পুরুষটিকে শেখানো কী করে সে স্ত্রীর সাথে স্থাপন করতে পারে একটা সুখকর সঙ্গতি। মনোবিশ্লেষকেরা ও চিকিৎসকেরা কাজ করছেন বিবাহ উপদেষ্টা রূপে; সাধারণভাবে তারা একমত যে নারীদের কামসুখের অধিকার আছে এবং পুরুষদের জানা দরকার যথোচিত কলাকৌশল। যদি তরুণটি বিশখানা বিবাহবিষয়ক সারগ্রন্থ মুখস্থও করে, তবুও তার পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় যে নববধুকে সে শেখাতে পারবে তাকে ভালোবাসতে। নারীটি সাড়া দেয় সমগ্র মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতিতে। এবং প্রথাগত বিয়ের পক্ষে নারীর কাম জাগানো ও বিকশিত করার মতো অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি আদৌ সম্ভব নয়।

আগে, মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠিতে, বিয়ের সময় মেয়েটির কুমারীত্ব দাবি করা হতো না; এবং অতীন্দ্রিয় কারণে রীতি ছিলো যে বিয়ের আগে মেয়েটির সতীত্বমোচন ঘটাতে হবে। ফ্রান্সের কিছু পল্লী অঞ্চলে এ-প্রাচীন রীতি এখনো দেখা যায়; সেখানে বিবাহপূর্ব সতীত্ব চাওয়া হয় না; এবং এমনকি যারা ভুল পা ফেলেছে। অর্থাৎ, অবিবাহিত মায়েরা তারা অনেক সময় অন্যদের থেকে অনেক সহজে পায় স্বামী। অন্য দিকে এও সত্য যে-সব বৃত্ত নারীমুক্তি স্বীকার করে নিয়েছে, সেখানেও ছেলেদের মতোই যৌনস্বাধীনতা দেয়া হয় মেয়েদের। তবে পিতৃতান্ত্রিক নৈতিকতা আবশ্যিকভাবে দাবি করে কনেকে তার স্বামীর কাছে তুলে দিতে হবে কুমারী অবস্থায়; স্বামীটি নিশ্চিতহতে চায় যে নারীটি অন্য কারো বীজ বহন করছে না; যে-দেহটিকে সে নিজের করে নিচ্ছে, সে চায় তার একক ও একচেটিয়া মালিকানা; কুমারীত্ব পরিগ্রহ করেছে একটা নৈতিক, ধর্মীয়, ও অতীন্দ্রিয় মূল্য, এবং এ-মূল্য আজো সাধারণভাবে স্বীকৃত। ফ্রান্সে আছে কিছু এলাকা, যেখানে বরের বন্ধুরা অপেক্ষা করে থাকে বাসরঘরের দরোজার আড়ালে, তারা হাসাহাসি করতে থাকে, গান গাইতে থাকে যে-পর্যন্ত না স্বামীটি বিজয়োল্লাসে বেরিয়ে আসে রক্তভেজা বিছানার চাদর দেখানোর জন্যে; বা মা-বাবারা পরের দিন ভোরে সেটা দেখায় প্রতিবেশীদের। কিছুটা কম স্থূলভাবে বাসররাত্রির প্রথা খুবই ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

শুধু প্রহসন ও বিচিত্রানুষ্ঠানেই আমরা দেখতে পাই না যে বাসররাত্রিতে অপূর্ণ নববধু পালিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে মায়ের কাছে। মনোচিকিৎসার বইপত্রও এ-ধরনের কাহিনীতে পরিপূর্ণ; এবং আমার কাছেও বলা হয়েছে এমন কয়েকটি কাহিনী : ওই মেয়েদের খুবই যত্নের সাথে লালনপালন করা হয়েছিলো, এবং তাদের যেহেতু কোনো যৌনশিক্ষা দেয়া হয় নি, তাই হঠাৎ কাম আবিষ্কার তাদের সাধ্যাতীত হয়ে ওঠে। মেয়েরা অনেক সময় বিশ্বাস করেছে যে চুমো খাওয়াই হচ্ছে সম্পূর্ণ যৌনমিলন, এবং স্টেকল এক নববধুর কথা বলেছেন যে তার স্বামীকে পাগল মনে করেছিলো, যেহেতু স্বামীটি মধুচন্দ্রিমার সময় করেছিলো খুবই স্বাভাবিক আচরণ। কোনো মেয়ে এমনকি একটি নারী বিপর্যস্তকে বিয়ে করেও কোনো অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ না করেই কয়েক বছর বাস করতে পারে তার সাথে।

অতিশয় উগ্রতা কুমারীকে ভীত করে, অতিশয় সশ্রদ্ধতা তাকে অবমানিত করে; নারীরা চিরকাল ঘৃণা করে সে পুরুষক, যে তাদের কষ্টের মূল্যে স্বার্থপরায়ণতার সাথে সুখ উপভোগ করে; কিন্তু তারা সে-সব পুরুষের প্রতি বোধ করে চিরন্তন ক্ষোভ, যারা তাদের অবজ্ঞা করেছে বলে মনে হয়, এবং প্রায়ই ক্ষোভ বোধ করে তাদের প্রতি, যারা প্রথম রাতেই তাদের সতীত্বমোচনের উদ্যোগ নেয় নি, বা ব্যর্থ হয়েছে। হেলেন ডয়েটশ কিছু স্বামীর উল্লেখ করেছেন, যারা শক্তি বা সাহসের অভাবে চিকিৎসক দিয়ে নববধুদের সতীত্বমোচন করা বেশি পছন্দ করেছে, তাদের অভিযোগ হচ্ছে যে তাদের সঙ্গিনীদের সতীচ্ছদ অস্বাভাবিকভাবে প্রতিরোধক, যা সাধারণত অসত্য। এসব ক্ষেত্রে, তিনি বলেন, যে-পুরুষটি স্বাভাবিক রীতিতে তাকে বিদ্ধ করতে পারে নি, তার প্রতি নারীটি বোধ করে এমন ঘৃণা, যা কাটিয়ে ওঠা কঠিন।

বিয়ের রাত্রি কামকৰ্মটিকে রূপান্তরিত করে এক পরীক্ষায়, যাতে উভয়েই ভয় পায় যে তারা উত্তীর্ণ হতে পারবে না, প্রত্যেকেই নিজের সমস্যা নিয়ে এতো উদ্বিগ্ন থাকে। যে অন্যের সম্পর্কে সদয়তার সাথে ভাবতেও পারে না। এটা ঘটনাটিকে দেয়। ভীতিকর গাম্ভীর্য; এটা বিস্ময়কর নয় যে এ-ঘটনা নারীটিকে করে তোলে স্থায়ীভাবে কামশীতল। স্বামীটি যে-কঠিন সমস্যায় পড়ে, তা হচ্ছে এই : আরিস্ততলের ভাষায়, ‘যদি সে তার স্ত্রীকে অতিরিক্ত কামুকতার সাথে কামোদ্দীপ্ত করে’, তাহলে স্ত্রীটি মর্মাহত ও অবমানিত বোধ করতে পারে; এ-ভয়ই বিহ্বল করে মার্কিন স্বামীদের। অন্য দিকে, তার স্বামী যদি তাকে ‘মান্য’ করে, তাহলে সে স্ত্রীর কাম জাগাতে ব্যর্থ হয়। এ-উভয়সংকট সৃষ্টি হয় নারীর মনোভাবের দ্ব্যর্থতার ফলে : তরুণী যুগপৎ কামসুখ চায় ও পেতে অস্বীকার করে। যদি সে অসাধারণ ভাগ্যবান না হয়, তবে তরুণ স্বামীটিকে মনে হয় লম্পট অথবা একটা ভণ্ডুলকারী। তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে স্ত্রীর কাছে দাম্পত্য দায়িত্বকে প্রায়ই মনে হয় ক্লান্তিকর ও বিস্বাদ।

প্রকৃতপক্ষে, বহু নারী কখনো কামপুলক বোধ না করেই বা আদৌ কামোত্তেজনা অনুভব না করেই হয় মা ও দাদী; কখনো কখনো তারা চিকিৎসকের পরামর্শ বা অন্য কোনো অজুহাতে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে তাদের মর্যাদা লাঘবকারী ‘দায়িত্ব’। কিন্সে বলেছেন বহু স্ত্রী ‘জানিয়েছে তারা মনে করে তাদের সঙ্গমের পৌনপুনিকতার মাত্রা অত্যন্ত বেশি এবং তারা চায় যে তাদের স্বামীরা যেনো এতো ঘনঘন সঙ্গম করতে না চায়। কিছু স্ত্রী কামনা করে আরো ঘনঘন সঙ্গম’। তবে আমরা দেখেছি যে নারীর কামসামর্থ্য প্রায় অসীম। এ-বিবোধ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে কামকে বিধিসম্মত করতে গিয়ে বিয়ে হত্যা করে নারীর কাম।

মনে হতে পারে যে বাগদানের সময়টিতে মেয়েটি ধীরেধীরে দীক্ষিত হবে; কিন্তু প্রথা অধিকাংশ সময়ই যুগলের ওপর চাপিয়ে দেয় কঠোর কৌমার্য। বাগদানের কালে কুমারী যখন জানে তার ভবিষ্যৎ স্বামীকে, তখনও তার পরিস্থিতি তরুণী বিবাহিত। নারীর থেকে বেশি ভিন্ন নয়; সে ধরা দেয় শুধু এ কারণে যে তার কাছে বাগদানকে বিয়ের মতোই চুড়ান্ত ব্যাপার বলে মনে হয়, এবং তার প্রথম সঙ্গম তখনও একটি অগ্নিপরীক্ষা। একবার যখন সে নিজেকে দান করেছে–যদি সে গর্ভবতী নাও হয়, যা নিশ্চিতভাবেই হবে বিয়ের বাধ্যবাধকতা তখন তার মন পরিবর্তন খুবই দুর্লভ ঘটনা।

সুবিধার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি মিলনের পক্ষে প্রেম উৎপন্ন করার বিশেষ সুযোগ আছে, এ-মত পোষণ নিতান্তই ভণ্ডামো; এটা নিতান্তই বাজেকথা যে দুটি বিবাহিত মানুষ, যারা আবদ্ধ ব্যবহারিক, সামাজিক, ও নৈতিক স্বার্থের বন্ধনে, তারা যতদিন বাঁচবে ততোদিন কামসুখ দিতে থাকবে পরস্পরকে। তবে সকারণ বিয়ের প্রস্তাবকারীদের এটা দেখাতে কোনোই অসুবিধা হয় না যে প্রেমের বিয়েও দম্পতির সুখের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারে না। প্রথমত, তরুণী প্রায়ই যে-আদর্শ প্রেমের আবেগ বোধ করে, তা তাকে যৌন প্রেমের দিকে নিয়ে যায় না; তার প্লাতোয়ী মূর্তিপুজো, তার দিবাস্বপ্ন, তার শিশুসুলভ বা কৈশোরিক আবিষ্টতা প্রক্ষেপকারী। সংরাগ, প্রাত্যহিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপযোগী নয়, সেগুলো দীর্ঘকাল স্থায়ীও হয় না। যদি তার ও তার প্রেমিকের মধ্যে একটি শক্তিশালী ও আন্তরিক যৌন আকর্ষণ থাকেও, তবুও তা একটি সারাজীবনের উদ্যোগের দৃঢ় ভিত্তি নয়।

এমনকি যখন বিয়ের আগেও থাকে যৌন প্রেমসম্পর্ক বা জেগে ওঠে মধুচন্দ্রিমার সময়, খুব কম সময়ই তা টিকে থাকে পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে। সন্দেহ নেই যৌন প্রেমের জন্যে দরকার বিশ্বস্ততা, কেননা প্রেমে জড়িত দুটি মানুষ যে-কামনা বোধ করে, তা তাদের জড়িত করে ব্যক্তিরূপে; বাইরের কারো সাথে অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা একে অস্বীকার করতে চায় না; তারা পরস্পরকে পরস্পরের জন্যে মনে করে বিকল্পহীন; কিন্তু এ-বিশ্বস্ততার ততোটুকুই অর্থপূর্ণ যতোটা তা স্বতস্ফূর্ত; এবং কামের ইন্দ্রজাল বেশ দ্রুতই স্বতস্ফূর্তভাবে উবে যায়। অলৌকিক ব্যাপারটি হচ্ছে প্রত্যেক প্রেমিককে, ওই মুহূর্তে ও দেহে, এটা দান করে এমন একটি সত্তা, যার অস্তিত্ব ছড়িয়েপড়ে সীমাহীন সীমাতিক্ৰমণতায়; এ-সত্তাটিকে অধিকার করে রাখা নিঃসন্দেহে অসম্ভব, তবে এক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ও মর্মভেদী উপায়ে অন্তত সাধিত হয় সংস্পর্শ। কিন্তু ব্যক্তি দুটি যখন শত্রুতা, বিরক্তি, বা উদাসীনতাবশত আর এমন সংস্পর্শ কামনা করে না, তখন বিলীন হয়ে যায় যৌন আকর্ষণ।

সত্য হচ্ছে শারীরিক প্রেমকে যেমন চূড়ান্ত লক্ষ্য হিশেবে বিবেচনা করা যায় না, তেমনি একে নিতান্তই একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় বলেও গণ্য করা যায় না; এটা অস্তিত্বের যাথার্থ প্রতিপন্ন করতে পারে না; তবে অসংশ্লিষ্টরূপে এর যাথার্থ্যও প্রতিপাদন করা যায় না। অর্থাৎ, যে-কোনো মানুষের জীবনে এর পালন করা উচিত একটি কাহিনীমূলক ও স্বাধীন ভূমিকা। একথা বলার অর্থ হচ্ছে সর্বোপরি একে হতে হবে মুক্ত।

তাই বুর্জোয়া আশাবাদ বাগদত্তা একটি মেয়েকে যা দিতে পারে, তা নিশ্চিতভাবেই প্রেম নয়; তার সামনে তুলে ধরে রাখা হয় যে-উজ্জ্বল আদর্শ, তা হচ্ছে সুখের আদর্শ, যা বোঝায় সীমাবদ্ধতা ও পুনরাবৃত্তির জীবনে শান্ত ভারসাম্যের আদর্শ। সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার বিশেষ বিশেষ পর্বে সার্বিকভাবে এটাই হয়েছে মধ্যবিত্তের আদর্শ এবং বিশেষ করে ভূসম্পত্তিশালীদের আদর্শ; ভবিষ্যৎ বা বিশ্বকে জয় করা তাদের লক্ষ্য ছিলো না, ছিলো অতীতকে শান্তিপূর্ণভাবে রক্ষা করা, স্টেটাস কৌ অক্ষুন্ন রাখা। আকাঙ্খ ও সংরাগহীন এক কারুকার্যখচিত মাঝারিত্ব, নিরন্তর পুনরাবৃত্ত লক্ষ্যহীন দিনের পর দিন, যে-জীবন তার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন না করে ধীরেধীরে এগিয়ে চলে মৃত্যুর দিকে—‘সুখ’ বলতে তারা এই বুঝিয়েছে। এপিকিউরাস ও জেনোর দ্বারা অস্বচ্ছভাবে অনুপ্রাণিত এ-ভ্রান্ত প্রজ্ঞা আজকাল বাতিল হয়ে গেছে : বিশ্ব যেমন আছে তেমন টিকিয়ে রাখা ও চলতে দেয়া আকাঙ্খিতও নয় সম্ভবও নয়। পুরুষকে দায়িত্ব দেয়া হয় কর্মের, তার কাজ উৎপাদন, যুদ্ধ, সৃষ্টি, প্রগতি, নিজেকে বিশ্বের সমগ্রতা ও ভবিষ্যতের অনন্ততার দিকে সম্প্রসারিত করা; কিন্তু প্রথাগত বিয়ে নারীকে পুরুষের সঙ্গে সীমাতিক্ৰমণতার জন্যে আমন্ত্রণ জানায় না; এটা নারীকে আটকে রাখে। সীমাবদ্ধতায়, তাকে আবদ্ধ করে রাখে তার নিজের বৃত্তের ভেতরে। তাই একটি অপরিবর্তনীয় ভারসাম্যের জীবন, যাতে অতীতের ধারাবাহিকতারূপে বর্তমান এড়িয়ে চলে আগামীকালের বিপদগুলো, নারী সে-জীবন নির্মাণের বেশি আর কিছু করার কথা ভাবতে পারে না। অর্থাৎ, তৈরি করে সম্যকভাবে এক সুখের জীবন। প্রেমের বদলে নারী বোধ করবে এক বিঘ্ন ও সশ্রদ্ধ আবেগ, যার নাম দাম্পত্য প্রেম, পত্নীসুলভ প্রীতি; তাকে কাজ করতে হবে গৃহের দেয়ালের ভেতরে, সে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলবে তার বিশ্ব; অনন্তকাল ধরে সে যত্ন নিতে থাকবে মানবপ্রজাতির অনুবর্তনের।

সুখের আদর্শটি সব সময়ই বস্তুগত রূপ নিয়েছে একটি গৃহরূপে, তা কুটিরই হোক বা হোক ক্যাসল; এটা নির্দেশ করে চিরস্থায়িত্ব ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা। এর দেয়ালের অভ্যন্তরে পরিবারটি প্রতিষ্ঠিত হয় একটি পৃথকখোপ বা একক গোষ্ঠিরূপে এবং প্রজন্ম আসে প্রজন্ম যায় এটি রক্ষা করে এর পরিচয়; অতীত, যা সংরক্ষিত হয় আসবাবপত্রের গঠন ও পূর্বপুরুষের চিত্রাবলিতে, প্রশ্রুিতি দেয় এক নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের; বাগানে ভোজ্য শব্জি ফলিয়ে ঋতুগুলো প্রকাশ করে তাদের আশ্বস্তকর চক্র; প্রতিবছর একই বসন্তকাল একই পুস্পসহ ভবিষ্যদ্বাণী করে নিত্য গ্রীষ্মের ফিরে আসার, ভবিষ্যদ্বাণী করে শরতের, যার এবারের ফলগুলো ভিন্ন নয় অন্য কোনো। শরতের ফলগুলো থেকে : কাল ও স্থান হঠাৎ তাদের কাজের রীতি বদল করে না, নির্দিষ্ট চক্রে তারা ফিরে ফিরে আসে। ভূসম্পত্তিভিত্তিক প্রতিটি সভ্যতায় বিপুল পরিমাণ সাহিত্য গায় চুলো ও গৃহের কবিতার গান। প্রায়ই ঘটে যে গৃহের কবিরা নারী, কেননা নারীর দায়িত্ব পরিবারপরিজনের সুখ নিশ্চিত করা; যখন রোমের দমিনারা বসততা আত্ৰিউমে, সে-সময়ের মতো তার ভূমিকা হচ্ছে ‘গৃহকত্রী’ হওয়া।

আজ গৃহ তার পিতৃতান্ত্রিক মহিমা হারিয়ে ফেলেছে; অধিকাংশ পুরুষের কাছে এটা থাকার জায়গা মাত্র, মৃত পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে সে আর ভীত নয়, এটা আর তার আগামী শতাব্দীগুলোকে বেষ্টন করে না। কিন্তু আজো নারী তার অভ্যন্তরকে সে-অর্থ ও মূল্য দেয়ার জন্যে ব্যর্থ, একদা যে-অর্থ ও মূল্য ধারণ করতে প্রকৃত ঘর ও গৃহ। ক্যানারি রোতে স্টেইনবেক বর্ণনা করেছেন এক ছিন্নমূল নারীকে, যে স্বামীসহ বাস করতো একটি বাতিল ইঞ্জিন বয়লারে, ছেড়া কাপড় ও পর্দা দিয়ে ওটি সাজানোর জন্যে নারীটি ছিলো বদ্ধপরিকর; পুরুষটি আপত্তি করে পর্দার কোনো দরকার নেই-‘আমাদের কোনো জানালা নেই’।

এ-উদ্বেগ একান্তভাবেই নারীধর্মী। একটি স্বাভাবিক পুরুষ তার চারপাশের জিনিশপত্রকে হাতিয়ার বলে মনে করে যে উদ্দেশ্যে ওগুলো তৈরি করা হয়েছে সে ওগুলো বিন্যস্ত করে সেভাবে; তার কাছে গোছানোর–নারী সেখানে প্রায়ই দেখতে পায় শুধু অগোছানো–অর্থ হচ্ছে তার সিগারেট, তার কাগজপত্র, তার যন্ত্রপাতি তার হাতের কাছে থাকা। আরো অনেকের মধ্যে আছে শিল্পীরা, যারা তাদের পছন্দের বস্তুর মাধ্যমে পুনর্সৃষ্টি করতে পারে বিশ্বকে–চিত্রকর ও ভাস্কররা–তারা যেখানে বাস করে তার প্রতিবেশ সম্পর্কে তারা থাকে অমনোযোগী। রদা সম্পর্কে রিল্কে লিখেছেন :

আমি যখন প্রথম বার কাছে আসি… আমি জানতাম তার গৃহ তার কাছে কিছুই নয়, হয়তো একটা তুচ্ছ ছোট্ট দরকার মাত্র, বৃষ্টির সময় ও ঘুমের জন্যে একটা ছাদ; এটা তার কাছে কোনো উদ্বেগের ব্যাপার ছিলো না এবং তার নির্জনতা ও স্থৈর্যের ওপর এটা কোনো ভার ছিলো না। নিজের গভীরে তিনি বইতেন একটি গৃহের অন্ধকার, আশ্রয়, ও শান্তি, এবং তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এটির ওপরের আকাশ, এবং এর চারপাশের বনভূমি, এবং দূরত্ব ও মহানদী সব সময়ই পাশ দিয়ে বয়ে চলতো।

কেউ যদি নিজের ভেতরে পেতে চায় চুল্লি ও গৃহ, তাহলে প্রথমে তাকে আত্মসিদ্ধি লাভ করতে হয় তার সৃষ্টিতে বা কর্মে। পুরুষ তার অব্যবহিত প্রতিবেশের প্রতি কম আগ্রহী, কেননা সে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারে কর্মোদ্যোগের মধ্য দিয়ে। আর সেখানে নারী আটকে থাকে দাম্পত্য এলাকার মধ্যে; তারই দায়িত্ব ওই কারাগারটিকে একটি রাজ্যে পরিণত করা। যে-দ্বান্দ্বিকতা সাধারণভাবে সংজ্ঞায়িত করে তার পরিস্থিতি, সেএকই দ্বান্দ্বিকতা নির্দেশ করে তার গৃহের প্রতি তার মনোভাব : সে গ্রহণ করে শিকার হয়ে, সে স্বাধীনতা পায় স্বাধীনতা ত্যাগ করে : বিশ্বকে প্রত্যাখ্যান করে সে জয় করতে চায় একটি বিশ্ব।

একটু অনুতাপের সাথেই তার পেছনে সে বন্ধ করে দেয় তার নতুন গৃহের দরোজা; যখন সে বালিকা ছিলো তখন সমগ্র পল্পীই ছিলো তার স্বদেশ; অরণ্য ছিলো তারই। এখন সে আটকে আছে এক সীমাবদ্ধ এলাকায়; প্রকৃতি ক্ষীণ হয়ে ধারণ করেছে ভাণ্ডে বোনা জারেনিয়ামের আকার দেয়াল বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে দিগন্তকে। তবে সে উঠে পড়ে লেগে গেছে এসব সীমাবদ্ধতা জয় করার জন্যে। কম বা বেশি দামি ব্রিক-আব্র্যাকরূপে সে তার চারদেয়ালের ভেতরে জড়ো করেছে জগতের যতো প্রাণী ও উদ্ভিদকুল, তার আছে বিচিত্র দেশ ও অতীত কাল; তার আছে স্বামী, যে প্রতিনিধিত্ব করে মানবসমাজের, এবং তার আছে সন্তান, যে তাকে বহনযোগ্যরূপে দেয় সমগ্র ভবিষ্যৎ।

গৃহ হয়ে ওঠে বিশ্বের কেন্দ্র এবং এমনকি তার একমাত্র বাস্তবতা; এক ধরনের প্রতি-বিশ্ব বা বিরোধী অবস্থানে বিশ্ব (বাশলা); আশ্রয়, নির্জনবাস, এটো, গর্ভ, এটা বাইরের বিপদ থেকে দেয় আশ্রয়; অলীক হয়ে ওঠে বিভ্রান্তিপূর্ণ বাহ্যজগত। এবং বিশেষভাবে সন্ধ্যাবেলা, যখন দরোজাজানালা বন্ধ, স্ত্রীর নিজেকে মনে হয় রাণী; যেসূর্য জ্বলে সকলের জন্যে, দুপুরবেলা দিকে দিকে ছড়ানো তার আলোতে সে বিরক্ত হয়; রাত্রিতে সে আর নিঃস্ব নয়, কেননা সে পরিহার করেছে সে-সব কিছু, যা তার অধিকারে নয়; সে দেখতে পায় প্রদীপের ঢাকনার নিচে জ্বলছে একটা আলো, যা তার নিজের এবং যা একান্তভাবে আলোকিত করে শুধু তার গৃহকেই : আর কিছু নেই। গৃহের ভেতরে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে বাস্তবতাকে, আর তখন মনে হয় যেনো ভেঙেচুরে পড়ছে বাইরের জগত।

ধন্যবাদ মখমল ও রেশম ও চিনামাটির বাসনকোসনকে, যা দিয়ে সে ঘিরে ফেলে নিজেকে, এসব দিয়ে নারী কিছুটা পরিতৃপ্ত করতে পারে সে-স্পর্শেন্দ্রিয়গ্রাহ্য কামকাতরতাকে, তার কামজীবন যা কদাচিৎ প্রশমিত করতে পারে। এ-গৃহসজ্জাও প্রকাশ করে তার ব্যক্তিত্বকে; সে-ই পছন্দ করেছে, তৈরি করেছে, খুঁজে বের করেছে সাজসজ্জা ও তুচ্ছ আসবাবপত্র, সে-ই এসব বিন্যাস করেছে এমন এক নান্দনিক নীতি অনুসারে, যাতে প্রতিসাম্য সাধারণত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান; এগুলো প্রতিফলিত। করে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, আবার সবার চোখের কাছে প্রকাশ করে তার জীবনযাপনের মান। এভাবে তার গৃহ হচ্ছে তার পার্থিব ভাগ্য, তার সামাজিক মূল্যের ও তার সত্যতম সত্তার প্রকাশ। যেহেতু সে কিছুই করে না, তাই তার যা আছে, তার মাঝেই সে ব্যাকুলভাবে খোঁজে আত্মসিদ্ধি।

গৃহস্থালির কাজে, চাকরদের সাহায্য নিয়ে বা না নিয়ে, নারী তার গৃহকে নিজের করে নেয়, প্রতিপন্ন হয় তার সামাজিক যাথার্থ্য, এবং নিজের জন্যে পায় একটি পেশা, একটি কাজ, যা উপকারিতা ও পরিতোষের সঙ্গে জড়িত থাকে জিনিশপত্রের সাথে–ঝলমলে চুলো, পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড়, উজ্জ্বল তাম্র, ঘষামাজা আসবাবপত্র–কিন্তু এগুলো সীমাবদ্ধতা থেকে কোনো মুক্তির উপায় দেয় না এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সামান্যই। এসব কাজের আছে একটা ঋণাত্মক ভিত্তি : পরিষ্কার করা হচ্ছে ময়লা থেকে মুক্তি পাওয়া, গোছগাছ করা হচ্ছে বিশৃঙ্খলা দূর করা। এবং দরিদ্র অবস্থায় কোনো সন্তোষই সম্ভব নয়; নারীর ঘাম ও অশ্রু সত্ত্বেও কুঁড়েঘর কুঁড়েঘরই থাকে; ‘জগতের কিছুই তাকে সুন্দর করতে পারে না’। বিপুল নারীবাহিনী লিপ্ত এ-অন্তহীন সংগ্রামে, কিন্তু তাতেও তারা ময়লা জয় করতে পারে না। এবং এমনকি সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্তের জন্যেও জয় কখনোই চূড়ান্ত নয়।

অন্তহীন পুনরাবৃত্তিতে ভরা গৃহস্থালির কাজের থেকে খুব কম কাজই সিসিফাসের পীড়নের মতো : পরিচ্ছন্ন জিনিশ ননাংরা হয়ে ওঠে, নোংরা জিনিশকে পরিচ্ছন্ন করা হয়, বার বার, দিনের পর দিন। গৃহিণী নিজকে ক্ষয়করে ফেলে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে : সে কিছু তৈরি করে না, শুধু স্থায়ী করে বর্তমানকে। সে কখনো কোনো ধনাত্মক শুভর জয় অনুভব করে না, বরং ঋণাত্মক অশুভর সাথে করতে থাকে অন্তহীন সংগ্রাম। এক তরুণী ছাত্রী তার প্রবন্ধে লিখেছে : ‘আমি কখনো ঘর ঝাড়ামোছার দিন নেবো না’; সে ভবিষ্যৎকে মনে করে কোনো অজানা শিখরের দিকে ধারাবাহিক অগ্রসরণ; কিন্তু একদিন, তার মা যখন থালাবাসন ধুচ্ছিলো, হঠাৎ তার মনে হয় তারা দুজনেই আমৃত্যু আটকে পড়বে এ-ব্রতে। খাওয়া, ঘুমোনো, ধোয়ামোছা–বছরগুলো আর আকাশের দিকে ওঠে রং ষাষ্টাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে থাকে, ধূসর ও অভিন্ন। ধুলোবালির বিরুদ্ধে সংগ্রামে কখনো জয়লাভ ঘটে না।

ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ঝাঁট দেয়া, কাপড়ের আলমারি নিচে থেকে ফেঁশো খুঁজে বের করা–এসব ক্ষয়রোধও জীবনকে অস্বীকার করা; কেননা জীবন একই সময়ে সৃষ্টি ও ধ্বংস করে, এবং এর ঋণাত্মক দিকটিই জড়িত গৃহিণীর সাথে। দার্শনিকভাবে দেখলে, তার অবস্থা ম্যানিকীয়বাদীর। ম্যানিকীয়বাদের সারকথা শুধু দুটি নীতি স্বীকার করা নয়, যার একটি শুভ, আরেকটি অশুভ; এটাও পোষণ করা হয় যে অশুভের বিলুপ্তির মাধ্যমেই অর্জিত হয় শুভ এবং কোন সক্রিয় কাজের মাধ্যমে নয়। এ-অর্থে শয়তানের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বে খ্রিস্টধর্ম আদৌ ম্যানিকীয়বাদী নয়, কেননা এতে অশুভকে সরাসরি পরাভূত করার প্রয়াস মাধ্যমে নয়, বরং বিধাতার কাছে আত্মনিবেদনের মাধ্যমে বড়াই করতে হয় শয়তানের সঙ্গে। সীমাতিক্ৰমণতা ও মুক্তির যে-কোনো মতাদর্শ শুভর দিকে অগ্রসরণের নিচে স্থান দেয় অশুভকে পরাভূত করা। কিন্তু নারীকে উৎকৃষ্টতর বিশ্ব নির্মাণের জন্যে আহ্বান জানানো হয় না : তার এলাকা। স্থিত এবং তার কাজ হচ্ছে তার এলাকায় ঢুকে পড়া অশুভ নীতির বিরুদ্ধে সমাপ্তিহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া; ধুলো, দাগ, কাদা, এবং ময়লার বিরুদ্ধে তার সংগ্রামে সে যুদ্ধ করে পাপের সাথে, কুস্তি লড়ে শয়তানের সাথে।

খাবার তৈরি করা, খাবার বাড়া, অনেক বেশি ধনাত্মক প্রকৃতির কাজ এবং প্রায়ই ঝাড়ামোছার কাজের থেকে অনেক বেশি প্রীতিকর। সবার আগে এটা বোঝায় বাজার করা, যা প্রায়ই হয়ে থাকে দিনের উজ্জ্বল স্থানটিতে। এবং শজি বাছতে বাছতে দরোজায় দাঁড়িয়ে গল্পগুজব হচ্ছে নিঃসঙ্গতা থেকে এক আনন্দজনক মুক্তি; জল আনতে যাওয়া আধা-নিঃসঙ্গ মুসলমান নারীদের জন্যে একটা বড় রোমাঞ্চ; বাজারে ও দোকানে নারীরা একই আগ্রহ নিয়ে নিজেদের একই দলের সদস্য মনে করে আলাপ করে গৃহস্থালি সম্পর্কে, ওই মুহূর্তে যা পুরুষের দলের বিরোধী, যেমন অপরিহার্য বিরোধী পরিহার্যের। কেনাকাটা করা এক গভীর সুখ, একটি আবিষ্কার, প্রায় একটি উদ্ভাবন। যেমন জিদ তার জর্নাল-এ বলেছেন, মুসলমানেরা জুয়োখেলা জানতো না বলে তার বদলে তারা আবিষ্কার করেছে গুপ্তধন; এটাই হচ্ছে বাণিজ্যিক

সভ্যতার কবিতা ও রোমাঞ্চ। গৃহিণী জুয়োর কিছুই জানে না, তবে একটি নিরেট। বাঁধাকপি, একটা পাকা কমবের এমন সম্পদ, যা চাতুর্যের সাথে জিতে নিতে হবে অনিচ্ছুক দোকানির থেকে; খেলাটি হচ্ছে সবচেয়ে কম টাকায় সবচেয়ে ভালোটা পাওয়া; মিতব্যয় ততোটা বাজেট সাশ্রয়ের জন্যে নয় যতোটা খেলায় জেতার জন্যে। যখন সে ভাবে তার পরিপূর্ণ ভাড়ারঘরের কথা সে সুখ পায় তার ক্ষণস্থায়ী বিজয়ে।

গ্যাস ও বিদ্যুৎ হনন করেছে অগ্নির ইন্দ্রজালকে, কিন্তু গ্রামে আজো বহু নারী উপভোগ করে জড় কাঠ থেকে জ্বলন্ত শিখা জ্বালানোর আনন্দ। যখন জ্বলে ওঠে তার আগুন, নারী হয়ে ওঠে অভিচারিণী; একবার হাত নেড়ে, যেমন সে মেশায় ডিম, বা আগুনের যাদুর মাধ্যমে, সে সম্পন্ন করে বস্তুর রূপান্তর : পদার্থ হয়ে ওঠে খাদ্য। এসব রসায়নের আছে মোহিনীশক্তি, কবিতা আছে খাবার সংরক্ষণ করার মধ্যে; চিনির যাদের মধ্যে গৃহিণী ধরে ফেলেছে খাদ্যের স্থায়িত্বকাল, সে জীবনকে আটকে ফেলেছে বয়ামের ভেতরে। রান্না হচ্ছে প্রত্যাদেশ ও সৃষ্টি; এবং নারী সফলভাবে তৈরি একটি কেক বা পরতে পরতে তৈরি একটি পেস্ট্রিতে পেতে পারে বিশেষ সুখ, কেননা সবাই তা বানাতে পারে না : ক্ষমতা থাকা চাই।

এখানেও ছোটো মেয়ে স্বাভাবিকভাবেই পছন্দ করে বড়োদের অনুকরণ করতে, সে তৈরি করে কাদার পাই বা অমন কিছু, এবং রান্নাঘরে সাহায্য করে আসল ময়দার তাল বেলতে। তবে অন্যান্য গৃহস্থালির কাজের মতোই পুনরাবৃত্তি অচিরেই আনন্দ নষ্ট করে দেয়। চুলোর যাদু বিশেষ আবেদন জাগাতে পারে না মেক্সিকি ইন্ডীয় নারীর কাছে, যারা জীবনের অর্ধেকটাই ব্যয় করে টর্টিলা বানাতে বানাতে, দিনের পর দিন, শতাব্দীর পর শতাব্দী একই রকমে। পুরুষ ও নারী লেখকেরা যারা গীতিময়রূপে এবিজয়কে তুরীয়লোকে উন্নীত করেন, তারা কখনোই বা কদাচিৎ বাস্তবে গৃহস্থালির কাজ করেছেন। এটা জীবিকা হিশেবে ক্লান্তিকর, শূন্য, একঘেঁয়ে। তবে যদি কেউ একাজ করার সাথে সাথে হয় একজন উৎপাদনকারী, একজন সৃষ্টিশীল কর্মী, তাহলে এটা জৈবিক ক্রিয়াগুলোর মতো স্বাভাবিকভাবেই সমন্বিত হয়ে যায় তার জীবনের সাথে; এ-কারণেই পুরুষেরা যখন গৃহস্থালির কাজ করে, তখন সেটা হয় অনেক কম নিরানন্দ; এটা তাদের কাছে একটা ঋণাত্মক ও অকিঞ্চিৎকর মুহূর্ত, যা থেকে তারা শিগগিরই মুক্তি পেয়ে যায়। স্ত্রী-চাকরানির ভাগ্যকে যা অপ্রীতিকর করে তোলে, তা হচ্ছে সে-শ্রমবিভাজন, যা তাকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে সাধারণ ও পরিহার্যের মধ্যে বদ্ধ করে। বাসস্থান ও খাদ্য জীবনের জন্যে দরকার, তবে এটা কোনো তাৎপর্য দান করে: গৃহিণীর অব্যবহিত লক্ষ্যগুলো উপায় মাত্র, প্রকৃত লক্ষ্য নয়। স্বাভাবিকভাবেই সে তার কাজকে কিছুটা স্বাতন্ত্র দেয়ার চেষ্টা করে এবং অপরিহার্য করে তুলতে চায়। সে মনে করে যে তার কাজ আর কেউ তার মতো করতে পারতো না; তার আছে তার ব্রত, কুসংস্কার, ও কাজের ধরন। কিন্তু প্রায়সই তার ‘ব্যক্তিগত সুর’ হচ্ছে বিশৃঙ্খলার এক অস্পষ্ট ও নিরর্থক পুনর্বিন্যাস।

মৌলিকত্ব ও অনন্য উৎকর্ষ অর্জনের এ-ধরনের প্রাণপণ চেষ্টায় নারী নষ্ট করে প্রচুর সময় ও প্রয়াস; এটা তার কাজকে দেয় একটা খুঁটিনাটির প্রতি অতি-যত্নশীল, অবিন্যস্ত, ও সমাপ্তিহীন চরিত্র এবং এর ফলে গৃহস্থালির কাজের প্রকৃত ভার নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে যে বিবাহিত নারীরা গৃহস্থালির কাজ করে গড়ে সপ্তাহে তিরিশ ঘণ্টা, বা কোনো চাকুরিতে কর্মের সপ্তাহগুলোর চারভাগের তিন ভাগ। বেতনভুক্ত কোনো চাকুরির কাজের সাথে যদি এ-কাজও করতে হয়, তাহলে কাজ হয়ে ওঠে বিপুল, আর যদি নারীটির কিছু করার না থাকে, তাহলে কাজ হয় সামান্য। এর সাথে কয়েকটি শিশুর লালনপালন স্বাভাবিকভাবেই নারীর কাজ অনেক বাড়িয়ে দেয় : দরিদ্র মায়েরা সাধারণত সব সময়ই কাজ করে। অন্য দিকে, মধ্যবিত্ত নারীরা যারা কাজের লোক রাখে, তারা অনেকটা নিষ্কর্মা; তারা তাদের অবসরভোগের মূল্য পরিশোধ করে অবসাদে। যদি তাদের আর কোনো দিকে আগ্রহ থাকে, তাহলে তারা তাদের গৃহস্থালির দায়িত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে ও জটিল করে তোলে, শুধু হাতে কিছু একটা কাজ থাকার জন্যে।

এর মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার হচ্ছে যে এ-শ্রমের স্থায়ী কোনো কিছু সৃষ্টির কোনো লক্ষ্য নেই। নারী প্রলুব্ধ হয়–যতো বেশি প্রলুব্ধ হয় ততোবেশি কঠোরভাবে সে খাটাখাটি করে তার কাজকেই কাজের লক্ষ্য বলে গণ্য করতে। সদ্য উনুন থেকে বের করে আনা একটা পুরো কেক দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে : ‘ধিক, এই কেক খাওয়া!’ এটা সত্যিই খুব জঘন্য ব্যাপার তার স্বামী ও সন্তানদের কাদামাখা পায়ে তার মোমমাজা শক্ত কাঠের মেঝের চারদিকে ভারি পদক্ষেপে হাঁটানো! জিনিশপত্র ব্যবহৃত হলে ময়লা হয় বা নষ্ট হয় আমরা দেখেছি সে কতোখানি চেষ্টা করে যাতে ওগুলো ব্যবহৃত না হয়। সংরক্ষিত খাবার ছাতা-ধরা না পর্যন্ত সে জমিয়ে রাখে; সে বৈঠকখানা তালাবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু সময় নির্মমভাবে বয়ে চলে; খাদ্যদ্রব্য ইঁদুর আকৃষ্ট করে, ওগুলোতে পোকা ধরে; পতঙ্গরা আক্রমণ করে লেপকথা কাপড়চোপড়। বিশ্বটি পাথরে খোদাই করা কোনো স্বপ্ন নয়, এটা তৈরি পচনশীল সন্দেহজনক বস্তুতে; খাদ্যদ্রব্য দালির মাংসল ঘড়ির মতোই দ্ব্যর্থবোধক। একে মনে হয় জড়, অজৈব, কিন্তু গোপন শুয়োপোকারা হয়তো একে পরিণত করেছে লাশে। যে-গৃহিণী নিজেকে হারিয়ে ফেলে বস্তুর মধ্যে, সে বস্তুর মতোই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সারা বিশ্বের ওপর : পোশাকপরিচ্ছদ ঝলসে যায়, রোস্ট পুড়ে যায়, চিনেমাটির বাসনকোসন ভাঙে; এগুলো চরম বিপর্যয়, কেননা যখন জিনিশপত্র ধ্বংস হয়, ওগুলো চিরকালের জন্যে শেষ হয়ে যায়। এগুলোর মাধ্যমে সম্ভবত চিরস্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়।

তবে সব মিলিয়ে আজকাল বিয়ে হচ্ছে জীবনের মৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে টিকে থাকা একটি স্মৃতিচিহ্ন, আর স্ত্রীর পরিস্থিতি আগের থেকেও বেশি অপ্রীতিকর, কেননা আজো তার দায়িত্ব একই, তবে সেগুলো তাকে আর একই অধিকার, সুবিধা, ও সম্মান দেয় না। পুরুষ আজকাল বিয়ে করে সীমাবদ্ধতার মধ্যে একটা নোঙর ফেলার স্থান পাওয়ার জন্যে, তবে সে নিজে সেখানে আটকে থাকতে চায় না; সে চুলো আর গৃহ চায়, কিন্তু সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বাধীনতাও তার আছে; সে ঘর বাঁধে, কিন্তু প্রায়ই অন্তরে থেকে যায় ভবঘুরে; সে গার্হস্থ্য সুখকে ঘৃণা করে না, তবে একেই লক্ষ্যে পরিণত করে না; পুনরাবৃত্তি তাকে ক্লান্ত করে; সে চায় অভিনবত্ব, ঝুঁকি, পরাভূত করার মতো বিরোধিতা, সঙ্গী ও বন্ধু যারা তাকে নিঃসঙ্গতা থেকে নিয়ে যায় আ দো। শিশুরা এমনকি তাদের পিতার থেকেও বেশি চায় পরিবারের সীমার বাইরে চলে যেতে : তাদের জীবন আছে অন্য কোথাও, এটা তাদের সম্মুখে; শিশু সব সময়ই চায় ভিন্ন জিনিশ। নারী প্রতিষ্ঠা করতে চায় অবিনশ্বরতা ও অনুবর্তনের এক বিশ্ব; স্বামী ও শিশুরা চায় নারীর সৃষ্টিকরা পরিস্থিতির সীমা পেরিয়ে যেতে। এজন্যেই, যে-কাজে সে তার সারাটি জীবন নিয়োগ করেছে, সেগুলো যে অনিশ্চিত প্রকৃতির, তা স্বীকার করতে যদিও সে ঘৃণা করে, তবুও সে জোর করে তার দায়িত্বগুলো চাপিয়ে দিতে চায় : সে মা ও গৃহিণী থেকে হয়ে ওঠে এক কঠোর সৎ মা ও খাণ্ডারি।

আজকাল এ-দুস্তর ব্যবধান এতোটা গভীর নয়, কেননা তরুণী এতোটা কৃত্রিম মানুষ নয়; সে অনেক ভালোভাবে অবহিত, জীবনের জন্যে অধিকতর ভালোভাবে প্রস্তুত। তবে আজো প্রায়ই সে তার স্বামীর থেকে অনেকছোটো। এ-ব্যাপারটির ওপর যথোচিত গুরুত্ব দেয়া হয় নি; প্রায়ই যা আসলে অসম প্ৰায়তার ব্যাপার, সেটাকে গণ্য করা হয় লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা বলে; অনেক ক্ষেত্রে নারীটি শিশু, এজন্যে নয় যে সে নারী, বরং এজন্যে যে আসলেই সে খুবই অল্পবয়স্ক। তার স্বামী ও তার বন্ধুদের ধীরস্থির মনস্কতা শ্বাসরুদ্ধকর, এর ভার মেয়েটিকে চেপে ধরে। তলস্তয়ের স্ত্রী, সোফি, তার বিয়ের এক বছর পর লিখেছেন :

সে বৃদ্ধ, সে অতিশয় নিবিষ্ট, আর আমার প্রসঙ্গে আমি অনুভব করি এতো তারুণ্য এবং বোকামির দিকে আমার এতো ঝোক! শয্যায় যাওয়ার বদলে পাগলের মতো আমি নাচতে চাই, কিন্তু কার সাথে?

বৃদ্ধ বয়সের জলবায়ু আমাকে ঘিরে আছে, আমার চারপাশের সবাই বুড়ো। আমি নিজেকে বাধ্য করি যৌবনের প্রতিটি বাসনা দমন করতে, এ নিরাবেগ পরিবেশে মনে হয় আমি আছি খুবই অস্থানে।

স্বামীর দিক দিয়ে, স্বামী তার স্ত্রীর মধ্যে দেখতে পায় একটি শিশু; সে যেমন প্রত্যাশা করেছিলো তার স্ত্রী তার তেমন সঙ্গিনী নয় এবং সে স্ত্রীকে এটা বুঝিয়ে দেয়, এতে স্ত্রী অপমান বোধ করে। সন্দেহ নেই স্ত্রীটি নিজের বাড়ি ছাড়ার সময় একটি নতুন পথপ্রদর্শক পেয়ে খুশি হয়েছিলো, তবে সে চায় তাকেও গণ্য করা হোক ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ বলে; সে শিশু থাকতে চায়, সে নারী হয়ে উঠতে চায়; একজন বেশি বয়সের স্বামী তার সাথে কখনোই পুরোপুরি সন্তোষজনক ব্যবহার করতে পারে না।

তবে যখন বয়সের ব্যবধান কম, তখনও একটি ব্যাপার থেকে যায় যে ওই তরুণ ও তরুণীটি লালিতপালিত হয়েছে বেশ ভিন্নভাবে; তরুণীটি এসেছে একটি নারীর জগত থেকে, যেখানে তাকে শেখানো হয়েছে নারীর সদাচরণ ও নারীর। মূল্যবোধগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আর সেখানে তরুণটিকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে পুরুষের নীতিবোধের সূত্রানুসারে। প্রায়ই তাদের পক্ষে পরস্পরকে বোঝা শক্ত হয়ে ওঠে এবং অচিরেই দেখা দেয় বিরোধ।

বিয়ে যেহেতু সাধারণত স্ত্রীকে স্বামীর অধীন করে, তাই তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যাটি তীব্রতর হয়ে ওঠে নারীটির কাছেই। বিয়ের কূটভাষ এখানে যে এটা একই সাথে একটি কামমূলক ও সামাজিক কাজ : নারীটির চোখে স্বামীরূপে। প্রতিফলিত হয় এ-পরস্পরবিপরীত মূল্য। স্বামীটি হচ্ছে পৌরুষের মর্যাদায় ভূষিত একটি নরদেবতা এবং সে গ্রহণ করবে স্ত্রীটির পিতার স্থান : রক্ষক, ভরণপোষণকারী, শিক্ষক, পথপ্রদর্শক; তার ছায়ায়ই বিকশিত হবে স্ত্রীটির অস্তিত্ব; স্বামীটি মূল্যবোধের প্রতিপালক, সত্যের রক্ষক, সে-ই প্রতিপাদন করে দম্পতিটির নৈতিক যথার্থতা। তবে সে একটি পুরুষও, যার সাথে স্ত্রীটিকে সঙ্গী হতে হবে এমন একটি অভিজ্ঞতায়, যা। প্রায়ই লজ্জাজনক, উদ্ভট, আপত্তিকর, বা বিপর্যস্তকর, অনেকটা নৈমিত্তিক; স্বামীটি তার সাথে ইন্দ্রিয়চর্চায় মেতে ওঠার জন্যে স্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাবে, আবার সে-ই দৃঢ়ভাবে স্ত্রীকে পথ দেখিয়ে নেবে আদর্শের দিকে।

বিজ্ঞ পরামর্শদাতা ও ফনের মাঝামাঝি থাকতে পারে বহু সংকর রূপ। অনেক সময় পুরুষটি হয়ে ওঠে একই সঙ্গে পিতা ও প্রেমিক, যৌনকর্মটি হয়ে ওঠে এক পবিত্র কামোৎসব এবং অনুরাগিণী স্ত্রীটি সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করার মূল্যে লাভ করে চুড়ান্ত মোক্ষ। বিবাহিত জীবনে প্রীতিপূর্ণ সংরাগ খুবই দুর্লভ। অনেক সময়, আবার, স্ত্রীটি তার স্বামীকে ভালোবাসে প্লাতোয়ীভাবে, কিন্তু যে-পুরুষটিকে সে অতিশয় ভক্তি করে, তার বাহুবন্ধনে নিজেকে সমর্পণ করতে সে সম্মত হয় না, যেমন ঘটেছে একজন মহান শিল্পীর সাথে বিবাহিত এক নারীর বেলা, যে অনুরাগিণী ছিলো শিল্পীর, কিন্তু তার সাথে সে ছিলো পুরোপুরি কামশীতল। এর বিপরীতে, স্ত্রীটি স্বামীর সাথে মিলে উপভোগ করতে পারে এমন কোনো আনন্দ, যা তার কাছে মনে হতে পারে। উভয়ের জন্যেই এক নিচাশয়তা এবং এটা তার অনুরাগ ও ভক্তির জন্যে মারাত্মক। আবার, কামহতাশা তার স্বামীকে চিরকালের জন্যে নামিয়েদিতে পারে একটা বর্বরের স্তরে : দেহরূপে সে ঘৃণিত, চৈতন্যরূপে সে অবজ্ঞার পাত্র; ব্যস্তানুরূপে, আমরা দেখেছি কীভাবে তিরষ্কার, পারস্পরিক বিদ্বেষ, বিরক্তি নারীকে করে তুলতে পারে কামশীতল। যা প্রায়ই ঘটে, তা হচ্ছে তাদের কামের অভিজ্ঞতার পর স্বামীটিকে থাকতে হয় একজন শ্রদ্ধেয় শ্রেষ্ঠতর মানুষ, যার পাশব দুর্বলতাগুলো ক্ষমার যোগ্য; উদাহরণস্বরূপ, এটাই হয়তো ঘটেছিলো ভিক্তর উপোর স্ত্রী আদেলের বেলা। অথবা স্বামীটি হতে পারে নিতান্তই একটি প্রীতিকর সঙ্গী, যার নেই বিশেষ কোনো মর্যাদা, একই সঙ্গে যে ভালোবাসা ও ঘৃণার পাত্র।

স্ত্রী প্রায়ই প্রেমের ভান করে নৈতিকতা, কপটতা, গর্ব, বা ভীরুতার মাধ্যমে। স্বামীর আধিপত্য এড়ানোর জন্যে তরুণী স্ত্রীর কম-বেশি প্রচণ্ড চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তার প্রকৃত বিরূপতা। মধুচন্দ্রিমা ও পরবর্তীগোলমাল, যা প্রায়ই দেখা দেয়, সে-সময়টা কেটে যাওয়ার পর স্ত্রীটি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে তার স্বাধীনতা, যা সহজ কাজ নয়। স্বামীটি প্রায়ই হয় বয়স্কতর, তার আছে পুরুষের মর্যাদা, আইনগতভাবে সে ‘পরিবারের প্রধান’, তার আছে একটা নৈতিক ও সামাজিক শ্রেষ্ঠতর অবস্থান অধিকাংশ সময়ই, অন্তত, স্বামীটি হয় বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবেও শ্রেষ্ঠতর। তার আছে উৎকৃষ্টতর সংস্কৃতির সুবিধা, বা যা-ই হোক, তার আছে পেশাগত প্রশিক্ষণ; কৈশোর থেকে সে আগ্রহ পোষণ করেছে বৈশ্বিক ব্যাপারের প্রতি–এগুলো তারই। ব্যাপার–সে কিছুটা আইন জানে, সে রাজনীতির সাথে তাল রেখে চলে, সে একটি দলের সদস্য, একটি সংঘের সদস্য, একটি সামাজিক সংস্থার সদস্য; কর্মী ও নাগরিক হিশেবে তার চিন্তাভাবনা কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। কঠোর বাস্তবের পরীক্ষার সাথে সে পরিচিত : অর্থাৎ, গড়পড়তা পুরুষের আছে যুক্তিপ্রয়োগের কৌশল, আছে সত্যঘটনা সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতাবোধ, কিছুটা সমালোচনার শক্তি।

বিপুল সংখ্যক নারীর মধ্যে এরই অভাব। এমনকি যদি তারা পড়াশোনা করেও থাকে, বক্তৃতা শুনেও থাকে, কোনো কিছুতে পারদর্শিতা অর্জনের জন্যে অল্পসল্প ভাবনাচিন্তা করেও থাকে, তবুও তাদের যাবতীয় তথ্য সংস্কৃতি হয়ে ওঠে না; এমন নয় যে তারা মানসিক ক্ৰটিবশত ঠিকমতো যুক্তিপ্রয়োগে অসমর্থ, বরং এজন্যে যে অভিজ্ঞতা তাদের ঠিকমতো যুক্তিপ্রয়োগের প্রতি নিষ্ঠাপরায়ণ করে নি; তাদের কাছে চিন্তাভাবনা হাতিয়ার নয়, একটা মজা; যদিও তারা বুদ্ধিমান, স্পর্শকাতর, আন্তরিক, তবুও বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের অভাবে তারা তাদের অভিমত প্রকাশ করতে পারে না এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারে না। এজন্যে তাদের স্বামীরা, তুলনামূলকভাবে মাঝারি ধীশক্তির হলেও, সহজেই তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং এমনকি যখন তারা ভুলও করে, তখনও নিজেদের ঠিক বলে প্রমাণ করে। পুরুষের হাতে যুক্তিও অনেক সময় এক ধরনের হিংস্রতা, এক ধরনের প্রতারক স্বৈরাচার : স্বামীটি স্ত্রীটির থেকে বয়স্ক ও অধিকতর শিক্ষিত হলে যখন সে স্ত্রীর সাথে কোনো ব্যাপারে একমত হয়, তখন তার এ-শ্ৰেষ্ঠতাবশত সে স্ত্রীর মতামতের কোনো মূল্যই দেয় না; অক্লান্তভাবে সে স্ত্রীর কাছে প্রমাণ করে যে সে-ই ঠিক। স্ত্রীর কথা বলতে গেলে, সে জেদি হয়ে ওঠে এবং স্বামীর যুক্তির মধ্যে যে কোনো সার আছে, তা স্বীকার করতে চায় না; স্বামীটি পুরোপুরি অটল থাকে তার ধারণায়। তাই তাদের মধ্যে গভীর ভুল বোঝাবুঝি দেখা দেয়। নিজের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়াগুলোর সত্যতা প্রতিপাদনের মতো যথেষ্ট বুদ্ধি স্ত্রীটির নেই, যদিও সেগুলোর মূল তার ভেতরে গভীরভাবে প্রোথিত, স্বামীটি সেগুলো বোঝার কোনো চেষ্টাই করে না; স্ত্রীটি বুঝতে পারে না তার স্বামী যে-পণ্ডিতি যুক্তি দিয়ে তাকে বিহ্বল করে, তার পেছনের অপরিহার্য ব্যাপারটি কী। তখন নীরবতা, বা অশ্রু, বা হিংস্ৰতা ছাড়া স্ত্রীটির আর কোনো অবলম্বন থাকে না, এবং শেষে স্ত্রীটি কিছু একটা ছুঁড়ে মারে স্বামীটির দিকে।

কখনো কখনো স্ত্রীটি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তবে প্রায়ই সে ইবসেনের এ ডলস হাউজ নাটকের নোরার মতো ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় এটা ছেড়ে দেয়, এবং স্বামীকে সুযোগ দেয় তার সম্পর্কে ভাবার অন্তত কিছু সময়ের জন্যে। সে তার স্বামীকে বলে : ‘তুমি তোমার রুচি অনুসারেই সব কিছু করেছে এবং আমার রুচিও ছিলো তোমার মতোই, বা আমি তার ভান করেছিলাম। আমি জানি না কোনটি–হয়তো দু-রকমেই–কখনো এটা, কখনো অন্যটা’। ভীরুতাবশত, বা বিব্ৰত বোধ করার জন্যে, বা আলস্যবশত স্ত্রীটি সমস্ত সাধারণ ও বিমূর্ত বিষয়ে তাদের যৌথ সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার স্বামীর ওপরই ছেড়ে দেয়। একজন বুদ্ধিমান, সুসংস্কৃত, স্বাধীন নারী, স্বামীকে যে তার থেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে পনেরো বছর ধরে স্বামীর ওপর নির্ভর করে এসেছে, এমন এক নারী আমাকে বলেছে, স্বামীর মৃত্যুর পর সে পীড়া বোধ করেছে যখন সে দেখতে পায় যে তার নিজের বিশ্বাস ও আচরণ সম্বন্ধে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে; সে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভাবার চেষ্টা করে এব্যাপারে তার স্বামী কী ভাবতো।

এ-বিজ্ঞ পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় স্বাভাবিকভাবেই স্বামীটি সুখ বোধ করে। নোরার স্বামী তাকে নিশ্চয়তা দেয় : ‘শুধু আমার ওপর নির্ভর করো—আমাকে উপদেশ দিতে ও পথ দেখাতে দাও তোমাকে! আমি আঁটি পুরুষ হতাম না, যদি না তোমার এ-নারীসুলভ অসহায়তা আমার চোখে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় করে তুলতে তোমাকে… তোমাকে রক্ষা করার জন্যে আমার আছে বিস্তৃত ডানা’। তার সমানদের সাথে সংগ্রামের একটি কঠিন দিনের পর, উর্ধ্বতনদের কাছে আত্মসমর্পণের পর, সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সে নিজেকে অনুভব করতে চায় একজন পরম পুরুষ ও একজন অকাট্য সত্যদাতারূপে। সে বর্ণনা করে সারাদিনের ঘটনা, বিরোধীদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে সে কতটা নির্ভুল ছিলো, তা ব্যাখ্যা করে, সে সুখ পায় তার স্ত্রীর মধ্যে নিজের একটি ডবল পেয়ে, যে তার আত্মবিশ্বাসের প্রতি জানায় সমর্থন ও তাকে উৎসাহ দেয়; সে পত্রিকাগুলো ও রাজনীতিক সংবাদের ওপর তার মতামত দেয়, ইচ্ছে করেই সে ওগুলো জোরে জোরে পড়ে শোনায় স্ত্রীকে, যাতে এমনকি সংস্কৃতির সাথেও তার স্ত্রীর সংস্পর্শ স্বাধীন না থাকে। সে নারীর অসামর্থ্যকে অতিরঞ্জিত করতে থাকে তার কর্তৃত্ব বাড়ানোর জন্যে; স্ত্রীটি কম-বেশি বশমানাভাবে মেনে নেয় এঅধীন ভূমিকা। যে-সব নারীকে কিছু সময়ের জন্যে নিজেদের ভেবেচিন্তে কাজ করতে হয়, তারা স্বামীদের অনুপস্থিতিতে আন্তরিকভাবেই আক্ষেপ বোধ করতে পারে, কিন্তু তারা প্রায়ই এটা আবিষ্কার করে বিস্মিত ও আনন্দিত হয় যে এমন পরিস্থিতিতে তাদের আছে অভাবিত সম্ভাবনা; তারা দায়িত্বভার গ্রহণ করে, সন্তান বড়ো করে, সিদ্ধান্ত নেয়, সাহায্য ছাড়াই চালিয়ে যায়। যখন তাদের পুরুষেরা ফিরে এসে আবার তাদের যোগ্যতাহীন করে তোলে, সেটা তার জন্যে হয় বিরক্তিকর।

বিয়ে পুরুষকে প্ররোচিত করে এক খামখেয়ালপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদে : আধিপত্য করার প্রলোভন সত্যিকারভাবেই সর্বজনীন, যতো প্রলোভন আছে, এটা সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য; শিশুকে তার মায়ের কাছে সমর্পণ করা, স্ত্রীকে তার স্বামীর কাছে সমর্পণ করা হচ্ছে বিশ্বে স্বৈরাচারকে উৎসাহিত করা। তার কথা মেনে নেয়া ও তার প্রতি অনুরাগ পোষণ করা, তাকে পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শকরূপে গ্রহণ করা, প্রায়ই এটা স্বামীর কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয় না; সে আদেশ জারি করে, সে অভিনয় করে প্রভু ও মনিবের। বাল্যকালে ও পরবর্তী জীবনে তার মনে যতো ক্ষোভ জমেছে, যে-সব ক্ষোভ প্রতিদিন জমেছে অন্য পুরুষদের সাথে কাজ করে, যে-সব পুরুষের অস্তিত্ব বোঝায় সে আছে শাসানোর নিচে ও আহত অবস্থায়–এ-সবেরই মোক্ষণ ঘটে যখন সে বাড়িতে ফিরে স্ত্রীর ওপর নির্বিচারে চালায় তার কর্তৃত্ব। সে বিধিবদ্ধ করে হিংস্রতা, ক্ষমতা, একরোখা সিদ্ধান্ত; সে কঠোর স্বরে নির্দেশ দিতে থাকে; সে চিল্কার করে এবং টেবিলের ওপর বাড়ি মারতে থাকে : এ-প্রহসন তার স্ত্রীর জন্যে এক প্রাত্যহিক বাস্তবতা। নিজের অধিকারে সে এতো অটল যে স্ত্রীর দিক থেকে স্বাধীনতার সামান্য ইঙ্গিতকেও তার কাছে মনে হয় বিদ্রোহ; তার অনুমতি ছাড়া স্ত্রীকে নিশ্বাস ফেলতে দিতেও সে রাজি নয়।

তবে স্ত্রীটি সত্যিই বিদ্রোহ করে। যদিও প্রথম দিকে সে মুগ্ধ হয়েছিলো পুরুষের। মর্যাদায়, অচিরেই তার চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার ভাবটা কেটে যায়। শিশু একদিন বুঝতে পারে যে তার পিতা একটি নিশ্চয়তাহীন মানুষ; স্ত্রীটি অবিলম্বে আবিষ্কার করে যে তার সামনে নেই কোনো প্রভু ও মনিবের মহান মূর্তি, আছে একটি পুরুষ; সে আর স্বামীটির ক্রীড়নক হয়ে থাকার কোনো কারণই দেখতে পায় না; স্বামীটি তার কাছে হয়ে ওঠে অপ্রীতিকর ও অন্যায় দায়িত্বের প্রতিমূর্তি। মর্ষকামী সুখে কখনো কখনো সে বশ্যতা মেনে নেয় : সে নেয় একটি বলি-হয়ে-যাওয়া মানুষের ভূমিকা এবং বিনা প্রতিবাদে তার এটা মেনে নেয়া হচ্ছে এক দীর্ঘ, নিঃশব্দ ভৎসনা; তবে কখনোকখনে এও ঘটতে পারে যে সে তার প্রভুর সাথে লিপ্ত হয় খোলাখুলি যুদ্ধে এবং স্বামীটির ওপর পাল্টা স্বৈরাচার চালাতে চেষ্টা করে।

একটা স্বামী ‘ধরা’ হচ্ছে শিল্পকলা; তাকে ‘ধরে রাখা’ হচ্ছে একটি চাকুরি–এবং এমন একটি, যার জন্যে দরকার অসামান্য দক্ষতা। এক বিজ্ঞ ভগ্নী তার বিরক্তিকর নববিবাহিত তরুণী বোনকে বলেছিলো : ‘সাবধানে থেকো, মার্সেলের সাথে এসব দৃশ্য ঘটালে তুমি তোমার চাকুরিটা খোয়াবে’। যা বিপন্ন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : বস্তুগত ও নৈতিক নিরাপত্তা, নিজের একটা বাড়ি, স্ত্রীর গৌরব, প্রেম ও সুখের কমবেশি সন্তোষজনক একটা বিকল্প। স্ত্রী শিগগিরই বুঝতে পারে তার যৌনাবেদন হচ্ছে তার অস্ত্রগুলোর মধ্যে দুর্বলতম; ঘনিষ্ঠতার ফলে এটা তিরোহিত হয়; আর আহা, চারদিকে আছে আরো কতো আকর্ষণীয় নারী। তবু, সে চেষ্টা করতে থাকে নিজেকে কামপ্রলুব্ধকর করার চেষ্টা করতে থাকে খুশি করার; সে প্রায়ই ছিড়েফেড়ে যেতে থাকে গর্বে, যা তাকে নিয়ে যেতে থাকে কামশীতলতার দিকে ও এ-আশার মধ্যে যে তার কামনার ব্যগ্রতা হয়তো মুগ্ধ করবে তার স্বামীকে এবং স্বামীর কাছে তাকে প্রিয় করে তুলবে। সে নির্ভর করে অভ্যাসের জোর, একটি সুখকর গৃহের মোহিনীশক্তি, বিশেষ খাদ্যের প্রতি স্বামীর আকর্ষণম সন্তানদের প্রতি স্বামীর স্নেহের ওপরও; স্ত্রীটি তার আপ্যায়নের রীতি ওপোশাকপরিচ্ছদের সাহায্যেও চেষ্টা করে স্বামীটির সুনাম বাড়ানোর, এবং সে তার উপদেশ ও পরামর্শ দিয়ে স্বামীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে; তার পক্ষে যতোটা সম্ভব সে স্বামীর সামাজিক সাফল্য ও কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে অপরিহার্য করে তোলার চেষ্টা করে।

তবে, সর্বোপরি, সমগ্র প্রথাগত ঐতিহ্যধারা স্ত্রীদের ওপর নির্দেশ দেয় একটি পুরুষকে ‘বশে রাখা’র শিল্পকলা শিখতে; এজন্যে স্ত্রীদের আবিষ্কার ও প্রশ্রয় দিতে হবে স্বামীর দুর্বলতাগুলো, এবং চতুরতার সাথে পরিমাণমতোপ্রয়োগ করতে হবে তোষামোদ ও অবজ্ঞা, বাধ্যতা ও প্রতিরোধ, পাহারা ও ক্ষমাশীলতা। মনোভাবের শেষের মিশ্রণটি বিশেষভাবেই এক সুকুমার ব্যাপার। স্বামীকে খুব বেশি বা খুব কম স্বাধীনতা দিলে চলবে না। স্ত্রীটি যদি হয়অত্যন্ত বাধ্যগত, তাহলে সে দেখতে পাবে তার স্বামী পালাচ্ছে তাকে ছেড়ে; স্বামীটি যে-টাকা ও আবেগ নিয়োগ করে অন্য নারীদের ক্ষেত্রে, তা তার থেকেই নেয়া; এবং সে মুখোমুখি হয় একটা ঝুঁকির যে কোনো উপপত্নী তার স্বামীর ওপর এতো ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে যে সে তার স্বামীকে বাধ্য করতে পারে স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে অথবা অন্তত তার স্বামীর জীবনে অধিকার করতে পারে প্রথম স্থানটি। তবে সে যদি স্বামীকে কোনো রকমরোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ডই করতে না দেয়, যদি সে স্বামীকে জ্বালাতন করে সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে, আবেগের বিস্ফোরক দৃশ্য ঘটিয়ে, তার দাবি দিয়ে, তাহলে সে তার স্বামীকে ক্ষেপিয়ে তুলবে নিজের বিরুদ্ধে। কীভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘ছাড় দিতে হয়’, এটা জানতে হয়; যদি কারো স্বামী একটু ‘ঠকায়’, তাহলে তার চোখ বুজে থাকা ভালো; তবে অন্য সময় দু-চোখ খুলে রাখতে হবে বড়ো করে। বিবাহিত নারী বিশেষ করে পাহারা দেয় তরুণী নারীদের, যারা, সে মনে করে, আনন্দের সাথেই তার কাছে থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে তার ‘চাকুরিটি’। একটি ভীতিকর। প্রতিপক্ষের কবল থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে আনার জন্যে সে স্বামীকে নিয়ে দূরে কোথাও যায়অবকাশ কাটাতে, তাকে আমোদপ্রমোদ দেয়ার চেষ্টা করে; যদি দরকার হয়মাদাম দ্য পপাদরের আদর্শে–তাহলে স্বামীর পেছনে লাগিয়ে দেয় একটি নতুন ও কম ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। কিছুতেই কাজ না হলে সে আশ্রয় নেয়কান্নাকাটির, স্নায়ুদৌর্বল্যের, উদ্যোগ নেয় আত্মহত্যার, এবং এমন অনেক কিছুর; তবে খুব বেশি ভাবাবেগপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা ও পাল্টা অভিযোগ স্বামীকে দূর করে দেবে বাড়ি। থেকে। যে-মুহূর্তে স্ত্রীটির খুবই হওয়া দরকার কামপ্রলুব্ধকর, তখনই সে ঝুঁকি নেয় নিজেকে স্বামীর কাছে অসহ্য করে তোলার; যদি সে খেলায় জিততে চায়, তাহলে তাকে সুকৌশলে মিশেল ঘটাতে হবে কপট অঞ ও সাহসী স্মিতহাসির, ধাপ্পা ও ছেনালিপনার।

বিয়ের ট্র্যাজেডি এটা নয় যে তা ব্যর্থ হয় নারীর প্রতি প্রতিশ্রুত সুখ নিশ্চিত করতে–সুখের ব্যাপারে নিশ্চয়তাবিধান বলে কোনো জিনিশ নেই–ট্র্যাজেডি হচ্ছে এটা বিকলাঙ্গ করে নারীকে; তাকে ধ্বংস করে পুনরাবৃত্তি ও নিত্যনৈমিত্তিকতায়। আমরা দেখেছি নারীর জীবনের প্রথম বিশটি বছর অসাধারণভাবে সমৃদ্ধ; সে আবিষ্কার করে বিশ্ব ও তার নিয়তি। বিশ বা তার কাছাকাছি বয়সে সে হয় একটি ঘরের গৃহিণী, স্থায়ীভাবে বাঁধা থাকে একটি পুরুষের সাথে, কোলে একটি শিশু, তখন তার জীবন চিরকালের জন্যে কার্যত শেষ; প্রকৃত কর্ম, প্রকৃত কাজ তার পুরুষটির বিশেষাধিকার : নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে তার আছে তুচ্ছ কাজ, যেগুলো অনেক সময় খুবই ক্লান্তিকর, কিন্তু কখনই সন্তোষজনক নয়। তার আত্মবিসর্জন ও নিষ্ঠা প্রশংসা লাভ করেছে, কিন্তু ‘দুটি মানুষের সেবাযত্ন করে জীবন কাটিয়ে দেয়া’কে প্রায়ই তার মনে হয় অর্থহীন। নিজের কথা ভুলে থাকা খুবই চমৎকার, তবে মানুষের জানা দরকার কার জন্যে, কীসের জন্যে। এবং এর মাঝে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে যে তার নিষ্ঠাকেই অনেক সময় মনে হয় বিরক্তিকর, নাছোড়বান্দা ধরনের; এটা স্বামীর কাছে হয়ে ওঠে একটা স্বৈরাচার, যার থেকে সে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে; তবে স্বামীটিই এটা স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেয় স্ত্রীর পরম, অনন্য যাথার্থ প্রতিপাদনরূপে। নারীটিকে বিয়ে করে সে নারীটিকে বাধ্য করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তার কাছে দান করতে; তবে স্বামীটি এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বাধ্যবাধকতা মেনে নেয় না।

ভারসাম্যপূর্ণ দম্পতি কোনো ইউটোপীয় কল্পনা নয়; এমন দম্পতির অস্তিত্ব আছে, অনেক সময় আছে বিয়ের কাঠামোর মধ্যেই, তবে অধিকাংশ সময়ই বিয়ের বাইরে। কিছু সহচর মিলিত হয় তীব্র যৌন প্রেমে, যা তাদের স্বাধীন রাখে তাদের বন্ধুত্বে ও তাদের কর্মে; অন্যরা পরস্পরের সাথে জড়িত থাকে এমন বন্ধুত্বে, যা তাদের কামস্বাধীনতা খর্ব করে না; আরো কম সুলত হচ্ছে তারা, যারা একই সাথে প্রেমিকপ্রেমিকা ও বন্ধু, তবে তারা পরস্পরের মধ্যেই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ সন্ধান করে না। একটি পুরুষ ও একটি নারীর সম্পর্কের মধ্যে সম্ভব বহু সূক্ষ্ম দ্যোতনা; সহচারিতা, আনন্দ, বিশ্বাস, ভালো লাগা, সহযোগিতা, প্রেমে তারা পরস্পরের কাছে হতে পারে মানুষের পক্ষে লভ্য আনন্দোল্লাস, সমৃদ্ধি, ও শক্তির। অপর্যাপ্ত উৎস। বিয়ের ব্যর্থতার জন্যে ব্যক্তিমানুষকে দোষ দেয়া ঠিক নয় : কোঁৎ ও তলস্তয়ের মতো প্রবক্তাদের দাবির বিপরীতে দোষী সংস্থাটি নিজেই, যা শুরু থেকেই বিকৃত। একটি পুরুষ ও একটি নারী, যারা হয়তো পরস্পরকে নিজেদের পছন্দে বেছে নেয় নি, তারা পরস্পরকে জীবনতর সব রকমে তৃপ্ত করার জন্যে দায়িত্ববদ্ধ, এধারণা পোষণ ও ঘোষণা একটা পৈশাচিকতা, যা অবধারিতভাবে জন্ম দেয় ভণ্ডামো, মিথ্যাচার, শক্রতা ও সুখহীনতার।

প্রথাগত বিয়ের রূপটি এখন বদলাচ্ছে, তবু এখনো এতে আছে পীড়ন, যা স্বামীস্ত্রী দুজনে ভোগ করে ভিন্নভাবে। তারা যে-বিমূর্ত, তাত্ত্বিক অধিকার উপভোগ করে, তাতে আজ তারা প্রায় সমান; তারা পরস্পরকে পছন্দ করার ব্যাপারে আগের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন, তারা বিচ্ছিন্নও হতে পারে অনেক সহজে, বিশেষ করে আমেরিকায়, যেখানে বিবাহবিচ্ছেদ বিরল ব্যাপার নয়; একদা স্বামীস্ত্রীর বয়স ও সংস্কৃতির মধ্যে যে-পার্থক্য ছিলো, এখন তা সাধারণত কম দেখা যায়; এখন স্ত্রী যেস্বাধীনতা দাবি করে, স্বামী তা অনেক বেশি স্বেচ্ছায় মেনে নেয়; তারা ঘরকন্নার। কাজগুলো ভাগ করে নিতে পারে সমভাবে; তারা আমোদপ্রমোদও উপভোগ করে একত্রে : শিবিরাবকাশ, সাইকেল চালানো, সাঁতারকাটা, গাড়িচালনা ইত্যাদি। স্ত্রী আর স্বামীর ফেরার প্রতীক্ষায় দিন কাটায় না; সে খেলাধুলো করতে যেতে পারে, কোনো ক্লাবের, সংঘের, সঙ্গীতদলের বা এমন কিছুর সদস্য হতে পারে, সে প্রায়ই ঘরের বাইরে ব্যস্ত থাকে, এমনকি তার থাকতে পারে কোনো কাজ, যাতে তার হাতে কিছু পয়সা আসে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *