৫. সকালে হিথরোতে

এতো সকালে হিথরোতে নামলো ওরা, ইমিগ্রেশনে কোনো ভিড় নেই। আর যেহেতু সাথে কোনো লাগেজও নেই, কাজেই ঝামেলা আরো কম।

নাইলন ব্যাগে ডিক ডিকের চামড়া ভরে সেটা বগলের নিচে নিয়ে নিল নিকোলাস। এরপর এক হাত ধরে রোয়েনকে নিয়ে রওনা হলো।

ট্যাক্সির সারিতেও কোনো জ্যাম নেই। সোমবার সকাল আটটা ত্রিশ তখন। নাইটসব্রিজে নিকোলোসের বাড়িতে পৌঁছল ওরা।

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো রোয়েন, ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস কিনে আনলো নিকোলাস। দু জন মিলে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে খেলো।

অ্যাবি গিরিখাতে যেতে হলে আপনার তো এক্সপার্ট সাহায্য প্রয়োজন হবে। রুটিতে মাখন লাগাতে লাগতে মন্তব্য করলো রোয়েন।

একজনের কথা ইতোমধ্যেই চিন্তা করে রেখেছি আমি। আগেও কাজ করেছি ওর সাথে, নিকোলাস বলে। এক্স-রয়াল ইঞ্জিনিয়ার। ডাইভিং এবং আন্ডার ওয়াটার কন্ট্রাকশন বিশেষজ্ঞ। ডেভনে একটা কটেজে থাকে। রিটায়ার্ড। নির্ঘাত এখন পরে পরে বোক্ব হচ্ছে। আমি ডাকলেই ছুটে আসবে।

খাওয়া শেষ হতে নিকোলাস.বলল, আমি এটো প্লেট ধুয়ে নিব। ফিল্মগুলো ডেভলপ করিয়ে আনুন আপনি, আমার রেইনকোটটা ধার হিসেবে নিয়ে যান। এদিকে আমি জরুরি কয়েকটা ফোন সারি।

রোয়েন বেরিয়ে যেতে কুয়েনটন পার্কে মিসেস স্ট্রিটকে ফোন করলো নিকোলাস।

আপনার ডেস্কে দুই ফুট লম্বা কাগজপত্র জমে গেছে।

খুব আনন্দের খবর।

বেশিরভাগই বিল। লয়েড ব্যাঙ্ক এবং ল-ইয়ারেরা ফোন করে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে।

এই ভালো। আমি ইয়র্কে থাকলে ওরা আমাকে খুঁজে পাবে না। নোটবুক আর পেন্সিল নাও। তারপর শোনো কী কী করতে হবে তোমাকে।

দশ মিনিট ডিকটেশন দিল ও।

শেষমেষ বলল, ইয়র্কে ফোন করে বাড়তি রুমটা তৈরি রাখতে বলো। ডক্টর আল সিমা আর আমি অনির্দিষ্ট সময় থাকবো ওখানে।

এরপর এক্স-রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড্যানিয়েল ওয়েবকে ফোন করলো নিকোলাস, ডেভনে। উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে তৈরি একটা জাগুয়ার আছে তার, শখ বলতে সেটা খুলে আবার জোড়া লাগানো আর মাছ ধরা। দু বার রিঙ হতে রিসিভার তুললাম, ভেসে এলো ড্যানিয়েলের গলা, কে হে?

নিকোলাস, বলল ও। স্যাপার, একটা কাজ আছে। কথা বলবে? কোনো ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দিল ও।

ঠাট্টা কোরো না তো, বলল ড্যানিয়েল। তুমি ডাকলে কবে যাই নি? তবে বিস্তারিত সব জানতে হবে। কোথায় দেখা করব?

কাল আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। স্লাইড রুলটা নিয়ে আসতে ভুলো না। নিকোলাস জানে ড্যানিয়েল পকেট কমপিউটর ব্যবহার করে না।

এরপর আদ্দিস আবাবায় ফোন করে জিওফ্রে টেনেন্টকে চাইলো নিকোলাস। জিওফ্রে লাইন আসতেই বলল, মিস রোয়েন তোমাকে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানিয়েছেন।

বিশ্বাস করতে পারলে খুশি হতাম, জবাব দিল জিওফ্রে। তোমরা তাহলে ভালোয় ভালোয় পৌঁছে, কেমন?

হ্যাঁ, কোনো অসুবিধে হয় নি, বলল নিকোলাস। আমার একটা উপকার করতে হয়, জিওফ্রে। কর্নেল মারিয়াম কিদেন, ইথিওপিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। তুমি তাকে চেনো?

সজ্জন ব্যক্তি,বলল জিওফ্রে। খুব ভালো করে চিনি। শনিবারে তাঁর সঙ্গে টেনিস খেলেছি। কেন, কী দরকার তাঁকে তোমার?

আমি একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি। তাঁকে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবে। বলবে, ইমার্জেন্সি। প্লিজ, জিওফ্রে।

এরপর, আফ্রিকা এয়ার সার্ভিসে ফোন করে জেনি বাদেনহোর্সকে চাইলো। কিন্তু সে নেই। শেষমেষ একটা মেসেজ দিয়ে রাখলো ও জেনি, নিকোলাস কুয়েনটন হারপার বলছি। তোমার সেই পুরনো হারকিউলিস বিমানটা এখনো ওড়ে তো? কাজে ঝুঁকি আছে, তবে টাকা আছে। আমার ইউ কে ফ্ল্যাটে ফোন করো। ধন্যবাদ।

রিসিভার নামিয়ে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠলো।

দরজা খুলে দিতে ভেতরে ঢুকলো রোয়েন, কোটের পকেট থেকে হলুদ একটা প্যাকেট বের করে দেখালো নিকোলাসকে। আপনি সত্যি মাস্টার ফটোগ্রাফার। সবগুলো ছবি নিখুঁত হয়েছে। ফলকের প্রতিটি ক্যারেক্টর খালি চোখে পড়তে পারছি আমি। টাইটার সঙ্গে খেলাটায় আবার আমরা ফিরে এসেছি।

ডেস্কের উপর গ্লসি ফটোগ্রাফগুলো সাজালো ওরা, মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আপনি দেখছি ডুপ্লিকেটও করিয়েছেন গুড। নেগেটিভগুলো আমার ব্যাংকের সেফ ডিপোজিটে চলে যাবে। দ্বিতীয়বার ওগুলো হারাবার ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না।

নিকোলাসের বড় সাইজের ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে প্রতিটি প্রিন্ট এক এক করে স্টাডি করলো রোয়েন, ফলকের চারটে সাইডেরই একটা করে সবচেয়ে পরিষ্কার প্রিন্ট আলাদা করলো। এগুলো ব্যবহার করব আমরা। রাবিংগুলো না থাকায় খুব একটা অসুবিধে হবে না। তারপর হায়ারোগ্লিফিক্স-এর একটা অংশ পড়তে শুরু করলো, গোক্ষুর কুণ্ডলী ছাড়িয়ে মণি পরানো ফণা তুললাম। প্রভাতের তারাগুলো তাঁর চোখে ঝিলিক মারলো। তার কালো আর পিচ্ছিল জিভ তিনবার চুমো খেলো বাতাসকে। উত্তেজনায় গরম আর লালচে হয়ে উঠলো ওর চেহারা। এখানে টাইটা কি বলছে বুঝতে পারছি না। উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে উঠলো ও।

ও-সব এখন রেখে দিন, একটু কঠিন সুরে বলল নিকোলাস। আপনাকে আমি চিনি, একবার শুরু করলে সারাদিন আর উঠবেন না। ইয়র্কে যেতে হলে এখনো রেঞ্জ রোভারে বহু রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, এদিকে আবহাওয়ার খবর বলছে বাইরে তুষারপাত হবে। অন্তত অ্যাবি গিরিখাতের চেয়ে ভিন্ন কিছু তো উপভোগ করা যাবে!

হঠাৎ কী যেনো মনে পড়ায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো রোয়েন। হ্যাঁ। মাঝেমধ্যে আমি একটু বেশি বেশিই করে ফেলি। দাঁড়িয়ে পড়লো রোয়েন, যাওয়ার আগে কি দেশে একটা ফোন করতে পারি?

অবাক হলো নিকোলাস। দেশে মানে কায়রোতে?

হ্যাঁ–মানে–ডুরেঈদের পরিবার তো ওখানে–

আরে, এটা আবার বলতে হয় নাকি! ফোন আছে ওখানে, যতো খুশি করুন। নিচে, কিচেনে আছি আমি। রওনা হওয়ার আগে এক চাপ চা না খেলেই নয়।

আধা ঘণ্টা পরে চেহারায় একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে নিচে নেমে এলো রোয়েন। সরাসরি নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় লাগছে। কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়!

বলুন, নিকোলাস বলে।

দেশে যেতে হবে আমাকে কায়রোতে। অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকালো। নিকোলাস। অল্প কিছুদিনের জন্য, দ্রুত বলে চলে নিকোলাস। ডুরেঈদের ভাইয়ের সাথে কথা বললাম মাত্র। কিছু কাজ পরে আছে ওখানে।

কিন্তু একা একা আপনার ওখানে যাওয়াটা আমার মনঃপুত হচ্ছে না, মাথা নাড়ে নিকোলাস। অন্তত গতবার যা হলো, তারপর?

আপনার কথা সত্য হলে–নাহুত গাদ্দাবি যদি বেঈমান হয়, তবে তো আর কোনো চিন্তা নেই। সে এখন ইথিওপিয়ায়।

তারপরেও, ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না। টাইটার খেলায় আপনি হলেন আমার চাবিকাঠি।

অনেক ধন্যবাদ। গলার সুরে ব্যঙ্গ ফুটিয়ে তুললাম রোয়েন। কেবল এ জন্যই আমার জন্য চিন্তা করেন?

না, সত্যি করে বললে, আপনার সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

আরে, আপনি টের পাওয়ার আগেই আমি চলে আসবো। মাত্র কয়দিনের ব্যাপার। আর তাছাড়া, ব্যস্ত থাকার বহু উপায় আপনার হাতের নাগালে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস বলে, আপনাকে ঠেকানো আমার সাধ্য নয়। কখন রওনা হচ্ছেন

আজই সন্ধের ফ্লাইটে।

একটু যেনো তাড়াহুড়ো করে ফেললেন। আজই মাত্র এলাম। চলুন, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি এয়ারপোর্টে।

মাথা নাড়ে রোয়েন। না, নিকি। আমি ট্রেনে যেতে পারবো। হিথরো আপনার বিপরীত দিকে।

তবুও আমি যাবো! নিকোলাস নাছোরবান্দা।

বিকেলে রোয়েনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়ার সময় নিকোলাস বলল, কর্নেল মারিয়াম কিদেনের মাধ্যমে আমার বন্ধু মেক নিমুরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। আমার প্ল্যানে মূল চাবিই হলো মেক। তার সাহায্য ছাড়া টাইটার সঙ্গে খেলাটায় আমরা অংশগ্রহণই করতে পারব না।

এয়ারপোর্ট বিল্ডিঙে অদৃশ্য হওয়ার আগে রোয়েন বলল, আমি কায়রো পৌঁছে জানাবো। আপনিও তাই, নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে ফোন করবেন।

রোয়েন চলে যেতেই অদ্ভুত একটা দুঃখবোধ ঘিরে ধরলো নিকোলাসকে। যেনো কি একটা হারিয়েছে সে। পরক্ষণেই, মনের গহীন কোণে বেজে উঠলো সতর্কঘণ্টি। খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রোয়েন মিশরে পৌঁছলেই ব্যাপারটা শুরু হবে। কিন্তু কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না নিকোলাস, ব্যাপারটা কি হতে পারে।

ওহ্। দয়া করে ওর কোনো ক্ষতি করো না। নিজের অজান্তেই জোরে জোরে বলল নিক, কার উদ্দেশ্যে এটা অবশ্য বোঝা গেল না। একবার মনে হলো, জোর করে রোয়েনকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু কোন অধিকারে?

পছন্দ হলো না ব্যাপারটা, বিড় বিড় করে নিজের মনেই বলল নিকোলাস।

*

কর্মচারীরা সবাই জানে ভদ্রলোক তাদের কাছ থেকে ঠিক কি আশা করেন। প্রতিটি জিনিস যেমনটি চান তেমনটিই পেলেন তিনি। কোয়ানসেট হাট এর চারদিকে সপ্রশংস দৃষ্টি বুলালেন হের ফন শিলার। বস-এর আগমন উপলক্ষ্যে বেসটাকে ভালোভাবেই সাজিয়েছে হেলম্।

লম্বা পোর্টেবল বিল্ডিঙের অর্ধেকটাই দখল করে রেখেছে তাঁর নিজের প্রাইভেট কোয়ার্টার। ভেতরে জীবাণুনাশক স্প্রে আর এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করা হয়েছে। কাবার্ডে ঝুলছে তার কাপড় চোপড়, কসমেটিক্স আর মেডিসিন সাজানো হয়েছে : বাথরুম কেবিনেটে। প্রাইভেট কিচেনে সব রকম ইকুইপমেন্ট রাখা হয়েছে, তার প্রিয় ডিশ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণেরও কোনো অভাব নেই। সঙ্গে করে নিজের চাইনিজ শেফকেও তিনি নিয়ে এসেছেন।

হের ফন শিলার নিরামিষভোজী, অধূমপায়ী ও টিটোটেলার। চা, মদ আর মাংস তিনি বিশ বছর আগে পরিত্যাগ করেছেন। তখন তিনি মোটা ছিলেন, চোখের নিচে কালচে পোটলা ঝুলত। এখন তিনি একহারা, চামড়ায় যথেষ্ট লাবণ্য ফিরে পেয়েছেন। শক্তির বিচারে এখনো তাকে তরুণই বলা যায়, অথচ বয়েস হয়েছে সত্তর।

সেই যৌবন কাল থেকেই শারীরিক চাহিদাকে দমিয়ে রেখে মনের চাহিদাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। মানুষ বা জীবিত কোনো প্রাণীর চেয়ে জড়পর্দাথকেই বেশি মূল্য দিয়েছেন। যে রাজমিস্ত্রী হাজার বছর আগে মারা গেছে, তার হাতে খোদাই করা একটা পাথর যে কোনো সুন্দরীর নরম দেহের চেয়ে বেশি উত্তেজিত করে তাঁকে। তিনি শৃংখলা পছন্দ করেন, কর্তৃত্ব ফলাতে ভালোবাসেন।

তাঁর বিশাল সংগ্রহে অমূল্য সব প্রাচীন বস্তু রয়েছে, সবই অন্য লোকদের আবিষ্কার করা। জীবনে এ একবার সুযোগ পেয়েছেন তিনি নিজে কিছু আবিষ্কার করার, একজন ফারাও-এর সমাধি ভেঙে ভেতরে ঢুকবেন, চার হাজার বছরের মধ্যে তিনিই হবেন প্রথম মানুষ যিনি নিজের চোখে দেখবেন কি আছে সেখানে। এ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছেন হের ফন শিলার, পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। এরইমধ্যে কিছু মানুষ মারা গেছে, আরো কিছু মারা গেলে তার কিছু আসে যায় না। কোনো মূল্যই তাঁর কাছে বেশি নয়।

প্রমাণ সাইজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলেন হের ফন শিলার। ঘন, কর্কশ, কালো চুলে আঙুল চালালেন। অবশ্যই কলপ লাগানো, শরীর বা চেহারার এতোটুকু যত্ন তাঁকে নিতেই হয়। কাঠের মেঘে ধরে এগিয়ে এসে কনফারেন্স রুমের দরজা খুললেন তিনি।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই। টেবিলের মাথার দিকে এগিয়ে এলেন হের ফন শিলার, দাঁড়ালেন কার্পেট মোড়া নিচু ও ছোট একটা মঞ্চের উপর। এ মঞ্চটা সঙ্গে নিয়ে বেড়ান তিনি। মাত্র নয় ইঞ্চি উঁচু ওটা। পুরুষ ও মহিলাদের দিকে এ উঁচু মঞ্চ থেকে তাকান তিনি। বেশ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন, সবাইকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। সবার চেয়ে উঁচু হয়ে থাকে তাঁর মাথা।

প্রথমে তিনি জ্যাক হেলমের দিকে তাকালেন। টেক্সান হেলম্ এক যুগ ধরে তাঁর কাজ করছে। অত্যন্ত বিশ্বস্ত, গায়ে গণ্ডারের মতো শক্তি, মনটাও ইস্পাতের মতো কঠিন। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই যে কোনো আদেশ পালন করা তার প্রধান গুণ। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো কাজ দিয়েই পাঠানো হোক তাকে, সম্ভাব্য কম ঝামেলার মধ্যে কাজ সেরে নিরাপদে ফিরে আসবে।

এরপর হের ফন শিলার সুন্দরী মহিলার দিকে তাকালেন। উতে কেম্পার তার প্রাইভেট সেক্রেটারি। মনিবের সমস্ত ব্যক্তিগত দিকগুলো দেখেন তিনি। ওঁর অনুমতি ছাড়া ফন শিলারের সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারে না। কেম্পার ফন শিলারের কমিউনিকেশন এক্সপাটও বটে। হাট-এর একদিকের দলে থরে থরে সাজানো ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্টগুলোর নিয়ন্ত্রণ ওঁর হাতে। বয়েস প্রায় চল্লিশ হলেও দেখে আরো কম মনে হয়। দেখতে খুবই সুন্দর।

ফন শিলারের স্ত্রী, ইনজেমার, আজ বিশ বছর হলো প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। সেই থেকে খালি জায়গাটা পূরণ করছেন কেম্পার।

টেবিলের উপর নিজের সামনে রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে বসেছেন কেম্পার তাঁকে ছাড়িয়ে ফন শিলারের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো আরো দু জন কর্মচারীর উপর।

আদ্দিস আবাবা থেকে জেট রেজ্ঞার হেলিকপ্টার চড়ে নাইল গিরিখাদের চূড়ায় নিজেদের বেস ক্যাম্পে আজ সকালে পৌঁছেছেন হের ফন শিলার, হেলিকপ্টার থেকে নামার সময় আজই প্রথম কর্নেল নগুকে দেখেছেন। কর্নেল সম্পর্কে খুব কমই জানেন তিনি, তবে, হেলমের নির্বাচন মন্দ হবে না বলে ধরে নিয়েছিলেন। কর্নেলের কাজ সম্পর্কে হেলম্ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও, তিনি নিজে ঠিক তৃপ্ত হতে পারেন নি। এরই মধ্যে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন কর্নেল নগু। হারপার নিকোলাস আর ঈজিপশিয়ান মেয়েটাকে মুঠোয় পেয়েও বেরিয়ে যেতে দিয়েছেন। আফ্রিকায় বহু বছর ধরে অপারেশন চালাচ্ছেন ফন শিলার, কালো মানুষদের উপর তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ জন্মায় নি। কর্নেল নগু তাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তবে আপাতত তার সার্ভিস দরকার হবে। হাজার হোক দক্ষিণ গোজামের মিলিটারি কমান্ডার কর্নেল। চিন্তার তেমন কিছু নেই, কাজ পুরালে উটকো ঝামেলা সরিয়ে ফেলা যাবে। হেলই সে-ব্যবস্থা করবে। কীভাবে কী করা হলো বিশদ জানতে চাইবেন না ফন শিলার।

টেবিলে দাঁড়ানো শেষ লোকটার দিকে তাকালেন তিনি। এ আর এক লোক, আপাতত যাকে তাঁর খুব দরকার। নাহুত গাদ্দাবিই প্রথম তাঁকে সপ্তম স্ক্রোল সম্পর্কে সচেতন করেন। যতটুকু তিনি শুনেছেন, ওই স্ক্রোলের সূত্র ধরে একজন ইংরেজ লেখক একটা উপন্যাস লিখেছেন। না, উপন্যাসটি তিনি পড়েননি। এ সব ছাইপাঁশ কখনোই তাঁর পড়তে ইচ্ছে করে না। কথাটা সত্যি, নাহুত সচেতন না করলে একজন ফারাও-এর গুপ্তধন উদ্ধারের এ সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত থেকে যেতেন।

আদি স্ক্রোলটা অনুবাদ করেন দুরেঈদ আল সিমা, কাজটা শেষ হওয়া মাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করে নাহুত। ইতিহাসে রেকর্ড করা হয় নি এমন একজন ফারাও আর তাঁর সমাধির অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা। সেই থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন তাঁরা। ডুরেঈদ আর তার স্ক্রোলের সূত্র ধরে তদন্ত চালাচ্ছিলেন, তাদের তদন্তের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে জানার পর নাহুতকে তিনি ওদের ব্যবস্থা করতে বলেন, বলেন স্ক্রোলটা তার চাই।

স্ক্রোলটা এখন তার কালেকশনের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে, অন্যান্য অমূল্য সম্পদের সঙ্গে ইস্পাত আর কংক্রিটের ভল্টে রেখে দিয়েছেন যত্ন করে। স্কলস পাহাড়ের নিচে তার নিজের একটা নিভৃত দুর্গ আছে, ভল্টা সেখানে।

তবে নাহুত তার উপকার যেমন করেছেন, অপকারও কম করেন নি। ডুরেঈদ আর তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলার দায়িত্বটা তাঁকে দেওয়া উচিত হয় নি। উচিত ছিল প্রফেশনাল কাউকে পাঠানো। কিন্তু নাহুত জেদ ধরে বলেছিলেন কাজটা তিনি নিখুঁতভাবে সারতে পারবেন। এর জন্য মোটা টাকা নেন তিনি, অথচ গোটা ব্যাপারটা লেজেগোবরে করে ছাড়েন। কাজেই, সময় হলে, নাহুতকেও সরিয়ে ফেলা হবে। তবে এ মুহূর্তে ওকে তাঁর দরকার।

সন্দেহ নেই ঈজিপ্টোলজি আর হায়ারোগ্লিফিক্স-এর নাহুত একজন এক্সপার্ট। হবে না, সারাজীবন এসব নিয়েই তো পড়ে আছেন। তিনি নিজেও কিছু কিছু বোঝেন বৈকি, তবে উৎসাহী অ্যামেচার ছাড়া আর কিছু বলা যায় না তাকে। স্ক্রোল ছাড়াও নতুন যেসব উপকরণ পাওয়া গেছে, সবই গড় গড় করে পড়তে পারেন নাহুত, যেনো বন্ধুকে লেখা চিঠির মতোই সহজপাঠ্য। ওর সাহায্য নিয়ে ফারাও মামোস-এর সমাধি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

বসুন সবাই, বসুন, প্লিজ, বললেন হের ফন শিলার। আসুন শুরু করি আমরা।

সবাই বসার পরও খুদে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকলেন ফন শিলার। সবার চেয়ে উঁচু হয়ে থাকতে ভালোবাসেন তিনি। একটা কথা পরিষ্কার বলে দিতে চাই। এ কামরা থেকে কোনো পর, ডকুমেন্ট, নোট ইত্যাদি বাইরে বের হতে পারবে না। এখানকার সব কিছুই অত্যন্ত কনফিডেনশিয়াল এবং আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ফ্রয়লিন কেম্পার আপনাদেরকে একটা করে ডকুমেন্ট ফোল্ডার দেবেন, মিটিং শেষে ওগুলো আবার তার কাছে ফিরে যাবে। আমার ইচ্ছা আর নির্দেশের এদিক ওদিক হলে তার পরিণতি ভালো হবে না।

সবাইকে একটা করে ফোল্ডার বিলি করলেন প্রাইভেট সেক্রেটারি উতে কেম্পার। টেবিল থেকে ডোশিয়ে তুলে খুললেন ফন শিলার। আপনদের ফোল্ডারে হারপার নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে সংগ্রহ করা পোলারয়েড ফটোগ্রাফির কপি আছে। প্লিজ, ওগুলো দেখুন।

সবাই যে যার ফোল্ডার খুলল।

স্টাডি করার পর ড. নাহুত বলছেন ফটোগ্রাফে যে ফলকটা দেখা যাচ্ছে সেটা জেনুইন, প্রাচীন ঈজিপশিয়ান আর্টিফ্যাক্ট, প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া চলে যে সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড সতেরোশো নব্বই বি.সি.-র। আপনি নতুন আর কিছু বলতে চান, ড. নাহুত?

ধন্যবাদ, হের ফন শিলার, বলে হাসলেন নাহুত, নার্ভাস দেখাচ্ছে তাকে। জার্মান ধনকুবেরের আচরণে ঠাণ্ডা এমন কিছু আছে যা তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। ডুরেঈদ আর রোয়েনকে খুন করার নির্দেশ দেয়ার সময় ভদ্রলোকের মধ্যে এক বিন্দু উত্তেজনা বা আবেগ দেখেন নি তিনি। জানেন, তাঁকে খুন করার জন্য অন্য কাউকে নির্দেশ দেয়ার সময়ও একদম নির্লিপ্ত দেখাবে ফন শিলারকে। কোনো সন্দেহ নেই, স্বেচ্ছায় বাঘের পিঠে চড়ে বসেছেন তিনি। আমি আমার আগের কথাই রিপিট করতে চাই। এ প্রিন্টের ফলকটা জেনুইন বলেই মনে হচ্ছে। তবে নিশ্চিত হবার জন্য ফলকটা আমাকে দেখতে হবে।

সেটা যাতে আপনি দেখার সুযোগ পান তার ব্যবস্থা করার জন্যই এখানে আমরা মিলিত হয়েছি, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ফন শিলার। এখন আপনার মতামত দিন, প্লিজ। ফলকটা যদি জেনুইন হয়, কোথায় পাওয়া যাবে? মানে, কোথায় আমরা খুঁজব?

শুধু ফলকটার কথা ভাবলে চলবে না, বললেন নাহুত। কর্নেল নও যে পোলারয়েড সংগ্রহ করেছেন সেগুলোও বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। নিজের ফোল্ডার থেকে একটা ফটোগ্রাফ বেছে নিলেন তিনি। এই যেমন এটা। তার দেখাদেখি বাকি সবাই যে যার ফোল্ডার থেকে নির্দিষ্ট ওই ফটোগ্রাফটা হাতে নিল।

ফলকটার পেছনে তাকালে দেখতে পাবেন ছায়ার ভেতর একটা গুহার দেয়াল রয়েছে, আবার বলল নাহুত, ফন শিলার উৎসাহ দিয়ে হাসলেন। আরো রয়েছে বার লাগানো একটা দরজা বা প্রবেশ পথ। হতেরটা রেখে দিয়ে আরেকটা ফটো তুললেন। এবার এটা দেখুন। অন্য এক সাবজেক্টের ছবি। দেয়ালচিত্র বলল আমি, প্লাস্টার করা দেয়ালে বা কোনো গুহার মসৃণ পাথরের উপর আঁকা হয়েছে। সম্ভবত গ্রিল বা বার লাগানো দরজার ভেতর ক্যামেরা গলিয়ে এ দেয়ালচিত্রের ছবি তোলা হয়েছে। দেয়ালচিত্রে ঈজিপিশিয়ান স্টাইলের ছাপ ও প্রভাব স্পষ্ট। আপার ঈজিপ্টের কুইন লসট্রিসের সমাধিতে এ ধরনের দেয়ালচিত্র আছে, ওখান থেকে আদি টাইটা স্ক্রোল উদ্ধার করা হয়। কাজেই আমার ধারণা, ওই একই গুহা বা সমাধি থেকে এসেছে এ ফলক আর দেয়ালচিত্রের ছবি।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ালো, ছবিগুলো হারপার নিকোলাস কোত্থেকে তুলেছেন। কর্নেল নগু, এলাকটা আপনি চেনেন। মোনা যাক এ ব্যাপারে আপনার কি বলার আছে।

অনেক আলোচনার ও তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্তে আসা হলো, ছবিগুলো তোলা হয়েছে একটা কপটিক খ্রিস্টান গির্জার ভেতর থেকে। নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন কর্নেল নগু, একটা ফটোয় লাল কালির বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পসাইট থেকে মাত্র এক মাইল দূরে জায়গাটা। বৃত্তের ভেতর ওটা সেন্ট ফুমেনটিয়াসের মঠ।

ওই মঠ সার্চ করা হোক, নির্দেশ দিলেন ফন শিলার কর্নেল নগু, ওখানে আপনার লোকজন ঢুকতে পারবে?

কেন পারবে না, হের ফন শিলার? মঠের একজন সন্ন্যাসী আমার নিজের লোক। তাছাড়া, গোজাম এলাকায় এখনো মার্শল ল বলবৎ রয়েছে, কিন্তু আমি ওখানকার কমান্ডার। বিদ্রোহী বা চোর ডাকাতদের ধরার জন্য যে কোনো জায়গা আমি সার্চ করতে পারি।

ভেরি গুড, বললেন ফন শিলার। ওই ফলকটা আমি চাই। আপনি জেনে রাখুন–গুণী লোকদের পুরস্কার দিই আমি। যে কোনো সময় মি. হেলম্ কে ফোন করে খবর দিতে পারেন আপনি। আর, আমি চাই ড. নাহুত আপনার সাথে গিয়ে এলাকটা সার্চ করে দেখুক। যে কোনো রকম চিহ্ন-প্রমাণ যেনো না হারায়।

কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে তাঁকে স্যালুট করলেন কর্নেল নগু। এরপর দ্রুত বেরিয়ে গেলেন কক্ষ ছেড়ে।

*

এর সৈন্যদের মধ্যে থেকে বিশজনকে বাছাই করলেন তিনি, জানেন ধর্ম বা নৈতিকতার প্রতি তাদের কোনো মোহ নেই। ভোর হওয়ার দু ঘণ্টা আগে নিরাপদ পেগাসাস কমপাউন্ডে প্যারেড করালের তাদের, তারপর ফ্লাডলাইটের নিচে দাঁড় করিয়ে ব্রিফ করলেন। কাছেই জেট রেঞ্জার তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে, কন্ট্রোলে বসে আছে পাইলট। অস্ত্রশস্ত্র সহ এতোগুলো লোককে একবারে বহন করা সম্ভব হবে না, কাজেই ঠিক হয়েছে চারবারে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথম ফ্লাইটে নগু থাকলেন, সঙ্গে কারিফ ফারকী। মঠ থেকে তিন মাইল দূরে কপ্টার ওদেরকে নামিয়ে দিল, ডানডেরা নদীর কিনারা ঘেঁষে ফাঁকা একটা জায়গায়। এ একই জায়গায় মিলিত হয়েছিল তারা নিকোলাসের ক্যাম্পে হামলা চালাবার আগে।

ভোরের প্রথম আলোয় মঠে পৌঁছনোর প্ল্যান করেছেন কর্নেল। কনটিনজেন্ট নিয়ে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন, রাবার সোল লাগানো প্যারাট্রুপার বুট থেকে প্রায় কোনো শব্দই হচ্ছে না।

পাথুরে চাতাল বা চাতাল ফাঁকা পড়ে আছে। আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাথেড্রাল থেকে পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত প্রার্থনাসঙ্গীতের একটানা ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ ভেসে আসছে। মাঝে মধ্যে বিরতি নিচ্ছেন তাঁরা, তখন শুধু প্রধান পুরোহিতের গলা শোনা গেল। দরজাগুলোর সামনে সৈনিকদের নিয়ে থামলেন কর্নেল। কাউকে কোনো নির্দেশ দেয়ার প্রয়োজন নেই, সবাই জানে কার কি কাজ। সবার উপর একবার চোখ বুলালেন তিনি, তারপর লেফটেন্যান্টের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকালেন।

গির্জার আউটার চেম্বার খালি। সন্ন্যাসীরা জমায়েত হয়েছেন মিডল চেম্বার কিচ্চিতে। ভেতরে ঢুকে আউটার চেম্বারের ঢোকার দরজা খোলা দেখা গেল। ভেতরে ঢুকলেন তিনি, তার লোকজন দু সারিতে ভাগ হয়ে সাড়ি ওয়াল ঘেঁষে পজিশন নিল, হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল কক ও লক করা, ডগায় আটকানো বেয়নেট হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত ভক্তদের কাডার দিচ্ছে।

ব্যাপারটা নিঃশব্দে ও দ্রুত ঘটে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সন্ন্যাসীরা টের পেলেন যে তাদের পবিত্র স্থানে বৈরী একদল লোক ঢুকে পড়েছে। ঢাক-ঢোল পেটানোর আওয়াজ থেমে গেল, থেমে গেল প্রার্থনাসঙ্গীত, গাঢ় মুখগুলো পেছন ফিরে সশস্ত্র লোকজনকে দেখছে। একা শুধু প্রধান পুরোহিত ওলি জারকস সচেতন নন, চোখ বুজে নিবিষ্টচিত্তে প্রার্থনা করছেন এখনো।

নিস্তব্ধতার ভেতর এগুলেন কর্নেল নগু, হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সন্ন্যাসীদের লাথি মেরে পথ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। ওদি জারকাসের হাড়সর্বস্ব কাঁধ ধরে একটা ঝুঁকি দিলেন, তারপর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন মেঝেতে। প্রধান পুরোহিতের মাথা থেকে খসে পড়লো মুকুটটা।

সন্ন্যাসীদের দিকে ফিরে অ্যামহ্যারিক ভাষায় কর্নেল বললেন, চোর-ডাকাত আর গুণ্ডাবদমাশদের খোঁজে গোটা মঠ সার্চ করা হবে। আমার লোকজনকে কর্তব্য পালনে বাধা দিলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।

ক্রল করে তাঁর দিকে ঘুরলেন জালি হোরা, এমব্রয়ডারি করা পর্দা ধরে অনেক কষ্টে সোজা হলেন। স্পষ্ট ও কঠিন সুরে বললেন, এটা আমাদের পবিত্র স্থান। এখানে আমরা পরম পিতা, সন্তান ও পবিত্র আত্মার আরোধনা করি।

চুপ ব্যাটা! গর্জে উঠলেন কর্নেল নগু, হোলস্টার থেকে টেকারেভ পিস্তল বের করে তাক করলেন প্রধান পুরোহিতের বুকে।

হুমকিটা গ্রাহ্য না করে জালি হোরা বললেন, এখানে কোনো শুফতা নেই। আমরা সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যিশু ও পরম পিতার নামে বলছি, আপনারা চলে যান, আমাদেরকে নির্বিঘ্নে….

পিস্তলটা উল্টো করে জালি হোরার চোয়ালে প্রচণ্ড বাড়ি মারলেন কর্নেল, গালটা তরমুজের মতো ফেটে গিয়ে লাল হয়ে উঠলো। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলেন প্রধান পুরোহিত, পর্দা ধরে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গোঙাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে সন্ন্যাসীরাও।

হেসে উঠে জালি হোরার পায়ে ল্যাং মারলেন কর্নেল। মেঝেতে একটা রক্তাক্ত স্কুপে পরিণত হলেন প্রধান পুরোহিত। বুড়ো বেবুন, কোথায় তোর গড? যত জোরে পারিস ডাক, কোনো সাড়া পাবি না। হেসে উঠলেন নগু, পিস্তল নেড়ে লেফটেন্যান্টকে সংকেত দিলেন।

মিডল চেম্বরে ছয়জনকে পাহারায় রেখে মাকডাস-এর দিকে এগুলেন কর্নেল। দরজায় তালা দেওয়া দেখে লেফটেন্যান্ট সবাইকে পিছিয়ে যেতে বলে হাতের একে-ফরটিসেভেন তুলে গুলি করলো। বন্ধ জায়গার ভেতর এক পশলা গুলি বিকট আওয়াজ করলো, সেটা থামার পর শোনা গেল সন্ন্যাসীরা একযোগে বিলাপ শুরু করেছে।

কাঁধের ধাক্কায় বিশাল দরজা পুরোপুরি খুলে ফেলা হলো। ভেতরে কয়েকটা মাত্র কুপি জ্বলছে। হঠাৎ এমন কি নাস্তিকরাও এ পবিত্রতম স্থানে ঢুকতে ইতস্তত করছে। বুঝতে পেরে হাঁক ছাড়লেন কর্নেল, নাহুত! এদিকে আসুন! হের ফন শিলার আপনাকেই জিনিসটা খুঁজে বের করতে বলেছেন।

একটা ঢোক গিলে মাকডাস-এ ঢুকলেন নাহুত, টর্চ হাতে তার পেছনেই থাকলেন নও। টর্চের আলো উপহার সামগ্রী ভরা শেলফ, রঙিন কাঁচ আর মূল্যবান পাথর, তামা আর রুপো, সোনা আর দেয়ালচিত্রের উপর নাচানাচি করছে। আলোটা থামলো উঁচু সিডার কাঠের বেদির উপর, উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো এপিফানি মুকুট, পানপাত্র আর রুপালি কপটিক ক্রস।

বেদির সামনে! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো নাহুত। গ্রিল লাগানো দরজা। এখান থেকেই পোলারয়েড ছবি তোলা হয়েছে! গ্রিল ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। আলো, আলো!

কাপড় মোড়া ট্যাবট পাথরটাকে পাশ কাটিয়ে তাঁর দিকে ছুটে এলেন কর্নেল, গ্রিলের ভেতর টর্চের আলো ফেললেন।

এতোক্ষণ চিৎকার করছিলেন নাহুত, এখন গলা থেকে আওয়াজ বের হতে চাইছে না, আবেগে ফিসফিস করছেন, এগুলো প্রাচীন দেয়ালচিত্র। কোনো সন্দেহ নেই, ক্রীতদাস টাইটার কাজ! কর্নেলের দিকে তাকালেন তিনি। দরজাটা ভাঙতে বলুন!

কিন্তু প্রাচীন হলেও কাঠামোটা এখনো সাংঘাতিক মজবুত, সবাই মিলে চেষ্টা করেও নড়ানো গেল না। কর্নেলের নির্দেশে কয়েকজন ট্রুপারকে নিয়ে একজন জুনিয়ার অফিসার ছুটলো সন্ন্যাসীদের কোয়ার্টার সার্চ করতে, গ্রিলের গেট ভাঙার জন্য যন্ত্রপাতি দরকার।

ওরা চলে যেতে গ্রিল গেটের দিকে পেছন ফিরলেন কর্নেল। ফলকটার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, বলে মাকডাস-এর চারদিকে টর্চের আলো ফেললেন। কাপড় মোড়া ট্যাবট পাথরে স্থির হলো আলো। বোধহয় এটাই! রূপো আর সোনার তৈরি সুতোয় এমব্রয়ডারি করা কাপড়টা ভারী বলে মনে হলো। সেটা ধরে টান দিলেন নগু।

টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট, খোদাই করা ফলক বা পিলার, উন্মোচিত হলো। ফটোতে এ পাথরটাই দেখেছি আমরা! বিড়বিড় করলেন তিনি। হের ফন শিলার এটাই চেয়েছেন। আমরা সবাই রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেলাম!

এগিয়ে এসে ফলকটার সামনে হাঁটু গাড়লেন নাহুত, আলিঙ্গন করলেন পাথরটাকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন।

এই সময় মাকডাসে ফিরে এলো জনিয়ার অফিসার। কোথাও থেকে মরচে ধরা একটা কোদাল পেয়েছে সে, কাঠের হাতল সহ।

গ্রিল গেট ভাঙার পর সমাধির ভেতর প্রথমে ঢুকলেন নাহুত। ধুলোর ভেতর দিয়ে ছুটে এসে প্রাচীন কাঠের কফিনের সামনে হাঁটুগেড়ে বসলেন। তার পেছনে এসে টর্চের আলো ফেললেন কর্নেল কফিনের উপর।

কফিনের ভেতর যে মানুষটা শুয়ে আছেন তার ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকা হয়েছে-শুধু কফিনে পাশগুলোয় নয়, ঢাকনির উপরও। দেয়ালচিত্র আর কফিনের ছবি যে একই শিল্পীর আঁকা, সেটা স্পষ্ট।

সমাধির উপর দেয়াললিপির দিকে মুখ তুললেন নাহুত। তারপর আবার কফিনের দিকে তাকালেন। সোনালি চুলের বীরযোদ্ধার ছবির নিচে লেখাগুলো পড়লেন তিনি। ট্যানাস, লর্ড হেরাব। ভাবাবেগে কেঁপে গেল তাঁর গলা, সশব্দে ঢোক গিললেন। সপ্তম স্ক্রোলের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। ফলক আর কফিন পেয়ে গেছি আমরা। এগুলো মহামুল্যবান ট্রেজার। হের ফন শিলার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবেন।

যদি আপনার কথা সত্যি হয়, বললেন নগু। মনে রাখবেন, তা না হলে কিন্তু গর্দান হারাতে হবে। হের ফন শিলার অত্যন্ত ডেঞ্জারাস মানুষ।

ফলক আর কফিনটা মঠের বাইরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন, কর্নেল, অভয় দিয়ে হাসলেন নাহুত। এগুলো কপ্টারে তুলে পেগাসাস ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারলে বস্তা বস্তা টাকা পাবেন আপনি।

কয়েকজন লোককে লাগিয়ে দেওয়া হলো, ফলকের চারপাশ থেকে চৌকো পাথরের ভিত ভাঙার কাজ শুরু হলো। ভিত থেকে ফলকটা মুক্ত করার পর নাহুত আন্দাজ করলেন, কম করেও আধ টন ওজন হবে। সন্ন্যাসীদের করুণ আবেদনে কান না দিয়ে মিডল চেম্বার থেকে উলেন পর্দা ছিঁড়ে নিয়ে এলেন তিনি, সেই পর্দা দিয়ে কফিন আর ফলক মোড়া হলো। দশজন স্বাস্থ্যবান ট্রুপার ফলকটা বহন করবে। কফিন নিয়ে রওনা হবে তিনজন। বাকি সাতজন এসকর্ট হিসেবে থাকবে।

ফলক আর কফিন নিয়ে মিছিলটা রওনা হলো। পথ তৈরি করার জন্য বসে থাকা সন্ন্যাসী আর পুরোহিতদের লাথি মারছে ট্রুপাররা। তারপর হঠাৎ প্রায় একযোগে কপাল ও বুক চাপড়ে হায় হায় করে উঠলেন সন্ন্যাসী ও ভক্তবৃন্দ। ট্রপাররা রাইফেলের গুতো মারছে তাদেরকে, কারো কারো বাহু আর পাঁজরে। বেয়নেটের ডগাও ঢুকে গেল। চিৎকার, কান্না, প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়ছে। উপাসকরা কেউ কেউ লাফ দিয়ে সোজা হলেন, সন্ন্যাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পরস্পরকে উৎসাহ দিচ্ছেন। দেখতে দেখতে ধর্মীয় একটা উন্মাদনা দানা বেঁধে উঠলো। সবার চোখে মুখে আক্রোশ আর হিংস্রতা ফুটে উঠেছে, যেনো পবিত্র পলক আর মহামান্য সেইন্টের কফিন রক্ষা করার জন্য জান দিতেও পিছপা হবেন না তারা।

উত্তেজনা ও হৈ-চৈ তুঙ্গে উঠলো, এ সময় সরু কাঠির মতো কাঠামো নিয়ে। সোজা হলেন প্রধান পুরোহিত জালি হোরা। তাঁর দাড়ি আর আলখেল্লায় রক্ত লেগে রয়েছে, চোখ দেখে মনে হবে বদ্ধ উন্মাদ, লালচে আর নিষ্পলক। থেতলানো ঠোঁট আর চামড়া তোলা গাল থেকে অদম্য একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো, তীরবেগে ছুটলেন তিনি। রঙ করা কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে, ছুটে আসছেন কর্নেল নগুকে লক্ষ্য করে।

কর্নেল নগু গর্জে উঠলেন, আরে, পাগলটা করে কি! হাতে ধরা রাইফেলের বেয়নেট সামনে তাক করলেন। এটা কি দেখতে পাচ্ছ, হাঁদারাম?

কিন্তু জাগতিক কোনো বাধা গ্রাহ্য করার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন জালি হোরা। তিনি থামলেন না, সরাসরি ছুটে এলেন বেয়নেটের তীক্ষ্ণ ডগা লক্ষ্য করে। আলখেল্লা ভেদ করে ঘ্যাঁচ করে শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল ধারাল ফলাটা, পিঠ দিয়ে বের হলো শিরদাঁড়ার পাশে। বিদ্ধ হবার পর মোচড় খাচ্ছে শরীরটা, কাতর আওয়াজ বেরিয়ে আসছে গলা থেকে।

টান দিয়ে বেয়নেটটা বের করতে চাইছেন কর্নেল, কিন্তু পারছেন না। যতই জোর খাটাচ্ছেন ততই দোমড়ানো-মোচড়ানো পুতুলের মতো নাচানাচি করছেন জালি হোরা, হাত ছুঁড়ছেন চারদিকে, পা ছুঁড়ছেন বাতাসে। বেয়নেট মুক্ত করার একটাই উপায় আছে এখন। রেট-অব-ফায়ার-সিরেক্টর ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেল শটে নিয়ে এলেন কর্নেল, একটা মাত্র গুলি করলেন।

বেয়নেট মুক্ত হলো, মেঝেতে চলে পড়লেন জালি হোরা। পরমুহূর্তে সন্ন্যাসী আর পুরোহিতরা আক্ষরিক অর্থেই যেনো উন্মাদ হয়ে গেল। একযোগে ছুটে এলেন তারা, সশস্ত্র ট্রুপারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কেউ কেউ কালি হাতে আঁকড়ে ধরলেন বেয়নেট।

যেখানে বহু লোক ধস্তাধস্তি করছে সেখানে গুলি করা সম্ভব নয়। কাজেই প্রথমে বেয়নেট চার্জ শুরু হলো। নিরস্ত্র প্রতিপক্ষ বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। গুরুত্বর জখম নিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে অনেকে, কেউ কেউ ভিড় ঠেলে সামনে এগুতে পারছে না, বাকি সবাই দলবদ্ধভাবে হামলা করার জন্য অপেক্ষা করছে। এ সুযোগে ট্রপাররা কোমরের কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলো। আঠাশ রাউন্ডের ম্যাগাজিন, একটা শেষ হলে আরেকটা লোট করা হচ্ছে।

পিলার বা ফলকটা মেঝেতে পড়ে রয়েছে, সেটার পেছনে লুকিয়ে আছেন নাহুত। চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছেন, ভাবছেন এ সব আমার না দেখাই ভালো, শুধু শুধু রাতের ঘুম নষ্ট হবে।

সীজ ফায়ার! এক সময় নির্দেশ দিলেন কর্নেল নগু। প্রতিপক্ষের একজনও বেঁচে নেই। কার্গো তোলো। ফরওয়ার্ড মার্চ! রক্তাক্ত মেঝে আর লাশের মাঝখান দিয়ে পথ করে নিয়ে আবার এগুলো ট্রুপাররা।

আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে নাহুত। মাথার উপরের হেলিকপ্টারের শব্দ এ জন্যই পেল না।

*

ইথিওপিয়ায়, নিজ বাসভবন কোয়েনসেন হাট-এর সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হের ফন শিলার। এক পা পেছনে উতে কেম্পার। জেট রেঞ্জারের পাইলট আগেই ফোন করে জানিয়েছে গুপ্তধনের আগমনের কথা। কাজেই সবাই তৈরি, কি আছে দেখার জন্য।

একরাশ ধূলো উড়িয়ে নিচে নামলো কপ্টার। থামবার সাথে সাথেই হেলম্ লোক লাগিয়ে দিল, নাইলনের দড়ি আলগা করে বাক্স খুললো ওরা। ভিতরে নিয়ে যেতে লাগলো ওগুলো।

কনফারেন্স রুমের মাঝখানের লম্বা টেবিলটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করা হয়েছে। প্রথমে, অতি সতর্কতার সাথে রাখা হলো থামগুলো, এরপর লর্ড ট্যানাস, মিশরের সাহসী সিংহের কফিন।

হাতের ইশারায় নিজের লোকদের চলে যেতে বলে, ফন শিলারের দিকে চাইলো হেলম্। একপাশে উতেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি।

খুলবো? শিলারের মুখ দেখতে দেখতে নরম স্বরে জানতে চায় হেলম্।

সাবধানে, কর্কশস্বরে বললেন শিলার। কোনোক্ষতি যেনো না হয়।

কপালে একস্তর ঘাম জমা হয়েছে। পাশে দাঁড়ানো উতের দিকে কোনো মনোযোগ নেই শিলারের, একদৃষ্টে দেখছেন সব ট্রেজার। একটা ছুরি দিয়ে সমস্ত দড়িদড়া কেটে ফেলতে লাগলো হেলম্। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বাড়ছে ফন শিলারের। যেনো ফুসফুসের রোগী–ঘরঘর করছে বুকের ভেতর।

হ্যাঁ, ফিসফিস করে বললেন তিনি। ওমন করে, আস্তে আস্তে।

তাঁর মুখ পরখ করলো উতে কেম্পার। সবসময় নতুন কোনো সংগ্রহ এলে এমনটিই করতে দেখছে সে শিলারকে। মনে হয় যেনো, হার্টের রোগী–এখনি মারা যাবেন।

থামের উপরে প্রান্তের কাপড়টা সরিয়ে দিল হেলম্। ধূলো উড়ে এসে পড়লো শিলারের ঘামচর্চিত কপালে। খাকি বুশ জ্যাকেটের সামনেটা ভিজে গেল ধূলোমিশ্রিত ঘর্মস্রোতে। খোদাই করা হায়াগ্লিফিকে চোখ পরতে নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠে শিলার। ওদিকে উতে নিজের ভিতরেই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা টের পাচ্ছে। এমন আবেগঘন সময়ে কী করে শিলার জানা আছে তার।

এ দিকে দেখুন–হের ফন শিলার, নাহুত বলে। ডানা ভাঙা বাজপাখির একটা প্রতাঁকের উপর হাত বোলায় সে। এটা হলো দাস টাইটার স্বাক্ষর।

আসল? চরম অসুস্থ মানুষের গলায় বললেন শিলার।

একদম আসল। আমার জীবনের কসম! নাহুত বলে।

চোখ দুটো দারুণ জ্যোতিতে চকচক করছে জার্মান ধনকুবেরের।

এই থামটা আজ থেকে চার হাজার বছর আগে খোদাই করা হয়েছিল, নাহুত বলে চলে। এই হলো লিপিকারের স্বাক্ষর। দ্রুত অনুবাদ করে যেতে থাকে সে, শিয়াল-মাথা দেবতা আনুবিস তাঁর থাবায় রক্ত আর মাংসপিন্ড ধরে আছেন, ধরে আছেন হাড়, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড। বাও খেলার ঘুটির মতো সেগুলোকে নাড়াতে পারেন তিনি, আর আমার প্রতঙ্গ তাকে সহায়তা দেয়, আর আমার মাথা লম্বা খেলার ষড়

থামো! শিলার নির্দেশ দিলেন। এর জন্য পরেও সময় পাবে। এখন যাও এখান থেকে! আমাকে একা থাকতে দাও!।

অবাক হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় নাহুত। এমন সময়ে কেউ মানা করতে পারে? হেলম্ ওকে ডেকে নিতে দুইজনে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে।

হেলম! পেছন থেকে ডাকে শিলার। নিশ্চিত করো, যেনো কেউ বিরক্ত না করে।

নিশ্চই, হের শিলার। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে উতের দিকে তাকালো হেলম্।

ও থাকবে! শিলার বলেন।

লোক দু জন চলে যেতে উতে এগিয়ে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে এলো। এরপর, দরজায় পিঠ রেখে তাকালো জার্মান ধনকুবেরের চোখে।

তার উন্নত বুকজোড়া সামনে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে; দৃঢ় বৃন্তদুটো বড়ো বিন্দুর মতো। পাতলা সুতির ব্লাউজের নিচে থেকে পরিষ্কার দেখা যায়।

কসটিউম? জানতে চাইলো উতে। ওটা চাই আপনার? তার নিজের কণ্ঠস্বরও কষ্টার্জিত। এ খেলাটা সেও কম পছন্দ করে না।

হ্যাঁ, কসটিউম চাই। ফিসফিসায় শিলার।

ব্যক্তিগত দরজা গলে উতে অদৃশ্য হয়ে যেতেই নিজের কাপড় খুলতে শুরু করলো সে। পুরোপুরি নগ্ন হয়ে উতে যে দিক দিয়ে আসবে, সেদিকে ফিরে দাঁড়ালো।

হঠাৎ, দোরগোড়ায় উদয় হলো উতে। ওর রূপান্তরে শ্বাস আটকে ফেললো শিলার। বেণী করা চুলের মিশরীয় পরচুলা পরেছে উতে, তার উপর ফনা তোলা কোব্রার ইউরিয়াস মুকুট। বহু পুরনো জিনিস ওটা–পাঁচ মিলিয়ন ডয়েস মার্ক দিয়ে কিনেছে ফন শিলার।

আমি প্রাচীন মিশরের রানী, লসট্রিসের পুনর্জন্ম, নীচুস্বরে বলে চলে উতে।

আমার আত্মা অমর। আর দেহ অবিনশ্বর। রানির কবর থেকে উদ্ধার করা স্বর্ণের স্যান্ডেল উতের পায়ে। ব্রেসলেট, আংটি, কানের দুল–সবই রানি লসট্রিসের সমাধি থেকে পাওয়া। ভক পাওয়া।

হ্যাঁ, তুমি-তাই–শিলারের স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

আমি চিরকাল বাঁচবো, এমন কোনো শক্তি নেই, আমাকে বিনাশ করে।

চিরকাল–শিলার কাঁপছে আবেগে।

কোমড়ের উপরে পুরোপুরি নগ্ন উতে। সাদা, বিশাল স্তন একেবারে দুধ সাদা। দুই হাত দিয়ে ও দুটোকে মুঠোর ভেতর ধরলো সে।

চার হাজার বছর ধরে এ সম্পদ তোমার অপেক্ষায় আছে, আহ্বান জানায় উতে। নাও ওদের!

স্বর্ণের স্যান্ডল থেকে সুন্দর পা জোড়া ছাড়িয়ে আনে লসট্রিস। হলুদ স্কার্টের সামনের অংশ দুই ভাগ করা ফাঁক করে ধরে নিজের শরীরের চুম্বক অংশ দেখায়। প্রতিভাবান অভিনেত্রী উতে, তার প্রতিটি ভঙ্গি হিসেবি।

এ হলো অমরত্বের শপথ, মধু-রঙা যৌনাঙ্গের চুলের উপর একটা হাত রাখে। উতে। নাও আমাকে!

চোখ পিটপিট করে ঘাম সরায় শিলার, মৃদু শব্দে গুঙিয়ে উঠে।

ধীরে, কোমর নাচায় উতে; খুব ধীরে, যেনো প্যাঁচ খুলতে থাকা কোব্রা। ঊরুজোড়া ফাঁক করে দাঁড়ায়। দুই আঙুলে ছড়িয়ে দেয় যোনির ঠোঁট।

এ হলো অমরত্বের প্রবেশদ্বার! ঢোকো এখানে!

জোরে গুঙিয়ে উঠেন শিলার। বহুবার অভিনীত এ নাটক কখনোই তাকে হতাশ করে না। ঘোরের মধ্যে যেনো উতের দিকে এগিয়ে যায় সে। পাতলা, কাঠখোট্টা; হাজার বছরের পুরনো শুকনো মমির মতো তার দেহ। বুকের চুল রুপালী, কোমড়ের চামড়া আলগা হয়ে ঝুলে গেছে, কিন্তু যৌনাঙ্গের এবং মাথার চুল কুচকুচে কালো ফন শিলারের। বিশাল পুরুষাঙ্গ তার দেহের সাথে মেলে না। ধীরে উতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে ক্রমশ ফুলে প্রবল হয়ে উঠলো তা–অগ্রভাগের চামড়া সরে গিয়ে পথ করে দিল গোলাপি ডগাটার।

তাড়াতাড়ি, শিলার আবেদন জানালেন, ওই পাথরটার উপরে!

তার দিকে পেছন ফিরে প্রাচীন পাথরটার উপর উবু হয়ে বসলো উতে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে শিলারকে, পেছন থেকে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে সে, অসট্রিচ পাখির ডিমের মতো গোলাকার দু অংশের মাঝখান দিয়ে।

*

সারারাত ধরে কাজ করলো হেলম্ আর তার লোকজন। পেগাসাস ওয়ার্কশপে বসে সমস্ত মালামাল কাঠের বাক্সে ভরে রাখলো। সকালে ট্রাকে তুলে আদ্দিস আবাবায় পাঠানো হলো সেগুলো। তার পরামর্শে নাহুত ট্রাকের পেছনে রইলো। হের ফন শিলার রাজধানীর এয়ারপোর্টে পৌঁছল কোম্পানির হেলিকপ্টারে চড়ে, সঙ্গে রয়েছেন উতে কেম্পার। ওঁরা পৌঁছবার কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজির হলেন পুলিশ কমিশনার জেনারেল ওবেঈদ। হের ফন শিলারকে বিদায় জানাতে এসেছেন তিনি।

ত্রিশ ঘণ্টার কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে পেগাসাস ট্রাকও সময়মতোই পৌঁছল। কাঠের বাক্সগুলো যখন ফন শিলারের প্রাইভেট জেটে তোলা হচ্ছে, জেনারেল ওবেঈদ তখন ডিউটিরত কাস্টমস অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। জিওলজিক্যাল স্যামপল হিসেবে ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে,তাতে সই করে নিঃশব্দে বিদায় নিলেন অফিসার।

একুশশো ঘণ্টায় ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো জেট প্লেনটা। সিনিয়র। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন অফিসার যারা অপেক্ষা করছেন তারা সবাই হের শিলারের পুরানো বন্ধু, খবর পাওয়া মাত্র এয়ারপোর্টে চলে আসেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে জেটে বসে হুইস্কি খেলেন তারা, প্রত্যেককে একটা করে মোটাতাজা এনভেলাপ দেওয়া হলো।

বাকি রাতটুকু পাহাড়ী পথ ধরে ছুটলো ট্রাক। তেরপল দিলে ঢাকা ট্রাকটাকে অনুসরণ করছে হের শিলারের শোফার, কার্গো ট্রাক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না। ভোর পাঁচটার দিকে লোহার গেট দিয়ে দুর্গের ভেতর ঢুকলো গাড়ি। দুৰ্গটা আকারে বিশাল, পরিবেশেটাও ভৌতিক। বাটলার থেকে শুরু করে বিশাল, পরিবেশটাও ভৌতিক। বাটলার থেকে শুরু করে কর্মচারীরা সবাই মনিবের জন্য অপেক্ষা করছিল। শিলারের কালেকশন দেখাশোনা করেন হের রিপার, তিনিও স্টাফসহ উপস্থিত। বাক্স দুটো ফর্কলিফটে তোলা হলো, ভল্টে নিয়ে যাওয়া হবে।

কাঠের বাক্স খোলা হচ্ছে, দুর্গের উত্তর টাওয়ারে চলে এলেন ফন শিলার। গোসল সেরে ব্রেকফাস্ট করলেন, পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলো চাইনিজ শেফ। নাস্তা শেস করে স্ত্রীর বেডরুমে চলে এলেন তিনি। আগের চেয়ে রোগা আর নিপ্রভ লাগলো ভদ্রমহিলাকে। সব চুলই একদম সাদা হয়ে গেছে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে মোমের তৈরি। নার্সকে বিদায় করে দিয়ে স্ত্রীর কপালে চুমো খেলেন ফন শিলার। ক্যান্সার রোগ ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছে মহিলাকে, তবু ফন শিলারকে তিনি এক জোড়া পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছেন, এ কথাটা মনে রেখে এখনো স্ত্রীকে ভালোবাসেন ফন শিলার।

স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটিয়ে নিজের বেডরুমে চলে এলেন তিনি, ঘুমালেন চার ঘণ্টা। যতই ক্লান্ত হোন, এর বেশি ঘুম তার দরকার হয় না। দুপুর পর্যন্ত ব্যবসার কাগজপত্র দেখলেন তিনি। তারপর তত্ত্বাবধায়ক রিপার ইন্টারকমে জানালেন, তাঁরা সবাই তার জন্যে ভল্টে অপেক্ষা করছেন।

প্রাইভেট সেক্রেটারি কেম্পারকে সঙ্গে নিয়ে এলিভেটরে চড়লেন ফন শিলার। এলিভেটরে দরজা খোলার পর দেখা গেল হের রিপার ও নাহুত অপেক্ষা করছেন। একবার চোখ বুলাতেই ফন শিলার বুঝতে পারলেন দু জনেই উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছেন। এক্স-রে শেষ হয়েছে? আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজ ধরে ভল্টের দিকে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

জ্বী, হের ফন শিলার! হের রিপার জবাব দিলেন। বয়েসে তিনি প্রৌঢ়, আর্কিওলজি নিয়ে অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করেছেন, মুখে ফ্রেঞ্জকাট দাড়ি। টেকনিশিয়ানরা দারুণ কাজ দেখিয়েছেন। প্লেটগুলো ভারি চমৎকার হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকে নিয়মিত চাঁদা দেন ফন শিলার, কাজেই তাঁর যে কোনো অনুরোধ রাজকীয় আদেশ বলে গণ্য করা হয়। ক্লিনিকের ডিরেক্টর তাঁর সবচেয়ে আধুনিক পোর্টেবল এক্স-রে ইকুইপমেন্টসহ দু জন টেকনিশিয়ানকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে একজন সিনিয়ন রেডিওলজিস্ট। লর্ড হারাব-এর ছবি ভোলা হয়েছে। প্লেটগুলো স্টাডি করে রিপোর্ট তৈরি করেছেন রেডিওলজিস্ট।

স্টীল ভল্টের তালায় প্লাস্টিক পাস কার্ড ঢোকালেন হের রিপার, হিস হিস শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। সবার আগে ভেতরে ঢুকলেন ফন শিলার। ভেতরে ঢুকে ভল্টের চারদিকে চোখ বুলালেন তিনি। বরাবরের মতো উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে এলো তার।

ভল্টের দেয়াল দুই মিটার পুরু, ইস্পাত আর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। ভল্টটা অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে সুরক্ষিত। আরো ভেতরে চলে এলেন ফন শিলার, থামলেন মেইন ডিসপ্লে রুমে। ইউরোপের বিখ্যাত ডিজাইনার এ কামরার প্ল্যান ও ডিজাইন তৈরি করেছেন। প্রধান রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে নীল। কালেকশনে প্রতিটি আইটেম আলাদা কেসে রাখা হয়েছে।

মিডনাইট-ব্লু ভেলভেট কুশনে রাকা হয়েছে স্বর্ণালংকার আর মূল্যবান রত্ন, কামরার ভেতর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ওগুলো নেই। সুকৌশলে লুকানো স্পটলাইটের আলো এসে পড়েছে আইভরি আর অবসিডিয়ান-এর উপর। প্রাচীন দেব-দেবীর অসংখ্য মূর্তি শোভা পাচ্ছে উঁচু মঞ্চের উপর-তথ, আনুবিস, হাপি আর সেথ আছেন, আছেন ওসিরিস, আইসিস আর হোরাস।

কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট। পাশে দাঁড়িয়ে ওটার মসৃণ গায়ে হাত বুলালেন ফন শিলার, তারপর পাশের কামরায় চলে এলেন।

এখানে কাঠের জোড়া সেতুর উপর রাখা হয়েছে ট্যানাস, লড হেরাব-এর কফিন। সাদা কোট পরা একজন রেডিওলজিস্ট আলোকিত ডিসপ্লে বোর্ডে সামনে ঝুঁকে রয়েছেন, বোর্ডে আটকানো রয়েছে কয়েকটা এক্স-রে প্লেট। পাশে এসে সেগুলোর দিকে তাকালেন ফন শিলার। কাঠের কফিনে আউটলাইনের ভেতর কোঁকড়ানো মানুষের আকৃতি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, হাত দুটো বুকের উপর ভাজ করা। এই বডি সম্পর্কে আমাকে আপনার কি বলার আছে? মহিলা রেডিওলজিস্টের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ফন শিলার।

পুরুষ, বললেন মহিলা। মধ্যবয়স্ক, মৃত্যুর সময় বয়েস ছিল পঞ্চাশের উপর, তবে ষাটের নিচে। ছোটখাট আকৃতি। উপস্থিত সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। পাঁচটা দাঁত নেই….

একটানা পাঁচ মিনিট লাশের বর্ণনা দিলেন রেডিওলজিস্ট, তারপর বললেন, মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ বুক ভেদ করা জখম। জখমের জন্য দায়ী হতে পারে বল্লম বা বর্শা। অস্ত্রটা কোনাকুনি ঢোকে, বাম ফুসফুস ফুটো করে ফেলে।

আর কিছু?

হের ফন শিলার, রেডিওলজিস্ট এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বললেন, আপনার আরো অনেক মমি পরীক্ষা করেছি আমি। কিন্তু এরকম আগে কখনো দেখিনি। পেটের ভিসেরা বের করার জন্য যেভাবে পেট কাটা হয়েছে, বোঝাই যায় অত্যন্ত দক্ষ কোনো ফিজিশিয়ানের কাজ।

ধন্যবাদ, বললেন ফন শিলার, তাকালেন নাহুতের দিকে। এ পর্যায়ে কোনো মন্তব্য?

ট্যানাস, লর্ড হেরাব-এর যে বর্ণনা সপ্তম স্ক্রোলে দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে এ সব মেলে না।

কোথায় মেলে না?

ট্যানাস ছিলেন দীর্ঘদেহী। বয়েস আরো কম। কফিনের ঢাকনিতে তার ছবি দেখুন, হের ফন শিলার।

বলে যান।

এক্স-রে প্লেটের ডিসপ্লের সামনে এসে দাঁড়ালেন নাহুত, হাত তুলে গাঢ় ও নিরেট কয়েকটা দাগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। জুয়েলারি, বললেন তিনি।

কবচ। বাজুবন্ধ। বুকের আচ্ছাদন বা বর্ম। কিছু নেকলেস। আঙটি আর কানে রিঙ। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো মুকুটটা, মুকুটে বসানো গোক্ষুর সাপের ফণা। ওটা শুধু রাজপরিবারের সদস্যরা পরেন।

এ সব কিসের ইঙ্গিত দেয়? ফন শিলারকে হতভম্ব দেখালো।

এটা সাধারণ কোনো মানুষের বডি নয়, কিংবা শুধু অভিজাত কারো বডিও নয়। অলংকারের পরিমাণ খুব বেশি। আমার বিশ্বাস এটা আসলে একটা রাজকীয় মমি।

অসম্ভব, ধমক দিলেন ফন শিলার। কফিনে কি লেখা রয়েছে পড়ন। পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে এটা মিশরীয় একজন সেনাপতির মমি।

ক্ষমা করবেন, হের ফন শিলার, সবিনয়ে বললেন নাহুত। সম্ভাব্য ব্যাখ্যা একটা নিশ্চয়ই আছে। রিভার গড বইটায় আভাস দেওয়া হয়েছে টাইটা নাকি দুটো মমি অদলবদল করে-একটা ছিল ফারাও মামোসের মমি, অপরটা ছিল তার সুহৃদ ট্যানাসের।

অদলবদল করার কী কারণ ছিল? শিলারের চেহারায় অবিশ্বাস।

কুসংস্কার বা আধ্যাত্মিক কারণ থাকতে পারে, জাগতিক কোনো কারণ যদি না ও থাকে। টাইটা চেয়েছিল তার প্রিয় বন্ধু ট্যানাস ফারাও-এর গুপ্তধন মৃত্যুর পরও পাহারা দিবে এবং ব্যবহার করবে। বন্ধুর প্রতি এটা ছিল তার শেষ উপহার।

এ সব আপনি বিশ্বাস করেন?

অন্তত অবিশ্বাস করি না। এ ধারণার পক্ষে আরো যুক্তি আছে, হের ফন শিলার। এক্স-রে থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মমির তুলনায় কফিনা আকারে অনেক বেশি বড়। আমার ধারণা, আরো দীর্ঘ কোনো মানুষের জন্য কফিনটা তৈরি করা হয়েছিল। জ্বী, হের ফন শিলার, প্রচুর সম্ভাবনা আছে যে এটা একটা রাজবংশীয় মমি।

শিলারের চেহারা পশুর মতো দেখাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কথা বললেন

কর্কশ সুরে, হোয়াট! কোনো রাজার মমি?

সম্ভবত, তাই।

হ্যাঁ। কফিনের ডালায় ছবিতে স্বর্ণের ইউরিয়াস মুকুট দেখা যাচ্ছে!

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কফিনটার পাশে দাঁড়ালেন শিলার। খুলুন এটা। ফারাও মামোসের মমিটা আমাকে দেখান।

*

কাজটা অত্যন্ত কঠিন। প্রথমে নাহুতকে নিশ্চিত হতে হবে রঙের নিচে কোথায় রয়েছে ঢাকনির জয়েন্ট। সেটা জানার পরই কেবল বার্নিশ আর আঠা তোলার কাজে হাত দেওয়া যাবে। কাজগুলো শেষ করতে প্রায় সারাটা দিন লাগিয়ে দিলেন তিনি।

ঢাকনি মুক্ত হওয়ার পরও সেটা তোলা হলো না। হের ফন শিলার দুই ছেলের সঙ্গে মিটিংয়ে রয়েছেন, তাঁকে খবর পাঠানো হলো। জরুরি আলোচনা বাদ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভল্টে চলে এলেন তিনি, কুদে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কফিনের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, তুলুন এবার ঢাকনি।

ঢাকনি তোলা হলো। ভেতরে তাকালেন হের ফন শিলার। তার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠলো। ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গিতে একটা লাশকে শুয়ে থাকতে দেখবেন বলে আশা করেছিলেন, তার বদলে কফিনের ভেতরটা এলোমেলো ও আলগা লিনের ব্যান্ডেজে ভর্তি দেখতে পাচ্ছেন। এ সব কি…. মনে হলো রেগে উঠবেন, ঝুঁকে বিবর্ণ ব্যান্ডেজ ধরতে গেলেন।

না! ছোঁবেন না! বাধা দিলেন নাহুত। চিৎকার করা হয়ে গেছে, বুজতে পেরে আড়ষ্টবোধ করলেন তিনি। মাফ করবেন, হের ফন শিলার। ব্যাপারটা সত্যি বিস্ময়কর। লাশ অদলবদল হবার সম্ভাবনাটা আরো বেড়ে গেল। আপনার অনুমতি পেলে ব্যান্ডেজ খোলার আগে আরো স্টাডি করতে চাই, হের ফন শিলার।

মঞ্চ থেকে নেমে পড়লেন হের ফন শিলার। গাঢ় নীল ডাবলব্রেস্টেড জ্যাকেটের ব্রেস্ট পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন মুখের। ঠিক আছে। কিন্তু এ কি সম্ভব? সত্যি এটা ফারাও মামোসের মমি হতে পারে? আবার মুখ মুছলেন তিনি। আলগা বাধনগুলো ভোলা হোক।

তার আগে, হের ফন শিলার, ফটো তোলা দরকার।

হ্যাঁ, অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন ফন শিলার। আমরা আর্কিওলকিস্ট, বিজ্ঞানী, সাধারণ লুটেরা নই। তুলুন ছবি।

আলগা বাধনও খুব সাবধানে, একটু একটু করে তুলতে হচ্ছে। এতো বেশি সময় লাগছে যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার অবস্থা হলো শিলারের। পুরানো আলগা কাপড়ের শেষটুকু মমির গা থেকে সরিয়ে নিলেন নাহুত, সময় তখন রাত একটা। আলগা কাপড়ের পর নিখুঁতভাবে কয়েক স্তরে বাধা হয়েছে ব্যান্ডেজ, তবে সেগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারছে চকচকে সোনা।

রাজকীয় কফিনে, কফিনের ভেতর আরো কয়েকটা কফিন থাকার কথা। এখানে সে সব দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না মুখোশগুলোও। ওগুলো নিশ্চয়ই ফারাও-এর নিজস্ব কফিনে রয়ে গেছে। সেই কফিনে অবশ্যই ট্যানাসের মমি শুয়ে আছে, আবিষ্কারের অপেক্ষায়। এখানে আমরা শুধু রাজবংশীয় মমির ইনার ড্রেসিং দেখতে পাচ্ছি।

লম্বা ফরসেপ দিয়ে ব্যান্ডেজের ওপরের স্তরটা ছাড়ালেন নাহুত। ইতোমধ্যে আবার মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন হের ফন শিলার, ঝুঁকে কপিরে ভেতর তাকিয়ে আছেন।

এটা মামোস রাজপরিবারের বক্ষাবরণ বা বুকের বর্ম, রুদ্ধশ্বাসে ফিসফিস করলেন নাহুত। স্পট লাইটের নিচে অলংকারটা ঝলমল করছে। বর্মটা সোনার তৈরি, বহুমুল্য রত্নখচিত, গোটা কুব জুড়ে আছে। মাঝখানে একটা শকুনের আকৃতি, সোনার উপর, বিশাল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে, বাঁকা নখে ধরে আছে রাজপরিবারের প্রতীক চিহ্ন, সোনার তৈরি সর্পিল অলংকরণ।

আর কোনো সন্দেহ নেই, হের ফন শিলারও ফিসফিস করলেন। ঐ প্রতীক চিহ্নই লাশের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে।

এরপর ওরা রাজার হাত মুক্ত করলেন, বক্ষাবরণের উপর ভাঁজ করা ছিল। আঙুলগুলো লম্বা, প্রতিটি আঙুলে একের পর এক আঙুটি পরানো, হাতের মুঠোয় রাজদণ্ড। রাজার প্রতীক চিহ্ন। এটাই আসল প্রমাণ। কথা বলার সময় হাঁপাচ্ছেন নাহুত। উনি অষ্টম মামোস, প্রাচীন মিশরের আপার ও লোয়ার কিংডমের শাসনকর্তা। রাজার মাথার দিকে এগুলেন তিনি, এখনো সেটা ব্যানডেজে মোড়া।

না, মাথা খুলবেন সবশেষে, বাধা দিলেন ফন শিলার। ফারাও-এর মুখ দেখার জন্য এখনো আমি প্রস্তুত নই।

কাজেই রাজার শরীরের নিচের দিকটায় কাজ শুরু করলেন নাহুত আর হের রিপার। ব্যান্ডেজের প্রতিটি স্তরের নিচ থেকে বের হলো মন্ত্রঃপূত কবচ, সবই সোনার তৈরি, বহুমূল্য রত্নখচিত। আকাশ, জমি আর পানিতে এমন কোনো প্রাণী নেই যার নকশা খোদাই করা হয় নি কবচগুলোয়, সবই রঙিন। প্রতিটি কবচের ফটো তোলা হলো, তারপর কফিন থেকে তুলে রাখা হলো রুপোর ট্রেতে।

অনেক রাত হয়েছে, হের ফন শিলার, এ সময় বললেন নাহুত। আপনি যদি বিশ্রাম নিতে চান….

না!

এরপর রাজার আঙুল থেকে আঙটিগুলো ভোলা হলো এক এক করে। সবশেষে নাহুত আর হের রিপার এসে দাঁড়ালেন মাথার দু পাশে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে ফারাও-এর মুখ আর মাথা, প্রায় চার হাজার বছর পর এ প্রথম। চুল খুব পাতলা, হেনা দিয়ে রাঙানো। চামড়ায় সুগন্ধী লাক্ষার প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল, পালিশ করা অম্বরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। নাকটা বড়, টিকালো। ঠোঁট জোড়া পেছন দিকে সামান্য ঢুকে আছে, যেনো স্বপ্নের ভেতর হাসছেন। চোখের পাতায় রেজিন বা লাক্ষার প্রলেপ থাকায় অশ্রুতে ভেজা মনে হলো, পাতাগুলো আধবোজা। ফারাও তার কপালে রাজকীয় মুকুট পরে আছেন। গোক্ষুরের মাথার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এখনো নিখুঁত ও স্পষ্ট। লম্বা জিভ মাঝখানে চেরা। চোখগুলো চকচকে নীল কাঁচ। ফণার পেছনে রাজপরিবারের প্রতীক চিহ্ন।

ওই মুকুট আমার চাই, আবেগে কেঁপে গেল শিলারের কণ্ঠস্বর। তুলুন ওটা, আমার হাতে দিন।

কিন্তু তুলতে গেলে মমির ক্ষতি হতে পারে…

নাহুতকে ধমক দিলেন ফন শিলার। আবার তর্ক করেন!

এখুনি তুলছি, হের ফন শিলার, তাড়াতাড়ি বললেন নাহুত। তবে সময় লাগবে। হের ফন শিলার যদি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন, তোলার পর আমরা খবর পাঠাব…।

রেজিন মোড়া কপালের চামড়ার সঙ্গে সোনার বৃত্তটা শক্তভাবে আটকে আছে। কপাল থেকে ওটাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কফিন থেকে গোটা মমিটা তুলতে হলো প্রথমে। তোলার পর স্টেইনরেস স্টীলের স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো। বিশেষভাবে তৈরি সলভেন্টের সাহায্যে নরম করা হলো রেজিন। কাজটা শেষ করতে প্রচুর সময় লাগলো।

মুকুটটা আলাদ করে রাখা হলো নীল ভেলভেট কুশনে। ভল্টের সমস্ত আলো নিস্তেজ করে দিয়ে একটা মাত্র স্পট লাইটের আলো সরাসরি ফেলা হলো ওটার উপর। তারপর নাহুত আর হের রিপার উপরতলায় গেল ফন শিলারকে খবর দিতে।

মুকুট দেখার জন্য ভল্টে যখন আবার নামলেন ফন শিলার, সঙ্গে ওদের কাউকে রাখলেন না, ওদের বদলে পাশে থাকলেন প্রাইভেট সেক্রেটারি উতে কেম্পার। ভারী ভল্টের দরজা আটকে দিলেন জার্মান ধনকুবের।

মুকুটটা দেখামাত্র হাঁপাতে শুরু করলেন তিনি, হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস টানতে লাগলেন। এতো জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন উতের কোমড়, ব্যাথায় ঝাঁকিয়ে উঠলো মহিলা। কিন্তু এ ব্যাথাই যেনো জাগিয়ে তুললাম উতেকে। ফন শিলার সমস্ত কাপড় খুলে ফেললেন তার দেহ থেকে। সোনালী মুকুটটা পড়িয়ে দিলেন উতের মাথায়, এরপর নগ্ন শরীরে শুইয়ে দিলেন খোলা কফিনের ভেতর।

আমি জীবনের চাবিকাঠি, প্রাচীন কফিনের মধ্য থেকে ফিসফিস করে বলে উঠলো উতে। আমার মুখ অমরত্মের ছোঁয়ায় চিরউজ্জ্বল।

নগ্ন শিলার দাঁড়িয়ে রইলেন কফিনের সামনে। তার পুরুষাঙ্গ ফুলে-ফেঁপে বিশাল আকার নিল, দপ দপ করে কাঁপছে ওটা–যেনো নিজস্ব কোনো জীবন আছে তার।

নিজের শরীরে ধীরে হাত বোলাচ্ছে উতে, আঙ্গুলগুলো যখন যোনর স্পর্শকাতর অঙ্গ ছুঁলো, কেঁপে উঠে সে বলল, আপনি চিরজীবী হোন!

ফারাও মামোসের মুকুটের প্রভাব হলো অবিশ্বাস্য। আগে কোনোদিনও গুগোল্ড ফন শিলারের এমন হয় নি। উতের কথা শেষ হতে না হতেই তার পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ নিজে থেকেই উগড়ে দিল রুপালি বীজের ধারা–আঠালো তরল লেপ্টে গেল উতের সাদাটে, নরম পেটে।

ওদিকে, ভোলা কফিনে উতে কেম্পার চরম পুলকে কেঁপে কেঁপে উঠছে; পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে অসহ্য সুখে, যেনো খিচুনি ধরেছে তার।

*

রোয়েনের মনে হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ নয়, বহু বছর ধরে মিশরের বাইরে ছিল সে। শহরতলীর জ্যাম, লোকের ভিড়, বাজারের মশলা আর ধূলোর মিলিত গন্ধ, মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি–সবকিছু কতকাল ধরে যেনো শোনে নি।

প্রথম দিনে অন্ধকার থাকতেই নিজের গির্জার ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পরলো রোয়েন। নীল নদের তীর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চললো। হাঁটুটা এখনো উঠলো, লাঠি ব্যবহার করতে হচ্ছে হাঁটার জন্য। দূরের পানিতে ফেলুচ্চার তেকোণা পাল দেখে কেমন আনমনা হয়ে গেল রোয়েন। মৃদুমন্দ বাতাসে কাঁপছে নীলের জল।

ইথিওপিয়ায় যে নীল নদ দেখে এসেছে ও, তার থেকে এটা কত আলাদা। এ। যে অ্যাবি নয়–সত্যিকারের নীল নদ। অনেক চওড়া, ধীর, বাতাসে সোঁদা একটা গন্ধ–রোয়েনের অত্যন্ত প্রিয়। এটা তার নদী, তার স্বদেশ। যা করতে এখানে সে এসেছে, মনে মনে তার সপক্ষে জোর পেল রোয়েন। সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝরে গেল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হাঁটতে লাগলো ও।

ডুরেঈদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য তারা নিশ্চই খুব চিন্তায় আছে। প্রথমে ডুরেঈদের ভাই কিছুটা শীতল আচরণ করছিল ওর সাথে; পরে তার স্ত্রী যখন রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো, আর বাচ্চারে এসে জড়ো হলো তার পাশে, একটু সহজ হয়ে উঠলেন ভাইজান। বাচ্চাগুলো সবাই রোয়েনকে আম্মা বলে ডাকে। শেষমেষ, ভাইজান নিজেই ওকে মরুদ্যানে পৌঁছে দেওয়ার কথা জানালেন। কিন্তু রোয়েন বিনীত কণ্ঠে জানালো, সমাধিতে ও একা যেতে যায়। অতুক্তি না করে নিজের প্রিয় সিত্রো : গাড়িটা ধার দিতে রাজি হলেন তিনি।

ডুরেঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মরুর বাতাসে চুলগুলো সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেল রোয়েন। এ মরু দুরেঈদের জীবনভর প্রিয় ছিল। ভালোই হলো–আর কখনোই মরু থেকে দূরে থাকতে হবে না তাকে। খুব সাধাসিধে কবরের ফলকে শুধু নাম আর তারিখ লেখা। একটু নিচু হয়ে কবরের উপর থেকে শুকনো ফুল আর পাতা সরিয়ে পরিষ্কার করে দিল রোয়েন।

অনেকক্ষণ ডুরেঈদের পাশে বসে রইলো ও। কত উপভোগ্য সময়ই পার করেছে সে, এ জ্ঞানতাপসের সঙ্গে। তার নরম মনোভাব, প্রজ্ঞা, ভালোবাসা সবকিছু ভিড় করে আসছে রোয়েনের মনে। রোয়েন জানে, ডুরেঈদের মতো করে তাঁকে সে কখনোই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারে নি, কিন্তু এতে ডুরেঈদের মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না।

ও নিশ্চই বুঝেছে–কেননা আমি আজ এখানে এসেছি–রোয়েন ভাবে। বিদায় বলতে এসেছে রোয়েন। ওর জন্য তার শোক আর ভালোবাসা থাকবে, তবু তাকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন থেমে থাকে না। ডুরেঈদ, আমাকে বিদায় বলো! বহুক্ষণ পর, দৃঢ়পায়ে সমাধি ছেড়ে বেরিয়ে আসে রোয়েন, একবারো পেছনে ফিরে তাকিয়ে।

ঘুরপথে গিয়ে আগুনে পোড়া ভিলার রাস্তা এড়িয়ে গেল ও। কায়রোতে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন মুখে ওর অপেক্ষায় বসে ডুরেঈদের পরিবার। রাতে ভালো খাবারের আয়োজন আছে আজ রোয়েনের সম্মানে।

*

মূলত, মন্ত্রী আতালান আবু সিন-এর সঙ্গে দেখা করতেই কায়রো এসেছে রোয়েন, কিন্তু তিনি অফিসের কাজে প্যারিসে আছেন। তিন দিন ধরে অপেক্ষা করতে হলো তাকে। রোয়েন জানে, নাহুত গাদ্দাবি কায়রোতে নেই, তাই ওর মনে তেমন কোনো ভীতিরও উদয় হলো না। মনের সুখে প্রচুর সময়ে মিউজিয়ামে কাটালো ও। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে এখানে, তাদের সাথে আলাপ গল্পে অনেকটা সময় কাটলো।

বাকি সময় মিউজিয়ামের রিডিং রুমে বসে টাইটার স্ক্রোলের মাইক্রোফিল্মে চোখ বোলালো সে। বার বার করে পড়ে নিশ্চিত হতে চাইলো, কোনোকিছু বাদ পরেছে কি না। একটা অংশ ভালোমতো পড়ে বিষদ নোট নিল রোয়েন। এখন যখন ফারাও মামোসের সমাধি আবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারছে সে।

একটা অংশে লিপিকার টাইটা ফারাও-এর সমাধি পরিদর্শনের বর্ণনা দিয়েছে। এ অংশটা বেশ আকর্ষণ করলো রোয়েকে। বিশেষত, ফারাও-এর মৃত্যু-মুখোশের তাকে যেনো জাদু করলো। টাইটা লিখেছে, আমি নিশ্চিত, হাজার বছরেও কোনো স্বর্ণকার এমন একটি জিনিস তৈরি করে নি কখনো। অনাগত দিনগুলোর মানুষজন একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখবে এ সৃষ্টি।

একজন কপটিক খ্রিস্টান হিসেবে সরাসরি এ প্রাচীন লিপিকারের উত্তরসূরী রোয়েন। আবেগে কেঁপে উঠে সে।

কিন্তু আতালান আবু সিনের জন্য অপেক্ষার দিনগুলোতে নিকোলাস কুয়েনটন হারপারের কথা বারবারই মনে হলো তার। তার অনেক বিষয়েই বেশ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রোয়েন। অনেকগুলো কঠিন সিন্ধান্ত নিতে হবে তাকে, খুব দ্রুত।

অবশেষে, আতালান আবু সিনের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রহর চলে এলো। চুড়ান্ত সময়টাতে বিদ্রোহ করতে চাইলো রোয়েনের মন, ইচ্ছে হলো, না যায়, কিন্তু নিশিথে পাওয়া মানুষের মতোই বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে চললো ও।

এক ঘণ্টা দেরি করে মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসে পৌঁছলো রোয়েন। বেশ চনমনে মুডে আছেন আতালান। সাদা দিশদাশা আর পাগড়ী মাথায়। আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত মেলালেন রোয়েনের সাথে। লন্ডনে হলে হয়তো গালে চুমো খেতেন!

গত কয়েকদিন মিউজিয়ামে পড়ে কাটিয়েছি আমি, অনেক পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। শুনে অবাক হলাম–নাহুত নাকি ইস্তফা দিয়েছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আতালান। আমার ভাইপোটা আসলে মোটেও ধীরস্থির নয়। সে নাকি জার্মানিতে কি একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। আমি অবশ্য জোর করেছিলাম, কিন্তু–

তাহলে পরিচালক পদে কাকে নিয়োগ দিচ্ছেন এখন? এমন নিষ্পাপ কণ্ঠে জানতে চাইলো রোয়েন, যেনো কিছু সন্দেহ না হয়।

এখনো কোনো এপয়েন্টমেন্ট দিই নি, স্বীকার করলেন আতালান। নাহুত ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে ভালো কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। হতে পারে, হয়তো আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দিব। কিন্তু বিদেশী কেউ ওই পদ পেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।

সম্মানীত মন্ত্রী–আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে রাজি হলেন আতালান।

ব্যক্তিগত সেক্রেটারিকে ইশারায় বিদায় করে দিলেন তিনি।

বলুন, মাই লেডি, কি ব্যাপারে কথা বলতে চান?

এর এক ঘণ্টা পর রোয়েন বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। ওকে বিগলিত ভঙ্গিতে এগিয়ে দিলেন মন্ত্রী মহোদয়।

বিদায়ের ক্ষণে নিচু গলায় বললেন, আবার আমাদের দেখা হবে, খুব শীঘ্রই ইনশাল্লাহ!

*

হিথরো বিমান বন্দরে ইজিপশিয়ান বিমান থেকে নামলো রোয়েন। দারুণ ঠান্ডা এখানে অন্তত পনেরো ডিগ্রি কম মিশরের চেয়ে। বিষণ্ণ, কুয়াশাঘেসা সন্ধ্যায় ইয়র্কের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়লো ও। ট্রেন ইয়র্কে পৌঁছতে স্টেশন থেকে নিকোলাসের নাম্বারে ফোন করলো।

আরে, আপনি আমাকে বললেই তো এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিতাম, ভর্ৎসনার সুরে বলল নিকোলাস।

আবার নিকিকে দেখে নিজের আনন্দে অবাক হয়ে গেল রোয়েন নিজেই। রেঞ্জ রোভার থেকে নেমে, লম্বা পায়ে এগিয়ে আসছে সে। এ ক-দিনে চুল কাটে নি নিকোলাস–এলোমেলো হয়ে আছে বড়ো বড়ো চুল।

আপনার হাঁটুর খবর কি? প্রথমেই জানতে চাইলো নিকোলাস। এখনো কি পিঠে তুলে নেয়ার প্রয়োজন আছে?

প্রায় সেরে গেছে হাসতে হাসতে জবাব দিল রোয়েন। লাঠিটা এবার ফেলে দিলেই পারি। ইচ্ছে হলো, দুই হাতে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে–এতো আনন্দ হচ্ছে। বদলে, শান্ত ভাবে ঠান্ডায় লালচে হয়ে আসা গালটা বাড়িয়ে ধরে রোয়েন। চুমো খেলো নিকি। পুরুষ পুরুষ গন্ধ–সম্ভবত আফটার শেভের রোয়েনের সমগ্র অস্তিত্বে ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো।

আপনাকে দেখে দারুণ তপ্ত মনে হচ্ছে। কায়রো সফর কেমন হলো?

কায়রো সবসময়ই আমার কাছে টনিকের মতো। অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হলো। রোয়েন বলে।

বাসায় তো কোনো খাবার নেই। থেমে, সামনে কোনো পাবে খেয়ে নেবেন?

আগে মাকে দেখতে চাই। অনেক দিন দেখি না। কেমন আছেন, কে জানে।

গত পরশু গিয়েছিলাম দেখতে। ভালোই আছেন। নিকোলাস বলে। নতুন কুকুর ছানাটা বেশ মনে ধরেছে। নাম কি রেখেছে শুনবেন–টাইটা!

সত্যি, আপনি খুব দয়ালু মানুষ।

ভালোলাগে ওনাকে। চলুন, এক বোতল লাফ্রোয়েগ কিনে তাকে দেখে আসি।

মধ্যরাত হয়ে গেল জর্জিনার কটেজ ছেড়ে বের হতে। দারুণ খাওয়া-দাওয়ার পর, ওদেরকে দরজায় বিদায় জানালেন তিনি। বুকে ধরে আছেন নতুন কুকুরছানা টাইটা-কে।

আপনি আমার মা-কে খারাপ করে দিচ্ছেন! অনুযোগের সুরে রোয়েন বলে।

কে-কাকে খারাপ করছে? নিকোলাস জানতে চায়।

আমাকে উনার সাথে থাকতে দেওয়া উচিত ছিল।

এখন তো টাইটা আছে তার সাথে। আর, আপনাকে আমার এখন হাতের কাছে রাখা দরকার। মিশরে যখন ছিলেন, কাজ অনেক এগিয়ে রেখেছি।

ইয়র্ক মিনিস্টারের পেছনের ফ্ল্যাটে কুয়েনটন পার্কের হাউজকিপার কামরা প্রস্তুত করে রেখেছিল।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে রোয়েনের ব্যাগ নিয়ে করিডর ধরে এগুচ্ছে নিকোলাস, পাশের একটা কামরা থেকে নাক ডাকার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো রোয়েন। কে ওখানে?

স্যাপার ওয়েব, বলল নিকোলাস। দলের নতুন সদস্য। আমাদের নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ার। কাল আপনার সঙ্গে পরিচয় হবে। দাঁড়িয়ে পড়েছে নিকোলাস, ওর পেছনে এসে দাঁড়াতে হলো রোয়েনকেও।

আপনি কি কুয়েনটন পার্কে থাকছেন, না এখানে?

আরে না! কুয়েনটন পার্কে আমি আছি জানলে ব্যাঙ্কের লোকেদের আসার. ধুম পরে যাবে। ওদের সাথে এখন দেখা করতে চাচ্ছি না। আপনার উপরের তলার বেডরুমে আছি। কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন।

নিকোলাস চলে যেতে ছোট্ট রুমটার চারপাশে চোখ বোলালো রোয়েন। বেশ বড়ো একটা বেড, সঙ্গে ছোট্ট এটাচ বাথরুম। বিছানায় শুয়ে তার মনে হলো, নিকোলাস বলেছে প্রয়োজন হলে ডাকতে!

প্রলোভন দেখিও না! ফিসফিসালো রোয়েন, ছাতের দিকে তাকিয়ে।

অ্যাবি গিরিখাদে ফিরে গেল ও। নিকোলাসের মেদহীন একহারা কাঠামো, ঘামে ভেজা, খাড়া ট্রেইল ধরে উঠে যাচ্ছে, পিঠে ঝুলে রয়েছে ও।

রোয়েনের অস্তিত্ব তারস্বরে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে সর্বগ্রাসী এক ক্ষুধার কথা।

যথেষ্ট হয়েছে আজে-বাজে চিন্তা! নিজেকেই বকুনি দিল ও, বাথরুমে ঢুকলা শাওয়ার নিতে।

*

পরদিন সকালে দরজায় নিকোলাসের ধাক্কায় ঘুম ভাঙলো রোয়েনের।

ব্রেকফাস্ট খেতে বসে তার সঙ্গে ড্যানিয়েলের পরিচয় করিয়ে দিল ও। ড্যানিয়েলের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো, দারুণ স্বাস্থ্যবান।

হ্যালো, আমি রোয়েন আল সিমা, রোয়েন বলে।

ওহ হো, আমারই পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, ডিম পোঁচে ঘা দিয়ে নিকোলাস বলে উঠে। এ হলো ড্যানি ড্যানিয়েল ওয়েব, বন্ধুরা ডাকে স্যাপার।

রোয়েনকে সে বলল, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিস আল সিমা।

মাথা নাড়লো রোয়েন। না, আমাকে শুধু রোয়েন বলে ডাকবেন, প্লিজ। :

ব্রেকফাস্টে বসে ইথিওপিয়া বা টাইটা প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হলো না, ড্যানিয়েল আর নিকোলাস নিজেদের অতীত স্মরণ করে খানিকক্ষণ হাসাহাসি করলো। তারপর হাতে কফির কাপ নিয়ে দাঁড়ালো নিকোলাস, আসুন, রোয়েনকে বলল। আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।

ওর পিছু নিয়ে সিটিংরুমের সামনে এসে দাঁড়ালো রোয়েন আর ড্যানিয়েল। কামরাটার দরজা খুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে কুর্নিশ করলো নিকোলাস, বলল, দয়া করে ভেতরে ঢুকুন!

সেন্ট্রাল টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে জলজ্যান্ত ডোরাকাটা ডিক-ডিক, শিং সহ। আফ্রিকা থেকে আনা ছালটা কিছু দিয়ে ভরা হয়েছে, জায়গামতো বসানো হয়েছে শিং দুটো-ব্যস, তৈরি হয়ে গেছে নিখুঁত মডেল। রোয়েনের মনে হলো, এখুনি ওটা লাফ দেবে। ওহ, নিকোলাস, কি সুন্দর! ডিক-ডিককে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে ও।

মডেলটা সব কথা মনে করিয়ে দিল রোয়েনকে। গিরিখাদের ঝোঁপের ভেতর প্রচণ্ড গরম, খাদ থেকে নিচে পড়ে যাবার ভয়, ডানডেরা নদী, টাইটার পুল, পেগাসাসের হেলিকপ্টার, মঠ, সন্ন্যাসী, তামেরের মর্মান্তিক মৃত্যু, সব যেনো একসঙ্গে ভিড় করে এলো মনের কানাচে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা গ্রাস করলো ওকে। সেটা বুঝতে পেরে ওর একটা হাত ধরে টান দিল নিকোলাস, ফিরিয়ে আনলো ডাইনিং রুমে।

ডানডেরা নদীর গহ্বরে কীভাবে নামব, আসুন আলোচনা করি, বলল নিকোলাস। আপনি ছিলেন না, ড্যানিয়েল আর আমি একটা প্ল্যান তৈরি করেছি। আপনার মনে আছে তো, টাইটার পুলে ডুব দেয়ার জন্য স্কুবা ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলাম আমরা? কী কী সমস্যা আছে তা-ও বলেছিলাম।

হ্যাঁ, মনে আছে, বলল রোয়েন। আপনি বলেছিলেন অ্যান্ডারওয়াটার ফাটলের কাছে প্রেশার খুব বেশি, কাজেই অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।

হ্যাঁ। সেই অন্য পদ্ধতির কথা আমাকে জানিয়েছেন ড্যানিয়েল। বলা যায়, সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেছে।

ড্যানিয়েলের দিকে তাকালো রোয়েন। ড্যানিয়েল একবার কেশে গলা পরিষ্কার করলো, তারপর বলল, একটু আভাস দিই। মাঝে মধ্যে পুরানো পদ্ধতিই সবচেয়ে ভালো কাজ দেয়।

ওকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হচ্ছে, বুঝতে পেরে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিল রোয়েন। আপনার যদি এতোই বুদ্ধি, তাহলে বিখ্যাত নন কেন? প্রশ্নটা করার পর হঠাৎ ভুরু কোঁচাকাল। পুরানো পদ্ধতি? তার মানে টাইটা যেভাবে কাজটা করেছিল? ডাইভিং ইকুইপমেন্ট ছাড়া যেভাবে সে হ্রদের তলায় পৌঁছেছিল?

কী সাংঘাতিক! উনি তো ধরে ফেলেছেন! নিকোলাস, কে কাকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে? অসহায় দেখালো ড্যানিয়েলকে।

একবার তালি মারলো রোয়েন। বাধ! বলল ও। চার হাজার বছর আগে টাইটা যেখানে বাঁধ দিয়েছিল আপনারাও সেখানে আবার বাঁধ দিতে চাইছেন!

টেবিল ছেড়ে দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালো ড্যানিয়েল, দেয়াল ঘেঁষে খাড়া করা পর্দা ঢাকা একটা বোর্ড রয়েছে ওখানে। পর্দাটা সরালো সে উন্মোচিত হলো পিন দিয়ে আটকানো এনলার্জ করা ফটোগুলো। ডানডেরা নদীর যেখানে টাইটা বাঁধ। তৈরি করেছিল বলে ধারণা করে ওরা, নিকোলাসের তোলা সেই জায়গার ফটো রয়েছে এখানে। আর রয়েছে তামেরের দেখানো প্রাচীন পাথরখনির ফটো।

ওগুলোর উপর মার্কার পেন দিয়ে রেখা টানা হয়েছে, দূরত্বের হিসাব রেখাও হয়েছে।

নিকোলাস আমাকে এ পয়েন্টে রিভার বেড-এর ডাইমেনশন-এর হিসাব দিয়েছে, আগের প্রবাহ ফিরে পেতে হলে কতটা উঁচু করতে হবে পাঁচিল, তারও আনুমানিক একটা হিসাব আমরা বের করেছি। সঙ্গে খুব কম ইকুইপমেন্ট থাকবে, তবু কাজটা করা সম্ভব বলে মনে করি আমি।

প্রাচীন মিশরীয়রা যদি করতে পারে, আপার জন্য কাজটা পানির মতো সহজ হবার কথা, ড্যানিয়েল, মন্তব্য করলো রোয়েন।

ধন্যবাদ, রোয়েন, আড়ষ্ট হেসে বলল স্যাপার ওয়েব। তবে কাজটা সহজ নয় মোটেই। বোর্ডে আটকনো ড্রইংগুলোর দিকে তাকালো সে। বাঁধ তৈরি করার অনেক পদ্ধতি আছে, তবে আজকাল যে পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় তাতে হাতের কাছে রিউনফোর্সড কংক্রিট আর হেভি আর্থ-মুভিং ইকুইপমেন্ট দরকার। এসব আধুনিক সুবিধে আমরা পাব বলে মনে হয় না।

টাইটা তো বুলডোজারের সাহায্য ছাড়াই কাজটা করেছিল।

কিন্তু তার ছিল বিপুল লোকবল।

লোকবল কমবেশি আমরাও যোগাড় করতে পারব।

নিকোলাস বলল, বর্ষা শুরুর আগে আমাদের হাতে সময় মাত্র দু মাস। ভাবছি মঠ সন্ন্যাসীদের সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা।

তোমরা আমাকে শ্রমিক এনে দেবে, আমি তোমাদেরকে বাঁধ তৈরি করে দেব, প্রতিশ্রুতি দিল ড্যানিয়েল। আগে যেমন বলেছি, পুরানো পদ্ধতিই ভালো। প্রাচীন মিশরীয়রা মুল বাঁধের ভিত তৈরির জন্য যে কফার ড্যাম আর গ্যাবিয়ন সিস্টেম ব্যবহার করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সরি বাধা দিল রোয়েন। গ্যাবিয়ন? ইঞ্জিনিয়ারিঙে আমার কোনো ডিগ্রী নেই।

সরি বলা উচিত আমার, আড়ষ্ট হেসে বলল ড্যানিয়েল। আমার ড্রইংগুলো দেখুন, প্লিজ। বোর্ডের দিকে ফিরলো সে। এই টাইটা ভদ্রলোক সম্ভবত বাঁশ বা বেত দিয়ে বিশাল আকারের ঝুড়ি তৈরি করে সেগুলোয় পাথর ভরেছিলেন। এগুলোকে গ্যাবিয়ন বলে। বোর্ডের আঁকা নকশা দেখালো সে। তারা গ্যাবিয়নগুলোর মাঝখানে বৃত্তাকার পাঁচিল তোলার জন্য কাঠ ব্যবহার করেন। সেগুলোও তিনি পাথর আর মাটি দিয়ে ভরাট করেন।

মোটামুটি একটা ধারণা পাচ্ছি, বলল রোয়েন। তবে এতো সব খুঁটিনাটি আমার না জানলেও চলে।

তা ঠিক, বলল ড্যানিয়েল। নিকোলাস আমাকে জানিয়েছে, কাঠের কোনো অভাব হবে না। তবে বাঁশ বা বেতের বদলে ব্যবহার করব তারের জাল, গ্যাবিয়ন তৈরির কাজে।

তারের জাল? রোয়েন অবাক। অ্যাবি উপত্যকায় আপনি তারের জাল পাবেন কোত্থেকে?

কাছাকাছি একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে তৈরি হচ্ছে ওগুলো, বলল ড্যানিয়েল। অন্যান্য ইকুপিমেন্টেরও অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

পাথরখনির কথাটাও বলো, উৎসাহ যোগালো নিকোলাস।

মাথা ঝাঁকালো ড্যানিয়েল। পাথরখনির ফটো দেখেছি আমি। দেড়শোর বেশি গ্র্যান্টি ব্লক সাইজ করা আছে। তারের জাল আর টিম্বার কফার ওয়াল-এর সঙ্গে যদি এ ব্লকগুলো ব্যবহার করি, মুল বাঁধের ভিত খুব শক্ত হবে।

একেকটা ব্লক কত টন ওজন, আন্দাজ করতে পারেন? আনবেন কীভাবে? প্রশ্ন করার পর হাত তুললাম রোয়েন। থাক, বলতে হবে না। আপনি সম্ভব বললে আমি মেনে নিব।

সম্ভব, আশ্বস্ত করলো ড্যানিয়েল।

টাইটা যখন আনতে পেরেছে, আমরাও পারব, বলল নিকোলাস। তার পদ্ধতিই ব্যবহার করব আমরা। আপনার এতে খুশি হওয়ার কথা। হাজার হোক,

সে আপনার আত্মীয়।

ঠাট্টা নয়, আত্মীয়ই তো।

সমস্ত ইকুইপমেন্ট কাল থেকে লোড করার কাজ শুরু হবে, বলল নিকোলাস। আপনাকে বলা হয় নি, আমরা মাল্টায় যাচ্ছি।

মাল্টায় কেন?

কেননা, মাল্টায় জেনি বাদেনহোর্সট-এর হোম বেস।

জেনি কি?

জেনি বাদেনহোর্সট, আফ্রিকা এয়ার-এর মালিক।

কিছুই তো বুঝছি না, কে এ?

আফ্রিকা এয়ার হলো একটা এয়ার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি, জেনি আর ওর ছেলে ফ্রেড মিলে চালায়। রদ্দি কিছু হারকিউলিস বিমান আছে ওদের। মাল্টা হলো বেস। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট দেশ–কোনো আফ্রিকান পলিটিক্স নেই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার যে কোথাও যেতে হলে এটাই হলো ভালো পথ। মূলত বিভিন্ন মুসলিম দেশে ড্রাগস চোরাচালানে ব্যবহৃত হয় জেনির বিমান, তাকে তাই মধ্যপ্রাচ্যের এলো ক্যাপোনো বলতে পারেন। তিব্বতে আমি আর ডুরেঈদ এ জেনির বিমানেই গিয়েছিলাম। এবারে, ও আমাদের অ্যাবেতে নিয়ে যাবে।

ইথিওপিয়া থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে আমাদের, বলল রোয়েন।

ফিরবো কীভাবে?

খিড়কি দরজা দিয়ে। নিঃশব্দে হাসলো নিকোলাস। গেট কীপার হিসেবে থাকবে পুরানো দোস্ত মেক।

মেকের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করেছেন?

টিসের মাধ্যমে। মনে হলো, টিসেই এখন মেকের প্রাইভেট সেক্রেটারি। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে মেক, কারণ বিশাল পরিধি জুড়ে টিসের যোগাযোগ, মেকের দূত হিসেবে আফ্রিকার যে কোন শহরে যেতে পারবে ও, যেসব জায়গায় যাওয়া মেকের জন্য নিরাপদ নয়।

দেখা যাচ্ছে অনেক কাজই সেরে ফেলেছেন আপনি, বলল রোয়েন। মেক কি টাইটার ব্যাপারটা জানেন?

বিশদ জানে না। মাথা নাড়লো নিকোলাস। তবে সন্দেহ করেছে। কিছু আসে যায় না, আমি, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি।

ওদিকের আর সব খবর কী?

ফোনে কথা বলার সময় টিসেকে খুব উত্তেজিত মনে হলো, বলল নিকোলাস। পরিষ্কার কিছু বলতে পারলো না, তবে শুনেছে সেইন্ট ফুমেনটিয়াস মঠে নাকি হামলা করা হয়েছে। জালি হোরা সহ চল্লিশ জনের মতো সন্ন্যাসী হতাহত হয়েছেন। চার্চে যেসব পবিত্র পুরানিদর্শন ছিল সবই নাকি লুঠ হয়ে গেছে।

ওহ, ডিয়ার গড, ননা! স্তম্ভিত দেখালো রোয়েনকে।এ কীভাবে সম্ভব! কারা করলো?

ডুরেঈদকে যারা খুন করেছে, বলল নিকোলাস। আর আপনাকে খুন করা জন্য তিনবার চেষ্টা করেছে।

পেগাসাস।

হ্যাঁ, বলল নিকোলাস।হের ফন শিলার।

এর জন্য আমরাই দায়ী। ফিসফিস করে রোয়েন বলে। আমরাই তো ওদের পথ দেখিয়ে ওই পবিত্র স্থানে নিয়ে গেছি। নির্ঘাত আমাদের ক্যাম্প থেকে চুরি যাওয়া পোলারয়েড ছবি দেখে ওরা ট্যানাসের কফিনের সন্ধান পেয়েছে।

ওহ হো, রোয়েন। ফন শিলারের পাগলামীর জন্য নিজেদের দায়ি করার কোনো মানে হয় না। তীক্ষ্ণ স্বরে নিকোলাস বলল।

আমরাই তো এসব শুরু করেছি। রোয়েন তবু শান্ত হয় না।

মোটেও না। আমরা কাউকে মারি নি। আর ফন শিলার পুরো মাকডাস খালি করে ফেলেছে।

নিকি, আমার যে কি খারাপ লাগছে।

তার মানে কি ধরে নেবো পুরো অভিযান আপনি বাতিল করতে চান? কাটা কাটা স্বরে বলল এবারে নিকোলাস।

কিছু সময় নিয়ে ভেবে, মাথা নাড়লো রোয়েন।

না। এমনও হতে পারে, ফিরে গিয়ে টাইটার পুলের তলায় পাওয়া ধন সম্পদের মাধ্যমে কিছুটা হলেও সন্ন্যাসীদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারবো আমরা।

তাই আশা করি, স্বস্তির ভঙ্গিতে সায় দেয় নিকোলাস। আমিও তাই চাই।

*

দৈত্যাকার হারকিউলিস সি-এমকে ওয়ান চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট টারবো প্রপ প্লেন, গায়ের রঙ ধূসর খয়েরি, ফিউজিলাজের আইডেনটিফিকেশন লেটারিং ঝাপসা হয়ে গেছে। প্লেনের কোথাও আফ্রিকান স্কাই লেখা নেই। জেনি বাদেনহোর্সটের হাতে পড়ার আগে চল্লিশ বছরে পাঁচ লাখ ঘণ্টা উড়েছে ওটা।

মাল্টার ভ্যালেটা এয়ারফিল্ডের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে রোয়েন। উড়বে তো? জিজ্ঞেস করলো ও।

জেনি ইচ্ছে করেই ওটার চেহারা এরকম করুণ করে রেখেছেন, ওকে আশ্বস্ত করলো নিকোলাস।

পাইলট হিসেবে কেমন ওঁরা?

দু জনেই, মানে বাপ ও ব্যাটা, ফাস্ট-রেট অ্যারো ইঞ্জিনিয়ার। বিগ ডলির ইঞ্জিন চকচকে রেখেছে এখনো।

বিগ ডলি কী জিনিস?

ডলি পারটনের বড়ো ভক্ত আমাদের জেনি।

হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে এলেন জেনি বাদেনহোর্সট, হাতছানি দিয়ে ডাকলেন ওদের। তাঁর পিছু নিয়ে বিশাল হ্যাঁঙ্গারে ঢুকলো ওরা, থামলো ছোট একটা অফিসের সামনে, দরজায় লেখা রয়েছে আফ্রিকান স্কাই। ভেতরে সুন্দরী একটা মেয়ে বসে রয়েছে।

জেনি বাদেনহোর্সটের নতুন সেক্রেটারি, ফিসফিস করলো নিকোলাস।

ম্যাচিউর আর রক্ত-রঙা চুলের না হলে ওর আবার মনে ধরে না!

ম্যারা ওদেরকে কফি পরিবেশন করলো। জেনি বাদেনহোর্সটের সঙ্গে ফ্লাইট প্ল্যান নিয়ে কথা হলো নিকোলাসের।

জ্ঞাতি ভাই গাদ্দাফীর সঙ্গে এ মুহূর্তে আমার একটু এ কষাকষি চলছে, তাই তাঁর রাজ্য এড়িয়ে প্লেন চালাতে হবে আমাকে। মিশরের উপর দিয়ে যাব, তবে ল্যান্ড করব না। হাত তুলে ডেস্কে ছড়ানো ম্যাপগুলো দেখালেন তিনি। সুদানে আবার গৃহযুদ্ধ চলছে, তবে উত্তর দিকটায় রাডার ব্যবস্থা আধুনিক নয়, তাই ব্ল্যাঙ্ক স্পট থেকে উড়ে যাওয়া কঠিন হবে না। সামরিক স্থাপনাগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকব আমরা। ল্যান্ড করবো সীমান্তের বেশ খানিক এ দিকে।

ফ্লাইং টাইম সম্পর্কে একটা ধারণা দিন, বলল নিকোলাস।

পনেরো ঘণ্টা।

রিফুয়েলিং?

দরকার হবে না। এক্সটা ট্যাংক আছে। একাত্তর হাজার কিলো ফুয়েল নিচ্ছি। হ্যাঁঙ্গারের গেট দিয়ে বড় একটা ট্রাক ঢুকলো। ফ্রেড আর ড্যানিয়েল ফিরে এসেছে।

ট্রাকটা থামলো হ্যাঁঙ্গারের শেষ মাথায়, ওখানে ইকুইপমেন্ট ও স্টোর তূপ হয়ে রয়েছে, ললাড করার জন্য তৈরি। ট্রাক থেকে নেমে এলো ফ্রেড, নিকোলাস ও রোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। ছেলেটা বাপেরই তরুণ সংস্করণ।

এটাই শেষ ট্রাক, ট্রাকের সামনের দিকটা ঘুরে এগিয়ে এলো ড্যানিয়েল। আর কোনো কার্গো নেই। ইচ্ছে করলে এখুনি আমরা প্লেনে ওগুলো তুলে ফেলতে পারি। আমার ফ্রন্ট-এন্ড লোডিং ট্রাক্টর একদম শেষে তুলবো।

ভোর চারটের সময় রওনা হতে চাই আমরা, বলল নিকোলাস। সব কার্গো একসঙ্গে নেওয়া যাচ্ছে না, হারকিউলিসকে আরো একবার কার্গো নিয়ে যেতে হবে।

জেনি বললেন, নো প্রবলেম।

টাইটা, আসছি আমরা! রোয়েনের ফিসফিসানি একা শুধু নিকোলাস শুনতে পেল।

এমন চোরের মতো ঢোকায় একটা সুবিধা হবে–পেগাসাসের টের পেতে সময় লাগবে, নিকোলাস মন্তব্য করলো।

আপনার কথা যেনো সত্যি হয়, হাতের আঙুলগুলো এক করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল রোয়েন। পেগাসাস ধারে কাছে না থাকলে টাইটার ধাঁধা নিয়ে পূর্ণমনোনিবেশ করা সম্ভব হবে।

*

ওরা আবার ইথিওপিয়ায় ফিরে যাচ্ছে, গম্ভীর সুরে বললেন হের ফন শিলার। আচ্ছা! আপনি ঠিক জানেন, হের ফন শিলার?

নাহুতের দিকে কটমট করে তাকালেন ফন শিলার। এ মিশরীয় আর্কিওলজি এক্সপার্ট তাঁর বিরক্তি উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছেন। ভদ্রলোককে চাকরি দেওয়ায় নিজের উপর এখন তিনি অসন্তুষ্ট। নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা ঝাড়লেও, মঠ থেকে উদ্ধার করে আনা ফলকটার খোদাই অনুবাদ করতে মোটেও সফল হননি নাহুত। কেন দেরি হচ্ছে জিজ্ঞেস করায় একের পর এক খোঁড়া অজুহাত খাড়া করছেন। আপনি কি ভাবেন, প্রতিপক্ষ কি করছে না করছে আমি তার খবর রাখব না? জেনারেল ওবেঈদ ওদের উপর নজর রাখছেন, তাঁর কাছ থেকে সব খবর পাচ্ছি আমি। ইংল্যান্ড থেকে ডক্টর রোয়েন মিশরে গিয়েছিলেন…

সেক্ষেত্রে, হের ফন শিলার, তার ব্যবস্থা করেন নি কেন?

আপনি গাধা নাকি? রেগে গেলেন ফন শিলার। ব্যবস্থা করি নি, কারণ আমার ধারণা আপনি নন, ডক্টর রোয়েনই আমাকে ফারাও-এর সমাধিতে নিয়ে যাবে।

কিন্তু স্যার, আমি তো…

এখন পর্যন্ত কিছুই আপনি করেন নি, নাহুত। ফলকটা এখনো দুর্বোধ্য…

কাজটা খুব কঠিন, হের ফন শিলার।

কঠিন বলেই তো মোটা টাকা বেতন দিয়ে আনা হয়েছে আপনাকে। ওই ফলকে সত্যি যদি মামোসের সমাধিতে পৌঁছানোর সূত্র থাকে, তাহলে লেখক টাইটা সেটাকে জটিল করেই তো রাখবে।

আমাকে যদি আরো খানিক সময় দেওয়া হয়…

কি বলছি শুনতে পাচ্ছেন না? হারপার নিকোলাস অ্যাবে গিরিখাদে ফিরে যাচ্ছেন। মাল্টা থেকে একটা চার্টার করা প্লেন নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন তাঁরা, সঙ্গে সমস্ত ইকুইপমেন্ট আছে, ট্র্যাক্টের সহ। আমার কাছে এর অর্থ হলো, তারা সমাধিটা খুঁজে পেয়েছেন, ফিরে যাচ্ছেন মাটি খুঁড়ে বের করতে।

ওরা মঠে পৌঁছাক না, খতম করা কোনো ব্যাপার না, বললেন নাহুত, যেনো নিজেই আশ্বস্ত হতে চাইছেন। কর্নেল নগুকে বললেই তিনি ব্যবস্থা করবেন।

আপনি একটা উজবুক। গর্জে উঠলেন ফন শিলার। যারা আমাকে মামোসের সমাধি পাইয়ে দেবেন, আমি তাদেরকে মেরে ফেলবো? নাহুতের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। আপনাকে আমি ইথিওপিয়ায় ফেরত পাঠাচ্ছি। ওখানে কোনো কাজে এলেও আসতে পারেন।

নাহুত চুপ করে থাকলেন।

বেস ক্যাম্পে গিয়ে হেলমের অধীনে কাজ করবেন আপনি, বললেন ফন শিলার। সে আপনাকে অর্ডার করবে, আপনি তার অর্ডার মতো কাজ করবেন। হারপার নিকোলাস আল রোয়েনের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিতে যাবে না।

ওখানে তাহলে আমার কাজটা কি হবে?

অ্যাকশন নেবেন না, তবে ওদের উপর নজর রাখবেন। কিন্তু সাবধান, নজর রাখতে গিয়ে ওদেরকে আবার সতর্ক করে দেবেন না যেন। কর্নেল নগুর একজন স্পাই আছে, ওদের গতিবিধি সম্পর্কে সে কর্নেলকে রিপোর্ট করবে, আপনি কর্নেলের কাছ থেকে সে সব জেনে নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন, বুঝতে চেষ্টা করবেন হারপার নিকোলাস ঠিক কী অর্জন করতে চাইছেন।

আর আপনি? ইথিওপিয়ায় আসছেন না?

এতো প্রশ্ন করেন কেন? সময় হলেই ঠিকই আমি ওখানে পৌঁছে যাব।

ফলকটার কি হবে?

আপনি ওটার ফটো তুলে নিয়ে যান। স্যাটেলাইটে রিপোর্ট পাঠাবেন।

আমাকে কখন আপনি পাঠাতে চান?

যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। সম্ভব হলে এক্ষুনি। আমার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলুন, যান।

সেইদিনে প্রথমবারের মতো সুখী দেখালো নাহুতকে।

*

পনেরো ঘণ্টার ফ্লাইট শেষ হয়ে এলো। পূর্ব দিগন্তে ইথিওপিয়ান পাহাড়-শ্রেণীর নীলচে আভাস ফুটে উঠলো গাঢ় নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে, হাত তুলে নিকোলাস না দেখানো পর্যন্ত রোয়েনের চোখে ধরা পড়লো না। প্রায় পৌঁছে গেছি, বলল ও। চলুন, ফ্লাইট ডেকে যাই।

উইন্ডশীল্ডের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে সামনে কোথাও ল্যান্ডমার্ক দেখলো না ওরা, যতদূর দৃষ্টি যায় ধু-ধু বৃক্ষহীন প্রান্তরই শুধু চোখে পড়ে।

আমার হিসেবে দশ মিনিটে পৌঁছে যাব আমরা, বললেন জেনি। কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছেন? উত্তরে কেউ কিছু বলল না।

পাঁচ মিনিট।

ওদিকে! জেনি বাদেনহোর্সটের কাঁধের উপর দিয়ে হাত লম্বা করে দেখালো নিকোলাস। ওটাই নীলনদের কোর্স। বহু দূর সামনে ঘন কাঁটাঝোঁপ গাঢ় একটা রেখা তৈরি করেছে। সুগার মিলের চিমনিটাও দেখা যাচ্ছে। মেক বলেছে মিল থেকে তিন মাইল দূরে এয়ারস্ট্রিপটা।

কিন্তু চার্টে নেই, বললেন জেনি। কোঅর্ডিনেটস-এর পৌঁছতে আর এক মিনিট। স্টপওয়াচে ধীরে ধীরে পার হলো সময়টা।

এখনো কিছু দেখছি না, কো-পাইলটের সিট থেকে বলল ফ্রেড। তার কথা শেষ হওয়া মাত্র হারকিউলিসের নাকের সামনে দিয়ে একটা ফ্লেয়ার উঠে গেল আকাশের আরো ওপরে। ককপিটে উপস্থিত সবাই স্বস্তির হাসি হাসলো।

জেনি বাদেনহোর্সটের পিঠ চাপড়ে দিল নিকোলাস। ধন্যবাদ।

কয়েকশো ফুট ওপরে উঠলো প্লেন, ওয়ান-এইটি টার্ন নিয়ে ফিরে আসছে। প্রান্তরে এখন দুটো সিগন্যাল ফ্লেয়ার জ্বলছে-একটা কালো ধোয়া ছাড়ছে, অপরটা সাদা। মাইলখানেক দূরে থাকতে ঝোপে ঢাকা ও পরিত্যক্ত ল্যান্ডিং স্ট্রিপের অস্পষ্ট রেখা ধরা পড়লো চোখে। বিশ বছর আগে রোজিরেস এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করেছিল একটা বেসরকারি কোম্পানি। নীলনদ থেকে পানি নিয়ে আখ চাষ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু বরাবরের মতো আফ্রিকান খরা জিতে যায়, পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় নেয় কোম্পানি। সেই থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এয়ারস্ট্রিপটা। মেক নিমুর রদেভো হিসেবে এ জায়গাটা বেছে নিয়েছে।

কাউকেই তো দেখছি না, বললেন জেনি। আমাকে এখন কি করতে বলেন?

আরেকটা ফ্লেয়ার থাকার কথা… ওই তো! রানওয়ের শেষ প্রান্ত থেকে আকাশে উঠলো আরেকটা ফ্লেয়ার। হাসছে নিকোলাস। কাঁটাঝোঁপের আশপাশে এ প্রথম মানুষের নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে গা ঢাকা দিয়েছিল ওরা।

মেক, সন্দেহ নাই। আপনি ল্যান্ড করতে পারেন।

*

ওদের সামনে রানওয়েতে এখন ক্যামোফ্লেজ ফেটিগ পরা সচল মূর্তি দেখা যাচ্ছে।

প্লেন থামার পর লোডিং র‍্যাম্প নিচু করা হলো, সেটা বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে এলো মেক। নিকোলাস! আলিঙ্গন করলো নিকোলাসকে, সশব্দে চুমো খেলো দু গালে, আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে চেহারা। আমার কথাই ঠিক! শুধুই ডিক ডিক শিকার নয়, অন্য কোনো রহস্য আছে! কি?

পুরানো বন্ধুকে মিথ্যে বলি কীভাবে! কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস।

তাহলে কি ধরে নিতে পারি দু জন মিলে খুব মজা করা যাবে? জীবন এখানে বড়ই একঘেয়ে।

কথা দিচ্ছি।

একহারা দেহ সৌষ্ঠব, একটা নারীমূর্তি উঠে এলো র‍্যাম্প বেয়ে। মেয়েটার পরনে জলপাইস সবুজ ফেটিগ। কথা না বলা পর্যন্ত টিসেকে নিকোলাস চিনতেই পারলো না। ক্যানভাস প্যারা বুট আর কাপড়ের তৈরি ক্যাপ পরে আছে, দেখে মনে হবে একটা ছেলে।

নিকোলাস! রোয়েন! ওয়েলকাম চিৎকার জুড়ে দিল টিসে, হাঁপাচ্ছে। রোয়েন আর টিসে জোড়া লেগে গেল।

আরে, এরা তো দেখছি খোশগল্পে মগ্ন হয়ে পড়লো! জেনি হাসছে। আমাকে আজ রাতেই মাল্টা ফিরতে হবে। সন্ধের আগেই টেক-অফ করতে চাই।

মেকের নেতৃত্বে দ্রুত মাল খালাস করার কাজ শুরু হলো। তার লোকজন প্লেনে ঢুকে রোলারে চড়ালো ভারী বাক্সগুলো। ড্যানিয়েল অবশ্য নিজের ফ্রন্ট-এন্ড লোডার স্টার্ট দিল, বাছাই করা কিছু কার্গো নামিয়ে এনে জড়ো করলো কাঁটাঝোঁপের আড়ালে। সূর্য পাটে বসেছে, এ সময় খালি হয়ে গেল প্লেন।

ককপিটে বসে শেষ একবার আলোচনা করলো নিকোলাস ও জেনি।

আজ থেকে চারদিন পর, একমত হলেন জেনি, হ্যান্ডশেক করলেন নিকোলাসের সঙ্গে।

ভদ্রলোকেকে যেতে দাও, নিকোলাস, নিচে থেকে হাঁক ছাড়লো মেক। ভোরের আগে সীমান্ত পার হতে হবে আমাদের।

প্লেন ফিরে যাবার পর টিসেকে নিয়ে একটা ঝোঁপের সামনে বসলো রোয়েন। আবার দেখা হওয়ায় দু জনেই খুব খুশি।

তোমাদের মালপত্র পাহারা দেওয়ার জন্য পুরো একটা কমব্যাট প্লাটুন রেখে যাচ্ছি এখানে, নিকোলাসকে বলল মেক। সীমান্ত পর্যন্ত খুব ছোট একটা দল যাব আমরা। আপাতত এদিকে শত্রুপক্ষের তৎপরতা খুবই কম, কাজেই কোনো বিপদ হবারই কথা।

ইথিওপিয়ান বর্ডার কত দূরে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হবে, বলল মেক। চাঁদ ওঠার আগেই সীমান্ত পার হতে চাই। আমার দলের বাকি লোকজন অ্যাবে গিরিখাদের মুখে অপেক্ষা করছে। কাল ভোরে ওদের সঙ্গে মিলিত হব।

প্লাটুন কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একপাশে সরে গেল মেক, রোজিরেসে রেখে যাওয়া অবশিষ্ট কার্গো তার অধীনেই পাহারা বেদে গেরিলানা। তারপর ছজন লোককে ডাকলো সে, বর্ডার পার হবার সময় এসকর্ট হিসেবে থাকবে ওরা।

হঠাৎ গলা চড়িয়ে নিকোলাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মেক। ওটা উনি কোনো, বুদ্ধিতে প্লেনে করে এনেছেন, নিকোলাস? থিয়ডালাইট-এর মোটাতাজা পায়াগুলোর দিকে বিরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। বিশাল এক বাক্স খুলে প্লেন থেকে ওটা বের করে এনেছে ড্যানি স্যাপার।

ড্যানিয়েল আরবি জানে না, কাজেই অনুবাদকের ভূমিকা নিতে হলো নিকোলাসকে। ড্যানিয়েল বলছে ওটার ডেলিকেট ইট্রুমেন্ট। প্লেন থেকে ড্রপ করার ঝুঁকি নিতে রাজি হয় নি। বলছে, এটার কোনো ক্ষতি হলেও যে কাজের জন্য তাকে আনা হয়েছে সে-কাজ করতে পারবে না।

কে ওটা বহন করবে? জিজ্ঞেস করলো মেক। আমার লোকদের বললে বিদ্রোহ করবে তারা।

বুনো ভাঁড়টাকে বলো আমি নিজে এটা বহন করবো, বলল ড্যানিয়েল। তার বাঁদরগুলো এটা ছুঁলে তাদের হাত আমি ভেঙে দিব। বোঝাটা হ্যাঁচকা টানে নিজের কাঁধে তুলে নিল সে।

হারকিউলিস ফিরে যাবার আধঘণ্টা পর অন্ধকার ও নিস্তব্ধ প্রান্তর ধরে রওনা হলো ওরা, অ্যাডভান্স পাগৰ্ড পাঁচ মিনিট আগে রওনা হয়েছে। পুব দিকে যাচ্ছে ওরা। লম্বা পা পেলে দ্রুত হাটছে মেক। রোয়েন ভাবলো, নিকোলাস আর মেকের চোখ শিকারি বিড়ালের মতো সতর্ক, ওদের দুজনের ঠিক পেছনেই রয়েছে ও। অন্ধকারে কীভাবে দেখতে পাচ্ছে কে জানে, মাঝে মধ্যেই ফিসফিস করে সাবধান করে দিচ্ছে ওকে কখনো মেক, কখনো নিকোলাস-সাবধান করায় গর্ত বা পাথরের স্তূপগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারছে রোয়েন। তারপরও যখন হোঁচট খেল, সব সময় মনে হলো ওর পাশেই আছে নিকোলাস, শক্ত হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো প্রতিবার।

নিস্তব্ধতার ভেতর শৃংখলা বজায় রেখে এগুচ্ছে দলটা। প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ মিনিট করে বিশ্রাম। বিশ্রামের সময় একসঙ্গে বসছে নিকোলাস আর মেক, ওদের দু একটা কথা রোয়েনের কানে ভেসে আসছে। অ্যাবে গিরিখাদে ওদের ফিরে আসার কারণটা মেককে ব্যাখ্যা করে নিকোলাস। মামোস আর টাইটা শব্দ দুটো কয়েকবার উচ্চারণ করলো নিকোলাস। মেকের ভরাট কণ্ঠস্বর থেকে প্রশ্নবোধক আওয়াজ বের হচ্ছে। বিশ্রাম শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা।

এক পর্যায়ে সময়ের আর কোনো হিসাব থাকলো না রোয়েনের। শরীর ও এ দুটোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপ পরিশ্রম সাপেক্ষ ও কষ্টকর মনে হলো। ক্ষতটা প্রায় সেরে গেলেও, আবার ব্যথা শুরু হলো হাঁটুতে। মাঝে মধ্যে অনুভব করলো নিকোলাস ওর বাহু ধরেছে, খানা-খন্দটুকু পার করে দিচ্ছে। আবার কখনো বা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো গোটা দল, সামনে থেকে নিচু গলার সতর্ক সংকেত ভেসে এসেছে। অন্ধকারে চুপচাপ অপেক্ষা। সবাই উত্তেজিত ও নার্ভাস। তারপর আরো একটা সংকেত এলো। আবার শুরু হলো কষ্টকর পদযাত্রা। একবার নদীর গন্ধ পেল রোয়েন, ভাবল নীলনদের কাছাকাছি কোথাও রয়েছে ওরা। কেউ কোনো কথা বলে নি, তবু পুরুষদের আড়ষ্ট ভাব লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো সামনে কিছু একটা আছে। গেরিলারা কাঁধ থেকে অস্ত্র নামিয়ে বাগিয়ে ধরলো।

সামনে বর্ডার, রোয়েনের মুখের কাছাকাছি নিঃশ্বাস ফেললো নিকোলাস। উত্তেজনাটা সংক্রামক। ক্লান্তিক কথা ভুলে গেল রোয়েন। পালস রেট বেড়ে গেছে।

এক ঘণ্টা পার হলো। তবু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলো না ওরা। আরো এক ঘণ্টা পর সামনে থেকে কারো হাসির অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো। অল ক্লিয়ার, রোয়েনকে বলল নিকোলাস। ইথিওপিয়ায় ঢুকে পড়েছি আমরা। আপনার খবর কি, রোয়েন?

ভালো আছি।

ক্লান্ত আমিও। চাঁদের আলোয় হাসলো নিকোলাস। খানিক পরই ক্যাম্প ফেলা হবে।

সন্দেহ হলো মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছে নিকোলাস। পথ যেনো ফুরোবার নয়, কাজেই হাঁটারও কোনো বিরাম নেই। এক সময় কান্না পেল রোয়েনের। তারপর হঠাৎ নদীর আওয়াজ ভেসে এলো কানে। ইতোমধ্যে ভোর হয়ে এসেছে। সামনে যারা অপেক্ষা করছিল, তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল মেককে। হাত ধরে পথ থেকে রোয়েনকে সরিয়ে আনলো নিকোলাস, এক জায়গায় বসিয়ে নিজের হাতে খুলে দিল পায়ের বুট।

সত্যি আপনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে গর্ব করা চলে, রোয়েনের মোজা খোলার সময় বলল নিকোলাস, পায়ের ফোস্কাগুলো পরীক্ষা করলো। হাঁটুর ব্যান্ডেজটাও খুললো। সামান্য ফুলে আছে। নরম ছোঁয়ায় ডলে দিল নিকোলাস। পেইনকিলার দিচ্ছি, আরাম পাবেন। ব্যাগ থেকে ট্যাবলেট বের করলো ও। তারপর প্যাড লাগানো নিজের জ্যাকেটটা মাটিতে বিছালো। দুঃখিত, স্লিপিং ব্যাগ পেছনে ফেলে আসা হয়েছে। এয়ার ড্রপের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ট্যাবলেট আর পানির বোতলটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিল। সবশেষে ইমার্জেন্সী রেশনের প্যাকটা খুললো।

মুখে খানিকটা শুকনো মাংস নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন। হাতে গরম এক মগ চা নিয়ে নিকোলাস যখন ওর ঘুম ভাঙালো, তখন বিকেল যাই যাই করছে। ওঁর পাশে বসে নিকোলাসও চুমুক দিচ্ছে নিজের মগে। শুনে খুশি হবেন, মেক এখন সব কথাই জানে। আমাদেরকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে সে।

কতটুকু কী বললেন?

আগ্রহী করে তোলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। ঠোঁট টিপে হাসলো নিকোলাস। সব কথা একসঙ্গে বলা ঠিক না, প্রতিবার একটু একটু করে বলতে হয়। আমরা কি খুঁচছি, জানে। আরো জানে নদীতে একটা বাঁধ দিতে যাচ্ছি।

বাধ তৈরির জন্য লোকবল দরকার, তার কী ব্যবস্থা?

সেন্ট ফুমেনটিয়াসের সন্ন্যাসীরা তার কথা শুনবেন। ওঁরা তাকে বীরপুরুষ বা হিরো বলে মনে করেন।

বিনিময়ে নিশ্চয়ই কিছু দেয়ার কথা বলেছেন। কি?

এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয় নি। আমি বলেছি, কি পাব জানা নেই। হেসে উঠে বলল, আমাকে ও বিশ্বাস করে।

উনি খুব চালাক, তাই না?

চালাক শব্দটা যদি নিন্দার অর্থে ব্যবহার করেন, আমি একমত হব না, বিড়বিড় করলো নিকোলাস। আমি জানি সময় হলে স্পষ্ট করেই বলবে সাহায্যের বিনিময়ে কী সে চায়। হঠাৎ মুখ তুলে তাকালো ও। তোমার কথাই হচ্ছিল, মেক।

এগিয়ে এসে নিকোলাসের পাশে উবু হয়ে বসলো মেক। আমাকে নিয়ে কি ষড়যন্ত্র করছিলে তোমরা?

রোয়েন বলছেন, তোমার মধ্যে দয়া-মায়া বলে কিছু নেই, সারারাত তাকে হটিয়েছ।

নিকোলাস আসলে আপনাকে পঙ্গু বানাচ্ছে। দেখলাম তো, আপনাকে নিয়ে কী রকম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার কথা হলো, ওদের সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করতে হবে। মেয়েরা সেটা উপভোগ করে। তারপরই সিরিয়াস হয়ে উঠলো মেক। সত্যি দুঃখিত, রোয়েন। সীমান্ত মানেই হাজার রকম বিপদ। হোম গ্রাউন্ডে চলে এসেছি, এখন আর আমাকে আপনার অতোটা দানব বলে মনে হবে না।

রোয়েন বলল, ধ্যাত, আমরা তো আসলে আপনার প্রশংসা করছিলাম। সত্যি কৃতজ্ঞ বোধ করছি, মেক।

নিকোলাস আমার পুরানো বন্ধু না!

প্রসঙ্গ বদলে রোয়েন বলল, মঠে কি ঘটেছে টিসের কাছে খানিকটা শুনলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

রাগে দু হাত দিয়ে ধরে নিজের দাড়ি টানছে মেক। ওখানে যা ঘটেছে তার জন্য নগু আর তার টুপাররা দায়ি। ওরা পশুও অধম। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় আমরা কাদের বিরুদ্ধে লড়ছি। মেনজিসটুর নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলাম, তার জায়গায় নতুন একটা আতংখ ছড়িয়ে পড়লো।

ওখানে ঠিক কি ঘটেছে মেক?

ধীরে ধীরে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিল মেক, বলল কী কী লুঠ হয়েছে। ঘুমা যে দায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ন্যাসী যারা পালাতে পেরেছেন তারা সবাই তাকে চেনেন।

রাগে দাঁড়িয়ে পড়লো মেক। থরথর করে কাঁপছে সে। যে কোনো গোজামবাসীর কাছে ওই মঠ প্রাণের চেয়েও প্রিয়। আমি নিজে ধর্মকর্ম করি না, কিন্তু যারা করেন তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আছে। জালি হোরাকে আমি গুরুজন বলে মানতাম। প্রধান পুরোহিতকে খুন করে আমাকে খেপিয়ে তুলেছে ওরা। এর ফল ওদেরকে ভোগ করতে হবে। মাথায় ক্যাপ পরল সে। চলুন এবার রওনা হতে হয়। সামনের পথ অত্যন্ত দুর্গম।

*

সীমান্তে অনেকটা পেছনে ফেলে আসায় এখন দিনের বেলাও হাঁটা নিরাপদ। দ্বিতীয় দিনের পদযাত্রা ওদেরকে গিরিখাদের গভীরে পৌঁছে দিল। বড় পাহাড়ের সামনে যে ছোট পাহাড় থাকে, এখানে তেমন কিছু নেই–এ যেনো অকস্মাৎ মাথাচাড়া দেওয়া একটা বিশাল দুর্গে ঢুকে পড়া। দু দিকে পাহাড়ের স্তূপ বা গুচ্ছের পাঁচিল প্রায় চার হাজার ফুট ওপরের আকাশ ছুঁয়েছে, মাঝখানের গভীরতায় সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে নদীটা, দৈর্ঘ্যের যত দূর দেখা যায় আলোচন আর উচ্ছ্বাস, দ্রুতগতি স্রোত আর ঘূর্ণি সমস্ত পানিকে সাদা করে রেখেছে। দুপুরে নদীর ধারে ঝোঁপ আর গাছপালার নিচে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামার। অনুমতি দিল মেক। ওদের নিচে সৈকত, প্রকাণ্ড সব বোল্ডারের ছাড়াছড়ি। ওগুলো নিশ্চয়ই পাহাড়-প্রাচীরের গা বেয়ে গড়িয়ে নেমেছে।

সামান্য ব্যবধানে বসে আছে ওরা পাঁচজন। থিয়ডালাইট নিয়ে মেকের সঙ্গে ড্যানিয়েলের এ কষাকষি এখনো থামেনি। ড্যানিয়েল বেশি কথা না বলে নির্লিপ্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারী ইট্রুমেন্টার কাছাকাছি বসে আছে সে। মেক আর টিসে একদমই চুপচাপ। তবে হঠাৎ টিসে হাত লম্বা করে মেকের বাহু স্পর্শ করলো। ওদেরকে আমি জানাতে চাই, বলল সে।

উত্তর দেয়ার আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলো মেক, তারপর মাথা আঁকালো। অসুবিধে কি, বলল সে, কাঁধ ঝাঁকালো।

আমি চাই ওরা জানুক, আবার বলল টিসে। বোরিসকে ওরা চিনতেন। কাজেই বুঝবেন।

তুমি চাও আমি বলি? নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো মেক, টিসের একটা হাত ধরল।

হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকালো টিসে। তুমি বললেই ভালো হয়।

কিছুক্ষণ কথা বলল না মেক, নিজের চিন্তা-ভাবনা গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর যখন শুরু করলো, নিকোলাস রোয়েনের দিকে তাকালো না, তাকিয়ে থাকলো টিসের দিকে। এই মেয়েটার উপর প্রথম যখন আমার চোখ পড়লো, উপলব্ধি করলাম ওর আর আমার নিয়তি এক সুতোয় বাঁধা।

মেকের আরো গা ঘেঁষে বসলো টিসে।

টিসে আর আমি তিমকাত উৎসবের রাতে শপথ নিই এবং ঈশ্বরের ক্ষমা প্রার্থনা করি, তারপর আমি ওকে আমার মেয়েমানুষ হিসেবে গ্রহণ করি।

মেকের পেশীবহুল কাঁধে হাত রাখলো টিসে।

রাশিয়ান লোকটা আমাদের পিছু নিল। সে এখানটায় আমাদেরকে ধরে ফেলে, ঠিক এখন যেখানে বসে আছি। আমি তাকে আলোচনায় বসে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে বললাম। কিন্তু সে রাজি হলো না। তখন আমি বললাম, টিসে যদি স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়, আমি বাধা দিব না। সে বলল, টিসেকে চায় না, চায় ওর লাশ। তারপরই গুলি করলো সে, প্রথমে আমাকে লক্ষ্য করে, তারপর টিসেকে। কিন্তু সে জানত না, আড়াল থেকে তার উপর আমার লোকজন নজর রাখছিল।

ঘটনাটা স্মরণ করে শিউরে উঠলো টিসে।

বোরিস নিজের বোকামিতে মারা গেছে। তার লাশটা আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিই।

বোরিস যে মারা গেছে আমরা তা জানি, এ প্রথম কথা বলল রোয়েন। তারপর প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্য জিজ্ঞেস করলো, মঠে পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে আমাদের?

এখুনি রওনা হলে সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাব, বলল মেক।

*

মাই মেতাম্মা, সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের নব নির্বাচিত প্রধান পুরোহিত, মঠের চাতালে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর মাথায় রুপালি চুল, জালি হোরার চেয়ে বয়েস কিছু কম হবে, একহারা ও লম্বা। আজ তিনি বিশিষ্ট অতিথি অ্যাল্যান মেকের সম্মানে নীল মুকুটটা পরেছেন।

অতিথিদের জন্য আলাদা সেল বরাদ্দ করা হয়েছে, গোসলের পর সেখানে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল ওরা। তারপর সন্ন্যাসীরা এসে নিয়ে গেলেন ওদেরকে। খানাপিনার বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। তেজ-এর পাত্র তৃতীয়বার ভরার পর প্রধান পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের মন-মেজাজ হালকা ও নরম হয়ে উঠলো, লক্ষ্য করে মাই মেতাম্মার কানে ফিসফিস করলো মেক।

সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের ইতিহাস নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে-ঝড়-বিক্ষুব্ধ সাগর থেকে কীভাবে ঈশ্বর তাঁকে আমাদের তীরে তুলে দিলেন, তিনি যাতে আমাদের সত্যিকার ঈমানদার হতে সাহায্য করতে পারেন?

প্রধান পুরোহিতের চোখ পানিতে ভরে উঠলো। তার পবিত্র শরীর, এখানে সমাধিস্থ করা হয়, আমাদের মাকডাসে। বর্বররা এলো, আমাদের ধর্মীয় ঐশ্বর্য লুঠ করে নিয়ে গেল। আমরা পিতৃহীন বালকে পরিণত হয়েছি। এখন আর পূণ্য অর্জনের জন্য ইথিওপিয়ার প্রতিটি প্রান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা এখানে আসবে না। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। এ মঠ ধ্বংস হয়ে যাবে। সন্ন্যাসীরা চলে যাবে ঝরে পড়া পাতার মতো।

সেইন্ট ফুমেনটিয়াস যখন ইথিওপিয়ায় আসেন, একা আসেন নি। বাইজানটিয়াম চার্চ থেকে তার সঙ্গে আরো একজন খ্রিস্টান এসেছিলেন, নরম সুরে তাকে মনে করিয়ে দিল মেক।

সেইন্ট অ্যান্টোনিয়া, তেজ পাত্র থেকে আরো এক ঢোক পান করলেন প্রধান। পুরোহিত।

সেইন্ট অ্যান্টোনিয়া, সায় দিল মেক। সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের আগেই তিনি মারা যান। তবে তিনি তার ভাইয়ের চেয়ে কম পবিত্র ছিলেন না।

অবশ্যই তিনি অতি পবিত্র এবং মহান সেইন্ট ছিলেন, আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা তার প্রাপ্য, বলে আরো এক ঢোক তেজ পান করলেন মাই মেতাম্মা।

ঈশ্বরের চাল বড়ই রহস্যময়, নয় কি? সবিস্ময়ে মাথা নাড়লো মেক।

তার পথ অত্যন্ত গভীর, আমাদের বুঝতে চাওয়ার বা প্রশ্ন তোলার কোনো অধিকার নেই।

তবে তিনি করুণাময় এবং বিশ্বাসীদের পুরস্কৃত করেন। তিনি পরম করুণাময়, ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন প্রধান পুরোহিত।

আপনারা, আপনাদের মঠ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বলল মেক। সেইন্ট ফুমেনটিয়াসকে লুঠ করে নিয়ে গেছে ওরা-হায়, তা আর কোনোদিন উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিন্তু ঈশ্বর যদি আরেকজনকে পাঠান, তাহলে কেমন হয়? তিনি যদি আপনাদেরকে সেইন্ট অ্যান্টোনিয়ার শরীর পাঠিয়ে দেন, তখন আপনারা কী করবেন?–ভেজা চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, মনে হলো প্রধান পুরোহিত একটা হিসাব মেলাবার চেষ্টা করছেন। সেটা হবে সত্যিকার একটা মিরাকল।

বৃদ্ধ প্রধান পুরোহিতের কাঁধে একটা হাত রেখে নরম সুরে ফিসফিস করলো মেক, কান্না থামিয়ে গভীর মনোযোগর সঙ্গে তার কথা শুনছেন মাই মেতাম্মা।

*

শ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে, পরদিন সকালে উপত্যকার ঢাল বেয়ে ওঠার সময় নিকোলাসকে বলল মেক। মাই মেতাম্মা কথা দিয়েছেন দুদিনের মধ্যে একশো লোক যোগাড় করে দেবেন। আরো পাঁচশো দেবেন আগামী সপ্তাহ। দূর দূরান্তের খ্রিস্টান গ্রামগুলোর খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন উনি, বাঁধ তৈরির কাজে সাহায্য করলে নরকের আজাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, কারণ এ বাঁধ তৈরির মাধ্যমে উদ্ধার হবে সেইন্ট অ্যান্টোনিয়ার পবিত্র দেহাবশেষ।

দুই মেয়েই ঢালের উপর দাঁড়িয়ে পড়লো।

বেচারা বুড়ো মানুষটাকে এসব বলে লোভ দেখিয়েছ তুমি? জিজ্ঞেস করলো টিসে।

সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের বদলে অন্য একজন সেইন্টের দেহ। আমরা যদি সমাধিটা খুঁজে পাই, মঠের পাওনা হবে মামোসের মমি।

কাজটা অত্যন্ত নিচ হয়েছে, বিস্ফোরিত হলো রোয়েন। সাহায্য পাবার বিনিময়ে আপনি তাকে চিট করবেন?

কেন, চিট করা হবে কেন?

অভিযোগ শুনে রেগে গেল মেক। কোনো প্রমাণ নেই যে ওটা আসলেই সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের লাশ ছিল। অথচ তারপরও কয়েকশো বছর ধরে এলাকার খ্রিস্টানদের ঐক্যবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্য পূরণ করছিল, গোটা ইথিওপিয়ার তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করছিল, উৎসাহ দিচ্ছিল ভক্তবৃন্দকে সন্ন্যাসী হতে। এখন সেটা লুঠ হয়ে যাওয়ায় মঠের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

তাই আপনি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেবেন? রোয়েন এখনো রেগে আছে।

ওঁরা যেটা হারিয়েছেন সেটার চেয়ে কোনো অংশে মামোসের লাশ কম অথেনটিক নয়। প্রাচীন খ্রিশ্চানের লাশের বদলে প্রাচীন মিশরীয়র লাশ হলে কী আসে যায়, যদি সবগুলো উদ্দেশ্য সেটা পূরণ করতে পারে এবং আরো পাঁচশো বছর টিতে থাকতে পারে মঠটা? নিকোলাসের দিকে ফিরলো মেক। তুমি কি বলো, নিকোলাস?

ধর্মীয় ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না, বলল নিকোলাস। তবে মনে হচ্ছে মেকের কথায় খানিকটা বোধহয় যুক্তি আছে।

খ্রিশ্চানিটি সম্পর্কে আপনি আবার কবে থেকে এক্সপার্ট হলেন? আপনি তো, আমি যতদূর জানি, অজ্ঞেয়বাদী।

সত্যিই তো, ওসব সম্বন্ধে আমি আর কী জানি। আপনি বরঞ্চ মেকের সঙ্গে আলাপ করুন, বলে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাতজোড়া করে উঠে দাঁড়ালো নিকোলাস। আমি বরং স্যাপার ওয়েবের সঙ্গে বাঁধটা নিয়ে আলোচনা করি। হন হন করে এগিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের পাশে চলে এলো, লাইনের একেবারে মাথায়।

পেছন থেকে মাঝে মধ্যেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। নিকোলাসের কানে। আপনমনে হাসলো ও। মেককে ওর চেনা আছে, নতুন করে চেনা হচ্ছে রোয়েনকে। ওদের মধ্যে কে জেতে দেখার খুব আগ্রহ জাগলো।

*

মাঝ দুপুরে গহ্বরের মাথায় পৌঁছল ওরা। ক্যাম্প ফেলার জন্য জায়গা খুঁজছে মেক, মারটনকে নিয়ে নদীর সরু গলায় চলে এলো নিকোলাস, ঠিক নদী যেখানে জলপ্রপাতে পরিণত হয়ে নিচে লাফ দিয়েছে, তার ওপরে। থিয়ডালাইট সেট করার পর হাত ইশারায় নিকোলাসকে লেভেলিং স্টাফ নিয়ে পাহাড়-প্রাচীরে ওঠা নামা করতে বলল ড্যানিয়েল, সারাক্ষণ থিয়ডালাইটের লেন্সে চোখ। ওঠা নামা করার সময় লেভেলিং স্টাফটা খাড়া রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে নিকোলাস।

ঠিক আছে, হাঁক ছাড়লো ড্যানিয়েল, বিশটা শট নেয়ার পর। এবার তুমি নদীর ওপারে চলে যাও।

কী বলে! কীভাবে যাব? সাঁতরে, নাকি উড়ে?

উজানের দিকে তিন মাইল হাঁটতে হলো নিকোলাসকে, ট্রেইরটা যেখানে অগভীর ডানডেরা নদীর উপর দিয়ে ওপারে পৌঁছেছে। ওপারে পৌঁছে কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে হলো ওকে, থামলো অপর পাড়ে বসে যেখানে ড্যানিয়েল সিগারেট ফুকছে। ফুসফুসে ক্যান্সার বাধিয়ো না, কেমন? পানির এদিক থেকে চিৎকার করে বলল নিকোলাস।

প্রয়োজনীয় শট নিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফেরার জন্য আবার নদীর অগভীর অংশটুকু পার হতে হলো নিকোলাসকে। শেষ এক মাইল প্রায় গাঢ় অন্ধকারে হাঁটতে হলো ওকে, তবে পথ দেখালো ক্যাম্পসাইটের কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট আলো। ক্যাম্পে পৌঁছে লেভেলিং স্টাফটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এতো খাটালে, ফলটা ফেলে দিল?

স্লাইড রুল থেকে চোখ তুললাম না ড্যানিয়েল। লণ্ঠনের আলোয় ড্রইংগুলো স্টাডি করছে সে, কিছু রদবদলও করছে। তোমার আনুমানিক হিসাব প্রায় নির্ভুলই বলতে হবে, এক সময় মুখ তুলে বলল সে। জলপ্রপাতের উপর ক্রিটিক্যাল পয়েন্টে নদীটা একচল্লিশ গজ চওড়া, যেখানে আমি স্ট্রাকচারটা খাড়া করতে চাই।

আমি শুধু জানতে চাই ওখানে একটা বাঁধ তৈরি করা সম্ভব কিনা।

নাকের পাশে আঙুল ঘষলো ড্যানিয়েল, হাসছে। তুমি আমাকে আমার লাল ফ্রন্ট-এন্ডার এনে দাও, আমি নীলনদকেও বাঁধতে পারব।

*

রাত একটু বেশি হতে আগুনের ধারে বসে সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া সারলো। ক্যাম্পফায়ারের দিক থেকে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন, চোখাচোখি হতে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। কয়েক সেকেন্ড পর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাম্প এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, একবার পেছন ফিরে দেখে নিল নিকোলাস ওকে অনুসরণ করছে কিনা। পাশে চলে এসে টর্চ জালল নিকোলাস, দু জন ফিরে এলো আবার ড্যাম সাইটে, বসলো একটা বোন্ডারের উপর।

টর্চ নিভিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকলো ওরা, চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে তারার আলোয় এখন অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। নিস্তব্ধতা ভাঙলো রোয়েন, খুব নিচু গলায় কথা বলছে, গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে, জানেন। ভেবেছিলাম আর বোধহয় কোনোদিন এখানে আমাদের ফিরে আসা হবে না।

মেক আর প্রধান পুরোহিত সাহায্য না করলে ব্যাপারটা সম্ভব হত না।

মেক আর আপনিই জিতলেন, ক্ষীণ হাসির শব্দ রোয়েনের গলায়। হ্যাঁ, সন্ন্যাসীদের সাহায্য আমাদের দরকার। স্বীকার করছি, মেকের সঙ্গে তর্কে পারা সম্ভব নয়।

তার মানে পুরস্কার হিসেবে ওদেরকে মামোসের মমি দিতে আপনার কোনো আপত্তি নেই?

যে মমিই পাই, আদৌ যদি পাই, বলল রোয়েন। আমরা যতো দূর জানি, আসল মামোসের মমিটা চুরি করে নিয়ে গেছেন কর্নেল নগু।

খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রোয়েনের কাঁধটা এক হাতে জড়িয়ে ধরলো নিকোলাস। কিন্তু রোয়েন ব্যাপারটাকে ঠিক সহজভাবে নিল না। আড়ষ্ট হয়ে গেল শরীর। তবে কিছু বলল না, হাতটাও সরিয়ে দিল না, খানিক পর বরং একটু পর ঢিল পড়লো পেশীতে।

ওহ, নিকোলাস, আমার যেমন ভয় লাগছে তেমনি উত্তেজিত হয়ে আছি। ভয় লাগছে এ ভেবে যে আমাদের আশা হয়তো পূরণ হবে না। আর উত্তেজিত হয়ে আছি এ আশায় যে টাইটার সঙ্গে খেলাটায় আমরাই জিতব। মুখ ফেরালে ওর নিঃশ্বাস অনুভব করলো নিকোলাস নিজের ঠোঁটে।

রোয়েনকে চুমো খেলো ও, আলতোভাবে, ফুলের স্পর্শের মতো আলতো। এরপর, ধীরে ঠোঁট সরিয়ে পরখ করে দেখলো মেয়েটার মুখ। সরে যাবার কোনো চেষ্টা নেই রোয়েনের অবয়বে, বরঞ্চ একটু এগিয়ে পাল্টা চুমো খেলো ও, নিকিকে। প্রথম চুমোটা হলো স্নেহ-পরবশ–বোনসুলভ, রোয়েনের দু ঠোঁটের পাঁচিল শক্ত করে সেঁটে আছে পরস্পর। এক হাত উপরে নিয়ে এসে তার মাথার পেছনের চুলে ধরলো নিকি, ধরে রাখলো রোয়েনের মুখ, ওর সামনে। প্রবল, সর্বগ্রাসী চুমো খেলো এবারে–রোয়েনের বদ্ধ ঠোঁটের উপর চেপে বসলো ওর ঠোঁট জোড়া।

ধীরে, সুস্বাদু কোনো চকোলেটের মতোই রোয়েনের ঠোঁটজোড়ার বাঁধন আলগা করে ক্রমশই ভেতরে ঢুকে পড়ছে নিকোলাস, জিভ দিয়ে পরখ করছে যেনো মিষ্টি স্বাদ। নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠলো মেয়েটা, ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো নিকোলাসকে। দু হাতে আঁকড়ে ধরে রইলো নিকির শরীর, দারুণ সাড়া দিচ্ছে ওর চুমোর। দুটো জিভ এখন পরস্পরের সান্নিধ্যে।

জোড়া দেহের মাঝখানে চোরের মতো উঠে এলো নিকোলাসের এক হাত; ধীরে ধীরে খুলে ফেলছে রোয়েনের শার্টের সামনের বোতামগুলো একদম কোমড়ের বেল্ট পর্যন্ত। ওর আলিঙ্গনে একটু সরে বসে কাজটা সহজ করে দিল রোয়েন। পাতলা, সুতির শার্টের নিচে তার উদ্ধত বুকজোড়া একেবারে নগ্ন বিষয়টা অদ্ভুত সুখ এনে দিল নিকোলাসকে। এক হাতে ও দুটোর একটাকে ধরলো ও, ছোট্ট, কিন্তু দৃঢ়, ওর মুঠো পুরোটা ভরলো কেবল। দুই আঙুলে অনুভব করে দেখলো সে বৃন্তটা; পাকা ছোট্ট স্ট্রবেরির মতো দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটা।

চুমো ভেঙে, মুখটা রোয়েনের নরম বুকে ডুবিয়ে দিল নিকোলাস। নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠে ওকে যেনো স্বাগত জানাচ্ছে মেয়েটা। একটা বৃন্তে নিকোলাসের ঠোঁটের স্পর্শে পরম সুখে শ্বাস আটকে আসতে চাইলো রোয়েনের, ওর আঙুলের লম্বা নখগুলো ডেবে গেছে দয়িতের পিঠের গভীরে। পুরুষসঙ্গীর দৃঢ় আলিঙ্গনের ভেতর নিজে থেকে আগুপিছু দুলছে রোয়েন; কিন্তু একটু পরই, ঠোঁট সরিয়ে নিল সে। নিকোলাস ভাবলো, ও হয়তো আমাকে প্রত্যাখ্যান করছে। পরমুহূর্তেই নিকোলাসের চুল খামচে ধরে আরেকটা বুক বাড়িয়ে ধরলো সে, ওর ঠোঁটের সামনে। এবারেও, নিকোলাসের তৃষ্ণার্ত টানার সময় কেঁপে কেঁপে উঠলো তার শরীর।

ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে উঠছে রোয়েনের নড়াচড়াগুলো। আর অপেক্ষা করতে পারছে না নিকোলাস–এক হাত রোয়েনের খাকি স্কার্টের নিচে দিয়ে নরম পাপড়ির উপর রাখল ও। হঠাৎই, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো রোয়েন। দ্রুত হাতে স্কার্ট সমান করে, লাগিয়ে ফেললো শার্টের বোতাম।

আমি আমি খুব দুঃখিত, নিকি! আমি সত্যি চাই অনেক বেশি করে চাই-কিন্তু বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বুকের আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। কিন্তু এখন না! এখনই না! দুটা দুনিয়ার মধ্যে পরে গেছি আমি, নিকি! আমায় ক্ষমা করো! একটা অংশ তোমাকে চায় ওহ, খুব করে চায় কিন্তু আমার অন্য অংশটা যে বাধা দেয়!

উঠে দাঁড়িয়ে, কেতাদুরস্ত চুমো খেল নিকোলাস। তাড়াহুঁড়োর কিছু নেই, হুঁ? সবুরে যেনো কী ফলে? এখন চলুন, আপনাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাই!

*

পরদিন ভোরে আলো ভালো করে ফোঁটার আগেই মাই মেতাম্মার প্রতিশ্রুতি অনুসারে সন্ন্যাসীদের প্রথম দলটা উপত্যকা বেয়ে উঠে এলো। এক লাইনের একটা মিছিল, সন্ন্যাসীরা সবাই তরুণ, সবার পরনে সাদা আলখেল্লা, সুর করে গান করতে করতে আসছে।

কী সর্বনাশ! অকারণে হাসি পাচ্ছে নিকোলাসের। আবার না ক্রুসেড বেঁধে যায়।

ডাকাডাকি করে টিসেকে খুঁজলো নিকোলাস, সে কাছে আসার পর বলল, অনুবাদক হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হলো তোমাকে। ড্যানিয়েল অ্যামহ্যারিক বা আরবীর একটা বর্ণও জানে না, কাজেই ওর কাছাকাছি থাকতে হবে তোমাকে।

ঠিক আছে, নিকি।

দিনের আলো আরো উজ্জ্বল হতে মেককে নিয়ে ড্রপ সাইট দেখতে বের হলো নিকোলাস। দুপুরের দিকে সিদ্ধান্তে এলো, উপত্যকাটাই ব্যবহার করতে হবে। ওদেরকে ঘিরে পাথুরে যে রিজগুলো দাঁড়িয়ে আছে তার তুলনায় উপত্যকার মেঝেই বেশি সমতল, বাধা-বিঘ্নও কম। তাছাড়া, প্লেন থেকে জিনিসগুলো ফেলা দরকার বাঁধ এলাকার যতোটা সম্ভম কাছাকাছি।

পরদিন সকালে নির্বাচিত সাইটে দাঁড়িয়ে মেককে নিকোলাস বলল, টাইম একটা মেজর ফ্যাক্টর। প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে বর্ষা।

আকাশের দিকে তাকালো মেক। সন্ন্যাসীদের ধরলে ওরা দেরিতে বর্ষা শুরু করার জন্য প্রার্থনায় বসবে।

ড্রপ শুরু করার আগে প্লেন নিয়ে পাঁচ মাইল সোজা এগিয়ে আসার মতো উন্মুক্ত আকাশ পাবেন জেনি। ফ্লেয়ার আর মার্কার গতকালই কিছু কিছু বসানো হয়েছে, আজ সেগুলো চেক করলো ওরা। উপত্যকার মাথায় রয়েছে ড্যানিয়েল, আকাশের গায়ে তার নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে স্মোক ফ্লেয়ার সেট করছে সে। ঘাড় ফিরিয়ে উল্টো দিকে তাকালো নিকোলাস, উপত্যকার দূর প্রান্তে একটা পাথরের উপর বসে রয়েছে ড্যানিয়েল। মেকের লোকজন এখনো মার্কার বসানোর কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারে নি, তবে জানিয়েছে আর বেশি সময় নিবে না।

সব কিছু সুষ্ঠুভাবেই ঘটলো। ঘড়ির কাঁটা ধরে উড়ে এলো জেনি বাদেনহোর্সটের প্রকাণ্ড হারকিউলিস। মোট ছয় বার উপত্যকার উপর দিয়ে উড়ে গেলেন তিনি, প্রতিবার চারটে করে ভারী ও চৌকো বাক্স ফেললেন নিচে। বাতাসে ভর করে প্যারাস্যুটগুলো উপত্যকার নানাদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আগেই নির্দেশ দেওয়া আছে, দল বেঁধে ছুটলো তরুণ সন্ন্যাসীরা, বাক্সগুলো ধরা ধরি করে তুলে আনবে। নিকোলাস, মেক আর মানটিন আলোচনা করে আগেই ঠিক করে রেখেছে ক্যাম্পের কোথায় কী রাখা হবে। প্রতিটি বাক্সে নম্বর দেওয়া আছে, নম্বর দেখে বোঝা যাবে কোনটায় কী আছে। এক নম্বর বাক্সে আছে শুকনো খাবার, ওদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট, মশারিসহ; মেককে খুশি করার জন্যে কয়েক বোতল হুইস্কিও আনা হয়েছে। এ বাক্সটার দায়িত্বে নিকোলাস নিজে থাকলো।

নির্মাণ সামগ্রী আর হেভি ইকুইপমেন্টের দায়িত্ব থাকলো ড্যানিয়েলের উপর। তার নির্দেশ অনুবাদ করছে টিসে, সন্ন্যাসীরা বাক্সটা বয়ে নিচে যাচ্ছে প্রাচীন পাথরখনিতে।

রাত হয়ে গেল, অথচ অর্ধেক বাক্সও উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি, যেখানে পড়েছে সেখানেই পড়ে থাকলো। সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করলো মেক, কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে।

পরদিন আবার হারকিউলিস নিয়ে ফিরে এলেন জেনি। এবার তিনি রোজিরেস থেকে কার্গো তুলে এনেছেন। সব বাক্স উপত্যকা থেকে তুলে আনতে আরো দুটো দিন লেগে গেল। প্রায় সবই জমা করা হলো প্রাচীন পাথরখনিতে, বাক্স খোলর পর জিনিসগুলো এমনভাবে সাজানো হলো যাতে যেটা যখন দরকার চাইলেই পাওয়া যাবে।

এ কয় দিন কাজ করার সময় সন্ন্যাসীদের উপর নজর ছিল নিকোলাসের, কয়েকজনের পরিচয় আলাদাভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। এদের মধ্যে কারো কারো রয়েছে নেতৃত্ব দেয়ার গুণ। দু একজন আরবি ও অল্পস্বল্প ইংরেজি জানে। তাদের মধ্যে একজন হানশিত শেরিফ। নিকোলাস তাকে সহকারি হিসেবে বেছে নিল, দোভাষীর কাজও চালানো যাবে।

ক্যাম্প গুছিয়ে নেয়ার পর কাজ ভাগাভাগির পালা। রোয়েন আর টিসের কাছ থেকে নিকোলাসকে দূরে সরিয়ে এনে মেক বলল, এখন থেকে আমার কাজ হবে সাইটের সিকিউরিটি রক্ষা করা। তৃতীয়বার হামলা করতে পারে নগু, কাজেই প্রস্তুত থাকা দরকার। তোমরা যে খাদে ফিরে এসেছ, এ খবর পেতে দেরি হবে না তার।

শাবলের চেয়ে একে-ফরটিসেভেনই মানাবে তোমার হাতে, সায় দিল নিকোলাস। তবে টিসেকে এখানে রেখে যাও। ওকে আমার দরকার।

তা থাকুক, তবে আশা করব ওর উপর নজর রাখবে তুমি। রাতে এসে একবার করে দেখে যাব আমি।

নিজের লোকজনকে ডিফেন্সিভ পজিশনে পাঠিয়ে দিল মেক। ট্রেইলের অনেক দূর পর্যন্ত থাকলো তারা, ক্যাম্পের চারধারেও পজিশন নিল। কাজ থেকে মুখ তুলে তাকালে নিকোলাস তাদের দু একজনকে উঁচু জমিনের মাথায় নড়তে চড়তে দেখতে পায়।

সেই থেকে রোজ রাতে ক্যাম্পে এসে টিসের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে মেক। কোনো কোনো গভীর রাতে টিসের তাঁবু থেকে তার ভরাট গলার উল্লাসধ্বনি ভেসে আসে, তার সঙ্গে মিশে থাকে টিসের জলতরঙ্গ হাসি। তখন রোয়েনের কথা মনে পড়ে যায় নিকোলাসের। পাশের তাঁবুতেই রয়েছে মেয়েটা, অথচ কত দূরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *