৫. সকালবেলা পুলিশ

সকালবেলা পুলিশ রথীনদের লাগানো কাগজগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলছে। জল ছিটা দিয়ে, কাটি দিয়ে, খুঁচিয়ে। টহল দিচ্ছে সেই অফিসারটি।

ভিড় হয়েছে শ্রীমতী কাফেতে, বিশের শব দেখবার জন্য। ডাক্তার এসেছে। পরীক্ষা করে বলেছে, কোনও বিষাক্ত জিনিস প্রচুর পরিমাণে ওর পেটে গিয়েছিল। স্টমাক ডায়ালট হয়ে গিয়েছিল। এও এক রকমের কলেরা।

বাজারের হোটেলের উড়ে ঠাকুরটা এসেছে। আনমনে কোমরের দাদ চুলকোচ্ছে আর হাঁ করে সকলের কথা শুনছে। যেন কিছুই বুঝতে পারেনি। কেবল মনে মনে ভাবছিল, পুণ্যিটা একেবারে মাঠে মারা গেছে। ব্যাটা মরে গেল।তারপরেই যে ভাবনাটা মনে হল, সেটা সাংঘাতিক। বিশে অপঘাতে মরেছে। অতএব, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। ভয়ে সে চোখ সরিয়ে নিল বিশেষ মৃতদেহের উপর থেকে। তাকাল একবার ঘরটার আশেপাশে, উপরে নীচে। তারপর সরে পড়ল।

আশেপাশের দোকানদারেরা বলাবলি করছে, শালা ঘোঁচাটা বোধ হয় কারও কিছু চুরি করে খেয়েছিল। হেসে ফেলছে কেউ কেউ।

হীরেনের কষ্ট হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও লোকটার প্রতি তার মন বিরূপ ছিল। মনে হত ভাঁড় বিশেষ। বিশেষ কোনও কথা তার বিশ্বাস হত না। এখন তার বুকের মধ্যে করুণার উদ্রেক হচ্ছে। বিশে তারই নিরন্ন অশিক্ষিত দেশবাসী।

রথীন আর সুনির্মল এসেছে। এসেছে প্রিয়নাথ। রথীন আর সুনির্মলের প্রিয়দা। নারায়ণের বন্ধু, প্রায় সমবয়স্ক। কয়েকদিন হল, সে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। তার মতের সঙ্গে নারায়ণের মতের একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, একটা মস্ত বিরোধ আছে গান্ধীবাদের সঙ্গে। এ অঞ্চলে তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ। সে স্টেশন ত্যাগ করতে পারে না স্থানীয় পুলিশের বিনানুমতিতে। কোনও শ্রমিক মহলে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ।

এরা, আর কয়েকজন ছেলে মিলে বার করল বিশের মৃতদেহ। একটা উগ্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

বিশে তাকিয়ে আছে, অবাক চোখে। মুখটা ভোলা, সামান্য ঘুচলো হয়ে গিয়েছে। দাঁতগুলো মেলা। ঘাড়টা বেঁকে গিয়েছে। মাছি বসেছে মুখে চোখে।

হীরেন মনে মনে আওড়াচ্ছে,

অন্তকালে চ মামেব স্ময়ম্মুক্ত কলেবরম্‌।…

কিন্তু বিশের কি কোনও দেবতা ছিল? সে শুধু বাঁচতে চেয়েছিল।

দুজন মেথর এসে ঘর সাফ করতে আরম্ভ করে দিল। ভজন ভাবছে, কী খেয়েছিল বিশে। এমন কোনও বস্তু তো ছিল না তার ঘরে। কয়েক টুকরো রুটি, আর সামান্য ঘুগনির অবশিষ্ট। কিন্তু সে তো বিষাক্ত ছিল না। তবে হয় তো কোথাও চুরি করেই কিছু খেয়েছিল।

কিন্তু বড় বিশ্রী খাপছাড়া! একটা মানুষ মরেছে, অথচ কেউ কাঁদছে না। সে জানে না, বিশের ঘরের সংবাদ। কে আছে আর কে নেই। শুধু জানত সে বিয়ে করেনি। আর বাপ মা ছিল, আছে কি না জানা নেই।

ভজন বাইরের সকলের দিকে তাকিয়ে দেখল। অনেকে হাসছে নয় তো নির্বিকার মুখে চুপ করে আছে। বিশে বেঁচে থাকতে, তার চলা, কথা বলা, খাওয়া সব দেখে লোকে হেসেছে। তার মরা দেখেও সবাই হাসছে।

কার চাপা গলার স্বর ভেসে এল, দোকানটায় অভিশাপ লেগেছে।

চমকে উঠল ভজন। অভিশাপ? সে তাকিয়ে দেখল সারা ঘরটা। অভিশাপ নয়, শ্রীমতী কাফে যেন শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। ওইখানে চিরমুদ্রিত চোখ দেশবন্ধুর। আর একদিকে প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ, সামনে তাকিয়ে আছে। গবাক্ষপথে কী যেন দেখছে তলোয়ারধারী সিরাজদ্দৌলা। ক্রুশে গাঁথা জুসের বিশ্বাসঘাতকতার এক দারুণ ও মহাপরিণতির প্রতিমূর্তি যীশুখ্রিস্ট। বিশ্বরূপে বিরাজিত র‍্যাফেলের মা ও ছেলে। আর ওই যে বিরাট ল্যান্ডস্কেপ দেখা যাচ্ছে, একটা বুড়ো বটের গোড়া ঘেঁষে পাক খেয়ে বেঁকে গিয়েছে একটা লাল রাস্তা। এঁকেবেঁকে মিশে গিয়েছে দিগন্তে, যেখানে আকাশ ঠেকেছে। ধুধু পথ আর আকাশ।

ভজনের মনটা যেন ঘর-বিমুখ বাউলটার মতো ছুটে গেল ওই পথে। যা, সে চলে যেতে চায় এই মুহূর্তে, অনেক দূরে। এ বিশ্বসংসারের বাইরে। শ্রীমতী কাফের অভিশাপে কি বিশে মরেছে? না। এ সংসারের অভিশাপে। অভিশপ্ত জগৎ।

বিশের মড়া নিয়ে সবাই বেরিয়ে গেল। কারা যেন বলাবলি করছে, ছি ছি, এরা আর জাতাজাত রাখলে না। কার মড়া কে বইছে। ঘর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ভজন বন্ধ করে দিল দোকান।

হীরেন বলল, বন্ধ করে দিলে?

ভজন জবাব দিল, হ্যাঁ, বিশের মৃত্যু উপলক্ষে শ্ৰীমতী কাফে আজ বন্ধ। কৃপালও এসেছে। এসেছে আরও কয়েকজন। মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশনের একটা বৈঠকের উদ্দেশ্যে তারা এসেছে।

কিন্তু সবাই চাক ভাঙা মৌমাছির মতো ছড়িয়ে পড়ল। বিমর্ষ, অপ্রস্তুত সবাই। অবাক! হেসে ফেলল কয়েকজন ভজনের কথা শুনে।

রামা আসছে, হীরেন দেখল। কত লোক রাস্তায়, কতরকম। কিন্তু সে দেখল শুধু একজন। ঘাগরার মতো কুঁচিয়ে পরা তার শাড়ি সামনে পেছনে দুলছে। মাঝারি শক্ত একটা মূর্তি। একটি কালো মুখ! নাক চোখে কিছু নেই। এলিয়ে পড়া ঘোমটা ছাপানো ধুলোরুক্ষ চুল।

ছোকরা পুলিশ অফিসারটি ঘুরে ফিরে এদের দেখতে লাগল, আর মনে মনে ভাবল, আশ্চর্য মানুষ এরা। কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু প্রিয়নাথবাবু মড়াটা কাঁধে করে কোথায় গেলেন? শ্মশানঘাটটা তো ওঁর এলাকার বাইরে। যাওয়ার পথে হয় তো আবার খানিকটা বিষ ছড়িয়ে যাবেন মজুর লাইনে। ওইখানেই তো মজুরদের লাইনটা পড়বে। সেও এগুল শ্মশানঘাটের দিকে।

বাঙালি সেপাই খুচিয়ে কাগজ তুলছে আর পড়ছে মনে মনে, আরহন বস থেক। সর্বহারা বিপ্লবী–ব্রিটিশ-বন্দেমাতরম্। তারপর চকিতে তার নজরটা চলে গেল শ্রীমতী কাফের দিকে। সে শুনেছে, ওইখানেই নাকি এই কাগজগুলো লুকনো থাকে।

ডালপুরীওয়ালা হাঁকছে, চাই ডালপুরী.তরকারি। কিন্তু বিশের জিভের লালা চিরদিনের জন্য শুকিয়ে গিয়েছে।

ভজন এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির সামনে, তার পুরনো দোকানের ধারে। এইখান থেকে শুরু। ঘরটা বেঁকে পড়েছে। ছিটেবেড়া এক এক জায়গায় পোকায় খেয়ে বড় বড় গর্ত করে ফেলেছে। কাঠের বোর্ডটা এখনও রয়েছে। বাপসা হয়ে গিয়েছে লেখাগুলো। খালি দেখা যাচ্ছে বড় হরফে, চা। দরজায় কে যেন ইটের টুকরো দিয়ে লিখে রেখেছে ১ নং শ্রীমতী কাফে। নীচে, ভজুলাট, লাটের বাট।

ভজন হেসে ফেলল। হেসে বাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকল সে। ফাঁকা বাড়িটা। আগে ফকা মনে হত না, বিয়ের আগে। ছেলেপুলে হওয়ার আগে। এখন মনে হয়।

বকুলমা রাঁধছেন। হালদারমশাই জবুথবু হয়ে বসে আছেন রাস্তার দিকে বারান্দায়। ওইভাবে বসে থাকেন সারাদিন অনেক রাত পর্যন্ত।

ভজনের গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। ঘরে ঢুকে ছোট আলমারিটা খুলে, বোতল হাতে নিয়ে দেখল সেটা খালি। খালি? মাথায় আগুন ধরে গেল ভজনের। জ্বলন্ত চোখে একবার তাকাল হালদারমশাইয়ের ঘরের দিকে। বুঝতে দেরি হল না কে এটি নিঃশেষ করেছে।

বোতলটা দেয়ালে ছুড়ে ফেলল সে। ঝনঝন করে ভেঙে ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেল। তারপর চিৎকার উঠল, আজ থেকে কেউ যেন আমার ঘরে না ঢোকে, কোনও জিনিসে হাত না দেয়। এর ফল ভাল হবে না বলে রাখলুম।

বলে দুম দাম করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

হালদার একটু নড়লেন না, ঘাড় বাঁকালেন না। বোতল ভাঙার শব্দে একবার চমকালেন একটু, নাকের পাশে কোঁচ দুটো আর একটু গভীরতর হল। চোখ দুটো যেন ঠেলে এল খানিকটা। বারকয়েক ঢোক গিললেন।

বকুলমা এসে বোতলের ভাঙা টুকরোগুলো একটা একটা করে তুলতে লাগলেন। বিস্ময়ের কিছু নেই, জিজ্ঞেস করবারও কিছু নেই। এ ঘটনা নতুন নয়।

কিন্তু সহ্য হয় না বকুলমায়ের। মা না হয়েও এত দৌরাত্ম্য কেন তিনি সহ্য করবেন। কেন আসবেন এ অপমানকর আসরে। হালদারমশাইয়ের দরজার দিকে তাকিয়ে অভিমানে বুক ভরে ওঠে তার। মনে মনে বললেন, আপনার জন্যই, শুধু আপনার জন্যই আমার এ দুর্দশা। ছেলেরা আমাকে কবেই ছেড়ে দিয়েছে, আপনি কার কাছে থাকবেন। চিরকাল এমনি কাজ করলেন যে, আজকে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার পাথেয়টুকুও আপনার নেই। বুঝি সে সাহসও নেই। কী করে থাকবে। সইয়ের অভিশাপ যে। থেমে গেলেন বকুলমা। কী হবে সে কথা ভেবে। হালদার পারেননি, তিনি যে মুক্ত হয়েও কোনওদিন খোলা আকাশের তলায় গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি।

ভজনের বিয়ের পর কিছুদিন কেমন একরকম মন হয়েছিল তার। প্রায় রোজই কোথাও না কোথাও কীর্তন গান শুনতে যেতেন। নিজের বাড়িতে আসর বসাতেন। গুণী গায়ক আর সন্ত্রাহ্মণের ছেলেদের নিত্য সেবা ও ভোজনের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। তিনি নিজেও যেন বড় কাঙাল হয়ে উঠেছিলেন। এরূপের উপরেও তিনি আপনার বৈধব্যের সাজের উপর চুরি করে নিজেকে সাজাতেন।

কিন্তু মন আপনা থেকেই বেঁকে এসেছিল। অপমানে লজ্জায় নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সব বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজে গান গাওয়া ধরলেন, বুকটা হালকা করার জন্য। লজ্জা শরমও অনেকখানি জলাঞ্জলি দিলেন। কী হবে ও পাপের বোঝা রেখে। প্রাণ খুলে হা হা করে হাসতে লাগলেন, গলা ছেড়ে কথা কইলেন। কে আছে কে নেই, তা ও মানলেন না। লোকে ভাবল উলটো রকম। ভাবুক। লোকে আজ এক রকম ভাবে, কালকে তা পালটে যায়। গাইলেন,

ওরে মন তোরে না রাখিব দেহের পিঞ্জরে।

সঙ্কোচ ঘুচিয়ে দিলেন হালদারের সামনে। কথা হাসি গানের মানামানি রইল না।

তবু কই মন তো দেহের পিঞ্জর ছেড়ে অসীমের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল না, বেরিয়ে পড়তে তো পারলেন না। ছড়িয়ে দিতে পারলেন না নিজেকে অসীমের মাঝে। এই যে হাসির ঝঙ্কার, তা কেন মাঝে কান্নার রোল হয়ে ওঠে। জানিনে। মনে মনে বলেন, জানিনে। জানলে আর এমনটা হবে কেন?

বোতলভাঙা তুলতে তুলতে বার বার মাথা নাড়তে লাগলেন। কেবলি যেন মনটা গাইল, যত আপদের সৃষ্টি করেছে ওই ছাইয়ের শ্রীমতী কাফে, না কি মুণ্ডু ওটার নাম। এ সংসারে যেন ওটাকে নিয়ে অশান্তি আরও বেড়েছে। ওটা যেন মানুষকে একটা পাগল করা পুরী, একটা যন্ত্র।

কলকাতা থেকে ফিরছে ভজন। আলিপুর জেলে দাদার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। শিয়ালদহে আসবার আগেই কয়েক পাত্র উজাড় করে এসেছে সে।

পকেট থেকে পয়সা বের করে টিকেট কাটতে গিয়ে পা ঠেকে গেল কার গায়ে। বলল, কে বাবা। রাধে, পথ ছেড়ে দে। মথরোনগর আমার পথ চেয়ে আছে য্যা!

আশেপাশের দু একজন হেসে উঠল। বদ্ধ মাতাল।

ভজন ভাল করে চোখ মেলে দেখল, পায়ের কাছে একটা ছেলে শুয়ে আছে। ধুকছে। রাধে নয়, এ যে কালো কেষ্ট ঠাকুরটি। উপপাসী কেষ্ট। ধুলো মাখা, ছাতলা পড়া, রোগা শরীর, কচি গালের চামড়ায় টান ধরেছে। চোখ বসে গিয়েছে।

ভজন বলল, ধুলোয় গড়াগড়ি করছ কেন বাবা? ঘর নেই?

ছেলেটার মুখে কথা সরছে না। বোধশক্তি নেই। খালি শোনা গেল, বাবু। …

আর বাবু বলে কাবু করতে হবে না। এ কলকেতায় আমার বাস নয়। বাড়ি কোথা?

চাটগাঁ।

ভজন বলল, মগের মুলুকের ছেলে দেখছি। বাপ মা নেই?

ছেলেটা কী বলল, বোঝা গেল না। কেবল চোখে জল দেখা দিল। ভজন ভাবল, বাপ মা নেই। বলল, এখনও জল আছে ওই চোখে? থাক, মায়া কান্না রাখ! চা তৈরি করতে পারবে? মাংস চপ রাঁধতে পারবে?

পারব।

ভেংচে উঠল ভজন, সব পারবে। কোনটিতে না নেই। ভজুলাটের ঠ্যাঙানি খেতে পারবে?

ছেলেটা বলল, বাবু?

বুঝতে পারলে না, না? আমার নাম ভজুলাট, ছিরিমতি কাফের পোপাইটার। বুঝেছ? তোমার নাম?

আজ্ঞে, চরণ।

চরণ! কার চরণ বাবা?

ছেলেটা আবার এলিয়ে পড়ল। ভজন বলল, তা হলে দুটো টিকিটই কাটছি বাবা চরণ। এক ব্যাটা খেয়ে মরেছে, তোমার মরণ কীসে, তা ছিরিমতিই জানে। অ্যাই-অ্যাই খাবারওয়ালা।

ভজন চেঁচিয়ে ডাকল খাবারওয়ালাকে। বলল, দেও, কিছু দেও চরণকে, কিছু গিলে নিক ব্যাটা।

খাবারওয়ালা বোধ হয় মাতাল দেখে একবার থাল। তারপর চরণের সামনে বাড়িয়ে দিল এক ঠোঙা খাবার।

চরণকে নিয়ে ভজু বাড়িতে এল। বাড়িতে আবার খাইয়ে রাত্রেই নিয়ে এল শ্রীমতী কাফেতে। বাতি জ্বেলে এক মুহূর্তে সে ভুলে গেল চরণকে। তার মনে পড়ে গেল বিশের কথা। পরশু দিন রাত্রে এই ঘরটাতে বিশে ছিল। আজ নেই। একটা উগ্র ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ যেন বলছে, বিশে মরে গিয়েছে।

চরণ হাঁ করে দেখছে সারা ঘরটা। উনুন, ঘুটে কয়লা, জলের জালা। মাতালবাবুটি তাকে কয়েকবার বলেছে, এ ঘরে একটা লোক মরেছে। কী ভাবে তা সে জানে না। শুনেছে, খেয়ে মরেছে। ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার নয়।

ভজু চরণকে একেবারে সামনের ঘরটা দেখিয়ে বলল, এই ঘরে তুই শুবি। ভোরবেলা উঠে উনুনে আগুন দিবি, ঘর সাফ করবি। বুঝেছিস? জীবনে কবার চুরি করেছি?

আজ্ঞে? চরণ যেন তটস্থ হয়ে উঠল। তবু ইতিমধ্যেই তার মনের মধ্যে বাবুটি হৃদয়বান বলে যেন ধরা পড়ে গিয়েছে।

ভজন বলল, বলছি বাবা চুরি টুরি করা অভ্যাস নেই তো?

চরণ দ্বিধাগ্রস্তভাবে একটু হাসল।

হাসি হচ্ছে? ভজন বলল, যম রদ্দা ঘাড়ে পড়লে আর হাসি পাবে না। আর চুরি যদি করিস, ওই বিশের মতো শিঙে ফুকতে হবে, বলে দিলুম। এবার শুয়ে পড়। বলে ভজন বেরিয়ে গেল।

চরণ দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের মেঝের মাঝখানে দাঁড়াল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, টেবিল, চেয়ার, ছবি আর আলো। আলোর শেডের গায়ে লেখাটা বানান করে পড়ল শ্রীমতী কাফে। তারপর তার চোখ গিয়ে পড়ল আয়নায়। তার চেহারাটা ভেসে উঠেছে আয়নার বুকে।

চুলগুলো তার কোঁকড়ানো। ছোট ছোট চোখ, চ্যাপটা নাক আর মেয়েলি ঠোঁট চরণের। উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ছাপ তার মুখে চোখে। বেঁটে খাটো শক্ত শরীর। এখন রোগা দেখলেও সেটা বোঝা যায় তার চেহারাটা দেখে। বয়স ষোলো সতেরোর বেশি নয় কিন্তু গোঁফের রেখা নেই। মুখটা তার মেয়েদের মতো কমনীয়।

নতুন আশ্রয়ে এসে চরণের খালি মনে হল, আগামীকাল হয় তো তার এ আশ্রয়ও ভেঙে যাবে। আবার বেরুতে হবে পথে, অজানার সন্ধানে। আবার কোনও নতুন আশ্রয়ের আগেই হয় তো পথেই পড়ে মরতে হবে। চলা তার জীবনের শুরু থেকে। চলবে জীবনের শেষ পর্যন্ত। এই বুঝি তার ভাগ্য। শিয়ালদহ স্টেশনে ওই অবস্থায় আর দুদিন থাকলে আজকে এখানে আসা তার কোনওরকমেই সম্ভব হত না। তার জীবনে অনেক মৃতদেহ সে পথের ধুলোয় পড়ে থাকতে দেখেছে। কল্পনা-চোখে সে দেখতে পেল, আয়নার ওই মূর্তিটাও পড়ে আছে রাস্তায়, মৃত, উলঙ্গ, ধুলোমাখা। থুতু ফেলছে পথচারীরা, কাপড় চাপা দিচ্ছে নাকে।

চরণের চোখে ভেসে উঠল তার নিজের জীবনের অতীত কথা। ভেসে ওঠে শৈশবের কথা, বাপ মায়ের কথা। ইরাবতীর শস্য শ্যামলা উঁচু তীর তার খেলার ভূমি। মাথার উপরে অসীম আকাশ। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় ঝড় গাছপালা খেত দুলিয়ে হৃদয় তোলপাড় করত। জীবনটা ছিল যেন আকাশের বুকে ঝোড়ো পাখিটার খুশির উদ্দামতা। খাওয়া আর হুতোশভরা চোখে দামড়া বাছুরটার মতো লাফিয়ে বেড়ানো, এই ছিল কাজ।

কিন্তু সে মাত্র তার দশবছরের জীবন পর্যন্ত। তার শিশু-জীবনে সব থেকেও কিছুই ছিল না। ছিল না তার মা। ছিল সৎ মা। মায়ের চেয়ে বলা ভাল, উৎকট চেহারার একটি অল্পবয়সী স্কুল মেয়েমানুষ। সে তুলনায় তার বাপ ছিল যেন বুড়ো। তাই মেয়েমানুষটির দৌরাত্ম্য ছিল ভয়ানক। কচি খুকির মতো হেঁচকি তুলে কাঁদত, প্রায় প্রত্যহ কিছু না কিছু তার বাপের কাছ থেকে আদায় করত, তারপর হাসত। হাসিটা মনে হলে এখনও যেন গা ঘিনঘিন করে ওঠে চরণের। সেই অল্প বয়সেই মেয়েমানুষটির দাঁতগুলো পান খেয়ে ক্ষয়ে লাল হয়ে গিয়েছিল। বিড়ি টানত যখন তখন। কালো কুতকুতে চোখে আবার কাজল দিত, আর কপালে একটা কালো টিপের তলায় দিত সিঁদুরের ফোঁটা। পায়ে পরত বাঁকমল, হাত ভরা রুপোর চুড়ি আর পড়ে পড়ে ঘুমোত। তার বাপের ছোট মুদিখানার কিঞ্চিৎ পুঁজি হলেও সে দেখত, বাপ যেন পোষা বাঁদরের মতো মেয়েমানুষটির পেছনে পেছনে ঘুরত। যা চাইত, সবই দিত আবার জোড় হাতে কাছে গিয়ে দাঁড়াত। সে বয়সেই তার মনে হত, বাবাকে টেনে নিয়ে সে এলোপাথাড়ি ঠেঙিয়ে দেয়। কই তার নিজের মা তো এমন ছিল না আর বাপও তার এরকম বোকা ছিল না।

এ-সব দেখেশুনেই সে বাইরে বাইরে ঘুরত মাঠে মাঠে, জলে পড়ে থাকত। তবু মাঝে মাঝে সৎ মায়ের পাল্লায় তাকে পড়তে হত হাত পা টিপে দেওয়ার জন্য। তখন মেয়েমানুষটি প্রায় উলঙ্গ হয়ে পড়ত। শাস্তি দিতে সে শুধু পা টিপত না, একদিন থুতু ফেলে সে বাধ্য করেছিল চরণকে তা চেটে নিতে।

ভরা বর্ষার টাবুটুবু ইরাবতীর চেয়েও চরণের চোখে বুঝি বেশি জল ছিল। বাবা যেদিন পিটত সেদিন সে মাঠ নালা ভেঙে চলে যেত বহু দূরে আর না ফেরার মনস্থ করে, কিন্তু যেখানেই শ্মশান পড়ত, সেখান থেকেই পালিয়ে আসত সে।

দিনের বেলা তার এমনি কাটত একরাম, কিন্তু রাত্রি নামত যেন তার কাছে নরকের মতো। এ সময়টা ছিল তার সৎ মায়ের বাবার কাছ থেকে সমস্ত দাবি আদায়ের সুযোগ। তাকে ঘুমন্ত ভেবে সৎ মা খোলাখুলি যেন জাদুমন্ত্র শুরু করত। আর চরণ তাদের গাঁয়ে মাঠে অনেক উলঙ্গ মানুষ দেখেছে; কিন্তু তার শিশু চোখে অত বড় বীভৎস উলঙ্গ রূপ আর কোথাও দেখেনি। এবং তার বাবা সোৎসাহে মানত সমস্ত দাবি।

তারপর এমনি এক রাতের সুযোগে তার মাথায় বজ্রাঘাতের মতো সৎ মা দাবি করে বসল এ বাড়ি থেকে তার পুত্র চরণের বিতাড়ন। নরকের প্রতিটি মুহূর্তেই টগবগ করে ফোটে। বাপ তার রাজি হয়ে গেল।

ভয়ে কান্নায় আর ঘামে সে রাতটা যে কেমন করে কাটল তা বুঝি সে নিজেই জানে না। পরদিন বাবা যখন তাকে নিয়ে গাঁয়ের থেকে অনেক দূরে বাজারের একটা দোকানে কাজে লাগিয়ে দিয়ে এল সেদিন একটা কথাও সে বলেনি। মানুষের এতবড় হীনতায় সে কাঁদতে পারেনি। সে বিশ্বাস করতে পারেনি, এ সংসারে আবার মানুষের বাবা বলে কেউ থাকতে পারে।

তারপর এ দোকানে সে দোকানে, চাকরের কাজ করে, এক মহকুমা থেকে আর এক মহকুমা, জেলার শহর থেকে একেবারে রেঙ্গুন। রেঙ্গুন থেকে সোজা কলকাতা। এর মাঝে যে জীবনটা কেটেছে তার সমস্তটাই ঠাসা ছিল সব বীভৎস ঘটনা, দুর্দান্ত ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির সব নরনারী; তাদের নানান ভাষা ও পেশা, দুরধিগম্য স্থান এবং জমাট অন্ধকার ভরা।

আর চরণ দেখেছে, জীবনের এত যে বিচিত্র সব কাণ্ড কারখানা, সবই শুধু টাকা পয়সা সোনার জন্য। পাগলা জানোয়ারের মতো এ পৃথিবীর অতল গুহায় সব হন্যে হাতিয়ে ফিরছে কেবলি সোনা। খুন জখম, প্রেম হাসি, সবই শুধু সোনার জন্য। রক্তের বদলে সোনা।

কেবল কলকাতায় তাকে যিনি নিয়ে আসছিলেন, তিনি ছিলেন দেবতা। তাঁর কেউ ছিল না, রোজগারও করতেন না। কলকাতা আসবার মুহূর্তে চরণ তাঁকে ধরেছিল, এ মুলুক থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি বলেছিলেন, সেই ভাল, তোমার মনিব যদি ছেড়ে দেন তো চলল। পরের দেশে ভাগ্যান্বেষণে যারা আসে, তারা চিরদিনই নিষ্ঠুর। সে অন্বেষণ কানাকড়ি হলেও তাই।

তারপর জাহাজে উঠে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, চরণ, তুমি আমি আমরা সবাই নানান গর্ভ থেকে জন্মে এমনি পরিচয়ের সীমানায় এসে পৌঁছেছি। কোনও অপরিচয়ের বাধা আমাদের আটকাতে পারে না। ওই দেখো, অসীম সমুদ্র, অনন্ত আকাশ..ওই সুদূর অচেনাকে আমরা জয় করব। তুমিও অসীমের সন্ধান করো।

কোনও কথাই চরণ ভাল বুঝতে পারেনি, কেবল তার চোখের কোল ছাপিয়ে জল এসে পড়েছিল।

কিন্তু তিনি আচমকা মারা গেলেন। কথা বলে ডেক থেকে কেবিনে গিয়ে শুলেন, চরণকে বললেন, আমার বুকটা একটু হাতিয়ে দাও।

হাড্ডিসার বুকটা হাতাতে হাতাতে তিনি ঘুমোলেন, আর উঠলেন না। কলকাতার পুলিশ তাকে কয়েক দিন আটকে রেখে নানান কথা জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দিল এই দুস্তর দুরধিগম্য বন্দরে। তারপর শিয়ালদহ, মনিব ভজুলাট। মনিবের নিজের মুখ থেকেই শুনেছে সে ওই নামটা, ভজুলাট। কীঅদ্ভুত নাম। আর এই দোকান। এও বড় বিচিত্র নাম, শ্রীমতী কাফে।

তার মনে পড়ে গেল, পরশুদিন একজন মরেছে এই ঘরে। এই ঘরে সে যেখানে রয়েছে। কোন দেশের মানুষ সে, কেমন সে দেখতে ছিল, কে ছিল তার, কিছুই সে জানে না। কত তারবয়স, তারও চরণের মতোই মা বাপ ছিল না কিছুই তার জানা নেই। শুধু শুনেছে, মরেছে। কিন্তু তার ভয় করছে না। মরণের কথায় মানুষের কত ভয়। তার সে ভয় নেই। মরণ কোনও সময়েই তার পেছন ছাড়েনি। বাগে পেয়েও পারেনি গ্রাস করতে। পরশু এখানে একজন মরেছে, আজকে সে এখানে এসেছে বাঁচার জন্য। আশ্চর্য! মরণ বাঁচন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।

মনে পড়ছে, জাহাজের সেই বাবুর কথা, ওই দেখো অসীম সমুদ্র, অনন্ত আকাশ, ওই সুদূর অচেনাকে আমরা জয় করব। তুমিও অসীমের সন্ধান করো।সেই অসীম কী! কী আছে, কী আছে সেখানে।

মেঝেয় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল চরণ। নিজের কাপড়েরই একাংশে পেতে গুটিসুটি হয়ে ঘুমোল।

নিশান্তে দিন, দিনান্তে নিশি। চক্রাকারে সময় এগিয়ে চলল।

শ্রীমতী কাফে তার অচল অবস্থাটা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে। আবার জমে উঠতে আরম্ভ করেছে তার সকাল সন্ধ্যার আসর। দিনে দিনে ভজনও যেন বড় উদভ্রান্ত হগে উঠছে। যেমন বেড়েছে তার পানের নেশা, তেমনি বেড়েছে পাগলামি। মাঝে মাঝে দেখা যায় বিকৃত মুখে পেটটাকে চেপে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে রয়েছে। তার শরীরের মধ্যে ব্যাধি প্রবেশ করেছে, কিন্তু কোনওদিন সেকথা কাউকে মুখ ফুটে বলতে শোনা যায় না। সে আত্মসমর্পণ করেছে চরণের কাছে। দোকানের সব ভারই প্রায় চরণের উপর। টাকা পয়সা পর্যন্ত চরণের হাতে চলে গিয়েছে।

আজকাল সন্ধ্যাবেলা প্রায়ই প্রিয়নাথের সঙ্গে কৃপালদের তর্ক হতে দেখা যায়। ঠিক তর্ক নয়, প্রিয়নাথকে সকলে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত করে তোলে। প্রিয়নাথকে শ্লেষ করে হাসাহাসির হররা পর্যন্ত পড়ে যায়। প্রিয়নাথ নিতান্তই একলা পড়ে গিয়েছে। হীরেন অবশ্য বিদ্রূপ করে না, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা করে তর্ক করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সে প্রিয়নাথকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আবহাওয়া এমনভাবে পেকে উঠেছে যে, নিজেদের বাগযুদ্ধের বহর কিছুটা কমে এসেছে। সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসের আপসের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। গান্ধীজি ইয়ং ইন্ডিয়াতে ঘোষণা করেছেন, তাঁর এগারো দফা দাবি সরকার মেনে নিলে সমুহ আন্দোলনের কোনও প্রয়োজনই হবে না। কিন্তু সরকার এগারো দফার একটাও বিবেচনা করতে রাজি নয়। ফলে সকলের মধ্যেই একটা উত্তেজনা ও প্রতীক্ষা থমথম করছে। দেশ জোড়া অসহিষ্ণুতা। সংবাদপত্রগুলো হিংসাকামী কর্মীদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে গান্ধীজির আদর্শ। সাবধান করে দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের।

কৃপাল সেইজন্য একদিন প্রিয়নাথকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তুমি শ্রীমতী কাফেতে আসসা বলেই পুলিশের নজর বারবার এদিকে এসে পড়ছে। এখন তোমার সরে পড়া উচিত। তার জবাব দিয়েছিল ভজু, এখানে যার প্রাণ চায় সে আসবে, যার চায় না, সে আসবে না। মনে হয় ভজুর বেশ খানিকটা পক্ষপাতিত্ব আছে প্রিয়নাথের উপর।

কৃপাল ভাবল, উলটা বুঝল রাম। যার ব্যবসার ভালর জন্য বলতে গেলুম, সে-ই তেড়ে মারতে আসে। কিন্তু হীরেন এ ভাবে প্রিয়নাথকে তাড়িয়ে দিতে চায় না। এমন কী, প্রিয়নাথ অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের ছেলে বলে হীরেন তাকে কয়েকবার আর্থিক সাহায্য পর্যন্ত করেছে। তার বিশ্বাস ছিল, শত হলেও আমরা সকলেই কংগ্রেসের সভ্য। আমাদের যদি কোনও মতবিরোধ থাকে, তবে তার অবসান করতে হবে নানান আলাপ আলোচনায়।

রাত্রি আটটার পর ভাঙা আসরে এল বাঙালি। বাঙালি আরও কয়েকদিন এসেছে। এসে শ্রীমতী কাফের বারান্দায় ধপাস করে বসে পড়ত। ভজনের সঙ্গে বকবক করে চলে যেত।

আজকে এল বাঙালি প্রায় মত্ত অবস্থায়। এসে বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে গান ধরে দিল,

আমি দুখচেটে দুখীরাম, আমার কথা বলো না,
আমার নেই সুখের সঙ্গে কোন বনিবনা।

বলে সে ধপাস করে বসে পড়ল বারান্দার উপর।

ভজন বলল, কী হল রে?

আর ঠাকুর, তুমি সব ভেস্তে দিলে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়ে সে বলল, তোমরা সব বাবুরা এক রকম। আগে রাস্তার ধারে বসে তোমার ছিটেবেড়ার ঘরে চা খেয়ে এসেছি। আগে ছিলে তুমি আমাদের, এখন তুমি পর হয়ে গেছ।

কথাটা ভজনের প্রাণে লাগল। বলল, কেন বল দিকিনি?

কেন আর কী। বাড়িতে যেদিন ভাত পেতুম না, সেদিনে তোমার দু পয়সার ঘুগনি খেয়ে কাটিয়ে দিতুম। আর এখন তোমার দোকানের দিকে চাইতে ডর লাগে।

ভজন বলল, তাই বুঝি তুই কোনওদিন আমার দোকানে ঢুকিস্‌নে?

বাঙালি মাতালের হাসি হাসল। বলল, ঢুকে কোথা বসব। ওই চ্যারে? শালা ছেলে বউ রাস্তা দিয়ে গেলে যে চিনতে পারবে না গো ঠাকুর। ভাববে কোন লাটের পো বসে আছে।

সকলে হেসে উঠল। প্রিয়নাথ আর হীরেন, গোলক চ্যাটুজ্যে মশাই আর কয়েকজন খদ্দের। কৃপাল গিয়ে জমেছে সারদা চৌধুরীর বৈঠকখানায়।

ভজন চেয়ার ছেড়ে দু হাত ধরে টেনে তুলল বাঙালিকে। বলল, আয় তবে, লাটের পো হয়েই বসবি আজ।

হা হা করে হেসে উঠল বাঙালি, কয়রা কি ঠাকুর। চ্যারে বসতে গেলে আমি আছাড় খাব মাইরি।

আছাড় খেলে গা টিপে দেব, তা বলে মিছে অপবাদ শুনবে না ভজুলাট। বলে টেনে বসাল তাকে হীরেনেরই পাশের একটা চেয়ারে। তারপরে বলল, বলি া রে, দু পয়সার ঘুগনি কি ভজুলাটের দোকানে বেচে না, না কেউ খায় না। শালপাতায় নয়। চিনে মাটির প্লেটে। তাতে কি তোমার জাত যাবে?

জাত গেলে তোমার দোকানের যাবে, আমাদের ও-সব নেইকো। বলে সে চেয়ার থেকে নেমে মাটিতে বসে বলল, দু পয়সার ঘুগনি দেও ঠাকুর, চোখে বাড়ি যাই। ওখানে আমি বসতে পারব না।

তারপরে হীরেনকে নজরে পড়তেই তার পায়ে হাত দিয়ে বলল, রাগ করো না লেউগিবাবু, মদ খেয়েছি, ভেবেছিলুম তোমাকে একটা কথা বলব। বলব এখন?

নিয়োগীর অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু এড়াবার উপায় নেই। বলল, বলল।

বাঙালির মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। তাতে তার লাল চোখে ফুটল যেন নিষ্ঠুরতা। বলল, তোমরা সেদিন মিটিনে বললে, দেশের লোককে লেখাপড়া শেখাবে, জাত বেজাতের ছোঁয়াছুঁয়ি উঠিয়ে দেবে। কে তোমার কলকেতা থেকে এক বাবু এসেছিলেন, তিনিও বলেছেন।

হীরেন বলল, তোমার ভাল লাগেনি বোধ হয়? বাঙালি বলল, ভাল লেগেছে। কিন্তু বাবু তোমাদের মন্দিরে আমরা যেতে চাইনে, ছোঁয়াছুঁয়ির কী দরকার। আমাদের পেট ভরে দুটি খাওয়ার পথ বাতলে দেও। বারো মাস আর ছেলে বউয়ের শুকনো মুখ দেখতে পারিনে। মাসে চোদ্দো টাকা মাইনে, এ সব কি আর নড়চড় হয় না?

হীরেন রাগ করল না। কিন্তু প্রিয়নাথের সামনে প্রশ্নটা তাকে যেন একটু বেকায়দায় ফেলল!

ভজন বলল, ব্যাটা বদরসিক হীরেন, কেটে পড়।

হীরেন বলল, কেটে পড়ব না। বাঙালি, আমরা সেই জন্যই স্বরাজ চাইছি। স্বরাজ আমাদের একলার নয়। কিন্তু তার মর্যাদা রাখতে হবে। খাওয়াটা অনেক বড়, তবু এ ছাড়া কি স্বরাজে আর কিছু নেই?

বাঙালি অন্যদিকে তাকিয়ে নীরবে মাথাটা নাড়ছিল। একটু একটু করে তার চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল। ছোট হয়ে এল চোখ দুটো। শক্ত হয়ে উঠল হাতের মুঠি। বলল, আছে, সেটাও তোমাকে বলি লেউগিবাবু। এর এট্টা ব্যবস্থা তোমরা করো। আমাদের সঙ্গে কাজ করে লোটন, খোয়া। থাকে কুলিবস্তিতে। আমাদের কাজ পথে পথে। আমাদের দশজনকে বললে, ভোর পাঁচটার মধ্যে এখান থেকে এগারো মাইল দূরে যেতে। সায়েব বাবুরা বলে খালাস, এট্টা টলির বন্দোবস্তও নেই। তা লোকে কেমন করে যাবে? কালা সায়েব বললে, পায়ে হেঁটে। এমনিতেই সেদিন পথে বাঘ বেরিয়েছিল। রাত করে যাবার ভয়ে লোটন বলেছে, অত সবিরে সে যেতে পারবে না। তা বললে বিশ্বাস যাবে না বাবু, শুনে সাদা সায়েব লোটনের পাছায় ঘপ করে কষালে এক লাথি, আর কালা সায়েব চুলির মুঠি ধরে এনতার কিল চড় ঘুষি।

বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল বাঙালি। তাকে দেখে মনে হল হিংস্র আক্রমণে এখুনি বুঝি শত্রুকে ধরে সে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলবে। দপদপ করে জ্বলে উঠল চোখ দুটো। বলল চিবিয়ে চিবিয়ে, তা বাবু প্রাণটা চাইল, ওই সাদা কালা দুটো কুত্তার বাচ্চাকে ওইখানেই হাম্বর দে ঠেঙ্গে ফেলে দে আসি লাইনে। কিন্তু পারিনি।

পারিনি বলতে গিয়ে যেন গলার স্বরটা একেবারে সপ্তম থেকে ভেঙে তলার পরদায় নেমে এল তার। মনে হল অসহায় আক্রোশের বাষ্প জমে উঠেছে তার গলায় আর চোখে। বলল, উলটে আমাদের দশজনের এক টাকা করে মাইনে কেটে দিলে। বাবু, দুয়োনা ছুঁয়োনা আমাদের, অ আ ক খ মাথায় থাক, এ পেটে পিঠে মার আর কদ্দিন সইব বলো। বলো।

বলতে বলতে গলার স্বরটা তার নিভে এল। আচমকা সবাইকে অবাক কয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল।

ভজন পেছন থেকে ডাকল, বাঙালি শুনে যা।

বাঙালি শুনল না। কেমন একটা অসহ্য অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। সে নিজেও বুঝতে পারল না, কেন এমন হল! সে নিজেও জানে না, প্রাণটা ছুটতে না চাইলেও কেন এমন করে সে ছুটছে। কেন শীতের কুয়াশা-ঘন রাস্তাটা তার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কেন একটা নোনা জলের স্বাদ তার ঠোঁটের দুই কষের ভেতর দিয়ে গিয়ে মুখটাকে লবণাক্ত করে তুলছে।

শ্ৰীমতী কাফে নিস্তব্ধ। ভজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। হীরেনের গায়ের থেকে চাদরটা খুলে পড়ে গিয়েছে নীচে। সে তাকিয়ে আছে দূরে, স্টেশনের ওভার ব্রিজ পেরিয়ে, টিনের শেডের তলা দিয়ে ঝাপসা তারা ভরা এক টুকরো আকাশের দিকে। প্রিয়নাথের দুই চোখে আগুন। বাঙালির চোখের মতো তার চোখ দুটোও জ্বলছে। চাটুজ্যে মশাই খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে হতভম্বের মতো বসে আছেন। তিনজন খদ্দের ছিল, তাদের অবস্থাও চাটুজ্যে মশাইয়ের মতো। কিছুটা বা বিস্ময় ও মর্মাহত।

রাস্তা দিয়ে সেই ছোকরা পুলিশ অফিসারটি যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। নিজের হাত ঘড়িটা একবার দেখে কাফেতে উঠে এসে বলল, কী ভাবছেন প্রিয়নাথবাবু?

চমকে উঠে প্রিয়নাথ অফিসারের দিকে তাকাল। অফিসার একটু ঘাবড়ে গেল তার চোখ দেখে। প্রিয়নাথ বলল, কী বলছেন?

আরও অমায়িক গলায় বলল অফিসার, না, কিছু না। নটা দশ। ভাবলাম, আপনার হয় তো মনে নেই।

প্রিয়নাথ দেওয়ালের দিকে ফিরে তাকাল। নটা বেজে গিয়েছে। পেণ্ডুলামে দুলছে কঙ্কালের মুখটা।

কয়েকদিন হল, সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত্রি নটা পর্যন্ত তার বাড়ির বাইরে থাকার মেয়াদ বেড়েছে। সে কোনও কথা না বলে উঠে পড়ল।

অফিসারটি সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, নমস্কার হীরেনবাবু।

নমস্কার। হীরেন তার চাদরটা কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে।

অফিসারটিকে কীরকম বোকা বোকা মনে হতে লাগল। যেন সে কোথাও অনধিকার প্রবেশ করেছে। সে একজন বাঙালি যুবক। আই. এ. পাশ করেছে। এখনও তার জীবনে অনেক শখ আছে। মনে তার কাব্য আছে। রীতিমত কাব্যরসিক। গানের দিকে ঝোঁক আছে। প্রায়ই গানের মজলিস বসায় সে। অগণিত লোক তাকে ভয় করে, শ্রদ্ধা করে। অনেকে তার করুণাপ্রার্থী। এই পথের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কত লোক তাকে সেলাম করে।

অথচ এই শ্রীমতী কাফেতে কোনওদিন সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। এই একটি জায়গা এই অঞ্চলে, যেখানে ওঠবার আগে তাকে ভাবতে হয়, তার ইউনিফর্ম পরা সাবলীল গতি বাধা পায়। যেখানে সেলাম নেই, আছে বোধ হয়…। কী আছে সেটা ভাবতে গিয়ে অসহায় রাগে ও দুঃখে তার বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা হয়। হঠাৎ অত্যন্ত তাচ্ছিল্যভরে ভজনের দিকে একবার তাকিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল সে।

হীরেন বারান্দায় এসে দাঁড়াল ভজনের সামনে। তার কিছু বলার ছিল প্রিয়নাথকে। বলা হল না। মনে মনে ভাবল সে, যদি কৃপাল হতুম, আমি কিছুই বলতুম না। কিন্তু বাঙালির এ বেদনা যে তারও বেদনা। সে কি জানে না দেশবাসীর এ দারুণ দুঃখ ও অপমানের কথা। সে বলতে চেয়েছিল প্রিয়নাথকে, শাসকের হৃদয় পরিবর্তন যতক্ষণ না ঘটছে ততক্ষণ পর্যন্ত জাতিকে প্রতীক্ষা করতে হবে। অন্তত এ শাসকের বিদায় লগ্নের জন্যও অপেক্ষা করতে হবে।

হীরেন ডাকল, ভজু।

ভজন ঘুরে বলে উঠল, দোহাই তোমার হীরেন, আমাকে আর কিছু বলল না মাইরি।

বলে সে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল। হীরেন বিস্মিত হয়ে ভজনের দিকে একবার তাকাল। দেখল, অদূরে দরজার কাছে শ্রীমতী কাফের বাবুর্চি চরণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দেখছে তার অপ্রস্তুত অবস্থাটা।

ভাবল, তারই ভুল হয়েছে ভজনকে কিছু বলতে যাওয়া। সে পথে এসে দাঁড়াল। একবার নসীরাম ঘোষের ওখানে যেতে হবে। কিন্তু মনটা বড় ভার হয়ে এল। ভার হয়ে এল, তার নিজেরই দিশেহারা মনটার জন্য। সত্যি, বাঙালির দুঃখের যে সীমা নেই।

কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্য, ভজনের এ কারখানা শ্রীমতী কাফে। জীবনের সব বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলো তার এইখান থেকেই হয়েছে। এইখানেই রামার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়েছে। রামা! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে চলল সে।

কে একটা পাড়ারই ছেলে বারকয়েক দোকানের সামনে পায়চারী করে টুক করে দোকানে ঢুকে পড়ল। যেন কোনও নিষিদ্ধ জায়গায় প্রবেশ করেছে। ঢুকেই ভজনের দিকে একবার ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে হাতের ইশারায় ডাকল চরণকে। এ-সব ছেলেদের চরণ চেনে। ওরা সব মত্ত ভজুলাটকে ভয় পায়। যদি খেপে গিয়ে একটা কিছু করে বসে।

বাদবাকি যে তিনজন বসেছিল, তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল ভজুর কথা। ফিসফিস করে। তিনজন যুবক। ব্রাহ্মণ। এখানে খেয়ে গিয়ে তারা পাড়ায় গল্প করে। বলে কত নিষিদ্ধ বস্তু তারা খেয়েছে। আর…আর ভজুলাট মাইরি ভারি মজাদার লোক। আমি একটি ঝোল চেয়েছিলুম মাংসের, তো মাইরি অ্যাত্তবড় একটা মাংসের টুকরো দিয়ে দিলে। ওখানে বসে একদিন মাল না খেতে পারলে শালা জীবনটাই বৃথা।

কিন্তু তাদের তো সে সাহস নেই। একজন বলল, মাইরি খচে গেছে।

আর একজন বলল, তুই পয়সাটা দিয়ে আয় না?

হ্যাঁ, তারপর আমার বাপান্ত করুক।

চরণের হাত দিয়ে পয়সা দিয়ে একে একে সবাই বেরিয়ে গেল।

রাত্রি বাড়ছে। চরণ তার ভাত বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পেছনের এই নিঃসঙ্গ ঘরটায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। সে বারবার মাঝের ফালি ঘরটা পেরিয়ে চলে আসে সামনের ঘরের দরজার কাছে। সামনে আসে না, যদি ভজু কিছু বলে। দরজার কাছ থেকে সে তার কালো মুখ বাড়িয়ে থাকে যেন একটা অন্ধকারের জীবের মতো। তবু সামনের ওই রাস্তাটা তো দেখা যায়।

মাঝে মাঝে পেছনের ছিটেবেড়ায় একটা ফট শব্দ শোনা যায়। চরণ বোঝে বাজারের সেই কান ঝোলা কুত্তিটা ল্যাজের ঝাপটা দিয়ে চরণকে ডাকছে। কোনও কোনওদিন যমদুতের মতো কুটে পাগলা তার পেছনের দরজায় এসে দাঁড়ায়। অনেক রাত্রে, যখন ভজু চলে যায়। এসে বলে, কী রে শালা কী করছিস? চরণ চমকে উঠে কয়লা ভাঙা লোহাটা হাতে নেয়। তার কী রকম ভয় হয় কুটে পাগলাকে। এক একদিন কুটে ভয় দেখাবার জন্যই বলে, কব রে শালা তোর ঘরে।তারপর বিকট দাঁত বের করে বলে, উঁ, শালা যেন আমার র‍্যাজাটে মাগ। চোখ পাকিয়েই আছে। খোল দরজা তোর কাছে শোব।

চরণ যেন তখন সত্যি একটা শঙ্কিত মেয়েমানুষের মতো প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, আয় একবার, তোর মুণ্ডুটা এইখানেই থেতলে দেব।

কুটে বলে হেসে, হেঁ হেঁ দে দে মাইরি, একটু কিছু দে নিয়ে কেটে পড়ি।

চরণ চপ কাটলেটের অবশিষ্ট তাকে দিয়ে দেয়। কুটে পাগলা শান্ত হয়ে ভেগে যায়। চরণ ও-সব খাবার কোনওদিন মুখে দিয়ে দেখে না। তার ভাল লাগে না।

.

রাত্রি বাড়তে থাকে। চরণ ভাত নামিয়ে বসেই থাকে। তখনও ভজন ওঠেনি। কখন উঠবে কোনও ঠিক নেই। এমন সময় আবার এল বাঙালি। তার লাল চোখে লজ্জা ও সংকোচের হাসি। এ লজ্জা তার এখান থেকে তখন ও-ভাবে চলে যাওয়ার জন্যই। এত শীতের মধ্যেও তার নীল কুর্তার বুক খোলা। বলল, কই ঠাকুর, ঘুগনি দেও।

ভজন মাথাটা তুলে বলল, অ্যাই যা। তাই তো ভাবি, বাবু গেলেন কোথায়। কোথায় মরতে যাওয়া হয়েছিল?

তেমনি হেসে বাঙালি বলল, মেয়েপাড়ায়।

মেয়েপাড়ায়? কেন রে?

আমাদের লবার বউ যে ছমাস ঘর ছেড়ে চলে এয়েছে গো। বেশ্যে হয়েছে।

কেন নবার কী হল?

একটু যেন বিরক্ত হয়েই জবাব দিল বাঙালি, তোমার বড় বেবভোম্‌ বাবু। গেল সালে লবা মরে গেল না? তাপর তোমাদের ওই তিলকঠাকুর ভুলিয়ে ভালিয়ে নে এল বউটাকে কাজ দেবে বলে। নিজে কদিন ফুর্তি করে ওই কাজ দিয়েছে এখন। ছেলেমানুষ তো। ..তা ওর কাছে গে এট্টু বসেছিলুম। খাওয়ালে ঠাকুর। কচুরি, গজা, সন্দেশ…। আমাকে বললে, ভাসুর, এসো মাঝে মাঝে।

বাঙালি দেখল ভজুলাট এক মনে তার কথাগুলো শুনছে। আর কী যেন বিড়বিড় করছে।

রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। শীতের রাত্রি। স্টেশনের রকে কয়েকজন মুড়িসুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আকাশটা প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে কুয়াশায়। কেবল শুকতারাটা অনেকখানি উঠে এসেছে পুব কোণ থেকে। …ভুনুর গাড়িটা তখনও রয়েছে। ভুনু ছিল না। কোথা থেকে হেঁটে এসে সে উঠল শ্রীমতী কাফের বারান্দায়।

বাঙালি আপন মনে তখনও বলছে, লবার সঙ্গে বে দে আমরাই তো নে এলুম তারকেশ্বর থেকে। এই এতটুকুন মেয়ে। আর এখন। পেখমে ছুঁড়ির পরে ভারী রাগ হয়েছে। আজ আর রাগ হল না। ঠাকুর, ভাবি কোনওদিন সবার কপাল আমার হবে।

ভাবতে পারে না। ভাবতে পারো না ভজন এ সমস্ত কথা। মনে হয়, তাকে যেন কেউ একটা জালের মধ্যে আটকে রেখেছে। মনে হয়, তার শিক্ষা দীক্ষা সম্মান শক্তি সমস্তটুকু নিয়ে সে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে। তার ভয় হচ্ছে। না, এতটুকু বিশ্বাস তার নেই। মত নেই, পথ নেই তার। তার চারিদিকে শুধুই বিভীষিকা! দাদার কথা মনে পড়ছে তার। সেই নির্ভীক শান্ত মুখ। কেন এত নির্ভয়, কীসের এত নির্ভয়। আমি তো পারিনে এত শান্ত থাকতে। আমার গৌর, নিতাই, যুঁই, আমার এই অন্তঃসারশূন্য শ্রীমতী কাফে, আমার বাবা, আমার দেনা, আমার ভয়, বেদনা, সুখ, দুঃখ, এসব ছাড়া যে আমার নিষ্কৃতি নেই। এত যে হা হা করে হাসি, এত যে নেশা করি, তাতে আমি যে আমার নিজেকে কখনওই ছাড়িয়ে উঠতে পারিনে। আমার যে কেবলই সব ধরে রাখার ভাবনা। ভাবনা, ভয়, উৎকণ্ঠা। এ যুগ ক্রুদ্ধ, বীভৎস, বিশ্বাসঘাতক। কতদিন এমনি জোর করে বেঁচে থাকত। বুঝি আমাকে হার মানতে হবে, অনুপযুক্ত প্রমাণিত হতে হবে এ যুগের কাছে।

হতাশা কী অসহ্য। অবসাদ কী দুরন্ত। কিন্তু তবু বার বউ মরতে যায়নি। ছি ছি, কেন মরতে যায়নি। নবার বউ গলায় দড়ি দিলে গৌরবের হত। কিন্তু আজ। আবার ভাবে, আজ নয়, যেভাবে হোক, মানুষ যে কেবল বাঁচতেই চায়! এই বাঙালি হয় তত একদিন বাঁচার জন্য ছুটে যাবে দেশে দেশে, আজ মরেনি, কালকে কালাধলা সাহেবের গলা টিপে শেষ করে দিয়ে জেলের ভাত খাবে, ফাঁসির দড়ি পরবে গলায়।

আর আমি? আমি শুধু পড়ে থাকব। মাথা তুলে সে মোটা গলায় আবৃত্তি শুরু করল,

এ মহানিদ্রা ঘুচিবে জানি,
আকাশে ধ্বনিবে অভয়বাণী।

ঠাকুর। বাঙালি ডাকল, এ আবার তুমি কী শুরু করলে?

কিছু নয়। বলে সে উঠে মদের বোতল নিয়ে এল। ভুনুকে ডাকল, এসো, আর কেন?

তারপরে তিনজনে তারা নিঃশব্দে মদ খায়। খেয়ে নিঃশব্দে ওঠে। ভুনু চলে যায় গাড়ি নিয়ে। বাঙালি বাড়ি না গিয়ে উত্তরদিকে হাঁটতে আরম্ভ করে। ভজন বাড়ির পথ ধরে।

শীতল রাত। অন্ধকার। ভজন চলেছে যেন অনেকখানি কুঁজো হয়ে। একদিন শ্মশান থেকে সে এমনি ফিরেছিল।

নিঃসঙ্গ একাকী চরণ। ঘুম নেই। পিছনের ঘরে এসে ইঁদুর-পাতা কলটা একবার দেখে। ছুঁচো তাড়া করে। কান ঝোলা কুত্তিটার সঙ্গে কথা বলে। আবার এসে শোয়। তার চওড়া বুকটা ভেদ করে একটা নিশ্বাস পড়ে। অন্ধকারে চকচক করে চোখ দুটো। বড় একা মনে হয় নিজেকে তার।

ঘড়ির পেণ্ডুলামে দোলে কঙ্কালের মুখটা। যেন বিশে দাঁত বের করে মাথা দোলাচ্ছে। টক টক টক।

ঠক ঠক ঠক। চলেছে রাত-পুলিশ। একটা সাইকেল চেপে চলেছে পুলিশ অফিসার। ছোকরা অফিসার। একবার তাকায় নিঝুম শ্রীমতী কাফের দিকে। তীক্ষ্ণ সন্দেহান্বিত চোখে।

.

সন্ধ্যাবেলা। চপ কাটলেট ভাজতে ভাজতে হঠাৎ চমকে উঠল চরণ। দেখল, পেছনের দরজা দিয়ে কাকে কাঁধে নিয়ে ঢুকছে রথীন। ঢুকে কাঁধের থেকে নামিয়ে শুইয়ে দিল মাঝের ঘরের বেঞ্চিতে। শোয়াল সুনির্মলকে। রিভলবার ছোঁড়া প্র্যাকটিস করতে গিয়ে তার হাতে গুলি লেগেছে। গুলি করেছে রথীন। টার্গেট দেখাতে গিয়ে আর হাত সরিয়ে নেওয়ার অবসর হয়নি সুনির্মলের।

সুনির্মলের হাতে ন্যাকড়া বাঁধা, কিন্তু সেটা লাল হয়ে উঠেছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। দাঁত চেপে চুপ করে আছে সে। যন্ত্রণায় কালো হয়ে উঠেছে মুখটা। চোখের কোণে জল জমে উঠেছে। কিন্তু নিঃশব্দ। এমন কি নিশ্বাসও চেপে ফেলছে। রথীন বলল, ভজুদাকে ডেকে দাও। কেউ যেন টের না পায়।

চরণ জানে রথীনকে। কয়েকদিন রথীন তার কাছে অনেক কাগজপত্র রেখে গিয়েছে। একদিন একটা সুটকেশ রেখে গিয়েছিল। আর একদিন ভোর রাত্রে তাকে দিয়ে ময়দায় কাই তৈরি করিয়ে নিয়েছিল দেওয়ালে পোস্টার মারার জন্য। ভজন এসে সব দেখে চমকে উঠল, এ কী ব্যাপার?

রথীন বলল সব কথা। ভজন অসহায়ের মতো বলল, তা এখানে এনেছিস কেন? এখুনি যে ধরা পড়ে যাবি?

কোথায় যাব? ভজনের চেয়েও অসহায় মনে হল রথীনকে।

ভজন হেসে ফেলল। শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর। চল তবে সব সুদ্ধ জেলে যাই।

এমন সময় প্রিয়নাথও এল সেখানে। বলল, মন্টুর কাছে ওর সংবাদ পেয়েছি। রথীন, তুমি এক কাজ করো, সন্তোষ মাসিমার কাছে চলে যাও। গিয়ে সব বলে, এখুনি তোমার সঙ্গে হরেন ডাক্তারকে নিয়ে এসো। ভজু তুমি কিছু টাকা দিয়ে দাও।

ভজন বলল, মাফ করো বাবা, এ সন্ধ্যার ঝোঁকে মালের দামটাও পুরো ওঠেনি এখনও।

বলেই ভজনের মনে হল সুনির্মলের যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টিটা তার দিকেই রয়েছে। কী মনে করে আবার বলল, শুধু তোরা মরিস না, আর একজনকে মেরে মরিস। নে, নিয়ে যা, যা আছে। বলেভজন ড্রয়ার খালি করে সব দিয়ে দিল রথীনের হাতে। রথীন বেরিয়ে গেল। প্রিয়নাথ কোলে টেনে নিল সুনির্মলের মাথাটা। বলল, চরণ, এ ঘরে বাতি নিভিয়ে তুমি কাজ করোগে। ভজন

প্রিয়নাথ ভজনের সময়বয়সী। ভজন কাছে এলে সে বলল, আজ কি তুমি নেশা করবে না?

একটু অবাক হয়ে ভজন প্রিয়নাথের দিকে তাকাল। বলল, করতে যাচ্ছিলুম, বাধা পড়েছে। পয়সা নেই, তা ছাড়া এখন আর মন চাইছে না।

প্রিয়নাথ বলল, এমনি হয়, কিন্তু মনটাকে একটু চাওয়াও ভাই। দোকানটাকে একটু মাতিয়ে রাখো।

ভজন যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। বলল, প্রিয়নাথ, ছোঁড়া বাঁচবে তো? আমার আশ্রয়ে এসে উঠেছে ও।

প্রিয়নাথ হেসে বলল, বাঁচবে বই কী।

জীবনে বোধ করি এই প্রথম ভজন অনিচ্ছায় নেশা করল। প্রথম রাত্রে রোজকার মতো জমে উঠল দোকান। কৃপালের সঙ্গে আজ সারদা চৌধুরীও কংগ্রেসের সভ্য হয়েছেন। কৃপালেরই কারসাজি। চৌধুরী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাঁড়াবেন। হীরেন বসে আছে খানিকটা অপাংক্তেয় হয়ে। তার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা ভাঁড়ামো বলে মনে হচ্ছে।

আটটা বেজে গেল। পুলিশ অফিসার একবার টহল দিয়ে গেল শ্রীমতী কাফের সামনে দিয়ে। ভজনের তা চোখ এড়াল না। মদ খেয়েছে, কিন্তু নেশা তার ধরেনি আজ। বাঙালি এসেছে। বসে আছে বারান্দায়। অপেক্ষা করছে প্রিয়নাথের জন্য। প্রিয়নাথ তাকে আসতে বলেছিল। কিন্তু জানে না, প্রিয়নাথ পেছনের ঘরেই রয়েছে।

ইতিমধ্যে সুনির্মলের ড্রেস হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়ে চলে গিয়েছেন কয়েক মিনিট আগে।

প্রিয়নাথ বলল, রথীন, রেল মজুরদের সম্পর্কে সেই কার্বন কপির ইস্তাহার লেখা হয়েছে?

রথীন জানালো, হয়নি। হয়নি, তা জানত প্রিয়নাথ। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, তোমার এই গুলি ছোড়াছুড়ির চেয়ে সেটা অনেক দরকারি কাজ ছিল রথীন।

রথীনের মুখ রাগে থঙ্কমিয়ে উঠল। আরও কয়েকদিন এমনি কথা সে শুনেছে প্রিয়নাথদার মুখে। তাতে তার রাগ হয়েছে, ঘৃণা হয়েছে, অবিশ্বাস ও সন্দেহ উঁকি মেরেছে তার মনে। ইনি নারায়ণদার সহকর্মী। বেশির ভাগ সময়েই বাইরের নানান জায়গায় ইনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। নারানদার অনুপস্থিতিতে ইনিই নেতা। কিন্তু সম্প্রতি ওঁর মুখে নতুন একটা কথা শোনা যাচ্ছে, সমাজতন্ত্রবাদ। কথায় কথায় মজুর কৃষক আন্দোলন। সেখানে রথীনের কোনও প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু সমিতির জীবনের প্রতি ওঁর কোনও দায়িত্ববোধ নেই।

রথীন জবাব দিল, আমি বলছি, দরকার ছিল।

প্রিয়নাথ মর্মাহত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ভাবে?

রথীনের চওড়া চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। হাতের মুঠি পাকিয়ে চাপা গলায় বলল সে, রেলের ইউরোপিয়ান ইয়ার্ড ম্যানেজারকে আমরা গুলি করে মারব।

ভুল প্রিয়নাথের মুখ দিয়ে খালি একটা কথা বেরিয়ে এল। অনেক কথা বলতে চেয়েছিল সে। কিন্তু কী বলতে হবে, সব কথা তার জানা নেই।

রথীন বলল, ভুল কেন? সমাজতন্ত্রে কি শত্রুকে মারা হবে না?

হবে, নিশ্চয়ই হবে কিন্তু এ ভাবে নয়। কিন্তু কীভাবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা প্রিয়নাথেরও নেই। শুধু, এটা সে জেনেছে সমাজতন্ত্রের আন্দোলনে, গণসংগঠন পূর্ণমাত্রায় হলে শত্রুকে আঘাত করতে হবে। অর্থাৎ সর্বহারা বিপ্লবে গণসংগঠিত হলে শ্রমিকরাই সাহেবদের মারবে। সে বলল, মারব ঠিকই রথীন, কিন্তু শ্রমিকরা আমাদের সঙ্গে থাকবে।

রথীনের মনে হল, তাতে সব ভেস্তে যাবে। উপরন্তু তার মনে সন্দেহ ঘনিয়ে এল আরও গুঢ় হয়ে। ভাবল, কাপুরুষের মতো কথা বলছেন প্রিয়নাথদা। হয়তো তিনিও অহিংস আন্দোলনের পথে চলে যাবেন। সে খালি তীব্র গলায় বিদ্রূপ করে বলল, নারানা থাকলে আপনি হয়তো এ কথা বলতেন না।

প্রিয়নাথ জবাব দিল, বলতুম, একশোবার বলতুম, রথীন। এই আমার বিশ্বাস।

রথীন তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে প্রিয়নাথের দিকে। পকেটে তার লোডেড রিভলভার। তার ক্রুদ্ধ অবুঝ মনটার মধ্যে সমাজতন্ত্রবাদ একটা অন্য রকমের আপসের মতোই মনে হতে লাগল। শ্রমিক বিপ্লব একটা ধোঁয়াটে সংস্কার। এই ধোঁয়াটে ভাবের মধ্যে তার কেবলি সুনির্মলের রক্তাক্ত হাতটার কথাই মনে পড়ছে। তার সন্ত্রাসবাদী জীবনে এ লজ্জা ও বেদনা রাখবার ঠাঁই ছিল না। তার উপরে এক দুর্বোধ্য আদর্শের দ্বারা তার প্রায় আজন্ম লালিত বিশ্বাসের প্রতি আঘাত সে সইতে পারছে না।

সে খালি বলল, আপনি আর কোনও কথা আমাকে বলবেন না।

প্রিয়নাথও বুঝতে পারছিল রথীনের মনের অবস্থা। সে বুঝতে পারছে, রথীন অস্থির হয়ে উঠেছে। ওর রাগ হচ্ছে। এমনকী এ রাগ একটা বিশ্রী ঘটনাও ঘটিয়ে দিতে পারে। তবু এ রাগ অস্বাভাবিক নয়, অন্যায় নয়। কেন না, সে পরিষ্কার করতে পারছে না তার মনের কথা। বলতে পারছে না, তার পথ দীর্ঘদিনের, ধৈর্যের এবং যন্ত্রণার পথ। তারও মনের মধ্যে একটা অসহ্য ছটফটানি নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার জন্য। কিন্তু রথীন একটা কিছু করে বসতে পারে। না করলে হয়তো ওর শাস্তি হবে না।

সে বলল ঠাণ্ডা গলায়, বলব না। তবু একটা অনুরোধ করব, ইয়ার্ড ম্যানেজারকে এখন মেরো। তাতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।

রথীন আরও খানিকটা ঝাঁজ দিয়ে বলল, আপনার নীতিতে হয়তো তাই।

বলে সে বেরিয়ে গেল। কিন্তু মনে মনে, এটা সে বুঝল, ম্যানেজার মারা মতব তাকে ত্যাগ করতে হবে। প্রিয়নাথদার অমত মানে, সমিতির সকলের মনের মধ্যেই একটা সংশয় এসে পড়বে। তা ছাড়া সুনির্মল অসুস্থ।

প্রিয়নাথ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। রথীনের উপর সে রাগ করতে পারছে না, কিন্তু অপমানে জ্বলে যাচ্ছে তার বুক। রথীনের চোখ মুখে কী অসহ্য ঘৃণা, অবিশ্বাস ও সন্দেহ। মতাদর্শের বিরোধ নয়, রথীন তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান। নিজেকে একবার দেখে নেওয়ার জন্য যেন সে মনের তলায় ড়ুব দিল। সত্যই কি তার চরিত্রে কোনও মালিন্য দেখা দিয়েছে। তার বিশ্বাস কি কলঙ্কের পথ ধরেছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তারও মনের মধ্যে ক্রোধ জ্বলে উঠল। ধকধক করে জ্বলে উঠল তার চোখ দুটো। মনে হল রথীনকে অত কথা বলতে দেওয়ার আগে উচিত ছিল, একটি ঘুষিতে ওকে স্তব্ধ করে দেওয়া। ওর পকেট থেকে রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে, হাত দুটো মুচড়ে ভেঙে ফেলে রাখা উচিত ছিল।

ভজন এল এ সময়ে চরণকে একটা হাঁক দিয়ে। এসে বলল, কেমন ভাল তো? উঃ, মাইরি কী আয়োডিনের গন্ধটাই বাইরে যাচ্ছিল। ভাবলুম, দিলে ঠেলে সবসুদ্ধ!

শান্ত হয়ে এল প্রিয়নাথের মন। এতখানি রাগের জন্য নিজেকে ছিছিকার দিয়ে উঠল সে। বরং উল্কা এল তার মনে। ভাবল, রথীন হয়তো সত্যি একটা কিছু করে বসবে। ওর কাছেই যাওয়া উচিত আমার এখুনি। ওকে বোঝাতে হবে। ভুলে যাচ্ছি এ গাছ আমরাই পুঁতেছি। সত্যি, সেকথা ভাবলে যে, আমারই হাত নিসপিস করে ওঠে। ইচ্ছে হয়, ইয়ার্ড ম্যানেজারকে সাবাড় করে দিয়ে আসি এই মুহূর্তে। সে বলল, ভজু, আমি এবার যাচ্ছি। ও এখন ভাল আছে। তবে খুবই সাবধান, ধরা পড়ে গেলে ভয়ানক গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

ভজন বলল, বাঙালি যে তোর জন্য বসে আছে?

আজ আর ওর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। তুমি ওকে বাড়ি যেতে বলে দিয়ে। আর…সুনির্মল রইল। হয়তো রথীন আবার আসবে রাত্রে। তবু তুমি চরণকে একটু সাবধান করে দিয়ো।

বলে সে নর্দমা পেরিয়ে রাবিশ মাড়িয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।

বাইরের ঘরে ভিড় ঝিমিয়ে এসেছে। কৃপাল চলে গেছে তার সাঙ্গপাঙ্গসহ। হীরেন বসে আছে একলা। আগামী কাল মহকুমা কংগ্রেসের সাধারণ সভ্যদের একটা সভ্য হওয়ার কথা আছে। নবীন গাঙ্গুলী আসবেন সেখানে। তিনিই প্রেসিডেন্ট। সেখানে হীরেনের অনেক বক্তব্য আছে। তাই ভাবছে সে। কিন্তু সচেতন চোখ এড়ায়নি ভিতরের ঘরে একটা কিছু ঘটছে। কিছুটা সে আন্দাজও করেছে এবং সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে কোনও গণ্ডগোলের আশঙ্কা করেছে সে। সে বুঝতে পেরেছে রথীনদেরই কোনও ঘটনা ঘটেছে। শুধু এই নয়, আরও অনেক কথা তার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এমনকী বাঙালির বসে থাকার ধরন দেখেও তার মনে হচ্ছে, সে নিশ্চয়ই কোনও কারণে এসেছে। কিন্তু হীরেন কিছু বলেনি। সে বলবে না। দেশের যাতে ভাল হয়, তাই যদি ওরা করে করুক, কিন্তু কোনও অকারণ গণ্ডগোল ও রক্তপাতের সৃষ্টি যেন না হয়। কিন্তু রামার হাসি কী দুর্নিবার হয়ে উঠেছে দিন দিন। প্রায়ই দেখা যায়, একটা জোয়ান ডোমের ছেলে ওর পিছনে পিছনে ফেরে। কেন?

বসে আছেন গোলক চাটুজ্যে মশাই। কিছুক্ষণ আগেই তিনি এক ঠগের গল্প জুড়েছিলেন, যে কথা শুনে সারদা চৌধুরী উঠে পড়তে বাধ্য হয়েছেন।

বাঙালি ঘুমিয়ে পড়েছে বারান্দার উপরেই। একটা লোক মাংসের হাড় চিবুচ্ছে। নিরালা পেয়ে, মনের সুখে চোখ বুজে দাঁত খিঁচিয়ে, কটমট করে চিবোচ্ছে। তারপর হঠাৎ যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, হাড়ে আর এটুও মাংস নেই। হাঁপিয়ে পড়েছে। হতাশার নিবাস পড়ল একটা।

ভজন তাকিয়ে দেখল সুনির্মলকে। ঘাড় এলিয়ে শুয়ে আছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা আটকে দিয়েছে গলায় সঙ্গে, কাপড়ের ফালি দিয়ে। মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ। নিশ্বাস পড়ছে তো? পড়ছে। সে কী বলবার জন্য মুখটা তুলতে গিয়ে বলতে পারল না। হঠাৎ তার দম বন্ধ হয়ে এল। মুখটা লাল হয়ে উঠল। পেটে একটা ভীষণ ব্যথা উঠছে। এমনি হঠাৎ ব্যথাটা উঠে যেন তার সমস্ত চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দেয়। অসহ্য। বাড়ি যেতে হবে। সে একটা কবিতা বলতে যাচ্ছিল। আজকের রাতটা আর ঘুমোসনি—দেখিস একে। ভাবল বিপদ আসতে পারে দোকানে পুলিশ আসতে পারে কাল সকালে। কিন্তু ওকে ফেলে তো দিতে পারিনে। যদি শ্ৰীমতী কাফে বিসর্জন যায় সেটা ভাববার অবকাশ পরে পাব।

.

সকালে নারায়ণ বসেছিলেন নিজের ঘরে। কিছুক্ষণ আগে ভজনের দুই ছেলে গৌর, নিতাই তাঁর সঙ্গে ভাব করে গিয়েছে। নারায়ণ ভাবছিলেন হালদারমশাইয়ের কাছে গিয়ে বসবেন। গতকাল রাত্রে বকুলমা এসেছিলেন, আবার হয়তো আসবেন এখুনি। আসবে হয়তো আরও অনেকে। প্রতিবেশী গুরুজনেরা, ছেলেরা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে একটা কথা তার মনে পড়ছিল। ভাবছিলেন, নিজের অন্নসংস্থানের কথা। এ ভাবে ভজনের উপর তিনি কতদিন থাকবেন। অবশ্য একথা ঠিক, নারায়ণের ভাবনা নেই। তাঁকে আহার ও আশ্রয় দেওয়ার জন্য অনেকেই উদগ্রীব। কিন্তু এখানে থেকে তো তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, নিজের কাজও তাঁর এখানে থেকে বেশি দিন চলবে না।

এমন সময় একটি ছেলে একে তাকে প্রণাম করল। বছর বারো বয়স ছেলেটির। মুখোনি যেন চেনা চেনা, তবু মনে করতে পারলেন না কিছুতেই কার ছেলে, কোথায় দেখেছেন। এই টানা টানা ভূ আর চোখ, টিকালো নাক আর উজ্জ্বল শ্যাম রং, এমনি মুখের ছাঁদ যেন খুবই চেনা। জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী তোমার?

শ্রীনবীন ভট্টাচার্য। বলতে বলতে ছেলেটির নজর চলে গেল দরজার দিকে।

তাকে কাছে টেনে নিলেন নারায়ণ। নবীন বিস্মিত চোখে নারায়ণের দিকে তাকাল।

নারায়ণ বললেন, তোমার বাড়ি কোথায়?

রানাঘাট।

এখানে কোথায় এসেছো?

মামার বাড়ি।

কোথায় মামার বাড়ি?

গঙ্গার ধারে।

একেবারেই চিনতে পারলেন না নারায়ণ। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবার নাম কী?

শ্রীননীমাধব ভট্টাচার্য।বলতে বলতে নারায়ণের দিকে তাকানো তার বড় বড় চোখের মণি দুটো আবার ঘুরে গেল দরজার দিকে।

নারায়ণও সেদিকে তাকালেন। দেখলেন, খয়েরি রং চেক শাড়ি উঁকি দিয়ে আছে সেখানে। মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি আবার তাকালেন ছেলেটির দিকে। ভয় যেন অনেকখানি কেটেছে। খানিকটা তন্ময়তা এসে গিয়েছে কিশোর নবীনের চোখে। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, এ মানুষটি তার সেই মানুষটি কিনা। হঠাৎ বলল, আমার মা এসেছে।

তোমার মা!

বলতেই খয়েরি শাড়ি ঘরে ঢুকে এল। এসে প্রণাম করল নারায়ণকে। নারায়ণ শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আহা, কী করেন। বসুন।

নবীনের মা বসল। বসে বলল মাথা নিচু করে, আমার নাম প্রমীলা। বাবার নাম, শ্রীনকুলেশ্বর পাঠক।

বুঝেছেন, বুঝেছেন নারায়ণ। আর বলতে হবে না। সেই পাঠকবাড়ির মেয়ে, মেয়ে নয় সেই বালিকা। বুকের মধ্যে ধ্বক্ করে উঠল বিপ্লবী নারায়ণের। তাই তাঁর মনে হচ্ছিল নবীনাকে দেখে, এ মুখ যেন চেনা। নবীন কিশোর, সে ছিল কিশোরী, কিন্তু একটি-ই মুখ যেন।

দেখলেন, বয়সের ভার ও গম্ভীর হয়েছে প্রমীলার মুখ। একহারা মেয়ে দোহারা হয়েছে। মাথায় ঘোমটা নেই। চুলের গোছ আছে তেমনি। ঘাড় আর পিন জুড়ে খোপা একটু এলোমেলো। গায়ের রং যেন আরও ফরসা হয়েছে।

একটা মুহূর্তে সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল নারায়ণের। নানান কথা মনে পড়ছে। সব বাজে কথা। সেই কথা, একদিন বিয়ে বসতে চেয়েছিল এই মেয়ে নেকো হালদারের বড় ছেলের সঙ্গে। হাসির কথা। কী হাসির কথা বলতেন ঠাকমা, নাতনি আমার শিব গড়ে যেন হালদারের বড় ব্যাটা। তার চেয়েও হাসির কথা, নারায়ণের প্রায় কৈশোরোত্তর বয়সের সেই গোপনউন্মাদনা। নাম না জানা বিচিত্র অনুভূতি। অনুভূতি নয়, পাগলামি। পাগল না হলে গাধারের পাড়ায় কেন বারবার ছুটে যেতে হত। শুধুই পাগলামি। আর সেই পাগলামি আজও বুকের মধ্যে কী এক কাঁটার মতে যেন খচখচয়ে উঠছে। নিখাস জমে জমে ভার হয়ে আসছে বুক! বুকের মধ্যে ঢাকাটুকি দেওয়া একটা মুখ, একষ্ট অন্ধকার আচ্ছন্ন মুখের ঢাকনা কে যেন হুস করে উড়িয়ে দিল। সাধ নেই, ইচ্ছাও নেই, অথচ মেঘের মতো আপনা আপনি ফল যেন জমে উঠেছে থরে থরে, বুকের মাঝে। এই মাটির সংসারে বোধকরি তার কোনও বাস্তব রূপ নেই। থাকতেও পারে না। বুঝি জানাজানি নেই সেই গোপন অন্ধকার মুখটির সঙ্গে মানুষটির।

কারও মুখেই কথা নেই। আর একজনও চুপচাপ। তাকে দেখে মনে হয়, সে ঘরানা ঘরের বউ। তার দুঃখ নেই, দারিদ্র্য নেই। নবীনের মতো তার ছেলে আছে। নিশ্চয় আছে উপযুক্ত স্বামী। বোধ হয় লজ্জা করছে। হাসি ও সংকোচে ভরা মুখ। তুলি তুলি করেও তোলা যাচ্ছে না। তারপরে হঠাৎ বলে ফেলল, ঠাকমা মরে গেছে।

বলে ফেলেই মুখটা নামিয়ে নিল প্রমীলা। ঠাকমার কথা বলতে গিয়ে চোখে বড় বড় ফোঁটার জল জমে উঠেছে।

আশ্চর্য, প্রথমেই ঠাকমার কথা কেন। তা ছাড়া আর কে আছে। কে ছিল আর সেদিন তাদের মাঝখানে। ঠাকমা যেন তাদের কৈশোরের দূতী। রাধার সঙ্গিনী বড়ায়ির মতো।

নারায়ণ বললেন, আহত গলায়, কত দিন আগে?

আজ তিন বছর। চোখের জল মুছল প্রমীলা।

নারায়ণ নিশুপ। প্রমীলা আবার বলল, আপনার কথা খালি বলত।

আবার জল এসে পড়ল চোখে। কত যে কথা ঠাকমার। সে সব কথা মনে মনে করলে কান্না রোধ করা যায় না। সে কান্না হলই বা প্রমীলার পক্ষে লজ্জার। কোনও পাপ তো সে করেনি। ঠাকমা কত দিন অকারণ তাকে এই মানুষটির কথা বলেছে, ঠাকমাও যেন কেমন একরকম করে ভালবেসেছিল এই মানুষটিকে। কেমন একরকম করে তারও মনের মাঝে এ মানুষটি রইতে বসতে রয়ে গিয়েছে। কোথায়, তা জানে না। বিবাহিত জীবনে মনে হয়েছে পাপ, কিন্তু কোথায় রয়েছে সে পাপ না জানলে কেমন করে তাড়াবে। এই যে চোখের জল, সে কোথায় আছে কে জানে। তবু সে সময় হলে না এসে পারে না। কে কাকে তাড়াবে।

থাক। কী হবে সেসব কথা বলে। নারায়ণ নড়েচড়ে বসলেন। নেহাত কথার কথা, কবে এসেছ শ্বশুরবাড়ি থেকে?

এক মাস। চলে যাবার কথা ছিল, যাইনি। বোধ হয় আপনাকে দেখব বলেই যাওয়া হয়নি।

নারায়ণ হা হা করে হেসে উঠলেন এতক্ষণে। কিন্তু গুমোট কাটল না তাতে।

প্রমীলা আবার বলল, হাসি নয়। নারায়ণদা, আপনার জন্যে বড় ভাবনা ছিল।

নারায়ণ আবার হেসে উঠতে চাইলেন। প্রমীলা কী অদ্ভুত ছেলেমানুষ। যেন কোনও পার্থক্য নেই ওর সঙ্গে ওর ছেলেটার।

প্রমীলা কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলে গেল তার নিজের কথা, এ সংসারে সবাই উলটোটা ভাবে। তাই কোনও দিন কাউকে মনের ভাবনার কথা বলতেও পারিনি। কিন্তু নারায়ণদা, আপনি তো উলটো বুঝবেন না। দিনরাত লুকিয়ে লুকিয়ে ভগবানকে ডেকেছি। দিন-রাত।

কেন ডেকেছে সেকথা বলার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু নারায়ণের বুকের মধ্যে নিশাস আটকে এল। তাঁর কঠিন অটল প্রাণ এই মেয়েটির কাছ থেকে এসব কথা শোনার জন্য এক মুহূর্ত আগেও প্রস্তুত ছিল না। আচমকা তার হৃদয়ের গোপন ক্ষতটা যেন কে সকলের সামনে খুলে দেবার মতলব করেছে। কিন্তু কী যে বলবেন, সে কথাটা পর্যন্ত মুখে জোগাল না।

প্রমীলা তার জলভরা চোখ দুটো এবার তুলে ধরল নারায়ণের দিকে। বলল, জেলে তো শুনেছি ওরা খুবই অত্যাচার করে।

নারায়ণ নবীনের মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বললেন, তা করে। প্রথম দিকে করেছিল, শেষের দিকে হাল ছেড়ে দিয়েছিল।

একটু হেসে আবার বললেন, ওরা শুধু অত্যাচারই করে। মানুষকে তো দেখেছ, যে যত দুর্বল হয়, তত তার অত্যাচার বাড়ে, আমাদের মাথাও তত উঁচু হয়। প্রমীলা, একটা কথা বলি। কেবলই দুশ্চিন্তা করে ভগবানকে ডেকে ডেকে তাঁকে বিব্রত করো না। আমার সুখের জন্য বারবার তাঁকে বললে তিনি বিমুখ হবেন। বলল, এ জীবনে যেন হার মানতে না হয়। যদি হার মানি, তবে একশো বছরের পরমায়ু নিয়ে বেঁচে থাকাও যে অভিশাপ।

প্রমীলা বলল অসহায়ের মতো, এত কথা যে বুঝি না। কিন্তু, আপনি হার মানবেন, একথা ভগবান এসে বললেও আমি মানতে পারব না। তা হলে যে সবই যাবে।

একথা শুনে নারায়ণের বদ্ধ প্রাণটার দরজা যেন খুলে গেল। বললেন, সত্যি, তা হলে সবই যাবে। কিন্তু হার মানব না আমরা। তোমরা দিন-রাত কামনা করছ, সে কি কখনও ব্যর্থ হয়?

কী কথা বলতে গিয়ে প্রমীলা চুপ করে রইল। শুধু দেখল, নারানদার সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, কীসের স্বপ্নে যেন তলিয়ে গিয়েছেন।

এবার নবীন সুযোগ বুঝে বলল, মা, বলি?

প্রমীলা একটু হেসে সম্মতি দিল। নবীন ডাকল, মামাবাবু।

নারায়ণ হেসে বললেন, বলো বাবু।

আপনি সায়েব মেরেছেন?

মারলে কি তুমি খুশি হও।

নবীন গম্ভীর গলায় বলল, হই, সায়েবগুলো সব মরে গেলে আরও খুশি হই।

কেন বলো তো?

ওরাই তো আমাদের দেশটাকে পরাধীন করে রেখেছে।

নারায়ণ তবু বললেন, কী করে বুঝলে?

একটু বিব্রত হল নবীন, বলল, ওরা কেন আছে আমাদের দেশে? আমাদের দেশে ওরা কেন রাজা হবে? মামাবাবু, আমি আপনার সঙ্গে থাকব।

সত্যি? নারায়ণ একবার প্রমীলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার মা কেন থাকতে দেবেন?

মা-ই তো বলেছে। আপনার মতো হতে পারলে, মা মনেও দুঃখ থাকবে না।

নারায়ণ হেসে উঠলেন। জড়িয়ে ধরলেন নবীনকে কোলের কাছে।

প্রমীলা বলল, ওকে আপনি আশীর্বাদ করুন না। আপনাকে একটিবার দেখার জন্য ও পাগল হয়ে উঠেছিল। এমনি পাগল ছেলে যে, এখান সেখান থেকে ঘুরে এসে বলে, নারানমামাকে দেখে এলুম। অথচ আপনাকে কোনও দিন ও চোখেও দেখেনি।

তারপর হাত বাড়িয়ে প্রণাম করে বলল, নারানদা, আমি আপনার কেউ নই, তবু কালে ক্কচিৎ একটা চিঠি দিয়েও যদি জানান কেমন থাকেন, তবে বেঁচে যাই।

নারায়ণের পক্ষে কথা দেওয়া সম্ভব নয়। বললেন, স হলেই দেব প্রমীলা।

নবীনও প্রণাম করে উঠল। যেতে গিয়েও আবার দাঁড়াল প্রমীলা। বলল, একটা কথা বলে যাই। নারানদা, আমার টাকা পয়সা সোনার অভাব নেই, আমার স্বামীও আর দশজনের মতো ভাল মানুষ। তবু একবার যদি আপনি আমার ঘরে পায়ের ধুলো না কেন, তা হলে মরেও আমার কোনও অভাব ঘুচবে না। যাবেন তো?

নারায়ণের মুখে কথা ফুটতে চায় না। প্রমীলার পক্ষে এ দাবি কতখানি শোভন, সে ভাবনার চেয়েও বড় ভাবনা, কেমন করে নারায়ণ কথা দেবেন। হয়তো আজ বাদে কাল তাঁর জীবনে নতুন কোনও অভিশাপ নেমে আসবে, হয়তো আচমকা নেমে আসবে মৃত্যু, কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে সে যে নিজের জীবনেও আক্ষেপ থেকে যাবে। আবার মনে হল, এ ডাকে সাড়া দিয়ে একবার না গেলে এ জীবনের অনেকটাই যেন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সে ব্যর্থতার কথা মুখ ফুটে কাউকে বলার নয়। বলা যাবে না কোনও দিন। আজকে প্রমীলা না এলে কথা ছিল না। কিন্তু আজকের পর, যাব না, বলার মতো নিষ্ঠুরতা তিনি কেমন করে করবেন।

নারায়ণ বললেন, যাব, সময় এলে একদিন নিশ্চয় যাব।

সে সময়টি যেন আমার মরণের আগে হয় নারায়ণদা, বলে প্রমীলা নবীনের হাত ধরে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যেতে গিয়ে সব ঝাপসা হয়ে গেল চোখের সামনে।

উঠানের উপর পথরোধ করে দাঁড়াল যুঁই। মা ও ছেলের হাত ধরে বলল, খোকাকে না খাইয়ে নিয়ে যেতে পারবে না দিদি। বলে সে দুজনকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। কেন জানি না, তারও দুই চোখের কোল ছাপিয়ে জল এসে পড়ছে। একই নোনা স্বাদের সমুদ্রের অতলে ড়ুবে গেল তাদের দুজনেরই হৃদয়। এই চোখের জলের বেদনার সমান একটা লজ্জা ও সঙ্কোচ ছিল কিন্তু তাকে ঢেকে রাখার অবকাশ ছিল না কারওই। আর শিশু নবীন খেতে খেতে এই দুটি নারীকে কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গেই দেখছিল।

তারপর তাদের চোখের জল খানিকটা প্রশমিত হলে, প্রথমে প্রমীলার মুখেই রক্ত ফুটে উঠল। যুইয়ের চোখের দৃষ্টি যেন তার মনের শেষ পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি নিজের অতিভ ভাবটা কাটিয়ে প্রমীলা বলল, ভাই বউদি, তোর সঙ্গে একটা বড় বিবাদ আছে।

যুঁই বলল হেসে,বেঁচে যাই ভাই ঠাকুরঝি। সত্যি, একটু ঝগড়া করে যাও।

প্রমীলা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ঠাট্টা নয়। যা শুনছি, এ ভাবে চললে কতদিন এ সংসার টিকে থাকবে। ভজুদার হাল কি তুই একেবারে ছেড়ে দিইছিস?

যুঁই তবুও হেসে বলল, আমি হালদারনী, হাল ছাড়লে কি আমার চলে? কিন্তু ভাই ঠাকুরঝি, হালে যে পানি পাইনে।

বলতে বলতে তার গলার স্বর করুণ হয়ে উঠল। প্রমীলা এক মুহূর্ত নির্বাক থেকে বলল, জানি ভাই বউদি, তবু এত বড় সংসার, দেখে বড় ভয় হয়। ওই শ্রীমতী কাফে না কি, সেটুকু তো সম্বল। তাও আর দশজনের সঙ্গে ভজুদা, ওটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এ বিশ্বের পুরুষমানুষেরা কী নিয়ে মেতে আছে জানিনে, কিন্তু এ অন্ধকার ঘরের কোণ থেকে ওরা আমাদের কোথায় ভাসাচ্ছে, সে সংবাদটুকুও তো জানাবে?

না, জানাবে না। যুঁইয়ের গলার স্বর তীব্র হয়ে উঠল। বলল, শুনি দেশোদ্ধারের জন্য বাই মেতে উঠেছে। ভাবি, আমাদের উদ্ধারের জন্য আমরা কবে দাঁড়াব।

প্রমীলা বিস্মিত চমকে যুঁইয়ের মুখের দিকে তাকাল। বলল, বউদি ভজুদাকে কি তুই–

যুঁই তাড়াতাড়ি বলল, উলটো বুঝে না ভাইঠাকুরঝি। চাপা পড়া বুকে তুমি নাড়া দিলে, তাই বললুম। সব দিয়েও যদি শুধু ওই তোমাদের ভজুদার মনটি পেতুম, তবে বাঁচতুম। কিন্তু আমি তারও দোষ দিইনে। নিজের মন নিয়ে সে হাঁসফাঁস করছে, আমি আর বোঝা বাড়াব না।

কীসের হাঁসফাঁস বউদি?

তা জানিনে।

দুইজনেই তারা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ যুঁই বলল, সবখানেই এমনি ওলটপালট ঠাকুরঝি, দোষীকে খুঁজে পাইনে। নইলে বলো–

তাকে থামতে দেখে প্রমীলা বলল, থামলি যে?

যুঁই বলল, নইলে বলল, আজ তুমি এই বাড়িতে এমনি করে এসে ঘুরে যাবে কেন? ওই ঘর থেকে–

চুপ, চুপ, চুপ কর বউদি। ভয়ে লজ্জায় একেবারে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল প্রমীলা।  চাপাগলায় ফিসফিস করে বলল, এ-সব তুই কি বলছিস বউদি। ওকথা আমার শুনতে নেই। তার চোখ ছাপিয়ে জল এসে পড়ল। জল এসেছে যুঁইয়ের চোখেও। মনে মনে বলল, ভাবতে নেই কেন। সত্যকে ড়ুবিয়ে প্রাণ পোড়ানোর জন্য বেঁচে থাকা কেন, কীসের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *