৫. ললিত-লতা

ললিত-লতা
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এক

ইন্দুবাবুর সঙ্গে সোমনাথের আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়াছিল। তিনি মাঝে মাঝে তাহাকে নিজের বাসায় নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ করিতেন। ইন্দুবাবুর স্ত্রী রন্ধনে সুনিপুণা, তাঁহার হাতের চিংড়িমাছের মালাইকারি ও কাঁকড়ার ঝাল খাইয়া সোমনাথ পরম তৃপ্তিলাভ করিত।

আহারের পর ইন্দুবাবু গড়গড়ার মাথায় খাম্বিরা তামাকুর তাবা চড়াইয়া নল হাতে লইয়া বসিতেন; তখন তাঁহার মুখ দিয়া নানা প্রকার মজার গল্প বাহির হইত। নিম্নোক্ত কাহিনীটি তিনি একদিন সোমনাথকে শুনাইয়াছিলেন। কাহিনীর মধ্যে কোনও প্রচ্ছন্ন হিত-উপদেশ ছিল কিনা তাহা বলা যায় না; সম্ভবত অভিজ্ঞতার বিবৃতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমরা গল্পটি ইন্দুবাবুর জবানিতে প্রকাশ করিলাম।

ছয় বছর আগে এ গল্পের আরম্ভ হয়েছিল। তখন আমি কলকাতায় থাকি। সাহিত্যচর্চার ফাঁকে ফাঁকে গান গাইতাম। গলাটা তখন ভাল ছিল; রবিবাবুর গান গাইতে পারতাম।

সাহিত্যিক হিসেবে যত না হোক, রবীন্দ্রসঙ্গীতের অবৈতনিক গায়ক রূপে কলকাতার অভিজাত সমাজে আমার বেশ মেলামেশা ছিল; কোথাও পার্টি বা জলসা হলেই আমার নেমন্তন্ন থাকত। সেই সূত্রেই দিগ্বিজয়ী ব্যারিস্টারের মেয়ে লতার সঙ্গে পরিচয় হয়। লতা কিছুদিন আমার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখবার জন্যে খুব ঝুঁকেছিল; আমিও শেখাবার চেষ্টা করেছিলাম। লতার প্রাণে দুরন্ত আবেগ ছিল—কিন্তু তার গলায় সুর ছিল না–

একটা কথা গোড়াতেই বলি রাখি, এটা লতা ও ললিতের গল্প; আমি দর্শক মাত্র। লতাকে তুমি চিবে না; বড়লোকের মেয়ে এবং কলকাতার বিশিষ্ট অতি-আধুনিক সমাজের মুকুটমণি হলেও সাধারণের কাছে সে অপরিচিতা; কিন্তু ললিতের নাম নিশ্চয় শুনেছ; পর্দায় তাহার চেহারাও দেখেছ বোধহয়–বাংলা চিত্রাকাশের উজ্জ্বল পুং তারকা।

আগে লতার কথাই বলি। এমন আশ্চর্য মেয়ে আমি দেখিনি। তখন তার বয়স সতেরো কি আঠারো; একটু পুরন্ত গড়ন দেখলে মনে হয় রজনীগন্ধার বোঁটায় একটি চন্দ্রমল্লিকা ফুটে আছে; কিন্তু কী তার মনের তেজ, যেন আগুনের ফুলকি। আর তেনি কি সরলতা! মনের কথা লুকোতে জাত না; মাঝে মাঝে হঠাৎ এমন কথা বলে বসতো যে শ্রোতাদের কান লাল হয়ে উঠতো, তার বাবা লজ্জিত হয়ে পড়তেন; কিন্তু লতার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

মেয়েটাকে আমার বড় ভাল লাগত; ঠিক যেন শেক্সপীয়ারের মিরান্ডার সঙ্গে ক্লিওপেট্র মিশেছে। সরলতা আর তেজ। মাঝে মাঝে ভাবতাম, এ মেয়ের জীবনের ধারা শেষ পর্যন্ত কোন বিচিত্র খাতে বইবে কে জানে! সাধারণ গতানুগতিক খাতে যে বইবে না তা অনেকটা অনুমান করেছিলাম।

তাকে দুচার দিন গান শেখাতে গিয়েই বুঝতে পারলাম, গান গাওয়া তার কর্ম নয়। গলায় সু নেই; ভগবান মেরেছেন; কিন্তু কথাটা তাকে বলতে সঙ্কোচ হতে লাগল; হয়তো মনে কষ্ট পাবে।

একদিন সে নিজেই বলল—মাস্টারমশাই, আমার গলায় সুর নেই—না? আমি গাইতে শিখ না?

আমিই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম, বললাম,–তোমার গলা বেশ মিষ্টি—কিন্তু–তুমি বাজনা বাজাতে শেখো না কেন? সেতার কিম্বা এস্রাজ–

লতার চোখ জলে ভরে উঠল—বাজনা বাজাতে আমার ভাল লাগে না। এত দুঃখু হচ্ছে যে আমি গান গাইতে পারব না।

বললাম—আমারও দুঃখু হচ্ছে লতা।

লতা চোখ মুছে হাসবার চেষ্টা করল—যাক গে, উপায় নেই যখন, তখন আর কেঁদে কি হবে, আপনি কিন্তু আসা বন্ধ করতে পারবেন না। অন্তত হপ্তায় একদিন আসতে হবে। গাইতে না পার আপনার গান শুনতে তো পাব। বলুন আসবেন।

খুশি হয়েই কথা দিলাম। না যাবার কোনও কারণ ছিল না; লতা ভারি যত্ন করে খাওয়াতো। তাছাড়া ব্যারিস্টার সায়েবও খুব খাতির করতেন। ভদ্রলোক কম বয়সে বিলেত থেকে ফিরে কি মাতামাতি করেছিলেন,—শোর-গরু খেয়েছিলেন। তারপর পঞ্চাশোর্ধে আবার ঠাণ্ডা হয়ে জপত সন্ধ্যা আহ্নিক আরম্ভ করেছেন।

যাহোক, তারপর মাঝে মাঝে যাতায়াত করি। ক্রমে লতা গান শিখতে না পারার শোক ভুলে গেল; তবে আমি গেলে প্রত্যেক বারই দু একটা গান না শুনে ছাড়ত না। সে সময় আমি বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাঝে-মধ্যে সিনেমার গান প্লে-ব্যাক করতাম। বাংলা দেশের পুকু অভিনেতাদের যে গানের গলা নেই একথা অনেকেই জানে না, দর্শকেরা মনে করে অভিনেতাই বুঝি গান গাইছে। সিনেমার এইসব অজানা নতুন গান শুনতে লতা ভারি ভালবাসত।

একদিন তাকে একটা নতুন গান শুনিয়ে আমি বললাম-শিগগির এই গানটা সিনেমায় শুনতে পাবে, একটি নতুন ছেলের মুখে।

লতা জিগ্যেস করল,—নতুন ছেলেটি কে?

বললাম—তার নাম ললিত, এই প্রথম ছবিতে হিয়োর পার্ট পেয়েছে। ভারি ভাল ছেলে, আমি তাকে ছেলেবেলা থেকে চিনি। তার বড় ইচ্ছে শিক্ষিত ভদ্রসমাজে মেলামেশা করে।

লতা বলল—তবে তাঁকে নিয়ে আসেন না কেন?

আমি বললাম—সে সিনেমার অভিনেতা—তাকে তোমরা ভদ্রসমাজে মেশবার অযোগ্য মনে করতে পার, তাই সাহস করে আনিনি।

লতা বললে—কিন্তু তিনি যদি ভদ্রলোক হন তাহলে অযোগ্য মনে করব কেন? বললাম-তুমি না করলেও তোমার বাবা মনে করতে পারেন। বাজারে সিনেমার লোকের সুনাম নেই।

লতার বাবা ঘরেই ছিলেন, আমি তাঁর পানে তাকালাম; কিন্তু তিনি হাঁ না কিছুই বললেন না, তাঁর নির্বিকার মুখ দেখেও বুঝতে পারলাম না তাঁর মনের ভাবটা কি। কারণ, লতা যাই বলুক, গৃহস্বামীর অমতে একজন আগন্তুককে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি না।

কিন্তু তার চোখ একটু খর হয়ে উঠল। সে বলল—সিনেমার লোক সবাই মন্দ হয়? তবে যে বললেন ইনি ভদ্রলোক?

আমি বলিলাম—ললিত যে ভদ্রলোক আমি তার জামিন হতে পারি।

লতা বলল—তবে কেন বাবা আপত্তি করবেন? উনি আপত্তি করলেও আমি শুনব না।

লতার বাবা একটু হাসলেন, বললেন—শুনলেন তো আধুনিকা মেয়ের কথা! তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সহজ স্বরে বললেন—আপনি তাকে নিয়ে আসবেন, আমার কোনও আপত্তি নেই।

ললিতকে ভাল ছেলে বলেছিলাম, এ কথার মধ্যে এতটুকু অত্যুক্তি ছিল না। আমার গাঁয়ের ছেলে, আমি তাকে একরত্তি বেলা থেকে দেখেছি—যেমন শান্তশিষ্ট তেমনি বুদ্ধিমান। তার বাপ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, তাই বাড়ির শিক্ষা-দীক্ষা ভালই হয়েছিল। আজকাল বেশীর ভাগ ছেলেরই মনে আদর্শ-বিভ্রাট ঘটেছে দেখা যায়। বিলিতী কালচার আর দেশী সংস্কৃতির ভেজালে এক কিম্ভুতকিমাকার চরিত্র তৈরি হয়; তারা হাত তুলে নমস্কার করবার বিদ্যেটাও ভুলে গেছে, আবার শেকহ্যান্ড করবার কায়দাটাও আয়ত্ত করতে পারেনি। ললিতের চরিত্রে কিন্তু দেশী বিলিতী। সংস্কারের গঙ্গা যমুনা সঙ্গম হয়েছিল। তার মনটা যেমন ছিল খাঁটি দেশী, তেমনি আচার ব্যবহার দেখে তাকে সেকেলে বলে মনে হত না, বরং একটু বেশী মাত্রায় আধুনিক বলে মনে হত। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের, একাল ও সেকালের সুন্দর সমম্বয় হয়েছিল তার মনে।

ললিত কলকাতায় বি. এ. পড়ছিল হঠাৎ তার বাবা মারা গেলেন। আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না, ললিতকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হল। চাকরির সন্ধানে আমার কাছে এল। তখন আমিই চেষ্টা চরিত্র করে তাকে সিনেমায় ঢুকিয়ে দিলাম। তার চেহারা ভাল; একেবারে নব কার্তিক না হলেও পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের সঙ্গে এমন একটি মিষ্টি কমনীয়তা ছিল যে দেখলেই ভাল লাগে। তাকে সিনেমায় ঢোকাতে বেশী বেগ পেতে হয়নি, যদিও সে গান গাইতে জানত না।

প্রথম বছরখানেক শিক্ষানবিশীতে কেটে গেল, দুএকটা ছোট ভূমিকায় অভিনয় করল। তারপর সে হিরোর পার্ট পেল।

এই সময় আমাদের গল্পের আরম্ভ। ললিত তখন ওয়েলেসলি অঞ্চলে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। ভারি ছিমছাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাট; ললিতের সৌখীন স্বভাবের ছাপ তার প্রত্যেকটি টুকিটাকিতে পরিস্ফুট। একলা মানুষ, তাই মাইনে তখন খুব বেশী না পেলেও বেশ স্টাইলে থাকত।

কিন্তু তার মনে একটা দুঃখ ছিল, সিনেমার লোকের সঙ্গে সে প্রাণ খুলে মেলামেশা করতে পারত না। কাজের সময় সে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করত, কিন্তু একটু ছুটি পেলেই আমার কাছে পালিয়ে আসত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আমার সঙ্গে গল্প করত, গিন্নির সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করত। ক্রমে আমি তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলাম। জল বিনে মীনতার শিক্ষা এবং রুচি যে পরিবেশ কামনা করে, সে পরিবেশ তার কর্মক্ষেত্রে নেই! তাই তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে; তাই আমার কাছে ছুটে ছুটে আসে।

কিন্তু আমাকেও কাজকর্ম করতে হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গে গল্প করলে আমারই বা চলে কি করে? বুদ্ধিটা প্রথমে আমার মাথায় এসেছিল, ললিত মুখ ফুটে কোনও দিন কিছু বলেনি। আমি ভাবলাম, তাদের সমাজে একবার যদি তাকে জুটিয়ে দিতে পারি তাহলে আর তার কোনও দুঃখ থাকবে না, নিজের মনের মত বন্ধু-বান্ধবী ও নিজেই যোগাড় করে নিতে পারবে। ও যে নিজেকে অভিজাত সমাজে বেশ ভালভাবেই মানিয়ে নিতে পারবে সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহই ছিল না। ওর মত সুমার্জিত ব্যবহার অতি বড় সভ্য সমাজেও খুব বেশী পাওয়া যায় না।

কথাটা তুলতেই সে আহ্লাদে লাফিয়ে উঠল। তারপর একদিন বিকেলবেলা তাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেলাম।

লতা তার গোলাপ বাগানে একটা ঝারি নিয়ে ফুলগাছের গোড়ায় জল দিচ্ছিল; আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই সে একদৃষ্টে ললিতের মুখের পানে চেয়ে রইল। ললিত হাত তুলে নমস্কার করল। আমি দেখলাম, লতার হাতের ঝারিটা থেকে জল ঝরে তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছে; কিন্তু সেদিকে তার লক্ষ্য নেই। আমি সাহিত্যিক মানুষ, আমার মনে একটা কবিত্বময় প্রশ্ন উদয় হল-লতার পদমূলে অজ্ঞাতে যে-জল ঝরে পড়ছে তার ফলে লতার ফুল ধরবে নাকি?

সেদিন বেশীক্ষণ রইলাম না, লতা আর ললিতের পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে এলাম। তাড়াতাড়ি চলে আসার কারণ আমার মনের মধ্যে হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটেছিল। কিছুদিন থেকে একটা উপন্যাসের প্লট আবছায়া ভাবে আমার মাথার মধ্যে ঘুরছিল; আজ লতার বাগানে, কি করে জানি না, গল্পটাকে হঠাৎ আগাগোড়া চোখের সামনে দেখতে পেলাম। এমন আমার মাঝে মাঝে হয়; অবচেতন মন থেকে পরিপূর্ণ গল্পটি সমুদ্রোপ্তবা উর্বশীর মত উঠে আসে। তখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, সহসা এ জগৎ ছায়াবৎ হয়ে যায়। আর কিছু ভাল লাগে না; আমার বাসার ছোট্ট ঘরে কাগজ কলম-সাজানো একটি টেবিল আমাকে টানতে থাকে।

সেদিন চলে এলাম। তারপর কিছুদিন আর লতাদের ওদিকে যাওয়া ঘটে ওঠেনি। নিজের উপন্যাসে মগ্ন হয়ে আছি। ললিত মাঝে দুএকবার এসেছিল; তার কাছে শুনলাম সে এখন ওদের সমাজে মিশে গেছে। এইভাবে কয়েক মাস কেটে গেল।

মাসচারেক পরে হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা ললিত এসে হাজির; মুখে উত্তেজনাভরা হাসি। বলল—আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, আজ আমাদের ছবির উদ্বোধন। চলুন ইন্দুদা, আপনাকে দেখিয়ে আনি। বৌদি, আপনিও চলুন না।

গিন্নি যেতে পারলেন না। কোলের ছেলেটা বাসেছে; আমি একাই ললিতের সঙ্গে গেলাম। তার মুখে আমার গানগুলো কেমন ওত্রালো শোনবার ইচ্ছে হল।

বেরুবার সময় ললিত গিন্নিকে বলে গেল—ইন্দুদা ছবি দেখে আমার বাসাতে খাওয়া-দাওয়া করে ফিরবেন। একটু রাত হবে, আপনি যেন ঘাবড়াবেন না।

ছবিঘরে খুব ভিড়; উদ্বোধন রজনীতে যেমন হয়ে থাকে। তখনও ছবি আরম্ভ হয়নি; ললিত আমাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে একটা বক্সে বসিয়ে দিল। দেখলাম, বক্স আর ব্যালকনি অভিজাত সমাজের স্ত্রীপুরুষে ভরা। ললিত তাদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে গল্পগাছা করতে লাগল। সে বেশ জমিয়ে নিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। আশ্চর্য হলাম, না; ললিত যেরকম মিষ্টি স্বভাবের ছেলে তাতে যে-কোনও সমাজে সে জনপ্রিয় হতে পারে।

ছবি আরম্ভ হল। দেখলাম ছবিটি ভালই হয়েছে, গানগুলি ললিতের মুখে বেশ মানিয়েছে। আর সব চেয়ে ভাল লাগল ললিতের সহজ সাবলীল অভিনয়। তার চেহারায় বোধহয় একটা জিনিস আছে, যাকে ইংরাজিতে বলে sex appeal; সেটা এক্ষেত্রে মেয়েদের কাছেই বেশী ধরা পড়বার কথা, আমার আন্দাজ মাত্র। মোট কথা মেয়েরা যে তাকে খুবই পছন্দ করেছিলেন তার পরিচয় সে রাত্রে পেলাম; কিন্তু সে পরের কথা। ছবি দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে ললিতের কপাল খুলেছে, এবার তাকে নিয়ে পরিচালক মহলে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।

ছবি শেষ হলে ললিত আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। ললিতের বাসায় মাত্র একটি চাকর, সে-ই রান্নাবান্না করে। বাসায় পৌঁছে ললিত চাকরকে ছুটি দিয়ে দিলে; চাকর রাত্রির শোতে। মালিকের ছবি দেখতে যাবে।

টেবিলের ওপর খাবার সাজানো ছিল, আমরা খেতে বসলাম। ললিতের বাসায় তিনটি ঘর—শোবার ঘর–বসবার ঘর আর ডাইনিং রুম। ঘরগুলি ভারি সুরুচির সঙ্গে সাজানো। একটু বিলিতী ঘেঁষা কিন্তু উকট সাহেবিয়ানা নেই; দেশী আরামের সঙ্গে বিলিতী পরিচ্ছন্নতা মিশেছে; ভারি ভাল লাগল।

খেতে বসে ললিত খুব উৎসাহ আর উত্তেজনার সঙ্গে কথা কইতে লাগল। নবলব্ধ সিদ্ধি আর খ্যাতি মানুষকে আনন্দে অধীর করে তোলে, কিন্তু লক্ষ্য করলাম, সে তার উদ্দীপ্ত আনন্দের মধ্যেই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। থেকে থেকে একটা অস্বস্তির ভাব তার মুখে ফুটে উঠছে। কিছু বুঝতে পারলাম না; ভাবলাম ললিত ভারি বিনয়ী ছেলে, অহঙ্কারের লেশমাত্র তার শরীরে নেই; তাই সে এই হঠাৎ পাওয়া গৌরব হজম করতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না; ললিতের মনের অবস্থাও বোধহয় অনেকটা সেই রকম।

খাওয়া শেষ করে উঠতে পৌনে এগারোটা বাজল। ভাবলাম, আর দেরি নয়, এবার উঠে পড়ি; কিন্তু ললিত কোথা থেকে এক গড়গড়া যোগাড় করেছিল; খাম্বিরা তামাক সেজে যখন গড়গড়ার মাথায় বসিয়ে দিলে তখন আর পারলাম না। বসবার ঘরে কৌচের ওপর আড় হয়ে আবার গল্প আরম্ভ হল।

তারপর কখন এগারোটা বেজে গেছে; আমাদের আগড়ুম বাগড়ম গল্প চলছে। হঠাৎ এক সময় ললিত জিগ্যেস করল—ইনুদা, আজ সিনেমায় লতাকে দেখেছিলেন?

আমি বললাম-লতাকে? কই না। সে এসেছিল নাকি?

 ললিত বলল—হুঁ। আমার বড় ভয় করছে ইন্দুদা। সে হয়তো একটা কাণ্ড করে বসবে।

উঠে বসে বললাম—কী কাণ্ড করে বসবে? তোমাদের ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানি না। সব খুলে বল।

ললিত একটা ঢোক গিলে বলল—আপনি তো লতার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে এলেন। তারপর—তারপর অনেক ব্যাপার ঘটেছে। 

ললিতকে জেরা করে সব কথা বার করতে হল। প্রথম সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গেই লতার সমস্ত মন ললিতের ওপর গিয়ে পড়ে; যেন এতদিন ললিতের জন্যই সে পথ চেয়ে ছিল। লতা মনের কথা গোপন করতে পারে না, চেষ্টাও নেই। অল্পদিনের মধ্যেই ললিত বুঝতে পারল লতা তাকে পাবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছে। ললিতের অবস্থা শোচনীয়। ললিত লতাকে খুবই পছন্দ করে; কিন্তু লতার দুরন্ত হৃদয়াবেগ দেখে তার ভয় করে—সে লতাকে এড়িয়ে চলে। আজ সিনেমায় ছবি শেষ হবার পর ক্ষণেকের জন্য তাদের দেখা হয়েছিল; লতা এমনভাবে একদৃষ্টে তার মুখের পানে তাকিয়েছিল যে ললিতের ভয় হয়েছিল বুঝি শহরসুদ্ধ লোকের সামনে একটা কেলেঙ্কারী কাণ্ড করে বসে। প্রবল নেশায় মানুষের যেমন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না লতার চোখে সেই দৃষ্টি। দুএকটা কথা বলেই ললিত পালিয়ে এসেছে।

ভালবাসার পাত্রকে নাটকের নায়করূপে দেখলে বোধ হয় অনুরাগ আরও বেড়ে যায়। সব শুনে আমি বললাম-কিন্তু তোমার পালিয়ে বেড়াবার কী দরকার কুঝতে পারছি না। লতা যখন তোমাকে বিয়ে করতে চায় তখন তাকে বিয়ে করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। তাকে তো তোমার অপছন্দ নয়?

ললিত বলল—আপনি বুঝছেন না ইন্দুদা। লতা খুব ভাল মেয়ে, তার মনে ছলাকলা নেই—তাকে আমার বড় ভাল লাগে; কিন্তু ভাল লাগলেই তো চলে না। লতা বড় ঘরের মেয়ে, বড় মানুষের মেয়ে; আর আমি সিনেমা অ্যাক্টর। আমি কোন মুখে লতার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করব? তিনি বোধহয় তার মনের ভাব বুঝতে পেরেছেন, আজকাল আমাকে দেখলেই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। তা থেকেই বুঝতে পারি আমাকে তিনি লতার উপযুক্ত পাত্র মনে করেন না, হয়তো লতাকে আমার সঙ্গে মিশতে দিয়ে মনে মনে পস্তাচ্ছেন—

এই সময় ঘড়ির ওপর চোখ পড়ল, দেখি সাড়ে এগারোটা। লতা এবং ললিতের প্রসঙ্গ খুবই জটিল হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু আর দেরি করা চলে না। আমি উঠে পড়লাম, বললাম—দিব্যি জট পাকিয়েছ দেখছি। রাতারাতি এ জট ছাড়ানো যাবে না, একটু ভেবে-চিন্তে দেখতে হবে। আজ উঠি।

ললিত আমার হাত ধরে মিনতি করে বলল-আজ রাত্তিরটা থেকে যান না ইন্দুদা, কাল সকালে বাড়ি যাবেন। কত কথা যে বলবার আছে, আপনাকে বললে মনে বল পাব—

বেচারা বড়ই বিব্রত হয়ে পড়েছে; কিন্তু আমাকে মাথা নেড়ে বলতে হল—না ভাই, তোমার বৌদি ভীতু মানুষ আমি না ফিরলে সারারাত্রি ছেলে কোলে করে বসে থাকবে। আজ ফিরতেই হবে।

কিন্তু এত সহজে ফেরা হল না। চাদরটি গলায় দিয়ে বেরুবার উপক্রম করছি এমন সময় দরজায় খুট খুট করে টোকা পড়ল।

ললিত চমকে উঠে বলল—কে?

দরজার ওপার থেকে কিছুক্ষণ জবাব নেই; তারপর চাপা গলায় আওয়াজ এল—দোর খোল—আমি লতা।

ঘরের মাঝখানে বজ্রপাত হলেও এমন স্তম্ভিত হতাম না। লতা! এই রাত্রে লতা এসেছে ললিতের নির্জন বাসায়? ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম ললিতের মুখের পানে; সেও ফ্যালফ্যাল করে আমার পানে তাকাল। তারপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল-কী করি আমি এখন? তার ভাব দেখে মনে হল যেন সে চোর, কোণঠাসা হয়েছে!

আমি বললাম—দোর খুলে দাও—আর উপায় নেই। আমি পাশের ঘরে লুকোচ্ছি। আমাকে দেখলে লতা লজ্জা পাবে।

আমি ললিতের শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ও ঘর থেকে শব্দ পেলাম, ললিত সদর দরজা খুলে দিলে; তারপর দরজা আবার বন্ধ হল। তারপর আর সাড়াশব্দ নেই।

আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বোকার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ নজরে পড়ল দরজার চাবির ফুটো দিয়ে আলো আসছে।

লোভ সামলাতে পারলাম না।

ললিত দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে, আর তার পানে চেয়ে লতা সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে; তার মুখের ওপর পড়েছে বিদ্যুৎবাতির লজ্জাবিদারী আলো। লতার সে মুখ আমি জীবনে ভুলব না। আমি সাহিত্যিক, প্রেম নিয়েই আমার কারবার; কিন্তু এমন তীব্র সর্বগ্রাসী প্রেম যে মানুষ অনুভব করতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি, তবু আমারই যেন দম বন্ধ হয়ে আসবার উপক্রম হল।

তারপর লতা ছুটে গিয়ে ললিতের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর তারপর—সে কী চুম্বন! বিলিতী সিনেমাতেও এমন চুম্বন কখনও দেখিনি; যেমন দীর্ঘ তেমনি জ্বালাময়। অভিনয়ে ও জিনিস হয় না; একটি চুম্বনে নিজেকে সর্বস্বান্ত করে বিলিয়ে দেওয়া বাস্তবেও কদাচিৎ হয়।

ফুটো থেকে চোখ সরিয়ে নিতে হল।

কিছুক্ষণ কাটবার পর দুজনের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। খুব স্পষ্ট নয়—ছাড়া-ছাড়া ভাঙা-ভাঙা-লতাই বেশী কথা বলছে…তুমি আমাকে চাও না?…একটুও ভালবাস না? কিন্তু আমি তো তোমাকে…।

ললিত বলছে…লতা, আমি তোমাকে ভালবাসি…তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু তোমার বাবা…

আমি ফুটোতে কখনও চোখ লাগাচ্ছি, কখনও কান। লতা দুহাত দিয়ে ললিতের গলা জড়িয়ে ধরেছে, ললিতও একটা বাহু দিয়ে তার কাঁধ বেষ্টন করে ধরেছে; মুখোমুখি কথা হচ্ছেলতা বলছে…আমি আজ সারা রাত্রি তোমার কাছে থাকব…তাহলে তো বাবা আপত্তি করতে পারবেন না…আমার লজ্জা নেই, কিছু নেই, আমি তোমার কাছে থাকব–

ললিত একবার চকিতে শোবার ঘরের দোরের দিকে তাকাল। তারপর তার কানে কানে কি বলল। লতাও বিস্ফারিত চোখে দোরের দিকে তাকাল, তারপর ক্ষোভে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট। কামড়ে ধরল। বুঝলাম, আমার কথা হচ্ছে–

ফুটো থেকে সরে গিয়ে ললিতের বিছানার ওপর বসলাম। যুবক যুবতীর দুর্বার হৃদয়াবেগ বেশী বয়সে সহ্য হয় না, স্নায়ু ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যাহোক, মিনিট পাঁচেক বসে থাকবার পর সদর দরজা খোলার শব্দ পেলাম। তার কিছুক্ষণ পরে ললিতের ভাঙা গলার আওয়াজ এল-ইন্দুদা, বেরিয়ে আসুন, লতা চলে গেছে।

তখন বারোটা বেজে গেছে। বেরিয়ে এসে দেখলাম ললিতের মুখখানা ফ্যাকাসে। সে কোচের ওপর বসে পড়ল, কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে বলল—এই ভয়ই আমি করেছিলাম ইন্দুদা; কিন্তু এখন উপায় কি বলুন।

বললাম-বিয়ে করা ছাড়া উপায় নেই।

লতার বাবা আমার সঙ্গে বিয়ে দেবেন না।

চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

চেষ্টা করব; কিন্তু আমি জানি তিনি রাজি হবেন না। তারপর কি করব?

আমি একটু অধীর হয়ে পড়লাম। মনে মনে আদর্শবাদী হলেও আদর্শ নিয়ে মাতামাতি করা আমার সহ্য হয় না। বললাম—লতা তোমাকে যে সুযোগ দিয়েছিল তা যদি তুমি নিতে তাহলে সব সমস্যাই সহজ হয়ে যেত। এখনও সে পথ খোলা আছে—

ললিতের ফ্যাকাসে মুখ হঠাৎ লাল হয়ে উঠল। সে আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলল—ছি ইন্দুদা, আমাকে এমন ছোটলোক মনে করেন আপনি? বাপ-পিতামর রক্ত নেই আমার শরীরে? মরে। গেলেও আমি তা পারব না।

তবে আর কোনও উপায় নেই। বলে আমি চলে এলাম।

ললিত সে রাত্রে যে ব্যবহার করেছিল তার জন্যে তাকে নিন্দে করবার কথা বোধ হয় কারুর মনে উদয় হবে না; তার রক্তে বহু পূর্বপুরুষের সঞ্চিত শুচিতা তাকে যে শক্তি দিয়েছিল সে শক্তি সকলের নেই তা আমি জানি; কিন্তু তবু আমার মনটা সন্তুষ্ট হতে পারল না। লতা আর ললিতকে আমিই একত্র করেছিলাম; তাদের মন নিয়ে আজ যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্যে খানিকটা দায়িত্ব। আমার আছেই। অথচ এই জটিলতার গ্রন্থিচ্ছেদ কি করে করব ভেবে পেলাম না। লতার ব্যবহার আমি সমর্থন করি না, তাকে আদর্শ মেয়ে বলেও মনে করি না; তাকে ঘৃণা করবার মত মনের জোরও আমার নেই। তার ঐকান্তিক আত্ম-বিস্মৃতি একটি সুখময় সৌরভের মত চিরদিন আমার মনে গাঁথা হয়ে থাকবে; কিন্তু ওদের মিলন ঘটাবার জন্যে আমি কি করতে পারি? লতার বাবাকে আমার কোনও কথা বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল, যদি আমি ললিতের বাসায় এত রাত্রি পর্যন্ত না থাকতাম তাহলে জৈব নিয়মে সমস্যার সমাধান আপনিই হয়ে যেত—বিধাতার ঘূর্ণি হাওয়া যেমন নিজের প্রচণ্ডতার বলেই পৃথিবীর বন্ধ কলুষভরা আবহাওয়াকে পরিষ্কার করে দেয় না তেমনি ওদের জীবনের গুমও কেটে যেত; কিন্তু বিধাতার বোধ হয় তা ইচ্ছে নয়।

এদিকে আমার ভাগ্যেও যে বিধাতার ঘূর্ণি হাওয়া ঘনিয়ে এসেছে তা তখনও টের পাইনি। দুচার দিন কেটে গেল; ললিত বা লতার আর দেখা নেই। এদিকে উপন্যাসখানা শেষ করে ফেলেছি, এমন সময় বোম্বাই থেকে ডাক এল। ঘূর্ণি হাওয়ায় গাছের পাতা যেমন বোঁটা থেকে ছিঁড়ে উড়ে যায়, আমি তেমনি উড়ে এসে বোম্বাইয়ে পড়লাম। সেই থেকে বোম্বাইয়ে আছি। ইতিমধ্যে লতা বা ললিতের আর কোনও খবর পাইনি। তাদের জীবনের পরম সমস্যা কি করে সমাধান হল, অথবা সমাধান হল কিনা তার কিছুই জানি না।

কয়েক মাস আগে একবার কলকাতা যেতে হয়েছিল; গিয়ে দিন দশেক ছিলাম।

একদিন সকালবেলা ললিতের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ললিত এখন মস্ত আর্টিস্ট, অনেক টাকা রোজগার করে; কিন্তু সেই পুরানো বাসাতেই আছে।

আমি গিয়ে দেখি, ললিত সবে ঘুমিয়ে উঠেছে; চুল উস্কখুস্ক, দাড়ি কামায়নি, বসবার ঘরে একলা চা খাচ্ছে। আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার পায়ের ধুলো নিলে।

ললিতের ঘরের আর সে ছিমছাম ভাব নেই। ললিতও এই পাঁচ বছরে অনেক বদলে গেছে। চেহারা যে খুব খারাপ হয়েছে তা নয়, কিন্তু কান্তি নেই। সব চেয়ে বেশী পরিবর্তন হয়েছে তার মনে; আগে যা তালশাঁসের মত কচি ছিল তাই আঁটির মত শক্ত হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তনটাই। আগে চোখে পড়ে।

ললিত প্রথমে আমার চোখে ধূলো দেবার চেষ্টা করল, অভিনয় করতে লাগল যেন সে আগের মতই আছে; কিন্তু অভিনয় বেশীক্ষণ টিকল না, হঠাৎ এক সময় ভেঙে পড়ল। সে বলল—ইন্দুদা, আপনি বোধহয় বুঝতে পেরেছেন। আমি বয়ে গেছি—মদ ধরেছি। এই বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

বুঝতে আমি পেরেছিলাম। শুধু মদ নয়, সব রকম দোষই তার হয়েছে কিন্তু তবু সে বেপরোয়া বেলেল্লা হয়ে যায়নি। আদর্শ ভ্রষ্ট হওয়ার লজ্জা আর ধিক্কার তার মনে রয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে ঠাণ্ডা হয়ে সে আস্তে আস্তে সব কথা বলল। লতার বাবার কাছে সে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল কিন্তু তিনি রাজি হননি। তারপর হঠাৎ একদিন তাকে নিয়ে তিনি বিলেত যাত্রা করেছিলেন। মাস ছয়েক আর তাঁদের কোনও খোঁজ খবর ললিত পায়নি। ছমাস পরে একেবারে মেয়ে জামাই নিয়ে তার বাবা দেশে ফিরে এলেন। জামাই একজন নবীন বার-অ্যাট-ল।

লতার বাবার চরিত্রের কথা ভাবতে লাগলাম। বিপদে পড়লেই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে। তিনি কম বয়সে সাহেবিয়ানা করেছিলেন; মাঝে রক্তের জোর কমবার পর দেশের পুরোনো সংস্কৃতি তাঁকে টেনেছিল; কিন্তু যেই তিনি বিপদে পড়লেন অমনি ছুটে গেলেন যৌবনের পরিচিত ক্ষেত্রে। দলের পাখি একটু শঙ্কিত হলেই নিজের দলে ফিরে যেতে চায়।

লতার সঙ্গে তারপর আর ললিতের দেখা হয়নি। সমাজে মেশা ললিত ছেড়ে দিয়েছে। প্রথম কিছুদিন সে বেশ শক্ত ছিল। তারপর একদিন কখন্ তার মনের মধ্যে একটা সুতো ছিঁড়ে গেল, সংস্কার আর তাকে তার আদর্শের কোলে ধরে রাখতে পারল না; বাপ পিতামহের রক্ত ভেসে গল। মন যতই শক্ত হোক, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন সময় আসে যখন মনে হয় বুঝেছি ভাই সুখের মধ্যে সুখ, মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া।

যেদিন ললিত লতাকে মুঠোর মধ্যে পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিল সেদিন তার বিচার করিনি, আজও তাকে বিচার করবার স্পর্ধা হল না।

তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছি, ললিত হঠাৎ বলল—আচ্ছা ইন্দুদা, সে রাত্রে যদি লতার কথা শুনতাম তাহলেই বোধহয় ভাল হত—না? অন্তত বয়ে যেতাম না।

আমি বললাম-ভাই, এ দুনিয়ায় কিসে যে ভাল হয় আর কিসে মন্দ হয় তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি। তবে দেখেছি, বেশীর ভাগ সময়েই ভাল করলে মন্দ হয়; কিন্তু তা বলে সবাই মিলে মন্দ করলেই যে মানবজাতি উদ্ধার হয়ে যাবে এ বিশ্বাসও আমার নেই। গীতায় শ্রীভগবানই খাঁটি কথা বলেছেন—মা ফলেষু।

দোর পর্যন্ত এসে জিগ্যেস করলাম—লতারা কোথায় আছে জানো।

ললিত বলল—শুনেছি ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতেই আছে। লতার বাবা বিলেত থেকে ফিরে আসবার কিছুদিন পরেই মারা গেছেন। এই বলে সে একটু তিক্ত হাসল।

.

সেদিন সন্ধ্যেবেলা ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে লতাকে দেখতে গেলাম।

বাড়ি বাগান ঠিক আগের মতই আছে, কিচ্ছু বদলায়নি। লতাও ঠিক তেমনি আছে, তার স্বভাবে কোনও পরিবর্তন হয়নি। শুধু এই কয় বছরে তার দেহ-মন আরও পরিণত হয়েছে, পরিপূর্ণ হয়েছে।

আমাকে আগের চেয়েও বেশী আদর যত্ন করল। কত কথা জিজ্ঞাসা করল—বোম্বাইয়ে কেমন আছি—কি করছি–কত টাকা রোজগার করি—এই সব। আমাকে অনেকদিন পর পেয়ে তার যেন আনন্দ ধরে না। সরল প্রাণের অকুণ্ঠ আনন্দ।

কিছুক্ষণ পরে একটি বছর তিনেকের মেয়ে ছুটে এসে তার হাঁটু জড়িয়ে দাঁড়াল। ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি, লতার মত নির্ভীক স্বচ্ছ দুটি চোখ। লতা বলল—আমার মেয়ে। ওর নাম ললিতা।

আমি চমকে লতার মুখের পানে তাকালাম। লতা আমার চোখের চকিত প্রশ্ন বুঝতে পারল; একটু হেসে মাথা নেড়ে বলল—আপনি যা ভাবছেন তা নয়—ও আমার স্বামীর মেয়ে।

আমার কান লাল হয়ে উঠল। লতা তখন মেয়েকে বলল—যাও ললি, খেলা করগে।

ললিতা চলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি সঙ্কুচিতভাবে বললাম—লতা, যা হতে পারত তার জন্যে তোমার মনে কি কোনও দুঃখ নেই?

লতা সরলভাবে বলল—আগে ছিল, এখন আর নেই। যা পাব না তার জন্যে কেঁদে কি হবে। মাস্টারমশাই? কিন্তু ভুলিনি। ভুলতে চাইও না। তাই মেয়ের নাম রেখেছি ললিতা।

তবু আবার জিগ্যেস করলাম—তুমি মনের সুখে আছ?

সে একটু যেন অবাক হয়ে বলল-মনের সুখে থাকব না কেন?

তারপর লতার স্বামী এলেন। ঢিলা পায়জামা ও ড্রেসিং গাউন পরা সুপুরুষ যুবক। লতা পরিচয় করিয়ে দিল—ইনি আমার মাস্টারমশাই—এঁর কথা তোমাকে বলেছি–বলে এমনভাবে স্বামীর মুখের পানে তাকাল যে বুঝতে পারলাম, সেই রাত্রির কথাও লতা স্বামীর কাছে গোপন রাখেনি।

লতার স্বামী হাসিমুখে আমায় অভ্যর্থনা করলেন। শেষে স্ত্রীকে বললেন-লতা, ওঁকে সহজে ছেড় না, রাত্রি ডিনার খেয়ে যাবেন। আমার এখন থাকবার উপায় নেই, বাইরের ঘরে মক্কেল বসে আছে; কিন্তু ওঁকে যদি গান গাইতে রাজি করতে পার তাহলে আমি যেন বঞ্চিত না হই। বাইরে খবর পাঠিও।

সে রাত্রে ডিনার খেয়ে তবে ওদের হাত থেকে ছাড়া পেলাম। লতা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার জন্যে ঝুলোঝুলি করেছিল, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত সেদিন আমার গলা দিয়ে বেরুল না। রামপ্রসাদের বল মা তারা দাঁড়াই কোথা গেয়ে ফিরে এলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *