৫. পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট

১৯৮৭-৮৮ সালের গণঅভ্যুত্থান আকস্মিকভাবে স্তব্ধ হলে অন্য সবার সঙ্গে আমিও সমান বিচলিত হই। রাজনৈতিক দলের বাদানুবাদের আবর্তে শহীদদের শব নামপরিচয়হীন দিগন্তের দিকে ভেসে যায়–এ রকম বেদনা এই চাকা নাটকের মূলে আছে। গল্পের সার সংক্ষেপে নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে প্রেরিত হলে প্রথমে তিনি খুব একটা উৎসাহী হন না। তবুও পরে খ্রিস্টীয় নব্বই সালের বসন্তকালের অন্তে বৈশাখে মাত্র পাঁচ দিনে প্রবল স্বেদকম্পনে নাটকটি লেখা হয়ে যায়।

রাজনৈতিক অভিপ্রায় নাটকের শরীরে নেই–শিরায় হয়ত আছে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই–সমাজমনস্ক রাজনীতিপিপাসু পাঠক নাড়ি ধরে পাবেন কিনা তেমন উদ্বেলিত স্পন্দন তাদের নিজ নিজ ঘড়ি মিলিয়ে। না পেলে আমার অস্বস্তি নেই এ জন্য যে সমকালীন রাজনৈতিক আবেগ তাতে তড়িৎ ক্রিয়া করে না–আমি যদুর জানি আমার কবি স্বভাব। আর স্বভাব বিরুদ্ধ শিল্পকর্ম অন্য যাদের সন্তুষ্ট করুক নিজেকে বাঁচায় না। সেদিক থেকে বলতে পারি চাকা নাটকের একটি নিজস্ব ও নৈসর্গিক অর্থ আছে। দর্শক শ্রোতা তাতেই তৃপ্ত হবেন। এবং লেখার পর আমারও মনে হয়েছে সমকালের বেদনা ও রচনায় বহুদূরে নানা বাঁক ঘুরে ভিন্ন শিল্প ভাষায় এসেছে। ধরা যাক আমি বাস্তবেই একটি গল্প বলতে চেয়েছি–সে গল্পের শববাহী চাকার সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছি মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে। এ কাহিনীর ক্ষেত মজুরদের হাতে কবর খনন হলে অনামা মৃতের গতি হল। কেউ যে চিনতে পারল না তার কষ্ট নির্ধারিত হল জানাযা ও কবরের পরে। সে আনন্দ ও শোকের যদি কোন মানবিক তাৎপর্য থাকে তবে তাতেই আমি খুশি হব।

এক মধ্যরাতে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পুরো গল্পটি আমার কাছে থেকে পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। তিনি চাকাতে মানবিক সম্পর্কের দিকটাকে খুব বড় করে দেখেছেন। আমিও একমত। কিন্তু তার প্রক্রিয়া বিচিত্র পথে চলেছে। নীল আকাশ–নদী–উজ্জ্বল–সূর্যকিরণ–মৌমাছির ঝক-দিগন্ত রেখা–জ্যোত্সার কুহক–নিশ্চাপ সঁড়ের শরীরে রক্তপাত প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে শব চলে গেছে ক্ষেত মজুরদের হাতে কাটা গোরে। অন্যদিকে মৃতের প্রতি সহানুভূতির কথাটি নাটকে আছে। কিন্তু তা কর্তব্যও বটে–এ কথাটি সত্য।

আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি তাই এর নাম দিয়েছি কথানাট্য। একে কথকতাও বলা যায়। কিন্তু কথকতা অভিনয়রীতির নাম– নাট্যরীতির নাম নয়। উপরন্তু কথকতা বললে কথানাট্যের দাবি পূরণ হয় না। রামায়ণও কথকতা কিন্তু আসরে লোকগল্প বলার রীতিটাকে আমরা কেউ কথকতা বলি না। কারণ–যারা পুরাণ কিংবা লোককথাগুলো পরিবেশন করেন তারা একে শাস্ত্র বা হাস্তর বলে থাকেন।

গৃহাঙ্গণে কথক যে কিসসা বলেন–দোহারদের সঙ্গে এ নাটকের আঙ্গিক পরিকল্পনায় সে রীতির শিক্ষাটি সক্রিয় ছিল। গ্রাম থিয়েটারের কাজে এ দেশের নানান অঞ্চলে যাই বলে এ দেশের শিল্প শস্যক্ষেতের নানান সুগন্ধি ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাই। পূর্ব পুরুষের সমৃদ্ধ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কৃষকের সাহস বাড়ে। নইলে একজন গায়েন আমার হাতের লেখায় সত্তর বাহাত্তর পৃষ্ঠার নাটক গাইবেন এ ধারণা ইউরোপীয় ধাঁচের নাটক থেকে পাবার কথা নয়।

চাকা রূপক সাংকেতিক নাটক নয়–নিরবলম্ব বাস্তবতাও যে এর লক্ষ্য ছিল তা বলা যায় না। গল্পটি যেভাবে বলতে ভালো লেগেছে সেভাবেই বলা। আমার অন্যসব নাটকের মতো এ নাটকেও পুরাণ আছে। চাকার গল্পটি গল্পই। নাটকটিকে কেউ যদি ঘটে গেছে এমন একটি ঘটনার ব্যাখ্যা বলেও মনে করেন আপত্তি করব না।

 গল্পকথা। কাকেশ্বরী গাঙের পাড়ে একটি গঞ্জ-এলংজানি। সে গঞ্জের হাসপাতাল থেকে অপঘাতে মৃত এক যুবকের লাশ বোশেখের এক উজ্জ্বল ভোরে ধান কাটতে যাবে এমন একটি গরুর গাড়িতে মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে গন্তেব্যে পৌঁছে দেবার শর্তে উঠানো হয়। কিন্তু যে ঠিকানায় লাশটি পাঠানো হয় তার সঙ্গে কোন কোন গাঁয়ের নাম খানিকটা করে মিলে এমন কি মৃত যুবকের নামের সঙ্গেও একজনের নাম মিলে যায় তবে প্রকৃত ঠিকনার অভাবে কোন গাঁয়ের কেউই লাশটির দায়-দায়িত্ব নিতে রাজি হয় না। নয়ানপুর নামে যে গ্রামটাতে গাড়োয়ান ও তার সঙ্গীরা প্রথমে উপস্থিত হয় সে গ্রামের এক স্কুলের হেডমাস্টার লাশটিকে নবীনপুরের কেউ বলে সন্দেহ করে। কিন্তু নবীনপুরে নিয়ে দেখা গেল বাহিত লাশটি সে গাঁয়েরও কারো নয়।

 রাত কাটে ভোর হয়। বহনকারী গাড়ির ষড়দ্বয়ের সাথে স্থানীয় স্বাড়ের লড়াই হয়। গাড়োয়ানের জিতে যাওয়া ষাড়দ্বয়কে নবীনপুরের লোকেরা অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে বসে। আহত হয় লড়াকু ষড়দ্বয়।

একটি অপরিচিত বাজারে এসে ভাত বেঁধে খায় অভুক্ত গাড়োয়ান ও তার সঙ্গী দুই পইরাত। লাশটি তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে সঙ্গী হয়ে উঠেছে। অবশেষে তারা নিজেরাই নামহীন ঠিকানাহীন এই মৃতকে দাফন করে এক শীর্ণ নদীর বালুচরে।

অব্যক্ত বেদনায় অশ্রুপাত করে গাড়োয়ান। যুবকটির মৃতদেহ সমাহিত হলে তারা তিনজন ধান কাটতে চলে যায় তাদের গন্তব্য–দিল সোহাগীর বিলের পথে।

ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত চাকা নাটকের কুশীলবদের তালিকা–

গ্রন্থিকগণ। শিমূল ইউসুফ–কথক। গরুর গাড়ির মিস্ত্রি। চাচি। গাড়িওয়ালা। লাশ। রাইসুল ইসলাম আসাদ–বাহের গাড়োয়ান। কৌশিক সাহা–প্রৌঢ়। দেলোয়ার হোসেন–শুকুরচান। সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল গ্রামের শ্রমিক। গাড়িওয়ালা। গ্রামের যুবক। বাজার শ্রমিক। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়িত হয় যুক্তরাষ্ট্রে জামিল আহমেদের নির্দেশনায় ইংরেজি ভাষায়।

২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের এন্টিয়ক থিয়েটার কর্তৃক অভিনীত চাকা নাটকের প্রথম মঞ্চায়নের পাত্র পাত্রী ও কলাকুশলীগণ–

ANTIOCH THEATER PRESENTS–THE WHEEL—–a new play from Bangladesh By SELIM AL DEEN. DIRECTED BY JAMIL AHMED & DENNY PARTRIDGE SCENERY & LIGHTS BY JAMIL AHMED. COSTUMES BY DENNY PARTRIDGE. STAGE MANAGER ALICE LUHRMANN, CAST in speaking order…ELIZABETH EDDY-JYM BUCK ASHER–LESLIE WEINSTEIN-ANNA MARIE SOMERA-LESLIE H EINHORN–MARKS SIMMONS–SABIAN TROUT-CUONG RHODES. Flute : DIMITRI VIETZE. Drums : SARAH GABBEY

MATTHEW WISWALL. Script translation by Jamil Ahmed. English adaptation by Steve Friedman. Dances choreographed by Naila Azad. Lighting Crew-Russell Pachman-Kristine Hofstra. Richard Boylan Eric johnson Michael-Pendleton. Production Crew-Dann Auld-Christelle Evans jane Webb. Cornelia Mc Namara-Mary Rusnack. Noah. Robishon and the cast. Co-op Technical Director : Naila Azad. Co-op office Manager : Kat Kavanagh

চাকা নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ কাল–১ ফাল্গুন ১৩৯৭। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১।

প্রকাশক—হুমায়ুন কবীর–গ্রন্থিক-~-৫০ পুরানা পল্টন লাইন-ঢাকা ১০০০।

প্রচ্ছদ আনওয়ার ফারুক।

নাসরিন নাহার–আয়া। বৃদ্ধা। কেঁচো। হাঁসুলী। ফারুক আহমেদ–অর্শরোগী ডাক্তার। হেডমাস্টার। দিনমজুর। সিনসাদুম। কামাল বায়েজীদ–শ্বেতীরোগী ডাক্তার। পাখি শিকারী। গ্রামের যুবক। প্যান্টপরা যুবক। কাছিম। মোস্তাগিসুর রহমান বাবু–ধরমরাজ। শহিদুজ্জামান সেলিম–গুদারার ভাড়া আদায়কারী। হোসেনালী। বৃদ্ধ। বোয়াল। শতদল বড়ুয়া বিলু–গুদারার ভাড়া আদায়কারী। হোসেনালী। বৃদ্ধ। বোয়াল। সহিদ হাসান রিংকু কুষ্ঠরোগী। গাড়িওয়ালা। বিয়ে বাড়ির মালিক। গ্রামের যুবক। বাজার কমিটির মেম্বার। মিলু চৌধুরী–গুদারা ঘাটের শ্রমিক। জব্বারের বাপ। শ্রমিক। কালো ষাঁড়ের মালিক। কাকড়া। বাজার শ্রমিক। শিল্পী সিদ্দিকা–মৌমাছি। শরবতী। হাঁস। মেয়েটি। রোজী সিদ্দিকী-বউ। রেহানা। হাঁস। মেয়ে সঙ্গী। কুমকুম হাসান মেয়ে। হাঁসুলি। এশা ইউসুফ–মেয়ে। হাঁস। সেঁজুতি খান তমা–মেয়ে। বাদ্য যন্ত্ৰী–সুদীপ বড়ুয়া খোকন। পঙ্কজ বণিক। মোস্তাগিসুর রহমান বাবু। চন্দন।

কলাকুশলী। রচনা-সেলিম আল দীন। নির্দেশনা-মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা-জামিল আহমেদ। সুর ও আবহসঙ্গীত পরিকল্পনা শিমূল ইউসুফ। পোষাক পরিচ্ছদ ও দ্রব্যসম্ভার পরিকল্পনা–রাশেদুল হুদা। কোরিওগ্রাফ মিনু হক। প্রচার ও প্রকাশনা–আফজাল হোসেন। রেজাউল হায়দার। সুলতান মুহম্মদ রাজ্জাক। মোসাদ্দেক মিল্লাত। মঞ্চ নির্মাণ আলোক প্রক্ষেপণ ও নির্দেশনা সহকারী-আমিরুল ইসলাম টিপু। প্রযোজনী কর্মী–ইউসুফ খসরু। পলাশ। সাইফ উদ্দিন মাহমুদ। এহসান। মামুন। বকর। ফেরদৌস। জালাল। সুব্রত। মনু। মেজবাহ। শান্তনু। শাহরিয়ার। ব্যবস্থাপনা-নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সুবর্ণা মুস্তাফা। হুমায়ুন ফরীদি। হুমায়ুন কবীর হিমু। আলো সরবরাহ সিরাজ আহমেদ। মিলনায়তন ব্যবস্থাপনা–ঢাকা থিয়েটার-এর কর্মীবৃন্দ।

চাকা নাটকটি হিন্দি ভাষায় ভারতের দিল্লিস্থ ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা শেষ বর্ষের ছাত্রদের প্রযোজনা হিসেবে জামিল আহমেদের নির্দেশনায় ১২ থেকে ১৫ অক্টোবর ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে মঞ্চস্থ হয়। চাকা নাটকটি হিন্দি অনুবাদ করেন ভি কে শর্মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *