৫. গোয়েন্দাগিরিতে ইস্তফা

২১. গোয়েন্দাগিরিতে ইস্তফা

এবার ওই তাই-পিংটির খোঁজ নেয়া যাক! এত ধকল সয়ে রাতটা কিন-ফো সসঙ্গী বিশ্রামেই কাটিয়েছিলো; কিন্তু পরদিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কথা সে বললে, এবার ওই তাই-পিং-এর পালা! লাও-শেনের এক্তিয়ারের মধ্যেই আছে এখন তারা; আজ তিরিশে জুন; পুরো ব্যাপারটা চরম সংকটে পৌঁছেছে একেবারে। এই দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে কিন-ফো অটুট, অক্ষত ও বিজয়ী বেরিয়ে আসবে তো? ওয়াং-এর এই নির্মম প্রতিনিধি তার বুকে চরম আঘাত বসিয়ে দেবার আগেই সে কি ওই চিঠিটা ফিরে পাবার প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারবে?

ক্রেগ আর ফ্রাই নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে প্রতিধ্বনি তুললো :এবার ওই তাই-পিঙের পালা!

আগের দিন সন্ধেবেলায় যখন ছোটো দলটি ফু-নিন-এ পদার্পণ করেছিলো, তখন তাদের ওই অদ্ভুত পোশাক ছোট্ট বন্দরটিতে বেশ সাড়া তুলে দিয়েছিলো। লোকের কৌতূহলের সীমা ছিলো না তাদের দেখে; সরাইখানার দরজা অব্দি ছোটোখাটো একটা ভিড় তাদের অনুসরণ করেছিলো; ক্রেগ আর ফ্রাই ভাগ্যিশ তাদের জাদুকরের ঝুলি ওরফে জল-নিরোধী থলিতে টাকাকড়ি রাখতে ভোলেনি-না-হলে অবস্থার সঙ্গে খাপ খায় এমন পোশাক তারা কিনতে কী করে? আর চারপাশে অমন বিষম ভিড় জমে না-গেলে বিশেষ একটি চৈনিককে হয়তো লক্ষ করতে পারতো তারা, যে একবারের জন্যও তাদের পিছন ছাড়েনি। তাদের বিস্ময় হয়তো আরো বিপুল পর্যায়ে পৌঁছুতে যদি তারা জানতে পারতো যে সেই চৈনিকটি সারারাত ওই সরাইখানার দরজায় বসে পাহারা দিয়েছে, এবং শুধু তা-ই নয়, সকালবেলাতেও কাষ্ঠ-পুত্তলিকাবৎ ওই চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

যেহেতু তারা এ-সবের কিছুই জানতো না, সেইজন্য তারা সরাইখানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো তখন। যখন লোকটি এসে বললে সে এই অচেনা মুলুকে তাদের পথপ্রদর্শকের কাজ করতে চায়, তখন তাদের মনে কেননা সন্দেহই জাগলো না। চৈনিকটির বয়েস হবে ত্রিশের মতে, দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না এমনি নিরীহ ও নির্বিরোধী এক সাধুপুরুষ। ক্রেগ আর ফ্রাই অবশ্য জানে যে সাবধানের মার নেই, সেই জন্য তারা জিগেশ করলো কেন এবং কোথায় সে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

একেবারে চিনের প্রাচীর অবধি, বলাই বাহুল্য বললে লোকটা, ফু-নিন-এ যাঁরাই বেড়াতে আসেন, তারা সবাই চিনের প্রাচীর দেখতে যান আর এখানকার পথঘাট যেহেতু আমার নখদর্পণে রয়েছে, সেইজন্য আমি ভাবলুম পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে নিয়োগ করতে আপনাদের হয়তো কোনো আপত্তি থাকবে না।

কিন-ফো মাঝে-পড়ে জিগেশ করলো, এ-অঞ্চলটা কেমন? নিরাপদ তো ভ্রমণকারীদের পক্ষে? পথপ্রদর্শকটি বললে যে এখানে ভয়ের কিছু নেই খুবই নিরাপদ জায়গা।

লাও-শেন বলে একটা লোক নাকি এখানে থাকে–তুমি তার হদিশ দিতে * পারবে? কিন-ফো জিগেশ করলে।

ও! তাই-পিং লাও-শেনের কথা বলছেন? উত্তর করলো পথপ্রদর্শক, কিন্তু চিনের প্রাচীরের এ-পাশে তো তাকে ভয় করার কিছু নেই। চিন মুলুকে পা দেবার সাহস তার আদৌ হবে না : সে তার স্যাঙাৎদের নিয়ে মোঙ্গোল এলাকায় লুঠতরাজ করে বেড়ায়।

শেষ কোথায় দেখা গিয়েছিলো তাকে? জিগেশ করলে কিন-ফো। চিন-তাং-হোর আশপাশে–প্রাচীর থেকে মাইল কয়েক দূরে। আর ফু-নিন থেকে চিন-তাং-হো কদ্দূর? তা প্রায় পঁচিশ মাইল হবে।

বেশ; আমাকে লাও-শেনের ডেরায় নিয়ে যাবে, এই জন্য তোমাকে নিয়োগ করলুম।

লোকটা চমকে উঠলো।

মোটা টাকা দেয়া হবে তোমাকে এ-জন্য-ইনাম পাবে, কিন-ফো যোগ করলো তক্ষুনি।

কিন্তু পথপ্রদর্শকটি ঘাড় নাড়লো; স্পষ্ট বোঝা গেলো সীমান্ত পেরিয়ে এক পা যাবার মতো বুকের পাটা তার নেই। চিনের প্রাচীর পর্যন্ত যদি বলেন তো যেতে পারি–তার একচুলও ওদিকে নয়। প্রাণ হাতে করে ওপাশে যাবার দুঃসাহস আমার নেই।

যত টাকা চায়, দেবে–কিন-ফো তাকে জানালে; শেষকালে অনেক উপরোধের পর হাত কচলাতে-কচলাতে লোকটার কাছ থেকে একটা অনিচ্ছুক সম্মতি আদায় করা গেলো।

মার্কিন গোয়েন্দাদের দিকে ফিরে এবার কিন-ফো বললে যে ইচ্ছে করলে তারাও সঙ্গে যেতে পারে, আবার না-ও যেতে পারে–যা তাদের মন চায়।

আপনি যেখানে যাবেন- শুরু করলো ক্রেগ।

আমরাও সেখানে যাবো, শেষ করলো ফ্রাই, এখনো সেন্টেনারিয়ানের মক্কেলের দাম দু-লাখ ডলার।

পথপ্রদর্শকটি যে শেষ অব্দি বিশ্বস্ত মিলেছে, এ-বিষয়ে গোয়েন্দা দুজনের আর-কোনো সংশয় ছিলো না। মাঙ্গোল দস্যুদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য চিনেরা যে বিরাট প্রাচীর তুলেছে, তার এ-পাশে অন্তত কোনো বিপদের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হলো না। সুনকে অবশ্য এ-কথা কেউ জিগেশই করলে না সে যাবে কিনা–তাকে তা যেতে হবেই।

যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হলো; এই ছোট্ট শহরটিতে না-পাওয়া গেলো কোনো ঘোড়া, না-বা কোনো খচ্চর, না কোনো যানবাহন। তবে উট পাওয়া গেলে অনেক, মোঙ্গোল ব্যাবসাদারেরা তাদের বেসাতি নিয়ে যায় উটে করেই। উটের সার নিয়ে এই ব্যাবসাদারেরা পেইচিং থেকে কিয়াচ অবধি ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে যায় তাদের বিপুল মেষপাল। রুশদেশের সঙ্গে চিনের যোগসাধন ঘটায় এই উটের পালই–যদিও মোঙ্গোলরা কখনো সশস্ত্র বা দলে ভারি না-হলে বিশাল স্তেপভূমিতে পা দিতে চায় না। মঁসিয় দ্য বোভোয়া এই মোঙ্গোলদের সম্বন্ধে এই বর্ণনা দিয়েছেন, হিংস্র মানুষ এরা, অহংকারী ও দেমাকি–চিনেদের এরা ঘেন্না করে।

শেষকালে পাঁচটা উটই কিনলে তারা–জিন-টিন সমস্ত জরুরি উপকরণ সমেত। খাদ্যসম্ভার নেয়া হলো সঙ্গে, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা করতেও ভুললো না তারা–তারপর সব জোগাড়-যন্তর শেষ হলে পথ-প্রদর্শকের সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়লো।

জোগাড়-যন্তর করতে গিয়ে এত সময় চলে গেলো যে বেলা একটার আগে তারা রাস্তায় নামতে পারলে না। পথপ্রদর্শকটি অবশ্য বললো যে মাঝরাতের আগেই তারা চিনের প্রাচীরের কাছে পৌঁছে যাবে–সেখানে তারা একটা সাময়িক শিবির করবে বলে ঠিক হলো। তার পরেও যদি কিন-ফো প্রাচীর পেরিয়ে ও-পাশে যেতে চায় তাহলে না-হয় কাল সকালে তারা সীমান্ত অতিক্রম করবে।

ফু-নিন-এর আশপাশে জমি ঢেউয়ের মতো বন্ধুর ও অসমতল-রাস্তা গেছে ঘুরে-ঘুরে খেত-খামারের মধ্য দিয়ে : তারা যে এখনো চিন-সাম্রাজ্যের সোনার মতো জমি দিয়ে যাচ্ছে, খেতখামারগুলো তারই ইঙ্গিত; রাস্তা থেকে হলদে ধুলো ওঠে হাওয়ায়–আকাশ পর্যন্ত যেন উঠে যায়।

উটের চলার ভঙ্গি ধীরস্থির, ছন্দোময়-দুই কুঁজের মাঝখানে বেশ আরাম করে বসে থাকে আরোহী। এইভাবে যেতে সুনের কোনো আপত্তি নেই, বরং বেশ খুশিই হলো সে : এইভাবে একেবারে পৃথিবীর শেষ সীমায় যেতেও তার কোনো আপত্তি নেই। গরম অবিশ্যি প্রচণ্ড পড়েছে; মাটি থেকে প্রতিসরিত হয়ে গরম হাওয়া অদ্ভুত সব মরীচিকা সৃষ্টি করেছে, রচনা করে যাচ্ছে সিন্ধুবিভ্রম; যেমন আচম্বিতে তারা দেখা দিলো তেমনি আচম্বিতেই তারা মিলিয়ে-মিলিয়ে গেলো দেখো সুনের সন্তোষের সীমা রইলো না : আরেকটি সমুদ্রযাত্রার কথা ভাবলেই আতঙ্কে ও বিভীষিকায় তার রোমকূপগুলি খাড়া হয়ে ওঠে।

ফু-নিন চিনের একেবারে সীমান্তে অবস্থিত হলেও লোকবসতি এখানে নেহাৎ কম নয় : ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যা এমনকী একেবারে মধ্য-এশিয়ার মরুভূমি পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। লাল আর নীল পোশাক-পরা তাতার পুরুষ ও রমণীরা খেতে-খামারে কৃষিকর্মে লিপ্ত। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে হলদে রঙের ভেড়ার পাল–তাদের লম্বা ল্যাজ বেচারা সুনকে বোধহয় ঈর্ষাতুরই করে তুললো। মাথার উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো বাজপাখি, কোনো মেষশাবক দল ছাড়া হয়ে তাদের খপ্পরে একবার পড়লেই হলো! ব্যস, অমনি এই সমস্ত দুর্দান্ত হিংস্র শিকারি পাখি ভেড়া, হরিণ, শম্বরদের ছোঁ মেরে নিয়ে যায়–মধ্য-এশিয়ার কিরঘিজরা ডালকুত্তার বদলে অনেক সময় এ-সব শিকারি বাজ পোষে।

শিকারের কোনো অভাব নেই আশপাশে; কারু কাছে বন্দুক থাকলে সে বুঝি কোনো অবসরই পাবে না, যদিও কোনো সত্যিকার শিকারি হয়তো সব জানার আর গমখেতে পেতেরাখা ও-সব জাল ফজ আরো-সব কৌশলকে খুব-একটা ভালো চোখে দেখবে না কখনো।

কিন-ফো আর তার সহযাত্রীরা একটানা এগিয়েই চললো ধুলো-ঝড়ের মধ্য দিয়ে : কোনো ছায়া-ভরা গাছতলা, একা খামার বাড়ি বা কোনো গ্রামেই তারা থামলো না। দূর থেকেই গ্রাম চেনা যায়, কারণ সব গ্রামেই বৌদ্ধ শ্রমণদের স্মৃতিস্তম্ভ আছে–দূর থেকেই সেগুলো চোখে পড়ে। উটগুলো একটানা লাগিয়ে চললো সার বেঁধে–একটার পিছনে আরেকটা–আর গলায় ঝোলানো গোল লাল ঝুমঝুমির তালে-তালে ছন্দোময় ভঙ্গিতে তাদের পা পড়তে লাগলো।

এ-অবস্থায় কোনো কথাবার্তা সম্ভব ছিলো না। পথপ্রদর্শকটি অত্যন্ত চাপা ও মুখবোজা–সে-ই সবসময় চললো সকলের আগেভাগে : সবসময়েই সামনে হলদে ধুলোর পরদা থাকলে কী হবে, কোন পথে যেতে হবে সে-সম্বন্ধে তার কোনো দ্বিধা বা সংশয় দেখা গেলো না : এমনকী চৌমোহনায় এসে কোনো চিহ্ন না-থাকলেও সে ইতস্তত না-করে নিজের পথ চিনে নিতে পারলে। তার সততা সম্বন্ধে ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের আর-কোনো সংশয় ছিলো না বলে তারা এবার কিন-ফোর দিকেই মনঃসংযোগ করলে। স্বভাবতই সময় যতই কেটে গেলো, তাদের উৎকণ্ঠাও ততই বাড়তে লাগলো। এখুনি একটা এসপার ওসপার হয়ে যাবে–যে শত্রুর ভয়ে তাদের বুকের ধ্বকঋক বেড়ে যায়, এবার নিশ্চয়ই সে-একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য এসে হাজির হবে।

কিন-ফোর কিন্তু এদিকে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো উদ্বেগই ছিলো না–সে মনে-মনে বরং অতীতকেই নাড়াচাড়া করে দেখছিলো। গত দু-মাসের এই একটানা বিপর্যয়ের কথা মনে পড়তেই কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ছে সে। সান ফ্রান্সিসকো থেকে তার প্রতিনিধি তার সব সম্পত্তি হারাবার খবর পাঠাবার পর থেকে তার জীবনে এই-যে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, দুর্ভাগ্য তাকে যে ভাবে তাড়া করে ফিরছে লাটুর মতো, এটা কি একটু অদ্ভুত নয়! যখন সব সুযোগ-সুবিধে ছিলো তখন সে তার মর্যাদা বোঝেনি! এখন সেই হারানো দিনগুলোর কী-বিষম বিপরীত তার দশা। ওই চিঠিটা ফিরে পেলেই কি তার দুর্ভাগ্যের অবসান হবে? সত্যি কি শেষে লা-ওকে সে পাবে? মাধুরীর প্রতিমা সে–তার স্নিগ্ধ ও সযত্ন সান্নিধ্য তাকে কি এই বিষম দিনগুলি ভুলিয়ে দেবে? ভাবনারা তাকে কেমন যেন বিমূঢ় করে দিয়ে গেলো! হায়! এখন আবার ওয়াংও নেই যে তাকে দুর্দশায় সান্ত্বনা ও পরামর্শ দেবে–তার যৌবনের বন্ধু ও চিন্তাগুরু তারই জন্য শেষকালে কিনা স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলো!

আরো কত-কী সে ভাবততা কে জানে! হঠাৎ তার উটটি পথপ্রদর্শকের উটের গায়ে ধাক্কা খেতেই তার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেলো–আরেকটু হলেই একেবারে আছড়ে পড়তো সে মাটিতে।

কী হে? থেমে পড়লে কেন? জিগেশ করলে কিন-ফো।

আটটা বাজে এখন, পথপ্রদর্শকটি বললে, আমি বলি কি এখানে একটু থেমে আমরা নৈশভোজটা সেরে নিই। তারপর আবার না-হয় যাওয়া যাবে।

কিন্তু তখন তো অন্ধকার করে আসবে, কিন-ফো আপত্তি জানালো।

পথ আমি কিছুতেই হারাবো না। চিনের প্রাচীর আর মাইল দশেকের বেশি দূর হবে না। আমার বরং উটগুলোকে একটু বিশ্রাম দিই এবার।

এ-প্রস্তাবে কিন-ফো সম্মতি দিতেই পুরো দলটা বিশ্রাম নেবার জন্য থেমে পড়লো। পথের পাশেই একটা পোডড়া বাড়ি পড়ে ছিলো তার পাশেই ছিলো ছোট্ট একটা ঝরনা–উটগুলো সেখানেই জল পাবে। তখনও অন্ধকার হয়নি। কিন-ফোরা বেশ দেখে-শুনেই ভোজ্যদ্রব্য সাজালো সামনে, বেশ তৃপ্তিসহকারেই উদরপূর্তি করলে তারা অতঃপর।

কথাবার্তা হলো ভেঙে-ভেঙে। কিন-ফো দু-তিনবার লাও-শেনের সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলো অবিশ্যি, কিন্তু পথপ্রদর্শকটি বারেবারে কেবল ঘাড় নেড়ে বোঝাতে চাইলো এ-বিষয়ে সে কোনো কথা বলতে চায় না। সে শুধু তার আগের কথারই প্রতিধ্বনি করলে :লাও-শেন কদাচ চিনের প্রাচীরের এ-পাশে আসে না, যদিও তার শাগরেদরা অবিশ্যি মাঝে-মাঝে আবির্ভূত হয়। ভগবান বুদ্ধ আমাদের ওই তাই-পিং-এর হাত থেকে রক্ষা করুন, এই হলো তার শেষ কথা।

পথপ্রদর্শকটি যখন কথা বলছিলো, ক্রেগ আর ফ্রাই তখন ভুরু কুঁচকে ঘড়ি দেখতে-দেখতে ফিশফিশ করে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছিল। শেষকালে তারা জিগেশ করলো, কাল সকাল অব্দি এখানে থেকে গেলেই হয় না?

এই পোড়োবাড়িতে! পথপ্রদর্শকটির চোখ যেন কপালে উঠলো : তার চেয়ে ভোলামেলা জায়গা ঢের ভালল। আচমকা কেউ চড়াও হতে পারবে না তখন।

এ-কথা তো আগেই ঠিক হয়েছিলো যে আজ রাতেই আমরা প্রাচীরের কাছে পৌঁছুবো, বললে কিন-ফো, সেখানেই আমি রাত কাটাতে চাই আজকে।

তার গলার স্বর শুনে গোয়েন্দা দুজন আর আপত্তি করতে পারলো না। সুন তো ভয়ে একেবারে আমশি হয়ে গেছে : প্রতিবাদ করার কোনো ক্ষমতাই তার তখন ছিলো না।

প্রায় নটা বাজে তখন; খাওয়াদাওয়া শেষ করে পথপ্রদর্শক যাত্রার সংকেত করলে। কিন-ফো তার উটে উঠতে যাবে, এমন সময় ক্রেগ আর ফ্রাই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আপনি কি লাও-শেনের খপ্পরে পড়বেন বলেই প্রতিজ্ঞা করেছেন?

প্রতিজ্ঞাই বটে, বললে কিন-ফো, যেভাবেই হোক, ওই চিঠিটা আমায় উদ্ধার করতেই হবে।

মস্ত বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছেন কিন্তু আপনি–তারা বোঝাবার চেষ্টা করলো, এই যে এভাবে তাই-পিং-এর ঘাঁটিতে যাচ্ছেন, তাতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

এত দূরে এসে আর ফেরবার কোনো মানে হয় না, কিন-ফোর গলায় কোনো অনিশ্চিতির আভাস নেই, আপনাদের তো আগেই বলেছি যে আপনারা ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে না-ও আসতে পারেন।

পথপ্রদর্শকটি ততক্ষণে একটা ছোট্ট পকেটলণ্ঠন বার করে জ্বালিয়েছে। ক্রেগ আর ফ্রাই আরো কাছে এগিয়ে এলো, ঘড়ি দেখলো একবার; আবারও বললো, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ঢের বুদ্ধিমানের কাজ করতেন।

বাজে কথা! কিন-ফো বলে উঠলো, লাও-শেন আজও যেমন, কাল-পরশুও তেমনি বিপজ্জনক থাকবে–রাতারাতি তার বদলে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি মনস্থির করে ফেলেছি : এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়তে হবে আমাদের।

তাদের কথাবার্তার শেষ দিকটা পথপ্রদর্শকটির কানে গিয়েছিলো। আগেও দু-একবার ক্রেগ আর ফ্রাই যখন কিন-ফোকে নিষেধ করতে গেছে, তার মুখে অসন্তোষের ভঙ্গি ফুটে উঠেছিলো। এবার যখন তাদের নাছোড়বান্দার মতো গাঁইগুই দেখলো, তখন সে আর তার বিরক্তি চেপে রাখতে পারলে না।

তার এই বিরক্তির ভঙ্গিমাটি কিন-ফোর নজর কিন্তু এড়ায়নি। তার বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো যখন তাকে উটের পিঠে উঠতে সাহায্য করতে এসে পথপ্রদর্শকটি তাকে কানে-কানে বলে গেলো : ওই লোক দুটো সম্বন্ধে সাবধানে থাকবেন!

এ-কথার অর্থ কী, জিগেশ করতে যাচ্ছিলো কিন-ফো কিন্তু লোকটি মুখে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলে যাত্রার সংকেত করলে। ছোট্ট বহরটি রাতের রাস্তায় রওনা হয়ে পড়লো।

পথপ্রদর্শকটির ওই রহস্যময় কথাটিতে কিন-ফোর বড্ড অস্বস্তি ও খটকা লাগলো; অথচ এটাও তার আদৌ বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে দু-মাস ধরে ছায়ার মতো অচঞ্চলভাবে তাকে সেবা করে শেষকালে তারা তার সঙ্গে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কিন্তু তাই-পিংয়ের ঘাঁটিতে তাকে যেতে দিতে চাচ্ছে না কেন তারা? এই উদ্দেশ্যেই কি তারা পেইচিং থেকে বেরোয়নি? চিঠিটা কিন-ফো ফিরে পাক, এটা কি তাদেরও স্বার্থের অন্তর্ভুত নয়! সত্যি, এদের আচরণ ক্রমশই ধাঁধার মতো ঠেকেছে।

এ-সব হি টিং ছট প্রশ্ন কিন-ফো মনে-মনেই চেপে রাখলো। পথপ্রদর্শকটির উটের ঠিক পিছনেই রয়েছে সে, আর ক্রেগ আর ফ্রাই রয়েছে তার পিছনে; কোনো কথা না-বলেই ঘণ্টা দু-এক একটানা গেলো তারা।

তখন মাঝরাতের আর বেশি বাকি নেই, হঠাৎ পথপ্রদর্শকটি থেমে পড়ে আঙুল তুলে দেখালো উত্তর দিকে : আকাশের গায়ে দীর্ঘ একটি মিশকালো রেখা ফুটে উঠেছে উত্তর দিকে–আর ওই কালো রেখার আড়াল থেকে জ্যোৎস্না-পড়া কতগুলো চকচকে পাহাড়ের চুড়ো দেখা যাচ্ছে : চাঁদ অবশ্যি। তখনো ওঠেনি–এখনো দিগন্তের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে চাঁদের টুকরো।

মহাপ্রাচীর! বললে পথপ্রদর্শকটি।

আজ রাতেই প্রাচীরটা পেরিয়ে যাবো কি আমরা? কিন-ফো জিগেশ করলে।

আপনি যদি বলেন, তাহলে যাবো নিশ্চয়ই।

তাহলে তা-ই হোক!

আমি তাহলে আগে গিয়ে পথঘাট দেখে আসি, পথপ্রদর্শকটি বললে, যতক্ষণ-না ফিরে আসি, ততক্ষণ এখানেই অপেক্ষা করুন।

উটগুলো সব থেমে পড়লো, মোড় ঘুরে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো পথপ্রদর্শকটি। ক্রেগ আর ফ্রাই এগিয়ে এসে কিন-ফোর কাছে দাঁড়ালো।

আপনার দেখাশুনা করবার ভার পাবার পর থেকে আমাদের কাজকর্মে আপনি তুষ্ট হয়েছেন তো? এক নিশ্বাসে তারা জিগেশ করলে।

নিশ্চয়ই।

তাহলে দয়া করে এই মর্মে এই কাগজটায় দস্তখৎ করে দেবেন কি যে আপনার তদারকি করার সময় আমাদের আচার-আচরণে আপনি অতীব সন্তোষ লাভ করেছেন?

ক্রেগ তার নোটবইয়ের একটা পাতা ছিঁড়ে হতভম্ব কিন-ফোর দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

প্রশংসাপত্রটা কর্তাকে দেখালে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন, ফ্রাই বিশদ করলো বক্তব্য।

আমার পিঠটাকে টেবিল করে ওখানে রেখে লিখুন,বলে ক্রেগ কুঁজো হয়ে পিঠ বাড়িয়ে দিলো তার সামনে।

আর আপনার নাম দস্তখত করার জন্য এই যে কালিকলম যোগ করলো ফ্রাই।

কিন-ফো হেসে ফেললো; সই করতে-করতে বললো, কিন্তু এত রাতে হঠাৎ এই অনুষ্ঠান কেন?

কারণ আর দু-এক মিনিটের মধ্যেই আপনার সেন্টেনারিয়ানের বিমার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে, বললে ক্রেগ।

তখন আপনি আত্মহত্যা করুন বা বধ হতে যান–আমাদের তাতে কোনো আপত্তি নেই, বললো ফ্রাই।

কিন-ফো একেবারে স্তম্ভিত। অত্যন্ত মৃদু, স্পষ্ট ও অনুত্তেজিত স্বরে বললেও তাদের কথার একবর্ণও সে বুঝতে পারছিলো না। হঠাৎ পুবদিকে। এমন সময় চাঁদ উঠে এলো।

ওই যে, চাঁদ উঠেছে! বলে উঠলো ফ্রাই।

আজ তিরিশে জুন তার মাঝরাতে ওঠার কথা, বললে ক্রেগ।

আপনার বিমার মেয়াদ বাড়ানো হয়নি–দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দেননি আপনি, বললে ফ্রাই।

সেই জন্যে, ক্রেগ বুঝিয়ে বললো, আপনি আর সেন্টেনারিয়ানের মক্কেল নন এখন।

শুভরাত্রি, বিনীতভাবে বিদায় জানালো ফ্রাই।

শুভরাত্রি, ক্রেগও সমান সৌজন্য সহকারে প্রতিধ্বনি তুললো।

তারপরেই গোয়েন্দা দু-জন তাদের উটের মুখ উলটো দিকে ঘুরিয়ে কিন-ফোকে হতবাক, বিমূঢ় ও স্তম্ভিত করে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

আর তাদের উটের পায়ের শব্দ মেলাবার আগেই রে-রে করে এসে একদল লোক চড়াও হলো কিন-ফোর উপরে, তাদের পুরোভাগে ছিলো স্বয়ং পথপ্রদর্শকটি। সুন অসহায় কিন-ফোকে ফেলে রেখেই পালাতে চাচ্ছিলো, কিন্তু লোকগুলো তাকেও বাদ দিলো না।

পর মুহূর্তেই প্রভু-ভৃত্য দুজনকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো মহাপ্রাচীরের তলায় একটা ছোটো চোর-কুঠুরির কাছে : তারা ভিতরে ঢুকতেই তাদের পিছনে দরজাটি সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো।

.

২২. আবার শাংহাই

চিনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট তিন-চি-হুয়াং–সেই তৃতীয় শতাব্দীতে; লম্বায় প্রায় ১৪০০ মাইল–লিয়াও-তং উপসাগর থেকে শুরু হয়ে কানসু প্রদেশ পর্যন্ত গেছে, তারপর ক্রমশ সরু হয়ে মিলিয়ে গেছে। সারি-সারি গেছে দুর্গপ্রাচীরের ডবল দেয়াল-পঞ্চাশ ফুট উঁচু আর কুড়ি ফুট চওড়া একেকটা অংশ প্রাচীর থেকে ঠেলে বেরিয়েছে; নিচের দিকটা এ্যানাইট পাথরের, উপরের দিকটা ইট দিয়ে তৈরি, চিন-রুশ সীমান্ত ধরে যে-গিরিশ্রেণী গেছে, এই প্রাচীর গেছে তারই গা বেয়ে। চিনের দিকে দেয়ালটা এখন জীর্ণ হতে চলেছে, কিন্তু যে-পাশটা মাঞ্চুরিয়ার দিকে, তা এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে–সেই দুর্ধর্ষ ঘুলঘুলির সারি এখনো আছে, যার ভিতর থেকে গুলি-গোলা ছোঁড়া হতো।

এই দুর্গপ্রাচীর কেউ রক্ষা করে না আজকাল-না-কোনো সেনাবাহিন, না-কোনো গোলন্দাজ দল। রুশী, তাতার, কিরঘিজ আর চৈনিক–সবাই অবাধে এখান দিয়ে যাতায়াত করতে পারে; তাছাড়া এই দেয়াল মোঙ্গোল ধুলোর ঝড়কেও কোনো বাধা দিতে পারে না–কখনো-কখনো হাওয়া এমনকী রাজধানী পর্যন্ত রাঙা ধুলো উড়িয়ে নিয়ে আসে।

একরাশ খড়ের উপর একটা হতচ্ছাড়া রাত কাটাবার পর কিন-ফো আর সুনকে পরদিন সকালবেলায় এইসব পরিত্যক্ত ও নিরিবিলি প্রাচীরের থামের তলা দিয়ে জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো। বারো জনের একটা দল তাদের নিয়ে যাচ্ছে; লোকগুলো যে লাও-শেনেরই স্যাঙাৎ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যে-পথপ্রদর্শকটি তাদের অ্যাদুর নিয়ে এসেছে, তার আর কোনো পাত্তা নেই; এটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে সে দুরভিসন্ধিবশতই তাদের এই বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে গেছে–ব্যাপারটা মোটেই কোনো দৈবদুর্ঘটনা নয়। মহপ্রাচীরের ওপাশে যাবে না বলে বদমায়েশটা যে গাঁইগুই করেছিলো, তা যে আসলে সন্দেহ না-জাগাবার একটা ফন্দি মাত্র–এটা এখন আর বুঝতে অসুবিধে হলো না; সেও যে তাই-পিং-এর হুকুমই তামিল করছিলো, তাও এখন প্রশ্নাতীতরূপে সত্যি।

তোমরা নিশ্চয়ই আমাকে লাও-শেনের ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছো? বাহিনীর সর্দারকে বললো কিন-ফো।

ঘণ্টাখানেক পরেই সেখানে পৌঁছে যাবো আমরা, লোকটা উত্তর দিলে।

কিন-ফোর অনুমানই যে ঠিক, এ-কথায় এটাই প্রমাণিত হলো, যদিও প্রমাণের কোনো দরকার ছিলো না; তবু কেন যেন এ-কথা জেনে বেশ তৃপ্তি পেলে সে। যেখানে যাবে বলে সে রাস্তায় বেরিয়েছিলো, সেখানেই তো এরা নিয়ে যাচ্ছে তাকে–তাই নয় কি? তাছাড়া যে-কাগজটার জন্যে তার প্রাণ ছিন্নপ্রায় সূক্ষ্ম রঞ্জুতে ঝোকুল্যমান, এবার তো সেটাই ফিরে পাবার সম্ভাবনা দেখা দিলে অবশেষে। কোনো চাঞ্চল্যই দেখা গেলো না তার, নির্বিকার ও আশ্বস্ত তার ভঙ্গি–যাবতীয় আতঙ্কের অভিব্যক্তি দেখা গেলো বেচারা সুনেরই হাবভাবে-ভয়ে তখন দাঁতকপাটি লেগে যাচ্ছিলো বেচারার।

দেয়াল পেরিয়ে বাহিনীটা কিন্তু সেই বিখ্যাত মোঙ্গোল সরণি ধরলো না, বরং পার্বত্য অঞ্চলের এক খাড়াই ও বন্ধুর পথ ধরে চললো; বন্দীদের তারা এমনি সাবধানে পাহারা দিচ্ছিলো যে পালাবার সব চেষ্টাই তাদের ব্যর্থ হতো-যদি অবিশ্যি তারা পালাবার কোনো মলব আঁটতো।

ওই উত্রাই দিয়ে যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়, ততটা দ্রুতবেগেই তারা যাচ্ছিলো। ঘণ্টা দেড়েক পরে একটা ঠেলে-বেরিয়ে-পড়া চুড়োয় বাঁক ঘুরেই তারা একটা জরাজীর্ণ ও হতশ্রী দালানের কাছে এসে পড়লো; আগে এটা ছিলো একটি বৌদ্ধ বিহার–বৌদ্ধ ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখা গেলো পাহাড়ের চুড়োয়, এই দালানটিতে। এখন বোধহয় সীমান্তের এই ফাঁকা জায়গায় কেউই আর পুজো দিতে আসে না; বরং দস্যুদের আস্তানা গড়ার পক্ষে এর চেয়ে চমৎকার কুঠি আর হতেই পারে না। লাও-শেন যদি এখানেই তার ডেরা বেঁধে থাকে, তাহলে সে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে।

কিন-ফোর প্রশ্নের উত্তরে সর্দার তাকে জানালে যে সত্যি, ওটা লাও-শেনেরই ডেরা।

এক্ষুনি তার কাছে নিয়ে চলো আমাকে, কিন-ফো বললো।

লোকটা বললো, সেই জন্যেই তো আপনাকে আনা হয়েছে।

প্রথমে কিন-ফো আর সুনের পিস্তলগুলো কেড়ে নিলো তারা, তারপর সেই পুরোনো মন্দিরটার ভিতরের একটা বারান্দায় নিয়ে আসা হলো তাদের। দুর্দান্ত দেখে দেখতে জনাবিশেক লোক এখানে অপেক্ষা করছিলো : পরনে অস্ত্রশস্ত্র সমেত দস্যুদের পোশাক। কিন-ফো ঢুকতেই তারা দু-ধারে সার করে। দাঁড়ালো। কিন-ফো বিন্দুমাত্র বিচলিত না-হয়ে তাদের মধ্যে দিয়ে নির্ভীকাবে এগিয়ে গেলো, কিন্তু সুনকে ঘাড় ধরে টেনে আনতে হলে সেখানে। বারান্দাটার শেষপ্রান্তে নিরেট দেয়ালের গায়ে খাঁজ কেটে সারি-সারি সিঁড়ি গেছে একেবারে পাহাড়ের মাঝখান অব্দি–এমন জটিলভাবে গোলকধাঁধার মতো ঘুরে-ঘুরে পথ গেছে সেখানে যে, অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে পথ চিনে । চলাই মুশকিল হতো।

মশাল জ্বালিয়ে বন্দীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো তারা, প্রায় তিরিশটা সিঁড়ি নেমে-আসার পরে একটা সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রায় দুশো হাত হেঁটে এসে শেষটায় একটা মস্ত হলঘরে এসে পৌঁছুলো তারা; আরো মশাল জ্বালানো ছিলো সেই ঘরে, কিন্তু তবু ঘরটা মোটেই যেন আলো হয়নি–ঝাঁপশা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। নিচু ছাত, বিশাল একেকটা থামের গায়ে চৈনিক পুরাণের নানা অতিকায় ও আতঙ্কজাগানো জীবজন্তুর মূর্তি খোদাই-করা, থামগুলো যত উপরে উঠেছে, ততই যেন চওড়া হয়েছে। কিন-ফো ঢুকতেই সারা ঘরে একটা মৃদু মর্মর উত্থিত হলো, আর তাইতেই সে বুঝতে পারলো যে ঘরটায় লোক আছে, মানে ঘর শুদ্ধ গিশগিশ করছে লোক–যেন কোনো বিশেষ অধিবেশন বসবে বলে রাজ্যশুক্কু তাই-পিং এসে হাজির হয়েছে।

সেই অর্ধবর্তুল হলঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা পাথরের মঞ্চ–আর তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশালদেহী মানুষ; কোনো গোপন বিচারসভার সভাপতি যেন সে, তাকে দেখে এটাই মনে হয়; তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারটি অনুচর, যেন তারা তার উপদেষ্টা পরিষৎ; বিচারপতির ইঙ্গিতে তারা বন্দীদের কাছে এগিয়ে আনার আদেশ দিলো।

ইনিই লাও-শেন, পাহারাওলাদের সর্দার মঞ্চের উপরকার সেই বিশাল মানুষটিকে দেখিয়ে দিলে।

দৃঢ়পায়ে সামনে এগিয়ে এলো কিন-ফো, একেবারে সরাসরি কাজের কথা পাড়লে।

আমার নাম কিন-ফো, সে শুরু করলে। ওয়াং আপনার পুরোনো বন্ধু ও সহযোগী ছিলেন। ওয়াংকে আমি একটা চিরকুট দিয়েছিলুম–তাতে বিশেষ একটা চুক্তি সম্পাদন করা ছিলো। ওয়াং সেই চিরকুটটা আপনাকে দিয়ে গেছেন। আমি এই কথাটি বলতেই এসেছি যে ওই চুক্তি এখন আর বৈধ নয়। আমি আপনার কাছ থেকে চিরকুটটা ফিরে চাই।

তাই-পিং-এর একটি পেশীও ঈষৎ কম্পিত হলো না; সে যদি ব্রনজ নির্মিত হতো তাহলেও বোধকরি এত অচঞ্চল থাকতে পারতো না।

 তার বিনিময়ে আপনি যে-কোনো দাম চাইতে পারেন, বলে, কিন-ফো উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো।

কিন্তু কোনো উত্তর এলো না।

কিন-ফো বলে চললো, যে-ব্যাঙ্কে চান, সেই ব্যাঙ্কের নামে আমি চেক লিখে দিচ্ছি। যাকেই পাঠাবেন, সেই-ই যাতে টাকাটা পায়, আমি তার গ্যারান্টি দিচ্ছি। কেবল একবার মুখ ফুটে বলুন কত টাকা পেলে চিরকুটটা আপনি ফিরিয়ে দেবেন।

তবু কোনো উত্তর এলো না।

কিন-ফো আরো স্পষ্ট করে ধীরে-ধীরে তার কথার পুনরাবৃত্তি করলে, কত চান? পাঁচ হাজার তায়েল?

তবু স্তব্ধতা অটুট থেকে গেলো।

দশ হাজার?

লাও-শেন আর তার দলবল যেন পাথরের মূর্তি।

কিন-ফো উদ্বিগ্ন ও অধীর হয়ে উঠলো।

আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না আপনি?

লাও-শেন গম্ভীর ভাবে মাথা হেলিয়ে জানালো যে সে শুনতে পেয়েছে।

তিরিশ হাজার তায়েল দেবো আমি আপনাকে। সেন্টেনারিয়ানদের কাছ থেকে যত টাকা পেতেন, সেই টাকাই আপনাকে দেবো। কাগজটা আমার চাই। বলুন, কত চান, একবার বলুন কেবল।

তাই-পিংটি আগের মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

উত্তেজনায় ও অস্বস্তিতে অধীর হয়ে উঠলো কিন-ফো। হাত মুঠো করে সবেগে সে ছুটে গেলো মঞ্চের কাছে। কত টাকা চান আপনি, কত টাকা?

টাকা দিয়ে সে-কাগজ তুমি কিনতে পারবে না, অবশেষে স্পষ্ট, কঠিন ও নির্মম গলায় বলে উঠলো তাই-পিং : তুমি ভগবান বুদ্ধের কাছে দোষ করেছে : তথাগত তোমাকে যে-জীবন দিয়েছেন, সেই জীবনকে তুমি ঘৃণা করতে শুরু করেছিলে। ভগবান বুদ্ধের অবমাননার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে। জীবন যে কত বড়ড়া মহার্ঘ উপহার, তাকে যে তোমার মতো এমন হালকাভাবে নেয়া যায় না, এটা তুমি বুঝতে পারবে কেবল মৃত্যু হলে।

যে-স্বরে এ-সিদ্ধান্ত জানানো হলো তাতে এটা বোঝা গেলো যে উত্তর দিয়ে কোনো লাভ হবে না; আর তাছাড়া কিন-ফো যদি নিজের সপক্ষে কিছু বলতেও চাইতো, তাহলে সে সুযোগ সে কিছুতেই পেতো না। লাও-শেন ইঙ্গিত করবামাত্র তাকে ধরে সজোরে টেনে নিয়ে একটা খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে তার দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দেয়ে হলল। হাউমাউ করে কান্নাকাটি করা সত্ত্বেও সুনেরও সেই একই দশা হলো।

ভালোই হলো! একা হয়ে আপন মনে বললে কিন-ফো, যারা জীবনকে অপছন্দ করে মৃত্যুই বুঝি তাদের একমাত্র প্রাপ্য।

কিন্তু মৃত্যু তাই বলে মোটেই নিকটবর্তী ছিলো না। ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে গেলো, কিন্তু কেউ তাকে বধ করলে না। তাই-পিং হয়তো তাকে অকথ্য যন্ত্রণা দিয়ে মারতে চায় : কিন-ফো মনে-মনে ভাবতে চেষ্টা করলো আর-কী নিগ্রহ তার কপালে আছে। একটু পরে তার কেমন যেন মনে হলো খাঁচাটা ধরাধরি করে নিয়ে কোনো শকটে তুলে দেয়া হলো। বোঝা যাচ্ছে তাকে দূরে-কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে একটানা ঘোড়ার খুরের। আওয়াজ শোনা গেলো, শোনা গেলো পাহারাওলাদের অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি, আর নির্দয়ভাবে সারাক্ষণ তার খাঁচাটা বারেবারে ধাক্কা খেলো, নড়ে-চড়ে উঠলো। তারপরে খানিকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নেই-পরে বোঝা গেলো বুঝি অন্য-কোনো যানবাহনে ভোলা হলো তার খাঁচাটা, একটা গুঞ্জন উঠলো চাকার, হতাশ বন্দীটি বুঝতে পারলো যে কোনো স্টিমারে তোলা হয়েছে তাকে।

জাহাজ থেকে জলে ফেলে দিতে চায় নাকি আমাকে? মনে-মনে ভাবলে সে, তাহলে বলতেই হয় যথেষ্ট দয়া দেখালো–এর চেয়ে ভীষণ-কোনো নিগ্রহের ব্যবস্থা করলো না যখন–

একে-একে আটচল্লিশ ঘণ্টা কেটে গেলো। দিনে দুবার করে খাঁচার দরজা খুলে সামান্য খাদ্য দেয়া হতো তাকে : বাড়িয়ে-দেয়া হাতটি ছাড়া আর-কিছুই দেখতে পেতো না সে-কে তাকে খাবার দিচ্ছে তাও না; কত প্রশ্ন জিগেশ করেছে সে তখন, কিন্তু কোনো উত্তরই আসেনি।

অঢেল অবসর তার এখন : যতক্ষণ খুশি ভাবতে পারে শুয়ে-বসে। বছরের পর বছর কেটে গেছে–কোনো মানবিক অনুভূতিই সে বোধ করেনি; কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মেছে যখন, তখন মানুষের আবেগ-অনুভব না-করে তার উপায় কী! তাই বুঝি গত কয়েক সপ্তাহে চূড়ান্তই হলো সবকিছুর : মানুষের যত-রকম অনুভূতি হয়, সব সে অনুভব করলো, যথেষ্ট মাত্রায়; জানে যে মরতে তাকে এখন হবেই–কিন্তু একটা তীব্র ইচ্ছে তাকে বেঁধে ফেললো–যেন মরবার আগে দিনের আলো দেখতে পায় সে; আচমকা অজ্ঞাতসারে তাকে যদি গভীর সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, এই ভয়ে এখন তার সর্বাঙ্গে শিহরন খেলে যায়। হায় রে! যদি মরবার আগে অন্তত একবার দেখতে পেতো লা-ওকে; লা-ও তার সর্বস্ব, তার সমস্তকিছু–আর তাকে দেখতে পাবে না সে! এই চিন্তাও যে কী ভয়ানক!

শেষ পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রাও শেষ হয়ে গেলো। তবু এখনো সে বেঁচে আছে; কিন্তু এবার নিশ্চয়ই তার জীবনের শেষ ক-টি মুহূর্ত সমাগত; আর এটাই ছিলো তার চরম ভয়। প্রত্যেকটি মিনিট এখন তার কাছে এক-এক বছর বলে ঠেকে, এক ঘণ্টাকে একশো বছর বলে মনে হয়!

কিন্তু তার বিস্ময় অসীমে পৌঁছে গেলো : হঠাৎ অনুভব করলো আবার তার খাঁচাটি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে কারা, কোন-এক অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখলো যেন; বাইরে লোকজনের সাড়া পেলো সে; কয়েক মিনিট পরে দরজা খুলে গেলো খাঁচার, আর চট করে তাকে ধরে তার চোখের উপর একটা পট্টি বেঁধে দেয়া হলো, তারপর সজোরে তাকে ধাক্কা দিতে-দিতে নিয়ে গেলো পথ দিয়ে। কিছুক্ষণ পরে সে বুঝতে পারলো তার সঙ্গের লোকজনের পায়ের শব্দ থেমে গেছে : এটাই যে বধ্যভূমি, তাতে তার আর সন্দেহ রইলো না; সে চেঁচিয়ে উঠলো : একটা শেষ আরজি আছে আমার। একটা মাত্র অনুরোধ : আমায় চোখ খুলে দাও–দিনের আলো দেখতে দাও আমায় মানুষের মতো মরতে দাও আমাকে-মরতে আমি যে ভয় পাই না এটা বোঝতে দাও।

দাও, অপরাধীর শেষ প্রার্থনাটা পূরণ করে দাও, কে যেন তার কানের পাশেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো : চোখের উপর থেকে বাঁধন খুলে দাও ওর।

বাঁধন খুলে দিতেই কিন-ফো স্তম্ভিত বিস্ময়ে কেঁপে উঠলো। স্বপ্ন দেখছে নাকি সে? অর্থ কী এর?

তার সামনেই সুস্বাদু ভোজ্যদ্রব্যে সাজানো খাবার-টেবিল। পাঁচজন অতিথি বসে মৃদু-মৃদু হাসছেন, যেন তারা এতক্ষণ তারই আগমন প্রত্যাশা করছিলেন। দুটো আসন এখনো ফাঁকা পড়ে আছে।

আমি কি পাগল হয়ে গেছি। কিছুই বুঝতে না-পেরে উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কিন-ফো।

নিজেকে শামলাতে বেশ কিছুক্ষণ লাগলো তার; চোখ রগড়ে চার পাশে তাকিয়ে দেখলো সে ভালো করে; তার ভুল হয়নিঃ ওই তো ওয়াং, আর ওই তার চার বাল্যবন্ধু, ইন-পাং, হুআল, পাও-শেন আর তিং। দু-মাস আগে কোয়াংতুঙের পার্ল রিভারের বজরায় বসে যাদের সঙ্গে সে ভোজ খেয়েছিলো। এই তো এটা তার শাংহাইয়ের ইয়ামেনের খাবার ঘর।

বলো, বলো, চেঁচিয়ে উঠলো সে :এ-সবের মানে কী? এ কি সত্যি তুমি, না তোমার ভূত?

দার্শনিক মুচকি হাসলো। ভয় নেই, আমি সত্যিই ওয়াং!

কিন-ফো আরো যেন হতভম্ব হয়ে গেলো। ওয়াং তখন বোঝালো :বেশ শিক্ষা হলো তোমার, কী বলে? অবশেষে জীবনের কাছে একটি নির্দয় পাঠ নিয়ে তুমি বাড়ি ফিরে এসেছে। এই পাঠটা অবশ্য আমারই কাছে তুমি পেলে। তোমাকে যে এত কষ্ট সইতে হলো, তার জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু সবই করেছি তোমার ভালোর জন্য, কাজেই আমাকে তোমার ক্ষমা করতে হবে।

কিন-ফো আরো হতভম্ব হয়ে চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

এক্ষুনি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি, বললে ওয়াং, তোমার অনুরোধে তোমাকে হত্যা করতে কেন সম্মত হয়েছিলুম, জানো? যাতে অন্য-কারু হাতে সে-ভার তুমি না-দাও। তোমার আগেই আমি জানতে পেরেছিলুম যে তোমার ওই সম্পত্তি হারাবার খবর সর্বৈব মিথ্যা; সেই জন্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে এখন মরতে চাইলে কী হবে, একটু পরেই বাঁচবার জন্যে তুমি ব্যাকুল হয়ে উঠবে। আমি আমার প্রাক্তন সহযোগী লাও-শেনকে সব খুলে বললুম। লাও-শেন এখন সরকারের অতিবিশ্বস্ত বন্ধুদের একজন : বহু আগেই সে বর্তমান সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু এই ব্যাপারে সে আমার সহযোগিতা করতে রাজি হলো-আর করলোও; গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো কেমন করে তোমাকে একেবারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো সে; জীবনের মূল্য বোঝবার জন্য এটা তোমার দরকার ছিলো বলে আমার মনে হয়েছিলো; যে-নিগ্রহ আর উৎপাত তুমি সহ্য করেছে, যে কষ্ট তুমি পেয়েছে এ-ক-দিন, তাতে প্রতিদিন যেন আমারই বুক থেকে রক্ত ঝরে পড়েছে : এই দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তোমাকে একা ছেড়ে দিতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো–কিন্তু আমি এটা জানতুম আর-কোনো সহজ উপায়ে তোমাকে শেষ অব্দি সুখের সন্ধান দেয়া যাবে না।

ওয়াং আর-কিছু বলবার আগেই কিন-ফো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বেচারা ওয়াং! আমার জন্য কত কষ্টই না-জানি তোমাকে সইতে হয়েছে। আর তাছাড়া তুমি ঝুঁকিও খুব-একটা কম নিয়েছিলে নাকি! পালিকাওর সেতুর উপর সেদিন যা হয়েছিলো, তা আমি কোনদিনও ভুলবো না।

দার্শনিক হো-হো করে প্রাণখোলাভাবে হেসে উঠলো। সত্যি, কনকনে ঠাণ্ডা ছিলো জলটা–যে-কোনো লোকেরই রক্ত জমে যেতো ঠাণ্ডায়; তায় আমি হলুম পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ, অনেকটা পথ তাড়া খেয়ে ঘেমে একশা হয়ে গিয়েছিলুম। আমার দর্শন আর বয়েস-দুয়ের উপরই সেদিন ভীষণ ধকল গিয়েছে। কিন্তু ভেবো না, তাতে কোনো বিপদ হয়নি। অন্যের উপকার করতে গেলে লোকে যত জোরে দৌড়তে পারে, তেমন বোধহয় আর-কখনো পারে না।

অন্যের উপকার? সত্যি, আমার আর এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যের ভালোর জন্য কাজ করাতেই যে সুখ, তাতে সত্যি বলছি আমার আর-কোনো সংশয় নেই।

আলোচনাটা আরো তত্ত্ববহুল হয়ে পড়তে হয়তো, যদি-না তখন সুনের আবির্ভাব ঘটতে। দু-দিন সমুদ্রযাত্রার ধকলে বেচারা একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে। তার গায়ের রঙ কী হয়ে পড়েছিলো তা বলা মুশকিল, কিন্তু প্রভুগৃহে পুনঃপ্রবেশ করতে পেয়ে তার আহ্বাদের সীমা ছিলো না।

ওয়াংকে ছেড়ে দিয়ে কিন-ফো এবার ঘুরে-ঘুরে তার বন্ধুদের সঙ্গে একে-একে করমর্দন করলো। কী আহাম্মকই ছিলুম এতকাল! বললো সে সবাইকে।

কিন্তু এখন থেকে তুমি নিশ্চয়ই পরমজ্ঞানী হয়ে উঠবে, বললে ওয়াং।

তাহলে আমার প্রথম বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হবে, যদি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করতে পারি। আমার সব বিপত্তির মূল ওই চিরকুটটা না-পেলে আমার কিছুতেই স্বস্তি হবে না। যদি ওটা লাও-শেনের কাছে থেকে থাকে, তাহলে ফিরিয়ে দিতে বলো, কারণ কোনো বিবেকহীন লোকের হাতে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ঘরশুদ্ধ লোকের মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।

ওয়াং বললে, বন্ধুটির সব রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তার চরিত্রটা একেবারে আমূল বদলে দিয়েছে। আর সেই নির্লিপ্ত মানুষটি নেই।

কিন-ফো তবু বললে, কিন্তু বললে না তো চিরকুটটা কোথায় আছে। চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলে তার ছাই উড়িয়ে না-দেয়া অব্দি আমি কোনো শান্তি পাবো না।

ওয়াং বললে, তোমাকে বড্ড উৎসুক দেখাচ্ছে—

উৎসুক হব না? বললে কিন-ফো, কিন্তু চিরকুটটা কই? লাও-শেন ফিরিয়ে দিয়েছে কি?

লাও-শেনের কাছে ছিলোই না কোনোদিন। তাহলে তোমার কাছে আছে? তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ফিরিয়ে দিতে দ্বিরুক্তি করবে না? আমার আহাম্মকির পুনরাবৃত্তি যাতে না-হয় তার গ্যারান্টি হিশেবে নিশ্চয়ই ওটা রাখতে চাইবে না তুমি?

নিশ্চয়ই না। বললে ওয়াং, কিন্তু চিরকুটটা তো আমার কাছে নেই। সত্যি-বলতে আমার কোনো অধিকারই নেই ওটার উপর!

তার মানে! কিন-ফো চেঁচিয়ে উঠলো, নিশ্চয়ই তুমি বোকার মতো সেটা অন্য-কাউকে দিয়ে দাওনি?

তা-ই করেছি কিন্তু, উত্তর দিলো ওয়াং।

কেন? কখন? কাকে দিয়েছো? কিন-ফো ব্যাকুল হয়ে উঠলো।

দিয়েছি–ওয়াং শান্ত গলায় শুরু করলো।

কাকে? কাকে দিয়েছো? বাধা দিয়ে জিগেশ করলো কিন-ফো।

বলবার সময়টা দিচ্ছো কই? এমন একজনকে দিয়েছি যে নিজেই তোমাকে ওটা ফিরিয়ে দেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।

তার কথা শেষ হবার আগেই কিন-ফো দেখতে পেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লা-ও, তার বাড়িয়ে-ধরা কোমল হাতে রয়েছে চিরকুটটা; পরদার আড়াল থেকে এতক্ষণ সে সব শুনেছে–এখন আর থাকতে না-পেরে এগিয়ে এসেছে কিন-ফোর কাছে।

লা-ও! বলেই কিন-ফো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে গেলো।

কিন্তু লা-ও পিছিয়ে গেলো–যেন যেমন রহস্যময়ভাবে ঘরে এসে ঢুকেছিলো তেমনিভাবেই চলে যাবে এক্ষুনি।

ধীরে, অত তাড়াহুড়ো নয়! লা-ও বললে, আনন্দ করার আগে কর্তব্য শেষ করে নাও। তোমার হাতের লেখা বলে চিনতে পারছো এটাকে?

সে আর বলতে! জগতে এমন আহাম্মক আর দ্বিতীয় আছে না কি যে ও-রকম লিখবে?

সত্যি, ওটাই তোমার মত? লা-ও জানতে চাইলো।

সত্যি ।

তাহলে কাগজটা তুমি পুড়িয়ে ফেলতে পারো, বললে লা-ও, সেই সঙ্গে সেই মানুষটারও মৃত্যু হোক, যে ওটা লিখেছিলো। উদ্ভাসিত হেসে তাকে সে ওই ছোট্ট কাগজটা ফিরিয়ে দিলো–যা কিনা এতদিন তার এত যন্ত্রণা ও নিগ্রহের কারণ হয়ে ছিলো। মোমবাতির শিখায় তুলে ধরলো কিন-ফো কাগজটিকে, যতক্ষণ-না পুড়ে ছাই হয়ে গেলো ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে। তারপর বাগদত্তা বধূটির দিকে ফিরে তাকে সে বুকে চেপে ধরলো, বললো, এবার তুমি এসে আমাদের পুনর্মিলন উৎসবের কর্তী হও এখানে। ভোজ্যদ্রব্যের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করতে পারবো বোধহয় এখন।

তা আমরাও পারবো অবিশ্যি, অতিথিরা একযোগে বলে উঠলো।

এর কয়েকদিন পরেই রাজশোকের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলো। আগের চেয়েও জমকালো সব ব্যবস্থার পর বিয়ে হলো দুজনের।

আশা করা যায় নবদম্পতির ভালোবাসা আর ভাঙবে না কোনোদিনও।

পরবর্তী জীবনটা তাদের এমন সুখে কাটতে লাগলো যে শাংহাইয়ের সেই ইয়ামেনে একবার পদার্পণ করলেই আপনি হয়তো অতি সহজেই তার সৌগন্ধ্য ও নির্যাস পেতেন।