৫. ইতিমধ্যে ওর স্বামী এল

ইতিমধ্যে ওর স্বামী এল, এসেই মেয়েটাকে নিল ওর কোলে আর বধুর গালে আস্তে একটা টোকা দিল। হাসিমুখে বধুটি তাড়াতাড়ি রুটি ক’খানা সেঁকে ওকে জল খেতে দেবার ব্যবস্থা করছে। নিত্যান্ত অভাবের সংসার তবু কত সুখের নীড় ওরা রচনা করেছে ভাবছে মাধুরী, বিরাট প্রাসাদে গগনচুম্বি বিলাস দ্রব্য ওখানে নাই রইল, ওখানে আছে অন্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাধুরী মুরলীর মূর্তিমতি শান্তিসুধা। মাধুরীর মুখে অপরূপ একটা তৃপ্তির হাসি ফুঠে উঠলো। শুক্রবারের দিন মাধুরী ফোন করে মহেন্দ্রকে তার অফিসে জানালো যে আগামীকাল শনিবার সে শঙ্করের নৃত্য দেখতে যাবে, মহেন্দ্র যেন ছুটির পরই মেসে ফেরে। অব্যাহতি নাই মহেন্দ্র জানে তা সম্মতি দিল, মাধুরী শনিবার দিন দুটোর আগেই কতগুলো জিনিস নিয়ে এসে উঠলো মহেন্দ্রের মেসে। মহেন্দ্র তখনো ফেরেনি, অনেক বাবুই ফেরেননি। মাধুরী সোজা উঠে এলো উপরে মেসের চাকরটা এল ওর সঙ্গে। মহেন্দ্রের ঘর তালা বন্ধ। মাধুরী চাকরটাকে বললো।

তালা ভেঙ্গে দাও—

সে কি! বাবু বকবেন। চাকরটা বিপন্ন বোধ করছে খুবই।

–না আমি বলছি, তুমি ভাঙো–

–আজ্ঞে না বাবু–

মাধুরী ওকে আর কিছু বললো না, ড্রাইভার অনুপ সিং জিনিসগুলো নিয়ে ও পেছনে এসেছে। মাধুরী ইঙ্গিত করলো তালা ভাঙতে। অনুপ সিং পকেট থেকে একটা লম্বা গ্লাস কে করে তালাটা মোচর দিল, কম দামী তালা আধ মিনিটের মধ্যে ভেঙে গেল। ঘরে ঢুকলো মাধুরী অনুপ সিং। জিনিসগুলো ঘরে নামাতেই মাধুরী তাকে একখানা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললো, ভাল একটা তালা আন দুটো চাবি যেন থাকে।

অনুপ সিং চলে গেলে মাধুরী চাকরটাকে বললো, ঝাটা আন। ঘরে একটা চৌকি আনা হয়েছে কোথা থেকে কিন্তু বই রাখবার শেলফ ছিল না। মাধুরী একটা সেলফ এনেছে, একখানা টিপয়, দুটো ভাজা চেয়ার আর একখানা ক্যাম্বিসের ইজি চেয়ার, ওর লোক দুতিন বারে সেগুলো বয়ে আনলো নীচে থেকে। চাকরটা ঘর ঝাট দিতে লাগলো মাধুরী ঘরের প্রত্যেকটি কোন পরিষ্কার করিয়ে নিচ্ছে, চাকরটা পারছে না কেড়ে নিল মাধুরী ঝাটা তার হাত থেকে বললো–ছাড়ো অকর্মা। নিজেই একোন কোন পরিষ্কার করলো, তারপর বিছানাটা ঝেড়ে পেতে দিল। ঝালর দেয়া নতুন বালিশ দিয়ে পার দিকে রাখলো। পুরুইটালিয়ান ব্যাগ। লেপ আছে একখানা, চেয়ারগুলো ভাজ খুলে বসালো, একধারে ইজিচেয়ার, পাশে টিপয়টার ওপর কভার ঢেকে একটা ফুলদানীতে একগুচ্ছ ফুল সাজিয়ে দিল এরপর মাথার দিকের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিল একটা বড় ছবি রবীন্দ্রনাথের। ওর তলায় ছোট একটি ধুপদানী কয়েকটা ধুপকাঠি গুঁজে ধরিয়ে দিল। সে ঘর এখন আর চেনা যায় না। মাধুরী দেখছে নিজের সাজানো ঘরখানা নিজেই। মহেন্দ্র অফিস থেকে ফিরে উপরে এল দেখলো মাধুরীকে তদবস্থায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো–

 : এসব কি হচ্ছে মাধুরী?

: সেবা। হেসে জবাব দেয় মাধুরী।  

: একে সেবা বলে না মাধুরী, মহেন্দ্র করুণ কণ্ঠে বললো।  

: কি বলে তাহলে? প্রশ্নটা হাস্যদ্বারা রঞ্জিত।

: পূজা। শান্ত জবাব মহেন্দ্রের কণ্ঠ থেকে।

: পেশ পূজাই, যাও, হাতমুখ ধোও বেরুতে হবে।

 : আমাদের পুরোনো এমন অনেক পূজার গল্প আছে মাধুরী, যার তন্ত্রঃ প্রভাব ইষ্ট দেবতা সইতে অক্ষম হয়েছেন–

 : তুমি খুব ছোটলোক হয়ে যাচ্ছো মহীনদা, মাধুরী ক্রদ্ধকণ্ঠে বললো, আমার এ পূজা তো নয়ই সেবাও নয়, আমার পিতৃবন্ধুর পুত্রের প্রতি কর্তব্য যাও কাপড় ছাড়–

: কর্তব্য, Stem daughter of the voice of God মাধুরী সে শুষ্ক এতো সরস তো হয় না।

 : আমি নারী, কর্তব্যকে সরস করিতে পারি, যাও—

: ওর চোখের কারুণ্য দেখতে পেলো না মাধুরী। মহেন্দ্র নিঃশব্দে কোণার কলে গিয়ে। মুখ হাত পা ধুলো তারপর ঘরে ঢুকে ধূতী পাঞ্জাবী বদলে ফেললো।

মাধুরী ততক্ষণে বইগুলো সেলফে গুছিয়ে রাখছে, পোষাক পরে মহেন্দ্র তৈরী হয়ে বললো এবার কি করতে হবে।

 : তুমি বাইরে দাঁড়াও আমি আসছি।

মহেন্দ্র বাইরে ছাদে এসে দাঁড়াল। এখানে মেসের বাবুদের কয়েকজন ইতিমধ্যে উঁকি দিচ্ছে মাধুরীকে দেখার জন্য, মেসের বাবুরা এ সুযোগ কম পায়। কে ঐ মেয়েটি কোত্থেকে আসে মহেন্দ্রের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কি, এই নিয়ে ওকে দেখবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা ওরা করেছে, কিন্তু অতিশয় সাবধান, সরাসরি মহেন্দ্রকে প্রশ্ন করে জেনো নেয়া যায়, কিন্তু মহেন্দ্র এখনো নতুন, তবু আজ একজন জিজ্ঞেস করলো।

উনি কে আপনার? বিশেষ কেউ নিশ্চয়। হাসলো ছোঁকরা!  

হ্যাঁ, বলে মহেন্দ্র আর কিছু বললো না। মুখে সামান্য হাসি।

রোমন্সের সুযোগ মেলে কম, ভাগ্যবান মহেন্দ্রের সে সুযোগ পেয়েছে, অতএব তাকে ঘিরে অল্পবয়সী থেকে অধিক বয়সী মেম্বারগণ পর্যন্ত বেশ একটি রোমান্টিক গল্প খাড়া করে নিলেন মনে মনে, কিন্তু মাধুরী তার পূর্বে ঘরে তালা দিয়ে মহেন্দ্রকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

গাড়ীতে চড়ে সটান এলো চৌরঙ্গতে। সেখানে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে বসলো মহেন্দ্রকে নিয়ে। ভাল ভাল কয়েকটা খাবার আনতে আদেশ করলো। মহেন্দ্র আস্তে বললো অত কি হবে।

–খেতে হবে, হেসে বললো মাধুরী ক’দিন যা খাচ্ছ তা বোঝা যাচ্ছে চেহারা খানা দেখেই, নাও খাও, মানুষকে বাঁচতে হবে মহীনদা।

: হ্যাঁ, কিন্তু লক্ষ লোক রেস্তোরাঁয় না খেয়েও বাঁচে মাধুরী ভাল ভাবেই বেঁচে থাকে।

তর্ক করো না মহীনদা, সতর্ক করে দিই তোমায়। আমার ইচ্ছে সপ্তাহে একটা দিন অন্ততঃ দুজন এক জায়গায় বসে খাব।

–মানে আমাকে খাওয়াবে, এই তো!!

 হ্যাঁ তাই। মাধুরী রেগে শুধালো, তোমাকে খাওয়াবার আমার অধিকার আছে, বলল নেই।

–আছে, নিশ্চয়ই আছে বলে মহেন্দ্র কথাটাকে জোরালে করলো এবং নিঃশব্দে খেতে লাগলো। ওর মুখের হাসিটা লক্ষ্য করছে মাধুরী। গম্ভীর হয়ে বললো, হাসছো যে।

মানুষ যখন নিজেকে অপরের চোখে দেখে মাধুরী, তখন তার হাসিটা হার মানার হাসি?

ধন্যবাদ। হার মানলে তাহলে। বলে মাধুরীও হাসলো।

এরপর খাওয়া শেষ করে ওরা গেল নিউ এম্পায়ারে শঙ্করের নৃত্য দেখতে, সামনের আসনে বসলো দু’জনে। নৃত্য আরম্ভ হোল। অপূর্ব বাজনা! অনস্বাদিত এক সৌন্দর্য রসের পরিবেশন, কিন্তু কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি লেগে রয়েছে মহেন্দ্রের অন্তরে। মাধুরী শুধালো?

–তোমার ভাল লাগলো না মহীনদা?

–সে কি। একি ভালো না লাগবার বিষয়?

–তবে মুখোনা অত গম্ভীর কেন?

কারণটা ঠিক বুঝতে পারবো না মাধুরী। কোথায় যেন একটু অতৃপ্তি হয়ে গেল, যেন পেলাম না, দেবতা এসেছিলেন, আলো জ্বেলে দেখা হয়নি।

: কেন মহীনদা এরকম কেন মনে হচ্ছে?

: বোঝানো যাবে না মাধুরী। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয় যখন অতীন্দ্রিয়তে আঘাত করে তখন সে থাকে অনুভূতির কোঠায়, ভাষায় তাকে রূপ দেয়া যায় না?

মাধুরী কথাটা বিশেষ বুঝলো না। নিঃশব্দে মেসের দরজায় মহীনকে নামিয়ে দিয়ে ফিরলো। রাত তখন দশটারও বেশী।

মেসের লোকগুলি কেরানী হলেও ভদ্রসন্তান এবং প্রায় সকালেই শিক্ষিত, এই কয়দিনেই মহেন্দ্রকে ওরা ভালবেসে ফেলেছে, তার প্রধান কারণ মাধুরী। মেস জীবনে নারীর স্নেহের স্পর্শ কদাচিৎ ঘটে, কিন্তু যদি কোন ভাগ্যবান মেম্বারের ভাগ্যে তা ঘটে তাহলে অপর সকলেরও যে কিছু ভাল হয়, অতল সৈকতে বাড়িবিন্দুর মত, ঈর্ষার সুযোগ এখানেই নেই, অসুয়া এখানে আসে না, অহেতুক অনুরাগ, এ মেসেও তাই ঘটলো। সমবয়সী সকলেই মহন্দ্রেকে নিয়ে বেশ আনন্দের পরিমণ্ডল গড়ে তুললো।

সেদিন মাধুরী এসে ওর ঘরখানাকে সাজিয়েছে চমৎকার করে, আজ আবার শনিবার, সে নিশ্চয়ই আসবে আশা করে মেম্বারগণ যে যতটা সম্ভব শীঘ্র ফিরলে ঐ অপরূপাকে একবার দেখতে পাব।

ঠিক আড়াইটার সময় এলো মাধুরী। হাতে ঘেরাটোপ জড়ানো সেতার। শান্তি নিকেতন ঝোলানো ঝোলানো আরো কতগুলি কি বস্তু। সটান উপরে উঠে গেল একটা চাবি ওর কাছে আছে, ঘর খুললো গিয়ে, জিনিসগুলো সাজিয়ে রাখবে এবার।

মেসে ছোঁকরা মেম্বার ক’জন তখন কেউ তেলে ভাজা মুড়ি চিবুচ্ছে, কেউবা দু’পয়সার বিস্কুট আর চা খাচ্ছে, একজন খাচ্ছিল কমলালেবু সে মাধুরীকে দেখাতে চায় যে সেই এখানে কমলালেবু খায়, অতএব সে খোসাটাকে ছুঁড়ে ফেললো মহেন্দ্রের ঘরের সম্মুখে, মাধুরী এসে বলল।

–মেস মানে ভেড়ার গোয়াল নয়, ভদ্রলোকের থাকবার আস্তানা।

–আজ্ঞে মাপ করবেন, ওগুলো আমাদের বদ অভ্যাস, তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিল খোসাটা।

শুধরে নেবে, বলে মাধুরী আবার ঘরে ঢুকে নিজের কাজে মন দিল। মহেন্দ্র এসে পড়লো। ও জানে মাধুরী আসবে কাজেই কিছু মাত্র ব্যস্ত না হয়ে নিঃশব্দে জামা কাপড় খুলছে।

নাও শীঘ্রী কাপড় ছাড়া বেরুতে হবে।

–কোথায়?

এত খোঁজে কাজ কি? যা বললাম কর।

মাধুরী ফুলগুলো সাজিয়ে রাখলো, একটা প্লেটে কিছু লেবু আর পেঁপে কেটে মহেন্দ্রর সামনে রেখে দিল। মহেন্দ্র কোট গায়ে দিতে দিতে বললো

–ওটা কি? সেতার?

–হ্যাঁ—

–তোমার নিজের সেতারটাই আনলে মাধুরী?

–নিজেরটাই তো দান করে আনন্দ মহীনদা।

–কিন্তু ওটা তোমার হাতের জিনিস।

: বেশ তো তোমার হাতে বাজবে। মাধুরীর মুখ ফিরালো অন্য দিকে।

: মাধু। মহেন্দ্র গম্ভীরকালো চোখে আনন্দ বিষাদ একসঙ্গে বাম্পময় হয়ে উঠেছে।

: বলো। মাধুরী হেসে তাকালো ওর পানে।

: না কিছু না, সব কথা বলা যায় না মাধুরী।

: থাক, না বলা কথাটা আমার বেশী ভাল লাগে।

মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি, ফলের টুকরোগুলো গিলতে আরম্ভ করছে। সন্দেশটা গেলা যাচ্ছে। মাধুরী হেসে বললো অত তাড়া কেন? আস্তে খাও চাকরী তো আর ছুটে যাবে না।

: না কোথায় যেতে হবে বললে?  

: হ্যাঁ, তার দেরী আছে, মাধুরী হাতের ঘড়িটা দেখলো–যাব ‘জ্যু’ দেখতে।

: ‘জ্যু’ কেন? মহেন্দ্র বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো।

: সব কেনোর উত্তর থাকে না মহীনদা চলো। মাধুরী উঠলো। বেরিয়ে গাড়ীতে চড়ে মাধুরী বললো। এ ক’দিন কি লিখলে, শোনাবে এসে আমায়?

তোমাকে শোনাতে আমার ভয় করে মাধুরী?

কেন? কড়া সমালোচনা করি বলে?

হ্যাঁ।

ভালো তো ঢের লোকই বলে থাকে? আমার ভালো না লাগায় কি তোমার বয়ে গেল? মহেন্দ্র একটু চুপ করে রইল, মাধুরীর ভাল না লাগায় কি কার ক্ষতি কি করে বলবে? পরে বলবো–

কে কোথায় ভাল বলে না বলে, আমি তো শুনতে যাইনে, যারা পরিচিত তারা যদি পড়ে ভাল বলে, তবেই না লেখা সার্থক।

ভাল না লাগলেও ভাল বলতে হবে নাকি? আচ্ছা এখন থেকে ঐ রকম খোশামোদের কথাই না হয় বলা যাবে। কিন্তু সে মিছে কথা, এ তোমায় জানিয়ে রাখছি, বলে মাধুরী ওর। মুখপানে একটু চেয়ে বললো আবার, শোন তোমার লেখার প্রশংসা বহু লোক করে, নিন্দেও করে অনেক কিছু তোমার কাছে আমার পরিচিত সবাই বলবে, বেশ লিখেছেন, আমাকে কি তুমি সেই দলে ফেলতে চাও। তা যদি চাও তো তোমার কোন লেখা আর আমায় শুনিও না। আমি না শুনেই বলবো চমৎকার ব্যাখ্যা সাহিত্য দ্বিতীয় নাস্তি। আর যদি আমাকে। তোমার সাহিত্যিক বন্ধু মনে করো তবে কোনটা ভালো লাগলো, তোমার নাই বা বললাম। কোনটা মন্দ লেগেছে এবং কেন মন্দ লেগেছে তাই শুধু আমি বলব। তোমার ক্রটি যদি কিছু থাকে তো সেটা ধরিয়ে দেওয়াতেই আমার স্বার্থকতা।

তাই বলে মাধুরী তবে তোমার ভাষাটা বড় তীক্ষ্ণ। মহীন হাসল।

তীক্ষ্ণ না হলে তোমার খেজুরে কবি বৃদ্ধির রস ঝরে না। কবি আর খে জ্বর গাছ একই পদার্থ, শীতকালে যখন সমস্ত প্রকৃতি জড় হয়ে থাকে, সেই সময় খে জ্বর বুকে ক্ষত করে তার রস ঝরাতে হয়–

মহীন নিঃশব্দে শুনে গেল কথাগুলো। গাড়ীটা সবেগে চলেছে গড়ের মাঠের উপর দিয়ে। সোজা রাস্তা পিচঢালা মাধুরী হেসে বললো–

আমাদের এটা প্রমোদ ভ্রমণ একসঙ্গে মহীনদা।

কেন? প্রয়োজনটা কিসের?

আলোর হাওয়ার, আনন্দের যার অভাবে কেরানি জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? ঠিক কথা। মাধুরী দিনে আলো জ্বেলে অফিসে কাজ করতে হয়, আঠারো ফিট লম্বা ছয়খানা টেবিল, রাশীকৃত কাগজ আর স্তুপাকৃত আবর্জনা। বাড়ি ফিরেও ওদের না আছে আলো না আছে হাওয়া বাংলার মধ্যবিত্ত এই কেরানীগুলো ধ্বংস হতে চলেছে মাধুরী। অশান্তি আর অস্বাস্থ্য ওদের চিরসাথী।

কথাগুলোতে ব্যথা বেদনা যেন মুর্ত হয়ে উঠলো। মাধুরী ওটাকে এড়াবার জন্য বললো। থাক মহীনদা, মানুষের দুঃখের মহাসমুদ্রে তুমি আমি নিতান্ত তুচ্ছ বুদ্ধদ। ওর কোন প্রতিকারই করা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।

প্রতিরোধ করার চিন্তাটাও করা ভাল মাধুরী, তোমার আমার মধ্যে তাতে কিছু মনুষ্যত্ব জাগবে।

মাধুরী আর কিছু বললো না।

নিজেকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মহেন্দ্র আতঙ্কিত হয়ে উঠলো, কোথায় সে এ কোন অমৃতসাগরে কিন্তু ওখানে তার ঠাই নাই। কে যেন ঠেলে ওর মত একটা নগণ্য মানুষকে ঊর্ধ্ব আকাশে তুলে দিয়েছে, তাই বলে নিজেকে নক্ষত্র মনে করা ওর দারুণ ভুল হবে। গভীর রাত্রে মাধুরীর আনা সেতারখানা বাজাতে বাজাতে ভাবছিল মহেন্দ্র, এই সেতারে যার পেলব আঙ্গুলের পরশ লেগে আছে, তার স্নেহ তার সহানুভুতি ওর জীবনে অক্ষয় হয়ে রইল, কিন্তু, তারপর?

মহেন্দ্র মধ্যরাত্রে বেহাগ রাগিনী ধরললা–

আমায় কোথায় আনিলি
আনিয়ে তরঙ্গমাঝে তরী ডুবালে—

গানটা শেষ হবার পর মহেন্দ্র বুঝতে পারলো দীর্ঘক্ষণ ধরে ওর চক্ষে জল গড়াচ্ছে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সেতারখানা রাখলো, তারপর শুয়ে পড়লো। সকালে উঠতে দেরী। হয়েছে, আজ রবিবার, তাড়ার কিছুই নাই কিন্তু দেখতে পেল চাকর ওর জন্যে চায়ের জল গরম করে এনেছে। এরকম কোনদিন হয় না। বললো, কি ব্যাপার, চাইতে চায়ের জল?

আজ্ঞে, কাল দিদিমনি বলে গেছেন, আর বকশিশ দিয়েছেন। বলেছেন আবার দেবেন।

মহেন্দ্ৰ বুঝলো ব্যাপারটা, চা তৈরী করে খাবে, রাম বললো যে আবার জল গরম করে। অভালটিন না হয় কোকো করে দিতে বলেছেন, কখন দেব?

নয়টার পর, বললো মহেন্দ্র। চাকরটা চলে গেল।

মাধুরীর এই মাতৃরূপ এই স্নেহশীল অন্তরটায় আবগাহন করতে চাইল মহেন্দ্রঃ দরিদ্র দীনাতিদীন এক পল্লী যুবকের প্রতি অহেতুক করুণায় বিগলিত হৃদয় একটি তরুণীর স্নেহসজল মাতৃত্বের অভিব্যক্তি ভগ্নিত্বের প্রকাশ এর বেশী নয় না, না এ বেশী কিছু নয় আর।

শীতের রোদপোহাতে মেম্বারদের অনেকে ছাদে উঠেছে, বসলো সব রোদে আজ ওদের বেগুন পোড়া মুড়ি খাওয়া হবে আনন্দে চোখে জল আসছে। এতো দুঃখের জীবনকে এমন সুখের করতে পারে এই মেসের লোক না দেখলে বোঝা যায় না। অতি সামান্য কিছুকে ওরা। অসামান্য করে গ্রহণ করে না হলে ওরা বাঁচতে পারতো না। তাই মাধুরীর আবির্ভাব ওদের। সরল সতেজ করে তুলছে এবং যাকে অবলম্বন করে মাধুরী আসে সেই মহেন্দ্র এক বিশেষ। ব্যক্তি ওদের কাছে।

আজ আসবে নাকি! অনিলবাবু প্রশ্ন করলো।

কে? মহেন্দ্র কথাটা বুঝেও যেন বুঝেনি, এইভাবে প্রশ্ন করলো।

ঐ যে, আসে সেই মেয়েটি?

নাও আসতে পারে, বলে মহেন্দ্ৰ কথা কটিয়ে দিতে চায় কিন্তু সতীনাথ বলল, মেসের জীবনের নিরামিশ আমরা, বাঁশপাতা চিবুই, কিন্তু আমাদের মাংসের দর বাজারে দিন দিন চড়েছে। মন্টা পাঁচটাকা সের আজকাল সবাই হাসলো, কিন্তু কথাটার অন্তর্নিহিত রস উপলব্ধি করতে সময় লাগে। সতীনাথ খুব বুদ্ধিমান ছেলে, ওর কথার ধরন কতকটা হেয়ালির মত কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই মহীন ঠিকই বুঝলো–ও সেগুলোকে পোলটি ফার্মে পালন করা হয়, মেসের গোয়ালে নয়। সবাই আরেক চোট হাসলো, এবং এই হাসাহাসির মধ্যে একজন বললো, ওরা কিন্তু জবাই করে।

ক্ষতি কি? গলায় দড়ি নিয়ে মরা আর জলে ডুবে মরার তফাৎ নেই।

বেশী আছে হে, তফাৎ আছে জলে ডুবতে যেতে হয় নদীতে, গলায় দড়িটা আমাদের ঘরেই জুটেছে, বললো সতীনাথ, দড়িটা সিল্কের বড় সরু আর শক্ত।

তাতে কি ক্ষতি? বললো একজন।

না, ক্ষতি নাই, লাভ, অনেকগুলো ঘাড় লটকানো যাবে তোমার আমার ওর।

এইসব তরল হাস্য পরিহাসে কিন্তু মহেন্দ্রর ওর মন তখন কোন সুদূর স্বপ্নের রাজ্যের বিচরণশীল। অনুভুতির তীব্র আলোকে অন্তরের কোন গোপন প্রকোষ্ঠ অবলোকন করতে চায়। মহেন্দ্র চুপচাপ বসে রইলো। অথচ ওকে দিয়েই এতগুলি লোক জটলা করছে।

মুড়ি বেগুন–পোড়া এসে গেল, ছুটির দিনের প্রাতঃকালনি জল খাবার। সবাই চিল শকুনীর মত পড়লো, সে যার ভাগে বেশী টানতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য মহেন্দ্র বসে থাকলেও দেখা গেল, সকলেই তার ভাগটা ঠিক করে ওর কাছে এনে দিল, এই যে মহীন বাবু আসুন।

এই সহানুভুতি সোনার কাঠি রয়েছে মাধুরীর চরণধ্বনিতে। এই ধুলি মলিন মেসবাড়ির হাওয়ার আর আলোতে ভরা দিব্য দুতি। মহেন্দ্র হাসলো একটু আপন মনে মুড়ির বাটিটা হাতে করে নিল।

আমি খাবো কাকু আহা কোথায় যেন ক্রন্দনাতুর বালক। না মহেন্দ্র আর খেতে পারবে না। এতোভাল খাদ্য মাধুরী খাওয়ালো কৈ, কেউ তো তার মনে এমন করে গুঞ্জন করেনি খোকন তো এই দু’মাস কিছু বলেনি তাকেও খাবারগুলো ওর রুচি নাই বুঝি! না ওগুলো বিদেশী খাদ্য, খোকন খেতে শেখেনি, কিন্তু বেগুন পোড়া মুড়ি একান্ত আপনার, খোকন অত্যন্ত ভালবাসে। মহীন মুড়ির বাটি নামিয়ে রাখলো।

কি হলো? খাবেন না?

না, থাক, আমি কথা আর বলতে পারবো না। তাড়াতাড়ি গিয়ে ঘরে ঢুকল মহেন্দ্র কিন্তু মেস মেম্বারগণ অত সহজে ছেড়ে দেবেন না, একজন বললো–

ফারপোহাতে ডিনার খাওয়া অভ্যাস, বেগুন পোড়া রুচবে কেন?

না, না তা নয়, ঐ শ্রীহস্তের পরিবেশন হলে ঠিক করবে!

থাক, থাক অত কথার কি দরকার যুগলবাবু বললেন ওনার রুচি না হয় খাবেন না। তবে অত বড় মানুষী চাল এ মেসে কেন ভাই গ্লান্ডে গেলেই পারতেন।

মহেন্দ্র কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ছবিখানার কাছে পঁড়িয়ে, মহীনকে ওরা অহংকারী ধনীমাত্র ঠাওরেছে কিন্তু মহীনের অন্তর যদি কেউ দেখতে পেত ও মুহর্তে। ছবিখানার পানে চাইল মহেন্দ্র বললো–

ইচ্ছা হয়েছিল মনে মাঝারে—

ছিলি আমায় পুতুল খেলার প্রভাতে শীবপূজার বেলায়।

তোরে আমি ভেঙ্গেছি আর গড়েছি!

ঝর ঝর করে জল পড়ছে মহীনের চোখ থেকে। নিঃশব্দে মাধুরী দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছে ওকে মহীন কিছুই জানতে পারেনি। অকস্মাৎ মাধুরী বললো, মায়ের রূপটা আমার মধ্যে বেশী, না তোমার মধ্যে বেশী মহীনদা।

এসে মহীনের চোখের জলটা মুছে ফেললো।

আমার কথার জবাব দাও।

জানি না মাধুরী।

বিশ্বজোড়া সন্তানদের বেদনার্ত হাহাকার কে জানে কোন পরম জননীর প্রাণকে ব্যথিত করে? কার অন্তরে তিনি বেশী প্রকাশমান কে জানে? কিন্তু তোমার ব্যথাটা খোকনের জন্যই–

না মাধুরী, ওকে অবলম্বন করে পৃথিবীর অগণ্য খোকুখুকুকে দেখি আমি তাদের মা, বাবা কাকার অন্তরকে অনুভব করি, কে কোথায় তার শিশুর মুখে স্বাস্থ্যকর খাদ্য দিয়ে অপরাগ তার বেদনা তুমি বুঝতে পারবে না, মাধুরী।

বুঝতেই পারবো না। বিস্মিত মাধুরী আহত হলো, নাগিনীর মত বেণীটা ঘুরিয়ে বললো, তোমার স্পধ্যা বড় বেশী মহীনদা। পুরুষ হয়ে তুমি বুঝবে আর আমি মেয়ে হয়ে বুঝব না! ভাল বুঝি কিনা একদিন দেখতে পাবে। মাধুরী ঘরের মধ্যে এলো।

বাইরে যারা এতক্ষণ কথা বলছিল, তারা স্তব্ধ হয়ে গেছে, কথাগুলোও শুনেছে, কিন্তু কেউ বিশেষ কিছু বুঝতে পারলো না, মহীন বেরিয়ে এলো। মাধুরী ঘরের মধ্যে কি সব রাখছে সাজিয়ে। মহেন্দ্রের চোখের কোন তখনো ভিজে। প্রকাশবাবু প্রশ্ন করলো অকস্মাৎ

হলো কি স্যার?

কিছু না, বলে মহেন্দ্র তার ভাগের বাটিটা তুলে নিয়ে আবার ভেতরে গেল। মাধুরী একটা চামচ দিয়ে কতটা তুলে নিয়ে নিজের মুখে নিয়ে বললো খোকনের অকল্যাণ করো না, মহীনদা খাও।

আর কিছু বলতে হলো না, মহীন নিঃশব্দে খেতে লাগলো এবং মাধুরীও দু’চার চামচ খেল ওর সঙ্গে। বাইরে বসা বাবুরা দেখলো ওদের এক বাটিতে খাওয়া এর পর ঝালটা যে কোথায় গিয়ে ছাড়াবে, আন্দাজ করতে পারছি না। কিন্তু কি যায় আসে?

তোমার মেসে আজ ভাল রান্না হচ্ছে দেখে এলাম, মাধুরী বললো—

হ্যাঁ রবিবার কিছু উন্নত খাদ্য হয় উত্তরে বললো মহেন্দ্র।

বেশ আমিও খাবো এখানে, বলে দিও ঠাকুরকে।

তুমি। কেন! তুমি কেন খাবে এখানে মাধুরী।

আমার খুশী খাব! বলে মাধুরী চুপ করে রইলো, একটুক্ষণ পরে বললো তুমি যেখানে খাও সেখানে আমিও খেতে পারি থাকতে পারি এইটুকু জানাতে, মাধুরীর কণ্ঠস্বর গভীর এবং দৃষ্টি বাইরের দিকে।

মাধুরী মহেন্দ্র, কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল।

বলো–প্রশ্ন করলো মাধুরী।

কিন্তু মহেন্দ্র কিছুই বলতে পারলো না। নিঃশব্দে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলো, মাধুরী ইতিমধ্যে ঘরখানা পরিষ্কার করে সব গোছালো। কয়েকটা নতুন আনা জিনিস রাখলো, বিছানাটা ঝেড়ে পেতে ঠিক করলো। এখানে বাবুদের ক্ষুধিত দৃষ্টির সম্মুখে খাওয়া যাবে না। মহীনদা আধপেটা থাকতে আমার ইচ্ছে নেই। বাড়ি যাচ্ছি, তুমি বিকালে যেও রাত্রে ওখানে খাবে। মহেন্দ্রকে কোন কথা বলার অবকাশ না দিয়েই মাধুরী তর তর করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। নীচের তলায় দু’তিনজন বাবু তাদের একজন বললো, চলে যাচ্ছেন যে! খাবেন বলেছিলেন–

না, আজ আর হলো না? খাব আর খাওয়াব, আপনারা যেদিন সুবিধে, দিন ঠিক করবেন, নমস্কার মাধুরী গাড়িতে উঠলো গিয়ে।

মেসের বাবুদের সে খাওয়াবে, এ অত্যন্ত সুসংবাদ তাদের কাছে, কথাটা তৎক্ষণাৎ প্রচারিত হয়ে গেল সকলের কাছেই শুধু মহেন্দ্র জানালো না, কারণ ও নিশ্চয় জানে ভেবে কেউ ওকে জানাতে আসেনি।

মহেন্দ্র বসেই আছে কত দীর্ঘক্ষণ ও জানে না।

ও বাড়ির কেউ চায়নি যে মহেন্দ্র অন্যত্র গিয়ে চাকরি নেবে কিন্তু কার্যত যখন তাই। ঘটলো, তখন দেখা গেল যে বাড়ির সকলেই কিছু ক্ষুণ্ণ হয়েছে অথচ সর্বস্তরে ও করছে, মহেন্দ্রকে নিজের অফিসে চাকরি দিতে ভরসা করছিল না ওরা এবং মহেন্দ্রও কোনদিন মুখ ফুটে বলেনি সে কথা। বললে অবশ্য ব্যাপারটা কিছু সহজ হতো, কিন্তু মহেন্দ্র যখন নিজেই। চাকরি যোগাড় করে চলে গেল তখন ক্ষুণ্ণ হওয়া ছাড়া আর কিছুই ওদের করবার রইল না। কিন্তু মহেন্দ্র জানে এই ক্ষুণ্ণতেই মানুষের ম  র‍্যাদা বাড়ে।

মহেন্দ্র চলে যাওয়ার পর বাড়ির সকলেই দৃষ্টি পড়লো মাধুরীর উপর। এই দুই আড়াই মাসে মাধুরী যেন অনেকটা বড় হয়ে উঠেছে। যেন সে মাধুরী পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সাগর তরঙ্গিনীর মত অচপল, স্থির সে।

বড়বৌদির, ভাই বরুণ এসছে গত সন্ধ্যায়, জমিদারের ছেলে, বিলাত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকার বড় অফিসার। সকালেই তার সঙ্গে মাধুরীর দেখা হবার কথা কিন্তু মাধুরী বেরিয়ে গিয়েছিল। কোথায়? ফিরে এলো বেলা এগারোটা নাগাদ এবং এসেই নিজের ঘরে ঢুকলো। বড়বৌদি আন্দাজ করেছে মাধুরী গিয়েছিল মহীনের মেসে, কিন্তু বাড়ি ফিরে সে নিশ্চয়ই বরুণের সঙ্গে আলাপাদি করবে, এই আশা সবাই করছিল। কিন্তু দেখা গেল, মাধুরী বেরুলোই না। নিজের ঘরেই বসে। এরকম কাজ ও কখনো করে না কিন্তু। অবশেষে বড়বৌদি এসে প্রশ্ন করল। তো হোল কিরে ছোড়দি? সারাদিন বেরুসনি?

সকালেই তো আড়াই গ্যালন পেট্টল পুড়িয়ে এলাম বৌদি।

হ্যাঁ–তবে বাড়ির কেউ তোকে দেখেনি আজ।

কেউ মানে থেমে গেল মাধুরী তারপর বললো সন্ধ্যায় একটা আসর করব তখন দেখা হবে। যখন যা তা বেশে কি আর সবার সামনে বেরুনো যায় বৌদি? তাছাড়া তোমার ভাইটি বিলেতী আপেল, দেশী পেয়ারা হলেও বা কথা ছিল হেসে ফেললো মাধুরী। আপেল খুব মূল্যবান ফল জানিস।

নিশ্চয় আমি কি বলছি যে তিনি আম?

আম হলে যখন তখন দেখা করতিস?।

অবশ্য কারণ আমের বোল থেকে আটির খেট্ট পর্যন্ত আপন। আপেলের সঙ্গে পরিচয় করতে সময় লাগে বেশি, কিছু মনে করো না ভাই হাসলো মাধুরী। না বোনটি, মনে কি করবো? তুই আপেল আতা, আনারস, আম যা ইচ্ছে নে, তোকে সুখী দেখলেই আমার আনন্দ, বড় বৌদি সস্নেহে ওর মাথায় হাত দিল। তাহলে নিশ্চিত থাক আমি সুখী হবোই।

অতঃপর বড়বৌদি চলে গেল, জেনে গেল যে সন্ধ্যায় মাধুরী গানের আসর বসাবে এবং যেখানে বরুণের সঙ্গে ওর দেখা হবে। বরুণ বড়বৌদির ছোট ভাই। মাধুরী তাকে জীবন সাথী রূপে গ্রহণ করলে খুবই খুশি হয় বড়বৌদি, কিন্তু মাধুরী সে কাজ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলে তবে তো। বিশেষ কোন আশা করে না বড়বৌদি ও সম্বন্ধে–কারণ মাধুরীর মনের গঠন ওর জানা। সেইজন্যে নিজে প্রত্যক্ষভাবে বলেওনি কোন কথা। তবু অন্তরে একটা সুপ্ত আশা। জেগে আছে, যদি হয় তো ভাল হয়। মেজবৌদি বোম্বাই থেকে ফিরেছে পরশু, আজ বোধ। হয় কুমারও আসবে এখানে অতএব যা হোক একটা কিছু স্থির হতে পারে ভেবে বড়বৌদি নিজের কাজে আত্মনিয়োগ করলো।

সন্ধ্যায় কিন্তু সঙ্গীতের আসর বসালো না মাধুরী সাহিত্যেরও না। ভালো রকম সাজপোশাক করে টয়লেট সেরে দাদাদের কাছে এসে নমস্কার করলো বরুণাবাবুকে। কুমার সুশীল এবং মেজবৌদিও ছিল ওখানে। বড়বৌদি ওদের চা দিচ্ছে এই আমাদের ছোড়দি, বললো বরুণ। মাধুরী হাত জোড় করেই ছিল, আবার কপালে ঠেকালো! আজ কি প্রোগ্রামঃ প্রশ্ন করলো কুমার বাহাদুর। চুপ করে থাকার প্রতিযোগিতা মাধুরী জবাব না দিয়ে চুপ করে বসলো।

ঈশ্বর মানুষকে স্বর দিয়েছেন ভাষা দিয়েছেন সে কি চুপ করে থাকার জন্য? না, তার জন্যই তো প্রতিযোগিতা চালানো হচ্ছে। কে কতক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে দেখা যাক আরম্ভ হোল ওয়ান, টু থ্রী।

এক মিনিট এর কি পুরস্কার? বরুণ প্রশ্ন করলো।

এক মাত্র পুরস্কার, যিনি জয়ী হবে, তাকে এই মালা দান করবো বলে মাধুরী আঁচল থেকে একরাশ জাপানী চন্দ্র মল্লিকা বের করে টেবিলে রাখলো তারপর সুচ সুতো বের করে একটা ফুল নিয়ে গাঁথতে গাঁথতে বললো, আরম্ভ হোক ওয়ান, টু থ্রী–

মেজবৌদি, হাসছে বড়বৌদিও, কুমার এবং মেজদাও হাসছে কাণ্ড দেখে কিন্তু বরুণবাবু নিতান্তই নবাগত, বিশেষ এখনো কিছু জানে না। মাধুরী সম্বন্ধে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল বেচারা। কিন্তু চুপ করে আছে সবাই। একটা ঘরে চার পাঁচজন লোক অথচ কারো মুখে কথা নেই এ যে কী অবস্থা তা বর্ণনাতীত। কিন্তু মাধুরীর মালার প্রতি লোভ ওদের তিনজনেরই সমান অতএব কথাও কেউ কইছে না। মেজবৌ বললো মালাটা গাঁথা শেষ পর্যন্ত তো কমপিটিশান?

মাধুরী জবাব দিল না, শুধু সামনের কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখলো মেজবৌদি আউট। লেখাটা পড়ে মেজবৌ বললো–বাপরে। বাচলাম কথা না করে কি মানুষ থাকতে পারে?

যা বলেছ বলে মেজদাও কথা কইল, সঙ্গে সঙ্গে মাধুরী লিখলো মেজদা আউট। ওরা দেখলো এবং চলে যাচ্ছে দু’জনেই। এখন আছে সুশীল কুমার বরুণ এবং মাধুরী–এই সময় এলো মহেন্দ্র। সে কিছুই জানে না কিন্তু মেজবৌদি জানিয়ে দিল

কথা বলো না। ঠাকুরপো এখানে চুপ থাকার কমপিটিশন চলছে। যে জয়ী হবে। মাধু তাকে ঐ মালাটা দেবে দেখ যদি পারতো।

ওর উদ্দেশ্য তো ভাল না বৌদি। মহেন্দ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললো ও চায় যার গলায় ও মালা দেবে সে চিরদিন চুপ করেই থাকবে তার নি। বলবার অধিকার থাকবে না এরকম প্রতিযোগিতায় যোগদান আহাম্মকি ছাড়া কি আর–

ঠিক। আমি উইথড্র করছি বলে সুশীল চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো।

আমিও। এমন একটা সাংঘাতিক কৌশল ওর মধ্যে আছে, কে জানতো। বরুণ। উঠলো। রিয়েলি, এ প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া আহাম্মকি বলে কুমার আসন ত্যাগ করলো।

মাধুরীর মালা গাঁথা প্রায় শেষ হয়েছে। ধীরে ধীরে পেন্সিল দিয়ে সবার সামনে পাশে লিখলো আউট, আউট, তারপর মালার সুলতায় প্যাঁচ দিয়ে বললো আমি জয়ী হয়েছি অতএব আমার মালা আমিই পরলাম, চলে যাচ্ছে মাধুরী। আমরা তো যোগ দিলাম না প্রতিযোগিতায় বললো বরুণ।

নিশ্চয়ই দিয়েছিলেন, মহীনদা না বুদ্ধি দিলে দুপুররাত পর্যন্ত আপনাদের বোবা বানিয়ে রাখতাম।

কিন্তু মালা তো গাঁথা শেষ হয়েছিল কুমার বললো।

ও মালা কোনদিন গাঁথা শেষ হতে না সারা জীবন গাঁথাই চলতো চলে গেল মাধুরী। তিনজন প্রতিযোগিই পরিস্কার বুঝলো মাধুরী ওদের কারো হবে না।

মহেন্দ্র আজ এখানে বিশেষ একটা স্থান লাভ করল এমন কি কুমারের কাছেও ওর বুদ্ধি এবং বিনয় ব্যবহার সকলেরই প্রশংসা অর্জন করে কিন্তু কোথায় মাধুরী? রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত গান গল্প খাওয়া সেরে মেসে ফেরার সময় মহেন্দ্র তাকে দেখতে পেল না অবশ্য কাউকে ওর কথা জিজ্ঞাসাও করেনি সে। মেসে ফিরে এলো এবং শুলো।

সোমবার থেকে সমস্ত সপ্তাহ যথারীতি অফিস করলো মহেন্দ্র মাধুরীর কোন খবর এল। ফোন করে অবশ্য সে খবর জানতে পারতো, কিন্তু কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ হয়। কেন এ সঙ্কোচ মহেন্দ্র নিজেই যেন ঠিক বুঝতে পারে না। মাধুরী কেন ফোন করলো না এই কয়দিন?

ভেবে দেখলো সেদিন বিকালে মাধুরী মেসে বসেছিল ওর সঙ্গে খাবে বলে ছিল, খায়নি। সেদিন অকস্মাৎ চলে গেছে এবং তারপর থেকেই মহেন্দ্রের সঙ্গে মাধুরীর আর কথা হয়নি? সেদিন কি কথা হয়েছিল মনে করতে চেষ্টা করল মহেন্দ্র ঠিকঠাক মনে পড়ে না কিন্তু কোন রকম ঝগড়ার কথা তো হয়নি এবং সেদিনই মহেন্দ্ৰ সন্ধ্যায় গিয়েছিল ওখানে।

আজ আবার শনিবার হয়তো মাধুরী আজ আসবে, নিশ্চয় আসবে, ভাবতে ভাবতে মহেন্দ্র অফিসে কাজ শেষ করে মেসে ফিরছে। তার একটু দেরী হল, হয়তো ইচ্ছে করেই দেরী করলো মহেন্দ্র। মাধুরী এসে তার ঘরে অপেক্ষা করবে আশায় কিন্তু পৌঁছে দেখলো মাধুরী আসেনি।

মেসের অন্যান্য মেম্বারের অবস্থা দেখে কিন্তু মহেন্দ্র অনুভুতিশীল অন্তরে একটা ঝঙ্কার উঠলো আহা বেচারা! দেখলো, ওদের প্রায় সকলেই যথাসাধ্য যত্নে সাজ পোশাক পরছে। কেউ দাড়ি কামাচ্ছে, কেউ বা তার সব থেকে ভাল জামা কাপড় পরে এদিক ওদিক ঘুরছে। আর কেউ বা আগে ভালো ভাবে নিজেকে সজ্জিত করে গুণ গুণ করে গান ধরেছে, কিন্তু। সবাই যে, মাধুরীর আসার প্রতীক্ষায় এটা বুঝিতে কিছুই দেরী হয় না। মহেন্দ্র হাসলো মনে মনে। নিজের ঘরে এসে দেখলো মাধুরীর কোকো, ওভালটিন, দুধ এখনো প্রচুর রয়েছে, খেলেই হয় কিন্তু কেমন যেন অভিমান জাগলো অন্তরে। অতগুলো খাবার জমা করে রেখে গেলেই কি যথেষ্ট হোল? থাক মহেন্দ্র খাবে না ওসব।

উনি কি আসবে না আজ? প্রশ্ন করলো অনিল নামে একজন তরুণ মেম্বার। কে? মাধুরী।  হ্যাঁ।

কি জানি হয়তো আসবেন না। মহীন উত্তর দিল। চেয়ে দেখলো এবং অন্য সকলের মুখের ভাব করুণ বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে।

অনিল বললো, আপনি যাবেন তাহলে?

না আমার ও তো যাবার কিছু কথা নেই, বলে মহীন গরম জলে চা ছেড়ে দিল। ঘেরাটোপরে সেতারখানা এক কোণে রয়েছে, এইটাকে নিয়েই সেদিনকার কথা মনে পড়লো মহিনের। অন্য দিন সে সন্ধ্যায় বাজায় ওটা, আজও হয়তো বাজাতো কিন্তু কেমন যেন অনিচ্ছা জাগছে, ঐ সেতারটায় আঙ্গুল বুলিয়ে যাবার এক উদগ্র ক্ষুধা ওকে পেয়ে বসেছে। হাত বাড়ালো ওটা নিতে কিন্তু তখনি হাত সরিয়ে নিল, না ওটাকে ছোবে না মহেন্দ্র। কেমন একটা অবসাদ পেয়ে বসেছে, না কেমন জ্বর, একটা জ্বালা যেন না কেমন একটা কান্নার ঢেউ বুকে ঠেলে উঠতে চায়, মহেন্দ্র মাধুরীর আনা নরম জোড়া বালিশে মাথা গুজলো। ওঠো মহীনদা ওঠো মহীনদা। স্নেহ সজল সুকোমল কণ্ঠে ঝংকার, কতক্ষণ চা ছেড়েছ। এ্যা। এ আর খাওয়া যাবে না, ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে। নাও, কাপড় পর, বাইরে গিয়ে চা খাব ওঠো ওঠো ওঠো—

একটানা কথা বলে চলেছে মাধুরী, হাতের বাস্কেট থেকে ফলগুলো সাজিয়ে রাখছে। টিপটের লিকারটা বাইরে ফেলে দিয়ে এল তারপর আবার বললো–

বাজার করতে দেরী হয়ে গেল–তা অত, রাগবার কি হয়েছে?

রাগিনী মাধুরী, মহেন্দ্র হাসতে হাসতে বললো।

তবে কি অভিমান না অনুরাগ? হাসছে মাধুরী।

তোমার ভাষাটা একটু সংযত করলে ভাল হয় মাধুরী–

ও, আচ্ছা। চুপ করে থাকার প্রতিযোগিতা চলুক। মাধুরী ঘরটা নিঃশব্দে গোছাতে লাগলো। মহেন্দ্র উঠে কাপড় ছাড়লো, এবং একটা সবেদা খেতে খেতে বললো–কোথায় যেতে হবে?

তুমি হাসলে–চলো বেরোও। দরজায় তালা দিল মাধুরী।

মেসের বাবুর দল ভিড় করেছে, মাধুরী বললো ওদের মধ্যে বয়েজ্যেষ্ঠকে কাল আমি খাওয়াব আপনারা কোথায় খাবেন বলুন? কি খাবেন?

যেখানে ইচ্ছে। যা দেবেন তাই খাব।

বেশ আমাদের বাড়িতে খাবেন সব, আমি বাস রিজার্ভ করে আপনাদের নিয়ে যাব কাল রাত্রে ঠিক রইল তাহলে–

যে আজ্ঞে খুব আনন্দের কথা—

ঠাকুর চাকর সবাইকে যেতে হবে। আচ্ছা নমস্কার।

চলে এল মাধুরী, গাড়িতে উঠলো মহীনকে নিয়ে। মহেন্দ্র এতক্ষণে বলল। ওদের কেন খাওয়াবে মাধুরী?

একদিন ওরা একটু ভাল খাবে মহীনদা।

ওদের উপরে তোমার এই সহানুভূতির মানে বুঝতে পারছিনে—

ওর তোমায় ভালবাসে কিনা তাই। হাসলে মাধুরী নঃশব্দে।

মহেন্দ্র আর কিছু বললো না, অথবা বলতে পারলো না। দু’জনে চৌরঙ্গীর বড় একটা দোকানে ঢুকে গেল, নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ালো দীর্ঘ পথ গড়ের মাঠে, কিন্তু আশ্চর্য, কেউ কোন কথা বললো না। ওর বাক্য স্ত্রীতে যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে। নদী যেমন সমুদ্রে এসে মিশেছে, স্থির শান্ত, গভীর সমুদ্র। রাত নটা নাগাদ মহেন্দ্রকে মেসের দরজায় নামিয়ে বললো–চুপ করে থাকার প্রতিযোগিতায় এবার আমিই হেরে গেলাম মহীনদা–

মহীন তাকিয়ে রইলো গাড়ির ভেতর বসে থাকা মাধুরীর পানে, গাড়িটা চলে যাচ্ছে, মহেন্দ্র মনে মনে আবৃত্তি করলো–

এতো মালা নয় নয়গো–এ যে তোমার তরবারি—

ক্লান্ত পদে নিজের ঘরে এসে মহেন্দ্র কোন রকমে কোটখানা খুলে শুয়ে পড়লো। খেয়ে এসেছে, আর কিছু খাবে না ও। কিন্তু ওর সমস্ত হৃদয় মন জুড়ে যে মাধুরীর রাগিনী বেজে চলেছে, তার অসহনীয় আনন্দ ও ধরতে পারছে না। একি সুখ। নাকি বেদনা, কে জানে!

সকালেই ঘুম ভাঙ্গলো চোখ মেলে মহেন্দ্র দেখতে পেল, মেসের বাবুর দল তার। জানালায় দাঁড়িয়ে ডাকছে–অনেক বেলা হয়েছে স্যার, উঠুন না। দরজা খুলে বাইরে আসতেই ওরা সমস্বরে প্রশ্ন করলো–

বাস কটায় আসবে।

 তাতো জানি না সন্ধ্যা নাগাদ আসবে হয়তো।

আপনি জানেন না সে কি! অবাক হয়ে গেল বাবুর দল, কিন্তু মহেন্দ্র ওদের কেমন করে বোঝাবে যে সে সত্যি জানে না। মুখে জল দিতে দিতে বললো–

বাস ঠিক সময় আসবে ও ব্যবস্থায় কোন ভুল হয় না।

বাবুরা আর কোন কিছু শুধোলো না, মহেন্দ্র অতঃপর কি যে করবে, ভেবে পাচ্ছে না, নিজের সম্বন্ধে মহীনের ভয় লাগছে, অহেতুক ভয় না হেতু কিছু আছে, কি সেটা। মহেন্দ্র যেন ইচ্ছা করেই ভাবতে চাইছে না, সেটা কি। অত খানা পাবার যোগ্যতা নাই ওর, প্রত্যাশা ও নাই কিন্তু মানুষের মন এমন আশ্চর্য পদার্থে গঠিত যে, মনের অজ্ঞাত আশাকে অকস্মাৎ সামনে দেখলে চমকে উঠে অথচ ওটা তারই মনের কথা। মহেন্দ্রের ঠিক সেই অবস্থা। কিন্তু মানুষের মনের সত্য অনেক আছে, যাতে সচেতন মনের স্বাক্ষর দিতে সে ভয়–মাত্র এড়িয়ে যায়, অগ্রাহ্য করে–

এই কয়েকদিন মহেন্দ্ৰ দুখানা গল্প লিখেছে একটি উপন্যাসও লিখতে শুরু করেছে, আর কিছু টাকা যোগাড় করে দাদাকে পাঠিয়েছে, যদি সে টাকা অতি সামান্য মাত্র কুড়ি টাকা।

কিন্তু টাকা সে রোজগার করতে পারবে তার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। মাইনের টাকা কয়টা ছাড়াও রোজগার ওর কম হবে না। যুদ্ধের বাজারে বাংলা বইয়ের কাটতি বেড়েছে। এবং আজ লেখকের আদর যথেষ্ট! গল্প লিখে টাকা এর পূর্বে কম লোকই অর্জন করেছে। লেখক হিসাবে নাম করে ফেলতে পারলে চাকরি হয়তো ছেড়েই দেবে মহেন্দ্র, কিন্তু জীবনের একটা জটিলতা ওকে অতিষ্ট করে তুলেছে এখানে সে অসহায়।

ঠিক সময় বাস এলো এবং মেসের মেম্বারদের তুলে নিল। খালি বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে মাধুরী দুজন গুর্খা দারোয়ান পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। চমৎকার ব্যবস্থা ওর মহীনকে নিয়ে সবাই হৈ হুল্লা করতে করতে গিয়ে পৌঁছিল। অভ্যর্থনা করলেন স্বয়ং উমেশবাবু এবং মাধুরী।

মাধুরী ওদের আনন্দের জন্য প্রচুর ব্যবস্থা করে রেখেছে। নৃত্যনাট্য, মুক অভিনয় এবং ম্যাজিক দেখালো বেশ কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে তারপর খাইয়ে দিল সবাইকে এবং ফেরবার সময় প্রত্যেককে দিল একগোছা করে রজনীগন্ধা ফুল। নমস্কার করে বললো সকলকে–

অতিথি হিসেবে আপনাদের তো ডাকিনী আমি আত্মীয় ভেবেই ডেকেছি। সুযোগ পেলে আবার ডাকবো আসবেন তো?

নিশ্চয় একসঙ্গে সবাই বললো ওরা তারপর শুধালো–

আমাদের ওখানে আপনি কবে খাবেন?

যে কোনদিন সুবিধে মত খাব গিয়ে। আমি আর ভোজ খেতে যাব না, আপনারা কেমন খান দেখতে যাব। হাসলো মাধুরী।

ওরা সকলে বাসায় ফিরলো, সঙ্গে মহেন্দ্র। মেসের জীবনে এরকম উৎসব কমই ঘটে। এর জন্যে মহেন্দ্রকে ওরা ধন্যবাদ দিচ্ছে।

উর্বশী, উত্তর এবং আরো কয়েকটি পত্রিকায় গল্প লিখেছে মহেন্দ্র। কিন্তু ওতে তার মন ভরে না বড় একটা কিছু করবার ইচ্ছায় কতকগুলি বই কিনে আনলো পুরানো বইয়ের দোকান থেকে, পড়া আরম্ভ করে দিল। পরবর্তী শনিবার মাধুরী যথাসময় এল এবং বইয়ের গাদাটা দেখে বলল–ওতে অনেক রোগ জীবানু থাকে মহীনদা।

চিন্তার জীবানুও থাকে মাধুরী। মহেন্দ্র মৃদু হেসে জবাব দিল।

 হ্যাঁ কিন্তু রোগকে ওরা ঠেকাতে পারে না।

না, বরং এগিয়ে আনে বলে হাসলো মহেন্দ্র, পরে বললো কিন্তু গরীবের ঘোড়ারোগ ধরলে কাঠের ঘোড়ারই সন্ধান করতে হয়। তাছাড়া এসব বই নতুন পাওয়া যায় কম দেখছো না, সব পুরান আর উপপুরান

কি করবে ওগুলো পড়ে? মাধুরী প্রশ্ন করলো ও দিয়ে কি হবে তোমার?

অনেক হবে। বাংলার এই প্রাচীন সাহিত্য মন্থন করে অমৃত উঠাতে চাই। গরলও উঠতে পারে বলে মাধুরী যেন অপ্রসন্নভাবে ঘরের জিনিসগুলো গোছালো, চা তৈরী করে খাওয়ালো মহেন্দ্রকে। তারপরই বললো, চল খোলা হাওয়ায় বেড়িয়ে আনি তোমায়

এখানে বিস্তর খোলা হাওয়া মাধুরী–

এটা কলকাতার কনজেষ্টেড এরিয়া–নাও উঠে পড়। বা

ইরে যেতেই হবে?

অবশ্যই যেতে হবে, কারণ বড় মিলনটা বাইরেই হয়, আকাশ নীল আম বনের সবুজে, সাগরের নিলে আর মাঠের শ্যামলতায়–হাসছে মাধুরী।

ওকে কি ঠিক মিলন বলে মাধুরী? ও শুধু ছুঁয়ে থাকে, আকাশ থেকে আকাশেই, সাগর ঠিক থেকে যায়, ঐ মিলনের মধ্যে বিরাট শূন্যতা, ব্যাকুল হাহাকার! তার থেকে ঐ কার্নিসের কবুতর দুটোকে দেখো অতটুকু জায়গায় ওরা কেমন এক হয়ে গেছে–

মহেন্দ্র কথাগুলো শেষ করতেই দেখতে পেল, মাধুরী প্রদীপ্ত চোখ মেলে ওর পানে চেয়ে আছে। আরক্ত হয়ে উঠেছে মহেন্দ্র অকস্মাৎ। তার কবি মন আকস্মিকভাবে কার কাছে কি কথা প্রকাশ করেছে, এতক্ষণে যেন সেটা অনুভব করলো তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলাবার। জন্যে বললো কিন্তু বাইরের ওই মিলনটা ভালো মাধুরী।

কেন ভালো কেন হলো আবার? মাধুরীর কণ্ঠে ব্যাঙ্গোক্তি।

 হ্যাঁ, ভালো চলো বাইরে যাই–ওর যে আকাশ আর বনের সবুজের মধ্যে বিরাট অবকাশ মহেন্দ্র কোটখানা গায়ে চড়াতে চড়াতে ভেবে নিল বলল

আকুলতা আর ব্যাকুলতা-–এসো বাইরে। ঘরে তালা দিতে হবে।

হু মৃদু হাসিটা মহেন্দ্রর মুখে লেগেই আছে, বেরিয়ে এলো। মহেন্দ্র তালা দিল ঘরে, তারপর চলতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। মাধুরী বললো–

আকুলতা আর ব্যাকুরতার পর? বললো, শেষ কর তোমার কথা–

ওর আর শেষ নাই মাধুরী, ওটা অশেষ, অনন্তকাল থেকে ওরা এই ভাবে আছে, ওদের মিলনের আকুতিতেই মহামিলনের যন্ত্র ধ্বনিত হয়।

গাড়িতে উঠলো দু’জনে। মাধুরী কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল, আর মহেন্দ্র নির্বাক। ফেরা বেলায় মেসের দরজায় নামবার সময় মহেন্দ্র বললো। আমাকে দিনকতক একটু বেশি। করে পড়তে হবে মাধুরী একটা বড় কিছু লিখতে চাই।

বেশ তো পড়, ভাল করে খাবে আর রাত জেগে না।

মাধুরী চলে গেল, মহেন্দ্র দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, বাষ্প যতক্ষন বাষ্প থাকে ততক্ষণ ভেসে থাকে আকাশে, কিন্তু শীতলতার সান্নিধ্যে এলেই তাকে পড়তে হয় এসে সে সবুজ ঘাসে তা তপ্ত বালিতেও তো সে পড়তে পারে–

মাধুরী বায়না নিয়েছে, বাড়িতে তার অসুবিধা হচ্ছে অতএব যে কোন মেয়ে হোষ্টেলে গিয়ে থাকবে। কিন্তু বাড়িতে কেউ এই আনন্দ প্রতীমাকে বোডিং এ বিসর্জন দিতে চায় না। মাধুরীর বক্তব্য হচ্ছে যে ছোটদার বিয়ে আসন্ন ছোট বৌদি আসবে। কিন্তু মাধুরীর সঙ্গে তার বনিবনাও হবে না।

কেন হবে না? সব দাদা আর বৌদিরা ওকে ঘিরে প্রশ্ন করলো।

কারণ সে ধনীর একমাত্র সুন্দরী সঙ্গীতজ্ঞা মেয়ে।

তুই ধনীর সুন্দরী মেয়ে এ বাড়িতে একমাত্র মেয়ে আর সঙ্গীতজ্ঞা।

শোন ভাই ছোটদা, মাধুরী বললো, আমার যেন মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে আমার কিছুতেই মিলবে না। কেন অনর্থক অশান্তি–

শোন ছোটদি, রতীন বললো, তোর সঙ্গে যার মিল না হবে, এ বাড়িতে তার জায়গা। হবে না তা সে লক্ষ্ণৌঠুংরি হোক আর মাদ্রাজ কথাকলিই হোক।

এ বিয়ে বন্ধ করে দাও বড়দা মাধুরীকে চাইবে, সে আসবে বৌ হয়ে–সবাই পরস্পরের মুখপানে তাকালো। মাধুরী হেসে বললো–

বেশ আসুক সেই লক্ষ্ণৌঠুংরী তারপর দেখা যাবে।

ওর সম্বন্ধে কেন তোর এত ভয় মাধুরী। রতীন প্রশ্ন করলো–

ভয় নাই ছোট দা, ভাবনা, ওর সেতারের ঢাকনাটার মধ্যে আড়াই হাজার মণি মুক্তা আছে–ওর বাগানের গোলাপ নাকি ছয় ইঞ্চি চওড়া হয়।

মেজবৌদি হেসে পালিয়ে গেল। বড়বৌদি হাসছে, কিন্তু মাধুরী তেমনি গম্ভীর। বললো হাসছো কি? ওকে ঘরে এনে পোষা বিলেতী কুকুর পোষার থেকে বেশি। তোর জন্যে একগাছা শেকল আর একটা চাবুক এনে দেব, তুই যথেষ্ঠ ব্যবহার করিস তার সঙ্গে বলে চলে যাচ্ছে ছোটদা আবার ফিলে বলল।

শোন মাধু এই পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যার জন্যে তোকে আমরা পর করতে পারি। তোকে যে সইতে পারবে না আমরা কেউ তাকে সইবো না, চলে গেল রতীন।

অতঃপর ব্যাপারটা এইখানেই ইতি হয়ে যেতো হোষ্টেলে যাওয়া হতো না মাধুরীর, কিন্তু বলে রাখলো, দরকার বোধ করলে সে যাবে। আগামী সাতই মাঘ রতীনে বিয়ে। শীতকালে লক্ষৌ এ বিয়ে দিতে যাবার ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই যেতে পারলো না। মহেন্দ্র গেল না। যথাকালে রতীন বিয়ে করে ফিরলো। বৌভাতের রাত্রে মাধুরী আবার মেসশুদ্ধ সকলকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়ে দিল কিন্তু সে এখন কম আসে মেসে। দু’এক শনিবার বাদ যায়। মেসের একজন সেদিন প্রশ্ন করলো–

আপনি আজকাল আর যান না বড়?

সামনে পরীক্ষা বলে কাটিয়ে দিল মাধুরী।

মাধুরী খেয়ে এসে বললো ভাগ্যিস মহীন এখানে এসেছির, তাই মধ্যে মধ্যে ভাল ভোজ জোটে ওদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *