৫. অভিনয় ক্ষমতা

তা অভিনয় ক্ষমতা বোধ করি মানুষের সহজাত। তাই সহজ সুস্থ একটা মানুষ পাগলের পার্ট প্লে করেও কাটিয়ে দেয় ছমাস আট মাস। হাতে পয়সার বালাই নেই, তবু খাওয়াও জুটে যাচ্ছে, চেয়ে চিন্তে জুটে যাচ্ছে।

উলঙ্গ পাগল নয় যে, ধরে পুলিশে দেবে,-উন্মাদ পাগল নয় যে, ধরে কেউ ঠেঙাবে। এ হচ্ছে মজার পাগল!

কথার পাগল!

তাই আদর আছে লোকের কাছে।

সুস্থ লোকের কাছে পাগল বড়ো আকর্ষণীয় জীব। পাগলের মগজটা যেন একটা অজানা রত্নখনি, সেখান থেকে আহরণ করে তুলে নেওয়া যায় মণিমাণিক্য।

তাই পাগলের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা কয় লোকে, কুরে কুরে প্রশ্ন করে, খাওয়ার লোভ দেখিয়ে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, তার তারপর ক্ষেপিয়ে মজা দেখে।

এ সবই নাকি সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ!

এইসব সুস্থদের কাছে পাগলের আদর আছে।

তা লোকটা এদের বিপরীতে ভালোই অভিনয় করে চলেছে। মথুরা, বৃন্দাবন, প্রয়াগ অনেক জায়গায় ছিটকে ছিটকে বেড়িয়ে, আশ্রয় নিয়ছে কাশীতে।

আর কাশীটা রীতিমতো ভালোই লেগে গেছে। তাই থেকে গেছে। ভাবে, এই বা এমন কি মন্দ পেশা? লোকে নাচ দেখায়, থিয়েটার দেখায়, ম্যাজিক দেখায়, ভঁড়ামি দেখায়, আমি না হয় পাগলামি দেখাই। ওসবেও পয়সা দেয় লোকে, এতেও দিচ্ছে। দোষ কি?

.

কিন্তু কবে থেকে ওর এই অভিনয়ের শুরু?

তা জানতে হলে ওই মাস আষ্টেক পিছনে সরে যেতে হয়।

যখন নাকি লোকটা আস্ত এটা মানুষ ছিল, বউ ছিল তার, বাসা ছিল।

বউ তার জন্যে পরিপাটি করে বেঁধে রাখত,—আর নিজে পরিপাটি হয়ে বসে থাকত, ও যখন ঘরে ফিরত, ওকে মনে হতো সম্রাট।

এই সম্রাটের জীবনেই হয়তো জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো লোকটা, যেমন আরও হাজার হাজার লোক দিচ্ছে। অসাধুতা করছে, অজ্ঞতা করছে বলে কে আর সাম্রাজ্য হারাচ্ছে?

হারজিত শুধু ধরা পড়ায়, আর না পড়ায়।

লোকটা ধরা পড়ে গিয়েছিল।

আর বড়ো মোক্ষমই ধরা পড়েছিল।

একেবারে সরাসরি মালিকের সামনে।

কাছার খুঁটে হোমিওপ্যাথি শিশিতে কুন্তলবিলাস বেঁধে নিয়ে সরে পড়া নয়, খদ্দেরের কাছে মকরধ্বজের পুরিয়া পাচার করছিল।

খদ্দেরকে বিদায় করে সিঁদুর আর মিহি ইটের গুঁড়ো মিশিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করছিল, অসময়ে এসে পড়লেন মনিব।

জেরার চোটে বেরিয়ে গেল সব।

অনেকদিন ধরেই এ ব্যবসা চলছিল।

সালসার বোতলে আধাআধি চিরেতার জল, বচূর্ণ মাজনে স্রেফ ঘুঁটের ছাই, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু প্রকাশ পেয়ে গেল। ওই খদ্দেরটিই এসব বুদ্ধি দিয়েছে অজিতকে, হাতে ধরে শিখিয়েছে। অর্ডার দিয়ে যায়, অজিত সাপ্লাই করে।

লাভজনক ব্যবসা।

তিল কুড়িয়ে তাল।

কর্তা বললেন, তুমি অনেকদিন আছ। তোমায় খুব বিশ্বাস করতাম। তাই পুলিশের হাতে আর দেব না, এই দণ্ডে আমার এখান থেকে বেরিয়ে যাও, জীবনে আর মুখ দেখিও না।

চাকরি গেল।

পকেটে একটাকা এগারো আনা পয়সা সম্বল।

এতদিনের সহকর্মীদের সামনে থেকে ঘাড় হেট করে বেরিয়ে আসতে হল।মনে হল, পৃথিবী দ্বিধা হও।

যে লোকটা তার কুমন্ত্রণাদাতা, তাকে মালিক আটকে রেখেছেন, নইলে হয়তো কিছু আদায় হত। অনেক পাওনা ছিল তার কাছে। সে এল না। অথচ পৃথিবীরও দ্বিধা হবার নাম নেই।

এই মুখ নিয়ে কি করে মলিনার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে অর্জিত? এ খবর কি চাপা থাকবে? চাকরি যাওয়ার খবর চাপা থাকবে না, যাবার কারণও চাপা থাকবে না। মাধববাবুর বাসার সবাই জেনে ফেলবে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র আর সবচেয়ে সম্রান্ত অজিত ভট্টাচার্যের এই কাজ! এই স্বরূপ!

না, এ মুখ নিয়ে বাসায় ফেরা যায় না।

অথচ এই একটাকা এগারো আনা পয়সা সম্বল করে এতবড়ো পৃথিবীতে কোথায় পাড়ি দেবে?

হাওড়া স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ ভাবল অজিত, তারপর একটা প্লাটফরম টিকিট কেটে ঢুকে পড়ে মারাত্মক ভীড় সম্বলিত একটা থার্ড ক্লাস কামরায় উঠে পড়ল।

বিনা টিকিটের যাত্রীর ভাগ্যে যে কত লাঞ্ছনা জোটে, সে আর তখন মনে পড়ল না তার। বিনা টিকিটে উঠে পড়ার বাহাদুরীতেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

মনে পড়ল না, চুরির অপবাদে চাকরি হারিয়ে মুখ দেখাতে পারবে না বলে বাড়ি ফেরেনি সে। মনে পড়ল না, একটু আগে মনে মনে কান মলেছিল সে যে, জীবনে আর অসততা করব না বলে।

আপাতত যে মাধববাবুর বাসার কারও সামনে পড়তে হল না এটাই পরম লাভ মনে হল।

ওর না ফেরাটা মলিনার ওপর কি আঘাত হানবে, তা স্পষ্ট খেয়ালে এল না। একবাড়ি লোকের সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলল মলিনাকে।

ভীড়ে ঠেলাঠেলি গাড়িতে একটা কোণে গুঁজে বসে রইল, আর ট্রেন ছাড়তেই বলল, দুর্গা দুর্গা।

কোথায় যাবে জানে না।

টিকিট চেকার যদি না ধরে, তাহলে অনেক দূর পাড়ি দেওয়া যাবে। যদি ধরে, কী অদৃষ্টে আছে কে জানে?

আচ্ছা, পাগল সাজলে কেমন হয়?

চমৎকার! চমৎকার! এতক্ষণ কেন মনে পড়েনি।

অজিতের মনে হল জগতের সমস্ত রকম অসুবিধে আর বিপদ, অপমান আর লজ্জার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার এর থেকে সহজ উপায় আর নেই।

মনে হল এ চালটা মাধববাবুর বাসাতেও চালালে মন্দ হত না!

যাক।

এখন তো অজানা সমুদ্রে পাড়ি!..মাসের বাজার করা আছে মলিনার। মাসের মাইনেটাও আছে বাড়িতে। এক্ষুণি চট করে কষ্টে পড়বে না।

এখন পাগলের ভঙ্গিটা রপ্ত করা।

তা এখন থেকেই শুরু করলেই বা মন্দ কি?

সেই থেকে পাগলের ভূমিকা।

ক্রমশ যেন এইটাই স্বাভাবিক হতে চলেছে।

এখন আর গায়ে ছাই-কাদা মেখে, অথবা গালে-মুখে লাল-নীল রং মেখে নিতে বুকটা ফাটে না, যার তার জামায় টান দিয়ে বলে উঠতে দ্বিধা হয় না, এই শালা, আনা কতক পয়সা দে দিকি, পেটের মধ্যে খাণ্ডব দহন হচ্ছে।

পাগলে গাল দিলে কেউ রাগ করে না। বরং কথার চার ফেলে ফেলে আরও গালমন্দ আদায় করে, তবে দুআনা চার আনা পয়সা দেয়।

নেহাত যেদিন না জোটে, গিয়ে বসে পড়ে কোনো ছত্রে, পেটটা ভরে যায়।

ছত্রের খাওয়ায় পেটটা ভরলেও হয়তো মনটা ভরে না। এসে দাঁড়ায় কোনো খাবারের দোকানের সামনে, গিয়ে বলে ও দাদা, খুব যে খোসবু বার করেছ, চারটি ছুঁড়ে মারো না, এইখানে রাখি।

বলে আর পেটটা দেখায়।

.

পাগলের মতো কথা এখন আর ভেবে ভেবে সাজাতে হয় না ওকে, কথা আপনিই এসে হাজির হয় ঠোঁটের আগায়।

লজ্জাও হয় না।

এটা যে একটা বেশ মজাদার পেশা, সেটাই সে ধরে নিয়েছে।

আর এটাও ধরে নিয়েছে, এ পেশার পক্ষে কাশীই হচ্ছে উপযুক্ত ক্ষেত্র।

চোর-জোচ্চোর, ভিখিরি, পাগল, আর ধর্মের ষাঁড় এই জীবগুলোর জন্যে সদাব্রত খোলা আছে এখানে।

তাই শুধু যে পেটটাই ভরে যাচ্ছে তা নয়, পকেটেও কিছু কিছু উদ্বৃত্ত হচ্ছে।

তবে ওই পয়সাগুলো লুকিয়ে রাখার জন্যে অনেক পাঁচ কষতে হয়।

মণিকর্ণিকার ঘাটে যে সাধুটি রাতদিন ধূনী জ্বালিয়ে বসে থেকে ভস্মের পাহাড় জমিয়ে ফেলেছে, তার সেই ভস্ম-পাহাড়ের খাঁজে এক খুরি পয়সা-টাকা আছে পাগলার, আর ঘাটের ওপর যে অশ্বত্থ গাছটা অনেক ঝুরি নামিয়ে বসে আছে অগুনতি বছর ধরে, তার একটা ঘন অন্ধকার ডালে ঝোলানো আছে একটা কৌটো ভর্তি টাকা। শ্মশানে কুড়িয়ে পাওয়া ময়লা ন্যাকড়ার টুকরো দিয়ে বেঁধেছে, পাছে কারও চোখে পড়ে যায়।

আর এসব করে সে রাতবিরেতে।

অথচ লোকটা নাকি একদা জাতে বামুন ছিল, নিরীহ ভদ্রলোক ছিল।

বাসায় কারও সঙ্গে একদিনের জন্যে বচসা হত না তার।

এই জীবনের মধ্যে আটকে গেছে সে।

যদিও ভাবছে অভিনয় করছি।

তবে এক এক সময় বউয়ের জন্যে মন বড়ো উচাটন হয়ে ওঠে।

তখন এই ঘৃণ্য খোলসটাকে বড়ো অশুচি মনে হয়। তখন এই পেশাটাকে নারকীয় মনে হয়।

আর তখনই প্রাণটা ছটফটিয়ে ওঠে সেই বিস্মৃতপ্রায় সহজ সুস্থ জীবনটার জন্যে।

ইচ্ছে হয় বউটাকে কোনো প্রকারে একবার কাশীতে এনে ফেলে। তারপর সব সহজ হয়ে যাবে।

কাশীতে থেকে বুঝেছে, রাজ্যটা যে মা অন্নপূর্ণার বলা হয়, সেটা ভুল বলা হয় না। উপপাসী এখানে থাকতে হবে না।

বামুনের মেয়ে তো, একটা কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। কিছু না হোক, একটা ঠাকুর মন্দিরে ফুল জল ফেললে, মন্দির ধোয়া মোছা করলে, পুজোর বাসন দুখানা মাজলেও পেটটা চলে যাবে।

আর–

কে জানে বউটার কী হচ্ছে। সারাদিনের ছলনার পর রাত্রে কোনো মন্দিরের আনাচে কানাচে শুয়ে ভাবে পাগলা।

অবিশ্যি, সামান্য যা কিছু সোনা-রূপো, কাসা-পেতল ছিল, তাতে চলেছে কিছুদিন। তারপর? তা অতগুলো ঘর কি আর এক মুঠো করে চাল চাঁদা দিয়ে একটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখছে না? আর বাড়িওলা?—ওর অবস্থা দেখে কি আর ঘর ভাড়াটা মাপ করছে না?

পাগলামির নেশায় সত্যিই যেন পাগল হয়ে থাকি আমি। একখানা চিঠিও তো লিখতে পারতাম! অন্তত বেঁচে আছি, এই খবরটুকু দিয়ে! কিন্তু

আমি পালিয়ে আসার পর নিশ্চয়ই ওরা আমার ওই আপিসে খোঁজ নিয়েছিল, আর যা শোনবার শুনেছিল।চোর স্বামী এই ঘেন্নায় গলায় দড়ি দেয়নি তো মলিনা? যে মানিনী!

এই কথাটা যেই মনে আসে, সত্যিই যেন মাথার মধ্যে পাগলেরই মতো হিজিবিজি হয়ে যায়। আর চিঠি লিখতে সাহস হয় না। ভাবে যা থাকে কপালে, গিয়েই পড়ব একবার। আশেপাশে জিগ্যেস করব, মলিনা বেঁচে আছে কিনা। তারপর যা আছে অদৃষ্টে।

এখন চিঠি দিলে হয়তো বিপদই বাড়বে। বিপদই হয়েছে চিন্তা।

এখন দরকার কিছু নগদ টাকার।

ভেবে চিন্তে পাড়াটা বদলায়।

পাগলামীর ভোলটাও বদলায়।

আর সেই গায়ে ছাই মেখে হি হি করে হেসে লোকের মনোরঞ্জন করে না। চেয়ে চিন্তে একটা ধুতি আর শার্ট জোগাড় করেছে, পরে মন্দিরের রাস্তায় আসে, আর কোনো যাত্রী নামলেই কাছে। এগিয়ে গিয়ে বলে, বিলেত থেকে এলেন তো বাবু? দেশটা মন্দ না, কী বলেন? তা আমারও একবার যাওয়া দরকার। পরিবার সেখানে পড়ে আছে, আনতে পারছি না, এরোপ্লেনের ভাড়াটা জোগাড় হচ্ছে না, গোটা পাঁচেক টাকা ছাড়ুন না, বাবু?

অধিকাংশই অবশ্য ব্যঙ্গ হাসি হেসে সরে যায়, কেউ কেউ মজার মজার কথা শোনে জিগ্যেস করে করে।

বলে, তা বউ বুঝি মেম? এরোপ্লেন ছাড়া চড়বে না?

আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। মেমই। বাঙালির মেয়ে হয়েও মেম! বুঝলেন কি না বিলেত গেলে যা হয়, মেম দেখে দেখে মেম বনতে সাধ হয়। আমি চাষাভুসো বামুন, আমার পরিবার হয়ে তুই

ওরা হেসে হেসে বলে, তা তুমিই বা হঠাৎ পরিবার নিয়ে বিলেত গেলে কেন?

কেন?

পাগল চোখ মটকায়, আঙুল মটকায়, লজ্জা লজ্জা মুখে বলে, গেলাম কি আর সাধে? পরিবারের জেদ, বিলেত দেখবে, সাহেব-মেম দেখবে, চুরি-জোচ্চুরি যে করে হোক টাকা জোগাড় কর।

নে শালা তুই মর।-বউয়ের জন্যেই যে তার এত জ্বালা সেই কথাই বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।

তারপর হঠাৎ সুর ফেৰ্তা করে বলে, তা যাই বলুন বাবু, দেখবার মতোন দেশ বটে!

লোকে হাসির কথার দাম স্বরূপ দেয় চার আনা আট আনা।

কিন্তু কে জানে কথাগুলো ওর শুধুই বানানো কি না। না কি সাজা পাগলের পাগলামি আসলে অবয়ব নিচ্ছে?

সেদিনও এমনি ধরেছে একজনকে। গড়গড় করে বলে চলেছে, সব দেশ দেখলাম বাবু—চিন, জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া। বিলেতের মতন এমন দেশ দেখলাম না। বিশ্বাস না হয়, চলুন।

লোকটা হেসে বলে, তুই বুঝি ঘুরে এসেছিস!

শুধু ঘুরে? পাগল দুহাতের দশটি আঙুল ছড়িয়ে বলে, পাক্কা দশটি বছর কাটিয়ে এসেছি। পরিবার বলল, তুমি এখন যাচ্ছ যাও, আমি আর দুটো দিন থেকে যাই। তা বলব কি বাবু, পয়সার অভাবে পরিবারকে আনা হচ্ছে না।

লোকটা আরও হেসে ওঠে, তা এত দেশ বেড়ালি, পয়সা কে দিল? হঠাৎ সে সব পয়সা গেল কোথায়?

ওই তো, ওই বেড়িয়ে বেড়িয়েই তো বিলেত গেছি, এন্তার চাল ফলাচ্ছি, ষোলো ঘোড়ার গাড়ি ভিন্ন চড়ি না, ফল ফললো! পকেট গড়ের মাঠ! এখন এই দেখুন—ভদ্দরলোকের ছেলে, পায়ে এক জোড়া জুতো নেই।…আর বিলেতের এমন আইন, পায়ে জুতো নেই তো দাও ঠেলে হাজতে।

দিন না বাবু গোটা দশ টাকা—একজোড়া জুতো কিনে ফেলি–

লোকটা হয়তো আরও মজা করত, হঠাৎ বিশ্বনাথের গলি থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় বাঙালি ভদ্রলোক।

পাশের লোককে বললেন—”কি রে যতীন?

যতীন মৃদু হেসে বলে, কিছু না বাবু, এক ব্যাট পাগল। বলে, বিলেত যাবে

কথা শেষ হয় না, হঠাৎ পাগলটা সামনে আঁড়ানো মোটর গাড়িটাকে পাক দিয়ে ডিঙিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে চেষ্টা করে।

কিন্তু পালাতে পারে না।

পথ আগলানো এক ষাঁড়ের ধাক্কায় ছিটকে আছাড় খেয়ে পড়ে যায়।

আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আচরণটা পাগলজনোচিতই।

কিন্তু প্রৌঢ় ভদ্রলোক যেন দিশেহারা হয়ে এগিয়ে যান। হাত ধরে তোলেন পাগলকে। এবং পাগলের একরাশ দাড়ি গোঁফ সম্বলিত মুখটার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কে তুই?

পাগল হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে।

মুখ নীচু করে বলে, কেউ নেই। একটা পাগলা-ছাগলা ছেড়ে দিন বাবু।

ভদ্রলোক কিন্তু ছেড়ে দেন না।

বরং আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলেন, তুমি অজিত ভট্‌চায না?

চেষ্টা করেছিল কিছুক্ষণ।

বলেছিল—”আমি বাবু, সাহেব মানুষ, ভটচাযের খবর জানি না। বলেছিল—”বিলেত যাবার টাকাটা জোগাড় হলেই চলে যাই বাবু—পরিবার সেখানে পড়ে আছে!

কিন্তু বেশিক্ষণ পারেনি।

হাউ হাউ করে কেঁদে পা জড়িয়ে ধরেছিল।

যোগাযোগটা অদ্ভুত।

কাশীতে বেড়াতে এসেছেন, কুন্তল বিলাসের মালিক। যোগেন তাঁর সরকার। যোগেনের গুপ্তচরবৃত্তিতেই মালিক ধরতে পেরেছিলেন ওকে।

মালিক যেন বড়ো বেশি মর্মাহত হয়েছেন।

হয়তো অজিতের এই দুর্দশা দেখে তাঁর মনে হচ্ছে সেদিনের ব্যবহারটা বড়ো বেশি নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল। হয়তো মনে হয়েছে, লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়েছিলাম আমি। গরিব লোক, লোভ সামলাতে পারেনি, একবারের দোষ ক্ষমা করা উচিত ছিল। অতগুলো লোকের সামনে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ে লোকটার জীবনটাই নষ্ট করে দিলাম।…

আমার ব্যবহারে পাগল হয়ে গেছে লোকটা!

এই মর্মদাহ তাকে পীড়িত করতে থাকে।

আসলে অজিতকে ভালোবাসতেন। আর বাসতেন বলেই বোধ করি অত বেশি রেগেছিলেন তার অবিশ্বাসের কাজে।

জোর করে গাড়িতে তুলে বাড়ি নিয়ে গেলেন।  

আর নাইয়ে, খাইয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, বস্তুত পুরো পাগল নয়। লজ্জায়, ঘেন্নায় পালিয়ে এসে আর পথে পথে ঘুরে ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেছে।

যে জীবনটা নষ্ট হবার জন্যে তিনি নিজেই কিছুটা দায়ী, সে জীবনটাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না তিনি? ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না আর একবার সুযোগ দিতে?

চল আমার সঙ্গে।

বললেন মনিব।

অজিত মাথা হেট করে বলল, এ মুখ আর কলকাতায়–

আরে বাবা, রাগের মাথায় বাপ জ্যাঠা, মাস্টার মনিব অমন কত বলে। সেইটা ধরে, মাথা খারাপ করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হবে? ছি ছি! তোমার স্ত্রী আছে না?

ছিল তো

ছিল মানে? মানে, আর তো খবর নিইনি!

না না, অজিত কাজটা ভালো করনি। এতদিন কিভাবে কাটছে মেয়েটার, কে জানে। তুমি এই করে বেড়াচ্ছো জানলে, খোঁজখবর নিতাম। এখন চল আমার সঙ্গে, কাজকর্ম করবে।

আবার কাজকর্ম!

বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকায় অজিত।

মালিক জোর দিয়ে বলেন, কেন করবে না? মানুষ তো ভুল করেই। এবার নতুন করে–

কর্পূরের মতো উবে যাওয়া অজিত ভট্টচার্য তবে নতুন করে জীবন শুরু করতে আবার দেশে ফেরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *