1 of 2

৫০. কামিজের ওপরে ওড়না

কামিজের ওপরে ওড়না, ওড়না ময়লা হলেও একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় যে, মেয়েটির একটি স্তন নাই। বিহারে হিন্দুরা মেয়েটির অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে দুটো স্তনই আশ মিটিয়ে চাটা ও চোষার পর একটি কেটে ফেলেছে, খবরটা এই রিফিউজি ক্যাম্পে সবাই জানে এবং এর ফলে তার আত্মীয়স্বজনের রিলিফের হিস্যাটা একটু বেশি। কাদেরের হুকুমে কেরামত আলি একটা শাড়ি তার দিকে এগিয়ে ধরতেই সেটা চালান হয়ে যায় অন্য একটি হাতে। ওড়নার ভেতর থেকে মেয়েটি চোখ মেলে তাকালে ঘোমটা একটু সরে যায়। তার নিশ্বাস নেওয়ার আওয়াজে কেরামতের কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে এবং ঐ নিশ্বাসের আওয়াজে বা নিজের কানের ঝাঁ ঝাঁ গোলমালে কেরামতের বাবরি চুল এলোমেলো হয়ে যায়। এও কি গন্ধ শুকে কে মানুষের ভেতরের কথাবার্তা সব জেনে ফেলবে নাকি? কিন্তু এর গায়ের রঙ তো রীতিমতো ফর্সা, এর নাক তোক টিকালো। কুলসুমের মতো এর চোখ অতো বড়ো নয়, এর চোখে পটলচেরা ভাব।–তা হলে মিলটা কোথায়?

মেয়েটির কাটা স্তন এবং কুণ্ডবাড়ির একতলা, দোতলা ও ছাদ জুড়ে উর্দু ও দেহাতি হিন্দিতে প্রকাশিত রিফিউজিদের ক্ষোভ, রাগ, বিলাপ ও অভিযোগ ভাষার দুর্বোধ্যতা মুছে ফেলে এবং কেরামতের বাবরি চুল ছুঁড়ে খোঁচাতে থাকে অবিরাম। খোঁচায় খোঁচায় একটি পদ্যের কুঁড়ি তার মাথার চাঁদিতে বেঁধে ছোটো একটি কাটার মতো, কিন্তু কুঁড়িটা ফোটে না। কুণ্ডুবাড়ির সব জায়গায় আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে রিলিফের মাল দিতে দিতে কেরামতের মাথায় পদ্য ফোঁটার বদলে ফুটে ওঠে কুলসুমের মুখ। মুখটা গাঁথা হয়ে যায় বিহারি মেয়েটির ধড়ের ওপর। মাঝখান থেকে কুলসুমের বুকের একটা স্তন খসে পড়ে খাড়ার আঘাতে।

রিকুইজিশন করা যতীন রায়ের বাড়িতে রিফিউজি-ক্যাম্পের জন্যে বড়ো দুই টিন পাউডার দুধ নিয়ে একটি কাদেরের বাড়িতে রেখে এবং আরেকটি রিকশায় চাপিয়ে বাদুড়তলা যাবার সময় কুলসুমের কাটা স্তন কেরামতের চোখে ঝাপসা হতে থাকে। তাই রেলগেটের সামনে এসে নিজের নামটা শুনতে তার অনেকটা সময় লাগে। হঠাৎ চমকে উঠে ডানদিকে তাকিয়ে দেখে, রেল লাইনের ধারে চশমার ডালা থেকে ছোটো আয়না ধরে চোখের চশমা পছন্দ করছে কালাম মাঝি। তার সঙ্গেও রিফিউজিদের জন্যে রিলিফের পাাকেট। কালাম মাঝি তার রিকশায় উঠে বসলে তার চশমাপরা মুখ জীবনে। এই প্রথম দেখে কেরামত তাকে মিনিট তিনেকের মধ্যে দ্বিতীয়বার স্লামালেকুম বলে তাজিম করে। যতোটা সম্ভব বিনয় করে সে জিগ্যেস করে, সোমাচার ভালো?

আর ভালো! ভালো না থাকার কারণ সে বয়ান করে একে একে–। মাঝিপাড়ার কয়েকটা চোরাডাকাতকে পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে বলে ইসমাইল অকারণে তার ওপর খাপ্পা হয়ে রয়েছে। আরে নিজের রক্ত পানি করা পয়সায় যে বিল ইজারা নিয়েছে, সে কি চোরডাকাতদের মাছ ধরার জুত করে দিতে? ইসমাইল এই রাগে তকে রিলিফের মাল পর্যন্ত দিলো না। তা তাতে তার বয়েই গেলো! বলতে গেলে এই কারণেই তার দাম। বেড়েছে ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার আর সাদেক উকিলের মতো জাঁদরেল নেতাদের কাছে। ডাক্তার তাকে দুধের টিন দিতে না পারলেও বেশ কিছু শাড়ি আর লুঙি জোগাড় করে দিয়েছে। তবে কি-না ইসমাইল হোসেন একজন এম এল এ এবং গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা গোলাবাড়ি এলাকায় এখনো তার পজিশন ভালো। শরাফত মণ্ডলের বেটা কাদের ইসমাইলের কান ভারি করে রেখেছে। মাঝিপাড়াটাও হাত করার তালে আছে মদের। কালাম অনুমান করে, তমিজকে লুকিয়ে রেখেছে এই শালা কাদেরই। কালাম মিনতি করে, কেরামত কি ইসমাইল হোসেনকে তার হয়ে একটু বুঝিয়ে বলতে পারে না?

কিন্তু কুলসুমের একটি কাটা স্তন ও তার গায়ে ফর্সা ছাপ দেখে কেরামত বড়ো বিচলিত, শোলোকের কুঁড়িটা তার মাথায় ফোটে না। অন্যমনস্কভাবে সে জিগ্যেস করে, গোলাবাড়ির দিকে তো রিফিউজি যায় নাই, না? এবং তমিজ এখনো ধরা পড়ে নাই?

প্রশ্ন দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলেও কালাম মাঝি জবাব দেয় দুটোরই, এখাননা যায় নাই, তবে যাতে কতক্ষণ? এবং শালা খুনের আসামী হয়া পলায়া বেড়ায়।

কুলসুম একা একা নিরাপদে থাকে কী করে? কালাম মাঝির দারোগা বেটা কি তার ফোর্স নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না তার ওপর? পুলিস কি তার স্তনে ছুরি বসিয়ে দিলো? তার কাটা স্তনের দুধ ও রক্ত লেগেই কি কুলসুমের কালো মুখ গোলাপি হয়ে গেলো? কালাম মাঝিকে তো আর এসব প্রশ্ন করা সম্ভব নয়। কথাগুলো কেরামতের স্তনবিহীন বুকেই পড়ে থাকে এলোমেলোভাবে। কালাম মাঝি নিজে থেকেই বলে, বেটা তার চোরডাকাত জেলখাটা কয়েদি হলে কী হয়, তমিজের বাপ তো আছিলো ফেরেশতার লাকান মানুষ। হামরা একই বংশের মানুষ। তার বৌয়েক দেখাশোনা করা লাগে হামাকই। হামার ঘরত তাক থাকবার দিছি, দেখাশোনা করা লাগবি না?

কুলসুমের এই দুর্দিনে তার দেখাশোনার ভার নিয়েছে, আহা মানুষটা খুব সওয়াবের কাম করছে গো। কেরামত গদগদ চোখে তাকায় কালামের নতুন চশমা-পরা চোখের দিকে। আবার কুলসুমের দেখাশোনার সুযোগ কালাম মাঝির ভাগ্যেই জুটে যাওয়ায় তার বুকটা একটুখানি চিনচিন করে ওঠে। তার হিংসাটুকু হেঁকে পড়লে তার ভক্তিজৰ্জর দৃষ্টির প্রতিদান দেয় কলাম মাঝি তার কাব্যচর্চায় আগ্রহ দেখিয়ে, কেরামত আলি, তোমার দেখাই পাই না। এখন আর গান বান্দো-না?

টাইম পাই না কালাম ভাই। ব্যস্ত থাকার গৌরবে কেরামতের বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও . চিনচিনে হিংসা কেটে যায়, কিংবা এইসব কাটাতেই সে ব্যস্ত হওয়ার উপায় খোজে, হামার টাইম কোটে? ইসমাইল সাহেব কয়, কেরামতের হাতে রিলিফেরমাল দিলে নষ্ট হবি না। আবার সালেক উকিল ওইদিন কলো, কবি, এখন তোমাগোরে গান লেখার টাইম। পাকিস্তান হলো, এখনো যদি হিন্দু কবিদের কবিতাই পড়া লাগে তো ইসলামি : স্টেট করার ফায়দাটা কী? ঢাকাত যাও, ইসলামি জোশের গান লিখ্যা মানুষের মন পরিষ্কার করো। হামার ঢাকাত যাবার ফুরসৎ কৈ? কিন্তু নতুন শোলোকের কুঁড়িটা ফোঁটাবার ফুরসৎ তো তাকে করে নিতেই হবে। আপন মনে সে বলে, অনেকদিন বাদে গান একটা বান্দিচ্ছি। রিফিউজি লিয়া গান।।

চলো হামাগোরে ওটি চলো। একটা মজলিশ না হয করি। কালাম মাঝির প্রস্তাবে খুশি হলেও নিজের একটু দাম বাড়ায় কেরামত, মাঝিপাড়াত গান শোনার মানুষ কোটে?

মাঝিপাড়াত গান করবা কিসক? ওটি মানুষ কৈ মাঝিপাড়ার মানুষের কাব্যবোধে কালাম মাঝির আস্থা নাই, গান করবা তুমি গোলাবাড়ি হাটেত। মুকুন্দ সাহার দোকান তো আমি লিচ্ছি, সাহাক বায়না দিয়া রাখিছি। ঐ দোকানের সামনে মেলা জায়গা।

নিজের বাঁধা শোলোক অনেক অনেক মানুষের সামনে গাইবার জন্যে কেরামত কাঙাল হয়ে ওঠে, নিজের দাম বাড়াবার ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে সে বলে ওঠে, আজই যাবেন? চলেন। রিলিফের এই টিনটা যতীনবাবুর বাড়িত দিয়াই আমি আসিচ্ছি। এক ঘড়িও লাগবি না।

দুধ তো গোলাবাড়িতও দরকার। ওটা না হয় লিয়াই চলো।

দুধের বড়ো টিন হাত করে কেরামতকে সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা কালাম মাঝির আরো তীব্র হয়। মাঝিপাড়ায় সে বড়ো একা পড়ে গেছে। নিজের পরিবার পর্যন্ত মুখ গোমড়া করে থাকে তার সামনে। বৌয়ের চাচাতো বোনের ভাসুর আর খালাতো বোনের ছেলে বিলের ঘটনায় হাজত খাটছে। গোটা মাঝিপাড়ায় একটু আরাম পাওয়া যায় বরং কুলসুমের ঘরে গেলে। বিলডাকাতির কোনে কথাই সে তোলে না। মাঝিবংশের মেয়ে তো নয়, হাজার হলেও চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি। তমিজের বাপ নাকি প্রায়ই তার কাছে আসে। এসব কথায় কালাম তেমন আমল দেয় না। কিন্তু কয়েকদিন হলো তার কথা সে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। তমিজের বাপের কথা বলতে বলতে কুলসুমের লম্বাটে মুখ কেমন জ্বলজ্বল করে। দূর সম্পর্কের এই চাচিকে কালাম মাঝি দেখে আসছে কতোদিন থেকে, তার বাঁশঝাড়ের ভেতরেই তো সে বড়ো হলো দাদার সাথে। তারপর মেয়েটির বিয়েও হলো তারই সম্পর্কের চাচার সঙ্গে। কিন্তু এই মুখে এরকম আলো তো কালাম আগে কখনো খেয়াল করে নি।

আরার ওই আলো দেখে তার কেমন ভয় ভয় করে, একলা ঐ ঘরে ঢুকে কখন কী করে ফেলে সে নিজেই বুঝতে পারে না। মাঝিপাড়ার মানুষের কাছে দিনদিন সে ছোটো হয়ে যাচ্ছে, কালাম মাঝির নিজের ওপর নিজের দখল যেন কমে যাচ্ছে। কেরামত আলিকে আজকাল সে আর কাছছাড়া করতে চায় না। তার বাড়িতে নতুন ওঠানো চারচালা খানকা ঘরে তার থাকার ব্যবস্থাও সে করে দিয়েছে। বাঁশঝাড়ের পেছনে চেরাগ। আলির জন্যে যে ছাপরাটা ভোলা হয়েছিলো, ঐ ভিটাটা এখনো খালিই রয়ে গেছে। কেরামতের জন্যে ওখানে একটা ঘর তুলে দেওয়া এমন কোনো ব্যাপারে নয়। কিন্তু এই কবি শালা মানুষটা বড়ো ছটফটে, কখন কেটে পড়বে, হয়তো কাদেরের এক ডাকেই কুত্তার মতো চলে যাবে কালামকে কিছু না বলেই। তবে থাক, খানকা ঘরেই থাক। যতদিন থাকে, ততোদিনই লাভ। কালাম মাঝি এখন তার সঙ্গে, গপ্পো করতে পারে, তাকে নিয়ে হাটে যায়, বাজারে যোরে। আবার লোকজনের সামনে তার ওপর একটু তম্বিও করতে পারে।

কুলসুমের জন্যে কেরামতের টানটা কালামের কিন্তু ভালৈই লাগে। কুলসুমের সঙ্গে একা একা কথা বলতে তার যতোই ভালো লাগুক, ভয়ও করে। কেরামতটা থাকলে নিরাপদ।

কালাম মাঝির বাড়িতে সকালে পান্তা বা কড়কড়া ভাত, দুই সন্ধ্যা মাছ দিয়ে গরম ভাত খেয়ে এবং সময় অসময়ে কালাম মাঝির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে কেরামতের সময় কাটে, কিন্তু মাথার পদ্যটা তার ফোটে না। কুলসুমের দেখা পেলে এ্যাদ্দিনে গান বাঁধা হয়ে যেতো। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কালাম মাঝি হুট করে তুমি একটু আগাও, হামি আসি বলে কুলসুমের ঘরে ঢোকে, কেরামত ধীর পায়ে চলে কালামের খানকা ঘরে। আবার কেরামতের সঙ্গে কালাম কুলসুমের গপ্পোও করে। বলে, কেরামত কি সারাটা জীবন এমনি বাউণ্ডেলে হয়েই থাকবে? বিয়ে শাদি করবে না? কুলসুমটাও এই বয়সে ব্লাড়ি হয়ে থাকবে আর কতোদিন? কালাম মাঝি সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতটা কেরামত ঠিকই বোঝে। কিন্তু কালাম তাকে কুলসুমের ঘরে ঢুকতে দেয় না কেন?

এক মেঘলা ভোরে বাঁশঝাড়ে চেরাগ আলির শূন্য ভিটার দিকে মুখ করে পায়খানা করতে বসে কেরামত হঠাৎ খুব উতলা হয়ে ওঠে। কালাম মাঝি এখনো বাড়ির ভেতরে, তার বেরুতে দেরি আছে। কেরামত ডোবার পানিতে ভালো করে হাত ধুয়ে চলে যায় তমিজের বাপের ঘরে।

ঘরের চৌকাঠে বসে সে কুলসুমকে নিবেদন করে, তুমি তো তোমার দাদার শোলোক শাস্তর সবই জানো। হামাক কলে হামি না হয় লিখ্যা লিবার পারি।

বইতো তোমাক দিলাম। তুমি বলে বেচ্যা দিছো কার কাছে? দাদা অ্যাসা বই উটকায়, পায় না। সেই বই ফেরত পাওয়ার কোনে সম্ভাবনাই কেরামতের নাই। কুলসুম  ববাঝে না কেন, কেরামত নিজেই কতো কতো শোলোক বাঁধতে পারে, খোয়াবনামার তুলনায় সেগুলো কম কোনোদিকে? রীতিমতো ছাপা বই, লোকে পয়সা দিয়ে কেনে, পাইকাররা বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে যায়।

এখন তার লেখা আসছে না। ওই ছেড়াখোড়া বইটাই যতো অনিষ্টের মূল। একবার হাতে পেয়ে সেখানে কী যে সে পেলো, তার ওপর কী যে আসর করলো, এখন বইটা হাতছাড়া হতেই কলম তার একেবারে শুকিয়ে গেলো। কুলসুম যদি একটু পাশে থাকে, ফকিরের গানগুলো যদি একটু শোনায় তো কেরামত ফের আগের মতো গান বাঁধতে পারে। মরিয়া হয়ে সে বলেই ফেলে, তোমাকে দেখলে হামার গান বান্দা হয়। হাজার হলেও তুমি ফকিরের লাতিন। একটা গান বান্দিচ্ছি, এখনো শেষ করবার পারি নাই। শুনবা?

কাগজ নাই, কলম নাই, তবু তার পদ্যের বীজ মাথা ফেটে বেরোয় এই রকম আওয়াজে :

বাস্তভিটা হইতে বিতাড়িত মোহাজের।
পাকিস্তানেতে তারা হইয়াছে হাজের।।

কুলসুমের দিকে চোখ রেখেই সে পদ্য বলছিলো, কিন্তু তার চোখ দরজার বাইরে। চোখে তার তেজের বদলে একটুখানি হাসির কুচি। কেরামতের শোলোক তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। দরজার বাইরে কুলসুম কাকে দেখে? কেরামত বাইরে চোখ মেললে কাউকেই তো দেখতে পায় না। কেরামতের দিকে তাকিয়ে কুলসুম হঠাৎ বলে, দুয়ার ছাড়ো, আসবার দাও।

কৈ, কেউ তো নাই। অথচ কুলসুম কার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, তোমার বেটার বৌ তো পোয়াতি হছে গো। উনিক গেছিলাম।

সত্যি সত্যি কে যেন ঘরে ঢোকে, কেরামতের গা তার গতির বাতাসে কাঁপলে সে একটু সরে বসে। কিন্তু মানুষটাকে দেখা যায় না কেন? কুলসুম তার সঙ্গে কথা বলেই চলে, ঘেগি হলে কী হয়, বৌটা মানুষ ভালো। আমাকে বোয়াল মাছের সালুন দিয়া ভাত খিলালো। ওপরে এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি থেকে একটা কথা বার করে কুলসুম সামনে এগিয়ে ধরে, বৌ হামাক খ্যাতাখান দিলো। একটা কোণ অল্প একটু ছিড়া গেছে, তাও দুইটা শীত পাড়ি দেওয়া যাবি, লয়? এগিয়ে দেওয়া কাথার একটা কোণ শূন্যে একটু ওপরে উঠলো, কেউ হাত দিয়ে ধরে ছেড়ে দিলো। কুলসুম বলে, বৌয়ের বোন খ্যাতা সেলাই করিছে। কী সোন্দর খ্যাতা গো, লকসা দেখিছো? অদৃশ্য লোকটি দেখে, কেরামতও দেখে, সারা কাঁথা জুড়ে লাল নীল ও হলুদ সুতায় বরফি আঁকা, মাঝে মাঝে চাঁদ তারার ছবি। একেকটা চাঁদ পিছু তিনটে তারা।

কিন্তু তমিজের বাপের হাজিরা অনুমান করে, ঠিক করে বললে বলতে হয়, টের পেয়ে কেরামত শুকনা টোক গেলে। সবটা ঘরে বিলের কাদাপানির গন্ধ, পানির আঁশটে গন্ধ।

 

কেরামত আর কথা না বলে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসছে, দেখা হয়ে যায় কালাম মাঝির সঙ্গে। কালাম হঠাৎ এতো গম্ভীর হয়ে গেলো কেন? তমিজের বাপের ঘরে গিয়েছিলো শুনে স্থির চোখে সে তাকায় কেরামতের দিকে।

তবে বিকালবেলাতেই কালাম তাকে জানায়, কাল বুধবার না? হাটবার। কালই। তোমার গান হবি।

কালই? গান তো পুরা বান্দা হয় নাই। শুক্কুরবার দিন হাটবার আছে না?

বালের গান বান্দো! আজ রাতের মধ্যেই গান বান্দা রাখবা।

 

মুকুন্দ সাহার দোকানের বারান্দায় তক্তপোেষ পাতা হলো। তক্তপোষ ঘর থেকে বার করে দিলো বৈকুণ্ঠ নিজেই। আড়তে ঢুকে কালাম চোখ দিয়ে জরিপ করে বলে, ক্যা রে, মরিচের বস্তা না উদিনকা দেখলাম আটটা। আজ ছয়টা কিসক? জিরার বস্তা খালি একটাই আছে? সব বেচ্যা দিছু?

কালামের কথায় নয়, মুকুন্দ সাহাকে হিসাব দিতে হবে বলে বৈকুণ্ঠ মুখ কাঁচুমাচু করে। বাবুর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ও যে দাম পায় তাতেই মাল ছেড়ে দিচ্ছে। খরচাও করছে দেদার। সকালে চিড়া খায় আধসের রসগোল্লা দিয়ে, দুইবেলা ভাত খাচ্ছে বড়ো মাছ রান্না করে। তা ছাড়া সারাদিন তার মুখ চলছেই। হাটে কি আর খাবারের অভাব থাকে সেদিন গোসাইবাড়ির মেলায় গিয়েছিলো, নটিপাড়ায় পয়সা ঢেলে এসেছে খুশিমতো।

কিন্তু কালাম তাকে শাসায় অন্য কারণে, সাহা বায়না লিছে, দোকান হামাক দিবি মালশুদ্ধা। তুই বামাক মাল বেচলে লোকসান কার?

বৈকুণ্ঠ অবশ্য খুব একটা কানে নেয় না, সে মহা ব্যস্ত কেরামতের জন্যে মঞ্চ সাজাতে। দুটো হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিলো বারান্দার টিনের ছাদের সিলিঙে। নিজের দোকান থেকে কালাম একটা হাতলওয়ালা চেয়ার নিয়ে আসে বুধাকে দিয়ে। বৈকুণ্ঠ আরেকটা চেয়ার নিয়ে এলে কালাম মাঝি বলে, একটাই হবি। কবি বস্যা থ্যাকা গান করবি নাকি? চেয়ারে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে কালাম হুকুম করে, উগলান পরিস্কার কর। বৈকুণ্ঠ বুঝতে না পারলে সে দেখিয়ে দেয় দরজায় ঝোলানো লক্ষীপূজার সোলার সরা আর দড়িতে বাঁধা আমপাতার দিকে। বৈকুণ্ঠ বলে, উগলান তো লক্ষীপূজার।

যা কই শোন। বুধা দূরজা সাফ কর। মামার হুকুমে বুধা দরজার সোলার সরা আর আমপাতা সরাতে গেলে হাঁ হাঁ করে ওঠে বৈকুণ্ঠ আরে করো কী? করো কী?

না, ধরেন, পূজার জিনিস, যি সি মানুষ ধরা হয় না।

হামরা হাত দিলে দরজা লষ্ট হয়? শালা হামারই ঘরের দরজা, হামার ভাইগ্না হাত দিবার পারবি না?

না, তা কই নাই। ধরেন পূজা বলে কথা। বেজাতের মানুষ হাত দিলে– বলতে বলতে বৈকুণ্ঠ নিজেই ওসব সরিয়ে ফেলে। তখন কালাম মাঝি ফের হাঁক ছাড়ে, ক্যা রে বুধা, আগরবাতি কুটি?

ছোটো দুটো চালের মালসায় আগরবাতি গুজে বুধা মালসা দুটো রাখে মঞ্চের সামনে। কালাম মাঝি দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়, নারায়ে তকবির। তেমন জোরে সাড়া না পেয়ে সে ধমক দেয়, আল্লার নাম মুখোত লিতে আটকায়? জোরে কন। এরপর সে কয়েকবার নারায়ে তকবির ও পাকিস্তান বলে চিৎকার করলে সন্তোষজনক জবাব পায়। বেরাদারানে ইসলাম সম্বোধন করে কালাম মাঝি শুরু করে তার বক্তৃতা। মাসখানেক আগের একটা দৈনিক আজাদ তার চশমা-পরা চোখের সামনে ধরে সে শুরু করে ইনডিয়ার মোসলমানদের ওপর হিন্দুদের জুলুম ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিবরণ। মনে মনে বানান করে ফের চেঁচিয়ে পড়তে তার কষ্ট হয় বলে কাগজটা হাতে রেখে নিজেই পেশ করে ভারতীয় মোসলমান নিধনের ভয়াবহ কাহিনী। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস তার নাই; টাউনে রিফিউজি ক্যাম্পে ঘুরে ও এর ওর কাছে শুনে যেটুকু সে জানে তাই বলে যায় অগোছালো ভঙ্গিতে। ভাষা তার তেজোদীপ্ত না হলেও মোসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, পাইকারি হারে তাদের ধর্ষণ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, ভিটা থেকে তাদের উচ্ছেদ প্রভৃতি বিবরণে শ্রোতারা উৎসাহিত, এমন কি উত্তেজিত হতে থাকে। তারা বারবার ফিরে তাকায় পালপাড়ার শ্রোতাদের দিকে। আর এইসব শ্রোতাদের মাথা নিচু হতে হতে প্রায় মাটি স্পর্শ করে। কালাম মাঝি এবার ইশারা করে কেরামতকে, তোমার গান শুরু করো।

কালাম মাঝির বেপরোয়া বর্ণনায় কেরামত একটু উসখুস করছিলো। এরপর তার নতুন গান কি আর জমবে? সে তাই স্মৃতি থেকে শুরু করে, যাহার হাতে নাঙল, ফলায় ফসল অন্ন নাই তার পাতে।

কালাম মাঝি ধমকে বলে, ইগলান প্যাচাল বাদ দেও। মোহাজের লিয়া গান ধরো।

বৈকুণ্ঠ গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, বারান্দার নিচে থেকেই জিগ্যেস করে, তুন গান বান্দিছো?

এ কালাম মাঝির হুকুমে এক রাতেই নতুন গান লিখলেও এটা নিয়ে কেরামত খুঁতখুঁত করছিলো। এখন কী আর করা যায়? পকেট থেকে রুল টানা কাগজ বার করে সে পড়তে শুরু করে,

শোনো শোনো শোনো রে ভাই হিন্দু মোসলমান।
মোহাজেরের দুষ্কু কিছু করিব বয়ান।।
বাস্তুভিটা হইতে বিতাড়িত মোহাজের।
পাকিস্তানেতে তারা হইয়াছে হাজের।।
তাদের ঘর ছিলো বাড়ি ছিলো ছিলো পুষ্করিনী।
খোদার ফজলে তারা ছিলো নাকো ঋণী।।
আল্লা ও রসুলে তারা রেখেছে ইমান।
ইমান রাখিতে গিয়া দিলো শত জানা।।

তাকে থামিয়ে দিতে, কিংবা তার গানে অনুপ্রাণিত হয়েও হতে পারে, কালাম জিভে এচ এচ করে,বলে, মোসলমান জান দিয়া লিজের ইমান ঠিক রাখে! কতো মানুষ যে মরিচ্ছে। কোনো বাজনা ছাড়া পয়ারের একঘেয়ে ছন্দে বৈকুণ্ঠ মাথা দোলায়, কোথাও তাল কেটে গেলে মাথা নাড়া টললেও গানে মনোযোগ তার একটুও চিড় খায় না। কেরামত ফের গান ধরে,

কাফের হস্তে মায়েবোনে হারালো ইর্জত।
সব্বোশ্রান্ত হইয়া হেথায় করিলো হিজরত।।
হেথা হইতে যায় চলিয়া হিন্দু ভাইগণে।
মাতৃভূমি ত্যাগে বড়ো দাগা পায় গো মনে।।
স্বর্গদর্পে গড়িমসি এহি জম্মভূমি।
পিতাপিতামহ রহে এহি মাটি চুমি।।
তাহাদের মনোকষ্টে আল্লা হয় নারাজ।

কেরামত কোনো ভুল কথা বললো কি-না না জেনেও নিজের কথা বলার বেগ প্রবল হয়ে ওঠায় কালাম মাঝি তাকে থামিয়ে দেয়, রাখো। তারপর সে তার বক্তৃতার উপসংহার টানে, ভাইসব, পাকিস্তান শুধু মোসলমানের নয়, হিন্দুরও দেশ। হিন্দু ভাইগণ যদি এই দেশকে আপন মনে না করে, এদেশের মালসম্পত্তি সামান যদি ঐপারে পাঠায় তবে পাকিস্তানের বুকে ছুরি মারা হয়। হয় কি-না বলেন? হিন্দু হোক আর মোসলমান হোক, দেশের সয়সম্পত্তি নষ্ট করলে পাকিস্তানের পাক জমিনে তার জায়গা নাই।

কিন্তু শ্রোতারা তার কথায় তেমন কান না দিয়ে উঠে যেতে শুরু করলে এবং বিশেষ করে মাঝিপাড়ার লোকজন পানি আসবি গো, বাড়িত চলো। বলে ডাকাডাকি শুরু করলে কালামকে থামতে হয়। বৈকুণ্ঠ শুধু কেরামতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, শ্যাষ করবা না?

কালাম মাঝি তাকে মুখ ঝামটা দেয়, মোসলমান তোর ঘরত হাত দিলে ঘর নষ্ট হয়, মোসলমানের শোলোক শুনলে কান দুইখান তোর পচ্যা যাবি না?

বৈকুণ্ঠ কৈফিয়ত দেয়, না, না কি যে কন! লক্ষ্মীপূজার সরা তো? বেজাতের মানুষ হাত দিলে–।

মোসলমানে বেজাত হলো? মালাউনের বাচ্চা তুই কোস কি রে? কালাম মাঝি রাগে কাঁপে, ভাত খাস তুই পাকিস্তানের আর মোসলমানক তুই গাল পাড়িস জাত তুল্যা?

পালপাড়ার বিষ্ণু পাল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে প্রচণ্ড ধমক ছাড়ে, বৈকুণ্ঠ, হুঁশিয়ার হয়া কথা কোস। না হলে তোর দাঁতের পাটি দুইটাই একো চড়ে ফালায়া দিমু কলাম। তার হয়ে সে মাফ চায় কালাম মাঝির কাছে, এটা একটা পাগলা চোদা, অর কথা হামরা কি ধরি?

তোমরা ধরবা কিস? তোমার তো জাত তুল্যা কথা কয় না। বিটু পালকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে কালাম মাঝি চোখ পাকায় বৈকুণ্ঠের দিকে, শালা মালাউনের বাচ্চা, হামার ঘরত থাকিস, আর হামারই জাত লিয়া মুখ খারাপ করিস? ওঠ, শালা, আজই তোক এই ঘরছাড়া করমু। ঐ দরজাত হামি কলমা লেখ্যা টাঙায়া দিমু। দেখি শালা তোর লক্ষ্মী হামার কি বাল ঘেঁড়ে।

কেষ্ট পালের ভাই বিষ্ণু এবার পিছু হটে। আর কারো বিরোধিতা কিংবা সমর্থন না পেয়ে কালাম মাঝি ধরে এবার তার ভাগ্নেকে, ক্যা রে বুধা, ভাত খাস না? শালা মালাউন জাত তুল্যা কথা কয় আর তুই চুপ করা খাড়া হয়া মজা দেখিস! ওই শালাক কান ধরা বার কর‍্যা দে এই ঘর থ্যাকা।

বৈকুণ্ঠ এবার ভয় পায়, বাবু তো খবর পাঠাছে, আর কয়টা দিন বাদে আসিচ্ছে।

তোর বাবুর গোয়া মারি। তোর জাতের গোয়া মারি হামি। গতকাল সাহার ফিরে আসার খবর পাবার পর থেকে কালাম তার সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প ঘোষণা করে আসছে। কিন্তু এতোগুলো মোসলমান কেউ তার হয়ে কিছু বলছে না দেখে সে। আরো ক্রদ্ধ হয়ে উঠলে সামনে এগিয়ে আসে গফুর কলু।

অতো গরম কিসের গো? মাঝির বেটার অতো গরম কিসের? কাদের ভাই কয়া গেছে, মুকুন্দ সাহার দোকানে কিছু হলে, কি তার মানষের উপরে জুলুম হলে ফল ভালো হবি না। হুঁশিয়ার হয়া কথা কবা। বুঝিছো তো? বলতে বলতে গফুর কলু কালামের একেবারে কাছাকাছি চলে এলে কালাম সরে দাঁড়ায়, শালা কলুর বেটা তফাত থাক, তফাত থাক। কলুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে সে নিজেই আরো পিছে হটে। শালা মাঝির বেটিক লিকা করা মনে করিস, জাভোত উঠিছু, না? অতো সোজা লয়। শালা বুধবার দুপুর বেলা কলুর মুখ দেখিছি, তখুনি বুঝিছি, শনির লজর লাগলো।

বুধবার শনির নজর লাগায় কালাম মাঝি হন হন করে রওয়ানা হয় বাড়ির দিকে। তার পাশাপাশি দূরের কথা, ঠিক পেছনে পেছনে হাঁটতেও বুধাকে দৌড়াতে হয় সারাটা পথ। তবে মামুর কথাগুলো সে শুনতে পায় সবই, মণ্ডল তো সাহার বাড়ি দখল করিছে, এখন দোকানখানও লেওয়ার তালে আছে। হামিও দেখমু।

পরদিন সকালে কেরামতের সঙ্গে কালাম মাঝি নিজের দুঃখবেদনার কথা বলে। মাঝিদের উন্নতি হবে কী করে? এই যে শালা গফুর কলু, কিছুদিন আগেও মাঝিপাড়ার মানুষ ঘেন্না করে তার ছায়া মাড়াতো না। আর কাল সেই কলুর বাচ্চা তাকে বেইজ্জত করলো, মাঝিরা নাকি উত্তরপাড়ায় তাই নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছে। মাঝিরাই যদি মাঝির দুষমনি করে তো এই জাতের ওঠার কোনো পথ আছে? মাঝির খাঁটি মুরুব্বি। ছিলো এক তমিজের বাপ। নিজের জাতের জন্যে মানুষটা মণ্ডলের হাতে খড়মের বাড়ি খেয়েছে। তার ছেলেটা পর্যন্ত মাঝির সঙ্গে, নিজের বাপের সঙ্গে বেইমানি করলো। কুলসুমের ঘরে তমিজের বাপের রুহ নাকি রোজই একবার না একবার আসে, কথা কয়, কথা শোনেও। কুলসুমের কাছে বসে নিজের দুঃখবেদনার কথা বলার জন্যে কালাম মাঝির প্রাণটা আইঢাই করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *