৫ড. গীতিসংগ্রহ – মিলন

গীতিসংগ্রহ – মিলন

আইস ধনী রতন মন্দিরে
ভাবে পুলকিত ধনী পাইয়া বন্ধরে।
রতি রাধা রিসাবতী বিভোর শ্যামের কুলে
কমলের মধু যেন লুটিয়া ভ্ৰমরে।
কুমুদিনীর চন্দ্ৰ সুন্দর রাধার সুন্দর কানু।
প্ৰেমসাগরে দুই কান্ডারী ভাইস ফিরে জলে
তাহে ধইরা রসরাজু আনন্দে সাঁতারে।
ভাইবে রাধারমণ বলে দেখা গো সকলে
রাই কুলে শ্যাম, শ্যাম কুলে রাই শোভা করিয়াছে।

সুখ/৩৪

৭৮৩

আর তো দেরী নাই গো সখী
বিদায় দাও গো প্ৰাণবন্ধুয়া রাই।
দেও গো আমার চূড়াধড়া হাতে দেও মোর বাঁশি
দেখলে রাধার খুশিবাসী প্ৰাণেতে হই খুশী
ভাইবে রাধার খুশিবাসী প্ৰাণেতে ভাবিয়া
পরান দিয়া পরান নিব গো হয় গো পিরিাতের লাগিয়া।

ন/৯

৭৮৪

একাসনে রাইকানু প্ৰেমে ভাসিয়া যায়
একজনের গায়ের বসন আরেক জনের গায়
কে রাধা কে কৃষ্ণ চিনন না যায়।।
শ্যামের বামে রাইকিশোরী বইছইন দুইজনে
পুষ্পবৃষ্টি করে তারা সব সখীগণে।
দুবাহু তুলিয়া শ্যামে ধরেন রাইর গলায়
চন্দ্ৰগ্ৰহণ লাগিয়াছে ভাবে বুঝা যায়।
ভাইবে রাধারমণ বলে দেখো সখীগণে
যুগলামিলন হইল আজি রস বৃন্দাবনে।

নৃ/১

৭৮৫

ও বন্ধু নবীন রসিয়া
কেমনে বঞ্চিমু গৃহে তোমা ছাড়া হইয়া
নয়ন-জলে বুক ভাসিয়া যায়, না চাইলায় ফিরিয়া
তুমি এতো পাষাণ বুকী আগে জানিনা
না জানিয়া পিরিত করি এতেক যন্ত্রণা।।
চাতক রইল মেঘের আশে মেঘ না হইল তায়
জল বিনে যুবতী রাধা কি হইবে উপায়
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
এতদিনে পাইছি বন্ধু না দিব ছাড়িয়া।।

ক ম / ৮

৭৮৬

কত আদরে আদরে
শ্যাম সুয়োগী রসিক নাগর মিলিল দুইজনে।
কত ভঙ্গী করি দাঁড়াইয়াছে একই আসনে।।
শ্যামকুলে রাই রাইকুলে শ্যাম, শ্যাম রাইরে কুলেতে
কী আনন্দ হইল আজি নিকুঞ্জ বনে।।
মেঘের কোলে সৌদামিনী উদয় গগনে
কত পুষ্পপচন্দন ছিটাইয়াছে সব সখীগণে
ভাইবে রাধারমণ বলে, আমায় রাখিও কমল-চারণে।।

আশা/ ২৩৬

৭৮৯

(রাধার বারমাসী)

কান্দে রাধা চন্দ্ৰমুখী দিবসরজনী
গোবিন্দ ছাড়িয়া গেলা মুই অভাগিনী।
চৈত্রমাসের দিন নিদ্রার আবেশ
আমায় ছাড়িয়া (ঠাকুর) কৃষ্ণ রইলা কোন দেশ।
কোন দেশে রইলা কৃষ্ণ নিলয় না জানি
গোকুলে কান্দিয়া বেড়ায় রাধা বিনোদিনী।
বৈশাখ মাসের দিন বিরহিত হইয়া
শীতল চন্দন রাধে অঙেজগতে লাগাইয়া।
শীতল চন্দন অঙ্গে লাগাও সখীগণ
বন্ধু দরশন বিনা বাঁচে না জীবন।
জ্যৈষ্ঠ মাসের দিন ফুটে নানান ফুল
রাধার বন্ধু কুঞ্জে নায় রমণীর পুড়ে বুক।
আষাঢ় মাসের দিনে আশা ছিল মনে
আসিবা ঠাকুর কৃষ্ণ রথযাত্ৰা দিনে।
শ্রাবণ মাসের দিনে দেখিলা স্বপন
শিয়রে গোবিন্দ বইছইন প্ৰভু নারায়ণ।
ভাদ্রমাসের দিনে ধাদা ছিল মনে
ভাণ্ড ভাণ্ডি মাখন খাইব গোয়ালের বাথানে।
আশ্বিন মাসের দিনে উদ্ধবরে জিজ্ঞাসে
যাইবা নি রে প্রাণ উদ্ধব শ্ৰীকৃষ্ণের উদ্দেশে—।
একথা শুনিয়া উদ্ধাব করিলা গমন
কৃষ্ণের সাক্ষাতে উদ্ধাব দিলা দরশন।
উদ্ধবরে দেখিয়া কৃষ্ণ জিজ্ঞাসে কুশল
কুশলে নি আছইন আমার রমণীসকল।
কার্তিক মাসের দিনে উদ্ধাব আইল দেশে
কান্দিয়া কান্দিয়া রাধা উদ্ধাবরে জিজ্ঞাসে।
কহ কহ আরো উদ্ধাব কহ রে কুশল
কুশলেনি আছইন আমার শ্ৰীমধুসুধন।
অঘ্রাণ মাস হইল শেষ পৌষের তিন দিন
এবো তো না ঠাকুর কৃষ্ণের দেশে আইবার চিন
মাঘ মাসের দিন ভীম একাদশী
স্নান করিতে চলিলা রাধা তীৰ্থ বারাণসী।
সোনা না হয় রূপা না হয় অমূল্য রতন
সধবা থাকিতে রাধার বিধবা লক্ষণ।
ফাল্গুন মাসের দিন দোল পুর্ণমাসী
আসিলা ঠাকুর কৃষ্ণ আবিরের বৃষ্টি।
ভাবিয়া বাধারমণ বলে শুন সখীগণ
রাধাকৃষ্ণের মিলন হইল রাসববৃন্দাবন।

সর্ব/১

৭৮৮

কি অপরূপ লীলা দেখবি যদি আয়
শ্যাম অঙ্গে রাইর অঙ্গ দিয়া রাই ধনী ঝুলায়।
শ্যামের মাথায় মোহনচূড়া বাতাসে হিলায়
রাইয়ার মাথায় মোহন বেণী ভুজঙ্গ খেলায়।
ভাইবে রাধারমণ বলে সময় গাইয়া যায়।।
এমন সুযোগ সখী আর কি পাওয়া যায়।

সূহ / ১ ৫

৭৮৯

কুঞ্জবনে রাধার মদনমোহন চলে গো
ধীর ধীর গমন।
হালিয়া ঢলিয়া পড়ে চলে না চরণ।।
চন্দ্ৰাবলীর কুঞ্জ হইতে করিলা গমন
শ্ৰীরাধার মন্দিরে গিয়া দিলা দরশন।
সিন্দুরের ইন্দুবিন্দু ললাটে চন্দন
কে খাইয়াছে কমলমধু শুকাইয়াছে চাঁদবদন
ভাইবে রাধারমণ বলে শুন সখীগণ
পুরুষ ভ্রমরা জাতি দোষ কি কারণ।।

সুখ/৩৩, ক/৩৯

পাঠান্তর : ধীর ধীর গমন > এর পর যোগ হবে–শ্ৰী রাধার মন্দিরে যাইতে করিলা গমন; শ্ৰীরাধার … দরশন > এর পরে যোগ হবে–কলা চান্দের কালা অঙ্গ কালা আভরণ / শ্ৰীমুখে কাপুরের বাস দরশনে পরশন।

৭৯০

চলনা চলনা মাধব নিশি যায় পোষাইয়া
কিবা ধনী শুইয়া আছে কপাট লাগাইয়া
মন্দিরের সামনে গিয়া হস্তে দিলা তালি
আপনি খসিল রাধার কপাটের খিলি
মন্দিরে ঢুকিয়া কৃষ্ণ চতুর্দিকে চাইন
শিয়রে বসিয়া কৃষ্ণ রাধারে জাগাইন
কৃষ্ণের মুখে মুচকি হাসি রাধার মুখে চায়
কেবা কৃষ্ণ কেবা রাধা চিনন না যায়।
ভাবিতে ভাবিতে কৃষ্ণ বাঁশিত দিলা টান
একটানে উড়াইয়া দিলা শ্ৰীরাধিকার পরান
ভাইবে রাধারমণ বলে শুন গো ধনি রাই
চক্ষু মেলি দেখ তোমার আসিয়োছইন কানাই।

ক/ ৭

৭৯১

ছাড়িয়া না দিব বন্ধুরে ছাড়িয়া না দিব
তুমি যদি ছাড় বন্ধুরে আমি না ছাড়িব।
ওরে সুনারো পুতুলার মত হৃদয়ে রাখিব।।
তুমি হইবায় কল্পতরু রে বন্ধু আমি হইব লতা
ওরে দুই চরণে বান্ধিয়া রাখিমু ছাড়িয়া যাইবায় কোথা।
ভাইবে রাধারমণ বলে রে বন্ধু মনেতে ভাবিয়া
অভাগীরে সঙ্গে নেও নিজ দাসী জানিয়া।

রা/১৪২

৭৯২

ছাড়িয়া যাইবার না লয় মনে আমরা বিদায় হই।
জন্মের মতো প্ৰাণনাথরে আবার দেখিয়া লই।।
থাক থাক ওরে বন্ধু বৃন্দাবন জুড়িয়া।
কাকুতি মিনতি করইন চরণে ধরিয়া।।
দয়া নি রাখবায় বন্ধু অধম জানিয়া
ভাবিয়া রাধারমণ বলে শুন গো ধনী রাই
পাইবায় তোমার ঠাকুর কৃষ্ণে কোনো চিন্তা নাই।।

আশা / ১ ২

৭৯৩

দেখ দেখা গো সখী দেখা নয়ন ভরি
বিপুলায় শ্যামকে দেখে খৈ বরিষণ করি।
খৈ ছিটায় মুষ্টি ভরি মুখে বলে হরিহরি
আনন্দে নৃত্য করে শ্যামাপ্ৰদক্ষিণ করি।
বিপুলায় হর্ষ করে ঘুরি ঘুরি শ্যাম নেহারে
মনানন্দে উছলে পড়ে। শ্যাম ধরি কি ধরি।
ভাইবে রাধারমণ বলে আয় গো সবে কৌতুহলে
জয় গোবিন্দ বলে নাচ নাচ উল্লাস ভরি।।
গো (২৯৯)

৭৯৪

বাজে গো চাইর আতে এক বাঁশি
বৃন্দাবন চইলে যায় আনন্দেতে ভাসি।
শ্যাম আমার চিকন কাল অমাবস্যার নিশি
রাই আমার বিদ্যুমুখী পূর্ণিমার শশী।
গাথিয়া ফুলের মালা যতেক রূপসী
শ্যামের গলে দেয় মালা মৃদু মৃদু হাসি।
ময়ুরায় নৃত্য করে তামালেতে বসি
ভেইবে রাধারমণ বলে হাইতাম শ্যামের দাসী।

সুখ/৭

৭৯৫

বাঁশি কে বাজাইয়া যায়–
এমন সুখের বাঁশিয়ে রাধারে জাগায়।
আর রাস্তায় চলিয়ে কিষ্ণে
বাঁশিয়ে দিলা টান।
ওয়রে ঘরে থাকি শ্ৰীরাধিকার
উড়াইলা পরান।।
আর মন্দিরে সামাইয়া কিষ্ণে
চারিপানে চায় :
ওয়রে হাতের বাঁশি ভূমিত থইয়া
রাধারে জাগায়।।
আর ঘুম ঘুম করিয়া কিষ্ণে
মুখে দিলা পান।
ও রাধারমণ বলে,
শ্ৰীরাধিকায় যৈবন কইলা দান।

শ্রী/৩৪৪

৭৯৬

মধু বৃন্দাবনেরে রাই মিলিল গিরিধারী
উচ্চ পুচ্চ তুলে নাচে ময়ুর ময়ুরী
আমরা যেন নিতই নিতই শ্যামরূপ হেরি
তরুয়া কদম্ব ডালে ডাকে শুকশারি
প্ৰেমানন্দে সখীবৃন্দে দেয়ারে করতালি।
রাধাশ্যাম মিলন হইল বলো হরি হরি।
ভাইবে রাধারমণ বলে সদায় চিন্ডিয়া মারি–
জন্মবধি কইলাম চিন্তা পাইলাম গো শ্ৰীহরি।

গো (৩০০)

৭৯৭

মধুর মধুর অতি সুমধুর মোহন মুরলী বাজে
দেয় করতালি, ব্রজের নাগরী মঙ্গল আরতি মাঝে।।ধু।।
শঙ্খ ঝাঞ্জরী পাখোয়াজ খঞ্জরী কেহ কেহ বীন বাজে।
তা ধৃক তা ধৃক তা — তা তা থৈয়া মধুর মৃদঙ্গ বাজে।
ধূপ দীপ লইয়া মধুর আনন্দে ললিতা বিশাখা সাজে
ময়ুরা ময়ুরী নাচে ঘুরি ঘুরি রাই কানু থইয়া মাঝে।
কহে প্ৰেমানন্দে মনের আনন্দে আর কি এমন হবে
শ্ৰী রাধারমণ যুগল চরণ কবে সে দেখিতে পাবে।

গো (১২৪)

৭৯৮

মিলিল মিলিল মিলিল রে
আজ কুঞ্জে রাধা কানাই মিলিল রে।
শ্ৰীরাধিকার প্ৰেমরসে বিচিত্র পালঙ্ক ভিজে
কানাইর মাথার চূড়া হালিল রে।
শ্যামকুঞ্জের জল অতীব সুশীতল
মকর কুঞ্জে কানাই শোভিল রে
ভাইবে রাধারমণ কয় রাধা কানাইর মিলন হয়
মধুর বৃন্দাবন আজ প্ৰেমরসে ভাসিল রে।

সুখ/৩৫

৭৯৯

শুনগো কিশোরী           বাজে গো বাঁশরী
নিকুঞ্জ কানন বনে
শুক পিক সব           করে কলরব
মধুর মুরলী গানে।
মনের বেদনা           বিচ্ছেদ যাতনা
এত যাহার কারণে
আসিল সেজন           করগো যতন
মিলোগো তাহার সনে।।
মেলিয়া নয়ন           করিয়া দর্শন
পুলক আনন্দ মনে
করিয়া আদর           পুস্পশয্যা পর
বসিলেন দুইজনে।।
শ্ৰীরূপ মঞ্জরী           ..অধিকারী
ললিতাদি সখীগণে
যতেশ্বরীগণ           আনন্দে মগন
কহে শ্ৰীরাধারমণে।

য/১১২

৮০০

শুনগো সখী রাধার মন্দিরে বাজে বেণু
আইজ বুঝি শ্ৰীরাধিকায় পাইয়াছে কানু।।ধু।।
রাধারে লইয়া হরি আছে কত রঙ্গ করি
রঙ্গে রক্তিগলা শ্যামনু
কুঞ্জের ফুলের বাসে ঝাঁকে ঝাঁকে ভ্ৰমর আসে
সুগন্ধ মোহিত ফুলের রেণু।
কুঞ্জশোভা মনোহর দেখা কত রং ধরে
চক্ষে ভাসে যেমন রামধনু
চল সখী শীঘ্ৰগতি দেখি রাধা কেমন সতী
রতি করে কুঞ্জে লই কানু।
কানু কয় এস পিয়ারী দুইজনে ছল করি
দুই অঙ্গে হই এক তনু
রাধারমণ বলে কলঙ্ক ভঞ্জন করে
রাই অঙ্গে মিশি গেল কানু।

গো (২৯৮)

৮০১

শ্যামের সনে রাই মিলিল গো মিলিয়া মিশিয়া
তোরা দেখা গো আসিয়া
নানা জাতি মালা গীখি যতন করিয়া
শ্যাম গলে দিতাম মালা গো বুলাইয়া ঝুলাইয়া।
চুয়াচন্দন রাখি কটরায় ভরিয়া
শ্যাম অঙ্গে দিতাম চন্দন ছিটাইয়া ছিটাইয়া
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আমারে নি করবায় দয়া শ্ৰীমতী জানিয়া।

ক. ম /৩

৮০২

সখী দেখো রঙ্গে কেলি কদম্বতলায় নাচে রাধাবনমালী।।ধু।।
দুই তনু এক করি করে তারা কেলি বামেতে রাধিকা দেখো
ডানে বনমালী।
দুই রূপ এক হইয়া উঠিছে উজলি বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে
করে ঝলমলি।
ব্ৰজাঙ্গনা মোহিত দেখি রাধা বনমালী
আনন্দে মাতোয়ারা হইয়া হাতে দেয় তালি।
ভাইবে রাধারমণ বলে কুলে দিয়া কালি
নামেতে যোগিনী আইয়া না পাইলাম বনমালী।

গো (২৯৭)

৮০৩

সুখের নিশিরে বিলয় করি প্রভাত হইও না
তুমি নারী হইয়ে নারীর কোন বেদন জানি না।
ও নিশি রে আমার একটা কথা রাখা আঁধার হইয়া থাক
প্ৰভাত কালে যাবে ফেইলে কেনো নিশিরে।
তুমি যদি হও রে প্রভাত আমার বুকে দিয়ে আঘাত
তুমি নারী বধের পাতাকিনী হবে রে
ও নিশি রে রাত্র প্রভাতকালে কোকিলায় পঞ্চম বলে
বিনয় কইরমু কোকিলার চরণে নিশিরে।
ভাইবে রাধারমণ বলে রাই ধইরাছে শ্যামের গলে

আমি কেমনে তোরে করিতাম বিদায় রে।

সুখ / ৩৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *