৪. যুদ্ধের দ্রুত কলকাতা

যুদ্ধের দ্রুত কলকাতা।

বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসে জরিনা বলেছিল, এখুনি সে বাসায় ফিরবে না। ঘুরে বেড়াবে। এসপ্ল্যানেড দিয়ে গাড়ি ছুটছে। ড্রাইভ করছে আলীজাহ্ আর জরিনা পাশে বসে।

অন্ধকার আকাশের নিচে কলকাতায় যেন অসংখ্য আলোর নৃত্য চলেছে। চকোলেট, র‍্যাপার, চুয়িংগাম আর ইউনিফর্মড হোয়াইটস। এত রাতে শহরে সে আর কোনদিন এমনি লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ায়নি। আলীজাহ্‌ উদার দুহাত থেকে সে আজ মূল্যবান উপহার পেয়ে গেছে।

আর সমস্ত কলকাতা যেন শূন্য, বিস্তৃত, বিশাল একটা পটভূমি যেখানে এতকাল কিছুই হয়নি; আজ সেই পটভূমিতে নানা রঙের আলোর রেখা–দীর্ঘ এবং বিন্দু বিন্দু–আলোর বৃত্ত অবিরাম জ্যামিতির জ্বলন্ত নকসা এঁকে চলেছে। আর তাই দেখতে মানুষ ভিড় করেছে, অস্থির তাড়া খাওয়া মানুষ এখানে ওখানে ময়দানে, চৌরঙ্গিতে। একটা কটু কিন্তু মিঠে মিঠে জন্মান্তরের চেনা জ্বালাকর ঘ্রাণ বাতাসে গাড়ির দুপাশ দিয়ে হুহু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। জরিনা নড়েচড়ে বসলো। আলীজাহ্‌ শুধালো, কিরে আরো বেড়াবি?

হুঁ।

মোমাছির গুঞ্জনের মতো হেসে উঠলো আলীজাহ্।

তার পায়ের চাপে দ্রুত উদ্দাম হয়ে উঠল গাড়িখানা। সমস্ত অস্তিত্ব থরথর করে কাঁপতে থাকে যেন আবেগে। জরিনার মন আশ্চর্য রকমে হালকা হয়ে যায়। অপূর্ব একটা খুশিতে টলমল করে ওঠে। আলীজাহ্ তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বলে, চল দমদমের ওদিক ঘুরে আসি।

জরিনার দুই করতল তালি হয়ে উঠতে চায় আনন্দে, গতিতে, মুক্তিতে। সেই পার্টির কথা এখন তার একটুও মনে পড়ছে না। দিগন্তের আড়ালে দ্বীপের মত তলিয়ে গেছে যেন সবকিছু।

বাসায় যখন ফিরে এলো তখন বেশ রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। কেবল আলো জ্বলছে সাদেকের স্টাডিতে। আলীজাহ্ বলল, আব্বা পড়ছেন। ইস্ মেলা দেরি হয়ে গেল, নারে?

গ্যারেজের তালা খুলে আলীজাহ্ গাড়িটাকে এগিয়ে পেছিয়ে কাটিয়ে ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, কেমন লাগল বল এবার।

ভালো।

কী ভালো?

জরিনা বুঝতে পারল না তার প্রশ্ন! তাকিয়ে রইল।

জন্মদিনের সেই মেয়েটিকে কেমন লাগল তাই জিগ্যেস করছি। খুব সুন্দর করে সাজতে পারে, কথা বলতে পারে, না?

হ্যাঁ–জানো আলীচাচা, আমাকে রোজ যেতে বলেছে।

কোথায়?

আলীজাহ্‌ বিস্ময়ে মুখটাকে প্রকট করে তোলে।

ওর ওখানে।

যাবি, বেশতো।

তোমার সঙ্গে যাবো। তোমাকে ওরা সবাই চেনে, না আলীচাচা?

আলীজাহ্‌ হাসলো অনেকক্ষণ ধরে।

গাড়ি ততক্ষণে গ্যারেজে ঢুকে গেছে। বেরিয়ে এসে আলীজাহ্ দরোজা বন্ধ করতে লাগল। জরিনা তার দুহাত দিয়ে দরোজার অন্য পাল্লা টেনে এনে ভিড়িয়ে দিল।

বাহ, খুব কাজের হয়েছিস তো। হাতে ব্যথা পেলি নাকি?

নাহ।

পরিশ্রমে, প্রশংসায় লাল হয়ে ওঠে জরিনার মুখ।

এই–ছি, ছি, সরে দাঁড়া জরিনা।

জরিনা চকিতে নিচে তাকিয়ে দেখে গ্যারেজের সমুখে সরু নালাটায় একটা ইঁদুর মরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। জরিনা মনে মনে শিউরে ওঠে– এ র‍্যাট, এ ডেড র‍্যাট। আর এ টি–র‍্যাট।

 আলীজাহ্‌, জরিনার হাত ধরে বাসার ভেতর যেত যেতে বলে, ড্রাইভার কদিন হলো যা ফাঁদ পেতে রেখে গ্যারেজের চারদিকে। কটা মরলো কে জানে?

বড্ড বিশ্রী, আলীচাচা।

সেদিনের মতোই দুটো করে সিঁড়ি একসাথে ভাঙতে থাকে জরিনা। আলীজাহ্‌ একটা তালি দিয়ে বলে, আজ তিনটে করে জরিনা। পারলে তোকে তোকে একটা শাড়ি কিনে দেব। খুব দামি শাড়ি। লাল টুকুটুকে, রেশমি।

জরিনার সমুখে ক্রীমঙ্গা দেয়ালটা যেন হঠাৎ লাল হয়ে জ্বলে ওঠে– সংগীত হয়ে রিমঝিম করতে থাকে।

এর ঠিক পাঁচদিন পরে আলীজাহ্ বম্বে চলে গেল ছবির কাজ পেয়ে। জরিনার তখন কান্না পেল। তিনদিন ধরে খাতার পৃষ্ঠায় বড় বড় করে চিঠি লিখলো বাঁকা হাতের লেখায়। তারপর কখন যে সেই পৃষ্ঠাগুলো অনাদরে অযত্নে কোথায় পড়ে রইলে তা জরিনা নিজেও জানতে পেল না।

.

শাহ সাদেক আলী জরিনার কামরার কাছে এলেন। এসে দেখলেন দরোজা বন্ধ। ভেতরে রেডিওগ্রামের ভল্যুমটা এত ওপরে ওঠানো যে ডাকলে তার স্বর গিয়ে পৌঁছুবে কী না সন্দেহ।

মেয়েটি তার এমনি, মনে মনে ভাবলেন তিনি, বিব্রত হয়ে, খানিকক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে। কিছু বোঝা যাবে না, নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না তবু যেমন বুঝতে পারলেন তিনি, কোথায় কী একটা ধাক্কা লেগেছে আজ জরিনার মনে যেটা ভুলবার জন্য চলেছে এই আয়োজন।

এমন ছোটখাটো ঘটনা বহু দেখেছেন সাদেক আলী। দেখেছেন জরিনাকে কষ্ট পেতে। দরোজায় করাঘাত করলেন তিনি। কিন্তু সে শব্দ নিজের কানেই শোনা গেল না। আবার তিনি হাত তুললেন। এবারে আরো একটু জোরে। তবু শোনা গেল না। হঠাৎ ভীষণ জোরে আঘাত করলেন দরোজায়। শাহ সাদেক আলীর গৌর মুঠিতে রক্তিমতা ফুটে উঠলো! ব্যথা করল।

তখন দরোজা খুলে জরিনা দেখল বাবাকে।

কী বাবা?

জরিনাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছেই যেন নিজে লজ্জিত হলেন সাদেক। বললেন, তোর কি শরীর খারাপ করেছে?

নাতো।

জরিনা বাঁ–হাতে চুলের প্রান্তভাগ সামলাতে সামলাতে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল তার দিকে। বলল, কিছু বলবে?

রোকসানা ভল্যুম কমাতে বলেছে, কথাটা বলতে সাদেকের কুণ্ঠাবোধ হলো। পরে হঠাৎ উৎসাহের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন–কেননা তার মনে পড়ে গেছে, আলী লাহোর থেকে আসছে আজ। তার করেছে।

কখন?

সন্ধ্যের প্লেনে। যাবি এয়ারপোর্টে?

বলেই সাদেক আর দাঁড়ালেন না, এমনকি একটু আগে যে মেয়ের সঙ্গে বসে চা খাবেন সিদ্ধান্ত করেছিলেন, সেটাও ভুলে গেলেন বলতে।

জরিনা ফিরে এলো ঘরের মাঝখানে। এক মুহূর্ত তার শ্রুতি বধির হয়ে রইলো–কোনো সঙ্গীত সেখানে তুলতে পারল না তরঙ্গ।

আলীচাচা আসছেন।

যেন পৃথিবীর একটা পরম আশ্চর্য সংবাদ শুনেছে সে। ঠিক তার জীবনের এইসব মুহূর্তগুলোতেই আলীচাচার মুখ কেন এমনি করে ভেসে উঠবে? আজ সে ভাবছিল কার কথা? আলী চাচার কথা। আজ তার একটু আগেই না মনে হচ্ছিল তার এই আপনতম লোকটার কথা? যার সহানুভূতির অমৃত আঁজলা ভরে সে পান করতে পারে।

জীবনের যে সমস্ত দুঃসময়ে তার মনে হয়েছে নিচে মাটি নেই আর সমুখের দিগন্ত গাঢ় অন্ধকার তখন মরে যাবার কথা মনে হয়নি। মনে হয়েছে তার শৈশবের কথা, কৈশোরের কথা, মায়ের চ্যাপ্টা কাঠপুতুলের মুখ আর আলীজাহ্‌ কথা। আলীজাহ্ বলেছে, একমাত্র হৃদয়কে যা স্পর্শ করে তাই–ই সত্য। হৃদয়কে তখন স্পর্শ করতে অতীতের মুখগুলো যা সত্য; হৃদয়কে তখন স্পর্শ করতে নিজের মনোবল যা সত্য; হৃদয়কে তখন স্পর্শ করতে পৃথিবীর অফুরন্ত ব্যঙ্গ—যা সত্য, কিন্তু তেতো।

একবার শুধু তার মনে হয়েছিল আলীচাচার কথা মিথ্যে, যেদিন ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল। কলকাতা থেকে ঢাকা আসছিল ওরা তখন। রেলে গিজগিজ ভিড়। আপার ক্লাশ আর লোয়ার ক্লাশে কোনো তফাৎ নেই তখন। টিকিট একটা থাকলেই হলো। তারপর যে কোনো ক্লাশে ওঠা; গাড়ি পাকিস্তানে যাবে।

ট্রেন ছুটে চলেছে অন্ধকার ভেদ করে। আলীজাহ্‌ সাদেককে কলকাতা থেকে ভালো জায়গা করে তুলে দিয়েছিলো। বাঙ্ক রিজার্ভ করা ছিল তার জন্য–একটা ব্রাঙ্কে তিনজন যাত্রী, তবু সুবিধে। আর শেষ অবধি হুটোপুটির ভেতরে, বুক কাঁপানো গাড়ির ঘণ্টার শব্দের ভেতরে, টালমাটাল পায়ে অন্ধের মতো নূরুন্নাহার আর জরিনা গিয়ে উঠেছে তৃতীয় শ্রেণীর মহিলা কামরায়।

কামরার ভেতরটা যেন লালচে আলোয় বিভৎস হয়ে উঠেছে আরো। একে মানুষ, ট্রাঙ্ক, তৈজসপত্র, বাচ্চা–কাচ্চা–তার ওপরে ভ্যাপসা গরম। বাচ্চাদের চিৎকারে থেকে থেকে বুকের ভেতরে ছাৎ করে ওঠে, যে এখনি মরে যাবে কেউ। এরি ভেতরে বিলাপ করছে কেউ, কী জিনিস–পত্ৰ আগলে আছে রক্তচোখে।

বুকের ভেতরে ভয় ভয় করছিল দুবোনের। জনাির মনে হচ্ছিল যেন সৃষ্টির আদি থেকে সে এখানে গাড়ির ভেতরে জন্ম নিয়ে এতটা বয়স অবধি পার হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছিল, এই বর্তমানই সত্য, বর্তমানেই সব। আর পেছনে যে অতীত, সমুখে যে ভবিষ্যৎ দুইই কোনদিন ছিল না, থাকবে না।

তাই তীব্র করে সে অনুভব করতে পারছিল বর্তমানের প্রতিটি তরঙ্গ।

নূরুন্নাহার অনেকক্ষণ জেগে থেকে থেকে এককোণে চুলতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ঘুম নেই জরিনার চোখে। যেন ঘুম বলে কোনদিন কিছু তার জানা ছিল না।

একটা করে স্টেশন আসে আর মৃদু গুঞ্জন ওঠে ট্রেনে ওঠে আরো নতুন যাত্রী। জায়গা নেই, তাতে কী!

একটা রাতের মত ট্রেনের কষ্ট সইতে পারেন না আপনারা?–জানালা দিয়ে গলা ঢুকিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা অনুনয় করে। আপনাদেরই মা বোন যাচ্ছেন, আপনারা একটু কষ্ট করুন, পাকিস্তান আসবার আর বাকি নেই।

আর বাকি নেই? আর কত দূর?

আবার ট্রেন চলতে থাকে।

তখন রাত দুপুর। কী একটা স্টেশনে গাড়ি থেমেছে। কচি একটা বউ উঠলো তাদের কামরায়– ভীত, সন্ত্রস্ত। সঙ্গে তার ততোধিক ভীত, সন্ত্রস্ত স্বামী। আর একজন বুড়ি–মা হবেন হয়তো।

স্বামীটি নেমে গেল। বুড়ি বসে পড়ল মেঝেয়। আর বউটা ডাগর চোখ মেলে ভয়ে ভয়ে তাকালো। তখন জরিনার চোখ পড়ল তার দিকে। কী সুন্দর তার চোখ; মনে হলো জরিনার, অমন একজোড়া চোখ থাকলে কিছু দরকার নেই আর। শুধু চোখ দিয়েই দেয়া যায়, নেয়া যায়, ভরে ওঠা যায়।

নিজের মুখের জন্য আপশোষের অন্ত ছিল না জরিনার। বসে বসে খুঁত বের করা ছিল তার কৈশোরের একটা সময় কাটানোর উপায়। মনে মনে গাল দিত খোদাকে, যিনি তাকে নিখুঁত চেহারা দেন নি, যিনি কপালটাকে অহেতুক চওড়া করে দিয়েছেন, চোখ যথেষ্ট টানা করে। দেন নি, আর চিবুকের নিচে যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে না দিয়েই শেষ করে দিয়েছেন, তাই সুন্দর মুখ চোখে পড়লে, জরিনা চিরকাল তার জন্য বুকের ভেতরে টান অনুভব করেছে।

জরিনা বউটিকে ডেকে নিল কাছে। বসবার জায়গা নেই। কোলের কাছে বসালো তাকে। নিজের অসুবিধে হলো, কিন্তু ভালো লাগল। শুধালো, পাকিস্তান যাবেন?

বউটা তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাৎ করলো। মুখে কিছু বলল না। তারপর বউটা জানালার ওপর মুখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

গাড়ি ছেড়ে দিল। গতি কেবল এসেছে কী আসে নি, প্লাটফরম তখনো পেরিয়ে যায়নি, আজো স্পষ্ট মনে আছে জরিনার তখন বাইরে অন্ধকারের ভেতর এক ঝলক উষ্ণ তরল কী এসে ছিটকে পড়ল তাদেরই কামরায় তারই জানালা দিয়ে। বউটার চোখে মুখে জরিনার পিঠে এসে পড়েছে। চমকে জরিনা তাকিয়েছে জানালার দিকে। আর বউটা আকস্মিক রকমে চিৎকার করে উঠেছে যন্ত্রণায়, আর্তনাদে খানখান করে ফেলেছে দুধারের বয়ে যাওয়া। হুহু বাতাস।

ইস্, সে কী বীভৎস দৃশ্য! আজো মনে করলে জরিনার হাড় বরফ হয়ে আসে। কয়েক মুহূর্ত কী করে কেটেছে কিছু মনে নেই তার।

পরের ছবিটা যা মনে পড়ে তা হচ্ছে জরিনা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আর বউটা দুহাতে দুচোখ ধরে কাটা মুরগির মতো দাপাচ্ছে মেঝেয়। তার চিৎকারে বধির হয়ে আসছে কান। সেই বুড়িটা ছুটে এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠেছে কোলের বাচ্চারা। বড়রা বিস্ফারিত চোখে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। নূরুন্নাহার উঠে দাঁড়িয়েছে।

চুনের গরম পানি ছুঁড়ে মেরেছিল ওরা। এক পলক দেখেছিল জরিনা তিন চারটে নারকী মূর্তি প্লাটফরমে দাঁড়ানো।

বউটা তার ডাগর দুচোখে কোনদিন আর কিছু দেখতে পাবে না। তার স্বামী এসে দেখবে, তার বউ অন্ধ হয়ে গেছে।

চেন টানো, গাড়ি থামাও। সবাই বলেছিল।

পুলিশ ডাকো। আরেকজন বলেছিল।

আর বউটা তখনো চিৎকার করছে।

জরিনা বলেছিল, না, গাড়ি থামবে না। তারপর বউটাকে দুহাতে সোজা করে বসিয়ে বলেছে, আপনারা কেউ পানি আনুন।

পানি এলে পরে ধীরে ধীরে তার মুখ চোখ ধুইয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ শান্ত ছিল কী করে সে? কোথা থেকে সে পেয়েছিল এই শক্তি? নূরুন্নাহার, তার মায়ের পেটের বোন, সে পর্যন্ত বিহ্বল; আর সবাই তো এই কেবল সংসার ছেড়ে পৃথিবীতে বেরিয়েছে তারা তো ভয় পাবেই।

তার গা কাটা দিয়ে উঠেছিল তখন। সারাটা পথ সে আগলে বসেছিল বউটাকে।

আজো চুপ করে বসে থাকলে একেক সময় শ্রুতির ভেতরে সেই বউটার বুক ফাটানো যন্ত্রণার কান্না তাকে দোজখে নিয়ে যায়।

আলীচাচার কথা সেদিন মিথ্যে বলে মনে হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল এ পৃথিবীতে স্বর্গ হবে না, যে স্বর্গের কথা আবাল্য তাকে শিখিয়েছে আলীচাচা।

অনেকদিন পরে আলীজাহ্‌কে এই ঘটনাটা লিখেছিল জরিনা; আলীজাহ্ তখন লাহোরে। উত্তরে আলীজাহ্‌ লিখেছিল–তুই একটা বোকা, জরিনা। এ নিয়ে মন খারাপ করবার কী আছে? মানুষ তো পশুই–তাই বলে যারা স্বর্গ সৃষ্টি করতে চায় তারা সে পশুত্বকে দেখে ভয় পাবে কেন? তোর ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। তুই তখন ট্রেন থামাতে বাধা দিয়েছিলি কেন? বাধা দিয়েছিলি এইজন্যে যে, তাহলে পশুদের হাতে নিজেকে তুলে দিতে হতো। একজন যখন পুলিশ ডাকবার পরামর্শ দিয়েছিল, তুই মনে মনে তখন নিশ্চয়ই হেসেছিলি, আমি কল্পনা করতে পারছি। কেননা কী হবে শক্তি ডেকে? শক্তি চিরকালই দুর্বল। শক্তি দিয়ে পৃথিবীর বিহিত করা গেলে, মানুষ আত্মার সাধনা না করে কাঁচা শক্তির সাধনা করত যে।

যে মানুষগুলো চুনের পানি ছুঁড়ে মেরেছিল, ওদের আসনে বসিয়ে বিগ্রহ ছুঁইয়ে সত্যি কথা বলতে বল– দেখবি ওরা যা করেছে তাতে অন্তরের সায় ছিল না। তবে কেন করেছে? কেননা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই অন্তরের সায় না নিয়েই কাজ করে। যদি মানুষ একবার ভাবতে পারত তার অন্তরকে কী স্পর্শ করছে, আর কী করছে না, যদি মানুষ সেই ভাবে বাঁচতে পারত, তাহলে এত অন্যায় অসঙ্গতি সব ইতিহাসের পাতাতেই বন্দি থাকত, বর্তমানে এসে বর্ধিত হতো না, ভিড় জমাতো না।

বউটার চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়াকে আমি প্রতীক হিসেবে নিলাম। তুইও তাই নে। মনে কর, দীপ্তি থাকে না বলেই তো দীপ্তির সন্ধান চলছে আমাদের।

আজ এই বৃষ্টির মুহূর্তে নতুন করে তার মনে হলো, আমি তো আলো আমার মুখে নেবার সাধনা করে চলেছি, আমি কেন কাঁদবো? মানুষের নিচতা দেখে হাত–পা সেঁদিয়ে আসবে কেন আমার?

মনে মনে এত মনে পড়ছিল আলীজাহ্‌ কথা। তাই বাবার মুখে আলীজাহ্‌ আসবার খবর পেয়ে সে কী উল্লাস হলো তার। সে সান্ত্বনার হাত যে এমনি অপ্রত্যাশিত এগিয়ে আসবে তা কে ভাবতে পেরেছিল? দুপুর থেকে তো, এই কথাই ভাবছিল সে–আজ যদি আলীচাচা থাকত ঢাকায়।

ভাববার কারণ ছিল বৈকি?

জরিনা উঠে কাপড় বদলালো, চুল বাঁধলো দ্রুত দুহাত। তারপর বাইরে বেরুবার জন্য চটি পরল যে চটি বৃষ্টি ভেজা রাস্তা থেকে কাদা তুলে মাখিয়ে দেবে না।

তাকে বেরুতে দেখে অবাক হলেন শাহ সাদেক আলী।

রোকসানা বলল, ওকে গিয়ে বলেছিলেন কী? রাগ করে বেরিয়ে গেল নাতো।

রোকসানার ভয় হলো বুঝি সাদেক তাকে গিয়ে বলেছে রেডিওগ্রামের ভল্যুম কমাতে তারই নাম করে। নইলে জরিনা একবারও তাকাল না কেন ফিরে?

সাদেক মৃদু হেসে বললেন, ঐ বয়সে আমরাও অমন করতাম না কি? আমি অত অবুঝ নই যে গিয়ে তোমার নাম করবো।–আমাকে আর একটু চা দাও।

বলতে বলতে সাদেক টেনে নিলেন সদ্য লেখা বিবৃতিটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন। চোখের সমুখে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ বসে আছে এবং মানুষটা যে তাঁরই স্ত্রী একথা যেন তিনি সম্পূর্ণ বিস্মিত হয়ে গেছেন।

রোকসানা তাঁর কাপে চা ঢেলে দিয়ে পেয়ালাটাকে সমুখে রেখে তখন উঠে গেলো। উঠে গিয়ে শোবার ঘরে বসলো। বসে বসে ভাবতে লাগল নতুন বাড়ির কথা। তার সারা জীবনের স্বপ্ন নিজের একটা বাড়ি। বাড়িটা শেষ অবধি হলো তাহলে। আর কদিন পরে। যখন তারা গিয়ে উঠবে তখন–সেই তখনের স্বপ্ন লাগল রোকসানার চোখে মুখে।

পথে তো বেরুলো, কিন্তু যাবে কোথায়? বৃষ্টির পর সারাটা পথ কেমন বিশ্রী হয়ে আছে। কিন্তু আকাশ দেখাচ্ছে অপরূপ — ধোওয়া ধোওয়া, স্বচ্ছ, ভালো। আকাশে অমন সুন্দর রঙটা যেন খোদা এইমাত্র সৃষ্টি করলেন– এমনটি কোনদিন ছিল না, কোনদিন আর আসবে না।

হাসলো জরিনা, মনে মনে। পথটাকে পায়ের নিচে খুব কাছে করে দেখতে পারছি বলেই বিশ্রীটুকু চোখে পড়ছে। আর আকাশটা অনেক দূরে বলে তার ভালোটুকুই চোখে লেগেছে। যদি আকাশে গিয়ে দৃষ্টি করতে পারা যেত এই পথটাকে তাহলে ভালো লাগত তখন –মনে হতো, রেশমি ফিতের মতো পথটা পড়ে আছে শহরের ভেতরে।

মাসুদের আজকের ব্যবহারটা যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি নিষ্ঠুর। নিজের ওপর আক্রোশ হতে থাকে জরিনার–কেন একটা মানুষের ওপর এত নির্ভর সে করতে গিয়েছিল? এতটা নির্ভর করেছিল বলেই তো আজ পতন এত বিষম হয়ে বেজে উঠেছে।

কতকাল আগের কথা সব। এত আগের যে আরেক জনের, আরেক জীবনের গল্প বলে সব মনে হচ্ছে।

.

কর্ণফুলীর পাড়ে তখন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ক হচ্ছে, নদী বাঁধ দেয়া হচ্ছে, রাস্তা হচ্ছে। কাগজ তৈরির কারখানা। কাজ চলছে দিনরাত। ডাইনামো আর অন্যান্য যন্ত্রের অবিরাম কানে তালা লাগানো। শব্দে নিথর নীরব অরণ্য, নদী মুখরিত, শিহরিত।

নূরুন্নাহার আর হামিদুর রহমানের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল জরিনা। আসলে ছুটিতে এসেছিল চাটগা। দুলাভাই বললেন, চলে। কোথাও পিকনিক করে আসি।

প্রস্তাবটা ভালো লেগেছিল জরিনার। যেখানে কিছুই ছিল না, সেখানে রক্ত মাংসের মানুষ পৃথিবীর এবং পৃথিবী ছাড়িয়ে যা কিছু সবার তুলনায় ছোট, অত্যন্ত ছোট একটা প্রাণস্পন্দিত পদার্থ– কী করে জনপদ গড়ে তোলে তা ভেবে রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়েছিল তার মন। এইতো মানুষের স্বাক্ষর। মানুষ আছে বলেই তো জগৎ আছে। যদি মানুষ না থাকতো তাহলে কি জগৎ থাকতো? তাই সে রাজ্য গড়ে, দালান ওঠায়, পিরামিড বানায়, গান লেখে। প্রকৃতি যে আজ পৃথিবী দিয়েছে মানুষ তার চেহারা বদলাতে পারে নিজের জন্য, নিজের হাতে–আর কিছু সে নাইবা বদলাতে পারল। আদি সৃষ্টিশক্তি থেকে জাত মানুষ পৃথিবীতে এসেই প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে তার উৎসেরই, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজই তো জীবন।

জরিনা অবাক হয়ে গিয়েছিল এসে। পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার মনে হচ্ছিল–এ আমি। নিজের দেহ যেন মাটি হয়ে আছে এখানকার, রক্ত যেন ঐ নদী। সকাল থেকে দুপুর, তারপর এক লহমা জিরিয়েই আবার বেরিয়ে সন্ধ্যা অবধি সে ঘুরে ঘুরে দেখেছে। কাজ চলেছে অবিরাম। সেই কাজের প্রতিভা যেন রৌদ্র হয়ে দিনমান জ্বলছে পৃথিবীতে! ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল জরিনার। অকারণ, বাধন না মানা, বুঝতে না পারা আনন্দ –যে আনন্দ শুধু আনন্দেই বাঁধা থাকে না, অব্যক্ত বেদনা হয়ে গলার কাছে, বুকের ভেতরে সারাটা শরীরের ভেতরে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

রাতে বসে বসে এক শিট কাগজ চেয়ে নিয়ে এইসব কথা লেখা চলছিল নামহীন কোনো পাঠকের জন্য। যদি উৎসাহ থাকে, তাহলে ঢাকা ফিরে গিয়ে আলীজাহ্‌কে পাঠানো যাবে। আর যদি ভুলে যায়, তাহলে জরিনার আরো অনেক লেখার মতো এটাও অযত্নে কোথাও পড়ে থেকে থেকে বিবর্ণ হয়ে যাবে একদিন।

এটা তার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে; এই, নিজের মনে যে তরঙ্গ উঠল তা না লিখে কিছুতেই স্বস্তি না পাওয়া; বিচার করে, বিশ্লেষণ করে, সব তল থেকে দেখে দেখে একটা ভাবাকে লিখবে, তবেই স্বস্তি। লিতে লিখতে শাসন থাকে না আর নিজের ওপর। বেদনা আর আনন্দ বা ঘৃণা, তা সে যে অনুভবই হোক না কেন, যতক্ষণ না নিঃশেষে শেষ বিন্দুটিও নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে শাদা কাগজে ততক্ষণ ভার য়ে থাক মাথাটা। মাঝে মাঝে বকুনি দিয়ে আলীজাহ্ চিঠি লেখে. যাহ, তোর কিছু হবে, এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছিস তুই দিন দিন। আমি তোকে শাস্তি দেব ভাবছি। খুব কড়া একটা শাসন।

তখন উত্তরে জরিনা লেখে –শাসন করতে হবে না তোমার। তোমার কাছে লিখি বলেই কি মনে কর সবার সঙ্গে সব কিছুতেই ফিনিক দিয়ে আমার সেন্টিমেন্ট ছুটেছে? তুমি বুঝি জানো না আলী চাচা, সেন্টিমেন্ট থাকবেই, আর ওকে বের করে দেয়ার জন্য কিছু না কিছু করা চাই। সেবার তুমি আমার একগাদা লেখা খে হো হো করে হেসেছিলে। ওগুলো যে আমার কী উপকার করেছে তা যদি তুমি জানতে? আমার মনের ময়লা ধরে রেখেছে ওরা। তাইতো এত মায়া লাগে, না পারি ছিঁড়ে ফেলতে, না পারি প্রকাশ করতে। ভালো কথা, তুমি বলেছিলে না আমি সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছি? দোহাই তোমার একবার ঢাকায় এসে এই কথাটা ছেলেগুলোকে জানিয়ে দাও দিকি। ওরা আমাকে যেন চিড়িয়াখানার জন্তু পেয়েছে। বলে কিনা– পাথর মেয়ে। ইশারা করলে নাচি না, ইনিয়ে বিনিয়ে চলতে পারি না, কথায় কথায় নিজের নারীত্বকে জাহির করি না–যা আর দশটা মেয়ে করে থাকে, এই হচ্ছে আমার অপরাধ। ভাবি, এমন নারীত্ব–বর্জিত মেয়েকে নিয়ে তোমাদের এই সমাজ চলবে কী করে? নাকি চিরকাল আমাকে তোমাদের অঙ্গনের বাইরেই থাকতে হবে?

আলীজাহ্ তখন লেখে– কোন অঙ্গনের কথা বলছিস, রিনু? ওখানে যে তোকে যেতে হবে না, ওরা যে তোকে ডেকে নেবে– এটা কত বড় সৌভাগ্য তোর, তা আরো বড় হলে বুঝতে পারবি। যাসনে কারুর কাছে। একেকটা মানুষ থাকে অমনি। জন্ম থেকে একা–একেলা। তাদের সঙ্গে কারুর মিল হয় না।

.

ওরা এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিল। দুলাভাইয়ের বন্ধু স্থানীয় স্কুলের হেড মাস্টার। দুলাভাই এসে বললেন, কী লেখা চলছে এত? এখানে এসেও মাথা কিলবিল করছে বুঝি?

হ্যাঁ করছে। কপট ক্রোধে জরিনা বলে, করছে না? একটু পরেই উঠে গিয়ে ক্যানাস্তারা বাজাবো ভাবছি। কেমন হয় বলো তো?

বাহ চমৎকার। গ্রাণ্ড আইডিয়া।

পরদিন দুপুরের কথা। ওলটানো মাটি রোদে তেতে রুখু হয়ে আছে। ভারী চাকায় গুড়ো হয়ে ধুলো হয়েছে খুব। একটু বাতাস পেলেই ঝড়ের মতো উড়তে থাকে।

জরিনা, নূরুন্নাহার, দুলাভাই আর হেড মাস্টার ভদ্রলোকটি বেরিয়েছেন দেখতে। তারা যখন হ্যাঁ করে একটা বিরাট বরগা ওঠানোর রোমাঞ্চ অনুভব করছিলেন তখন জরিনা আপনমনে। এদিক ওদিক দেখতে সরে এসেছে অনেক দূর।

আবার সেই বেদনার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আনন্দ আসছে।

হঠাৎ কৌতূহলী চোখ পড়ে একটা মানুষের ওপর। শার্ট, ট্রাউজার পরা ধবধবে, কড়া ইস্ত্রি করা, চোখে চশমা। ধুলোর ওপর চার হাত পায়ে উবু হয়ে কী যেন দেখছে।

কাছে গিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে, আঁকিবুকি কাটা বিরাট একটা কাগজের ওপর পেন্সিলের ডগা দিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে ভদ্রলোক আপন মনে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার পায়ের ধাক্কায় মিহি এক পশলা ধুলো বৃষ্টি হয়ে গেল সেই নকশার ওপর, তাতে হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হলো জরিনা, কিন্তু লোকটার তা নজরেই পড়ল না। জরিনা ভাবলো সরে যায় সেখান থকে। ছি, ছি, কী বিশ্রী ব্যাপার। পায়ের ধুলো মাখিয়ে দিল তার কাজের কাগজে!

কিন্তু তার আগেই লোকটা বলল ঠিক তেমনি আত্মসমাহিত ভাবে নকশার দিকে চোখ রেখে খুঁজতে খুঁজতে, দাঁড়ান, দাঁড়ান একটু।

জরিনা অবাক হলো। কী বলছেন তিনি!

একটু পরে লোকটার পেন্সিল একটা রেখা ধরে নেমে এসে থেমে গেল দ্রুত। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ। ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ তুলতে তুলতে বলল, এতক্ষণে বুঝেছি এটা যাবে এদিকে দিয়ে আপনি!

জরিনার দিকে চোখ পড়তেই আমতা আমতা করে থেমে গেল সে। তারপর উঠে দাঁড়াল দুহাত ঝাড়তে ঝাড়তে। বলল, মাফ করবেন। বুঝতে পারিনি। কন্ট্রাকশনের লোক মনে করেছিলাম। বেড়াতে এসেছেন বুঝি?

হ্যাঁ।

আমরা গড়ি, আপনারা দেখেন। গড়বার বিনিময়ে এটাও একটা পাওনা। ফাউ বলতে পারেন। লোকটা হাসে। বলে, এইতো দেখুন না, গড়ে চলেছি আমরা। শেষ হলে কোথায় যাবো, আবার কী গড়তে হবে কিছুই জানি না। দশ বছর বাদে এখানে এলে, আমাদের কেউ চিনতেই পারবে না, জানবেও না।

জরিনার ভালো লাগল লোকটার কথার ধরন। আর তার কণ্ঠ কী মুক্ত–খোলা আকাশের নিচে, এলোপাথারি ছড়ানো মানুষ আর যন্ত্রপাতির ভিড়ে এমন কণ্ঠই যেন মানায়। বল, আপনি নিজের দিকটা বড্ড বেশি করে দেখেন, তাই না?

কী জানি। কোনকালে তো নিজের দিকে তাকিয়ে দেখিনি। আপনি বলবার পর মনে হচ্ছে হয়ত হতেও পারে।

আপনি এঞ্জিনিয়ার?

নাহ। সলজ্জ হেসে বলেছিল লোকটা, ফিল্মে কাজ করি, ব্যাস।

পরে অবশ্যি জেনেছিল যে মাসুদ শুধু এঞ্জিনিয়ারই নয়, আমেরিকা থেকে একটা বড় ডিগ্রিও এনেছে।

সেদিন মাসুদ তাকে সমস্ত এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।

আসবার সময় মনে হয়েছিল জরিনার, আসাটা খুব সহজ হচ্ছে না। মাসুদও কেমন বিব্রত বোধ করছিলো তখন। বলেছিল, কদিন থাকবেন?

কাল পরশু, ঠিক নেই।

আপনাদের এখানে ভালো না লাগারই কথা। কী আছে এখানে? বলে অসহায় চোখে তাকিয়েছিল মাসুদ, আর দুহাতের আঙ্গুলগুলো সবল একজোড়ে গ্রিপের মতো নাড়ছিল। ভাবটা যেন এমন কিছু এখনি বানিয়ে ফেলা যায় না, যা জরিনাকে আর কটা দিন এখানে ধরে রাখতে পারবে?

জরিনা যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। তাই সে বলেছিল, আপনারা হলেন এ কালের আলাদিন। আমরা আলাদিনদের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্যে এখনো এক পায়ে খাড়া। ভালো লাগবে না কেন? বেশ লাগছে? ঢাকা যেতে হবে কিনা, তাই যাচ্ছি।

মাসুদ তখন বলেছিল, দেখলেন তো, একটু আগে বলছিলাম না, আমাদের কথা কেউ মনেও রাখে না। নইলে আমার মতো কম কারখানা গড়া মানুষ এসেছে পৃথিবীতে? অথচ একজনের নামও জানেন না। আলাদিন বলেই বুঝিয়ে দিলেন। বড় ভালো লাগলো আপনাকে দেখিয়ে শুনিয়ে। তৃপ্তি পেলাম সত্যি। নির্লজ্জের মত শোনাচ্ছে হয়ত।

না, একটুও না।

তাহলে আরো একট নির্লজ্জ হতে বাধা নেই, কী এলেন? আসুন, আমার লাঞ্চ শেয়ার করি। কেমন?

থাক, থাক। লোভ দেখাতে নেই।

কীসের লোভ?

বিস্ময়ে, বোধহয় কিছুটা ভয়ে, মাসুদ শুধিয়েছিল।

মুখ গোল করে জরিনা উত্তর দিয়েছিল, খা–বা–র।

ওহো। তবু ভালো। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।

হেসে উঠলো জরিনা। বলল, তারচে এক কাজ করুন। সন্ধ্যের সময় দ্র হয়ে আসুন, মানে ধুলো কালি মুছে, হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে। আজ রাতটা আমাদের সঙ্গেই খাবেন। নিজে কিছু গড়ার সামর্থ নেই, ইচ্ছে–এতদিনে ইচ্ছেটাও বোধহয় মরে গেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলে দেখি সেটাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় কি না।

সেদিন সন্ধ্যের সময় সত্যি সত্যি মাসুদ ধুলোকালি ঝেড়ে ফিনফিনে পাঞ্জাবি চাপিয়ে এসেছিল। ভীষণ সৌখিন কিন্তু কোথাও বাড়াবাড়ি নেই –দেখে এমনি একটা মন্তব্য করা চলে।

এসেই বলেছে, আপনার কথামতো নিজেকে যথাসম্ভব ভদ্রলোক করে হাজির করলাম। এখন বলুন, কত নম্বর দিলেন ফুলমার্কের ভেতর?

ফেল! ডাহা ফেল করেছেন।

জরিনা তাকে নিয়ে বসালো ওধারের প্রশস্ত বারান্দায়, যেখানে দূরের কনস্ট্রাকশন ক্যাম্পগুলো চোখে পড়ে। সন্ধ্যে হয়েছে। বিন্দু বিন্দু আলোয় নতুন বউয়ের চন্দন চৰ্চিত মুখশ্রীর মতো হয়ে উঠেছে আকাশ মাটি মেলানো অন্ধকার। সেদিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলো মাসুদ।

কী ভাবছেন?

সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া জরিনার মুখের দিকে তাকিয়ে মাসুদ ম্লান হাসলো। বলল, না কিছু না।

ভাবছেন না? কেন মিথ্যে কথা বলছেন?

খুব অস্পষ্ট, প্রায় শোনা যায় না, এমনি করে তখন মাসুদ উত্তর করল, মানুষ চুপ করে থাকে ভাবনা কিছু না থাকলেও। আমাকে খুব কি ভাবিত দেখাচ্ছিল?

হ্যাঁ ভাবছিলেন। হয়ত ভাবছিলেন, গড়ে ওঠার পর যে চেহারা হবে এই মাটির, তাই।

খুব সম্ভব, তাই। একেকদিন রাতে স্বপ্নেও দেখি। দেখি– লক্ষ লক্ষ মানুষের বসতিতে আলো হয়ে উঠেছে কর্ণফুলীর দুই তীর। বলছিলেন না গড়ার ইচ্ছে আপনারও, কিন্তু সামর্থ নেই। কী গড়তে চেয়েছিলেন?

জরিনা ঘাড় কাৎ করে আনমনে টেবিলে পানির গ্লাশটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে ভাবল খানিক। ততক্ষণ মাসুদ নিবিড় একমুঠো অধীরতা হয়ে অপেক্ষা করল তার উত্তরের জন্য। কিছুক্ষণ পরে ভাবনা রেখে জরিনা বলল, না কিছুই না। কিছু মনে করতে পারছি না।

সে কেমন কথা? নিজেই জানেন না?

না। নাতো। ভেবে দেখিনি। তারপরে হঠাৎ জোর পেয়ে গেল যেন সে, বলল, ইচ্ছেটাই বা কজনের থাকে?

সত্যি কথা। আমি নিজে, জানেন, বড় ইন্সপায়ার্ড মানুষ। মা বলেন, এটা আমার একটা ম্যানিয়া। আমি তো বলি–ইচ্ছেটাই নেই এখন আমাদের। নইলে প্রতিভা আছে, বুদ্ধি আছে, হাত আছে, চোখ আছে, কাদামাটি আছে, অথচ মূর্তি গড়তে পারি না কেন? বদলে কাদামাটি দিয়ে কেবল ছোঁড়াছুড়ি করি।

কথাটা ভাল লাগল জরিনার। কোনো আত্মম্ভরিতা নেই, চটক নেই, প্যাঁচ নেই– একেবারে অন্তর থেকে উঠে এসেছে যেন। কতদিন সে এমন মানুষ দেখেনি যে ঠোঁট দিয়ে কথা বলে না, অন্তর দিয়ে বলে।

কোথায় যেন বাবার সঙ্গে, আলীজাহ্‌ সঙ্গে মিল আছে মাসুদের। জরিনার এটা আরেকটা স্বভাব–পৃথিবীর সব মানুষকে সে যেন সহজ দুটো ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। বাবা ও আলীজাহ্‌ মতো কিংবা বাবা ও আলীজাহ্‌ মতো নয়। আলীজাহ্ বলতো–তোর নিজের মতো কাউকে খুঁজে নে। বলতো–অবশ্যি খুঁজে পেলেই যে তুই বেঁচে গেলি তা নয়; একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কিছু করতে পারে না, তা সে যতই মিল থাক; শুধু সহানুভূতি দিতে পারে–তা সেটাই বা কম কীসে?

জরিনার মনে হলো এই মানুষটার সহানুভূতি যেন সে আশা করতে পারে। খুব স্পষ্ট করে মনে হওয়া নয় এটা। কেবল একটা ইশারা মাত্র।

মাসুদ একটু পর বলল, গড়তে আপনিও জানেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।

কী?

কেন, এই যে সন্ধ্যেটা। এমন সন্ধে। তো জীবনে প্রত্যেকটা দিনই হচ্ছে। কিন্তু আজকের সন্ধ্যেটার বিশেষত্ব আছে। এটা আপনার হাতে গড়া।

একটুও না। কী এমন?

এমনটি কোনদিন ছিল না, কোনদিন হবেও না। তাছাড়া আরো আছে।

আর কী?

জরিনার মৃদু হাসিটা এবারে কেমন বিব্রত দেখালো। তখন মাসুদ ইশারা করলো টেবিলে রাখা বাতিগুলোর দিকে।

এগুলো।

ওহ্। এতো ছেলেখেলা। কাজ ছিল না তাই।

তা বাতিগুলো যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করত বৈকি। বারান্দায় গোটা তিনেক ব্রাউন কাগজের ঠোঙ্গা পড়েছিল। জরিনা সেগুলো তুলে নিয়ে তলা সমান করে বসিয়েছে– ভেতরে ইঞ্চি খানেক ভরে দিয়েছে শুকনো মাটি দিয়ে আর মুড়ে দিয়েছে রিবনের মতো করে খোলা মুখের চারধার। তারপর সেই মাটিতে মোম জ্বালিয়ে বসিয়ে দিয়েছে।

সেই বাতি একটা ছিল টেবিলে; আর দুটো বারান্দার রেলিংয়ে। অনেকটা আকাশ–প্রদীপের মতো হয়েছে দেখতে। স্পষ্ট কোনো আলো হচ্ছে না, তীক্ষ্ণ কোনো ছায়া পড়েনি। যেন এককোণে একটি স্বর্গ সৃষ্টি হয়েছে।

এটা কোনো পরিকল্পনা করে করা নয়। মনে হয়েছে, তাই করেছে। কিন্তু মাসুদ সেটা উল্লেখ করবার পর তার মনে হলো –ও ভাবছে আমি ইচ্ছে করে করেছি। ওর জন্য করেছি।

নিজের ওপরে নিজেই মনে মনে চটে গেল জরিনা। যদি করেই থাকি তাতে কিইবা এমন ক্ষতি হয়েছে। একটা মানুষকে স্বাগতম জানানোর জন্য একটু কিছু করাটা কি অপরাধ?

মাসুদ তখন বলছে, বলছিলেন এগুলো ছেলে–খেলা। খেলাচ্ছলে আর কী করেন আপনি?

জরিনা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল তাকে। প্রশ্নটার গভীরতা আন্দাজ করবার চেষ্টা করল।

পরে বলল, না, সব বানিয়ে বলেছি। খেলার জন্যে কিছুই করি না আমি। যা ভালো লাগে তা–ই করি। তা নিয়ে ঠাট্টা করছেন কেন?

কই নাতো। ঠাট্টা করিনি তো। আমি ইট কাঠ পাথর লোহা ছাড়া আর কিছু দিয়ে গড়তে জানি না। যারা জানে তাদের হিংসে করি মনে মনে।

তাহলে হিংসে হচ্ছে বলুন।

মাথা দুলিয়ে মাসুদ উত্তর করলে, হ্যাঁ তা বলতে পারেন বৈকি।

গড়তে পারেন, ভাঙতে পারেন না?

জরিনা হঠাৎ শুধোল। শুধিয়ে গভীর দুচোখে প্রায় অন্ধকার মাসুদের দিকে তাকিয়ে থাকল। মাসুদ চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। বিস্মিত হল। অপরূপ মন হল তার মুখটাকে। পৃথিবীর অনন্ত জলতল ভেদ করে বিশাল একটা ঝিনুকের মতো জরিনার মুখ উঠে এসেছে যেন।

না পারি না। কখনো পারি না।

আমি পারি। দেখবেন।

ফুঁ দিয়ে বাতিগুলো নিভিয়ে দিল জরিনা। তলিয়ে গেল অন্ধকারে। কোথা থেকে ঝিল্লির মতো মিহি একটা আলো তখন ফুটে উঠল তাদের দুজনকে ঘিরে। সেই আলোতে মুখ দেখা চলল না। অনুভব করা গেল।

.

তারপর থেকে এমন হলো, ঢাকা এলেই মাসুদ একবার দেখা করতই জরিনার সঙ্গে।

সেই দেখাটা আস্তে আস্তে ভালবাসার রূপ নিল মাসুদের মনে। আর জরিনা? জরিনা বুঝতে পারত না তার ভেতরে কী হচ্ছে। যা হচ্ছে তার নামই কি ভালোবাসা? এই ভালোবাসার কথাই কি এতদিন বলে এসেছে সবাই বই লিখে, গান গেযে, ছবি এঁকে? এই কি সেই ভালোবাসা যা নূরুন্নাহার অনেকদিন আগে বানান করে শিখিয়েছিল তাকে?

না, না। প্রথম প্রথম জরিনা ভেবেছে–এ হচ্ছে সহানুভূতি, এ হচ্ছে–। আর কোন নাম মনে আসতো না তার। তখন বিব্রত লাগত নিজেকে। তখন কাগজ টেনে পাগলের মতো আবোল তাবোল লিখত আলীজাহ্‌কে। লিখত–তুমি বলোত, এই ব্যাপারটাই কি ভালোবাসা?

আলীজাহ্ খুব স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেনি তার। লিখেছে– ভালোবাসা কি ঐ মেডিক্যাল কলেজে উপুড় করে শোয়ানো কালো হয়ে যাওয়া পিন করে রাখা মরা মানুষের শরীর যে ছুরি কাঁটা দিয়ে কাটা ছেঁড়া করলেই গট গট করে সব বলে দেয়া যাবে?

তা এই অনুভূতির নাম যা কিছুই হোক, মাসুদকে আমার যেমন করে ভালো লাগে, নিজের মনে করতে ইচ্ছে হয়, তেমন আর কাউকে লাগে না, হয় না–জরিনা ভেবেছে। যদি এটাই ভালোবাসা হয় তো, হোক।

ঠিক বাইরের একটা মানুষকে এমনি করে কোনদিন আর নিজের মনে করতে ইচ্ছে করেনি তার। মাসুদ চাটগাঁয়ে থাকবে, কিন্তু সে কেমন থাকবে না থাকবে তা জানবার অধিকার যেন জরিনার আছে। এই ভাবনাটা এত প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল অল্প কিছুদিনের মধ্যে যে, হপ্তায় একটা চিঠি না পেলে ভীষণ রাগ হতো। সেজন্য তক্ষুণি বকাবকি করে লিখতে বসতে না বটে, কিন্তু পরে কখনো উত্তর দিতে বসে কিছুটা ঝাঁজ ছড়াতে কার্পণ্য করতে না। এদিকে ফি হপ্তায় মাসুদের চিঠি চাইই আর নিজে লিখবার বেলায় মাসে দুমাসে একখানা– তাও খুব বেশি হলে আট থেকে বারো লাইন।

মাসুদ ঢাকায় এসে অনুযোগ করলে জরিনা উত্তর করতো, কেন, অনেক তো লিখি। আর কিছু আছে নাকি লেখার?

কথাটা সত্যি নয়। লিখতো সে –অনেক কিছুই লিখতো, যদি না তার জানা থাকত মাসুদ তাকে ভালোবাসে, আর যদি না নিজের ভেতরেও যা হচ্ছে তা ভালোবাসা বলে সন্দেহ করা হত। এই সত্য আর সন্দেহটাই তাকে যেন বারণ করে বেশি লিখতে, বারবার লিখতে। নইলে যে রাশি রাশি কাগজ তার মনের আকুলি বিকুলি নিয়ে কালিমাময় হয়ে ওঠে তা থেকে একমুঠো তুলে পার্সেল করে পাঠাতেও তার এতটুকু দ্বিধা হবার কথা নয়।

এমনি করেই চলছিল। একদিন কে একজন বলল, কিরে তুই নাকি প্রেম করছিস খুব?

কী করছি!

আর্তনাদের মত শোনালো জরিনার কণ্ঠ।

আহা, প্রেম। ওতো সবাই করে। তুই বাইরে ঠাট্টা করিস সবাইকে আর ডুবে ডুবে এত?

মিথ্যে কথা, বাজে কথা। যে বলেছে সে ইতর।

.

এ ঘটনাকে ভুলেই যেত হয়ত। কিন্তু একদিন জরিনা শুনতে পেল, সে নাকি মাসুদকে বিয়ে করবার জন্যে খেপে উঠেছে, মাসুদই তাকে আমল দিচ্ছে না; তবু কি জরিনা ছাড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কৈশোর পেরুনো বাচাল একটা ছেলে বা মেয়ের কাছ থেকে শুনলে হয়ত উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু যে বলেছে সে রীতিমত প্রৌঢ় এবং দুলাভাই হামিদুর রহমানের বেশ অন্তরঙ্গ মানুষ। কথাটা দুলাভাই মারফৎ শোনা।

সেদিন রাতে সে ভাবতে বসলে কী করে এই কথাটা ছড়িয়ে পড়ল এমনি করে?

ভালোবাসা সম্পর্কে তো নিজেই এখনো সন্দিহান, এখনি বিয়ের কথা উঠল?

ইতিমধ্যে মাসুদের একটা চিঠি এলো। তাতে সে লিখেছে–জানি না, তোমার কানে উঠেছে কিনা, কিন্তু সবাই বলাবলি করছে আমার সঙ্গে তোমাকে জড়িয়ে। তাতে তোমার মনে আঘাত লাগতে পারে ভেবে বড্ড খারাপ লাগছে আমার। ভয় করো না লক্ষ্মীটি। যদি দরকার হয়, আমার বাড়ানো হাত তো রইলোই। আমি তোমাকে ফেলে পালিয়ে যাবো না। কী বল তুমি?

চিঠিটার ভেতর থেকে একটা প্যাচানো উদ্দেশ্য যে ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠে আসতে চাইছে। মাসুদ তো কোনদিন এমন ছিল না। যে মাসুদকে সে এতখানি নির্ভরতা আর বিশ্বাস দিয়েছে, যার কাছ থেকে এতকাল সে বিশ্বাস নিয়েছে আর নির্ভরতা খুঁজছে, সে কেন তাকে চাইতে গিয়ে এমন জটিল–কণ্ঠ হয়ে উঠবে? তার এই ভঙ্গিটার সঙ্গে কিছুতেই যেন সে আপোষ করতে পারে না। কেবলি কে যেন ভেতর থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চায়।

সেদিনই সে জরুরি ডাকে চিঠি লিখল মাসুদকে, অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো বেপরোয়া করে–মানুষের কাছে ভালোবাসার গল্প করার সাহস পেলে কী করে? আমাকে তুমি মনে কর, অনেক চিনেছো? অমন মনে করে থাকলে ভুল শুধরে নিও। ভালোবাসার জন্যে এখনো প্রস্তুত নই। তোমার প্রস্তাবটা নিয়ে তাই ভাবতে পারলাম না।

এই চিঠিটার জবাব আসতে অনেক দেরি হয়েছিল। তখন দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে তার, মাসুদই বলেছে সবাইকে এই বিয়ের কথা, ভালোবাসার কথা। যে কথা সরাসরি বলতে তার বেধেছে, সেই কথা সে লোকের মুখ দিয়ে তাকে শুনিয়েছে।

জরিনার এমন মনে হয়, প্রথমদিন যে মানুষকে সে দেখেছিল, আর আজকের যে মাসুদ তারা সম্পূর্ণ আলাদা দুজন।

একে তো জরিনা মাসুদকে লিখত কম, এরপরে লেখাটা যেন প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়াল। শুধু তাকেই নয়, আলীজাকেও। মাসুদ অতিষ্ঠ হয়ে একের পর এক চিঠিতে লিখত–কী হয়েছে তোমার? একবার কি আসবো?

আলীজাহ্‌ লিখেছে–সেন্টিমেন্টের আতশগুলো নিঃশেষ পুড়িয়ে ফেলেছিস বুঝি? নইলে তোর পাগলপাগল চিঠিগুলোর কী হলো? নাকি মহাকাব্য লেখার পরিকল্পনায় মগ্ন হয়ে আছিস?

জরিনা লিখেছে–হ্যাঁ আলীচাচা, মহাকাব্য লেখাই চলছে আমার। জীবন–কাব্য। জীবনের কবিতা। জীবনে যে কবিতা নেই সেই কথাটা স্বপ্নচারীর মতো কবিতা করে বলার কথা ভাবছি। অবশ্যি, এ ছাই লেখা হবে না কোনদিন। আমাকে দিয়ে শুধু পরিকল্পনাই চলে, হয়তো আরম্ভ পর্যন্ত, কিন্তু শেষ আর হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *