৪. দুঃসংবাদটা পৌঁছালো

চতুর্থ পর্ব। এক

দুঃসংবাদটা পৌঁছালো লারার কাছে। সেক্রেটারী মারিয়ান বেলের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। খবরটা শুনে লারা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর জানতে চাইল-আঘাতটা কি খুব গুরুতর?

–মিস ক্যামেরন, আমরা এখনও পুরো খবরটা পাইনি। ওঁকে নিউইয়র্কের হাসপাতালের এমার্জেন্সী রুমে রাখা হয়েছে।

লারার কণ্ঠস্বর কাঁপছে–ঠিক আছে। আমি এখনই আসছি।

রিসিভারটা লারা রেখে দিল। সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। মনে হল মাথা ঘুরে উনি বোধহয় পড়ে যাবেন।

দু-ঘন্টা বাদে লারা হাসপাতালে পৌঁছল। হাওয়ার্ড সেখানে অপেক্ষা করছিলেন।

লারা আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরে জানতে চাইল কি ঘটেছিল?

–কার্নেগী হল থেকে প্রোগ্রাম শেষ করে বেরোবার পর ঘটনাটা ঘটে। 

–কতটা আঘাত?

–হাতের কব্জির কাছটা ফালা ফালা হয়ে গেছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

লারা এমার্জেন্সী রুমে গেল। ফিলিপ বিছানাতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। শরীরে টিউব লাগানো। লারার মুখ থেকে অস্ফুট আর্তনাদের স্বর বেরিয়ে এল–ফি-লি-প…।

ফিলিপের চোখ দুটো খুলে গেল। আচ্ছন্ন ভাব, পাশেই হাওয়ার্ড, ফিলিপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সে বলল–আমার কি হয়েছে?

লারা বলল–তোমার চোট লেগেছিল, এখন ভালো হয়ে উঠেছ।

ফিলিপ বিড়বিড় করে বলছে–আমার ব্যাগ, ঘড়িটা একজন লোক…তারপর…। চোখ দুটো বন্ধ করলো সে।

হাওয়ার্ড বলল–ওখানকার এক দারোয়ান তোমাকে এই অবস্থায় ওখানে পড়ে থাকতে দেখেছিল।

–আমার কব্জির আঘাত কতখানি?

লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–ডাক্তার এখনই তোমাকে দেখতে আসছেন। ফিলিপ বিড়বিড় করে বলল–লোকটা…আমার…কজিতে…কেন…আঘাত…করলো?

.

শেষপর্যন্ত ফিলিপ সুস্থ হয়ে উঠলো কিন্তু বাঁহাতের আঙুলগুলো অকেজো হয়ে গেল, ডাক্তাররা চেষ্টা করলেন যাতে সে আবার আগের মতো হতে পারে। কিছু কৃত্রিম ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছিল। তাতেও সাফল্য পাওয়া গেল না। আঙুলগুলো সামান্য নাড়াচাড়া করতে পারে ফিলিপ। একদিন এক ডিটেকটিভ এসে ফিলিপের ঘরে হাজির হল। তখনও হাসপাতালের বেডে সে শুয়ে আছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ। তিনি বললেন–অ্যাডলার, আমি লেফটেন্যান্ট ম্যানচিনি। আপনি বরাত জোরে বেঁচে গেছেন, ভাগ্য ভালো লোকটা আপনার গায়ে আঘাত করেনি।

হাওয়ার্ড এসে ঢুকলো। ফিলিপ হাওয়ার্ডের সঙ্গে ম্যানচিনির পরিচয় করিয়ে দিল।

হাওয়ার্ডকে দেখে ম্যানচিনি বললেন–আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?

হাওয়ার্ড বলল–আমি তো বলতে পারবো না।

ম্যানচিনি বললেন–চিকাগোতে আপনি একসময় বেসবল খেলতেন, তাই না?

হাওয়ার্ড বলল–আপনি মনে রেখেছেন?

ম্যানচিনি বললেন আমার এখনও মনে আছে।

হাওয়ার্ড বলল–আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি বাইরে লারার জন্য অপেক্ষা করছি।

হাওয়ার্ড চলে গেল, ম্যানচিনি ফিলিপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–লোকটাকে চিনতে পেরেছিলেন?

–লোকটা লম্বা, ফর্সা রং, ছফুটের ওপর উচ্চতা। বয়েস পঞ্চাশের বেশি।

–আবার দেখলে চিনতে পারবেন?

–মুখটা আমি কখনও ভুলবো না।

ম্যানচিনি বললেন–মিঃ অ্যাডলার, লোকটা খুব উঁচু দরের খুনী নয়। একরকম ছিনতাইবাজ। পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। তাদেরই কেউ একজন হবে।

ম্যানচিনি জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার কি কি নিয়েছে?

–মানিব্যাগ আর রিস্টওয়াচ।

–ঘড়িটির কোনো বিশেষত্ব আছে?

–এটা আমাকে আমার স্ত্রী উপহার দিয়েছিল।

–লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছেন?

–না, কেন বলুন তো?

–ঠিক আছে। এখন চলি। দেখি কি করা যায়। ফিলিপ চুপ করলো, ম্যানচিনি হেসে বললেন–আজকের মতো চলি মিঃ অ্যাডলার।

ফিলিপ অসহায়ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল–লোকটা আমার হাতটা আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না।

ফিলিপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ম্যানচিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

.

করিডোরে হাওয়ার্ড আর লারা দাঁড়িয়েছিল। ডিটেকটিভ ম্যানচিনি কাছে যেতেই লারা বললেন–আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান?

–হ্যাঁ। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো। প্রথম প্রশ্ন, আপনার স্বামীর কি কোনো শত্রু আছে?

–শত্রু? না, কেন বলুন তো?

ম্যানচিনি বললেন–যে কোনো শত্রু। যেমন কোনো মিউজিশিয়ান কিংবা এমন কেউ যে আপনার স্বামীর ক্ষতি করতে চায়?

–আমার ধারণা রাস্তার ছিনতাইবাজদের কাজ।

ম্যানচিনি বললেন কিন্তু আঘাতের স্টাইলটা একটু অন্য রকম। ব্যাগ আর ঘড়ি কেড়ে নিয়ে বাঁহাতের কব্জিতে আঘাত করেছে আততায়ী। ওই হাতটাই তো মিঃ অ্যাডলারের

সবকিছু ছিল।

লারা চুপ করে রইল। হাওয়ার্ড চুপচাপ। লারা বলল–আমি তো সাধারণ ছিনতাইবাজদের সঙ্গে কোনো তফাৎ দেখতে পাচ্ছি না।

ম্যানচিনি বললেন–এতই আচমকা ঘটনাটা ঘটে গেছে যে আপনার স্বামী বাধা দিতে পারেনি।

ম্যানচিনি চলে গেলেন। হাওয়ার্ড এবং লারা দাঁড়িয়েছিল। লারার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। তারা বললেন–ফিলিপ নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।

–সে তো বটেই। হাওয়ার্ড সান্ত্বনা দিল। হাওয়ার্ডের মনে হল এত অর্থ থাকলে কি হবে, এই পৃথিবীতে লারা সত্যিই অসহায়!

.

তিনদিন বাদে ফিলিপ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এসেছে। লারা ফিলিপকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। এমন সময় মারিয়ান এসে বলল মিস ক্যামেরন, আপনার ফোন।

–কে করেছে?

–মিঃ পল মার্টিন।

লারা একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন–গিয়ে বল আমি এখন ব্যস্ত আছি।

–ঠিক আছে।

চলে গেল মারিয়ন, লারা হঠাৎ অনুভব করলেন–শরীরটা ভীষণভাবে কাঁপছে।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়

ফিলিপের আঙুলগুলো প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত লারা একজন থেরাপিস্টকে ডেকে এনেছিল। ভদ্রলোকের নাম রসম্যান। রসম্যানের বয়স বেশি নয়। কলম্বিয়া হাসপাতালে কাজ করছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ফিলিপের হাতের অবস্থা আগের মতো করতে। ম্যাসেজ এগিয়ে চলেছে, কিন্তু ফিলিপ আঙুলগুলো নাড়াতে পারছে না। নাড়াতে গেলে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।

দিন এগিয়ে চলেছে, একদিন মাঝরাতে লারার ঘুম ভেঙে গেল। পিয়ানোর শব্দ কানে এল। লারা বিছানা থেকে উঠে ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, ফিলিপ পিয়ানো বাজানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ডান হাতের আঙুলগুলো আলতোভাবে পড়ছিল। লারার পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল–তোমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি দুঃখিত।

লারা বলল–তুমি?

–আমি এখন শিল্পী নই, একজন পঙ্গু মানুষ, তাই না লারা?

লারা ফিলিপের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল–কে বললে তুমি পঙ্গু? তুমি অনেক কিছু করতে পারো।

ফিলিপ ম্লান হাসলো। বলল–তা পারি…

–এসো শোবে, এসো এখন ফিলিপ। লারা নরম স্বরে বললেন।

ফিলিপ বলল–না। আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।

লারা চলে গেল, ফিলিপ পিয়ানোর সামনে বসে রইলো। ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটা অসহায়তা তখন জন্ম নিচ্ছে তার মনের মধ্যে!

ফিলিপ এখন আর বাইরে যায় না। কারো আমন্ত্রণে সাড়া দেয় না। লারার পার্টিতেও যোগ দিতে চায় না। লারা কিন্তু এখনও ফিলিপকে আগের মতোই ভালোবাসেন। বেশিরভাগ সময়টা তার কাছে থাকার চেষ্টা করেন।

–একদিন টেরি হিলের কাছ থেকে লারা একটা দুঃসংবাদ পেলেন। ফোনে টেরির কণ্ঠস্বর শোনা গেল–একটা খারাপ খবর আছে।

–কি খবর বলুন?

–পেনিং কমিশন তোমার ক্যাসিনোর লাইসেন্স সাসপেন্ড করে দিয়েছে। ওরা আরও একবার তদন্ত করে দেখবে। তোমার বিরুদ্ধে ক্রিমিন্যাল চার্জ আনা হতে পারে।

লারা এই কথা শুনে খুবই আতংকিত হয়ে পড়ল। পল মার্টিনের কথা মনে পড়ে গেল–চিন্তার কিছু নেই। ওরা প্রমাণ করতে পারবে না। লারা টেরিকে বলল–আমাদের পক্ষ থেকে কিছু করা যেতে পারে কি?

–এই মুহূর্তে নয়, চুপচাপ বসে থাকতে হবে।

টেরি হিলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। লারা রিসিভারটা রেখে দিলেন। মিনিট পনেরো বাদে হাওয়ার্ড আসতে তাকে কথাটা বললেন।

হাওয়ার্ড বললো–সেকি! ক্যাসিনোর থেকে তিনটি বিল্ডিং-এর মর্টগেজ পেমেন্ট শোধ করার কথা। এখন লাইসেন্স সাসপেন্ড করলে খুব বিপদ হবে।

–কি যে করবো কিছু বুঝতে পারছি না।

হাওয়ার্ড বলল চিকাগোর হোটেলটা আমরা বরং বিক্রি করে দিই। তার থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে হাউসম্যান প্রপার্টির মর্টগেজের পেমেন্টটা হয়ে যাবে। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা এখন খুবই মন্দা চলছে।

লারা একটু বাদে বলল ঠিক আছে। এখনই অত চিন্তার কিছু নেই। ব্যাঙ্ক আমাদের কিছুই করতে পারবে না!

লারা যে কি করে এখনও নিজের ওপর এতটা আস্থা বজায় রেখেছে, ভাবতে ভাবতে অবাক হল হাওয়ার্ড।

বিজনেস উইক ম্যাগাজিনে খবরটা ফলাও করে বেরোল। হেডলাইন ছিল ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজ বিপাকে। রেনোর ব্যাপারে লারা ক্যামেরনের বিরুদ্ধে ক্রিমিন্যাল চার্জ আনা হতে পারে।

এবার প্রতিবেদন শুরু হয়েছে। লারা সবটা পড়ল। তারপর ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ঘরের এককোণে ফেলে দিল।

হাওয়ার্ড উল্টোদিকে বসেছিল। লারা হাওয়ার্ডকে জিজ্ঞাসা করলেন ক্যামেরন টাওয়ার্সের পুরোটাই ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে কি?

–সত্তর ভাগ হয়ে গেছে।

–ঠিক কমাস বাকি সবটা শেষ হতে?

–ছ-মাস লাগবে।

লারার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা–দেখো হাওয়ার্ড, কি করবো আমরা? এটাই পৃথিবীর সব থেকে উঁচু বিল্ডিং তাই তো? এত সুন্দর অট্টলিকা পৃথিবীতে আর নেই। দোতলায় আমাদের অফিস এবং অ্যাপার্টমেন্ট। আমরা এখান থেকে পাবলিসিটি প্রমোশন-এ নামবো। আমরা নিজেরাই ব্যবসাটা গড়ে তুলবো।

হাওয়ার্ড বলল–আমি স্টিভ মার্চিসনকে নিয়ে ভাবছি।

–ভয় পাবার কিছু নেই, এখানেও আমরা ওকে হারিয়ে দেবো।

লারা জেরি টাউনসেন্ডকে ডেকে পাঠাল। লারা বললেন ক্যামেরন টাওয়ার্স-এর। উদ্বোধনের দিন আমরা স্পেশ্যাল কিছু একটা করতে চাই।

জেরি জানতে চাইলেন–উদ্বোধনটা সেপ্টেম্বরের দশ তারিখ, তাই তো?

লারা বলল–হ্যাঁ, সেদিন আমার জন্মদিন।

জেরি টাউনসেন্ডের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। সে বললস্কাইস্কাপারের উদ্বোধনের দিনে আমরা বিরাট একটা বার্থডে পার্টি দেবো।

–বাঃ। প্লানটা চমৎকার।

–সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে এই শুভ সংবাদটা পৌঁছে যাবে। মনে মনে লারা অতিদ্রুত একটা লিস্ট তৈরি করে ফেললেন। অন্তত দু শশা জন গণ্যমান্য মানুষকে নিমন্ত্রণ করা হবে।

জেরির ওপর পুরো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল।

বিজনেস উইক ম্যাগাজিনটার দিকে অবজ্ঞা ভরে তাকালেন লারা। বললেন–আমরা ওদের দেখিয়ে দিতে চাই।

.

দিন এগিয়ে চলেছে। লারা ফিলিপকে আরও কাছে পাওয়ার চেষ্টা করছ। এখন লারার কাছে ফিলিপ ছাড়া পৃথিবীর আর সবকিছুই অর্থহীন। কিন্তু এখন লারার ভালোবাসায় ফিলিপ আগের মতো আর উন্মাদ হয়ে ওঠে না। ফিলিপের কেবলই মনে হয়, এইভাবে লারা বুঝি ওকে করুণা করতে চাইছে। ফিলিপ অনেকবার লারাকে বলেছে–ও যেন ব্যবসা কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত পার্টি অবহেলা না করে। একদিন ফিলিপ বিষণ্ণ মুখে বললপারা, আমার কি মনে হয় জানো?

পরম মমতায় ফিলিপকে জড়িয়ে ধরে লারা বলল–কি?

–আমার মনে হয় তোমাকে আমি নরকের দিকে নিয়ে চলেছি।

–মোটেই না, তুমি আমাকে একটু একটু করে স্বর্গের দিকে নিয়ে চলেছে।

লারার মুখটা গম্ভীর, লস এঞ্জেলসের শপিং মলটা এবার বোধহয় হাতছাড়া হয়ে যাবে। ব্যাঙ্কগুলো টাকা দিতে চাইছে না।

লারা চিন্তিত মুখে জানতে চাইলেন হাওয়ার্ড, ঠিক সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ হবে

হাওয়ার্ড বলল–হবে।

লারার কণ্ঠস্বরে কেমন একটা বিষণ্ণতা ঝরে পড়ছে।

এক বছর আগে হলে লারা কখনই এই প্রশ্নটা করতেন না। কেন? লারা কি পতনের গান শুনতে পাচ্ছেন?

.

শেষ পর্যন্ত ফিলিপ অ্যাডলার বাইরে বের হল। উইলিয়াম এলারবির সঙ্গে একটা পার্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মারিয়ান বেল-ই এই কাজটা করেছে।

ফিলিপ প্রস্তাবটা শুনে খুবই রেগে গিয়েছিল। হঠাৎ হেসে ফেলে বলেছিল–মারিয়ান, তোমাকে নিয়ে আর পারা যাবে না।

মারিয়ান মৃদুভাবে হেসেছিল। ফিলিপকে সে করুণা করে না, কিন্তু ফিলিপের মধ্যে যে ঘুমন্ত সম্ভবনা লুকিয়ে আছে, মারিয়ান তাকে আবার উন্মোচিত করতে চাইছে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা লারা ফিরতেই ফিলিপ বলল–লারা আগামীকাল আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এলারবির সঙ্গে লাঞ্চও করবো।

–কখন এত বড় সিদ্ধান্তটা নিলে? আমাকে বলোনি কেন?

–সিদ্ধান্তটা আমার না মারিয়ানের।

–তাই নাকি। কিন্তু আমার কথায় তো তুমি বাইরে যেতে চাওনি। হঠাৎ মারিয়ানের কথায় রাজী হলে কিভাবে?

লারা জানতে চাইল।

ফিলিপ বললও সমস্ত ব্যবস্থা করে আমাকে জানিয়েছে। তারপর রাজী না হয়ে উপায় ছিল না।

মনে মনে লারা ভাবল, এবার থেকে বোধহয় মারিয়ানকে আর ফিলিপের দায়িত্বে রাখা সম্ভব হবে না। একদিন ফিরে দেখলেন ফিলিপ আর মারিয়ান মুখোমুখি ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে। ফিলিপ খুবই হাসছে। দরজার সামনে লারা দাঁড়াতেই মারিয়ান প্রথম তাকে দেখতে পেয়েছিল। মারিয়ান উঠে সরে দাঁড়িয়ে বলল–আসুন।

–আরে লারা তুমি, এসো।

ফিলিপ উঠে গিয়ে লারার কাঁধে হাত দিল।

মারিয়ান বলল–আমি এখন যাই তাহলে?

লারা একটু গম্ভীর হয়ে বলল–তুমি এখন যাও তোমাকে আর দরকার নেই।

লারার মনে ভেতর একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা তৈরি হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে লারা ফিলিপকে বলল–ফিলিপ, রেনোর ক্যাসিনো নিয়ে আমি খুব চিন্তায় আছি। আমাকে এবার অফিসে একটু বেশি সময় দিতে হবে।

–বেশ তো, আমার জন্য তুমি আর চিন্তা কোরা না।

–আমি আগামীকাল রেনোতে যাচ্ছি। তুমি চলো না আমার সঙ্গে।

ফিলিপ হাতটা দেখিয়ে বলল–এখন নয়, আরও একটু সারুক।

–আমি দুতিন দিনের বেশি থাকবো না। তারা বললেন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও লারা আগের আন্তরিকতা ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না।

পরের দিন সকালে ফিলিপ ঘুমিয়ে ছিল। মারিয়ান অফিসে বসেছিল। লারা এসে চেয়ারে বসলেন। বলল–মারিয়ান, মিঃ অ্যাডলার আমার জন্মদিনে যে ডায়মন্ডের ব্রেসলেটটা উপহার দিয়েছিলেন সেটা তো তুমি দেখেছো, তাই না?

–হ্যাঁ, মিসেস অ্যাডলার। মারিয়ান বলল।

–তুমি শেষবার কবে ওটা দেখেছো?

–মারিয়ান একটু ভেবে বলল–দুদিন আগে বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ছিল।

–হুঁ, তাহলে তুমি দেখেছে।

–কেন, বলুন তো?

মারিয়ান জানতে চাইলো। লারা গম্ভীর গলায় বললেন–এখন ওটা পাওয়া যাচ্ছে না। মারিয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইলো–সে কি? পাওয়া যাচ্ছে না? কে নেবে ওটা?

–আমি সমস্ত কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করেছি তারা কিছুই জানে না। মারিয়ান বলল–আমি কি পুলিশে খরব দেবো?

–তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে অস্বস্তির মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছি না।

–কি বলছেন আপনি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

লারা বলল–বুঝতে পারছো না? যাই হোক ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত।

মারিয়ান বলল–আপনি কি আমাকে চেনেন না মিসেস অ্যাডলার?

–তোমার আর না থাকাই ভালো মারিয়ান।

মারিয়ান এই আকস্মিক আঘাতে বিমূঢ় হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নিজেকে নিজেই ঘৃণা করতে চাইছিলেন লারা। শেষপর্যন্ত এতটা ছোটো হতে হল তাকে? কিন্তু এছাড়া কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর আর কেউ ফিলিপের কাছে আসুক, লারা সেটা বরদাস্ত করতে পারবে না।

.

ব্রেকফাস্টের সময় লারা ফিলিপকে বলল–আবার একটা সেক্রেটারী রাখতে হয়েছে। আমাকে।

–কেন মারিয়ানের, কি হয়েছে?

লারা শান্তভাবে বলল–সানফ্রানসিসকোতে একটা ভালো অফার পেয়েছে সে।

–তাই নাকি? আমি তো ভাবতাম ও এখানেই বোধহয় ভালো আছে।

কিন্তু আমরা তো ওকে বাধা দিতে পারি না। বলো পারি কি?

–ও কি চলে গেছে না আছে এখনো?

–চলে গেছে। কিন্তু আমি তো আছি…

লারা ফিলিপের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু ফিলিপ কিছুই বুঝতে পারছিল না।

.

লাঞ্চের সময় এলারবি ফিলিপকে বলল–ফিলিপ, তুমি বোধহয় বাজাতে পারবে না।

–ঠিকই বলেছে, এই আঙুলগুলো এখন একেবারে মরে গেছে।

–এতে ভেঙে পড়ো না, তোমাকে আমি একটা পরামর্শ দেবো, তুমি কি নেবে?

–বলো।

–শোনো ফিলিপ, তুমি ইস্টম্যান স্কুল অব মিউজিকে অনায়াসে মিউজিকের শিক্ষকতা করতে পারো। আমি ওখানকার প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে কথা বলেছি।

ফিলিপ এবার ভুরু কুঁচকালো। বলল–তাহলে আমাকে নিউইয়র্ক যেতে হবে। তাই তো?

সিডনি, সেলডন রচনাসমগ্র হা। তাতে কি হয়েছে। এলারবি জানতে চাইলো। ফিলিপ বলল–না, আমি এখানেই ঠিক আছি।

–কিন্তু ইস্টম্যানের প্রিন্সিপ্যাল নিজে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

–ওকে বলবে আমার খুব ইচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই।

এলারবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–ঠিক আছে। ভবিষ্যতে যদি তোমার মত পরিবর্তন হয় তাহলে জানিও।

ফিলিপ বলল–ঠিক আছে জানাবো।

অ্যাপার্টমেন্টে যখন ফিলিপ পৌঁছলো তখন লারা বেরিয়ে গেছেন। ফিলিপ বেশ কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করল। ব্যাপারটা খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু লারাকে ছেড়ে থাকবে কেমন করে?

হঠাৎ দরজায় শব্দ হল। ফিলিপ বলল–কে?

–আমি মারিয়ান।

–ও তুমি? এসো কি ব্যাপার?

–আমি চাবিটা ফেরত দিতে এসেছি। মারিয়ান ঘরে ঢুকে চাবিটা ফিলিপের হাতে দিল। ফিলিপ বলল–আমি ভেবেছিলাম তুমি এতক্ষণে সানফ্রানসিসকোতে পৌঁছে গেছে।

–সানফ্রানসিসকোতে কেন?

–বাঃ। তুমি নতুন চাকরি পেয়েছে শুনলাম।

এই কথায় মারিয়ান অবাক হয়ে বলল–না। আমি কোনো চাকরি পাইনি।

কিন্তু লারা যে বলল। ফিলিপ থেমে গেল। মারিয়ান বুঝতে পারলো।

–তাহলে মিসেস অ্যাডলার কেন যে আমার ওপর রেগে গিয়েছিলেন তা আপনাকে বলেন নি?

–তোমার ওপর রাগ করেছে লারা? কিন্তু ও বলল যে তুমি ভালো অফার পেয়ে এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়েছো?

–না, তা সত্যি নয়।

ফিলিপ বলল–সে কি? তুমি বোসো।

মারিয়ান বসলো। ফিলিপ বলল কি ব্যাপার আমাকে খুলে বলো তো।

মারিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব ব্যাপারটা বলল। ফিলিপ বলল–তোমাকে ব্রেসলেট চুরির ব্যাপারে অভিযুক্ত করেছে? না এ মোটেই সত্যি নয়। নিশ্চয়ই ও নিজেই অন্য কোথাও রেখেছে।

মারিয়ান বলল–আপনার জন্য উনি সবকিছু করতে পারেন।

–না, না আমি লারার সঙ্গে…

–না, না মিঃ অ্যাডলার, আপনি কখনই একাজ করবেন না, আমি এখানে আছি এটা যেন বলবেন না ওকে।

মারিয়ান উঠে দাঁড়াল। ফিলিপ জিজ্ঞাসা করলএখন তুমি কি করবে?

ম্লান হেসে মারিয়ান বলল–আমি একটা কাজ খুঁজে নেবো।

ফিলিপ বলল–যদি দরকার হয় তাহলে আমার সঙ্গে যোগযোগ কোরো কেমন?

–তার দরকার হবে না। শরীরের যত্ন নেবেন। চলি। মারিয়ান চলে গেল। ফিলিপ চুপ করে বসে রইলো। কে সত্যি কথা বলছে, সে বুঝতে পারছে না। লারা না মারিয়ান!

বেশ কিছুক্ষণ অকেজো আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবলো লারার মতো মেয়ে কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারে না। কিছুতেই না।

.

তৃতীয় অধ্যায়

হঠাৎ একটা টেলিফোন পেল ফিলিপ। ও প্রান্তের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে–আমি ডিটেকটিভ ম্যানচিনি বলছি।

–আচ্ছা, কি ব্যাপার বলুন তো?

–মিঃ অ্যাডলার আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম মনে আছে আপনার?

–মনে আছে।

–আপনার ঘড়ি পাওয়া গেছে।

–পাওয়া গেছে! কোথায়?

–আপনার আক্রমণকারী একটা বন্ধকী দোকানে এটা বন্ধক রেখেছে। আপনি চিনতে পারবেন কি?

–নিশ্চয়ই।

–ঠিক আছে। আমি ঠিক সময়ে যোগাযোগ করবো।

ফিলিপ রিসিভারটা রেখে দিল। যাক লোকটাকে পাওয়া গেছে।

.

সুন্দর পোশাকে লারাকে আরও সুন্দরী লাগছে। ফিলিপ বলল–তোমাকে ভালো লাগছে।

–অনেক দিন বাদে তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে। দুজনে হেসে উঠল। ফিলিপের চোখ পড়ল লারার কব্জির দিকে। ডায়মন্ডের ব্রেসলেটটা জ্বলজ্বল করছে। ফিলিপ অবাক হয়ে গেল। তাহলে মারিয়ান ওটা নেয়নি। লারা এরকম আচরণ করলো কেন? ফিলিপ ভাবলো এখনই সব কিছু জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু সে কথাটা মুখে আনতে পারলো না। লারাকে কষ্ট দিতে ও কখনই পারবে না। সে রাতে ফিলিপ ছিল নিদহারা।

.

চিকাগোর বিল্ডিংটা অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রইল। পঁচিশতলা অফিস। অর্ধেকটা শেষ হয়েছে। ডোরের সামনে একটা গাড়ী এসে থামলো। দুজনে নেমে ভেতরে ঢুকে গেল। একজনকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো ওরা–তোমাদের ফোরম্যান কোথায়?

লোকটা দেখিয়ে দিল। ফোরম্যানের কাছে দুজন হাজির হল। একজন বলল–আপনি চার্জে আছেন।

-হ্যাঁ। আমি ভীষণ ব্যস্ত। কি চান আপনারা?

–জেসি শা বলে একজন কাজ করেন এখানে?

–ওইতো ওপরে। চেনের পাশে।

কয়েক মিনিট বাদে জেসি শা হাজির হল। ফোরম্যান বলল–জেসি, তোমার সঙ্গে এরা কথা বলতে চান।

–ও, বলুন, জেসি অবাক হয়ে বলল। একজন বলল–আমরা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি।

পকেট থেকে একটা রিস্টওয়াচ বের করলো। তারপর বলল–এটা তোমার?

জেসি ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তার চোখের পলক পড়ছে না।

লারা ক্রমশই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। একদিন ফিলিপকে জড়িয়ে ধরে তারা বলল–শোনো ফিলিপ, এসব ঝামেলা মিটলে আমরা দুজন কোথাও চলে যাব। যেখানে কোনো সমস্যা থাকবে না।

ফিলিপ বলল–বেশ তো, কোথায় যাবে?

লারা ফিলিপের বুকে মাথাটা রাখল। লারা ভাবল মারিয়ানের ব্যাপারটা খুলে বলতেই হবে। লারা যা করেছেন তা অন্যায়। তাসত্বেও তিনি করেছেন, কারণ ফিলিপকে হারালে উনি আর বেঁচে থাকবেন না।

.

পরের দিন মিঃ টিলি লারাকে ফোন করলো। বলল–লবির মেঝের জন্য মার্বেলের অর্ডারটা আপনি কেন ক্যানসেল করেছেন, মিস ক্যামেরন?

লারা অবাক হয়ে বলল–আমি তা করতে যাবো কেন?

–তা তো জানি না, মার্বেল তো আজ ডেলিভারি দেবার কথা। কিন্তু আমি যখন ফোন করলাম তখন ওরা বলল ওই অর্ডারটা নাকি দুমাস আগে আপনি ক্যানসেল করেছেন।

লারা চিৎকার করে উঠল অসম্ভব। এসব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠিক সেই সময় হাওয়ার্ড কেলার ঘরে ঢুকলো। বলল–লারা, ব্যাঙ্ক আমাদের ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করছে। ওরা আমাদের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করবে?

লারা গম্ভীরভাবে বলল ক্যামেরন টাওয়ার্স শুধু শেষ হবার অপেক্ষাতে আছে হাওয়ার্ড। আর তিন মাস বাকি।

হাওয়ার্ড বলল–আমি ব্যাঙ্কের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু ওরা আর সময় দিতে চাইছে না।

ইন্টারকমে ক্যাথির গলা ভেসে এল মিস ক্যামেরন, মিঃ টিলি আপনাকে চাইছেন।

লারা হাওয়ার্ডের দিকে তাকাল। বলল–যেও না হাওয়ার্ড, বোসো। বলেই রিসিভারটা তুলে নিলেন–বলুন।

–মিস ক্যামেরন, আরও একটা সমস্যা…

–শুনছি।

–এলিভেটরটা কাজ করছে না।

–ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাগুলো কি ঘটানো হচ্ছে?

–সেটা বলা কঠিন। তবে দায়িত্বহীনতার জন্যও হতে পারে।

–ঠিক হতে কত সময় লাগবে। লারা জানতে চাইলেন।

টিলি বলল–আমার কিছু লোক আছে…

–ঠিক আছে। নিয়ে আসুন।

লারা রিসিভারটা রেখে হাওয়ার্ডের দিকে তাকাল।

জিজ্ঞাসা করল–হাওয়ার্ড সব ঠিক আছে? একটু বাদে আবার জানতে চাইলেন, স্টিভ মাৰ্চিসনের খবর কি?

হাওয়ার্ড বলল–কেন? ওর খবর নিয়ে কি হবে?

লারা বলল–আমি কিন্তু সত্যিই অবাক হচ্ছি, স্টিভ যা করতে শুরু করেছে ওকে .. এখনই থামিয়ে দেওয়া দরকার। …

.

লারা গম্ভীর হয়ে বসেছিল। হাওয়ার্ড বলল চিন্তা কোরো না, সময়টা ভালো যাচ্ছে না। আমি বলি কি, কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে দাও।

লারা শান্তভাবে বলল–ঠিক আছে তোমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখবো। লারা তখন একেবারে বিধ্বস্ত। ফিলিপের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারছে না। ফিলিপের নিজের অনেক সমস্যা। লারার সমস্যা শুনলে সে আরও হাঁপিয়ে ওঠে।

.

পরের দিন ভোরে টেলিফোন বেজে উঠলো। টিলি লারাকে আসতে বলছে। লারা জবাবে বলল–কেন কিছু হয়েছে কি? ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।

ক্যামেরন টাওয়ার্সে সমস্যা দেখা দিয়েছে, লারা সেখানে পৌঁছে গেলেন। সঙ্গে নিলেন হাওয়ার্ডকে।

কিন্তু সমস্যাটা কি? ফ্যাক্টরিতে লারা ঢুকে পড়েছে, দেখল অসংখ্য একই সাইজের রঙীন কাঁচ চতুর্দিকে ছড়ানো। সামনের তাক থেকে আরো নামানো হচ্ছে। টিলি ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বলল–আপনারা এসেছেন ভালোই হয়েছে।

–কি ব্যাপার?

টিলি বলল–মিস ক্যামেরন, আমরা এই সাইজের গ্লাসের অর্ডার দিইনি। এই সাইজের গ্লাস ফেরত পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। সম্ভবত কোথাও একটা ভুল হয়েছে।

লারা এবং হাওয়ার্ড পরস্পরের দিকে তাকাল। টিলিকে জিজ্ঞাসা করলো হাওয়ার্ড-এগুলো আমাদের সাইজের কেটে নেওয়া যায় না?

–অসম্ভব। এতে সময় এবং পরিশ্রম দুটোরই অপচয় হবে।

লারা জানতে চাইল–এই অর্ডারটা কে দিয়েছিল?

হাওয়ার্ড বলল–আমি।

–কোন কোম্পানী?

–নিউ জার্সি প্যানেল অ্যান্ড গ্লাস কোম্পানী। টিলি বলল।

লারা বলল–ঠিক আছে ওদের ডাকা হোক।

–দু-সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা গ্লাস পাই তাহলে আমরা ঠিক সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো।

–ঠিক আছে, চলো হাওয়ার্ড যাওয়া যাক।

.

লারার কথা শুনে নিউ জার্সি প্যানেল অ্যান্ড গ্লাস কোম্পানীর ম্যানেজার অটো কার্প অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন–আমরা ভুল সাইজের গ্লাস দিয়েছি। এ হতেই পার না। কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে।

শুনুন মিঃ কার্প, দুসপ্তাহের মধ্যে নতুন গ্লাস না পাঠালে আমরা নির্দিষ্ট সময় সীমার ভেতর বাড়িটা শেষ করতে পারবো না। তারা এ কথা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অটো কাৰ্প ভেতরে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। বললেন মিস ক্যামেরন, অর্ডারটা ভুলভাবে লেখা হয়েছিল।

–ওসব আমি জানি না, নতুন গ্লাস পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। পরে অন্য কথা বলা হবে।

–কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে না। দু-তিন মাস সময় লাগবে।

–সেকি? আমাদের এখনই চাই। লারা গর্জন করে উঠল।

কার্প বলল–কিন্তু তা হবার নয়। আগে যেসব কাস্টমার আছে তাদের মাল সাপ্লাই করতে হবে।

লারা বলল–আমারটা এমার্জেন্সী।

–তাতো বুঝেছি মিস ক্যামেরন। কিন্তু…

–আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। আপনারা যা ভালো বুঝবেন করবেন। তারা অফিসে ফিরে এল। টিলিকে জিজ্ঞাসা করল–মিঃ টিলি, আর কোনো কোম্পানী আপনার জানা আছে?

হাওয়ার্ড বলল–শোনো লারা, আমি একটা ব্যাপার ভেবেছি। অবশ্য লোকটাকে পছন্দ না করলেও তুমি একবার ওকে বলে দেখতে পারো। এই জাতীয় কোম্পানীর সাথে ওর ভালো কানেকশন আছে।

–কে? জিজ্ঞাসা করলেন লারা।

–পল মার্টিন। হাওয়ার্ড বলল। তারপর মৃদু হেসে তাকাল লারার মুখের দিকে। লারার মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা গেল না।

.

পল মার্টিন বললেন–তোমাকে দারুন দেখাচ্ছে লারা।

–ধন্যবাদ পল, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।

–তা আমি বুঝেছি। চিন্তার কিছু নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। বলল কি করতে হবে?

লারা পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। পল বললেন–দেখি কি করা যায়। আমি চেষ্টা করছি।

লারার দুচোখে কৃতজ্ঞতা। তুমি সত্যিই আমার উপকার করলে পল। পল বললেন–শোনো লারা, কালকে একবার আমার সঙ্গে দেখা কোরো, কথা আছে।

–আমি তোমাকে সকালে ফোন করবো।

পরের দিন সকালে লারা পলকে ফোন করল। পলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–লারা আমি আমার কজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি। ব্যাপরটা খুব একটা সোজা না। তবে সপ্তাহ। খানেকের মধ্যে ডেলিভারী হয়ে যাবে।

–ঠিক আছে। আমি সময় করে তোমার সঙ্গে দেখা করবো। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

লারা ফোনটা রেখে দিল। পলের মুখটা ভেসে উঠল তার মনের ক্যানভাসে।

এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে। তখনও কোনো খবর নেই। হাওয়ার্ড বলল–মিঃ টিলির সাথে কথা বলেছি। শুক্রবারের মধ্যে কাঁচ না এলে আমরা শেষ হয়ে যাব।

লারা কোনো জবাব দিল না। বৃহস্পতিবার। তখনও পর্যন্ত কোনো খবর নেই। আশার আলো এবার ধীরে ধীরে নিভে যেতে বসেছে।

লারা ক্যামেরন টাওয়ার্সে গিয়ে হাজির হল। কোথাও কোনো শ্রমিক নেই। সাইট একেবার ফঁকা, হঠাৎ লারার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। তিনি মনে মনে বললেন–যে করেই হোক এই বিল্ডিং আমি শেষ করবোই। কেউ আমাকে রুখতে পারবে না।

অফিসে গিয়ে পল মার্টিনকে ফোন করলেন। পলকে পাওয়া গেল না। সেক্রেটারী বলল–পল জরুরী কাজে বাইরে গেছেন। ফিরতে দেরী হবে।

সেক্রেটারীকে লারা জানালপল এলেই যেন ফোন করেন। হাওয়ার্ড সামনেই ছিল। লারা হাওয়ার্ডকে বললেন–হাওয়ার্ড তুমি একবার খোঁজ নিয়ে দেখ তো ওই গ্লাস ফ্যাক্টরির মালিক কে? স্টিভ মার্চিসন কিনা?

–ঠিক আছে, যাচ্ছি।

একঘন্টা বাদে হাওয়ার্ড ফিরে এল। মুখটা ফ্যাকাশে।

হাওয়ার্ড বলল–খোঁজ নিয়েছি, কোম্পানীর রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল ডেলাওয়ার-এ। এটনা এন্টারপ্রাইজেস এখন ওটার মালিক।

লারা অবাক হয়ে বলল–এটনা এন্টারপ্রাইজেস?

হাওয়ার্ড বলল–বছর খানেক আগে পল মার্টিন ওই কোম্পানীটা কিনে নিয়েছেন।

লারা ফ্যালফ্যাল করে হাওয়ার্ডের মুখের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সমস্ত ব্যাপারটাই এখন তার বুদ্ধির বাইরে চলে গেছে।

.

চতুর্থ অধ্যায়

জেসি শা শেষপর্যন্ত স্বীকার করল সবকিছু। জেসির ব্যাগ থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া গিয়েছিল। ম্যানচিনির চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় সে।

ওদের কথাবার্তার কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরা হল।

ম্যানচিনি–তুমি এখন চিকাগোয় কাজ করছে তাই না?

জেসি–হ্যাঁ।

ম্যানচিনি–তুমি নিউইয়র্কে কখনো কাজ করেছো?

জেসি–হ্যাঁ।

ম্যানচিনি–আমার কাছে পুলিশ রিপোর্ট আছে। তুমি কুইন্স বিল্ডিং-এ যখন কাজ করছিলে তখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে। একটা ক্রেন ছিঁড়ে কনস্ট্রাকশনের ফোরম্যান বিল হুইটম্যানের ঘাড়ে পড়েছিল। সে ওখানেই মারা যায়। আর সেই ক্রেনের অপারেটার তুমি ছিলে। তাই তো?

জেসি–হ্যাঁ। ওটা একটা দুর্ঘটনা।

ম্যানচিনিকতোদিন ধরে কাজ করছিলে?

জেসি–মনে পড়ছে না।

ম্যানচিনি–মনে করার চেষ্টা করো। আমি বলছি। তুমি ওখানে মাত্র তিনদিন কাজ করেছিলে। দুর্ঘটনার আগের দিন তুমি চিকাগো থেকে এসেছিলে। তারপর দুদিন পরেই আবার ওখানে ফিরে গেছো। ঠিক বলছি তো?

জেসি–তাই হবে।

মানচিনি–আমেরিকান এয়ারলাইন্সের রেকর্ড অনুযায়ী তুমি চিকাগো থেকে রেনোতে আবার এসেছিলে, ঠিক দু-দিন পরেই ফিলিপ অ্যাডলার গুরুতরভাবে জখম হল। তারপরের দিন তুমি চিকাগোতে ফিরে যাও। এই সংক্ষিপ্ত যাওয়া-আসা কেন তুমি করেছিলে?

জেসি–আমি এখানে একটা নাটক দেখতে এসেছিলাম।

ম্যানচিনি–কি নাটক?

জেসি–নাম মনে নেই।

ম্যানচিনি–ক্রেন অ্যাকসিডেন্টের সময় তুমি কোন কোম্পানীর কাজ করছিলে?

জেসি–ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজেস।

ম্যানচিনি–চিকাগোতে?

জেসি–হ্যাঁ।

ডিটেকটিভ ম্যানচিনির সঙ্গে জেসি শা-র কথার্বাতা এখানেই শেষ।

ফিলিপ অ্যাডলার ডিটেকটিভ ম্যানচিনির কাছ থেকে একটা ফোন পেল। বলল–বলুন ডিটেকটিভ কি খবর?

ম্যানচিনির কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আপনার খবর আছে।

–বলুন। খুঁজে পেয়েছেন লোকটাকে?

–আপনার ওখানে গিয়ে আলোচনা করতে চাই।

ডিটেকটিভ ম্যানচিনি পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে ফিলিপকে বলল–দেখুন তো এটা আপনার রিস্টওয়াচ কিনা?

ফিলিপ দেখেই চিনতে পারলো। কিন্তু প্রথমে ও ঘড়িটা নিতে চাইল না। সেই বৃষ্টিভেজা রাতের বীভৎস দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। পেছনে দেখলো নামটা রয়েছে। লারা ওকে ঘড়িটা উপহার দিয়েছিল। ফিলিপ বলল–হ্যাঁ, আমার রিস্টওয়াচ।

ম্যানচিনি রিস্টওয়াচটা পকেটে রেখে দিয়ে বললেন–এটা আপাতত আমার কাছে থাকবে মিঃ অ্যাডলার। প্রমাণ হিসাবে দরকার। আপনি কাল এসে ওকে সনাক্ত করে যাবেন। লোকটা কনস্ট্রাকশান ওয়ার্কার।

.

ম্যানচিনির এই কথা শুনে ফিলিপ খুবই রেগে গেছে। ঠিকানাটা পকেটে রেখে সে প্রশ্ন করল–আপনি বলছেন ও সাধারণ ছিনতাইবাজ নয়।

ম্যানচিনি বললেন–আপনাকে আক্রমণ করার জন্য লোকটিকে ভাড়া করা হয়েছিল।

একথা শুনে ফিলিপ খুবই অবাক হয়ে গেছে। ও জানতে চাইল, আপনি কি ঠিক বলছেন?

ম্যানচিনি বললেন–দেখুন মিঃ অ্যাডলার, আমি একজন পেশাদার গোয়েন্দা। আপনার হাতের কবজি কেটে দেবার জন্য ওকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছে।

ফিলিপের মুখ দিয়ে প্রথমে কোনো শব্দ বেরোল না। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল আপনার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করছি না।

ফিলিপ আবার জানতে চাইল–ঠিক আছে, আমাকে এরকম অবস্থায় ফেলে দেবার জন্য কে ওকে ভাড়া করেছিল, তা আপনি জানেন কি?

–তার নাম- ডিটেকটিভ ম্যানচিনি থেমে গেলেন।

ফিলিপ অধৈর্য হয়ে বলল কী ব্যাপার বলুন?

ম্যানচিনি বললেন–আপনি সহ্য করতে পারবেন তো?

একটু থেমে তিনি বললেন মিসেস অ্যাডলার, অর্থাৎ আপনার স্ত্রী।

ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও বোধহয় ফিলিপ এতখানি অবাক হত না। বিস্ফারিত চোখে সে ম্যানচিনির দিকে তাকিয়ে থাকল।

লারা এরকম কাজ করেছে? ফিলিপ ভাবতে পারছিল না। লারার কথাগুলো ও মনে করার চেষ্টা করল। মারিয়ানের মুখটা মনে পড়ে গেল ফিলিপের। তার মানে? ফিলিপকে নিজের কাছে রাখার জন্য লারা সব কিছু করতে পারে?

.

পঞ্চম অধ্যায়

লারা ক্যামেরন খুবই গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। পাশে হাওয়ার্ড কেলার।

ম্যানচিনি সামান্য একটু কেশে নিলেন। বললেন–আপনার স্বামীকে যে লোকটা আক্রমণ করেছিল, তাকে ধরা হয়েছে।

লারা উৎফুল্ল হয়ে উঠে বলল কী বলছেন লোকটা?

হাওয়ার্ড বলল–কীভাবে ধরলেন?

ম্যানচিনি বললেন–লোকটা আপনার স্বামীর কাছ থেকে একটা হাতঘড়ি ছিনতাই করেছিল। সেটা দোকানে বিক্রি করতে গিয়েছিল। দোকানদারের সন্দেহ হয়েছে। সেই আমাকে ফোন করে।

লারার দিকে তাকিয়ে ম্যানচিনি বললেন–ঘড়িটা আপনি উপহার দিয়েছিলেন, তাই না?

–হ্যাঁ।

ম্যানচিনি বললেন–লোকটার নাম জেসি শা।

ম্যানচিনি লক্ষ্য করলেন, এই নামটা শুনে লারার মুখে কোনো পরিবর্তন হল না। অর্থাৎ লারা এক জন উঁচু দরের অপরাধী।

ম্যানচিনি জানতে চাইলেন–আপনি লোকটাকে কি চেনেন?

লারা ভুরু কুঁচকে বলল–না, ওকে চিনব কী করে?

ম্যানচিনি বললেন–লোকটা চিকাগোতে আপনার কোম্পানীর ওয়ার্কার। কুইন্স-এ আপনার যে প্রেজেক্ট তাতে ও কাজ করেছে। ক্রেন অপারেটর বিল হুইটম্যান নামে আপনার কোম্পানির একজন ম্যানেজার মারা গিয়েছিল মনে আছে কি? ক্রেনের চেন ছিঁড়ে ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়। আপারেটর ছিল জেসি শা। করোনার বলেছিলেন, এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা।

লারা ক্রমশ অবাক হচ্ছে, হাওয়ার্ড বলে উঠল–শুনুন মিঃ ডিটেকটিভ, আমাদের কোম্পানীতে কয়েক শশা লোক কাজ করে। প্রত্যেকের নাম জেনে রাখা কি সম্ভব?

–আপনি জেসিকে চেনেন না মিঃ কেলার? ম্যানচিনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন।

হাওয়ার্ড বলল–না, এছাড়া আমি নিশ্চিত যে মিস ক্যামেরন–

–আমি সেই উত্তরটা ওনার কাছ থেকেই পেতে চাই। আপনি এখানে দাঁড় করাবেন, প্লিজ।

লারা বলল–ওর নাম আমি শুনিনি।

ডিটেকটিভ ম্যানচিনি বললেন–মিস ক্যামেরন, আপনার স্বামীকে আঘাত করার জন্য। লোকটিকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছিল।

—আমি বিশ্বাস করি না। এসব আপনি কী বলছেন ডিটেকটিভ?

লারার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

ম্যানচিনি বললেন–আপনি সত্যি এব্যাপারে কিছু জানেন না?

এবার লারার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠেছে। লারা বলল–আপনি কাউকে সন্দেহ করছেন?

ম্যানচিনি বললেন–মিঃ অ্যাডলার জানেন।

–আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন?

–হ্যাঁ, আমি বলেছি।

কথার মাঝখানেই লারা উত্তেজিত হয়ে অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।

.

চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ফিলিপের। উত্তেজনায় কাঁপছে সে। অক্ষম হাতে ঝক্সে পোশাক রাখছে। লারা জিজ্ঞাসা করলেন কী করছো?

ফিলিপ পেছন দিকে তাকাল। মনে হল লারাকে ও চিনতে পারছে না। বাক্স গুছোতে গুছোতে বলল–আমি চলে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত তুমি..

–এসব মিথ্যে ফিলিপ, এসব মিথ্যে। তুমি বিশ্বাস করো না।

–ফিলিপ বলল–লারা, অনেক শুনেছি, তোমার কাছ থেকে নতুন করে আর মিথ্যা শুনতে আমি রাজি নই। আমাকে মুক্তি দাও।

–আমি মিথ্যে বলছি না, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।

লারা ভেঙে পড়ল, বলল তুমি আমার কথা শোনো, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তোমাকে আমি শারীরিক ভাবে আঘাত করব, তুমি ভাবছ কি করে? কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। বিশ্বাস করো ফিলিপ, এই পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র পুরুষ, যাকে আমি ভালোবাসি।

ফিলিপ শান্তভাবে বলল–পুলিশের বক্তব্য লোকটা তোমার হয়ে কাজ করেছে। এর জন্য ওকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছে।

লারা বলল–আমি একটা কথাই তোমাকে বলতে পারি, প্রাণ গেলেও আমি এসব নোংরা কাজ করতে পারব না।

ফিলিপ লারার দিকে তাকিয়ে রইল। লারা ফ্যাকাশে চোখে একবার ফিলিপকে দেখলেন। উন্মাদিনীর মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

.

শহরতলীর ছোটো হোটেল। ফিলিপ একা রুমে শুয়ে আছে। কাল সারারাত সে ঘুমোতে পারেনি। লারার সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিন থেকে গতকাল পর্যন্ত সব স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে তার। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, লারা সত্যি সত্যি ওকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু এই কাজটা কেন সে করতে গিয়েছিল?

সত্যি কি কোথাও কোনো গোলমাল হয়েছে? লারা অথবা অন্য কেউ? লারা কি অভিনয় করছে? লারার সম্পর্কে ও কি ভুল ভেবেছে? পুলিশের হেড কোয়ার্টারে যাবার জন্য ফিলিপ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। এলারবির একটা ফোন পেয়ে ওর সঙ্গেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

শেষ অব্দি ফিলিপ অ্যাডলার হেড কোয়ার্টারে হাজির হল। ডিটেকটিভ ম্যানচিনি বললেন–আসুন মিঃ অ্যাডলার। লোকটাকে আপনি সনাক্ত করুন। তাহলে আমাদের কাজ অনেকটা সহজ হবে।

ফিলিপ নিস্পৃহ স্বরে বলল–চলুন। এখন এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। জীবন থেকে সব উন্মাদনা সে হারিয়ে ফেলেছে।

সামনের মাঠে ছ-জন লোক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একই বয়স, চেহারা একই রকম। জেসি শা মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ফিলিপের নজর ওর দিকে পড়ল। এই লোকটাই তাকে আক্রমণ করেছে।

রাতের দৃশ্যটা আর একবার ভেসে উঠল। ভেতরে ভেতরে একটা অচেনা শিহরণ অনুভব করল সে। মনে হল, বাঁ হাতের কবজিতে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

ম্যানচিনি বললেন–কী ব্যাপার? মিঃ অ্যাডলার? ভালো করে বলুন তো কে ওই আততায়ী?

ফিলিপ তাকাল জেসি শা-র দিকে। লারা এমন একটা কাজ করতে পারে? লারার একটা কথা মনে পড়ে গেল ফিলিপের–পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র সেই পুরুষ, যাকে আমি সত্যিকারের ভালোবেসেছি।

তাহলে? কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে কি?

ম্যানচিনি অধৈর্য হয়ে বললেন–কী ব্যাপার মিঃ অ্যাডলার?

আবার লারার কথা মনে পড়ে গেল–পৃথিবীর সবথেকে সেরা ডাক্তার ডাকিয়ে আমি তোমার হাত ভালো করে তুলব ফিলিপ।

দিনরাত লারা পরিশ্রম করেছে। একটানা সেবা করে গেছে। ম্যানচিনির শেষ কণ্ঠস্বর–মিঃ অ্যাডলার, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?

ফিলিপের মনে হল, না, লারাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।

ম্যানচিনি জানতে চাইলেন–চিনতে পারছেন নোকটাকে?

ফিলিপের গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল–না।

ম্যানচিনির বললেন–আপনি তো বলেছেন, লোকটাকে ভালো করে দেখেছিলেন। চিনতে অসুবিধা হবে না।

–হ্যাঁ, বলেছিলাম।

–তাহলে বলুন।

ফিলিপ বলল–আমাকে যে আক্রমণ করেছিল সে এখানে নেই।

–আপনি সুনিশ্চিত।

–হ্যাঁ।

–ঠিক আছে মিঃ অ্যাডলার, আপনি আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তাই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে আনমনে ফিলিপ বাইরে এল। এখুনি তাকে একবার লারার সঙ্গে দেখা করতে হবে।

.

লারা জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। অবিন্যস্ত চুল উড়ছে বাতাসে। মুখখানা ফ্যাকাসে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরে সে অসুস্থ। ফিলিপ বিশ্বাস হারিয়েছে, এর থেকে সাংঘাতিক ব্যাপার আর কী হতে পারে?

একটু একটু করে ভাবনার মধ্যে ফিরছিল সে। হঠাৎ পল মার্টিনের কথা মনে পড়ে গেল। এই রহস্যময় ঘটনার অন্তরালে কি পলের কালো ছায়া আছে? পল কি লারার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন? এতে পলের লাভ কী? পল কি ফিলিপকে মেনে নিতে পারেন নি? ঈর্ষার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন?

পল ওকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তা হলে?

হাওয়ার্ড ঘরের ভেতর ঢুকল। বিমর্ষ স্বরে বলল–লারা, ক্যামেরন টাওয়ার্স বুঝি স্বপ্নই রয়ে গেল। দুটি ব্যাঙ্ক আমাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা ঠিক সময় মতো কাজটা শেষ করতে পারিনি। পৃথিবীর সব থেকে উঁচু বাড়ি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, লারা, আমি তোমার মনের করুণ অবস্থাটা বুঝতে পারছি।

লারা হাওয়ার্ডের দিকে তাকাল। লারাকে এক অসহায়া নারী বলে মনে হচ্ছে। দুচোখের নীচে গভীর কালির দাগ। চোখের দৃষ্টির সে উজ্জ্বলতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ লারা এইভাবে বসে রইলেন।

হাওয়ার্ড বলল–শুনছ লারা, ক্যামেরন টাওয়ার্স আমাদের হাতে নেই।

লারার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, দূরাগত ধ্বনির মতো চিন্তার কিছু নেই হাওয়ার্ড, আমাদের তো আরো অনেকগুলো বাড়ি আছে। লোন নিতে অসুবিধা হবে না। ঋণের টাকা আমি সব মিটিয়ে দেব।

–লারা লোন নেবার জন্য আর একটি বাড়িও অবশিষ্ট নেই। তুমি এখন একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেছ। ঘোষণাই যা বাকি আছে।

–হাওয়ার্ড কী বলছ তুমি?

হাওয়ার্ডের কথা শুনে লারা সত্যি অবাক হয়ে গেছেন। চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। ঘরের চারপাশে জিনিসপত্র এলোমেলো ছড়ানো।

হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে লারা বললেন–হাওয়ার্ড এই পৃথিবীতে আমি বিষণ্ণতম রমণী, তাই তো? আমার ফিলিপও শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

হঠাৎ লারার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল। তারা বলল, সব ব্যাপারটাই কেমন মজার, তাই না? কী তাড়াতাড়ি আমি সব কিছু হারিয়ে ফেললাম। আমার ব্যবসা, আমার সম্পত্তি, এমন কী আমার প্রিয়তম স্বামীকেও। ভাগ্য বোধহয় আমর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লারা আবার বললেন–ভাগ্যের হাতে আমরা খেলার পুতুল ছাড়া আর কিছু নই, তাই না হাওয়ার্ড।

হাওয়ার্ডের বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ও এই রূপসী নারীটিকে কাছ থেকে দেখে আসছে। লারার এই ভেঙে পড়া মূর্তি যে কোনোদিন দেখতে হবে, আগে ভাবেনি হাওয়ার্ড।

–আজ আমাকে রেনোতে যেতে হবে, তাই তো? ওখানে শুনানি আছে। তাই না? হাওয়ার্ড থেমে গেলেন। ইন্টারকমে সেক্রেটারীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল মিস ক্যামেরন, ডিটেকটিভ ম্যানচিনি এসেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে।

–পাঠিয়ে দাও। লারা হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন।

হাওয়ার্ড বলল–ম্যানচিনি আবার কি মনে করে?

লারা বললেন–হয়তো উনি আমাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন।

–কী বলছ যা-তা, হাওয়ার্ড বলে উঠল।

লারার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক। তারা বললেন–ওদের ধারণা স্বামীর ওপর আক্রমণ করেছি। আমি।

হাওয়ার্ড বলে উঠল–এসব ব্যাপার ওরা ভাবতেই পারে।

লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দরজাটা খুলে গেল। ম্যানচিনি ঢুকলেন। লারার দিকে তাকালেন। হাওয়ার্ডের মুখখানা দেখলেন। একপা-একপা করে এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে।

হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে ম্যানচিনি বলে উঠলেন–আমি দুঃখিত, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটা আমার সঙ্গেই আছে।

হাওয়ার্ডের মুখটা তখন রক্তশূন্য। হিংস্রভাবে হাওয়ার্ড বলে উঠলনা, আপনি মিস ক্যামেরনকে কিছুতেই গ্রেপ্তার করতে পারবেন না। উনি নির্দোষ। উনি কখনোই ওনার স্বামীকে আক্রমণ করেননি। আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে।

মানচিনি হেসে বললেন–আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ কেলার, সত্যি উনি নির্দোষ। আমি আপনাকেই গ্রেপ্তার করতে এসেছি। এবার আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

ঘরের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটলেও বোধহয় লারা এতখানি অবাক হতেন না। অবিশ্বাসীর দৃষ্টি ঝরে পড়ছে তার দুটি চোখ থেকে।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়

হাওয়ার্ড কেলার আর ম্যানচিনি মুখোমুখি বসে আছেন। হাওয়ার্ডের মুখটা খুবই করুণ। মনে হল তার শরীরের সমস্ত রক্ত কে যেন শুষে নিয়েছে।

ম্যানচিনি বললেন–মিঃ কেলার, আপনার অধিকারের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আপনি দেখে নিয়েছেন?

–হ্যাঁ।

–আপনি কি অ্যাটর্নি রাখবেন?

–তার প্রয়োজন নেই।

–ফিলিপ অ্যাডলারকে আক্রমণ করার জন্য আপনি জেসি শা-কে পঞ্চাশ হাজার ডলার দিয়েছিলেন, তাই তো?

–হ্যাঁ।

–কেন?

–ফিলিপ ওর জীবনটা দুর্বিসহ করে তুলেছিল। লারা সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। লারা চেয়েছিল ফিলিপ বাড়িতেই থাকুক। কিন্তু ফিলিপ তা চায়নি।

–তাই আপনি মিঃ অ্যাডলারের বাঁ হাতটা সম্পূর্ণ অকেজো করে দিলেন?

–আমি জেসিকে এতটা বাড়াবাড়ি করতে বারণ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, ফিলিপকে ভয় দেখাতে।

–কিন্তু বিল হুইটম্যানের ব্যাপারটা?

–লোকটা জঘন্য ধরনের ছিল। লারাকেও ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল। লারার কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাইনি।

–তাই ওকে মেরে ফেললেন?

–হ্যাঁ, লারার জন্য এটা করেছি।

–মিস ক্যামেরন আপনার এ সমস্ত কাজ সম্বন্ধে জানেন?

–না, জানলে ও রাজি হত না। আমি ওকে সবসময় আগলে রাখতে চেয়েছি। এমন কী লারার জন্য আমি মরতেও পারি।

এতক্ষণ ধরে ম্যানচিনি হাওয়ার্ডকে প্রশ্ন করছিলেন। এবার হাওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করল আপনি কীভাবে জানলেন যে, আমিই আসল অপরাধী?

.

পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ক্যাপ্টেন জনসন আর ডিটেকটিভ ম্যানচিনি মুখোমুখি বসে আছেন।

জনসন জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কী করে জানলেন মিঃ কেলার এসব ঘটনা ঘটিয়েছে?

ম্যানচিনি হাসলেন। বললেন–ছোট্ট একটা সূত্র থেকে আমার সন্দেহ শুরু হয়। জেসি শার অতীতের একটা ঘটনা। পুলিশ রেকর্ডে ছিল সতেরো বছর বয়সে জেসি চিকাগোর একটা বেসবল টিমে কয়েকটা জিনিস চুরি করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেই বেসবল টিমের সদস্য ছিল হাওয়ার্ড কেলার। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দুজনে একই টিমের প্লেয়ার ছিল। ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল ওরা।

ম্যানচিনি বলতে থাকেন–এই জায়গাতে হাওয়ার্ড হেরে গেল। কারণ আমি যখন জেসির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন ও বলেছিল, জেসি বলে কাউকে চেনে না। এরপর আমি চিকাগোর সানটাইমস নামে একটা কাগজের স্পোর্টস এডিটরের সঙ্গে দেখা করলাম। ভদ্রলোক আমার বন্ধু। ওরা যখন খেলত, তখন ওই বন্ধুটি সাংঘাতিক ছিল। নাম বলা মাত্রই চিনতে পারল। এবার আর সমস্যা রইল না। ক্যামেরন এন্টাপ্রাইজে হাওয়ার্ড জেসিকে নিয়ে আসে। অবশ্য লারার অনুমতি নিয়ে। লারা ক্যামেরন জেসিকে হয়তো কোনোদিন দেখেন নি।

জনসন বললেন–বাঃ, চমৎকার সমাধান। কিন্তু এর পরেরটা?

ম্যানচিনি মাথা নাড়লেন–আমি যদি হাওয়ার্ড কেলারকে ধরতে না পেরে মিস ক্যামেরনের পেছনে ছুটতাম, তাহলে সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতাম।

–কী করে? ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন।

ম্যানচিনি বললেন–সেক্ষেত্রে হাওয়ার্ড আমার কাছে এসে সবকিছু স্বীকার করত।

–কেন?

–ফিলিপকে যেমন লারা উন্মাদের মতো ভালোবাসেন, হাওয়ার্ডও তেমনি লারা ক্যামেরনকে ভীষণ ভালোবাসে। লারার কোনো ক্ষতি সে সহ্য করতে পারত না।

–তোমার মস্তিষ্ককে অসংখ্য ধন্যবাদ ডিটেকটিভ।

ম্যানচিনি একথার জবাব না নিয়ে মৃদু হাসলেন।

.

লারার পৃথিবীটা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। হাওয়ার্ড যে এরকম কাজ করতে পারে তিনি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেন নি। কিন্তু সবটাই করেছে লারাকে বাঁচানোর জন্য। লারাকে খুশি করার জন্য। লারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইন্টারকমে ক্যাথির কণ্ঠস্বর–গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে মিস ক্যামেরন। আপনি তৈরি?

লারাকে রেনোতে যেতেই হবে। আজই হিয়ারিং ডেট।

লারা বেরিয়ে যাবার পাঁচ মিনিট বাদে ফিলিপের ফোন বেজে উঠল। ক্যাথি বলল, লারা তো নেই। একটু আগেই উনি রেনোতে রওনা হয়ে গেলেন। আজ হিয়ারিং ডেট।

ফিলিপের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। লারাকে একটিবার দেখার জন্য সে পাগলের মতো হয়ে গেছে। সে বলল–ক্যাথি, তুমি যখন ওর সঙ্গে কথা বলবে, তখন জানিও আমি এখানে আছি। আমি এখানেই ওর জন্য অপেক্ষা করছি।

ফিলিপ রিসিভার নামিয়ে রাখল। লারার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। দশ মিনিট বাদে বলল–এলারবি, তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি।

–কী কথা?

–তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি। আমি নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাই। শিক্ষকতা করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

–অধ্যক্ষকে তোমার কথা জানাব।

এলারবি ফোন রেখে দিল। ফিলিপ রিসিভারটা রেখে চারদিকে তাকাল। কী একটা অদ্ভুত শূন্যতাবোধ তখন ক্রমশই তাকে গ্রাস করছে।

.

লারা মিঃ টেরি হিলকে জিজ্ঞাসা করল–টেরি, ওরা আমার কী করতে পারে?

টেরি ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল–ওরা অনেক কিছুই করতে পারে। এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, আপনি নির্দোষ। সেক্ষেত্রে আপনি ক্যাসিনো ফেরত পেতে পারেন। আর যদি আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি প্রমাণিত হয়, তাহলে সর্বনাশ, ক্রিমিনাল চার্জে আপনার জেলও হতে পারে। কিছুই করা যাবে না।

বাবার কথা মনে পড়ে গেল লারার-লারা, ভাগ্যের বিরুদ্ধে জেতা অসম্ভব। সব কিছুই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে।

লারা সামনের দিকে তাকাল। তারপর বিচার কক্ষে ঢুকে পড়লেন। জুরিরা গম্ভীরমুখে পাশাপাশি বসে আছেন। লারা ওদের মুখোমুখি বসলেন। টেরি পাশে বসেছে। এবার শুনানির পালা শুরু হবে।

চার ঘন্টা ধরে শুনানি চলেছে। ক্যামেরন প্লেস হোটেল আর ক্যাসিনোর ব্যাপারে লারাকে নানারকম প্রশ্ন করা হল। হিয়ারিং রুম থেকে তারা বেরিয়ে এলন। টেরি হিল লারার হাত দুটো চেপে ধরে বলল–আপনার তুলনা নেই মিস ক্যামেরন। আপনার বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর প্রমাণ নেই। আপনি বোধহয় মুক্তি পাবেন।

জুতোর শব্দে লারা পেছন ফিরে তাকাল। অ্যান্টি চেম্বার থেকে পল মার্টিন বেরিয়ে আসছেন। লারা ওনাকে আসতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছেন।

টেরি হিল অস্ফুটস্বরে বললেন–উনিও এসেছেন দেখছি। ওনার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। আচ্ছা, মিস ক্যামেরন, একটা কথা সত্যি করে বলবেন? ওনার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কী রকম? উনি আপনার ভালো চাইবেন তো?

লারা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–আমি পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

টেরি বলল–পল মার্টিন যদি আপনার বিরুদ্ধে রায় দেন, তাহলে আপনার জেল অনিবার্য। শেষ হয়ে যাবনে আপনি।

লারা দেখল পল আপন মনে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। লারা মৃদু স্বরে বলল–আমি শেষ হয়ে যাব ঠিক কথা। কিন্তু আমার সঙ্গে পল নিজেও শেষ হয়ে যাবে, তাও আমি জানি।

টেরি বলল–উনি কি আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারেন?

–তা জানি না।

লারা নিস্পৃহ স্বরে জবাব দিলেন।

পল মার্টিন এগিয়ে এলেন। লারাকে দেখতে পেয়ে হেসে বললেন–আরে লারা, শুনলাম তোমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না?

কিন্তু পলের কণ্ঠস্বরে দুঃখ ঝরে পড়ছে না কেন?

আবার পল বললেন–তোমার জন্য সত্যি আমার কষ্ট হয়।

হাওয়ার্ডের কথা মনে পড়ে গেল লারার সাবধান লারা, পল একজন, সিসিলিয়ান। ওরা কখনো কিছু ভোলে না। জীবনে কখনো কাউকে ক্ষমা করে না।

এখন কী বলা উচিত, লারা বুঝতে পারলেন না।

পল বললেন–লারা, এখন আমি চলি।

কিছুটা এগোতেই লারা ডাকলেন–পল?

–কিছু বলছো?

–তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন পল। তারপর বললেন–ঠিক আছে। সামনের করিডরটা ফঁকা। পল বললেন, তাহলে ওখানে চলল। ওখানে গিয়ে কথা বলা যাক।

ওঁরা দুজন এগিয়ে গেলেন, একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ঘরটা ফাঁকা ছিল। টেরি ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। দরজা বন্ধ হবার শব্দ শোনা গেল। টেরি ভাবল, দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।

.

কীভাবে শুরু করবে, লারা ভেবে পাচ্ছেন না।

পল জিজ্ঞাসা করলেন–বলো, কী বলতে চাও?

–আমি তোমার সাহায্য চাই।

–কীভাবে?

লারার বুক থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। লারা বলল, তুমি আমাকে অনেক শাস্তি দিয়েছে, আমাকে দেখে তা বুঝতে পারছো কি?

পল মার্টিনের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে নিস্পৃহতা। পাথরের মতো মুখ। অভিব্যক্তিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই।

লারা বলল–এক সময় আমরা দুজনে চমৎকার বন্ধু ছিলাম, তাই নয় কি? ফিলিপ ছাড়া তুমি সেই পুরুষ যে, আমার কাছে অনেকখানি। তোমাকে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। তোমাকে আমি সত্যি সত্যি আঘাত করতে চাইনি। তুমি বিশ্বাস করতে পারো।

পরিস্থিতি ভারী হয়ে উঠেছে। লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–আমি জানি, তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে শেষ করে দিতে পারো। তুমি কি তাই চাও? আমাকে জেলে পাঠিয়ে সুখে থাকতে পারবে তো?

লারা আবার বলল–পল, আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি, আমাকে তোমার শত্রু ভেবে না।

পল তখনো চুপ করে আছেন।

লারা আবার বলল–তুমি আমাকে ক্ষমা করো। লড়াই করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি পল, এই লড়াইতে তুমি জিতেছে, আমি হার স্বীকার করছি।

শেষ পর্যন্ত লারা আর পারলেন না। কান্নায় আটকে গেল।

পল দরজা খুলে দিলেন। সামনে বেলিফ দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার মার্টিন, জুড়িরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

পল লারার দিকে তাকালেন। কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। লারার মনে হল, ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে।

টেরি লারার সামনে এসে হাজির হল। বলল–এখন সব ঈশ্বরের হাতে। অপেক্ষা করা। ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।

.

অপেক্ষার প্রহর শুরু হল। লারার মনে হল, এটা বুঝি অনন্তকাল। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল। পল বেরিয়ে এলেন হিয়ারিং রুম থেকে। দুচোখে ক্লান্তির ছাপ, যেন আরো বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। পল পায়ে পায়ে লারার দিকে এগিয়ে এলেন। পল মৃদুস্বরে বললেন–লারা, আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। তুমি দিনের পর দিন আমাকে বোকা বানিয়েছে। কিন্তু–

পল কথা শেষ করলেন না। একটু থেমে আবার বললেন–আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তোমারই দেওয়া। চোখ বন্ধ করলে আমি সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা ভাবি। তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী। আমি তোমার কাছে কোনো একটা ব্যাপারে অভয় দিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে কিনা জানি না। ওদের আমি কিছু বলিনি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

লারার দিকে তাকালেন পল। লারার চোখ দুটি জলে ভরে গেছে। লারা বলল পল, তোমাকে আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।

–মনে করো, এটা তোমার জন্মদিনের আগাম উপহার। চলি, কেমন?

পল চলে গেলেন। জন্মদিনের উপহার? জন্মদিনের পার্টির ব্যাপারটা লারা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলেন। শ-দুয়েক অতিথি ম্যানহাটন ক্যামেরন প্লাজাতে অপেক্ষা করছেন। লারা। টেরি হিলকে বললেন, আজ রাতেই, আমরা নিউইয়র্কে যাব ওখানে একটা মস্ত বড়ো পার্টি আছে।

টেরি হিল হিয়ারিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। পাঁচ মনিট বাদে ফিরে এল। বলল–মিস ক্যামেরন, আপনি নিউইয়র্ক যেতে পারবেন। জুরিরা আগামীকাল সকালে রায় ঘোষণা করবেন। আপনি আবার ভোর রাতে এখানে ফিরে আসবেন। মিঃ মার্টিন সত্যি কথা বলেছেন, জুরিদের কাছে উনি কিছুই বলেননি।

লারার অন্তরটা আনন্দে ফেটে পড়তে চাইছে। চুড়ান্ত সংযম দেখিয়ে লারা স্বাভাবিক থাকলেন। আধঘন্টা পর লারা নিউইয়র্কের পথে রওনা হলেন।

.

গ্র্যান্ড বলরুমের মাঝখানে লারা দাঁড়িয়ে ছিল। হলঘরটা একেবারে ফাঁকা। অতীতের দিকে লারা ফিরতে থাকলেন। গ্রেস বে-থেকে সিন ম্যাক অ্যালিস্টার, চিকাগোর চার্লস কোহন, নিউইয়র্কের পল মার্টিন, সবশেষে ফিলিপ অ্যাডলার–একটির পর একটি সাফল্যের ইতিকথা! দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লারা। কেউ পাশে নেই কেন?

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। লারা? কে ডাকছে? লারা পেছনের দিকে তাকল। জেরি টাউনসেন্ডকে দেখা গেল। জেরি টাউনসেন্ড বলল–কারলোসের কাছে শুনলাম, তুমি এখানে বার্থ-ডে পার্টির ব্যাপার এসেছে, আমি দুঃখিত।

লারা জিজ্ঞাসা করল–কী হয়েছে?

–হাওয়ার্ড তোমায় কিছু বলেনি?

–না তো! কী ব্যাপার?

–আমাদের খারাপ অবস্থার কথা বিবেচনা করে আমরা শেষপর্যন্ত পার্টি ক্যানসেল করে দিয়েছি।

বিরাট সাজানো গোছানো হলঘরটাকে শেষবারের মতো লারা দেখে নিলেন। তারপর বললেন–জেরি, আমি এখানে পনেরো মিনিট ছিলাম, তাই না?

–কিছু বলছো? জেরি অবাক।

–না, কিছু না। লারা দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। এই বিশাল অট্টালিকা আর কোনদিন আমার হাতে আসবে না। হাওয়ার্ডের কাছে আমি সব কিছু শুনেছি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

লারা মাথা নাড়িয়ে বলল, জেরি, আমি এসব কিছুর জন্য দায়ী।

–এটা কোনোমতেই আপনার ত্রুটি নয়।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জেরি বলল–আমি দুঃখিত লারা–এখন চলি, ব্যস্ত আছি।

জেরি টাউনসেন্ড চলে গেল। লারা একাই এগোতে থাকলেন। নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে তার। সব শেষে উনি কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়লেন।

একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস পড়ল লারার পেলব ঘাড়ের ওপর। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল পল দাঁড়িয়ে আছে। লারা পলের দু-বাহুর বাঁধনে ধরা পড়েছে। এই মুহূর্তে দুজন দুজনকে আরো কাছে পেতে চাইছে। লারার রক্তিম ঠোঁট জোড়া পলের উষ্ণ ঠোঁটের মধ্যে বন্দিনী হয়েছে। লারার এই প্রথম মনে হল, পৃথিবীতে সত্যিকারের সুখী নারী যদি কেউ থাকে, তাহলে সে নিজে। আর, তখন ফিলিপের মুখখানা? না, চোখ বন্ধ করল লারা। কোথাও ফিলিপের অস্তিত্ব দেখতে পেল না। নিজের কাছে এই প্রথম হেরে গেল সে!