৪. কুসুম নিজের ঘরের বিছানায়

কুসুম নিজের ঘরের বিছানায় বসে কাপড়ের ওপর ফুল তুলছে, ললিতা তার পিছনে হাঁটু গেড়ে তার মাথা থেকে পাকা চুল তুলছে।

কুসুম বলল—হয়েছে, অনেক তুলেছিস।

ললিতা চুল তুলতে তুলতে বলল— আর কয়েকটা হলেই শেষ, তোমার মাথা একেবারে কালো হয়ে যাবে।

মুখ তুলে কুসুম হেসে বলল–কালো মাথা আমার দরকার নেই। ছেলে বড় হল, দুদিন পরেই নাতির মুখ দেখব।

ললিতা একটু থতমত খেয়ে জড়িত স্বরে বলল–তার এখনো অনেক দেরি আছে।

কুসুম বলল— সে যা হোক, আমার মাথা ছেড়ে তুই একবার বাইরে গিয়ে দ্যাখ সোমনাথ কোথায়, তাকে ডেকে নিয়ে আয়।

ললিতা একটু উসখুস করে বলল-ও এখন বাগানে পাখির ঘর তৈরি করছে। দিনরাত তাতেই লেগে আছে। পাখির ঘর ছাড়া অন্য ভাবনা নেই।

কুসুম বলল—যা ডেকে নিয়ে আয়। তাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

ললিতা উঠে দোরের দিকে যাচ্ছে, বাইরে থেকে একনাথের গলায় ডাক এল-বৌমা। বৌমা।

ললিতা এখনো একনাথকে ভয় করে, সে তাড়াতাড়ি দোরের পাশে লুকিয়ে পড়ল। কুসুম মাথায় আঁচল টেনে উঠে দাঁড়াল—বাবা।

টেলিগ্রামখানা নাড়তে নাড়তে একনাথ ঘরে ঢুকলেন— খবর শুনেছ, ছোঁড়া পাস করেছে, ফার্স্ট ক্লাস-এইমাত্র তার এল। আমি ওর সঙ্গে বাজি রেখেছিলাম ও পাস করতে পারবে না, যদিও মনে মনে জানতাম পাস করবেই। হ্যা! হ্যা!

দোরের আড়াল থেকে খবর শুনে ললিতার মুখে আনন্দের বিদ্যুৎ খেলে গেল, সে একনাথের চোখ এড়িয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একনাথ বললেন—একটা কিছু করা দরকার আমোদ-আহ্লাদ হৈ-চৈ খাওয়া-দাওয়া ধুমধাম। তুমি পুরুতঠাকুরকে এই হপ্তায় একটা ভাল দিন দেখতে বল, সেদিন বাড়িতে উৎসব হবে—বাঈনাচ, বাজি পোড়ানো, গাঁয়ের মাতব্বরেরা আসবে, খাওয়া-দাওয়া হবে, বাড়ি জমজমাট হবে। কি বল?

কুসুম ক্ষীণ স্বরে বলল,-আপনার যা ইচ্ছে তাই হবে বাবা।

একনাথ বললেন-বেশ। কিন্তু সোমনাথ গেল কোথায়? বাড়িতে কোথাও দেখছি না।

কুসুম বলল–শুনলুম বাগানে কোথায় নাকি পাখির ঘর বানাচ্ছে। —ডেকে পাঠাচ্ছি।

না না, আমি নিজেই যাচ্ছি। একেবারে চমকে দেব। —পাখির ঘর বানাচ্ছে। হুঁঃ হুঁ– নিজের ঘর বানাবার সময় হয়েছে কিনা–গলার মধ্যে হাসি চেপে রেখে একনাথ চলে গেলেন।

.

বাগানের এককোণে ঝোপঝাড়ের মধ্যে সোমনাথ বাঁশের খুঁটোর ওপর তক্তা দিয়ে পাখির বাসা তৈরি করছে। অনেকটা পায়রার খোপের মত। ছোট ছোট পাখিরা এসে তার মধ্যে বাসা বাঁধবে, ডিম পাড়বে, বাচ্চা ফোটাবে, এই তার লক্ষ্য।

ললিতা ছুটতে ছুটতে সেই দিকে আসছিল, কাছাকাছি এসে সে টিপে টিপে ঝোপের মধ্যে ঢুকল। সোমনাথ তখন ঠকঠক হাতুড়ি চালিয়ে পেরেক ঠুকছে, ললিতা পিছন থেকে তার চোখ টিপে ধরল।

এই ললি, কী হচ্ছে

ললিতা তার কানে কানে বলল—একটা ভারি সুখবর এনেছি, কী খাওয়াবে বল?

চোখ থেকে ললিতার হাত ছাড়িয়ে সোমনাথ ফিরে দাঁড়াল, কিছুক্ষণ ললিতার হাসিভরা মুখের পানে চেয়ে থেকে গম্ভীর মুখে বলল—কী খাওয়াব? এমন খাবার খাওয়াব যা খেতে খুব মিষ্টি কিন্তু পেট ভরে না।

ললিতা অবাক হয়ে এক পা কাছে সরে এল, বলল—সে আবার কী খাবার?

কী খাবার জান না? সোমনাথ নিজের আঙুল ললিতার ঠোঁটে ঠেকিয়ে সেই আঙুল নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করল, বলল—এই খাবার।

লজ্জায় লাল হয়ে ললিতা এক পা পিছিয়ে গেল। বলল-যাও, তুমি ভারি দুষ্টু।

সোমনাথ মুখ টিপে হাসল কই, কি সুখবর বলবে না?

ললিতা আবার এগিয়ে এল দাদুর কাছে তার এসেছে, তুমি পাস করেছ, ফার্স্ট ক্লাস

ওদিকে একনাথ টেলিগ্রামের হলদে রঙের কাগজখানা হাতে নিয়ে সোমনাথকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, ঝোপের মধ্যে সোমনাথ ও ললিতাকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওরা তাঁকে দেখতে পায়নি, সোমনাথ ললিতার কাঁধে হাত রেখে খাটো গলায় কথা বলছে, ললিতার চোখ দুটি সোমনাথের মুখের দিকে উঠতে উঠতে আবার নত হয়ে পড়ছে। দুজনের মুখেই ভঙ্গুর হাসি। তারপর সোমনাথ ললিতাকে আরো কাছে টেনে নিল, ললিতা তার বুকে মুখ লুকলো।

একনাথ দেখলেন, কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। ক্রোধে তাঁর মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল, তিনি ধৈর্য হারিয়ে ওদের দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু এক পা গিয়ে তিনি থমকে গেলেন, তারপর পিছু ফিরে বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করলেন। টেলিগ্রামের কাগজটা অজ্ঞাতসারে তাঁর হাতে ধরা রইল। সোমনাথ তখন ললিতার দুই কাঁধে হাত রেখে মুখের কাছে মুখ এনে সুর করে বলছে

উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী
        কিশোরী গলার হারা
        কিশোরী ভজন কিশোরী পুজন
        কিশোরী নয়ন তারা।

নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে একনাথ বিক্ষিপ্ত চিত্তে পায়চারি করতে লাগলেন। পঁচিশ বছর আগে যা ঘটেছিল, আবার কি তার পুনরাবৃত্তি আরম্ভ হল! লাঠিয়ালের মেয়েকে সোমনাথ! কি কুক্ষণে মেয়েটাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন!

হাতে টেলিগ্রামের কাগজটার ওপর নজর পড়ল। ইচ্ছে হল কাগজখানা ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলেন। কিন্তু তা না করে পকেটে রাখলেন। তারপর একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। দুরবগাহ দুশ্চিন্তায় তাঁর মন ড়ুবে গেল।

ঘরের মধ্যে সন্ধ্যের ছায়া নেমেছে এমন সময় গোবর্ধন এসে দোরের কাছে দাঁড়াল বাবু, তামাক সেজে আনব? আপনার আফিম খাবার সময় হয়েছে।

সুপ্ত বাঘের ঘাড়ে পা দিলে যেমন হয়, একনাথ গর্জে উঠলেন–হতভাগা উল্লুক! কে তোকে ডেকেছে?

গোবর্ধন থতমত খেয়ে বলল—আজ্ঞে

বেরিয়ে যা—দূর হয়ে যা! একনাথ আরক্ত চোখে চেয়ার থেকে ওঠবার উপক্রম করলেন।

গোবর্ধন একনাথের এমন উগ্র মূর্তি অনেক দিন দেখেনি, সে ভড়কানো ঘোড়ার মত ছুটে পালাল।

কুসুম ঠাকুরঘরের প্রদীপ জ্বেলে বাইরে এসে দেখল গোবর্ধন মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। সে একটু আশ্চর্য হয়ে বলল— কি হয়েছে গোবর্ধন?

গোবর্ধন বলল— আর বৌদিদি, যা হবার তাই হয়েছে। এতদিন পরে কর্তাবাবু আবার রেগে গেছেন।

কুসুম শঙ্কিত হয়ে বলল— কি বলবে খুলে বল।

গোবর্ধন খুলে বলল। শুনে কুসুমের মন নানারকম সন্দেহে ভরে উঠল। সে প্রশ্ন করল সোমনাথ কোথায়?

গোবর্ধন বলল—তা তো জানি না বৌদিদি। দেখব?

না, থাক—বাবার ঘরে আলো দিয়েছ?

না বৌদিদি। তাঁর এখন আফিমও খাওয়া হয়নি। বাঘের মত চেহারা দেখেই পালিয়ে এসেছি।

তোমাকে আর যেতে হবে না, আমি দেখছি।

একনাথ অন্ধকার ঘরে বসেছিলেন, কুসুম কেরাসিনের টেবিল ল্যাম্প নিয়ে ঘরে ঢুকল, টুলের ওপর ল্যাম্প রেখে বলল–বাবা, আফিম দেব?

নিরাসক্ত সুরে একনাথ বললেন–দাও।

দেরাজ থেকে আফিমের কৌটো এনে কুসুম একনাথের হাতে দিল, কুঁজো থেকে জলের গেলাস ভরে পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইল। একনাথ গুলি পাকিয়ে মুখে দিলেন, জল খেয়ে গেলাস ফিরিয়ে দিতে দিতে কতকটা যেন নিজ মনেই বললেন— সব ভেঙে পড়ছে, আবার সব ভেঙে পড়ছে।

কুসুম চেয়ারের পাশে নতজানু হয়ে ব্যগ্র স্বরে বলল–কিছু ভেঙে পড়বে না বাবা, সব ঠিক থাকবে। এ বাড়িতে কারুর সাহস নেই আপনার কথার ওপর কথা বলে। আপনি যা বলবেন তাই হবে।

একনাথ মনে একটু সান্ত্বনা পেলেন, আস্তে আস্তে কুসুমের মাথার ওপর হাত রাখলেন।

সে রাত্রে কিন্তু আফিমের প্রভাব সত্ত্বেও তাঁর চোখে ঘুম এল না।

.

বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় উৎসবের আয়োজন শুরু হয়েছে। প্রকাণ্ড একটা শামিয়ানা খাটানো হচ্ছে। চারিদিকে জন-মজুরের ভিড়। শহর থেকে বাঈজি আসবে, বাঈ-নাচ হবে, বাজিওয়ালা আসবে, বাজি পোড়ানো হবে। আশেপাশের গণ্যমান্য সকলের কাছে নিমন্ত্রণপত্র গিয়েছে। দেওয়ান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ তদারক করছেন।

বাগানের এক পাশে গোলাপের কেয়ারি। সোমনাথ সেই দিক দিয়ে যেতে যেতে একটি রাঙা গোলাপ ফুল তুলে নিয়ে তার আঘ্রাণ নিল, তারপর সেটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে পাখির খাঁচার দিকে চলল।

খুঁটোর ওপর জাল দিয়ে ঢাকা খাঁচার মধ্যে একঝাঁক মুনিয়া পাখি খেলা করছে, ললিতা খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে তাদের দেখছে। সোমনাথ তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

ললিতা বিগলিত আনন্দে বলল–কি সুন্দর পাখি!

সোমনাথ গোলাপ ফুলটি তার চোখের সামনে ধরল–আর এটা? সুন্দর নয়?

ললিতা ফুল দেখে বলল–খুব সুন্দর। কিন্তু এ তো দাদুর বাগানের ফুল! কারুর হাত দেবার হুকুম নেই।

জানি। আমি চুরি করেছি। এখন তুমি চোরাই মাল রাখো, আমি দাদুর কাছে চললাম।

ললিতা চোখ বিস্ফারিত করে বলল— দাদুর কাছে! কেন?

সোমনাথ বলল— দাদুকে বলতে যাচ্ছি তুমি তাঁর গোলাপ ফুল চুরি করেছ।

অ্যাঁ-না, সত্যি বল না কেন দাদুর কাছে যাচ্ছ?

সোমনাথ গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলল জরুরী কাজ আছে। জরু-রী কাজ।

হঠাৎ হেসে উঠে ললিতার থুতনি নেড়ে দিয়ে সে চলে গেল।

.

কুসুম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জলসা-মণ্ডপের নির্মাণ কার্য দেখছিল, ওদিকে একনাথ নিজের ঘরে কপালে হাত দিয়ে বসে দুশ্চিন্তার জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাইরে উৎসবের আনন্দ-তৎপরতা, কিন্তু ঘরের কোণে দুর্ভাবনার উপছায়া।

কুসুম বারান্দা থেকে দেখল সোমনাথ বাগান পেরিয়ে বাড়ির দিকে আসছে। তার পদক্ষেপ এবং গতিভঙ্গিতে দৃঢ়তার ব্যঞ্জনা, যেন সে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছে। কুসুমের মন কৌতূহলী ও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল।

সোমনাথ দোতলায় উঠে এসে একনাথের দোরে টোকা দিল— দাদু, আসব?

ঘরের মধ্যে একনাথ চমকে উঠলেন। তাঁর মনে হল তিনি আজ এক প্রচণ্ড সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছেন। একটু দম নিয়ে তিনি সহজ স্বরে ডাকলেন–আয় ভেতরে আয়।

সোমনাথ পর্দা সরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। কুসুম বারান্দা থেকে দেখছিল, আস্তে আস্তে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়াল। তার মনে অনেক রকম অস্পষ্ট উৎকণ্ঠার যাতায়াত শুরু হয়েছিল।

ঘরের মধ্যে সোমনাথ একনাথের চেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল। একনাথ আতঙ্ক-ভরা চোখে তার পানে চাইলেন। সোমনাথ বলল–দাদু, আপনি বলেছিলেন পাস করলে আমাকে প্রাইজ দেবেন

একনাথ ভয়ার্ত চোখে চাইলেন। পঁচিশ বছর আগের আর একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। লোকনাথ সে-ও প্রাইজ চেয়েছিল।

একনাথ অস্ফুট গলায় বললেন— প্রাইজ অ্যাাঁ হ্যাঁ বলেছিলাম বটে–তা তাড়া কিসের

সোমনাথ বলল— তাড়া নেই। কিন্তু আমি যে-প্রাইজ চাইব আপনি দেবেন তো?

একনাথ এবার ভেঙে পড়লেন। তাঁর অসহিষ্ণু উগ্র স্বভাবে কোথায় ঘুণ ধরেছিল, হঠাৎ মড় মড় করে ধূলিসাৎ হল। তিনি সোমনাথের একটা হাত চেপে ধরে ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলেন— ওরে, আমি জানি তুই কি চাইবি। কিন্তু তার আগে আমার কথাটা শোন। আমি বুঝতে পেরেছি তুই ললিতাকে চাস। কিন্তু এই বুড়োটার একটা কথা মন দিয়ে শোন। আমি তোর দাদা, তুই আমার নাতি

প্রবল আবেগে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। সোমনাথ বিস্ময়ভরে চক্ষু বিস্ফারিত করে চাইল। এত বিচলিত এমন অভিভূত অবস্থায় তাঁকে সে আগে কখনও দেখেনি। উপরন্তু সে কী চায় তা তিনি। বুঝতে পেরেছেন। কেমন করে বুঝলেন?

দোরের বাইরে মাথা নীচু করে কুসুম সব শুনছে।

সোমনাথ কোন কিছু বলার আগেই একনাথ আবার বলে উঠলেন— ললিতা আমার লাঠিয়ালের মেয়ে একথা তুই জানিস?

সোমনাথ অবাক হয়ে চাইল—কেন জানব না। একথা তো সবাই জানে, আমিও গোড়া থেকে জানি। কিন্তু

একনাথ বাধা দিয়ে বললেন–থাম–আগে আমাকে বলতে দে। —তুই আমার একমাত্র নাতি, আমি তোকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি। তোর বাবাকেও ভালবাসতাম। সে ছিল আমার একমাত্র বংশধর, উত্তরাধিকারী। কিন্তু আমার কাছে নিজের ভালবাসার চেয়ে বংশের মর্যাদা ঢের বেশি বড়। এরই জন্যে আমি ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলাম। তাঁর গাল বেয়ে জল পড়তে লাগল–মা চণ্ডী জানেন, কী নরক-যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি। কিন্তু যা করেছি বংশের জন্যে করেছি, বাপ-পিতামহের মর্যাদা রক্ষার জন্যে করেছি। তাঁরা তোরও পূর্বপুরুষ, তোর জন্যে তাঁরা এই অগাধ ঐশ্বর্য সঞ্চয় করে রেখে গেছেন। তাঁদের প্রতি কি তোর কোন কর্তব্য নেই?

কিন্তু দাদু

আমার কথাগুলো শেষ পর্যন্ত শোন। তোর সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। জানি তোরা এ যুগের ছেলে, তোদের রীতি-নীতি সবই আলাদা। তাকিয়ে দেখ, আমার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, আমার এই মাথাটি ধুলোয় লুটিয়ে দিস না। হঠাৎ সোমনাথের হাত চেপে ধরে তিনি বললেন–আমাকে আগে মরতে দে। কদিনই বা বাঁচব। তারপর তুই হবি এই সংসারের কর্তা। তখন তোর যা মন চায় করিস, কেউ তোকে বাধা দিতে আসবে না।

শুনতে শুনতে সোমনাথের চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। কিন্তু সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে। একনাথ তার মুখের পানে ব্যাকুল চক্ষে চেয়ে বলে উঠলেন–দাদু, তুই ছাড়া আমার সংসারে আর কেউ নেই, তুই আমার একটা কথা রাখবি না?

এবার সোমনাথ তার কণ্ঠস্বর ফিরে পেল, উঠে দাঁড়িয়ে কম্পিত অধরে বলল–দাদু, আপনি যাতে কষ্ট পান সেকাজ আমি কখনো করব না।

একনাথ থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন, নাতিকে বুকে জাপটে নিয়ে স্খলিত স্বরে বললেন-বেঁচে থাক— বেঁচে থাক—।

বাইরে দাঁড়িয়ে কুসুম সব শুনল, তারপর ঠোঁট কামড়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।

নিজের ঘরে গিয়ে কুসুম দেখল ললিতা দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটি গোলাপ ফুল। ললিতা বলল-বৌমা, আমার খোঁপায় ফুল পরিয়ে দাও না।

কুসুম তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল— ওরে, কেন তোরা বড় হয়ে উঠলি, ছোট হয়েই থাকলি না কেন?

.

শামিয়ানার মধ্যে নাচ-গানের আসর বসেছে। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। বাগানেও অসংখ্য গ্যাসলাইটের দীপদণ্ড। সভায় অনেক গণ্যমান্য অতিথির সমাগম হয়েছে, চিকের আড়ালে মহিলাদের স্থান। একনাথ সভায় বসে রুপোর গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছেন। মধুকণ্ঠী বাঈজি লহর তুলে গান গাইছে, সঙ্গে সারেঙ্গীর সঙ্গত। বাঈজির পায়ে ঘুঙুর, সে গাইতে গাইতে ঘুরে ফিরে বাহু বিলোলিত করে নাচছে। সকলের চক্ষুকর্ণ বাঈজির ওপর বিন্যস্ত।

একনাথ অলসভাবে সভার চারিদিকে চোখ ফেরালেন। দেখলেন সোমনাথ সভার এক কোণে বসেছিল, কখন অলক্ষিতে উঠে গেছে। একনাথের কপালে একটু ভুকুটি দেখা দিল, তিনিও আস্তে আস্তে উঠে সভার বাইরে গেলেন। সবাই বাঈজির সঙ্গীতসুধা পানে মোহাচ্ছন্ন, কেউ লক্ষ্য করল না।

বাগানের কোণে পাখির ঘরের ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ললিতা আর সোমনাথের কথা হচ্ছিল। দূর থেকে গ্যাসলাইটের ঝিলমিল আলো তাদের মুখের ওপর খেলা করছে। সোমনাথ ললিতার কাঁধে হাত রেখে ব্যগ্রস্বরে বলছিল—এই উৎসবনাচ গান—এসব আমার কাছে অর্থহীন-আমি তোমাকে চাই–ললি, আমি তোমাকে চাই। কিন্তু দাদু

একনাথ ঝোপের বাইরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন। ললিতা বলছে—দাদু আমাকে চান না।

সোমনাথ বলল—ললি, তুমি দাদুকে ভুল বুঝো না। তিনি সাবেক কালের মানুষ, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মত নয়। কিন্তু তিনি জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছেন, আমি তাঁকে আর দুঃখ দিতে পারব না। দাদুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তিনি যতদিন বেঁচে আছেন আমি তোমাকে বিয়ে করব না।

কিছুক্ষণ কোন কথা নেই, দূর থেকে বাঈজির গানের কলি ভেসে আসছে। একনাথ উৎকর্ণ হয়ে আছেন।

শেষে সোমনাথ বলল—তুমি জানো, দাদু আমাকে কত ভালবাসেন। আমি যদি তাঁর কথা না শুনি, তিনি হয়তো মারা যাবেন…সে আমি পারব না। আর কদিনই বা তিনি বাঁচবেন। ললি, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?

কান্নাভরা গলায় ললিতা বলল—পারছি।

আমরা দুজনে এক বাড়িতেই থাকব, কিন্তু দূরে দূরে থাকব। আমাদের ভালবাসা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

না।

একনাথ আর সেখানে দাঁড়ালেন না, যেমন চুপিচুপি এসেছিলেন তেমনি চুপিচুপি ফিরে গেলেন।

.

রাত্রির উৎসব শেষ হয়েছে, আলো নিভে গেছে, যারা উৎসবে যোগ দিয়েছিল, সকলে চলে গেছে। উৎসব-মণ্ডপ অন্ধকারে আবৃত হয়ে শুন্য পড়ে আছে।

বাড়িও সুষুপ্ত অন্ধকার। কেবল একনাথ জেগে আছেন। তাঁর চোখে নিদ্রা নেই। তিনি নিজের ঘরে একাকী পায়চারি করছেন। পায়চারি করতে করতে কখনো তিনি পালঙ্কের পাশে বসছেন, কখনো চেয়ারে বসছেন। তাঁর মন যেন ঝড়ের সমুদ্রে ওঠা-পড়া করছে।

সকাল হল, রোদ উঠল। একনাথ স্নান ও প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে চেয়ারে এসে বসলেন। বেশ প্রশান্ত মূর্তি, বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। গোবর্ধন আফিমের কৌটো ও জলের গেলাস নিয়ে অপেক্ষা করছিল, চেয়ারের পাশে টিপাইয়ের ওপর জলের গেলাস রাখল। একনাথ আফিমের কৌটো খুলে গুলি পাকাতে পাকাতে বললেন–গোবর্ধন, তুই যা, ডাক্তার পাণ্ডেকে একবার ডেকে নিয়ে আয়।

গোবর্ধন উদ্বিগ্ন চোখে একবার তাঁর পানে তাকাল, কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে সাহস করল না, আজ্ঞে বলে চলে গেল।

আধঘন্টা পরে ব্যাগ হাতে ডাক্তার এলেন। হাসিমুখে বললেন—কাল রাত্রে মজলিশ খুব জমেছিল। আপনি তো নটা বাজতে না বাজতেই উঠে গেলেন। কি ব্যাপার বলুন তো, ঠাণ্ডা লেগে গেছে নাকি?

একনাথ বললেন—না, ঠাণ্ডা লাগেনি। বোস, বলছি।

ডাক্তার বসলেন। একনাথ খানিক চুপ করে থেকে বললেন—ডাক্তার, আমার শরীরটা একবার ভাল করে পরীক্ষা কর দেখি। আমি জানতে চাই আর কতদিন বাঁচব।

ডাক্তার হেসে বললেন—এখনো অনেক দিন বাঁচবেন। গত কয়েক বছর আপনার তো সর্দিকাশি পর্যন্ত হয়নি। আপনারা দীর্ঘায়ুর বংশ, এরই মধ্যে মৃত্যুচিন্তা কেন?

একনাথ বললেন—দীর্ঘায়ুর বংশ হলেও সবাই তো সমান বাঁচে না। আমার ঠাকুর্দা তিরানব্বই বছর বেঁচে ছিলেন, বাবা উনআশিতেই গিয়েছিলেন, আর লোকনাথ–। কিন্তু যাক। তুমি একবার পরীক্ষা কর।

একবার কেন, দশবার করব। কিন্তু আমি আপনার ধাত জানি, আশঙ্কার কোন কারণ নেই।

আশঙ্কার—কারণ– নেই। হুঁ। একনাথ একবার ডাক্তারের মুখের পানে চাইলেন। ডাক্তার কি করে বুঝবে তাঁর মনের গোপন কথা!

তারপর ডাক্তার প্রায় আধঘণ্টা ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পরীক্ষা করলেন একনাথের শরীর। বুক পেট হৃদযন্ত্র ফুসফুস রক্তচাপ সব দেখলেন। লোহার ভাটার মত নিরেট শরীর, কোথাও দূর্বলতার চিহ্ন নেই।

লম্বা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পাণ্ডে বললেন—আপনার বয়স কত জানি, তিয়াত্তর বছর। কিন্তু শরীরটা পঞ্চাশ বছরেই আটকে গেছে, আর বাড়েনি।

একনাথ বিরক্ত স্বরে বললেন—হেঁয়ালি কোরো না, স্পষ্ট করে বলো আর কতদিন বাঁচব।

ডাক্তারের মুখে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল—যদি আত্মহত্যা না করেন, এখনো পনেরো কুড়ি বছর বাঁচবেন।

পনেরো কুড়ি বছর! বলতে বলতে একনাথের নিশ্বাস ফুরিয়ে গেল, তিনি যেন বিভীষিকা দেখছেন এমনি ভাবে চেয়ে রইলেন—আরো পনেরো কুড়ি বছর বেঁচে থাকব!

ডাক্তার ব্যাগের মধ্যে যন্ত্রপাতি ভরতে ভরতে বললেন—তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি পাড়াগাঁয়ে প্র্যাকটিস করি বটে, কিন্তু একেবারে হেতুড়ে ডাক্তার নেই। আমার কথা বিশ্বাস না করেন, শহর থেকে বড় ডাক্তার আনিয়ে পরীক্ষা করাতে পারেন—আচ্ছা চলি এখন, অনেকগুলো রোগীকে ডাক্তারখানায় বসিয়ে রেখে এসেছি। তিনি ব্যাগ নিয়ে প্রস্থান করলেন।

কিছুক্ষণ একনাথ অসাড় বসে রইলেন, তারপর উঠে পায়চারি করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মাথার মধ্যে চিন্তার বিষক্রিয়া চলতে লাগল-পনেরো-কুড়ি বছর…তখন দাদুর বয়স হবে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ…না না, এ হতে পারে না…কিন্তুবংশের অমর্যাদা আমি নিজের চোখে দেখব? না না, এ হতে পারে না…

সন্ধ্যের সময় একনাথ সোমনাথের দোরে টোকা দিলেন—দাদু, ঘরে আছিস?

সোমনাথ ঘরে একলা বসে ধূসর ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল, তাড়াতাড়ি এসে দোর খুলল—এই যে দাদু।

সোমনাথ বেরিয়ে এল। একনাথ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন—চল আমার ঘরে, এক দান দাবায় বসা যাক। সেদিন তুই আমায় মাৎ করেছিলি, আজ আমি তোকে মাৎ করব। এমন মাৎ করব যে চিরদিন মনে থাকবে।

সোমনাথ মুখে হাসি এনে বলল-বেশ তো দাদু, বেশ তো। দেখা যাক কে কাকে মাৎ করে।

একনাথের ঘরে গিয়ে সোমনাথ দেখল বিস্তীর্ণ পালঙ্কের মাঝখানে দাবার বোর্ড পেতে ঘুঁটি বসানো হয়েছে। তখনো দিনের আলো একটু ছিল। একনাথ পালঙ্কের শিয়রের দিকে বসে হাঁক দিলেন–গোবর্ধন!

গোবর্ধন এসে দাঁড়াল—আজ্ঞে?

আলো দে। আর আমার আফিম রেখে যা।

আজ্ঞে। গোবর্ধন চলে গেল।

সোমনাথ খাটের ওপর বসল। আধা-অন্ধকারে খেলা আরম্ভ হল। তারপর গোবর্ধন আলো এনে টিপাইয়ের মাথায় রাখল, দেরাজ থেকে আফিমের কৌটো নিল, গেলাসে জল ঢেলে একনাথের হাতের কাছে রেখে চলে যাচ্ছিল, একনাথ বললেন—ভাল কথা, গোবর্ধন, দাদুর পাস করার জন্যে তোকে বকশিশ করা হয়নি। এই নে। ফতুয়ার পকেট থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট নিয়ে তিনি গোবর্ধনের হাতে দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে খেলায় মগ্ন হয়ে গেলেন।

গোবর্ধন নোটের তাড়া দেখে ঘাবড়ে গেল, বিহ্বলভাবে একবার নোটের পানে একবার একনাথের পানে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—বাবু, এ যে অনেক টাকা।

একনাথ দাবার ছক থেকে চোখ তুললেন না, হাত নেড়ে তাকে বিদেয় করলেন। সোমনাথের মন খেলায় নিবিষ্ট, সে কিছু লক্ষ্য করল না।

কিছুক্ষণ নীরবে খেলা চলল। কয়েক চাল পরে একনাথ নিজের ঘোড়াকে আড়াই ঘর এগিয়ে সোমনাথের রাজার সামনে বসালেন, বললেন-কিস্তি।

কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সোমনাথ গলার মধ্যে শব্দ করল—হুম। একনাথ হাসি হাসি গলায় বললেন—কেমন বেড়াজালে পড়েছিস! চাল খুঁজে পাচ্ছিস না।

সোমনাথ উত্তর দিল না, বোর্ডের ওপর ঝুঁকে একমনে চাল ভাবতে লাগল। একনাথ তীক্ষ্ণচোখে তার পানে চাইলেন, তারপর আফিমের কৌটো তুলে নিয়ে কৌটো খুলে সমস্ত আফিম মুখে দিলেন। কৌটোয় প্রায় দেড় ভরি আফিম ছিল।

একঢোঁক জলের সাহায্যে আফিম গলাধঃকরণ করে একনাথ বিজয়ীর চোখে নাতির পানে চাইলেন, বললেন—তোরা আজকালকার ছোকরা খুবই চালাক-চতুর, কিন্তু আমরা বুড়োরাও বড় কম যাই না, এখনও তোদের হারাতে পারি। ভাল কথা, ডাক্তার আজ একটা ভারী দামী কথা বলেছিল। বলেছিল, যদি আত্মহত্যা না করি, পনেরো কুড়ি বছর বাঁচব-হাঃ হাঃ হাঃ! এই আংটিটা রাখ, ডাক্তার পাণ্ডেকে দিবি। নিজের আঙুল থেকে হীরের আংটি খুলে তিনি সোমনাথের দিকে এগিয়ে ধরলেন—এই নে।

সোমনাথের তখন কাদের সাপ অবস্থা। সে অন্যমনস্কভাবে আংটি নিয়ে বলল—আংটি—কি হবে?

একনাথ বললেন—ডাক্তার পাণ্ডেকে দিবি—আমার উপহার।

ও—আচ্ছা— আংটি পকেটে রেখে সোমনাথ আবার বোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

আরো কিছুক্ষণ খেলা চলার পর, একনাথ পিছনের তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুজলেন। তাঁর ঘুম আসছে, ঘুমের জোয়ারে তাঁর চেতনা যেন ড়ুবে যাচ্ছে। সম্মুখে শান্তি পারাবার

দাদু, এবার আপনার চাল।

একনাথ চোখ টেনে টেনে চাইলেন, তারপর উঠে বসে ছকের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। কিছুক্ষণ কাটবার পর তিনি গলার মধ্যে হাসির মত একটা শব্দ করলেন, কম্পিত হাতে নিজের মন্ত্রী কোণাচে ভাবে দুঘর এগিয়ে দিয়ে বললেন—কিস্তিমাৎ। দাদু, তুই হেরে গেলি।

একনাথ পিছনের তাকিয়ার ওপর আবার এলিয়ে পড়লেন, আফিমের শুন্য কৌটো হাত থেকে স্খলিত হয়ে বিছানায় পড়ল।

সোমনাথ বোর্ড থেকে চোখ তুলে লজ্জিতভাবে একনাথের পানে চাইল, সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে উদ্বেগের ছায়া পড়ল। একনাথের এলিয়ে পড়ার ভঙ্গিটা স্বাভাবিক নয়।

সোমনাথ বলে উঠল–দাদু। কী হয়েছ?

একনাথ সাড়া দিলেন না। সোমনাথ তখন উঠে গিয়ে তাঁর গায়ে নাড়া দিয়ে ডাকল—দাদু! দাদু!

এবারও একনাথের কাছ থেকে সাড়া এল না। সোমনাথ স্তম্ভিতভাবে খানিক দাঁড়িয়ে রইল, তারপর তার চোখ পড়ল আফিমের কৌটোর ওপর। সে সেটা তুলে নিয়ে দেখল, কৌটো শুন্য। সে হঠাৎ ভেঙে পড়ে বলল–এ আপনি কি করলেন দাদু। তারপর চিৎকার করে উঠল—গোবর-দা, গোবর-দা, শিগগির এস।

গোবর্ধন ছুটে এল। সোমনাথ তাকে ডেকে বলল—যাও শিগগির ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনো। জলদি জলদি! দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন!

গোবর্ধন একবার একনাথের পানে চাইল, তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠিতভাবে কুসুম ঘরে ঢুকল, তার পিছনে ললিতা।

কুসুম উৎকণ্ঠা ভরা গলায় বলল—কী হয়েছে কী হয়েছে সোমনাথ?

সোমনাথ প্রায় কেঁদে উঠল—মা, সর্বনাশ হয়েছে দাদু—এই দ্যাখো। সে আফিমের শূন্য কৌটো খুলে দেখাল। কুসুম তাই দেখে হু হু শব্দে কেঁদে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে বলল—অ্যাাঁ! এ কি হল! মা চণ্ডী, তুমি এ কি করলে—!

ললিতা তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।

.

আধঘণ্টা কেটে গেছে। ঘরে কয়েকটা বড় বড় ল্যাম্প জ্বালা হয়েছে। একনাথের দেহ খাটের ওপর লম্বাভাবে শোয়ানো হয়েছে। গোবর্ধন তাঁর পায়ের ওপর মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে। ডাক্তার পাণ্ডে খাটের শিয়রে দাঁড়িয়ে একনাথের পানে চেয়ে আছেন, তাঁর মুখে কঠিন গাম্ভীর্য। পাশে কুসুম আর ললিতা পরস্পরকে যেন আগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খাটের পায়ের কাছে সোমনাথ, তার চোখে মাঝে মাঝে জল উথলে উঠছে। সে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুচছে। ঘরে এই পাঁচজন ছাড়া আর কেউ নেই।

অবশেষে সোমনাথ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—আমরা যাতে সুখী হই তাই তুমি এভাবে চলে গেলে। দাদু, হেরে গিয়েও তুমি মাথা নীচু করলে না। তুমিই সত্যিকার অভিজাতক। ভগবান তোমায় শান্তি দিন।

1 Comment
Collapse Comments

I want to read next episode of Abhijatak written by Saradindu bandopadhyay

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *