৪৬-৫০. রূপার পরে পলবি ফিরে আসে

৪৬.

রূপার পরে পলবি ফিরে আসে। কিন্তু পলবির আর লুঠ হবার মতো চেহারা থাকে না। বিগত সাত আট বছরে সে এত বেশি লুঠ হয়েছে যে এখন আর ছিচকে চোরও তার দিকে হাত বাড়াতে রাজি নয়। তার দাম্ভিক যাযাবরী মুখমণ্ডল এখন আর হাসিতে গালে টোল ফেলে না। চোখের চাহনি মুহূর্তেই উচ্ছলতা ছুঁড়ে দেয় না। তার চেহারায় ছিল অসামান্য আকর্ষণ, সহজাত বন্যতা, যার জন্য সে একসময় সদাই সন্ত্রস্ত থাকত। এখন সে নির্ভর।

এই সময়ের মধ্যে সে তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এইসব সন্তানেরা দিগিন মণ্ডলের, মহিমবাবুর, মহিমবাবুর শালা হেলার, না লালমিয়ার তা সে নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না। বলার প্রয়োজনও আর নেই। কেননা একজনও দু-বছরের বেশি বাঁচেনি। শেষপর্যন্ত সে লালমিয়ার বাড়িতে খলালির কাজ করত। ওখানে থাকার শেষ তিনবছর। খলান পরিষ্কার করা, ধান ভানা, ধান শুকানো, গোয়াল কাড়া, এসব খলালির কাজ।

তখন দিগিন মণ্ডল ছিল না, মহিমবাবু ছিল না। পাঁচবিবিতে তখন একা লালমিয়ার রাজত্ব। সান্তাহার রেলস্টেশনের দাঙ্গার পর লালকুন্‌ঠি লুঠ হয়, মহিমবাবু পালিয়ে বাঁচে। দিগিন মণ্ডল অসম বিনিময়ে এপারে এসে যা জমি পায় তাতে হীনবল হয়ে পড়ে।

তমো তো সেথা খাবা পাতি। হেথায় আলু ক্যান্?

ডরে।

ডর! আর কি ডর?

সুখী বুড়ি যি মরি গিল হয়।

তো কি? দুদিন গোহালের পাছুৎ মইরে পড়ি ছিল। বাস ছড়াতে সোব্বার খ্যাল হয়। ইথে তোর কি? হামার? এর থেকে বেশি আলোড়ন মোহরের বাজিকরপাড়ায় পলবি আর তুলতে পারে। দু-দিনে সুখী বুড়ির চোখ নাক ছুঁচো আর পিঁপড়েতে খুবলে খেয়েছে। অথচ সুখী ত বিশ বছর চৌধুরীবাড়িতে খলালির কাজ করেছে।

হেথায় খাবি কি?

ক্যান কাজ কইরে খামো।

অথচ পলবি জীবনটাকে বাঁধবার কথা কি মনেও ভাবে না? বাজিকরপাড়ায় একজন পুরুষও কি সে পাবে না? কিছুদিন স্বস্তিতে থাকলে কি সে পুরনো দিনের এমন কিছুই ফিরে পাবে না? এখন নসিবনকেও তার ঈর্ষা হয়, যে নসিবন তার দ্বিগুণবয়সী এক পুরুষমানুষের ঘর করে। যে নসিবন তার নিজস্ব দু-টি জারজ ছাড়াও আরো তিনটি কংকালসার মনুষ্যসন্তানকে সামলায়।

ফলে কয়েকমাসের মধ্যেই সে বাজিকরপাড়ায় সমস্যা সৃষ্টি করে। তার মানসিক জগতে শনিবারের ভূমিকম্পের থেকেও জোরালো কোনো ভূমিকম্প মারাত্মক ভাঙচুর করে দিয়ে গেছে। বিপর্যস্ত জীবনকে আবার যাহোক কিছু একটা গ্রহণযোগ্য পরিণতিতে আনতে শ্লীলতা, শিষ্টাচার ও বিচারের মধ্যে রাখে না। বিপর্যস্ত বিচারবোধে বাজিকরপাড়ার কোনো সমর্থ পুরুষমানুষই তার আহ্বান থেকে বাদ যায় না, এমনকি আকালুও নয়, এমনকি সামর্থ্য যার প্রান্তিক সীমায়, এমন মানুষও নয়।

পুরুষেরা প্রথমে সহানুভূতিতে তারপর বিরক্তিতে তাকে এড়িয়ে যায়। মেয়েরা প্রথমে তার দুঃখে সহমর্মিতা বোধ করত, তারপর তাকে রসিকতা করত, শেষপর্যন্ত তারা তাকে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করল।

পলবি শা-জাদিকে ধরে, তুমার ব্যাটাক বল হামা বিহা করবা।

আচমকা এরকম প্রস্তাবে শা-জানি একটু হকচকিয়ে যায়। তারপর বলে, তুই-ই বল।

হামার নাজ নাগে।

কেন্তু শারিবা তোর ছোটই হবে, লয়?

য়েঃ, অত্তোবড় জোঁয়া!

হামি বয়সের কথা ক-ছি, পলবি।

ছোট হোবে নাঃ, সোমান সোমানই হোবে।

এটা কি আমার বলা ঠিক? ছাওয়াল জুয়া হইছে না?

ছাওয়াল তুমার, তুমু ছাড়া কবে ক্যায়?

ঠিক আছে, ছাওয়ালের বাপে বলি দেখম।

তখনকার মতো নিষ্কৃতি পায় শা-জাদি। সেদিন বিকেলেই সে রূপার বাড়িতে আসে।

শারিবার বাপ ঘরেৎ আছে?

শরমী খেজুরপাতার চাটাই বিছায়।

বসে দিদি, বসেক্‌।

শা-জাদি বসে। বলে, না বুন, বসার সোমায় নাই হামার। সিদ্ধ ধান শুকাচ্ছে হামার, কুটবা হোবে।

রূপা এলে সোজাসুজি শা-জাদি তার মুখের দিকে তাকায় না। একটু পাশ হয়ে থাকে। বলে, এতোদিন তো ঘুরি বারালে বাজিকর, ছাওয়াল হামি পালনো।

ঘুরি বারাই নাই, শারিবার মাও, পালাই বারাছি।

হঁ, সিতো দেখবাই পাছি। একা পালাই বারানোতে জুত হচ্ছিল না, তাই কার ঘরেৎ সিধ কাটি চিড়িয়া ভাগালেন আর দোকা হলেন হয়।

রূপা বলে, ই দেখেন, ই দেখেন, এলা কথা এখুন আবার ক্যান। ছাবাল কুন্‌ঠি বা আছে। ইসোব কথা কানে গেলে শরম যাবি।

হুঁ, ছাবাল শরম যায় যাক, বাপের শরম না গেলেই হয়, লিলাজ বাজিকর!

হাটে মেলায় যে রূপা অমন লম্বা বক্তৃতা করে, এখন একেবারে কোণঠাসা হয়ে যায়। শরমী খালি হাসে। রূপা বলে, এই দেখেন, মেয়া মানষির মুখেৎ আগল নাই।

তো সি যাক, এখুন কথাটা কি শুনি?

ছাবালের বিহা দিবার হোবে না? সিটাও হামি দেখম?

হঁ তো, সিটা তো ঠিকেই। তো নওরিঁ দেখ।

নওরিঁ হামি দেখম’ আর লতুন ‘বিয়ের’ ঘরে তুলবো তুমু বাজিকর? লতুন ‘বিয়ের’ তুমার সেবা কইরবে, যতন কইরবে, তুমু কোলে শোকর লাচাবা, লয়? বাজিকর এমুন স্বার্থবাদী হয় বটে!

না, না, আমরা সোব্বাই খোজম।

কুন্‌ঠি? বাজিকরের ঘরে ময়া নাই। যি ক-টা আইবুড়া আছে তারাদের মাওবাপ আগভাগেই বেটার বাপদের সাথ কথা করি রাখিছে। তা-বাদে আরো পাঁচটা আবিয়াৎ জুয়া আছে, তার মাঝে হামার শারিবা এটা। ইয়াদের নওরিঁ কুন্‌ঠি জুটবে? ইসোব হিসেব হামার করা সারা।

তবি তত ভারি গোল!

ই গোলের লিদান হামি দিম? ছাবালের যতদিন মাও ছিল, ছিল। মাও গেল তো বাপ আলো তালুই হ-য়া। শারিবার কপালে বুঝি আর নওরিঁ জুটল না, হায়!

হঃ ভারি আমার বুঝদার হছেন। মেয়র আবার অভাব! এমুন জুয়া বেটা হামার বিটিগুলা হামলাচ্ছে—

মুখেৎ আগল আঁটেন, বাজিকর। কথা যিটা বলনো, খ্যাল রাখেন আর সর্দারের সাথ শলা করেন। ই ক-বছর বাজিকরপাড়ায় বিটি ছাবালের মড়ক চইলছে। অনেকগুলা মেয়া এবার ওধার হোই গিছে। হিন্দু সমাজ হামরাদের লেয় না, মোছলমান সমাজও হামরাদের লেয় না। কুন্‌ঠি যাম’ হামরা? ইসব কথা এখুন ভাবা করেন, বাজিকর।

ওঠার আগে শা-জাদি শরমীকে বলে, তুমাক এটা কথা বলি যাই, বুন। পলবি আবাগী বড় ছোঁক ছোঁক করবা লাগিছে। ছাবালের খোরৎ ও আগুবা দিবা না।

 

৪৭.

মোহর গ্রামে চার ঘর মাত্র ব্রাহ্মণ, ছয় ঘর কায়েত, নতুন বসতির বাজিকররা বাদ দিলে বাকিরা সদগোপ, মাহিষ্য ও কৈবর্ত। কৈবর্তদের মধ্যে আবার দুই ভাগ আছে, একদল হালুয়া, অন্যদল জালুয়া। একমাত্র জালুয়া কৈবর্ত্যরাই ‘জলচল’ নয়। অবশ্য বাজিকরদের বিষয় একেবারেই স্বতন্ত্র। মোহরের পাশের বাদা-কিসমৎ নমোশূদ্র ও মুসলমানপ্রধান গ্রাম। বাজিকরদের বসতি এই দুই গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায়, দুই গ্রামেরই প্রত্যন্তে। নমোশূদ্ররাও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে জলচল নয়, কিন্তু বাদাকিসমতের ভৈরব মণ্ডল ইত্যাদি কয়েকজন নমোশূদ্র বেশ বর্ধিষ্ণু এবং দাম্ভিক। ভৈরবের বা ভায়রোর কয়েক পুরুষের রেহানি কারবার, এখনো তেজি। ভায়রো এখনো ঘোড়ায় চড়ে মহালে যায়।

চার ঘর ব্রাহ্মণের মধ্যে তিন ঘরই বর্তমানে ভূস্বামী। চার ঘরই এখানে ভাগ্যান্বেষী হয়ে এসেছিল। মাত্র এক ঘর এখনো যজমানী করে, অন্য তিন ঘর সম্পন্ন গৃহস্থ। সবারই সম্পদের উৎস যজমানী এবং সুদের কারবার।

এছাড়া প্রত্যেক গ্রামেই আছে কয়েক ঘর করে সাঁওতাল কিংবা ওরাওঁ বসতি।

এই বিন্যাসে যে যার নিজস্ব বৃত্তে থাকে। ব্রাহ্মণ ও কায়েতরা যেহেতু সংখ্যায় কম, কাজেই অন্যদের সঙ্গে সামাজিক বিরোধ এড়িয়ে চলে। সবচেয়ে শক্তিশালী ভায়রো তার সমাজের বাইশ ‘দিগর’-এর মাথশ। দিগরের মজলিশ কিংবা জমায়েতে সে এখনো বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে পুরুষানুক্রমিক ক্রোধ প্রকাশ করে। বন্নাল হামরাদের জাত মারি রাখি গিইছে। হামারা তো জাত-মরা ছিলাম না। বল্লাল হামরাদের সাথ আঁটবা পারছিল না, তাই জাতে মারে। শোনা যায় তার পাঁচ হাজার বিঘা জমি। অবশ্যই তার সম্পদের মূলে মাথা হিসাবে এই বাইশ দিগর ও তার বাইরের নমোশূদ্রদের শোষণ। কিন্তু জাতপ্রীতি তাকে তার দিগরের সঙ্গে একাত্ম রাখে ও সম্প্রদায়ের মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রভৃতি অক্ষুন্ন রাখে। নমোশূদ্র হিসাবে হীনমন্যতা নেই। সে কারণেই আরো অনেকের মতো সে ‘সরকার’ কিংবা ‘দাস’ হয়নি, এখনো মণ্ডলই আছে। অবশ্য মণ্ডল থাকার একটা সুবিধা এই, জলচল মাহিষ্যদের থেকে অজানা লোক তাকে পৃথক করতে পারে

ওমর নামে বাজিকরদের একটি তরুণের সঙ্গে নমোশূদ্রপাড়ার মালতী নামে একটি মেয়ের গোপন প্রণয় হয়। অবশেষে যুগলে পালায়, কেননা তাদের সামনে স্বাভাবিক পরিণতির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। নমোশূদ্র যুবকেরা বাজিকরপাড়া তছনছ করে এবং শেষপর্যন্ত মালতীকে না পেয়ে ইয়াসিনকে ধরে নিয়ে আসে ভায়রোর কাছে।

ভায়রোর সমাজ যদিও ‘জলচল’ নয়, তবুও তার বিরাট বিস্তৃতি আছে। কাজেই ঠিক মহিমবাবু কিংবা লালমিয়ার মতোই সেও জানতে চায়, তোমরা হিন্দু, না মুছলমান। সেই পুরনো প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন, যাকে বাজিকর সিঁদুরে মেঘের মতো ভয় পায়।

ভায়রো আবার বলে, তুমার ঘরের এটা ছেড়া হামার ঘরের এটা ছেড়ি নিয়া পালাবা পারে, ইকে বয়সের দোষ, কি, বয়সের গুণই কবা পার। কেন্তু সিটা কথা লয়, বড় কথা হল, তুমরা হিন্দু না মুসলমান?

এ প্রশ্নের উত্তর বাজিকর দশ বছর আগেও দিতে পারেনি, এখনো পারে না। ইয়াসিন চুপ করে থাকে।

ভায়রোই আবার বলে, কোন বল্লাল তুমাদের জাত মারোছে, হামার জানা নাই। তবি মারটা বড় কঠিন বটে। এ

ইয়াসিন জানত, নমোশূদ্র উচ্চবর্ণের হিন্দুর কাজে বেজাত। সে শেষপর্যন্ত একটা মুখের মতো আবেদন করে, হামরার্দের আপনার জাতে তুল্যে লেন, মালিক। শুন্যাছি আপুনি দিগরের মালিক সমাজ আপনার কথা শোনবে।

ভায়রো প্রচুর হাসে। বলে, বাইশ দিগর হামা নমোশুদদুর বানাবার হক্ দেয় নাই বাজিকর। হিন্দুধর্মে এমুন হক্ কেরো নাই। তুমু ব্রাহ্মণ, কায়েৎ, মাহিষ্য, সদ্‌গোপ, নমোশুদদুর কেছুই হবা পারবা না। তুমু ইসব জাতের হয়া জন্মবা পার, হবা পারো না।

ইয়াসিনের সঙ্গে বাজিকরপাড়ার কয়েকজনও এসেছিল কর্তব্যের খাতিরে। তাদের মধ্যে থেকে শারিবা এগিয়ে এসে বলে, সবই তো বোঝনো, মালিক। এখুন বিচারটা করবা হয়।

ভায়রো লঘু পরিহাস ছেড়ে তার দিগরের নেতৃত্বের ভূমিকায় মুহূর্তেই ফিরে আসে। গলা চড়িয়ে বলে, বিচার হামার করাই আছে। মেয়াক খুঁজি আনা করাও আর উ মেয়ার বিহার যা খরচা লাইগবে, তা উ বাজিকরের বেটা জরিমানা দিবার হোবে।

কথা বলে লাভ নেই। তবুও শারিবা বলে, মালিক, বাজিকর নেংটা গরিব। ভিখ মেঙ্গে খায়। অত্তো টাকা কুন্‌ঠি পাবে? ইবারটা মাপ করি দেন।

টাকা দিবে আজুরা মণ্ডল। সি তো তুমাদের বসত করাইছে। তবি কি কড়ারে দিবে সিটা তার সাথ বুঝ কর।

কি শর্তে আজুরা টাকা দেবে, তা জানে শারিবা। জানে অন্য সব বাজিকরেরাও। মুখ নিচু করে ফিরে আসে সবাই। শেষ চেষ্টা, আজুরা যদি মধ্যস্থতা করে ভায়রোর সঙ্গে।

কিন্তু আজুরা তাতে রাজি হয় না। ভায়রো সর্দারকে সে ভালোমতোই চেনে, ভয়ও পায়। আর তাতে তার লাভই বা কি?

দিনসাতেক পরে রাতের অন্ধকারে ওমর শারিবার কাছে আসে।

শারিবা, হামাক্ বাঁচা।

শারিবা চুপ করে থাকে।

আকালু বলে, তুমার বাঁচন নাই।

শারিবা, হামরা বাঁচা।

এবার শারিবা চোখ তুলে তাকায়।

মেয়াটা ফিরোৎ যাবি না?

না শারিবা, না!

তোর সাথ থাকবি?

মাইরে ফালালেও মালতী ফিরোৎ যাবি না।

ভায়রো অংকা হোবার দিবি না। ভায়রো তোর লাশ ফেলি দিবি। আকালু বলে, ভায়রোর জাতের অহঙ্কার বড় ভোয়ানক!

দিগরপতি ভায়রো নিজের জাতের মধ্যে কোনো বেচাল সহ্য করবে না। দিগরের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তার রেহানি কারবার। সুদ আদায়ের ব্যাপারে সে নির্মম, কিন্তু তার সামাজিক অনুশাসনও মানতে হয় তার জাতের প্রত্যেকটি লোককে। শারিবা এ সমস্যার কথা আগে বোঝেনি। মালতীর ফেরত নিয়ে যে সমস্যা দাঁড়াতে পারে, একথা সে চিন্তা করেনি। আছিস কুন্‌ঠি?

দহের ভাঙা নৌকায়।

ওমর ফিসফিস করে বলে। মাইল দুয়েক পুবে জনহীন প্রান্তরের মধ্যে অনেকখানি অঞ্চলকে ভেঙে বাঁক নিয়েছে। পাতালু। পাতালু সেখানে গভীর। জেলেদের দু-খানা ভাঙা নৌকা সেই বাঁকে পড়ে আছে। সাপের ভয়ে মানুষ সেখানে যায় না! ওমর সেখানে লুকিয়ে থাকে মালতীকে নিয়ে।

খাস কি?

একবেলা মাও যায় নুক্‌কে।

আজ ফেরৎ যা। কাল আমি যাম।

পরদিন শারিবা ভায়রোর কাছে যায়। অনেকক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কেননা সকালের এ সময়টা ভায়রো বিনোদ সরকারের কাছ থেকে রেহানির হিসাব বোঝে। হিসাব বোঝা শেষ করে বাইরে আসে না। হঠাৎ শারিবা ভয় পায়। ভায়রো সর্দারের চেহারাটা বিরাট। লম্বা কঁচাপাকা চুল পিছনে খোঁপা করে বাঁধা। কপালে লম্বা সিঁদুরের তিলক। চোখের দৃষ্টি এত তীব্র, মনে হয় ভিতর পর্যন্ত দেখে ফেলছে। প্রথম প্রশ্নতেই সে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

খোঁজ পাওয়া গেছে?

শারিবা চুপ করে থাকে। ব্যাপারটা সে গোপন রাখতেই মনস্থ করেছিল। কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে এই ভীষণ লোকটা মুহূর্তেই সব কিছু বুঝে ফেলে।

কুন্‌ঠি আছে।

শারিবা আরো দুর্বল হয়ে যায়। তার গা ঘামে, হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

রাও কাড়ে না, ঠসা নাকি?

ভায়রো গর্জন করে ওঠে। যেন বাঘের সামনে শারিবা, যেন বুদ্ধি নষ্ট শারিবার। সে স্থির হবার চেষ্টা করে। ভায়রোর চোখের দিকে তাকায় চোখ তোলে। চোখ নামায়।

খোঁজ পাই নাই, মালিক। শারিবা কথাটা বলে, একটু সাহস ফিরে পায় যেন। একটু দম নেয়, তারপর আবার বলে কেন্তু খোঁজ পালেও মুশকিল, মালিক। আজুরা মণ্ডল টাকা দিবার রাজি হচ্ছে নাই।

হা-রা-ম-জা-দা।

ভায়রো চুলের মুঠি ধরে শারিবার। মাটি থেকে টেনে শূন্যে ওঠাতে চায় যেন।

হারামজাদা, মিছা কথা আমার কাছে!

একটা চড়ে শারিবার মাথার ভেতরের সব কিছু নড়ে যায় যেন। কোথাও মাথার শিরা-উপশিরায় সাপের ছোবল লাগে তার।

কুন্‌ঠি আছে?

শারিবাকে ছেড়ে দিয়ে দৈত্যের মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ভায়রো। শারিবা এবার সোজাসুজি তাকায়। তার চোখের যাযাবরী হল্কা আগুন কাঁপছে।

হামার জানা নাই, মালিক।

জানবা হোবে। আজ ছাড়ি দিলাম। দু-দিনের মধ্যে খবর চাই।

শারিবা কয়েক পা পিছিয়ে আসে, তারপর হাঁটতে থাকে। ক্রমশ তার হাঁটা দ্রুত হয়, তারপর সে ছুটতে থাকে। সমস্ত শরীর তার অপমানে জ্বলছিল। সে দিশেহারার মতো দৌড়াচ্ছিল সামনের দিকে। কোথায় যাচ্ছে, কোনো কাণ্ডজ্ঞান

 

৪৮.

বাদা-কিমৎ একটি যুক্ত গ্রাম। এর বাদা অংশে নমোশূদ্রদের প্রাধান্য আর কিসমৎ অংশে মুসলমানদের। নমোশূদ্রদের যেমন ভায়রোই একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানুষ, মুসলমানপাড়ায় তেমন নয়। সেখানে বেশ কয়েকজন অবস্থাপন্ন গেরস্থ আছে। তার মধ্যে দু-ঘর হাজি। দেশভাগের ফলে বেশ কয়েক ঘর গেরস্থ ওপারে চলে গেছে জমি বদল করে, সেখানে কয়েকঘর হিন্দু এসেছে। এতে মুসলমানপাড়ায় মুসলমান প্রাধান্য কিছুটা কমেছে। ভালো অবস্থার কোনো গেরস্থই দেশ ত্যাগ করেনি। উভয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিতে সান্তাহার রেলস্টেশনের দাঙ্গা এখনো গোপন ত্রাস।

কিসমতের হাজি খেসের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। নদীতে ওজু করতে গিয়ে সে শারিবাকে নির্জনে বসে থাকতে দেখে। কায়িক পরিশ্রমে যারা বেঁচে থাকে, এরকম আধ্যাত্মিক নির্জনতা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক নয়।

কে তুমু, বাপো?

শারিবা, শারিবা বাজিকর।

চোখে পানি ক্যান, বেটা?

চোখের জল এরপরে আর কোনো বাধাই মানে না। হাজি শারিবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।

দেশভাগের পর সমষ্টিগতভাবে মুসলমান এদেশে দুর্বল হয়ে গেছে। উপরন্তু, ওপার থেকে যেসব হিন্দুরা এসেছে তাদের আক্রোশ ও জ্বালা নিভবার কোনো লক্ষণ নেই। উসকানি দেবার লোকের অভাব কোনোদিন কোথাও হয় না। হাজি খেসের সমাজপ্রধান হিসাবে সদাই শঙ্কিত থাকে। শারিবাকে সে বোঝায়, ইসলামে জাতপাতের বালাই নেই। কাজেই বাজিকর মুসলমান হলে ধর্ম পাবে, সমাজ পাবে, স্বজন পাবে। পড়ে পড়ে মার খাওয়ার কিবা অর্থ হয়। তুমার বাপকে বল, ইয়াসিন সর্দারকে বল, সব বুঝ করি রাজি হওতো মৌলভী বুলা করাই, কলমা পড়ার ব্যবস্থা করি।

একজন বিধর্মীকে ইসলামে দীক্ষিত করলে হজ্জের সমান পুণ্য। কিন্তু হাজি খেসের-এর নজর সেদিকে নয়। স্বজন কমে গেছে, বাড়বে না, কিন্তু স্বধর্ম বাড়বে।

শারিবা বলে, ওমর-মালতীকে কলমা পড়াবা পারবেন, হাজিসাহেব?

মালতীর কথায় ভেসের বিপন্ন বোধ করে। দিগরপতি ভায়রোর সঙ্গে বিরোধ করতে যাওয়া কোনোমতেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মালতী-অপহরণ বৃত্তান্ত এ অঞ্চলে সবাই জানে। তার সঙ্গে ভায়রোর শর্তের কথাও জানে। এসব ব্যাপার ক্রমশ বেশি বেশি করে সম্মানের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ভায়রোর রোখ বাড়ছে। এতক্ষণ শারিবার সঙ্গে কথা বলে খেসের এসব বুঝতে পারে।

মালতীকে ছাড়বা হোবে, বেটা। তুমরা মুসলমান হলে কেরো কেছু যাবে আসবে না, কেন্তু মালতীর বেলায় কি কথা খাটে না।

ক্যান্?

তার সোমাজ আছে, নিয়ম আছে।

হামার নাই?

দুঃখ করে না বাপো। নিজের কাছে শুধাও!

ওমরের কাছে যাওয়া হয় না শারিবার। কী আশ্বাস নিয়ে যাবে? খেসেরকে বলে, আপনার কথা বাপোক্ কমো, সর্দারোক্‌ কমো।

 

সন্ধ্যার পর অন্ধকারের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে পাড়ায় ঢোকে শারিবা। শারিবা ভায়রোর কাছে মার খেয়েছে, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই এখবর চাউর হয়ে যায়। রূপা সহ কয়েকজন তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। শারিবা ফিরতে রূপা নির্বাক হয়ে বসে থাকে। শারিবার মুখ নিচু কতকাল আগে জমির বাজিকর মার খেয়েছিল? পাটখেত নিড়ানি ঠিকমতো দিতে না পাড়ার জন্য মার খাওয়া, মোষের পায়ে চোট দেওয়ার জন্য মার খাওয়ার সঙ্গে আজকের মার খাওয়ার তফাতটা সবাই বুঝতে পারে। তার সঙ্গে যেন একটা অপরাধবোধ ছিল, যা মানুষকে অনেক অত্যাচারও মেনে নিতে সাহায্য করে। আরো ছিল জামিরের রোখ।

সময়ের স্রোত অনেকখানি রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। জামির বাজিকরের তৃতীয় পুরুষ শারিবা নিজেকে কখনোই এখন আর যাযাবর ভাবতে পারে না। শ্রমের মধ্যে নিয়োজিত অস্তিত্বকে সে বিপন্ন দেখতে পারে, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আর ভবঘুরে কল্পনা করতে পারে না।

অন্ধকার আরো গাঢ় হলে প্রায় সবাই আসে রূপার আঙিনায়। ইয়াসিন বলে, এমুন দিন এসবে, জানতাম। বুঢ়াগুলা তো আগেই বলি গিছে। তুমার বাপ বলিছিল, বাজিকরের বেটারা, জানবার হয়ো না। তা ইবার বোধহয় বাজিকর জানবারই হোই যাবে। একজন তরুণ বলে, ক্যান্? বাজিকরের ধরম নাই! এভোবড় দুনিয়ার বেবাক মানষিক হয় ভগবান, লয় আল্লা, লয়তো যিশু বানাইছে। তো ই বাজিকরগুলো কি এংকা আসমান ফুড়া বারাইছে? আরেকজন বলে, বাজিকরের বিটি পাট খ্যাতে চিৎ করা চলে, বাজিকরের বিটি লুঠ করা চলে, ঢেমনি বানাবার চলে, আর বাজিকরের ব্যাটাক্ জামাই করা চলে না।

আঃ থাম্। শরমের কথাগুলো নিয়া চিল্লাইস না!

নাঃ চিল্লাবে না, নুক্ করে থাকবে!

হাঁ নুক করে থাকবু, হারামজাদা। চিল্লায়ে কুত্তি যাবু? মোনোৎ নি, পাঁচবিবি ঠেঙে কুত্তাখো কেমন হলু?

শুধু রূপা চুপ করে থাকে। শারিবার গায়ে হাত দেওয়ার ব্যাপারটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। তার চোখে রক্ত ঝলসে উঠছে বারবার। আঃ শারিবা, ডায়রো সর্দাবোক ছাড়ান নাই। সে মনে মনে এমন চিন্তা করছিল। তার যাযাবর রক্ত তাৎক্ষণিক চরিতার্থতা চাচ্ছিল। পাঁচবিবির রক্তাক্ত স্মৃতিতে সে তর্পণ করেছিল এবং তার স্বভাব অনুযায়ী ঘটনার গতি ধরে আগাম চিন্তা করতে সে রাজি ছিল না।

ইয়াসিন এবং তার সমবয়সীরা রূপাকে চেনে। রূপার নির্বাক ছটফটানি তারা দেখে ও শঙ্কিত হয়। পাঁচবিবির দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি।

রূপা কেছু কতা কও না যি?

কি কমো?

দশঝনে বসি এ্যটা বিহিত কেছু করবা হয়।

কি বিহিত করবা? ভায়রো সর্দারের সাথ বিবাদ করবা?

ভায়রোর সঙ্গে বিবাদ! পাগল না হলে একথা কেউ ভাবে না।

না, বিবাদ লয়—

তবি কি আশ্নই?

ওভাবে কথা হয় না। রূপার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ। শারিবা বলে, মামা, খেসের হাজি এটা কথা কলেন। কথাটা ভাবা লাগে।

কি কথা, বেটা?

হিন্দু সমাজ হামরাদের নেবে না, কেন্তু মুছলমান সমাজ নেবার পারে।

কেম্‌কা?

কলমা পড়ে মুছলমান হলো—

খবরদার, শারিবা, ওলা কথা মুখে আনবুনা। হামি হিন্দু, হামার ঘরোৎ বিষহরির vট আছে, হামার বেটা হয়্যে তুইও হিন্দু।

রূপা ফুঁসে ওঠে। তার অজ্ঞাতবাসের জীবনে সে হিন্দুসঙ্গ করেছে, হিন্দু মেয়েকে নিয়ে এখন ঘর করছে। তার সংস্কারের মধ্যে হিন্দুত্ব ঢুকে গেছে। সে বিষহরির গান গায়, ঘটপূজা করে, রাজবংশীদের কালীপূজা এবং গম্ভীরার উৎসবে যোগদান করে। শারিবা চুপ করে থাকে।

কিন্তু ইয়াসিন বলে, ক্যান্ মুছলমান হলে দোষ কি। তমো, এটা কোট ধরা থাকা। শালো বাজিকর, শালো বেজাত’ আর শোনবা হবু না। বেটাবেটিগুলা বিহার ঘর পাবু, হামরা পামো সমাজ।

এতো সস্তা লয়, এতো সস্তা লয়।

লয় সস্তা তো, আত্রাই হয়লো। কেরমে কেরমে হোবে। মুছলমানের ঘরে ঝামেলা কম, বাছবিচার কম। হামারদের পড়তা হোবে।

বাদবিতণ্ডা এবং কোলাহল শুরু হয়। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে। ভিড়ের মধ্যে কখন একসময় ওমর এসে স্থান নিয়েছে কেউ টের পায়নি। সে বলে, আমার কি হোবে, ইয়াসিন চাচা? আমি তো মরে গেলাম। কেউ একজন তাকে উপদেশ দেয়, তুই মোছলমান হোই যা, ওমর। তবি ভায়রো আর তো ছোবার পারবু

আর মালতী?

তাকও মোছলমান বানা।

শারিবা বলে, সিটা হোবার লয়। বাজিকর মোছলমান হোবার পারে, মালতী পারে না। ক্যান?

আঃ হা!

তবি?

নাজবাব।

তবি আমি কি করছো? পাঁচকুন, হামাক্ বাতায়া দ্যান। পালায়া হামি কতদিন বাঁচমো? কি খামো? কুথা যামে?

কী আফসোস! যে সমাজে কোনো বন্ধন নেই, সেখানে কে কার দায়িত্ব নেয়? যে যার নিজের জ্বালায় জ্বলছে অহর্নিশ, অন্যের হেপা কে সামলায়?

ক্যায় কইছিল তুমাক্ হিদুর মেয়ার সাথ পিরিত করবা? শালো হারামজাদা, নিজে ম-লি, হামরাদেরও মজালি!

ক্যান, কি খারাপটা করলু হামি?

খারাপটা করো নাই শুয়োরের বাচ্চা, বাজিকরের ঝন্যি দোতলা দালান বানাবার বেবস্থা করিছ।

চড়ের শব্দ, চিৎকার। ওমরের ভাঙা গলায় আক্ষেপ।

তুমরা হামা তাড়ায়া দিবার চাছেন, চাচা? কুন্‌ঠি যামো হামি?

যিথায় খুশি সিথায় যাও। মোহরের ই বসতিৎ আগুন জ্বলবার আগে ভাইগে যাও।

হাঁ ভাইগে যাও, হামরা তুমার খিদমৎ করবা পারমো না। এক উপা বাজিকরের মদ্দানিৎ পাঁচবিবির বাস উঠল হয়, কোত্তোগুলা পরান গেল, আর লয়, আর পারমা না।

তোর পাও ধরি চাচা, হামা মারা করিস না। হেই শারিবা হামা বাঁচা।

বাঁচামো তুমা? হারামজাদ, হিদুর নাং পুষার সখ হইছে তুমার!

অন্ধকারের মধ্যে প্রহারের শব্দ। ওমরের আর্তনাদ। সব মিলিয়ে সবাই বুঝতে পারে ওমর সত্যিই কতখানি সর্বনাশ ঘনিয়ে এনেছে। বুঝবার বয়সের সবার স্মৃতিতেই পাঁচবিবি এখনো জীবন্ত। আর একবার নয়, আরেকবার কিছুতেই নয়। কয়েকজন নির্মম হয়ে ওঠে, অন্যরা নির্বাক হয়ে থাকে, বাধা দেয় না, ওমর মার খায়। শারিবা তুই হামা বাঁচাবু বলিছিলি। তুই হামা দেখলু না। শারিবা মুখ নিচু করে থাকে। ওমর অন্ধকারের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যায়।

ওমর চলে যেতে একটা স্তব্ধতা নামে, একটা লজ্জা ও বিষাদের স্তব্ধতা। শুধু একজন রমণী বিনিয়ে কাঁদে, সে ওমরের মা। একে একে সবাই চলে যায়। অন্ধকারের মধ্যে শারিবা আচমকা রূপাকে লাড়িয়ে উঠতে দেখে। রূপা দ্রুত সপরিবার কাছে আসে।

তুই মোছলমান হবি?

কেছু ভাবি নাই।

ভাবার দোরকার নাই।

ভাবার দোরকার আছে, বাপ।

না।

বাপ, আর কুন্‌ঠি পালাবু?

আঃ!

ভায়রো সর্দার তোর গায়ে হাত দিছে! ভায়রো সর্দার উপা বাজিকরকে চিনে না!

বাপ!

রূপা দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে যায়। শারিবা শঙ্কিত হয়। রূপাকে সে চেনে। সে অত্যন্ত অস্থির রক্তের মানুষ। ভয়ঙ্কর কিছু না ঘটলে সে স্বাভাবিক হয় না।

অনেক রাতে শারিবা রূপা ও শরমীর দ্বৈতকণ্ঠে বিষহরির গান শোনে। দু-জনের কণ্ঠেই নেশার ক্লান্তি। বিষহরির গান বাজিকরেরা গায় না। শুধু রূপা গায়। পলাতক জীবনে নতুন সংস্কার নিয়ে এসেছে রূপা, সেই সংস্কারকে সে রক্ষা করতে চায়। শারিবা শুয়ে শুয়ে গান শোনে, যে গান সে কিছুই বোঝে না, তবু ভালো লাগে।

মেনকা বলে ওগো বাপ
বড় পালু মনস্তাপ
কেনে আইলে বেললি ছাড়িয়া
অমূল্য রতন মোর
ভাসিয়া যায় সাগর–
কি ধন আইলেন বাড়ি লইয়া
তোর যত ধন জন
সপ দেখি অকারণ–
কুড়লে চিরিম তোর নাও,
সুন্দরি বেললি মোর
ভাসিয়া যায় সাগর
ছয় পুত্র মোর নাজুড়া গাও
মৎস্য মকর ঘড়িয়াল
শিশু চরে পালে পাল–
উঠিয়ে মৃত্যু খাইবার আশে,
দেখিয়া বিপরীত
হইবে চমকিত—
পরান জারি তারাসে।
বাপের প্রাণ ধন
মাইয়ের জীবন–
ভাই-এর প্রাণ সোয়াগিনি
হারাইলাম নিধি
আর পাব কৃতি–
চক্ষে বহে মন্দাকিনি।

 

৪৯.

সব বাজিকর জানে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও সব বাজিকরই এখনো রহু চণ্ডালের হাড়ের স্বপ্ন দেখে মনে মনে ও বিশ্বাস করে তার সার্থক অস্তিত্ব সম্ভব।

রহু চণ্ডালের হাড়। তার সঙ্গে সম্পর্ক ঘোর অমাবস্যার। শুধু পীতেম ও জামিরের মতো শারিবা জানে রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূখণ্ডের ফলপ্রসূ মৃত্তিকার গভীরে, যে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি খুঁজে বের করবার জন্যই বাজিকরের এই ভূ-পরিক্রমণ। তার সমস্ত স্থিতি, স্থায়িত্ব, স্বস্তি ও শান্তি হবে সেই ভূ-খণ্ডে। সব বাজিকর নিজস্ব বোধবুদ্ধিমতো সেই হাড় খোঁজে।

কেউ খুঁজে না পেলেও পলবি যেন খুঁজে পায় সেই জিনিস। কয়েক মাসের মধ্যে তার প্রেতিনীর মতো চেহারায় আশ্চর্য পরিবর্তন আসে। রহুর হাড়ের অদৃশ্য স্পর্শে যেন তার শরীরের হারানো সম্পদ ফিরে আসতে থাকে। এত দ্রুত ও অবিশ্বাস্য নিয়মে সে নিজের রূপ-যৌবনকে ফিরে পায় যে লোকে এর পিছনে রহুর ইন্দ্রজাল ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না।

হাড়ের আসল ভেলকি তারপরে শুরু হয়। যেসব রমণী তাকে পরিহাস করত অথবা মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিত, পলবি এখন তাদের স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে খেলা শুরু করে। মর্মান্তিক খেলা। বাজিকরের সমাজে জামির যেসব বিধি-বিধান ও শৃঙ্খলার প্রবর্তন করেছিল, সব যেন তছনছ হয়ে যায়। পলবি তার জীবনের যাবতীয় লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে থাকে তার স্বজনদের উপর। সমর্থ সব পুরুষকে সে আকর্ষণ করে। এর মধ্যে কোনো গোপনীয়তা সে রাখতে চায় না।

ফলে ঘরে ঘরে অশান্তির অশ্লীল কলহ বাড়ে। বাজিকর যুবকেরা তার স্কুল ঠোঁট, টোল পড়া গাল, ছোট অথচ তীব্র চোখের মধ্যে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাওয়ার আদিম আহ্বান শোনে। পলবি এখন কলহাস্যে কথা বলে, রাস্তা দিয়ে হাঁটে অস্বাভাবিকভাবে, দু-হাত ও শরীরে দোল দিয়ে প্রকাশ্যেই আহ্বানের কটাক্ষ করে প্রত্যেকটি সমর্থ পুরুষকে।

আকালু বলে, শারিবা, রহু চণ্ডালের হাড়ের ভেলকি দেখিছিস?

রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে পলবি হঠাৎ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ, হামা ছাড়ি সব্বাইকে লাগ।

সে অশ্লীলভাবে হাসে।

আকালু বলে, লাগ্যেছে, হামার লাগ্যেছে। কিন্তু শারিবার যি লাগে না পলবি?

পলবির উচ্ছলতা দপ করে নিয়ে যায়। বলে, লাগবে আকালু, লাগবে।

কেরমে কেরমে লাগবে।

তেমনি দুর্বিনীত ভঙ্গিতে সে হেঁটে যায়। শারিবা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। শা-জাদি পলবিকে বলে, এলা হ-ছেটা কি?

কি হ-ছে?

বাপের নাম হাসাছো!

বাপ? মানুষে যখন মোক্ লুটে নিল, তখুন বাপ কুন্‌ঠি আছিল?

তা এখুনতো ফিরা আছিস, এখন দেখভাল করে বিহাসাদি কর। না, খালি ঘরে ঘরে অশান্তি লাগাছে!

ক্যান, তুমার বেটার সাথ সাদির কথা কছিলাম না? তখন কি কছিলা?

ক্যান? সাতঘাটের জল খাওয়া মাগি মোর বেটা বিহা করবা যাবে কোন দুঃখেত?

তো সাতঘাটের জল খাওয়া মাগি আর ধম্মের কথা না শোনালেই পার। বাজিকরের মেয়ামানষের আবার লাম্বাচওড়া কথা!

থাম্ হারামজাদী ধাম। লয়তো বারুন দে বারায়ে মুখ ভাইঙ্গে দিমো। নিলজ্জ, বেহায়া মেয়েমানুষ! আসে আইজ তোর বাপ

বাপ আইসে মোর করবেড়া কি? মুই বাপের খাই, না পরি? হামা হামার মত থাকবা দি।

শরমী এবং পলবি প্রায় একবয়সী। সেজন্যই হোক, অথবা দু-জনেই রূপসী বলে হোক, কিছুটা অন্তরঙ্গতা জন্মেছিল তাদের মধ্যে।

শরমী বলে, খালি চাইখে বেড়াছেন, ইবার আন্ কথা ভাবেক।

আন্ কথা?

থিতু হবার কথা।

দুনিয়ার মাষে এত্তোকাল হামাক চাখল, এখুন মুই তারাদের ছাইড়ে দিমো?

তো কি করবি? ঘর ঘর আগুন লাগাবি?

তোর ঘরেতো লাগাই নাই।

সাহস আছে?

ডর দেখাস না, শরমী। উপা বাজিকর এখুনো বুড়া হয় নাই।

হঁ, বাপও জুয়ান, বেটাও জুয়ান, কান্ ধরবি?

শরমী পলবির চোখে চোখে তাকিয় থাকে। শারিবা সম্পর্কে পলবির দূর্বলতার কথা অজানা নেই কারো কাছেই।

হঁ, মোর আর কাম কি? বাপ বেটা য্যান দুই ভাই, দোনোজনকে তাতাব।

বাপরে যদি বা পারিস, বেটাকে পারবি না, পলবি।

পলবি ফেস করে ওঠে, ক্যান, শারিবা কোন বারের বেটা যি এত হংকার?

শরমী হাসে। বলে, উয়া ছুবার পারবি না, পলবি। উ আন্দা মনিষ্যি।

ক্যান, উ আন্দা মনিষ্যি ক্যান, শরমী? ক্যান, উ আর দশটা বাজিকরের মত লয়?

শরমী এবার গম্ভীর হয়ে বলে, শারিবা লষ্ট করবি না পলবি, শারিবা হামার বেটা।

ইঃ বেটা! প্যাটের ছাওয়াল!

প্যাটের ছালয়াল লয়, তমো শারিবা হামার বেটা।

মোর কি দোষ? উ ক্যান্ হামার পানে তাকায় না? তোরা ক্যান্ হামা খেদাস্?

এসব কথার পরিষ্কার উত্তর শরমী দিতে পারে না। আবার শারিবার সঙ্গে পলবির সম্পর্কের সম্ভাবনাও সহ্য করতে পারে না। দ্বৈরিণী বৃত্তিকে সব মানুষই সম্ভবত ঘৃণা করে। পলবির স্বেচ্ছাচারের খুব বড় কোনো কারণ এই মুহূর্তে ছিল না।

পলবি বলে, কিন্তু শারিবা হামাক একসময় চাইত।

মিছা কথা।

সি তুই জানো না। তখুন তুই বা কোথায় আর মোরাই বা কোথায়?

পাঁচবিবি থাকতে?

হঁ।

সি সব চ্যাংড়া বয়সের কথা ভুলি যা। এখুন তো চায় না।

তবি কি করমো হামি? কার কাছে যামো?

একথারও কোনো উত্তর নেই শরমীর কাছে। সে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে দৃঢ়স্বরে বলে, সি হামি জানো না। তবি ইখানে লয়, শারিবার চিন্তা ছাড়ান দেও।

কিন্তু এতেও পলবি আশা ছাড়ে না। ওমরের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে অন্ধকারে শারিবাকে ধরে সে।

শারিবা?

কি বেপার?

শারিবার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত এবং বিপন্ন।

শারিবা, হামার কি দোষ?

ই কথা হামা শুধাও ক্যান্?

যদি তুমাকেই শুধাই?

হামার দোষ-গুণের বিচারে কার কী যায় আসে?

যদি কহি, হামার যায় আসে?

পথ ছাড়, পলবি। আমার কাম আছে।

শারিবা, হামার কী দোষ?

নিজের কাছে শুধাও।

মাসে হামা ছিড়া খালো

তাই কি তুমু এখন মানুষ ছিড়া খাও?

পলবিরে ঘিন্না লাগে?

না, তবি ভালও লাগে না।

পাশ কাটিয়ে শারিবা চলে যায়। আর সেই থেকে পলবী নিজেকে আড়ালে রাখে। যখন তখন কেউ আর তাকে বাইরে দেখে না কেউ। এই পরিবর্তনে মেয়েদের থেকে পুরুষরাই অবাক হয় বেশি। পবি যাদের কৃপা করেছিল, তারাই এখন সব থেকে ভয় পায় পলবিকে। কিন্তু যার ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই, সেই আজুরা মণ্ডল বাজিকরপাড়ায় আবার আনাগোনা শুরু করে। কোথাও ফুল ফুটলে তার সৌরভ আজুরীর কাছে ঠিকই পৌঁছায়। আর আজুরাকে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য বাজিকরপাড়ার কারো থাকে না। পলবিরও নয়।

 

৫০.

ভায়রোর বাইশ দিগর কোলমা ও কাপড়া নমোশূদ্রদের নিয়ে। কোলমা অর্থাৎ যারা লেখাপড়ার কাজ করে এবং কাপড়া, যারা তাত বোনার কাজ করে, এই বাইশ দিগরের অন্তর্ভুক্ত। হালুয়া এবং জালুয়া নমোশূদ্ররা এই দিগরের বাইরে, যদিও তারাই সংখ্যায় অধিক। ভায়রোর বাপ দিগম্বর সর্দার অবস্থাপন্ন নমোশূদ্রদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করে এবং হালুয়া ও জালুয়াদের থেকে নিজেদের পৃথক করে নেয়। ভায়রো জন্মগত অধিকারে দিগরের নেতৃত্ব পায় ও দিগরের অনুশাসন আরো কঠিন করে তোলে। কাপড়া নমোশূদ্রদের মধ্যে যারা ছোট ছোট খটখটি তঁত চালিয়ে শুধু গামছা তৈরি করে, তারাও এই দিগরের অন্তর্ভুক্তি পায় না। দিগরভুক্ত মানুষেরা কখনো বাইরে বৈবাহিক ক্রিয়াকর্ম করে না, দিগরবহির্ভূত নমোশূদ্রদের সঙ্গে একত্রে পানাহার পর্যন্ত করে না। কিন্তু এইসব হালুয়া ও জালুয়া নমোশূদ্রদেরও দিগরের অনুশাসন, দিগরপতির আদেশ ইত্যাদি মেনে চলতে হয়। দিগরপতির দেহরক্ষীর কাজ কিংবা দিগরের মর্যাদা রক্ষার জন্য যারা সশস্ত্র বাহিনীর কাজ করে, তারা সদাই দিগর-বহির্ভূত নমশূদ্র। ভায়রো যখন কোনো সামাজিক ক্রিয়াকর্মে যায়, তখন তার ঘোড়ার দুইপাশে চারজন দেহরক্ষী হাতে বল্লম নিয়ে ছোটে। যখন বসে, দেহরক্ষীরা তার দুইপাশে থাকে। ভায়রো যখন কারো মাথা নামাবার কথা বলে, তখন তার মাথা নেমে যায়। এখনো ভায়রো সামাজিক বিচারে উপস্থিত হলে ডালিতে করে নজরানা আসে। সে রাজার মতো সম্মান পায়।

অথচ যদু চক্রবর্তী যখন তার কাছে টাকা ধার নিতে আসে, ভিতরে ক্ষোভ থাকলেও ভায়রো তার সামনে আসন গ্রহণ করে না। যদু বলে, ভায়রো, ঘর থিকা আইনায় নাইমে দাঁড়াও, আমি এটু জল খাই। ভায়রো আঙিনায় নেমে দাঁড়ায়। চক্রবর্তী জল খায়। পুরোহিত বাইশ দিগরের পুজো-পার্বণ করে, কিন্তু ছোঁয়া জল খায় না। বাইশ দিগরের নমোশূদ্রদের বাড়িতে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত পুজো করে না। তাদের পুজো-পার্বণ করে দিগরের অন্তর্ভুক্ত মৈত্র, ঘোষাল, চট্টোপাধ্যায় উপাধিধারী নমোশূদ্ররা। তারা উপবীতও ধারণ করে এবং অশুদ্ধ হলেও মন্ত্র উচ্চারণ করে।

সুতরাং ওমর-মালতীর ঘটনা এত সহজে মিটে যায় না। ভায়রোর বাইশ দিগর এখনো জলচল নয়। মোহর, বাদা-কিসমৎ ইত্যাদি গ্রামগুলোতে ব্রাহ্মণের আধিপত্য নেই বটে, কিন্তু থানা হেডকোয়ার্টারের আধা-শহর সোনামেলায় আধিপত্য ব্রাহ্মণদেরই। যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণদেরই হাতে। সর্বোপরি সমাজের উপরিকাঠামোর বিন্যাস সর্বত্রই একরকম। দিগরের গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এই উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্তি ও স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু দিগর এখনো জলচল হয়নি। মাহিষ্য, এমনকি সদ্‌গোপ অপেক্ষাও নমোশূদ্রের সামাজিক স্থিতি এখনো নিচে। সুতরাং ভায়রো কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করতে রাজি নয়।

ওমর আর মালতী ভাঙা নৌকা ছেড়ে প্রাচীন এবং পরিত্যক্ত এক মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল। ওমরের মা ও শারিবা তাদের খাদ্য জোগান দিত। অনেক চিন্তা করেও ওমরের জন্য কোনো সমাধান পায়নি শারিবা। এইভাবে লুকিয়ে কতদিন বাঁচা যাবে, একথা সবাই চিন্তা করত। কিন্তু অন্য কোনো উপায় কারো জানা ছিল না।

তারপর এক জ্যোৎস্না রাতে ওমর যখন তার প্রেমিকাকে নিয়ে নদীর বালি আর জলে চাঁদের আলো দেখে, আকাশে দুরযাত্রী হাজার হাজার হাঁসের পক্ষধ্বনি শোনে এবং শারিবার জন্য অপেক্ষা করে, তখন শারিবার বদলে চাঁদের আলোয় সে নদীর বালিয়াড়িতে অচেনা ছায়া দেখে। অর্যেক মানুষের ছায়া। অনেক সশস্ত্র মানুষ। তারা ক্রমশ কাছে আসে। তাদের হাতে পনেরো বিশ হাত লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁকানো চাঁদের আকৃতির কোটী হেঁসো, যা দিয়ে দূর থেকে একটি মোক্ষম টানে ধাবমান মানুষের মুণ্ড ধড় ঘেঁকে নিমেষে আলাদা করে যায়, আর যার ব্যবহার ও কৌশল একমাত্র স্থানীয় নোশূদ্রদের মধ্যেই প্রচলিত।

শারিবা মাত্র পঞ্চাশ হাত দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে। সে থেমে একটা ঝোপের পিছনে আশ্রয় নেয়। আট-দশজন সশস্ত্র মানুষ দ্রুত ওমরকে বৃহবন্দী করে ফেলে। ওমরের পিছনে পাতালু নদীর গভীর বাঁওড়। তিনদিকে অগ্রসর মানুষ। ওমরের ভয়ার্ত চিৎকার—‘না’ এবং আরো কিছু অনুচ্চ স্বরবিকৃতি। তারপর মালতীর চিকার। তারপর ওমরের আর্ত চিত্তার ও ছুটে পালাবার চেষ্টা। তারপর ওমরের শেষ চিৎকার এবং তারও পরে ওমরের শেষ আওয়াজ বের হয় নাকের ছিদ্র ও ছিন্ন কণ্ঠনালীর বহির্মুখ থেকে। তারপর দীর্ঘসময় ধরে মালতীর হাহাকার নির্জন নদীতীর, বাঁওড় আর সামনের আগাছার জঙ্গলের ভেতরে আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে।

শারিবা চাঁদের আলোয় একজনকে শূন্যে হেঁসো তুলতে দেখে ও বোঝে ওমরের মুণ্ড ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হল। তারপর সেই ব্যক্তি হাত দুলিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিল মুণ্ডটা। শারিবা মুহূর্তের জন্য চাঁদের দিকে ওমরের মুণ্ডর যাত্রা দেখল। নদীর জলে শব্দ। তারপর দু-জন ঘাতক কবন্ধ ওমরকে দুই হাত ও দুই পায়ে ধরে শূন্যে দুলিয়ে নদীর মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার বেশ জোরে শব্দ। এখন আশ্বিন মাস। পাতালু এখন ভরা, টানও খুব জোর। আধঘন্টার মধ্যে ওমরের দেহ ও মুণ্ড এক দেশ পার হয়ে অন্য দেশে পৌঁছোবেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাবে, একথা শারিবাও জানে।

মালতী এখন সংজ্ঞাশুন্য ও ভূপাতিত। ঘাতকরা নদীতে নেমে হাত পা দেহ পোয়। তারপর একজন সংজ্ঞাহীন মালতীকে কাঁধে তুলে নেয়। সবাই চলতে শুরু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *