৪৬. নিতাইয়ের বাড়ি থেকে

নিতাইয়ের বাড়ি থেকে চলে এসেছিল সত্য মাথার মধ্যে যাতনা হচ্ছে বলে, কিন্তু সেই যাতনা থেকে যে এমন জোর জ্বর হবে, সেকথা কে জানত?

সত্য নিজেও যখন শুয়ে পড়েছিল, তখন বুঝতে পারে নি। উঠল না, রান্না করল না দেখে সরল এসে আস্তে কপালে হাত দিয়ে দেখল, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! আর কি যেন বলছে বিড়বিড় করে।

ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল বেচারার, বাবাকে ডাকল।

কিন্তু বাবাই বড় ভরসাদার!

সে তো বিপদ দেখলেই মেয়েমানুষের মত কপালে করাঘাত করে। সে ডুকরে উঠে বলল, ছুটে গিয়ে পিসিকে ডেকে আন্!

সদু এসে মাথায় জলপটি, পায়ে গরম গামছা ভিজিয়ে সেঁক ইত্যাদি প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। এদের জন্য দুটো ভাতে-ভাতও ফুটিয়ে দিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে বিদায় নিল অনেক রাত্রে।

না, রাত্রে থাকল না।

সতীনের ছোট ছেলেটা নাকি বড়মা’কে নইলে ঘুমোয় না। আর মুখুয্যে মশাইয়েরও রাতে দশবার তামাক লাগে।

তবে আশ্বাস দিয়ে গেল সদু, ভোরেই আবার আসবে।

তখনো সত্য অজ্ঞান-অচৈতন্য।

নবকুমার মাথায় বাতাস দিচ্ছে।

অনেক রাত্রে হঠাৎ সত্য চোখ তাকিয়ে বলে উঠল, শোনো, কাছে এসো, আমার গা-টা ছোও!

শিউরে উঠল নবকুমার, কী এ? প্রলাপের ঘোর? না আসন্ন মৃত্যুর আভাস?

ছোঁও, গা ছোঁও!

নবকুমার ভয়ে ভয়ে গায়ে একটু হাত ঠেকাল।

সত্য উত্তেজিত স্বরে বলল, গায়ে হাত দিয়ে দিব্যি করলে কি হয় জানো তো?… মনে রেখো। শোন–আমি যদি মরে যাই, সুবর্ণকে তুমি সাতসকালে বিয়ে দেবে না। বল, বল, দিব্যি কর!

রোগীর প্রলাপ।

এতে সায় না দিলে প্রকোপ বাড়বে। নবকুমার তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, করছি।

বল, মুখে বল, ষোলো বছর বয়েস না হলে বিয়ে দেবে না সুবর্ণর?

ষোলো?

মেয়ের বয়েস?

ষোলো বছর পর্যন্ত আইবুড়ো রেখে দেবে?

নবকুমার ভাবল, হঠাৎ এত বড় জ্বর কেন হল সত্যর যে এতখানি ভুল বকা শুরু করেছে।

কিন্তু কারণ যাই হোক, ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

নবকুমার ব্যস্ত সুরে বলে, আচ্ছা আচ্ছা, তাই হবে।

তাই হবে বললে হবে না! সত্য প্রায় তেড়ে উঠে বসে, নিজে মুখে বল, ষোলো বছরের আগে সুবর্ণর বিয়ে দেব না!

পাগলের সঙ্গে চাতুরিতে দোষ কি?

আর প্রলাপের রুগীর সঙ্গে পাগলের প্রভেদই বা কি? টুক করে সত্যর গা থেকে হাতের স্পর্শটুকু তুলে নিয়ে নবকুমার বলে ওঠে, এই তো বলেছি, তোমার ইচ্ছে ব্যতীত বিয়ে দেব না সুবৰ্ণর!

আসল কথাটাই বললে না তুমি? সত্য চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আসল কথায় ফাঁকি দিও না। সুবর্ণকে মেরে ফেলো না। ওকে বাঁচাতে হবে, হাজার হাজার সুবর্ণকে বাঁচাতে হবে।

ধপ করে শুয়ে পড়ে সত্য।

নবকুমার পাখাটা আরো জোরে জোরে নাড়তে থাকে। হাজার হাজার সুবর্ণ! ভগবান, এ যে ঘোর বিকার!

ভগবান, এ কী করলে তুমি?

হে মা কালী, রাতটা পোহাতে দাও, আমি নিজে গিয়ে খাড়া-ধোয়া-জল এনে খাইয়ে দেব।

দেশের কালীর কাছেও মানত করে বসে নবকুমার। আবার হরির লুটও মানে। কী করবে?

নবকুমার যে শুনেছে, বিকারের রক্ত মাথায় চড়লে ভুল বকতে বকতে আর মাথা চালতে চালতে মরে যায় মানুষ! লক্ষণ তো দেখাই দিয়েছে, রাত্তিরের মধ্যে যদি জ্বর না কমে, সেই পরিণতিই তো অনিবার্য।

.

মা কালীর দয়াই বলতে হবে।

খাড়া-ধোয়া-জল না খেয়েই জ্বর কমে গেল।

শেষ রাত্তিরের দিকেই কমে গেল। ঘামের তোড়ে বিছানার চাঁদর সপসপিয়ে বিজিয়ে দিয়ে জ্বর প্রায় বিদায় নিলই বলা যায়।

কিন্তু ঠাণ্ডা গায়ের রক্ত, পাঁচদিন জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পরের রক্ত বিকারের তীব্রতা পেল কি করে? বিকারের বেগ? সেই তীব্রতার বেগ বিকারের বিকৃতি নিয়েই তো মাথায় চড়ে উঠল। নইলে ত্রিভুবনে কে কবে এমন কাণ্ড শুনেছে?

কোনো বাঙ্গালীর মেয়ের, গেরস্থ ঘরের মেয়ের পক্ষে কখনো সম্ভব এমন ভয়ানক কাণ্ড করা?

সত্যর চির অনুগত এবং চির সমর্থক ছেলেরা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গেল মায়ের এই ধারণাতীত দুঃসাহসে।

খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সদুকে আর তার বরকে ডেকে আনল সাধন, তথাপি নবকুমার ব্যাকুল হয়ে সরলকে বলে বসল, বিপদে পড়ের চক্ষুলজ্জা করতে নেই, শাস্ত্রের নির্দেশ, তুই যা বাবা, একবার মাস্টার মশাইকে ডেকে নিয়ে আয়!

মাস্টার মশাইকে!

সরল হাঁ হয়ে রইল।

বাবা ডাকতে বলছেন তাঁর মাস্টার মশাইকে! যার নাম করেন না, মুখ দেখেন না, সুহাসদি পর্যন্ত যার জন্যে চিরকালের মত পর হয়ে গেছে!

নবকুমার লজ্জাকে চাপা দেয় ব্যস্ততা দিয়ে।… হ্যাঁ হাঁ, বলছি তো তাই! বললাম না, বিপদের সময় চক্ষুলজ্জা শাস্ত্রের বারণ! তুই আমার নাম করেই ডেকে আন্। বলগে ভয়ানক গুরুতর কাণ্ড, পুলিস এসেছে বাড়িতে। বোধ হয় তোদের মার হাতে দড়ি পড়বে, এ শুনলে আর

দড়িটা মার হাতে পড়বে কেন, বিপদের সময় চক্ষুলজ্জার নিষেধটা কোন শাস্ত্রে আছে, সে প্রশ্ন করে না সরল, ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় রান্নাঘরের পিছনের দিকের দরজাটা দিয়ে।

এই দোরটা ছিল তাই রক্ষে।

নইলে সদর চেপে তো বসেছে বাঘা এক সাহেব পুলিশ।… কম্পিত কলেবরে নবকুমারের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারখানায় বসে সত্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

হ্যাঁ, সত্যকেই প্রশ্ন করছে।

ছোটখাটো ইংরিজি-মিশেল হাস্যকর উচ্চারণ-সমৃদ্ধ বাংলায়। আর পাথর-বাধানো-বুক সত্য সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ঠায় দাঁড়িয়ে।

সাহেব পুলিসের নামে ডাকাবুকো মুখুয্যে মশাইও প্রথমে আসতে চান নি, কিন্তু সদুর একান্ত ব্যাকুলতায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। হয়েছেন বটে, তবে সদরমুখো হন নি, পৈতে হাতে ধরে দুর্গানাম জপ করতে করতে সদুর পিছু পিছু সেই পিছন দরজা দিয়ে!

ঢোকা মাত্রই সুবর্ণ কেঁদে ওঠে, সদুর হাঁটু জড়িয়ে ধরে বলে, পিসি, মাকে ধরে নিয়ে যেতে গোরা এসেছে!

বালাই ষাট, দুগ্গা দুগগা, ধরে নেবে কেন? বলে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে সদু ফিসফিসিয়ে বলে, ঘটনাটা কিরে তুড়ু? হল কি?

সাধন শুকনো মুখে যা বিবৃতি দেয়, তার সার অর্থ এই, সত্যবতী কারুর সঙ্গে কোনো পরামর্শ করে, কারুকে না জানিয়ে পুলিস সাহেবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল কারুর জবানীতে পর্যন্ত নয়, নিজের নামে। সেই চিঠির সূত্রে এনকোয়ারিতে এসেছে পুলিস।

চিঠির কারণ?

কারণ অদ্ভুত। কারণ অভাবনীয়।

নিতাইয়ের বৌ ভাবিনীর বোনের শোচনীয় অকালমৃত্যুই নাকি কারণ।

মেয়েটাকে তার স্বামী আর শাশুড়ীতে মিলে কী রকম নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তা জ্বলন্ত ভাষায় বর্ণনা করে দৃপ্ত আবেদন জানিয়েছে সত্যবতী, এই দানবীয় অত্যাচারের সুবিচার হোক, সেই খুনী যুগলের উচিতমত শাস্তি হোক। তা যদি না হয়, বৃথাই তাঁদের ধর্মাধিকরণের নাম করে আদালত খুলে বসে থাকা।

আসামীদের নাম ধাম ঠিকানা সবই জানিয়েছে সত্যবতী সেই আবেদনপত্রে।

সব শুনে সদু নিঃশ্বাস ফেলে বলে, সেদিনের সেই বিকারেরই ঝোঁক এসব তুড়ু, দেহের রক্ত মাথায় চড়ে উঠেছিল জ্বরের ধমকে, সেই চড়া রক্তই বুদ্ধিসুদ্ধি বিগড়ে দিয়েছে। নচেৎ বাঙালী গেরস্থঘরের মেয়ের পক্ষে এ কাজ সম্ভব? আমি তোকে নির্ঘাৎ বলছি তুড়ু, তোর ওই মা একদিন মাথার শির ছিঁড়ে সন্যেস রোগ হয়ে মরবে! চিরদিনই মেয়েমানুষের আধারে ও একটা দস্যি পুরুষমানুষ! তাই এই দুরন্ত রোগ!

সাধন আরো শুকনো মুখে বলে, রোগই বলব, তা ছাড়া আর কি! চিরদিন এই এক রোগ, কোথায় কোনখানে কে কী অন্যায় করল, যেন মার ওপরই করেছে। সকলের জ্বালা-যন্ত্রণা নিজের ঘাড়ে নিয়ে কেবল কষ্ট পাওয়া রোগ। বাড়ির বাসনমাজা ঝিটা একদিন তার ছেলেকে মরে যা’ বলে গাল দিয়েছিল বলে মা তাকে তক্ষুনি ছাড়িয়ে দিলেন!

ছিষ্টিছাড়া, সবই ছিষ্টিছাড়া, চিরকেলে ছিষ্টিছাড়া! আশ্চর্যি!, ভগবান রূপ গুণ সবই দিয়েছিল, কিছু সার্থক করতে পারল না! এখন আবার নাকি শুনছি সেদিন জ্বরের ঘোরে তোর বাপকে দিব্যি গালিয়েছে, পঁচিশ বছর বয়েস না হলে সুবর্ণর বিয়ে দেওয়া চলবে না!

দিব্যিটা অবশ্য নিতান্তই হাস্যকর, অতএব এ নিয়ে মাথা ঘামায় না সাধন। প্রলাপের ঘোরে কী না বলে মানুষ!…. তবে ওরও মনে হয়, বাস্তবিকই মাকে মা’র বিধাতা অনেক বুদ্ধিসুদ্ধি দিয়েছেন, শুধু জেদটা যদি ঈষৎ কম দিতেন।

আপনি একটু ওদিকে যাবেন পিসেমশাই? সাধনের এই প্রশ্নে মুখুয্যে মশাই বিচলিত স্বরে বললেন, আমি আর কেন বুড়োমানুষ! এইমাত্র স্নান সেরেছি, এখনো আহ্নিক হয় নি। এখন ওই স্লেচ্ছস্পর্শে

না না, ছোঁবেন কেন? এমনি।

এই দেখ পাগল ছেলের কথা! বাক্যবিনিময় মানেই তো ছোঁয়া। বাক্যের দ্বারা স্পর্শ, সেও বড় কম নয়। তা ছাড়া তোমরা কলেজে পড়েছ, ইংলিশ শিখেছ…

শিখেছে।

শিখেছে সেটা সত্যি কথা।

কিন্তু এ তো লেখাপড়ার কথা নয়। সাহেব মাস্টার নয়। এ হল বিশ্রী একটা গোলমেলে ব্যাপার। এক্ষেত্রে প্রবীণ লোকই ভাল।

কিন্তু প্রবীন লোক দ্বিতীয়বার স্নানের ভয়ে গেলেন না। শুধু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলেন, সত্য কিভাবে সাহেবের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।

হ্যাঁ, তখন সত্যই বলছে, বলো তবে কী জন্যে আদালত খুলে বসে আছো তোমরা? সতীদাহ করে মেয়েমানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারতো আমাদের দেশ, তোমরাই সে পাপ থেকে উদ্ধার করেছো আমাদের। তবু এখনো কিছুই হয় নি। এথনো অনেক অনেক পাপ জমানো আছে। চারযুগ ধরে জমছে এই পাপের বোঝা। এই পাপ দূর করতে পারো, তবেই বলি শাসনকর্তা সেজে বসে থাকা শোভা পাচ্ছে!… নচেৎ পরের দেশে রাজগিরি কিসের? জাহাজ বোঝাই হয়ে ফিরে যাও না?

মা!

সাধন এগিয়ে যায় মাকে নিবৃত্ত করতে। দেখছিল “বাংলা-নবীশ” সাহেব তার মা’র এই ওজস্বিনী বক্তৃতার সামনে পড়ে সমস্ত বাংলা জ্ঞান হারিয়ে “হোয়াট? হোয়াট?” করছে!

এই বক্তৃতার স্রোতে দোভাষীর কাজ করতে এলে, তার এফ. এ পড়া বিদ্যে স্থলকূল পাবে, ভরসা হল না। তাই মা বলে ডেকে নিবৃত্ত করতে চাইলে।

কিন্তু সত্য বুঝি তখন সত্যিই পরিবেশ পরিস্থিতির জ্ঞান হারিয়েছে, তাই ছেলের এই ডাকের ইশারায় কর্ণপাত না করে বলতেই থাকে, তোমার দেশে তো শুনি মেয়েমানুষের অনেক মান, অনেক সম্মান। সেই চোখ খুলে দেখতে পাও না, এই হতভাগা দেশে মেয়েমানুষকে কী অপমানের মধ্যে, কী লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলে রেখেছে? আইন করে বন্ধ করতে পারো না এসব? নিত্যি নিত্য অনেক আইন তো বার করছো

বড়বৌ!

নবকুমার আর থাকতে পারে না, চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে, আর ঠিক এই সময় ভবতোষ মাষ্টার এসে দাঁড়ান সরলের সঙ্গে সঙ্গে।

ঢুকবার মুখেই বোধ করি সত্যর এই তীব্র ভাষা তার কানে ঢুকেছে। তাই সত্যকেই উদ্দেশ্য করে শান্ত স্বরে বলে, ভিন্ দেশের লোক এসে আইন করে এদেশের সমাজের গ্লানি দূর করবে, এ আশা করো না বৌমা। দেশকেই করতে হবে।

মাস্টার মশাইকে এ বাড়িতে দেখে অবাক হতে গিয়েও, সঙ্গে সরলাকে দেখেই রহস্যভেদ হয়ে গেল সত্যর কাছে।

আস্তে মাথার কাপড়টা টেনে দিয়ে দূর থেকে আলগোছে একটা প্রণামের মত করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

একটা নাকি প্রবাদ আছে, “বুক থেকে পাহাড় নামা”-ভবতোষ আসার পর নবকুমারের সেই অবস্থা। যাক বাবাঃ, আর তার করণীয় কিছু নেই! এবার সে ঘরে ঢুকে চৌকিতে শুয়ে পড়ে হাতপাখা নেড়ে হাওয়া খেতে পারে!

এখন অপেক্ষা মাস্টার আর সাহেবটার বিদেয় হওয়া। তারপর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। বহু সহ্য করেছে সে, আর নয়। মুখুয্যে মশাই এইমাত্র বলেছেন, স্ত্রৈণ পুরুষের স্ত্রীরা এইরকমই হয়। সেই বাক্য-দাহ সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরাচ্ছে!

মাস্টারের সঙ্গে কিন্তু বেশী কথা হল না সাহেবের, শুধু সত্যর প্রেরিত চিঠি দেখাল সাহেব এবং একটু পরেই ‘গুডবাই’ বলে বিদায় নিল সে। ভবতোষ তাকে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসে, এদের উঠোনে আর একবার এসে দাঁড়ালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তোমার মাকে বলো সাধন, সাহেব কথা দিয়ে গেছে দোষীকে খুঁজে বের করে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।… আর– মাস্টার মশাই একটু হাসালেন, আর তোমার মাকে অনেক অভিনন্দন জানিয়ে গেছে।

এতক্ষণে মুকুন্দ মুখুয্যের গলা নিজের কাজ করে। তিনি হুঁকো হাতে দাওয়া থেকে উঠে উঠোনে নেমে এসে বলেন, শুনলাম আপনি একসময় নবকুমারের শিক্ষক ছিলেন, সে হিসাবে নমস্কার জানানো উচিত, তা জানাচ্ছি, কিন্তু ওই যে কি বললেন, সাধনের মাকে সাহেব কি দিয়ে গিছে

অভিনন্দন ইয়ে প্রশংসা।

হুঁ, বুঝেছি। তা প্রশংসাটা কিসের?

ভবতোষ একবার এই গায়ে-পড়া অভব্য বুড়োটার দিকে দৃষ্টিপাত করেন, তারপর হয়তো ব্যঙ্গের খাদ মেশানো একটু পরিহাসের ধরনের হাসি হেসে বলেন, বুঝতে তো খুব অসুবিধে বার কথা নয়? সাহসের জন্য প্রশংসা করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস কজনের থাকে। বলুন?

মুখুয্যে মুখ বিকৃত করে বলেন, লোকের ঘরে আগুন লাগাবার, লোকের মাথায় লাঠি বসাবার সাহসও একরকম সাহস, তা সকলের থাকে না স্বীকার করছি। তবে সাহস মানেই প্রশংসা পাবার যোগ্য সেটা স্বীকার করব না।

না করলেই বা কি করবার আছে! বলে ঈষৎ হেসে চলে যেতে চান মাস্টার। যাওয়া হয় না। নবকুমার তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলে, মাস্টার মশাই, চলে গেলে চলবে না, একটু জল খেয়ে যেতে হবে।

বোধ করি বিপদতারণ মধুসূদনরূপী মাস্টার মশাইয়ের পরম উপকারের একটা প্রতিদান আবশ্যক বলে মনে করার প্রতিক্রিয়া এই প্রস্তাব!

তবে মাস্টার মশাই এ প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই চমকে তাকালেন আর বোধ হয় ভাবলেন, ধৃষ্টতার কেন সীমা থাকে না!

কিন্তু একদা যে ভবতোষ মাস্টার রামকালীকে তাঁর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির দুঃখদুর্দশা বর্ণনা করে ওজস্বিনী ভাষায় চিঠি দিয়েছিলেন, সেই ছেলেমানুষ ভবতোষ তো আর নেই। তারপর অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে। অনেক মানসিক দ্বন্দ্বের টানা-পোড়েনে পোড়খাওয়া আর অনেক জ্ঞান-অর্জনে পরিণত হয়ে ওঠা প্রৌঢ় ভবতোষ ভয়ানক কিছু একটা জবাব দিয়ে বসলেন না। শুধু মৃদু হেসে বলেন, পাগল!

পাগল কেন? বাঃ! ঋণী থাকবো না এই বাসনাতেই হয়তো নবকুমার আবার জেদ করে, এই রোদে তেতেপুড়ে এলেন। আপনার বৌমার মান-মর্যাদা রক্ষা করলেন, সে অমনি কেন ছাড়বে? আপনার বৌমা বলছে, একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়বে না আপনাকে।

ভবতোষ আর একবার ভয়ঙ্কর ভাবে চমকালেন। বোধ করি কোনও একখানে হিসাব মিলাতে পারলেন না, কেমন অসহায় ভঙ্গীতে বললেন, কে? কে ছাড়বে না বলেছে?

এই যে, আপনার বৌমা! চোখের ইশারায় ইতিমধ্যেই সাধনকে দোকানে পাঠিয়ে ফেলেছে নবকুমার, তাই বুকের বল আছে। অতএব জোর গলায় বলে, সে এখন কলসীর জল ঢেলে আপনার জন্যে মিছরির পানা করছে—

নবকুমার ভেবেছিল এই ইশারাতেই মিছরির পানা বানানো হয়ে যাবে। কিন্তু কথা শেষ করতে হয় নি নবকুমারকে।

কলসীর ঠাণ্ডা জলে’র ইশারা কাজে লাগানো না। সত্যবতী বেরিয়ে এসে দৃঢ়স্বরে বললো, মিথ্যে কেন রোদে দাঁড়িয়ে পাগলের প্রলাপ শুনছেন মাস্টার মশাই! বাসায় যান!

ভবতোষ সহসা একবার স্পষ্ট চোখে সত্যর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন।

ঠিক সঙ্গে সঙ্গে নবকুমার একটা কিম্ভুতকিমাকার কাজ করে বসলো। হঠাৎ দু হাতে ঠাস ঠাস করে নিজেই নিজের গালে চড়িয়ে বলে উঠলো, আর কেন, এইবার একখানা জুতো এনে মুখে মারো! মোলকলা সম্পূর্ণ হোক! ওইটুকুই তো বাকী আছে। স্ত্রৈণ পুরুষের ওইটাই বোধ হয় শেষ শাস্তি।

সামনে সদু সামনে মুকুন্দ মুখুয্যে, সামনে সরল, সেই মুহূর্তে সাধন সন্দেশের ঠোঙা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

সত্য কি কারো দিকে তাকিয়ে দেখে?

বোধ হয় না।

সত্য নিঃশব্দে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। আর বোধ করি ফেলে ছড়িয়ে চলে যাওয়া হাতের কাজটা আবার গুছিয়ে তুলতে থাকে।

সদুতে সদুর স্বামীতে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়। তারপর সদু উত্তেজিত নবকুমারকে বসিয়ে একখানা হাতপাখা দিয়ে মাথায় বাতাস দিতে দিতে খাদে গলা নামিয়ে বলে, আর ক্ষেপে উঠে কি করবি ভাই? এতদিনে তো সবই পরিষ্কার হয়ে গেল। চিরদিন মাথাটা একটু ইয়ে ছিল, এখন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তোর কপালে ভগবান এমন তেতুল গুলবেন, তা কখনো ভাবি নি।

মামীর কাছে থাকতে সদুর যেমন ধারালো পরিষ্কার কথাবার্তা ছিল তেমন যেন আর নেই। সদু গেরস্থর গিন্নী হয়েছে। তাই গিন্নীদের মত কথা রপ্ত করেছে।

নবকুমার বলে, এক ঘটি জল দাও সদুদি!

সদু তাড়াতাড়ি জল এনে হাতে দিয়ে বলে, খা, খেয়ে এইবার মনের বল করে কবরেজ ডেকে এনে চিকিচ্ছে করা। নেহাত হাতেপায়ে ছেকল না পরাতে হয়, সেটা তো দেখতে হবে!

নবকুমারের বোধ করি জল খেয়েই বল বাড়ে। সে বীরবিক্রমে বলে, পাগল না হাতী! সব বদমাইশি! লোকের সামনে আমাকে হেয় করাই ওর একমাত্র কাজ। জীবন-ভোর তাই দেখলাম।

হ্যাঁ, বড় হয়ে পর্যন্ত ছেলেরাও তাই দেখছে। ছেলেবেলায় মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল সহানুভূতি ছিল, মায়ের কথা বেদবাক্য বলে ভাবতো ছেলেরা এবং বাবাকে “অল্পবুদ্ধি” বলে মনে মনে করুণা করতো। কিন্তু বাবার ওপর করুণাটা বজায় থাকলেও, বড় হয়ে পর্যন্ত মায়ের ওপর থেকে যেন সহানুভূতি অনেকটা চলে যাচ্ছে, বিশেষ করে বড় ছেলেটার।

সে ভাবতে থাকে

এ কী!

প্রত্যেকটা ব্যাপারে তাল ঠুকে লড়াই।

শান্তির সংসারে সেধে অশান্তি ডেকে আনা, আর বাবাকে হেয় করা!

এটা অন্যায়।

সুহাসকে নিয়ে কী কাণ্ডই করলেন! তবু তার পিছনেও না হয় একটা যুক্তি আছে। মানুষটার একটা গতি করার দরকার ছিল। কিন্তু নিতাই কাকার শালী যে মরে ভূত হয়ে গেছে, তার জন্যে এ কী কেলেঙ্কারী! নিজের স্বামী-পুত্রকে এইভাবে শাস্তি দিয়ে, সেই অদেখা অচেনা অপরাধীকে শাস্তি দেওয়াতে হবে?

বাঁচবে তাতে মড়া?

বাঁচবে না। শুধু নবকুমার আর তার ছেলেদের মৃত্যুতুল্য অপমান বয়ে বেড়াতে হবে। পাড়াসুদ্ধ সমস্ত লোক তো দেখলো সাহেব পুলিস ঢুকলো তাদের বাড়িতে। সবাই জল্পনা-কল্পনা করবে না, হয়েছে কি?

কে তাদের বোঝাতে যাবে?

আর বোঝালেই বা কে বিশ্বাস করবে? এরপর হয় এ পাড়ার বাস ওঠাতে হবে, নয় দু’গালে চুনকালি মেখে আর কানে তুলো দিয়ে পথে বেরোতে হবে। পিসী যা বলছে, তাই হয়তো সত্যি। মাথার মধ্যে কোনো গোলমালই আছে।

আশ্চর্য।

এত বুদ্ধি, এত বিদ্যে, এত কর্মদক্ষতা, তার মাঝখানে এ একটা কি বিটকেল বুদ্ধি?

ছেলেবেলাকার মাকে মনে পড়ে।

কত উজ্জ্বল, কত আনন্দময় সেই স্মৃতি। অন্তত ছেলেদের কাছে সত্যর সেই উজ্জ্বল আনন্দময়ী মূর্তিটাই ছিল।

নবকুমারের আড়ালে চুপি চুপি ছেলেদের সঙ্গে কত জল্পনা-কল্পনা। ভবিষ্যতের ছবি এঁকে কত রঙের তুলি বুলোনো! দুই ছেলে সত্যবতীর দুই দিকপাল হবে, দেশ থেকে যত অনাচার কুসংস্কার আর কু-প্রথা দূর করবার চেষ্টায় লাগবে একজন, আর একজন দেশ স্বাধীন করবার কাজে আত্মনিবেদন করবে।

তবে সকলের আগে বিদ্যার্জন।

বিদ্বান না হলে কোনো কাজেই লাগতে পারবি না তুড়ু, কেউ তোকে পুঁছবে না। আর তা ছাড়া ভালমন্দ-বোধই বা আসবে কোথা থেকে? তোরা জজ হবি, ম্যাজিস্ট্রেট হবি, নয়তো ডাক্তার আর মাস্টার হবি। এমন গুণ দেখাবি, লোকে বলবে, হ্যাঁ, ছেলেদের মানুষ করেছে বটে।

শিশু-মনে এই চাকচিক্যের ছবি কি মনোরম প্রভাবই বিস্তার করতো। কিন্তু বড় হয়ে ক্রমশই দেখছে মায়ের ভিতরের সেই ঔজ্জল্য যেন আগুন হয়ে উঠছে।

দেড়-দু’বছর বারুইপুরে থেকে এসে আরো যেন বদলে গেছে মা। এই মায়ের জন্যে ভালবাসার থেকে ভয় আসে বেশী।

ছোট ছেলেটা অবশ্য অনেকটাই মায়ের ভাবে অনুপ্রাণিত। কিন্তু এই সব চেঁচামেচি অশান্তিকে সে বড় ঘৃণা করে। সমাজের বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে মানুষ নিজে যেন বিকৃত না হয়ে যায়, সেটাও তো দেখতে হবে।

নিতাইকাকার শালীর মৃত্যুর জন্যে মা যা করে বসলেন, তার মধ্যে সাহসের পরিচয় আছে সত্যি, কিন্তু একটু যেন দুঃসাহসই! অন্তত ছেলেদের সঙ্গে তো পরামর্শ করে কাজটা করতে পারতেন। তাছাড়া সাহেবদের যদি তাড়াতেই চাই আমরা, অসুবিধেয় গড়ে ওদের সাহায্য চাইতে যাব কেন? মার যদি সহজ অবস্থা থাকতো, কথাটা জিজ্ঞেস করতো সে। কিন্তু মা এখন ক্ষেপে আছে।

কিন্তু সত্যর ছেলেরা যা ভাবছে তা নয়। সত্য এখন আর ক্ষেপে নেই। সত্য স্তব্ধ হয়ে আছে। আর সত্য এখানকার সমস্ত কিছু বিস্মৃত হয়ে শুধু ভাবছে, সত্যর ছেলেরাও সাহেব দেখে ভয় পেয়ে পিছনে থাকলো, এগিয়ে গিয়ে কথা বলল না, মায়ের বক্তব্যটা বুঝিয়ে এবং গুছিয়ে বলবার জন্যে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল না!… যে ছেলেদের কলেজে পড়ানোর জন্যে জীবন পণ করছিল সত্য, যে ছেলেদের উপরই জীবনের সমস্ত আশা রেখে এসেছে সত্য!

হয় তো সত্যর আশাটা একটু বড়।

সত্য ছেলেদের ডিগ্রীটাই দেখছে, বয়েসটা দেখছে না। এই ব্যাপারটা ওদের বিচলিত করবার পক্ষে যথেষ্ট তা বুঝছে না।

কিন্তু সত্যিই বুঝছে না সত্য?

সত্য ভেবে পাথর হয়ে যাচ্ছে, সরল কি বলে মাস্টার মশাইকে ডেকে নিয়ে এল?

এতটুকু লজ্জা করল না?

ওরা কী না জানে?

দেখে নি মাস্টার মশাইকে কী অপমানিত হয়ে চলে যেতে হয়েছে এ বাড়ি থেকে?

হঠাৎ বিপদে পড়ে গিয়ে তাকেই ডেকে আনার মত প্রস্তাব নবকুমারের পক্ষে সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সত্যর গর্ভের সন্তান স্বচ্ছন্দে সেই নিলর্জ কাজটা করতে পারলো কি করে?

সত্যর মাথাটা ধুলোয় লুটিয়ে দিল সত্যর ছেলে! আর কার কাছে? যেখানে সব চেয়ে সম্ভ্রম ছিল সত্যর।

সত্য তবে এখন কী করবে?

কাকে জিজ্ঞাসা করবে, সারাজীবন আমি যে পথে চলে এলাম, সে পথ কি ভুল পথ?

রান্নার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল তবু চুপ করে বসেছিল সত্য রান্নাঘরে। ডেকে খেতে দেবার উৎসাহ পাচ্ছে না।

সদু চলে গেছে, কাজেই তাকেও ডেকে খেতে দিতে বলতে পারছে না। অনেকক্ষণ পরে সুবর্ণ খেলা ফেলে ছুটে এল। বলল, আজ বুঝি খাওয়াদাওয়া নেই? শুধু বসে বসে চিন্তা করলেই চলবে?

এত কথা শেখার বয়সটা নয়, তবু সারাক্ষণ ঠাকুমা এলোকেশীর সঙ্গে থেকে থেকে কথার ওস্তাদ হয়ে উঠেছে, কথা বললে বোঝে কার সাধ্যি ছ-সাত বছরের মেয়ে!

অবশ্য কেবলমাত্র এলোকেশীর দোষ দেওয়াও অধর্ম। পাকা কথা, প্রচুর কথা এ তো সুবর্ণর ঐতিহ্য, অনুক্রম!

সত্য কি ভুলে গেল সেকথা? তাই সত্য মেয়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তীব্রস্বরে বলল, ফের পাকা কথা?

সুবৰ্ণ মায়ের মূর্তিতে ভয় পেল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, খিদে পায় না বুঝি?

সত্যর জ্বলন্ত দৃষ্টি ঈষৎ কোমল হয়ে এল। বলল, দিচ্ছি ভাত, বাবার দাদাদের ঠাই করে দাও গে।

হ্যাঁ, ঠাই করা কী এক ঘটি জল দেওয়া এ সুবর্ণ শিখেছে। আরো কাজ শিখেছে, বিছানা পাতা বিছানা ভোলা, তাও টেনে টেনে পারে। পারে মায়ের সঙ্গে বসে শাক বেছে দিতে।

কাছে বসিয়ে কাজ শেখাতে শেখাতে বইয়ের পদ্যও শেখায় মেয়েকে। মুখে বানান শেখায়।

ঠাই করতে চলে গেল সুবর্ণ।

আর ওর পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগল সত্য, এবার কি তবে শেষবারের মত এই মেয়েটার উপরই সব আশা রাখবে সত্য? সুহাসের মত হবে সুবর্ণ?

সুহাসকে সত্য গড়লো, ভোগ করতে পেল না।

অবিশ্যি মেয়েসন্তান ভোগ্যবস্ত নয়, তবু সুহাসের যদি এমন অদ্ভুত অঘটনের জীবন না হত, এমন করে তো চিরদিনের মত সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে হত না সত্যকে। সত্য তো তাকে দেখতে পেত।

নব নব রূপে বিকশিত হত সে সত্যর চোখের উপর। এ আর সত্যর দেখার উপায় রইল না, কেমন সংসার করছে সুহাস।

সুবর্ণ সত্যর চোখের সামনে বিকশিত হবে।

ছেলেরা শেষ অবধি বংশের ধারায় কাপুরুষই হবে। হবে স্ত্রী-বশ!…যেমন ছিলেন ঠাকুর্দা নীলাম্বর, যেমন নবকুমার!

নীলাম্বর অসৎচরিত্র, তবু স্ত্রীর ভয়ে কাঁটা। নবকুমারের তো কথাই নেই!

কিন্তু?

সত্য আজ নিজেকে বিশ্লেষণ করে দেখছে… সত্য কি নবকুমারের এই বশ্যতার পরিবর্তে উল্টোটা হলে সুখী হত?… অনেকবার মনের কোণে কোণে আলো ফেলে ফেলে দেখেছে সত্য, হত সুখী? সত্যর স্বামী যদি সত্যর যুক্তি খণ্ডন করে স্বমতে প্রতিষ্ঠিত থেকে বিপরীত ভাবে নিজেকে চালাতে পারতো, তাতেও সত্য সুখী হত?

নবকুমার তা নয়।

নবকুমার ফী কথার তাল ঠুকে স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নিজের কোনো মত খাড়া করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সত্যই জয়ী।

কিন্তু কেবলমাত্র জয়ী হয়েই কি সুখ? পরাজয়েও কি সুখ নেই? যে পরাজয় স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেওয়া যায়, তেমন পরাজয়ের স্বাদ জীবনে কখনো পেল না সত্য।

তবে সুবর্ণই উঁচু হোক, মস্ত হোক। তাই ভাল, মেয়ের কছে ছোট হবে সত্য। যেন অবাক হয়ে বলতে পারে, বাবা কত বুদ্ধি তোর! এত কথা, এত তত্ত্ব, এত তথ্য শিখলি কি করে? যেন বলতে পারে, সুবর্ণ, তুই আমার মুখ রেখেছিস!

.

বাপ-ভাইকে গিয়ে যখন জানালো সুবর্ণ, ভাত বাড়া হয়েছে, তারা যেন হাতে চাঁদ পেল। যাক তা হলে সংসারটা আবার ছন্দে এলো। ওরা তো বসে বসে ভাবছিল আজ আর সত্য রান্নাবান্না করে নি!

এই মূল কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা ঘটলেই বড় মুশকিল।

ওরা কৃতার্থ হয়ে নিঃশব্দে এসে খেতে বসলো।

নবকুমার যে সাহেবের উপস্থিতির সময় মনে করেছিল, ওরা একবার চলে যাক, সে একবার হেস্তনেস্তটা দেখে নেবে, সে কথা আর মনে পড়ে না। তখন নিজের গালে নিজে চড়ানোর পরই সমস্ত সাহস উপে গেছে তার। এখন অবিরত সদুর কথাটাই মনে পড়ছে।

মাথাটাই খারাপ বৌয়ের!

খারাপ!

নচেৎ আচরণ এমন উল্টোপাল্টা হয়? যাক, তার মধ্যে যেটুকু সোজা করে তাই মঙ্গল। খেতে বসতে পেয়ে ধন্য হল বাপ-ছেলেয়।

সুবৰ্ণ পাকা গিন্নীর মত বলতে লাগলো, আর দুটি ভাত নাও না বাবা?

তা নবকুমার আবার এখন সত্যর মন রাখতে ভাতও দুটি নিল চেয়ে। তারপর যখন খাওয়া হয়ে গেছে, তখন সত্য এসে তার সংকল্প ঘোষণা করলো।

সহজ গলায় বললো।

বললো, অসুখটা হয়ে অবধি শরীরটা মোটে ভাল যাচ্ছে না, তাই ভাবছি কাশীতে বাবার কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকবো। পশ্চিমের হাওয়ায় স্বাস্থ্য-শরীরটা একটু ভালো হতে পারে।

নবকুমারের মনে হল, সত্য যেন হঠাৎ তাকে বর দিতে এলো!

বোধ করি মনের মধ্যে এই ধরনের একটা সুরই বাজছিল। কিছুদিন কোথাও ঘুরে আসুক সত্য। তা হলে সেও সারবে, নবকুমারও বাঁচবে।

কিন্তু এক কথায় কি করে বলা যায়–হ্যাঁ আচ্ছা, তাই যাও!

তাই আস্তে আস্তে,ভয়ে ভয়ে বলে, কাশীতে? বাবার কাছে? তাই কি সম্ভব? তিনি একা মানুষ, তাঁর কাছে গিয়ে কি থাকবে?

সত্য সংক্ষেপে বলে, সে যা হয় হবে। সাধন, তুই আমায় পৌঁছে দিতে পারবি না?

সাধনকেই প্রশ্ন করেছিল সত্য, বড় ছেলে বলেই করেছিল। কিন্তু সাধন এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অকূলপাথারে পড়লো। একা সে নিজের দায়িত্বে মাকে নিয়ে কাশী যাবে, এ হেন প্রস্তাবটাই যেন তার কাছে মার আর এক পাগলামি বলে মনে হল।

ছেলের এই বিপন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যর মুখে হঠাৎ সূক্ষ্ম একটি হাসির রেখা ফুটে উঠল, আর তেমনই সূক্ষ্মভাবে সে বললে, পারবি না বলেই মনে হচ্ছে, তবে থাক!

অন্য সময় হলে এই হয়তো ছেলেকে তীব্র তিরস্কার করত সত্য, কিন্তু আজ আর করল না। ওইটুকু বলেই হাতের কাজ সারতে লাগলো।

নবকুমারের চোখে ওই সূক্ষ্ম হাসিটুকু ধরা পড়ার কথা নয়, কিন্তু কেন কে জানে পড়লো। আর কেন কে জানে সে এতে একটা অপমানের জ্বালা অনুভব করলো। আর সেই অনুভূতির ফলেই ফট করে বলে বসলো, কেন, সাধনই বা কেন, আমি পারি না?

আমি নিয়ে যাবো, এ কথা বললো না অবশ্য, বললো, আমি পারি না? সত্য এবার ওদের অবাক করে দিয়ে ভাল গলাতেই হেসে উঠল। হেসে বলল, কী আশ্চর্য, পারবে না এ কথা কখন বললাম? তবে ওরা বড় হয়েছে, ওদের মায়ের ভার কিছু কিছু নেবে, এইটাই তো আশা।

বড় হয়েছে, ভারী লায়েক হয়েছে! বলে কথায় যবনিকাপাত করে অন্য এক মতলব ভঁজতে থাকে নবকুমার।

তবে আর একটা ঝড়ের আশঙ্কা করে। কিন্তু ঝড় ওঠে না। নবকুমার আশ্বস্ত হয়, আবার আশ্চর্যও হয়।

সত্য কি হঠাৎ বদলে গেল?

.

ঝড় উঠল অন্যত্র।

উঠল পরদিন।

স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা নামিয়ে সুবর্ণ ছুটে এসে হঠাৎ দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, মা মা, আমার একটা দিদি আছে?

সুবৰ্ণর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সত্য গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা, এই আমি কাঁচা কাপড়টা পরলাম, আর তুই ইস্কুলের জামায় ছুঁয়ে দিলি?

যাক গে, হোক গে, সুবর্ণ মায়ের হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বলে, ইস্কুল কি কিছু খারাপ জায়গা?

কাপড়ের কাঁচাত্ম যখন ঘুচেইছে, তখন আর কি করা! সত্য সস্নেহে মেয়েকে কাছে টেনে বলে, দুর্গা দুর্গা! তাই কি বলেছি? তবে বাইরের জামাকাপড়ে কত ধুলো-নোংরাও তো লাগে। সে যাক, দিদির কথা কি বললি?

সেই তো বলছি– সুবর্ণ মহোৎসাহে বলে, আমাদের ইস্কুলে একজন নতুন মাস্টারনী এসেছেন, তিনি আমার দিদি হন।

আঃ সুবর্ণ! আবার ওই রকম বিচ্ছিরি করে বলছিস? কতদিন বলেছি মাস্টারনী বলবি না!

বাবা তো বলেন! গোঁভরে বলে সুবর্ণ।

বলুক! সত্য দৃঢ়স্বরে বলেন, ছেলেমানুষদের ওসব কথা বলতে নেই। তোমরা কি ওঁদের মাস্টারনী বলে ডাকো?

ধ্যাৎ, আমরা তো দিদি বলি! একজন নতুন দিদি এসেছেন, তিনি বললেন, তিনি আমার দিদি হন!

সত্য অবাক হয়ে বলে, কে রে? নাম কি?।

নাম? নাম হচ্ছে নাম হচ্ছে–নাম হচ্ছে সুহাস দত্ত। উনির বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সিঁথেয় সিঁদুর নেই। একটা মেয়ে বললো, বেহ্ম তো, বেহ্মদের সিঁদুর থাকে না।

মেল ট্রেন চালিয়ে যায় সুবর্ণ।…হয়তো আরোই যেত। সত্য থামায়। রক্তিম মুখে বলে, সুহাস দত্ত? তুই ঠিক শুনেছিস?

এই দেখ মা’র কাণ্ড! শুনবো না? সবাই বলছে। কী সুন্দর দেখতে! আমায় বললেন, জানো আমি তোমার দিদি হই?

সত্য রুদ্ধকণ্ঠে বলে, তা তুই কি উত্তর দিলি?

আমি? আমি বললাম, দিদি হন তো আমাদের বাড়ি যান না কেন? তা উনি বললেন, সময় পান না। সত্যি মা? তোমার নিজের মেয়ে?–আমার মায়ের পেটের বোন?

সত্য বিচলিত গলায় বলে, কী বকিস বাজে? অত বড় মেয়ে আমার হতে পারে? ও আমার সম্পর্কে মেয়ে!

তবে যে উনি বললেন, তোমার মা আমার মা।

বলেছে, এই কথা বলেছে? সত্য হঠাৎ কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, তাতে তুই কি বললি?

বললাম, আচ্ছা আজ মাকে শুধাবো

দূর বোকা, ওকথা বলতে নেই। বলতে হয়—

কিন্তু কী বলতে হয়?

সত্য নিজের কি জানে এক্ষেত্রে কি বলতে হয়! তবু সত্য বলে, বলতে হয়, তবে চলুন আমাদের বাড়ি। ভারি বোকা তুই!

সুবর্ণ লজ্জা পেয়ে বলে, তাই বলবোই তো ভাবলাম। কিন্তু ভয় হল তোমাকে। তুমি পাছে রাগ করো।

সত্য হঠাৎ মেয়ের হাতটা ধরে আরো কাছে টেনে কেমন একরকম হতাশ গলায় বলে, ভয় হল? আমাকে তোদের ভয় হল? আমি কেবল রাগই করি?

সুবৰ্ণ মায়ের এই স্বর-বৈচিত্র্যে বিশেষ বিচলিত হয় না, সুযোগ পেয়ে যাওয়ার ভঙ্গীতে অবলীলায় বলে ওঠে, তা ভয় হয় না? ভয়ে তো কাটা হয়ে থাকি। বাবা এস্তক সবাই। তোমার মুখের পানে চাইতে প্রাণ উড়ে যায়। আবার বলা হচ্ছে, আমি কেবল রাগই করি? রাতদিন রাগের ঠাকুর হয়েই তো আছ!

রাগের ঠাকুর!

মেয়ের এই মনোহর নামকরণের ভঙ্গিমায় কি হেসে উঠল সত্য? বলে উঠল কি, আর তুই হচ্ছিস কথার ঠাকুর!

না, তা বলল না সত্য।

সত্য হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল।

সত্য এই অবোধ শিশুর অবাধ উক্তির মধ্যে যেন নিজের বহিমূর্তিটা দেখতে পেল।

ঠাকুর!

তা ঠাকুরই যদি হয় তো গাছতলায় পড়ে থাকা রুক্ষ দীর্ণ রৌদ্রের তাপে ঝলসানো এক শ্রীহীন শোভাহীন ভয়ঙ্করী ঠাকুর!

স্বামী-সন্তানের কাছে অতএব এই পরিচয় সত্যর?… প্রীতিকর নয়, ভীতিকর? এলোকেশীর সঙ্গে তফাৎটা কোথায় সত্যর?

নিজেকে এই পর্যায়ে তুলেছে সত্য? স্নেহহীন সরসতাহীন পাতাঝরা গাছের মত? হঠাৎ কি যে হল, ভিতরটা মোচড় দিয়ে হু হু করে একরাশ জল উপচে পড়ল সত্যর জোড়া ভুরুর নীচে বড় বড় গভীর কালো চোখ দুটির কোল বেয়ে।

সুবৰ্ণ অপ্রতিভ হয়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে। সন্দেহ থাকে না তার মা’র সেই বড় মেয়ের জন্যে মন-কেমন করছে।

মুহূর্তেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেয় সত্য। কান্নাঝরা মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, ওই সুহাস দত্ত কেমন পড়ায় রে?

সুবর্ণ লাজুক-লাজুক মুখে বলে, আমাদের তো পড়ান না, উঁচু কেলাসের মেয়েদের পড়ান।

উঁচু ক্লাসের মেয়েদের পড়ায় সুহাস!

বিধবা শঙ্করীর অবৈধ সন্তান সুহাস এত উঁচুতে তুলতে পেরেছে নিজেকে! কিসের জোরে? শিক্ষা, সাহস? শঙ্করীর নিজের এ জোর থাকলে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হত না তাকে।

সত্য কি নিজের সহিষ্ণুতা অসহিষ্ণুতাকে একটা সমস্যা করে তুলে তার মেয়ের এই উন্নতির পথকে কণ্টকিত করে তুলবে? এই কচি মেয়েটাকে নিতান্তই বাপ-ভাইয়ের কাছে ফেলে রেখে দিয়ে সত্য নিজে কাশীযাত্রা করবে মন বদলাতে? মনের স্বাস্থ্য ফেরাতে?

সে বদল কি এখানে থেকে একেবারেই অসম্ভব? মনের ওপর কি সেটুকু হাত নেই সত্যর? ইচ্ছে করলে কি সত্য আবার সেই অনেকদিনের আগের সত্যর মূর্তিতে ফিরে যেতে পারে না? যে সত্য হাসতে জানে, কৌতুক করতে জানে, নতুন নতুন রান্না করে আর খাবার করে স্বামী-পুত্রকে খাওয়াতে জানে! যে সত্য এই কিছুদিন আগেও মেয়েকে কত স্তব স্তোত্র পদ্য মুখস্থ করিয়েছে, তার পড়া ধরেছে।

কতকাল সংসারের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখে নি সত্য। এই ছোট্ট সংসারের গণ্ডিটুকুর বাইরে চোখ ফেলতে গিয়ে চোখে তা শুধু জ্বালাই ধরেছে তার। সত্যর ছোট ছেলের কথাই কি তবে ঠিক? সে যে বলে, জগতে যেমন কোটি কোটি মানুষ, তেমনি কোটি কোটি অন্যায়, সব দিকে তাকাতে গেলে যে চোখে ধাঁধা লেগে যাবে তোমার মা। নিজে তুমি কোন অন্যায় করছ কিনা সেটুকু দেখ ভাল করে।

সেটা তা হলে ঠিকই বলে?

নবকুমার যে সত্যর আদর্শের অনুযায়ী নয়, সে সত্যর ভাগ্য। আর হয়তো সেটা আশা করাও ভুল। নিজের গর্ভজাত সন্তান, নিজের হাতেগড়া পুতুল, তাই বা নিজের আদর্শ অনুযায়ী হয় কই? বড় ছেলেটা তো ঠিক তার বাপের ধারাতেই চলে যাচ্ছে।

সত্যর জীবন যদি এমন ঘঁচে-ঢালা সাধারণ না হয়ে খুব উল্টোফাল্টা অদ্ভুত কিছু হত! সুহাসের মত, শঙ্করীর দুর্গা দুর্গা বলে শিউরে উঠল সত্য।

আর তার চোখের সামনে হঠাৎ ভুবনেশ্বরীর মুখটা ভেসে উঠল। ঘোমটায় ঘেরা কপালে বড় বড় করে সিঁদুরের টিপ আঁকা-ভীরু নরম মুখ।

ভুবনেশ্বরী কোনদিন জগতের কোথায় কি অন্যায় ঘটছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যায় নি, তাল ঠুকে লড়তে যায় নি। ভুবনেশ্বরীর মুখটা ভেসে উঠল। ঘোমটায় ঘেরা কপালে বড় বড় করে সিঁদুরের টিপ আঁকা-ভীরু নরম মুখ।

ভুবনেশ্বরীর কোনদিন জগতের কোথায় কি অন্যায় ঘটছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যায় নি, তা ঠুকে লড়তে যায় নি। ভুবনেশ্বরী সবাইকে ভয় করেছে, সবাইকে ভালবেসেছে।

মায়ের মুখটা মনে পড়তেই হঠাৎ বাবার ওপর একটা ক্ষুব্ধ অভিমানের জ্বালা অনুভব করল সত্য। যেন মায়ের ওই অকালমৃত্যুর সঙ্গে বাবার কোনো অবিচার জড়িত আছে। সাহস করে একটা দিন একটা কথা বলতে পায় নি ভুবনেশ্বরী স্বামীর মুখের ওপর।

নিতান্ত আক্ষেপের সঙ্গে মনে এল সত্যর, ভুবনেশ্বরীর মেয়ে তার শোধ তুলেছে।

সত্য কি তবে জীবনকে নতুন মোড়ে বাঁক নেওয়াবে? সত্য শুধু তার সংসার-জীবনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলবে? সত্য সুখী হবার চেষ্টা করবে?

মেয়েটাকে নিতান্ত কাছে টেনে নিয়ে সত্য তার মাথার ওপর মুখ রেখে বলে, আমি কাশী চলে গেলে তুই কাঁদবি সুবর্ণ?

তুমি চলে গেলে?

সুবৰ্ণ মার স্নেহস্পর্শ থেকে ঠিকরে উঠে বলে, আমি যাবো না বুঝি?

তুই? সত্য হতবুদ্ধি। তুই যাবি কি? তুই কি করে যাবি?

যে করে তুমি যাবে! আমি যাবো না তো কে যাবে?

দেখ মুশকিল! আমার সঙ্গে তোর তুলনা? আমার ইস্কুল আছে? সেই ইস্কুল কামাই করে যাচ্ছি আমি?

সুবর্ণ গোঁভরে বলে, কামাই করলে কী হয়? বাবা তো বলে, ছোট মেয়েরা ঢের কামাই করে

বলেন বুঝি? ভাল! কিন্তু তোর বাপের মত কামাই করাকে ভাল বলি না। ইস্কুল কামাই করা চলবে না।

সুবর্ণ দৃপ্তস্বরে বলে, দেখো চলে কিনা! আমায় ফেলে রেখে চলে গেলে কী করি আমি দেখো!

সত্য আর রাগ করবে না।

সত্য হেসে ফেলে বলে, চলে গেলে আর দেখবো কি করে? তার থেকে বরং যাওয়া বন্ধ দিয়ে তুই কি করিস তাই দেখি বসে বসে!

ওমা, ওমা মাগো– সুবর্ণ মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, তুমি কী লক্ষ্মী!

ঠিক এই মিলন-মুহূর্তে নবকুমার এসে দাঁড়ায়, পিছনে এক দীর্ঘাকৃতি উত্তর ভারতীয়। সাজসজ্জা দেখে চিনতে ভুল হয় না, পাণ্ডাজাতীয়।

এই!

এই নবকুমারের ভেঁজে নেওয়া মতলব। কদিন আগে শুনেছিল তার অফিসের এক ভদ্রলোকের মা পিসি ইত্যাদি জনা ষোলো মহিলা দল বেঁধে গয়া কাশী মথুরা বৃন্দাবন যাচ্ছেন, পথ-সঙ্গী এই পাণ্ডাঠাকুর। তাই এঁকে নিয়ে এসেছে।

সত্যবতী মাথায় ঘোমটা টেনে গলায় আঁচলটা জড়িয়ে দূর থেকে একটি প্রণাম করে। আর নবকুমার উদাত্ত গলায় বলে, এই যে, এঁকে নিয়ে এলাম। কাশীর বিখ্যাত মানুষ ইনি–শ্রীরামেশ্বর পাণ্ডা। আমার এক বন্ধুর মা যাচ্ছেন এর সঙ্গে, তাই বলতে বলেছিলাম দয়া করে যদি তোমাকেও সঙ্গে নেন। তারপর তোমার বাবার ঠিকানায় ছেড়ে দেবেন তোমাকে। ইনি তাতে রাজী হয়েছেন। সামনের পূর্ণিমায় যাত্রা

সত্যর মাথার ঘোমটা নড়ে না, কিন্তু সত্যর গলা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বৃথা পাণ্ডাজীকে কষ্ট দিলে, আমি এখন আর যাচ্ছি না।

এখন আর যাচ্ছ না?

না।

নবকুমার ঈষৎ উষ্ণস্বরে বলে, তা আবার যখন হঠাৎ যাবার বাসনা চাপবে তখন এঁকে পাচ্ছো কোথায়?

না, ওঁকে আর কোথায় পাবো! সত্য মৃদু স্বরে বলে, তুমিই নয় কষ্ট করবে তখন!

ওঃ চালাকি! তা সেটা আগে বললেই হত। এভাবে ধাষ্টামো করতাম না… পাণ্ডাজী আপনাকে মিছে কষ্ট দিলাম, ইনি যাবেন না।

পাণ্ডাজী অবশ্য এই সামান্য বাধায় চট করে টলেন না, কাশীধামের মহিমা সম্পর্কে অবহিত করিয়ে দেবার জন্যে বহুবিদ বাক্যব্যয় করেন। কিন্তু সত্য বিনীত উত্তর দেয়, বাবা টানেন নি বুঝতেই পারছি। যখন টানবেন তখন না গিয়ে উপায় থাকবে না।

নবকুমার ক্রুদ্ধ প্রশ্ন করে, হঠাৎ মত বদলাবার হেতু?

সত্য এবারও বিনীত উত্তর দেয়, সুবর্ণটা হয়তো ছাড়বে না, সঙ্গে যেতে চাইবে, তাতে অনেক ইস্কুল কামাই হবে।

নবকুমার তো চিরদিনই বিরহে কাতর, তবে হঠাৎ উল্টো সুরে গান ধরে কেন? সত্য কাশী যাবে না শুনেই তো হাঁফ ছেড়ে বাচবার কথা তার, তবে চটে ওঠে কেন?

তা নবকুমারেরও “মন” বলে একটা বস্তু আছে বৈকি, আর সে মনের তত্ত্বও আছে। সত্য কিছুদিন কাশী ঘুরে আসতে যাচ্ছে, এই ঘটনাটাকে সে মনের মধ্যে বেশ একটু খাপ খাইয়ে নিয়ে বিরহকালীন অবস্থাটা ছকে নিয়েছিল, তার মধ্যে প্রধান কাজ ছিল মাকে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় এনে রাখা।

মনের মধ্যে কোথায় যেন একটু অপরাধ-বোধের কাঁটা বিঁধে আছে নবকুমারের বাপ মারা গিয়ে পর্যন্ত। মা আসতে চান নি সত্য, কিন্তু একেবারের জন্যেও অন্তত মাকে মহাতীর্থ কালীঘাট দর্শন করানো কর্তব্য ছিল বৈকি। যে কলকাতায় এতগুলো বছর কেটে গেল নবকুমারের, সেখানে একবারও তার মা এল না!

আগে এ চিন্তাটা এত প্রবল ছিল না, হয়েছে কিছুদিন আগে অফিসের এক বন্ধুর ধিক্কারে।

বন্ধু শুনে অবাক হয়ে গেছে নবকুমারের মা কখনো কলকাতায় তার বাসায় আসেন নি শুনে। নবকুমারকে স্ত্রৈনী বলে ধিক্কার দিয়েছে বন্ধু। সেই অবধি ওই চিন্তাটা পাক খাচ্ছিল মাথায়। আর এ কথাও পাক খাচ্ছিল, মাকে এনে স্বাধীনভাবে রাখতে হবে, বৌয়ের হাত-তোলায় নয়। তা ছাড়াও আছে কিছু কিছু মতলব।

যে সব আচার-আচরণগুলো মোটেই দোষণীয় নয়, অথচ সত্যর চোখে দোষণীয়, সে রকম কিছু কিছু করে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। সত্য থেকে গেলে তাও হয় না তাহলে। যেমন গড়গড়া খাওয়া। জগত্ৰহ্মাণ্ডে সবাই গড়গড়া খায়, শুধু সত্যর বরের খাওয়া চলবে না। এ কী জুলুম!

সত্যর অসাক্ষাতে অভ্যাসটা পাকা করে ফেলে যদি বলা যায় কবরেজ বলেছিল খেতে, আর এখন না খেলে পেটের মধ্যে গণ্ডগোল শুরু হয়, তা হলে ওটা কায়েম হয়ে যায়! নবকুমারের একান্ত বাসনার একান্ত কামনার ওই নেশাটি।

আরও একটা আছে।

পয়সার বাজী ধরে তাস খেলা।

তাকিয়ে ঠেসান দিয়ে শুধু ওই খেলা খেলে কত লোক কত রোজগার করে নিচ্ছে, অথচ নবকুমারের ওপর খাড়া উঁচিয়ে আছে সত্যর মাথার দিব্যি!

এত বাধা-বন্ধর মধ্যে থাকতে প্রাণ হাঁপিয়ে আসে।

আচ্ছা সত্য যখন বারুইপুরে ছিল তখন তো নবকুমার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় ছিল! তখন কেন এসব সাধ মেটায় নি?

তা সেটাও মনস্তত্ত্ব।

তখন নবকুমারের মনোভাবটা অন্য রকম ছিল। তখন সদাসর্বদা বিরহের যন্ত্রণাটাই প্রাণকে খাঁ খাঁ করে তুলত। সত্যর অনভিপ্রেত কিছু করার ইচ্ছা হত না।

কিন্তু এখন নবকুমারের মন পাল্টেছে। সেই পুলিসের ঘটনা থেকেই পাল্টেছে। নবকুমার দেখছে সত্য যেন দিন দিন শুষ্ক কাঠ হয়ে যাচ্ছে।

এখন সে যেন দেখতে পাচ্ছে, পুরুষ হয়েও সে চিরদিন পরাধীন। সত্যর ইচ্ছে-অনিচ্ছে, সত্যর রুচি-অরুচি, সত্যর ভ্রুকুটির ভয় নবকুমারকে যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। কেন রে বাবা, কেউ তো এমন বন্ধন-দশাগ্রস্ত নয়!

ওই যে মুখুজ্যে মশাই!

কত তাঁর বায়নাক্কা, কী তার মেজাজ! সদুদি বুড়ো বয়সে ঘর করতে এসেও সব কিছুর ঠেলা সামলাচ্ছে, তোয়াজ করে চলেছে। মুখুজ্যে মশাইয়ের বাড়িতেই তো তাসের জমজমাটি আসর।

সদুদি ডাবর ডাবর পান সেজে সেই আড্ডায় যোগান দিচ্ছে…কই, রাগ তো করছে না? নবকুমার ওসব ভাবতে পারে? পারে না।

এখন নবকুমারের তাই মুক্তির বাসনা জাগছিল। সত্যর আড়ালে শুরুটা করে ফেলে দেখাবে বিদ্রোহ, সে-গুড়ে বালি দিল সত্য।

তাও কারণটা কি?

না, সুবর্ণর ইস্কুল কামাই হবে!

এর চাইতে গাত্রদাহকারী কথা আর কী আছে?

পাণ্ডা চলে যেতে আর একবার মেজাজটা প্রকাশ করল নবকুমার। বলল, বন্ধুর কাছে মুখ থাকবে না তার। কারণটা শুনলে গায়ে ধুলো দেবে তারা।

সত্য হাসলো। বললো ধুলো ঝেড়ে ফেলতে জানলে লেগে থাকে না!

তারপর নবকুমার আসল কথায় এল।

বলি মেয়েকে বিদ্যেবতী করে হবেটা কী? তোমার ওপর আরো দশকাঠি বাড়া হবে, এই তো? গাঁয়ের পাঠশালা পড়েই যদি মায়ের এই মেজাজ হয়ে থাকে, কলকাতা শহরে ফ্যাসানি ইস্কুলে পড়ে মেয়ের কী হবে সে তো দিব্যচক্ষে দেখতেই পাচ্ছি!

সত্য তবুও হাসিমুখে বলল, তোমার যে এমন একজোড়া দিব্যচক্ষু আছে, তা তো জানতাম না! তা হ্যাঁগো, ওই চক্ষুতে আরো কি কি দেখতে পাচ্ছ বল তো? আচ্ছা আমি কবে মরব বল দিকি!

সব কথা তামাশা করে উড়িয়ে দিলেই হয় না! বলে রাগ করে উঠে যায় নবকুমার।

সেই রাগ-রাগ ভাবটাই বজায় থাকে।

সত্য যখন প্রতিজ্ঞা করেছে আর সে রাগের ঠাকুর থাকবে না, তখন সত্যর বর উল্টো প্রতিজ্ঞা করে বসে।

এই রাগের পালা কতদিন চলত কে জানে, হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটলো। সন্ধ্যের সময় সদু এক ঘটকি নিয়ে এসে হাজির। নাচতে নাচতে বললেই হয়।

ছেলের বিয়ে দিবি বৌ?

সত্য আকাশ থেকে পড়ল না।

সত্য প্রতিক্ষণ এই আক্রমণের আশঙ্কায় কাঁটা হয়েই আছে। কখন না-জানি কথা ওঠে! তাই সাবধানে বলল, পড়া-লেখাটা শেষ হলেই হবে ঠাকুরঝি।

সদু বিরক্ত কণ্ঠে বলে, তোর ছেলেদের লেখাপড়া যে কোনো কালে শেষ হবে বৌ, এ বিশ্বাস তো রাখি নে! বিয়ের বয়স তো গড়িয়ে গেল ছেলেদের। বড়টা তিন-তিনটে পাস করে বেরোলো, হাঁফ ফেলতে না ফেলতে দিলি ওকালতি পড়তে। ছোটটাও তিনটে পাসের একজামিন দিচ্ছে, বেরোতে না বেরোতে আবার কিসে ঢুকিয়ে দিবি তুই-ই জানিস! তা মাথার চুল পাকিয়ে ফেলে টোপর মাথায় দেবে নাকি ছেলেরা?

সত্য মৃদু হেসে বলে, ঠাকুরঝি বড্ড রেগেছ মনে হচ্ছে! কিন্তু ভেবে বল, একটা আয়-উপায়ের পথ না দেখে বিয়ে দেওয়াই কি ন্যায্য?

সদু আকাশ থেকে পড়ে।

সদু ধিক্কার দিয়ে বলে, নবকুমারের ঘরে কি ভাতের এমনি অভাব যে ছেলে উপায়ী না হলে আর ছেলের বৌ দুটো ভাত পাবে না? বলে, মা হয়ে এমন নির্লজ্জ কথা বললো কি করে সত্য? তার পর জোর করে বলে, ওসব মেমিয়ানা ছাড় বৌ, এই ঘটকি ঠাকরুণ এসেছেন, মন দিয়ে শোন ওঁর কথা। দুটি মেয়েই ওঁর হাতে আছে, সৎ বংশ, দেবে-থোবে ভাল, মেয়েরা দেখতে সুন্দর, একসঙ্গে লাগিয়ে দে।…আর আমার মামীবুড়ীর কথাটাও ভাব। বুড়ীর জন্মের শোধ একটা সাদ মিটুক।

নবকুমার আর ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারে না। বেরিয়ে আসে। এবং সঙ্গে সঙ্গে উদাত্ত কণ্ঠে বলে, পাগলের অনুমতি নিয়ে কাজ করতে গেলে তো জগতের সব কাজ-কারবারই বন্ধ থাকে সদুদি! তুমি ঘটকি ঠাকরুণকে বল মেয়ের বিবরণ দিতে। মেয়ে আমরা দেখব।

সত্যর প্রতিজ্ঞা, আর সে “রাদের ঠাকুর” থাকবে না। তাই হেসে মাথার কাপড়টা একটু টেনে গলাটা একটু খাটো করে বলে, তা হলে তো হয়েই গেল ঠাকুরঝি! স্বয়ং বাড়ির কর্তা যখন ভার নিলেন!

সদুর সামনে দুজনে মুখোমুখি কথা বলা শোভা পায় না, অতএব সদুর মাধ্যমে।

নবকুমার বলে, হাসি-তামাশার কথা নয় সদুদি, ছেলের বিয়ে আমি শীঘ্রই দেব। বিয়ের বয়েস হওয়া কি, বিয়ের বয়স গড়িয়ে গেল। আর সদুদি জিজ্ঞেস কর তোমাদের বৌকে, ছেলেরা যে বুড়ো হাতী হয়েও এখনো এক পয়সা ঘরে আনছে না সে কি ছেলেদের দোষ? ওদের গর্ভধারিণী দিয়েছে ওদের চাকরি করতে? আমি হতভাগা যতবার চাকরির সন্ধান এনে দিয়েছি, ততবারই অগ্রাহ্য করে ঠেলে দিয়েছে। তোমাদের বৌয়ের ছেলেরা জজ ম্যাজিস্ট্রেট উকিল ব্যারিস্টার হবে গো!

সদু আপসের সুরে বলে, তা হবে না কেন রে নবু? ভাগ্যে থাকলে ঠিকই হবে। ওসব মানুষের ছেলেরা হয় বৈ আর কিছু আকাশ থেকে পড়ে না তারা। কিন্তু তার জন্য বিয়েয় বাধা কি? আমি ঘটকি ঠাকরুণকে বলছি তাহলে বৌ!

সত্য নির্লিপ্ত স্বরে বলে, তোমার ওপর আর আমি কি কথা বলব ঠাকুরঝি!

আহা তুই মা, তুই বলবি না?

সত্য মুখ তুলে বলে, আমার কথাটাই যদি জিজ্ঞেস করছ ঠাকুরঝি, আমার ইচ্ছে পাসটা হয়ে গেলে

এবার ঘটকি খনখনিয়ে ওঠে, ওমা তোমার বেটার বৌ এসে কি বেটার বই কাগজ ছিঁড়ে দেবে? যেমন তেমন ঘর নিয়ে কাজ আমি করি না! এরা হল ঘাটালের মুখুজ্যেগুষ্টি। কত বড় বনেদী ঘর, চন্দরসূয্যি এদের ঘরের ঝি-বৌয়ের মুখ দেখতে পায় না। এ হচ্ছে জ্ঞেয়াতি বোন।

চন্দর-সূয্যি মুখ দেখতে পায় না!

সত্য একটু হেসে ফেলে বলে, ঠাকুরঝি, ঘটক ঠাকরুণকে বল, ওঁদের মেয়েদের জন্যে আরো মস্ত বনেদী ঘরের পাত্তর পাবেন, আমরা ওঁদের যুগ্যি নই! চন্দর-সূয্যির মুখ দেখেছে এমন মেয়েই আমার প্রার্থনা!

ভাই-বোন দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠে বলে, তার মানে?

মানে তবে স্পষ্ট করেই বলি! একটু লেখাপড়া জানা মেয়ে আনার ইচ্ছে। ইস্কুলে পড়ে এমন মেয়ের সন্ধান যদি থাকে–

কী, কী বললে?

নবকুমার ঠিকরে উঠে বলে, শুধু মেয়েকে বিদ্যেবতী করে সাধ মিটছে না, আবার বৌ আনতে হবে তাই? কেন, বৌ এসে তোমার ছেলের পড়া বলে দেবে?

ঘটক ঠাকরুণ একটু টেপা-হাসি হেসে বলেন, আহা, সে তো দেবেই গো! পরিবারের কাছে পড়া মুখস্থ না করে আজকের বাজারে কোন পুরুষমানুষটা আর উতরাচ্ছে? একালে পরিবারই মাস্টার। সেই মাস্টারের শিক্ষেই শিরোধার্য। তবে আমার হাতে তেমন মাস্টার মেয়ের সন্ধান নেই। এ হল একেবারে নবাবী আমলের বনেদী বংশ। এদের শিক্ষে-দীক্ষেই আলাদা। তা হলে আর কি করা! উঠি দিদি?

ঘটকির সঙ্গে সঙ্গে সদুও বিদায় নেয়।

কারণ যদিও একটা গলিপথ পার হওয়া নিয়ে কথা, তবু সন্ধ্যের পর একা যাওয়া চলে না। আবার তবে নবুকে কি ছেলেদের পৌঁছতে যেতে হয়। থাক।

ওরা চলে যেতে নবকুমার ফেটে পড়ে, বাড়িটাকে কী বানাতে চাও তুমি? বিদ্যের বিন্দাবন? ছেলেদের এত বিদ্যেয় হবে না, আবার বৌয়েরও চাই?

সত্য আস্তে বলে, চেঁচামেচিতে কাজ কি, ওরা ঘরে পড়া করছে, গলা তো তোমার দোতলা কোঠায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে। তবে এই কথাটাই বলি–আমার মতামত ইচ্ছে-বাসনার কথা যদি শুধোও তো বলব–কানা অন্ধ বৌ আমার ইচ্ছে নয়!

কানা অন্ধ! নবকুমার আকাশ থেকে পড়ে।

সত্য দৃঢ়স্বরে উত্তর দেয়, তা বৈ আর কি! ক-অক্ষর যে না চিনল সে অন্ধেরই সামিল! চোখ থাকতে অন্ধ!

সত্যর এই রায় দেওয়ার পর খুব একটা ঝড় ওঠে বাড়িতে। রাগের সঙ্গে হাসিরও। সত্যর ওই ‘অন্ধ’ কথাটার ব্যাখ্যাটা সবাইকে ডেকে ডেকে শোনায় নবকুমার এবং নিতাই ও নিতায়ের বৌ, মুখুয্যে মশাই, তার জীইয়ে-ওঠা ছোট গিন্নী, তার বড় মেয়ে, সবাই এই নতুন ব্যাখ্যার রসে মশগুল হয়ে হাসি-তামাশা করে।

শুধু সদুই হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।

আর একসময় নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কথাটা বৌ মিথ্যে বলে নি নবু, চোখ থাকতেই অন্ধ! এই তোর সদুদিরই যদি একখানা পত্তর লেখবার জ্ঞান থাকত, তা হলে হয়তো সারাজীবনটা তার বরবাদ হয়ে যেত না!

অতঃপর সদুই আশ্বাস দেয়, কলকাতা শহরে ইস্কুলে-পাঠশালায় পড়া মেয়ে পাওয়া অসম্ভব হবে না মনে হয়! বলে, আমি অন্য ঘটকি ধরছি!

অর্থাৎ ভাইপোর বিবাহ-তরণীর হাল সে এবার ধরবেই। দেখছে কাণ্ডারী বিহনে নৌকা বানচাল।

তুড়ুর কানেও অবশ্য এ আশ্বাস ঢোকে। এবং অবশ্যই সে আশার স্বপ্ন দেখতে থাকে। কারণ তার সহপাঠীদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে, দু-একজন তো ছেলের বাপ হয়ে বসে আছে। তার বিয়ের কথা উঠছে না কেন, এ কথা সে ভেবেছে মাঝে মাঝে।

তবে খোকা এক অসমসাহসিক কথা বলে বসেছে। বলেছে অবশ্য পিসির কাছে। দাদার হচ্ছে হোক, আমায় নিয়ে টানাটানি কোর না বাবা, আমি ওসবের মধ্যে নেই।

নেই? তুই তবে সন্নিসী হবি নাকি? ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল সদু।

খোকা সহাস্যে বলেছিল, কী যে হবো তা জানি না! সাপও হতে পারি, ব্যাঙও হতে পারি, তবে গলায় গন্ধমাদন নিয়ে যে কিছুই হওয়া যায় না এটা দেখে দেখে শিখেছি!

এত তুই দেখলি কোথায়? রাতদিন তো বই মুখে পড়ে থাকিস!

ওই ওর মধ্যে থেকেই সব দেখেছি!

সদু অবশ্য এ কথা গ্রাহ্য করে না

সদু ভেবে নেয়, একসঙ্গে তাড়াহুড়োর দরকার নেই, দুটো তো মাত্তর ছেলে। দুবারই ঘটা হবে, দাদার বিয়েটা হোক, রাঙা টুকটুকে বৌ আসুক, দেখব কেমন সন্নিসী হবার সাধ বজায় থাকে!

অতএব সেই রাঙা টুকটুকের সাধনাই করতে থাকে সদু। তবে ছেলের বয়েস গড়িয়ে গেছে, যেটের তেইশ বছরেরটি হয়েছে, ও ছেলের যুগ্যি মেয়ে নিতে হলে কোন্ না বারো! অত বড় বাড়ী মেয়ে সোন্দর পাওয়া শক্ত! সোন্দর মেয়ে কি পড়ে থাকে? তবু চেষ্টা করতে থাকে সদু।

.

তা চেষ্টায় বাঘের দুধ মেলে, সাধনায় ভগবান মেলে।

পাঁচটা দেখতে দেখতে তুড়ুর বৌও মিলল।

বারো বছর বয়েস, দেখতে ভাল, আবার লিখতে-পড়তেও জানে, মেমের ইস্কুলে পড়েছে তিন তিনটে বছর।

এরপর আর সত্য আপত্তি করবে কোন পথ দিয়ে?

না, সত্য আপত্তি করল না, সত্য তার বড় ছেলের মন বুঝেছে। কিন্তু আপত্তি এল অন্য দিক থেকে। আপত্তি করলেন এলোকেশী।

বড় ছেলের বিয়ে ভিটে থেকেই হওয়া উচিত, এ কথা সবাই জানে। সেই সব ব্যবস্থা করতে দিন দশেকের ছুটি নিয়ে নবকুমার দেশের বাড়িতে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল সুবর্ণকে। সুবর্ণই বায়না ধরলো, ওর গরমের ছুটি পড়েছে।

সত্যর ইচ্ছে হচ্ছিল না এতদিন মেয়েটা কাছছাড়া হয়, তা ছাড়া ছুটির মধ্যে পড়া তো তাহলে গাছে উঠল! এই দশ দিন এমনি কাটবে, তারপরই ভাইয়ের বিয়ে!

তবু না করাও শক্ত।

নবকুমার হয়তো বলে বসবে, হিংসে করে তুমি ওকে একবারও ঠাকুমার কাছে যেতে দাও না!

কাজেই হেসে মেয়েকে বলল, যা তবে, গাছের আম খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে আয়। দাদার বিয়েয় খাটতে হবে মনে রাখিস।

নবকুমার বলে, দেখ তোমার মেয়ের ওই ঘাগরা-টাগরাগুলো দিও না, ও থাক। কাপড়-চোপড় যা আছে তাই দাও সঙ্গে।

সত্য বুঝল পরামর্শটা সমীচীন।

নাতনীর পরনে ঘাগরা দেখলে এলোকেশী রসাতল করবেন। অতএব মায়ের দরুন একখানি পুরনো নীলাম্বর জামদানী পরে আর নিজের শাড়ির সম্বলগুলি নিয়ে মহোৎসাহে বাপের সঙ্গে রওনা দিল সুবর্ণ। আর সেটাই বোধ করি “কাল” হল।

ভিটেয় পা দিতে না দিতেই ঘটলো বিপত্তি। এলোকেশী সেই শাড়ি জড়ানো নাতনী দেখে হৈ হৈ করে বলে উঠলেন, বেটার বে’র তো তোড়জোড় করছিস নবা, বলি এত বড় ধিঙ্গি ধাড়ী মেয়ে ঘরে পুষে কেউ বেটার বে দেয়?

আর একটি মহিলা সভা উজ্জ্বল করে বসেছিলেন, তাঁকে চিনি চিনি করেও চিনতে পারে না নবকুমার। তিনিও বলে ওঠেন, কী ঘেন্নার কথা, এত বড় মেয়ে নবুর! ওমা, আর নবু ছেলের বিয়ের ভাবনা ভাবছে?

এলোকেশী অতঃপর তার ছেলের বৌয়ের যথেচ্ছার এবং ছেলের বৌয়ের পড়ুয়া অবস্থা নিয়ে সব আলোচনা করে বলেন, আমি এই তোকে বলে রাখছি মুক্ত, ওই বৌয়ের বুদ্ধির যোগেই এ বংশের চৌদ্দপুরুষ নরকস্থ হবে!

নবকুমার মৃদুকণ্ঠে বোঝতে চেষ্টা করে, মেয়েটার বয়স আর কত, আট বৈ তো নয়, পড়নট। ওর মার মত বাড়ন্ত বলেই–ছেলেরই বরং বয়স গড়িয়ে গেছে!

দুই মহিলার প্রবল কণ্ঠ-প্রতাপে সে কথা দাঁড়ায় না। ওঁরা বলেন, ওই মেয়ে আট? কেউ তো আর ঘাসের বীচি খায় না! আশ্চর্যের কথা, এলোকেশীও নাতনির জন্মকাল বিস্মৃত হন। আর নাতির বয়স তেইশ হল, সে কথা মানতে চান না!

কিছুক্ষণের পর নবকুমার টের পায়, মহিলাটি নবকুমারের ‘সইমা’র কন্যা মুক্তকেশী। দিন কয়েকের জন্যে তিনি তার সইমার কাছে এসে অবস্থান করছেন।

বেচারী সুবর্ণ ভেবেছিল, এসেই পেয়ারা গাছে উঠবে, পুকুরে ছুটবে, পাড়া বেড়াবে, ফুল তুলবে, সে জায়গায় কিনা এইসব আলোচনা!

থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেচারা।

এলোকেশী অবশেষে রায় দেন, ছেলের বে দিচ্ছে দাও, তোড়জোড় করে মেয়ের পাত্তর খোজো, যাতে এক যজ্ঞিতে কাজ হয়। পাঁচজনে না ধিঙ্গি আইবুড়ো মেয়ে দেখে পাঁচকথা বলতে পারে।

মুক্তকেশী মহোৎসাহে বলেন, এ মেয়ের পাত্তরের অভাব হবে না সইমা, রূপের ডালি মেয়ে। আজ বললে কাল হবে। আমি দেখছি।

কিন্তু ঠিক এইখানে হঠাৎ এক বজ্রপাত হয়।

সুবর্ণ ঝট করে বলে ওঠে, ইস্, এক্ষুনি বিয়ে হলেই হল! মা তাহলে বাবাকে মেরে ফেলবে না? আমি বলে এখন নতুন কেলাসে

কথা শেষ হল না।

তীব্র তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ যেন ঝড়ের বেগ নিয়ে আছড়ে পড়ল সুবর্ণর ওপর।

কী বললি? কী বললি? মা বাবাকে মেরে ফেলবে? ওরে নবা, একথা শোনার আগে আমার কেন মরণ হল না রে? ওরে ইস্কুলে পড়িয়ে এই বিদ্যে করছিস তোর মেয়ের? অ মুক্ত, এক ঘটি জল এনে আমার মাথায় থাবড়া। নইলে ‘বেম্মতেলো’ ফেটে মরে যাব। কোন কামরুপ কামিখ্যের ডাইনির হাতে আমার একটা মাত্তর সন্তানকে সঁপে দিয়ে বসে আছি, তুই দেখ মুক্ত!

মার এই আক্ষেপোক্তিতে দিশেহারা নবকুমার হঠাৎ আর কিছু না পেয়ে মেয়েটার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *