1 of 2

৪৫. কালিতলায় আবদুল আজিজের নতুন বাড়ি

কালিতলায় আবদুল আজিজের নতুন বাড়ি চিনতে কেরামত আলির বেগ পেতে হয় না। কার্তিক ভাদুড়ির বাড়ি বলতেই রিকশাওয়ালা এক কথায় চিনে ফেললো। মাধবীলতায় ছাওয়া কাঠের গেটের সামনে রিকশা থেকে নামতে কেরামতের সংকোচ হয়, এই বাড়িতে রিকশায় আসাটা বোধ হয় বেয়াদবিই হয়ে গেলো! গেটের পরে ঘাসে ঢাকা ছোটো মাঠ পেরিয়ে বারান্দা, বারান্দায় সতরঞ্চির ওপর বসে রয়েছে ১৫/২০ জন মানুষ। আবদুল কাদের কেরামতকে দেখে হাসলো।

ছোটোখাটো দালানটার ছাদের দিকে দেখতে দেখতে কেরামত সহজ হতে চেষ্টা করে। ছাদের রেলিঙের মাঝখানটা উঁচু, সেখানে সিমেন্টে খোদাই করা ওঁ এবং এর নিচে লেখা শ্ৰীশঙ্করালয় এবং তার নিচে ১৩০৭।—এসবের কোনো কিছুই সাম্প্রতিক

চুনকামে মুছে ফেলা যায় নি। রেলিঙটা না ভাঙলে ওগুলো ওঠানো মুশকিল।

আরে আসো, আসো। বসে পড়ো। বাবর টেস্ট পরীক্ষায় ফাস্ট হছে। স্কুলের স্যারদের একটু মিষ্টিমুখ করানো হচ্ছে আর কি। আবদুল কাদের সরে বসে কেরামতকে বসার জায়গা করে দেয়।

মিষ্টির প্লেট সাবাড় হলে আসে চা। বাবরের মেধা ও শ্রম নিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রশংসা ও উপদেশ পর্ব শেষ হলে শিক্ষকগণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত অবনতি সম্বন্ধে নিজেদের উদ্বেগ ও বেদনা জানাতে থাকে, কখনো একে একে, কখনো একসঙ্গে। ভালো টিচাররা সবাই চলে যাচ্ছে ইনডিয়া। স্কুল কলেজে কি তালা ঝুলবে নাকি? আবদুল আজিজ বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত : বাবর অঙ্ক কষতে অখিল বসুর কাছে, দিন পনেরো হলো তার বাড়িতে তালা ঝুলছে। শোনা যাচ্ছে অখিলবাবু চলে গেছে বালুরঘাট, তার বাড়ি একসচেঞ্জ করেছে এক মুসলমান রিটায়ার্ড সাব-ডেপুটির সঙ্গে।

শেরোয়ানি, পাজামা ও জিন্না টুপিপরা লম্বা ও রোগা হেডমাস্টারের কষ্টটা একটু বেশি। তার ব্যক্তিগত বন্ধু বলে কেউ থাকছে না। আবার স্কুলে পড়াশোনার মান ঠিক রাখতে তার হিমসিম খাবার জোগাড় হয়েছে।

হেডমাস্টারের কাছ থেকে একটু তফাতে বসেছিলো নীরেন লাহিড়ী, ২৫/২৬ বছরের যুবক, ওপরের ক্লাসে ভূগোল পড়ায়। বাবরের সবচেয়ে প্রিয় স্যার। নীরেন বারবার ওপরে তাকিয়ে বারান্দার ছাদের বিম, একদিকের দেওয়াল এবং অন্যদিকে বারান্দা ঘেঁষে পঞ্চজবা, টগর ও কামিনীর ফুলভরা গাছগুলো দেখছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে দেখা গেলো সামনের ছোটো বাগানে। বাড়ির সংস্কার করতে গিয়ে দোপাটি ও গাদা গাছগুলো চাপা পড়েছে বাশের নিচে, সে ঘুরছিলো ঐ জায়গাটায়। বাবর তাকে বারবার বলছিলো, চলেন না স্যার, ভেতরে চলেন। আমার পড়ার ঘরটা দেখবেন স্যার। আবদুল কাদের বারান্দা থেকেই ডাকে, নীরেনবাবু, যান না, ভেতরে যান।

নীরেন বারান্দায় ফিরে এলে আবদুল আজিজ বলে, বাবরের মুখে দিনরাত খালি নীরেন স্যারের নাম। যান, ওর পড়ার ঘরটা দেখে আসেন। তারপর জিগ্যেস করে, আগে এদিকটায় আসেন নাই, না? আপনার বাড়িতে মালতিনগর, না? আপনারা রেল লাইন পারই হতে চান না।

নীরেন কিছুক্ষণ ফাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, এটা আমার পিসিমার বাড়ি।

তাই নাকি? কার্তিকবাবু আপনার–।

পিসেমশাই। বড়োপিসেমশাই।

তাই নাকি?

পিসিমা মারা গেলো ফর্টি ওয়ানে, পিসেমশাই ফের বিয়ে করলেন। তারপরেও আমরা আসতাম। আর পিসিমা বেঁচে থাকতে তো প্রায় রোজই আসা হতো। আমার বড়োপিসিমা এই পঞ্চজবা, কামিনী লাগিয়েছিলেন। পিসিমার হাতের গাছ হতো! যা লাগাতেন তাই হতো! নীরেন লাহিড়ীর মনে হয় কথার ব্যামোতে পেয়ে বসেছে। তার প্রিয় শিক্ষক ও বর্তমান বস এই হেডমাস্টারের সামনে অনেক দিন মাথা নিচু করে বসে থাকাটা সে হঠাৎ করে পুষিয়ে নিতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে, আর পিসেমশাই লাগিয়েছিলেন কনকচাপার গাছটা। কলকাতা থেকে কলম নিয়ে এসে দুটো লাগান, একটা মরে গেলো, আর একটা বাঁচলো। কী সুন্দর ফুল যে হতো! ঐ যে ওদিকটায়, তাই না? গাছটা দেখছি না। কনকচাঁপার গাছ খুঁজতে সে এদিক ওদিক তাকালে আবদুল আজিজ কৈফিয়ৎ দেয়, ওখানেই ছিলো। লম্বা গাছটা তো? পাঁচিল তোলার সময় গাছটা আর রাখা গেলো না।

অতো সুন্দর ফুলের গাছটা নষ্ট করলা? কী সুন্দর গন্ধ! ইসমাইল ভাইয়ের বাড়িতে দুইটা আছে। কাদেরের এই আফসোসে আজিজ রাগ করলেও নীরেন লাহিড়ীর কাছে। গাছ কাটার কারণ ব্যাখ্যা করে, এই বাড়িতে তো চুনকাম হয় নি বহুদিন। ঘরের দেওয়াল টেওয়াল সব নষ্ট হয়ে গেছিলো। পাশের বাড়ির সঙ্গে সীমানা নিয়ে গোলমাল, তাই পাঁচিল ছিলো না ওদিকে। পাঁচিল দেওয়ার সময়।

বাড়ির সংস্কার ও উন্নয়নে নীরেনের উৎসাহ নাই, সে দাড়িয়েই থাকে। বাবর তাকে ভেতরে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করলেও সে নড়ে না।।

এর মধ্যে বড়ো রাস্তায় শোনা যায় নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর আওয়াজ। বারান্দার লোকজনের মধ্যে উসখুস শুরু হয়। এদের অনেকেই এই দুই বছর আগেও এই স্লোগানে উত্তেজিত, এমন কি উদ্দীপ্ত হয়েছে। আবদুল কাদের উঠে দাঁড়ায়, শালা শুকুর শেখ বোধহয় এসেছে। শালা রিফিউজিদের নিয়ে গোলমাল পাকাবার তালে আছে।

একজন শিক্ষক বলে, গত কয়েক দিনে টাউনে খালি রিফিউজি আসছে। যতীন রায়ের বাড়িটা রিফিউজিতে ভরে গেছে।

যতীন রায়? আমাদের যতীনবাবু? তাঁর বাড়ি কি রিকুইজিশন করা হয়েছে নাকি? হেডমাস্টারের এই উদ্বেগের জবাবে কাদের বলে, উপায় কী? এতো এতো রিফিউজি আসছে। তাদের শেলটার দিতে হবে তো।

হেডমাস্টার সন্তুষ্ট নয়, বিড়বিড় করে বলে, এতো বড়ো লিডার। তার মতো লোকের বাড়ি নিয়ে নেওয়া।

এই আক্ষেপের দিকে খেয়াল না করে কাদের নির্দেশ দেয়, আপনারা কয়েকজন আমার সঙ্গে আসেন। হিন্দু পাড়া, শুক্কুর আলি যা তা কিছু করে ফেলবে। হিন্দু শিক্ষকদের সে অভয় দেয়, আপনারা বরং বাড়ির ভেতরে যান। নিশ্চিন্ত থাকেন।

কয়েকজন নিয়ে সে বেরিয়ে গেলে হেডমাস্টারও তাদের সঙ্গে যায়।

বাইরের নারায়ে তকৃবির আল্লাহ আকবর-এর বুলন্দ আওয়াজের সাড়ায় এই। বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলি গলার তীক্ষ্ণ চিৎকারে লোকজনের কাপড়চোপড়ের ভাঁজে ভাজে ও কোঁচায় কেঁচায় এবং বারান্দায় ঝুঁকে পড়া পঞ্চজবা ফুলের লাল আভায়, টগরের সাদা পাপড়িতে, এমন কি কেটে-ফেলা কনকচাপার হারিয়ে-যাওয়া ছায়ায়। শিরশির করে ছমছমে কোলাহল, ও বাবরের বাপ! ও বাবর! আসিচ্ছে রে, আসিচ্ছে। ভাইজানের গলাত কোপ তুললো রে। হুমায়ুনেক টান দিয়ে লিয়া আসো গো। ও বাবরের বাপ।

আবদুল আজিজের স্ত্রীর ব্যারামের কথা বাইরের লোকদের মধ্যে জানে কেবল নীরেন। বাবরের মুখে তার মায়ের কষ্টের কথা শুনে ছেলেটির মাথায় সে হাত রেখেছে কয়েকবার। কিন্তু মহিলার সরাসরি আর্তনাদ নীরেনকে বড়ো বিভ্রান্ত ও বিব্রত করে তোলে। ছেলেটিকে কোনোভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাবনাও তার মাথায় আসে না নারায়ে তকবির-এর সঙ্গে হামিদার চিৎকার বাড়ে পাল্লা দিয়ে। আবদুল আজিজ বলে, মুশকিল, রাস্তায় সামান্য গোলমাল হলেই বাবরের মা অসুস্থ হয়া পড়ে। কলকাতায় হিন্দুরা তার ভাইকে মারলো–। বাবরের শিক্ষকদের মুখেচোখে ভয় দেখতে পেয়ে সে থামে।

ভাইজান, তাবিজ দিছিলেন? আজিজের কানের কাছে মুখ নিয়ে জিগ্যেস করে কেরামত আলি। সে এসেছে ফকির চেরাগ আলির বইটা নিতে। বইটা হাতছাড়া করার পর থেকে কুলসুমের সঙ্গে সে দেখাই করতে পারে না। তার স্বামী মরেছে, তমিজটা। বাইরে বাইরেই থাকে। কুলসুমের সঙ্গে দেখা করার, কথা কওয়ার কতো সুযোগ! অথচ তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াবার জো নাই। কুলসুমের এক কথা, তুমি হামার দাদার বই বেচা খাছো। তোমার ভালো হবি না। কেরামতের পদ্য আর আসে না, খোয়াবনামার মধ্যে কী যে আছে, তার হাতে পড়লেই কপাল খুলে যাবে। এখানে এসে সে একটু সুযোগ খুঁজছিলো। গোলমালের মধ্যে যাওয়াটা নিরাপদ নয় বলে কাদের সবাইকে ডাকলে সে মুখ লুকিয়েছিলো মোটা থামের আড়ালে। এখন আজিজকে বাবরের মায়ের কথা জিগ্যেস করলে আজিজও মহা বিরক্ত হয়ে বলে, দূর! ডাক্তারবদ্যি হেঁচা খাওয়ালাম। তাবিজ দিলো আমার মামাশ্বশুর। কৈ, তার ব্যারাম তো খালি বাড়েই দেখি।

আবদুল আজিজের কোঁচকানো ভুরুতে দমে গেলেও কেরামত আলি মরিয়া হয়ে বুকে বল সঞ্চয় করে, ফকিরের ঐ বইটা যদি পাই তো না হয় একটু চেষ্টা করা দেখা গেলে নি। কেতাবটা দেবেন?

কেতাব? কিসের কেতাব? আবদুল আজিজ একটু ভেবে বলে, তোমার ঐ ঘেঁড়া বইটা? তমিজের বাপের বই? আরে উগলান হাবিজাবি শোলোক শূন্যাই তো তার এই হাল। আমার মামাশ্বশুর কলো–।

মামাশ্বশুরের উক্তি প্রকাশ না করেই সে জানায়, নয়া বাড়িত ওঠার সময় গোলমালের মধ্যে বইটা যে কোথায় গেলো! আরে কতো দামি দামি জিনিস হারালো। আর তোমার ঐ বই!

আবদুল আজিজ বাড়ির ভেতরে লোকজনের ও তার স্ত্রীর খোঁজখবর নিতে গেলে এ কেরামত আরেকটি সুযোগ নেয়। বাবরকে সে কাছে টেনে বলে, বাবা, বইটা তোমার আব্বা কোটে থুছে তুমি কবার পারো?

তার কথা শুনে এবং তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করে বার মনে করতে পারে, ও হঁ্যা, আপনার ওই বই? খোয়াবনামা না কী যেন নাম না?–বইটা তো আব্বা কাউকে দেখতেই দেয় না। ওই বই হাতে পাওয়ার পর আব্বা নাকি এতো সস্তায় এই বাড়ি কিনতে পারলো! তারপর—।

বইটা তোমার আব্বা কোথায় রাখিছে কবার পারো?

না। তা ওই বই দিয়ে আপনি করবেন কী? পিকিউলিয়ার বই! কী সব স্বপ্ন টপ্ল নিয়ে আজগুবি কথা। আবার লাইন টানা স্কয়ার, ট্রায়াঙ্গল,মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। বাবরের হাসিতে বিজ্ঞানমনস্ক বালকের অবজ্ঞা। তা ছাড়া তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়াও মুশকিল। এই বাড়ির উত্তর দিক থেকে বাচাও! বাচাও! আর্তনাদ এবং তার। জবাবে বাড়ির ভেতর থেকে হামিদার ও বাবরের বাপ, ভাইজানেক কোপ মারলো গো! চিৎকারে সবাই চুপ মেরে গেছে। আবার এর মধ্যে কে যেন রাস্তা দিয়ে বলতে বলতে দৌড়ে যায়, বোসবাড়ি লুট হলো গো! আবদুল কাদেরের এক কর্মী এসে বলে যায়, আপনারা কেউ বাইরে যাবেন না। এখানে থাকলে ভয় নাই। পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে। সে ফিরে যেতে যেতে জানিয়ে যায়, লুটের সময় বাধা দিতে গেলে শুক্কুরের লোকদের হাতে বুকে ছুরি খেয়ে সিড়ির ওপর পড়ে রয়েছে ফণীবাবু। বড়োভাই মণীন্দ্র বোস আগেই সরে পড়েছে, সে বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে কোথাও।

এসব খবর আসছে তো আসছেই। এমন সময় এক গাদা ছেলেবুড়ো ও মেয়েমানুষকে নিয়ে আজিজের বাড়িতে ঢোকে কাদের। আজিজ যে কী করবে বুঝতে পারে না। তার মায়ের পেটের ভাই তার নতুন বাড়িটা মনে হয় সহ্য করতে পারে না, যতো সব উৎপাতের আখড়া বানাবার তালে আছে। দেখো, এর পরেই আবার হেডমাস্টারের নেতৃত্বে মণীন্দ্র বোস তার দুই ছেলে ও খুড়তুতো ভাই মিলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসে এক বুড়িকে। মহিলা হলো মণীন্দ্র বোসের বিধবা পিসি, সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সিঁথি খা খা করে রাখার পুণ্যে আজ তার মাথা ভরা তরল সিঁদুর। ভেতরের ঘরে একটা তক্তপোষে তাকে শুইয়ে দিতেই বয়স, লিঙ্গ ও সর্বোপরি জাতের কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে হামিদা ভাইজান, ভাইজান গো বলে চিৎকার করে তার বুকে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে পড়ে যায় মেঝেতে এবং কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে হারায় তার এমনি জ্ঞান। দুইজন বেহুঁশ মহিলার গায়ে গা লাগে নি বলে পরম নিষ্ঠাবতী ও ভক্তিময়ী পিসি মৃত্যুর মুহূর্তেও স্লেচ্ছাস্পর্শমুক্ত থাকায় মণীন্দ্রনাথ বসু স্বস্তি পায় এবং এই অবসরে তার তিন পুরুষের বনেদি বাড়ির মূল্যবান সম্পত্তি নিয়ে উৎকণ্ঠিত হবার সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে। মিনিট পঁচিশেক পর তার ছোটোভাই ফণীন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তার উৎকণ্ঠার টার্গেট অপরিবর্তিত ছিলো।

নীরেনকে এর আগেই বাবর নিয়ে গেছে তার পড়ার ঘরে। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে নীরেনের বাধো বাধো ঠেকছিলো, পিসি থাকতে এই ঘরে সে কখনো ঢুকতে পারে নি। এটা পিসিমার ঠাকুরঘর। খুব ছোটোবেলায় চুপ করে এই ঘরে ঢুকে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পিসিমার পিঠে। পূজা ছেড়ে পিসিমা তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় তার মায়ের কোলে তুলে দিয়ে বলেছিলো, দুষ্টু ছেলে, তোমার জন্যে আমাকে আর এখন ফের ঠাকুরের ভোগ রাঁধতে হবে। সেই থেকে ঠাকুরকে নীরেন একটু হিংসাই করতো। বড়ো হতে হতে সেই হিংসা আর রাগ তার আপনাআপনি ঝরে যায়। ঠাকুর কেউ থাকলে তো তার ওপর হিংসা হবে! ঠাকুরুদেবতা নিয়ে স্কুলে ছেলেদের সামনে নীরেন কম ঠাট্টা করে না। বাবরদের ক্লাসেই একদিন বলেছিলো, পৈতার অসম্মান করলে নাকি মাথায় বজ্রপাত ঘটবে। তা কলেজে ভর্তি হয়েইে তো পৈতা দিয়ে সে খাতা। সেলাই করেছে। কৈ তার মাথায় তো একটা দেশলায়ের কাঠিও জ্বললো না। আর এখন তার প্রিয় ছাত্রের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো পৃথিবীর মানচিত্র, আলমারির ওপর গ্লোব, টেবিলে ইনস্ট্রমেন্ট বক্স, রঙের বাক্স, বই খাতাপত্র। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো দেখেও ঠাকুরের অভাবে নীরেনের বুকটা পিসিমার জন্যে হু হু করতে থাকে।

পুলিসের গাড়ি এসে জীবিত, আহত, মৃতপ্রায় ও নিহত সবাইকে নিয়ে গেলে আবদুল আজিজের বাড়িতে প্রকট হয়ে ওঠে হামিদার চিৎকার। জ্ঞান ফিরে পেয়ে লাভ হয় নি, তার পাশ থেকে হুমায়ুন অথবা আহসানকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে সে চিৎকার করে, বিলাপ করতে থাকে।

আজিজ তার স্ত্রীর ব্যারামে ত্যক্ত হয়ে বাড়ির সামনে গেটের কাছে গেলে তাকে অনুসরণ করে আবদুল কাদের। বড়োভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে সে বলে, বাড়ির খবর শুনিছেন?

এই প্রশ্নে সে বাড়ির প্রতি আজিজের উদাসীনতাকে খোটা দেয়। আজিজ একটু বিব্রত হলেও পরিবারের নতুন সম্পত্তি হাতাবার জন্যে কাদেরের সন্দেহজনক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলে, মুকুন্দ সাহার বাড়ির চাবিটাবি তুই রাখিছিস? দলিল দস্তাবেজ ঠিক রাখিছিস?

চাবি বাজানের কাছে। দলিলও তার সিন্দুকের মধ্যে। পাহারা মোতায়েন করিছি আমি।

রাস্তায় বেরিয়ে কাদের দেখে তার পাশে পাশে চলছে কেরামত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *