৪৫. কাটে দিন, কাটে রাত্রি

কাটে দিন, কাটে রাত্রি।

সংঘর্ষটা আজকাল কম।

কারণ সত্যর একটা কাজ বেড়েছে, সে কাজ সুবর্ণর। সুবর্ণর মধ্যে বুঝি নিজের জীবনের সম্পূর্ণতা দেখবে সত্য। তাই ছোট্ট থেকেই তার ভাঙাচোরা খণ্ডগুলো জড়ো করে পালিশ করতে চায় সে, নক্সা কাটতে চায় তাতে।

এদিকে নবকুমারের প্রাণপুতুল সুবর্ণ।

অতএব সুবর্ণই এখন দুজনের মাঝখানে একটি মনোরম সেতু।

নবকুমার ডাকে, এই শুনছো তোমার মেয়ের বাক্যি?

সত্য ভ্রূভঙ্গী করে বলে, তুমি শোনো!

নবকুমার হাসে, আমার তোমার বাক্যি শুনতে শুনতেই জীবন ওষ্ঠাগত! তাই না?

সত্য হাসে, তোমার জামাইয়ের কপালে আবার বিধাতা কি লেখন লিখেছে দেখো!

নবকুমার রসিকতা করে বলে, তা সে কপালে শ্বশুর ব্যাটার চাইতে কোন্ না এককাঠি সরেস। মেয়েকে আবার মা মস্ত বড় বিদ্যেবতী করে তুলবে!

তা এসব রসিকতাই।

সংঘর্ষ নয়।

সুবৰ্ণ যেন সংসারের তপ্ত বালুকায় একটুকরো স্নিগ্ধ ছায়া! আচ্ছা, এই ছায়াটুকু কি মেয়ে মাত্রেই?

তাই কি মেয়েকে “লক্ষ্মী” বলে? “শ্রী” বলে? অন্তত সুবর্ণর ক্ষেত্রে এগুলো সফল হয়েছে। তাই সত্যর জীবনে যেন কিছুটা স্তিমিত শান্তি এসেছে।

অবিশ্যি ওরই মধ্যে একবার–ছেলেদের কলেজে পড়া নিয়ে একবার সংঘর্ষ উঠেছিল, তবে সেটা টেকে নি। নবকুমার বলেছিল, ছেলেরা এন্ট্রান্স পাস করেছে শুনে সায়েব তো মহাখুশি। বলে, দুই ছেলে একসঙ্গে পাস করেছে? গুড! তাদের, নবকুমারবাবু, আমি থাকতে থাকতে অফিসে ঢুকিয়ে দিয়ে যাই।

সত্য কথার মাঝখানে বলেছিল, পাগল!

পাগল। পাগল মানে? নবকুমার অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল খবরটা দেওয়ার পরই সায়েবের মহানুভবতা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করতে পারে। তার পর অফিসের সহকর্মীদের নবকুমারের সৌভাগ্যে কতটা ঈর্ষান্বিত হবে, সে প্রসঙ্গে নিয়ে হাসাহাসি করবে।

কিন্তু চিরাচরিত বিরুদ্ধতার নীতিতে সত্য এই সৌভাগ্য-সংবাদের উপরও অগ্রাহ্যের ঝাঁপটা মারে, বলে, পাগল!

নবকুমার বলে, পাগল মানে?

মানে ওরা এখন চাকরি করবে না, পড়বে।

পড়বে! আবার কত পড়বে? আর চাকরির জন্যই তো পড়া! তাই যখন হয়ে যাচ্ছে–

সত্য একবার নবকুমারের দিকে শীতল দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বলেছিল, না, চাকরির জন্যে পড়া নয়, মানুষ হওয়ার জন্য পড়া। তাছাড়া সাধন উকিল হবে, সরল ডাক্তার।

সাধন উকিল হবে, সরল ডাক্তার!

নবকুমার তীব্ৰস্তরে বলে, কোথায় দুজনে দু’মুটো টাকা ঘরে আনবে তা নয়, ঘরের কড়ি খরচা করে ওদের এখন বিদ্যেদিগগজ করে তুলতে হবে! লক্ষীছাড়া বুদ্ধি আর কাকে বলে!

তোমায় ওদের পড়ার জন্যে এক পয়সাও খরচা করতে হবে না।

আমায় করতে হবে না? চমৎকার! টাকাটা তা হলে আসবে কোথা থেকে?

সত্যবতী নিশ্চিন্ত স্বরে বলেছিল, ওরা ছেলে পড়িয়ে কলেজের মাইনে যোগাড় করবে।

সত্যবতী এই ঘোষণাটি উচ্চারণ করে কথায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে চলে যাচ্ছিল, নবকুমার সব্যঙ্গে বলে ওঠে, ছেলে পড়িয়ে! গলা টিপলে দুধ বেরোয়, কে ওদের মাস্টারির চাকরি দেবে?

সত্য হঠাৎ হেসে ওঠে, ওমা সে কি গো, আপিসে চাকরি দিতে চাইছিল

সেটা ওদের মুখ দেখে নয়। আমার খাতিরে

তা হলে ধরে নাও, আমারও কোথাও কিছু খাতির আছে।

তা আশ্চয্যি নেই, নবকুমার সক্রোধে বলেছিল, তুমি যে তলে তলে কী করে বেড়াও তুমিই জান! সাতটা বেটাছেলের কান কাটতে পার তুমি!

রেগেছিল, তবে পরাভব যে নিশ্চিত সেটাও বুঝে নিয়েছিল। শেষ চেষ্টা আক্ষেপ প্রকাশ।

সাহেবকে যে কোন মুখে মুখ দেখাব তাই ভাবছি!

ভাববার কিছু নেই, সত্য বলেছিল, বলবে ওদের মায়ের ইচ্ছে আরো লেখাপড়া করে।

সে কথা বলা মানেই বোঝানো, আমি পরিবারের কথায় চলি-

তা সে কথা ভাবলেও দোষ নেই, সত্য হেসেই উঠেছিল, ওদের সমাজে পরিবারই সর্বেসর্বা। পরিবারের কথায় ওঠে বসে ওরা।

ও, তুমি ওদের দেশে গিয়ে ওদের সমাজ সংসার দেখে এসেছ যে

সত্য আর একটু হেসেছিল, সবই কি আর চোখে দেখে তবে শিখতে হয়? চোখে না দেখে শেখা যায় না?

অতঃপর ছেলেরা কলেজ ভর্তি হল এবং সুবর্ণ মায়ের কাছে অ আ শিখতে শুরু করল।

সদু বেড়াতে আসে মাঝে মাঝে, দেখে গালে হাত দেয়, এক ফোঁটা মেয়েকে তুমি অক্ষর পরিচয় করাচ্ছ বৌ! পাঁচে পা না দিলে বিদ্যে ছুঁতে আছে!

সত্য মৃদু হেসে বলে, সে ছেলেদের ছুঁতে নেই। মেয়ের আবার নিয়ম! ওকে তো আর তোমরা হাতেখড়ি দিতে দেবে না?

তা তোমার বুড়ো বয়সের আহ্লাদীকে তাই দিতে বরং! তোমার তো সবই গা-জুরি!

বলে সদুও হেসেছে। সদু চিরদিনই হাসে, এখনও তার হাসির কামাই নেই, তবে ধরন বদলেছে।

সদুর দেহে মেদের সঞ্চার হয়েছে, সদুর মুখে পরিতৃপ্তির মসৃণতা! সদ্ গল্প করে, আমার বড় ছেলেটা, আমার সেজ মেয়েটা–, বলে, মেজ মেয়ে বোধ হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে আসবে!

সদুর সতীন তা হলে সত্যিই মরেছে?

নাঃ, তা নয়।

সদুর সতীন বেঁচে আছে, বরং ভালই আছে। রোগটা একটু সেরেছে, চেহারা একটু ফিরেছে। রাতদিন বলে, দিদি, তুমি যাই এসেছিলে, তাই তরে গেলাম! বলে, ওই কসাইয়ের হাতে পড়ে সারা জীবনটা শুধু জ্বলেপুড়ে মরেছি দিদি, যত্ন যে কী বস্তু তা তুমি আসার আগে কখনো জানি নি। গরীবের ঘরে মা-বাপ-মরা মেয়ে, তারা পার করেছিল না দূর করেছিল, তুমি বোধ হয় আমার আর জন্মের মা ছিলে।

সদু হেসে বলে, মরণ আর কি! কাকে কি বলতে হয় তা জানিস না? সতীনকে মা?

কিন্তু সতীনকে সদু সত্যিই মেয়ের অধিক যত্ন করে। যে মানুষটা আস্ত এত বড় একটা সংসার সদুকে ভোগ করতে দিয়েছে, তার ওপর কৃতজ্ঞতা থাকবে না সদুর?

মুকুন্দ বলেন, কী গো, তুমি যে দেখি অসাধ্য সাধন করতে পার! মড়াটাকে যে দিব্যি সারিয়ে তুললে?

মড়া কেন হবে? তোমার অছেদ্দা-অযত্নয় ঘুণ ধরে যাচ্ছিল। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সদু নিজস্ব স্বভাবে, শুকনো গাছটাতেও নিয়মিত জল দিয়ে ফুল ধরে, বুঝলে?

তা তো বুঝলাম–, মুকুন্দ ভারী যেন এক রহস্যের ভঙ্গিতে বলে, সতীনকাটাকে জীইয়ে তুলছ, ফিরে উল্টে তোমায় আবার বিধবে না তো?

সদু বলে, বেঁধার ভয় সৌদামিনী করে না। হুঁ, কন্টকশয্যাতেই তো জীবন গেল!

মুকুন্দ বিগলিত মুখে বলেন, এখন তাই ভাবি, কি কাজই করেছি এতকাল! এমন একখানা ঘরণী-গৃহিণী পরিবার থাকতে

সদু একটু আনমনা হয়।

বলে, মামা-মামীর সন্যে একটু কষ্ট হয়। মামী তো গতরটি নাড়তে চাইত না, এখন হাঁড়ির হাল হচ্ছে আর কি!

মুকুন্দ সতেজে বলেন, তা তাঁদের বেটা বেটার-বৌ থাকতে হাঁড়ির হাল হয় তো বলতে হবে অভাগ্যির কপাল! সে দায়িত্ব আমার নয়!

নয়ই বা বলি কি করে? অসময়ে আশ্রয়দাতা তো বটে? মামী না টানলে কোথায় ভেসে বেড়াতাম, কে বলতে পারে?

এ কথাগুলো মুকুন্দর গায়ে লাগে।

অতএব আরো সতেজ উত্তর দেন তিনি, টেনেছেন তোমার দরকারে নয়, নিজের দরকারে। তা ছাড়া যার হাঁড়িতে যার যতদিন অন্ন মাপা থাকে, কেউ রদ করতে পারে না, এ হচ্ছে শাস্ত্রের কথা!

শাস্ত্রবাক্যের পর বোধ করি আর তর্কের সাহস হয় না সদুর। অথবা অনেক দুঃখের শেষের এই পাতার আশ্রয়টুকু হারাবার ভয়।

মামা-মামীর কথা মনে পড়লে মন কেমন করে না তা নয়, কিন্তু আবার সেখানে ফিরে যাবার কথা ভাবতেও গা শিউরোয়।

.

তা গা শিউরোয় সকলেরই।

নবকুমার পর্যন্ত এখন শহর-জীবনের সুবিধে-স্বাচ্ছন্দ্যে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে দেশে যাবার নাম করে না।

কিন্তু তার এই নিশ্চিন্ত জীবন রইল না। হঠাৎ এল বিপর্যয়। খবর এল নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে মৃত্যুশয্যা নিয়েছেন।

খেয়ে উঠে ঘাট থেকে আঁচিয়ে ফিরছিলেন, হঠাৎ ঘাড় লটকে অজ্ঞান। কেউ বলছে সন্ন্যাস রোগ, কেউ বলছে ভূতে পাওয়া। তবে বাঁচার আশা নেই আর।

খবর পেয়ে নবকুমার উথলে উথলে কাঁদতে থাকে এবং এযাবৎকাল যে কোনদিনই পুত্র-কর্তব্য পালন করে নি, সে কথা তুলে ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করতে থাকে। তার সঙ্গে এ আমেজটুকুও থাকে, পরিবারের প্ররোচনাতেই তার এই অকর্তব্য আর অকৃতজ্ঞতা।

সত্য একটা ছোট তোরঙ্গে কয়েকটা কাপড়চোপড় পুরে নিচ্ছিল, নবকুমারের শোক উদ্দাম হয়ে উঠেছে দেখে উঠে এল। কঠিন গলায় বলে উঠল, তা স্ত্রৈণ পুরুষের তো এরকম হবেই। সে পুরুষের তুলনা ভেড়ার সঙ্গে। কেঁদে হাট বাধিয়ে আর কি হবে? এখুনি যাতে যাওয়াটা হয় সে ব্যবস্থা কর। কাঁদবার জন্যে অনেক সময় পাবে এর পর।

নবকুমার গলা ঝেড়ে নিয়ে বলে, আমি তো এখুনি রওনা দিচ্ছি।

তুমি একা নও, আমিও যাব।

তুমি! তুমি?

অবাক হচ্ছ কেন? কথাটা খুব আশ্চয্যি লাগছে?

না, মানে তুমি এখন হঠাৎ যাবে কি করে? সামনে ওদের একজামিন—

ওদের একজামিন, ওরা দেবে। তার জন্যে আমার আটকাচ্ছে কিসে?

আহা, বলি ভাত-জল তো দিতে হবে ওদের?

সে ওরা দু-ভাইয়ে দুটো ফুটিয়ে নিতে পারবে। সব গুছিয়ে বলে দিয়েছি।

অর্থাৎ ব্যবস্থা যা করবার সব করে ফেলেছে সত্য এই ক-ঘণ্টার মধ্যে।

নবকুমার হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ওরা নিজেরা? তার মানে আর একটা বিপদ ডেকে আনা? সবতাতেই গা-জোর! তার থেকে সদুদির কাছে থাক কদিন

না।

না? কেন, না কেন?

কেন, কী বিত্তান্ত এত কথা কওয়ার আমার সময় নেই এখন–

বেশ, কুটুমবাড়িতে যদি আপত্তি থাকে, নিতাইয়ের বৌ ডাল-তরকারি দিয়ে যাক্, ওরা শুধু দুটো ভাত সেদ্ধ করে

হয়েছে থাম তো তুমি! তুচ্ছ ব্যাপারকে এতখানি করে তুলো না। যে কদিন আমি না আসতে পারব পাতে-ভাতই খাবে, ব্যস!

নবকুমার আবার ডুকরে ওঠে, কদিন থাকতে হবে জান তুমি? বাবার যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়?

যা হবার তা হবেই। আগে থেকে ভেবে লাভ?

সদু বললো, বৌ, আমিও যাই তোমাদের সঙ্গে

সত্য সদুর শুকনো মুখটার দিকে তাকাল।

ভাবল এই শুষ্কতা কি শুধুই নিকট আত্মীয়ের জীবনমরণ নিয়ে দুশ্চিন্তায়? নাকি অন্য কিছু?

সদু কি ভয় পাচ্ছে, এরা সদুকে রোগীর সেবার জন্যে ঠেলে দেবে? ভয় পাচ্ছে, বাইরে কেউ ঠেলা না দিলেও, ঠেলার হাত এড়াতে পারবে না সে! ভিতরের ঠেলায়–

সত্য কী বুঝল কে জানে? বলল,

না ঠাকুরঝি, তোমার আর এখন গিয়ে কাজ নেই। আমরাই তো যাচ্ছি।

তা হলেও আমার একটা কর্তব্য তো আছে?

সত্য বলে, থাক ঠাকুরঝি, অনেক সমুদ্র পার হয়ে সবে একটু মাটি পেয়েছো, এখন আর নড়াচড়ায় কাজ নেই।

সদু অবাক হয়।

এ ধরনের কথা সত্যর মুখে যে বড় দুর্লভ। সদুর সতীনের ঘর করতে যাওয়াটা যে সত্যর সমর্থন পায়নি, এ কি সদু বোঝে না? তবে?

তবেটা কী, সত্য নিজেও ভাবে। ভেবে ঠিক করতে পারে না, সদুর প্রতি সেই ঘৃণা আর ধিক্কারের ভাবটা তার চলে গেল কী করে? আর কবেই বা গেল? এখন দেখছে সে জায়গায় এসেছে যেন করুণা, মমতা।

চিরবঞ্চিত সদুর মুখের পরিতৃপ্তির ছাপটাই কি সত্যর পাথর মনকে গলিয়েছে?

নাকি আজকের সদুর মাতৃমূর্তি দেখে উপলব্ধি করছে সত্য, কত বঞ্চিত ছিল সদু!

ভিতরের কথা ভিতরই জানে, তবে আজকাল সত্য সদুকে মমতা করে। এখনও করল।

সত্য তার বারুইপুর যাওয়াটা সমর্থন করল না দেখে কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এল সদুর। সেই চোখ মুছে বলল, মামী ভাববে সদু কত বড় বেইমান।

সত্য মৃদুস্বরে বলে, প্রাণ উচ্ছুজ্ঞু করেও কেউ কারুর ভাবা আর বলা আটকাতে পারে না ঠাকুরঝি, ও নিয়ে মন খারাপ করো না। ছেলে দুটো রইল, একটু দেখোশুনো।

সদু আক্ষেপের সুর তোলে, দেখাশুনোর আর পথ কোথায় রাখছিস বৌ, স্বপাকের ব্যবস্থা করে যাচ্ছিস শুনছি! কেন, পিসির কাছে দুদিন খেলে কি ওদের জাত যেত?

সত্য একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, জাত যাওয়ার কথা নয় ঠাকুরঝি, নিজের ভার যে নিজে বইতে হয় এইটুকুই শুধু ওদের শেখাতে চাই আমি। ওরা যেন ওদের বাপের মতন অসাড় না হয়।

.

পাড়ার কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি ঘর-বার করছিলেন এবং ভিতরে মহিলাকুল এলোকেশীর পুত্রভাগ্যের নিন্দাবাদে পঞ্চুমুখ হয়ে উঠেছিলেন।

এলোকেশীও নিঃসংশয় হয়েছিলেন, তার গোবর-গণেশ ছেলেকে বৌ হারামজাদী আসতে দেবে না। ছেলে থাকতে ছেলের হাতের আগুন পাবে না মানুষটা, এই আক্ষেপে তৎপর হচ্ছিলেন এলোকেশী, মানুষটার দেহে প্রাণ থাকতেই।

এই সময় হঠাৎ একজন ছুটে এসে খবর দিল, ওগো এসেছে!

কে? কে? আমার নবু এল?

নবু বৌ দুজনেই এসেছে।

কে? বৌ এসেছে?

এলোকেশী কি আশাভঙ্গ হন? ঈশ্বর জানেন। তবে এলোকেশী রোগী ফেলে ঘরের বাইরের এসে দাঁড়ান।

আর গরুর গাড়ি থেকে নেমে মানুষ দুটো বাড়ির উঠোনে পা দিতেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন, ওরে নবা লক্ষীছাড়া হতভাগা, এই শেষাবস্থায় এলি তুই বাপের মরা মুখ দেখতে? এলি এলি, তুই একলা এলি না কেন? ওই মায়াবিনী রাক্ষুসীকে নিয়ে এলি কেন? কী দেখতে এসেছে ও? মজা দেখতে? চিরদিনের দাপটে শাশুড়ীর তেজ-দপ্ন ভাঙা দেখতে এসেছে? শাঁখা-সিঁদুর ঘোচা দেখতে এসেছে?

সত্য গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করছিল। উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে, বিপদের সময় ধৈর্য হারাতে নেই মা, ধৈর্য ধরতে হয়।

.

কিন্তু সেযাত্রা নীলাম্বর মরলেন না। যম যেন বড় একটা কামড় বসিয়ে আবার ফেলে দিয়ে চলে গেল। শুধু কামড়ের দাগটা রইল মোক্ষম। কোমর থেকে নীচের দিকটা সব পক্ষাঘাতে অসাড় হয়ে গেল নীলাম্বরের।

কবিরাজ বললেন, এ রোগের এই দস্তুর। তড়ি-ঘড়ি গেল তো গেল, নচেৎ পক্ষাঘাত।

কিন্তু পাড়ার লোক গালে হাত দিল। বলতে লাগল, ধন্যি বটে এলোকেশী বামনীর শাখা সিঁদুরের জোর! নইলে সন্নেস রোগ হয়ে কেউ কখনো বাঁচে?

হতাশও একটু হল কেউ কেউ।

শাশুড়ী বিধবা হলে ওই অহঙ্কারী শহুরে বৌ কী রকম ব্যাভার করবে এবং কলকাতার মোটা মাইনেওলা চাকরে ছেলে বাপের শ্রাদ্ধে কী রকম ঘটা-পটাটা করবে এই জল্পনা-কল্পনা করছিল তারা, সেটা আপাতত দেখার সৌভাগ্য হল না। বুড়ো এখন এই ন্যাকড়ার ফালির মত লটপটে বা দুখানা আর অবশ কোমর নিয়ে কতকাল বাচবে কে জানে!

কবরেজ তো বলছে, এ অবস্থায় দীর্ঘকাল টিকে থাকতে দেখা যায়।

নবকুমারের ছুটি ফুরিয়ে গেছে, কামাইয়ে চলছে এখন। কিন্তু আর কতদিন চলবে? আড়ালে আবডালে কথাটা একদিন তুলল নবকুমার।

আড়ালেই, কারণ এখন আর রাত্রে একত্র হতে পারা যাচ্ছে না। সত্য সুবর্ণকে নিয়ে শ্বশুরের ঘরের পাশে ছোট্ট একটা ঘরে শুচ্ছে, দু’ঘরের মাঝখানের দরজা খুলে রেখে।

অতএব দিনের বেলাতেই—

ঘাটে যাচ্ছিল সত্য, পেয়ারাতলার ছোপটায় ধরল তাকে নবকুমার।

এ কি! ছিঃ!

সত্য হাত ছাড়িয়ে নেয়।

নবকুমার অপ্রতিভ হাস্যে বলে, তুমি যে একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে উঠেছ। দরকারী কথাও তো আছে!

সত্য বলে, বল।

বলছি এবার তলপী গোটাও। ছুটি তো কবে শেষ হয়ে গেছে। নেহাত সায়েব সুনজরে দেখে, তাই সাহস করে এতদিন কামাই চলছে। কিন্তু মাত্রা রাখতে হবে তো?

সত্য একবার আশশ্যাওড়ার বেড়া-ঘেরা আর কাটা-নটের জঙ্গলে ভরা উঠোনটায় চোখ বুলোয়, একবার ভরা আকাশটার দিকে তাকায়, তারপর নবকুমারের দিকে তাকিয়ে বলে, তা বেমাত্রা কাজ করবেই বা কেন? দুর্গা বলে বেরিয়ে পড় এইবার।

বেরিয়ে পড় বললেই তো পড়া হচ্ছে না। পাজিপুঁথি দেখতে হবে, বাড়িতে মায়ের কাছে থাকতে একটা ঝিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তোমাকে সেটা জানান দিচ্ছি। মায়ের কাছেও তো রয়েসয়ে পাড়তে হবে কথাটা?

সত্য শান্ত গলায় বলে, সায়েবের আপিসের চাকরি, ছুটি ফুরিয়ে গেলে অধিক দিন থাকা চলে, এ কথা কচি ছেলেটাও বোঝে, মাকেই বা বোঝাতে হবে কেন?

হবে কেন! জানো না মা চিরকালে অবুঝ! তোমার দ্বারা যতটি হচ্ছে, ততটি ঝিয়ের দ্বারা হবে না সেটা তো সত্যি। কাজে কাজেই

ঝিয়ের দ্বারা করাতে হবে কেন? সত্য স্থির গলায় বলে, আমার তো আর আপিসের ছুটি ফুরোয় নি? আমি তো চলে যাচ্ছি না কোথাও?

আমি তো যাচ্ছি না!

এ কী নিদারুণ বাণী!

নবকুমার আকাশ থেকে পড়ে।

তুমি যাচ্ছ না?

না, আমি এক্ষেত্রে যাব কি করে?

বুঝলাম। মানলাম সেটা অকর্তব্য হবে। কিন্তু ওদিকে? ছেলে দুটো কতকাল হাত পুড়িয়ে খাবে?

তা যতকাল না তাদের ঠাকুর্দার রোগ সারে

ও রোগ আর সেরেছে–, নবকুমার আক্ষেপে ডুকরে ওঠে, ও কি সারবার রোগ? এখন শুধু পড়ে পড়ে দিন গোনা!

সত্য সামান্য হেসে বলে, তা সে দিন তো কেউ একা বসে গোনে না, দিন গোনার সঙ্গী হতে হয় আত্মীয় বন্ধু ছেলেমেয়েকে।

তার মানে তুমি থাকবে?

নবকুমার চোখে অন্ধকার দেখে।

নবকুমার যেন অকূল সমুদ্রে পড়ে।

সত্য যে এমন একটা অদ্ভুত সংকল্প করে বসে আছে, এ কথা তো স্বপ্নেও ভাবে নি সে। বরং উল্টোটাই ভেবেছিল। ভেবেছিল সত্য কলকাতায় যাবার জন্যে এক পায়ে খাড়া আছে, প্রস্তাবটা উঠতে যা দেরি!

কিন্তু এ কী?

প্রথমটা সত্যর সংকল্পকে “অবাস্তব” বলে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে নবকুমার, অসম্ভব বলে অভিহিত করে, তারপর কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। ছেলেদের মুখ চাইতে বলে, নিজের টাইমের ভাতের কথা তোলে এবং শেষ অস্ত্র হিসাবে বলে ওঠে, আর এই যে বলেছিলে সামনের মাস থেকে সুবর্ণকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে, তার কি হবে?

তার? সত্য স্থির অবিচল গলায় বলে, হবে না।

হবে না? শখ মিটে গেল?

শখ?

সত্য কঠিন গলায় বলে, তা শখই যদি বলছো তো বলতে হয়, কর্তব্যের কাছে শখ বড় নয়।

নবকুমার আবার মিনতি শুরু করে। বার বার বোঝাতে থাকে, ভালমত একটা লোকের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে মা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে

সত্য একভাবে বলে, তা হয় না।

আর আমি যদি বলি সুবর্ণকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

ওটা বাজে কথা! ‘ছেড়ে থাকতে পারব না’ বলে কোনো কথা নেই জগতে। কত কারণেই ছাড়তে হয়।

নবকুমার কাঁদো কাঁদো হয়।

স্বামীপুরকে একেবারে ভাসিয়ে দেবে তুমি? বাবার তো এখন

পাগলামি করছো কেন? ধরো রোগটা যদি আমারই হত!

অতঃপর যুক্তির পথ ত্যাগ করে–এলোমেলো পথ ধরে নবকুমার। বলে, নবকুমারের কিংবা ছেলেদের যদি হঠাৎ অসুখ-বিসুখ করে?

সত্য মৃদু হেসে বলে, সে যদি করে, কপালে যদি লেখা থাকে, আমি কি আটকাতে পারবো?

আটকাতে না পারো সেবা করতে পারবে। সেটা?

কি মুশকিল! অত কথাই বা ভাবছো কেন? সহজ সুস্থ মানুষ, তিন বাপ-বেটায় থাকবে খাবে, এত ভাবনার কি আছে? আর তেমন দরকার হয়, ঠাকুরঝি তো রয়েছেন-

নবকুমার এবার মারমূর্তি হয়।

প্রায় খিঁচিয়ে উঠে বলে, তা তোমার সেই ঠাকুরঝিটিই বা কলকাতায় বসে সুখ করবেন কেন? তিনি এসে মামার সেবা করতে পারেন না? চিরকালটা এখানে কাটল

সত্য বিরক্ত হয়।

নিজের দায় অপরের ঘাড়ে চাপাব, অমন অন্যায় ইচ্ছে কেন? ঠাকুরঝির করার কথা, না আমার করার কথা?

নবকুমার অগ্নিশর্মা মুখে বলে, তারও কিছু কম কর্তব্য নয়! যে মামা এতকাল ভাত-কাপড় দিয়ে পুষল–

থামো। নীচ কথাগুলো আর বোলো না। ভাত-কাপড়ের কথা যদি বললেই তো বলি– তার দামও উসুল করে নেওয়া হয়েছে। পরের বাড়ি খাটলে বরং ভাত-কাপড়ের ওপর মাইনে বলে হাতে কিছু জমতে।

চিরকালের স্পষ্টবক্তা সত্য স্পষ্ট অভিমত প্রকাশে ভয় পায় না।

কিন্তু নবকুমার যোগ দেখাতে পারছে না। যতবারই ভাবছে যে একলা ফিরে যেতে হবে, আর সেই বাসাবাড়িটায় নিতান্ত বাসাড়ে হয়ে কাটাতে হবে কতকাল কে জানে, ততবারই বিশ্বভুবন অন্ধকার লাগছে তার।

এতর পরেও তর্ক করতে ছাড়ে না সে।

খোটা দিয়ে বলে, এতকাল তো শ্বশুর-শাশুড়ী-মুখো হতে ইচ্ছে হত না সত্যবতীর, হঠাৎ এত ছেদ্দা উথলে উঠল কেন? বলল, আর কিছু নয়, টাইমের ভাত রেঁধে রেঁধে আলিস্যি এসে গেছে, তাই গাঁয়ের বেটাইমের সংসার ভাল লাগছে।… ভয় দেখাল, ছেলেরা বড় হয়ে উঠেছে, এখন মায়ের চোখছাড়া হয়ে বেশীদিন থাকলে স্বভাব-চরিত্র খারাপ করে বসতে পারে। আরো অনেক রকম বলতে লাগল উল্টোপাল্টা সামঞ্জস্যহীন। তবু সত্যবতী নিজ সংকল্পে অটল।

ছেলেদের স্বভাব-চরিত্রের কথা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া দেখে শুধু ভুরু কুঁচকে বলল, তেমন ছেলে যদি মানুষ করে থাকি তো নিজের হাতে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলব ছেলেকে, আর নিজে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলব।

.

মোট কথা নবকুমারকে একাই ফিরতে হল। সুবর্ণ বাবা বাবা করে পথ অবধি ছুটে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল।

নীলাম্বরকে নিয়ে এখন সদসর্বদা আর জীবনমরণ সমস্যা নেই, অতএব এলোকেশী পেয়ারাতলার উত্তপ্ত বাদ-প্রতিবাদটির মূল রহস্য ভেদ করতে ঘর থেকে বেরিয়ে কাঁঠালপাতার ঝরাপাতা পরিষ্কার করতে থাকেন। কিন্তু পোড়া বয়সের এমনি জ্বালা, কানটা ভোতা হয়ে গিয়ে শত্রুতা সাধে। ভাল বুঝতে দেয় না।

অগত্যাই জিজ্ঞেস করতে হয়, অত কিসের রাগারাগি হচ্ছি নবার সঙ্গে?

সত্য উত্তর দেয় না তা নয়, দেয়, বলে, ছেলে ছেলের বৌয়ের ঘরোয়া কথা, ও আপনি শুনে কি করবেন মা?

আপনি!

হ্যাঁ, কলকাতা থেকে ফিরে শাশুড়ীকে আপনিই বলতে সত্য!

এলোকেশী এই “মেয়েমর্দানি” দেখে অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, মেয়েমানুষের মুখে বৈঠকখানার বেটাছেলের মত আপনি! আপনি-টাপনি বোলো না বাছা, শুনে গা জ্বলে যায়!

সত্য বলেছিল, যা সভ্যতা সৌজন্য তা করতে দোষ কি? বেটাছেলেরই সভ্য হতে আছে, মেয়েমানুষেরই নেই? গুরুজনকে আপনি বলাই তো ভাল।

একে হাড়জ্বালানো কথা, তায় সে আপনি! এলোকেশী বেসামাল হন। কোমরে কাপড় খুঁজতে খুঁজতে চিৎকার করেন, ওরে তোর ভেতরটা চিনতে আর আমার বাকী নেই! ওই আধমরা শ্বশুরকে ফেলে বাসায় যাবার জন্যে মরছিলি কোদল করে! বুঝি না আমি কিছু?

সত্য প্রায় হাসির সুরে বলে, তা আপনি আর বুঝবেন না কেন, প্রাচীন হয়েছেন, জগতের কত দেখেছেন!

দেখেছি, তবে তোর মতন আর দুটো দেখিনি। আর আমার ওই ভ্যাড়াকান্ত ছেলের মতন ছেলেও দুটো দেখি নি। যাবে তো নিয়ে মাথায় করে!

সত্য মৃদুস্বরে বলে, না, একাই যাবেন।

এলোকেশীর মুখে হাসির আভাস দেখা দেয়। কারণ এদিকে যত পাজীই হোক, কাজেকর্মে যে চৌকস। ও এসে পর্যন্ত তো এলোকেশীকে কোনো দিকে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে না। অত বড় রুগী, এই সংসার, গরুবাছুর, গাছপালা হাঙ্গাম তো কম নয়!

তাছাড়া মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গেছে এলোকেশীর, চলে যাবে ভেবে হাত পা আছড়ানি আসছিল, যাবে না শুনে আহ্লাদ গোপন করতে পারলেন না। ছেলে যে তার চিরকালের পিতৃমাতৃভক্ত সেটি সত্যর কাছে সাড়ম্বরে ঘোষণা করে বান্ধবীদের কাছে বলে বেড়াতে লাগলেন, যাবার জন্যে লাফিয়েছিল হারামজাদী! নবা কান করে নি! মুখে নাথি মেরে একা চলে যাবে। বলেছে! সেই নিয়ে ভাই কী ঝগড়া, কী ঝগড়া! কাক ওড়ে তো চিল পড়ে!

সত্য অপ্রতিবাদে শুনে যায় এসব কথা, স্থির-ধৈর্যে আপন কাজ করে যায়। সত্যকে ঈর্ষা-বিদ্বেষ ও সমীহর দৃষ্টিতে দেখছিল, কিন্তু যখন দেখল নবকুমার চলে গেল সত্যকে রেখে এবং সত্য ঠিক তাদেরই মতন জীবনযাত্রার মধ্যে নির্ভুল চলছে, তখন সাহস সঞ্চয় করে হৃদ্যতা করতে এল।

অবিশ্যি তারাও নেহাত খুকী নয়, কারো দু-একটা জামাই হয়ে গেছে, কারো নাতি-নাতনী রয়েছে। সত্যর বেশী বয়সে সন্তান হয়েছে, তাও প্রথমটি নেই, দ্বিতীয় তৃতীয় দুটি ছেলে। কোলপোছা এই মেয়েটার কবে বিয়ে হবে কে জানে! তাই সত্যর জীবনে পরিণতি আসে নি।

ওরা ওদের পরিণত বুদ্ধি নিয়ে বলে, বাব্বাঃ, দজ্জাল শাশুড়ী ঢের দেখছি, বৌ-কাঁটকী শাশুড়ীও দেখেছি, তোমার শাশুড়ীর মত এমন আর দেখলাম না! কী অকথা কুকথা কইতে পারে বাবা!

সত্য বলে, ভীমরতির বয়সে অমন কত আজেবাজে কথা বলে মানুষ! আমরাও বুড়ো হলে অবিশ্যিই বলব! রাগ করে লাভ কি?

ওরা কিছুদিন পরে দেমাকী বলে ত্যাগ করে সত্যকে।

.

ধীরে ধীরে মাস গড়ায়, মাস গড়াতে গড়াতে বছর। নীলাম্বর একই অবস্থায় আছেন, না জীবিত মৃত। আর তার সঙ্গে আরও একটা মানুষ নিতান্ত কর্তব্যবোধে জীবন্মৃত হয়ে পড়ে আছে। নবকুমার মাঝে মাঝে ছুটি-ছাটায় আসে। ছেলেরাও আসে। কিন্তু নীলাম্বরের জীবদ্দশায় যে সত্যকে নিয়ে যাওয়া যাবে এ বিশ্বাস আর নেই তাদের।

নবকুমার রায় দিয়েছে, ভূতে পেয়েছে ওকে। ওই খিড়কির দরজায় রাতবিরেতে যাওয়া! বেলগাছ কাঁঠালগাছ ছিষ্টি!

সত্যি ভূতে না পেলে কেউ এমন করে নিজের মাথা নিজে খায়? নিজের পায়ে নিজে কুড়ল মারে? সাধন-সরলও মায়ের দৃঢ়তায় অবাক হয়ে যায়।

তা এক হিসেবে ওই ভূতে পাওয়া কথাটাই হয়তো সত্যি। যে সত্য মেয়েকে স্কুলে দেবার জন্যে, মেয়ের বয়সটা অন্তত গোটাপাঁচেক হবার জন্যে একটি একটি করে দিন গুনছিল, সে হঠাৎ সে বিষয়ে এমন নির্বিকার হয়ে গেল কি করে?

কিন্তু সত্যি কি নির্বিকার?

ওই একটা কারণেই কি মাঝে মাঝে কর্তব্যবোধের বন্ধন ছিন্ন করে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না সত্যবতীর?

সে তো ভেবে নিয়েছিল অবস্থাকে মানিয়ে নিয়ে চলতেই হবে। অতএব নিজেই পড়িয়ে পড়িয়ে দুটো ক্লাসের যুগ্যি করে তুলবে সুবর্ণকে। কিন্তু এলোকেশী যেন ওইটিতেই বাগড়া দিতে বদ্ধপরিকর।

সত্যকে মেয়ে নিয়ে পড়াতে বসতে দেখলেই রেগে জ্বলে মরবেন তিনি, আর ছুতোয়নাতায় ডাক দিয়ে উঠিয়ে ছাড়বেন তাকে। সুবর্ণ যদি একবার পেন্সিল নিয়ে বসবে তো দূর করে দে, ফেলে দে ইত্যাদি তীব্র মন্তব্যে দিশেহারা করে তুলবেন বেচারাকে।

ক্রমশ আরো চালাকি চালাচ্ছেন, সুবর্ণ পড়তে বসলেই ডাকবেন, সুবর্ণ, তোর ঠাকুদ্দা তোকে ডাকছে!

সুবৰ্ণ মায়ের মুখের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে, সত্য চোখের আগুন চোখে চেপে বলে, যাও। শুনে এসো।

কিন্তু দু-এক ঘণ্টার মধ্যে আর ফেরে না মেয়ে। ফিরতে দেন না এলোকেশী।

ঠাকুর্দার গায়ে হাত বুলোনোর কাজে তাকে নিযুক্ত করে, মেয়েমানুষের বিদ্যে শেখা যে কতদূর গর্হিত কাজ তাই বোঝাতে চেষ্টা করেন নাতনীকে। এতেও কাজ না এগোলে সারা দুপুর তাকে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোন।

সত্য এক-আধদিন বলে, ঠাকুরকে ফেলে আপনি বেরোন, আমি কাজে থাকি, উনি একা পড়ে থাকেন।

এলোকেশী অপ্রতিভতা ঢাকতে বিরক্তিটা বাড়ান, তা থাকবেন না আর কি হবে? কথাতেই আছে নিত্যি নেই, দেয় কে? নিত্যি রুগী দেখে কে? আর ওই মানুষের কাছে বসা না-বসা! কথা জড়িয়ে গেছে, রাতদিন মুখ দিয়ে নাল গড়াচ্ছে, কী কথা কইব? কী সেবা করব? আমার আর রুচিও নেই। আজন্ম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেলেন, এখন বিছানায় পড়েও জ্বালিয়ে যাচ্ছেন! কই, যে লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষটা চিরটাকাল দখল করে বসে থাকল, সে এসে সেবা করতে পারছে না?

সত্য কখনো লজ্জা পেয়ে চুপ করে যায়, কখনো মৃদু প্রশ্ন করে, করতে এলে আপনি বাড়িতে ঢুকতে দেবেন?

এলোকেশী সদম্ভ চিৎকার করেন, ঢুকতে দেব? মুড়ো খ্যাংরা নেই বাড়িতে? ভাঙা আঁশবাটি? এই বুড়োর চোখের ওপর ঝেটিয়ে বিষ ঝাড়ব না? অঙ্গই পড়ে গেছে, চোখ দুটো তো আছে? দেখবে প্যাট-প্যাট করে!

আর প্রশ্ন করে না সত্য। আর উত্তর দেয় না।

আড়ালে সত্য সুবর্ণকে পড়ার জন্য তাড়না করে।

সুবৰ্ণ কখনো কাঁদে, কখনো সতেজ জবাব দেয়, আমি কী করবো? ঠাকুমা যে ডাকে! পড়লে গাল দেয়! ঠাকুমা যে রাগী!

বলে, তবু সত্য দিনে দিনে অনুভব করে, ঠাকুমার দিকেই ঢল নামছে মেয়ের, ঠাকুমারই ন্যাওটা হচ্ছে।

এ লোকসান সওয়া বুঝি কঠিন উঠছে ক্রমশ।

অথচ সুবর্ণকে দোষ দেওয়া যায় না। ঠাকুমার কাছেই যে সর্ববিধ প্রলোভনের বস্তু। ঠাকুমার সঙ্গে পাড়া বেড়ানো, ঠাকুমার সঙ্গে ঠাকুরতলায় গিয়ে বসে থাকা, ঠাকুমার কাছেই যত অপথ্যি কুপথ্যি আর ঠাকুমার কাছেই যত গল্প।

শুধু রূপকথার গল্প নয়। এমনি গল্পও চলে।

এলোকেশী বলেন, তোর মার কি ইচ্ছে জানিস? কলকাতায় গিয়ে তোকে মেমের ইস্কুলে পড়িয়ে আপিসে চাকরি করতে পাঠাবে। বিয়ে দেবে না, গয়না কাপড় দেবে না, খালি চোখ রাঙাবে আর পড়াবে। আর যদি আমার কাছে থাকিস তো লাল টুকটুকে বর এনে বিয়ে দেব, এত এত গয়না দেব, লাল বানারসী শাড়ি দেব। তারপর সে বিয়েতে কতো ঘটা করবো!

উৎসুক আগ্রহে অধীর শিশু ঠাকুমার কাছ ঘেঁষে বলে, কি গয়না দেবে ঠাকুমা?

এলোকেশী সোৎসাহে বলেন, এই মাথার মটুক, গলায় চিক, সাতনরী, দানার মালা, হাতে তাগা বাজুবন্ধ মুড়কি মাদলি, নীচের হাতে বাউটি কঙ্কণ, বালা শাখা, পায়ে মল চরণপদ্ম

সুবৰ্ণ বিগলিত কণ্ঠে বলে, আর খোঁপায় ফুল দেবে না ঠাকুমা? ও বাড়ির কাকীমার মতন?

হুঁ, তাও দেব। মাথায় ফুল, কানে সেঁড়ি ঝুমকো। এখন বল্ আমার কাছে থাকবি, না মার সঙ্গে কলকাতায় যাবি?

বলা বাহুল্য সুবর্ণ সতেজে বলে, তোমার কাছেই থাকবো।

তোর মা থাকতে দিলে তো? মেনে মেরে নিয়ে যাবে!

ই! দেবে না বৈকি! যাবে বৈকি! আমি তা হলে এমন কাঁদবো, আকাশ ফেটে যাবে!

এলোকেশী সহর্ষ চিত্তে বলে, তা তুই পারবি। সে জোর আছে। ওই মায়ের মেয়ে তো! মা যেমন কুকুর, তার উপযুক্ত মুগুর হবি তুই!

তিলে তিলে কাজ এগোয়।

দিনে দিনে পূর্ণশশী রাহুগ্রস্ত হতে থাকে। তা ছাড়া মাকে ঠিক একান্ত আপন হিসেবে দেখতেই বা পেল কবে সুবর্ণ?

নিতান্ত শৈশবটা তো কেটেছে পিসির কাছে, তার পর সত্যর উদাসীনতায় বাপের কাছেই বেশী বেশী। আবার বাপ চলে যাবার সময় বলে গেছে, তোর মা তোকে আমার সঙ্গে যেতে দিলে না!

তার উপর মানেই পড়া-লেখা। যে পড়া-লেখাকে ঠাকুমা বিষ দেখে। আর সুবর্ণরও কিছু মধু ঠেকে না।

অতএব মা সম্পর্কে একটু বৈরীভাবই গড়ে উঠছে সুবর্ণর। পরিপূরক হিসেবে ঠাকুমার প্রতি বন্ধুভাব।

সত্য এই ধ্বংসের ছবি দেখতে পায়।

তীব্র যন্ত্রণায় রাত্রে প্রায়ই ঘুম আসে না সত্যর। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে এ প্রশ্নও আসে আমি কি ভুল করেছি? নবকুমারের প্রস্তাবেই কি রাজী হওয়া উচিত ছিল তখন?

কিন্তু কে জানতো মৃত্যু এমনভাবে কুটিল ব্যঙ্গ করবে সত্যর সঙ্গে? কে জানতো একটা অনুভূতিহীন মাংসপিণ্ডও পৃথিবীর মাটি কিছুতে ছাড়তে চাইবে না?

আবার ভাবে, ছি ছি এ কী ভাবছি আমি! এ রকম চিন্তাতেও যে প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন!

অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সত্য। আর সেই সিদ্ধান্তের বশে নবকুমারকে চিঠি লেখে। তুমি অবশ্য করে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবে। সুবর্ণকে নিয়ে যাবে তুমি। নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেবে। যতদিন না আমি যেতে পারি, ঠাকুরঝির কাছেই থাকুক। এমন ভাবে ইহকাল পরকাল মাটি হতে দিতে পারব না মেয়েটার। ঠাকুরঝির কাছে ভালই থাকবে, বলতে গেলে সুবর্ণ তো তারই।

এই প্রথম নবকুমারকে চিঠি লেখা

এর আগে যা লিখেছে বা লেখে সবই ছেলেদের কাছে।

প্রথম পত্র, কিন্তু প্রেমপত্র নয়।

এ চিঠি নিয়ে নবকুমার সদুর কাছে গিয়ে সত্যর আক্কেল এবং নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে খুব গলাবাজি করে। কিন্তু সদুই থামায়। বলে, অন্যায়টা কি বলেছে বৌ? একদিকে জড় না-মনিষ্যি রুগী, একদিকে সংসার, আর একদিকে ওই দামাল ছটফটে মেয়ে। তার ওপর আবার মামীর মধুমাখা বাক্যি তো আছেই। পেরে উঠবে কেন তার? নয় নয় করে প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। না না, তুই তাকে নিয়েই আয়। আমি দেখবো। আহা, পড়া পড়া করে বাঁচে না বৌটা!

নবকুমারের মুখে আসে, তার চাইতে তুমিই যাও না দুদিন– ও চলে আসুক!

কিন্তু বলতে পারে না।

মুকুন্দ মুখুয্যে সামনে আসীন। এখন ওই বাজখাই এবং রাশভারী পুরুষটির গিন্নী সদু, মামার বাড়ি পড়ে থাকা হতভাগী ভাগ্নী নয়।

ঘাড় গুঁজে বলে, বেশ, তাই যাবো।

.

কিন্তু অলক্ষ্য দেবতা বোধ হয় তখন অলক্ষ্যে উপস্থিত ছিলেন আর কৌতুকের মেজাজে ছিলেন। তাই

তা বিধাতার কৌতুক ছাড়া আর কি?

এতদিন যে জড় মাংসপিণ্ডটা শুধু পরমায়ু ফুরোনোর অভাবেই পৃথিবীর খানিকটা জায়গা জুড়ে থেকে অজপা’র ঋণশোধ করছিল, সেই জড়পিণ্ডটা আচমকা এমন একটা মুহূর্তে তার বহু বছরের দখলীকৃত জমিটা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল যেটা একটা চরম মুহূর্ত।

অনেক কাটখড় পুড়িয়ে অনেক নিন্দে কুড়িয়ে আর এলোকেশীর অনেক শাপমন্যি উড়িয়ে দিয়ে সত্যবতী যখন কোন প্রকারে সুবর্ণকে নবকুমারের সঙ্গে বাড়ির বার করাতে সমর্থ হয়েছে, আর ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ কণ্ঠরুদ্ধ নবকুমার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে করতে পা বাড়িয়েছে, সুবর্ণকে নিয়ে গিয়ে ওই মায়ামমতাশূন্য হৃদয়হীনা পাষাণী মায়ের নাম ভুলিয়ে ছাড়বে, ঠিক সেই সময় বিধাতা সেই কৌতুকের হাসিটি হাসলেন। সে হাসির ফলে এলোকেশী সহসা প্রচণ্ড এক চিৎকারে গগন বিদীর্ণ করে ঘর থেকে আছড়ে এসে উঠোনে পড়লেন।

এত বিরাট চিৎকারের মধ্য থেকে কথা হৃদয়ঙ্গম করা শক্ত, তবে করতে পারলে শুনতে পাওয়া যেত, এলোকেশী সর্দমৃতকে উদ্দেশ করে চিৎকার করছেন, ওগো, হাতে করে মেরে ফেলল তোমায়, বেটা বেটার বৌ হাতে করে মেরে ফেলল!

হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত এই কলঙ্কই মাথায় বইতে হল সত্যবতী আর নবকুমারকে, হাতে করে মেরে ফেলেছে তারা নীলাম্বরকে। এলোকেশী আকাশ ফাটিয়ে বোঝাচ্ছেন সবাইকে, নাতনীটা তার প্রাণপাখী ছিল, সেটাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির বার করে নিয়ে গেল স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করে। আর বাচে মানুষ? যেই বার করে নিয়ে গেল, সেই বরফড়িয়ে প্রাণটা বেরিয়ে গেল। যাবে না? এত বড় দাগা বুক বুকে সয়? রোগজীর্ণ খাঁচাখানা মনের কষ্টে খুঁড়ো হয়ে গেল।

যে শুনল সে ছিছিক্কার দিল শহুরে ছেলে-বৌয়ের হৃদয়হীনতাকে। কেউ এ প্রশ্ন তুলল না, মন কেমন করবার মত মনটা নীলাম্বরের ছিল কোথায়?

দীর্ঘকাল ধরে বোধহীন অনুভূতিহীন একটা জড় মাংসপিণ্ড মাত্র হয়ে পড়ে ছিল যে প্রাণীটা শুধু পরমায়ু ফুরোনোর অপেক্ষায়, তার প্রাণপাখীর খবরটা এলোকেশী জানলেন কোন উপায়ে? নবকুমার এসে যখন বাবা বাবা করে সহস্র ডাক ডেকেছিল, এতটুকু চৈতন্যের স্ফুরণও তো দেখা যায় নি সেই পিণ্ডটার মধ্যে। সুবর্ণ চলে যাচ্ছে এই ভয়াবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি তবে ঝলসে উঠল তার রোগ চৈতন্য অনুভূতি?

না, এসব প্রশ্ন কেউ তোলেনি।

সত্যবতীর পাষাণীত্বটাই প্রধান হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু সে যাক, নিন্দে তো সত্যবতীর সঙ্গের সাথী, সমস্যা অন্য। সমস্যা এল পরে। বাপের শ্ৰাদ্ধশান্তি তো নবকুমার সাধ্যের অতিরিক্ত করল। সত্যর প্রবল প্ররোচনায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক খরচ করতে হল তাকে। বৃষৎসর্গ, পণ্ডিত বিদায়, শত ব্রাহ্মণকে ছত্র পাদুকা দান, অনেক কিছুই বিধান বার করেছিল সত্য। সদু এসেছিল মামার শ্রাদ্ধর ঘটায় এবং একা আসে নি, বরকে আর দুই ‘ছেলে’কে সদু সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। সদুর পাতাচাপা কপাল দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল সবাই। তা ছাড়া নিতাই, নিতাইয়ের বৌও এই উপলক্ষে গ্রামে ঘুরে গেল একবার। এ পর্যন্ত সবই বেশ। গোল বাধল যাত্রাকালে।

এখন আর সত্যবতীর এখানে থাকার কারণ নেই, অতএব যাবে। কিন্তু এলোকেশীর একা থাকার প্রশ্নটাও ফেলনা নয়। সত্যবতী প্রস্তাব তুললো, ঠাকরুণও এবার চলুন আমাদের সঙ্গে!

এ প্রস্তাবের খবরে সদু অবশ্য আড়ালে বলেছিল, মর নির্বুদ্ধির ঢেঁকি, নিয়ে যাওয়া মানে তো চিরকালের মত নিয়ে যাওয়া! তার মানে তোর সুখের সংসারে কুলকাঠের আংরা জ্বেলে দেওয়া! এতগুলো দিন তো হাড়মাস কালি করলি, স্বামীপুরের হাঁড়ির হাল হল। তার পুরস্কার হল খানিক বদনাম। আবার এখন শাউড়ীকে মাথায় করে নিয়ে যা, আর ও তোর বুকে ভাতের হাঁড়ি বসাক!  বলেছিল সদু, কিন্তু নবকুমার হাতে চাঁদ পেল। মার যদি এত বড় একটা সুব্যবস্থা হওয়া সম্ভব হয়, আর ভাবনা কি? সত্যিই সত্যর বুদ্ধি আছে সাহসও আছে।

কিন্তু এলোকেশী এ সুব্যবস্থায় কর্ণপাত করলেন না। তিনি আর একবার ছেলেকে ধিক্কার দিলেন, বাপ মরতে না মরতে ভিটের সন্ধ্যেপিদ্দিম বন্ধ করার প্রস্তাবে।

সন্ধ্যাদীপ? তা তার জন্যে জ্ঞাতিদের কাউকে বলে কয়ে এলে?

গলায় দড়ি এলোকেশীর!

যাদের দেখলে বিষ ওঠে তার, তাদের শরণাপন্ন হতে যাবেন? তা ছাড়া এই চিরকালের জায়গা ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে শহুরে খাঁচায় দমবন্ধ হয়ে মরতে যাবেন তিনি, বিবি বৌয়ের সুবিধে করতে? এসব দুর্মতি ছাড়ক নবকুমার!

তা হলে?

সমস্যার সমাধানটা কি?

কি আবার, রাতে আগলাতে একটা শক্তপোক্ত মেয়েলোক ঠিক রেখে যাক নবকুমার মায়ের জন্যে, আর মায়ের এই শোকাতাপা প্রাণ শীতল করতে মেয়েটাকে রেখে যাব। এখুনি ওজে ছিঁড়ে নিয়ে গেলে এলোকেশীও নির্ঘাত পতি-পদাঙ্ক অনুকরণ করবেন।

নবকুমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, শুনলে কথা?

সত্যবতী যাত্রাকালের গোছগাছ করছিল, সে গোছ বন্ধ না রেখেই বলল, শুনলাম বৈকি।

এখন উপায়?

উপায় আর কি! মাকে দমবন্ধ করে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে তো লাভ নেই? তার থেকে একটা ঝিয়ের ব্যবস্থাই কর।

আর সুবর্ণ?

সুবর্ণ আমাদের সঙ্গে যাবে। সংক্ষেপে রায় দেয় সত্য।

তা তো যাবে, কিন্তু একেই তো বাবার জন্যে বদনামের শেষ নেই, তার ওপর আবার যদি মা সত্যিই 

কি? যদি মন-কেমন করে মরে যান? সত্য তীক্ষ্ণ একটু হেসে বলে, তা হলে তো সহমরণের পুণ্যিই হয়ে যায়। একই অনলে দগ্ধ হয়ে উভয়ের মৃত্যু!

তামাশা করছ?

পাগল! এ কী আবার তামাশার কথা?

আমি কিন্তু বলতে পারব না মাকে।

তোমায় বলতে হবে না। যা বলবার আমিই বলবো।

কিংকর্তব্যবিমূঢ়, নবকুমার বুঝে উঠতে পারে না, এক্ষেত্রে কি করা উচিত। মা যেটা বলেছেন সেটা অযৌক্তিক, বৌ যেটা বলছে সেটা অকর্তব্য। তা হলে?

অবশ্য একটা কাজ আছে নবকুমারের। চিরকালের কাজ। প্রথমে একবার সত্যর কথার প্রতিবাদ করে নেওয়া। সেটাই করে। বলে, পিতৃহত্যার পাতক হয়েছি, আবার মাতৃহত্যার পাতক হবো?

সত্য অবিচল।

উপায় কি? তোমার ললাটে যদি বিধাতা এই দণ্ড লিখে থাকে, তাই হবে!

সুবর্ণ তোমার একলার নয়। বাপ-ঠাকুমারও ওর ওপর দাবি-দাওয়া আছে!

তা অবশ্যই আছে। তবে কতখানি আছে তার ফয়সালা করতে তো আবার তোমাদের আইন আদালত করতে হয়।

কী বললে? কী বললে তুমি?

কিছু না। সত্য হাতের কাজে মন রেখে বলে, যা বলাচ্ছ তাই বলতে হচ্ছে।

শ্বশুরের সময় তো কর্তব্য উথলে উঠেছিল, আমাকে একেবারে ধুলোর অধম করছিলে, এখন শাশুড়ীর বেলায় এমন মারমূর্তির কারণ?

কারণ বোঝাতে বসি, এত ধৈর্য আমার নেই। সুবর্ণ আমার সঙ্গে যাবে, এই হচ্ছে কথা। সত্যর শেষ কথা।

অতএব এ কথার নড়চড় নেই।

তা ছাড়া ওদিকে ছেলে দুটো তালেবর হয়ে উঠেছে, আর মা-অন্ত প্রাণ তাদের, বাপের সঙ্গে আদৌ বনে না। কাজেই পৃষ্ঠবল সত্যরই বেশী।

কলেজ কামাই হচ্ছে বলে চলে গেল ছেলেরা, কিন্তু যাবার সময় বলে গেছে, মা যা বললেন, নিশ্চিত তাই যেন করা হয়।

এ কী বেপরোয়া কথা! এ কি দুঃসাহসিক কথা! বাপ তুচ্ছ মা প্রধান?

নবকুমার এ সমালোচনা তুলেছিল, কিন্তু সত্যর ব্যঙ্গ থামিয়ে দিয়েছে তাকে। সত্য বলে। উঠেছিল, আহা, তা ওতে রাগের কি আছে? মাতৃভক্তির বংশ, মাতৃভক্ত হবে না? কেন, মাতৃভক্তি কি খারাপ বস্তু?

যদিচ মেয়েকে আর বৌকে এই দীর্ঘকাল পরে নিয়ে যেতে পেরে কৃতার্থ হচ্ছে নবকুমার, তবু স্বভাববশেই এই তর্ক এই প্রতিবাদ। যথারীতি শেষ পর্যন্ত সত্যই ইচ্ছাই জয়ী হল। প্রায় দু বছর পরে আবার শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ ডিঙোল সত্য, স্বামীর সঙ্গে মেয়ের হাত ধরে।

পিছনে মড়াকান্না কাঁদতে লাগলেন এলোকেশী আছড়ে আছড়ে, কপালে ঘা মেরে মেরে।

.

এবার কিন্তু গ্রামের লোক এলোকেশীর কাজকে তেমন সমর্থন করল না। বলতে লাগল, ছেলে-বৌ নিয়ে যেতে চাইছিল গেলেই হত! কালী–গঙ্গার দেশ, কতবড় একটা তীর্থস্থান! যেতে বাধা কি ছিল? সত্যি তো আর ছেলে অফিস ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে না? আর বৌও চিরকাল স্বামী-পুতুরের সংসারকে ভাসিয়ে বসে থাকবে না! তবে? একা ঘরে কোন দিন মরে থেকে পাড়ার লোকের হাড় জ্বালাবি! তা ছাড়া ছেলেটা যাত্রা করছে, মহাগুরু নিপাতের বছর পড়ল তার, মড়াকান্না কেঁদে এ কী অকল্যেণ করা?

এ যাবৎকাল এলোকেশীর সকল প্রকার আচার-আচরণই সমর্থনযোগ্য ছিল, এই প্রথম তাতে ভাঙন ধরলো।

কে জানে কেন? কে বলতে পারে কারণ?

এলোকেশী একা থাকায় পরোক্ষে পাড়ার লোকের ওপর কিছুটা দায়িত্ব পড়ল, তাই কি?

অথবা বেশ কিছুটা বেওয়ারিশ জমিজমা বাগান পুকুর গাছগাছালির সূক্ষ্ম লোভে বাগড়া পড়ল তাই? ফলে-ভর্তি তিনটে বাগান এলোকেশীর মাছে-ভর্তি দুটো পুকুর। তাছাড়া এদিকে ওদিকে আরো কত সব!

নাকি অত লুব্ধমনা নয় এলোকেশীর বান্ধবীরা? এ শুধু চিরাচরিত প্রভাব। বৈধব্যে স্ত্রীলোকের বাজারদর একটু পড়েই যায়। “কর্তার গিন্নী”র দামই আলাদা। কর্তা গত হলে যা কিছু জোর গলার জোর।

সে যাই হোক, মোট কথা অবস্থাটা এই।

এমন কি নিতাইয়ের বৌ পর্যন্ত নবকুমারের মুখে ওই মড়া কান্নার গল্প শুনে সত্যবতীর পক্ষ হল। হল হয়তো মনের অবস্থা তার হঠাৎ একটা কারণে ভয়ানক খারাপ হয়ে গেছে বলেই। শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন সেরে বেশ উৎফুল্ল মনেই কলকাতায় ফিরেছিল বেচারী, এসেই মাথায় বাজ! অভাবনীয় কাণ্ড!

মায়ের কোলপোছা একেবারে সব ছোট বোনটা– এই কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছিল, বেগোরে প্রাণ হারিয়েছে তার আগে বোন। এসে দেখল ভাই বসে হাউ হাউ করে কাঁদছে। জানালো, মেরে ফেলেছে তাকে শাশুড়ীতে আর বরেতে মিলে। স্রেফ মেরে ফেলেছে। মেরে ফেলে রটিয়েছে রাত্রিকালে ঘাটে যেতে আছাড় খেয়ে পড়ে মরে গেছে।

মেরে ফেলেছে! হা হয়ে গেল নবকুমার।

নবকুমার আর সত্যবতী দুজনেই এসেছিল ভাবিনীর এই শোকতাপ শুনে। ইদানীং ভাবিনী নবকুমারের সঙ্গে একটু আড়াল রেখে একরকম কথাই কয়। এখন শোকের সময় আরো বাধ ভেঙেছে।

মেরে ফেলল! নবকুমার বলে তীব্র স্বরে, এ কি মগের মুলুক?

তা ছাড়া আর কি, ভাবিনী চোখ মুছতে মুছতে বলে, সকল খুনের শাস্তি আছে, দেশে বৌ খুনের তো আর শাস্তি নেই! ওই ছেলের আবার এক্ষুনি ড্যাংডেঙ্গিয়ে বিয়ে দেবে মাগী। যেতে আমাদেরই গেল। কচি বাচ্ছা, ন বছর পেরিয়ে এই সবে দশে পা দিয়েছে ভাই, কিছু জানে না কিছু বোঝে না। আর কী ভাল মানুষ! শ্বশুরবাড়ি যাবার নামে সাত দিন ধরে খায় নি দায় নি, শুধু কেঁদেছে। গেল আর একটা মাসও না যেতেই এই। মায়ের আমার অবস্থাটা ভাবো।

আরো বহুবিধ আক্ষেপ করতে থাকে ভাবিনী।

বলে, নিজের তার পেটে একটা জন্মায় নি। মায়ের এই কোলপোঁছা মেয়েটাকে সন্তানতুল্য দেখত, যেতে কিনা সেটাই গেল! স্তব্ধ হয়ে বসে শুনছিল সত্য, সান্তনা দেবার চেষ্টা করে নি, অনেকক্ষণ পরে আস্তে বলে, মেরে ফেলেছে, সে কথা কে বললে? এমনি যা বলছে, হতেও তো পারে?

ওই ভাই, এ কথা কি চাপা থাকে? তাদের পাড়ার লোক এসে আমার বাবার কাছে চুপি চুপি খবর দিয়ে গেল! ভাবিনী আর একবার ডুকরে কেঁদে ওঠে, তারা নাকি বলেছে, একেবারে নিশংস কাণ্ড মশাই! নোড়া দিয়ে ঘেঁচে মেরে ফেলেছে, মাথা ফেটে একেবারে ছাতু!

সত্য হঠাৎ যেন কেমন হয়ে যায়, সত্যর চোখের মধ্যে যেন উন্মাদ মানুষের দৃষ্টি।

নোড়া দিয়ে ছেঁচে মেরে ফেলেছে!

নবকুমার সত্যর এ পরিবর্তনে ভয় পায়, কিন্তু ভাবিনী তেমন লক্ষ্য করে না, একই ভাবে বলে, ও দিদি, সেই নিশংস কান্ডই করেছে। বেটা আগে মেরে আধমরা করেছিল, মা দেখলে আধমরা হয়ে থাকায় বিপদ, তার চেয়ে পুরো শেষ করে দিই, আর কথা বলবে না। দিলে ঠুকে। বল ভাই, এরা মানুষ না রাক্ষস? ভদ্দরলোকের সাজে সেজে বেড়ায়, ভেতরে বাঘ সিংহী!

ভাবিনী আবার চোখ মুছতে থাকে।

সত্য হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, বসে বসে কাদবে, এ অন্যায়ের কোন প্রতিকার করবে না?

ভাবিনী একটু চমকায়।

সত্যর চোখের ওই দৃষ্টি এবার ওর দৃষ্টিপথে পড়ে। কেমন থতমত খেয়ে বলে, আর প্রতিকারের কি আছে ভাই, যা হবার তা তো হয়েই গেছে

যা হবার! এই হবার ছিল?

তা–তা ছাড়া আর কি! শেষ বয়সে মায়ের আমার এই শাস্তি ছিল কপালে–

চমৎকার! আর ওদের কারুর কোনো শাস্তির দরকার নেই? ওই খুনে মা-বেটাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার চেষ্টা করবে না তোমরা?

ভাবিনী কপালে করাঘাত করে বলে, আর সে চেষ্টায় লাভ কি বল? পুঁটি তো আমাদের ফিরে আসবে না তাতে! মিথ্যে থানা পুলিসের ঝামেলা!

মিথ্যে ঝামেলা!

মিথ্যে ঝামেলা!

সত্য কঠোর গলায় বলে, দেশে আরো হাজার হাজার পুঁটি নেই? তাদের ওপর অত্যাচার নেই?

হাজার হাজার পুঁটি! সেটা আবার কি?

তাজ্জব বনে যায় ভাবিনী।

সত্যকে হঠাৎ অমন পাগল দেখাচ্ছে কেন? না বুঝেসুঝেই ভাবিনী ভয়ে ভয়ে বলে, অত্যাচার তো আছেই ভাই জগৎ জুড়ে। মেয়েমানুষ তো পড়ে মার খেতেই জন্মেছে। তবে দুধের বাছাটা গেল সেটাই বড় কষ্টের। এখনকার যে একটু বয়স হয়ে বে হচ্ছে সেটা ভাল। তোমার সুন্নকে যে ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছ ভাল করেছ। তবু একটু বল-বুদ্ধি হোক। আহা, পুঁটিটা আমার নিপাট ভাল মানুষ ছিল ভাই!

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে সত্য বলল, বাড়ি যাব।

বাড়ি যাব!

নবকুমার এই অসভ্যতায় অবাক হয়। মানুষটাকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলা নেই কিছু না। ব্যস্ত হয়ে বলে, যাবে তো! একটু রও না!

না বসতে পারছি না আমি। মাথার মধ্যে কেমন যাতনা হচ্ছে। কিছু মনে কোর না বৌ, শুধু একটা জিনিস চাই। তোমার ওই বোনের বরের নাম ধাম ঠিকানা আমায় দাও দিকি।

নাম ধাম ঠিকানা!

নবকুমার চমকে এবং ধমকে বলে, ওদের নাম ধাম ঠিকানা নিয়ে তুমি কি করবে? তোমার কি?

আছে কাজ। তুমি দাও তো বৌ!

ভাবিনী শিথিল স্বরে বলে, নাম তো রামচরণ ঘোষ, শ্বশুরের নাম ছিল তারাচরণ

থাকে কোথায়? ঠিকানা কি?

নবকুমার আর একবার ধমক দেয় কী মুশকিল। তাদের ঠিকানায় তোমার কাজ কি? কড়া চিঠি লিখতে যাবে নাকি?

কড়া চিঠি? তাদের? নাঃ! সত্য একটু কঠোর কঠিন হাসি হেসে বলে তাদের চিঠি লিখে কি হবে? অনুতাপে খানখান হবে?

তবে?

আছে কাজ। তুমি বল বৌ।

ঠিকানা আর কি ভাবিনী যেন একটু অনিশ্চাসত্ত্বেই বলে, এই তো হাওড়া পঞ্চাননতলা। চৌমাথায় কোথায় একটা অশ্বথ গাছ আছে–

ওসব যাক। সত্য নবকুমারকে বলে, তুমি যদি আর একটু বসো তো থাকো, আমি যাচ্ছি

নবকুমার ব্যস্ত হয়ে বলে, না, না, আমি আর কি করবো, নিতাইও নেই, তোমরাই বরং গল্পসল্প করো, আমি যাই।

হঠাৎ নিজেই সে তড়বড় করে পালায়।

যেন ভয় পেয়েছে।

সত্যকে ভয় সে চিরকালই করে, তবু তার মধ্যেও কোথায় যেন একটু ভরসা ছিল। কিন্তু এই দু’বছরকাল দূরে থাকা অবধি কেমন যেন ভরসাছাড়া ভয় গ্রাস করেছে নবকুমারকে। যেন সত্যর মুখের দিকে তাকাতে সমীহ আসে। যেন চট করে আড়াল পেয়ে হাতটা একবার চেপে ধরতে পারবে, নিজের ওপর এ আস্থা নেই।

নবকুমারের চলে যাওয়ার দিকে একটুক্ষণ কেমন একরকম তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে সত্য, পাড়ার লোক তো খবরটা বলে গেল, কারণটা কিছু বলল? বৌয়ের কোন অপরাধে হঠাৎ মাথায় খুন চাপলো তাদের?

ভাবিনী আজ আর সত্যর প্রত্যেকটি কথার পিঠে ঠিকরে উঠছে না। বোধ করি পারছে না বলে উঠছে না। এ কথার উত্তরে আর একবার আঁচলে চোখ রগড়ে গলার স্বর নামিয়ে বলে, অপরাধ? সে আর কি বলবো ভাই, বলতে লজ্জা, শুনতে লজ্জা! তোমার উনি’ বসেছিলেন তাই বলতে পাচ্ছিলাম না। অপরাধের মধ্যে একটু হুড়কো-হুড়কো ছিল পুঁটি। তা ওই তো পাকাটির মতো মেয়ে, দেখেছ তো সেবার? বিয়ের জল গায়ের পড়েও কিছুই সারে নি। সেই মেয়ে, আর দোজপক্ষের বর! সা-জোয়ান একটা তাগড়া বেটাছেলে, বৌ মরে খাই-খাই অবস্থা! তার কাছে যেতে ওর সাহস হয়? যেতে চায় না, মাটি ধরে পড়ে থাকে, সেই নিয়ে নাকি রোজ মায়ে-বেটায় দুজনে মিলে শতেক খোয়ার লাথি ঝাটা জুতো গলাধাক্কা! তাই বলি পুঁটিটাকেও, মুখ্যর অগ্রগণ্য। দেখছিস তো ওদের জোর আঠারো আনা, তোর কানাকড়িরও নেই, যা বলছে তাই শোন! তা নয়, মাটি ধরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকবো, কিছুতেই বরের ঘরে ঢুকব না! পারলি লড়তে? দুশমন রাক্ষসের রাগ চড়ে উঠল। একেই তো এক্ষেত্রে বেটাছেলেদের মাথায় আগুন জ্বলে, দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না, তার ওপর মা সহায়। সোনায় সোহাগা! অদেষ্ট, সবই অদেষ্ট!

তা তো বটেই, সত্য রূঢ়স্বরে বলে, সবই অদেষ্ট বৈকি! এই হতচ্ছাড়া দেশে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মানোই এক দূরদিষ্ট! চোখের ওপর একখানা করে পুরু পর্দা ঝুলিয়ে বসে থাকবো আর অদেষ্টকে দোষ দেবো!

ভাবিনী কাঁদতে কাঁদতে ভুরু কুঁচকে বলে, পর্দার কথা কি বললে?

কিছু বলি নি বৌ। শুধু বলছি নোড়া কি শুধু তাদেরই ছিল? তোমাদের ঘরে ছিল না? ছুঁড়ে মেরে মাথা দু-চির করে দেওয়া যেত না সেই মা-ছেলের? আর তো মেয়ে বিধবা হবার ভয় নেই, ভয় নেই মেয়ের লাঞ্ছনা হবার!

ভাবিনী এবার একটু বিরক্ত হয়েছিল, তোমার যে কী ছিষ্টিছাড়া কথা দিদি! আমরা সে কাজ করে পার পাবো? হাতে দড়া পড়বে না? বিয়ে করা পরিবারকে মারতে পারো, কাটতে পারো, হেঁচতে পারো, কুটতে পারো, আর কাউকে করা যায়?

আমি হলে করতাম। ওই জামাইয়ের মাথা উঁটিয়ে গুঁড়ো করে দিতাম। তারপর ফাঁসিকাঠে ঝুলতাম! সত্য আগুন মুখে বলে।

ভাবিনী আর একবার কেঁদে ফেলে, মাও আমার রাতদিন ওই কথাই বলছে দিদি, বলছে আর কেঁদে মরছে। কিন্তু সত্যি তো আর তা হবার নয়? বরং আমার এক জ্ঞাতি পিসি মাকেই দুষছিল। বলছিল, যেমন ন্যাকা করে তৈরি করা, হবে না শাস্তি? বিয়ে হয়েছে, বরের ঘরে যাব না! আহ্লাদ! দোজপক্ষের বর, শুধু তোকে পুতুল খেলনা কিনে দিতে বে করেছে! কি বলবো দিদি, নির্ঘাত পিসির মতলব খারাপ! নিজের একটা বারো-তেরো বছরের ধেড়ে ধিঙ্গী মেয়ে আছে।

সত্য কিন্তু ততক্ষণে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে, মাপ কর বৌ, আর থাকতে পারছি না, মাথার মধ্যে বড় যাতনা হচ্ছে।

ভাবিনীর এত দুঃখেও সান্ত্বনা দেয় না সত্য দেখে ভাবিনী মনে মনে বলে, সত্যিই বটে কাঠপ্রাণ! পরের শোক-দুঃখ দেখলে ভাবিনীর তো প্রাণ ফেটে যায়। মানুষকে যে কতরকম করেই গড়েন ভগবান!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *