৪৪. জগন্নাথের রথের চাকা

জগন্নাথের রথের চাকা গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলে, কখনো বালির গাদায় বসে যায়। বসে যাওয়া রথের রশিতে টান দিতে এগিয়ে আসে লক্ষ মানুষের হাত। শ্রেণীহীন নির্বিচার।

মানুষের হাতে জগন্নাথের মুক্তি।

রূপকের রূপে দেবতার রূপ।

জগন্নাথের রথ যুগের প্রতীক। যুগের চাকার গতিও কখনো উদ্দাম, কখনো মন্থর। সেই মন্থরতার মুক্তিও মানুষের হাতে। জনগণের জাগরণে যুগের জাগরণ।

তবু বলতেই হবে যুগের দেবতা একটু শহর-ঘেঁষা। শহর দ্রুত ছন্দে আবর্তিত হয়, গ্রাম ছায়াচ্ছন্ন উঠোনে পড়ে ঘুমোয়। “শহুরে হাওয়া” যখন তার কাছে এসে পৌঁছয় তখন শহর থেকে হাওয়াকে ত্যাগ করে আর এক নতুন হাওয়ার পিছনে ছুটছে।

কিন্তু শহর আর মফঃস্বল কি কেবলমাত্র মানচিত্রের বর্গমাইলের ওপর নির্ভরশীল? একই ঘরের মধ্যে বাসা করে না কি শহর আর মফঃস্বল? জাগন্ত আর ঘুমন্ত? মানুষে মানুষের মনের গড়নে কি পার্থক্য নেই?

তা মনের গড়নেরও শহর মফঃস্বল আছে বৈকি। নইলে যুগচক্রের আবর্তনে সত্যবতী কেন এমন অধীর হয়, চঞ্চল হয়, আন্দোলিত হয়, আর নবকুমার কেন সে আবর্তন টেরও পায় না?

সত্যবতী তো ঘরে থাকে।

নবকুমার তো বাইরে ঘোরে।

নবকুমার বাইরে ঘোরে। অর্থাৎ নবকুমার বাজারে যায়, মুদির দোকানে যায়, নিতাইয়ের বাসায় তাস খেলতে যায়, সদুর বাড়িতে তত্ত্বতল্লাস করতে যায়। এই বহির্জগৎ নবকুমারের।

কিন্তু সত্যবতীই বা এমন কি করে?

সত্যবতীও তো কুটনো কোটে, বাটনা বাটে, রান্না করে, বড়ি দেয়, মুড়ি ভাজে, আচার বানায়। শুধু অবসরকালে বই পড়ে সত্যবতী। পড়ে পত্র-পত্রিকা।

এইটুকু জানলা।

খোলা জানলা।

এই জানলাখানি সত্যকে বহির্জগতের বার্তা বয়ে এনে দেয়।

এই জানলাখানি খোলা রাখার সহায় ছোট ছেলে সরল। মায়ের সঙ্গে তার যত গল্প যত কথা। আর বই যোগাড়ের ব্যাপারে উৎসাহ ষোল আনা। নবকুমার এ খবর রাখে না।

নবকুমার এক-একদিন তাসের আড্ডায় শোনা গল্প এনে উত্তেজিত ধিক্কার তোলে, শুনেছ কেলেঙ্কারি? মেয়েমানুষ বিলেত যাচ্ছে! কিনা এম.এ., বি.এ. পাশ করতে! বিদ্যের পাহাড়ের চূড়োয় ওঠা চাই!…. কালে কালে কতই হবে!….. শুনেছ কাণ্ড, পিরিলি বাড়ির কোন্ বৌ নাকি

সত্য বলে ওঠে, থাম, চুপ কর।

নবকুমার বিচলিত স্বরে বলে, বাবাঃ। বুড়ো হয়ে গেলাম, জীবনে কখনো মন খুলে দুটো গল্প করতে পেলাম না!

সত্য বলে, কেন, কর না গল্প! তোমার নাগালের উপযুক্ত গল্প কর! বাজারের দরদামের গল্প আছে, কায়েত-ঠাকুরপোর বৌ কী খাওয়াল তার গল্প আছে, আপিসের বড়বাবুর গল্প আছে….

নবকুমার কুদ্ধগলায় বলে, কেন, দেশের দশের কথা বলা বুঝি আমার বারণ?

বারণ নয়। বারণ কেন হবে? নিজে জেনে বুঝে কথা কও, তার মানে আছে, তুমি যে পরের মুখে ঝাল খাও!

নবকুমার এবার অভিমানে ভারী হয়, আমার জেনেও দরকার নেই, বুঝেও দরকার নেই। তুমি আর তোমার বিদ্বান ছেলেরা কথা কও গে।…. আয় সুবর্ণ, আমরা গল্প করি।

সুবর্ণ? হ্যাঁ, সুবর্ণ!

সোনার পুতুলের মত মেয়েটাকে সুবর্ণলতা নামই তো মানায়। বছর চারেকের হয়ে উঠেছে মেয়েটা, বাপের ভারী সুয়ো হয়ে উঠেছে।

কথা কয় যেন পাখীর মত।

হাঁড়ি-কুড়ি নিয়ে রাধাবাড়া খেলতে শিখেছে ইতিমধ্যে। বলে, এস বাবা, ভাত খাও। বলে, মার মতন রান্না করতে পারি আমি। পারি না বাবা?

নবকুমার সত্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, তা পেরো মা! কিন্তু মার মতন রাগী হয়ো না যেন!

এইভাবেই চলছিল দিন, কিছুটা মন্থর ছন্দে।

সেই মন্থরতার মাঝখানে হঠাৎ একটা আলোড়ন এল একদিন। সে আলোড়ন এল সত্যর ঘর পালানে বন্ধু নেড়ুর মূর্তি ধরে! তা নেড়ু তার বন্ধুই, দাদা আর বলেছে কবে তাকে সত্য? ছ মাসের নাকি বড় নেড়ু সত্যর থেকে। সে কথা মানে না সত্য। এখনও মানে না।

রুদ্ধকণ্ঠে শুধু বলে উঠল, নেড়ু, তুই?

নেড়ু হেসে উঠে বললো, বিশ্বাস হচ্ছে না? নেড়ুর ভূত মনে হচ্ছে? তা সন্দেহ মোচন করতে চিমটি কেটে দ্যাখ।

তা ভূত বললে অন্যায় হয় না– সত্যর রুদ্ধ কণ্ঠে এবার উচ্ছাস আসে, রংটা অন্তত ভূতের মত করে তুলেছিস বাবা। তাঁরে নেড়ু, তোর সেই বেলেপানার মত রংটা কী করলি রে?

নেড়ু হো হো হেসে ওঠে, কি মনে হচ্ছে? বেচে খেয়েছি? তা মাঝে মাঝে যা অবস্থা যায়, চুল নখ হাত পা বেচে খাই এমনই মতি হয়। রংটা বেচতে পারলে নিশ্চয় বেচতাম, বেচবার নয়, এই যা! রোদে পুড়ে পুড়েই আর কি—

নেড়ুর ওই কৌতুক কথা কটির মধ্যে থেকেই নেড়ুর অবস্থাটা স্পষ্ট ধরা পড়ে যায়, আর ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে জল এসে যায় সত্যর।

কিন্তু সে জল চোখেই আটকে রেখে সত্য সেই অতীতকালের মতই ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, খুব তো ব্যাখ্যান করছিস অবস্থার, বলি হঠাৎ এমন নিরুদ্দেশ হবার শখ হল কেন বল দিকি? এমন হাঁড়ির হাল করে বেড়িয়ে লাভটা কি হচ্ছে তোর?

নেড়ুর বহু অবস্থার ছাপ পড়া কাঠ-কাঠ মুখটায় হঠাৎ একটা বিদ্যুৎব্দীপ্তি খেলে যায়। বিদ্যুৎ উদ্ভাসিত মুখে উত্তর দেয় নেড়ু, লাভ? সে তোদের সংসারের কড়াক্রান্তির হিসেবে অবশ্য পড়বে না সত্য, সেটাকে বলতে পারিস অদৃশ্য বস্তু। তবে হয়েছে বৈকি লাভ। ভগবানের রাজ্যে এই পৃথিবীটা যে কেমন তার কিছুটা আস্বাদ লাভ হয়েছে।

সত্য কি নেড়ুর এই উত্তরে চমকে ওঠে? সত্যর মুখটা কি হঠাৎ ছাইয়ের মত সাদাটে দেখায়? সহসা কি একটা বিরাট লোকসানের খবর দিয়ে গেল কেউ সত্যকে? সত্যর মুখে তাই দিশেহারা উদ্ভ্রান্তির ছায়া।

সত্যর তাই কথা বলতে মুহূর্ত কয়েক দেরি হয়। বুঝি বড় একটা নিঃশ্বাস চাপে সত্য।

পরে বলে, পায়ে হেঁটে পৃথিবীর কতটা দেখবি শুনি?

নেড়ু দু’হাত উল্টে বিশেষ একটা ভঙ্গী করে বলে, নাও ঠ্যালা! পৃথিবীর সব মাটি মাড়িয়ে মাড়িয়ে কি আর পৃথিবীটা দেখবার বায়না করেছি!…. আসল কথা চেনা-জানা সংসারের চৌহদ্দিটার বাইরে পা বাড়াতে পারলেই আর এক জগৎ, বুঝলি? তার মজাই আলাদা। সত্যি বটে তোরা সংসারী লোকেরা বলবি হাঁড়ির হাল, কিন্তু আমি বাবা বলবো তোফায় কাটাচ্ছি। ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্ট মন্দিরে, এ কি সোজা মজা? কোনদিন আহার জুটছে, কোনদিন জুটছে না, কোনদিন মাথার উপর আচ্ছাদন আছে, কোনদিন গাছতলা সার!…. কখনো কারো কাছে এক ঘটি জল চাইলে সব ব্যাজার মুখ করে, কখনো কেউ মুখের চেহারাটা দেখেই ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ বলে অনুরোধ উপরোধ করে ডেকে নিয়ে গিয়ে তোয়াজ করে খাওয়া। কত লীলাখেলা পৃথিবীর! কত ঢঙের মানুষ, কত সঙের বাজার!

সত্য যেন হাঁ করে শুনতে থাকে নেড়ুর এই অভিনব অভিজ্ঞতার গল্প।…আশ্চর্য! আশ্চর্য! সেই তার চিরকূপার পাত্র বোকা নেড়ুটা হঠাৎ যেন সত্যর নাগালের বাইরে চলে গেছে।

সন্তর্পণে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সত্য। আস্তে আস্তে বলে, খুব ভাল লাগে, নারে নেড়ু?

নেড়ু তার রুক্ষ চুলগুলো মুঠোয় চেপে ধরে চাপতে চাপতে বলে, ভাল লাগা মন্দ লাগা বুঝি না সত্য, একটা অন্যরকম জীবন, এই আর কি। কুমোরের চাকে গড়া হাঁড়ি-কলসীর মত এক ছাঁচের না হয়ে, নিজের হাতে গড়া যা তোক একটা গড়ন পাওয়া, এই হচ্ছে কথা। তোরা বলবি, বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়া ভবঘুরে! বলবি আহা কী কষ্ট! আমি মনে মনে হাসবো। ভাববো ওই বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়া ভবঘুরে হয়ে দ্যাখো, বুঝবে তার রহস্য রস।

সত্য আর একবার ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, বলছিস তো খুব! বলি মেয়েমানুষে পারবে তোর মতন ভবঘুরে হতে? ব্যাটাছেলে হয়ে জন্মেছিস, তাই যা খুশি করবার সুখ পেয়েছিস। বাবাও তো বাড়ি ছাড়া হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন

নেড়ু আঙুল তুলে বলে, ওই তো, ওই কথাই তো বলছি– গিয়েছিলেন তাই একটা মানুষের মত মানুষ হতে পেরেছেন। গায়ে পড়ে থাকলে আমার বাবাটির মতন হতেন।

এই নেড়ু, পিতৃনিন্দে করছিস?

নিন্দে-ফিলে বুঝি নে সত্য, আমার হচ্ছে হক কথা! যাক তুই কেমন আছিস বল?

সত্য ঈষৎ উদাস গলায় বলে, আমার কথা ছেড়ে দে। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি

নেড়ু বলে ওঠে, এই সেরেছে, তুইও যে দেখছি আক্ষেপ করতে শিখেছিস! আগে তো এমন ছিলি না! মেয়েমানুষ মানুষ নয়’ একথা বললেই তো রেগে যেতিস

সত্য তেমনি গলায় বলে, সে এখনো যাব। তবে তোকে দেখে যেন আক্ষেপটার সৃষ্টি হচ্ছে ভাই! কোথায় ছিলি তুই, কী বা ছিলি! মিথ্যে বলব না, তোকে মাথামোটা ভেবে একটু কৃপার চক্ষেই দেখতাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোর মাথাটাই সব চেয়ে সরু। তাই তোকে ভক্তি ছেদার চোখে দেখছি।.. যাক বেশী বলব না, অহঙ্কার হবে। তবে এটা ঠিক, ভগবান যদি আমার মেয়েমানুষ না গড়ে বেটাছেলে করে তৈরি করতেন, তোর মতন ঘরই ছাড়তাম। যাক হই নি যখন, ভগবানের ভুলের খেসারত দিই বসে বসে। সে তো হল, কিন্তু তুই কিভাবে আমার বাড়ির খোঁজ পেলি বল দিকি?

হা, সেটাই কথা।

ঘরপালানে ছেলেটা এতদিন পরে হঠাৎ সত্যর বাড়ি এসে হাজির হয় কী করে?

তা হল প্রায় দৈবের আনুকূল্যেই।

উত্তর প্রত্যুত্তরের মধ্য দিয়ে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে এই, ঘুরতে ঘুরতে কলকাতায় এসেছে নেড়ু কিছুদিন হল। আর ওই ঘোরার সূত্রেই কালীতলায় এসে বসেছিল আজ সকালে, দৈবক্রমে সত্য গিয়েছিল সেই ঠাকুরতলায় পূজো দিতে।

যায় এমন সত্য।

বারব্রত থাকলেই যায়।

আজ অষ্টমীর উপোস ছিল, গিয়েছিল। নেড়ু দেখতে পায়। কিন্তু পথের মাঝখানে বা মন্দিরের চাতালে তো একটা বৌমানুষকে ডেকে কথা কওয়া যায় না, তাই নেড়ু একটু দূরে দূরে থেকে সত্যর সঙ্গে সঙ্গে এসে বাড়িটা বুঝে নিয়েছিল। সত্যর সঙ্গে পাড়ার একটি গিন্নী ছিলেন। তিনি বিদায় নিতেই নেড়ু এগিয়ে গিয়েছিল এবং মহোৎসাহে কড়ানাড়া দিয়েছিল।

সত্য সেইমাত্র পড়শী গিন্নীকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে পিছন ফিরেছে, তখনো দাওয়ায় ওঠে নি। ভাবল সেই মহিলাই বোধ করি কিছু বলতে ভুলেছেন বা সত্যর সঙ্গে তার কোন বস্তু চলে এসেছে। নিশ্চিন্ত চিত্তেই তাই ফের খিলটা খুলেছিল সত্য, আর খুলেই থতমত খেয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়েছিল।… 

কিন্তু পিছিয়ে গিয়েই কি তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সত্য? তাই দেওয়াই তো উচিত ছিল। তা বলতেই হবে, উচিত কাজ সত্য করে নি। সে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়ে সামনের মূর্তিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থেকেছিল।

রুক্ষ ধূসর মাথাভর্তি চুল, তামাটে কালচে রং, শীর্ণ পেশীবহুল মুখ, আর রোগা পাকসিটে চেহারা! দৈর্ঘ্যের তুলনায় প্রস্থটা নিতান্তই কম। আর ওই দৈর্ঘ্যের জন্যই পরনের ধুতিটা খাটো মনে হচ্ছে। গায়ের রং-জ্বলা গলাবন্ধ কোটটাও যেন মানুষটার নীচের দিকের অনেকখানি অংশকে বঞ্চিত করে সহসা থেমে পড়েছে।

হাতে একটা ক্যাম্বিসের পোর্টম্যান্টো, সেটাকে দোলাতে দোলাতে মৃদু মৃদু হাসছে লোকটা। হঠাৎ কেউ সত্যকে এই অবস্থায় দেখলে কী বলবে বা বলতে পারে, সে কথা স্মরণাত্র না করে হাঁ করে দাঁড়িয়েই থাকে সত্য। অতঃপর লোকটা হেসে উঠে বলে, কী রে সত্য, চিনতে পারলি নে তা হলে?

অথচ চিনে ফেলেছে তখন সত্য, ঠিক সেই মুহূর্তেই চিনে ফেলেছে। আর সেই আকস্মিকতার মুহূর্তে রুদ্ধকণ্ঠে উচ্চারণ করেছে, নেড়ু তুই!

উঠে এসে দাওয়ায় গুছিয়ে বসে নেড়ু বলে, যা ভাগ্যি যে চিনতে পারলি, চোর হ্যাঁচোড় বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলি নে, এই ঢের!

সত্য তিরস্কারের সুরে বলে, তা দিলেও তুই আমায় দোষ দিতে পারতিস না নেড়ু। চেহারাখানা যা বাগিয়েছিস, চোর ছাচোড়ের অধম! তোকে দেখে আহাদ করবো, না কাঁদবো তা বুঝছি না। বলে দিচ্ছি এখন থেকেই, সহজে তোর এখান থেকে যাওয়া হবে না, থাকবি আমার কাছে।

নেড়ু হেসে ফেলে বলে, তোর হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে মোটা হবো?

হবিই তো! মিথ্যে নাকি? সত্য সতেজে বলে, কিছুকাল খেয়ে ঘুমিয়ে স্বাস্থ্য শরীর ভাল ক। এই তালে চললে বেশীদিন আর পৃথিবী দেখে বেড়াতে হবে না।

তা সত্যর কথাটা একেবারে অবহেলা করতে পারে নি নেড়ু। ছিল কয়েকটা দিন। ভারী খুশি খুশি মনেই ছিল। দুবেলা খেতে বসে রান্নার প্রশংসায় পঞ্চুমুখ হত আর বলতো, নাঃ, যতদূর বুঝছি বোনাই-বাড়ি থেকে আমাকে আর নড়তে দিবি না তুই সত্য! তোর এই সুক্ত, মোচার ঘন্ট, আঁচড়ের ডালনা, মাছের ঝোলের বন্ধনেই বেঁধে রেখে দিবি…। বলতো, জামাইবাবুর আমার এখনও শরীরটা যে কী কারণে অমন নাড় গোপালটির মত রয়ে গেছে, তা বুঝতে পারছি। ছেলেদের ডেকে বলতো, বুঝলে হে বাপধনেরা, তোমরা যে জননী রত্নটি পেয়েছ, লাখে একটি এমন মেলে না!

সত্য মুগ্ধ বিগলিত চিত্তে ওর কথা শুনতো, চোটপাট উত্তর দিতেও ভুলে যেত মাঝে মাঝে।

বাড়ি ছেড়ে পথে পথে ঘুরে নেড়ুর কথার ধরনটা কী অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে! এ ভাষা এ সুর নিত্যানন্দপুরের নয়। বারুইপুরেই কি এমন সহজ কৌতুকের সুরের হালকা চালের কথা শুনেছে সত্য? অথবা কলকাতায়?

নাঃ, শোনে নি।

সত্যর দেখা মানুষরা সব যেন চোখের সামনে ভিড় করে আসে। কেউ চঞ্চল, কেউ গম্ভীর, কেউ ব্যস্ত, কেউ মন্থর। কেউ ভয়ঙ্কর, কেউবা হাস্যকর। এমন হাসিতে উজ্জ্বল, কৌতুকে সহজ, অথচ ভারহীন নির্লিপ্ত কই কোথায়?

নেড়ুর কথা শুনবে বলেই সত্য তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সেরে নিত, সত্যর ছেলেরা আগে আগে পড়া সেরে নিত…. হ্যাঁ, সত্যর ছেলেরাও সত্যর মতই মুগ্ধ বিমোহিত। নানা দেশ-বিদেশের গল্প ফাঁদতে নেড়ু, নানা অভিজ্ঞতার। রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতো তার।….

ট্যাঁকে নেই পয়সা, পেটে নেই ভাত। অথচ মুখে হারছি না, বুঝলি? ধর্মশালার সেই লোকটাকে জোর গলায় বলছি–আমি রাধছি না খাচ্ছি না তাতে তোমার কি হে বাপু? তোমার এই ধর্মশালায় এমন কোন লেখাপড়া আছে যে রাঁধতেই হবে, খেতেই হবে? লোকটা একেবারে গরুড়ের অবতার, বুঝলি? হাত জোড় করে বলল, আজ্ঞে লেখাপড়া কিছু নেই, তবে আপনি ব্রাহ্মণসন্তান, চোখের সামনে না খেয়ে পড়ে থাকবেন, দেখি কি করে? দেখছি তো আপনি রাধছেন খাচ্ছেন না। বেরিয়ে গিয়ে পুরী-কচুরীও কিনে আনছেন না–

বললাম, আমার ব্রত আছে।

তবু ব্যাটা নাছোড়বান্দা। বলে, কী ব্রত?

আরো গম্ভীর হয়ে বলি, সে তুমি বুঝবে না।

তা এমন কি ব্ৰত যে দুধ গঙ্গাজল এসব খেতে মানা?

আমি রাগ দেখিয়ে বলি, অত কৈফিয়ৎ তোমায় দিতে যাব কেন হে? ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি অন্য ধর্মশালায়। অথচ বুঝলি কিনা, মনে মনে ভাবছি, অত কথা না শুধিয়ে এনেই দে না বাবা ছড়াখানেক মর্তমান, গোটাকতক মিষ্টি পুরুষ্ট আম, সেরটাক মালাই, আর গণ্ডা আষ্টেক মণ্ডা–।

কথার মাঝখানেই হেসে লুটোপুটি খেত সাধন সরল। সরল হয়তো বা যোগও দিত–গণ্ডা বারো চমচম, এক চাঙারি গরম জিলিপি…

তা মন্দ বলিস নি নেড়ু বলতো, তখন মনে হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শেষ করি। অথচ হ্যাংলা বামুন হতে রাজী নই। তাই বলবো কি, সত্যিই সেদিন এসে হাজির করলো লোকটা বড় লোটার এক লোটা ক্ষীরের মত ঘন গরম দুধ, আর ইয়া বড় বড় গোটাচারেক কদলী। বলে এ খেলে তোমার ব্রত নষ্ট হবে না। আমি বুঝলি কিনা, তাকে যেন কতই কৃপা করছি, এইভাবে মেরে দিলাম সেগুলো। মারছি আর ভাবছি, আরো চারটি কিছু আনলি না কেন বাবা?

এরা হেসে ওঠে।

এ আসরে নবকুমারও এক-একদিন যোগ দিত। এই ভবঘুরে শালাটির প্রতি তারও বেশ একটু প্রীতির সঞ্চার হয়েছিল। চুপি চুপি সত্যকে বলতো, কায়দা করে আটকে ফেলে একটা কনেটনে যোগাড় করে বিয়ে দিয়ে ফেল না? তখন দেখবে, বাছাধন কেমন বাউণ্ডুলে হয়ে বেড়ায়!

সত্য বলতো, থাক গে, বেড়াক না। একটা মানুষ না হয় জগৎ-ছাড়া হল। সবাইকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করতেই হবে, এমন তো কিছু লেখাপড়া নেই?

আহা, সন্নিসী হত তো সে এক কথা। এ যে না গেরুয়া; না সংসারী!

তা হোক।

নবকুমার বলতো, তবে আর কি বলবো! আসরে গিয়ে বলতো, তারপর শালাবাবু, কোন কোন্ তীর্থ করেছ বল?

নেড়ু বলতো, তীর্থ-টির্থ কিছু করি নি বাবা, তীর্থধর্ম নিয়ে মাথাও ঘামাই নি। তবে ভ্রমণ করতে গেলেই তীর্থ। পৃথিবীর যেখানে যত শোভা-সৌন্দর্যের জায়গা, সেখানেই তো মানুষ দিব্যি এক-একখানা তীর্থ বানিয়ে রেখেছে।

সত্য প্রশ্ন করেছিল, শেষ তুই কোথা থেকে ঘুরে এলি?

কাশী। কাশী আগেও গিয়েছিলাম অবিশ্যি। প্রথম তো কাশীতেই যাই।

কাশী? সম্প্রতি কাশী গিয়েছিলি তুই? সত্য রুদ্ধকণ্ঠে বলে, বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলি?

বাবা মানে মেজকাকা? নেড়ু আশ্চর্য হয়ে বলে, কাশী গেছেন বুঝি?

গেছেন কি রে নেড়ু! বরাবরের জন্য গেছেন। বাবা কাশীবাসী হয়েছেন।

আঁ! সে কি!

তবে আর বলছি কি!

নেড়ু এই একটিমাত্র প্রসঙ্গে গম্ভীর হয়! আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, জানি না তো! জানলে খুঁজে নিয়ে দেখা করবার চেষ্টা করতাম। নিত্যানন্দপুরে মেজকাকা নেই, এ যেন ভাবাই যায় না, না রে সত্য?

সত্য কথার জবাব দেয় না।

সত্য চোখ তোলে না। সুবর্ণকে কোলে চেপে বসে থাকে।

আবার কোনো এক সময় পুণ্যির প্রসঙ্গ ওঠে।

এক বেলার জন্যে শ্রীরামপুরে পুণ্যির বাড়িও গিয়েছিল নেড়ু। তা এক বেলার বেশী থাকতে পারে নি। পুণ্যি নাকি এমন গিন্নী হয়ে গেছে যে দেখে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল নেড়ুর। যতটুকু সময় ছিল নেড়ু, ততটুকুই কেবল তাকে উপদেশ দিয়েছে আর ধিক্কার দিয়েছে পুণ্যি।

জগৎটা কতই বদলে যাচ্ছে! সত্য নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ছোটবেলার কথা তোর মনে পড়ে নেড়ু?

পড়ে। পড়বে না কেন? তবে কি জানিস সত্য, একে তো তুই মা-বাপের এক সন্তান, তায় আবার মেজকাকা মেজখুড়ীর মত বাপ-মা! তোর স্মৃতিতে আমার স্মৃতিতে তফাৎ আছে। চোদ্দটা ছেলেমেয়ের একটা আমি।

তা হলেই বা। তুই তো কোলের ছেলে।

দূর! দূর! মানুষ না হাঁস-মুরগী!

এ ধরনের কথায় সত্য লজ্জিত হয়ে অন্য প্রসঙ্গ এনে ফেলতো। হয়তো পুণ্যির কথাই ফের তুলতো। সেই রকম রোগা আছে পুণ্যি, না মোটা হয়েছে? এখনো তেমনি চুলের রাশি আছে কিনা?

চুল?

নেড়ু হেসে উঠেছে, এই এত বড় একখানি টাক! তার ওপর এততখানি সিঁদুর লেপা। অবিকল সেজঠাকুমা। আমি বললাম, মা শেতলা, গড় করি! আর নয়!

সত্য হেসে ফেলে বলে, সেই তো বোকা-হাবা ছিলি তুই নেড়ু এত কথা শিখলি কি করে?

নেড়ু বলে, হাওয়ায় বাতাসে! যত মানুষ দেখবি, তত বুদ্ধি বাড়বে! খুব স্ফূর্তিতে ছিল নেড়ু।

আর সত্যি বলতে, দিন দশ-বারোতেই যেন চেহারা ফিরে যাচ্ছিল। রং ফিরছিল, গড়ন ফিরছিল। হয়তো মাস দেড় দুই থাকলে দশাসই হয়ে উঠতে রোগা লম্বা নেড়ু। কিন্তু থাকলো না। হঠাৎ বলে উঠলো, আর নয় রে সত্য, তোর এখানে শেকড় গজিয়ে যাচ্ছে, এবার পলায়ন দিই!

সত্য চমকে উঠেছিল।

সত্য বসে পড়েছিল।

চলে যাবি?

এই দ্যাখো, চলে যাবো না তো কি বোনাই-বাড়িতে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বাস করতে এসেছি?, না, আর একদিনও না।

সত্যর কাকুতি-মিনতি, সত্যর ছেলেদের দরদস্তুর আর নবকুমারের অনুরোধ উপরোধ, সব ঠেলে ক্যামবিশের ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে পা বাড়ালো নেড়ু। শুধু যাত্রাকালে বললো, দে বাবা তোর ওই নারকেলনাড় দিয়ে দে পুঁটলিখানেক। পচবার মাল নয়। চলবে বেশ কিছুদিন। যখনি খাবো, তোদের মনে পড়বে।

তা শুধুই নারকেলনাড়ু নয়, চোখের জল মুছতে মুছতে একবেলার মধ্যেই অনেক কিছু বানিয়ে ফেলেছিল সত্য।…

তিলের নাড়, ক্ষীরের ছাঁচ, মুগের বরফি, কুচো গজা, মুড়কির মোয়া।

জবরদস্তি করে সব পুরে দিয়েছিল তার ব্যাগে। আগে মাথার দিব্যি দিয়ে লুকিয়ে দশ টাকা হাতে গুঁজে দিয়েছিল তার।

ভবঘুরে নেড়ুরও কি চোখ দুটো ভিজে এসেছিল?

এসেছিল কিনা চোখই জানে। তবে গলাটা যে ভিজে উঠেছিল তার, সেটা সত্য টের পেয়েছিল। টাকা কটা সেই রংচটা কোটের পকেটে রাখতে রাখতে ভিজে গলায় বলেছিল, তুই তাই নিলাম সত্য। আর কারো সাধ্য ছিল না যে আমাকে

সুবর্ণকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক লোফালুফি করে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল নেড়ু। সত্যর বর্তমানের নিস্তরঙ্গ জীবনে নেড়ু যেন বড় একটা তরঙ্গ তুলে দিয়ে গেল। অনেকদিন পর্যন্ত নেড়ুর প্রসঙ্গ ধ্বনিত হতে থাকলো এ বাড়িতে।

অনেকদিন পর্যন্ত সত্য যেন আনমনা হয়ে রইল। সমবয়সী, বরং বা একটু বড়, এই ভাইটির ওপর সত্যর যে কেন বাৎসল্য-স্নেহের মত এমন একটা স্নেহ জেগে উঠেছিল কে জানে? অথচ তার মাঝখানেই যেন শ্রদ্ধা, সমীহ আর ভক্তি বিমিশ্রিত একটা অপূর্ব ভাব।

নেড়ু বেচারা!

নেড়ু অবোধ!

তবু নেড়ু যেন অনেকটা উঁচুতে, সত্যর নাগালের বাইরে।

ভবঘুরেনেড়ুর জীবনদর্শন নেড়ুকে সত্যর চোখে এক মহান নাটকের মহিমান্বিত নায়করূপে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *