1 of 2

৪১. কালাহার বিলে জাল ফেলার সুযোগ

কিন্তু কালাহার বিলে জাল ফেলার সুযোগ তমিজের বাপের আর হলো না। ঐ দিন গোলাবাড়িতে কালাম মাঝির দোকানে মিষ্টি খেয়ে সে ঘরে ফেরে একটু রাত করে। তখন তার খিদেও পেয়েছে। শুধু নুনমরিচ দিয়ে ভাত, কুলসুম সেটাও একবারের বেশি দিতে পারে না। তবে তমিজের ধান তো এসে যাচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই। আর কয়েকটা দিন এরকম এক বেলা কি আধপেটা খাওয়া। তারপর অন্তত মাস দুয়েক সানকি সানকি ভাত জুটবে। কয়েক মাসের মধ্যে বিলের দখল এসে গেলে ভাতের সাথে। বড়ো বড়ো মাছের চাকা। মাছভাত খাওয়ার সম্ভাবনায় তমিজের বাপের পেটে নতুন হাওয়া খেলে, সেই হাওয়ায় তার চোখে নামে রাজ্যের ঘুম। এক পশলা ঘুমের পর তার ঘুম তন্দ্রায় নেমে এলে সে উঠে পড়ে মাচা থেকে এবং হাঁটা দেয় কাৎলাহার বিলের। দিকে। কদমে কদমে ঘুম তার ফের ঘন হয়, সুতরাং চেনা পথ ধরে উত্তর সিথান পর্যন্ত যেতে তার একটুও এদিক ওদিক হয় নি।

সেই সন্ধ্যায় মাঝিপাড়ার অনেকেই বিলের এ মাথা ও মাথা ঘুরে এসেছে। কিন্তু তমিজের বাপ যখন পৌঁছলো তখন কেউ নাই। ইটের ভাটার পাশে খড়ের চালার নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে ইটখোলার মিস্ত্রিরা। বিলের ধারে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের আঙুলে ভর করে ঘাড়ের রগ টানটান করে সে যতোটা পারে ওপরে তাকায়। পেছনের ইটের ভাটার মন্থর ধোয়া কুয়াশায় মিশে উত্তরের আসমানকে যতোটা পারে আড়াল করে রেখেছে। উত্তরের গাছ তার নজরে ঠেকে আর কি করে? ঐ আড়ালের সুযোগ নিয়ে লুকোচুরি খেলার টু-কি দেওয়ার মতো কে যেন ফুটো গলায় গলা খাঁকারি দেয়। তমিজের বাপের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। তার হাত পা বুক চিনচিন করে, এমন কি আধপেটা খাওয়া পেটটাও মোচড় দিয়ে ওঠে, হাত পা বুক, পেট, ঊরুর ওপরকার ও হাঁটুর নিচের ঘা শিরশির করে; চোখে মুখে ও গালে শিরশির করে মুনসির গলার স্বর।

কিন্তু এই শোলোকের কথা তো বোঝা যায় না। এটা মুনসি ছাড়া কেউ নয়, চেরাগ আলি কখনো এমন কথাছাড়া শোলোক কয়নি, তার গলাও তো এটা নয়। শোলোক : আসছে উত্তর থেকে, সুতরাং এর উৎস খুঁজতে তমিজের বাপকে একটু পিছু হটতে হয়। উত্তরের আকাশ জুড়ে তখন ফুঁড়ে ওঠে নানান রঙের আলো। মুনসির মুখের আদল বড়ো ঝাপসা, কিংবা চারদিকের আলোতে তার মুখ ঢাকা পড়েছে আলোর নিচে। তার কালো। টুপিজুলছে কালো আগুনে, বন্দুকের গুলিতে-ফাকা গলার নিচে লোহার শেকলে লাল আগুনের আভা। আর সমস্ত কুয়াশা জ্বলে তার সাদা দাড়ির ঝাপটায়। মাছের মুখের নকশা-আঁকা লোহার পান্টি তার জ্বলছে দাউদাউ করে। সেই সঙ্গে পোড়ে তার পাকুড়গাছ। হায়, হায়, মুনসির আরস পুড়ে যাচ্ছে তার নিজের আগুনে? তমিজের বাপের গায়ে আগুনের আঁচ লাগলে সে তাড়াতাড়ি করে পেছনে হাঁটে। একটু দক্ষিণে। সরলে তার বামে বিলের ধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে বালি, সেই বালির ওপর মুনসির আরস-পোড়া ছাই পড়তে দেখে সে সাহস করে ওপরে তাকায়। মণ্ডলের শিমুলগাছের পোষা ঝাকের উড়াল দেখে তার ভয় বাড়ে, বালির ওপর কি তাদের ডানার ছায়া পড়ে? না-কি পোড়া পাকুড়গাছের ছাই ঝরে পড়ছে তাদের ডানা থেকে? সেই ছাই থেকে বাচতে কিংবা গায়ে মাখার জন্যে সেই ছাই নিতে তমিজের বাম পা ফেলে আরো পুবদিকে। তার পা লাগে চোরাবালির সীমানা ঠিক করার জন্যে ইটখোলার মিস্ত্রিদের পোতা বাঁশের সঙ্গে। তার ভীতু ও তেজি কদমের তোড়ে বাঁশ উপড়ে তমিজের বাপ পড়ে যায় চোরাবালির ভেতর।

 

সকালবেলা তমিজের বাপের বাম পা প্রথম দেখতে পায় হঁটখোলার মিস্ত্রিরা। ওপড়ানো বাঁশের গাঁটের সঙ্গে মোটা কঞ্চির ফাঁকে আটকে ছিলো তার ভঁজ হওয়া হাঁটু। হাঁটুর ঘায়ের ওপর মলমের মতো লেগে ছিলো বালির একটা পরত। পশ্চিমা মিস্ত্রি বলে, ভাটার আগুন ঠিকমতো জ্বলছে কি-না দেখার জন্যে অনেক রাত্রে উঠে সে খেয়াল করে যে, ঐ আধ পাগলা মাঝিটা আসমানের দিকে তাকিয়ে দেওদানার সাথে কিসব বাতচিত করছে। তা লোকটা তো প্রায় রোজই আসে।-ভাটা ঠিকঠাক আছে দেখে মিস্ত্রি ঢুকে পড়ে ফের তার ঝোপড়ির মধ্যে। তারপর তোররাতের দিকে সে এদিকে হুটোপুটির আওয়াজ পায়, তখনি তার মনে হয়েছিলো কোনো দেও বুঝি কারো সঙ্গে মারামারি করছে।

বেলা হতে হতে খবর চাউর হয়ে যায় চার দিকে। গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি, পালপাড়া এমন কি লাঠিডাঙার কাছারি থেকেও মানুষ আসতে থাকে দলে দলে।

তমিজের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলো হুরমতুল্লা, বুড়া খুব ভয় পেয়েছে, তমিজের কাছ ছাড়া হতে চাইছে না। তমিজ একেবারে চুপ। সে কেবল দেখছিলো বাপের হাঁটুর দিকে। বৈকুণ্ঠ একবার কাঁদছিলো তমিজকে জড়িয়ে ধরে, একেকবার সে ছুটে ছুটে যাচ্ছিলো চোরাবালির দিকে। তাকে ধরে রাখছিলো কেষ্ট পাল। কখনো কখনো চোরাবালি থেকে বৈকুণ্ঠকে দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করছিলো কেরামত আলি। তবে কুলসুমকে সমবেদনা জানানোটা আরো জরুরি বলে মনে হচ্ছিলো তার। স্বামীর এরকম অপঘাতে মরণে হতবিহ্বল মেয়েটির শোকমোচনের জন্যে যা কিছু করা সম্ভব। সবই করায় জন্যে কেরামত ছটফট করছিলো।

কালাম মাঝির আক্ষেপের প্রধান কারণ হলো, হায়রে, হামার বিলে পরথম জালটা হামি ফালাবার চাছিলাম বাঘাড় মাঝির লাতিক দিয়া। আল্লা হামার নিয়তটা পুরা করবার দিলো না। কপাল! হামার কপাল!

আবদুল আজিজ ও কাদের দুজনেই টাউনে। তবে শরাফত মণ্ডল এসেছে তার কামলাপাট নিয়ে। তার লোকদের দিয়ে লম্বা লম্বা বাঁশ বেঁধে আঁকসি তৈরি করিয়ে তমিজের বাপের হাঁটুর ভজের সঙ্গে আটকে তার লাশ তোলার আয়োজনও করলো মণ্ডলই । কিন্তু বাঁশের আঁকশি লাগিয়ে একটু টানতেই গোটা শরীর তার ড়ুবে যায় চোরাবালির ভেতরে। ওপরের কাঁপন দেখে মনে হয় তার শরীরটা বোধহয় নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।।

বৈকুণ্ঠ বারবার তার বুড়ো আঙুল কাটা হাতটার সঙ্গে সবগুলো আঙুলওয়ালা হাত জোড়া করে সবাইকে মিনতি করে, তমিজের বাপেক আপনেরা ওটি থাকবার দেন গো! তিনি লিজে তার আসন পছন্দ করিছে, হামরা বাধা দেই ক্যাংকা করা? কান্নায় তার গলা আটকে আসে, দলদলা দিয়া তমিজের বাপ কোটে গেছে হামরা তার কী জানি? পাকুড়গাছ লিয়া মুনসি কোনমুখে গেলো কেউ কবার পারে? তমিজের বাপ তার সাথ : ধরিছে! তাক লিয়া আপনেরা আর টানাটানি করেন না গো!

শরাফত মণ্ডল তার ওপর রাগ করে, আঃ তুই এতো কথা কোস কিসক রে? মোসলমানের মুর্দা, শরিয়ত মোতাবেক তাক গোসল করান লাগবি না? তার কাফন লাগবি না? তার জানাজা পড়ান লাগবি না?

কালাম মাঝি মণ্ডলের সঙ্গে একমত। তবে তার অতিরিক্ত প্রস্তাব হলো এই যে, তমিজের বাপের কবর হবে মাঝিদের পুরোনো গোরস্তানে। ওখানে তার বাপদাদা পরদাদার কবর। কেউ দখল করলেই ঐ গোরস্তান তার সম্পত্তি হয়ে গেলো না। পাকিস্তান কোনো মগের মুল্লুক নয়! আর তমিজের বাপের মাজার হবে গোরস্তানের ঠিক–মাঝখানে! সে তো আর যে সে মানুষ ছিলো না, এই এলাকার সবাই তাকে ইজ্জত করেছে।

তমিজের বাপের লাশ কিন্তু আর ভোলা গেলো না। তখন কালাম মাঝি প্রস্তাব করে, সে নিজেই চোরাবালির চারদিকে অনেকটা জায়াগা ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেবে।

এর মানে মণ্ডলদের ইর্টখোলার অনেকটা চলে যাবে এই মরা মাঝির দখলে। তবু গোরস্তান দখলের তুলনায় এতে লোকসান অনেক কম। শরাফত তখন নিজেই। প্রয়োজনীয় সমস্ত ইট বরাদ্দ করার কথা ঘোষণা করে।

তিন দিনের মধ্যে ইটখোলার এক নম্বর হঁট দিয়ে চোরাবালির সবটাই ঘিরে দেওয়া। হলো। চোরাবালির খানিকটা পড়ে পানির ভেতরে সেদিকটা অবশ্য ফাঁকাই রইলো। কুন্দুস মৌলবী তার তালেবেলেমদের নিয়ে কোরান খতম করতে লাগলো দেওয়ালের ধারে বসে। কালামের দোকান থেকে রোজ রোজ আগরবাতির কাঠি আসতে লাগলো গোছা গোছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *