৩.৫ বিয়ের পালকিবহন দুদিনের আমোদ

বিয়ের পালকিবহন দুদিনের আমোদ। কোনো কোনো বিয়েতে তিন দিনও লাগে—সে খুব দূর পথ হলে। গায়ে হলুদের দিনই বর রওনা হয়, কনে-বাড়িতে হয় নান্দীমুখ। নইলে রওনা বিয়ের দিন। বিয়ের দিবসে বর নিয়ে কনের বাড়িতে সন্ধে নাগাদ পৌছে-খাওয়া-দাওয়া আমোদ! তার পরের দিন বর নিয়ে বউ নিয়ে আবার সনজে নাগাদ বরের বাড়ি ফেরত-গোষ্ঠ। তার পরেতে বিদেয়, ঘরে ফেরে কাহারেরা এক প্রহর রাত্রি পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুপুর রাত্রিও হয়ে যায়। গা-গতরে ব্যথা একটু-আধটু হয় বৈকি, তবু প্রচুর মদের নেশায় হইহই করে। ফেরে। বিয়েতে দুদিন মদ খায় বটে, কিন্তু বেশি খাওয়া বারণ। পালকি কাঁধে পা ঠিক রেখে যেতে হবে পরস্পরের পায়ে পায়ে পা ফেলে যেতে হবে। এর পায়ে ওর পায়ে ঠোক্কর খেলে পালকি নড়বে। পা টললে পালকি উলবে। বর-কনের মাথায় ঠোক্কর লাগবে পালকির কাঠে, সে একটা খ্যানত। তার পরেতে রাস্তা, আলপথ, খানা, মেটেপথে চলতে হয় বেশি নেশা করলে চলবে কেন? তাই ফেরত-গোষ্ঠের পর পেট ভরে মদ খেয়ে টলতে উলতে বাড়ি ফেরে কাহারেরা। পাওনাগণ্ডা ভাগ মদের দোকানে হয়। ঢুকবার আগেই যে যার বুঝে নেয়, নয়তো মাতব্বরের কাছে জমা থাকে, বাড়ি ফিরে পরের দিন নেশা ছুটলে আপন আপন ভাগ নিয়ে। আসে। বনওয়ারীর দলের নিয়ম-পরের দিন বুঝে নেওয়া। রতন প্ৰহ্লাদ প্রভৃতিরা বলে মানুষ বুঝে কই কথা, দেবতা বুঝে নই মাথা। অর্থাৎ মাথা নোয়ই। বনওয়ারীর কাছে টাকা থাকা আর লক্ষ্মীর হাড়িতে সিঁদুর মাখিয়ে তুলে রাখায় কোনো তফাত নাই। বনওয়ারী বলে পরের কালারুদ্দের কণ্ঠের বিষ; নিজের লোকের জিনিস ফেলে দেবার উপায় নাই, রেখে সোয়াস্তি নাই, পেটে দিলে ইহকাল তো ইহকাল পরকাল পর্যন্ত জ্বালিয়ে খাক করে দেবে।

পাওনাগণ্ডা মন্দ হল না—ষোল কাহারে দুখানা পালকি, পালকি পিছু ষোল টাকা—অর্থাৎ প্রত্যেককে দু টাকা হিসাবে বিদায়, ষোল জনে ষোলখানা গামছা; কনের বাড়িতে বিদায়বকশিশ পাঁচ টাকা অর্থাৎ পালকি পিছু আড়াই টাকা, মদের ইলাম দুখানা পালকিতে দু গোলা অর্থাৎ দু জালা মদের মূল্য। পরমের দলও বেশ পেয়েছে রায়বেশে গিয়েছিল ছ জন, বকশিশবিদায় নিয়ে পেয়েছে বার টাকা। এ ছাড়া এক গোলা মদ। মদের দিক দিয়ে পরমেরা বেশি পেয়েছে। তাতে বনওয়ারী কাউকে আপত্তি করতে দেয় নাই; ছি, ওসব হল ছোট নজরের কাণ্ড পরমেরা খেলা দেখিয়েছে ভাল। হা, লাঠিতে পরম ওস্তাদ বটে, যাকে বলে—একখানা খেল দেখিয়ে দিয়েছে। পাঁচ-পাঁচটা সাকরে লাঠি নিয়ে ঘিরলে পরম পাঁচটাকেই হটিয়ে লাফ মেরে বেরিয়ে এল। দুজনের মাথা ফেটেছে, একজনের আঙুল এমন ঘেঁচেছে যে, ভুগবে ছোকরা কয়েকদিন। দুপক্ষের কৰ্তারা ধরেছিলেনবনওয়ারীকে ধরতে হবে লাঠি পরমের সঙ্গে। পরমই বলেছে লাঠি খেলা দেখবেন তো বনওয়ারীকে বলেন। , একহাত খেলে সুখ পাই, আপনারাও দেখে সুখ পান। বনওয়ারী হাতজোড় করেছে। লাঠি খেলা সে দেখিয়েছে, কিন্তু একা একা; রতন প্রহ্লাদের সঙ্গেও দু হাত খেলেছে। কিন্তু পরমের সঙ্গে খেলে নাই। কাজ কি? পাড়ার রেষারেষি চিরকাল। তা ছাড়া পরম ডাকাত, দাঙ্গাবাজ, ওকে বিশ্বাস করে না বনওয়ারী। আর কালোশশী আছে মাঝখানে। মনে পড়েছে আটপৌরে-পাড়ায় ঘেটুগানের কথা। পরমের হাসিটাও ভাল লাগে নাই। যাক, বাবার কৃপায় বিয়েশাদির কাজ হইহই করে ভালয় ভালয় মিটে গেল। আমোদও হল খুব। অনেকদিন এমন আমোদ হয় নাই। পালকিতে পালকিতে জবর পাল্লা হয়েছে।

যাবার সময় খুব জমে নাই। দুখানা পালকির একখানাতে ছিল বর, একখানাতে ছিল। ‘গুরুঠাকুর’। জমেছিল আসবার সময়। এক পালকিতে বর, এক পালকিতে কনে। দুই পালকিতে পাল্লা কে আগে যাবে? এ পাল্লার আমোদ হাঁসুলী বাঁকের উপকথার সেই প্রথম কালের আমোদের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে কালে তারা ছিল কুঠির দরবারের গোলাম, যে কালে দেশে বড় বড় বাড়িতে ছিল মতির ঝালর দেওয়া কিংখাবে মোড়া পালকি, পালকির ট্র্যাটে থাকত। রুপোর মকর মুখ, কি বাঘের মুখ, কি সিংহের মুখ। কত্তা-গিন্নির পালকি কাধে নিয়ে পাল্লা চলত। হাঁসুলী বাঁকের চাকরান ভোগী কাহারদের গায়ে তেজ জাগত, পায়ে দৌড় জাগত সোয়ারী পিঠে ঘোড়ার মত। সাহেব-মেমকে কত্তা-গিন্নিকে কাঁধে নিয়ে পাল্লা দিয়ে তালে তালে। ‘প্লো-হিপ্লো-হি’ শব্দে হক মেরে চারিদিকে ‘শোর’ জাগিয়ে ছুটত তারা। সে কাল চলে গিয়েছে। এখন ভাঙা পালকির আমল। কাহারদেরও আর চাকরান নাই, দেশেও আর সেসব পালকি নাই। সে আমলের সেসব পালকি-চড়িয়ে কর্তা গিন্নিও নাই। এই কর্তার চেহারা, পাকী আড়াই মন ওজন। তেমনি চেহারা গিন্নির, দু মনের তো কম নয়, তার উপর গিন্নির গায়ে গয়না, সেও কোন না আধ মন ওজন হবে। পালকি কাঁধে উঠল তো মনে হল, কাঁধ কেটে বসে গেল। এক-এক জন আবার এর চেয়েও জবরদস্ত হতেন। তাঁকে নিয়ে পালকি তুললে মাথা ঝনঝন করে উঠত, বুকের কলিজায় চাপ পড়ত। রসিক বেহারারা নানা বোলের মধ্যে-মাঝে বলত বাবু বড় ভারী। লোকে আজও বেহারার বোলের ঐ লাইনটাই বলে থাকে, তারা রসিকতা করে বলে—বোেরারা বলে শালা বড় ভারী। হরি হরি রাধাকৃষ্ণ! তাই পারে বলতে কাহারেরা? এই বিয়েতে অনেক কাল পরে দুখানা পালকিতে পাল্লা চলেছে। সচরাচর এক পালকিতেই বর-কনে আসে আজকাল, তাই পাল্লার সুযোগ মেলে না। মিত্র মহাশয়রা দুখানা পালকি করেছিলেন।

আট ক্ৰোশ পথ মাতিয়ে, পথের ধুলো উড়িয়ে চলে এসেছে। চার-চার জনে কাঁধ দিয়ে চলেছে এক-এক পালকিতে, বাকি চার-চার জন ছুটে এসেছে সঙ্গে। সে প্রায় চৌঘুড়ির মত জোরে এসেছে। বর যাবে আগে, কি কনে যাবে আগে? কত্তা আগে, না গিনি আগে? ‘নক্ষ্মী আগে, না ‘লারায়ণ’ আগে? প্লে-হিপ্লো-হিপ্লো-হিপ্লো-হি! বনওয়ারীর পালকিতে বনওয়ারী আছে আর আছে সেই পাগল কাহার, পালকির আগের ডাণ্ডায় প্রথমেই আছে পাগল। সে হাঁসুলীর বাঁকের কাহারপাড়ার আদ্যিকালের গান গাইতে গাইতে এসেছে। গান গাইতে পাগলের জুড়ি কেউ নাই। পাগল গেয়েছে—

–সরাসরি ভাল পথে–
পিছনওয়ালারা হেঁকেছে—প্লো-হিঁ।
—জোর পায়ে চলিব।
—প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ–
–আরও জোর কদমে–
—প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ—

পাগল হাসতে হাসতে সুর করে এবার বলে–বরেরো পালকি।–প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ!– পড়িল পিছনে–

–প্লো-হিঁ— প্লো-হিঁ–
—আগে চলে লক্ষ্মী—
–প্লো-হিঁ— প্লো-হিঁ–
-–পিছে এস লারায়ণ।

বরের পালকির সামনে আছে রতন, সেও হাঁকলে—জোরে ভাই, জোরে ভাই—প্লো-হিঁ–প্লো-হিঁ। কনের পালকিতে কনে বরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে, বরও হাসছে পালকিতে বসে—এ কথা তারা জানে।

হঠাৎ বনওয়ারী জোরে হাঁকে—বেহারা সাবোধান!— প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ । —আলপথে নামিলাম। পায়ে পায়ে–পায়ে পায়ে। অর্থাৎ পা যেন ডাইনে বায়ে না পড়ে, একটি পায়ের দাগে আর একটি পা, একজনের পায়ের ছাপের উপর আর একজনের পায়ের ছাপ ফেলে সাবধানে এসো বেহারারা। এসব জায়গায় বনওয়ারী নিজে সুর ধরে, পাগলকে বিশ্বাস করতে পারে না। সে যে-রকম আলাভোলা লোক, হয়ত গানের ঝোকে পথের কথা না বলে বর-কনের কথাই বলে যাবে। পিছনে বেহারারা পড়বে বিপদে। বনওয়ারী হাঁকলে—ফেলে ফেলে সাবোধানে, এসো রে বেহারা। ডা-ইনে বেঁ-কি-ব। হুঁশ করে–হুঁশ করে। প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ! সামনে উঠতি—আলকাটা নালা ভাই। প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ! পিছে টান পড়িছে! পিছন হতে প্লো-হিঁ-র বদলে শব্দ হল—কাঁধ—কাঁধ। থামল পালকি। একজন পালকি ছাড়বে, একজন কাধ বদলাবে, অর্থাৎ ডান থেকে বা কাঁধে নেবে।

দেখতে দেখতে ডান পাশ দিয়ে বরের পালকি নিয়ে রতন হাকতে হকতে চলে গেল হুম্‌-হুম্ শব্দে। গুনে বোল বলে জোরে ছুটেছে।

—হেঁইয়ো-হুঁশিয়ার–

–প্লো-হিঁ

–পাশ কর পালকি —

–প্লো-হিঁ–

—কর্তার হুকুমত

–প্লো-হিঁ–

–গিন্নির পালকি–পিছনে পড়িল—

–প্লো-হিঁ–প্লো-হিঁ–প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ–

পার হয় চলে গেল ওরা।

বনওয়ারী পাগল আবার ছুটল—বরের পালকি এগিয়ে গেল, চল চল। জোর কদমে আবার চলল কনের পালকি।কদমে কদমে বেহারা চল রে। পাগল আবার সুরে হাঁক ধরে কত্তা আগে গেল। প্লো-হিপ্লো-হি। ছুটে চল বেহারা, ধর ওই পালকি। জোরসে জোরসে। আগে যাবে লক্ষ্মী। তবে তো লক্ষ্মীর মুখে হাসি ফুটবে। লক্ষ্মীর কাছে হেরে ‘লারায়ণ’ও হাসবে। প্লো-হিঁ– প্লো-হিঁ–। বর এবং কনে যে পরস্পরের দিকে চেয়ে হেসেছে, এ ওরা ঠিক বুঝতে পেরেছে। পালকির ডাণ্ডা বেয়ে সে হাসি এসে ওদের পরশ দিয়ে যায় যে!

অনেক কাল পর এবার ভারি আমোদ গিয়েছে। পান সুপারি চিড়ে মুড়কী লুচি মিষ্টি প্রচুর বেঁধে নিয়ে ফিরল কাহারেরা।

মিত্রকর্তা বনওয়ারী এবং পরমের পিঠ চাপড়ালে—বাহবা! খুব খুশি হয়েছি।

পরমেরা ঘাঘরা, বডিজ, পায়ের নূপুর, কানের মাকড়ি খুলে ফেললে। পুঁটলি বেঁধে মাথায় নিয়ে রওনা হল। বনওয়ারীকে ডাকলে—আয়।

হাসলে বনওয়ারী, বললে চল, মাতালশালায় আসর পাত গিয়ে; আমরা যাচ্ছি—আমাদের কৰ্ম্ম এখনও বাকি আছে।

পরম ব্যঙ্গভরে বললেহ। বটে বটে। ঘোড়াদিগে গাড়ি তুলে দিতে হবে আস্তাবলে।

কাহারদের অশ্বগোত্র। তাই ঠাট্টা করলে। বনওয়ারীকে এখন পালকি দুখানি নিয়ে পৌছে দিতে হবে চন্ননপুরে বড় বাবুদের বাড়ি। পালকি দুখানা তাদের। মিত্রেরা চেয়ে নিয়েছিল বিয়ের জন্য। পালকি দুখানির জন্য দুটি বড় মাছ বাবুদের সম্মানী দিতে হবে। বিয়েশাদিতে পালকি নিলে মাছ দিতে হয়। জ্ঞানগঙ্গা নিয়ে যাবার জন্য পালকি নিলে সিধে দিতে হয়-ঘি-ময়দার সিধে। এগুলি বহন করে নিয়ে যায় কাহারেরাই। এই কাজ সেরে তবে বনওয়ারীদের ছুটি। তবে এ কাজটা ছেলে-ছোকরাদের। তারাই বরাবর করে। খালি পালকি দুই কাহারে বয়ে নিয়ে যায়, এক কাহার নেয় মাছ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দুজনের একজনই হাতে ঝুলিয়ে নেয় মাছটা। সাধারণ গেরস্তে মাছ দেয় দু সের ন পো, বড়জোর আড়াই সের ওজনের। এর বেশি ওজনের দিতে পাবে কোথায় তারা? যার থাকে, সেও নজরের জন্যে দিতে পারে না। মিত্র মহাশয় মানী লোক দুটো মাছ দিয়েছেন দশ সের ওজনের। বড়বাবুদের বাড়ি যাবে, ছোট কি দেওয়া যায়? বনওয়ারী ঠিক ওই জন্যেই ছেলে-ছোকরাকে ভারটা না দিয়ে নিজেই যাবে। বড়বাবু রাজলক্ষ্মীর আশ্রিত, তাঁকে দর্শন হবে, প্রণাম হবে। বাবু মাছ দেখে খুশি হবেন। বলবেন—তুই? কে বল্ তো তুই?

বনওয়ারী বলবে-আজ্ঞে হুজুর, আমি বনওয়ারী। আপনার চাকর, পেজা হয়েছি নতুন। সায়েডাঙায় জমি নিয়েছি।

এ ছাড়া আরও একটু কারণ আছে। সুবালা এক ফাকে এসে বলে গিয়েছে ব্যানোকাকা, বর বলেছে তোমাকে দেখা করতে। দেখা না করে যেয়ো না যেন। লুকিয়ে বললে আমাকে। কনে হাসছিল।

বনওয়ারী পাগল রতন প্রহ্লাদ পরস্পরের দিকে চেয়ে মুচকে হেসেছে। পাল্লা দিয়ে পালকি নিয়ে আসার জন্যে বর কনে দুজনেই খুব খুব খুশি হয়েছেন। গোপনে রাঙাহাতের ‘বশকিশ’ আসবে। সেটা আর পরমকে সে জানাতে চায় না। ওরা মনে মনে হিংসে করবে। হয়ত ওরাও গিয়ে বরের কাছে দাবি করবে। কথাটা লোক-জানাজানি হবে। বর কনে হাজার হলেও ছেলেমানুষ, বিয়ে ব্যাপারে দশের কাছে আশীর্বাদী দু-দশ টাকা ওরা পেয়েছেন, তা থেকেই দেবেন, দেশসুদ্ধ লোককে দু হাতে বিলুতে পাবেন কোথায়? পরমকে দিলে বাজনদার আসবে, বাজনদারের পিছনে রোশনাইদার আসবে, তার পিছনে এ-ও- সে কতজন আসবে তার ঠিক আছে?

ওই যে! সুবালা হাতছানি দিয়ে ডাকছে খিড়কির দোরে। নসুবালার কাপড়খানা একেবারে ‘অঙে-অঙে’ ‘অসনজে’ হয়ে গিয়েছে। খুব রঙ মেখেছে নসু। গলা ভেঙে গিয়েছে। গান গেয়েছে দিনরাত। হাতে দু হাত ভরে কাচের রেশমি চুড়ি পরেছে।

বনওয়ারী পাগল এগিয়ে গেল। পাগল মুচকি হেসে বললে—তা হলে গাঁয়ে ফিরে আমার সাঙাটাও হয়ে যাক ব্যানো-ভাই। কনে তো তৈরি।

নসুবালা গাল দিয়ে উঠল—ম, মর, মুখপোড়া! ভদ্দনোকের ঘর মান না! নিলেজো, গলায় দড়ি দেগা!

পাগল হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বললেও বাবা, যাব কোথা? কনের নাকে ঝিকমিক। করে! ও তো পেতল লয়, ওটি তো দেখি নাই যখন এলি সেদিনে!

গা দুলিয়ে পরম পুলকে নসু এবার বললে—আদায় করেছি হে, আদায় করেছি। কনের কাছে। সোনার ‘সামিগ্যি’ এই—এই এত! নাকবি চার পাঁচ গণ্ডা। কানের ফুল মাকড়ি আটদশটা। কাপড় এক মোট। কনে নাকছবিটি দিলে। গিনিছা পাছাপেড়ে শাড়ি দেবে। বরকে বলেছি—দাদাবাবু, কাহার বলে আমি ননদপেটারি পাব না কি? তা হবে না, সে ছাড়ব না আমি-হা। নতুন ড়ুরে কাপড়। হঠাৎ লজ্জায় মুখে কাপড় দিয়ে সে সরে দাঁড়াল। বর মহাশয় বেরিয়ে এসেছেন। বর পাঁচ টাকার একখানি নোট বনওয়ারীর হাতে দিয়ে বললেন কনের পালকির বেহারারা তিন টাকা নিয়ো, আমার বেহারাদের দু টাকা।

বনওয়ারী খুশিই হয়েছিল, কিন্তু নসুবালা বলে উঠল—হেই মা রে, তিন টাকা? তিনে দোশমন। না দাদাবাবু, শুভকাজে দোশমন করতে নাই। আর এক টাকা দাও তুমি।

বর হেসে বললেন—তোকে নিয়ে হয়েছে বিপদ! বলেও কিন্তু এক টাকা না দিয়ে পারলেন না।

বনওয়ারী বললে—জয়-জয়কার হোক বাবু মশায়। পাগল বললে—একটি পাওনা রইল কিন্তুক।

বর বললেন–কি, বল?

—খোকাবাবু হলে আমরা কিন্তু বউদিদি আর খোকনকে বহন করে আনব; বায়না আমাদের হয়ে রইল।

বর লজ্জা পেয়ে হাসলেন। নসু হাতে তালি দিয়ে নেচে উঠল।

তাই ঘুনাঘুন—তাই ঘুনাঘুন।

 

মাতালশালায় এসে বসল বনওয়ারী। জমে উঠেছে মাতালশালা। বসে গিয়েছে দলে দলে মাতালেরা। জেলেরা এক জায়গায়, সাঁওতালরা এক জায়গায়, ডোমদের দল বসেছে আমগাছের তলায়, হাড়িরা বসেছে ওপাশে, চন্ননপুরের বাউরিরা বসেছে আলাদা, বাগদীরা ওখানে বসে বড় মদ খায় না, বাড়ি নিয়ে গিয়ে পাড়ায় বসে খায়। পরম দলবল নিয়ে বসেছে ডোমেদের দলের কাছাকাছি। বনওয়ার আশা করেছিল, আজ অন্তত এই একসঙ্গে বিয়ের কার্য সেরে ফেরার পথে সকলে একসঙ্গেই বসবে। ক্ষুণ্ণ হল সে। বললেপরম হোথা গিয়ে বসল!

গুপী বললে—যাক বাপু, যার যেথা মন সেথাই বিন্দাবন; বেশ বসেছে। বনওয়ারী সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিলে, পথে কিছু ঘটেছে। পরমকে সে তো জানে। হেসে বসল সে। বসে বললে— হল কি? ল্যাই করেছে বুঝি পাওনা নিয়ে? অর্থাৎ ঝগড়া।

–পাওনা নিয়ে ল্যাই হলে বুঝতাম—মনের ঝাল। জাত নিয়ে, গোত্ত নিয়ে ল্যাই।

—জাত নিয়ে, গোত্ত নিয়ে?—বনওয়ারীর কপালের শিরা ফুলে উঠল।

পাগল বললে-ছাড়ান দাও। লাও, ঢাল ঢাল।

–ছাড়ান কিসের? তোর ঘেন্নাপিত্তি সব গিয়েছে পাগল।

—তু খেপেছিস ব্যানো! জাত নিয়ে ঝগড়া কিসের? যে বড় সে বড়, যে ছোট সে ছোট। ভগবান যা করে পাঠালছেন, তাতে কার কি হাত? আসল জাত নিজের নিজের আচার-আচরণে, কাম-কম্মে।

বনওয়ারী বুঝে গেল। এইটি ওর গুণঠিক ঠিক, এ তু ঠিক বলেছিস, বাস্। লাও ঢাল। ছোট বললে ছোট হয় না, খুঁড়িয়ে দাঁড়ালে বড় হয় না। বাস্।

পাগল গান ধরলে। মুড়ি বেগনি ফুলুরির সঙ্গে চলতে লাগল মদ। বনওয়ারী হঠাৎ পাগলকে ডেকে দেখালে—দেখ, শালো জাত দেখায়, শালোর করণ দেখ।

সকলেই দেখলে, পরম ডোমেদের আসরের মাঝখানে গিয়ে বসেছে। মদও খাচ্ছে।

পাগল বললে—ছাড়ান দাও।

—ছাড়ান দোব কেনে? এ তো পরমের ডোমে জাত দেওয়া হল।

–নিশ্চয়।—সকলেই একবাক্যে সায় দিলে।

শুধু পাগল বললেওহে, ওতে জাত যায় না। জাত যার যায় তার যায়—এমনিতেই যায়। যার যায় না, তার যায় না। জাত না দিলে, লেয় কে? তার নাম কি, ঘর কোথা?

বওয়ারী অবাক হয়ে গেল।

পাগল বললে—লাখ কথার এক কথা বলেছে করালী। ঠিক বলেছে। সেদিন থেকে ভেবে আমি দেখলাম। সার কথা বলেছে ছোকরা।

—করালী! করালী বলেছে?

–হ্যাঁ। সেদিনে বললাম তো তোমার কথা। তুমি বলেছিলে, শুধাস করালীকে। তা করালী বললে—আমার জাত আমি না দিলে লেয় কে? তার ঘর কোথা? তা ছাড়া আর একটি কথা বললে–ভীষণ কথা। বললে ছোঁয়া খেলে জাত যায় না, জাত যায় এঁটো খেলে। জাত আমার যায় নাই, আমি কারুর এঁটো খাই না। কাহারেরা সদ্‌গোপদের এঁটো কুড়িয়ে স্বগ্‌গে যায়।

সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বনওয়ারী মাটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

শুধু পানা বললে আমি কিছু বলব না বাবা। সবেই দোষ আমার হয়। বুয়েচ!

বনওয়ারী তার হাতখানা ধরে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললে—তু বেটার ওই সরিঙ্গে মুখ দেখলে আমার সব্বাঙ্গ জ্বলে যায়। সরে যা, ছামু থেকে তু সরে যা।

রতন বললে–ওঠ, ওঠ, ঘর চল। আর লয়।

বনওয়ারী বললে—এক গোলা গোটা নিয়ে লে। মেয়েছেলে–। এক গোলা লইলে হবে না।

পাড়ার জন্যে মদ নিতে হবে। তারা মদ খেলে, আমোদ করলেপাড়ার লোকে খাবে না, এ কি হয়? পাড়ার জন্য মদ নেওয়ার নিয়ম বরাবর আছে।

পরম শুধালে—উঠলি নাকি?

গম্ভীরভাবে বনওয়ারী বললো–হ্যাঁ।

পরম বললে তার দলকেও—ওঠ্‌। আমাদেরও ওঠ্‌।

চন্ননপুর আর বাঁশবাঁদির মধ্যে মস্ত একটা মাঠ–ক্রোশখানেক লম্বা। পোয়া-তিনেক গিয়ে প্রথম পড়বে বা হাতের দিকে জাঙল গ্রাম, তারপর বাঁশবাঁদি। রাস্তার মাঝামাঝি এসে পরম ডাকলে—বনওয়ারী!

বনওয়ারী আগে চলছিল, সাড়া দিলে—কে? কে ডাকলি?

–আমি পরম। হ্যাঁ। তোর সাথে একটা কথা আছে।

—আমার সাথে? কি?

—বলি দাঁড়া।

পরম দু দলকেই বললে—চ, চ, তোরা এগিয়ে চ। আমরা কথা বলতে বলতে যাই। একটা গোপন কথা আছে আমাদের।

পাগল সকলকে ডেকে নিয়ে গেলচ চ। সঙ্গে সঙ্গে সে গান ধরে দিলে—

গোপনে, মনের কথা বলতে দে গো আঁধার গাছতলায়,
ও হায় ঠাণ্ডা শেতল সাঁজবেলায়।

খপ করে বনওয়ারীর হাত চেপে ধরলে পরম। স্থিরদৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল বনওয়ারীর মুখের দিকে। বনওয়ারী বুঝে নিলে। সে সঙ্গে সঙ্গে নিশ্বাস নিয়ে ছাতিটা ফুলিয়ে দাঁড়াল। বললে—মার করবি? অর্থাৎ মারামারি করবি?

পরম বললে—করালীকে কি বলেছিস? আমি ডাকাত, আমি দাগী?

বনওয়ারী হেসেই বললে–নোস তু উ সব? তু নিজেই বল্ কেনে?

এবার পরম দাঁতে দাঁত ঘষে বললে—শালো সাধু নোক, আমাদের পাড়ার বটতলাতে তোমার কিসের ভজন?

পরমের লজ্জা নাই। ‘ন্যাংটার আর বাটপাড়ের ভয়’ কিসে? যে সর্বাঙ্গে কাদা মেখে থাকে, উপর মুখে থুতু ছুঁড়ে যে নিজের গায়েই মাখে, এ জ্ঞান তার থাকবে কি করে? নিজের ঘরের মেয়ের কেলেঙ্কারি নিয়ে ঝগড়া করা আর উপর দিকে থুতু ছোঁড়া একই কথা। জ্ঞানও নাই, ঘেন্নাও নাই; যার ঘেন্না নাই, তার লজ্জাও নাই। কিন্তু বনওয়ারীর লজ্জা আছে, কেলেঙ্কারিকে ভয় তাকে করতেই হয়, গোটা কাহারপাড়ার মাতব্বর সে। আগেকার কাল ছিল আলাদা। এ কাল আলাদা। আর এ কালের এই হালচাল—বনওয়ারীরাই বাপ-বেটা দু পুরুষে প্রতিষ্ঠা করেছে। কাহারপাড়ায় ‘মেয়েদের পানে তাকিও না’। মানে না সবাই, তবুও অনেক হাল ফিরেছে। সুতরাং নেশার মধ্যেও বনওয়ারী মাথা ঠিক রেখে বললে–হাত ছাড়, পরম। উ সব মিছে বাজে কথা।

–ও শালো, পানা আমাকে বলেছে। সে নিজের চোখে দেখেছে তোমার কীৰ্ত্তি। চাপা গলায় অকুণ্ঠভাবেই বলে গেল পরম, একবার বাঁধল না মুখে।

বনওয়ারী চুপ করে রইল। না, উত্তর দেবে না সে। পাপ তার বটে, তবুও উত্তর তার আছে। সে উত্তর দিতে গেলে কালোশশীকে দোষ দিতে হয়। পরমের অবহেলার জন্য সেই বনওয়ারীকে টেনেছে পাপের পথে। বনওয়ারী তাকে ডাকে নাই। কিন্তু সে কথা সে বলবে না, বলতে পারবে না।

পরম হঠাৎ তার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলে, বললে—কি শালো, চুপ করে। অয়েচ যে! ধাৰ্ম্মিক! মাতব্বর।

আর আত্মসংবরণ করা সম্ভবপর হল না বনওয়ারীর পক্ষে। সে হুঙ্কার দিলে—পরম!

মত্ত পরম দু হাতে শূন্যলোকে অনুসন্ধান করে বললে–লাঠি? আমার লাঠি?

মনের উত্তেজনায় পরম লাঠি ফেলে দিয়ে দু হাতে বনওয়ারীর হাত চেপে ধরেছিল। খেয়াল নাই। মুহূর্তে বনওয়ারী পরমের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। তার হাতে লাঠি নাই। পরম লাঠি পেলে মানুষখেকো বাঘ। লাঠি পরমকে আর কুড়িয়ে নিতে দেবে না সে।

এরপর আরম্ভ হল যুদ্ধ। নিঃশব্দে–সেই নির্জন প্রান্তরের মধ্যে তারা দুজনে বন্যপশুর মত পরস্পরকে আক্রমণ করলে। জড়াজড়ি করে দুজনে এ অঞ্চলের পাষাণের মত মাটির উপর পড়ে গড়াতে লাগল। কখনও এ উপরে, কখনও ও উপরে। পরম ডাকাত, পরম খুনে,-সে উপরে উঠে নিষ্ঠুর নৃশংসভাবে বনওয়ারীকে আঘাত করবার চেষ্টা করছিল। কোশকেঁধের ঘরের ছেলে বনওয়ারীর গায়ের শক্তি বেশি, সে তাকে প্রতিহত করলে, কিন্তু মারাত্মক আঘাত করতে চাইল না। না, তা সে করবে না।

হাঁসুলীর বাঁকের উপকথার রাত্রে দাঁতালে দাঁতালে লড়াই হয়। গাছের মাথায় হনুমানের দলে বীরে বীরে যুদ্ধ হয়। সুচাঁদ বলে-হাঁসুলী বাঁকে মাঝে মাঝে মরদে-মরদেও খুনোখুনি ‘অক্তগঙ্গা’ হত সেকালে। কাহারপাড়ার মরদে-মরদে সে খুনোখুনি এখন নাই। সেকালে হামেশাই হত দুই ‘দানোতে অর্থাৎ দানবে যেন যুদ্ধ লাগত। দুই বুনো দাতালে অঁতোতির মত লড়াই। একালে সে লড়াই লজ্জার কথা। কিন্তু উপায় কি? পরম আক্রমণ করলে ঠেকাতেই হবে। ঠেকাতে গিয়ে মার খেয়ে রাগও জাগছে। এইবার সেও মারবে! হুঁশিয়ার পরম! আবার সে নিজেকে সামলে তাকালে রাস্তার দিকে। পরম এবং বনওয়ারীর সঙ্গীরা তাদের পিছনে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বনওয়ারীর ইচ্ছা হল, ওদের চিৎকার করে ডাকে। কিন্তু না। সে বড় লজ্জার কথা। সে হল হার মানার শামিল। সে প্রাণপণ শক্তিতে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে। প্রাণপণে টেনে পরমকে নিয়েই উঠে দাঁড়াল। এবং সঙ্গে সঙ্গে এই সুযোগে তাকে আছাড় মেরে মাটিতে ফেললে। এই আছাড়েই পরম প্রায় অসাড় হয়ে পড়ল। বনওয়ারীরও খুব বেশি শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। তবু সে চেপে বসল পরমের বুকে। মারলে আরও কয়েকটা নিষ্ঠুর কিল। তারপর ছেড়ে দিলে। সে পাশে বসে হাঁপাতে লাগল। সর্বাঙ্গ যেন থেঁতলে গিয়েছে।

অনেকক্ষণ পর কোনোরকমে সামলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। পরমও তখন উঠে বসেছে। বনওয়ারী গিয়ে তার হাত ধরে টেনে বললে–উঠতে পারবি?

পরম গর্জন করে উঠল—ছাড়।

বনওয়ারী তাকে ছেড়ে দিয়ে চলতে টলতে চলল। পরম বারকয়েক উঠবার চেষ্টা করে শুয়ে পড়ল সেই মাঠের উপরেই।

***

গ্রামে তখন মদ নিয়ে আনন্দ চলেছে, তার সঙ্গে নানা উপাদেয় খাদ্য। বনওয়ারী গ্রামের প্রান্তে থমকে দাঁড়াল। কি ভেবে, গ্রামে না ঢুকে পাশের পুরনো কালের ঘন গাছপালার অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে উঠল আটপৌরে-পাড়ায়। আজ যেন কালোবউ শতগুণ লোভনীয় হয়ে তাকে আকর্ষণ করছে। শরীরের মধ্যে যেন এখনও রক্ত গরম আগুন হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে, আজ কালোবউকে নিয়ে এখুনি সে চলে যায় নিজের ঘরে। কোনো পাপ হবে না। পরম নিজেই সে পাপ হওয়ার পথে কাঁটা দিয়েছে। সে কম্পিত হাতে গোটা কয়েক ছোট ঢেলা তুলে নিয়ে পরমের উঠান লক্ষ্য করে ছুঁড়ল।–টুপ, টুপ, টুপ। সুচতুর মেয়ে কালোশশী ঠিক বুঝতে পেরেছে। আবছা অন্ধকারে সাদা মূর্তি উঠানে এসে দাঁড়াল।

সে এবার মৃদু গলাঝাড়ার শব্দ করলে। চতুরা কালোবউয়ের কান এদিক দিয়ে বেহালার। তারের মত, খুট করলেই তারে সাড়া জাগে। চকিত দৃষ্টি হেনে বনওয়ারীকে দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সে। মুখ ভরে হেসে বললে—তুমি ঠিক বুঝেছি আমি, সে-ই বটে।

–হ্যাঁ।

–কিন্তু এ কি, হাঁপাইছ কেন?

–পরমের সাথে হয়ে গেল এক হাত।

গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠল কালোবউ-এ কি! অক্ত?

–হ্যাঁ। সি পড়ে আছে মাঠে।

কালোবউ বিন্দুমাত্র ব্যস্ত কি উৎকণ্ঠিত হল না। সে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইল মুগ্ধ দৃষ্টিতে, তারপর বললে—দাঁড়াও, অক্ত-উক্ত ধুয়ে ফেল আগে।

—ঘটির জলে যাবে না। আসলে বনওয়ারী। অক্ত-ধুলো—চান করতে হবে।

বনওয়ারীর হাত ধরে সে বললে—চল তবে নদীতে। কাচের পারা জল, ধুয়ে মুছে চান করবা।

–চল। বনওয়ারী খুশি হয়ে উঠল। আজ কালোবউকে সবচেয়ে বেশি মনোরমা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কালোবউ ধুয়ে মুছে দিলে সকল ক্ষত এবং আঘাতের যন্ত্রণা জুড়িয়ে যাবে। কালোবউয়ের কাঁধে হাত রেখে সে বললে—চল।

পাড়া আনন্দে তখন মাতোয়ারা। ঢোল বাজছে। মদে খাবারে মেতে উঠেছে সকলে। আটপৌরে-পাড়াতেও চলছে। বনওয়ারী টলতে টলতে কালোবউকে নিয়ে কোপাইয়ের গর্ভে এসে নামল। আকাশে সবে চাদ উঠেছে। একপাশ-খাওয়া লালবরণ মস্ত চাদ। হাঁসুলীর বাঁকের ওপারে গাছের মাথায় মাথায় আকাশ ফরসা হয়ে উঠেছে, গাছের ডালগুলির পাতায় চিকচিক করে নাচছে উঠতি চাদের লালচে আলোর ছটা। আলো নাচছে না, পাতাগুলিই নাচছে বাতাসে, কিন্তু মনে হচ্ছে—চাদের আলোই নেচে খেলে বেড়াচ্ছে উড়ন্ত প্রজাপতির হিলহিলে পাখনার মত। বনওয়ারী কোপাইয়ের জলে গলা ড়ুবিয়ে বসল। জল পেয়ে ক্ষতগুলি জ্বলছে, কিন্তু তবু যেন মনে হচ্ছে, শরীর জুড়িয়ে গেল। কালোবউ বসেছে নদীর বালিতে পা ছড়িয়ে দেখতে দেখতে চাদের আলো দুধবরন হয়ে গাছপালা বাঁশবন ঝলমল করে তুলে নদীর বুকে নামল। কোপাইয়ের জলে গলানো রুপোর ছটা জেগে উঠল। কোপাইয়ের তরতরে স্রোতের মধ্যে চাদ যেন ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন খিলখিল করে হেসে ঢলে গড়িয়ে পড়ছে। ওই ছটায় কালোবউকে বড় সুন্দর লাগছে। তার উপর মনে ধরেছে রঙ, সে রঙের ছটাও গিয়ে পড়েছে কালোশশীর মুখে।

বনওয়ারী বললে—মিহি সুরে এক পদ গায়েন কর কেনে?

হাসলে কালোবউ। কালোবউয়ের দাঁতগুলি ঝিকমিক করে উঠল, সে বললে— গায়েন?

–হ্যাঁ। বেশ অঙের গায়েন।

–আজ যে দেখি নেশা খুব!

হাসলে বনওয়ারী। কালোবউ গান ধরলে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার গান। সে যে কে রচনা করেছে, কেউ তা জানে না। কালোবউ গাইলে—

আমার মনের অঙের ছটা।
তোমায় ছিটে দিলে না—
পদ্মপাতায় কাঁদিলাম হে
সে জল পাতা নিলে না—
টলোমলো-টলোমলো—
হায় বঁধু হে পড়ে গেল—
ও হায়, চোখের জলের মুক্তোছটা মাটির বুকে ঝলে না।

হঠাৎ কোপাইয়ের পাড়ের উত্তর পারে দুটো ‘টিটে’ অর্থাৎ টিটিভ পাখি চিৎকার করে উঠল, মাথার উপরে তালগাছটা থেকে একটা পাঁচা কর্কশ শব্দ করে পাখা ঝটপট করে উঠল। কালোবউ চমকে উঠল, বললে মা গো! মর্মর মুখপোড়ারা। বলতে বলতে সে পিছন ফিরে দেখতে চাইলে ওই অশুভক্ষণে পাখিটাকে। ফিরে তাকিয়েই সে ভয়ার্ত কণ্ঠে অস্ফুট আৰ্তনাদ করে উঠল!-ও কে? সে। চাদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে পরম। চোখ জ্বলছে শ্বাপদের মত। অন্ধকারে পরমের হাসা চোখ বুনো বিড়ালের চোখের মত জ্বলে। কিন্তু এমন জ্বলতে কেউ কখনও দেখে নি। সে টলছে। মুহূতে কালোশশী উঠে দাঁড়াল; বনওয়ারীকে ডাকলে। কিন্তু কই বনওয়ারী? কই? সমস্ত কোপাইয়ের জলস্রোতটা চাদের আলোয় চকচক করছে। কিন্তু বনওয়ারী কই? ওদিকে পাড়ের উপর থেকে ঝাপ দিয়ে পড়ল পরম। কালোবউ পরমকে জানে। তারই মুখে গল্প শুনেছে-মানুষের গলায় পা দিয়ে কেমন করে অনায়াসে মানুষকে মারা যায় এবং কতজনকে সে মেরেছে। কালোবউ শিউরে উঠল; তার পরই সে ছুটল—কোপাইয়ের গর্ভে গর্ভে বালির উপর দিয়ে। পরমও ছুটল তার পিছনে। গোঙাচ্ছে পরম।

জলের তলে তলে বেশ খানিকটা দূরে ভেসে গিয়ে মাথা তুললে বনওয়ারী। জলে ড়ুবে নদীর স্রোতে সে ভেসে চলেছিল। মাথা তুলে সে ব্যাপার দেখে চমকে উঠল। উপরের দিকে অর্থাৎ স্রেতের উল্টো দিকে ছুটছে কালোবউ। পিছনে টলতে টলতে ছুটছে পরম। সে এবার জল থেকে উঠল তাড়াতাড়ি। ছুটতে চেষ্টা করল। কিন্তু সেও টলছে। তার উপর বালি।

ওই কালোবউ ছুটছে! ওই!

ওই পরম!

সর্বনাশ! সামনে যে ‘সায়েবড়ুবির দহ’, কেউ বলে—‘যখের দহ’, কাহারপাড়ায় লোক বলে—কত্তার দহ। কত্তা ওই দহে চান করেন। কালারুদ্র ওই দহে জলশয়ানে আছেন। কাহারেরা বছরে চার বার নামে এইখানে। গাজনে কালারুদ্দের শিলারূপকে তুলে নিয়ে যায়, আবার জলশয়ানে রেখে আসে; আর ওখানে থাকেন কালারুদ্রের বেটী মা-মনসার ‘বারি’। একবার নেমে সেই বারি নিয়ে যায়—একবার নেমে সেই বারি ড়ুবিয়ে দেয়। তা ছাড়া কেউ ওদিকে ঘেঁষে না। ওখানে পাহারা দেয় আদ্যিকালের এক বুড়া কুম্ভীর। মধ্যে মধ্যে বেড়াতে এদিকে ওদিকে যায় বটে, কিন্তু দহের বিঘ্ন হলে নিশ্চয় সে কোপাইয়ের জল কেটে তীরের মত ছুটে আসবে। রক্ষা কর হে বাবাঠাকুর, রক্ষা কর।

ওই দহের কিনারা ধরে উপরে উঠছে কালোশশী। উঠতে পারলে নিশ্চিন্ত; শিমুলবৃক্ষটি পার হলেই কোপাইয়ের জঙ্গল, জঙ্গলে ঢুকলে কালোশশীকে খুঁজে বার করা পরমের সাধ্যে কুলাবে না। কালোশশী শিমুলবৃক্ষটির শিকড় ধরে উঠে যাচ্ছে বুনো বিড়ালীর মত। দহের মাটি খুলে গিয়ে শিমুলবৃক্ষের শিকড় বেরিয়ে আছে–ঝুলে আছে, তাই ধরে আর তাতেই পা দিয়ে উঠছে। বাহাবাহা! বাহারে কালোশশী।

হঠাৎ কালোবউয়ের ভয়াত চিৎকারে কোপাইয়ের স্তব্ধ গৰ্ভভূমি যেন বুকের উপর খুনির ঝকমকানি দেখে উঠল। ওটা কি? শিকড়ের তলা থেকে আকাশের বিদ্যুতের মত এঁকেবেঁকে মাথা তুলে দাঁড়াল, ওটা কি? চাদের আলোয় ঝলমল করছে কোপাইয়ের জল বালি। তীরের জঙ্গলের কোল পর্যন্ত ঘাস নড়ছে দেখা যাচ্ছে, বালির মধ্যে ঝিকমিক করছে বালুর কণা, দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কালোবউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? সে কই? কালোবউ কোথায় গেল? বনওয়ারী চারিদিকে চেয়ে দেখে চাপা চিৎকারে ডাকলে—কালোশশী।

খিলখিল করে হেসে উঠল পরম। পরম দহের কিনারা ধরে ফিরে এসে কোপাইয়ের জলে নামছে। কই কালোবউ? এ কি হল? শুধু দহের জলটা দুলছে। সে ছুটে গেল দহের দিকে। দুলছে জল ঢেউয়ে ঢেউয়ে। বিদ্যুতের আঁকাবাকা যেটা শিমুলবৃক্ষের তলা থেকে বেরিয়ে কালোবউয়ের বুকের উপর মাথার উপর দুলে উঠেছিল, সেটা এখনও মুখ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে। সেও দেখছে দহের জল ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছে। বনওয়ারী সভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর করজোড়ে প্ৰণাম করে পিছু হঠতে লাগল। সাদা গোখুরো একটা।

পিছন থেকে পরম আবার হেসে উঠল। বনওয়ারী ফিরল। বুঝাপড়ার শেষ হয়ে যাক। পরম কোপাইয়ের ও-তীরে দাঁড়িয়ে আসছে।

বনওয়ারী কঠিন স্বরে ডাকলে—পরম!

পরম উত্তর দিলে না। তার আক্রোশ মিটে গিয়েছে। সে পালাচ্ছে।

বনওয়ারী বললে—মরদ হোস তো ফিরে আয়!

পরম দাঁত মেলে হাসলে। তারপর মিশিয়ে গেল কোপাইয়ের ওপারের তীরের জঙ্গলের মধ্যে। বনওয়ারীর কিন্তু কত্তার দহে নামতে সাহস হল না।

বনওয়ারী থরথর করে কাঁপতে লাগল। কত্তাবাবার ক্রোধ কি তার উপরেও পড়ল? কালোবউকে জলের তলা থেকে কেউ কি টেনে নিলে? মাথার উপর, বুকের উপর কালদণ্ড তুলে দাঁড়িয়ে উঠল কে? বাবার বাহন! বাবার বাহন! সে চোখে অন্ধকার দেখলে, হয়ত পড়েও যেত! কিন্তু তাকে কে পিছন থেকে ধরে ফেললে। ধরেছে পাগল, সে ডাকলে—বনওয়ারী! বনওয়ারী! বনওয়ারী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *