৩.২ নয়ানের মা যে-অভিসম্পাতই দিক

নয়ানের মা যে-অভিসম্পাতই দিক, বনওয়ারী তার উপর রূঢ় হতে পারলে না। সে মাতব্বর, তার সে কর্তব্য নয়। বরং নয়ানের প্রতি যে অবিচার সে করেছে তার প্রতিকারের জন্যই সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। নয়ানের সাঙা দেবার জন্যে কন্যে খুঁজতে লাগল। তবে অবসর যে কম। কাজ যে অনেক। বৈশাখ মাস, দিন যাচ্ছে জাঙলের সদূগোপ মহাশয়দের ঘর ছাওয়াতে। কাহারেরা পাকা বারুই, বনওয়ারী প্রহ্লাদ রতন—এ অঞ্চলের ডাকসাইটে বারুই। ঘর ছাওয়াবার মজুরিও বেশি। এটা একটা রোজগারের মরসুম তাদের। চন্ননপুর পর্যন্ত যেতে হয় তাদের। এখন যে দিন-রাত্রির মধ্যে বিশ্রাম মিলছে না। দিনে ঘর ছাওয়ানো, রাত্রে রয়েছে জমি কাটার কাজ। শুক্লপক্ষ চলছে, এই পক্ষে চাঁদের আলোয় কাহারদের নিয়ে বনওয়ারী জমিটা কাটছে। গাঁইতি চলছে। পাথরেরা জব্দ হয়েছে। ভাগ্য ভাল, পাথরের থাক’ অর্থাৎ স্তরটা খুব পুরু নয়, পাথরের নিচে মাটিও ভাল। বনওয়ারীর কাছে কাহারেরা মজুরি নেয় না, নেয় দৈনিক মদের মূল্যটা। রোজই চন্ননপুরের পচাইয়ের দোকান থেকে দুটি জালা মদ ওরা ঘাড়ে বয়ে নিয়ে আসে, খায়, তারপর সন্ধে পার হলেই ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বললেই তারা যে যার ‘হাতিয়ার’ অর্থাৎ কোদাল টামনা-গাঁইতি-ঝুড়ি নিয়ে দল বেঁধে চলে সায়েবডাঙার দিকে। পথে বাবাঠাকুরকে প্রণাম করে নেয়। ধুলো মাথায় নিলেই নিৰ্ভয়—বাস, চল এইবার।

মধ্যে মধ্যে ওদের সঙ্গে করালীও এসে মাটি কেটে দেয়। করালী অনেকটা বশ মেনেছে। কদিন আগেই তাক বুঝে বনওয়ারী বলেছে—এইবার তোর মঙ্গল হবে করালী। সুমতি ফিরছে। তোর।

করালী হেসে মাথায় ঝুঁকি দিয়ে সামনে ঝুলে-পড়া চুলগুলি পিছনে ফেলে বললে—তা মতিভ্যম তো হয় মানুষের।

আবার কিছুক্ষণ নীরবে কাজ করে যায় বনওয়ারী। সবাই নীরব। শুধু শব্দ করে লোহার হাতিয়ার আর মাটি পাথর—ঠং-খ-খ-ঘং; সঙ্গে সঙ্গে চারি বেড়ে ঝুড়ির মাটি পড়ে ঝপ-ঝুপ-ঝাপ। বনওয়ারীর জমি দেখতে দেখতে বেড়ে যায়।

পাশে পরমের জমিটা পড়েই আছে। যে ডাঙা, সেই ডাঙা। কোনো একটা চুরি বা ডাকাতি করে পয়সা হাতে না পেলে পরমের জমি কাটানো হবে না।

কিছুক্ষণ পরে বনওয়ারী আবার কথা বললে। আফসোসের সুরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে— আঃ, তু যদি ওই খ্যাতটি না করতিস করালী!

—কি? করালী মাথা ঝুঁকি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কি করলে সে? ভুরু কুঁচকে উঠল তার।

—ওই বাবাঠাকুরের বাহনটিকে। আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সে। কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না এই ভয়টিকে। ভুলতে তাকে দিচ্ছে না নয়ানের মা। নিত্য সে গালাগালি করছে। যখনই শোনে বনওয়ারী তখনই সে চমকে ওঠে। মন তার খারাপ হয়ে যায়।

করালীর মনে কিন্তু এজন্য কোনো শঙ্কা বা সংশয় নাই। রেললাইনে সে কাজ করে, মাটি কাটতে গিয়ে কত সাপ বেরিয়ে পড়ে। সাপ দেখলেই মারে। তা ছাড়া ওই সাপটা মারবার কিছুদিন আগে ঠিক এমনি একটা চন্দ্রবোড়াকে তাদের সায়েব গুলি করে মেরেছে তার চোখের সামনে। সাপটা তার কাছে সেই জন্যেই সাপ ছাড়া আর কিছু নয়। সঙ্গী সাথীদের কেউ এ কথা বললেই সে বলে—ভাগ। বনওয়ারীর কথার উত্তরে সে এই কথাটা বলতে পারলে না, তবু ঠোট বেঁকিয়ে বললেওই তোমার এক কথা। সাপ আবার–

ও কথা বোলো না বাবা, ও কথা বোলো না।

করালী চুপ করে গেল। বনওয়ারীর কণ্ঠস্বরে গুরুগম্ভীর সুর গমগম করে উঠেছে। সে কোদাল ছেড়ে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করেছে।

কিছুক্ষণ পর বনওয়ারী আবার বললে–চন্ননপুর ছাড় তু করালী। ওখানে গিয়েই তোর এই সব মতিগতি। কিছু জমি কেন—

–জমি?

–হ্যাঁ। জমি কে, বলদ কে, চাষ কর।

সে বুড়ো বয়সে করব। হাসতে লাগল করালী। তারপর বললে—ওরে বাপ রে! এখন রেলের কাজ ছাড়তে পারি? যুদ্ধ আবার জোর ধরল। রেলের কাজ যুদ্ধের শামিল হবে। বুয়েচ? মজুরি বেড়ে ডবল হবে। এখন লোক-লোক শব্দ উঠেছে।

যুদ্ধের ব্যাপার। কালারুদ্দের মন, মহিমা। তিনিই লাগান যুদ্ধ। তার চড়কের পাকে ঘটে বড় বড় ব্যাপার। আকাল আসে, মহামারণ আসে। যুদ্ধও এসেছে।

যুদ্ধ, নাকি ঘোর ‘যুদ্ধ’ লেগেছে। সেই যুদ্ধের জন্যই নাকি এ দিকেও অনেক ব্যাপার হবে। লাইন বাড়বে। কোথা নাকি উড়োজাহাজের আচ্ছা হবে। গোটা রেললাইনই নাকি যুদ্মকোম্পানি নিয়েছে কেড়ে। অনেক নতুন লোক নেবে। অনেক খাটুনি, অনেক মজুরি। দেশবিদেশ, রেঙুন, না কোথা বোমা পড়েছে। ‘জাপুনি’ না কারা আসছে! কলকাতা থেকে লোক পালাচ্ছে। চন্ননপুরেও নাকি আসছে কলকাতার লোক। চন্ননপুরে হইহই পড়ে গিয়েছে।

বাঁশবাঁদির হাঁসুলী বাঁকের মাথার উপর দিয়েও উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে মধ্যে মধ্যে। পক্ষীগুলো কলরব করে ওঠে, দূর আকাশে বিন্দুর মত উড়ন্ত চিলগুলো জাহাজ দেখে ভয় খেয়ে পাখা গুটিয়ে সন্স করে নেমে পড়ে। কাহারপাড়ার মেয়েপুরুষ অবাক হয়ে দেখে। ছেলেগুলো অবোধ, মাঠে মাঠে ছুটতে থাকে ঊড়োজাহাজের সঙ্গ নিয়ে। আকাশে মেঘ থাকলে উড়ে চলে। মধ্যে মধ্যে মেঘের ভিতর ঢাকা পড়ে, আবার মেঘ কেটে বেরিয়ে পড়ে; গো-গোঁ শব্দে যায়। কোন্ মুলুক থেকে কোন্ মুল্লুকে।

প্রথম যেদিন উড়োজাহাজ উড়ে যায়, সেদিনের কথা বনওয়ারীর আজও মনে আছে। রাত্রিকাল, নয়ানের মা গাল পাড়ছে, বনওয়ারী বসে আছে একা। হঠাৎ বাঁশবাঁদির অন্ধকার কাঁপিয়ে আকাশের কোণে সে এক মহাশব্দ।

গোঁ-গোঁ শব্দ উঠেছে আকাশের দূর কোণ থেকে। শব্দ ক্রমশ এগিয়ে এল।

বনওয়ারীর হাত-পা কাঁপতে লাগল।

বাবার বাহন ফণা তুলে আবার কোনো নতুন রূপ ধরে আসছে নাকি! সমস্ত কাহারপাড়া অন্ধকার আকাশপানে উদ্গ্রীব শঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

লাল-নীল দুটো তারা যেন ছুটে আসছে। তার সঙ্গে ওই শব্দ।

করালীর সাকরেদ মাথলা ও নটবর বললে—উড়োজাহাজের শব্দ। উড়োজাহাজ। ওরই আচ্ছা হবে চন্ননপুরের পাশে কোন্‌খানে।

হে ভগবান! হাঁসুলী বাঁকের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল অলক্ষুণে উড়োজাহাজ!

এখন আর ভয় হয় না। কিন্তু এ যে অলক্ষণ, তাতে সন্দেহ নাই। ধানের দর চড়তে লেগেছে। কাপড়ও চড়ছে। অন্য ‘দব্য’ অর্থাৎ দ্রব্যের দরও চড়েছে কিন্তু কাহারদের আছে শুধু খাওয়া আর পরা—অন্য দ্রব্যের দর চড়লে বেশি কিছু যায়-আসে না।

 

রাত্রি নটার গাড়ি ঝমঝমিয়ে বাদ্যি বাজিয়ে কোপাইয়ের পুল পার হলেই জমি কাটার কাজ শেষ করে কাহারেরা বাড়ি ফেরে।

খেটেখুটে আর মজলিস জমে না। যে যার শুয়ে পড়ে। শুধু করালীর ঘরে আরও কিছুক্ষণ মজলিস চলে। ছোকরার দল, খেটে ওদের ক্লান্তিও হয় না, আর বয়সের কারণে খানিকটা আমোদ না করে ঘুমও আসে না। ওদের মজলিসে আজকাল মাঝখানে বসে হাঁসুলী বাঁকের আদ্যিকালের বদ্যিকুড়ি সুচাঁদ। ওর এক পাশে গা ঘেঁষে বসে নসুবালা, অন্য দিকে পাখী। চারিপাশে বসে ছোকরারা। ছোকরারা মাতব্বরের জমি কেটে না ফেরা পর্যন্ত যত অল্পবয়সী। মেয়েরা বসে। পুরুষেরা ফিরলেই ঘরে ফেরে তারা। মধ্যখানে জ্বলে একটা নতুন লণ্ঠন। হাঁসুলী বাঁকে সেকালে জ্বলত পিদিম। তাও নিম এবং রেড়ীর তেলের। নিমফল কুড়িয়ে, রেড়ীর ফল সংগ্রহ করে গড়াবাড়ি থেকে পেষাই করে আনত। ‘কেরাচিনি’ অর্থাৎ ‘কেরোসিন’ উঠে ‘লম্প’ অর্থাৎ ডিবে হয়েছে। লণ্ঠন আজও কাহারদের কেউ কেনে নাই। বনওয়ারীর বাড়িতে আছে একটা, তাও ঘোষ-বাড়ির দেওয়া পুরনো। পানার ঘরেও একটা আছে, সেটাও পুরনো সেটা মনিব-বাড়ি থেকে চুরি করা। পুরনো রঙ ঢাকতে প্রাণকেই তাতে আলকাতরা মাখিয়েছে। নয়ানদের বাড়ি সে আমলের চৌধুরী-বাড়ির একটা ভাঙা লণ্ঠন পড়ে আছে। তলাটা ফুটে গিয়েছে, মাথাটা নাই, কাচটা ভাঙা; সেটার আবার চারিপাশে তারের বেড় দেওয়া আছে। এসব আলোর কোনোটাই ওরা বড় একটা জ্বালে না। পালে-পার্বণে দায়ে-দৈবে জ্বালে। একটা লণ্ঠনের তেলে চারটে লম্প জ্বলে। সুতরাং কেন জ্বালবে কাহারেরা? চন্ননপুরের কারখানার চাকরে করালীর কিন্তু লণ্ঠন জ্বালা চাইই– সুচাঁদের আবার সেটি চাই ঠিক মুখের সামনে। একেবারে উজ্জ্বল করে জ্বলা চাই। তাকিয়ে দেখে আর হাসে। মধ্যে মধ্যে আরও একটু দম বাড়িয়ে দেয়, একটু বাড়াতে গিয়ে বেশি বেড়ে গেলে হাউমাউ করে ওঠে–গেল রে গেল রে—হেই মারে! ও পাখী–ও নসু–! ওরা কমিয়ে দিলে শান্ত হয়ে বলে হু-হু, সায়েবি কল!

পাখী বলে মরণ, লণ্ঠনেই মজেছে বুড়ি!

সুচাঁদ চুলের গোড়া থেকে দু আঙুলে টিপে টেনে কিছু বার করে নসুকে বলে—দেখ তো ভাই, ডেঙুর না নিকি?

নসু বলে–ও মাগো, এ যে ডেঙুর! অ্যাই একেবারে বলদের মতন বলে সেটা নিয়ে বা হাতের বুড়ো আঙুলের উপর রেখে ডান হাতের নখ দিয়ে টিপে মারে—পট করে শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে নসুও মুখে শব্দ করে! ওই শব্দটি না করলে উকুনের স্বৰ্গ হয় না।

পাখী বলে—ওই শোণের নুড়িগুলান কেটে ফেলাস। উকুনের রাজি হয়েছে।

—কি বললি? কেটে ফেলাব?

–হ্যাঁ।

—চুলগুলান?

–হ্যাঁ।

—আমার চুল শোণের নুড়ি?

—লয়? আয়না নিয়ে দেখবি?

–চিৎকার করে ওঠে বুড়ি—আতে আয়না? না। দেখে কাজ নাই আমার।

—কেনে?

–এই বুড়ো বয়সে কলঙ্ক হবে।

সমস্ত মেয়েরা এবার হেসে ভেঙে পড়ে। নসুবালা গান ধরে দেয়—

‘লষ্টচাঁদের ভয় কি লো সই, কলঙ্ক মোর কালো ক্যাশে
কলঙ্কিনী রাইমানিনী–নাম রটেছে দ্যাশে দ্যাশে।’

হঠাৎ ওই সুরে সুর মিশিয়ে অতি সুন্দর পুরুষালি গলায় কে বাড়ির বেড়ার ধার থেকে গেয়ে উঠল—

‘শ্যাম কলঙ্কের বালাই লয়ে–
ঝাঁপ দিব সই কালীদহে,
কালীগের প্রেমের পাকে মজব আমি অবশ্যাষে!’

সকলেই চমকে উঠল।—কে লো?

সুচাঁদ এবার হেসে গড়িয়ে পড়ল, বললে-রবশ্যাষে এল!

নসু লাফ দিয়ে সরে এসে বললেউ মুখপোড়া কোথা থেকে এল লো? মড়া মরে নাই তা হলে?

পাখী খিলখিল করে হেসে উঠল।

এইবার গায়ক এসে বাড়ি ঢুকে লণ্ঠনের আলোয় দাঁড়াল। অদ্ভুত বেশ। মাথায় জটা, হাতে ত্রিশূল—কিন্তু মহাদেব নয়, গাজনের সঙের নন্দীর বেশ।

পাখী হাততালি দিয়ে উঠল। —পাগল-দাদা!

পাগল কাহার-পাগল-পাগল ভাব, কারুর ভাতে নাই, কারুর মন্দতে নাই। ঘর নাই, সংসার নাই, ‘স্তী’ নাই, ‘পুত্ত’ নাই, বিচিত্র মানুষ পাগল। একটিমাত্র কন্যে, তার বিয়ে দিয়েছে। ভিন গায়ে। এখানে যদি দশ দিন থাকে তো পাগল সেখানে থাকে পনের দিন, বাকি পাঁচ দিন এখানে ওখানে সেখানে। নেহাত অভাব হলে কিছুদিনের জন্য কাজকর্মে মন দেয়, নগদ মজুরিতে রোজ খাটে, খায়। খাটুনির অভাব নাই, লোকটার বিদ্যে অনেক। ঘর ছাওয়ার কাজে ওস্তাদ, মাটির দেওয়ালের কাজে পাকা কারিগর, ঘর লেপনের কাজে সুন্দর হাত, বাঁশ কেটে ফেলে দাও, ঝুড়ি তৈরি করে দেবে পাকা ডোম কারিগরের মত, খাচা তৈরি করবে। লোকটার সবেই পাকা হাত। সবচেয়ে সেরা বিদ্যে গান, নিজেই গান বেঁধে গায়, গানও অতি চমৎকার। এখানকার ঘেটুগান একালে বরাবর পাগল বেঁধে আসছে। বনওয়ারীর পরম বন্ধু। কার নয়? সবারই বন্ধু পাগল। গলাগলি ঢলাটলি নিয়েই থাকে। হবে না কেন? সুচাঁদ পিসি বলেপাগলের মা অঙ খেলেছিল বোষ্টম আজমিস্ত্রি আখাল আজা দাস বোষ্টমের সঙ্গে। চন্ননপুরে নয়, জাঙলে বাবা কালারুদ্দুর থানটিতে যখন পাকা ইমারতের কাজ হয়, তখন জাঙলের চৌধুরীরা খুঁজে খুঁজে বোষ্টম আজমিস্ত্রিকে এনেছিলেন কাটোয়া থেকে। পাগলের গায়ে আছে সেই বেষ্টমের অক্ত। এককালে পাগলই আনত চন্ননপুরের সকল খবর। সে তখন নিত্য যেত চন্ননপুর। চন্ননপুরের বামুন-বউ লালঠাকরুণের সঙ্গে সে ‘দিদি’ পাতিয়েছিল। ছেলে ছিল না, বিধবা মানুষ, কি যে ভক্তি হয়েছিল পাগলের, ‘দিদি বলতে অজ্ঞান হত, রোজ যেত দিদির বাড়ি একটি ঘটিতে দুধ নিয়ে। ঘরের গাই নিজে হাতে দুয়ে কাপড় ছেড়ে নির্জলা দুধ দিয়ে আসত; পাগলের দিদি লালঠাকরুণ ‘আত্তিকালে’ সেবা করতেন, একাদশীর পরদিন লালঠাকরুণ পিরণ করে পাগলকে পেসাদ দিতেন। চন্ননপুরে কারুর বাড়িতে ভোজ-কাজ হলে লালঠাকরুণ থালা নিয়ে যেতেন, বলতেন—আমার বাড়িতে পুরুষ নাই, আমার ছদা দাও, আমি নিয়ে যাব, কাহার-ভাইকে। খাওয়াব। খাওয়াতেন তিনি। লালঠাকরুণের স্বগ্‌গ হয়েছে। পাগলও চন্ননপুর ছেড়েছে, হেথাহোথা যাওয়াও বেড়েছে। এখন নেশা পড়েছে কন্যের কন্যে পাঁচ বছরের কন্যে, নাতনীর ওপর। তাকে নিয়ে ছড়া বেঁধেছে-“গান বেঁধেছে-“এ বুড়ো বয়সে তুমি আমার নতুন নেশা হে।

ওই নেশায় মজে সে দেশ ছাড়ায় হাঁসুলী বাঁকের আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছে। এবার ঘেঁটু ভাল হয় নাই। বনওয়ারী মনে মনে আফসোস করেছে, পাগল থাকলে আটপৌরে-পাড়ার ঘেঁটুর জবাব দিত সে। গাজনের সময় পাগল থাকলে গাজন আরও জমত। সকলেই পাগলের আশা ছেড়েই দিয়েছিল। হঠাৎ আজ সে এসে উপস্থিত হল বছরখানেক পর। উপস্থিত হল বিচিত্র বেশে।

সুচাঁদ বললে—এলে তা হলে? বস বস। তা ই ব্যাশ কেনে? গাজন তো ফুরিয়েছে।

পাগল বললে—এই ব্যাশেই বেরিয়েছিলাম, বলি-গাজনের সঙে একেবারে গিয়ে নাচতে লেগে যাব। তা পথে কাটোয়ার ধুম দেখে সেইখানেই থেমে গেলাম। গাজ. গেল। ব্যাশ আর খুললাম না, এই ব্যাশে গান করে ভিখ মাগতে মাগতে চলে এলাম। কথায় বলে—ভ্যাক লইলে ভিখ মেলে না, জান তো! তা তোমার দেখলাম, বুয়েচ, পাওনা তোমার ভালই হয়েছে।

নিজের ঝোলাটা দেখালে সে। বললে—অ্যানেক আছে। চা পেলাম, বেচে টাকা করলাম। হাসতে লাগল সে।

সুচাঁদ বললে— এখানেও এবারে খুব ধুম।

–শোনলাম। ব্যানো চড়কে চেপেছিল!

–হ্যাঁ। বাবা নেমেছিল এবার কাহারপাড়ায়।

–হ্যাঁ, তাও শোনলাম। করালীর খুব নাম শোনলাম। পাখীর সঙ্গে অঙের কথা শোনলাম, সাপ-মারার কথা শোনলাম। তা বেশ, তা বেশ। বলেই সে হঠাৎ সুচাঁদের গা টিপে এবং ইঙ্গিত দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বললে—তা এই বারেতে আমার বেবস্থা কর। না কি?

নসু চমকে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে গালাগাল দিয়ে উঠল—মরু, মক্ খালভরা।

কথাটা কৌতুকের। পাগল সবালাকে ওই স্ত্রী-বেশের জন্য ক্ষ্যাপায়, বলে বিয়ে করব। নসু একেবারে ক্ষেপে যায়। ছুটে পালায়।

এই হাসি কৌতুকের মধ্যেই কোপাইয়ের পুল পার হয়ে নটার ট্রেন চলে গেল। মেয়েরা যে যার উঠল। করালীর দল ফিরল। পাগল তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললে—বলিহারি, বলিহারি!

—পাগল-দাদা?

পাগল গান ধরে দিলে

“পেমে পাগল হলাম আমি, পেমের নেশা ছুটল না—
হায় সখি গোসনজে হল ঝিঙের ফুল কই ফুটল না!”

করালী গানের বাহবা দিলে না, ঢোল পেড়ে বসল না। বরং উল্টে পাগলের হাত ধরে টেনে বললে—ঠিক নোক পেয়েছি।

—আই দেখ, নোক কিসের?

–ঠিক কথা বলবার। বল তুমি, বল!

—কি?

—বস নসুদিদি, বার কর বোতল।

—নসু ঝংকার দিলে—পারব না। উ মুনষে ভারি বদ। মুনষে অর্থাৎ মানুষটি–মানে এই পাগল!

এতক্ষণে করালী হাসলে। বললে—মর মুখপুড়ী মর। বুড়ো বসে ঢঙ দেখ।

সুচাঁদ একদৃষ্টে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল, মুখের দিকে তাকিয়ে শুনলে কথা বুঝতে খুব কষ্ট হয় না ওর। সুচাঁদ এবার বললে—দেখ কেনে, আমাকে আবার বলে-বুড়ো বয়সে ঢঙ!

নসু গজগজ করতে করতে বোতল এনে দূর থেকে হাত বাড়িয়ে দিলে করালীর হাতে।

করালী বললে—অল্যায় কোনখানটা বল?

কথাটা হল—বনওয়ারী বাড়ি ফিরবার পথে করালীকে এবং করালীর অন্য অন্তরঙ্গদের সাবধান করেছে, শাসিয়েছে। যুদ্ধ লেগেছে—চন্ননপুরের কারখানায় অনেক লোক চাই, মজুরি ডবল হয়ে গিয়েছে। অনেকে গোপনে করালীকে বলেছে, তারা যেতে চায়। কিন্তু বনওয়ারী বলেছে—খবরদার! খবরদার! হাঁসুলী বাঁকের গণ্ডি পেরিয়ো না বাবারা। চন্ননপুর হাঁসুলী বাঁকের উত্তর দিকে। কিন্তু আসলে ওই হল দক্ষিণপুরী। উপকথায় আছে—সব দিক পানে চেয়ে দেখো, মন চায় তো হাঁটতেও পার, কিন্তু দক্ষিণ দিক পানে চেয়ে দেখোনা; ও দিকে, ও পথে হেঁটো না।

শেষে গম্ভীর গলায় বলেছে- সাবোধান! সাবোধান!

করালী বলতে চায়—কিসের সাবোন? বল তুমি পাগল-দাদা, তুমি হলে গুণী নেক, তুমি বল কিসের সাবোন?

পাগল বললে–হুঁ, তুইও মন্দ বলছিস না ভাই, বনওয়ারীও মন্দ বলছে না।

নসুবালা সুযোগ পেয়ে বলে উঠল হাত নেড়ে-তুমিও মন্দ বলছ না ভাই। তুমিও ভালি, আমিও ভালি–ন্যাজ বাধা দিয়ে চরতে গেলি। তুইও মন্দ বলছিস না—বনওয়ারীও মন্দ বলছে না। খুব বলা হল।

সকলে হেসে উঠল। পাগল কিন্তু চটল না, অপ্রস্তুতও হল না। সেও হাসতে লাগল।

করালী বললে—এখন যে কামিয়ে লেবে, সেই কামিয়ে লেবে। তা ছাড়া ছেরকাল চাই করবে নাকি? আমি চাষ করলে এমুনি হত আমার। ওই জাঙলের সদূগোপদের কিল খেয়ে জান যেত। জান, মাথলা এবার চাষ করে কি পেয়েছে? পাঁচ আড়ি ধান। ধু! মায়ূ চাষের মাথায় ঝাড়!

সকলেই সমর্থন করে, কিন্তু নীরবে। কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল মজলিসটা। হঠাৎ সুচাঁদ বললে—যুন্ধু যুদ্ধ! কিসের যুন্ধু বাবা! ক্যা জানে?

করালী বললে—মরণ! সায়েব নোকের যুদ্ধ। ইংরাজ, জারমুনি, জাপুনী–

সুচাঁদ বললে—তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু। যুদ্ধ হয়েছিল সেকালে। বর্গী এয়েছিল। ছেলে ঘুমলো পাড়া জুড়ললা বর্গী এলো দেশে! সে বাবা শুনেছি বাপ-পিতেমর আমলে। অ্যাই বৰ্গীরা এল। ঘোড়া ছুটিয়ে টগবগ টগবগ করে তরোয়াল ঘুরিয়ে—কেটে-কুটে ঘর-দোর জ্বালিয়ে ভেঙে মানুষের নাক কেটে কান কেটে হাত কেটে মুণ্ড কেটে-খচখচখচাখচ, চলে গেল! লোকে তাদের ভয়ে পোড়া মালসা মাথায় দিয়ে জলে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকত।

পাগল বলে–হা দিদি, সাঁওতাল হাঙ্গামা-সেটা বল?

বুড়ির চোখ বড় হয়ে ওঠে। এই সিঁদুরে মুখ আঙিয়ে, কালো যমের মত সব—হেই বাবা! গাঁ কেঁপে ওঠে মা।

বুড়ি বলে যায় সে গল্প। পাখী বিরক্ত হয়ে বলে–গান কর পাগল-দাদা!

–গান?

–হ্যাঁ। যুদ্ধ আর যুন্ধু; ই কোথা যুদ্ধ হচেআর উ কোনকালে হয়েছে। তার চেয়ে তুমি রাম-রাবণের পাঁচালি বল।

পাগল শুরু করলে। করালী উঠল মজলিস থেকে। মাথলাদের নিয়ে বাইরে গিয়ে পরামর্শ শুরু করে দিলে। করালী বনওয়ারীর উপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। তা ছাড়া, এ কি রে বাপু? সাবোধান আর সাবোধান! বেটাছেলের আবার সাবোধান আছে? সে বললে—চল, তোরা চর্চ। তা’পরেতে যা হয় হবে।

মাথলা বললে—এই দেখ, কাউকে বলি নাই, দেখাই নাই, এই দেখ। সে করালীর হাতখানা নিয়ে নিজের মাথায় চুলের মধ্যে খুঁজে একটা স্থান দেখিয়ে দিলে।

করালী শিউরে উঠল—কাটল কি করে?

—মুনিব মেরেছে পাচন দিয়ে।

—কেনে?

–আমি বললাম, কৃষাণ করতে লারব। তা বলে—পাঁচ টাকা পাব দে, দিয়ে যেখানে খুশি যা। আমি বললাম, মাশয়, আপুনি যদি টাকাই পাবেন, তবে আমি পাঁচ আড়ি ধান ফেরত পেলাম কেনে? হিসেব করে আপুনিই তো দিয়েছ। তা আমার হাতের পাচনটা ফরা করে টেনে নিয়ে মেরে দিলে এক বাড়ি। কেটে গেল মাথা। তা আবার দয়া করে খানিক ন্যাকড়া পুড়িয়ে লাগিয়ে দিয়ে এক আঁচল মুড়ি দিয়ে বললে—ফের চালাকি করব তো আবার ঠ্যাঙাব!

করালী বললে—দাঁড়া। বলে হনহন করে ঘরে ঢুকে কিছু নিয়ে বেরিয়ে এল। মাথলার হাতে পঁচ টাকার নোট দিয়ে বললে—কালই ফেলে দিয়ে আসবি, বুঝলি? তারপর সটান চলে যাবি চন্ননপুরে। মাথলা আমার সঙ্গেই যাবে। আমি ঠিক দাঁড়িয়ে থাকব ইস্টিশানের সিগনালের ধারটিতে, বুঝলি?

পাগলের তখনও চলেছে পাচালি। রাম-রাবণের যুদ্ধ। সীতাকে নিয়ে বনে গেলেন রাম। দেশসুদ্ধ লোকে কাঁদল। রাম চলেন, সীতা চলেন, লক্ষ্মণ চলেন পিছনে পিছনে। পথে গুহক চণ্ডালের সঙ্গে পাতালেন মিতালি। এ-বন সে-বন ঘুরতে ঘুরতে শেষে ‘সুপ্যনখার’ সঙ্গে দেখা। লক্ষ্মণ তার নাক কাটলেন। রেগে এলেন রাবণ। সোনার হরিণের মায়া দেখিয়ে সীতাকে হরণ করলেন। রাম-লক্ষ্মণ খুঁজতে খুঁজতে কাঁদতে কাঁদতে বনের বানরকে দিলেন কোল, মিতালি করলেন। জয়রাম ধ্বনি দিলে বানরেরা। সাগর বাঁধলেন, লঙ্কায় এলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হল, অগ্নিবাণ নিবে যায় বরুণবাণে। বরুণবাণ ওড়ে বায়ুবাণে। সর্পবাণ কাটে অর্ধচন্দ্রবাণে। ব্রহ্মবাণে জ্বলে ওঠে দাউদাউ করে আগুন। মহাপাপী রাক্ষসের বুক কঁপতে থাকে। পৃথিবী কঁপে থরথর করে। পশুপক্ষী কলরব করে। নদীর জল স্তম্ভিত হয়। গাছপালা ঝলসে যায়।

পাখী এবং শ্রোতারা নির্বাক হয়ে শোনে। হাঁসুলী বাঁকে কাহারদের পূর্বপুরুষেরা কেঁপেছিল। সেকালে। হাঁসুলী বাঁকের পশুপক্ষী কলরব করেছিল, কোপাইয়ের জল স্তম্ভিত হয়েছিল। বাঁশঝাড়গুলির পাতা ঝলসেছিল। যত কালই হোক, হাঁসুলী বাক তো ছিল সেকালে। সেই রামরাবণের যুদ্ধের কালে।

হঠাৎ পাখী চকিত হয়ে আকাশের দিকে তাকালে। গুর-গু-গু-গু-গুর-গুর শব্দ উঠেছে আকাশের হুই কোণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *