1 of 2

৩.০১ আত্মিক চিকিৎসা

তৃতীয় খণ্ড
প্রথম
পাঠ
আত্মিক
চিকিৎসা (Psychic Healing)

মনঃশক্তি বলে রোগ চিকিৎসা করাকে ইংরাজীতে “সাইকিক হিলিং” (Psychic Healing) বলে। বাঙ্গলায় ইহাকে “আত্মিক চিকিৎসা বলিয়া আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। সাধারণতঃ ইহা ‘হিপ্নোটি মেস্‌মেরিক্‌’ বা ‘ম্যাগ্নেটিক্ হিলিং নামে অভিহিত হইয়া থাকে। সুতরাং সাজ্জেটিভ-থেরাপিউটিকস্ (Suggestive Therapeutics), ‘সাইকোথেরাপিউটিকস (Psyclio-Therapeutics) ম্যাগ্নেটি হিলিং” (Magnetic Healing), ‘বিশ্বাস-আরোগ্য’ (Faith Cure) ইত্যাদি প্রণালীর চিকিৎসা ইহারই অন্তর্গত। এতদ্ব্যতীত “আধ্যাত্মিক চিকিৎসা” (Spiritual Healing) নামক এক প্রণালীর চিকিৎসা দ্বারাও নানা প্রকার রোগ আরোগ্য হইয়া থাকে। ইহারা নামে বিভিন্ন হইলেও প্রায় একই রকমের চিকিৎসা।

আত্মিক চিকিৎসা প্রধানতঃ দুই প্রকারে করা হইয়া থাকে। প্রথম প্রকার-রোগীকে সম্মোহিত বা মোহ নিদ্রায় নিদ্রিত করিয়া; অন্য প্রকার—তাহাকে মোহিত না করিয়া তাহাকে কেবল উদাসীনাবস্থায় passive state) আনয়ন করিয়া। এই উভয় প্রণালীতেই রোগীকে রোগীরোগ্যের উপযোগী ইচ্ছা শক্তিপূর্ণ মৌখিক বা মানসিক আদেশ প্রদান এবং তাহার পীড়িত স্থানে পাস দিতে হয়; আর রোগ চরিত্র গত বা মানসিক হইলে কেবল উপযুক্ত মৌখিক বা মানসিক আদেশ দিতে হয়। সম্মোহনবিং এই প্রণালীতে কোন রোগ চিকিৎসা করিতে, রোগী বা তাহার আত্মীয়ের নিকট হইতে বোগোৎপত্তির বিবরণ সম্যক রূপে অবগত হইয়া, উপযুক্ত আদেশের সাহায্যে সর্বাগ্রে উহার মূল কারণ দূরীভূত করিতে চেষ্টা পাইবে। রোগ মানসিক হইলে কোন আত্মীয় অপেক্ষা রোগী নিজেই উহার কারণ সঠিকরূপে বর্ণনা করিতে পারিবে। সময় সময় কোন কোন রোগী স্বাভাবিক বা জাগ্ৰদবস্থায় বোগোৎপত্তির এক রূপ বিবরণ দিয়া, মোহিতাবস্থায় আবার উহার সম্পূর্ণ বিভিন্ন ইতিহাস প্রদান করে। এরূপ স্থলে কাৰ্যকারক তাহার মোহিতাবস্থায় প্রদত্ত বর্ণনার উপরই অধিক নির্ভরশীল হইয়া তাহার চিকিৎসা করিবে। এতদ্ব্যতীত তাহাকে সৰ্ব্বদা রোগের গুরুত্ব বুঝিয়াও কাৰ্য্য করিতে হইবে। রোগ কঠিন হইলে তাহা আরোগ্য করিতে প্রায়ই বেশী দিন চিকিৎসার আবশ্যক হইয়া থাকে। রোগী সংবেদ্য হইলে সময় সময় অনেক কঠিন বোগও ৪৫টা বৈঠকেই আরোগ্য হইতে পারে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসককে (healer) খুব ধৈৰ্য্য ও সহিষ্ণুতার সহিত কাৰ্য্য করিতে হয়। যে সকল সম্মোহনবিৎ আত্ম ক্ষমতার প্রতি দৃঢ় আস্থাবান ও প্রখর ইচ্ছাশক্তিশালী এবং অবিচলিত সঙ্কল্প, ধৈৰ্য্য ও সহিষ্ণুতার সহিত কাৰ্য্য করিতে সমর্থ, কেবল তাহারাই এই প্রণালীর চিকিৎসায় সমধিক পরিমাণে সাফল্য লাভ করিয়া থাকেন। অতএব শিক্ষার্থী এই শাখায় পারদর্শিতা লাভের অভিলাষী হইলে, তাহাকে অত্যাবশ্যকীয়রূপে এই সকল গুণ অৰ্জন করিতে হইবে।

প্রথম নিয়ম

রোগীকে সাধারণ নিয়মে মোহিত করিবে। যখন সে নিদ্রাভিভূত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইবে, তখন কাৰ্যকারক দক্ষিণ হাত দ্বারা তাহার পীড়িত স্থানের উপর পাস দিবে, কিম্বা উহা আস্তে আস্তে মলিয়া দিবে এবং তৎসঙ্গে দৃঢ় ও গম্ভীর স্বরে রোগরোগের উপযোগী আদেশ দিবে। রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত, প্রতিদিন বা একদিন অন্তর নিয়মিতরূপে দুই বার বা একবার করিয়া বৈঠক (sitting) দিবে। সম্মোহন আদেশের প্রতি রোগীর উপযুক্ত সংবেদনা থাকিলে, অতি অল্প সংখ্যক বৈঠকে ও নানা প্রকার রোগ আরোগ্য করা যায়।

দ্বিতীয় নিয়ম

রোগীকে একখানা আরাম কেদারায় বসাইয়া বা বিছানায় শোওয়াইয়া, সাধ্য মত তাহার শরীর শিথিল করিতে বলিবে। তৎপরে তাহাকে দৃঢ়রূপে চক্ষু বুজিয়া একাগ্রমনে ১•১২ মিনিট কাল ঘুমের বিষয় ভাবিতে উপদেশ দিবে। ইহাতে তাহার ঘুম হউক, আর না হউক, যখন ঐ সময় অতীত হইয়া গিয়াছে, তখন দক্ষিণ হাত দ্বারা তাহার পীড়িত স্থানের উপর পাস দিবে, অথবা উক্ত স্থান আস্তে আস্তে মলিয়া দিবে ও তৎসঙ্গে বোগায়োগ্যের উপযোগী আদেশ প্রদান করিবে। বলা বাহুল্য যে, রোগ আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত প্রতি দিন বা একদিন অন্তর নিয়মিতরূপে দুই বার বা এক বার করিয়া বৈঠক দিবে। এই প্রণালীতে রোগ আরোগ্য করিতে সময় অপেক্ষাকৃত বেশী লাগে; কারণ পূর্বোক্ত প্রণালীতে রোগী মোহিতাবস্থায় আদেশ প্রাপ্ত হয় বলিয়া, উহা তাহার মনে অত্যন্ত দৃঢ়রূপে অঙ্কিত হয় এবং তাহাতে তাহার অন্তর্নিহিত আবোগ্য-শক্তি শীঘ্র সতেজ হইয়া উঠে। এজন্য প্রথম প্রণালীতে যে রোগ ২৩ দিনে আরাম হইতে পারে, এই নিয়মে তাহা আরোগ্য করিতে ৮/১০ দিন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তদপেক্ষাও অধিক সময় লাগিতে পারে। যাহা হউক, কাৰ্যকায়ক স্বীয় শক্তির প্রতি দৃঢ় আস্থাবান থাকিয়া যথা নিয়মে কার্যে রত থাকিলে, এই নিয়মেও সে কোন কোন ক্ষেত্রে, অল্প সময়ের মধ্যে অভীষ্ট ফল লাভ করিতে সমর্থ হইবে। ইহার দুই-তিনটি বৈঠকেও কয়েক স্থলে আশাতীত রূপে সাফল্য লাভ হইয়াছে। এই প্রণালীর চিকিৎসার প্রতি রোগীর বিশ্বাস থাকা একান্ত প্রয়োজন।

আত্মিক চিকিৎসার দ্বারা মানুষের প্রায় সকল প্রকার রোগ আরোগ্য করিতে পারা গেলেও, বিশেষ ভাবে ইহা মানসিক, স্নায়বিক ও যান্ত্রিক কাৰ্য্য সম্বন্ধীয় রোগেই সমধিক ফলপ্রদ। উহা দ্বারা যে সকল রোগ সৰ্ব্বদা আরোগ্য হয়, নিম্নে উহাদের কতকগুলির নামোল্লেখ করা গেল। যথা—পিত্তশূল, দন্তশূল, কর্ণশূল, সর্বপ্রকার শরীর বেদনা, শিরঃপীড়া, কাশী, হিক্কা, হাপানি, মন্দাগ্নি, কোষ্ঠবদ্ধতা, বাতব্যাধি, অবশাঙ্গ, বধিরতা, নিদ্রাল্পতা, স্বপ্নদোষ, জ্বর, মূত্রনোগ, স্বপ্নভ্রমণ, বিকট স্বপ্নদর্শন, নিদ্রাবস্থায়-দন্ত-কড়মড়ি ও শয্যায় মুত্র ত্যাগ, হিষ্টিরিয়া, অনিয়মিত রজঃস্রাব, বাধক-বেদনা, গর্ভাবস্থায় বমন, তোতলামি, মাদক দ্রব্য সেবন-স্পৃহা, কাম-পীড়া, স্নায়বিক দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও সর্বপ্রকার অভ্যাস দোষ ইত্যাদি।

(১) শিরঃপীড়ার চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে! বলিবে—“তোমার মাথা ধরা ক্রমে ক্রমে কমিতেছে, ক্রমে ক্রমে আরও কমিতেছে,-খুব কমিতেছে এবং এখনই উহ সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হইয়া যাইবে, নিশ্চয়ই সারিয়া যাইবে।” এইরূপ ৭৮ বার বলিয়া আবার বলিবে—“এখন তোমার মাথা ধরা সম্পূর্ণরূপে আরাম হইয়া গিয়াছে এবং উহা আর তোমাকে আক্রমণ করিবে না।”

একখানা সাধারণ রুমাল তিন-চার ভাঁজ করিবে; তৎপরে উহা বেদনাযুক্ত স্থানের উপর রাখিয়া, উহার উপর জোরের সহিত এমন ভাবে কয়েকটা ফু দিবে, যেন গরম শ্বাসগুলি বেদনার উপর গিয়া পৌঁছে। সমস্ত প্রকার বেদনাতে এই প্রক্রিয়াটি বিশেষ উপকারী। ইহা সচরাচর রোগীর স্বাভাবিক অবস্থায় প্রযুক্ত হইয়া থাকে।

(২) তোতলামির চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি কথা কহিবার সময় আর তোতলামি করিবেনা কথা বলিবার সময় তোমার জিহ্বায় আর কোন শব্দ বা কথা আটকাইবে না, তুমি আমাদের মত সুস্পষ্ট রূপে সকল কথা উচ্চারণ করিতে পারিবে;-তুমি আমাদের মতই পরিষ্কার রূপে সকল কথা কহিতে পার; তুমি আর কখনও তোতলামি করিবেনা,তোমার তোতলামি সম্পূর্ণরূপে সারিয়া গিয়াছে।”

(৩) কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের চিকিৎসা করিতে নিম্নলিখিতরূপ আদেশ করিবে। বলিবে—“আজ হইতে তোমার আর কোষ্ঠবদ্ধ হইবে না,তুমি যাহা খাইবে, তাহা সুন্দররূপে পরিপাক হইয়া যাইবে এবং সকাল ও সন্ধ্যায় দুই বার বাহ হইয়া তোমার কোষ্ঠ সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার হইয়া যাইবে; তোমার প্রত্যহ নিয়মিতরূপ দুই বার করিয়া পরিস্কার বাহ হইবে।”

(৪) বাতরোগের চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে-“যখন আমি তোমাকে জাগ্রত করিয়া দিব, তখন তোমার পায়ের (শরীরের যে স্থানে বেদনা হইয়াছে, সেই স্থানের নামোল্লেখ করিয়া বলিবে) বেদনা দূর হইয়া যাইবে। তোমার পায়ের সমস্ত বেদনা নিশ্চয় বিদূরিত হইবে। প্রত্যেক বৈঠকেই তুমি অপেক্ষাকৃত সুস্থতা ও সবলতা বোধ করিবে। তুমি চোখ খোলার পর তোমার শারীরিকাবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ পরিবর্তন বোধ করিবে। তোমার বেদনা সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে।”

(৫) হৃদরোগের চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“যখন আমি তোমাকে জাগ্রত করিয়া দিব, তখন তোমার হৃদযন্ত্রের সকল যন্ত্রণা বিদূরিত হইবে। প্রতি বৈঠকেই তোমার যন্ত্রণা অপেক্ষাকৃত কম হইবে এবং তোমার হৃদযন্ত্র স্বাভাবিক ভাবে স্পন্দনে রত থাকিবে এবং কখনও উহা অনিয়মিত বা অস্বাভাবিক ভাবে স্পন্দিত হইবে না। দিন দিন তুমি অধিক উপশম বোধ করিতে থাকিবে এবং শীঘ্রই তোমার রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে। তুমি জাগ্রত হওয়ার পর হইতেই পূর্বাপেক্ষা অনেকটা সুস্থ ও সবল হইবে।”

(৬) পক্ষাঘাতের চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“যখন আমি তোমাকে জাগ্রত করিয়া দিব, তখন তুমি পূর্বাপেক্ষা অনেকটা সুস্থতা বোধ করিবে, তোমার মাংসপেশীর বল বৃদ্ধি পাইবে এবং তোমার অবশাঙ্গতা অনেক পরিমাণে বিদূরিত হইয়া যাইবে। তুমি প্রত্যেক বৈঠকেই অধিকতর সুস্থতা বোধ করিবে এবং শীঘ্রই তোমার রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে।”

(৭) পৃষ্ঠ দেশের বেদনা চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“যখন আমি তোমাকে জাগ্রত করিয়া দিব, তখন তোমার পিঠের বেদনা অনেকটা কমিয়া যাইবে। তুমি জাগ্রত হওয়ার পর খুব সুস্থতা ও সবলতা অনুভব করিবে। তুমি শীঘ্রই সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিবে।”

(৮) হিষ্টিরিয়ার চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ প্রদান করিবে। বলিবে—“আমি তোমাকে জাগ্রত করিয়া দিবার পর, তোমার রোগ আরোগ্য হইয়া যাইবে। যেরূপ মানসিক উত্তেজনা বশতঃ তোমার ফিট হয়, তোমার মনে সেরূপ উত্তেজনা আর কখনও হইবে না। কোন অবস্থায়ই তোমার মন আর উত্তেজিত হইবে না; কোন বিষয়ই তোমার মনকে আর গভীর ভাবে আলোড়িত করিতে পারিবে না। তুমি জাগ্রত হওয়ার পর তোমার মন অত্যন্ত দৃঢ় হইবে এবং তোমার রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে।”

(৯) স্বপ্নদোষ রোগ চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“আজ হইতে তুমি আর স্বপ্নে কখনও স্ত্রীলোক দর্শন করিবে না এবং নিদ্রাকালীন তোমার মন কামভাবে আর কখনও উত্তেজিত হইবে না। প্রতিদিনই তোমার খুব গভীর নিদ্রা হইবে এবং নিদ্রার সময় স্ত্রীলোক সম্বন্ধীয় কোন স্বপ্ন দর্শন করিবে না ও সেই সময় তোমার বীৰ্য আর কখনও খলিত হইবে না। তুমি জাগ্রত হওয়ার পরই তোমার রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে।”

(১০) শুচিবাই রোগ চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে “আজ হইতে তুমি আর এত বেশী পরিমাণে শুচিতা সম্পন্ন থাকিতে ইচ্ছা করিবে না। সংসারের অপরাপর লোক যেরূপ ভাবে কার্য-কৰ্ম্ম, চলা-ফেরা ইত্যাদি করে, তুমিও ঠিক তাহাদের ন্যায় সমস্ত কাৰ্য্য করিবে এবং তাহারা যাহা আত্মিক চিকিৎসা শুচি মনে করে, তুমিও ঠিক তাহাই শুচি জ্ঞান করিবে এবং উক্ত বিষয়ে তুমি কখনও কোনরূপ বাড়াবাড়ি করিবে না। তুমি আজ হইতে আর কখনও এই হাস্যকর রোগের অধীন হইয়া থাকিবে না। তুমি জাগ্রত হওয়ার পর হইতেই শুচিতা সম্বন্ধে তোমার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইয়া যাইবে।”

(১১) অস্ত্রোপচারের নিমিত্ত রোগীর শরীরে বোধরহিতাবস্থা উৎপাদন করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। এই বিষয়ে উপদেশ এই যে, যে রোগীর শরীরে অস্ত্র চিকিৎসা করিতে হইবে, সে স্বভাবতঃ সংবেদ্য হইলে তাহার শরীরে বেধরহিতাবস্থা (anaesthesia) উৎপাদন করিয়া বড় রকমের অস্ত্রোপচারও (major operation) বিনা যন্ত্রণায় সম্পন্ন হইতে পারিবে। অন্যথায় কেবল ছোট ছোট অস্ত্রোপচার (minor operation) করা যাইবে। রোগীকে সাধারণ নিয়মে মোহিত করিয়া যে স্থানে অস্ত্র চিকিৎসা করিতে হইবে, সেই স্থানে দক্ষিণ হাত দ্বারা খুব আস্তে আস্তে পাস করিতে করিতে (অথবা পাস না করিয়া বলিবে—“এইক্ষণ তোমার হাতের (যে স্থানে অস্ত্রোপচার করিতে হইবে, উহার নামোল্লেখ করিয়া বলিবে) এই স্থানের অনুভূতি ক্রমে ক্রমে হ্রাস পাইতেছে। ক্রমে ক্রমে তোমার হাত খানা অসার ও বোধশূন্য হইয়া যাইতেছে। তোমার হাতে এখন আমি একটা সূচ বিঁধাইয়া দিব, কিন্তু তুমি উহাতে একটুও বেদনা পাইবে না,-বিন্দু মাত্ৰও জ্বালা-যন্ত্রণা বোধ হইবেনা; তোমার হাত খানা এখন সম্পূর্ণরূপে বোধ শূন্য হইয়া গিয়াছে।” দুই-তিন বার এইরূপ আদেশ করার পর, ঐ স্থানে প্রথম আস্তে আস্তে একটা সূচ বিঁধাইয়া দিবে। যদি উহাতে তাহার যন্ত্রণা বোধ না হয়, তবে উহাকে আরও গভীর ভাবে বিধাইয়া দিবে। যদি ঐরূপ করাতেও তাহার যন্ত্রণা না হয়, তবে তখন উপস্থিত ডাক্তারকে অস্ত্রোপচার করিতে বলিবে। অস্ত্র করিবার সময়ও মাঝে মাঝে উক্তরূপ আদেশ দিবে। অস্ত্রোপচারের পর নিম্নোক্তরূপ আদেশ প্রদান করিলে, রোগী জাগ্রত হওয়ার পরেও কোনরূপ জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব করিবে না এবং তজ্জন্য তাহার মনে কোনরূপ ধাক্কা বা আঘাত (shock) লাগিবার সম্ভাবনা থাকিবে না। বলিবে“এখন আমি তোমাকে জাগ্রত করিয়া দেওয়ার পর, অস্ত্রোপচার জনিত তোমার কোনরূপ জ্বালা-যন্ত্রণা বোধ হইবে না, অথবা তজ্জনিত তোমার মনে কোনরূপ ধাক্কা বা আঘাত লাগিবে না। উহাতে তোমার শরীর বা মনে বিন্দুমাত্রও মন্দ ক্রিয়া হইবে না। তুমি জাগ্রত হওয়ার পর খুব সুস্থতা ও সবলতা অনুভব করিবে এবং তোমার ঘাও খুব শীঘ্র শীঘ্র আরোগ্য হইয়া যাইবে।

সম্মোহন নিদ্ৰাপেক্ষ। মোহ নিদ্রাতেই বোধরহিতাবস্থা সহজে উৎপাদিত হয়। হিপ্নোটিজমের প্রণালীতে এই অবস্থা উৎপাদন করিতে পুনঃ পুনঃ আদেশ দিতে হয়, কিন্তু মেস্‌মেরি পাত্রকে তাহা দিবার আবশ্যক হয় না। সে মোহ নিদ্রার তৃতীয় স্তরে উপনীত হইলেই তাহার শরীরে তখন কাটা বা সূচ বি ধাইলে, কিম্বা ছোট বা বড় অস্ত্রোপচার করিলে উহাতে তাহার বিন্দুমাত্রও যন্ত্রণা বোধ হয়না। ১৮৪০ খৃঃ অঃ কলিকাতার মেসমেরি হাসপাতালে এডেইল (Esdaile) নামক একজন ডাক্তার মোহ নিদ্রার সাহায্যে এই অবস্থা উৎপাদন পূৰ্ব্বক বহু সংখ্যক রোগীর শরীরে ছোট বড় নানা প্রকার অস্ত্রোপচার করিয়া খুব কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন এবং তাহাতে তদানীন্তন চিকিৎসক মহলে একটা হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছিল। যদি দেশের অস্ত্র চিকিৎসকগণ এই বিদ্যা শিক্ষা করিয়া কথিত প্রণালীতে অস্ত্রোপচার করেন, তবে যে তাহাদের ব্যবসায়ের বিশেষ প্রসার হইবে, তাহতে কোন সন্দেহ নাই।

(১২) প্রমেহ বা ধাতু দৌর্বল্য রোগ চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“আজ হইতে তোমার ব্যায়ামের উপসর্গগুলি সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হইয়া যাইবে। প্রতিদিনই তুমি অধিকতর সুস্থতা ও সবলতা বোধ করিতে থাকিবে। তুমি শীঘ্রই সম্পূর্ণরূপে সুস্থ ও নীরোগ হইবে।”

(১৩) পাকস্থলীর রোগ চিকিৎসা নিম্নোক্তরূপে আদেশ দিবে। বলিবে—“যখন আমি তোমাকে জাগ্রত করিব, তখন তোমার পাকস্থলীর গোলমাল দুর হইয়া যাইবে। আজ হইতেই তোমার হজম শক্তি বৃদ্ধি পাইবে এবং তুমি যাহা খাইবে, তাহা সুন্দররূপে পরিপাক হইয়া যাইবে; এবং প্রত্যহ দুইবার তোমার পরিষ্কার বাহ হইবে। তুমি এখন হইতেই বেশ ভাল বোধ করিবে। তুমি দিন দিনই অধিকতর সুস্থ ও সবলতা বোধ করিতে থাকিবে এবং অল্প দিনের মধ্যেই তুমি নিশ্চিতরূপে সম্পূর্ণ সুস্থ ও নীরোগ হইবে।”

(১৪) শূলবেদনা চিকিৎসা করিতে নিম্নলিখিত আদেশ দিবে। বলিবে—“তোমাকে জাগ্রত করার পরই তুমি বেশ ভাল বোধ করিবে। এখন হইতে তোমার হজম শক্তি বৃদ্ধি পাইবে, প্রতিদিন নিয়মিতরূপে কোষ্ঠ পরিষ্কার হইবে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পাইবে। আজ হইতেই তোমার বেদনার প্রকোপ কমিতে থাকিবে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই তুমি সম্পূর্ণরূপে আবোগ্য হইয়া উঠিবে। তুমি নিশ্চয় আরোগ্য হইবে।

(১৫) নিদ্রাল্পতা রোগ চিকিৎসা করিতে নিম্নলিখিতরূপ আদেশ দিবে। বলিবে- “আজ হইতে তোমার ঘুম গভীর ও দীর্ঘ হইবে। তুমি প্রতিদিন নিয়মিতরূপে ৭৮ ঘণ্টা কাল ঘুমাইবে এবং ঘুমের সময় তোমার পাকস্থলী ও মাথা বেশ ঠাণ্ডা থাকিবে এবং তুমি আর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখিবেনা। দিন দিনই তোমার নিদ্ৰা অধিক গাঢ় ও দীর্ঘ হইবে। অল্প দিনের মধ্যেই তোনার এই রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে নিশ্চয় আরোগ্য হইবে।”

(১৬) হিক্কার (Hiccough) চিকিৎসা করিতে নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করিবে। রোগীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার নাসা-মুলে স্থির দৃষ্টি স্থাপন করণান্তর তাহাকে, ডান হাত খান যথা সম্ভব জোরের সহিত টান্ করিয়া লম্বাভাবে উপরের দিকে খাড়া করিতে বলিবে। এই অবস্থায় তাহাকে এক মিনিট কাল থাকিতে দিবে; পরে তাহাকে চোখ বন্ধ করিতে বলিয়া তাহার গলার উপর (উহার এক পার্শ্ব হইতে অপরু পার্শ্ব পৰ্য্যন্ত) কিঞ্চিৎ নিয়াভিমুখী করিয়া তিনটি পাস দিবে এবং তৎসঙ্গে রোগ আরোগ্য হউক বলিয়া ইচ্ছাশক্তি পূর্ণ মানসিক আদেশ দিবে। এই সহজ প্রক্রিয়াটির দ্বারা কঠিন রকমের হিক্কাও আরোগ্য করা যাইবে।

উভয় প্রকার প্রণালীতেই চিকিৎসা করিবার কালীন রোগীকে উক্ত রূপ আদেশ দিতে হইবে। সুতরাং একটি আদেশ উভয় প্রণালীতেই প্রয়োগ করা যাইবে। আদেশগুলিকে খুব গম্ভীর ও দৃঢ় স্বরে রোগীর মনে অঙ্কিত করিয়া দিবে। সময় সময় সরলভাবে না দিয়া ঘুরাইয়া আদেশ প্রদান করিলে, তাহা সহজে কাৰ্য্যকর হয়। লেখাপড়ায় অমনোযোগী বালককে, কেবল “তুমি প্রতিদিন নিয়মিতরূপে আট ঘণ্টা পড়িবে না বলিয়া যদি, “তুমি প্রতিদিন নিয়মিতরূপে আট ঘণ্টা পড়িবেনা পড়িলে তোমার শরীর ও মন ভাল লাগিবেনা”-বলা যায়, তবে তাহা অনেক সময় অধিক কার্যকর হইয়া থাকে। সম্মোহনবিৎ বিজ্ঞানের এই অংশে সাফল্য লাভের প্রয়াসী হইলে তাহাকে নিজ মতার প্রতি অতিশয় আস্থাবান হইয়া কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। এতদ্ব্যতীত তাহার যথেষ্ট অধ্যবসায়, ধৈৰ্য্য এবং সহিষ্ণুতাও থাকা চাই। সে প্রথম প্রথম নানা রকমের সহজ সহজ রোগ আরোগ্য করিবার চেষ্টা পাইবে এবং তাহাতে কৃতকাৰ্যতা লাভের পর কঠিন রোগের চিকিৎসায় হস্তক্ষেপ করিবে। শিক্ষার প্রারম্ভেই জটিল রোগ লইয়া চেষ্টা করিলে সাফল্য লাভ অত্যন্ত কঠিন হইবে। সুতরাং এই বিষয়ে সে খুব বিবেচনার সহিত কাৰ্য্য করিবে। উপযুক্ত সংবেদনার অভাবে সকল লোককে মোহিত করা যায় না এবং যাহারা সংবেদ্য তাহারাও রুগ্ন হইলে, অনেক সময় রোগ যন্ত্রণার জন্য মন স্থির করিতে পারেনা বলিয়া মোহিত হয়না। আবার যাহারা মোহিত হয়, তাহারাও সকলেই গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়না, এজন্য সম্মোহন আদেশ তাহাদের উপর তেমন কার্যকর হয়না। ইহা যে এই বিজ্ঞানের অক্ষমতা তাহা অবশ্য স্বীকার্য। এতদ্ব্যতীত আরও কতকগুলি কারণ বর্তমান আছে, যেজন্য জন সাধারণের মধ্যে এই চিকিৎসার তাদৃশ প্রসার হইতে পারিতেছেনা। সময় সময় ডাক্তার কবিরাজগণের পরিত্যক্ত কঠিন রোগীরাও এই চিকিৎসার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া সদ্যই রোগ মুক্ত হইবার আশা করে। যদি তাহারা দুই-চার দিনের মধ্যে আরোগ্য না হয়, কিম্বা বিশেষ রকমের একটা উপশম বোধ না করে, তবে তাহারা ইহার প্রতি বিশ্বাসহীন হয় এবং ইহা কিছুই নয়’ বলিয়া লোকের নিকট নানা প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকে। তাহাদের রোগ যে অত্যন্ত জটিল এবং তাহা আরোগ্যের জন্য যে উপযুক্ত কাল চিকিৎসার প্রয়োজন, ইহা তাহারা বুঝিয়াও যেন বুঝেনা। এই চিকিৎসায় আমি নিজে যে সকল ক্ষেত্রে অকৃতকার্য হইয়াছি, সেই সকল স্থানে রোগীদিগের অসহিষ্ণুতাই উহার প্রধান কারণ। যদি তাহারা রোগের গুরুত্ব ও স্থায়িত্ব বিবেচনা পূৰ্ব্বক ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া উপযুক্ত কাল আমার চিকিৎসাধীনে থাকিত তবে যে, তাদের অনেকেই আরোগ্য লাভ করিতে পারিত, তাহাতে সন্দেহ নাই। আবার এক শ্রেণীর চিকিৎসক আছেন, তাহারা এই চিকিৎসার বিরোধী। ইহার প্রতি তাহাদের বিরোধ বা বিদ্বেষের কারণ অজ্ঞতা ব্যতীত আর কি হইতে পারে, তাহা বুঝা কঠিন। তাহারা হিপ্নোটি বা মেসমেরি চিকিৎসার নাম শুনিলেই নাসিকা কুঞ্চিত করেন, আবার কেহ কেহ নানারূপ ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা বদনাম করতঃ ইহার প্রতি সাধারণের বিশ্বাস খৰ্ব্ব করিবার চেষ্টা পাইয়া থাকেন। এই শ্রেণীর বৈদ্যগণ নিজেদের অবলম্বিত প্রণালী অপেক্ষা আর সকল চিকিৎসাই হীন মনে করিয়া থাকেন। ইহারা অত্যন্ত সেকেলে-ধরণের ও গোড়া প্রকৃতির। ডাক্তার ব্ৰেইড, চাকো, লিবো, ব্রামওয়েল, বার্ণহি, ফরে, ষ্টল, রিসেনব্যাক, বিটে, ভেন্টি-ভেগনি, ওয়াটারষ্টা, প্রভৃতি ইয়ুরোপীয় নানাদেশের প্রসিদ্ধ চিকিৎসকগণ যে, এই চিকিৎসা দ্বারা বহু প্রকার রোগ আরোগ্য করিয়াছেন এবং বর্তমান সময়েও উচ্চ উপাধিধারী অনেক খ্যাতনামা ডাক্তার এই প্রণালীতে বহু রোগ আরোগ্য করিতেছেন, এবং তাহাদের প্রচেষ্টার ফলে যে ইহা ক্রমশঃ চিকিৎসা জগতে উচ্চ হইতে উচ্চতর স্থান অধিকার করিতেছে, তাহা বোধ হয় তাহাদের সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত; অন্যথায় তাহারা ইহার প্রতি নিশ্চয় শ্রদ্ধাবান হইতেন। তাহারা বোধ হয় ইহা জানেন না, অথবা জানিলেও ইহা স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন যে, ঔষধে রোগ আরোগ্য হয় না। আবোগ্য-শক্তি (healing power) রোগীর নিজ শরীরেই নিস্তেজাবস্থায় বিদ্যমান থাকে এবং ঔষধ কেবল উহাকে সতেজ করিবার নিমিত্ত প্রযুক্ত হইয়া থাকে মাত্র। যদি ঔষধের নিজস্ব আরোগ্যকরী শক্তি থাকিত তবে সমস্ত রোগই উহা দ্বারা আরোগ্য হইত। সকল চিকিৎসারই উদ্দেশ্য রোগীর এই আরোগ্য শক্তিকে উদ্দীপিত করা।

সকল কাৰ্যকারক উত্তম শ্রেণীর চিকিৎসক হইতে পারে না; কারণ সকলের রোগীরোগ্যের ক্ষমতা যাহাকে “হাত যশঃ” বলে, তাহা নাই; ইহা ঈশ্বর দত্ত। যাহাদের এই শক্তি আছে, কেবল তাহারাই ইহাতে সমধিক পরিমাণে সাফল্য লাভে সমর্থ হইয়া থাকেন। এই শক্তি সমন্বিত ব্যক্তিগণ যত সহজে নানা প্রকার রোগ আরোগ্য করিতে পারেন, অপরে তাহা পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *