৩. রাতের পর রাত

রাতের পর রাত, সপ্তাহর পর কষ্টকর সপ্তাহ, এবং মাসের পর ক্লান্তির মাস এগিয়ে চলল ওরা। তপ্ত শুকনো হাওয়ায় তাইতার কাঁধের ছুরির ক্ষতচিহ্ন স্পষ্টতই সেরে গেছে, তবে ঘোড়াগুলো শুকিয়ে গেছে, চলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে; দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছানোর ঢের আগেই নেতিয়ে পড়েছে লোকজন। নীলের জলে নতুন প্রাবনের জন্যে তাইতা ও লস্ত্রিস এক মৌসুম অপেক্ষা করেছিল এখানে, তাতে নৌবহরের জলপ্রপাতের চূড়ায় ওঠার জন্যে পর্যাপ্ত গভীরতা নিশ্চিত হতো। ওদের নির্মিত বসতির দিকে তাকাল তাইতা: সেই একই দেয়াল এখনও খাড়া রয়েছে-লস্ত্রিসের আশ্রয় হিসাবে ওর বানানো রাজ প্রাসাদের আনাড়ী দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ। ওই জমিতেই ধুরা শস্য রোপন করেছিল ওরা, এখনও কাঠের লাঙ্গলের কর্ষণের দাগ দেখা যায়। গাছপালার ওই সারি থেকে কাঠ যোগাড় করে রথ নির্মাণ ও গালির গলুই মেরামতের কাছ করেছে। গাছপালা এখনও বেঁচে আছে; মাটির অনেক গভীরে পুকুর ও ঝর্নায় ছড়িয়ে পড়া শেকড়ের সুবাদে টিকে আছে। কামারদের বানানো সেই হাপরটাও রয়েছে ওখানে।

ম্যাগাস, জলপ্রপাতের নিচের পুকুরটা দেখুন! ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল মেরেন। ওর উত্তেজিত চিত্তার তাইতার স্মৃতিচারণে বাদ সাধল। মেরেনের ইঙ্গিত মোতাবেক তাকাল ও। এটা কি ভোরের প্রথম আলোর কারসাজি? ভাবল ও।

পানির রঙটা দেখুন! এখন আর রক্ত-লাল নেই। পুকুরের পানি সবুজ-মিষ্টি তরমুজের মতো সবুজ।

ডাইনীর আরেকটা কারসাজি হতে পারে ওটা, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তাইতা। কিন্তু এরই মধ্যে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে মেরেন। রেকাবের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে, চিৎকার করছে। ওর লোকেরা অনুসরণ করছে। ওকে। পুকুরের তীর ধরে আরও সম্মানজনক গতি বজায় রাখল তাইতা ও উইন্ডস্মোক। পুকুরের তীরে মানুষ, ঘোড়া, খচ্চর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এখন। নিচু হয়ে আছে পশুগুলোর মাথা, কৃষকদের ওয়াটারহুইল শাদুফের মতো সবুজ পানি টেনে নিচ্ছে ওরা, আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখে ঢালছে লোকেরা, গলা ভেজাচ্ছে।

সন্দিহান ভঙ্গিতে পানি শুকল উইন্ডস্মোক, তারপর খেতে শুরু করল। জিনের পেটি ঢিল করে ওর পেট প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দিল তাইতা। শুয়োরের ব্লাডারের মতো চোখের সামনে ফুলে উঠল সে। ওকে পানি খেতে ছেড়ে দিল ও। পুকুরের পানি ভেঙে আগে বেড়ে বসে পড়ল। পড়ন্ত জল ওর চিবুক স্পর্শ করছে; চোখ বন্ধ করল ও। মুখে পরমানন্দের হাসি।

ম্যাগাস! নদীর কিনার থেকে ওকে ডাকল মেরেন। এটা আপনার কেরামতি। আমি নিশ্চিত। নদীটাকে বিশ্রী রোগ থেকে সারিয়ে তুলেছেন। ঠিক বলেছি না?

ওর উপর মেরেনের বিশ্বাস সীমাহীন, মন ছুঁয়ে যায়। ওকে হতাশ করা ঠিক হবে না। চোখ খুলল তাইতা, অন্তত শখানেক লোক ওর জবাবের অপেক্ষায় তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর উপর ওদের আস্থা গড়ে তোলাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মেরেনের দিকে তাকিয়ে হাসল ও, তারপর হেঁয়ালির ভঙ্গিতে ডান চোখ টিপল। হতবাক দেখাল মেরেনকে, পরমুহূর্তে খুশিতে চিৎকার করে উঠল লোকজন। পুকুরে নেমে জল ভেঙে আগে বাড়ল ওরা, পরস্পরের দিকে পানি ছিটাতে লাগল। তারপর একে অন্যের মাথা চেপে ধরল পানির নিচে। ওদের ফুর্তি করতে দিয়ে তীরে উঠে এলো তাই। এরই মধ্যে পানি আর বাচ্চায় এমন ফুলে গেছে যে না হেঁটে বরং জল ভেঙে আগে বাড়ল উইন্ডস্মোক। ওকে টলটলে শাদা নদীতে নিয়ে এলো ও, তারপর বসে পড়ল। ওটার দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও ওর ওপর মেরেনের কৃতিত্ব চাপিয়ে দেওয়া নদীর অলৌকিক পরিষ্কার জল নিয়ে ভাবল।

পানির দূষণ এরপর আর ছড়ায়নি, সিদ্ধান্তে পৌঁছল ও। এখান থেকে দক্ষিণে নদীর জল একেবারে পরিষ্কার। ক্ষীণতোয়া, মরা; তবে টলটলে।

সেদিন সকালে বনের ছায়ায় তাঁবু খাটাল ওরা।

ম্যাগাস, ঘোড়াগুলো সামলে ওঠা পর্যন্ত এখানেই থাকার পরিকল্পনা করছি আমি। এখুনি রওনা দিলে ওদের হারাতে হবে। বলল মেরেন।

মাথা দোলাল তাইতা। বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ, বলল ও। জায়গাটা ভালো করেই চিনি। মহান যাত্রার সময় পুরো একটা মৌসুম ছিলাম এখানে। এখানকার জঙ্গলে গাছপালা আছে যেগুলোর পাতা ঘোড়া খেতে পারবে। দারুণ পুষ্টিকর, কয়েক দিনের মধ্যেই চর্বিদার, তরতাজা করে তুলবে ওদের। তাছাড়া, উইন্ডস্মোকও অল্পদিনের ভেতরই বাচ্চা দেবে, মরুভূমির চেয়ে এখানেই ওটার বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকবে, ভাবল তাইতা, কিন্তু মুখে বলল না।

প্রাণবন্তভাবে কথা বলছে মেরেন। পুকুরের কাছে অরিক্সের পায়ের ছাপ দেখেছি। লোকেরা খুশিমনে শিকার করতে পারবে, ভালো মাংস পেয়ে শোকর করবে। আমরা আবার রওয়ানা দেওয়ার সময় অবশিষ্টগুলোকে শুকিয়ে, সেদ্ধ করে সাথে নিতে পারব।

উঠে দাঁড়াল তাইতা। যাই, আমাদের পশুর জন্যে বিচালীর খোঁজ করি।

আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে। এই ক্ষুদে স্বৰ্গটা আরেকটু ভালো করে দেখব। গাছপালার ভেতর একসাথে ঘুরে বেড়াতে লাগল ওরা, খাবার উপযোগি গুল্ম ও লতা চিনিয়ে দিল ওকে তাই। মরুভূমির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে ওগুলো, খরা পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়েছে। লম্বা লম্বা গাছের ছায়ায় তরতর করে বেড়ে উঠছে ওরা। দুহাত বোঝাই করে শিবিরে ফিরল ওরা।

উইন্ডস্মোককে বুনো ফসলের নমুনা খেতে দিল তাইতা। খানিক চিন্তাভাবনা করে আলতো করে একটায় কামড় বসাল সে; তারপর আরও খাবে বলে নাক বাড়িয়ে দিল। একটা বিরাট সংগ্রাহক দল গঠন করে ওদের বনে নিয়ে এলো ও; খাবার উপযোগি গাছপালা চিনিয়ে দেবে যাতে ওগুলো তুলতে পারে। দ্বিতীয় আরেকটা দল নিয়ে গেল মেরেন। শিকারের খোঁজে বনের সীমানায় সন্ধান চালাল ওরা। কুঠারের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে দুটো বিরাট অ্যান্টিলোপ শিকারীদের তীরের সহজ নিশানায় চলে এলো।

ছাল খসাতে উষ্ণ লাশ শিবিরে নিয়ে আসা হলে সাবধানে পরখ করল তাইতা। মদ্দা অ্যান্টিলোপটার শিং বেশ মজবুত, গাঢ় অসাধারণ রঙিন নকশাদার চামড়া। মাদীটা শিঙহীন, শরীরের গড়ন বেশ জটিল, পশম বাদামী, কোমল। জানোয়ারগুলো চিনেছি, বলল ও। কোণঠাসা হলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে মদ্দাগুলো। যাত্রার সময় আমাদের এক শিকারী একটা বিরাট মদ্দার ঘাই খেয়েছিল। ওর কুঁচকির রক্তবাহী শিরা কেটে ফেলে ওটা, ওর সাথীরা আমাকে ডেকে পাঠানোর আগেই রক্ত ক্ষরণে বেচারা মারা যায়। মাংস, বিশেষ করে বৃক্ক আর কলিজা, অবশ্য খাসা।

পুকুর ধারে শিবির করার সময় লোকজনকে নৈমিত্তিক কাজের ধারায় ফিরে যাবার সুযোগ দিল মেরেন। ঘোড়াকে দানাপানি খাওয়ানোর পর ঘোড়া আর নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করতে জঙ্গলের ভেতর মজবুত ও অনায়াস সুরক্ষিত দুর্গ বানানোর কাজে লাগিয়ে দিল ওদের। সেদিন সন্ধ্যায় কয়লার আগুনে সেঁকা ধুরা আটার রুটি দিয়ে আগুনে ঝলসানো অ্যান্টিলোপের মাংস, বুনো পুদিনা পাতা ও তাইতার বাছাই করা গুল্ম দিয়ে ভোজ পর্ব সারল ওরা। নিজের মাদুরে শোয়ার আগে আকাশ নিরীখ করতে জল ভেঙে পুকুরে নেমে এলো তাইতা। লস্ত্রিসের তারার শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে গেছে, তবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মহাজাগতিক ব্যাপার রয়েছে। খানিকটা সময় ধ্যানমগ্ন রইল ও, কিন্তু কোনও মনস্তাত্ত্বিক উপস্থিতি টের পেল না। সোয়ে কেটে পড়ার পর ডাইনীর সাথে যেন ওর সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে।

শিবিরে ফিরে এলো ও, কেবল শান্ত্রীকেই জাগ্রত অবস্থায় পেল। ঘুমন্তদের বিরক্তির উদ্রেক না করতে ফিসফিস করে ওদের নিরাপদ প্রতিরক্ষার জন্যে প্রার্থনা করল ও, তারপর মাদুরের বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।

সকালে মুখে নাকের স্পর্শ দিয়ে ওকে জাগাল উইন্ডস্মোক। নিদ্রালু চোখে ওটার মুখ সরিয়ে দিল ও। কিন্তু ঘোড়াটা নাছোড়বান্দা। উঠে বসল ও। ব্যাপারটা কী, প্রিয়া আমার? কী হয়েছে? পেছনের পা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করল ওটা; মৃদু কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠল। সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। চট করে উঠে ওটার মাথা ও ঘাড়ে, তারপর শরীরের পাশে হাত বোলাল। ফোলা পেটের গভীরে জরায়ুর ভেতর জোরাল খিচুনি টের পেল। আবার গুঙিয়ে উঠল ঘোড়াটা. পেছনের পাদুটো মেলে দিল। লেজ উপরে তুলে পেশাব করে দিল। এবার শরীরের পাশে নাক ঘষল সে। এক হাতে ওটার ঘাড় জড়িয়ে ধরে ওকে সীমানার শেষ প্রান্তে নিয়ে এলো তাই। ওকে শান্ত রাখার গুরুত্ব জানা আছে। বিরক্ত বা সতর্ক হয়ে উঠলে খিচুনি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাতে বাচ্চার প্রসব বিঘ্নিত হবে। চাঁদের আলোয় ঘোড়ার উপর নজর রাখতে বসে পড়ল ও। অস্থিরভাবে হ্রেষারব ছাড়ছে ওটা, নড়াচড়া করছে। এবার শুয়ে পড়ল ওটা, চিৎ হয়ে গেল।

দারুণ চালাক মেয়ে, ওকে উৎসাহ যোগাল তাইতা। প্রসব করানোর জন্যে সহজাত প্রবৃত্তির বশেই বাচ্চাটার অবস্থান ঠিক করে নিচ্ছে। আবার উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল ওটা। তারপর পেট ফুলে উঠল ওটার, পানি ভেঙে গেল। তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়া ঘাসের উপর লাথি হাঁকাল সে। পাক খেতে লাগল। এখন ওর দিকে মুখ করে আছে লেজটা। লেজের নিচে অস্পষ্ট জন্ম থলেটাকে আবির্ভূত হতে দেখল ও। আবার দুলে উঠল ঘোড়াটা, নিয়মিত ও জোরাল খিঁচুনি হচ্ছে। পাতলা ঝিল্লির ভেতর এক জোড়া পায়ের আউটলাইন চিনতে পারছে তাইতা, প্রতিটি খিঁচুনির সাথে খুরের পশম বের হয়ে আসছে। অবশেষে ওকে স্বস্তিতে ভাসিয়ে ছোট একটা কালো নাক দেখা গেল। ওকে আর ব্রিচ ডেলিভারির জন্যে তলব করা হবে না।

বাক-হার! ওর তারিফ করল তাইতা। বেড়ে দেখিয়েছ, প্রিয়া আমার। ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কষ্ট করে দমন করল। একাই ভালো কাজ দেখাচ্ছে সে। খিচুনি জোরাল, নিয়মিত।

বাচ্চাটার মাথা বের হয়ে এলো। মায়ের মতোই ধূসর, খুশিতে ফিসফিস করে বলল ও। তারপর সহসা পুরো থলে এবং ওটার ভেতরের বাচ্চাটা সবেগে বের হয়ে এলো। ওটা জমিন স্পর্শ করতেই নাড়ী আলগা হয়ে মুক্ত হয়ে গেল থলেটা। বিস্ময়ে হতবাক তাইতা। ওর দেখা হাজার হাজার ঘোড়ার বাচ্চার জন্মের ভেতর এটাই দ্রুততম। ইতিমধ্যে ঝিল্লি থেকে বের হতে যুদ্ধ শুরু করেছে বাচ্চাটা।

ঘূর্ণী হাওয়ার মতোই ক্ষিপ্র, হেসে বলল তাইতা। এটাই হবে ওর নাম। আগ্রহের সাথে সদ্যজাত বাচ্চাটাকে যুঝতে দেখল উইন্ডস্মোক। অবশেষে ঝিল্লি ছিঁড়ে গেল, তারপর কোল্টটা-ওটা কোল্টই-সোজা হয়ে দাঁড়াল, মাতালের মতো এপাশ-ওপাশ দোল খাচ্ছে। পরিশ্রম করার পর রীতিমতো হাঁপাচ্ছে এখন। দ্রুত ওঠানামা করছে ওটার রূপালি শরীরের দুপাশ।

দারুণ! মৃদু কণ্ঠে বলল তাইতা। বাচ্চাকে মাতৃসুলভ আদরে চেটে দিল উইন্ডস্মোক, স্বাগত জানাল ওকে, তাতে ওটার প্রায় উল্টে পড়ার দশা হলো। টলমল পায়ে নিজেকে স্থির করল ওটা। তারপর ঝটপট কাজে লাগল: জিভের দীর্ঘ দৃঢ় আঁচড়ে অ্যামিওটিক তরল মুছে তারপর সহজে নাগাল পাওয়ার মতো জায়গায় ফোলা ওলান স্থাপন করল। এরইমধ্যে দুধ চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছে ওটার নোম লাগানো বাট থেকে। মাথা দিয়ে ওখানে ধাক্কা দিল কোল্টটা, তারপর জেঁকের মতো একটা ওলান কামড়ে ধরল। হিংস্র ভঙ্গিতে চুষতে শুরু করল। সরে গেল তাইতা। ওর উপস্থিতির আর প্রয়োজন বা কাক্ষিত নয়।

ভোরে সেনাদল মা আর বাচ্চাটার তারিফ করল। প্রত্যেকেই ঘোড়ার সমঝদার, তাই ভীড় বাড়াতে গেল না; যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পরস্পরকে সদ্যজাত বাচ্চার চমৎকার গড়নের মাথা ও দীর্ঘ পিঠ দেখাতে লাগল।

দারুণ গভীর সিনা, বলল শাবাকো। টিকে থাকার মতো। সারাদিন দৌড়াতে পারবে।

সামনের পাজোড়া চ্যাপ্টা বা কবুতরের পায়ের মতো নয়। দ্রুত ছুটতে পারবে, বলল হিলতো।

পেছনের পাজোড়া চমৎকারভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, কাস্তে বা হিপ-শট কোনওটাই নয়। হ্যাঁ, বাতাসের মতোই ক্ষিপ্র, বলল তোনকা।

কী নাম রাখবেন ওটার, ম্যাগাস? জানতে চাইল মেরেন।

ওয়ার্লউইন্ড।

হ্যাঁ, সাথে সাথে একমত হলো ওরা। দারুণ মানানসই নাম।

দশদিনের ভেতর মাকে ঘিরে ঘাস খেতে লেগে গেল ওয়ার্লউইন্ড। যখনই খিদে মেটার মতো দ্রুত ওলানে দুধ পাঠাচ্ছে না, তীব্রভাবে মাথা দিয়ে তো মারছে।

লোভী পিচ্চি, মন্তব্য করল তাইতা। আমরা পথে নামতে নামতে অনুসরণ করার মতো যথেষ্ট শীক্তশালী হয়ে উঠবে ওটা।

*

আবার দক্ষিণের পথ ধরার আগে পূর্নিমার চাঁদ ওঠার জন্যে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করল মেরেন। কলাম বরাবর এগোনোর সময় সব কটা খচ্চরের পিঠে বাঁধা পানির পাত্র ও চুনা পাথরের পাউডারের থলে পরখ করছে তাইতা, লক্ষ করল মেরেন। দ্রুত ব্যাখ্যা করল ও, আমি নিশ্চিত ওগুলোর আর দরকার হবে না, কিন্তু…, কৈফিয়ত খুঁজে বেড়াতে লাগল সে।

তাইতা নিজেই দিল জবাবটা। ফেলে যাওয়ার মতো তুচ্ছ জিনিস নয় ওগুলো। কেবুইতে বিক্রি করা যাবে।

ঠিক একথাটাই ছিল আমার মাথায়, স্বস্তি পেল মেরেন। এক মুহূর্তের জন্যেও আপনার জাদুমন্ত্রের ক্ষমতায় সন্দেহ জাগেনি আমার। আমি নিশ্চিত, এখন থেকে সামনে কেবল মিষ্টি পানিই মিলবে।

তাই প্রমাণিত হলো। ওরা এরপর যে পুকুরের কাছে পৌঁছাল সেটার পানি সবুজ, মাগুর মাছের ছড়াছড়ি সেখানে, ওগুলোর মুখের চাপাশে দীর্ঘ কাটা। শুকিয়ে আসা পুকুর নিবিড় ঝাঁকে পরিণত করেছে ওদের। ঝটপট বর্শা ছুঁড়ে মারা হলো ওদের। ওগুলোর চর্বিদার মাংস উজ্জ্বল হলুদ। খাসা খাবার হলো ওগুলো। লোকজনের মাঝে তাইতার খ্যাতি মর্মর পাথরে সোনার হরফে খোদাই হয়ে গেছে। চার ক্যাপ্টেন ও তাদের সেনাদল দুনিয়ার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ওর সাথে যেতে তৈরি এখন, ঠিক একাজ করারই নির্দেশ দিয়েছেন ফারাও।

ঘোড়ার খড়ের সরবরাহের পরিমাণ সবসময়ই প্রয়োজনের চেয়ে কম, কিন্তুএই পথে আগেও গেছে যাওয়ার সময় আশপাশের এলাকায় ছুঁড়ে বেরিয়েছে তাই। নদীর কাছ থেকে ঘুর পথে ওদের একটা গোপন উপত্যকায় নিয়ে গেল ও, এখানে খাট শক্ত ধরনের মরুভূমির গুল্ম রয়েছে, দেখে মনে হবে মরে শুকিয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিটি গাছের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে একটা করে জল ও পুষ্টি ভরা বিরাট কন্দ। কঠিন সময়ে অরিক্সের মূল খাবার ছিল-খুরের ঘায়ে খুঁড়ে তোলে ওরা এগুলো। সৈনিকরা বড় বড় টুকরো করল ওগুলোকে। প্রথমে স্পর্শও করতে চাইল না ঘোড়ার দল, কিন্তু ক্ষুধা অচিরেই অনীহাকে জয় করে নিল। পানির পাত্র আর চুনা পাথরের ব্যাগ সরিয়ে তার জায়গায় কন্দগুলো নিল লোকেরা।

পরের মাসগুলোতে চলার গতি বজায় রাখল ওরা। কিন্তু ঘোড়াগুলো দুর্বল হয়ে আসায় পিছিয়ে পড়তে লাগল। সেগুলো লুটিয়ে পড়লে সৈনিকরা দুই কানের মাঝখান দিয়ে খুলির গভীরে তলোয়ার চালিয়ে ব্যবস্থা করল। চামড়া শুকোতে রোদে ফেলে রাখল ওরা। শেষ বাধা শাবলুকা গোর্জ মোকাবিলা করার আগে মোট বিশটা ঘোড়া প্রাণ হারাল-সংকীর্ণ একটা ফোকরের ভেতর দিয়ে প্রবল বেগে ধেয়ে গেছে নীল।

গোর্জের উপরে বিস্তৃত নীল নদ, প্রায় মাইলটাক প্রশস্ত। তবে গ্যাপের ভেতরে ওটা খাড়া পাথুরে কিনারা থেকে আরেক কিনারা পর্যন্ত সাকুল্যে শখানেক গজে সীমিত। ওরা যখন ওটার ঠিক নিচে তাঁবু ফেলল, কারনাক ছেড়ে আসার পর এই প্রথমবারের মতো প্রবাহমান পানির দেখা পেল। পাথুরে শ্যুটের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষীণ একটা পানির ধারা, নিচের পুকুরে জমা হচ্ছে। অবশ্য, মাইল খানেক দূরে যাবার আগেই আবার বালিতে শুষে নিয়েছে, ওদের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

গোর্জের ঠোঁটের কিনারা বরাবর একটা বুনো ছাগল চলাচলের পথ ধরে শাবলুকো রিজে উঠে এলো ওরা। চূড়া থেকে সমতল ভূমির উপর দিয়ে দূরের নিচু নীল পাহাড়ের রেখার দিকে তাকাল। কেরেন পাহাড়, বলল তাইতা। দুই নীলের পাহারাদার। কেবুই এখন মাত্র পঞ্চাশ লীগ সামনে।

তীরে পামগাছের সারিতে নদীর সীমানা চিহ্নিত। পশ্চিমের তীর ধরে পাহাড়ের দিকে এগোল ওরা। যতই কেবুইয়ের কাছাকাছি হচ্ছে নদীর ধারাও তত প্রবল হয়ে উঠছে। সেই সাথে প্রফুল্ল হয়ে উঠছে ওদের মন। মাত্র এক দিনেই যাত্রার বাকি অংশ শেষ করল ওরা। অবশেষে নীলের সঙ্গমে পৌঁছুল।

মিশরিয় সাম্রাজ্যের দূরতম সীমায় কেবুই একটা চৌকি। ছোট দুর্গে নোমের গভর্নর ও সীমান্ত রক্ষীদের আবাস। দক্ষিণ তীর বরাবর বিস্তৃত শহরটা। বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এটা, কিন্তু এতদূর থেকেও অনেকগুলো দালানকোঠার ধ্বসে পড়া দেখতে পেল ওরা, পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। নীলের ব্যর্থতার কারণে মিশর মায়ের সাথে উত্তরের সমস্ত ব্যবসা রুদ্ধ হয়ে গেছে। অল্প লোকই তাইতা, মেরেন ও অন্য যারা নীলের যেপথে এসেছে সেপথে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যেতে প্রস্তুত আছে।

পানির এই ধারা আসছে ইথিওপিয়ার উঁচু ভূমি থেকে। প্রশস্ত পুবের নদীর ধারার দিকে ইঙ্গিত করল তাইতা। জল বইছে, অপর পাড়ে শাদুফের চাকা ঘুরে ঘুরে সেঁচের নালায় পানি ঢেলে দেওয়া দেখতে পেল ওরা। ধুরা শস্যের প্রশস্ত ক্ষেত ঘিরে রেখেছে শহরকে।

এখানে ঘোড়ার দলকে মোটাতাজা করে তোলার মতো শস্যের ভালো সরবরাহের আশা করেছিলাম, খুশি মনে বলল মেরেন।

হ্যাঁ, সায় দিল তাইতা। ওরা পুরোপুরি সেরে ওঠার আগ পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নিতে হবে। উইন্ডম্মেকের ঘাড়ে হাত বোলাল ও। দুঃখজনকভাবে কাহিল অবস্থা হয়ে গেছে ওটা। পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়েছে, ম্লান হয়ে গেছে গায়ের চামড়া। এমনকি তাইতা ধুরা শস্যের ওর ভাগ থেকে খেতে দিলেও পেটের বাচ্চা ও যাত্রার খাটুনি অবস্থা কাহিল করে দিয়েছে ওকে।

নদীর পুব শাখার দিকে মনোযোগ দিল তাইতা। রানি লস্ত্রিস ওই পথে যাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিল, বলল ও। গালি নিয়ে আরেকটা খাড়া গোর্জের মুখ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম আমরা, ওটা পার হতে পারেনি ওগুলো; আমরা তখন নোঙর ফেলে রথ আর ওয়্যাগনে চেপে আগে বেড়েছি। পাহাড়ে যাবার পর রানি ও আমি ফারাও মেমোজের সমাধিস্থল নির্বাচন করি। আমি নকশা করেছিলাম; বুদ্ধি খাঁটিয়ে লুকিয়ে রেখেছি। ওটা যে কোনওদিনই আবিস্কৃত হয়নি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এবার হবে। এক মুহূর্তের জন্যে সম্ভষ্টির সাথে নিজের সাফল্যের কথা ভাবল ও। তারপর ফের খেই ধরল, ইথিওপিওদের চমৎকার ঘোড়া আছে, তবে ওরা যোদ্ধা এবং হিংস্রভাবে পাহাড়ী দুর্গ রক্ষা করে। ওদের পরাস্ত করে আমাদের সাম্রাজ্যের অধীনে আনার জন্যে পাঠানো দুদুটি সেনাদলকে হটিয়ে দিয়েছে ওরা। আমার ভয় হচ্ছে যে, তৃতীয় চেষ্টা আর হবে না। ঘুরে সরাসরি নদীর দক্ষিণ শাখার দিকে ইঙ্গিত করল ও। পুবের শাখার চেয়ে প্রশস্ত ওটা। তবে শুকনো, এমনকি ওটার তলদেশ দিয়ে ক্ষীণ কোনও ধারাও বইছে না। ওই পথেই যেতে হবে আমাদের। অল্প কয়েক লীগ এগোনোর পর জলাভূমিতে প্রবেশ করেছে নদী, কোনও চিহ্ন না রেখে এরই মধ্যে গোটা সেনাবাহিনীকে গ্রাস করে নিয়েছে ওটা। অবশ্য, ভাগ্য ভালো হলে বেশ শুকনো অবস্থায়ই পাব ওটাকে। সম্ভবত ওটার ভেতর দিয়ে যাবার মতো অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সহজ পথের দেখা পাব আমরা। পথ দেখানোর জন্যে রাজকীয় বাজপাখীর সীলমোহর সঠিক ব্যবহার করে গভর্নরদের কাছ থেকে দেশি প্রহরী নিতে পারব। এসো, নদী পেরিয়ে কেবুইতে যাই।

খরার সাত বছর ধরে এই চৌকিতে আটকে আছেন গভর্নর। তাঁর নাম নারা। জলাভূমির জ্বরে বারবার আক্রান্ত হয়ে এখন রীতিমতো কুঁজো ও হলদে হয়ে গেছেন। তবে তাঁর সেনাছাউনী অনেকটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। ধুরা খেয়ে বেঁচেবর্তে আছে। ওদের ঘোড়াগুলোও বেশ তরতাজা। মেরেন রাজকীয় সীলমোহর দেখিয়ে তাইতার পরিচয় জানানোর পর প্রবল হয়ে উঠল নারার আতিথেয়তা। পথ দেখিয়ে তাইতা ও মেরেনকে দুর্গের অতিথি ভবনে নিয়ে গেলেন তিনি, সেরা কামরা বরাদ্দ করলেন, নিজস্ব রাধুনীকে ওদের খাবার তৈরির নির্দেশ দিলেন। তারপর অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দিলেন, যাতে লোকজনকে সজ্জিত করে তুলতে পারে ওরা।

ঘোড়ার আস্তাবল থেকে পছন্দসই ঘোড়া বেছে নিন। আপনাদের কী পরিমাণ ধুরা ও খড়ের প্রয়োজন আমার কোয়ার্টার মাস্টারকে বলবেন। কাপণ্যের কোনও দরকার নেই। আমাদের ভালোই রসদ জমা আছে।

মেরেন যখন নতুন কোয়ার্টারে লোকজনেকে দেখতে গেল, সবাইকে সন্তুষ্ট দেখল ও। এখানকার রেশন অসাধারণ। শহরে বেশি মেয়েলোক নেই, তবে অল্প কয়েক জন যারা আছে তারা সবাই বন্ধুসুলভ। ঘোড়া আর খচ্চরের দল ধুরা ও সবুজ ঘাস খেয়ে পেট ভরে নিচ্ছে। কারও কোনও অভিযোগ নেই, জানাল হিলতো।

দীর্ঘ নির্বাসনের পর গভর্নর নারা সভ্য জগতের খবরাখবর পেতে উদগ্রীব ছিলেন। সংস্কৃত লোকদের সংস্পর্শ পেতেও ছিলেন লালায়িত। বিশেষ করে তাইতার প্রাজ্ঞ বয়ান তাকে মুগ্ধ করে দিল। বেশির ভাগ সন্ধ্যায় একসাথে খাবেন বলে মেরেন ও ওকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তিনি। তাই যখন ওকে জানাল যে ওদের উদ্দেশ্য জলাভূমি হয়ে দক্ষিণে যাওয়া, নারাকে গম্ভীর দেখাল।

জলাভূমির ওধারের দেশ থেকে কেউ কোনওদিন ফিরে আসেনি। আমি বিশ্বাস করি, দুনিয়ার শেষ প্রান্তে চলে গেছে ওই পথ। ওখানে যারা যায়, কিনারার উপর দিয়ে খাদে পড়ে যায়।

পরক্ষণেই আরও আশাবাদী সুর ধরলেন তিনিঃ এই লোকগুলোর কাছে রাজকীয় বাজপাখীর সীলমোহর রয়েছে, তাঁর উচিত ওদের দায়িত্ব সম্পর্কে উৎসাহিত করা। অবশ্যই পৃথিবীর শেষপ্রান্তে কেন আপনারাই প্রথমবারের মতো গিয়ে হাজির হয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারবেন না তার কোনও কারণ নেই। আপনার লোকেরা কঠিন, আপনার সাথে ম্যাগাস রয়েছেন। তাইতার উদ্দেশে মাথা নোয়ালেন তিনি। আপনাকে সাহায্য করতে কী করতে পারি আমি? শুধু বলে দেখুন।

আমাদের পথ দেখাতে দেশি শাস্ত্রী আছে আপনার? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, ওকে আশ্বস্ত করলেন নারা। ওদিকে কোথাও থেকে আসা লোকজন আছে আমার কাছে।

ওরা কোন গোত্রের লোক জানেন?

না, তবে ওরা লম্বা, খুবই কালো, গায়ে অদ্ভুত নকশার টাটু আঁকা।

তাহলে সম্ভবত শিলুক, খুশি হয়ে বলল তাইতা। যাত্রার সময় সেনাপতি লর্ড তানাস বেশ কয়েক রেজিমেন্ট শিলুককে নিয়োগ দিয়েছিল। ওরা বুদ্ধিমান, সহজে নির্দেশ দেওয়া যায়। সবসময় হাসিখুশি থাকলেও আসলে কিন্তু ভয়ঙ্কর যোদ্ধা।

ওদের বর্ণনার সাথে ভালোভাবেই মিলে যাচ্ছে, সায় দিলেন গভর্নর নারা। পদবী যাই হোক, দেশটাকে বেশ ভালোই চেনে ওরা। আমি যে দুজনের কথা ভাবছি, বেশ কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করছে, মিশরের ভাষাও শিখেছে কিছুটা। সকালে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব ওদের।

সকালে তাইতা ও মেরেন ওদের কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে নুবিয়ানদের প্রাঙ্গণের দেয়াল বরাবর হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখল। সোজা হয়ে দাঁড়ালে মেরেনকে ছাড়িয়ে গেল ওরা। ছিপছিপে শরীর চ্যাপ্টা কঠিন পেশিতে ঢাকা, আচরিক ক্ষতের জটিল নকশায় সজ্জিত। চর্বি বা তেলে চকচক করছে ওদের চামড়া। পরনে পশুর চামড়ার খাট স্কার্ট, হাড় থেকে বানানো কাটা লাগানো দীর্ঘ বর্শা বইছে সাথে।

তোমাদের দেখেছি, লোকেরা! শিলুক ভাষায় ওদের স্বাগত জানাল তাই। লোকেরা ক্ষমতা বোঝানোর এক ধরনের পরিভাষা, কেবল যোদ্ধাদের মাঝেই চল আছে এর; খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওদের সুদর্শন নিলোটিক চেহারা।

হে প্রবীন, প্রাজ্ঞজন, আপনাকে দেখেছি, ওদের ভেতর দীর্ঘজন জবাব দিল। এটাও সম্মান ও সমীহের ভাষা। তাইতার রূপালি দাড়ি ওদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে। কিন্তু আপনি কীভাবে এত সুন্দরভাবে আমাদের ভাষা জানেন?

তোমরা সিংহ হৃদয়ের নাম শুনেছ? জানতে চাইল তাইতা। শিলুকরা মনে করে হৃদয়ই পুরুষের সাহসের জায়গা।

হাও! হাও! হতবাক হয়ে গেছে ওরা। লর্ড তানাসের অধীনে ওদের গোত্র কাজ করার সময় তাকে এই নাম দিয়েছিল ওরা। আমাদের দাদা সিংহ হৃদয়ের কথা বলেছে, কারণ আমরা চাচাত ভাই। পুবের পাহাড়ে ওই লোকের পক্ষে যুদ্ধ করেছে সে। সে আমাদের বলেছে সিংহ হৃদয় যোদ্ধাদের বাবা ছিলেন।

সিংহ হৃদয় আমার ভাই ও বন্ধু, ওদের জানাল তাই।

তাহলে আপনি সত্যিই প্রবীন মানুষ, এমনকি আমাদের দাদার চেয়েও বয়স্ক। আরও মুগ্ধ হয়ে গেছে ওরা।

চলো, ছায়ায় বসে কথা বলা যাক, পথ দেখিয়ে প্রাঙ্গণের মাঝখানে একটা বিরাট ডুমুর গাছের নিচে নিয়ে এলো ওদের তাইতা।

সভার কায়দায় বৃত্তাকারে বসল ওরা। একে অন্যের মুখোমুখি। এবার নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করল ওদের। বয়স্ক চাচাত ভাইটি ওদের মুখপাত্র। ওর নাম নাকোন্তো, খাট ঘাই মারার বর্শার শিলুক প্রতিশব্দ। কারণ যুদ্ধে অনেক লোক খতম করেছি আমি। বড়াই নয়, বরং নেহাত সত্যি কথা বলছে। আমার চাচাত ভাই নোম্ভ, কারণ সে খাট।

সবকিছুই আপেক্ষিক, আপনমনে হাসল তাইতা। নোম্ভ মেরেনের চেয়েও এক মাথা লম্বা।

কোত্থেকে এসেছ তোমরা, নাকোন্তো?

জলাভূমির ওধার থেকে, চিবুক দিয়ে দক্ষিণে ইঙ্গিত করল সে।

তাহলে দক্ষিণের এলাকা ভালো করে চেনা আছে?

ওখানেই আমাদের দেশ। মুহূর্তের জন্যে আনমনা মনে হলো ওকে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল।

আমাকে পথ দেখিয়ে তোমাদের দেশে নেবে?

রোজ রাতে স্বপ্ন দেখি বাপ-দাদার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, মৃদু কণ্ঠে বলল নাকোন্তো।

ওদের আত্মা তোমাকে ডাকছে, বলল তাইতা।

প্রবীন পুরুষ, আপনি বুঝতে পেরেছেন, প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় ওর দিকে তাকাল নাকোন্তো। আপনি কেবুই থেকে যাবার সময় আমি ও নোম্ভ পথ দেখাতে আপনার সাথে যাব।

*

ঘোড়া এবং ওদের সওয়ারিরা পুরোপুরি যাত্রার জন্যে তৈরি হওয়ার আগে আরও দুটি পূর্ণ চাঁদ নীলের পুকুরে ঝিলিক দিয়ে গেল। ওদের রওয়ানা হওয়ার আগের রাতে বিরাট মাছের ঝাঁকের স্বপ্ন দেখল তাইতা। নানা রঙ, চেহারা ও আকারের মাছ।

আমাকে মাছের মাঝে লুকানো অবস্থায় পাবে, স্বপ্নে ওর মনে প্রতিধ্বনি তুলল ফেনের মিষ্টি ছেলেমানুষি কণ্ঠস্বর। তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি।

সকালে সুখ ও প্রবল প্রত্যাশার অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে উঠল ও।

*

বিদায় নিতে দেখা করতে এলে গভর্নর নারা তাইতাকে বললেন, আপনি চলে যাচ্ছেন দেখে আমি দুঃখিত, ম্যাগাস। আপনার সঙ্গ এখানে কেবুইয়ে কাজের নিঃসঙ্গতা দূর করতে অনেক সাহায্য করেছে। আশা করছি অচিরেই আবার আপনাকে স্বাগত জানানোর সুযোগ পাব। বিদায় উপলক্ষ্যে আপনার জন্যে একটা উপহার রয়েছে, আশা করছি আপনার বেশ কাজে লাগবে। তাইতার কাঁধে হাত রেখে ওকে নিয়ে উজ্জ্বল রৌদ্রালোকিত প্রাঙ্গণে এলেন তিনি। পাঁচটি প্যাক মিউল উপহার দিলেন ওকে। সব কটার পিঠে ঘাসের ডগাভর্তি এক জোড়া করে বস্তা। বনের গভীরে আদিম গোত্রগুলোর কাছে এই সামান্য জিনিসের অনেক চাহিদা। এরই এক মুঠো হাতে পেতে পুরুষরা তাদের সবচেয়ে সুন্দরী স্ত্রীকেও বিক্রি করে দেবে। বলে হাসলেন তিনি। যদিও আমি এর কোনও কারণ খুঁজে পাই নাঃ কী কারণে অমন অনাকার্ষণীয় মেয়েদের পেছনে আপনি ভালো জিনিস নষ্ট করতে যাবেন।

কলাম কেবুই ছেড়ে আসার পরই লাফ দিয়ে সামনে চলে এলো দুই শিলুক, ঘোড়ার দুলকি চালে ছোটার সাথে অনায়াসে খাপ খাইয়ে নিল। ক্লান্তিহীন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রথম দুই রাতে প্রশস্ত শুকনো নদীর তলদেশের পুব পারের বিস্তৃর্ণ পোড়া সমতল পার হলো লোকগুলো। তৃতীয় দিন ভোরের দিকে শিবির গাড়তে থামার পর রেকাবে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে নজর চালাল মেরেন। তীর্যক সূর্যের রশ্মিতে দিগন্তের ওধারে অবিচ্ছিন্ন বিছিয়ে থাকা অবারিত সবুজ দেয়াল দেখতে পেল ও।

তাইতার ডাকে উইন্ডস্মোকের মাথার কাছে এসে দাঁড়াল নাকোন্তো।

আপনি যা দেখছেন, প্রবীন পুরুষ, সেটা হচ্ছে প্যাপিরাসের প্রথম কেয়ারি।

ওগুলো সবুজ, বলল তাইতা।

মহান সুদের জলাভূমি কখনও শুকোয় না। পুকুরগুলো অনেক গভীর, শ্যাওলার কারণে সূর্যের আলোর নাগালের বাইরে থাকে।

আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে ওটা?

কাঁধ ঝাঁকাল নাকোন্তা। আরও এক রাত চলার পর লাল তীরে পৌঁছাব আমরা। তখন দেখা যাবে ঘোড়া পার করার মতো যথেষ্ট শুকিয়েছে কিনা জল। নাকি আমাদের পুবের পাহাড়ের দিকে দীর্ঘ ঘুর পথে যেতে হবে। মাথা নাড়ল সে। তাতে দক্ষিণ যাত্রা আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে।

নাকোন্তো যেমন আশা করেছিল, ঠিক পরের রাতেই প্যাপিরাসের কাছে পৌঁছাল ওরা। আগাছার কেয়ারি থেকে লোকেরা শুকনো খড়ি কেটে সূর্যের আঁচ থেকে নিজেদের বাঁচাতে নতুন করে নিচু ছাপরা বানাল। প্যাপিরাসের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল নাকোন্তো ও নোন্ত, পরর দুদিন আর দেখা গেল না তাদের।

ফের ওদের দেখা মিলবে, শঙ্কা প্রকাশ করল মেরেন, নাকি বুনো জানোয়ার বলে নিজেদের গ্রামে পালিয়ে গেছে?

ফিরে আসবে ওরা, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। খুব ভালো করেই চিনি ওদের। ওরা অনুগত ও বিশ্বস্ত।

দ্বিতীয় রাতের মাঝামাঝি শাস্ত্রীদের চ্যালেঞ্জ শুনে জেগে উঠল তাইতা, প্যাপিরাসের ঝোঁপ থেকে নাকোন্তোর জবাব শুনতে পেল। তারপর অন্ধকার থেকে উদয় হলো দুই শিলুক যেখানে নিখুঁতভাবে মিশে গিয়েছিল ওরা।

প্যাপিরাসের ভেতর দিয়ে যাওয়া পথ খোলা, জানাল নাকোন্তো।

ভোরে প্যাপিরাসের ভেতরে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো ওদের দুই গাইড। এরপর থেকে এমনকি নাকোন্তোর পক্ষেও অন্ধকারে দিশা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, ফলে দিনের বেলাতেই পথ চলতে বাধ্য হলো ওরা। জলাভূমি অচেনা, ভয়ঙ্কর এক জগৎ। এমনকি ঘোড়ার পিঠ থেকেও প্যাপিরাসের তুলতুলে গোছর উপর দিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না ওরা। অসীম দিগন্তের দিকে বিস্তৃত অবারিত সবুজের মহাসাগরের উপর দিয়ে দেখার জন্যে রেকাবের উপর ভর দিয়ে তাকাতে হচ্ছিল। ওগুলোর উপর উড়ে বেড়াচ্ছে জলচর পাখির ঝাঁক, ওদের ডানার ঝাপ্টানো ও ব্যাকুল আর্তনাদে ভরে আছে পরিবেশ। মাঝে মাঝে চোখের আড়ালে ধেয়ে যাচ্ছে বিশালদেহী জানোয়ার, আগাছার ডগায় কাঁপন উঠছে তখন। কোন প্রজাতির জানোয়ার, ধারণাই করতে পারছে না ওরা। কাদার উপর ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ জরিপ করছে দুই শিলুক, ওদের বর্ণনা তরজমা করছে তাই। ওটা ছিল মোষের পাল, বিরাট কালো বুনো জানোয়ার, বা জলখাসী ছিল ওগুলো, প্যাচানো শিংয়ের অদ্ভুত বাদামী রংয়ের পশু, পানিতেই থাকে। জল-হঁদুরের মতো সাঁতার কাটতে সাহায্য করার জন্যে দীর্ঘ খুর রয়েছে ওদের।

প্যাপিরাসের নিচের বেশিরভাগ জমিনই ভেজা, অনেক সময় নেহাতই স্যাঁতসেঁতে তবে প্রায়ই ঘোড়ার খুরের পশম ঢেকে দিচ্ছে জল। তা সত্ত্বেও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলল ছোট্ট কোল্ট ওয়ার্লপুল। আগাছার ভেতর লুকিয়ে আছে পুকুরগুলো, এগুলোর কোনওটা ছোট, কিন্তু অন্যগুলো বিরাট ল্যাগুনের মতো। আগাছার উপর দিয়ে দেখতে না পেলেও নির্ভুলভাবে হয় ওগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে বা দুটোর মাঝখান দিয়ে এগোচ্ছে শিলুকরা। একবারও বিকল্প পথের খোঁজে পিছু হটতে বাধ্য হয়নি কলামটা। রোজ সন্ধ্যায় শিবির খাটানোর সময় হলেই প্যাপিরাসের ভেতর শুকনো জমিনঅলা খোলা জায়গা খুঁজে বের করছে নাকোন্তো। শুকনো খড়ি দিয়ে লাকড়ি বানাচ্ছে, শিখা যাতে খাড়া থাকা আগাছার বাইরে যেতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখছে। ঘোড়া আর খচ্চরের দল আবদ্ধ জলে জন্মানো ঘাস আর গাছ খেতে নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল।

রোজ সন্ধ্যায় বর্শা নিয়ে কোনও পুকুরের জলে নেমে পড়ছে নাকোন্তো, তারপর শিকারী সারসের ভঙ্গিতে অটল দাঁড়িয়ে থাকছে। যখন কোনও বড় আকারের মাগুর মাছ সাঁতরে ওর কাছে এসে পড়ে, ওটাকে নিপূণভাবে বর্শায় গেঁথে তুলে আনে, লেজ দাপিয়ে ছোটার জন্যে লড়াই করে চলে ওটা। ইতিমধ্যে আগাছা দিয়ে একটা ঢিলাঢালা ঝুড়ি বুনে নিয়েছে নোম্ভ, মাথায় চাপিয়েছে ওটা, বুনটের ফোকর দিয়ে ওর চোখ দেখা যায়। তারপর তীর ছেড়ে গোটা শরীর পানিতে ডুবিয়ে ফেলল, কেবল ঝুড়ির আড়ালে থাকা মাথাটা রইল পানির ওপর। অসীম ধৈর্যের সাথে নড়াচড়া করছে। হাঁসের একটা ঝাঁক শিকার করবে বলে খুব সাবধানে আগে বাড়ছে। নাগালের ভেতর আসামাত্র একটা পাখির পা আঁকড়ে ধরল সে, টেনে নিয়ে গেল পানির নিচে। ঘাড় মুচড়ে দেওয়ার আগে চিৎকার করারও অবসর পেল না। ওটা। এভাবে ঝাঁক থেকে পাঁচটা হাঁস কায়দা করার পর সন্দিহান হয়ে উঠল অন্যগুলো, চেঁচামেচি জুড়ে ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ তুলে উড়াল দিল ওগুলো। বেশির ভাগ সন্ধ্যায়ই দলটা টাটকা মাংস আর ঝলসানো বুনো হাঁসের মাংস দিয়ে রাতের খাবার সারছে।

হুলঅলা পোকামাকড়ের দল মানুষ ও পশু উভয়কেই জ্বালিয়ে মারছে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে জলের তল থেকে গুঞ্জন তুলে উঠে আসতে শুরু করে ওরা, ওদের হাত থেকে বাঁচতে অসহায়ের মতো ক্যাম্পফায়ারের আগুনের কাছে জড়ো হয় সৈনিকরা। সকালে দেখা যায় ওদের চোখমুখ ফুলে গেছে, কামড়ের দাগ পড়েছে।

বার দিন পথ চলার পর প্রথম একজনের ভেতর জলাভূমির রোগের লক্ষণ ফুটে উঠল। অচিরেই একের পর এক আক্রান্ত হতে লাগল কমেরেডরা। তীব্র মাথাব্যথা আর এমনকি গুমোট গরমেও নিয়ন্ত্রণাতীত কাঁপুনির শিকার হচ্ছে ওরা, গায়ের চামড়া এত গরম হয়ে উঠছে যে হাত দেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ওদের সেরে ওঠার সুযোগ দিতে যাত্রায় বিরতি দিল না মেরেন। রোজ সকালে শক্তিশালী সৈনিকটি অচলদের ঘোড়ায় উঠতে সাহায্য করে, তারপর জিনের উপর বহাল থাকতে সাহায্য করতে পাশাপাশি এগোয়। রাতে অনেকেই মারাত্মক প্রলাপ বকে। সকালে আগুনের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে মৃতদেহগুলো। দ্বাদশ দিনে মারা গেল ক্যাপ্টেন তনকা। কাদার ভেতর ওর জন্যে একটা অগভীর কবর খুঁড়ল ওরা, তারপর এগিয়ে গেল আবার।

অসুখে আক্রান্ত কয়েকজন রোগ প্রতিহত করলেও ওদের চোখ মুখ হলদে রয়ে গেল, দুর্বল ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। তাইতা ও মেরেনসহ অল্প কয়েক জন অসুখে আক্রান্তই হলো না।

জ্বরে আক্রান্ত লোকদের আগে বাড়ার তাগিদ দিচ্ছে মেরেন: যত তাড়াতাড়ি এই ভয়ঙ্কর বিষাক্ত ধোঁয়াশা থেকে বের হতে পারব তত দ্রুত সেরে উঠবে তোমরা। তারপর তাইতাকে বলল, ভয় একটাই, জলাভূমির জ্বরে শিলুকদের হারাতে হলে, বা ওরা আমাদের ফেলে চলে গেলে বেকায়দায় পড়ে যাব আমরা; আর কোনওদিনই এই ভয়ঙ্কর বুনো এলাকা থেকে বেরুতে পারব না। এখানেই শেষ হয়ে যাব সবাই।

জলাভূমিই ওদের দেশ। এখানকার সব রকম রোগ থেকে ওরা মুক্ত, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকবে ওরা।

দক্ষিণে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চোখের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে প্যাপিরাসের বিশাল বিস্তার, তারপর পেছনে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে আবার। যেন মধুতে আটকে যাওয়া পতঙ্গ ওরা, প্রাণান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও মুক্ত করতে পারছে না নিজেদের। প্যাপিরাস বন্দি করে ফেলেছে ওদের; হজম করে নিচ্ছে, শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছে। এখানকার নিরেট একঘেয়েমি ক্লান্ত, শিথিল করে দিচ্ছে ওদের মন। অবশেষে, যাত্রার ছত্রিশতম দিনে ওদের সামনের দৃষ্টিপথের সীমানায় কালো বিন্দুর মতো একটা জটলা উদয় হলো।

ওগুলো কি গাছ? শিলুকদের উদ্দেশে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল তাইতা। লাফ দিয়ে নোন্তুর কাঁধে চড়ে বসল নাকোন্তো, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল, অনায়াসে ভারসাম্য বজায় রেখেছে। আগাছার উপর দিয়ে দেখার দরকার হলেই এমনটা করে সে।

নাহ, প্রবীন পুরুষ, জবাব দিল সে, লু-দের কুঁড়ে ওগুলো।

লু-রা আবার কারা?

ঠিক মানুষ বলা যাবে না ওদের। এখানকার জলাবাসী জানোয়ার, মাছ, সাপ আর কুমীর খেয়ে বাঁচে। যেমন দেখতে পাচ্ছেন, খুঁটির উপর বাসা বানায় ওরা। পোকামাকড় তাড়াতে কাদা, ছাই আর অন্যান্য নোংরা জিনিস দিয়ে সারা শরীর লেপে রাখে। বুনো, বর্বর, ওদের পেলেই মেরে ফেলি আমরা, কারণ আমাদের গরু ছাগল চুরি করে ওরা। আমাদের কাছ থেকে চুরি করা গরু-ছাগল এখানে এনে তারপর খায়। মানুষ না, বরং হায়েনা আর শেয়াল। অসন্তোষের সাথে থুতু ফেলল সে।

তাইতার জানা ছিল শিলুক যাযাবর গোত্র। গরু-ছাগলের জন্যে গভীর মমতা ওদের রয়েছে, কখনওই হত্যা করে না। তার বদলে সাবধানে পশুর গলায় একটা শিরা কেটে তারপর একটা কালাবাশে যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত জমা হলে ক্ষতস্থান ফের কাদা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এই রক্তের সাথে গরুর দুধ মিশিয়ে পান করে। এই জন্যেই আমরা এত লম্বা, শক্তিশালী। এমন শক্তিশালী যোদ্ধা। এই জন্যেই জলাভূমির রোগ আমাদের কখনও আক্রান্ত করে না। শিলুকরা ব্যাখ্যা করবে।

লু-দের শিবিরে পৌঁছার পর ওরা দেখল শাখা করছে খুঁটির ডগায় বসানো কুঁড়েগুলো। তবে ইদানীং বসবাসের আলামত রয়েছে। ওরা যেখানে আগুনে শিকার ঝলসেছে সেখানে পড়ে থাকা মাছের মুড়ো ও আঁশ এখনও বেশ টাটকা। টাটকা পানির কাঁকড়া খেয়ে নেয়নি; বা ছাদে বসে থাকা শকুনের পেটে যায়নি। তুলতুলে শাদা ছাইয়ের ভেতর জ্বলন্ত অঙার জ্বলজ্বল করছে। শিবিরের ওপাশের এলাকাকে ল্যাট্রিন হিসাবে ব্যবহার করেছে লু-রা, টাটকা বর্জ্যের ছড়াছড়ি ওখানে। ওটার পাশে দাঁড়াল নাকোন্তো। সকালেও এখানে ছিল ওরা। এখনও আশপাশে রয়েছে। সম্ভবত আগাছার আড়াল থেকে আমাদের উপর নজর রাখছে।

গ্রাম থেকে বের হয়ে আবার অন্তহীন মনে হওয়া দূরত্ব পার হলো ওরা। শেষ বিকেলের দিকে পথ দেখিয়ে ওদের একটা ভোলা জায়গায় নিয়ে এলো নাকোন্তো, জায়গাটা আশপাশের কাদার তীরের তুলনায় কিঞ্চিত উঁচু জলাভূমির বুকে এক চিলতে শুকনো জমিন। মাটিতে গাঁথা কাঠের খুঁটির সাথে ঘোড়া বাঁধল ওরা, চামড়ার নোজব্যাগে করে পেষা খাবার দিল খেতে। অসুস্থ সৈনিকদের পরিচর্যা করল তাইতা। লোকেরা রাতের খাবার তৈরি করল। রাত নেমে এলে আগুনের চারপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। কেবল শান্ত্রীরাই জেগে রইল।

অনেক আগেই আগুন নিভে গেছে। শাস্ত্রীরা যখন হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠল তখনও ওদের চোখে ঘুমের ছাপ। গোটা শিবির জুড়ে যেন প্রলয় নেমে এসেছে। চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, ঘোড়ার খুরের ছুটন্ত আওয়াজ, দ্বীপের চারপাশে জলাভূমির জলে ছলাৎছলাৎ শব্দ। মাদুর ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠল তাইতা, দৌড়ে গেল উইন্ডস্মোকের কাছে। পেছনে হটছে ওটা, লাফাচ্ছে, ওকে জমিনের সাথে আটকে রাখা পেরেক ওপড়ানোর চেষ্টা করছে। অন্য ঘোড়াগুলোও একই চেষ্টা চালাচ্ছে। ওটার হল্টার আঁকড়ে ধরল তাইতা, টেনে ধরে রাখল। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল, ত্রাসে কাঁপতে থাকা বাচ্চাটা এখনও রয়েছে ওর পাশে।

চারপাশে পিছলে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত কালো সব ছায়ামূর্তি, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করছে, বর্শা দিয়ে খোঁচা মারছে ঘোড়ার গায়ে। দড়ি ছিঁড়ে পালানোর জন্যে খেপাচ্ছে। লাফাচ্ছে শঙ্কিত জানোয়ারগুলো, দড়ির বাধন আলগা করতে ক্ষেপে উঠেছে। তাইতার দিকে তেড়ে এলো একটা ছায়ামূর্তি, বর্শার আঘাত হানল। হাতের ছড়ি দিয়ে ওটাকে একপাশে ঠেলে দিয়েই পরক্ষণে ডগাটা হানাদারের গলায় বসিয়ে দিল ও। লুটিয়ে পড়ল লোকটা, পড়ে রইল সেভাবেই।

মেরেন ও তার ক্যাপ্টেনরা লোকজন জড়ো করে ফেলেছে। উন্মুক্ত তলোয়ার বাগিয়ে তেড়ে এলো ওরা। অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকজন হানাদারকে কতল করতে পারল।

পিছু নাও ওদের! ঘোড়া নিয়ে পালাতে দিয়ো না! গর্জে উঠল মেরেন।

অন্ধকারে ওদের পিছু নিতে গিয়ে নিজের নোক হারাবেন না, তাইতার উদ্দেশে কাকুতি করল নাকোন্তো। লু-রা দারুণ বিশ্বাসঘাতক। ওদের পুকুরের কাছে নিয়ে অ্যাম্বুশে ফেলে খতম করে ফেলবে। অনুসরণ করার আগে দিনের আলো ফোঁটার অপেক্ষা করতে হবে।

মেরেনকে ঠেকাতে দ্রুত ছুটে এলো তাই। অনীহার সাথে সতর্কবাণী মেনে নিল ও; কারণ ওর রক্তে যুদ্ধের নেশা ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের লোকদের ফিরিয়ে আনল।

ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিল ওরা। চারজন শাস্ত্রীর গলাই দুফাঁক করে রেখে গেছে ওরা। সৈনিকদের একজন উরুতে বিরাট একটা আঘাত হজম করেছে। তিনজন লু কে হত্যা করা গেছে। আরেকজন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। নিজের রক্ত ও ক্ষতস্থান থেকে বের হয়ে আসা আবর্জনায় গড়াগড়ি খেয়ে গোঙাচ্ছে সে।

খতম করো ওকে! নির্দেশ দিল মেরেন। ওর দলের একজন যুদ্ধ কুড়ালের এক কোপে দুটুকরো করে ফেলল তাকে। আঠারটা ঘোড়া খোয়া গেছে।

এতগুলো ঘোড়া হারানো চলবে না, বলল তাইতা।

হারাব না, গম্ভীর কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি দিল মেরেন। ওগুলো উদ্ধার করব আমরা-আইসিসের অণ্ডকোষের কসম খেয়ে শপথ করছি।

আগুনের আলোয় লু-দের একজনের লাশ পরখ করল তাইতা। খাট, মোটাসোটা লোকের লাশ ওটা, নিষ্ঠুর বানরের মতো চেহারা। ঢালু কপাল, ঠোঁটজোড়া পুরু, খুব কাছাকাছি বসানো কুঁতকুঁতে চোখ। কোমরে জড়ানো চামড়ার বেল্টটা বাদ দিলে নগ্নই বলা চলে তাকে। বেল্টে একটা থলে ঝুলছে। ওটায় রয়েছে বেশকিছু জাদুর তাবিজ, গিঁটের হাড় ও দাঁত, সেগুলোর কিছু আবার মানুষের। লোকটার গলায় পঁাচানো বাকলের দড়িতে পাথরের ছুরি ঝুলছে। শাস্ত্রীদের কারও রক্তই জমাট বেঁধে আছে ওটায়। আনাড়ী কায়দায় বানানো হলেও ডগাটা লাশের গলায় বসিয়ে পরখ করতে গিয়ে তাইতা দেখল সামান্য ছোঁয়াতেই চামড়া ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। তার বুক ও মুখে শাদা কাদা, লাল হলদে ফোঁটা, বৃত্ত ও আঁকাবাঁকা আদিম নকশা আঁকা। কাঠের ধোঁয়া, পচা মাছ আর তার নিজস্ব বুনো গন্ধ বের হচ্ছে শরীর থেকে।

জঘন্য চিড়িয়া, থুতু ফেলে বলল মেরেন।

আহত সৈনিকের পরিচর্যা করতে এগিয়ে গেল তাইতা। বর্শার আঘাত গভীর, বুঝতে পারল ক্ষতস্থানে পচন ধরবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যাবে লোকটা। কিন্তু আশ্বস্তকর ভাব দেখাল ও।

এই সময় চোরদের পিছু ধাওযার করতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সক্ষম লোকদের নিয়ে একটা দল তৈরি করল মেরেন। দলের বাকি অংশ মালপত্র, বাকি ঘোড়া ও অসুস্থদের পাহারা দিতে পেছনে থাকবে। পুরোপুরি আলো ফুটে ওঠার আগে হানাদারদের যাবার পথে ফেলে যাওয়া নাদির খোঁজে আগাছার ভেতরে চলে গেল দুই শিলুক। সূর্য ওঠার আগেই ফিরে এলো।

পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো জড়ো করে দক্ষিণে নিয়ে গেছে লু-কুত্তারা, তাইতাকে জানাল নাকোন্তো। আরও দুটো লাশ আর একজন আহতের দেখা পেয়েছি আমরা, তখনও বেঁচে ছিল। এখন আর নেই। বেল্টে ঝোলানো ভারি ব্রোঞ্জের ছুরির বাট স্পর্শ করল নাকোন্তো। আপনার লোকেরা তৈরি থাকলে, প্রবীন ও মহান পুরুষ, এখুনি পিছু নেতে পারি আমরা।

ধূসর মেয়ারটাকে সাথে নিতে রাজি হলো না তাইতা, ওয়ার্লপুল এখনও অনেক ছোট, লু-দের বর্শার আঘাত পেয়েছে পেছন পায়ে। ভাগ্যক্রমে তেমন মারাত্মক কিছু নয়। তার বদলে একটা বাড়তি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো ও। ওরা বেরিয়ে যাবার পর ওর দিকে তাকিয়ে হেষাধ্বনি করল উইন্ডস্মোক, যেন ওকে রেখে যাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করছে।

আগাছার উপর একটা প্রশস্ত পথ তৈরি করে গেছে আঠারটা চোরাই ঘোড়ার খুর। ধাওয়া করে নিয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের ছাপের উপর পড়েছে লু-দের নগ্ন পায়ের ছাপ। অনায়াসে ওগুলোর পেছনে ছুটতে লাগল শিলুকরা। দুলকি চালে ওদের অনুসরণ করল ঘোড়সওয়াররা। সারাদিন ওদের টেনে নিয়ে চলল ট্রেইলটা। সূর্য ডোবার সময় ঘোড়াগুলোকে সামলে ওঠার সুযোগ দিতে পিছিয়ে এলো ওরা, কিন্তু চাঁদ ওঠার পর আবার সামনে বাড়ার মতো পর্যাপ্ত আলো পেয়ে গেল। ভোরে সামনের দূরত্বে আরেকটা বৈশিষ্ট দেখল ওরা। প্যাপিরাসের একঘেয়ে সাগরের পর ওদের চোখ এমনকি এই নিচু গাঢ় রেখা দেখেও খুশি হয়ে উঠল।

লাফ দিয়ে চাচাত ভাইয়ের কাঁধে উঠে বসল নাকোন্তো, তারপর সামনে তাকাল। তাইতার দিকে ফিরে দাঁত বের করে হাসল। দিনের আলোয় মুক্তোর মতো বিঁকিয়ে উঠল ওর দাঁত। প্রবীন পুরুষ, সামনে জলাভূমির শেষ দেখতে পাচ্ছেন। ওগুলো গাছপালা, শুকনো জমিনের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

মেরেন ও সৈনিকদের কাছে এই খবর চালান করল তাইতা। চিৎকার করে উঠল ওরা, হাসল, পরস্পরের পিঠ চাপড়ে দিল। ওদের ফের বিশ্রাম দিতে দিল মেরেন, কারণ অনেক জোরে ছুটেছে ওরা।

ট্র্যাক দেখে নাকোন্তো আঁচ করল যে বেশি দূরে নেই লু-রা। ওরা সামনে বাড়ার সময় গাছের সারি আরও বড় ও ঘন হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু তাসত্ত্বেও জনবসতির কোনও চিহ্ন দেখতে পেল না। অবশেষে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বাহিনী নিয়ে পায়ে হেঁটে আগে বাড়ল ওরা, যাতে প্যাপিরাসের মাথার উপর দিয়ে সওয়ারিদের মাথা দেখা না যায়। দীর্ঘদিনের মাঝ দুপুরের আগে আর থামল না ওরা। এখন কেবল প্যাপিরাসের পাতলা একটা পর্দা আড়াল করে রেখেছে ওদের কিন্তু সেটাও অকস্মাৎ ফ্যাকাশে জমিনের নিচু একটা তীরের বিপরীতে শেষ হয়ে গেল। দুই কিউবিটের চেয়ে উঁচু হবে না সেটা, ওটার ওপাশে রয়েছে ছোট ছোট সবুজ ঘাসের প্রান্তর ও লম্বা গাছের বন। ওগুলোর বিরাট বিরাট বীজাধার দেখে কিগালা সসেজ গাছ, সরাসরি কাণ্ডে জন্মানো হলদে ফল দেখে সিকামোর ডুমুড় চিনতে পারল তাইতা। অন্য বেশিরভাগ প্রজাতি ওর অচেনা।

বনের আড়াল থেকে চোরাই ঘোড়র পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওরা। নরম মাটির বাধ বেয়ে উঠে গেছে। তবে ওদিকের ভোলা চারণভূমিতে পশুর কোনও চিহ্ন নেই। গাছপালার সারি পরখ করল ওরা।

ওগুলো কী? গাছপালার মাঝে ক্ষীণ নড়াচড়া আর ধূলির সূক্ষ্ম ধোঁয়াশার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল মেরেন।

মাথা নাড়ল নাকোন্তো। মোষ, ছোট পাল। ঘোড়া নেই। নোম্ভ আর আমি সামনে রেকি করতে যাচ্ছি। আপনাদের এখানেই থাকতে হবে। প্যাপিরাসের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল দুই শিলুক। সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখলেও ওদের আর দেখতে পেল না তাইতা ও মেরেন; এমনকি ভোলা চারণভূমি পার হওয়ার সময় এক ঝলকের জন্যেও না।

প্যাপিরাসের কিনারা থেকে পিছিয়ে এলো ওরা, এক চিলতে উন্মুক্ত, শুকনো জমিন খুঁজে পেল, এখানে নোজব্যাগগুলো ভর্তি করে ঘোড়াকে খেতে দিয়ে বিশ্রাম নিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মাথায় শাল মুড়ে নিয়েছে তাই। ছড়ি হাতের কাছে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ও। যারপরনাই ক্লান্ত, কাদা ভেঙে চলার ফলে পায়ে ব্যথা করছে। ঘুমের সীমানা থেকে গড়িয়ে পড়ল ও।

মন ভালো রেখ, তাইতা, আমি অনেক কাছে, ওর কণ্ঠস্বর, ক্ষীণ ফিসফিসানি, এত পরিষ্কার ও সুর এত নির্ভুলরকম ফেনের যে চমকে জেগে উঠে বসল ও। চট করে এপাশ ওপাশ তাকাল, চোখে প্রত্যাশা। কিন্তু ঘোড়া, খচ্চর, বিশ্রামরত লোকজন ও অন্তহীন প্যাপিরাস ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। ফের ঘুমিয়ে পড়ল

ঘুম ফিরে আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। কিন্তু ক্লান্ত ছিল ও, অবশেষে ওর চারপাশে জল থেকে লাফিয়ে ওঠা মাছের স্বপ্ন দেখতে লাগল, রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের মাছ থাকলেও ওর পরিচিত মাছ নেই। তারপর ঝাঁক উন্মুক্ত হতেই দেখতে পেল ওটা। মূল্যবান পাথরের মতো ঝিলিক দিচ্ছে ওটার আঁশ, অসাধারণ লেজটা দীর্ঘ ও কোমল, ওটাকে ঘিরে থাকা আভা অলৌকিক, সূক্ষ্ম। চোখের সামনেই মানুষের চেহারা নিল ওটা, অল্পবয়সী মেয়ের অবয়ব। জল বেয়ে এগিয়ে এলো, ওর দীর্ঘ নগ্ন পাজোড়া ডলফিনের মতো মোহনীয় ভঙিতে কোমরের নিচ থেকে ওঠানামা করছে। মাথার উপরের সূর্যের আলো ওর ফিকে দেহ ও পেছনে বিছিয়ে থাকা দীর্ঘ উজ্জ্বল চুলে ঝিলিক খেলছে। চিত হলো সে, জলের ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। ওর নাক থেকে ছোট ছোট রূপালি বুদ্বুদ বের হয়ে এলো। আমি কাছে এসে গেছি, তাইতা। শিগগিরই আবার একসাথে হবো আমরা। খুব শিগগির।

জবাব দেওয়ার আগেই কর্কশ স্পর্শে ওর ঘুম টুটে গেল। পরমানন্দটুকু আঁকড়ে থাকার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু সেটা কেড়ে নেওয়া হলো ওর কাছ থেকে।

ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে নাকোন্তো। ঘোড়া আর লু-শেয়ালগুলোর দেখা পেয়েছি, বলল সে। এখন ওদের মারার সময় হয়েছে।

*

প্যাপিরাসের আড়াল ছাড়ার আগে রাত নামার অপেক্ষা করল ওরা, তারপর নিচু মাটির তীর বেয়ে উন্মুক্ত চারণভূমিতে উঠে এলো। নরম বালির উপর বলতে গেলে কোনও শব্দই করছে না ঘোড়ার খুর। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে গাছপালার কাছে নিয়ে এলো ওদের নাকোন্তো, তারার পটভূমিতে ছায়ামূর্তির মতো লাগছে ওগুলোকে। প্রলম্বিত আড়াল করা ডালপালার নিচে আসার পর জলাভূমির তীর বরাবার সমান্তরাল হয়ে গেল সে। অল্প খানিকটা সময়ের জন্যে নীরবে এগিয়ে চলল ওরা, তারপরই একটা বনে ঢুকে পড়ল, এখানে মাথার উপর ঝুলে পড়া ডালপালার হাত থেকে বাঁচতে ঘোড়ার পিঠে নুয়ে পড়তে হলো ওদের। বেশি দূরে যেতে পারল না, এই সময় সামনে রাতের আকাশে গোলাপি একটা আভা দেখা দিল। ওটার দিকেই ওদের নিয়ে চলল নাকোন্তো। এখন ভয়াবহ ছন্দে ঢাকের আওয়াজ কানে আসছে। ওরা এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আরও জোরাল হয়ে উঠল শব্দটা, এক সময় পুরো রাত যেন পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডের মতো তড়পাতে লাগল। আরও কাছে যাওয়ার পর ঢাকের আওয়াজের সাথে যোগ হলো বেসুরো কোরাস।

ওদের বনের সীমানায় থামাল নাকোন্তো। মেরেনের পাশে এসে দাঁড়াল তাইতা; খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে আদিম খড় আর কাদায় লেপা কুঁড়ের বিশাল এক গ্রাম দেখতে পেল ওরা, চারটে বিরাট বনফায়ারে আলোকিত হয়ে আছে, প্রবল বেগে ফুলিঙ্গ উঠছে ওগুলো থেকে। শেষ কুঁড়েটার পেছনে ধূমায়িত তাকের সারি, মাছের কাটা লাশের টুকরোয় ঢাকা, আগুনের আলোয় রূপালি চাদরের মতো ঝিলিক খেলছে ওগুলোর আঁশ। বনফায়ার ঘিরে আনুমানিক জনা বার মানবদেহ পাক খাচ্ছে, লাফাচ্ছে। আপাদমস্তক শাদা রংয়ে রাঙানো; সেখানে কালো, হলুদ আর লাল কাদার বিচিত্র নকশা। তাইতা বুঝতে পারল ওরা উভয় লিঙ্গের, শাদা কাদা ও ছাইয়ের প্রলেপের নিচে সবাই নগ্ন। নাচার সময় বুনো ছন্দে গান গাইছে, এক পাল বুনো জানোয়ারের চিৎকারের মতো আওয়াজ হচ্ছে।

হঠাৎ, ছায়া থেকে লু-দের নর্তনকুর্দন করতে থাকা আরেকটা দল টেনে হিঁচড়ে একটা চোরাই ঘোড়া নিয়ে এলো। ঘোড়সওয়ারদের সবাই চিনতে পারল ওটাকে। স্টার্লিং নামে একটা মেয়ার। ওটার গলায় বাকলের একটা রশি পেঁচিয়েছে লু, আর সামনে থেকে টানছে অন্য পাঁচজন; ওদিকে আরও জনা বার ওটার পাশ ও পেছন থেকে ঠেলছে, তীক্ষ্ণ কাঠি দিয়ে খোঁচা মারছে। আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতস্থানে রক্ত চিকচিক করছে। দুই হাতে ভারি মুগুর তুলে নিল এক লু, তেড়ে এলো ঘোড়াটার দিকে। ওটার মাথা লক্ষ্য করে সজোরে নামিয়ে আনল। খুলিতে লাগল আঘাতটা। নিমেষে মাটিতে লুটিয়ে পা ছুঁড়তে লাগল ওটা। সবুজ তরল হয়ে বের এলো পেটের মল। রঙ চর্চিত লু-রা ঝাঁপিয়ে পড়ল লাশের উপর, পাথরের ছুরি হাঁকাচ্ছে। পশুটার কাঁপতে থাকা দেহ থেকেই খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে, মুখে পুরে দিচ্ছে তারপর। চিবুক বেয়ে রঙচঙে ধড়ে রক্ত গড়িয়ে নামছে। বুনো কুকুরের দল ওরা। মরা লাশ নিয়ে মারপিট করছে, চিৎকার করছে। ক্রোধে গর্জন ছাড়ল অপেক্ষমান সৈনিকরা।

পাশে দাঁড়ানো তাইতার দিকে তাকাল মেরেন। মাথা দোলাল ও। বামে, ডানে, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে এগোও। নিচু অথচ পরিষ্কার কণ্ঠে নির্দেশ দিল মেরেন। পাখার মতো প্রসারিত রেখায় ছড়িয়ে পড়ল দুপাশে দুটি কলাম। ওরা অবস্থান গ্রহণ করার পরই ফের হাঁক দিল মেরেন: সেনাদল আগে বাড়বে! অস্ত্র বের করো! খাপ থেকে তলোয়ার বের করে আনল ওরা। আগে বাড়ো! দৌড়াও! ছোটো! আক্রমণ!

নিবিড় ফর্মে ছুটতে শুরু করল ওরা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রয়েছে ঘোড়াগুলো। সেনাদল ঝড়ের বেগে গ্রামে ঢোকার আগে লু-রা ওদের উপস্থিতি টেরই পেল না, এত উন্মত্ত ছিল ওরা। এবার ইতিউতি ছুটে সটকে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়ার পাল ওদের মাড়িয়ে দিল, পিষে ফেলল খুরের নিচে। ওঠানামা করল তলোয়ার, হাড়-মাংসের ভেতর দিয়ে থ্যাপ শব্দ করে চলল ওগুলোর ফলা। আক্রমণের পুরোভাগে ছিল দুই শিলুক। গর্জন করছে, আঘাত হানছে, লাফ দিয়ে উঠে ফের আক্রমণ করছে।

নাকোন্তোকে একজনের শরীরের ভেতর একটা বর্শা সেঁধিয়ে দিতে দেখল তাইতা। লু-র শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে খাড়া হয়ে রইল ওটার ফলা। নাকোন্তো ওটা বের করে আনার সময় মনে হলো যেন মরা মানুষটার শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়েছে। আগুনের আলোয় কালো ফোয়ারা ছুটল।

রঙ করা নাভী পর্যন্ত ঝুলে থাকা বিশালবক্ষা এক মহিলা মাথা ঢাকতে দুই হাত শূন্যে ওঠাল। সোজা হয়ে রেকাবে দাঁড়াল মেরেন, কনুইয়ের কাছ থেকে তার একটা হাত আলগা করে দিল। পরক্ষণেই ফের তলোয়ার হাঁকাল, তরমুজের মতো দুভাগ করে দিল অরক্ষিত মুণ্ডটা। তখনও কাঁচা মাংসে ঠাসা ছিল তার মুখ, মরণ চিৎকারের সাথে ছিটকে বের হয়ে এলো সেটা। নিবিড় ফর্মেশন বজায় রেখে লু দের তাড়া করে চলল সৈনিকরা, ওদের তলোয়ার ধরা হাত মারাত্মক ছন্দে উঠছে, নামছে। যারা পালানোর চেষ্টা করছিল তাদের পাকড়াও করল শিলুকরা। ঢোলবাদকরা ফুটো করা কিগেলা গাছের কাণ্ডের সামনে এমনভাবে জমে গেছে যে চোখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত। কাঠের লাঠি দিয়ে ক্রমাগত উন্মত্ত তালে ঢোল বাজিয়ে চলল, যতক্ষণ না ঘোড়সওয়ারা ওদের পিষে ফেলল। রক্তক্ষরণে তড়পাতে তড়পাতে নিজেদের ঢোলের উপরই মারা গেল ওরা।

গ্রামের দূর প্রান্তে গতি কমাল মেরেন। পেছনে তাকিয়ে দেখল কেউ দাঁড়িয়ে নেই। স্টার্লিংয়ের লাশের চারপাশের জমিন রক্ষিত মৃতদেহে ভরা। গুঁড়ি মেরে সরে যাবার প্রয়াস পাচ্ছে আহতদের অল্প কয়েকজন। অন্যরা গোঙাচ্ছে, ধুলিতে তড়পাচ্ছে। ওদের ভেতর ছুটে বেড়াচ্ছে শিলুকরা। ভীতিকর আর্তনাদ ছেড়ে আঘাত হেনে চলেছে।

ওদের খতম করার কাজে শিলুকদের সাহায্য করো! হুকুম দিল মেরেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ঝটপট বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে গেল ওর লোকেরা। যার মাঝে সামান্য প্রাণের চিহ্ন দেখছে তাকেই শেষ করে দিচ্ছে।

মেরেনের পাশে এসে লাগাম টেনে ধরল তাই। আক্রমণের প্রথম কাতারে ছিল না ও। তবে খুব কাছে থেকে অনুসরণ করেছে। কয়েকজনকে কুঁড়ের দিকে পালিয়ে যেতে দেখেছি, বলল ও। ওদের খুঁজে বের করো, তবে মেরো না। নাকোন্তো ওদের পেট থেকে সামনের এলাকা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য বের করতে পারবে হয়তো।

ক্যাপ্টেনদের উদ্দেশ করে নির্দেশ উচ্চারণ করল মেরেন। এক কুঁড়ে থেকে আরেক কুঁড়েতে ঘুরে ঘুরে লণ্ডভণ্ড করে ফেলল ওরা। আর্তনাদ ছেড়ে বাচ্চাসহ বের হয়ে এলো দু-একজন লু নারী। গ্রামের মাঝখানে এনে জমা করা হলো ওদের। ওদের ভাষায় নির্দেশ জারি করল শিলুকরা। মাথার উপর হাত তুলে সারি বেঁধে বসতে বাধ্য করা হলো ওদের। মাদের আঁকড়ে থাকল বাচ্চারা। ওদের ভীত চোখে অশ্রু টলটল করছে।

এবার আমাদের বেঁচে যাওয়া ঘোড়াগুলোর খোঁজ করতে হবে, চিৎকার করে বলল মেরেন। নিশ্চয়ই সবকটা কেটে খেয়ে ফেলেনি। স্টর্লিংকে যেদিক থেকে হত্যা করার জন্যে টেনে হিঁচড়ে আনতে দেখেছিল কসাইদের, সেই বনের দিকে ইঙ্গিত করল। সেনাদল নিয়ে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল হিলতো। সহসা হেষা ধ্বনি করে উঠল একটা ঘোড়া।

এখানেই আছে! খুশিতে চিৎকার বরে উঠল হিলতো। মশাল নিয়ে এসো!

কুঁড়ের ছাদ থেকে খড় খসিয়ে নিয়ে কোনওমতে মশাল তৈরি করল সৈনিকরা, ওগুলো জ্বেলে হিলতোকে অনুসরণ করে অন্ধকারে প্রবেশ করল। পাঁচজনকে বন্দি নারী-শিশুদের পাহারায় রেখে মশালধারীদের অনুসরণ করল মেরেন ও তাই। সামনে হিলতো ও ওর লোকেরা চিৎকার করে পথ বাৎলে দিচ্ছে, এক সময় গাঢ় হয়ে আসা আলো চোরাই পশুগুলোকে স্পষ্ট করে তুলল।

ঘোড়া থেকে নেমে ওদের কাছে দৌড়ে গেল তাইতা ও মেরেন। কয়টা বাকি আছে? তাগিদের সুরে জানতে চাইল মেরেন।

মাত্র এগারটা। শেয়ালের কছে ছয়টা খুইয়েছি আমরা, জবাব দিল হিলতো। ছোট একটা দড়ি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে একই গাছের সাথে সবগুলোকে বেঁধে রেখেছে লু-রা। এমনকি মাটিতে মাথা নামাতে পারছে না ওরা।

ওদের ঘাস বা পানি খেতে দেওয়া হয়নি, সক্রোধে বলে উঠল হিলতো। কেমন জানোয়ার এই লোকগুলো?

ওদের মুক্ত করো, নির্দেশ দিল মেরেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে হুকুম তামিল করতে ছুটে গেল তিনজন সৈন্য। কিন্তু ঘোড়াগুলো খুব কাছাকাছি থাকায় ঠেলেঠুলে ঢুকতে হলো ওদের।

হঠাৎ যন্ত্রণা ও ক্রোধে গর্জে উঠল ওদের একজন। সাবধান! এক লু লুকিয়ে আছে এখানে। ওর কাছে বর্শা আছে, আমাকে আহত করেছে।

সহসা হুটোপুটি এবং তারপর ঘোড়ার খুরের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ ছেলেমানুষী চিৎকার ভেসে এলো।

ধরো ওকে! পালাতে দিয়ো না।

কী হচ্ছে ওখানে? জানতে চাইল মেরেন।

একটা বাচ্চা জংলী লুকিয়ে আছে এখানে। সেই বর্শার ঘাই মেরেছে আমাকে।

এই সময় ঘোড়ার পালের ভেতর থেকে বেগে ছুটে এলো একটা ছেলে, হাতে হালকা আসেগেই। এক সৈনিক ধরার চেষ্টা করল তাকে, কিন্তু তাকে আঘাত করে গ্রামের দিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। অদৃশ্য হওয়ার আগ মুহূর্তে চকিতের জন্যে তাকে দেখলে তাইতা, তবে কিছুটা ভিন্ন কিছু চোখে লাগল ওর। এমনকি ছোট লু-রাও গাট্টাগোট্টা, বাঁকা পায়ের হয়। কিন্তু এটি প্যাপিরাসের বাকলের মতোই ছিপছিপে, পাজোড়া মোহনীয় ঋজু। সন্ত্রস্ত গেযেলের মতো মোহনীয় ভঙ্গিতে ছুটছে। সহসা তাইতা উপলব্ধি করল শাদা কাদা আর গোত্রীয় নকশার আড়ালে ওটা আসলে একটা মেয়ে, দেইজা ভ-র তীব্র অনুভুতিতে আক্রান্ত হলো ও। সব দেবতার কসম খেয়ে বলছি, ওকে আগেও দেখেছি আমি, আপনমনে বিড়বিড় করে বলল ও।

পিচ্চি শয়তানটাকে পাকড়াও করার পর ধীরে ধীরে খুন করব! ছেলেটাকে যেখান থেকে বের করেছে, সেই ঘোড়াগুলোর ভেতর থেকে বের হয়ে আসার সময় চিৎকার করে বলে উঠল আহত সৈনিক। ওর বাহুতে বর্শার আঘাতের চিহ্ন। আঙুলের ডগা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।

না! তাগিদের সুরে চিৎকার করল তাইতা। ও একটা মেয়ে। ওকে জীবিত চাই আমি। গ্রামের দিকে গেছে ও। এলাকাটা ঘিরে ফেল, কুঁড়েগুলোয় ফের তল্লাশি চালাও। যেকোনও একটায় গাঢাকা দিতে গেছে সে।

উদ্ধার করা ঘোড়াগুলোর ব্যবস্থা করতে অল্প কয়েকজন লোক রেখে কুঁড়েগুলোর চারপাশ ঘেরাও করে ফেলল মেরেন। নাকোন্তো ও নোস্তুকে জিজ্ঞাসাবাদ করল তাইতা। নারী-শিশুদের পাহারা দিচ্ছিল ওরা। এদিকে একটা বাচ্চাকে পালিয়ে যেতে দেখেছ? এতটা লম্বা, ওদের বাকি সবার মতো শাদা কাদায় ঢাকা?

মাথা নাড়ল ওরা।

ওরা ছাড়া, কাঁদতে থাকা বন্দিদের দিকে ইঙ্গিত করল নাকোন্তো। আর কাউকে দেখিনি।

বেশি দূরে যেতে পারেনি, ওকে আশ্বস্ত করল মেরেন। গ্রাম ঘিরে ফেলেছি আমরা। পালাতে পারবে না। ওকে আমরা খুঁজে বের করব। প্রতিটি কুঁড়েয় তল্লাশি চালাতে হাবারির প্লাটুনটাকে পাঠাল ও। সে ফিরে এলে তাইতাকে জিজ্ঞেস করল, এই খুনে ছুরিটা আপনার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন, ম্যাগাস?

আমি নিশ্চিত নই, তবে আমার ধারণা সে লু-দের কেউ নয়। অন্য রকম। এমনকি মিশরিয়ও হতে পারে।

আমার তাতে সন্দেহ আছে, ম্যাগাস। মেয়েটা বর্বর। নগ্ন, রঙচঙা।

ধরো ওকে, ধমকে বলল তাইতা।

এই সুর মেরেনের পরিচিত। ঝটপট তল্লাশির দায়িত্ব নিল ও। ধীরে, সাবধানে এগিয়ে গেল লোকগুলো, পেটে বর্শার ঘাই খাওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ওরা অর্ধেক গ্রাম তল্লাশি শেষ করার পর জঙ্গলের মাথার উপর ভোরের আলোয় ভরে উঠল। তাই অস্থির, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একটা কিছু খুঁচিয়ে চলেছে ওকে। স্মৃতির ভাণ্ডারে কোনও উঁদুরের মতো। একটা কিছু মনে করতেই হবে।

ভোরের হাওয়া দক্ষিণে বাঁক নিচ্ছে, ঝলসানোর তাক থেকে আধপচা মাছের গন্ধ বয়ে আনছে। গন্ধ এড়াতে সরে গেল ও। সাথে সাথে ভিড় করে এলো কাঙ্ক্ষিত স্মৃতি।

আর কোথায় চাঁদ মাছের খোঁজ করবে? অন্য মাছের মধ্যে লুকোনো অবস্থায় আমাকে পাবে তুমি। ফেনের কণ্ঠস্বর ছিল ওটা, দেবীর পাথুরে মূর্তির মুখ দিয়ে কথা বলছিল। তবে কি ওরা যে বাচ্চাকে ধাওয়া করছে সে সৃষ্টি চক্রে আটকা পড়া কোনও আত্মা? অনেক দিন আগে বেঁচে ছিল এমন কারও অবতার?

আমাকে ফিরে আসার কথা দিয়েছিল ও, জোরে বলল ও। এটা সম্ভব-নাকি আমার নিজের আকাঙ্ক্ষাই আমাকে প্রতারিত করছে? এবং নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিল: এমন কিছু ব্যাপার আছে যা মানুষের সবচেয়ে অসম্ভব কল্পনাকেও হার মানায়। অসম্ভব বলে কিছু নেই।

কেউ ওদের লক্ষ করছে না নিশ্চিত হতে চট করে চারপাশে তাকাল তাই। তারপর সহজ পায়ে গ্রামের কিনারায় চলে এলো। মাংস ঝলসানোর তাকগুলোর মাঝে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দৃষ্টিসীমার বাইরে আসামাত্র বদলে গেল ওর চেহারার অভিব্যাক্তি। শিকারের খোঁজে বাতাসে গন্ধ শোঁকা কুকুরের মতো দাঁড়াল ও। স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। খুব কাছেই আছে ও, বলতে গেলে ওর উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে। ওর আসেগেইর আঘাত ঠেকাতে ছড়িটা তৈরি রেখে সামনে এগোল ও। কয়েক কদম পরপরই হাঁটু ভেঙে বসে ঠাসাঠাসি করে মাছ গেঁথে রাখা তাকগুলোর নিচ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। ক্ষণে ক্ষণে লাকড়ির বান্ডিল আর ধোঁয়ার মেঘ বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ওর দৃষ্টিপথে। মেয়েটা আড়ালে লুকিয়ে নেই নিশ্চিত হতে প্রতিটি কাঠের তূপ ঘিরে চক্কর দিতে হচ্ছে। ফলে ওর আগ্রগতি ধীর হয়ে গেল। ইতিমধ্যে প্রথম সূর্যের রশ্মি গ্রামকে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছে। তারপর, যেই আরেকটা কাঠের তূপ ঘিরে নিঃশব্দে চক্কর খাবে, সামনে ক্ষীণ একটা নড়াচাড়ার আওয়াজ পেল। কোণ থেকে উঁকি দিল ও। কেউ নেই ওখানে। মাটির দিকে তাকাতেই ধূসর ছাইয়ের উপর ছোট্ট ছোট্ট নগ্ন পায়ের ছাপ দেখতে পেল। ওকে তাড়া করা হচ্ছে, জানে মেয়েটা, ওর ঠিক সামনে থেকে আগে বাড়ছে, এক স্তূপ থেকে নিমেষে আরেক তূপে লুকাচ্ছে।

মেয়েটার চিহ্নও নেই। এখানে নেই সে, কাল্পনিক সঙ্গীর উদ্দেশে বলল তাইতা, তারপর ফের গ্রামের পথ ধরল। শব্দ করে হাঁটছে ও, হাতের ছড়ি দিয়ে তাকে আঘাত হানছে, তারপর একটা প্রশস্ত বৃত্তের আকারে ঘুরল ও, দ্রুত, নিঃশব্দে এগোচ্ছে।

শেষবার যেখানে মেয়েটার পায়ের ছাপ দেখেছিল সেখানে পৌঁছল ও। তারপর একটা কাঠের তূপের পেছনে বসে মেয়েটার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সামান্য নড়াচড়া বা শব্দ শোনার জন্যে কান খাড়া করে রেখেছে। এখন ওকে না দেখে মেয়েটা ভীত হয়ে উঠবে। ফের অবস্থান বদলাবে। চারপাশে গাঢাকা দেওয়ার জাদু ছড়িয়ে দিল ও। তারপর পর্দার আড়াল থেকে মেয়েটার দিকে হাত বাড়াল। ইথারে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

আহ! মেয়েটাকে খুঁজে পেতেই বিড়বিড় করে বলল ও। খুব কাছেই আছে, তবে নড়ছে না। ওর ভীতি ও অনিশ্চয়তা টের পেল তাইতা: ওর অবস্থান জানে না সে। একটা কাঠের তূপের নিচে লুকাতে দেখল ওকে। সমস্ত শক্তি এবার ওর ওপর নিবদ্ধ করল তাইতা। মেয়েটাকে নিজের দিকে প্রলুব্ধ করতে অনুভূতি পাঠাচ্ছে।

ম্যাগাস? আপনি কোথায়? গ্রামের দিক থেকে ডাক ছাড়ল মেরেন। জবাব না পেয়ে কণ্ঠে তাগিদ ফুটে উঠল তার। ম্যাগাস, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? তাইতা যেখানে অপেক্ষা করছিল সেদিকে পা বাড়াল সে।

ঠিক আছে, ওকে নীরবে উৎসাহ যোগাল তাইতা। আসতে থাকো। ওকে নড়তে বাধ্য করবে তুমি। আহ! ওই যে চলে যাচ্ছে ও।

আবার নড়ছে মেয়েটা। কাঠের নিচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এসে ওর দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে এখন। মেরেনের সামনে দৌড়াচ্ছে।

এসো, ছোট্ট সোনা। চারপাশে জাদুর আঁকশী জোরদার করে তুলল ও। কাছে এসো।

ম্যাগাস! আরও কাছ থেকে আবার চিৎকার করল মেরেন। কাঠের স্তূপের কোণে তাইতার সামনে হাজির হলো মেয়েটা। থেমে মেরেনের কণ্ঠস্বরের উৎসের দিকে তাকাল। ত্রাসে মেয়েটাকে কাঁপতে দেখল তাইতা। ওর দিকে তাকাল সে। ওর চেহারা কাঁদার এক ভীতিকর মুখোশ, মাথার চুল দেখে মনে হচ্ছে কাঁদা আর বাবলা গাছের আঠা দিয়ে মাথার উপর তূপ করে বাঁধা হয়েছে। আগুনের ধোঁয়ায় চোখজোড়া রক্তলাল হয়ে গেছে, আর চুল থেকে গড়িয়ে পড়া রংয়ের কারণে ভুরুর রঙ ধরতে পারল না তাই। ওর দাঁত জোর করে কালো করা। ওদের আটক করা লু-নারীদের সবার দাঁতই কালো করা; ওদের চুল বাঁধার কায়দাও একই রকম। স্পষ্টতই, ওদের সৌন্দর্যের আদিম ধারণা এটা।

সন্ত্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় কাত হলো মেয়েটার মাথা। অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। ওর চারপাশে লাফ দিয়ে উঠল আভা। জীবন্ত আলোর সূক্ষ্ম একটা জোব্বা আবৃত করল ওকে। ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিল। কাদার ভুতুড়ে প্রলেপের নিচে নোংরা অসহায় মেয়েটা ফেন। ওর কাছে ফিরেছে ও। যেমন কথা দিয়েছিল। ওকে এমন একটা অনুভূতি ভাসিয়ে নিল যেমনটা ওর দীর্ঘ জীবনে একবারও ঘটেনি। ওর মৃত্যুর সময় ওকে গ্রাস করে নেওয়া শোকের প্রাবল্য অতিক্রম করে গেল তা, যার ফলে ওর অন্য জীবনে অবসান ঘটেছিল। ওর নাড়িভূঁড়ি বের করে লিনেন ব্যান্ডেজে মুড়ে পাথুরে শবাধারে রেখে দিয়েছিল যখন।

এখন এতগুলো নিঃসঙ্গ মলিন বছর আগে ঠিক যেমনটা ওর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ঠিক সেই বয়সে আবার জীবিত করে তোলা হয়েছে ওকে। এই একটি মাত্র আনন্দের প্রতাঁকের ভেতর দিয়ে সমস্ত দুঃখ আর বিষাদের অবসান ঘটেছে। ওর দেহের প্রতিটি তন্ত্রী, পেশি ও স্নায়ু অনুরণিত হচ্ছে সেই খুশিতে।

এতে চারপাশে গড়ে তোলা আড়ালের পর্দায় ব্যাঘাত ঘটল। সাথে সাথে টের পেয়ে গেল বাচ্চাটা। ঘুরে ওর দিকে তাকাল সে, ওর রক্তলাল চোখ ভুতুড়ে মুখোশের কারণে বিশাল দেখাচ্ছে। ওর উপস্থিতি টের পেলেও ওকে দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটার ক্ষমতা আছে বুঝতে পারল ও। এখনও ওর মানসিক ক্ষমতা পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু তাইতা জানে ওর মায়াভরা শিক্ষায় এক সময় ওর সমকক্ষ হয়ে উঠবে সে। উদীয়মান সূর্য মেয়েটার চোখে একটা রশ্মি পাঠাল। ফলে গাঢ় সবুজ হয়ে ফুটে উঠল চোখজোড়ার আসল ঔজ্জ্বল্য। ফেনের সবুজ।

ওদের দিকে ছুটে আসছিল মেরেন। কঠিন মাটিতে জোরাল শব্দ তুলছে ওর পা। ফেনের সামনে একটাই পালানোর পথ রয়েছে: মাংস ঝলসানোর তাক আর কাঠের তূপের মাঝখানের সংকীর্ণ জায়গাটা। সোজা তাইতার বাহুতে এসে ধরা দিল ও। দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরতেই প্রবল ভয় আর বিস্ময়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল ও। আসেগেইটা ফেলে দিল হাত থেকে। নিজেকে ছুটিয়ে নিতে যুঝতে গিয়ে ওর চোখে মুখে আঁচড়ে কামড়ে দিলেও বুকের সাথে ওকে ঠেসে ধরে থাকল তাইতা। ওর আঙুলের নখগুলো তীক্ষ্ণ, ভাঙা। নখের নিচে কালো কাদা আটকে আছে। তাইতার শরীর আর কপালে রক্তাক্ত আঁচড় কাটল ওগুলো। এক হাতে ওকে ধরে রেখে এক এক করে হাত দুটো ধরে শরীরের সাথে চাপ দিল। মেয়েটা এখন অসহায় হয়ে পড়ায় মুখটা সামনে নিয়ে ভালো করে চোখের দিকে তাকাল। ওর উপর নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করল। নিমেষে ও কী করছে বুঝে গেল ফেন। ওর সাথে মিলতে সামনে ঠেলা দিল। কিন্তু সময় মতোই ওর মনের ভাব বুঝে গেল তাইতা, ঝট করে মাথা পেছনে সরিয়ে নিল ও। ওর নাকের ডগা থেকে এক আঙুল সমান দূরত্বে কপাত করে বন্ধ হলো ওর মুখ।

আমার দুচোখের আলো, এখনও বুড়ো এই নাকটার দরকার আছে আমার। তোমার খিদে লেগে থাকলে আরও স্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করব আমি, হেসে বলল তাইতা।

ঠিক এই সময় ঝড়ের বেগে অকুস্থলে হাজির হলো মেরেন। ওর চোখে মুখে আতঙ্ক আর সতর্কতার ভাব। ম্যাগাস! চিৎকার করে উঠল সে। নোংরা বিষাক্ত জিনিসটাকে আপনার কাছে ঘেঁষতে দেবেন না। এরই মধ্যে একজনকে মারার চেষ্টা করেছে সে। এখন আপনাকে মারাত্মকভাবে আহত করে বসতে পারে। ওদের দিকে ছুটে এলো সে। ওকে ধরতে দিন। জলাভূমিতে নিয়ে সবচেয়ে কাছের পুকুরে ডুবিয়ে মারি।

পিছিয়ে যাও, মেরেন! গলা না চড়িয়েই বলল তাইতা। ওকে স্পর্শ করবে না।

নিজেকে সামলে নিল মেরেন। কিন্তু, ম্যাগাস, সে তো-

তেমন কিছুই সে করবে না। যাও, মেরেন। আমাদের একা থাকতে দাও। আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। এইমাত্র ওকে সেটা বুঝিয়েছি আমি।

তারপরও দ্বিধায় ভুগল মেরেন।

যাও, বললাম না। এখুনি।

চলে গেল মেরেন।

ফেনের চোখের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাসল তাইতা। ফেন, তোমার জন্যে অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছি আমি। শক্তির কণ্ঠ ব্যবহার করছে ও। কিন্তু প্রবলভাবে ওকে প্রতিহত করল সে। থুতু ফেলল, ওর লালার বুদ্বুদ মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়তে লাগল চিবুক থেকে।

আমাদের প্রথম পরিচয়ের সময় তুমি এত শক্তিশালী ছিলে না। রাগি আর বিদ্রোহী ছিলে বটে, কিন্তু এখনকার মতো এত শক্তিশালী নও। শব্দ করে হাসল তাইতা, চোখ পিটপিট করল ফেন। এমন শব্দ কখনও কোনও লু-র মুখ থেকে বের হয়নি। ওর চোখের সবুজ গভীরতায় পলকের জন্যে কৌতূহলের একটা ঝিলিক খেলে গেল। তারপর ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল মেয়েটা।

তখন কত সুন্দর ছিলে তুমি, কিন্তু এখন নিজের দিকে তাকাও তো একবার। ওর কণ্ঠে এখনও সম্মোহনী শক্তি বইছে। তুমি শূন্য থেকে আসা একটা দৃশ্য। কথাটাকে আদরের মতো বোঝাতে চাইল ও। তোমার চুল নোংরা হয়ে গেছে। চুলে হাত বোলাল ও, কিন্তু সরে যাবার চেষ্টা করল ফেন। পুরু কাদা আর বাবলা গাছের আঠার নিচে চুলের আসল রঙ আন্দাজ করা সহজ না। কিন্তু কণ্ঠস্বর শান্ত রাখল ও, উকুনের একটা স্রোত জটা থেকে বের হয়ে ওর হাত বেয়ে উঠে আসতে শুরু করলেও আশ্বাস জাগানিয়াই রইল ওর হাসি।

অহুরা মাযদা আর সত্যির কসম, তোমার গায়ে মেরুবেড়ালের চেয়েও বেশি দুর্গন্ধ, ওকে বলল তাইতা। তোমার আসল চামড়া পর্যন্ত পৌঁছতে অন্তত এক মাস ডলাডলি করতে হবে। মুক্ত হওয়ার জন্যে কিলবিল করতে লাগল সে। এবার তোমার গায়ের ময়লা আমার গায়ে তুলে দিচ্ছ। তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর দেখা যাবে আমার অবস্থা তোমার চেয়ে খুব ভালো নেই। মেরেন আর ওর সৈনিকদের থেকে দূরে গিয়ে শিবির করতে হবে আমাদের। এমনকি সৈনিকরাও আমাদের দুজনের গন্ধ একসাথে সহ্য করতে পারবে না। কথা বলে চলল ও কথার অর্থ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে বলার সুর ও প্রভাব আস্তে আস্তে ওকে প্রভাবিত করল। তাই টের পেল শিথিল হয়ে আসছে মেয়েটা, সবুজ চোখের বৈরী আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। প্রায় নিন্দ্রালু ঢঙে পিটপিট করছে চোখের পাতা। হাতের বাঁধন শিথিল করল ও। সাথে সাথে আঁকি দিয়ে নিজেকে জাগিয়ে তুলল সে। আবার বৈরীভাবে জ্বলে উঠল। মেয়েটা আবার নতুন করে যুঝতে শুরু করায় বাঁধন শক্ত করতে বাধ্য হলো তাই।

তোমাকে বাগ মানানো কঠিন, কণ্ঠে সমীহ ও অনুমোদনের সুর ফুটিয়ে তুলল তাইতা। তোমার মনটা যোদ্ধার, এককালে দেবী ছিলে সেই দৃঢ়তা আছে এখনও। এবার আরও দ্রুত শান্ত হয়ে গেল সে। টিউনিকের নিচে তাইতাকে কামড়ে দিল বিদায়ী উকুনের দল। উপেক্ষা করে কথা বলে চলল ও।

তোমার সম্পর্কে বলতে দাও, ফেন। এককালে আমার হেফাযতে ছিলে তুমি, যেমনটা আবার হয়েছ। আজও আমি বুঝতে পারি না কেমন করে তিনি তোমার মতো এমন অসাধারণ একটা জিনিস জন্ম দিয়েছিলেন। তুমি বলার বাইরে সুন্দরী ছিলে, ফেন। মাছি, উকুন আর নোংরার নিচে, আমি জানি এখনও তাই আছো। ধীরে ধীরে দরদভরা বিস্তারে ছেলেবেলার কাহিনী বলার সময় ওর প্রতিরোধ শিথিল হয়ে এলো। ওর বেশ কয়েকটা মজার কথা বা ঘটনার কথা রোমন্থন করল ও। ফের চোখ পিটপিট করতে শুরু করল সে। তাই বাঁধন শিথিল করলেও এবার পালানোর চেষ্টা না করে ওর কোলে শান্ত হয়ে বসে পড়ল। অবশেষে তাই যখন উঠে দাঁড়াল সূর্যটা মধ্য গগনে উঠে এসেছে। গম্ভীর চেহারায় ওর দিকে তাকাল ফেন। ওর হাত ধরার জন্যে হাত বাড়াল তাইতা। সরে গেল না ও।

আমার সাথে চলো এখন। তোমার খিদে না লেগে থাকলেও আমার লেগেছে। গ্রামের পথ ধরল ও। ওর পাশে পাশে দ্রুত পায়ে এগোল মেয়েটা।

গ্রাম থেকে বেশ তফাতে একটা সাময়িক শিবির গেড়েছে মেরেন: রোদে পড়ে থাকা লু-দের লাশগুলো অচিরেই পচতে শুরু করবে। এলাকা অসহনীয় হয়ে যাবে। শিবিরের দিকে এগিয়ে যেতেই মেরেন এসে যোগ দিল। আপনাকে দেখে খুশি হলাম, ম্যাগাস, চিৎকার করে বলল সে। ভেবেছিলাম পাগলীটা বুঝি আপনাকে শেষ করে দিয়েছে। তাইতার পেছনে লুকিয়ে আছে ফেন, মেরেন ওদের কাছে এগিয়ে আসতেই ওর একটা পা আঁকড়ে ধরল সে। হোরাসের বিক্ষত চোখের দোহাই, মেয়েটার গায়ে কী গন্ধ রে বাবা। এখান থেকেও গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

গলা নামাও, হুকুম দিল তাইতা। ওকে নিয়ে মাথা ঘামিও না। ওর দিকে এভাবে তাকিয়ো না, তাহলে আমার কঠিন পরিশ্রম নিমেষে নষ্ট করে দেবে। আমাদের আগে আগে গিয়ে শিবির ও তোমার লোকদের বলে দাও কেউ যেন ওর দিকে না তাকায় বা ওকে ভয় পাইয়ে না দেয়।

এবার তবে একটা বুনো ছুকরিকে পোশ মানাতে হবে আমাদের? অনুতাপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেরেন।

ওহ, না! আমাদের সামনের কাজটাকে খাট করে দেখছ তুমি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা।

*

শিবিরের ঠিক মাঝখানে বিরাট সসেজ গাছের নিচে ছায়ায় বসেছে তাইতা ও ফেন। একজন লোক খাবার নিয়ে এলো। প্রথমে ধুরা পিঠা পরখ করে দেখল ফেন, কিন্তু প্রথম গ্রাস মুখে নেওয়ার পর গোগ্রাসে খেল। তারপর ঠাণ্ডা হাঁসের বুকের মাংসের দিকে নজর দিল। এত দ্রুত সেগুলো মুখে পুরতে লাগল যে দম আটকে যাবার দশা হলো।

বুঝতে পারছি ফারাওর সাথে খেতে বসার জন্যে তৈরি হওয়ার আগে সবক দিতে হবে তোমাকে, কালো দাঁতে হাঁসের হাড় চিবুতে দেখে মন্তব্য করল তাইতা। শীর্ণ পেটটাকে যখন খেতে খেতে প্রায় ফাটানোর উপক্রম করেছে, নাকোন্তোকে ডাকল তাইতা। বাকি সবার মতোই ভদ্র দূরত্ব থেকে এতক্ষণ লক্ষ করছিল সে, এবার ওদের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। তাইতার কাছে ঘেঁষে এলো ফেন। নতুন করে সন্দিহান চোখে বিশালদেহী মানুষটাকে দেখছে।

বাচ্চাটাকে নাম জিজ্ঞেস করো। আমি নিশ্চিত, সে লু ভাষা জানে, এই ভাষায়ই কথা বলে সে। নির্দেশ দিল তাইতা, ওকে কয়েকটা কথা বলল নাকোন্তো। বোঝা গেল কথাগুলো বুঝতে পেরেছে সে, কিন্তু কঠিন জেদ আর একরোখাভাবে চেপে থাকল তার মুখটা। আরও খানিকক্ষণ ওকে উত্তর দিতে প্রভাবিত করার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু মচকাল না ফেন।

কোনও বন্দি লু মহিলাকে নিয়ে এসো, নাকোন্তোকে বলল তাইতা। অল্প সময়ের জন্যে ওদের ছেড়ে চলে গেল সে। ফিরে এলো যখন, তার সাথে গ্রামের এক বিলাপরতা বয়স্কা মহিলা।

জিজ্ঞেস করো, এই মেয়েটাকে চেনে কিনা, বলল তাইতা।

কান্না থামিয়ে মহিলাকে কথা বলতে বাধ্য করতে ধমকের সুরে কথা বলতে হলো নাকোন্তাকে। তবে অবশেষে লম্বা চওড়া একটা বিবৃতি ঝাড়ল সে। ওকে সে চেনে, তরজমা করল নাকোন্তো। বলছে ও একটা একটা ডাইনী। ওকে ওরা গ্রাম ছাড়া করেছিল, কিন্তু বনের খুব কাছে থাকে সে, গোত্রের উপর ডাকিনীবিদ্যা নিয়ে এসেছে সে। ওদের ধারণা সেই ওদের লোকজন মেরে ফেলতেই আপনাকে পাঠিয়েছে।

তার মানে বাচ্চাটা ওদের গোত্রের নয়? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

বয়স্কা মহিলার জবাবটা ছিল প্রবল অস্বীকৃতি। না, অচেনা মানুষ সে। আগাছায় বানানো একটা ছোট নৌকার ভেতর ওকে পায় ওদের এক মেয়ে। মিশরিয় গ্রামীণ নারীরা বাচ্চা রাখার জন্যে প্যাপিরাসে যে ধরনের দোলনা বোনে সেগুলোর বর্ণনা দিল নাকোন্তা। শয়তানটাকে গ্রামে নিয়ে আসে সে, ওর নাম রাখে খোনা মানযি, মানে, জল থেকে এসেছে যে। ওই মহিলা নিঃসন্তান ছিল বলে স্বামী তালাক দিয়েছিল তাকে। এই অচেনা চিড়িয়াটাকে আপন করে নেয় সে। মেয়েটার বিশ্রী চুল সুন্দর করে বেঁধে দিয়েছিল। ওকে সূর্য আর পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে মাছের মতো শাদা শরীর ছাই-কাদায় লেপে দিয়েছে; যেমনটা রেওয়াজ ও মানানসই। ওকে খাইয়েছে, যত্ন নিয়েছে। পরিষ্কার বিতৃষ্ণার সাথে ফেনের দিকে তাকাল বয়স্কা মহিলা।

সেই মহিলা এখন কোথায়? জানতে চাইল তাইতা।

দুষ্ট বাচ্চাটার ডাকিনী বিদ্যার সাথে নিয়ে আসায় কী এক রোগে মারা গেছে।

সেজন্যেই ওকে গ্রাম ছাড়া করেছিলে?

শুধু এ-কারণে নয়। আমাদের উপর আরও অনেক দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। সে। ওর আসার মৌসুমেই গ্রামের পানি নষ্ট হয়; যে জলাভূমি আমাদের দেশ, শুকিয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে। দুষ্ট বাচ্চাটারই কাজ ছিল এটা। ক্রোধে বিজবিজ করতে লাগল মহিলা। আমাদের উপর রোগ বয়ে এনেছে সে, বাচ্চাদের অন্ধ করেছে, অনেক অল্প বয়সী মেয়েকে বন্ধ্যা আর আমাদের পুরুষদের নপুংসক করেছে।

এই একটা মেয়ের কারণে? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

মহিলার উত্তর তরজমা করে দিল নাকোন্তো। সাধারণ বাচ্চা নয় সে। শয়তান, ডাইনী। আমাদের গোপন জায়গায় শত্রুদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, আমাদের বিরুদ্ধে জিতিয়ে দিয়েছে ওদের। ঠিক যেভাবে এখন আমাদের উপর আক্রমণ চালাতে তোমাদের নিয়ে এসেছে।

প্রথম বারের মতো কথা বলে উঠল ফেন। তিক্ত রাগে ভরা ওর কণ্ঠস্বর।

মহিলা মিথ্যে বলছে, বলছে সে। এসব কিছুই করেনি সে। মহিলাকে সে ভালোবাসত, ওর মা ছিল সে, তাকে ও হত্যা করেনি। একই রকম বিষাক্ত সুরে এই কথার জবাব দিল মহিলা। তারপর পরস্পরের উদ্দেশে চিৎকার শুরু করে দিল।

কিছুক্ষণ কিঞ্চিত আগ্রহের সাথে ওদের কথা শুনল তাইতা, তারপর নাকোন্তোকে বলল, মহিলাকে ফের গ্রামে নিয়ে যাও। বাচ্চাটার পক্ষে সুবিধার নয় সে।

হেসে উঠল নাকোন্তা। পোশ পশু হিসাবে একটা সিংহের বাচ্চা পেয়েছেন আপনি, প্রবীন জন। আমরা সবাই ওকে ভয় পেতে শিখব।

ওরা চলে যাবার পর শান্ত হয়ে এলো ফেন।

এসো, ওকে আমন্ত্রণ জানাল তাইতা। কথাগুলো না বুঝলেও অর্থ ধরতে পারল সে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। তাই সরে যেতেই দৌড়ে এলো ওর পিছন পিছন। আবার ওর হাত ধরল। এই অকপট ভঙ্গিতে গভীরভাবে আন্দোলিত হলো তাইতা। স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল মেয়েটা। কিছু না বুঝলেও ওর কথার জবাব দিল তাইতা। স্যাডল ব্যাগের কাছে এসে অস্ত্রপচারের সরঞ্জামের চামড়ার ব্যাগটা খুঁজে বের করল ও। মেরেনের উদ্দেশে কথা বলতে একটু কেবল থামল বাকি লোকজন আর ঘোড়াগুলো জলাভূমি থেকে এখানে নিয়ে আসতে পাঠাও নোম্ভেকে। নাকোন্তোকে আমাদের সাথে রাখো, কারণ এখানে সে-ই আমাদের চোখ আর জিভ।

এবার ফেনকে সাথে করে জলাভূমির কিনারে এসে নিচে নেমে আগাছার মাঝে এক চিলতে খোলা জায়গা খুঁজে বের করল। জল ভেঙে কোমর সমান গভীর জলে নেমে গেল ও। কুসুম গরম পানিতে হাঁটু গেড়ে বসল। কৌতূহলের সাথে কিনারা থেকে ওকে লক্ষ করছে ফেন। তাইতা মাথার উপর দিয়ে আঁজলা ভর্তি পানি ছুঁড়ে দিতেই প্রথমবারের মতো হাসিতে ভেঙে পড়ল মেয়েটা।

এসো, ডাকল তাইতা। কোনও দ্বিধা ছাড়াই পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। ওকে পেছন ফিরিয়ে দুহাঁটুর মাঝখানে বসাল তাইতা; তারপর ওর মাথায় জল ঢালতে লাগল। নোংরা আবর্জনার মুখোশ গলে যেতে শুরু করল, গড়িয়ে পড়তে লাগল ওর ঘাড় আর কাঁধের উপর দিয়ে। আস্তে আস্তে উকুনের কামড়ের দাগঅলা ফ্যাকাশে ত্বক দেখা দিল এখানে ওখানে। ওর চুলের ময়লা পরিষ্কার করতে যেতেই জমাট আঠা ওর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়ার যোগাড় করল। খুলির চুল ধরে টানাটানি করতেই খিলখিল করে হেসে প্রতিবাদ জানাল ফেন।বেশ, ভালো। পরে এর ব্যবস্থা করা যাবে। ওকে দাঁড় করিয়ে পুকুরের তলা থেকে মুঠি ভর্তি বালি নিয়ে ওর সারা শরীর ডলতে শুরু করল তাইতা। পাঁজরে সুরসুরি দিতেই হেসে উঠল সে, অনিচ্ছাভরে সরে যাওয়ার প্রয়াস পেল; কিন্তু তাই ওকে টেনে ধরার পরও হাসতে লাগল। ওর মনোযোগ উপভোগ করছে। অবশেষে যখন উপরের ময়লা পরিষ্কার করে ফেলল, অস্ত্রপচারের বান্ডিল থেকে একটা ব্রোঞ্জের খুর বের করে ওর মাথা কামাতে লেগে গেল। যারপরনাই যত্নের সাথে জট বাঁধা চুল মুড়িয়ে দিতে লাগল ও।

নিরাসক্তভাবে ব্যাপারটা মেনে নিল সে। ক্ষুরের পোঁচে চামড়া কেটে গেল; রক্ত বেরুল। জট বাঁধা চুল ভোঁতা করে দেওয়ায় একটু পরপর ক্ষুরে ধার দিতে হচ্ছে। থোকা থোকা চুল খসে পড়ছে। আস্তে আস্তে উন্মুক্ত হলো ফ্যাকাশে খুলি। অবশেষে কাজটা শেষ হলে ক্ষুরটা একপাশে নামিয়ে রেখে মেয়েটাকে জরিপ করল ও। তোমার কান কী বিরাট! বলে উঠল ও। সরু ঘাড়ের তুলনায় ওর মাথাটা অনেক বড় মনে হচ্ছে। সে তুলনায় চোখজোড়া আরও বড়। বাচ্চা হাতির মতো দুপাশে খুলির সাথে লেপ্টে আছে কানজোড়া। যেকোনও কোণ থেকে দেখ, যেমন আলোতে, তোমাকে সব রকম সন্দেহ থেকে মুক্তি দিলেও এখনও সেই কুৎসিত পিচ্চিই আছে। ওর কণ্ঠে দরদটা টের পেল সে। কালো দাঁত বের করে আস্থার হাসি দিল। চোখের পাতায় অশ্রুর রেখা টের পেল তাইতা। নিজের কথা ভাবল। শেষ কবে চোখের পানি ফেলেছ, নির্বোধ বুড়ো! মেয়েটার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিল ও। ওর তেল আর ভেষজ লতার মিশ্রণ বিশেষ মলমের ফ্লস্কের দিকে হাত বাড়াল। সব রকম ছোটখাট কাটাছেঁড়া ও অন্যান্য ছোটখাট রোগের মহৌষধ। খুলির উপর মলম লাগিয়ে দিল ও। আদর পেয়ে চোখ বন্ধ করা বিড়াল বাচ্চার মতো চোখ বুজে ওর গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল মেয়েটা। কাজ শেষ হলে পুকুর থেকে উঠে এলো ওরা। বসে রইল একসাথে। রোদ ও তপ্ত হাওয়ায় শরীর শুকোনোর পর একটা ব্রোঞ্জের ফোরসেপ বেছে নিল তাইতা, তারপর ওর দেহের প্রতি ইঞ্চিতে কাজ করল। ভেষজ মলম বেশির ভাগ উকুন ও অন্যান্য পোকা মেরে ফেললেও আরও অনেকগুলোকে ওর শরীর আঁকড়ে থাকতে দেখল। ওগুলো বেছে তুলে নিয়ে পিষে মারল। ফেনকে আমোদিত করে রক্তের ফোঁটায় বিস্ফোরিত হওয়ার সময় সন্তোষ জাগানো পপ আওয়াজ করছে। তাই শেষ উকুনটা বের করে আনলে ওর কাছ থেকে ফোরসেপটা নিল ফেন তারপর ওর শরীর থেকে তাইতার দেহে পাড়ি জমানো পোকাগুলোর ব্যবস্থা করতে লেগে গেল। তাইতার তুলনায় অনেক তীক্ষ্ণ ও ক্ষিপ্র। ওর রূপালি দাড়ি ও বগলতলায় জীবনের লক্ষণের খোঁজে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। তারপর আরও নিচে তল্লাশি চালাল সে। বুনো বলে ওর পেটের নিচে ওকে নির্বীজ করার সেই রূপালি ক্ষতে হাত বোলানোর সময় দ্বিধা প্রকাশ করল না। এই গ্লানির চিহ্নটাকে সব সময়ই অন্যদের চোখের আড়ালে রাখার চেষ্টা করে তাইতা। কেবল জীবিত লস্ত্রিসের চোখ ছাড়া। এখন আবার বেঁচে উঠেছে সে। কোনও রকম বিব্রত বোধ করছে না। তবু, ওর কাজটা নিষ্পাপ ও স্বাভাবিক হলেও হাতটা সরিয়ে দিল ও।

কথাটা মনে হয় আরেকবার বলতে পারি, পরস্পরকে ভালো করেই চিনি আমরা। মেয়েটা ওকে পরিষ্কার করার পর ভেবেচিন্তে বলল তাইতা।

তাইতা! নিজের বুক ছুঁয়ে বলল ও। গম্ভীরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। তাইতা। ভঙ্গিটা পুনরাবৃত্তি করল ও।

বুঝতে পারল মেয়েটা। তাইতা! আঙুল দিয়ে ওর বুকে খোঁচা দিল। তারপর নিজের ক্ষীণ বুকে চাপড় দিল।খোনা মানযি! বলল সে।

না! বাদ সাধল তাই।ফেন!

ফেন? অনিশ্চিতভাবে পুনরাবৃত্তি করল সে। ফেন? নিখুঁত উচ্চারণ। যেন মিশরিয় ভাষায় কথা বলতেই জন্ম হয়েছে ওর। এক মুহূর্ত ভেবে হেসে সায় দিল। ফেন!

বাক-হার! বুদ্ধিমতী, ফেন!

বাক-হার, অনুগতের মতো পুনরাবৃত্তি করল সে। বুদ্ধিমতী, ফেন। ওর হঁচড়েপাকামো আবার বিস্মিত, প্রফুল্ল করে তুলল ওকে।

*

ওরা শিবিরে ফেরার পর মেরেন ও অন্য পুরুষরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ফেনের দিকে, যদিও তেমনটা না করারই নির্দেশ ছিল ওদের উপর।

মিষ্টি আইসিস, এ যে দেখছি আমাদেরই একজন, বলে উঠল মেরেন।

মোটেই বর্বর না, যদিও তেমনই আচরণ করছে। ও মিশরিয়। স্যাডল ব্যাগ হাতড়াতে গিয়ে একটা বাড়তি টিউনিক খুঁজে পেয়ে তাইতার কাছে নিয়ে এলো ওটা।

পরিষ্কারই বলা চলে, ব্যাখ্যা করল সে। ওর পরিচয় লুকোতে কাজ দেবে।

পোশাকটার দিকে এমনভাবে তাকাল ফেন, যেন সাপের মতো বিষাক্ত। নগ্নতায় অভ্যস্ত বলে তাইতা ওটা ওর মাথার উপরে ধরতেই পালানোর চেষ্টা করল। টিউনিকটা বেশ লম্বা, স্কুল প্রায় গোড়ালিতে নেমে এলো। কিন্তু চারপাশে জড়ো হয়ে জোর গলায় অনুমোদন আর তারিফ করল লোকজন। খানিকটা খুশি হয়ে উঠল মেয়েটা।

মনে প্রাণে নারী, হেসে বলল তাইতা।

সত্যিই নারী, সায় দিল মেরেন, তারপর স্যাডল-ব্যাগের কাছে ফিরে গেল। একটা রঙিন সুন্দর রিবন বের করে নিয়ে এলো ওর কাছে। নারী-প্রেমিক মেরেন সব সময় সাথে এমনি মামুলি কিছু জিনিস রাখে। চলার পথে পরিচয় হওয়া বিপরীত লিঙ্গের সাথে সাময়িক সম্পর্ক পাতার বেলায় বেশ কাজ দেয়। টিউনিকের ঝুল যাতে মাটিতে গাড়াগাড়ি না খায় সেজন্যে একটা রিবন দিয়ে ওর কোমরে বো বেঁধে দিল ও। ঘাড় কাত করে এর প্রভাব দেখতে লাগল ফেন।

ওর গর্বের ভাবটা একবার দেখ, হাসল ওরা। মেয়েটা খুব বিশ্রী, এটাই সবচেয়ে দুঃখের বিষয়।

সেটা বদলে যাবে, কথা দিল তাইতা। মেয়েটা আগের জন্মে কত সুন্দর ছিল, ভাবল।

*

পরদিন মাঝসকালের দিকে মৃত লু-দের লাশগুলো পচে ফুলে উঠল। এমনকি বেশ দূর থেকেও পচা দুর্গন্ধ এত প্রকট হয়ে উঠল যে তাঁবু সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো ওরা। শিবির গোটানোর আগে রেখে আসা লোকজন আর ঘোড়া ফিরিয়ে আনতে নোন্তুকে আবার প্যাপিরাসের বনে পাঠাল তাইতা। তারপর মেরেনকে নিয়ে বন্দি লু নারীদের দেখতে গেল। গ্রামের কেন্দ্রে এখনও পাহারায় রয়েছে ওরা, দড়িতে বাঁধা, নগ্ন কাহিল অবস্থায় জোড়াসড়ো।

আমাদের সাথে ওদের নেওয়া যাবে না, যুক্তি দেখাল মেরেন। ওদের দিয়ে আমাদের আর কাজ নেই। এমনই জানোয়ার ওরা যে, এমনকি পুরুষদের আনন্দ দেওয়ার কাজেও লাগবে না। ওদের শেষ করে ফেলতে হবে। আমাকে সাহায্য করার জন্যে লোকজন ডাকব? বেশি সময় লাগবে না। খাপের তরবারি শিথিল করে নিল সে।

ছেড়ে দাও ওদের, নির্দেশ দিল তাইতা।

বিহ্বল দেখাল মেরেনকে। সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, ম্যাগাস। আমাদের ঘোড়া চুরি আর উত্যক্ত করতে জলাভূমি থেকে ভাইবেরাদারদের ডেকে আনবে না, তার কোনও নিশ্চিয়তা নেই।

ছেড়ে দাও, আবার বলল তাইতা।

ওদের কব্জি ও গোড়ালির বাঁধন কেটে দেওয়ার পরও পালানোর চেষ্টা করল না মেয়েরা। ভীষণ হুমকি ও মারাত্মক একটা ভাষণ ঝাড়তে হলো নাকোন্তোকে, তারপর বর্শা হাঁকিয়ে তেড়ে গেল ওদের দিকে, মুখে যুদ্ধের হুঙ্কার ছাড়ল, তারপর যার যার বাচ্চা কোলে নিয়ে বিলাপ ছেড়ে বনের দিকে পালাল ওরা।

ঘোড়া বোঝাই করে জলাভূমির কিনারা ধরে আরও দুই লীগ সামনে বাড়ল ওরা, তারপর ছায়াময় গাছের একটা বনে শিবির করল আবার। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে উড়ে আসা পোকামাকড়ের দল নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার শুরু করল।

একদিন পরে অবশিষ্ট ঘোড়া ও জীবিতদের জলাভুমি থেকে বের করে আনল নোম্ভ। দায়িত্বে ছিল শাবাকো, তাইতা ও মেরেনের কাছে রিপোর্ট করতে এলো সে। ভালো খবর নেই তার কাছে: ওরা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আরও পাঁচজন সৈনিকের মৃত্যু ঘটেছে। শাবাকোসহ বাকি সবাই অসুস্থ, দুর্বল; বিনা সাহায্যে ঘোড়ায় চাপতে পারবে না কেউ। জানোয়ারগুলোর অবস্থাও এরচেয়ে ভালো না। জলাভূমির ঘাস ও জলজ উদ্ভিদ তেমন একটা পুষ্টি যোগায়নি। বদ্ধ পানি থেকে পেটে পরজীবী তুলে নিয়েছে কয়েকটা। শাদা কৃমির দলা আর বটফ্লাই শুটকীট পায়খানা করছে।

পোকামাকড় ভরা এই জায়গায় থাকলে আরও মানুষ ও পশু হারানোর ভয় করছি আমি, উদ্বিগ্ন বোধ করল তাইতা। ঘাস টক, পচা গন্ধঅলা, এসব খেয়ে ঘোড়ার স্বাস্থ্য ভালো হবে না। আমাদের ধুরার মওজুদও প্রায় শেষের পথে। মানুষের জন্যেই যথেষ্ট হবে না, পশুর কথা তো আরও পরে। সুস্থ-সবল হয়ে উঠতে আরও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ লাগবে আমাদের। নাকোন্তোকে কাছে ডাকল ও, জিজ্ঞেস করল, আশপাশে এর চেয়ে উঁচু জায়গা আছে?

জবাব দেওয়ার আগে চাচাত ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করল নাকোন্তা। পুব দিকে বেশ কয়েক দিনের পথে একটা পাহাড়ী এলাকা আছে। ওখানে ঘাস মিষ্টি, সন্ধ্যায় পাহাড় থেকে শীতল হাওয়া ভেসে আসে। গরমকালে ওখানে গরু-ছাগল চরাতে অভ্যস্ত ছিলাম আমরা, বলল সে।

আমাদের পথ দেখাও, বলল তাইতা।

পর দিন বেশ সকাল সকাল রওয়ানা হলো ওরা। উইন্ডস্মোকের পিঠে সওয়ার হওয়ার পর হাত বাড়িয়ে ফেনের বাহু ধরে ওকে পেছনে তুলে নিল তাইতা। ওর মুখের অভিব্যক্তি থেকে বুঝতে পাল, অভিজ্ঞতাটুকু ভীত করে তুলেছে ওকে, তবে দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল সে; ওর পীঠে মুখ দাবিয়ে আঁটুলির মতো আঁকড়ে থাকল। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ঢঙে কথা বলল তাইতা। এক লীগের মতো দূরত্ব অতিক্রম করার পর শক্ত বাঁধন শিথিল করে উঁচু অবস্থান থেকে চারপাশে তাকাতে লাগল সে। আরও এক লীগ পার হওয়ার পর আনন্দ ও কৌতূহলে বকবক শুরু করে দিল। তাইতা সাথে সাথে জবাব না দিলে ওর পিঠে ছোট মুঠি দিয়ে কিল মারছে, নাম ধরে ডাকছে ওকে, তাইতা! তাইতা, তারপর ইঙ্গিতে ওর মনোযোগ আকর্ষণ করা জিনিসটা দেখাচ্ছে।

গাছ, জবাব দিচ্ছে ও, বা পাখি, কিংবা ঘোড়া, বা বড় পাখি।

বড় পাখি, পুনরাবৃত্তি করছে সে। চট করে শিখে নিচ্ছে, ওর শ্রবণশক্তি প্রখর। একবার দুবারের চেষ্টাতেই যেকোনও শব্দ তুলে নিতে পারছে। নিখুঁতভাবে উচ্চারণ করছে। একবার শেখার পর আর ভুলছে না। তৃতীয় দিন নাগাদ বিভিন্ন শব্দ দিয়ে সহজ বাক্য তৈরি শিখে গেল সে, বড় পাখি উড়ছে, বড় পাখি জোরে ওড়ে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। অনেক চালাক তুমি, ফেন, ওকে বলেছে তাইতা। মনে হচ্ছে যেন এককালে অনেক ভালো করে ভুলে যাওয়া জানা কিছু ফের মনে করতে শুরু করেছ। এখন দ্রুত মনে পড়ছে, তাই না?

মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে, তারপর এরইমধ্যে শেখা শব্দগুলো বেছে নিয়ে ঝঙ্কারের মতো উচ্চারণ করছে আবার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, চালাক ফেন। দ্রুত আসছে, দ্রুত। তারপর মেয়ারের পিছন পিছন আসতে থাকা ঘোড়ার বাচ্চা ওয়ার্লউইন্ডের দিকে তাকাচ্ছে: ছোট ঘোড়া জোরে আসছে!

ঘোড়ার বাচ্চাটা মুগ্ধ করে রেখেছে ওকে। ওয়ার্লউইন্ড নামটা কঠিন ঠেকেছে ওর কাছে, তাই ছোট ঘোড়া ডাকছে। শিবির খাটাতে স্যাডল ছাড়ার পরপরই চেঁচিয়ে উঠল সে, এসো। ছোট ঘোড়া। বাচ্চাটা যেন তাইতার মতো ওর সঙ্গও উপভোগ করতে শুরু করেছে। কাছে এসে গলায় হাত প্যাচানোর সুযোগ করে দিল ওকে। ফেন ওকে এমনভাবে কাছে টেনে নিল যেন মায়ের জঠরে জোড়া লাগা যমজ। লোকজনকে অন্য ঘোড়াগুলোকে ধুরা শস্য খাওয়াতে দেখল ও। তো কিছু শস্য চুরি করে খাওয়ানোর প্রয়াস পেল ওটাকে। কিন্তু ঘোড়াটা প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষেপে গেল। পচা ঘোড়া! ভৎর্সনা করল ও। পচা ঘোট ঘোড়া!

অচিরেই সবার নাম জেনে ফেলল সে। সবার অগে মেরেনের নাম, ওকে রিবন দিয়েছে, সব সময় বিশেষ প্রশ্রয় দিচ্ছে। অন্যরা ওর মনোযোগ লাভ করতে প্রতিযোগিতা করছে। ওদের সামান্য বরাদ্দ থেকেই ওর জন্যে এটা ওটা বাঁচিয়ে রাখছে, কুচকাওয়াজের গানের কথাও শিখিয়েছে: ও বেশ কিছু অশ্লীল কোরাস গাওয়ার পর এতে বাদ সেধেছে তাই। ওকে ছোটখাট উপহার দিয়েছে ওরা। উজ্জ্বল পাখা, সজারুর কাঁটা আর পার হয়ে আসা শুকনো নদীর তলদেশে উঠে আসা রঙিন নুড়ি পাথর।

কিন্তু কলামের অগ্রগতি খুব ধীর। মানুষ বা পশু কোনওটাই পুরো দিন চলতে পারছে না। দেরি করে শুরু করছে ওরা, আগে ভাগে থামছে। ঘনঘন বিরতি দিচ্ছে। আরও তিনজন সৈনিক প্রাণ হারিয়েছে জলাভূমির রোগে, বাকিদের বলতে গেলে কবর খোঁড়ারও শক্তি নেই। ঘোড়াগুলোর ভেতর উইন্ডস্মোক আর ওর বাচ্চাটাই সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। মেয়ারের পেছনের বর্শার আঘাত পুরোপুরি সেরে গেছে, যাত্রার প্রবল ধকল সত্ত্বেও তার দুধ বহাল তবিয়তে আছে, এখনও ওয়ার্লউইন্ডকে খাওয়াতে পারছে।

একদিন বিকেলে শিবির খাটাল ওরা, দিগন্ত তখন ধূলি আর তাপ তরঙ্গে ঘোলাটে হয়ে গেছে। কিন্তু ভোরে দেখা গেল রাতের ঠাণ্ডা বাতাস সব পরিষ্কার করে দিয়েছে, দূরে পাহাড়ের নীল নিচু রেখা দেখতে পেল ওরা। ওরা সেদিকে এগিয়ে যেতে শুরু করতেই পাহাড়গুলো ক্রমশঃ উঁচু হয়ে উঠতে শুরু করল, আমন্ত্রণ জানাতে লাগল বিস্তৃত দৃশ্য। জলাভূমি ছেড়ে আসার অষ্টম দিন একটা বিরাট ম্যাসিফের পাদদেশে পৌঁছাল ওরা। ঢালগুলো হালকাভাবে গাছে ছাওয়া, অসংখ্য রেভাইনে ভরা, ওগুলো বেয়ে গড়িয়ে নেমে এসেছে ঝর্না ও প্রবল জলপ্রপাত। একটা জলধারা অনুসরণ করে অনেক কষ্টে উপরে উঠতে লাগল ওরা, অবশেষে একটা বিস্তৃত মালভূমিতে উঠে এলো।

এখানে বাতাস অনেক টাটকা, শীতল। স্বস্তি ও আনন্দের সাথে ফুসফুস ভরে শ্বাস নিল ওরা, চারপাশে নজর চালাল। ঘাসের সমতলে চমৎকার গাছপালার বন চোখে পড়ল। তৃণভূমিতে অসংখ্য অ্যান্টিলোপ ও ডোরা কাটা বুনো পশু চরে বেড়াচ্ছে। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই কোথাও। অজানা, হাতছানি দেওয়া বুনো প্রান্তর।

প্রবহমান বাতাস, সূর্যের অবস্থান, প্রবহমান জলের নৈকট্য ও ঘোড়ার জন্যে চারণভূমি সবদিক বিবেচনা করে শিবিরের জন্যে জায়গা বাছাই করল তাইতা। খুঁটি ও ছাদের জন্যে ঘাস কেটে আরামদায়ক ঘর বানাল ওরা। তীক্ষ্ণ ডগা ও মোটা খুঁটি দিয়ে বসতির চারপাশে সীমানা প্রাচীর-যারীবা-তৈরি করল ওরা, ওটার একপ্রান্তকে ঘোড়া ও খচ্চরের জন্যে আলাদা খোঁয়াড়ে পরিণত করল। রোজ সন্ধ্যায় চারণভূমিতে নিয়ে আসে ওদের, তারপর রাতে খুনে বাঘ ও বর্বর মানুষের হাত থেকে বাঁচাতে আটকে রাখে ওখানে।

নদীর তীরে উর্বর ও সমৃদ্ধ জমিন পরিষ্কার করে লাঙল দিয়েছে ওরা। চরে বেড়ানো পশুদের দূরে সরিয়ে রাখতে ওটাকে ঘিরে আরেকটা কাঁটা ঝোঁপের বেড়া তৈরি করেছে। একটা একটা করে বস্তা থেকে ধুরা বীজ বের করে আভা দেখে শক্তিশালীগুলো রেখে দিচ্ছে তাইতা; দুর্বল, রোগাক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তগুলো ফেলে দিয়ে চাষ দেওয়া জমিনে রোপন করেছে। নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেঁচ দিতে একটা শাদুফ বানিয়েছে তাইতা। কয়েক দিনের মধ্যেই মাটি ভেদ করে প্রথম সবুজ চাড়া মাথা চাড়া দিল। পরের কয়েক মাসের ভেতর শস্য পাকবে। ক্ষেত পাহারা দিতে একজন রক্ষী নির্ধারিত করে দিল মেরেন। ঘোড়া ও যেকোনও বুনো জানোয়ার তাড়াতে ঢোল বাজায় সৈনিকরা। যারীবা ঘিরে প্রতিরক্ষা আগুন তৈরি করল ওরা। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করল। রোজ সকালে গোড়া ও খচ্চরগুলো একসাথে বেঁধে চারণভূমির রসাল ঘাসে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে ঘাস খেয়ে দ্রুত চাঙা হয়ে উঠল ওরা।

মালভূমিতে শিকারের অভাব নেই। রোজ শিকারীদের একটা দল নিয়ে বের হয়ে যায় মেরেন, অ্যান্টিলোপ ও অন্যান্য বুনো প্রাণীর মাংসে ব্যাগ ভর্তি করে ফিরে আসে। আগাছা দিয়ে মাছ ধরার ফাঁদ বুনেছে ওরা। নদীর পুকুরের মুখে ওগুলো পেতে রেখেছে। অসংখ্য মাছ ধরা পড়ছে ফাঁদে। রোজ রাতেই হরিণের মাংস আর টাটকা মাগুর মাছ দিয়ে ভোজপর্ব সারছে ওরা। মাংসের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুধা দেখিয়ে ওদের রীতিমতো বিস্মিত করে দিয়েছে ফেন।

এখানকার মালভূমির বেশির ভাগ গাছপালা, গুল্মের সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে তাইতার। ইথিওপিয়ার উঁচু এলাকায় থাকার সময় এগুলোর সাথে ওর পরিচয়। সংগ্রহকারী দলকে পুষ্টিকর গাছগাছালি চিনিয়ে দিয়েছে ও। ওরই নির্দেশনায় নদীর তীর বরাবর জন্মানো বুনো পুদিনা পাতা যোগাড় করেছে ওরা। বিপুলভাবে জন্মানো ইউফোরবিয়াসেয়াসের শেকড়ও খুঁড়ে বের করেছে। ওগুলো সেদ্ধ করে পুষ্টিকর পরিজে পরিণত করেছে; প্রয়োজনীয় খাবার হিসারে ধুরার স্থান দখল করেছে।

ভোরের শীতল, মিষ্টি হাওয়ায় বনে চলে যায় তাইতা ও ফেন; ঝুড়ি ভর্তি ভেষজ গুণসমৃদ্ধ পাতা ও বেরি, শেকড় ও ভেজা টাটকা বাকলের টুকরো আনবে বলে। গরম অস্বস্তিকর হয়ে উঠলে শিবিরে ফিরে এসে সংগৃহীত রসদের খানিকটা সেদ্ধ কিংবা রোদে শুকিয়ে নেয়। আর অন্যান্য উপকরণ বেটে গুড়ো বা মণ্ডে পরিণত করে। ওদের তৈরি আরকে মানুষ ও পশুর রোগের চিকিৎসা করে তাই।

একটা বিশেষ কাটা ঝোঁপের সেদ্ধ করা বাকলের নির্যাস খুবই তেতো, জিভ অবশ করে দেয়, চোখ জ্বালা ধরায়, দম আটকে দেয়। যাদের ভেতর এখনও জলাভূমির রোগের আলামত রয়ে গেছে তাদের উপর ওটা পরিমিত প্রয়োগ করল তাইতা। ওরা সেটা গিলতে গিয়ে বিষম খাওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ যোগাল ফেন। ভালো, শাবাকো। চালাক শাবাকো। কেউই ওর তোষামোদ ঠেকাতে পারল না। তেতো ওষুধ মুখে নিয়ে গিলে ফেলল। দ্রুত সম্পূর্ণ সেরে উঠল সবাই।

বাকলের গুঁড়ো ও ছোট মামুলি গুল্মের বীজে থেকে শক্তিশালী এক ধরনের জোলাপ তৈরি করল তাইতা। সবাই ধরে নিয়েছিল নাকোন্তোর পেট পাথরের মতো কষা হয়ে গেছে; সেও ফলাফলে খুশি হয়ে উঠল। ওটার ডোজ নিতে রোজ তাইতার কাছে আসছে সে। শেষ পর্যন্ত রোজ এক দফা ওষুধ খাওয়ার নিয়ম বেঁধে দিতে বাধ্য হলো তাই।

ফেনের খিদে সত্ত্বেও হাড় জিরজিরেই রয়েছে ও। ওর পেট শক্ত, চোপসানো। সেদ্ধ বাকলের আরেকটা আরক তৈরি করল তাইতা, ওকে সাহায্য করল ফেন। ওকে ওটা খেতে সাধলে একটা চুমক দিল সে। তারপরই সটকে পড়ল। ছুটে পালাচ্ছিল জোরে, কিন্তু ওর এমন আচরণের প্রস্তুত ছিল তাইতা। দুই দিনেরও বেশি স্থায়ী হলে পরবর্তী ইচ্ছাশক্তির লড়াই। ফল নিয়ে বাজি ধরল সবাই। শেষে তাইতাই জিতল। কোনও রকম মস্তাত্ত্বিক প্রয়াস ছাড়াই শেষে পুরো ডোজ খেল ফেন। ওর বেলায় অমন কিছু করতে চায়নি তাই। ওর বদ মেজাজ অব্যাহত ছিল পরদিনও, যতক্ষণ না ওকে অবাক করে ওর পেট থেকে প্রায় ওর মাথার সমান কিলবিলে শাদা আন্ত্রিক কৃমির একটা দলা বের হয়ে এলো। এই সাফল্যে দারুণভাবে গর্বিত বোধ করল সে। প্রথমে তাইতা, তারপর সবার কাছে স্বীকার গেল। ওরা সবাই জুৎসইভাবে মুগ্ধ হলো, প্রকাশ্যে সায় দিয়ে বলল যে ফেন আসলেই চালাক, সাহসী মেয়ে। কয়েক দিনের ভেতর ওর পেট অনেক সুখকর বাঁক পেল। ওর হাত-পা ভরাট হয়ে উঠতে শুরু করল। দেখার মতো হয়ে উঠল ওর শারীরিক বিকাশ। ওর কয়েক মাসের বৃদ্ধি পেতে সাধারণ মেয়েদের বেলায় হয়তো কয়েক বছর লাগবে। তাইতার মনে হচ্ছে, মেয়েটা বেড়ে উঠছে, ওর চোখের সামনে যুবতীতে পরিণত হচ্ছে।

ও সাধারণ শিশু নয়, আপনমনে ব্যাখ্যা করল ও। দেবী ও রানির অবতার। এব্যাপারে কখনও এতটুকু সন্দেহ মনে জাগলেই ওকে কেবল অন্তর্চক্ষু খুলে ওর আভার দিকে তাকালেই হয়। ওই আভার চমক স্বর্গীয়।

তোমার সুন্দর হাসি ঘোড়াকে চমকে দেবে, ওকে বলল তাইতা, চওড়া হেসে এক কালের কালো দাঁত দেখাল ফেন। ওর দাঁত লবনের মতো শাদা ও নিখুঁত। সবুজ রঙের গাছের ডাল বেছে ওটার আঁশ চিবুনোর কায়দা শিখিয়েছে দিয়েছ তাইতা; একটা ঝোঁপ চিনিয়ে দিয়ে দাঁত মাজা ও নিঃশ্বাস সুবাসিত করার বুদ্ধি বাতলে দিয়েছে। স্বাদটা ওর পছন্দ হয়েছে, দৈনিক রেওয়াজ থেকে কখনও পিছিয়ে যায়নি।

ভাষার উপর ওর দখল ভয়ানক থেকে দুর্বল পর্যায়ে উঠে এসে তারপর ভালো এবং শেষে নিখুঁত হয়ে উঠেছে। শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, মনের ভাব প্রকাশে এখন সঠিক শব্দ চয়ন করতে পারছে, বা কোনও একটা বিষয়ের নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারছে। অচিরেই তাইতার সাথে শব্দের খেলায় মেতে উঠতে পারল ও। ছন্দ তৈরি, হেঁয়ালি করা আর অনুপ্রাসে আমোদিত করে তুলল তাইতাকে।

শেখার জন্যে ফেনের তৃষ্ণা অশেষ। মন অন্য কিছুতে ব্যস্ত না থাকলে একঘেয়ে, কঠিন হয়ে পড়ে সে। তাইতার দেওয়া কোনও কাজ বোঝার চেষ্টায় থাকার সময় মিষ্টি ও সহজে সামালযোগ্য থাকে। প্রায় রোজই ওর জন্যে নতুন চ্যালেঞ্জের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে তাইতাকে।

নদীর তীরের কাদা দিয়ে লেখার ফলক বানিয়েছে ও। ওকে হিয়েরোগ্রাফিক লিপি শেখানো শুরু করেছে। ওদের কুঁড়ের দরজার বাইরে শক্ত মাটির একটা বাও বোর্ড বসিয়েছে ও। ঘুটি হিসাবে রঙিন পাথর বেছে নিয়েছে। কয়েক দিন পরে মূল নীতিমালা শিখে নিল সে। অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সাতের নিয়ম, তারপর দুর্গ সংহত করার কৌশল শেখাল। মেরেনকে যেদিন চরম লজ্জায় ফেলে দর্শকদের খুশি করে তিন দানের দুটোতে সরাসরি হারাল, মনে রাখার মতো একটা দিন ছিল সেটা।

সল্টওর্ট ঝোঁপের ছাই দিয়ে শিকারীদের আনা পশুর চর্বিকে সাবানে পরিণত করল তাইতা। তার উদার ব্যবহারে ফেনের শরীর থেকে রঙ ও অন্যান্য নামহীন পদার্থের অবশিষ্ট নাছোড়বান্দা দাগও উঠে গেল: যেসব রঙে ওর পালক মা রাঙিয়েছিল ওকে।

তাইতার নিজস্ব মলম আর নিরলস প্রয়াসে ওর মাথার চুলের শেষ উকুনগুলোও উৎখাত হলো। এক ধরনের ক্রিমের মতো নির্মল চেহারা নিল ওর ত্বক, রোদ লাগা জায়গাগুলো জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। বেড়ে উঠল ওর মাথার চুল। অবশেষে কান ঢাকা পড়ল; চকচকে আভাময় মুকুটে পরিণত হলো। ওর চোখজোড়া এখনও সবুজ ও ডাগড় ডাগড় থাকলেও এখন আর অন্যান্য সূক্ষ্ম বৈশিষ্টকে চাপা দিচ্ছে না, বরং সম্পূরক হয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাইতার নিষ্পলক চোখের সামনে অন্য জীবনে যেমন ছিল তেমনি অসাধারণ সুন্দরী হয়ে উঠল ও।

যখনই ওর দিকে চোখ ফেরায় বা রাতে ওর পাশের মাদুরে ঘুমানোর সময় মৃদু শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ কান পেতে শোনে, ভবিষ্যতের গর্ভে কী আছে ভেবে ওর সব আনন্দ ভয়ের কাছে মাথা নত করে। সূক্ষ্মভাবে ও সজাগ যে, অল্প কয়েক বছরের ভেতরই নারীতে পরিণত হবে সে, এবং ওর প্রবৃত্তি এমন কিছু দাবি করে বসবে যা দেওয়ার ক্ষমতা ওর নেই। তখন অন্য কোথাও খোঁজ করতে প্ররোচিত হবে সে, এমন একজন পুরুষের যে ওর সীমাহীন নারীসুলভ চাহিদা পূরণ করতে পারবে। ওর জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো অন্যের বাহুডোরে ধরা দিতে দেখতে হবে ওকে, হারানো প্রেমের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

ভবিষ্যতই নিজের ব্যবস্থা নেবে। আজ ওকে কাছে পেয়েছি। তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, আপন মনে বলে ও। নিজের শঙ্কাটুকু দূরে ঠেলে দেয়।

চারপাশের সবাই ওর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও সে সম্পর্কে মোটেই সজাগ নয় ফেন। নির্বিকার কমনীয়তা ও বন্ধুত্ব দিয়ে ওদের অতিপ্রশংসার জবাব দেয় ও, তবে মুক্ত প্রাণ রয়ে যায়। তাইতার জন্যে ওর সব দুর্বলতা তুলে রেখেছে।

*

উইন্ডস্মোকও ফেনের মায়ায় ধরা দেওয়া আরেকটা প্রাণী মাত্র। তাইতা ৩রসায়ন বা ধ্যানে মগ্ন থাকলে ওর খোঁজে চারণভূমিতে চলে আসে ফেন। ওর পিঠে ওঠার জন্যে ওকে ওর কেশর ব্যবহার করার সুযোগ দেয় মেয়ারটা, তারপর ঘোড়া হাঁকানোর সবক দেয়। প্রথমে শিথিল হাঁটার চেয়ে বেশি জোরে ছোটে না সে। ফেনের তাগিদ সত্ত্বেও সওয়ারির ভারসাম্য ঠিক আছে কিনা, সে ঠিক মতো বসেছে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুলকি চালে ছোটে না। অল্প কয়েক সপ্তাহর ভেতরই ফেনকে সহজ কদমে ছোটার কায়দার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল সে। শরীরের পাশে ছোট ছোট পায়ের খোঁচা অগ্রাহ্য করে গেল। ওর চড়া গলার তাগিদ আর হৈ ছোট! আবেদন উপেক্ষা করল। তারপর এক বিকেলে, ওদের কুঁড়ের দরজায় বসে ঝিমোচ্ছিল তাইতা, ঘোড়ার যারীবার দিকে এগিয়ে গেল ফেন, ধূসর মেয়ারের পিঠে চেপে বসল ও। যারীবার গেটে ওটার কাঁধের পেছনে পায়ের আঙুলে খোঁচা মারল ফেন। মসৃণ, লম্বা পায়ে দুলকি চালে ছুটতে শুরু করল উইন্ডস্মোক। ওরা সাভানাহ ঘাসের বাগানে এসে পৌঁছার পর ফের মেয়রকে তাগিদ দিল ফেন। দুলকি চালে চলার গতি বাড়াল ওটা। ওটার ঠিক কেশরের পেছনেই বসেছে ফেন, শরীরের ভর বেশ সামনের দিকে, দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রয়েছে, উইন্ডস্মোকের প্রতটি পদক্ষেপের সাথে তাল মেলাচ্ছে। তারপর, জানোয়ারটার সহযোগিতার আশায় কেশরের একটা গুচ্ছ মুঠি করে ধরে চিৎকার করে উঠল ফেন, চলো, প্রিয়া আমার, দূরে চলে যাই। সাথে সাথে ওর শরীরের নিচে প্রায় পুরো গতি আর ক্ষমতা ছেড়ে দিল উইন্ডস্মোক। অনায়াসে ওকে অনুসরণ করল ওয়ার্লউইন্ড। উৎফুল্ল মনে পার হয়ে এলো ওরা খোলা ঘেসো জমির বেসিন।

লোকজনের চিৎকারে জেগে উঠল তাইতা। দৌড়া, উইন্ডস্মোক, দৌড়া! হাঁকাও, ফেন, হাঁকাও!

ঠিক সময় মতোই গেটে চলে এলো ও, দূরে ত্রয়ীকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল সময় মতোই। কার উপর প্রথম রাগ ঝাড়বে বুঝতে পারল না।

ঠিক এই মুহূর্তটাকেই চিৎকার করার জন্যে বেছে নিল মেরেন। সেথের বাতাসের বিকট শব্দের দোহাই, সৈনিকের মতোই ছুটছে ও! ফলে নিজেকেই ওর রাগের লক্ষ্যে পরিণত করল।

তখনও ওর উপর ঝাল ঝাড়ছিল তাইতা, এমন সময় ঝড়ের বেগে বেসিনের উপর দিয়ে ছুটে গেল উইন্ডস্মোক, ওর পিঠে উত্তেজনায় চিৎকার করছে ফেন। ওদের ঠিক পেছনেই ওয়ার্লউইন্ড। তাইতার সামনে এসে থামল ওটা। পিছলে ওটার পিঠ থেকে নেমে ওর দিকে ছুটে এলো ফেন। ওহ, তাইতা, আমাদের দেখেছ? দারুণ না? আমাকে নিয়ে তোমার গর্ব হচ্ছে না?

চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাল তাইতা। এমন বিপজ্জজনক ও হদ্দ বোকামি আর করবে না, জীবনেও না। থতমত খেয়ে গেল সে। কাঁধ ঝুলে পড়ল, অশ্রু জমে উঠল চোখে। আড়ষ্টভাবে পিছু হটল তাইতা। তবে ভালোই হাঁকিয়েছ। তোমার জন্যে আমার গর্ব হচ্ছে।

ম্যাগাস বলতে চাইছেন তোমাকে ঠিক সৈনিকের মতো লাগছে, কিন্তু আমরা সবাই তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত ছিলাম, খুলে বলল মেরেন। কিন্তু আমাদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। চট করে খুশি হয়ে উঠল ফেন। হাতের পিঠে চোখের পানি মুছল।

সত্যিই কি তাই বুঝিয়েছ, তাইতা? জানতে চাইল সে।

মনে হয়, গম্ভীরভাবে জবাব দিল ও।

সেদিন সন্ধ্যায় মাদুরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে কেন। তেলের কুপির আলোয় গম্ভীর চোখে তাকাচ্ছে তাইতার দিকে। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে শুয়ে আছে তাইতা, ওর দাড়ির গুচ্ছ বের হয়ে আছে। ঘুমের চেষ্টা করছে সে। তুমি কোনও দিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না, সব সময় আমার সাথে থাকবে, তাই না, তাইতা?

হ্যাঁ, হাসল ও। আমি সব সময় তোমার সাথে থাকব।

খুব খুশি হলাম, সামনে ঝুঁকে ওর রূপালি দাড়িতে মুখ দাবাল ও। কী নরম, বলল ফিসফিস করে, মেঘের মতো। তারপর দিনের উত্তেজনা দখল করে নিল ওকে। ওর বুকে শরীর মেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ও।

খানিকক্ষণ শুয়ে রইল তাইতা, ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগল। এত সুখ বেশি দিন টিকতে পারে না। বড় বেশি তীব্র।

*

পরদিন বেশ সকাল সকাল উঠে পড়ল ওরা। ধুরা পরিজ ও মেয়ারের দুধ দিয়ে নাশতা সেরে শুল্মের খোঁজে বনে চলে এলো। সংগ্রহের ঝুড়ি ভরে ওঠার পর ওকে ওদের প্রিয় পুকুরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল তাইতা। উঁচু পাড়ে একসাথে বসে রইল। নিচে পুকুরের জলে ওদের ছায়া পড়ছে।

নিজের দিকে তাকাও, ফেন, বলল তাইতা। দেখ, কত সুন্দর হয়ে উঠেছ। কোনও রকম আগ্রহ ছাড়াই নিচের দিকে তাকাল ফেন। সাথে সাথে ওর দিকে পাল্টা তাকিয়ে থাকা চেহারা দেখে আকৃষ্ট হলো। হাঁটু গেড়ে সোজা হয়ে বসে নদীর দিকে ঝুঁকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। শেষে ফিসফিস করে বলে উঠল, আমার কোনজোড়া অনেক বড়, না?

তোমার কান ঠিক ফুলের পাপড়ির মতো, জবাব দিল তাইতা।

আমার একটা দাঁত বাঁকা।

খুবই সামান্য, তাতে বরং তোমার হাসি আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

আমার নাক?

এত নিখুঁত নাক আমি আর দেখিনি।

সত্যি?

সত্যি!

ওর দিকে ফিরে হাসল ও। তাই বলল, তোমার হাসি বন আলোকিত করে তুলেছে।

ওকে জড়িয়ে দরল সে, উষ্ণ দেহ; কিন্তু সহসা গালের উপর শীতল হাওয়ার স্পর্শ পেল তাইতা, যদিও ওদের মাথার উপর ঝুলে থাকা গাছের পাতা একটুও নড়েনি। শিউরে উঠল ও, কানের পর্দায় মৃদু তড়পাতে শুরু করেছে নাড়ী। ওরা আর এখন একা নয়।

ফেনকে রক্ষা করার ভঙ্গিতে বুকে চেপে ধরল ও। ওর কাঁধের উপর দিয়ে পুকুরের জলের দিকে তাকাল।

পানির তলের ঠিক নিচে একটা আলোড়ন দেখা যাচ্ছে, যেন গভীরে রাক্ষুসে মাগুর মাছ পাক খাচ্ছে। কিন্তু ওর কানের পর্দায় নাড়ীর স্পন্দন জোরাল হয়ে উঠেছে, ও বুঝতে পারছে ওটা মাছ নয়। ভালো করে তাকাল ও, নদীর গভীর অবর্তে শাপলা পাতার মতো তরঙ্গায়িত মনে হওয়া একটা আবছা ছায়া দেখতে পেল। ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে মানুষের চেহারা নিল ছায়াটা। আলখেল্লা পরা অবয়বের অস্পষ্ট ছায়া: আলখেল্লার বিশাল টুপির নিচে ঢাকা পড়ে গেছে মাথাটা। ভাঁজের আড়ালে চোখ চালানোর প্রয়াস পেলো ও। কিন্তু ওখানে ছায়া ছাড়া কিছুই নেই।

ওর আড়ষ্ট ভাব টের পেয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল ফেন। তারপর ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ ফেরাল। পুকুরের গভীরে দৃষ্টি চালাল ও। সভয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল: কী যেন আছে ওখানে। ও কথা বলার সময়ই উবে গেল ছায়াটা। পুকুরের উপরিতল ফের প্রশান্ত হয়ে উঠল। কী ছিল ওটা, তাইতা? জানতে চাইল ফেন।

কী দেখেছো তুমি?

পুকুরের পানির নিচে কে যেন।

একটুও অবাক হলো না তাইতা, কারণ মেয়েটার এই ক্ষমতা থাকার কথা আগাগোড়া জানা ছিল ওর। এই প্রথম তার প্রমাণ রাখছে ও।

পরিষ্কার দেখেছ? ওর মনে আগেই কোনও একটা ধারণা দিতে চাইল না।

দেখলাম পানির নিচে কে যেন, সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরা…কিন্তু মুখ ছিল না ওটার। পুরো দৃশ্যটাই দেখেছে ও, ভগ্নাংশ নয়। সাথে করে নিয়ে আসা মানসিক শক্তি খুবই জোরাল। মেরেনের সাথে যেভাবে কাজ করতে পেরেছে, সেভাবে এর সাথেও কাজ করতে পারবে। ক্ষমতা আরও বাড়ানোর ব্যাপারে ওকে সাহায্য করতে পারবে। ওর ইচ্ছাশক্তিকে বশ মানাতে পারবে।

ওটা দেখে তোমার কী মনে হয়েছে?

শীতলতা, ফিসফিস করে বলল সে।

কোনও গন্ধ পেয়েছো?

বিড়ালের-না, সাপের গন্ধ: ঠিক নিশ্চিত নই, তবে জানি গন্ধটা খারাপ। ওকে আঁকড়ে ধরল সে। কে ওটা?

ডাইনীর গন্ধ পেয়েছো তুমি। ওর কাছে কিছুই লুকোবে না। ওর দেহ শিশুর, কিন্তু সেখানে ধারণ করছে শক্তিশালী প্রতিরোধ সম্পন্ন নারীর আত্মা ও মন। ওকে আড়াল দিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। বিশেষ ক্ষমতা ছাড়াও অন্য জীবনে সঞ্চিত শক্তি ও অভিজ্ঞার ভাণ্ডার রয়েছে ওর। ওকে কেবল ওর মনের সেই মজবুত ঘরটির চাবির সন্ধান করতে সাহায্য করতে হবে ওকে, যেখানে এইসব অমূল্য রত্ন জমা আছে।

এটা ডাইনীর ছায়া দেখেছ তুমি। তার গন্ধই নাকে লেগেছে।

ডাইনীটা কে?

শিগশিগই বলব তোমাকে, তবে এখন আমাদের শিবিরে ফিরতে হচ্ছে। আরও জরুরি কাজ আছে আমাদের হাতে।

*

ডাইনী ওদের সন্ধান পেয়ে গেছে। তাইতা বুঝতে পারছে এই সুন্দর জায়গায় দীর্ঘদিন থাকার জন্যে প্রলুব্ধ করা হয়েছে ওকে। ওর জীবনী শক্তি তরঙ্গের মতো তৈরি হয়েছে, টের পেয়ে গেছে ডাইনীটা, তারপর গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলেছে। ওদের অবশ্যই সরে পড়তে হবে, এবং খুব দ্রুত।

সৌভাগ্যক্রমে লোকজন এখন তৈরি, পুরোপুরি সেরে উঠেছে ওরা। ওদের প্রাণশক্তি এখন তুঙ্গে রয়েছে। শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ঘোড়াগুলো। ধুরার থলেগুলো ভরে ফেলা হলো। তলোয়ারে ধার দেওয়া হয়েছে। সমস্ত সরঞ্জাম মেরামত করা হয়েছে। ডাইনী ওদের খোঁজ পেয়ে থাকলে তাইতাও তার খোঁজ পেয়েছে। তাই এখন জানে কোন দিকে তার আস্তানা।

লোকজনকে সংগঠিত করল মেরেন। জলাভূমির উসুল করা মাশুল বেশ চড়া ছিল। প্রায় দেড় বছর আগে তিরানব্বই জন অফিসার আর লোক কেবুইয়ের দুর্গ থেকে পথে নেমেছিল। এখন আহ্বানে সাড়া দিতে অবিশিষ্ট রয়েছে ছত্রিশ জন। ঘোড়া আর খচ্চরের দল ওদের চেয়ে ভালো দেখিয়েছে। প্যাক মিউলের উপহারসহ আদি পালের তিনশো ঘোড়ার ভেতর একশো অষ্টাশিটি টিকে গেছে।

কলামটা শিবির ছেড়ে আসার সময় পেছনে তাকাল না কেউ। শিবিরের পাশ দিয়ে এগিয়ে সমতলে এসে তারপর নদীর দিকে ফিরতি পথ ধরল। এখন আর তাইতার পেছনে উইন্ডস্মোকের পিঠে বসছে না ফেন। ঘোড়া হাঁকানোয় দক্ষতা প্রদর্শনের পর নিজের মালিকানায় ঘোড়া দাবি করেছিল সে। ওর জন্যে একই রকম স্বাস্থ্যের একটা সুঠাম বে গেল্ডিং বেছে দিয়েছে তাই।

ওটা পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছিল ফেন। ওকে হাঁস ডাকব, ঘোষণা করেছে।

অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছে তাই। হাঁস কেন?

হাঁস আমার পছন্দ। আমাকে হাঁসের কথা মনে করিয়ে দেয় ওটা। খুশির সাথে ব্যাখ্যা করেছে ও। তাইতা ধরে নিয়েছে বাড়তি তর্ক ছাড়াই নামটা মেনে নেওয়াই ভালো হবে।

পাহাড়ের পাদদেশে আসার পর পথ যথেষ্ট প্রশস্ত হলে সামনে বেড়ে তাইতার পাশাপাশি এগোতে লাগল ও; যাতে ওরা কথা বলতে পারে। পরস্পরের সাথে লেগে যাবার উপক্রম হচ্ছে ওদের হাঁটু। আমাকে পানির সেই ডাইনীর গল্প বলবে। বলেছিলে। এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।

হ্যাঁ, ঠিক। ডাইনীটা অনেক বয়স্কা এক মহিলা। সময়ের সূচনা থেকেই বেঁচে আছে। অনেক ক্ষমতাশালী, জঘন্য সব কাজ করে।

কীরকম জঘন্য কাজ?

সদ্যজাত শিশুদের খায়। শিউরে উঠল ফেন। জ্ঞানী লোকদের লোভ দেখিয়ে নিজের আস্তানায় টেনে নিয়ে তাদের আত্মা গিলে খায়। তারপর শরীরের খোলসটা ফেলে দেয়।

এমন কিছু সম্ভব হতে পারে জীবনেও ভাবিনি।

আরও খারাপ কথা বলা বাকি আছে, ফেন। ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীর মাতা মহান নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে সে, যে নদীর পানি সবাইকে জীবন, পানি ও খাবার দেয়।

কথাটা ভাবল ফেন। লু-দের ধারণা ছিল আমিই নদীকে মেরেছি। আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিল ওরা যাতে বনের ভেতর উপোস মারা যাই, কিংবা যাতে বুনো পশুর পেটে যাই।

ওরা নিষ্ঠুর, অজ্ঞ মানুষ, সায় দিল তাইতা।

তুমি আর মেরেন ওদের শেষ করায় আমি খুশি, সাধারণভাবে বলল ও। তারপর কিছুক্ষণ চুপ রইল। কী কারণে ডাইনী নদীটাকে মেরে ফেলতে চাইবে?

ফারাও-এর ক্ষমতা নষ্ট করে তাঁর সাম্রাজ্যের লোকদের দাস বানাতে চায় সে।

ফারাও কী, দাস বানানো মানে কী? ব্যাখ্যা করল তাইতা। ওকে গম্ভীর দেখাল। তাহলে তো আসলেই খারাপ সে। সে থাকে কোথায়?

অনেক দক্ষিণে এক দেশের এক বিরাট হ্রদের পাশের আগ্নেয়গিরিতে, বলে সামনের দিকে ইঙ্গিত করল ও।

সেখানেই যাচ্ছি আমরা?

হ্যাঁ। ওকে ঠেকানোর চেষ্টা করব আমরা, পানি যাতে ফের প্রবাহিত হয় সেই ব্যবস্থা করব।

অত দূর থেকে আমরা যেখানে দেখলাম, সেই পুকুরে এলো কীভাবে?

ওকে দেখিনি আমরা। ওট ছিল ছায়া।

ভুরু কুঁচকে ছোট্ট নাক কোঁচকাল ফেন, কথাটা বোঝার চেষ্টা করছে। বুঝলাম না।

গার্ডলের উপর রাখা চামড়ার থলের দিকে হাত বাড়াল তাইতা, তারপর ওটা থেকে প্রদর্শনীর জন্যে নিয়ে আসা পদ্ম ফুলের একটা বা বের করল। ওকে দিল ওটা। এই বাল্বটা তো চেন।

একটু ক্ষণের জন্যে ওটা দেখল সে। অবশ্যই। অমন অনেক যোগাড় করেছি আমরা।

এটার ভেতর অনেকগুলো পল্লা আছে, একটার ভেতর আরেকটা। মাঝখানে আছে ছোট শাঁস। মাথা দোলাল ফেন। বলে চলল তাইতা। আমাদের সারা দুনিয়াও এভাবে তৈরি। আমরা হলাম কেন্দ্রের শাঁস। আমাদের ঘিরে অস্তিত্বের অনেক স্তর রয়েছে যা আমরা দেখি না বা বুঝতে পারি না-যদি আমাদের সেই ক্ষমতা না থাকে। আমার কথা বুঝতে পারছ?

সাবধানে ফের মাথা দোলাল ও, তারপর আন্তরিক কণ্ঠে সায় দিয়ে বলল, না, বুঝিনি, তাইতা।

ঘুমানোর সময় স্বপ্ন দেখ না, ফেন?

হ্যাঁ, দেখি তো! উৎসাহের সাথে বলল ফেন। অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন! আমাকে তা অনেক খুশি ও প্রাণবন্ত করে তোলে। অনেক সময় স্বপ্নে পাখির মতো উড়ে বেড়াই। অচেনা সুন্দর সব জায়গায় যাই। তারপরই হাসির জায়গা দখল করে নিল ভীতিকর অভিব্যক্তি। কিন্তু অনেক সময় এমন স্বপ্ন দেখি আমাকে যা ভয় পাইয়ে দেয়, বা দুঃখ দেয়।

রাতে ওর পাশে শুয়ে থাকার সময় ফেনের দুঃস্বপ্নে কথা শুনছে তাইতা। কিন্তু ওকে সেগুলো থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেনি। বরং ওকে শান্ত করতে, ওকে আবার অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনতে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, ফেন, আমি জানি। ঘুমের ভেতর অস্তিত্বের এই স্তর ছেড়ে পরের স্তরে চলে যাও তুমি। বোঝার ভাব নিয়ে হাসল ও। খেই ধরল তাইতা। বেশির ভাগ মানুষ স্বপ্ন দেখলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অনেকেরই সূক্ষ্ম শাসের ভেতর দিয়ে দেখার বিশেষ ক্ষমতা থাকে। যেখানে আমরা বন্দি হয়ে আছি। অনেকের, যেমন মোহন্ত ও ম্যাগাইদের। অনেক দূর থেকে সব কিছু দেখার জন্যে এমনকি আত্মার রূপ নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতা থাকে।

তোমার আছে, তাইতা? হেঁয়ালির হাসি দিল তাইতা। ফেন জোরে বলে উঠল, নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর আর অদ্ভুত। আমিও যদি পারতাম, যা খুশি লাগত।

একদিন হয়তো পারবে। বুঝতেই পারছ, ফেন, পুকুরে ডাইনীর ছায়া দেখেছ তুমি, যার মানে তোমার সেই ক্ষমতা আছে। আমাদের কেবল তোমাকে সেই ক্ষমতা কাজে লাগানো শেখাতে হবে।

তার মানে আমাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছিল ডাইনীটা? আসলেই ওখানে ছিল সে?

তার আত্মা ছিল। আমাদের উপর নজর রাখছে।

ওকে ভয় লাগছে আমার।

সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে ওর কাছে আত্মসমর্পণ করা চলবে না। আমাদের, তোমার আর আমার, নিজস্ব শক্তিতে মোকাবিলা করতে হবে তার। অবশ্যই তার বিরোধিতা করে অশুভ মায়া নষ্ট করে দিতে হবে। সেটা যদি পারি, ওকে ধ্বংস করে দেব আমরা, তার জন্যে এই পৃথিবীই হবে ভালো জায়গা।

আমি সাহায্য করব তোমাকে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল ফেন। কিন্তু আগে তারকাঁদা শিখিয়ে দিতে হবে তোমাকে।

এ পর্যন্ত তোমার অগ্রগতি অলৌকিক, অকপট সমীহের সাথে ফেনের দিকে তাকাল তাইতা। অন্য জীবনে এক কালে যে রানি ছিল ইতিমধ্যে তার মতো মন ও আত্মা গড়ে তুলতে শুরু করেছে ও। আরও শেখার জন্যে তৈরি তুমি, ওকে বলল তাইতা। এখুনি শুরু করব আমরা।

*

রোজ ঘোড়ার পিঠে পাশাপাশি এগোনো শুরু করার সাথে সাথে শুরু হয় ওর মাদীক্ষা। যাত্রার দীর্ঘ দিন জুড়ে অব্যাহত থাকে। ফেনের মনে একজন ম্যাগাইয়ের কর্তব্য প্রোথিত করে দেওয়াই ওর প্রাথমিক লক্ষ্য। তাকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেই ক্ষমতার সযত্ন ও দায়িত্বশীল প্রয়োগের ভেতর দিয়ে এই কর্তব্য পালন করতে হয়। একে কখনওই হালকাভাবে বা অবহেলার সাথে বা স্বার্থপর তুচ্ছ মতলব হাসিলের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না তারা।

এই পবিত্র দায়িত্ব বুঝে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ওর সথে শপথ বাক্য উচ্চারণ করে সেটা স্বীকার করার পর জাদুকরী শিল্পের সাধারণ ধরণ নিয়ে আলোচনায় নামল ওরা। প্রথমে ফেনের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতার উপর বেশি জোর খাটাতে গেল না তাইতা। এমন একটা গতি স্থির করার চেষ্টা করল যাতে সে তাল মেলাতে পারে। কিন্তু উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন ছিল না ওর। মেয়েটা অক্লান্ত, ওর প্রতিজ্ঞা অটল।

প্রথমে ওকে আড়াল সৃষ্টির মায়া বিস্তারের কায়দা শেখাল তাইতা যা ওকে অন্যদের চোখের আড়ালে নিয়ে যাবে। রোজ দিনের শেষে ওরা অস্থায়ী প্রাচীরের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঢোকার পর এর চর্চা করতে লাগল ও। তাইতার পাশে চুপ করে বসে ওর সহায়তায় আড়াল সৃষ্টির চর্চা শুরু করে। মনোযোগ দেওয়ার জন্যে অনেকগুলো রাতের প্রয়োজন হলো, তবে শেষ পর্যন্ত সফল হলো ও। নিজেকে সে পুরোপুরি আড়াল করার পর চেঁচিয়ে মেরেনকে ডাকল তাইতা। ফেনকে দেখেছ? ওর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম।

এপাশ ওপাশ তাকাল মেরেন। কোনও বিরতি ছাড়াই ফেনের উপর দিয়ে ঘুরে এলো ওর দৃষ্টি। একটু আগেও এখানে ছিল সে। নিশ্চয়ই বাইরে ঝোপে টোপে গেছে। ওকে খুঁজতে যাব?

থাক লাগবে না, তেমন গুরুত্বপুর্ণ কিছু না। চলে গেল মেরেন, বিজয়ীর মতো হেসে উঠল ফেন।

পাঁই করে ঘুরল মেরেন, বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। ওই তো সে! আপনার পাশেই বসে আছে! হেসে ফেলল তারপর। চালাক মেয়ে, ফেন! অনেক চেষ্টা করেও পারিনি আমি।

ফেন ভৌত দেহ আড়াল করার কায়দা শেখার পর ওকে মন ও আভা আড়াল করার সবক দিতে পারল ও। এটা আরও কঠিন। প্রথমেই ডাইনীটা যে ওদের উপর নজর রাখছে না নিশ্চিত হতে হলো ওকে: পুরোপুরি দক্ষতা অর্জন না করা পর্যন্ত চেষ্টা চালানোর সময় যেকোনও বৈরী অপশক্তির কাছে নাজুক অবস্থায় থাকবে ও। দীক্ষা দান শুরু করার আগে চারপাশের ইথারে অনুসন্ধান চালাতে হলো তাইতাকে। নিজের প্রতিরক্ষা জোরাল রাখতে হলো।

প্রতিটি জীবন্ত বস্তুকে ঘিরে রাখা আভার বিষয়টি উপলব্ধি করাই ছিল ফেনের প্রথম কাজ। এটা দেখতে পাচ্ছিল না সে, অন্তর্চক্ষু উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত কোনওদিন দেখবেও না। ওকে দুর্গম যাত্রা পথে সরস্বতীর মন্দিরে নিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাইতা। তার আগে ব্যাপারটা ওর কাছে ব্যাখ্যা করতে হলো। আভার ধারণা বোঝার পর ফেনের কাছে অন্তর্চক্ষু ও সেটাকে কাজে লাগানোর মোহন্তের ক্ষমতার ব্যাপারটা খুলে বলতে পারল তাই।

তোমার অন্তর্চক্ষু আছে, তাইতা?

হ্যাঁ, তবে ডাইনীরও আছে, জবাব দিল ও।

আমার আভা দেখতে কেমন? অসাধারণ মেয়েলী অহঙ্কারের সাথে জানতে চাইল ফেন।

কাঁপতে থাকা সোনালি আলো, এমন কখনও দেখিনি বা দেখার আশাও করি না। উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফেনের চেহারা। বলে চলল তাইতা, এখানেই আমাদের সমস্যা। ওটাকে এভাবে জ্বলতে দিলে নিমেষে বুঝে ফেলবে ডাইনী, বুঝবে ওর পক্ষে তুমি কত মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারো।

কথাটা ভাবল ও। তুমি বললে, ডাইনী আমাদের উপর নজর রাখছে। তাহলে সেকি আগেই আমার আভা চিনে ফেলেনি? ওর কাছ থেকে তা লুকোনোর সময় ফুরিয়ে যায়নি?

অনেক দূর থেকে নজর রেখে এমনকি কোনও মোহন্তের পক্ষেও একটা আভা চিনে ফেলা সম্ভব নয়। শুধু বস্তুকে সরাসরি দেখেই সেটা সম্ভব। পুকুরের জলে ডাইনীকে একটা অপচ্ছায়া হিসাবে দেখেছি আমরা, আমাদেরও সে ওভাবেই দেখেছে। আমাদের দৈহিক সত্তা সম্পর্কে ধারণা করে থাকতে পারে সে, আমাদের কথাবার্তাও শুনতে পারে-এমনকি আমরা যেমন পেয়েছি তেমনি সেও আমাদের গন্ধ পেয়ে থাকতে পারে কিন্তু তোমার আভা দেখার কথা নয়।

তোমার বেলায়? তুমি আড়াল করে রেখেছিলে?

মোহন্ত হিসাবে-আমি বা ডাইনী-কেউই আভা বিলাই না।

আমায় আভা লুকোনোর কায়দা শিখিয়ে দাও, মিনতি করল ফেন।

সায় দিয়ে মাথা কাত করল তাইতা। শেখাব, তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। সে আমাদের উপর নজর রাখছে না বা আড়িপেতে কথা শুনছে না, এব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে আমাকে।

কাজটা সহজ ছিল না। ওর প্রয়াস কতটা সফল হচ্ছে বোঝার জন্যে তাইতার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে ওকে। ওর সর্বোচ্চ প্রয়াসে আভা প্রথমে ফিকে হয়ে এলেও অচিরেই আগের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরম অধ্যাবসায়ে কাজ চালিয়ে গেল ওরা; এবং আস্তে আস্তে ফেনের অসামান্য প্রয়াস ও তাইতার পরামর্শে মিটিমিটি ভাবটা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ম্লান হয়ে এলো। কিন্তু ইচ্ছামতো সেটাকে মেরেন বা অন্য কোনও সৈনিকের আভার চেয়ে নিচের মাত্রায় আনতে ও দীর্ঘ সময়ের জন্যে ঔজ্জ্বল্যের এই পর্যায়ে ধরে রাখতে কয়েক সপ্তাহ লেগে গেল।

মালভূমির শিবির ছেড়ে আসার নয় দিন পর নদীর ধারে পৌঁছুল ওরা। এপার থেকে ওপার প্রায় এক লীগ হলেও নীলের জল ওরা যেখানে ধুরা শস্য রোপন করেছিল সেখানকার পাহাড়ী জলধারার চেয়ে তেমন জোরে বইছে না। শুকনো বালি আর কাদার চরের বিশাল বিস্তারে ক্ষীণ ধারা প্রায় মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। তবে ওদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে এটাই যথেষ্ট ছিল। দক্ষিণে বাঁক নিল ওরা, তারপর পুব পার বরাবর আগে বাড়ল, রোজ অনেক লীগ দূরত্ব অতিক্রম করছে। হাতির দল ভূগর্ভস্থ পরিষ্কার পানির নাগাল পেতে নদীর তলদেশে গভীর গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। মানুষ ও পশু ওখান থেকে পানি খেল।

রোজ এই প্রাচীন ধূসর পশুর বিশাল পালের মুখোমুখি হচ্ছে ওরা, গর্ত থেকে পানি খাচ্ছে, খুঁড়ে করে প্রচুর পানি তুলে ফাঁক হয়ে থাকা গোলাপি গলায় ঢালছে, কিন্তু সেনা দলের আগমনে দল বেঁধে নদীর তীর ধরে কান দোলাতে দোলাতে ছুটে চলে যাচ্ছে, বনের ভেতর ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে হাঁক ছাড়ছে। পুরুষগুলোর অনেকেই বিরাট বিরাট শাদা দাঁত বহন করছে। অনেক চেষ্টায় শিকারীদের ওদের হত্যা করা থেকে বিরত রেখে ওগুলোকে অক্ষত চলে দিতে পারল মেরেন। এখন শিলুক গোত্রের অন্যদেরও গরুছাগল চরাতে দেখতে পাচ্ছে ওরা। আবেগে ভেসে গেল নো। প্রবীন সম্মানিত জন, এরা আমার আপন গ্রামের লোক। ওদের কাছে আমার পরিবারের খবর আছে, তাইতাকে বলল সে। দুই মৌসুম আগে আমার এক স্ত্রীকে কুমীর খেয়ে নিয়েছে, তবে অন্য তিনজন ভালো আছে, অনেক বাচ্চা হয়েছে ওদের। তাই জানে, গত সাত বছর কেবুইতে ছিল নোম্ভ, তাই বাচ্চা জন্মানোর কথা শুনে অবাক হলো ও। স্ত্রীদের ভাইদের হাতে রেখে গিয়েছিলাম, তিক্ত কণ্ঠে বলল নোস্তু।

মনে হচ্ছে ওদের ভালোই যত্ন নিয়েছে ওরা, শুষ্ক কণ্ঠে মন্তব্য করল তাইতা।

খুশি মনে বলে চলল নোস্তু, আমার বড় মেয়েটা প্রথম লাল চাঁদের দেখা পেয়েছে, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার বয়সে পৌঁছে গেছে ও। ওরা বলছে, বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে ও, অল্প বয়সী ছেলেরা অনেক গবাদি পশু যৌতুক দিতে রাজি হয়েছে। ওদের সাথে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। আমার আত্মীয় ওরা। গ্রামে ফিরে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। গরুছাগলের ব্যবস্থা করতে হবে।

তোমার বিদায়ে আমার খারাপ লাগবে, ওকে বলল তাইতা। তোমার কী অবস্থা নাকোতো? তুমিও কি আমাদের ফেলে চলে যাবে?

না, প্রবীন পুরুষ। আপনার ওষুধে আমার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, আপনার সাথে থাকলে ভালো খাবার যেমন মিলবে তেমনি মজার লড়াইও লড়া যাবে। অনেক স্ত্রী আর ওদের শোরগোল করে চলা ছেলেমেয়ের চেয়ে আমার বরং সেটাই পছন্দ। ওই সব বাধা ছাড়াই বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আপনার সাথেই থাকব।

নোন্তুর গ্রামের পাশে তিন দিনের জন্য শিবির করল ওরা। গরুছাগলের খোয়াড়ের চারপাশে বৃত্তাকারে তৈরি চমৎকারভাবে চাল বসানো বেশ কয়েক শো কোণাচে কুঁড়ের একটা সমাহার। রোজ রাতে ওখানে গবাদি পশু তুলে রাখে ওরা। এখানে রাখালরা গরুর দুধ দোয়ায়, তারপর প্রত্যেকটা পশুর গলার কাছের মহা ধমনী থেকে রক্ত সংগ্রহ করে। এটাই ওদের একমাত্র খাবার বলে মনে হলো। পুরুষ, এমনকি নারীরাও বেশ লম্বা, তবে ছিপছিপে; চলাফেরা মোহনীয়। গোত্রীয় টাটু থাকলেও অল্প বয়সী মেয়েরা বিবাহযোগ্যা ও দেখতে বেশ সুন্দর। শিবিরের চারপাশে ঘিরে বসে খোলামেলাভাবে সৈনিকদের সাথে হাসাহাসি করে ওরা।

তৃতীয় দিন নোয়ুকে বিদায় জানাল ওরা। বিদায়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল যখন, পাঁচজন সৈনিক মেরেনের কাছে এলো প্রতিনিধি হিসাবে। প্রত্যেকের সাথে একজন করে শিলুক মেয়ে; সঙ্গীর মাথা ছাড়িয়ে গেছে।

এই মেয়েদের সাথে নিয়ে যেতে চাই আমরা, ঘোষণা করল দলের মুখপাত্র শোফার।

তোমাদের ইচ্ছা ওরা বুঝতে পেরেছে? প্রস্তাবটা নিয়ে ভাববার সময় পেতে জিজ্ঞেস করল মেরেন।

নাকোন্তো ওদের বুঝিয়ে বলেছে, ওদেরও ইচ্ছে আছে।

ওদের বাবা আর ভাইদের কী মত? আমরা চাই না যুদ্ধ বেধে যাক।

ওদের সবাইকে একটা করে ব্রোঞ্জের ড্যাগার দিয়েছি আমরা, ওরা খুশি হয়েছে।

মেয়েরা ঘোড়া হাঁকাতে পারে?

না, তবে বেশ দ্রুত শিখে নিতে পারবে।

চামড়ার হেলমেট খুলে কোঁকড়া চুলে হাত চালাল মেরেন। তারপর পরামর্শের জন্যে তাইতার দিকে তাকাল। কাঁধ ঝাঁকাল তাইতা, তবে ওর চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠল। ওদের হয়তো অন্ততপক্ষে রান্না করা বা আমাদের কাপড়চোপড় ধোয়া শেখানো যেতে পারে, পরামর্শ দিল ও।

কেউ ঝামেলা বাধালে বা ঝগড়া বাধলে বা ওদের নিয়ে মারামারি লাগলে, ওদের যার যার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেব আমি, সে আমরা যত দূরেই যাই না কেন, শান্ত কণ্ঠে শোফারকে বলল মেরেন।ওদের সামলে রাখবে, ব্যস।

এগিয়ে চলল কলামটা। সেদিন সন্ধ্যায় ওরা যখন সেনা ছাউনীতে পৌঁছাল, রেওয়াজ মাফিক তাইতার কাছে রিপোর্ট করতে ছুটে এলো নাকোন্তো। কিছুক্ষণ ওর পাশে বসে থাকাই এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। আজ বেশ ভালোই এগিয়েছি আমরা, বলল সে। আরও এতগুলো দিন চলার পর… হাতের সবকটা আঙুল দেখাল ও। …আমার দেশের লোকদের ছেড়ে যাব আমরা, চিমাদের দেশে পৌঁছাব।

ওরা কারা? শিলুকদের ভাই?

ওরা আমাদের শত্রু। লম্বায় খাট, আমাদের মতো সুন্দর না।

ওরা আমাদের যেতে দেবে?

স্বেচ্ছায় নয়, প্রবীন পুরুষ, নেকড়ের মতো বলল নাকোন্তো। যুদ্ধ হবেই। অনেক বছর কোনও চিমাকে মারার সুযোগ হয়নি আমার। মামুলি ভাবনা হিসাবে যোগ করল সে। চিমারা মানুষখেকো।

*

উঁচু মালভূমি ছেড়ে আসার পর টানা চারদিন এগিয়ে তারপর পঞ্চম দিনে বিশ্রাম অনেওয়ার একটা রেওয়াজ খাড়া করেছে তাইতা ও মেরেন। সেদিন ক্ষতিগ্রস্ত সরঞ্জাম মেরামত করে ওরা, মানুষ ও পশুর দলকে বিশ্রাম দেয়, রসদের ঘাটতি পূরণের জন্যে শিকারী ও সংগ্রহকারী দলকে পাঠায়। নো ও তার স্ত্রীদের ছেড়ে আসার সতের দিন পরে শিলুকদের শেষ ক্যাটল পোস্ট অতিক্রম করে এলো ওরা। এমন একটা এলাকায় প্রবেশ করল যেখানে অ্যান্টিলোপের বিশাল সব পাল ছাড়া আর কোনও কিছুর বাস নেই বলেই মনে হলো। বেশিরভাগই এমন প্রজাতির যেমনটা এর আগে ওরা আর দেখেনি। গাছপালার নতুন সব প্রজাতিরও দেখা পেল ওরা। খুশি হয়ে উঠল তাইতা ও ফেন। তাইতার মতোই দক্ষ বৃক্ষ বিশারদে পরিণত হয়েছে ও। গবাদি পশু বা মানুষের সন্ধান করল ওরা, কিন্তু কারও ছায়া চোখে পড়ল না।

এটাই চিমাদের এলাকা, নাকোন্তো জানাল তাইতাকে।

জায়গাটা ভালো করে চেনো?

না, তবে চিমাদের ভালো করেই চিনি। গাঢাকা দিয়ে থাকে ওরা, বিশ্বাসঘাতক। গরুছাগল পোষে না, এটাই ওদের বর্বর হওয়ার আসল লক্ষণ। শিকারের মংস খায়। সবার চেয়ে স্বজাতীদের বেশি পছন্দ করে। ওদের রান্নার আগুনে গিয়ে পড়তে না চাইলে অনেক সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।

নাকোন্তোর সতর্কবাণী মাথায় রেখে রোজ সন্ধ্যায় যারীবা তৈরির সময় বিশেষ মনোয়োগ দিতে লাগল মেরেন। ঘোড়া ও খচ্চরের দলকে ঘাস খেতে ছেড়ে দেওয়ার সময় বাড়তি পাহারার ব্যবস্থা করছে। চিমা এলাকার আরও ভেতরে যাওয়ার সাথে সাথে ওদের উপস্থিতির নানান আলামত সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল ওরা। গাছের ফাঁপা কাণ্ড পেল, কেটে দুর্ফাক করে ধোয়া দিয়ে বের করে নেওয়া হয়েছে ভেতরের মোমাছি। তারপর একটা ছাপরার জটলার কাছে এলো ওরা, বেশ কিছুদিন মানুষের আবাস ছিল এখানে। অতি সাম্প্রতিক উৎসের চিহ্ন হচ্ছে নদীর কাদাময় তীরে একটা দলের পায়ের ছাপের সারি, এক সারিতে নদী পার হয়েছে তিরিশজনের দলটা। মাত্র কয়েক দিনের পুরোনো।

নতুন শিলুক স্ত্রীরা কেউই ফেনের চেয়ে বেশি বড় হবে না; গোড়া থেকেই ওকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ওরা। নিজেদের ভেতর ওর চুলের রঙ ও চোখ নিয়ে আলোচনা করছে, ওর প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে, কিন্তু দূরত্ব বজায় রাখছে। শেষে ওদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহার করে আগে বাড়ল ফেন, ফলে অচিরেই ওকে ওদের সাঙ্কেতিক ভাষায় কথাবার্তা বলতে দেখা গেল। ফেনের চুলের টেক্সচার অনুভব করল ওরা, মেয়েলি রসিকতায় তীক্ষ্ণ কণ্ঠে হাসতে শুরু করল, রোজ সন্ধ্যায় নগ্ন হয়ে অগভীর পুকুরে গোসল করতে লাগল। পরামর্শের জন্যে নাকোন্তোর কাছে আবেদন জানাল ফেন। ঠিক মিশরিয় ভাষার মতোই ঝটপট শিলুক ভাষা রপ্ত করে নিল ও। এক অর্থে এখনও ছেলেমানুষ রয়ে গেছে ও, মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার জন্যে সমবয়সী সঙ্গী পাওয়ায় খুশি হলো তাই। অবশ্য, সে যাতে অন্য মেয়েদের সাথে খুব বেশি দূরে চলে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করল। কাছে কাছে রাখছে ওকে যাতে বাতাসে অস্বাভাবিক শীতলতার প্রথম আলামতেই বা অচেনা উপস্থিতির অন্য কোনও লক্ষণ টের পাওয়া মাত্র ওর কাছে ছুটে যেতে পারে। শত্রুদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সে আর তাই শিলুক ভাষায় কথা বলতে শুরু করে।

সম্ভবত এটাই একমাত্র ভাষা এমনকি ডাইনীও যা বুঝতে পারবে না, যদিও আমার তাতে সন্দেহ আছে, মন্তব্য করল ও। অন্তত তোমার পক্ষে বেশ ভালো অনুশীলন এটা।

সারা দিন চলার পর চিমা এলাকার বেশ গভীরে চলে এসেছে ওরা, এখানে লম্বা লম্বা মেহগনি গাছের বনে যারীবা তৈরি করল। ওটার চারপাশে রসাল পাতার লম্বা লম্বা ঘাসের চারণভূমি। ঘোড়াগুলো পছন্দ করল। আগে থেকেই ওখানে অ্যান্টিলোপের দল চরে বেড়াচ্ছিল। এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ওই দলের উপর কখনও শিকারীর আক্রমণ হয়নি, কারণ ওগুলো এতটাই পোশ মানানো ও গায়ে পড়া ছিল শিকারীদের অনায়াসে তীর ছোঁড়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে পৌঁছে যেতে দিল।

মেরেন ঘোষণা করল, পর দিন ওরা বিশ্রাম নেবে। বেশ ভোরে চারটে শিকারী দল পাঠাল ও। তাইতা ও ফেন যখন ওদের রেওয়াজ মাফিক সংগ্রহ অভিযানে বের হলো, ওদের সাথে শোফার ও আরও দুজন সৈনিক দেওয়ার জন্যে জোর দিল মেরেন। হাওয়ায় এমন কিছু আছে আমাকে যা অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে, এছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা দিল না সে।

ফেনকে একান্তে কাছে রাখতেই পছন্দ করে তাইতা, কিন্তু মেরেন বাতাসে কুলক্ষণ টের পেলে তার সাথে তর্ক চলে না এটাও বেশ ভালোই জানে। মনস্তাত্ত্বিক না হলেও সে যোদ্ধা, ঝামেলার গন্ধ পায়। শেষ বিকেলে শিবিরে ফিরে এলো ওরা, মেরেনের পাঠানো শিকারী দলের ভেতর মাত্র তিনটা দলকে ফিরে আসতে দেখল। প্রথমে তেমন একটা কিছু মনে করল না এই ভেবে যে, হয়তো শেষ দলটা যেকোনও মুহূর্তে ফিরে আসবে। কিন্তু সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা পর নিখোঁজ শিকারীদের একজনের একটা ঘোড়া দৌড়ে শিবিরে ঢুকল। ঘামে সপসপ করছে ওটার শরীর, কাঁধে চোট পেয়েছে। সব সৈনিককে অস্ত্র তুলে নিতে বলল মেরেন, ঘোড়ার জন্যে বাড়তি পাহারার ব্যবস্থা নিল। নিখোঁজ শিকারীদের শিবিরে ফিরে আসতে সাহায্য করতে বনফায়ার জ্বলানোর নির্দেশ দিল।

ভোরের প্রথম ঝলকের সাথে সাথে আহত ঘোড়াকে ব্যাক ট্র্যাক করার মতো যথেষ্ট আলো ফোঁটার পর একটা সশস্ত্র অনুসন্ধানী দল নিয়ে বেরিয়ে গেল শাবাকো ও হিলতো। ফেনকে মেরেনের হেফাযতে রেখে নাকোন্তোকে নিয়ে ওদের সাথে যোগ দিল তাইতা। কয়েক লীগ এগোেনোর পরই রূপালি পাতার গাছপালার নিচে পৌঁছে ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মুখোমুখি হলো ওরা।

ট্র্যাক করার দক্ষতা ও চিমাদের অভ্যাস সম্পর্কিত বিদ্যায় ঠিক কী ঘটেছে বুঝে গেল নাকোন্তো। গাছপালার মাঝে গাঢাকা দিয়েছিল একটা বড়সড় দল, শিকারীদের জন্যে ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করছিল ওরা। একজনের ফেলে যাওয়া

একটা হাতির দাঁতের ব্রেসলেট তুলে নিল নাকোন্তো। এটা চিমাদের বানানো। দেখুন কত কাঁচা হাতের কাজ-একটা বাচ্চা শিলুকও এরচেয়ে ভালো জিনিস বানাতে পারবে। তাইতাকে বলল ও। গাছের কাণ্ডের চিহ্নের দিকে ইঙ্গিত করল, চিমাদের কেউ ওটা বেয়ে উঠেছিল। বিশ্বাসঘাতক শেয়ালগুলো এভাবেই লড়াই করতে পছন্দ করে, চোরের মতো চালাকি করে, সাহসের সাথে নয়।

গাছের ঝুলন্ত ডালের নিচ দিয়ে যাবার সময় চার মিশরিয়র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিমা। একই সময়ে আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে আসে তার সঙ্গীরা, আঘাত করে ঘোড়ার গায়ে। ঘোড়ার পিঠ থেকে আমাদের লোকদের টেনে নামায় চিমা শেয়ালগুলো, সম্ভবত প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্রও বের করতে পারেনি ওরা। লড়াইয়ের চিহ্নগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল নাকোন্তো। এখানে ওদের বর্শা দিয়ে মেরেছে-ঘাসের উপর রক্ত দেখতে পাচ্ছেন। গাছের বাকলের বেণী পাকানো রশি ব্যবহার করে লাশগুলো সবেচয়ে কাছের রূপালি পাতার গাছের নিচু ডালে উল্টো করে ঝুলিয়েছে চিমারা, তারপর অ্যান্টিলোপের মতো চামড়া খসিয়ে নিয়েছে।

সব সময় আগে কলজে আর নাড়িভূঁড়ি খায় ওরা, ব্যাখ্যা করল নাকোন্তো। কয়লার আগুনে পোড়ানোর আগে এখানেই পেটের ময়লা পুঁতেছে ওরা।

তারপর লাশগুলোকে চার টুকরো করে ভাড়ের সাথে গাছের বাকলের দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। এখনও গাছের ডালে ঝুলছে গোড়ালির সংযোগ স্থলে কেটে নেওয়া পাগুলো। মাথা আর হাত আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছে ওরা, পুড়ে যাওয়ার পর হাতের তালু চুষে খেয়ে আঙুলের হাড় থেকে মাংস টেনে নিয়েছে। আঙুল বাকা করে সেদ্ধ মগজ বের করতে বাড়ি মেরে খুলি ভেঙে তারপর গালের মাংস চেঁছে নিয়েছে, টেনে বের করে নিয়েছে জিভ, চিমাদের মজাদার খাবার। চারপাশে ভাঙা খুলি ও ছোট ছোট হাড়ের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মরা ঘোড়া নিয়ে মাথা ঘামাতে যায়নি ওরা। সম্ভবত এত মাংস সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তারপর হত্যা করা সৈনিকদের অন্যান্য অবশেষ, যেমন কাপড়চোপড়, শরীরের অন্যান্য অংশ, অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে চলে গেছে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমে।

ওদের শিকার করতে বেরুব আমরা? রাগের সাথে জানতে চাইল শাবাকো, রক্তের নেশায় লাল হয়ে আছে চোখজোড়া। কিন্তু এক মুহূর্ত ভেবে মাথা নাড়ল তাইতা। ওরা তিরিশ থেকে চল্লিশ জন, আমরা মাত্র ছয়জন। পুরো একটা দিনে এগিয়ে আছে ওরা, আমরা ওদের ধাওয়া করবে বলেই ধরে নেবে। আমাদের কঠিন এলাকায় টেনে নিয়ে গিয়ে অ্যাম্বুশে ফেলবে শেষে। বনের চারপাশে নজর বোলাল ও। নির্ঘাত আমাদের উপর নজর রাখতে তোক রেখে গেছে। এই মুহূর্তে সম্ভবত আমাদের দিকেই নজর রাখছে ওরা।

তলোয়ার বের করে নিয়েছিল কয়েক জন সৈনিক, কিন্তু গাছপালার ভেতর থেকে ওদের বের করে আনতে ছুটে যাবার আগেই ঠেকাল তাইতা। আমরা অনুসরণ না করলে ওরা আমাদের অনুসরণ করবে, সেটাই ওরা চায়। ওদের আমরা আমাদের পছন্দ মতো একটা বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতে পারব। কাটাপায়ের সাথে করুণ দর্শন খুলিগুলো কবর দিল ওরা, তারপর ফিরে এলো যারীবায়।

পরদিন সকাল সকাল কলাম গঠন করে ফের অন্তহীন যাত্রা শুরু করল। দুপুরে যাত্রা বিরতি দিয়ে বিশ্রাম নিল, ঘোড়াকে পানি খাওয়াল। তাইতার নির্দেশে গাছপালার ভেতর পিছলে ঢুকে পড়ল নাকোন্তো, বড়সড় একটা বৃত্তের আকারে চক্কর দিয়ে এলো। ছায়ার মতো পিছলে কলামের ব্যাক ট্রেইলে উঠে এলো ও। ঘোড়ার ট্র্যাকের উপর তিন সেট নালবিহীন ঘোড়ার পায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। দলের সাথে যোগ দিতে আরেকটা বড় বৃত্তের আকারে চক্কর দিয়ে তাইতার কাছে রিপোর্ট করতে এলো ও। আপনার চোখ অনেক কড়া, প্রবীন পুরুষ। যেমন অনুমান করেছিলেন, তিনটা শেয়াল আমাদের পিছু নিয়েছে। দলের বাকিগুলোর বেশি দূরে থাকার কথা নয়।

সেদিন সন্ধ্যায় যারীবার আগুনের পাশে বসে পরের দিনের পরিকল্পনা খাড়া করল ওরা।

পরদিন সকালে বেশ দ্রুত চালে যাত্রা শুরু করল। আধা লীগ যাওয়ার পরপরই গতিকে দুলকি চালে তুলে আনতে নির্দেশ দিল মেরেন। দ্রুত নিজেদের ও চিমা স্কাউটদের মাঝখানের ফাঁক বাড়িয়ে তুলল, জানে পিছন পিছন আসছে ওরা। সামনে বাড়ার সময় ওরা যে এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল সেটাকে জরিপ করছিল মেরেন ও তাই। সুবিধাজনক জায়গার খোঁজ করছে। সামনে বনের ভেতর ছোট বিচ্ছিন্ন টিলা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কোণাকুণি ওটার দিকেই এগোল ওরা। পুবের ঢাল ঘুরে আসার পর একটা মসৃণ বেশ পর্যদস্ত হাতি চলাচলের পথের দেখা পেল। ওটা অনুসরণ করে মাথার উপরের পাহাড়ের শরীর বেশ খাড়া আবিষ্কার করল। ঘন হয়ে জন্মানো কিতার কাঁটাঝোপে ঢাকা। ভয়ঙ্কর কাটা আর গায়ে গায়ে জড়ানো ডালপালা দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করেছে। রাস্তার উল্টো দিকে জমিন সমান, প্রথম দেখায় উন্মুক্ত জঙ্গলটা অ্যাম্বুশের পক্ষে তেমন একটা আড়াল দিতে পারবে বলে মনে হলো না। তবে গাছপালার ভেতর আরও খানিকটা দূরে আসার পর একটা ওয়াদি দেখতে পেল তাইতা ও মেরেন, ঝড়ের পানির ধাক্কায় তৈরি একটা শুকনো নালা, ওদের কলাম ও ঘোড়া আড়াল করার পক্ষে যথেষ্ট গভীর ও প্রশস্ত। নালার মুখটা হাতির রাস্তা থেকে মাত্র চল্লিশ গজ দূরে, তীরের সহজ নিশানার ভেতর। চট করে আবার মূল কলামের সাথে যোগ দিল ওরা। অল্প সময়ের জন্যে হাতির রাস্তায় এগিয়ে আবার থামল মেরেন, ওর সেরা তিনজন তীরন্দাজকে রাস্তার ধারে গা ঢাকা দেওয়াল।

তিন চিমা স্কাউট আমাদের পিছু নিয়েছে। তোমাদের প্রত্যেকের ভাগে একটা করে, ওদের বলল ও। ওদের কাছে আসতে দেবে, সময় নিয়ে শিকার বেছে নেবে। ভুল করা চলবে না। দ্রুত, পরিষ্কার নিকেশ। ওদের পেছন আসতে থাকা বাকি চিমাদের সতর্ক করে দিতে কাউকে পালাতে দেওয়া যাবে না।

তিন তীরন্দাজকে রেখে হাতি সড়ক ধরে আগে বাড়ল ওরা। আধা লীগ এগোনোর পর রাস্তা ছেড়ে বড় একটা বৃত্তের আকারে পাহাড়ের ঢালের নিচের নালার দিকে এগিয়ে এলো। ওটায় নামাল ঘোড়াগুলো, তারপর স্যাডল ছাড়ল। ফেন ও শিলুক মেয়েরা পশুদের ধরে রাখল। সৈনিকরা হাঁক দিলেই সামনে নিয়ে যেতে তৈরি। ফেনের সাথে অপেক্ষায় রইল তাইতা। কিন্তু সময় হলে মেরেনের কাছে হাজির হতে মাত্র এক মুহূর্ত সময় লাগবে ওর।

ধনুকে তীর পরাল লোকেরা, তারপর ওয়াদির ঠিক মুখের নিচে লাইন বেঁধে দাঁড়াল, হাতির রাস্তার দিকে মুখ। মেরেনের নির্দেশে পা আর ধনুক ধরা হাতকে বিশ্রাম দিতে ও লড়াইয়ের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করতে চোখের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল ওরা। কেবল মেরেন ও তার ক্যাপ্টেনরা রাস্তার দিকে নজর রাখছে, কিন্তু মাথার ছায়া আড়াল করতে ঘাস বা ঝোঁপের জটলার আড়ালে অবস্থান নিয়েছে ওরা।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওদের, রাস্তা ধরে হাজির হলো তিন চিমা স্কাউট। ঘোড়ার সাথে তাল মেলাতে অনেক জোরে ছুটতে হয়েছে ওদের। ঘামে চকচক করছে ওদের শরীর, হাপরের মতো ওঠানামা করছে বুক, হাঁটু অবধি ধূলোয় মাখামাখি হয়ে আছে পা। সতর্ক করার ভঙ্গিতে একটা হাত ওঠাল মেরেন। নড়ল না কেউ। বেশ দ্রুত দুলকি চালে অ্যাম্বুশের জায়গাটা পার হয়ে গেল স্কাউটরা, রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের ভেতর। একটু স্বস্তি বোধ করল মেরেন। খানিক পরে স্কাউটদের ব্যবস্থা করার জন্যে ওর রেখে আসা তিন সৈনিক বন থেকে পিছলে বের হয়ে ওয়াদিতে লাফিয়ে নামল। জিজ্ঞাসু চোখে ওদের দিকে তাকাল মেরেন। দাঁত বের করে হেসে নিজের টিউনিকে টাটকা রক্তের ছিটা দেখাল ওকে। স্কাউটদের ব্যবস্থা করা গেছে। এবার চিমাদের মূল দলের আগমনের অপেক্ষায় স্থির হয়ে বসল ওরা।

অল্প সময় পর ডান পাশের জঙ্গল থেকে ধূসর লরির কাঁচকোচ সতর্ক আওয়াজ কী-ওয়ে! কী-ওয়ে! শোনা গেল। তারপর পাহাড়ের মাথা থেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল একটা বেবুন। নিজের লোকদের সঙ্কেত দিতে একটা হাত তুলল মেরেন। ধনুকে তীর পরাল ওরা।

চিমাদের মূল দলের সামনের সারিটা হাতি সড়কের বাঁক ঘুরে দুলকি চালে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি আসার পর তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করল মেরেন: বাঁকা পা, গাট্টাগোট্টা লোকগুলোর পরনে কেবল ট্যান করা পশুর ছালের নেংটি ছাড়া কিছু নেই। এমনকি গোটা দলটা দৃষ্টিসীমায় আসার পরেও মাথা গোনা কঠিন হয়ে দাঁড়াল, নিবিড় ফর্মেশনে দ্রুত ছুটছে ওরা।

অন্তত একশো জন তো হবেই, বেশিও হতে পারে। ভালোই খেলা জমবে এবার। নিশ্চিত করে বলতে পারি, প্রত্যাশার সাথে বলল মেরেন। মুগুর আর পাথরের বর্শার মতো নানা ধরনের অস্ত্র রয়েছে চিমাদের কাছে। ওদের কাঁধে ঝোলানো ধনুকগুলো ছোট, আদিম। মেরেন আন্দাজ করল তিরিশ কদমের বেশি দূর থেকে মানুষ মারার মতো টান থাকবে না ওগুলোর। কাঁধে মিশরিয় তলোয়ার ঝুলিয়ে চলতে থাকা সর্দারের দিকে নজর গেল ওর। তার পেছনের লোকটার মাথায় চামড়ার হেলমেট, কিন্তু বেশ আদিম নকশার। ব্যাপারটা বিভ্রান্তিকর, কিন্তু এখন ওসব নিয়ে ভাববার সময় নেই। নিশানা বোঝার জন্যে রাস্তায় বসিয়ে রেখে আসা শাদা পাথরটার কাছে পৌঁছল চিমা ফর্মেশনের সামনের অংশ। এখন গোটা বামদিকের অংশ মিশরিয় তীরন্দাজদের জন্যে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে।

ডানে বামে তাকাল মেরেন। ওর লোকজনের চোখ ওর ওপর স্থির হয়ে আছে। অকস্মাৎ ডান হাত নামিয়ে আনল ও। নিমেষে সোজা হয়ে গেল তীরন্দাজরা। একসাথে ছিলা টানটান করল। নিশানা স্থির করতে মুহূর্তের বিরতি দিল, তারপরই আকাশের পটভূমিতে অনেক উঁচুতে ছুঁড়ে দিল নিঃশব্দ তীরের মেঘ। প্রথমটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার আগেই দ্বিতীয় মেঘটা উড়ে গেল আকাশের দিকে। এত কোমলভাবে নেমে এলো তীরগুলো, চিমারা এমনকি উপরের দিকে তাকালও না। তারপর ঝিলের জলে পড়া বৃষ্টির পানির মতো শব্দে ওদের মাঝে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ওদের কপালে কী ঘটছে চিমারা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো না। একজন তার পাঁজরের হাড়ের মাঝখানে খাড়া হয়ে থাকা তীরের ফলার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তরপর হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল তার। হুড়মুড় করে জমিনে লুটিয়ে পড়ল সে। আরেকজন গালায় বেঁধা তীর বের করার প্রয়াসে ছোট একটা বৃত্তের আকারে পাক খেয়ে চলেছে। অন্যদের বেশিরভাগই, এমনকি যারা মারণ আঘাত লাভ করেছে, আঘাত পেয়েছে বলে টের পেয়েছ বলে মনে হলো না।

তৃতীয় দফা তীরের বৃষ্টি এসে পড়ার সময়ও যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আতঙ্কে আর্তচিৎকার ছেড়ে গর্জন করতে করতে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল, যেন ঈগলের আক্রমণের ফলে ছুটছে এক দল গিনি-মুরগী। সোজা ওয়াদির দিকে ছুটে এলো কেউ কেউ, ওদের নিশানা করল তীরন্দাজরা। অল্প দূরত্বে একটা তীরও ফস্কালো না: ভারি শব্দে জীবন্ত দেহের গভীরে গেঁথে গেল। কোনওটা মূল লক্ষ্যবস্তুর ঠিক ধড় ভেদ করে তারপর পেছনের লোকটাকে আহত করতে উড়ে গেল। যারা পাহাড় বেয়ে উঠে পালানোর চেষ্টা করছিল, তারা সোজা কিতার কাঁটাঝোঁপের বেড়ার উপর গিয়ে পড়ল। চলার উপরই থমকে গেল ওরা, আবার তীর বৃষ্টির ভেতর ফিরিয়ে আনল ওদের।

ঘোড়া নিয়ে এসো! চিৎকার করে উঠল মেরেন। ফেন ও অন্য মেয়েরা গলার দড়ি ধরে টেনে নিয়ে এলো ওগুলো। উইন্ডস্মোকের পিঠে উঠে বসল তাইতা, ওদিকে মেরেন ও আরও লোকজন ধনুক পিঠে তুলে নিয়ে ঘোড়ায় চাপল।

সামনে বাড়ো! চিৎকার করে নির্দেশ দিল মেরেন। ওদের কাছে নিয়ে যাও তলোয়ারের ফলা। নালার পাশ বেয়ে সমতলে উঠে গেল অশ্বারোহীরা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চিমাদের বিশৃঙ্খল দলটার দিকে ধেয়ে গেল। ওদের আসতে দেখে ঢাল বেয়ে পালানোর চেষ্টা করল ওরা। কাঁটা ঝোঁপ আর চকচকে তলোয়ারের ব্রোঞ্জের বৃত্তের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল ওরা, হাত দিয়ে মাথা আড়াল করল। ওদের আঘাত করতে রেকাবে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ঘোড়সওয়াররা। অন্যরা জালে আটকা মাছের মতো কাঁটাঝোঁপের ভেতর তড়পাচ্ছে। কাঠ চেরাই করার মতো ওদের কচুকাটা করল সৈনিকরা। যখন বীভৎস কাজ শেষ করল ওরা, পাহাড়ের ঢাল ও নিচের জমিন লাশে ঢেকে গেছে। কয়েকজন চিমা গোঙাচ্ছে, বা বিলাপ বরছে, কিন্তু বেশিরভাগই স্থির পড়ে রয়েছে।

ঘোড়া থেকে নামমা! নির্দেশ দিল মেরেন। কাজটা শেষ করো।

মাঠের উপর দিয়ে দ্রুত এগোল সৈনিকরা। প্রাণের চিহ্ন দেখলেই আঘাত করছে চিমাদের। কাঁধে ব্রোঞ্জের তলোয়ার ঝোলানো লোকটাকে খুঁজে বের করল মেরেন। তিনটা তীরের ফলা বের হয়ে আছে তার বুক থেকে। তলোয়ারটা উদ্ধার করতে তার সামনে এসে উবু হলো মেরেন, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে চিৎকার করে উঠল তাইতা, মেরেন! তোমার পেছনে! কণ্ঠের শক্তিকে কাজ লাগাল ও। জমে গেল মেরেন। লাফ দিয়ে একপাশে সরে গেল। এতক্ষণ ওর পাশে পড়ে থাকা চিমা মড়ার ভান করছিল। মেরেন অসতর্ক হওয়ার অপেক্ষা করেছে, তারপর লাফিয়ে উঠে ভারি পাথরের মাথাঅলা মুগুর হাঁকিয়েছে। অল্পের জন্যে মেরেনের মাথা ফস্কে গেছে ওটা, কিন্তু বাম কাঁধে ঘষা লেগেছে। পাঁই করে ঘুরে কাছে চলে এলো মেরেন, অস্ত্রের পরবর্তী আঘাতটা ঠেকাল। পরক্ষণে চিমার শরীরে ঢুকিয়ে দিল নিজের তলোয়ারের ডগা, স্টারনাম থেকে মেরুদণ্ড পর্যন্ত এফোড়ওফোঁড় হয়ে গেল। ক্ষতস্থানটাকে আরও বড় করে তুলতে কব্জিতে একটা মোচড় দিয়ে তলোয়ার ঘোরাল ও। ওটা এক টানে বের করে আনার সময় সাথে সাথে ছলকে বের হয়ে এলো হৃৎপিণ্ডের রক্ত।

আহত বাম কাঁধ শক্ত করে ধরে চিৎকার করে উঠল মেরেন। সবকটাকে মেরে ফেল, আবার! এবার নিশ্চিত করো ব্যাপারটা।

বন্ধুরা কসাইয়ের তাকে ঝুলছিল, কথাটা মনে করে সানন্দে কাজে লেগে গেল সৈনিকরা। কোপ মরছে, ঘাই দিচ্ছে। কিতার কেঁপে কয়েক জন চিমাকে গাঢাকা দিয়ে থাকতে দেখল ওরা। টেনে হিঁচড়ে বের করে সবকটাকে জবাই করল, তখন শুয়োরের মতো চিৎকার করছিল ওরা।

ওদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবার পরেই কেবল লোকজনকে লাশের ভেতর আবার কাজে লাগাতে তীর সংগ্রহ করার অনুমতি দিল মেরেন। একমাত্র ওই আহত হয়েছে। কোমর পর্যন্ত নগ্ন হয়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল ও, ওর কাঁধ পরীক্ষা করল তাইতা। রক্ত ঝরছে না। কিন্তু গাঢ় একটা দাগ ছড়িয়ে পড়ছে। সন্তোষের সাথে ঘোঁৎ করে শব্দ করল তাইতা। কোনও হাড়গোড় ভাঙেনি। ছয় কি সাত দিনের মধ্যেই তোমার মতো বুড়ো কুকুর একেবারে তরতজা হয়ে উঠবে। একটা মলম দিয়ে কাঁধটা পরিষ্কার করে তারপর আরামদায়কভাবে বাহু ঝোলাত লিনেনের একটা স্লিং বেঁধে দিল। এবার মেরেনের পাশে বসল ওঃ ক্যাপ্টেনরা মৃত চিমাদের লাশ থেকে সংগ্রহ করা মালপত্র পরীক্ষার জন্যে এনে ওদের সামনে নামিয়ে রাখতে লাগল। খোদাই করা কাঠের উকুন বাছার চিরুণী, আনাড়ী হাতে বানানো হাতির দাঁতের ট্রিনকেট, জল-কধু, আর পাতায় মোড়ানো গাছের বাকলের দড়ি দিয়ে বাঁধা ঝলসানো মাংসের কিছু প্যাকেট, ওগুলোর কিছু এখনও হাড়ের সাথে লেগে আছে। পরীক্ষা করল তাইতা। মানুষের। প্রায় নিশ্চিতভাবেই আমাদের কমরেডদের অবশিষ্টাংশ। সম্মানের সাথে কবর দাও।

এরপর চিমা অস্ত্রের দিকে মনোযোগ দিল ওরা। বেশিরভাগই পাথর বা আগ্নেয় শিলার মাথাঅলা মুগুর আর বর্শা। ছুরির ফলাগুলো পাথরের কাটা অংশ, শুকনো চামড়ার ফিতেয় মোড়ানো হাতল। আবর্জনা! নিয়ে যাবার মতো নয়, বলল মেরেন।

মাথা দুলিয়ে সায় দিল তাইতা। সব আগুনে ফেলে দাও।

অবশেষে নিশ্চিতভাবে চিমাদের তৈরি নয় এমন সব অস্ত্র ও অলঙ্কার পরখ করল ওরা। কয়েকটা স্পষ্টতই অ্যাম্বুশে নিহত চার শিকারীর কাছ থেকে নেওয়া-ব্রোঞ্জের অস্ত্র ও বাঁকানো তীর, চামড়ার হেলমেট ও প্যাড লাগানো জারকিন, লিনেন টিউনিক ও টাকোয়েযের তাবিজ আর নীলকান্তমণি পাথর। তবে কৌতূহল জাগানোর মতো অন্য জিনিসও ছিল: জারজীর্ণ পুরোনো চামড়ার হেলমেট, অনেক দশক ধরেই এই জিনিস মিশরিয়রা ব্যবহার করে না। তারপর রয়েছে সেই তলোয়ারটা যেটার কারণে আরেকটু হলেই মরতে বসেছিল মেরেন। ওটার ফলা ক্ষয়ে গেছে, কিনারা কর্কশ গ্রানিট বা অন্য কোনও পাথরে সাথে ঘঁষে শানাতে গিয়ে প্রায় ধ্বংস হওয়ার যোগাড়। তবে, হাতলটা বেশ ভালোভাবে কাজের রয়েছে, রূপার আস্তরণ দেওয়া। খালি সিটিং রয়েছে যেগুলো থেকে মূল্যবান পাথর খুঁড়ে বের করে নেওয়া হয়েছে বা পড়ে গেছে। খোদাই করা হিরিওগ্রাফিক প্রায় মুছে গেছে। আলোর মুখে ধরে এপাশ ওপাশ নাচাল ওটা তাইতা, কিন্তু পড়তে পারল না। ফেনকে ডাকল ও। তোমার তীক্ষ্ণ তরুণ চোখ কাজে লাগাও।

ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে খোদাই কর্মে নজর বোলাল ফেন, থেমে থেমে পড়ল। আমি লত্তি, লত্তির ছেলে। লাল পথের দশ হাজার সঙ্গীর সেরা, স্বর্গীয় ফারাও মামোজের সেনাপতি ও কমান্ডার। তিনি চিরজীবী হোন!

লত্তি! জোরে বলে উঠল তাইতা। খুব ভালো করে চিনতাম ওকে। ইথিওপিয়া থেকে নীল মাতার উৎস খুঁজে বের করার জন্যে রানি লস্ত্রিসের পাঠানো অভিযানে লর্ড আকেরের অধীনে সহঅধিনায়ক ছিল। চমৎকার সৈনিক। মনে হচ্ছে, সে আর তার লোকজন অন্তত এ-পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল।

তবে কি লর্ড আকের ও বাকি সবাই এখানেই মারা গেছে, নাকি চিমারা খেয়ে নিয়েছে? ভাবনা প্রকাশ করল মেরেন।

না। হাথরের ছয় আঙুলঅলা ক্ষুদে যাজক টিপটিপের কথামতো আকের আগ্নেয়গিরি ও বৃহৎ হ্রদ দেখেছিল। তাছাড়া রানি লসি এক হাজার লোক দিয়েছিল তার অধীনে। ওদের সবাইকে চিমারা খেয়ে ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। বলল তাইতা। আমার বিশ্বাস, আমাদের লোকদের মতো লত্তির অধীনেও একটা ছোট ডিটাচমেন্টকে বাগে পেয়েছিল ওরা। কিন্তু চিমারা কি গোটা একটা মিশরিয় বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছে? মনে হয় না। আলোচনা অব্যাহত থাকার সময় আড়চোখে ফেনের অভিব্যক্তি জরিপ করছিল তাইতা। যখনই রানি লস্ত্রিসের নাম উচ্চারণ করছিল, ভুরু কুঁচকে উঠছিল ওর। যেন অনেক দূরের কোনও স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছে, পলাতক স্মৃতি। ওর মনের গভীরে কোথাও তুলে রাখা। কোনও একদিন সম্পূর্ণই ফিরে আসবে ওর কাছে, ওর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, ভাবল তাইতা, কিন্তু মেরেনের উদ্দেশে জোরে বলল, লত্তির নিয়তি সম্পর্কে আসল সত্যি হয়তো কোনওদিনই জানা হবে না আমাদের, তবে ওর তলোয়ারটা আমার কাছে লর্ড আকেরের অনেক আগে চলে যাওয়া দক্ষিণের পথে আমরা যে ঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছি তার প্রমাণ তুলে ধরছে। ইতিমধ্যে অনেক সময় নষ্ট করেছি এখানে। উঠে দাঁড়াল ও। কত দ্রুত রওয়ানা দেওয়া যাবে?

সবাই তৈরি, বলল মেরেন। পড়াশোনা থেকে সবে রেহাই পাওয়া ছেলেদের মতোই উৎফুল্ল ওরা, ছায়ায় বসে শিলুক মেয়েদের সাথে ঠাট্টা করছে, ওদের খাবার পরিবেশন করছে ওরা, ধুরা বিয়রের জার তুলে দিচ্ছে হাতে। ওরা কত উদগ্রীব হয়ে আছে দেখুন। উচ্চ রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী বেশ্যার সাথে রাত কাটানোর চাইতে মনোবল চাঙা করতে দারুণ একটা লড়াই অনেক বেশি উপকারী। জোরে হেসে উঠতে গিয়েও থেমে হাত তুলে আহত কাঁধ ডলতে শুরু করল সে। লোকজন তৈরি, কিন্তু দিন প্রায় শেষের পথে। অল্প একটু বিশ্রাম ঘোড়াগুলোর পক্ষে উপকারী হবে।

তোমার কাঁধের পক্ষেও, সায় দিল তাইতা।

*

প্রবল অথচ ছোটখাট লড়াইটা যেন আরও চিমা হামলার সম্ভাবনা পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হলো। পরের দিনগুলোতে ওদের উপস্থিতির আলামত চোখে পড়লেও কোনওটাই সাম্প্রতিক সময়ের ছিল না। এমনকি এইসব ইঙ্গিতগুলোও ক্রমশঃ কম ঘন হয়ে শেষে বন্ধ হয়ে গেল। চিমাদের এলাকা ছেড়ে জনবসতিহীন এলাকায় পা রাখল ওরা। নীল এখনও ক্ষীণতোয়া থাকলেও আশপাশের এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাতের চিহ্ন রয়েছে। শিকারের পশুতে গিজগিজ করছে বন আর সাভানাহ। মাঠের ঘাস রসাল, প্রচুর। ততদিনে সৈনিকরা বাড়ির জন্যে মন খারাপ করতে শুরু করবে, মনমরা হয়ে থাকবে বলে ভয় করছিল তাইতা; ওরা প্রফুল্ল রয়ে গেল, ওদের প্রাণশক্তি তুঙ্গে।

ফেন আর শিলুক মেয়েরা মেয়েলি হাসি-ঠাট্টা ও চড়া আমোদে দিয়ে পুরুষদের আনন্দ যোগাচ্ছে। মেয়েদের ভেতর দুজন অন্তসত্তা হয়ে পড়েছে। ওরা কীভাবে এমন একটা সুখময় অবস্থায় এলো সেটা জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠল ফেন। জিজ্ঞেস করলেই হাসিতে ভেঙে পড়তে লাগল ওরা। কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে তাইতার কাছে এলো ফেন। ব্যাখ্যা সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট রেখে দিল ও। খানিকক্ষণ ও নিয়ে ভেবে তারপর ফেন বলল, শুনে তো মজার খেলা মনে হচ্ছে। কথাটা মেরেনের কাছে শিখেছে ও।

চেহারা গম্ভীর রাখার প্রয়াস পেল তাইতা, কিন্তু হাসি ঠেকাতে পারল না।

আমিও তাই শুনেছি, সায় দিল ও।

আমি বড় হলে খেলার জন্যে একটা বাচ্চা চাইব, ওকে বলল ফেন।

সন্দেহ নেই, পাবে তুমি।

আমরা দুজনে মিলে সেটা পেতে পারি। সেটা কি দারুণ খেলা হবে না, তাইতা?

নিশ্চয়ই, বেদনার সাথে সায় দিল তাইতা, এটি কোনওদিনই হবার নয়। কিন্তু তার আগে আমাদের হাতে আরও অনেক জরুরি কাজ আছে।

সেই অনেক আগে যখন ও ছিল তরুণ আর লস্ত্রিস বেঁচে ছিল তারপর থেকে নিজেকে এত ভালো অবস্থায় আর কখনও দেখেছে, এমনটা মনে করতে পারে না তাইতা। নিজেকে এখন অনেক ক্ষিপ্র, অনেক কমনীয় মনে হয়। আগের মতো এখন অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে না। ফেনের সঙ্গের কারণেই এটা হয়েছে বলে ধরে নিয়েছে।

ফেনের শিক্ষা এত দ্রুত এগোচ্ছে যে ওর মন চালু বা এর ক্ষমতার কাছাকাছি রাখতে অন্যান্য উপায় বের করতে বাধ্য হচ্ছে তাই। ওকে একটু ঢিলে হতে দিলেই মন সরে যাচ্ছে। এতদিনে শিলুক আর মিশরিয় ভাষার দুটোই বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছে ও।

ওকে দক্ষ সাধকে পরিণত হতে ম্যগাইদের ভাষা তেনমাস শিখতেই হবে। অন্য কোনও ভাষা নিগূঢ় এই বিষয়টির সম্পূর্ণ শিক্ষা ধারণ করে না। তবে তেনমাস বেশ জটিল ও বহুমুখী ভাষা, অন্য মানবীয় ভাষার সাথে এর সম্পর্ক এত ক্ষীণ যে কেবল তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও মনোযোগের অধিকারীরাই দক্ষতা লাভের আশা করতে পারে।

এটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ, ফেনের ভেতর থেকে সেরাটা বের এনেছে ও। প্রথমে ওর মনে হয়েছিল বুঝি পলিশ করা কাঁচের দেয়াল বেয়ে উঠতে বলা হচ্ছে ওকে, যেখানে হাত বা পা রাখার মতো জায়গাই নেই। অনেক খেটে খানিকটা উপরে ওঠে ও, তারপর আতঙ্কের চোটে হাত ফসকে পিছলে পড়ে যায়। আবার নিজেকে তুলে আনার চেষ্টা চালায়। প্রতিবার আগের চেয়ে অনেক হিংস্রভাবে। একবারের জন্যেও হতাশ হয়নি ও, এমনকি যখন মনে হচ্ছিল একেবারেই অগ্রগতিই হচ্ছে না, তখনও না। ওকে দায়িত্বের গুরুত্বের মুখোমুখি করে তুলছিল তাইতা, কেবল তাহলেই সামনে এগোতে তৈরি হতে পারবে ও।

এলো সেই মুহূর্ত, কিন্তু রাতে মাদুরের বিছনায় একা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তাইতা। তারপর কপালে হাত রেখে ও সম্মোহনী ঘুমে তলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আস্তে আস্তে কথা বলে চলল। সম্পূর্ণ গ্রাহী হয়ে উঠলে ফেনের মনে তেনমাসের বীজ বপনের কাজ শুরু করতে পারল ও। শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মিশরিয় ভাষা ব্যবহার না করে বরং সরাসরি তেনমাস ভাষাতেই কথা বলল ওর সাথে। ভাষার বীজ শক্ত অবস্থান পেতে অনেকগুলো নিশি আসরের প্রয়োজন হলো। প্রথমবার দাঁড়ানোর প্রয়াসরত শিশুর মতো অনিশ্চিত কয়েকটা পদক্ষেপ নিল ও, তারপর লুটিয়ে পড়ল। পরের বার আগের চেয়ে অনেক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে উঠে দাঁড়াল ও। ওকে বেশি কষ্ট না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকলেও যুগপৎ ওকে আগে বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল তাইতা। বেশি চাপ দিলে ফেন পিছিয়ে যেতে পারে, ওর চেতনা ভেঙে পড়তে পারে জানা থাকায় বাও বোর্ডে যথেষ্ট আনন্দময় সময় কাটানো বা সহজ কিন্তু চনমনে আলাপে চালানো, কিংবা বিরল গাছ কিংবা অন্যান্য ছোটখাট প্রাণীর খোঁজে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর দিকে খেয়াল রাখল ও।

নদীর তলদেশে পছন্দসই নুড়ি পাথরের বিস্তার দেখলেই খচ্চরের পিঠ থেকে সোনা চালার পাত্র নামিয়ে একসাথে কাজে নেমে পড়ছে ওরা। তুলে আনা ঘোলা জল পাক খাওয়ায় তাইতা, ফেন ওর চোখ ও সাবলীল হাতে সুন্দর আধা-মূল্যবান পাথর বেছে নেয়। অনেক পাথরই পানির টানে অসাধরাণ সুন্দর আকার পেয়েছে। একটা ব্যাগ ভরে যাওয়ার পর মেরেনকে দেখাল ফেন। ওকে মানানসই অ্যাংকলেটসহ একটা বাজুবন্ধ বানিয়ে দিল সে। একদিন একটা শুকনো জলপ্রপাতের নিচে পাত্র থেকে বুড়ো আঙুলের প্রথম গিঁটের সমান আকৃতির একটা সোনার টুকরো খুঁজে পেল ও। রোদ লেগে ঝিকিয়ে উঠল ওটা, ওর চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিল। আমাকে একটা অলঙ্কার বানিয়ে দাও, তাইতা, দাবি জানাল ও।

ব্যাপারটা আড়াল করতে পারলেও ফেন মেরেনের বানানো অলঙ্কার পরার পর এক ধরনের ঈর্ষার খোঁচা বোধ করল তাইতা। এই বয়সে? নিজের অবস্থার কথা ভেবে হাসল ও। যেন প্রেমের জন্যে ব্যাকুল রাজহাঁস। তবে ফেনকে নিয়ে নিজের কাজের দিকে পূর্ণ মনোযোগ ও সৃজনশীল মেধা খাটাল ও। সোনার টুকরোটা ঝোলাতে লত্তির তলোয়ারের হাতলের রূপা থেকে একটা সরু চেইন ও একটা সেটিং বানিয়ে দিল ও। কাজটা শেষ হলে ওটা যে পরবে তাকে রক্ষার জন্যে প্রতিরক্ষার জাদু পড়ে ওর গলায় ঝুলিয়ে দিল। নদীর পুকুরে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকানোর পর চোখজোড়া জলে ভরে উঠল ওর। অনেক সুন্দর, ফিসফিস করে বলল ও। গায়ে বেশ উষ্ণ ঠেকছে, যেন জীবন্ত কিছু। ওর অনুভূত উষ্ণতা আসলে ওটাকে তাইতার দেওয়া ক্ষমতার বিচ্ছুরণ মাত্র। ফেনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসে পরিণত হলো ওটা, ও ওটার নাম রাখল তাইতার তাবিজ।

যতই দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছে, অভিযাত্রী দলের মেজাজ মর্জি ততই চনমনে ও হালকা হচ্ছে। হঠাৎ করেই তাইতার মনে এর ভেতর একটা কিছু অস্বাভাবিকতা রয়েছে বলে সন্দেহ জাগল। এটা ঠিক ওরা বিশাল জলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়ার বা চিমাদের দেশে থাকার সময়ের মতো বিপজ্জনক নেই পথটা, কিন্তু দেশ থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছে ওরা, রাস্তার শেষ নেই, আর অবস্থাও কষ্টকর। ওদের আশাবাদী আর হালকা মেজাজে থাকার কোনও কারণ নেই।

দিনের অপসৃয়মান আলোয় ফেনকে পাশে নিয়ে একটা নদীর পুকুরের পাশে বসেছিল ও। মাটির ফলকে তাইতার আঁকা তেনমাসের প্রাথমিক প্রতাঁকের একটা এয়ী জরিপ করছিল ফেন। ওগুলোর প্রত্যেকটা শক্তির একটা শব্দ প্রকাশ ধরে। ওগুলো একসাথে এত সক্রিয় ও সজীব হয়ে ওঠে যে কেবল সতর্কতার সাথে প্রস্তুত করা মনের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব হয়। ওর বেশ কাছে বসেছে তাইতা, একত্রিত করার ধাক্কায় কোনও বিপর্যয় দেখা দিলে যাতে রক্ষা করতে পারে ওকে। পুকুরের ওধারে জলের উপর উড়ে বেড়াচ্ছে বিরাট লালচে বাদামী বুকের একটা মাছরাঙা। ঝাঁপ দিল ওটা, কিন্তু ফলকের দিকে ফেনের মনোযোগ এতটাই নিবিষ্ট যে পাখিটার পানির উপরিতল স্পর্শ করার সময় পানি ঝলকে ওঠার শব্দে মাথা তুলে তাকাল না ও। ডানা ঝাপ্টে ফের আকাশে উঠে গেল ওটা, দীর্ঘ কলো ঠোঁটে একটা ছোট রূপালি মাছ আটকা পড়েছে।

নিজের অনুভূতি আরও নিবিড়ভাবে পরখ করার প্রয়াস পেলো তাইতা। নিজের প্রফুল্ল অবস্থার পেছনে একটা কারণই আন্দাজ করতে পারছে: পাশে বসে থাকা বাচ্চটার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং ওকে নিয়ে আনন্দ। অন্যদিকে দুজনের পক্ষেই ভীত হওয়ার বেশ ভালো কারণ রয়েছে ওর। ফারাও এবং দেশ বাঁচানোর গোপন দায়িত্ব পেয়েছে ও। পরিষ্কার কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই এক শক্তিশালী অশুভ শক্তির মোকাবিলায় এগিয়ে যাচ্ছে। নিঃসঙ্গ এক খরগোশ বেরিয়েছে খুনে চিতাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। সব সম্ভাবনাই ওর বিরুদ্ধে। প্রায় নিশ্চিতভাবে পরিণতি হবে মারাত্মক। তাহলে কেন পরিণতির কথা না ভেবেই এভাবে কাজ করে চলেছে ও?

এবার এমনকি এই সহজ যুক্তি অনুসরণ করতেও কষ্ট হচ্ছে বলে সজাগ হয়ে উঠল ও। যেন ইচ্ছে করেই বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে ওর পথে। এসব ভাবনা ছেড়ে আবার আত্মতুষ্টির ভালো থাকার ভাবনায় ফিরে যাবার জোরাল অনুভূতি হতে লাগল, কোনও রকম সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা ছাড়াই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার, বাধা এলে সেটা পেরুনোর জন্যে নিজের ক্ষমতার উপর আস্থা রাখতে প্ররোচিত হতে লাগল। মনের বিপজ্জনক ও বেপরোয়া অবস্থা এটা, ভবল ও, তারপর হেসে উঠল, যেন কৌতুক ছিল।

ফেনের মনোযোগে বাধা সৃষ্টি করেছে ও, চোখ তুলে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল ও। কী ব্যাপার, তাইতা? জিজ্ঞেস করল। তুমি বলেছিলে প্রতীকগুলো যৌক্তিক সহগ মেলানোর চেষ্টা চালানোর সময় মনোযোগ নষ্ট করা বিপজ্জনক।

ওর কথাগুলো ঝট করে মাথা তুলে তাকাতে বাধ্য করল তাইতাকে। বুঝতে পারল, কী বিশ্রী ভুল করেছে ও। ঠিক বলেছ। ক্ষমা করবে। আবার কোলে রাখা মাটির ফলকের দিকে তাকাল ও। সমস্যা নিয়ে ভাববার প্রয়াস পেল তাইতা, কিন্তু আবছা, গুরুত্বহীন রয়ে গেল সেটা। জোরে কামড় দিল ঠোঁটে, রক্তের স্বাদ পেল জিভে। তীব্র ব্যথা ওকে শান্ত করল। প্রয়াসসাধ্যভাবে মনোযোগ একত্র করতে পারল ও।

একটা কিছু মনে করতেই হবে ওকে। নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলেও সেটা ছায়াই রয়ে গেল। আবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু আগেই মিলিয়ে গেল তা। ওর পাশে আবার নড়ে উঠল ফেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর চোখ তুলে তাকিয়ে কাদার ফলকটা একপাশে নামিয়ে রাখল। মনোযোগ দিতে পারছি না। তোমার অস্থিরতা টের পাচ্ছি। একটা কিছু বাধা দিচ্ছে তোমাকে। আন্তরিক সবুজ চোখ মেলে ওর দিকে তাকাল ও, তারপর ফিসফিস করে বলল, এবার বুঝেছি, পুকুরের ডাইনীটা। চট করে গলা থেকে সোনার টুকরোটা খুলে হাতের মুঠিতে নিল ও। দুই হাতে ধরে বাড়িয়ে দিল সামনে। লক্ট্রিসের মাদুলিটা হাতে জড়িয়ে ধরল তাই। এবার দুজনে হাত ধরে প্রতিরক্ষার বৃত্ত তৈরি করল। প্রায় অলক্ষে অচেনা প্রভাবের মিলিয়ে যাওয়া টের পেল ও। ওকে খুঁচিয়ে চলা কথাগুলো এক লাফে ফিরে এলো মনে। দিমিতারের সতর্কবাণী মনে করার চেষ্টা করছিল ও। এরই মধ্যে নিজের অশুভ প্রভাবে আক্রান্ত করে ফেলেছে আপনাকে। জাদু ও প্রলোভনে আপনাকে ভেঙে দিতে শুরু করেছে। আপনার বিচারবুদ্ধি ঘোলা করে দেবে সে। অচিরেই সে আদৌ অশুভ কিনা তাতেই আপনার মনে সন্দেহ জাগবে। আপনার কাছে তাকে বেশ ভালো ঠেকবে, ভদ্র ও জীবিত যেকারও মতোই অভিজাত ও গুণী। অচিরেই মনে হবে আমিই খারাপ যে আপনার মনটাকে তার বিরুদ্ধে বিষাক্ত করে তুলেছে। সেটা যখন ঘটবে, আমাদের সে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে ও; আমি ধ্বংস হয়ে যাব। আপনি স্বাধীনভাবে, স্বেচ্ছায় তার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধেই জয়ী হবে সে।

তাইতা ইয়োসের বিকল করে দেওয়া প্রভাব ঝেড়ে না ফেলা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা বলয়ের ভেতর একসাথে বসে রইল ওরা। ওকে দেওয়া ফেনের সমর্থনে রীতিমতো বিস্ময় বোধ করছে তাই। ওর ছোট কোমল হাত জোড়া থেকে নিজের বুড়ো গ্রন্থিল হাতে বয়ে চলা শক্তির ধারা অনুভব করতে পারছ ও। ওরা একের বেশি জীবন ভাগাভাগি করেছে, এক সাথে মাৰ্বল ও গ্রানিট পাথরের দেয়ালের ভেতর আত্মার একটা দুর্গ গড়ে তুলেছে।

দ্রুত ঘনিয়ে এলো আঁধার। পুকুরের উপর বাদুরের ঝক ডানা ঝাপ্টে বেড়াতে লাগল, জলের উপর থেকে উঠে আসা পোকামাকড়ের উপর পাক খেয়ে খেয়ে নেমে আসছে। নদীর উল্টো তীরে একটা হায়েনা শোকাকুল আর্তচিৎকার ছাড়ল। ফেনের হাত ধরে রেখেই ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল তাইতা, তারপর পথ দেখিয়ে যারীবার পথে এগিয়ে গেল।

ওদের স্বাগত জানাল মেরেন। আপনাদের খোঁজে একটা তদন্ত দল পাঠাতে যাচ্ছিলাম, আমোদিত কণ্ঠে বলে উঠল সে।

পরে ক্যাম্পফায়ারের পাশে মেরেন আর ওর কর্মকর্তাদের নিয়ে বসল তাই। ওরাও আমোদিত হয়ে আছে। চৌহদ্দীর দূর প্রান্তের লোকজনেরও হাসিঠাট্টা ও শোরগোলের আওয়াজ পাচ্ছে ও। কয়েকবার ওদের সতর্ক করে শান্ত হতে বলবার কথা ভাবল তাইতা, কিন্তু শেষে ওদের মতোই থাকতে দিল। ওরাও ইয়োসের তীক্ষ্ণ গানের তালে তাল মেলাচ্ছে, তবে এমনিতেই যেখানে যেতে হবে সেখানে খুশি মনেই যেতে দেব ওদের। যতক্ষণ সামলে রাখতে পারছে, ওদের আবার পথে। ফিরিয়ে আনার মতো যথেষ্ট সময় নিয়ে এগোবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *