৩. মীমাংসার সুত্র

মীমাংসার সুত্র

সেদিন সন্ধ্যায় সমুদ্রের কিনারায় বসে কিরীটী ও ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল-গগনেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে।

কিরীটী বললে, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় একথা কেন তোর মনে হচ্ছে কুনো?

দেখ কিরাত, আমি একজন ডাক্তার। মৃতদেহ আমি সেরাত্রে ভাল করেই পরীক্ষা। করেছিলাম এবং বুড়োর ডান হাতের উপরে কি দেখেছিলাম, জানিস?

কি?

ছোট একটি রক্তবিন্দু ও হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ ফোটাবার দাগ। একটা pinpoint puncture! সেটা দেখেই আমার মনে কি একরকম সন্দেহ হয়। তাছাড়া আর একটা জিনিস সে-রাত্রে ঘটেছিল। আমি যখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসি, কুইনাইন খাবার জন্য আমার ডাক্তারী ব্যাগটা খুলতে গিয়ে দেখি, ব্যাগের মধ্যে আমার 2.5 c.c.হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা নেই। জ্বরে তখন আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথা বনবন করছে। তবুও একবার ব্যাগটা খুঁজলাম, কিন্তু সিরিঞ্জটা পেলাম না। বুঝতে পারলাম না সিরিঞ্জটা কোথায় গেল, কেননা এখানে আসা অবধি সিরিঞ্জটা আমি একদিনও ব্যবহার করিনি। কিন্তু আশ্চর্য হলেও, সে ব্যাপার নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে শুয়ে পড়লাম কম্বল মুড়ি দিয়ে। তারপর রাত্রি প্রায় দশটার সময় গগনবাবুর মৃতদেহ দেখে আবার ঘরে এসে শুই, এবং রাত্রি তিনটের সময় আবার আর এক দফা কাঁপিয়ে জ্বর আসে।

পরের দিন জ্বর ছাড়লে সকালে মুখ ধুতে উঠে দেখি আমার ব্যাগের উপরেই সিরিঞ্জটা রয়েছে এবং সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারলাম, সিরিঞ্জটা ব্যবহৃত হয়েছে। তখন স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, সিরিঞ্জটা কেউ নিয়েছিল, আবার রাত্রে কোন একসময় ফিরিয়ে রেখে গেছে।

কিন্তু সিরিঞ্জটা কে নেবে? কেনই বা নেবে? আচমকা তখন গগনেন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। নানা চিন্তায় আমার মাথা ঘুরতে লাগল।

বিকেলের দিকে সিরিঞ্জটা নিয়ে শহরের একজন কেমিস্টের কাছে গিয়ে সিরিঞ্জের মধ্যে অবশিষ্ট পদার্থটা পরীক্ষা করাতেই দেখা গেল, সেটা ডিজিটসি।

সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা বিদ্যুৎ-চমকের মত মনে এল। গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন; তবে কি কেউ overdose ডিজিটসিন ইজেক্ট করে তাকে হত্যা করেছে?

পাগলের মতো হোটেলে ফিরে এলাম, কেননা আমার ডাক্তারী ব্যাগে এক শিশি ডিজিটকসিন ছিল, কিন্তু আশ্চর্য, হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও সে ডিজিটসিনের শিশিটা পেলাম না। ভেবে দেখ, গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন, এক্ষেত্রে তাকে একটা overdose ডিজিটকসিন দিয়ে মারা কত সহজ!

কিরীটী এতক্ষণ গভীর মনোেযোগর সঙ্গে অমিয়র কথা শুনছিল, এখন বললে, হুঁ, ব্যাপারটা আগোগোড়াই সন্দেহজনক! কিন্তু তুই কি একথা কাউকে বলেছিস কুনো?

না। তবে একবার ভেবেছিলাম পুলিসে একটা সংবাদ দেব, কিন্তু পরে সাত-পাঁচ ভেবে তোর অপেক্ষায় বসে আছি। তোর কি মত এখন তাই ব! বলে অমিয় কিরীটীর মুখেরদিকে তাকাল।

আচ্ছা ধরে নিচ্ছি, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, কোন foul play আছে, কিন্তু কে খুন করতে পারে? কিরীটী প্রশ্ন করল।

খুন এক্ষেত্রে ভাইপোদেরই মধ্যে কেউ করতে পারে। গগনেন্দ্রনাথের অত্যাচারে প্রত্যেকেই দিনের পর দিন সহ্যের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছিল। এক্ষেত্রে বুড়োকে তাদের কার পক্ষেই খুন করাটা অসম্ভব নয়। দীর্ঘদিন একটা tension-এর মধ্যে থেকে থেকে মনের এমন একটা unsecured অবস্থা এসেছিল, যেখানে হঠাৎ ঝোকের মাথায় খুন করাটা এমন কিছুই নয়।

সত্যিই কি সত্য ব্যাপারটা জানতে চাস অমি? তাহলে কিন্তু পুলিসের সাহায্য নিতে হবে, এখানকার থানা-ইনচার্জ কে জানিস?

হ্যাঁ জানি, খোঁজ নিয়েছি, একজন বাঙালী ভদ্রলোক। কটকেই ডোমিসাইলড। নাম অমরেন্দ্রনাথ মিত্র।

পরের দিন অমরবাবুর সঙ্গে দেখা করে কিরীটী ও অমিয় সমগ্র ব্যাপার আলোচনা করল। সমগ্র ব্যাপারটা শুনে অমরবাবু অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

ফলে ঠিক হল, ডাঃ চক্রবর্তীর evidence-এর উপরে নির্ভর করে ব্যাপারটার একটা investigation করা হবে। রীতিমত আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান শুরু হল।

রণধীর প্রথমটা অত্যন্ত আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু আইনের যুক্তিতে বাধ্য হয়েই তাকে ঘটনার স্রোতে আপনাকে অসহায়ের মত ছেড়ে দিতে হল।

***

অমরবাবুর উপস্থিতিতেই কিরীটী কাজ শুরু করলে। প্রথমে সে প্রত্যেকের (যারা যারা হোটেলের নীচের তলায় ছিলেন) জবানবন্দি নিতে শুরু করলে। প্রথমেই ডাক পড়ল রণধীরের।

কিরীটী প্রশ্ন করতে শুরু করল, আপনার নাম রণধীর মল্লিক?

হ্যাঁ।

আপনি সর্বশেষ কখন আপনার কাকাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান?

আমি বেড়িয়ে ফিরে এসে কাকাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাই। কাকার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে যখন নিজের ঘরে গিয়ে হাতঘড়িটা খুলে শুয়ে পড়ি, তখন আমার মনে আছে বেশ স্পষ্টই ঘড়িতে চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিট।

সময়টা আপনার ঠিক মনে আছে?

আছে।

তারপর আর আপনি আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করেননি?

না।

অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে আপনার কাকা মৃত জানবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত হোটেলে ফিরে আসা থেকে আর আপনার কাকার সঙ্গে দেখা হয়নি?

না।

বেশ, আপনি বেড়িয়ে এসে ঘরের মধ্যে গিয়ে শুয়েছিলেন কেন?

আমার শরীরটা ভাল ছিল না, মাথাটাও ধরেছিল, তাই।

আপনি যখন ঘরে শুয়েছিলেন, আপনার সঙ্গে আর কারো দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ, প্রায় মিনিট পনের বাদে আমার স্ত্রী এসে আমার ঘরে ঢোকে।

আপনার স্ত্রী আপনাকে কাকার সম্পর্কে কোন কথা বলেছিলেন?

না।

আপনার ঠিক মনে আছে?

হ্যাঁ।

চা খেতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গেই ছিলেন কী সেই ঘরে?

হ্যাঁ।

আপনাদের দুজনের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল জানতে পারি কী?

না, বলতে আমার অত্যন্ত আপত্তি আছে, কেননা সে-সব কথা সম্পূর্ণ আমাদের জীবনের নিজস্ব ব্যাপার।

আচ্ছা আপনি যখন ফিরে এসে কাকার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তাকে কোন প্রকার অসুস্থ বা অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল?

যতদূর মনে পড়ে, না।

আপনার কাকার শরীরটা কয়েকদিন থেকে অসুস্থ ছিল?

হ্যাঁ।

আপনার কাকার সম্পত্তি কী ভাবে ভাগ হবে, জানেন কিছু?

হ্যাঁ–আমরা সব কজন ভাই সমানভাবে পাব।

আপনি আপনার কাকাকে ভালবাসতেন?

না।

কাকার ব্যবহারে আপনি দিনের পর দিন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন নিশ্চয়ই?

তা কতকটা হচ্ছিলাম বৈকি।

আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

না। তাছাড়া এটাকে আপনারা এভাবে ধরছেনই বা কেন? বুড়ো মানুষ, হাটের ব্যারামে ভুগছিলেন-হঠাৎ হার্টফেল করে মৃত্যু হয়েছে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ডাঃ চক্রবর্তী যে কেন ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখলেন, বুঝতে পারছি না। মিথ্যে একটা familyকে হয়রান করে আপনাদের লাভই বা কি? তাছাড়া যিনি আমাদের প্রতিপালক, তিনি যতই খারাপ হোন না কেন, আমরা কেউ তাকে খুন করতে পারি এ কথাটা ভাবাও কি বাতুলতা নয় মিঃ রায়!

আপনি এখন যেতে পারেন, রণধীরবাবু। সমীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন।

রণধীর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কিরীটী একটা কাগজে কতকগুলো কি নোট করে নিল।

সমীর এসে ঘরে প্রবেশ করল।

অত্যন্ত রুক্ষ বিষণ্ণ তার চেহারা। চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। চোখে একটা ভয়চকিত চঞ্চল দৃষ্টি!

অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন।

আসুন সমীরবাবু, বসুন। কিরীটী আহ্বান করলে সমীরকে। সমীর সামনের চেয়ারটার উপরে বসে পড়ল।

সমীরবাবু, আপনাকে কতকগুলো কথা জিজ্ঞাসা করব, আশা করি যথাযথ জবাব দেবেন।

বলুন?

আপনি সর্বশেষ কখন আপনার কাকাকে জীবিত দেখেছিলেন?

প্রায় তখন পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিট হবে।

সঠিক সময়টা আপনি জানলেন কি করে?

আমার রিস্টওয়াচটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে কাকার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কাকার হাতঘড়িটা দেখে সময় মিলিয়ে নিই।

হুঁ। আচ্ছা সেই সময় আপনার কাকাকে দেখে কোনরূপ অসুস্থ বা কোনপ্রকার অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল?

না।

আপনার কাকার সঙ্গে আপনার কি কথাবার্তা হয়েছিল?

তখনকার আমার মনের অবস্থা অত্যন্ত উত্তেজিত ও অস্থির ছিল। দীর্ঘকাল ধরে কাকার শাসনের মধ্যে থেকে আমি পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এ ভয়ঙ্কর অবস্থা আর আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমি কাকার সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া করবার জন্যই এসেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন কথাই আমার বলা হয়নি, তার সামনে এসেই সবটুকু সাহস আমার উবে গিয়েছিল-আমার কোন কথাই আর কাকাকে বলা হল না, ফিরে এলাম নিজের ঘরে।

আপনি যখন বেড়াতে বের হন, তখন কে আপনার সঙ্গে ছিল?

আমি যখন বের হচ্ছি, হোটেলের গোড়াতেই আমার সমীরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়, আমরা দুজনে একসঙ্গে সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে থাকি। দুজনে কথা বলতে বলতে অনেকটা পথ যাবার পর কিছুকষণ এক জায়গায় বসে গল্প করি, তারপর আমি সেখান থেকে উঠে আসি। পথে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি সমুদ্রের ধারে বসে গান গাইছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে গল্প করবার পর আমি হোটেলে ফিসে আসি।

ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?

সামান্য দিনের। মৃদুস্বরে সমীর জবাব দেয়।

হুঁ। আচ্ছা সমীরবাবু, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীকে আপনার কী রকম মনে হয়?

চমৎকার। শিক্ষিতা ও অত্যন্ত রুচিসম্পন্না।

ডাঃ গাঙ্গুলীকে আপনার খুব ভাল লাগে, না সমীরবাবু?

কিরীটীর প্রশ্নে সহসা সমীরের সমগ্ৰ মুখখানা সিঁদুরের মত রাঙা হয়ে উঠল, সে কিরীটীর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিপথ থেকে আপনার দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করলে, সেদিন বিকেলে আপনাদের মধ্যে—মানে আপনার ও ডাঃ গাঙ্গুলীর মধ্যে ঠিক কি ধরনের কথাবার্তা হয়েছিল সমীরবাবু?

মাপ করবেন মিঃ রায়, সে কথাগুলো একান্তই আমাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

আপনার কাকার সম্পর্কে কোন কথা হয়েছিল কি?

হ্যাঁ, হয়েছিল।

কী ধরনের কথা?

এমন বিশেষ কিছু নয়, এবং আমার মনেও নেই তা।

হুঁ। আচ্ছা আপনার কাকাকে আপনি খুব ভালবাসতেন, না?

মোটেই না, বরং বলতে পারেন ভয় করতাম।

আপনার কাকার ব্যবহার আপনার প্রতি কী রকম ছিল?

বলতে পারি না।

আপনি আপনার বর্তমান জীবনধারার প্রতি একান্ত বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিলেন সমীরবাবু, কেমন না?

তা হয়েছিলাম।

আচ্ছা আপনার কাকার হত্যা সম্পর্কে, যদি ধরে নেওয়া হয় তাকে হত্যাই করা হয়েছে, কাউকের সন্দেহ করেন?

না।

আচ্ছা আপনার কাকার এই আকস্মিক মৃত্যু স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক বলে আপনার মনে হয়?

বলতে পারি না।

তবু?

স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। একে তিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন, তারপর হার্টের ব্যারামে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন। মরবার দুদিন আগে palpitation অত্যন্ত বেড়েছিল।

আপনার কাকাকে ঔষধপত্র খাওয়াত কে?

সাধারণত বৌদিই কাকার দেখাশুনা করতেন ও ঔষধপত্র খাওয়াতেন, তবে মাঝে মাঝে আমিও করতাম।

আপনি জানতেন যে, আপনার কাকা নিত্য হার্টের অসুখের জন্য যে ঔষধটা ব্যবহার করতেন তার মধ্যে ডিজিটকসিন ছিল?

না, আমি তো ডাক্তার নই।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন; দয়া করে অধীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন এ ঘরে।

নমস্কার। সমীর উঠে দাঁড়াল।

নমস্কার।

কিরীটী টেবিলের উপরে রক্ষিত খাতাটায় কী কতকগুলো নোট করছিল মাথাটা নীচু করে, ধীরে ধীরে অধীর এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অধীরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে–সামনে বসুন। আপনি শ্রীযুক্ত অধীর মল্লিক?

অধীর চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললে, হাঁ।

অধীরবাবু, আপনাকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করব, আশা করি আপনি তার যথাযথ সত্যি জবাব দেবেন।

নিশ্চয় দেব। কী জানতে চান বলুন?

বেশ, আপনার কথা শুনে সুখী হলাম। আচ্ছা অধীরবাবু, আপনার কাকার এই আকস্মিক মৃত্যু, এটা স্বাভাবিক বলে আপনার মনে হয়, না অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয়?

অত্যন্ত স্বাভাবিক। যাঁরা এই সামান্য সাধারণ ব্যাপারের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক কিছুর ধারণা করছেন, তাদের মতের সঙ্গে আমি একমত নই।

কেন?

কেন আবার কী, বুড়ো মানুষ, দীর্ঘকাল ধরে হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন, মারা গেছেন হার্ট ফেল করে, এতে অস্বাভাবিক বা আশ্চর্য হবার কী আছে?

কিন্তু আপনার মতের সঙ্গে একজন বিচক্ষণ ডাক্তার মত মেলাতে পারছেন না, তার ধারণা আপনার কাকার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।

কেন?

তার কারণ আপনার কাকার হাতে তিনি ইনজেকশনের দাগ দেখেছিলেন। তাছাড়া তার মেডিকেল ব্যাগের মধ্যে এক শিশি ডিজিটসিন ছিল, সেটা ও একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তার ব্যাগ থেকে আপনার কাকার মৃত্যুর দিন খোয়া যায়! সিরিঞ্জটা পরদিন পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু ঔষধের শিশিটা এখনও পাওয়া যায়নি। ডিজিটসিন তীব্র বিষ। ডাঃ চক্রবর্তীর ধারণা, ডিজিটসিন overdose-এ কাকার শরীরে প্রবেশ করিয়েই তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। সোজা কথায় বলতে পারেন, তাকে খুন করা হয়েছে। আমাদেরও বিশ্বাস তার সে ধারণা নির্ভুল।

অধীর খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল।

হঠাৎ আবার কিরীটী প্রশ্ন করলে, আপনি সেদিন কখন বেড়িয়ে ফেরেন অধীববাবু?

প্রায় পাঁচটা দশ হবে।

হুঁ। ঠিক সময়টা আপনার মনে আছে কি করে?

আমি হোটেলে ফিরেই খাবার ঘরে গিয়ে খানসামার কাছে এক পেয়ালা চা চাই; খাবার ঘরের ওয়াল-ক্লকের দিকে আমার নজর পড়ে, তাতে তখন পাঁচটা বেজে পনের মিনিট।

বেশ। আপনি বেড়িয়ে ফিরে এসে আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করেছিলেন?

না।

বেড়িয়ে ফিরবার পর থেকে সন্ধ্যাবেলা চা পান করতে যাবার আগে পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন?

আমার নিজের ঘরে শুয়েছিলাম।

বেশ। আচ্ছা অধীরবাবু, আমি কোণারকে যাবার আগের রাত্রে আপনার ঘরে, রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে, কার সঙ্গে আপনি কথা বলছিলেন? কে সে?

কিরীটীর প্রশ্নে অধীর যেন সহসা অত্যন্ত চমকে উঠল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, মেজদার সঙ্গে।

সমীরবাবুর সঙ্গে?

হ্যাঁ।

আপনার মেজদা কী বলছিলেন, মানে কী সম্পর্কে কথা হচ্ছিল আপনাদের দুজনের মধ্যে?

আমার মনে নেই।

কার সম্পর্কে কথা হচ্ছিল, তাও কি মনে নেই?

না। সঠিক আমার মনে নেই।

এবার কিরীটী তীক্ষ্ণ গম্ভীর স্বরে বললে, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন অধীরবাবু। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো, আপনি সত্যি কথা বলছেন, আপনার মনে নেই?

অধীর চুপ করে বসে রইল, চোখ নীচু করেই।

শুনুন অধীরবাবু, কিরীটী রায়ের সঙ্গে বোধ হয় আপনার পরিচয় নেই, তাহলে এভাবে মিথ্যে কথা বলতে সাহস পেতেন না। আপনার সেদিকার কথা হয়ত মনে না থাকতে পারে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, আপনাদের সে-রাত্রে যে কথাবার্তা হয়েছিল তার কিছু কিছু আমার কানে গিয়েছিল, দুর্ভাগ্যই হোক আর সৌভাগ্যই হোক। আপনাদের মধ্যে কেউ বলছিলেন, না, এ আর সহ্য হয় না, ভেবে দেখ তুই, ওকে খুন করা ছাড়া আর আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ওকে খুন করাই উচিত। ও মরুক, ও মরুক। এখন ওর পক্ষে মৃত্যুই মঙ্গল। এবং সেই একই ব্যক্তি এ কথাও বলেছিলেন, আমি নিজে হাতেই ওকে এই পৃথিবী থেকে সরাব। হ্যাঁ, আমিই সরাব এবং তার উপায়ও আমি ভেবেছি। কে এ কথাগুলি সেরাত্রে বলেছিলেন অধীরবাবু, এবং কাকেই বা এ পৃথিবী থেকে সরাবার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল?

উত্তেজনায় ভয়ে তখন অধীরের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে, সে কোনমতে একটা ডোক গিলে অতি মৃদু ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, মেজদা কথাগুলো বলছিল, কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করেন আমরা তাকে খুন করেছি?

খুন করেছেন এমন কথা তো আমি বলছি না অধীরবাবু! কিন্তু কথাগুলো…

মিঃ রায়, আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাকার শাসনে নিষ্পেষিত হয়ে, এমন মানসিক অবস্থা আমাদের হয়েছিল যে, কখন কোন উত্তেজনার মুহূর্তে যদি কিছু আলোচনা করে থাকি সেটা কি সত্যি হবে? মানুষ যখন যা মনে ভাবে তাই কি সে করে বা করতে পারে? মনে মনে কখনও খুন করবার কথা ভাবলেই কি খুন করা যায়, আপনি মনে করেন মিঃ রায়?

কিন্তু করা কি একেবারেই অসম্ভব অধীরবাবু?

না না, এ আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমরা আবোল-তাবোল কিছু উত্তেজনার মুখে আলোচনা করলেও, সেটাকে সত্যতায় পরিণত করবার কল্পনাও করিনি।

আপনি এখন যেতে পারেন অধীরবাবু। আপনার বৌদিকে একটিবার দয়া করে পাঠিয়ে দিন।

***

বিনতা দেবী এসে ঘরে প্রবেশ করল।

কিরীটী মুখ তুলে একটিবার বিনতা দেবীর দিকে তাকাল।

মুখের দিকে চাইলে মনে হয় যেন প্রবল একটা ঝড় ওর মনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।

মাথার চুল রুক্ষ মুখখানা শুকিয়ে গেছে।

কিরীটী বললে, বসুন বিনতা দেবী।

বিনতা ধীরে ধীরে সামনের চেয়ারটার উপরে বসল।

বিনতা দেবী, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই, আশা করি সঠিক জবাব পাব।

আমার সাধ্যমত আপনার প্রশ্নের জবাব দেব, মিঃ রায়।

আপনি সেদিন বিকেলে কখন ফিরে আসেন?

সাড় চারটের পর, পাঁচ-দশ মিনিট এদিক ওদিক হতে পারে।

আপনি শেষ কখন আপনার খুড়শ্বশুরকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলেন?

বেড়িয়ে ফিরে আসবার পর আমি কাকার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে কথা বলি, তারপর আমার স্বামীর ঘরে চলে যাই। চা খেতে যাবার আগে পর্যন্ত সেই ঘরেই আমরা দুজনে ছিলাম।

কি কথা হয়েছিল আপনার সেই সময় কাকার সঙ্গে?

বিশেষ কিছুই নয়, তারই শরীর সম্পর্কে দু-একটা কথা হয়েছিল।

সেই সময় তাকে কোনপ্রকার অসুস্থ বা কোনরকম অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয়েছিল?

না।

আপনার শ্বশুরের শুশ্রুষা ও ঔষধপত্র দেওয়ার কাজ আপনিই বরাবর করতেন শুনেছি?

হ্যাঁ, তার কারণ বি. এ. পাস করে চাকরি নেওয়ার আগে আমি কিছুদিন নার্সিং শিখেছিলাম।

তাহলে ডাক্তারী আপনি কিছু কিছু জানেন বলুন?

তা একটু-আধটু জানি বললে বিশেষ ভুল হবে না মিঃ রায়। আমার এক মামাতো ভাই ডাক্তার ছিল, সে-ই আমাকে সাধারণ ডাক্তারী ও নার্সিং সম্পর্কে ছোটোখাটো অনেক কিছু শিখিয়েছিল এবং একসময় আমারও নার্সিং শিখবার প্রবল আগ্রহ ছিল।

হ্যাঁ, ভাল কথা, যে ঔষধের শিশিটা থেকে তিনি ঔষধ খেতেন সেটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হ্যাঁ, শিশিটা ভেঙে গিয়েছিল তাই ফেলে দেওয়া হয়েছে।

আচ্ছা আপনার খুড়শ্বশুর যে ঔষধটা প্রত্যহ খেতেন তার হার্টের ব্যারামের জন্য, তার মধ্যে ডিজিটসিন ছিল জানতেন?

না।

ডিজিটসিন posion-তা জানেন?

জানি।

আপনার স্বামী ও আপনি দুজনেই গগনেন্দ্রনাথের শাসনের আওতায় হাঁফিয়ে উঠেছিলেন?

সুস্থ ব্যক্তি মাত্রেরই সে অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে এ বাড়ির বিষাক্ত আবহাওয়ায় থেকে থেকে আমার স্বামীর মনটা যেন আগাগোড়া শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনিও যে একজন মানুষ এবং তাকে বাঁচাতে হলে যে মানুষের মত বাঁচা প্রয়োজন, সে কথা তাকে হাজারবার বুঝিয়েও বোঝাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এই বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি এ বাড়ি ও আমার স্বামীকে ছেড়ে চলে যাব, এ কথাও কয়েকদিন আগে আমার স্বামীকে বলেছিলাম, যাতে করে তার ঘুমন্ত মনটা সাড়া দেয়।

আপনার কাকার মৃত্যুটা স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক বলে মনে হয়?

স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ডাঃ চক্রবর্তীর যুক্তি মানতে আমি রাজী নই। তাছাড়া তার মৃত্যুতে এরা সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে; এত দীর্ঘদিন অশান্তির পর আজ যদি এরা। শাস্তি একটু পেয়েই থাকে, সে শান্তিটা আপনি নষ্ট করতে এভাবে উদ্যত হয়েছেন কেন মিঃ রায়? এরা তো আপনার কোনও অনিষ্ট করেনি। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, দিনের পর দিন এরা কী মানসিক যাতনাই সহ্য করেছে! মিঃ রায়, আপনাকে মিনতি জানাচ্ছি, এ প্রহসন বন্ধ করুন। এদের একটু শান্তিতে থাকতে দিন।

শুনুন বিনতা দেবী, আমি বিশেষ কোন একটা ঘটনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসেছিলাম এবং এখানকার ঘটনা দেখে কেবলই আমার মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা যোগসুত্র আছে। তাছাড়া সত্যের পূজারী আমি, এমন কথা এখনও প্রমাণ হয়নি বা আমি বলিনি যে, আপনাদের মধ্যেই কেউ না কেউ দোষী। তাছাড়া সত্যিই যদি গগনেন্দ্রনাথ খুন হয়েই থাকেন, তবে কি সমাজের পক্ষে, জনসাধারণের পক্ষে এটা একটা প্রকাণ্ড দোষ নয়? খুনীকে নির্বিবাদে সকলের মধ্যে বিচরণ করতে দেওয়াটা কি দোষের নয়? ব্যাপারটা আমি শুধু আপনাদের দিক থেকে বিচার করছি না, করছি ব্যাপক ভাবেই। তাছাড়া এরকম একটা সন্দেহ যখন উঠেছেই, তখন সেই সন্দেহ নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সন্দেহটাকে মিটিয়ে নেওয়াটাই কি মঙ্গলজনক নয়? আচ্ছা এখন আপনি যেতে পারেন। কিশোরকে একটিবার দয়া করে এ ঘরে পাঠিয়ে দেবেন, তাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।

বিনতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কিরীটী নিশ্চিন্ত ভাবে খাতার মধ্যে কতকগুলো কি নোট করতে লাগল।

ভীতচকিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে রুগ্ন এক বালক এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল, কী নাম তোমার খোকা? ঐ চেয়ারেই বস। কিশোর চেয়ারের উপরে বসে পড়ল।

আমার নাম?

হ্যাঁ, কী নাম তোমার?

দাঁড়ান। হ্যাঁ, আমার নাম কিশোর।

কিশোর! বাঃ, বেশ নামটি তোমার! তোমাকে সব চাইতে কে বেশী ভালবাসে কিশোর?

ভাল আমাকে কেউ বাসে না। আমি একা একা ঘরে শুয়ে থাকি। বড্ড ভয় করে আমার। সারারাত কারা যেন আমার বিছানার চারপাশে ঘোরে। তারা কেবলই আমাকে ডাকে। ওদের কাছে তো আমি যাব না-ওরা নিশ্চয়ই কাকার মত কেবল আমাকে বকবে। এই বড় বড় ছুরি তাদের হাতে, আমাকে নিশ্চয়ই তারা খুন করবে। তারাই, তারাই কাকাকে মেরে ফেলেছে। সেদিন আমার ঘরে তাদের একজন এসেছিল, সাদা ধবধবে পরীর মত পোশাক পরা। এমন সময় শুনলাম ডাঃ চক্রবর্তী যেন আমাকে ডাকছেন।

কবে দেখেছিলে তুমি?

কেন, যেদিন কাকা মারা যায়। সেই সাদা পরীদের একজন আমার ঘরেও আমাকে মারতে এসেছিল।

কখন?

বিকেলবেলা! আমি তখন ঘুমিয়ে আছি, আমার ঘরে এসে ঢুকেছিল।–আমি যাই। তারা। এখুনি হয়ত আবার এসে পড়বে। কিশোর এন্তে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

বস বস, ভয় নেই। আমরা তো আছি।

না না, আমি প্রতিমাদির কাছে যাই, সে আমাকে বড্ড ভালবাসে। বলো না কিন্তু ওকথা কাউকে। প্রতিমাদি মানা করে দিয়েছে। না, আমি যাই। কিশোর একপ্রকার যেন দৌড়েই ঘর ছেড়ে চলে গেল।

কিরীটী একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস নিল।

***

এরপর ডাক পড়ল সমরবাবুর।

কিরীটী সমরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, আপনার নাম?

সমর রায়। আধুনিক কবি সমর রায়ের নাম শোনেননি?

দুর্ভাগ্য আমার, শুনিনি তো? তা সে যা হোক, আপনি এখানে মানে পুরীতে বেড়াতে এসেছেন?

হ্যাঁ।

গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন আপনি এই হোটেলেই ছিলেন?

ছিলাম।

আপনি ও সমীরবাবু সেদিন বিকেলে একসঙ্গে বেড়াতে বের হন?

তা হয়েছিলাম বোধ হয়।

বোধ হয় তো মানে?

কত লোকের সঙ্গেই তো কত সময় আমরা বেড়াতে বের হই, সব কি আর মনে থাকে, সেটা মনে করে রাখাই আমার কাজ?

এবার জবাব দিলেন দারোগাবাবু, মশাই, আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তার ঠিক ঠিক জবাব দিন। আপনি সমীরবাবুর সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছিলেন কিনা?

হ্যাঁ।

কতক্ষণ সমীরবাবু আপনার সঙ্গে ছিলেন?

তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক হবে।

হুঁ, আপনি কখন হোটেলে ফিরে আসেন?

বারীনবাবু ও যতীনবাবুদের সঙ্গেই ফিরে আসি, তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।

গগনেন্দ্রনাথকে যখন মৃত আবিষ্কার করা হয়, তার আগে কিছু জানতে পেরেছিলেন কি?

না। খাবার সময়ও যেমন তাকে বারান্দায় চেয়ারের উপরে একা চুপটি করে বসে থাকতে দেখেছিলাম, ফেরার সময় তেমনিই তাকে দূর থেকে বসে থাকতে দেখি।

বেড়িয়ে ফিরে এসে সাড়ে ছটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?

নিজের ঘরে।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন। বারীনবাবুকে একটিবার পাঠিয়ে দিন।

নমস্কার। সমর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

প্রশান্ত সৌম্য চেহারার বারীনবাবু হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

কিরীটী সসম্ভ্রমে বারীনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন। আপনবার নামই বারীন…

আজ্ঞে আমার নাম বারীন্দ্র চৌধুরী।

আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন?

হ্যাঁ। চাকরি থেকে বিশ্রাম নেওয়া অবধি এইভাবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

আপনি কোথায় চাকরি করতেন?

পাঞ্জাবে লুধিয়ানার এক কলেজে।

বহুকাল আপনি সেখানেই ছিলেন?

হ্যাঁ। প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছরেরও বেশী হবে।

বাংলাদেশে আপনি কতদিন ফিরেছেন?

তাও প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল বৈকি!

বাংলায় এসে কোথাও আপনি স্থায়ীভাবে নিশ্চয়ই বসবাস করেননি?

না, বসবাস করবার কোথাও স্থায়ীভাবে আর ইচ্ছা নেই, একা মানুষ, ঘুরে ঘুরে বেড়াতেই ভাল লাগে।

গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন আপনি কখন বেড়াতে বের হন?

আমি ও যতীনবাবু সোয়া চারটের সময় বেড়াতে বের হই।

আবার কখন ফিরে আসেন?

বোধ হয় সাড়ে পাঁচটার পর আমি, যতীনবাবু ও সমরবাবু ফিরে আসি।

বেড়াতে যাবার আগে আপনি হোটেলেই ছিলেন?

হ্যাঁ, আমার নিজের ঘরে। এখানে একটা কথা বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। বেলা তখন বোধ করি পৌনে চারটে কি চারটে হবে-ওদিককার বারান্দায় গগনবাবু যেখানে বসেছিলেন তারই কাছে একটা গোলমাল শুনি এবং দেখি একজন সাদা উর্দি পরা খানসামা ছুটে পালাচ্ছে কিশোরের ঘরের দিকে। গগনবাবু অত্যন্ত খিটখিটে প্রকৃতির লোক ছিলেন, চাকরবাকরদের প্রায়ই গালাগালি দিতেন। ওই রকমেরই কিছু হবে বলে আমার মনে হয় সেদিনকার ব্যাপারটাও।

আপনি ঠিক স্পষ্ট দেখেছিলেন সাদা উর্দি পরা ছিল লোকটার?

হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখেছিলাম।

আপনি দেখছি রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন, চোখের অসুখ আছে নাকি কিছু?

না, চোখ আমার ভালই; তবে আলোটা তেমন সহ্য হয় না।

আচ্ছা বারীনবাবু, সেই খানসামাটাকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন?

না, লোকটা দৌড়ে চলে গেল, তেমন চিনতে পারিনি।

ওঃ, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন, যতীনবাবুকে একটিবার পাঠিয়ে দেবেন কি?

নিশ্চয়ই। নমস্কার। বারীনবাবু চলে গেলেন।

***

আসুন যতীনবাবু, ওই চেয়ারটায় বসুন। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে যতীনবাবু বললেন, নিশ্চয়ই, করুন। আমার দ্বারা যদি আপনাদের তদন্তের কোন সাহায্য হয় আমি সর্বদাই তার জন্য প্রস্তুত আছি।

আচ্ছা সেদিন বিকেলে আপনি বারীনবাবুর সঙ্গে বেড়াতে যাবার আগে একটা কোন গোলমাল শুনেছিলেন?

হ্যাঁ, আমি তখন আমার ঘরে বসে বই পড়ছিলাম।

কাউকে আপনি দেখেছিলেন?

হ্যাঁ, একজন খানসামাকে দৌড়ে যেতে দেখেছিলাম।

আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন?

না। তবে আমরা যখন বেড়াতে বের হচ্ছি, দূর থেকে দেখেছিলাম বিনতা দেবী গগনবাবুর সঙ্গে কি কথা বলছেন।

.

এরপরই প্রতিমা গাঙ্গুলী এলো।

আপনার নামই ডাঃ গাঙ্গুলী? বসুন। কিরীটী বললে।

প্রতিমা চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললে, হ্যাঁ।

আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই প্রতিমা দেবী।

বলুন?

ঐদিন আপনি কখন বেড়াতে বের হন?

বেলা প্রায় সোয়া তিনটে হবে।

বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের ধারে সমীরবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কী ধরনের কথাবার্তা আপনাদের হয়েছিল বলতে বাধা আছে কি?

তা একটু আছে। কেননা আমাদের দুজনের নিজস্ব সে-সব কথা। এ কেসের সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই।

আপনার সঙ্গে সমীরবাবুর কতদিনের আলাপ?

এখানে এসেই আলাপ হয়।

সমীরবাবু লোক কেমন বলে আপনার মনে হয়?

ভালই। প্রতিমার মুখখানা সহসা কেন না-জানি রাঙা হয়ে উঠল।

কিরীটী মনে মনে হাসতে হাসতে আবার প্রশ্ন করলে, ভালই মানে? আপনার তাকে ভাল লাগে, বলুন?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য কি, মিঃ রায়?

আচ্ছা কখন আপনি হোটেলে ফিরে আসেন?

সন্ধ্যা প্রায় ছটার সময়।

আপনি প্রথমে গগনেন্দ্রনাথের মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলেন যে তিনি মারা গেছেন?

হ্যাঁ।

আচ্ছা আপনি যখন গগনেন্দ্রনাথের দেহ পরীক্ষা করেন, তার কতক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?

ঘণ্টাখানেক আগেই বলে মনে হয়েছিল।

তাহলে আপনার ডাক্তারী মতে গগনেন্দ্রনাথকে মৃত আবিষ্কৃত হবার এক ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়েছিল?

হ্যাঁ, তাই।

আপনারা, মানে আপনি, বারীনবাবু ও সমরবাবু একসঙ্গে বেড়িয়ে ফিরেছিলেন?

হ্যাঁ।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।

***

পরের দিন যতীনবাবু কিরীটীর ঘরে এসে বললেন, মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ কথা ছিল।

বলুন?

যতীনবাবু পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে কিরীটীর হাতে দিতে দিতে বললেন, এই সিরিঞ্জটা আমি গগনবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন একজনকে ঘরের পিছনদিককার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখি। আগের দিন রাত্রে কয়েকটা বাজে কাগজের সঙ্গে আমার একটা জরুরী চিঠি বাড়ির পিছনদিকে ভুলে ফেলে দিয়েছিলাম, পরদিন সকালবেলা যখন সেটা খুঁজতে যাই, হঠাৎ সামনের দিকে আমার একটা জানালা খোলার শব্দে নজর পড়ায় দেখতে পাই, অধীরবাবু তার ঘরের পিছনদিককার জানালা থেকে এটা ফেলে দিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পাননি কিন্তু আমি তাকে স্পষ্ট দেখেছিলাম, পরে কৌতূহল হতে গিয়ে দেখি একটা সিরিঞ্জ। কাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম এটা হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারে, তাই এটা আপনাকে দিতে এসেছি।

আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ যতীনবাবু, একটা সন্দেহ আমার মিটল।