৩. মিস লেমনকে নোট দিতে

১০.

মিস লেমনকে নোট দিতে গিয়ে থামলো এরকুল পোয়ারো। মিস লেমন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। হা এরপর কি লিখবো বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত। হাত তুলে বললো পোয়ারো, এ চিঠিটা তেমন জরুরী নয়, মিস লেমন দয়া করে সেখানে তোমার বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে একবার।

হ্যাঁ এখুনি ফোন করছি মঁসিয়ে পোয়ারো। কয়েক মিনিট পরে পোয়ারো তার সেক্রেটারির হাত থেকে রিসিভারটা তুলে নেয়।

হ্যালো, বললো সে।

 বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, কি খবর? মিসেস হার্বার্ড এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো যেন।

ওখানে এখন নিশ্চয়ই বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো পোয়ারো।

না মঁসিয়ে বেশ সুষ্ঠ ভাবেই ইনসপেক্টর শার্প সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শেষ করেছেন। আজ তিনি সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছিলেন। মিসেস নিকোলেটিসের অবস্থা হিস্টিরিয়া রোগিণীর মতো তখন, আমাকে সামলাতে হয়েছে।

আহা। সহানুভূতি দেখালো পোয়ারো। তারপর সে বললো, একটা ছোট্ট প্রশ্ন করতে চাই। উধাও হওয়া সেই জিনিসগুলোর একটা ছোট্ট তালিকা তুমি আমাকে দিয়েছিলে মনে আছে? আচ্ছা সেগুলো কি তুমি পরপর সাজিয়েছিলে? মানে যেদিন যে জিনিসটা উধাও হয়েছিল সেই সব তারিখ অনুযায়ী লিখেছিলে।

না, ঠিক তা নয়। আমি দুঃখিত, যখন যেটা খেয়াল হয়েছে সেই ভাবে লিখেছিলাম। এ ব্যাপারে তখন আমার খেয়াল হয়নি। কিন্তু এখন দেখছি সেটার খুবই প্রয়োজন। তোমার সেই তালিকাটা আমার কাছে রয়েছে। বলল পোয়ারো। যেমন ধরা যাক প্রথমেই সান্ধ্যজুতো, তারপর ব্রেসলেট, হীরের আংটি, পাউডার কমপ্যাক্ট, লিপস্টিক, স্টেথোস্কোপ এবং আরো কিছু। কিন্তু তুমি এখন বলছে, এগুলো কালক্রমে সাজানো হয়নি।

না।

এখন তুমি কি মনে করতে পারো, নাকি সেগুলো পরপর সাজাতে তোমার খুব অসুবিধে হবে?

দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, ঠিক এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। বুঝতেই তো পারছেন, ঘটনাগুলো অনেকদিন আগের তাই আমাকে একটু ভাবতে হবে। আমার বোনকে আমি বলেছি, আসলে আপনি ফোন করার আগেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আর তখনই কালক্রমে সাজানো নতুন একটা তালিকা নিয়ে যাবো আপনার জন্য। আজ সন্ধ্যায় আপনার কাছে যাচ্ছি, তার আগে সম্ভব নয়, কারণ মনে করে তালিকাটা ঠিক করতে হবে তো? তাছাড়া প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যাচাই করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলতে যেমন বোরিক পাউডার, ইলেকট্রিক বাল্ব, ঝোলানো ব্যাগ–এগুলো সত্যিই জরুরী কিছু নয়, ভেবে দেখেছি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করা হয়েছিল।

তাই বুঝি! বললো পোয়ারো, হা দেখেছি আমি কি করতে পারিম্যাডাম প্রচুর সময় নিয়ে এসো অনেক কথা আছে তোমার সাথে। উধাও হওয়া জিনিসগুলো কালো ড্রেসে সাজিয়ে এনো।

নিশ্চয়ই মঁসিয়ে পোয়ারো, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাই প্রথম উধাও হয় বলেই আমার বিশ্বাস, তারপর ইলেকট্রিক বাল্ব, যা আমার মনে হয়েছিল অন্য হারানো জিনিসগুলোর সাথে সম্পর্ক নেই–তারপর ব্রেসলেট এবং পাউডার কমপ্যাক্ট, না, না-সান্ধ্যজুতো। কিন্তু এরপর এখনি যেন আমাকে অনুমান করতে বলবেন না। কালক্রমে এরপর কি কি হতে পারে। ঠিক ঠিক ভাবে পরের জিনিসগুলো আমি সাজিয়ে আনবো।

ধন্যবাদ ম্যাডাম, তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো পোয়ারো।

শনিবার সকাল, হিকরি রোডে সার্চ ওয়ারেন্ট সঙ্গে নিয়ে এসে মিসেস নিকোলেটিসের সাক্ষাৎকার নেওয়ার দাবি করলো ইনসপেক্টর শার্প।

প্রচণ্ড ভাবে আপত্তি জানালেন মিসেস নিকোলেটিস, কিন্তু এতো এক ধরনের অপমান, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা এরপর এখানে আর থাকবে ভেবেছো? সবাই চলে যাবে। তারা সবাই চলে যাবে। আমি তখন ধ্বংস হয়ে যাবো।

না, না ম্যাডাম। আমি ওদের চিনি, ওরা বোঝদার, ওরা ভুল বুঝবে না। হাজার হোক এটা তো খুনের কেস।

না, এ কখনোই খুনের নয়, আত্মহত্যার কেস।

 আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, কেউ আপত্তি করবে না-নরম সুরে বললো মিসেস হার্বার্ড। এ আমি হলফ করে বলতে পারি কেবল–কেবল মিঃ আহমেদ আলি আর মিঃ চন্দ্রলাল ছাড়া।

ফুঃ! ফুঁ দিয়ে দেওয়ার মতো করে মিসেস নিকোলেটিস বললেন কে ওদের তোয়াক্কা করে?

ধন্যবাদ ম্যাডাম! বললো ইনসপেক্টর, তাহলে আপনার এই বসবার ঘরেই শুরু করা যাক কি বলেন?

ইনসপেক্টরের উদ্দেশ্যটা জানার পরেই প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন মিসেস নিকোলেটিস, যেখানে খুশী আপনি সার্চ করতে পারেন, বললেন তিনি, কিন্তু এখানে নয়, আমি আপত্তি জানাচ্ছি।

আমি দুঃখিত মিসেস নিকোলেটিস, আমাকে পুরো বাড়ি সার্চ করতেই হবে।

 তা ঠিক, কিন্তু আমার ঘরে নয়, আমি আইনের ঊর্ধ্বে।

কেউ আইনের ঊর্ধ্বে হতে পারে না, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি একপাশে সরে দাঁড়ান।

এ আমার সাংঘাতিক ক্ষতি, প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়লেন মিসেস নিকোলেটিস। আপনারা ব্যস্ত অফিসার। আপনাদের এই অন্যায় জুলুমের ব্যাপারে আমি সবাইকে চিঠি লিখবো। আমি আমার পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে লিখবো। আমি কাগজেও লিখবো।

মাদাম, আপনি আপনার খুশিমতো যাকে মনে করেন লিখতে পারেন। বললো ইনসপেক্টর শার্প। যেভাবেই হোক, এ ঘর আমি সার্চ করবোই।

শার্প তার অনুসন্ধানের কাজ শুরু করলো টেবিল দিয়ে। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটির পর ঘরের এক কোণায় কাপবোর্ডের দিকে এগোল সে। এটা তো দেখছি চাবি দেওয়া। চাবিটা পেতে পারি?

কখখনো নয়, চিৎকার করে উঠলো মিসেস নিকোলেটিস। চাবি আপনি পাবেন না। কখখনো নয়, কখখনো নয়। আর ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড, থু! থু! থু!

আমি আবার বলছি, চাবিটা আপনি আমাকে দিন, তীক্ষ্ণস্বরে বললো ইনসপেক্টর। তা না হলে কাপবোর্ডের ডালা আমি ভাঙতে বাধ্য হবো।

না, আমি আপনাকে চাবি কিছুতেই দেবো না। চাবি পাওয়ার আগে আপনাকে আমার পোশাক ছিঁড়ে ফেলতে হবে। আর সেটা-সেটা হবে একটা স্ক্যান্ডাল।

একটা বাটালি নিয়ে এসো করব, শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বললো শার্প।

রাগে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন মিসেস নিকোলেটিস।

তাতে কোনো গুরুত্ব দিলো না শার্প। বাটালি দিয়ে কাপবোর্ডের ডালা খোলা হলো। ডালা খুলতেই অনেকগুলো খালি ব্ল্যান্ডির বোতল বেরিয়ে এলো কাপবোর্ড থেকে।

জানোয়ার! শুয়োরের বাচ্চা! শয়তান! চিৎকার করে উঠলেন মিসেস নিকোলেটিস।

ধন্যবাদ ম্যাডাম, নম্রভাবে বললো ইনসপেক্টর। এখানে আমাদের কাজ শেষ। বুদ্ধি করে বোতলগুলো কাপবোর্ডে আবার সাজিয়ে রাখলো মিসেস হার্বার্ড। ওদিকে মিসেস নিকোলেটিস তখন হিস্টিরিয়া রোগিণীর মতো ছটফট করছিলেন। রহস্য, একটা রহস্য মিসেস নিকোলেটিসের মেজাজের রহস্য এখন পরিষ্কার হয়ে গেলো। সবেমাত্র মিসেস নিকোলেটিসের যন্ত্রণা উপশম করার জন্য তাকে ওষুধ খাইয়ে তার পাশে বসবার উপক্রম করেছিল মিসেস হার্বার্ড, ঠিক সেই সময় পোয়ারোর ফোন এলো। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে আবার ফিরে গেলো মিসেস নিকোলেটিসের কাছে। তখনো তিনি সোফার উপর হাত-পা ছুঁড়ছিলেন তার বসবার ঘরে। বুঝতেই পারছেন ওরা ওদের কর্তব্য তো করবেই, তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন মিসেস হার্বার্ড।

তাই বলে আমার ব্যক্তিগত কাপবোর্ড খুলবে? আমি ওদের বললাম, ওটা আপনাদের জন্য নয়। এটা আমি চাবি দিয়ে রেখেছিলাম। চাবিটা আমি আমার বুকের মধ্যে রেখেছিলাম। তুমি যদি সাক্ষী হিসাবে না থাকতে ওরা তাহলে নির্লজ্জের মতো আমার পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলতো।

ওহো না, ওরা ও কাজ কখনোই করতো না, বললো মিসেস হার্বার্ড।

তুমি যে বলছো। বাটালি না পেলে ওরা তাই করত। এটা আমার বাড়ির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, এর জন্য আমি দায়ী হবো।

কিন্তু মিসেস নিকোলেটিস, মনে রাখবেন এখানে একজন খুন হয়েছে। আর খুন হলে পুলিস এমন কিছু কাজ করতে পারে যা অন্য সময় হলে মোটেই সুখকর হতো না।

খুনের ব্যাপারে আমি থুথু ফেলি। বললেন উত্তেজিত নিকোলেটিস। এই বাচ্চা মেয়ে সিলিয়া আত্মহত্যা করেছে, বিশ্রী প্রেমের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিল ও, তাই তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিষ খেতে বাধ্য হয়েছিল ও, এরকম ঘটনা তো আকছারই ঘটছে আজকাল, এই সব মেয়েরা প্রেমের ব্যাপারে এতো বোকা, প্রেমের জন্য ওরা নিজেদের জীবনকেও তুচ্ছ বলে ভাবতে পারে।

ভালোবাসা, বললো মিসেস হার্বার্ড। তারপর যেখান থেকে আলোচনা শুরু হয়েছিল তার জের টেনে সে আবার বললো, এমন সব ব্যাপারে আমার চিন্তা করা উচিত নয়।

তোমার পক্ষে সেটা হয়তো ভালো কথা, কিন্তু আমাকে চিন্তা করতেই হবে, আমার পক্ষে এটা আর নিরাপদ নয়।

নিরাপদ? অবাক চোখে তাকাল মিসেস হার্বার্ড।

এটা আমার ব্যক্তিগত কাপবোর্ড, জোর দিয়ে বললেন মিসেস নিকোলেটিস। আমার কাপবোর্ডে কি আছে কেউ জানতো না, আমি কাউকে জানতেও দিতে চাইনি। কিন্তু এখন ওরা জেনে গেল, আমি এখন অস্বস্তি বোধ করছি। ওরা হয়তো ভাবতে পারে–ওরা কি ভাবতে পারে?

ওরা বলতে আপনি কাদের বোঝাতে চাইছেন? বললে ভালো হতো, তাহলে আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম।

কেন বুঝতে পারছে না তুমি, আমার এখানে ঘুম হবে না, বললেন মিসেস নিকোলেটিস, এই চাবিগুলো একইরকমের। যে কোনো চাবি যে কোনো তালায় লাগতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছো ব্যাপারটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আমার চোখে আর ঘুম আসবে না।

মিসেস নিকোলেটিস আমি আবার বলছি, আপনি যদি কোনো কিছুর জন্য ভয় পেয়ে থাকেন তাহলে আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারেন।

মিসেস নিকোলেটিসের কালো গভীর চোখ থেকে যেন একঝলক আগুন ঝরে পড়লো, তুমি তো তোমার নিজের কথাই বললে, কৌশলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন তিনি। তুমি বললে এ বাড়িতে খুন হওয়ার দরুন যে কেউ অস্বস্তি বোধ করবে। পরবর্তী শিকার কে হবে? এমনকি কেউ এখনো পর্যন্ত জানে না খুনী কে? এই কারণেই পুলিশকে আমার খুব বোকা মনে হয়েছে। কাজের কাজটা তারা এখনো পর্যন্ত করতে পারেনি কিংবা এও হতে পারে, তারা ঘুষ খেয়ে বসে আছে।

ঘুষ খাওয়ার কথা বলবেন না, একথা বলা বোকামো, আর আপনি সেটা ভালোই জানেন, একটু কড়া সুরেই বললো মিসেস হার্বার্ড। বরং আপনি আমাকে বিশ্বাস করে বলুন, আপনার প্রকৃত উদ্বেগের কারণটা কি।

আহ আমার চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে মনে করো না। আছে কি নেই সে তুমি ভালোই জানো, সব কিছুই তুমি জানো! চমৎকার মেয়ে তুমি। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো ভালো খাবার খাওয়ানোর জন্য জলের মতো অর্থ ব্যয় করছো তুমি, তোমার লক্ষ্য ওদের প্রিয় হওয়া আর এখন তুমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইছে, কিন্তু তা হবে না। আমার সমস্যাটা আমি নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই, কেউ তার মধ্যে নাক গলাতে পারবে না। শুনতে পাচ্ছ তুমি? না মিসেস, বন্ধু সেজে কৌশলে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা জেনে নিতে দেবো না আমি তোমাকে।

দয়া করে আপনি

না, বলবো না, আমি জানতাম, তুমি একজন গুপ্তচর।

 কিসের গুপ্তচর?

কিছুই নয়, বললো মিসেস নিকোলেটিস, এখানে গুপ্তচরগিরি করার কিছুই নেই। তুমি ধরে নিয়েছে এখানে গোপন কিছু আছে, আর সেই ভেবে তুমি যদি পুলিসের কাছে মিথ্যে করে কিছু বলল, আমি ধরে নেবো কে বলতে পারে, বুঝলে?

এভাবে বলছেন কেন? বললো মিসেস হার্বার্ড, এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য আপনি আমাকে সোজাসুজিই তো বলতে পারেন।

না, তোমাকে যেতে হবে না। আমি নিষেধ করছি, এখন নয় যতদিন এই পুলিসী ঝামেলা চলবে, যতদিন না খুনী ধরা পড়বে তোমাকে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকতে হবে।

আমাকে ত্যাগ করে চলে যেতে দেবো না তোমাকে।

ঠিক আছে, নিরাশ হয়ে বললো মিসেস হার্বার্ড। কিন্তু আপনি সত্যি সত্যি কি যে চান বোঝা মুশকিল। এক এক সময় আমার কি মনে হয় জানেন, আপনি আসলে কি চান, নিজেই হয়তো তা জানেন না। আপনি বরং আমার বিছানায় শুয়ে থাকুন–আর ঘুমোবার চেষ্টা করুন

.

২৬ নম্বর হিকরি রোডে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলো এরকুল পোয়ারো। দরজা খুলে দিলো গেরোনিমো। পুরানো বন্ধুর মতো তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো সে, এখানে পুলিস এসেছিল। উঃ! সে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা। সার্চ ওয়ারেন্ট নামে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। রান্নাঘর তল্লাসি করতে গেলে মারিয়া তো ক্ষেপে লাল। রাগের মাথায় বলেই ফেলে সে পুলিসকে পেটাবে। আমি তাকে বোঝাই, অমন কাজ করো না, করলে আমরা সবাই আরো বেশি ঝামেলায় পড়ে যাবো।

তোমার দেখছি ভালো বোধশক্তি আছে, পোয়ারো তার কাজের প্রশংসা করে জিজ্ঞেস করলো, মিসেস হার্বার্ড কোথায়?

উপরতলায় চলুন, ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

এক মিনিট, পোয়ারো তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এখান থেকে কিছু ইলেকট্রিক বাল্ব ঠিক কবে উধাও হয়েছিল বলতে পারো?

সে তো অনেক, অনেকদিন আগে, তা প্রায় এক দুই কিংবা তিনমাস আগের ঘটনা হবে।

ঠিক কোনো বাল্ব উধাও হয়েছিল বলো তো?

একটা হলঘরের একটা কমনরুমের আর বাড়তি বাল্বগুলো উধাও হয়।

তাহলে ঠিক কোনো তারিখে সেগুলো উধাও হয়েছিল তুমি খেয়াল করতে পারছো না?

নির্দিষ্ট তারিখ বলতে না পারলেও মাসটা আমার মনে আছে–ফেব্রুয়ারী, কারণ ওই মাসেই পুলিস এসেছিল এখানে।

পুলিস? এখানে পুলিস এসেছিল কেন।

মিসেস নিকোলেটিসের সাথে দেখা করতে এসেছিল, একজন ছাত্রের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে। আফ্রিকা থেকে এসেছিল ছাত্রটি, খুবই বাজে ছেলে, কোনো কাজকর্ম করতো না, নারীসঙ্গ ছিলো তার। তার জন্য মেয়েটি অন্য পুরুষদের সঙ্গদান করত। খুবই খারাপ ব্যাপার। পুলিস সেটা পছন্দ করতে পারেনি এসব ঘটনা ম্যাঞ্চেস্টার, না আমার মনে হয় শেফিল্ডের। তাই সে সেখান থেকে পালিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পুলিস ঠিক তাকে খুঁজে পেয়ে মিস, হার্বার্ডের সাথে তার ব্যাপারে আলোচনা করে, কিন্তু পাখি তখন উড়ে গেছে এখান থেকে। তবে পরে পুলিস তাকে অন্য এক জায়গা থেকে আটক করে জেলে পুরে দেয়।

আর পুলিস যেদিন এখানে আসে সেইদিনই বাল্বগুলো চুরি গেছিল এই তো?

হা, সুইচ অন করতে গিয়ে দেখি আলো জ্বলছিল না। তখন কমনরুমে গিয়ে দেখি সেখানকার বাল্বও উধাও। এখানে ড্রয়ারে বাড়তি বান্ধ রাখা ছিল সেগুলোও উধাও।

গেরোনিমোর সঙ্গে মিসেস হার্বার্ডের ঘরে যেতে গিয়ে তার কাহিনিটা হজম করতে হলো পোয়ারোকে।

পোয়ারোকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানিয়ে তার হাতে একটা তালিকা তুলে দিয়ে মিসেস হার্বার্ড ক্লান্ত স্বরে বললো, এই জিনিসগুলো একেকটা উধাও হওয়ার দিনক্ষণ আমি আমার সাধ্যমতো লেখার চেষ্টা করেছি মঁসিয়ে পোয়ারো। তবে এটা একশো ভাগ নির্ভুল বলে ধরে নিতে পারেন আপনি।

ম্যাডাম, আমি তোমার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, এখন বলো মিসেস নিকোলেটিস কেমন আছেন?

আমি ওঁকে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছি, মনে হয় তিনি এখন ঘুমুচ্ছেন। সার্চ ওয়ারেন্টের ব্যাপারে উনি দারুণ ঝামেলা করেছিলেন। ওর ঘরের কাপবোর্ডের চাবি দিতে অস্বীকার করেন উনি। তখন ইনসপেক্টর তালা ভেঙে কাপবোর্ডের ডালা খুলতেই অনেকগুলো ব্র্যান্ডির খালি বোতল বেরিয়ে আসে।

আহ। পোয়ারো মুখে অমন একটা শব্দ করলে যেন সে মিসেস নিকোলেটিসের মনের ঠিকানা পেয়ে গেছে।

ব্ল্যান্ডির খালি বোতলগুলো সত্যি যেন অনেক কিছু ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। বললো মিসেস হার্বার্ড। সত্যি এ দিকটার কথা আমি চিন্তাই করিনি। কিছুদিন আমি সিঙ্গাপুরে চলে যাই। এরই মধ্যে এতগুলো ব্র্যান্ডির বোতল খালি করা হয়েছিল কিন্তু তা যাহোক–

এগুলো আপনার কৌতূহল উদ্রেক করে না, সবকিছুই আমাকে আগ্রহ জাগায়, বললো পোয়ারো।

চেয়ারে বসে সে আবার সেই তালিকার উপর দৃষ্টি ফেললো। কিছুক্ষণ পরেই সে আবার বলে উঠলো, আহ্, দেখছি ঝোলানো ব্যাগটাই তালিকার প্রথমেই হয়েছে।

হ্যাঁ, ওটা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু এখন আমি মনে করতে পারছি, গহনাগুলো আর কিছু দামী জিনিস উধাও হওয়ার আগে, যেন সেটা আগে সরানো হয়েছিল। সেই কালো চামড়ার ছেলেটির জন্য আমাদের খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়, মনে হয় এগুলোর সঙ্গে সেই ঘটনাটা হয়তো মিশে গিয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনায় একদিন কি দুদিন আগে এখান থেকে চলে যায় সে। তাই মনে হয় এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে এই রকম একটা হিংসাপূর্ণ কাজ করে যায় সে, যাতে করে আমাদের অসুবিধায় পড়তে হয়।

আহ্! সেরকম কিছু একটা বলতে চাইছিল গেরোনিমো। এখানে পুলিস এসেছিল, খবরটা ঠিক?

হা। মনে হয় শেফিল্ড কিংবা বার্মিংহ্যাম থেকে তারা তদন্ত করার হুকুম পেয়ে থাকবে। এ সবই স্ক্যান্ডাল। অসৎ উপায়ে উপার্জন এইরকম আর কি।

আর তারপরেই ছেঁড়া ঝোলা ব্যাগের সন্ধান পাও তোমরা?

হ্যাঁ আমার তাই মনে হয়-মনে রাখা খুবই কঠিন। লেন বেটসন তার সেই ঝোলা ব্যাগ হারানোর ব্যাপার নিয়ে খুব ঝামেলা করেছিল। তখন খোঁজ খোঁজ। সব শেষে গেরোনিমো বয়লারের পিছন থেকে টুকরো টুকরো অবস্থায় সেটা আবিষ্কার করে। এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা–এতো কৌতূহল, কিন্তু মিঃ পোয়ারো, এর কোনো মানে হয় না, তাই না?

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কি যেন ভাবলো সে।

 সেই বাল্বগুলো আর ঝোলানো ব্যাগ, তেমনি চিন্তিতভাবে আস্তে করে বললো পোয়ারো।

কিন্তু এখনো আমি মনে করি, বললো মিসেস হার্বার্ড, সেই জিনিসগুলো হারানোর সঙ্গে সিলিয়ার দোষত্রুটির কোনো সম্পর্ক নেই। আপনার মনে আছে, ঝোলানো ব্যাগ যে সে ছোঁয়নি, তা সে তীব্রভাবে অস্বীকার করেছিল।

হ্যাঁ সেটা সত্যি, এর কতদিন পরে চুরিগুলো ঘটতে শুরু করে বলো তো?

ওহে প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো, এ সব কথা মনে রাখা যে কতো কষ্টকর, আপনার কোনো ধারণা নেই, দাঁড়ান, আমাকে খেয়াল করতে দিন–মার্চ না ফেব্রুয়ারি-ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। হ্যাঁ আমার মনে হয়, তার এক সপ্তাহ পরে জেনেভিভও বলেছিল তার ব্রেসলেটটা হারিয়েছে। হা কুড়ি এবং পঁচিশ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।

আর তারপর থেকে মোটামুটি ভাবে চুরি হতে থাকে, তাই না।

হ্যাঁ, মিসেস হার্বার্ড বলে, ঝোলা ব্যাগটা ছিলো লেন বেটসনের। সে তো দারুণ খাপ্পা, এমনিতেই ছেলেটি একটি রগচটা ধরনের।

ব্যাগটা কি বিশেষ ধরনের?

ওহো তা নয়, নেহাতই মামুলি ধরনের।

 ঐরকম একটা ব্যাগ আমাকে দেখাতে পারো?

 নিশ্চয়ই। কলিনের ঐরকম একটা ব্যাগ আছে, নিজেলের এরকম একটা ব্যাগ আছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি লেন ঠিক ঐরকম একটা ব্যাগ আবার কিনেছে এই রাস্তারই শেষ প্রান্তের একটা দোকান থেকে। যে কোনো বড় বড় দোকানের থেকে সেখানকার জিনিস খুবই সস্তা।

ম্যাডাম, আমি কি সেইরকম একটা ব্যাগ দেখতে পারি?

কলিন ম্যাকনারের ঘরে তাকে নিয়ে গেলো মিসেস হার্বার্ড, কলিন ঘরে ছিলো না, তবে তার কাপবোর্ড খুলে তার ঝোলানো ব্যাগটা বার করে পোয়ারোর হাতে তুলে দিলো। ঠিক এই রকমই একটা হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া যায়।

এমব্রয়ডারি কাঁচি দিয়ে কেউ কাটতে পারবে না, বিড়বিড়িয়ে বললো পোয়ারো।

না, আপনি যা মনে করছেন তা নয়–যদিও এর জন্য যথেষ্ট শক্তির দরকার তাও আমি বলবো, উদাহরণস্বরূপ যে মেয়ের মনে অপরের অপকার করার স্পৃহা থাকে, অনায়াসে সে এটা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। এখানে একটু থেমে মিসেস হার্বার্ড বলে, ভ্যালেরির স্কার্ফের দশা এইরকমই করা হয়, ভালো কথা দেখেশুনে মনে হয়–কি বলবো-এ যেন অসামঞ্জস্যহীন।

আহ! বললো পোয়ারো, কিন্তু ম্যাডাম, আমার মনে হয় তুমি বোধহয় কোথাও ভুল করছো, এ ব্যাপারে আমার মনে হয় না এর মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্যহীন নেই। আমার আরো মনে হয় এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য আর প্রয়োজন আছে, যাকে আমরা বলতে পারি একটা বিশেষ ধরনের নিয়ম।

ঠিক আছে আমি সাহস করে বলতে পারি, এসব ব্যাপারে আপনি অনেককিছুই জানেন, বললো মিসেস হার্বার্ড, আমার যা বলার তা হলো, এসব আমি অপছন্দ করি। আমার বিচারে এখানকার সব ছাত্র-ছাত্রীই চমৎকার। ওদের মধ্যে কোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রী যদি

পোয়ারো তখন ব্যালকনি পেরিয়ে আর একটা ঘরে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির পিছন দিকের ঘরের মতো দেখাচ্ছিল। নিচে ছোট্ট একটা বাগান, পরিত্যক্ত ঝুল আর ভূষায় ভর্তি।

আমার ধারণা, বাড়ির সামনের থেকে পিছনটা অনেক বেশি শান্ত নির্জন, বললো সে।

বয়লার-হাউসটা কোথায় বলো তো?

 ঐ যে দরজা দেখছেন, কোল-হাউসের ঠিক পাশেই?

এই পথের মুখে কার কার ঘর আছে জানতে পারি?

নিজেল চ্যাপম্যান আর লেন বেটসনের।

তাদের ঘরের পরে কাদের?

 তারপরের ঘরগুলো মেয়েদের, প্রথম ঘরটা সিলিয়া, তারপর এলিজাবেথ জনস্টন আর প্যাট্রিসিয়া লেনের, সামনের দিকে ভ্যালেরি আর জন টমকিনসনের। মাথা নেড়ে ঘরে ফিরে এলো পোয়ারো।

ঝোলানো ব্যাগগুলো কোনো দোকান থেকে কেনা হয়েছিল?

দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো নামটা ঠিক এখনি মনে করতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয় মেবারলি কিংবা কেলসো ঐরকমই কিছু একটা হবে।

আহ! বললো পোয়ারো, অদেখা সূত্র! এই কারণেই ঠিক এ ধরনের জিনিসের প্রতি আমার খুব লোভ আছে। জানালার ওপারে আর একবার তাকালো সে, নিচে ঝুল ও ভূষায় ভরা বাগানের দিকে। তারপর মিসেস হার্বার্ডের কাছ থেকে বিদায় নিল সে।

হিকরি রোডের শেষ ভাগের দোকানে এসে দাঁড়ালো সে, তবে মিসেস হার্বার্ডের বর্ণনা মতো দোকানটার নামে মেবারলি কিংবা কেলসো কোনোটাই নয়। তবে তার নাম বিক্স, সেই দোকানে ঢুকে পোয়ারো তার ভাইপোর জন্য একটা ঝোলানো বাগ কেনার ভান করল, কলিনের ঝোলাব্যাগের মতো একটা ব্যাগ কিনে নিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দোকানীর কাছ থেকে জানতে পারল, তার দোকানের দাম অন্যসব বড় বড় দোকানের থেকে কম বলে ২৬নং হিকরি রোডের অনেক ছাত্রছাত্রীই তার দোকান থেকে জিনিস কিনে থাকে। পোয়ারো বুঝতে পারল মিসেস হাবার্ডের কথাই ঠিক।

তারপর সেখান থেকে বেরোতে যাবে হঠাৎ প্রবেশ পথে তার কাঁধের উপর একটা ভারি হাত পড়তেই পিছনের দিকে তাকালো সে।

ইনসপেক্টর শার্প, আরে আমি তো আপনার খোঁজই করছিলাম, বললো সে।

হিকরি রোডের হোস্টেলের তদন্ত শেষ?

হ্যাঁ তবে তদন্তের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছ বলে আমি মনে করি না, ইনসপেক্টর শার্প বলে, চলুন না একটা রেস্তোরাঁয় বসে আপনার প্রিয় স্যান্ডউইচ আর কফি খাওয়া যাক। আপনার সাথে কিছু কথা আছে।

স্যান্ডউইচ বার প্রায় কঁকা, একেবারে একপ্রান্তে তারা দুজন গিয়ে বসলো নিরিবিলিতে, হোস্টেলের ছাত্র-ছাত্রীদের জবানবন্দী সংক্ষেপে বলতে লাগল ইনসপেক্টর। একবার তরুণ চ্যাপম্যানের বিরুদ্ধেই আমরা কিছু প্রমাণ জোগাড় করেছি, বললো শার্প। তিনধরনের বিষ সেই এনেছিল, কিন্তু সিলিয়া অস্টিনের সাথে তার কোনো শত্রুতা ছিলো বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

তার মানে আর একটা সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে যদিও

হা–সবকিছুর মূলেই ছিলো সেই ড্রয়ারটা। বিশ্রীরকমের লোক, তরুণ গর্দভ। এরপর সে আসে এলিজাবেথ জনস্টনের প্রসঙ্গে। আর সিলিয়া তাকে কি বলেছিল সে কথাও উঠলো। সে যা বলেছে তা যদি সত্য হয় তাহলে সেটা অর্থপূর্ণ।

অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, তাকে সমর্থন করলো পোয়ারো।

 আগামীকাল এ ব্যাপারে আরো কিছু জানতে পারবো, বললো ইনসপেক্টর।

আপনার তদন্তের আর ফলাফল কি?

হ্যাঁ আছে, সম্ভবত আরো দু-একটা অভাবনীয় ঘটনা। যেমন এলিজাবেথ কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য। আমরা তার পার্টির কার্ড দেখেছি।

হ্যাঁ, বললো পোয়ারো, এটা একটা আগ্রহের ব্যাপার বটে। তবে আমার মনে হয় পার্টিতে তার প্রবেশ একটা মূল্যবান অ্যাসেট। আমি বলবো বয়সে তরুণী, আর অস্বাভাবিক বুদ্ধিমতী সে, সে যাই হোক, পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, এ ছাড়া আর কি দেখলেন?

ইনসপেক্টর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, মিস প্যাট্রিসিয়া লেনের ড্রয়ারে সবুজ কালিমাখানো রুমাল পাওয়া গেছে।

পোয়ারোর ভ্রূ উঁচু হলো।

সবুজ কালি? প্যাট্রিসিয়া লেন, মনে হয় সে কালি নিয়েছিল, আর এলিজাবেথ জনস্টনের কাগজের উপর সেই কালি ছিটিয়েছিল। তারপর সেই রুমাল দিয়ে হাত মুছেছিল সে। কিন্তু নিশ্চয়ই সে চাইবে না তার প্রিয়তম নিজেল সন্দেহভাজন হোক, তার হয়ে কথাটা শেষ করলো শার্প।

কেউ তা ভাবতে পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কেউ সেই রুমালটা তার ড্রয়ারে রেখে থাকবে।

আর কিছু?

হা লিওনার্ড বেটসনের বাবা লংউইথ ডেল, মেন্টাল হাসপাতালে রয়েছে। আমার মনে হয় এটা তেমন আকর্ষণীয় কিছু নয়, কিন্তু

কিন্তু বেটসনের বাবা বিকৃত মাথার লোক। আপনি যেমন বললেন এর মধ্যে কোনো ইঙ্গিত থাকতে পারে না, তা ঠিক, কিন্তু এটা মনে রাখার মতো ঘটনা। আরো জানার ইচ্ছা হলো, তার সেই উন্মত্তটা কোনোদিকে বাঁক নেয়–তার ছেলের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে কিনা সেটা দেখার বিষয়।

খুব ভালো ছেলে বেটসন, বললো শার্প, তবে একটু বদমেজাজী, অসংযমী এই যা। আর আহমেদ আলির ঘর থেকে কতকগুলো পর্নোগ্রাফির বই পাওয়া গেছে, এর থেকে বোঝা যায়, সার্চ করার কথা শুনে কেনই বা সে অমন রেগে গিয়েছিল। তারপর সেই ফরাসী মেয়েটি তো হিস্টিরিয়া রোগগ্রস্ত। আর সেই ভারতীয় মিঃ চন্দ্রলাল এটা একটা আন্তর্জাতিক ইস্যু করবে বলে হুমকি দিয়েছে। তার কাছ থেকে আপত্তিকর প্যামপ্লেট পাওয়া গেছে–আর একজন আফ্রিকানের কাছে ভয়ঙ্কর ধরনের স্যুভেনির ছিলো। অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষের অদ্ভুত অদ্ভুত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে–মিসেস নিকোলেটিস ও তার ব্যক্তিগত কাপবোর্ডের খবর শুনেছেন?

হা শুনেছি বৈকি!

দাঁত বার করে হাসলো ইনসপেক্টর শার্প। আমার জীবনে অভোগুলো খালি ব্র্যান্ডির বোতলের কথা কখনো শুনিনি। আর তিনি তো আমাদের ওপর পাগলের মতো খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। হাসলো সে, তারপর ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললো, কিন্তু আমরা যা খুঁজছিলাম পেলাম না সেটা। বৈধ ছাড়া অন্য কোনো পাসপোর্টের খোঁজ পেলাম না।

আপনি কি ভেবেছেন, আপনার কাছে সমর্পণ করার জন্য সেখানে নকল পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হবে? আচ্ছা আপনি কি আগে কখনো পাসপোর্টের ব্যাপারে ২৬ নং হিকরি রোডে গিয়েছিলেন? ধরুন বছর ছয়েক আগে?

মাথা নাড়লো শার্প, তারপর সাবধানে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করলো এসবের কোনো মানে হয় না, সব শেষে বললো সে।

একেবারে শুরু থেকে আমরা যদি শুরু করি, তাহলেই এ সব কিছুর মানে খুঁজে পাওয়া যাবে।

শুরু থেকে বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

বন্ধু সেই ঝোলানো ব্যাগটা, নরমসুরে বললো পোয়ারো। একটা ঝোলানো ব্যাগ দিয়েই সব কিছু শুরু।

.

১১.

 মিসেস নিকোলেটিস রাগে উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমি এখান থেকে চলে যাবো, যেখানেই যাই না কেন সেই জায়গাটা অন্তত এখান থেকে নিরাপদ হবে, সে আমি জোর গলায় বলতে পারি।

কিন্তু আপনার ভয় কিসের? আমি যদি জানতে পারতাম, সম্ভবতঃ আমি–

সেটা তোমার জানার কথা নয়। আমি তোমাকে কিছুই বলবো না। তুমি যেভাবে একনাগাড়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে, সেটা আমি মানতে পারছি না।

আমি দুঃখিত।

এখন তুমি অপমানিত আমার রূঢ় ব্যবহারের জন্য। কিন্তু আমি কি সাধ করে এমন উত্তেজিত হয়েছি? ঐ পুলিসের লোকগুলো সার্চের নাম করে আমার বাড়ি তছনছ করে দিয়েছে। আমার বুকটা ভেঙ গেছে। এখন একটু ব্র্যান্ডি পেলে ভালো হয়–চলি, উইক এন্ডটা যেন তোমার ভালো ভাবে কাটে। শুভরাত্রি।

হিকরি রোডটা বেশ বড়, লন্ডনের বড় বড় রাস্তাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। রাস্তার শেষ প্রান্তে ট্রাফিক লাইট এবং একটা পাবলিক হাউস, দি কুইন্স নেকলেস। পথ চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন মিসেস নিকোলেটিস। না পরিচিত কাউকে চোখে পড়ল না। দি কুইন্স নেকলেসের কাছে গিয়ে আর একবার অপরাধীর মতো ভয়ে ভয়ে চারদিক দেখে নিয়ে একা মেলুন বারে ঢুকে পড়লেন তিনি।

দ্রুত কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি গলাধঃকরণ করার পর একটু ধাতস্থ হলেন তিনি। তাকে আর ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে না। তবে পুলিসের উপর তার রাগ কমলো না। আজ পুলিস যেভাবে বাড়াবাড়ি করলে তাতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আর মুখ দেখাতে পারবেন না তিনি। মিসেস হার্বার্ডের একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো। কেউঁকি কাউকে বিশ্বাস করতে পারে? ব্যাপারটা গেরোনিমোও জেনে গেছে। সম্ভবত সে তার বউকে বলবে, তার বৌ আবার ঝাড়ুদারনিকে বলবে, এই ভাবে পাঁচকান হতে হতে তার গোপন কথাটি সবাই জেনে যাবে শেষ পর্যন্ত। উঃ অসহ্য। তার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো, তিনি আবার ব্র্যান্ডির ফরমাস করলেন। আজ তিনি আকণ্ঠ ব্র্যান্ডি পান করলেন। চোখ বুজে আসছিল তার আর চোখ বন্ধ করলেই তিনি যেন তার ভবিষ্যৎ দেখতে পান, অন্ধকারাচ্ছন্ন। তার গোপন পরিচয়টা পেয়ে সবাই যেন ঘৃণার চোখে দেখবে। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, তারপর যখন তারা জানতে পারবে–তিনি আর চিন্তা করতে পারছেন না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল মেলুন বারের বদ্ধ আবহাওয়ায়। তা তিনি এবার কোননারকমে উঠে দাঁড়ালেন, পা দুটো টলছিল। তবু সেই অবস্থায় তিনি বেরিয়ে এলেন, দি কুইন্স নেকলেস থেকে, তারপর খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে রাস্তায় নামলেন, দেওয়াল ঘেঁষে চলতে থাকলেন, একটু সময়ের জন্য যদি তিনি চোখ বন্ধ করেন

এই সময় সেইপথ দিয়ে পুলিস কনস্টেবল বটকে হেঁটে যেতে দেখা গেলো। একটু এগোতেই তাকে থামতে হলো একটা জটলা দেখে। অফিসার এখানে একজন মহিলা অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন–মনে হয় তিনি অসুস্থ কিংবা–ভীড়ের মধ্যে কে যেন বললো।

পুলিস কনস্টেবল বট ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে তার নাকে তীব্র ব্র্যান্ডির গন্ধ এসে লাগলো, আর তখনি সে বুঝলো, তার সন্দেহ ঠিকই।

বললো সে, মাতাল, চিন্তার কিছু নেই, আমরা দেখছি

.

এরকুল পোয়ারো রবিবারের প্রাতঃরাশ সেরে তার বসার ঘরে এসে বসল। টেবিলের উপর পরিষ্কার করে সাজানো চারটি ঝোলা ব্যাগ। মিঃ হিক-এর দোকান থেকে কেনা ঝোলানো ব্যাগের সঙ্গে জর্জের কিনে আনা বাকি ব্যাগগুলো থেকে কোনো অংশেই খারাপ নয়। কিন্তু তার কিনে আনা ব্যাগটা অনেক সস্তা।

মজার ব্যাপার তো, বলল পোয়ারো। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল সে ঐ ব্যাগগুলোর দিকে। তারপর সেই ব্যাগগুলো পরীক্ষা করে দেখতে থাকলো। বাথরুম থেকে একটা ধানকাটার ছুরি নিয়ে এসে মিঃ হিক-এর দোকানে ঝোলানো ব্যাগটা কাটবার চেষ্টা করলো। ভালো করে পরীক্ষা করে সে দেখলল ব্যাগের ভেতরে লাইনিং-এর তলায় করোগেটেড কাগজের একটা আস্তরণ। ব্যাগের টুকরো টুকরো অংশগুলো আগ্রহ সহকারে দেখতে থাকলো পোয়ারো। এরপর সে অন্য ব্যাগগুলোর উপর ছুরি চালিয়ে অপারেশনের কাজ শেষ করে তার কাজ পর্যালোচনা করে দেখতে থাকল। তারপর রিসিভারটা তুলে ডায়াল করলো, সামান্য একটু দেরি হওয়ার পর দূরভাষে ইনসপেক্টর শার্পের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, পোয়ারো তখন তাকে বললো, দুটো জিনিস আমি জানতে চাই।

হোহো করে হেসে উঠল ইনসপেক্টর শার্প।

গতকাল আপনি বলেছিলেন গত তিনমাসে পুলিসি তদন্তের কাজে আপনি হিকরি রোডে গিয়েছিলেন। আপনি তারিখ আর সময়গুলো বলতে পারেন?

হাঁ, সে তো খুবই সোজা, ফাইল দেখে এখনি বলছি। কিছুক্ষণ পরে উত্তরভাষে তার কণ্ঠস্বর আবার আসে, গত ১৮ই ডিসেম্বর বেলা সাড়ে তিনটের সময় একজন ভারতীয় ছাত্রের আপত্তিকর কিছু প্রচার করার জন্য পুলিস সেখানে তদন্ত করতে যায়।

সে তো অনেকদিন আগে।

একজন ইউরোপীয় মোন্টাও জোনসকে পুলিস খুঁজছিল। কেমব্রিজে মিসেস এ্যালিস কমবকে হত্যা করার অপরাধে। অরিখ ২৪শে ফেব্রুয়ারি–তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা হবে। আবার ৬ই মার্চ সকাল এগারোটার সময় পুলিস সেখানে যায় ওয়েস্ট আফ্রিকার বাসিন্দা উইলিয়াম রবিনসনের খোঁজে। শেফিল্ড পুলিস তাকে খুঁজছিল।

আহ্! ধন্যবাদ।

তবে আপনি কি মনে করেন, সেই কেসগুলো এই কেসের সঙ্গে সম্পর্ক

পোয়ারো তার কথায় বাধা দিয়ে বললো, না, সেগুলোর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তদন্তের তারিখ আর সময় সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিলো।

আপনার কিরকম মনে হচ্ছে পোয়ারো।

শুনুন বন্ধু ঝোলা ব্যাগগুলো আমি কেটে টুকরো করে ফেলেছি। এটা খুবই মজার ব্যাপার, তারপর শান্ত ভাবে রিসিভার নামিয়ে রাখে সে, তারপর সে তার পকেটবুক থেকে গত পরশু মিসেস হার্বার্ডের দেওয়া পরিবর্তিত তালিকাটি হাতে নিয়ে তার উপর চোখ বোলাতে থাকলো। তালিকাটা ছিলো এইরকম :

একটা ঝোলানো ব্যাগ (লেন বেটসনের) ইলেকট্রিক বাল্বগুলো। ব্রেসলেট (জেনেভিভের) হীরের আংটি (প্যাট্রিসিয়ার) পাউডার কমপ্যাক্ট (জেনেভিভের) সান্ধ্যজুতো (সেলীর)। লিপস্টিক (এলিজাবেথ জনস্টনের) কানের দুল (ভ্যালেরির)। স্টেথোস্কোপ (লেন বেটসনের) বাথ সল্ট (?)। ছিন্নবিচ্ছিন্ন স্কার্ফ (ভ্যালেরির) ট্রাউজার (কলিনের) রান্নার বই (?)। বোরিক (চন্দ্রলালের)। কস্টিউম ব্রোচ (সেলীর) এলিজাবেথের নোটের উপর কালি ছিটানোর ঘটনা। (আমার সাধ্যমত এই তালিকা আমি তৈরি করেছি। এটা সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। হার্বার্ড)

এখন এই তালিকা থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাদ দিতে হবে। এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা ছিলো না, ভাবল পোয়ারো। কে তাকে সাহায্য করতে পারে? আজ রবিবার, সম্ভবত বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেলে আছে। ২৬নং হিরি রোডে ফোন করলো সে। ফোনে মিস ভ্যালেরি জনহাউসের খোঁজ করতেই একটু পরে তার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো দূরভাষে। ভ্যালেরি জনহাউস কথা বলছি।

এ প্রান্ত থেকে এরকুল পোয়ারো। আমাকে তোমার মনে আছে?

নিশ্চয়ই মঁসিয়ে পোয়ারো, বলুন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?

 তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে। এখুনি আমি হিকরি রোডে যাচ্ছি।

বেশ তো, আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো, চলে আসুন।

কিছুক্ষণ পর গেরোনিমো পোয়ারোকে ভ্যালেরি জনহাউসের ঘরে নিয়ে এলো। ভ্যালেরি দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল তাকে স্বাগত জানানোর জন্য। খুব ক্লান্ত ভ্যালেরি, চোখের কোণে কালিমা পড়ে গেছে।

কথায় কথায় পোয়ারো তাকে জিজ্ঞেস করলো, মাদমোয়াজেল তুমি তো ছাত্রী নও, তাই না?

ওহো না। আমি চাকরীয়া। একটা বাসমেটিক ফার্মে?

 পোয়ারো বললো, মাঝে মাঝে প্যারিসে আর কন্টিনেন্টে যাও।

ও হ্যাঁ, মাসে একবার বটেই, মাঝে মাঝে একবারের বেশিও হয়ে যায়।

 মাফ করো আমাকে, হয়তো একটু বাড়তি কৌতূহল প্রকাশ করে ফেলেছি। কিছু মনে করলে না তো?

না, না, আপনি স্বচ্ছন্দে আপনার কৌতূহল প্রকাশ করতে পারেন।

ধন্যবাদ, এখানে একটু থেমে পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, তোমার ব্যাপারে ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন?

হা তাতো বটেই।

আর তুমি যা জানো সব তাকে বলেছিলে? আমার আশঙ্কা যদি সেটা সত্য হয়। পোয়ারোর দিকে তাকালো ভ্যালেরি, তার দুচোখ থেকে বিদ্রূপ ঝরে পড়ছিল। ইনসপেক্টর শার্পের প্রশ্নের উত্তরে আমি কি বলেছিলাম সেটা আপনি শোনেননি বলেই আপনার ধারণা যথাযথ নয়।

আহ, তা নয়, এ আমার একটা সামান্য অনুমান মাত্র। আমি এখানে এসেছি, বললো পোয়ারো, মিস প্যাট্রিসিয়া লেনের আংটি চুরির ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করার জন্য।

প্যাট্রিসিয়ার বাগদানের আংটি? মানে তার মার বাগদানের আংটি? কিন্তু আপনি সেটা নিলেন কেন?

দু-এক দিনের জন্য ধার নিয়েছিলাম, এই আংটিটার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিলো, বললো পোয়ারো। আগ্রহের কারণ–হঠাৎ সেটা উধাও হয়ে যাওয়া, আবার তেমনি হঠাৎ সেটা ফিরে আসা এবং আরো কিছু কারণ রয়েছে এর পিছনে। আংটিটা প্যাট্রিসিয়ার কাছ থেকে ধার নিয়ে আমি সোজা চলে যাই আমার এক বন্ধুর জুয়েলারির দোকানে, আমি তাকে হীরের ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে বলি, তোমার মনে আছে মাদমোয়াজেল, আংটিটার দুপাশে দুটি পাথর ছিলো?

আমার তাই মনে হয়, তবে খুব ভালো ভাবে আমার মনে নেই।

কিন্তু সেটা তুমি নাড়াচাড়া করেছিলে। সেটা তোমার স্যুপের প্লেটে ছিলো। ঐভাবেই সেটা ফেরৎ এসেছিল।

ও হ্যাঁ এখন আমার মনে পড়েছে, আংটিটা আমি প্রায় গিলেই ফেলেছিলাম, মৃদু হাসলো ভ্যালেরি।

হ্যাঁ একটু আগে যা বলছিলাম, তা আমার সেই বন্ধু জুয়েলার কি বলেছিল জানো? তার উত্তর হলো পরের দুটো আদৌ হীরে ছিলো না। আসলে পরের দুটো ছিলো গোমেদ, সাদা গোমেদ।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, অনিশ্চিতভাবে বললো, ভ্যালেরি সেগুলো প্যাট্রিসিয়া। হীরে বলেই মনে করতো, কিন্তু সেগুলো শুধু গোমেদ কি?

দ্রুত মাথা নাড়লো পোয়ারো, না, আমি তা ভাবিনি। তাংটিটি ছিলো বাগদানের, প্যাট্রিসিয়ার মা ছিলেন ভালো পরিবারের। তার স্বামীও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না, অতএব শেষে পোয়ারো বলে ফেললো, আমার মনে হয়, আসল হীরে দুটো বদল করা হয়েছিল, আর সেই সঙ্গে গোমেদ জাতীয় পাথর সেট করে দেওয়া হয় আংটিটাতে। এখানে একটু থেমে পোয়ারো বলল, সেই আংটিটা মাদমোয়াজেল মিলিয়ে নিয়েছিল আর তখনি ইচ্ছাকৃত ভাবে হীরের বদলে গোমেদ পাথর লাগিয়ে দেওয়া হয় তাতে।

তাহলে আপনি কি মনে করেন, সিলিয়াই ইচ্ছাকৃত ভাবে হীরে চুরি করেছিল।

না, বললো সে, আমার কি মনে হয় জানো তুমি, হ্যাঁ তুমিই সেই হীরে চুরি করেছিলে মাদমোয়াজেল।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো ভ্যালেরি জনহাউস, সত্যিই, মৃদু চিৎকার করে উঠলো সে, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আপনার কাছে নেই।

হ্যাঁ আছে বৈকি, তাকে বাধা দিয়ে পোয়ারো বললো, আমার কাছে প্রমাণ অবশ্যই আছে, একদিন সন্ধ্যায় আমি এখানে নৈশভোজ সারি। আমি লক্ষ্য করেছি যেভাবে এখানে স্যুপ দেওয়া হচ্ছিল, হয় সে তোমার প্লেটে সেই আংটি ফেলে রেখে থাকবে সবার অজান্তে, তা না হলে তুমি নিজেই তোমার এ কাজের মাধ্যমে নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আপনার বলা শেষ? অবজ্ঞার সঙ্গে বললো ভ্যালেরি।

না, না একেবারেই নয়। পোয়রো বলে উঠলো, সেদিন সন্ধ্যায় সিলিয়া যখন স্বীকার করলো চুরির ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী তখন, কয়েকটা ছোট ছোট পয়েন্ট আমার নজরে পড়ে, যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আংটিটার ব্যাপারে সে বলেছিল, সত্যি আমি বুঝতে পারিনি, আংটিটার দাম কতো হতে পারে জেনেই আমি তখন সেটা ফিরিয়ে দিই। মিস ভ্যালেরি, আংটির দাম সে কি করে জানবে? কে তাকে দামটা বলেছিল? তারপর আবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন সিল্কের স্কার্ফের কথায় আসা যাক।

সিলিয়া বলেছিল, তাতে ভ্যালেরি কিছু মনে করব না–একটা ভালো স্কার্ফ নষ্ট হলে কেনই বা তুমি কিছু মনে করবে না? এর থেকে আমার ধারণা হলো, এ চুরির সব ঘটনাগুলো সিলিয়াকে ক্লিপ্টোম্যানিয়াক প্রতিপন্ন করা, কলিন ম্যাকনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, এ সবই কেউ হয়তো ভেবে থাকবে সিলিয়ার জন্য আর সে তুমি, হ্যাঁ তুমিই, তুমিই তাকে হীরের দাম বলেছিলে, তুমিই তার কাছ থেকে আংটিটা নিয়ে বুদ্ধি করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আর তুমিই তাকে তোমার স্কার্ফটা দিয়েছিলে কেটে টুকরো করার জন্য।

আপনার কথাই ঠিক, ইনসপেক্টর শাপের কাছে যা করেনি ভ্যালেরি; পোয়ারোর কাছে শেষ অবধি তাই করলো। অকপটে স্বীকার করে বললো আমিই তাকে এসব ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলাম।

কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করতে পারি?

অধৈর্য হয়ে ভ্যালেরি বললো, লক্ষ্য করেছিলাম, বেচারী সিলিয়া দারুণ ভালোবাসত কলিন ম্যাকনারকে, ছায়ার মতো অনুসরণ করতো তাকে, কিন্তু কলিন ভুলেও ওর দিকে তাকাত না। তবে কলিনকে আমি জানতাম ভাবপ্রবণ যুবক, মানুষের মনঃস্তত্ব ভালো বোঝে। যাহোক সিলিয়ার মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারলাম না। তাই একদিন গোপনে তার সাথে দেখা করে আমার পরিকল্পনার কথা তাকে বলি, এখানকার কিছু জিনিস তাকে দিয়ে চুরি করিয়ে আমি তাকে ক্লিপ্টোম্যানিয়াক প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, সিলিয়া একটু নার্ভাস • হয়ে পড়ে, তবে পরে সেটার রূপরেখা দিতে গিয়ে রীতিমতো রোমাঞ্চ অনুভব করে, অবশ্য সিলিয়া বোকার মতো একটা কাজ করে বসে-বাথরুমে প্যাটের হীরের আংটিটা পড়ে; থাকতে দেখে সেটা তুলে নেয়। দামী আংটি সেটা চুরি গেলে দারুণ হৈচৈ পড়ে যাবে, পুলিস। আসবে, এসব কথা ভেবেই সেই আংটিটা আমি ওর কাছ থেকে নিয়ে নিই, পরে যেভাবেই হোক প্যাটের কাছে সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে এই ভেবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বললো, ঠিক এই রকমই আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু আংটিটা ফেরৎ দেওয়ার আগে কি ঘটেছিল, তাই বলো। পোয়ারো তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে থাকে। হঠাৎ ভ্যালেরিকে অস্বস্তিবোধ করতে দেখা গেল।

পোয়ারোর দিকে না তাকিয়েই মাথা নিচু করে ভ্যালেরি উত্তরে বলতে শুরু করলো, আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনার কাছে আমি নিজেকে পরিষ্কার করে তুলতে চাই। তাই অকপটে স্বীকার করছি মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি একজন জুয়ারী। ইদানীং জুয়ায় আমি কেবল হেরেই যাচ্ছিলাম, প্রচণ্ড অর্থাভাবে ভুগছিলাম। তাই প্যাটের সেই হীরের আংটির লোভটা সামলাতে পারলাম না, দামী হীরে মোটা টাকায় বিক্রি করে তার বদলে কম দামের গোমেদ সেট করিয়ে নিই তার আংটিতে একটা জুয়েলারী থেকে। তার পরের ঘটনা তো আপনি জানেনই, মানে কি ভাবে সেটা আমার স্যুপের প্লেটে রেখে দিই। কিন্তু সতোর সাথে আমি বলছি, এর জন্য সিলিয়া কখনোই দোষী হতে পারে না।

না, না, আমি বুঝি, পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে, এটা খুবই সহজ স্রেফ একটা সুযোগ মাত্র, আর তুমি সেটা গ্রহণ করেছিলে, কিন্তু মাদমোয়াজেল একটা বিরাট ভুল তুমি করেছিলে।

আমি সেটা বুঝতে পারি, শুকনো গলায় বললো ভ্যালেরি, তারপরেই সে ভেঙ্গে পড়লো, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? আমার অপরাধের কথা বলে দিন প্যাটকে, বলে দিন পুলিসকে, জানিয়ে দিন সারা বিশ্বকে, কিন্তু তাতে কি লাভ? এখন কিছু করলে সিলিয়ার হত্যাকারীর সন্ধান কি পাওয়া যাবে?

উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, কেউ তা জানে না, বললো সে, তবে প্রত্যেককেই খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে হবে। আমার জানার উদ্দেশ্য ছিলো, এই চুরির ব্যাপারে সিলিয়াকে কে অনুপ্রাণিত করেছিল। তুমি সেটা অকপটে স্বীকার করে আমার উদ্দেশ্য সফল করে তুলেছো, এখন বলছি প্যাটের কাছে গিয়ে তার আংটির ব্যাপারে তুমি তাকে সব খুলে বলো। এবং তোমার মানসিক যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করো তার কাছে।

ঠিক আছে তাই করবো, প্যাটের কাছে সব কথা স্বীকার করে বলবো তাকে, আমার আর্থিক সচ্ছলতা এলে আমি তার আংটিতে হীরে বসিয়ে দেবো, সঁসিয়ে পোয়ারো আপনি কি তাই চান?

আমি ঠিক এটা চাই না, তবে এটাই পরামর্শ দেওয়ার মতন।

এই সময় হঠাৎ দরজা খুলে যেতে দেখা যায় এবং মিসেস হার্বার্ড ঘরে এসে ঢুকলো। তার মুখ দেখে মনে হলো শ্বাস নিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার ওরকম অবস্থা দেখে মৃদু চিৎকার করে উঠলো ভ্যালেরি : কি ব্যাপার মা? কি হয়েছে?

একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে ভয়ার্ত গলায় বললো মিসেস হার্বার্ড, ওঃ প্রিয় ভ্যালেরি জানো মিসেস নিকোলেটিস আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি মারা গেছেন। গতরাত্রে তাকে রাস্তা থেকে পুলিস স্টেশনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ধারণা তিনি, তিনি–আমার মনে হয় মত্ত অবস্থায় ছিলেন

হা তিনি মদ খাচ্ছিলেন। যাই হোক, তিনি মৃত—

বেচারী বৃদ্ধা মিসেস নিক, কঁপা কাঁপা গলায় বললো ভ্যালেরি।

 মাদমোয়াজেল, তুমি ওঁর খুব প্রিয় ছিলে, তাই না? নম্র গলায় বললো পোয়ারো।

হা, ওর সঙ্গে সবারই ভালোলাগার কথা। তিন বছর হলো আমি এখানে আছি। শুরুতে তিনি অতো বদমেজাজী ছিলেন না। মিসেস হার্বার্ড বলে উঠলো, গত একবছর থেকে তিনি যেন কোনো কিছুর আতঙ্কে ভুগছিলেন।

আতঙ্ক? পোয়ারো এবং ভ্যালেরি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলো! হতাশ সুরে বললো মিসেস হার্বার্ড, হ্যাঁ তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি এখানে নিরাপদ বোধ করছেন না। আমি তার কাছে তার ভয়ের কারণটা কি, জানতে চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে পাত্তা দেননি, বলতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এখন আমি অবাক হচ্ছি

পুলিস ওঁর মৃত্যুর কারণ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলো পোয়ারো বিমর্ষ গলায়।

মিসেস হার্বার্ড বললো, না, তারা কিছু বলেনি। মঙ্গলবার তদন্ত হবে

.

১২.

 স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শান্ত একটা ঘর, একটা টেবিলের চারপাশে বসেছিল তারা চারজন, নারকোটিকস্ স্কোয়াডের সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং, কনফারেন্সের সভাপতি। তার পাশে বসে ছিল গ্ৰেহাউন্ডের সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে তরুণ ও আশাবাদী সার্জেন্ট বেল। ইনসপেক্টর শার্প হেলান দিয়ে বসেছিল। চতুর্থ ব্যক্তি হলো এরকুল পোয়ারো। টেবিলের উপর রাখা ছিলো একটা ঝোলানো ব্যাগ।

প্রথমে সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং মুখ খুললেন, সব সময়ই চোরাচালানের কারবার চলে আসছে, বিশেষ করে গত দেড় বছর ধরে তো বটেই। চোরাই জিনিসের মধ্যে হেরোইন সব থেকে বেশি উল্লেখযোগ্য। কন্টিনেন্টের সর্বত্র এর ঘাঁটি রয়েছে, ফরাসী পুলিস তো বোকা বনে গেছে কি করে এসব জিনিস ফ্রান্সে আসছে। আবার কি ভাবেই বা সেগুলো ফ্রান্সের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আমার বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। পোয়ারো তার কথার জের টেনে বললো, যদি বলি আপনার সমস্যাটাকে মোটামুটি ভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম সমস্যা সাদা দ্রব্যগুলো কিভাবে এদেশে বিতরণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো কিভাবে সেগুলো এদেশে চোরাচালান হয়ে আসছে আর তৃতীয় ও শেষ সমস্যা হলো কে এই ব্যবসা চালাচ্ছে আর আসল মুনাফাঁকে লুঠছে তা খুঁজে বার করা। আমি বলবো মোটামুটি ভাবে ঠিক এইরকমই, আমরা জানি এইসব মাদক দ্রব্য ছোট ছোট বিতরণকারীদের দ্বারা বিভিন্ন উপায়ে নাইটকারপাল ড্রাগ স্টোর্স এবং অন্য ডাক্তারদের কাছে বিতরণ করা হয় কিংবা ফ্যাশনপ্রিয় মহিলা, পোশাক প্রস্তুতকারক এবং হেয়ার ড্রেসারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

তাতো হলো, কিন্তু কি ভাবে সেগুলো এদেশে চোরাচালান হয়ে আসছে সেটা জানতেই আমার আগ্রহ বেশি।

আহ! আমরা তো একটা দ্বীপে বাস করি। তাই এখানে সেই পুরানো পদ্ধতি অর্থাৎ সমুদ্রপথে হেরোইন পাচার হয়ে আসছে। কিন্তু অন্য জিনিসগুলোে? যেমন, ধরা যাক হীরে-জহরত।

এবার মুখ খুললো সার্জেন্ট বেল। স্যার এখানে এর রমরমা ব্যবসা চলছে। এই সব অবৈধ হীরে আর দামী পাথরগুলো চোরাপথে বেশির ভাগ আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া থেকে এবং কিছু দূরপ্রাচ্য থেকে। সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং পোয়ারোর দিকে ফিরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, এইসব মাদকদ্রব্য আর হীরে-জহরত চোরাচালানের ব্যাপারে আপনার কি অভিমত?

দেখুন, বললো পোয়ারো, স্মাগলারদের দুর্বলতা চিরন্তনী, আজ না হয় কাল আপনার সব সন্দেহ অবশ্যই গিয়ে পড়বে এয়ারলাইন স্টুয়ার্ড, ছোট ছোট কেবিন সমেত উৎসাহী নৌ-বাইকের চালক, ফ্রান্সে যেসব মহিলারা নিয়মিত ভাবে ফ্রান্সে যাতায়াত করছে, যে সব আমদানীকারক আশাতিরিক্ত মুনাফা করে থাকে, যে সব লোক মূল আয়ের থেকে ব্যয় বেশি করে–এদের উপর। কিন্তু এই সব চোরাই জিনিস যদি একজন নিরীহ নির্দোষ লোককে দিয়ে আনানো হয়, সেক্ষেত্রে এদের চিহ্নিত করা খুবই কষ্টের ব্যাপার। ঝোলানো ব্যাগের দিকে উইন্ডিং হাত বাড়িয়ে বললেন, এটাই কি আপনার অভিমত?

হ্যাঁ। এখন আপনার শেষ সমস্যার প্রসঙ্গে আসা যাক। আজকের দিনে সেই সন্দেহজনক ব্যক্তিটি কে হতে পারে? ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কেউ একজন তো হতে পারে খুবই খাঁটি সত্য। বললেন উইন্ডিং। বেল ঝোলানো ব্যাগটা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নিরীক্ষণ করে তিনি আবার বললেন, এর মধ্যে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে অনায়াসে পাঁচহাজার পাউন্ড আনতে পারেন বলে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, বললো এরকুল পোয়ারো। এই ঝোলানো ব্যাগগুলো বাজারে বিক্রি হয় সম্ভবত একের অধিক দোকানে, দোকানের মালিক সম্ভবত এই র‍্যাকেটের সঙ্গে যুক্ত কিংবা নাও হতে পারে। হয়তো সস্তায় এইসব ব্যাগ বিক্রি করে শুধুই লাভ করে থাকে। অন্য বড় দোকানের থেকে এই দোকানের ব্যাগগুলো অনেক সস্তা আর মজবুতও বটে। এর পিছনে একটা বিরাট চক্র যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লন্ডন ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ছাত্রদের কিংবা ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে যারা তাদের একটা তালিকার উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। এই সব ছাত্র-ছাত্রীরা দেশের বাইরে যায়, ফিরে আসে আসল ঝোলানো ব্যাগের পরিবর্তে ডুপ্লিকেট ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে। ছাত্রছাত্রীরা ইংল্যান্ডে ফিরে এলে তাদের ঝোলানো ব্যাগ হয় কাপবোর্ডে কিংবা ঘরের এক কোণায় ফেলে রাখে। এখানেও আবার এই ব্যাগগুলো হাত বদল হয়ে যায়।

আর আপনি মনে করেন, হিকরি রোডে এইরকমই কিছু ঘটেছিল?

মাথা নাড়লো পোয়ারো। হ্যাঁ আমার সেই রকমই সন্দেহ।

কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো এরকম সন্দেহ আপনার কি করে হলো?

সেখানে এইরকম একটা ঝোলানো ব্যাগ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়, পোয়ারো বললো, তখনি আমার সন্দেহ হয়। কিছুদিন ধরে হিকরি রোডে পরপর কয়েকটা চুরির ঘটনা ঘটে যায়। সেই ঝোলানো ব্যাগটা অন্যতম। পরে সেটা টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া যায়। এইসব চুরির জন্য দায়ী মেয়েটি কয়েকটি জিনিস চুরির ব্যাপারে স্বীকার করলেও সে কিন্তু সেই ঝোলা ব্যাগ টুকরো টুকরো করার পিছনে নিশ্চয় অন্য কারণ আছে। আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, চুরির ঘটনা প্রথম শুরু হয় যেদিন প্রথম হিকরি রোডে স্মাগলিং-এর খোঁজে পুলিস তদন্ত করতে যায়। আর সেইদিনই হয়তো সেখানে হেরোইন কিংবা দামী পাথর চোরাই চালান হয়ে এসে থাকবে সেখানে। মনে হয় বাইরে পুলিসের কেউ হিকরি রোডের উপর নজর রেখে থাকবে। তাই সেই ঝোলা ব্যাগটা কোথাও লুকনো কিংবা বদলে ফেলার উপায় ছিলো না। এখন কেবল একটা জিনিসই আপনি চিন্তা করতে পারেন, ব্যাগটা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা, তারপর বয়লার হাউসের আবর্জনার মধ্যে লুকিয়ে রাখা। ওই বাড়িতেই সাদা দ্রব্য কিংবা দামী পাথর থাকলে সেগুলো সাময়িকভাবে বাথ সল্টের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু খালি ঝোলা ব্যাগের লাইনিং-এর নিচে যদি সাদাদ্রব্য কিংবা হীরে জহরত লুকনো থাকতো, আর সেটা যদি পুলিসের নজর কাড়ত কঠোর পরীক্ষা কিংবা বিশ্লেষণ করা হলে অবশ্যই ধরা পড়ার আশা থাকতো, সুতরাং ঝোলা ব্যাগটা নষ্ট করার একান্ত দরকার ছিলো। সেটা যে সম্ভব আপনি একমত তো।

হা আগে যেমন বলেছিলাম, এ একটা পরিকল্পনা বটে, বললেন সুপারিনটেন্ডেন্ট উইন্ডিং।

এদিক ওদিক ছোটখাটো আরো কয়েকটা ঘটনা পর্যালোচনা করলে আরো সম্ভব হবে বলে মনে হবে। যেমন ধরুন হিকরি রোডের ইতালীয় চাকর গেরোনিমোর কথা অনুযায়ী পুলিস প্রথম যেদিন সেখানে যায়, সেখানকার হলঘরের বাল্বগুলো এমনকি বাড়তি বাল্বগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়। এর থেকে মনে করা যেতে পারে যে সেখানে এমন কোনো অপরাধী ছিলো যার ভয় হয়েছিল, উজ্জ্বল আলোয় পুলিস তার মুখ দেখলে তাকে চিনে ফেলতে পারে, তাই সে আগেভাগে বাল্বগুলো সরিয়ে রেখেছিল। তবে এসবই আমার অনুমান মাত্র।

এ এক চতুর পরিকল্পনা, বললেন উইন্ডিং, আর তাই যদি হয়, তাহলে মনে হয় হিকরি রোডে আরো অনেক চমক অপেক্ষা করছে।

পোয়ারো মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করলো।

ও হ্যাঁ, ঐ সংস্থা বহু স্টুডেন্টস ক্লাব চালায়, পোয়ারো বলে, আর ঐ হোস্টেলের মালকিন মিসেস নিকোলেটিস সেই সব ক্লাবগুলো পরিচালনা করতেন।

চকিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন উইন্ডিং।

হ্যাঁ, বললো পোয়ারো, মিসেস নিকোলেটিসের অর্থের প্রতি খুব লোভ ছিলো, তবে তিনি নিজে স্বনামে সেই ক্লাবগুলো পরিচালনা করতেন না।

হুম! বললেন উইন্ডিং। আমার ধারণা মিসেস নিকোলেটিসের সম্পর্কে আরো বিশদ ভাবে জানতে হবে।

মাথা নাড়লো ইনসপেক্টর শার্প। আমরা তাঁর সম্পর্কে আরো খোঁজখবর নিচ্ছি স্যার। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমরা সেদিন সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গেলে দারুণ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি তার ঘরের কাপবোর্ডের চাবি কিছুতেই দিলেন না, তাই বাধ্য হয়েই তালা ভাঙতে হলো। শেষ পর্যন্ত তার সেই কাপবোর্ডের ভেতর থেকে গাদা গাদা খালি ব্র্যান্ডির বোতল বেরিয়ে আসে।

ব্র্যান্ডির বোতল? বললেন উইন্ডিং। তার মানে তিনি মদ্যপ ছিলেন? তাহলে ব্যাপারটা এখন বেশ সহজেই হয়ে গেলো। এখন তার খবর কি? তা তিনি কি এখন ফাঁদে পড়েছেন?

না স্যার, তিনি মৃত।

মৃত? উইন্ডিং-এর স্র উঁচু হলো। বুঝলে এ হলো বাঁদরের কারবার।

হ্যাঁ আমাদেরও তাই মনে হয়। বায়োপসি রিপোর্টের পর সব জানা যাবে। আমার মনে হয় তিনি বোধহয় মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, হয়তো তিনি খুন নিয়ে দরদস্তুর করতে চাননি। তাই

আপনারা সিলিয়া অস্টিনের কেসের কথা বলছিলেন। এই মেয়েটি কি কিছু জানতো?

কিছু জানতো বৈকি সে, বললো পোয়ারো, কিন্তু সেভাবে দেখলে আমার মনে হয় না। তার সব জানার দরকার ছিলো, জানেন তো মেয়েটি সরল ও বোকা প্রকৃতির মেয়ে ছিল। সে যা দেখেছিলো কিংবা শুনেছিল সে কথা অন্য কাউকে বোকার মতো হয়তো বলে থাকবে।

তা সে কি দেখেছিল কিংবা শুনেছিল, এ ব্যাপারে আপনার কি ধারণা মঁসিয়ে পোয়ারো?

আমি আন্দাজ করতে পারি, বলল, তবে এর বেশি কিছু নয়, মনে হয় পাসপোর্টের ব্যাপারে। সে হয়ত শুনে থাকবে হিকরি রোডের কারোর নকল পাসপোর্ট ছিলো, অন্য নামে কন্টিনেন্টে যাতায়াত করবার জন্য। তাছাড়া সে হয়তো কাউকে সেই ঝোলা ব্যাগ নষ্ট কতে দেখে থাকবে কিংবা কাউকে সেটার নকল বোতাম অপসারণ করতে দেখে থাকবে, কিংবা কাউকে বাল্বগুলো সরাতে দেখে থাকবে। আর এসব ঘটনার গুরুত্ব তেমন উপলব্ধি না করে কোনো ছেলে কিংবা মেয়েকে বলে থাকবে।

ভালো কথা, শার্প বলে, এখন মিসেস নিকোলেটিসের অতীত জীবন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। মনে হয় তাহলেই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে, তবে আমার মনে হয় না সত্যিই তিনি র‍্যাকেট চালাতেন।

মাথা নাড়ল পোয়ারো, না, আমিও তা মনে করি না, অবশ্য তিনি এই র‍্যাকেটের খবর জানতেন, কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, এর পিছনে ব্রেন ছিলো। না একেবারেই নয়।

কার ব্রেন থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

আমি আন্দাজ করতে পারি–হয়তো আমি ভুলও করতে পারি। হ্যাঁ আমার ভুলও হতে পারে।

.

হিকরি ডিকরি ডক, বললো নিজেল, ঘড়ির উপর ছুটে যায় নেংটি ইঁদুর, পুলিস বলেছে, ছিঃ ছিঃ। আমার আশঙ্কা, প্রসঙ্গক্রমে কে ডকে গিয়ে দাঁড়াবে? সে আরো বলে, বলা কিংবা না বলা সেটা একটা প্রশ্ন।

কি বলবে? জানতে চাইলো লেন বেটসন।

 মানে আমরা যা জানি, বললো নিজেল, আমাদের পরস্পরের সম্পর্কে হাজার হোক, আমরা পরস্পরের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। জানি না? একই বাড়িতে আমরা সবাই যখন বাস করি, জানতে বাধ্য।

কলিন ম্যাকনার গলা পরিষ্কার করে বললো, আমার মতে, বর্তমান অবস্থা আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত, নিক এর মৃত্যুর আসল কারণ কি হতে পারে?

আমার মনে হয় ভ্যালেরি বলে, পুলিসী তদন্তের পর সব কিছু জানা যেতে পারে।

তাতে আমার সন্দেহ আছে, কলিন বলে, আমার মতে তারা পুলিসী তদন্ত মুলতুবি রাখবে।

আমার মনে হয় মিঃ অ্যাকিমবো বলে হয়তো কেউ তাকে খুন করে থাকবে, তাই নয় কি? প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকালো সে সপ্রশ্ন চোখে।

কিন্তু কেই বা তাকে খুন করতে যাবে? জানতে চাইলো জেনেভিভ, তিনি কি প্রচুর অর্থসম্পত্তি রেখে গেছেন? তিনি যদি বিত্তবান হতেন, আমার ধারণা সেটা সম্ভব।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত বদমেজাজী মহিলা, বললো নিজেল, আমি নিশ্চিত প্রত্যেকেই তাকে খুন করতে চাইবে। আমাদের প্রায়ই তাই মনে হতো। রিজেন্ট পার্কের মুক্তাঙ্গনে সেলী এবং অ্যাকিমবো মধ্যাহ্নভোজ করতে গিয়ে চন্দ্রলালের বোরিক পাউডার উধাও হওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিল।

বোরিক? আরে এতো মোটেই ক্ষতিকারক নয়। বলে উঠলো সেলী। এমনকি বোরিক তুমি চোখেও দিতে পার, চন্দ্রলাল বোরিক দিয়ে তার চোখ পরিষ্কার করতো। বোরিকের বোতল সে বাথরুমে রাখত। সেখান থেকেই সেটা উধাও হয়ে যায়। তাতে খুব রেগে যায় সে। তার এ বোরিকের ব্যাপারে তোমার কি মন্তব্য শুনি?

এক এক করে আমি তোমাকে বলব, কিন্তু দয়া করে এখনি জানতে চেও না। আমাকে আরো চিন্তা করতে দাও।

ভালো কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে তুমি নাক গলাতে যেও না।

বলল সেলী, অ্যাকিমবো, আমি চাই না তুমি পরবর্তী সন্দেহে পরিণত হও।

ভ্যালেরি তোমার কি মনে হয় একটা ব্যাপারে তুমি আমাকে উপদেশ দিতে পারো? এ আমার বিবেকের প্রশ্ন, আর আজ ব্রেকফাস্টের টেবিলে নিজেল বলছিল, আমরা সবাই যখন কারোর ব্যাপারে কিছু জানি, আশা করি, তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে, মানে আমি পাসপোর্টে কথা বলছি, বললো জিন।

পাসপোর্ট? বিস্মিত হয়ে ভ্যালেরি জিজ্ঞেস করলো, কার পাসপোর্ট?

 নিজেলের, ওর একটা নকল পাসপোর্ট আছে।

আমি বিশ্বাস করি না, ভ্যালেরি বলে, দুর্ভাগ্য জিন, আসলে আমার বিশ্বাস এর একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে, প্যাট আমাকে বলেছিল, নিজেল এখানে এসেছিল টাকা রোজগারের জন্য, একটা শর্তে তার নাম বদল করতে হবে, তবে আইনসম্মত ভাবেই সে তার নাম বদল করেছিল। আমার বিশ্বাস তার আসল নাম ছিলো স্ট্যানফিল্ড কিংবা স্ট্যানলি, এ ধরনের কিছু হবে।

উত্তেজিত অবস্থায় কমনরুমে ঢুকলো জেনেভিভ, সমবেত ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তেমনি উত্তেজিত অবস্থায় বললো সে, আমি এখন নিশ্চিত, সম্পূর্ণ নিশ্চিত আমাদের প্রিয় বন্ধু সিলিয়াকে কে খুন করেছে আমি জানি।

কে সে জেনেভিভ? জিজ্ঞেস করলো জিন, তোমার এতো নিশ্চিত হওয়ার কারণ?

কমনরুমের দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখে নিলো জেনেভিভ, তারপর গলার স্বর নিচে নামিয়ে এনে বললো সে, খুনী, খুনী হলো নিজেল চ্যাপম্যান।

নিজেল চ্যাপম্যান, কিন্তু কেন, কেন সে তাকে খুন করতে গেলো?

শোনো করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম, প্যাট্রিসিয়ার ঘর থেকে নিজেলকে বলতে শুনলাম, তার বাবা নাকি তার মাকে খুন করেছিল। ওর বাবা স্যার আর্থার স্ট্যানলি, বিখ্যাত রিসার্চ কেমিস্ট এখন মৃত্যুশয্যায়। এই কারণেই সে তার নাম বদল করেছিল, ওর বাবা একজন অভিযুক্ত খুনী, আর বংশপরম্পরায় ওর বাবার চরিত্রের গুণই বলো বা দোষই বলো, সবই পেয়েছে নিজেল–

হ্যাঁ এটা সম্ভব, মিঃ চন্দ্রলাল তাকে সমর্থন করে বললো, অবশ্যই সম্ভব। নিজেল যেরকম ভয়ঙ্কর ছেলে, যেমন অসংযমী, সব পারে ও। নিজের উপর ওর যে আস্থা নেই, স্বীকার করো তো? তারপর অ্যাকিমবোর দিকে ফিরে তাকালো সে। উৎসাহ সহকারে মাথা নাড়ল সে, ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বার করে খুশির হাসি হাসলো সে।

আমি সবসময়েই ভেবে এসেছি, বললো জিন, নৈতিকবোধ ছিলো না নিজেদের। একেবারে অধঃপতিত চরিত্র যাকে বলে।

হ্যাঁ এটা সেক্স মার্ডার। বললো মিঃ আহমেদ আলি। এই মেয়েটির সাথে শুতো সে। তারপর একদিন সে তাকে খুন করে, কারণ চমৎকার মেয়ে ছিলো সে, সম্মানিতা, বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল মেয়েটি

বাজে কথা, চিৎকার করে বলে উঠলো লিওনার্ড বেটসন।

.

১৩.

 পুলিস স্টেশনে ইনসপেক্টর শার্পের কঠোর দৃষ্টির সামনে নিজেলকে ভীষণ নার্ভাস দেখাচ্ছিল।

আপনি বলছেন, বাইকারবোনেট বোতল যার মধ্যে মরফিন ছিলো, সেটা শেষ কখন মিস লেন দেখেছিল, ঠিক মনে নেই তার? ইনসপেক্টর শার্প দৃঢ়স্বরে বললো, মিঃ চ্যাপম্যান, আপনি যা বললেন, জানেন সেটা কি সাংঘাতিক হতে পারে?

অবশ্যই আমি বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা জরুরী মনে না করলে আমি কখনোই এখানে আসতাম না।

তাহলে এখুনি একবার হিকরি রোডে যাওয়া উচিত। কথাটা ইনসপেক্টর শার্প শেষ করা মাত্র টেলিফোন বেজে উঠলো। রিসিভারটা তুলে নিলো শার্প।

মিস লেন কথা বলছি, দূরভাষে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। মিঃ চ্যাপম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

শার্প ইশারা করতেই এগিয়ে এসে রিসিভারটা তার হাত থেকে তুলে নিলো নিজেল। প্যাট? আমি নিজেল কথা বলছি।

শোনো নিজেল, আমার মনে হয়, আমি সেটা পেয়ে গেছি। মানে, আমি জানি আমার রুমালের ড্রয়ার থেকে কে সেটা নিয়েছিল। দেখো, এখানে মাত্র একজনাই–সেই মুহূর্তে মেয়েটির কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে আর কথা শেষ করতে পারে না তার।

হ্যালো, হ্যালো প্যাট? কে, কে সে?

এখুনি তার নাম আমি বলতে পারবো না। পরে বলবো, তুমি এখানে ফিরে এলে বলবখন। আমি আমার ঘরে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো নিজেল। শার্প তার সব কথাই শুনেছিল কাছ থেকে, চলুন এখুনি ২৬নং হিকরি রোডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া যাক। বললো শার্প।

হিকরি রোডের বাড়িতে পৌঁছেই নিজেল তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো প্যাটের ঘরে। তাকে অনুসরণ করলো ইনসপেক্টর শার্প।

হ্যালো প্যাট, আমরা এসে গেছি–নিজেলের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেলো ঘরে ঢোকা মাত্র।

মেঝের উপর প্যাট্রিসিয়া লেনের রক্তাক্ত দেহটা পড়েছিল, তার মাথা থেকে রক্ত তখনো ঝরে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা

না? আঁতকে উঠলো নিজেল, না, না, না, এ হতে পারে না।

হ্যাঁ, মিঃ চ্যাপম্যান, মিস লেন মৃত।

না, না, প্যাট মরতে পারে না, বোকা মেয়ে প্যাট, কিন্তু কেমন করে খুন হলো

এটা দিয়ে।

সহজ, অতি সহজ, আধুনিক প্রথায় খুন, উন্নত ধরনের অস্ত্র, উলের মোজায় জড়ানো পেপারওয়েটের আঘাতে-মাথার পিছনে ওই অস্ত্রটা দিয়ে আঘাত করে ওকে হত্যা করা হয়েছে, অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র, মেয়েটি জানতেও পারেনি, তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে।

নিজেল তার বিছানায় বসে পড়ে বলে উঠলো, ঐ উলের মোজাটা আমার জন্য বুনেছিল প্যাট-হঠাৎ শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।

শার্প তখন ঘটনাটা এইভাবে সাজাচ্ছিল : কেউ হয়তো ব্যাপারটা ভালো ভাবেই জানতো, তার নামটা প্যাট্রিসিয়া নিজেলের কাছে প্রচার করে দেওয়ার আগেই সে তাকে সরিয়ে দিয়ে থাকবে। যেই এমন নিষ্ঠুর কাজ করে থাকুক না কেন, আমি তার সন্ধান পেলে খুন করে ফেলবো তাকে। শুয়োরের বাচ্চা, খুনী।

শান্ত হোন মিঃ চ্যাপম্যান। শার্প তাকে বোঝায়, হা হা আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝি, এ এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। তাকে শান্ত করে শার্প এবার নিচু হয়ে মৃত প্যাট্রিসিয়ার হাতের দু আঙুলের ফাঁক থেকে কি যেন সংগ্রহ করে রাখলো।

.

ভয়ার্ত চোখে একের পর একটা মুখের দিকে তাকালো গেরোনিমো। আমি কিছুই দেখিনি। আমি কিছুই শুনিনি। আমি আপনাদের বলছি, আমি এসবের কিছুই জানি না। রান্নাঘরে মারিয়ার সঙ্গে ছিলাম

কেউ তোমাকে দোষী করছে না, বললো শার্প, আমরা শুধু জানতে চাই এক ঘণ্টার মধ্যে কে কে এ বাড়িতে এসেছিল, আর কারা কারা বাড়ির বাইরে গিয়েছিল? মানে সকাল ছটা থেকে ছটা পঁয়তিরিশ পর্যন্ত।

সবাই বাড়িতেই ছিলো, কেবল মিঃ নিজেল, মিসেস হার্বার্ড আর মিস জনহাউস ছাড়া, এঁরা সবাই ছটার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

এদের মধ্যে কে কখন ফিরে আসে? জিজ্ঞেস করলো শার্প।

মিসেস হার্বার্ড এখনো ফেরেননি, মিঃ চ্যাপম্যান তো আপনার সঙ্গেই ফিরে এলেন, আর মিস সেলী ফিরে আসেন ছটার একটু পরে। তখন খবর হচ্ছিল। খবরের কোনো অংশ হচ্ছিল তখন?

ঠিক মনে নেই। তবে খেলার খবরের ঠিক আগে কারণ খেলার খবর হতেই আমি টিভির সুইচ অফ করে দিই।

হাসলো শার্প, তার মানে, কেবল নিজেল চ্যাপম্যান, ভ্যালেরি জনহাউস এবং মিসেস হার্বার্ডকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। এর অর্থ হলো দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ। কে কে তখন কমনরুমে ছিলো? কে কে সেখান থেকে চলে যায়। আর কখন? কে কার হয়েই বা সাক্ষ্য দেবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। বিশেষ করে এখানে যখন নানান দেশের ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে, তার মধ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকার ছাত্র-ছাত্রীরা অন্যতম।

মিসেস হার্বার্ডের ফেরার অপেক্ষা করছিল ইনসপেক্টর শার্প, একমাত্র সে-ই এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত গতিবিধির একটা নিখুঁত চিত্র তুলে ধরতে পারে। একটু পরেই হিকরি রোডের হোস্টেলে ফিরে এসে সেই বেদনাদায়ক ঘটনার কথা জেনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়লো সে। শার্প তাকে শান্ত হতে বলে বললো, মিসেস হার্বার্ড, এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না, মনটা শক্ত করে আমার কয়েকটা প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিন।

বেশ বলুন, কি জানতে চান?

মৃত মিস প্যাট্রিসিয়ার ঘরের দুপাশের ঘর দুটোর বাসিন্দা কারা কারা?

একপাশে থাকে জেনেভিভ–কিন্তু তার আর প্যাটের ঘরের মাঝে পাকা দেওয়াল তোলা আছে। অপরদিকের ঘরটা এলিজাবেথ জনস্টনের মাঝখানে শুধুই একটা পার্টিশান ওয়াল।

তাহলে এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ওদের দুজনের মধ্যে একমাত্র এলিজাবেথই পার্টিশন ওয়ালের এপার থেকে ফোনে মিঃ চ্যাপম্যানের সঙ্গে প্যাট্রিসিয়ার আলোচনার কথা শোনার সম্ভাবনা রয়ে গেছে, অবশ্য সে যদি তার শয়নকক্ষে তখন থেকে থাকে। কিন্তু সেলী ফিঞ্চ তার চিঠি পোস্ট করতে যাবার সময় তাকে কমনরুমে দেখে গিয়েছিল বলে বলেছে সে, সবসময়েই যে কমনরুমে ছিলো সে, তা নাও হতে পারে।

হা একসময় সে তার বই আনতে উপরে উঠে গিয়েছিল, তবে ঠিক কোনো সময়ে কেউ খেয়াল করতে পারে না।

সে যাই হোক, মিসেস হার্বার্ড বলে, ওদের দুজনের মধ্যে কেউ একজনই সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে মনে হয়।

ওদের জবানবন্দী মতো বলবো-হা, কিন্তু আমরা যে একটা বাড়তি প্রমাণ হাতে পেয়েছি-শার্প তার পকেট থেকে একটা খাম বার করলো।

ওটা কি?

হাসলো শার্প, কয়েকগাছা চুল, মৃত প্যাট্রিসিয়া লেনের আঙুলের ফাঁক থেকে এগুলো আমি সংগ্রহ করেছি।

তার মানে আপনি বলতে চান–

এই সময় দরজায় নক করার শব্দ হলো, ভেতরে আসুন, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো ইনসপেক্টর।

দরজা ঠেলে হাস্যরত অবস্থায় মিঃ অ্যাকিমবোকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেলো, কি ব্যাপার কিমিস্টার?

আমার মনে হলো আপনাকে কিছু বলা দরকার। এই বেদনাদায়ক নিষ্ঠুর রহস্যজনক ঘটনার ব্যাপারে হয়তো আমি কিছু আলোকপাত করতে পারি।

.

১৪.

 হ্যাঁ, বলুন মিঃ অ্যাকিমবো, আপনি কি বলতে চান?

দেখুন মিঃ শার্প আমি প্রায়ই পেটের অসুখে ভুগে থাকি, হঠাৎ একদিন রাতে পেটের যন্ত্রণায় কমনরুমে ছুটে যাই, কেবল এলিজাবেথই সেখানে ছিলো, আমি ওকে বলি তোমার কাছে বাইকারবোনেট কিংবা স্টমাক পাউডার আছে? আমারটা ফুরিয়ে গেছে, উত্তরে সে বলে, আমার কাছে তো নেই, তবে রুমাল ফেরত দিতে গিয়ে সেই ওষুধ প্যাটের ড্রয়ারে দেখেছিলাম। ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য একটু বাইকারবোনেট এনে দিচ্ছি। ও তখন উপরতলায় গিয়ে বাইকারবোনেটের বোতল এনে আমার হাতে তুলে দিল। আমি তখন পুরো এক চামচ বাইকারবোনেট পাউডার খেয়ে নিই, কিন্তু তারপর থেকে পেটের যন্ত্রণার উপশম হওয়া দূরে থাক, আমার তখন নতুন এক শারীরিক যন্ত্রণা দেখা দিলো। তখন আমি সেই বাইকারবোনেটের বোতলটা একজন কেমিস্টকে পরীক্ষা করতে বলি। সেটা পরীক্ষা করে সে আমাকে জানিয়ে দেয়, বোতলের পাউডার বাইকারবোনেট ছিলো না, তার বদলে সেটার মধ্যে বোরিক পাউডার রাখা হয়েছিল।

বোরিক? হতভম্বের মতো স্থির চোখে তাকালো ইনসপেক্টর শার্প। কিন্তু সেই বোতলে বোরিক পাউডার স্থান পেলো কি করে? আর মরফিয়া পাউডারই বা গেলো কোথায়? চিৎকার করে উঠলো সে। এ সবই বিক্ষিপ্ত ঘটনা। আমি তাই মিস সিলিয়ার কথা ভাবছি, কি করে তার জবানীতে লেখা সেই চিরকুটটা রেখে গিয়ে থাকবে–যাতে করে মনে হতে পারে আত্মহত্যা করেছে সে।

তার কথায় সায় দিলো ইনসপেক্টর শার্প।

কিন্তু কে, কে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে? নিশ্চয়ই এ কাজ কোনো মেয়ের? কারণ মেয়েদের ব্লকে কোনো ছাত্র কিংবা পুরুষ তো ঢুকতে পারে না, অ্যাকিমবো বলে, তবে সিলিয়ার ঘরের পাশে একটা ভোলা ব্যালকনি আছে। সুতরাং কোনো পুরুষ আর সে যদি ভালো এ্যাথলিট হয়, অনায়াসে সেই ব্যালকনি টপকে সিলিয়ার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। সিলিয়ার ঘরের ঠিক সামনে অন্য কারুর ঘর, মিসেস হার্বার্ড একটু চিন্তা করে বললো, নিজেলের আর-আর

লেন বেটসনের, বললো ইনসপেক্টর। তার হাতের সেই খামের ভেতরে সযত্নে রাখা দুগাছা লাল চুলের কথা মনে পড়ে গেলো তার–লেন বেটসন তার মাথার চুলও লাল, কোঁকড়ানো।

না, না, লেন বেটসন খুব ভালো ছেলে আমার খুব প্রিয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো মিসেস হার্বার্ড। হয়তো ও একটু বদমেজাজী ছেলে, কিন্তু এ কাজ ও কিছুতেই করতে পারে না, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

হ্যাঁ তা ঠিক, শার্পের চোখ দুটো ঝলসে উঠলো, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাধারণত সব খুনীই একটা না একটা ঠিক ভুল করবেই।

ম্যাকরিনা ফেয়ার সাইনবোর্ড টাঙ্গানো দোকানের সামনে এসে থামলো ডিটেকটিভ কনস্টেবল ম্যাকরে এবং সার্জেন্ট কব। আমরা বোধহয় ঠিক জায়গাতেই এসেছি, বললো সার্জেন্ট কব। কাউন্টারে একজন মহিলাকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো সার্জেন্ট কব। সুপ্রভাত ম্যাডাম। সম্ভাষণ জানিয়ে সার্জেন্ট কব তার পরিচয় পত্রটা এগিয়ে দিলো মেয়েটির দিকে। সেই সঙ্গে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট।

আমি মিসেস লুকাস, এই দোকানের মালকিন। সে আরো বলে, আজ আমার পার্টনার মিস জনহাউস আসেনি।

না, ম্যাডাম, বললো সার্জেন্ট কব, তার কাছে এটা কোনো খবরই নয়।

আপনার এই সার্চ ওয়ারেন্ট মনে হচ্ছে একেবারে উঁচুতলার হুকুম, বললো মিসেস লুকাস। এটা মিস জনহাউসের প্রাইভেট অফিস। আমি আন্তরিক ভাবেই আশা করি, আমাদের খদ্দেরদের অযথা হয়রানি করবেন না।

আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, বললো কব, আমরা যেটা খুঁজছি সেটা পাবলিক রুমে থাকার কথা নয়।

মিনিট পনেরো মিস জনহাউসের অফিসের টেবিল ড্রয়ার ঘাঁটাঘাঁটির পর সার্জেন্ট কবের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ম্যাকরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো সে, পেয়েছি বস্।

একেবারে নিচের ড্রয়ার খুলতেই আধডজন গাঢ় নীল রং-এর বই বেরিয়ে এলো, বইগুলোর উপর সোনালী অক্ষরে লেখা।

পাসপোর্ট, বললো সার্জেন্ট কব। পাসপোর্টগুলো বার করে ফটোগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেললো সে, ম্যাকরে ঝুঁকে পড়লো তার কাঁধের উপর দিয়ে দৃষ্টি ফেলে।

একই মহিলা বলে চলে মুশকিল, পারবে তুমি চিনতে? বললো ম্যাকরে। সেই পাসপোর্টগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামের–মিসেস দ্য সিলভিয়া, মিস আইরিস ফ্রেঞ্চ, মিসেস ভলগা কোহন, মিয়লিনা লে মেজারিয়ার, মিসেস গ্লেডিস থমাস এবং মিস ময়রা ওনীল। তাদের বয়স পঁচিশ থেকে চল্লিশ। প্রত্যেকের হেয়ার স্টাইল আলাদা ধরনের বললো কব। এখানে আরো দুটো বিদেশী পাসপোর্ট রয়েছে–ম্যাডাম মাদমৌদি, আলজিরিয়; শীলা ডোনাভান, আইরিশ, আমি বলবো, এইসব বিভিন্ন নামের ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে তার।

বেশ জটিল ব্যাপার, তাই না?

জটিল হতে বাধ্য, চোরই চালান করে অর্থ উপার্জন তেমন কষ্টকর ব্যাপার নয়। কিন্তু সেইসব অবৈধ উপার্জনের টাকার হিসেব রাখাটাই ঝামেলার ব্যাপার। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই কারণেই ঐ মহিলা মেফেয়ারে এই গ্যাম্বলিং ক্লাব খুলে বসেছে। জুয়ায় উপার্জিত অর্থের উপর ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের কিছু করার নেই। আর আমার মনে হয় এ ধরনের একটা নকল পাসপোর্ট বেচারী সিলিয়া হয়তো হিকরি রোডে দেখে থাকবে। সেই কারণেই তাকে অসময়ে চলে যেতে হলো এই পৃথিবী থেকে।

মিস জনহাউসের এটা একটা চতুর পরিকল্পনা, বললো ইনসপেক্টর শার্প। তাস খেলার মতো পাসপোর্টগুলো সাফল করলো সে। হ্যাঁ অবশ্যই এটা তার চতুর পরিকল্পনা। এটা আবিষ্কারের মূলে মঁসিয়ে পোয়ারো। ধন্যবাদ তাকে। তিনি এখানে আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। এখন সেই মহিলার সম্বন্ধে তার অভিমত শোনা যাক।

.

হাসছিল পোয়ারো। প্রশংসার চোখে তার দিকে তাকালো মিসেস হার্বার্ড। আলোচনা হচ্ছিল তার বসবারঘরে।

মিস ভ্যালেরি জনহাউস দারুণ লোভাতুর হয়ে উঠেছিল প্যাট্রিসিয়ার সেই হীরের আংটিটা দেখে। লোভ সামলাতে পারেনি। তার সেই আংটি থেকে আসল হীরে সরিয়ে সাদা গোমেদ পাথর বসিয়ে দেয়। অথচ চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয় সিলিয়া। মিস জনহাউসের সেই কাজ দেখে তখনি আমার মনে হয়েছিল, কি সাংঘাতিক চতুর এই মহিলাটি।

কিন্তু খুন, বললো মিসেস হার্বার্ড।

ঠান্ডা মাথায় খুন, সত্যি আমি এখনই বিশ্বাসই করতে পারছি না।

বিমর্ষ দেখায় ইনসপেক্টর শার্পকে।

এখনো পর্যন্ত সিলিয়া অস্টিনকে খুন করার মতো নির্দিষ্ট প্রমাণ আমরা পাইনি তার বিরুদ্ধে, বললো শার্প। অবশ্য সে যে স্মাগলিং-এর কারবারে যুক্ত তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। হয়তো সে নিজেলের বাজিধরা আর তার কাছে মরফিয়া থাকার কথা সে জানতো। কিন্তু এ ব্যাপারে সত্যিকারের কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া আরো দুটি মৃত্যু ঘটে গেছে। এখানে, মিসেস নিকোলেটিকে সে বিষ খাইয়েছিল মেনে নিলাম–কিন্তু অপর পক্ষে প্যাট্রিসিয়া লেনকে সে নিশ্চয়ই খুন করেনি। আসলে একমাত্র সেই–এ সব ব্যাপারে একেবারে সন্দেহ মুক্ত, গেরোনিমো বলেছিল মিস জনহাউস ঠিক ছটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। জানি না ঐ মেয়েটি তাকে ঘুষ দিয়েছিল কিনা–

না, মাথা দুলিয়ে পোয়ারো বলে, সে তাকে ঘুষ দেয়নি।

হিকরি রোডের একেবারে শেষ প্রান্তের একটা কেমিস্টের দোকান থেকে মিস জনহাউস ফেস পাউডার আর এ্যাসপিরিন কিনে তাদের ফোন ব্যবহার করেছিল, এর প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। ছটা পনেরোয় কেমিস্টের দোকান ছেড়ে চলে আসে সে।

পোয়ারো আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হ্যাঁ এই খবরটাই তো চমৎকার। বলে সে, আমরা তো এই খবরটাই চাইছিলাম। মানে বাইরে কোথা থেকে ফোন সে করেছিল কিনা। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো ইনসপেক্টর শার্প।

মঁসিয়ে পোয়ারো, এখন আমাদের জ্ঞাত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। দেখা যাচ্ছে, ছটা আট মিনিটের সময় প্যাট্রিসিয়া লেন বেঁচে ছিলো, কারণ ঠিক ঐ সময় এই ঘর থেকে পুলিস স্টেশনে ফোন করেছিল সে।

এ ব্যাপারে আপনি একমত? আমার মনে হয় না, এই ঘর থেকে ফোন করেছিল সে। এমনকি হলঘর থেকে নয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইনসপেক্টর শার্প। আমার ধারণা ফোনটা এসেছিল পুলিস স্টেশন মারফৎ। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন না। আমি আমার সার্জেন্ট, পুলিস কনস্টেবল আর নিজেল চ্যাপম্যান সবাই অলীক অস্তিত্বের বিশ্বাসের শিকার হয়ে পড়েছিলাম?

অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলতে পারি না। ফোনটা এসেছিল কেমিস্টের দোকানের কলবক্স থেকে।

সঙ্গে সঙ্গে ইনসপেক্টর শপের চোয়াল ঝুলে পড়তে দেখা গেলো। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, ফোনটা করেছিল ভ্যালেরি জনহাউস? অর্থাৎ প্যাট্রিসিয়া লেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল সে, আর প্যাট্রিসিয়া লেন আগেই মারা গিয়েছিল?

হ্যাঁ আমি সেটাই বোঝাতে চেয়েছি?

এক মুহূর্ত নীরব থেকে টেবিল চাপড়ে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো ইনসপেক্টর, এ আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিজের কানে মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম।

হ্যাঁ আপনি একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, এক নিঃশ্বাসে বলা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। কিন্তু প্যাট্রিসিয়া লেনের কণ্ঠস্বর আপনার ভালো করে অবশ্যই জানা নেই।

সম্ভবত আমার জানা নেই। কিন্তু নিজেল চ্যাপম্যান? সেও তো ফোনটা ধরেছিল, নিজেলও যে প্রতারিত হয়েছিল একথা বলতে পারেন না। সেই কণ্ঠস্বর প্যাটের না হলে তিনি ঠিক ধরে ফেলতে পারেন।

হা, বললো পোয়ারে, নিজেল চ্যাপম্যান জেনে থাকতে পারেন। নিজেল বেশ ভালোভাবেই জানতেন যে সেই কণ্ঠস্বর প্যাট্রিসিয়ার ছিলো না। তার থেকে ভালো আর কেই বা জানতে পারে বলুন। কারণ নিজের হাতে পিছন থেকে পেপারওয়েটটা দিয়ে প্যাট্রিসিয়ার মাথায় আঘাত করে এসেছিল সে, পুলিস স্টেশনে যাওয়ার খানিক আগে।

চুপ হলেন শার্প। সম্বিৎ ফিরে পেতে তার বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো। নিজেল চ্যাপম্যান? প্যাট্রিসিয়া লেনের খুনী নিজেল চ্যাপম্যান? কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, কেন, কেনই বা সে তাকে হত্যা করতে গেলো? হয়তো সিলিয়া অস্টিন খুন করতে পারে প্যাট্রিসিয়া লেনকে, কিন্তু কেন?

.

সেটা, বললো পোয়ারো, কারণটা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।

আপনাকে অনেকদিন দেখিনি, বৃদ্ধ উকিল মিঃ এন্ডিকট বললো এরকুল পোয়ারোকে। তা এসেছেন ভালোই করেছেন। সেঁতো হাসি হাসল সে। আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি বুঝি অবসর নিয়েছেন।

আজ আমি এখানে এসেছিলাম একজন অত্যন্ত পুরানো মক্কেলের সাথে দেখা করার জন্য, এখনো আমি দু-একজন পুরানো বন্ধুর কেস নিয়ে থাকি। স্যার আর্থার স্ট্যানলি আমাদের একজন পুরানো বন্ধু এবং মক্কেল, তাই না?

হ্যাঁ, আমার পর আইন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ শেষ করেছিলাম, সে ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান তার স্নায়ুকোষগুলো সবার থেকে আলাদা ছিলো। আমার বিশ্বাস, তার মৃত্যুর খবরটা গতকাল ছটার সময় ঘোষিত হয়েছিল।

হ্যাঁ, শুক্রবার তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবে। কিছুদিন ধরে কঠিন অসুখে ভুগছিল সে। লেডী স্ট্যানলি তো বছর আড়াই আগে মারা যায়। তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল বলতে পারেন?

সঙ্গে সঙ্গে উকিল ভদ্রলোক উত্তর দেয়, অতিরিক্ত ঘুমের পিল খেয়ে। পুলিসী তদন্ত হয়েছিল। তাদের রিপোর্টেও সেই একই কথা লেখা হয়েছিল দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু।

তার মৃত্যু সত্যি সত্যি কি সেইভাবে হয়েছিল?

এক মিনিট নীরব থেকে বললো মিঃ এন্ডিকট, আমি আপনাকে অপমান করব না। আপনার এরকম প্রশ্ন করার ভালোরকম যুক্তিই যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এন্ডিকট বলে চলে কিন্তু তার স্বামী তার সাক্ষ্যে বলে। তার স্ত্রী অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়তো। এমনিতে অতিমাত্রায় ঘুমের পিল খেতো, সে বিনিদ্র রজনীর অবসান করার জন্য। তার উপর খেয়েছে কিনা বুঝতে না পেরে দ্বিতীয় দফায় ঘুমের পিল খেয়ে নিতো। মনে হয় ঘটনার দিন সে এই ভাবে দু-তিনবার ঘুমের পিল খেয়ে থাকবে। আর তাতেই তার মৃত্যু ঘটে থাকবে। পুলিসের কাছে এইরকম একটা জবানবন্দী গিয়েছিল স্যার আর্থার স্ট্যানলি।

মিথ্যে বলেনি তো সে?

সত্যি পোয়ারো। অবান্তর প্রশ্ন। আপনি একথা ভাবতে পারলেন কি করে?

 হাসলো পোয়ারো। ভাববার কারণ আছে বলেই তো বলছি, পোয়ারো বলে, এমনো তো হতে পারে, অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করার জন্য সে তার স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছিল?

না, তার জীবনে অন্য আর কোনো নারী ছিল না। সে তার স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত ছিলো।

হ্যাঁ তা বটে আমিও তাই মনে করি, বললো পোয়ারো, এখন যে কারণে আসা সেটা বলি–আপনি একজন সলিসিটর, আর্থার স্ট্যানলির উইল তো আপনি তৈরি করেছিলেন? আর সম্ভবত আপনিই তার একজিকিউটর?

হ্যাঁ ঠিক তাই।

আর্থার স্ট্যানলির একটি ছেলে ছিলো, শুনেছি সেই ছেলেটি তার মার মৃত্যুর পর বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। এতোই সে তার বাবার উপর রেগে যায় যে, সে তার নাম অব্দি বদলে ফেলে!

তা আমার অজানা, অন্য কি নামে সে তার পরিচয় দিয়েছিল?

সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আমার মনে হয় আর্থার স্ট্যানলি আপনার কাছে সীলমোহর করা চিঠি রেখে গেছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কিংবা তার মৃত্যুর পর সেটা ভোলা যেতে পারে।

সত্যি পোয়ারো, বয়সের এই মধ্যগগনে আজও আপনি জ্বলজ্বল করছেন। চিঠির ব্যাপারটা আপনি জানলেন কি করে?

তাহলে আমার অনুমান ঠিক? আমার আরো মনে হয়, সেই চিঠিতে একটা বিকল্প ব্যবস্থাও ছিলো। হয় সেই চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে হবে কিংবা প্রয়োজনে আপনাকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

আপনি যখন সবই জানেন, বললো এন্ডিকট, আপনি যা যা জানতে চাইবেন সবই বলবো আপনাকে। আমি জানতাম যে আপনার পেশাগতভাবে তরুণ নিজেল সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জেনে ফেলেছেন। তা এই শয়তানটা এখন কি করছে জানতে পারি?

আমার মনে হয় তার কাহিনি এই রকম : বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর সে তার নাম বদলে পরিচয় দেয় নিজেল চ্যাপম্যান হিসাবে তারপর সে এক স্মাগলিং র‍্যাকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ড্রাগ আর জুয়েলারীর চোরাচালান। অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের স্মাগলিং-এর কাজে লাগায় সে। নিজেল চ্যাপম্যান আর এক তরুণী মিস ভ্যালেরি জনহাউস এই র‍্যাকেটের অংশীদার। চোরাচালানের ব্যবসা তাদের বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু মাঝপথে যে হোস্টেলে তারা এই পাপব্যবসা চালাতে সেখানকার দুজন ছাত্রী আর হোস্টেলের একজন পার্টনার মিসেস নিকোলেটিসের কাছে কোনো ব্যাপারে ধরা পড়ে যায়। তখন সে পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের তিনজনকে হত্যা করে। তার খুনের মোটিভও আমাদের কাছে এখন আর অজানা নয়। তবে তার বিরুদ্ধে খুনের নির্দিষ্ট চার্জ আনার জন্য তার অতীত ইতিহাস আমাদের জানা দরকার। আমার ধারণা তার বাবা আর্থার স্ট্যানলি তার সেই চিঠিতে নিশ্চয়ই নিজেল সম্পর্কে কটাক্ষ করে গেছেন। তাই আপনাকে আমার একান্ত অনুরোধ আপনি যদি সেই চিঠিটা আমাকে একবার দেখান

বেশ তো, এখনি দেখাচ্ছি। মিঃ এন্ডিকট উঠে দাঁড়ালো। ঘরের শেষ প্রান্তে একটা আলমারি থেকে একটা লম্বা খাম বার করে এনে পোয়ারোর হাতে তুলে দিলো। আর্থার স্ট্যানলি মৃত। তার আগেই সেই খামের সীলমোহর ভেঙ্গে রেখেছিল সে। খামের ভেতর থেকে দুটি চিঠি বেরিয়ে এলো। প্রথম চিঠিটার ভাষা এইরকম : প্রিয় এন্ডিকট,

আমার মৃত্যুর পর তুমি চিঠিটা খুলবে, আমার ইচ্ছে আমার পুত্র নিজেলের খোঁজ করবে তুমি। খবর নিও, সে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে কিনা, এখানে যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি সেটা কেবল আমি একাই জানি। নিজেলের চরিত্র কোনো সময়েই সন্তোষজনক ছিলো না। দু-দুবার সে আমার সই জাল করে আমার ব্যাঙ্ক থেকে চেক ভাঙ্গায়। কিন্তু আমি তাকে সাবধান করে দিই, তৃতীয়বার এরকম অপরাধ সে যেন আর না করে।

তৃতীয়বার সে তার মায়ের সই জাল করে আমার ব্যাঙ্ক থেকে চেক ভাঙ্গায়। নিজেকে এর জন্য চার্জ করে। আমি তাকে নীরব থাকার জন্য অনুরোধ করি। সে আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে নিজেলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে যায়। প্রতি সন্ধ্যায় আমার স্ত্রীকে ঘুমের পিল খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিলো নিজেলের। ঘুমের পিলের প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে আমার স্ত্রী আমার কাছে এসে সব খুলে বলে পরদিন সে নিজেলের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। কিন্তু পরদিন সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, আমি বেশ ভালো করেই জানি, তার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী।

নিজেলকে তার মায়ের হঠাৎ মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত করে আমি বলি, পুলিসের কাছে তার নামে আমি অভিযোগ করবো। সে তখন বেপরোয়া ভাবে আমাকে অনুরোধ করে পুলিসকে না জানানোর জন্য। এন্ডিকট, আমার মতো অবস্থায় পড়লে তুমি কি করতে? আমার অপরাধী ছেলের জন্য আমার কোনো মোহ নেই। তাকে বাঁচানোর কোনো কারণও দেখতে পাচ্ছি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কেউ একবার খুন হলে বার বার খুনী হতে বাধ্য সে। ভবিষ্যতে আরো অনেকে তার শিকার হতে পারে। আমি আমার ছেলের সঙ্গে দরদস্তুর করলাম, জানি না ঠিক করলাম, নাকি ভুল করলাম। তাকে তার দোষ স্বীকার করতেই হবে। আর তার সেই স্বীকারোক্তি আমি রেখে যাবো। তখনকার মতো তাকে ক্ষমা করার শর্ত ছিলো, তাকে আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে, আর কোনোদিনও সে ফিরে আসতে পারবে না। তবে যেখানেই সে থাক না কেন, নতুন করে জীবন শুরু যেন সে করে। আমি তাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেবো। স্বাভাবিকভাবেই সে তার মার টাকা পাবে, তার ভালো শিক্ষাদীক্ষা আছে, ভালো হওয়ার সবরকম সুযোগ তার আছে। কিন্তু সে যদি কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়। যে স্বীকারোক্তি সে আমাকে দিয়ে গেছে, সেটা পুলিসের কাছে যাওয়া উচিত। আমি মনে করি, আমার মৃত্যু দিয়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তুমি আমার সব থেকে পুরানো বন্ধু। আমি তোমার কাঁধে একটা বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছি। তবে আমার স্ত্রীর নাম নিয়ে তোমাকে এই অনুরোধ করছি আর সেও তো তোমার বন্ধু ছিলো। নিজেলের খোঁজ কোরো। তার রেকর্ড যদি পরিষ্কার হয়, এই চিঠিটা আর নিজেলের স্বীকারোক্তি নষ্ট করে ফেলো। আর যদি না হয় তাহলে তার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত।

তোমার স্নেহের বন্ধু
আর্থার স্ট্যানলি

 আহ! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো পোয়ারো, তারপর নিজেলের স্বীকারোক্তির উপর চোখ রাখলো সে।

আমি এখানে স্বীকার করছি ১৫ই-১৮ই নভেম্বর অতিরিক্ত ঘুমের পিল খাইয়ে আমি আমার মাকে হত্যা করেছি–

নিজেল স্ট্যানলি।

মিস লেমনের রেখে যাওয়া চিঠিটা সই করলো এরকুল পোয়ারো, একটাও ভুল হয়নি, গম্ভীর ভাবে বলল সে।

আশা করি আমি প্রায়ই ভুল করি না। বললো মিস লেমন। প্রায়শই নয় তবে এটা ঘটেছিল। ভালো কথা তোমার বোন কেমন আছে?

জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো জাহাজে চড়ে এখন ঘোরবার কথা ভাবছে। দক্ষিণের রাজধানীগুলোতে।

আহ অস্ফুটে বললো পোয়ারো, তার বিস্ময় জাগে যদি–সম্ভবত–জাহাজে চড়ে ঘুরতে? তাই বলে এই নয় যে, সে নিজে সমুদ্রযাত্রার ব্যবস্থা করবে–এমনকি কাউকে কোনো পরামর্শ দিতে যাওয়ার জন্যও নয়।

তার পিছনের ঘড়িতে একবার শব্দ হলো।

ঘড়িটা একটা বাজার সময় ঘোষণা করলো।

নেংটি ইঁদুরটা নিচে নেমে এলো।

হিকরি ডিকরি ডক্‌।

ঘোষণা করলো এরকুল পোয়ারো।

মাফ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

 কিছুই নয়, বললো এরকুল পোয়ারো।