৩. মাসখানেক অতীত হয়ে গেছে

মাসখানেক অতীত হয়ে গেছে, মহেন্দ্র আবার পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়েছে কিন্তু এ টাকাও তার রোজগারের টানা না, উমেশবাবুর দান। দেবেন্দ্র নিঃশব্দে সই করে নিয়েছেন টাকাগুলো নিরুপায় হয়ে। কিন্তু দারিদ্রের অসম্মান আহত হয়েছে বার বার। শ্বশুরের ভ্রাতৃপ্রতীম কোন বন্ধু অসময়ে কিঞ্চিৎ অর্থ সাহায্য করেছে, এতে তার মনঃপীড়া হবার কিছু সে খুঁজে পায়না, কিন্তু স্বামীকে সে চেনে দেবেন্দ্র যে এই সাহায্য নিতে চাইছেন না, এটা ভালোই জানা আছে আপনার। তবু নিয়তির কাছে মানুষ এতোই নিরুপায় যে এই সাহায্য হাত পেতে নিতে হচ্ছে, এবং মহেন্দ্রকে চিঠি লিখে জানানো যাচ্ছে না এরকম সাহায্য যেন সে না দেয়, কারণ সে চিঠি উমেশবাবুর হাতে পড়তে পারে। তথাপি দেবেন্দ্র ঠিক করলেন মহেন্দ্রকে তিনি লিখে জানাবেন, চাকুরী যদি সে না পায় তো অবিলম্বে বাড়ি ফিরে আসুক। কিন্তু নিজে লেখা সম্ভব নয়, দয়ালকে দিয়ে, লিখতে হবে। খোকনকে ডেকে বললেন, তোর দয়াল দাদাকে ডেকে আনতো খোকন বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই জন পাঁচ ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন বাড়িতে। গ্রামেরই লোক, দেবেন্দ্র স্বাগত আহ্বান জানালেন। এখন আর চিঠি লেখানো হবে না। তাই দয়ালকে ডাকতে নিষেধ করলেন দেবেন্দ্র। খোক বেঁচে গেল। কাকু চার পাঁচদিন পরে আসবে বলে আজও এলোনা। মর্মান্তিক দুঃখ ভুলতে পাচ্ছিল না ছেলেটা। বাবার কাছে থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকে, শুধু গান শিখবার সময় বাবার কাছে যায়, মুখে মুখে গান ভালই শিখেছে সে।

ভদ্রলোক কয়েকজন এসে প্রস্তাব করলেন এই গ্রামে তারা একটা চতুম্পাঠি খুলতে চান। আপাততঃ গ্রামের লোকই চাদা দিয়ে সেটা তারা চালাবে এবং সরকার থেকে বৃত্তি পাবার চেষ্টা করবে। আর চতুম্পাঠি চালাতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি দেবেন্দ্র। পাঁচটি ছাত্র পাওয়া গেছে গ্রামের পাঁচজনের বাড়িতে তারা খাবে এবং দেবেন্দ্রর ভিটার পশ্চিমদিকে যে বড় কুঠুরীটা আছে, ওই খানে থাকবে আর পড়বে। এই ঘরটাতেই এই বংশের মৃদঙ্গ সেতার তানপুরা ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে।

প্রস্তাবটা সুন্দর, উদার এই মানুষটির হৃদয় উচ্চ, এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু দেবেন্দ্রর মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই বাড়িতেই টোল ছিল, ছাত্ররা এই বাড়িতেই অন্ন এবং বিদ্যালাভ করতো, আজ সেটা চালাবে গ্রামের লোক উপরন্তু চাদা করে মাইনেও দেয়া হবে দেবেন্দ্রকে। তাঁর দৃষ্টি হীন চক্ষু থেকে জল বেরুতে চাইছে, কিন্তু সামলে নিলেন, বললেন প্রস্তাবটা খুবই ভাল নরেশ এতো বড় গ্রামের যোগ্য প্রস্তাব কিন্তু কিন্তু কি বলুন? নরেশ শুধাল না।

আমার কি আর অত খাটবার সমর্থ হবে ভাই?

সে কি। আপনি এমন কিছু বুড়ো হয়ে যাননি।

না, না, পারবো কি করে চোখ যার নেই, পড়ানো কি তার পক্ষে সম্ভব?

 হ্যাঁ সে কথা আমরা ভেবেছি, কিন্তু আপনাকে সাহয্য করতে মাধুবী থাকবে ও তো ব্যাকরণতীর্থ। আর সন্ধ্যেবেলা ঐ ঘরে সঙ্গীত চর্চা হবে, উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত, আমরা আজই ওই তবলা মৃদঙ্গ সেতারগুলো সারিয়ে আনছি, আপনি আপত্তি করবেন না দেবু দা আমরা অনেক আশা নিয়ে এসেছি।

আপত্তি করবার মত মনের জোর খুছে পাচ্ছে না দেবেন্দ্র। আজ যদি খবর পেতেন মহীন ত্রিশ টাকার কোন কাজে ঢুকেছে, মাসে দশটা টাকা দিতে পারবে তাহলে তিনি গ্রামের চাঁদায় নিজের পেট চালাবার কাজে সম্মতি দিতেন না। কিন্তু এখন ওসব ভেবে লাভ নেই, মহীনকে তিনি বাড়ি ফিরতে চিঠি লিখে দেবেন। বড় লোকের বাড়ির রাজভোগ খেয়ে ছেলেটি বয়ে যাচ্ছে হয়তো।

নরেশের দল পাশের ঘরে গিয়ে সেতার তানপুরাগুলো তুলে নিল তারপর হৈ হৈ করে চলে গেল বাজারে। ওদের উৎসাহ বিপুল, উদ্যম অসাধারণ। কিন্তু দেবেন্দ্রর মন ক্ষুণ্ণ হয়েই রইল তার পিতৃপুরুষের পবিত্র বস্তুগুলিতে অপরের সংস্পর্শ তিনি ঘটাতে চাননি তাই কিন্তু ঘটলো। ঘটুক বিধাতার ইচ্ছা। তিনি যেন আত্মসমর্পণ করলেন ভাগ্যের কাছে, ভাবলেন মানুষের শক্তি কত ক্ষুদ্র কত অসহায়তার অধীন। কিন্তু খোকনের আনন্দ ধরছে না। বাড়িতে গানের আসর হবে, নিত্য গান বাজনা চলবে কত কি আলাপ হবে, রাগ রাগিনী শিখতে পারবে। আঃ কাকু যদি বাড়ি থাকতো। কিন্তু ওই সঙ্গে একটা টোলও নাকি হবে। সেটা কি বস্তু, খোকনের জানা নেই। সেখানে নাকি ছাত্ররা পড়তে আসবে, খুব বড় বই পড়ানো হবে নিশ্চয়। ভাবতে ভাবতে খোকন ভেতরে এলো। ওর মা রান্নাঘরে, কিন্তু সেও শুনেছে। বাইরের আলোচনার কথা খোকনকে বললো।

এবার গান শিখবার খুব সুবিধা পাবি, বুঝলি।

হ্যাঁ মা, কিন্তু ওই যে টোল নাকি খুলেছে, ওটা কি?

ওটা পাঠশালা, তোকে ওখানে পড়তে হবে না।

ওটা কি জন্য হবে তাহলে?

সরকারী বৃত্তি পেলে কিছু হবে বাবা।

খোকন অতকিছু বুঝল না নিঃশব্দে চলে গেল পুকুর পাড়ের দিকে। কাকু যে কেন এতো দেরী করছে কে জানে? ওর বটের বেদীটা ভেঙ্গে গেছে, আবার তৈরি করতে আরম্ভ করলো আর একটু বড় করে।

অর্পণা রান্নাঘরেই ছিল স্বামীর কাছে কি একটা দরকারে আসছে কিন্তু দরজার কাছে এসেই দেখলো দেবেন্দ্র দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নিঃশব্দে বসে দৃষ্টিহীন চোখ থেকে জলধারা গড়াচ্ছে। অর্পণা বিস্মিত হয়ে থেমে গেল। কি হোল কেন উনি কাঁদছেন।

কে? অর্পণা। দেবেন্দ্র সামান্য সাড়া আন্দাজ করেই বুঝতে পারেন।  

হ্যাঁ, কি হলো? কাঁদছো।

না। চোখ মুছছেন দেবেন্দ্র ও কিছু না? একটু থেমে আবার বললেন, এই পরিবারের উপর একটা অভিশাপ রয়েছে অর্পণা।

ও মা কেন? কার অভিশাপ।

সঙ্গীতের ইষ্টদেবীর। এই বংশের রাগসিদ্ধ হয়ে এতো অহংকারী হয়েছিলেন সে এক দরিদ্র সঙ্গীত শিল্পীকে সামান্য ভুলের অপমান করে তাড়িয়ে দেন। চোখের জলে তিনি অভিশাপ দিয়ে যান, ওই সিদ্ধ যন্ত্র কলঙ্কিত হবে। তারপর থেকে এই বংশের অকালমৃত্যু আকস্মিক মৃত্যু অন্ধতা কিছু না কিছু লেগে আছে।

না ছিঃ ওসব রূপকথার গল্প অভিশাপ কেন থাকবে। ওসব কেন যে তুমি ভাবো।

নানা জায়গায় দরখাস্ত করেছে মহেন্দ্র কিন্তু কই কোন জবাব তো এলো না। অবশ্য আসবার সময় পার হয়ে যায় নি। ইতিমধ্যেই টাইপ করাটা আরো ভাল করে রপ্ত করে নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে অফিসের অন্যান্য কাজও করছে।

চাকরিতে ঢুকবার আগেই দাদাকে সে টাকা পাঠাতে পারছে, এটা ওর পক্ষে খুবই আনন্দের ব্যাপার হতো, কিন্তু দাদাকে সে চেনে। ওই টাকা কয়টা দান যে গভীর দুঃখের সঙ্গে হাত পেতে নিতে বাধ্য হন, মহেন্দ্রের তা অজানা নয় উপায় কি? ছেলেটা না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিল আর এই আশ্বিন কার্তিক মাসে রাজার ভান্ডারও খালি হয়ে যায়, নতুন ধান না উঠা পর্যন্ত ঘরে হাঁড়ি চড়ার কোনো উপায় নাই যদি বাজার থেকে চাল না কেনা হয়। শহরে অবশ্য সর্বত্র রেশন, কিন্তু পল্লীতে চাল কিনতে গেলে মহেন্দ্র অনেক ভেবে উমেশবাবুর এই দান গ্রহণ করেছিল।

প্রায় মাসখানেক ওর কাটলো এ বাড়িতে। কলকাতায় অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। মহেন্দ্র। রেষ্টুরেন্টে বসে কাঁটা চামচেতে খাওয়া, সেলুনে গিয়ে চুল ছাটাই করে আসে আর চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠা শিখতে দেরী লাগলো কারণ মন প্রাণ দিয়ে এসব ও পছন্দ করে না।

ঘোড়া দৌড় ক্রিকেট খেলা এবং এ জাতীয় ব্যাপারগুলো দুর্বোধ মহেন্দ্রের কাছে। কিন্তু সে দেখতে পায় এ বাড়িতে সবাই খেলাধুলা নিয়ে খুবই মাতামাতি করে। এমন কি খবরের কাগজের খেলার রিপোর্ট নিয়েও ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। রেডিও খুলে সবাই বসে থাকে, কোথায় কি খেলা হচ্ছে তার খবর শোনার জন্য।

যুদ্ধ কবে শেষ হয়েছে, এখানে দেশের লোকের হাতে টাকা কিছু রয়েছে–যাকে বলে ইনফ্লমেশন–কিন্তু সে আর কদিন? কিন্তু এতো কথা লোকে ভাবছে না। জিনিষ পত্রের দাম অনেক চড়া কিন্তু বিক্রি কম হয় না, কারণ হাতে পয়সা রয়েছে। মানুষ হন্যে হয়ে খেলার মাঠে টিকেট কেনে, সিনেমায় যায়, মদ খায় এবং আরো কত কি করে টাকার গরম এমনিই। মহেন্দ্র এসব দেখে শুধু লিখে রাখে তার দিনলিপিতে। এই আর্থিক উদ্বায়ী বৃত্তি, এই আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ের ব্যধি এই আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহ পরিণাম মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। কিন্তু ওর এসব ভেবে লাভ কি? তবু মহেন্দ্র ভাবে। ওর চিরন্তনশীল মন না ভেবে পারে না। গভীর রাত্রে ওর ভাবনাগুলি লিখে রাখে দিনলিপির পাতায় অত্যন্ত গোপনে সে লিখে এই দিনলিপি, মাধুরীও জানে না এই লেখার কথা। ও আজ লিখছে। কিছুতেই সে ধনী পরিবারের সাথে নিজেকে মেলাইতে পারছে না। ও যেন বাতাসে উড়ে আসা একটা ঘুড়ি, এই বাড়ির ছাদের কার্নিশে তার সুতোটা আটকে গেছে, তাই ও এখানে উড়ছে কিন্তু জানে ঐ ক্ষীণ সূত্রটুকু  ছিঁড়ে যাবে আর মহেন্দ্র গিয়ে পড়বে কোন সুদূর আকাশে। সেখান থেকে হয়তো এ বাড়ির চিলে কোঠাটা নজরে পড়বে না কিন্তু সত্যি কি তাই, এ বাড়ির সব স্মৃতিই কি সে ভুলতে পারবে? না দীর্ঘ দিনের দেখা আবছা স্বপ্নের মত মনে থেকে যাবে একথা–এ স্মৃতি এর মায়া। কিন্তু মহেন্দ্র এই মায়ার শৃঙ্খল অবিলম্বে কাটাতে চায়। কেন? জানে না মহেন্দ্র ওর চিত্তে যেন অহরহ তাগিদ দিচ্ছে সারা, সরে যাও মহেন্দ্র এতখানা অসামঞ্জস্যের মধ্যে থাকলে মানুষ্যত্বের মহিমা খর্ব হয়, ক্ষুণ্ণ হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিন্তু এবাড়িতে মহেন্দ্র কয়েকটা বিশেষ সুবিধে পেয়েছে যা অন্যত্র দুর্লভ। পড়বার জন্য প্রচুর পুস্তক আর গানবাজনা শিখবার জন্য বহু রকমের যন্ত্র এবং অখন্ড অবসর ঘন্টা দুই তিন টাইপ শেখা, আর অফিসের কাজ শেখা ছাড়া তার আর কর্ম নেই। বিকালে মাধুরীর সঙ্গে। বেড়াতে যাওয়া, কিন্তু তাও হয় কোনো সঙ্গীতের আসরে না হয় সাহিত্য আসরে অথবা শিল্পকলা কেন্দ্র বা ঐরকম কিছু একটা দেখতে। অকারণে মাধুরী তাকে কোথায় নিয়ে যায়।

সেদিন ঘরোয়া সাহিত্য আসরে যে কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তাদেরই একজন আজ লেখা চাইলেন মহেন্দ্রর কাছে। মাধুরী সেখানে ছিল না, থাকলে। মহেন্দ্র লজ্জায় মরে যেত কারণ সেদিন সেই আলোচনার পর মাধুরীর সঙ্গে আর কোন কথা। হয়নি এ সম্বন্ধে মতটা মাধুরী কিভাবে নিল আজো জানে না মহেন্দ্র। এই ভদ্রলোক তার। সাপ্তাহিক কাগজের জন্য লেখা চাইলেন অতিশয় সঙ্কোচের সঙ্গে মহেন্দ্র একটা ছোট গল্প এগিয়ে দিল, বলল কে জানে চলবে কিনা। আপনার যদি ভাল না লাগে তো ছাপাবেন না, খারাপ জিনিস আমি ছাপতে চাই না। আচ্ছা আচ্ছা, সে ভার আমার। আপনার লেখা খারাপ হবে আমি বিশ্বাস করি না। না না, আমি নিতান্তই অব্যাপারী, থাক, সেদিন আপনার বানীতেই বুঝেছি কি আপনি, আর কেমন আপনি। আমার কাগজটা সাপ্তাহিক সিনেমার কাগজ কিন্তু তাতেও আমি চাই আপনার মত স্বাস্থ্যকর চিন্তাধারা পরিবেশন করতে। আপনি। আগে পড়ে দেখবেন বলে সলজ্জে মহেন্দ্র নমস্কার জানালো। মাধুরী ব্যাপার কিছু জানলে না, মহেন্দ্র জানাল না তাকে। সে জানে মাধুরী ওসব পছন্দ করবে কিনা। হয়তো চোখ। পাকিয়ে বলবে–রবীন্দ্র, বঙ্কিম, শরতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সাহস কম নয় বলবে লোকের কাছে মুখ দেখানো দায় হল কি সব ছাই পাশ লিখতে শুরু করলে মাধুরী ভাল বলবে এ রকম আশা করে মহেন্দ্র হয় খারাপ বলে, না হয় কিছুই বলে না। একেই তো মহেন্দ্র নিতান্ত কুণ্ঠিত হয়ে থাকে এখন। তার ওপর প্রতি কাজে খুৎ ধরলে ও টেকে কি করে? অবশ্য আর কেউ কিছু ওকে বলে না–না ভাল না মন্দ? এমন কি অফিস ঘরে ওর যতক্ষণ ইচ্ছে থাকে, যখন খুশী চলে আসে কোন কৈফিয়ৎ নাই।

মহেন্দ্রের অসহায়তার দিকে মাধুরীর সতর্ক দৃষ্টি অগাধ অপার্থিব করুণ আকর্ষণ করে। দুর্বারভাবে এ যেন তার মাতৃমূর্তি কিন্তু মহেন্দ্রের সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতিতে মাধুরীর শাসন যেন রাজদণ্ড। সেখানে মাধুরী ক্ষমাহীন হয়তো হৃদয়হীনও। এই বিচিত্র অতলস্পর্শ শহরে পরে মহেন্দ্র নিজেকে যেন সামলাতে পারছে না।

কিন্তু চাকরীও একটা জুটছে না আর চাকরী জোগাড় করে নেবার জন্যেও কারুর মাথাব্যাথা দেখা যাচ্ছে না বাড়িতে। মহেন্দ্র আছে থাক বাড়ির একটা লোক যে সে? বাইরের কেউ এখন আর ধরতেই পারবে না যে মহেন্দ্র এ বাড়ির কেহ নয়। কিন্তু মহেন্দ্র নিজে সেই সত্যটা অনুক্ষণ অনুভব করে আত্মপরীক্ষা করে আত্ম–বিশ্লেষণ করে আপনাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করে বলে তুমি এ বাড়ির কেউ নও মহেন্দ্র তুমি নিতান্ত গরীবের ছেলে তোমার পিত্র প্রতীম দাদা অন্ধ তোমার একমাত্র ভ্রাতুস্পুত্র নাবালক তাকে মানুষ করতে হবে। পরের দানে নয় নিজের রোজগারের টাকায়।

কুমার নৃপেন্দ্রনারায়ণ আরো দু’একদিন এসেছে মহেন্দ্রের সঙ্গে দেখাও হয়েছে–

প্রশ্ন করেছে সে মহেন্দ্রকে কি করবে বা কি করতে চায় সে সম্বন্ধে। কুমার বেশি আসে না কারণ মেজদাই সস্ত্রীকে ওখানে যায়, টেনিস খেলতে বা ক্লাবে বেড়াতে কিন্তু আজ নাকি কুমার বাহাদুর এখানে আসবে তার আয়োজন চলছে।

এ পাড়াটা কলকাতায় বনেদী বাসিন্দাদের পাড়া। টেনিস খেলা বালীগঞ্জী ব্যাপার এখানে টেনিসকোড বসিয়েছে। বাড়ির কারো ওতে সম্মতি নেই, কিন্তু কিছু বললে গাছে ভ্রাতৃবিরোধ ঘটে, তাই সবাই চুপ করে আছে। মাধুরী বলে।

শ্যামবাজার শ্যামসুন্দরে ক্রীড়া ভূমি–এখানে গোচারণ হয় টেনিসে কেন? গরুচরবার জায়গা নষ্ট করে দিলে তুমি মেজদা।

কি করি বল–তোর মেজ বৌদির ঘুম হয় না–মেজদা বলে।

হবে কেন? ও তো আর গোপী নন গোপী গরবিনী রাধা ভাগ্যি কোথায় ওর? ও হোল সেই, মাধুরী থেমে যায়।

কি? কিরে ছোটদি–তাহলে কি? প্রশ্ন করে মেজো বৌ হাসে।

তুমি? মেজবৌদি গোপীনও। গোবরচনা নও। তুমি একেবারে গোবর—

ভালই তো, তোদের বাড়ি পবিত্র হোল ঘর নিকুষি।

হ্যাঁ–সে আর হতে দিলে কই। খুঁটো হয়ে উনুন জলছো যে! বলেই চলে যায় মাধুরী।

কিন্তু এসব তর্ক বিতর্ক, বাকবিতণ্ডায় ওদের অন্তরের স্নেহরস, কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। মাধুরী সকলের স্নেহপাত্রী, দাদারা ওর দোষ দেখে না বৌদিরাও দেখে না। ওকে ভালবেসেই যেন আনন্দ। ওর কথায় যেন সুরের ঝঙ্কার পায় ওরা, মেজবৌদি স্বামীকে বলল–

কথায় ওকে যে হারাবে, তার সঙ্গে ওর বিয়ে দেব।

এমন ছেলে আছে নাকি? আমি তো দেখিনি মেজদা বলে।

তাহলে বুদ্ধিতে যে হারাবে।

তেমনই বা কৈ?

কেন কুমার বাহাদুর।

তুমি ভুল করছো গোপী! কুমারের বুদ্ধিটা বৈষয়িক বুদ্ধি মাধুরী তার কাছ দিয়ে যায় না। ওর আদর্শবাদী মন কোথায় বাঁধা পড়বে কে জানে?

কুমার কিন্তু খুব আশা করে ওর সম্বন্ধে।

আমরা এক ফোঁটা করি না আর ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই আমরা করবো না।

বিয়ে দেবে না?

ওর ইচ্ছে হয় তো করবে আমরা এতগুলো ভাই ঐ এক ফোঁটা একটা বোন যা ইচ্ছে ওর করবে ও আমাদের বাড়িতে আনন্দ প্রতীমা।

বৌরা জানে দাদাদের এই মত। মা বাপের মত যাই হোক। দাদারা মাধুরীকে কোনদিন। কিছু বলবে না। না হলে মহেন্দ্রের মত কোথাকার এক অশিক্ষিত ছেলেকে নিয়ে মাধুরী এ তো মাতামাতি করছে কারও কি চোখে পড়ে না। আশ্চর্য।

কিন্তু এসব কথা বলতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়, মেজবৌ সেই দিন বাড়ির সকলের চক্ষুশূল হয়ে উঠবে। মাধুরীর মনে আঘাত দেবে বাবা বা তার দাদার কল্পনাতীত। দরকার নাই, পাঠা সে লেজ দিয়েই কাটুক, অতএব বৈকালিক অর্ভ্যথনার আয়োজন করতে লাগলো মেজবৌরাণী।

কুমার সাহেব আসবেন এবং আরেকজন কে বিশেষ ব্যক্তি আসবেন তার সঙ্গে অতএব আয়োজনও বিশেষ হওয়া দরকার। চায়ের টেবিলগুলো সাজাচ্ছে মেজবৌ, হঠাৎ মাধুরী অভিভুত হয়ে বললো–

বাঃ। মন্দ নয়। বড়দা বড়বৌদি হবে কাগিন্নী ঘর সামলাচ্ছে তোমরা হলে খেলোয়াড় খেলোয়াড়নী, বাহির সামলাচ্ছ এরপর ছোটবৌদি যদি লক্ষ্ণৌ ঠুংরী হয়ে এসে সংগীতের আসরটা সামলান তো এ বাড়ি আর দেখতে হবে মানবতোক, দানবপোক, দেহলোক সব হয়ে যাবে…।

তুই সাহিত্যের আসরটা সামলাবি তাহলে আরো কিছু হবে মেজবৌ রসিকতা করল। আর কি হবে। আর কিছু হবার নেই ঐ তিন লোকই সব–তিন লোকের তিন উপসর্গ অপবিদ্যা–অপবিদ্যাটা কে?

তুমি মেয়ে হয়ে খোলোয়াড় হচ্ছে এরপর গোঁফ গজাবে।

দুর মুখপুড়ি। মেজবৌ হেসে উঠলো–কিন্তু তুইও তো ভাল খেলতে পারিস ছোটদি। তোর গোঁফ গজাবে তাহলে।

না–আমি শুধু শিখে রেখেছি তোমার মতন বাতিকগ্রস্থ নই আমি যে এক দিন খেলা না হলে ঘুম হবে না। যাক আজ কোন মহাপুরুষ আসছেন? সে কুমাণ্ড তো? কুমাও কি করে? কুমার বাহাদুর আর মাদ্রাজের আদিলিংগমঃ ভারত বিখ্যাত যাক। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত হোন, কিছু যায় আসে না, বর্তমান যুগটা উড়োখ্যাতির যুগ।

তার মানে? উড়োখ্যাতি কি?

মানে খ্যাতিটা আকাশে উড়ছে যে পার ধরে না, খেয়ালে খ্যাতি, খাওয়ায় খ্যাতি, স্নানে, সঁতারে খ্যাতি, সৌন্দর্য খ্যাতি তাই সবাই এক এক দিক খ্যাতিমান। শুধু বীরত্বে, মনুষ্যত্বে করে কতটা খ্যাতি তাই জানা গেল না যাক আমারও গানের আসর আছে আজ! পিয়ানোটা একটু বাজিও বুঝলে, তোমাদের খেলা চুকলে আমার আসর।

মহেন্দ্র কোথায়? মহেন্দ্র ঠাকুরপো বলে গেছে, সে গেছে কোন অফিসের চাকুরি খুঁজতে।

ও। বলে মাধুরী আধমিনিট চেয়ে রইল। মেজবৌদির পানে তারপর বললে তোমার জানানোটা বাইরের ঢাকঢোল মেজবৌদি, মন্দিরের ভেতরের মৃদু ঘন্টাধ্বনি নয়, হলে তুমি মহেন্দ্র বলতে না মহীন বলতে। মা যা বলে বড় বৌদি যা বলে আদুরে নাম অধরকে স্নেহরসে সিক্ত করে, যার মধুর সৌরভ লুকানো যায় না, যাকগে। মহীনদা চাকরি পেলেই চলে যাবে তোমাদের আতঙ্কের কোনো কারণ নেই, তোমার কুমার বন্ধুরাই নাচবে এখানে।

চলে গেল মাধুরী। মেজবৌ নিমেশে চেয়ে রইল ওর দিকে অনেকক্ষণ। মহেন্দ্র সম্বন্ধে। অতি অল্পতেই মাধুরী যেন কেমন উত্তেজিত হয়ে যায় কেন?

কি এমন ঐ অজ পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত ছেলের? রূপে এমন কিছু রাজপুত্র নয় যদিও দেখতে ভালই। বিদ্যা তো একেবারে মাধুরীর থেকেও কম গলাটা ভাল গাইতে পারে। কিন্তু তাইবা কি এমন শিখেছে? স্বাস্থ্য তো নাই–ই। কিন্তু ও আশ্রিত। মাধুরীর স্নেহসজল নারী মন মায়ের মত ওকে ঘিরে আছে সত্যি। তো মাধুরী নায়িকা শ্রেণীর মেয়ে নয়। ওর মাতৃরূপটাই সব সময় জল জল করে। বাড়ির দারোয়ান পর্যন্ত এ সংবাদ জানে। মেজবৌ নিজের কাজে মন দিল।

উর্বশী কাগজের অফিসে গিয়ে মহেন্দ্ৰ শুনলো তার গল্পটা ছাপা হয়েছে অর্ধেকখানা বাকিটুকু এই সপ্তাহে বেরুবে আশাতীত আনন্দের সঙ্গে। আশাতীত সৌভাগ্য মহেন্দ্রের। সম্পাদক ওকে দক্ষিণা বাবৎ পনরটি টাকা দিয়ে বললেন কিছু মনে করবেন না, দুসংখ্যার জন্যই দক্ষিনা আর বেশি পারা যায় না, বাংলাদেশের পত্রিকা চালানো যে কঠিন ব্যাপার

মহেন্দ্রের কিছুই বলবার ছিল না, টাকা পাবার আশায় সে করেনি। অত্যাধিক আনন্দটা কোনো রকমে অন্তরে চাপা দিয়ে মহেন্দ্র ধন্যবাদ জানালো এবং আর বেশি বিলম্ব না করে ঐ সংখ্যার দুখানা কাগজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সটান পোষ্ট অফিসের দিকে।

এ টাকা ওর নিজের রোজগারের টাকা এই ওর জীবনে প্রথম উপার্জন। স্বােপার্জিত এবং সুদুপায়ে অর্জিত এই অর্থ সে দাদার হাতে দেবে এর একটি পয়সাও মহেন্দ্র নিজে খরচ করবে না।

মহেন্দ্র জানে উমেশবাবুর দয়ার দান দাদা কত কষ্টে গ্রহণ করেন। তিনি বাধ্য হচ্ছেন মনঃপীড়া ভোগ করছেন। কিন্তু মহেন্দ্রের অর্জিত এই অর্থ তো যতই সামান্য হোক তাকে অসীম আনন্দ দেবে।

পোষ্ট অফিসে গিয়ে একখানা কমল চেয়ে মহেন্দ্র চৌদ্দ টাকার মনিঅর্ডার লিখলো বাকি টাকার কয়েক আনা মনিঅর্ডার কমিশন। এই অর্থে সে আর কারো দানের ছোঁয়া লাগাতে চায় না কিন্তু এতটা শূচিব্যয়ুগ্রস্ত মহেন্দ্র না হলেও পারতো। হলো কিন্তু মহেন্দ্র!

টাকাটা পরশু গিয়ে পৌঁছাবে শনিবার দিন। দাদার অন্ধ নয়ন অশ্রুভরা হয়ে উঠবে। টাকাটা পেয়ে। ভাবতে গিয়ে মহেন্দ্রের নিজের চোখ দুটো জল ভরা হয়ে উঠলো। একজন বয়স্ক ভদ্রলাক ওর মুখ পানে চেয়ে বলে উঠলেন কি হলো মশাই কাঁদছেন।

আজ্ঞে না, কিছু না বলেই সলজ্জে চোখ মুছে মহেন্দ্র রাস্তায় নামলো। নিজের মনে বলল মানুষের জীবনে, মর্মান্তিক দুঃখ যেমন আছে মর্মান্তিক সুখও তার চেয়ে কম নেই।

কিন্তু মহেন্দ্র ঘরে ফিরলো না শেষ টাকাটার বাকি কয়গণ্ডা পয়সা ওর পকেটে তাই দিয়ে ও কিছু কিনবে খোকনের জন্য লাটিম না হয় বল না বশি। মহেন্দ্র ফুটপাতের দোকানগুলোয় চোখ বুলিয়ে ফিরতে লাগলো।

আর একটা গল্প লিখতে হবে অনুরোধ করেছে সম্পাদক। কি লিখবে। ভাবতে মহেন্দ্র। ঐ রকম ঘুরতে ঘুরতে বেশ বড় একটা প্লট যদি মাথায় এসে যায় তো না না না। বড় প্লট বড় লোকের জন্য। দুনিয়ায় অধিকাংশ লোকেই গরীব মহেন্দ্র তাদের জন্য ছোট গল্প লিখবে। তার মতন এমনি কত দুর্ভাগ্য পীড়িত বাবা কাকা সোনার শিশুর জন্য দু’পয়সার তালপাতা ভেপু খুঁজে ফিরছে দিনাস্তের মুখের একটু ফোঁটা হাসি দেখবার আশায় হয়তো সেই হতভাগ্য পিতা কোন ধনীর মূল্যবান মোটরের তলায়–

আহ হা। চার পাঁচজন লোক ছুটে এল অন্যমনষ্ক মহেন্দ্র কলার খোসায় পা পিছলে ফুটপাতে পড়ে গেছে। দামী কোটখানায় কাদা লেগে গেল। একজন ধরে তুলে বলল খুব লেগেছে মশাই?

না তেমন কিছু না ধন্যবাদ উঠে দাঁড়ালো। লেগেছে বেশই কিন্তু তার জন্য মহেন্দ্রের তিলমাত্র আফসোস নেই। ওর তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল অন্তর আচ্ছন্ন করে খোকনের মধুর হাসি ভেসে উঠলো। হাত ধরা বরাবরের বলটাও ছাড়েনি, পড়ে গেলেও হয়তো ছাড়বে না। মহেন্দ্র উঠেই চলে গেল।

আঃ এই পরম তৃপ্তির কথা সে পাঠককে জানাবে। তার অতি ক্ষুদ্র জীবনের অতি তুচ্ছ অনুভূতির অপরূপ সুষমা সে কি সঞ্চারিত করতে পারবে না পাঠকের অন্তরে? দরিদ্র কেরানী। পিতা মাসের শেষে মাইনে পেয়ে দু’পয়সার লজেন্স কিনে নিয়ে তার ছোট খুকুটার জন্য সে কি জীবন নয়, তাতে কি মাধুর্য নেই তার কি অমৃতস্বাদ অনুভব করবার মত অন্তর সৃষ্টি করে নেবে মহেন্দ্র শিল্পীর দরদ দিয়ে?

মহেন্দ্র স্টান শ্যামবাজারে ফিরে ঘরে ঢুকলো লিখবে কিন্তু লেখার এটা সময় নয় শীতের বিকাল এক্ষুনি হয়তো ডাক পড়বে চা খেতে কিংবা বেড়াতে যেতে। থাক রাত্রে লেখা যাবে।

মহেন্দ্র মেজদা ওর ঘরে ঢুকে ডাক দিল। এরকম খুব কমই হয়।

আজ্ঞে। মহেন্দ্র জবাব দিয়ে তাকালো ওর পানে। মেজদা বলল–

আজ কুমার আর তার এক বন্ধু আসবেন বাড়িতে থেকে বেরিও না। তিনি একটা কাজ জোগাড় করে দিবেন বলছেন, বুঝলে?

আজ্ঞে  হ্যাঁ। বলে মহেন্দ্র কিযে ভাবছে। মেজদা চলে গেল।

মহেন্দ্র ভাবছে তো ভাবছেই। কি যে ভাবছে ঠিক নেই। ওদিকে এক এক করে কয়েকখানা গাড়ি ঢুকলো টেনিস লনে, কুমার ইত্যাদি বলেন, বেতের চেয়ারে। একটা চাকর এসে মহেন্দ্রকে আসতে বললো ওখানে। কাদা মাখা জামাটা খুলে রেখেছে মহেন্দ্র, অন্য একটা পরেছে, এগিয়ে নমস্কার জানালো সকলকে। কুমার ওর পানে দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করলো টাইপ শেখা হলো তোমার? আজ্ঞে  হ্যাঁ এখন চোখ বুজে টাইপ করতে পারি তবে স্পিড কম–আরো দিনকতক অভ্যাস করলে ঠিক হয়ে যাবে।

এবার কাজের মাথায় অভ্যাস করবে–পরশু সোমবার আমার ওখানে যাবে দশটার সময়, সাদার্ণ পার্কে কেমন।

যে আজ্ঞে। বললো মহেন্দ। আনন্দই হচ্ছে ওর একটা কাজ এতদিন পর হোল। কিন্তু এখানেই মাধুরী চা পরিবেশন করছে অতিথিদের হঠাৎ কুমারকে সে প্রশ্ন করলো–

কাপটা কি? টাইপ না কি বাজার সরকারী।

দরকার হলে সবই করতে হবে বললো কুমার গম্ভীর স্বরে।

না ও যাবে না। আপনার জুতো বুরুশ করার মতো শিল্প জ্ঞান নেই ওর। –সে কি। মাধুরী। বুরুশ করবার কথা কি?

–এই তো বললেন সবই করতে হবে তার মধ্যে জুতো বুরুশও পড়ে।

–না না, আমি বলছি, বাড়ির ছেলের মত থাকবে যখন যা দরকার–

–আজ্ঞে না। এ ক্ষেত্র মুখুয্যেরই বাড়ির ছেলে আর কারো বাড়ির ছেলে হয়ে কাজ নেই। মহীনদা তুমি বলে দাও, আমি তোমাকে যেতে দেব না বলেই মাধুরী বাকি চারজনকে চা পরিবেশন করলো, ধীরে ধীরে, তারপর নিঃশব্দে চলে গেল।

ব্যাপারটা এমন দৃষ্টিকটু হয়ে দাঁড়ালো যে কুমার আর বললো না। মেজদা যেন গম্ভীর আর মেজবৌদির চোখে জ্বলন্ত একটা অগ্নি যেন ধিকধিক করছে কিন্তু মহেন্দ্রর অবস্থা আরো শোচনীয়। সে নিরুপায়ভাবে একখানা চেয়ারে বসে।

চল, আরম্ভ করা যাক। কুমারই বললো কথাটা। খেলোয়াড়দের এখন খেলার মধ্যে আত্মসমর্পণ করে ওরা গুমোট ভাবটা কাটাতে চায়, কিন্তু খেলার একজন সঙ্গী কম হচ্ছে। অতিথি যিনি আসার কথা তিনি এখনো আসেননি।

এসো। মহীন ততক্ষণ তোমাকে নিয়েই আরম্ভ করা যাক বলে কুমার অকস্মাৎ মহীনকে হাতে ধরে টেনে  দাঁড় করে দিল। মহীন এর আগে দু’একদিন খেলেছে মাধুরীর সঙ্গে কিন্তু শুধু খেলা শিখবার জন্য ওর মোটে অভ্যাস নেই। আমি। আমিতো ভাল খেলতে পারি না।

–খুব পারবে এসো। বলে তাকে টেনে নিয়ে এল, হাতে গুঁজে দিল টেনিস   র‍্যাকেটটা। নিরুপায় মহেন্দ্র দাঁড়ালো খেলতে।

পড়ে গিয়ে ওর কোমরে ব্যথা হয়েছে, তারপর খেলার তেমন অভ্যাস নাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মহেন্দ্র কাবু হয়ে পড়লো, অবস্থাটা এমন যে অন্যান্য খেলোয়াড়রা হাসছে। কিন্তু কুমার পরম অভিজাত ব্যক্তি মহেন্দ্রর মত নগন্য ব্যক্তিকে কেন খেলার সাথী করলো। কেউ ভেবে দেখলো না।

অকস্মাৎ মাধুরীর আবির্ভাব ঘটলো, এক মিনিট দাঁড়িয়ে দেখলো অবস্থাটা তারপর মহেন্দ্রের হাত থেকে   র‍্যাকেটখানা কেড়ে নিয়ে বললো–আসুন কে কত পারেন দেখা যাক বলেই মহেন্দ্রকে বললো, যাও তুমি আমার গানের আসরটা ঠিক করগে।

অতঃপর মাধুরী খেলতে আরম্ভ করলো যেন, দশভূজা। এত ভালোখেলা ও হয়তো জীবনে খেলেনি কী এক আশ্চর্য উত্তেজনা ওকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে।   র‍্যাকেটখানায় যাদু লেগেছে যেন। মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওকে।

খেলাটা শেষ করে   র‍্যাকেটখানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আঁচলে মুখ মুছলো, বললো, দুর্বলকে জয় করতে যাওয়ার কোনো মহিমা নেই সপ্তরথী ঘিরে অভিমুন্যকে হত্যার কলঙ্ক শুধু মহা ভারতের কলঙ্ক নয় আপনাদেরও।

চলে গেল মাধুরী। কে কি বললো, জানবার জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। ইতিমধ্যে সেই আহুত খোলোয়াড়টি এসে পড়েছে। তিনিও দেখছিলেন খেলা মাধুরী তাকে নমস্কার পর্যন্ত করলে না, ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু, খেলোয়াড়টি সত্যি স্পোর্টম্যান হেসে বললেন–

: চমৎকার খেলেন। উনি তো খুব ভাল খেলোয়াড় হবেন।

: ও কিছু হবে না একটা জলন্ত তল্লা, আগুন জলতে জলতে ও নিজেই পুড়ে যাবে কথাটা বললো যতীন তারপর এসে করমর্দন করলো অতিথির সঙ্গে।

: কেন একথা বলছেন? মেয়েটি কে আপনার? শুধালেন ভদ্রলোক?

আমার বোন, অনেক দুঃখেই কথাটা বলছি, মিঃ আদিলিঙ্গম। ও আমাদের ঘরের প্রদীপ। লেখায়, সঙ্গীতে, শিল্পে ওর বিচিত্র প্রতিভা বিস্ময় জাগায়। কিন্তু ঐ হোমকুণ্ডে আহুতি দেবার মত স্মৃত্বিক আমরা খুঁজে পাচ্ছিনে হয়তো ও ব্যর্থ হয়ে যাবে।

ছিঃ ছিঃ ! এরকম কথা কেন ভাবছেন নিতান্ত ছেলে মানুষ এখনো। বলে মিঃ আদিলিঙ্গম সস্নেহ দৃষ্টি একবার তাকালেন বাড়িটার পানে। যেন মাধুরীকে আর একবার দেখতে চাইছেন। মেজবৌ ব্যাপারটা বুঝে চাকরকে বললো ডাকতো ছোটদিকে।

কিন্তু ডাকতে হলো না, মাধুরী নিজেই এলো এবং সুষ্ঠু ভঙ্গীতে নমস্কার করে বললো শুরুতেই মার্জনা চাইছি; আপনার কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম।

–না না, কিছু না ওতে আর কি হয়েছে? আপনার খেলা দেখে খুশী হয়েছে আমি। আপনি ভালো খেলোয়াড় হতে পারবেন।

আপনার আশীর্বাদ মাথা পেতে নিলাম কিন্তু খেলোয়াড় হবার ইচ্ছে নেই।

কেন? মিঃ আদিলিঙ্গম সস্নেহে প্রশ্ন করলেন।

কারণ, খেলার আগ্রহ খেয়াল থেকে জন্মায় বাস্তবের রূঢ়তা ও সইতে পারে না।

তাহলে তো শিল্প সাহিত্য সবই খেয়ালের সৃষ্টি সবই বাদ দিতে হয়।

না, মহীনদা বলেন, শিল্প, সাহিত্য আর সঙ্গীতের মধ্যে আছে অন্য একটা গতি, অন্তর্মুখী গতি যে পথে মানুষ নিজ আত্মাকে খুঁজে পায় আর, অতিমানসকে ধরতে পারে। খেলাটা পুরোপুরি বহির্মুখী। খেলাকে আমি নিন্দে করছি না, ওটা আমার স্বভাবের পরিপন্থী।

মিঃ আদিলিঙ্গম আর কিছু বললেন না, চা খেতে লাগলেন পরে শুধুলেন আপনার মহীনদা বুঝি আপনার গুরু? কে তিনি? কোথায় থাকেন?

গুরু নন, গুরু থাকেন উঁচুতে, মহীনদা আমাদের খুব কাছাকাছি এই মাটিতেই থাকেন। খেলা শেষ হলে আমাদের গানের মজলিসে মহীনদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব যাবেন তো?

–হ্যাঁ নিশ্চয় যাব বললেন, আদিলিঙ্গম সস্নেহে।

অতঃপর মাধুরী নমস্কার জানিয়ে চলে গেল। ওদের খেলা আরম্ভ হল। মিঃ আদিলিঙ্গম ভালো খেলোয়াড়, এক একটি বলের এমন চমৎকার মার তিনি দিতে লাগলেন যে বিপক্ষ দলের আনন্দ হয়। গেম শেষ হতে দেরী হবে।

ওদিকে মহেন্দ্র গানের আসরটা সাজিয়ে ভাবছে কোথায় মাধুরী? কিন্তু মাধুরী আসবার আগে এলো ছোটদা রতীন্দ্র। বেহালাটা নিয়া সুর বাঁধতে লাগলো এই ফাঁকে প্রশ্ন মহেন্দ্র। বাজাতে পারে কিনা।

না, বললো মহেন্দ্র। রতীন্দ্র অবাক হয়ে তার মুখ পানে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, তাহলে কোন যন্ত্র বাজাও তুমি। বেহালার মতন সুরের যন্ত্র আর কিছু আছে নাকি;

–কি জানি। ধীর কণ্ঠে বললো মহেন্দ্র আমাদের বাড়িতে বেহালা নেই। আছে মৃদঙ্গ, তানপুরা, তবলা, ভুকি, মাদলা, মন্দিরা।

ব্যাস ওতেই গান বাজনা চলে?  

হ্যাঁ এখন আর চলে না, আগে চলতো। মানে আমার বাবার আমলে।

–হারমোনিয়াম নেই?  

: না ও আমরা বাজাই না, আমাদের তিন পুরুষের যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ছেলেটাকে যে কি করে শিখাবো। এসো বলে রতীন অভ্যর্থনা জানালো। সংগীতের আসর হল ওদের। কিন্তু কোথায় মাধুরী? আশ্চর্য তো! যার আসর সেই উপস্থিত নেই। খেলা শেষ হলেই মিঃ আদিলঙ্গম কুমার এবং মেজবৌদি ঢুকলো।

মেজবৌদি বললো, এই মহীন ঠাকুরপো, আর ইনি মিঃ আদিলিঙ্গম।

সবিনয়ে নমস্কার জানালো মহীন। ওরা বসার পর একজন একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন অন্যজন একটা ভজন। রতীন বেহালা বাজালো মাধুরী এখনো আসছে না এর পরে কে গাইবে? মেজবৌদি বললো মহীন ঠাকুরপো গান একখানা। মহীন সেতার বাজাচ্ছিল সেটা বাজাতে লাগলো। বাজাচ্ছেই সুর ক্রমশঃ আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে ঘরখানাকে, সারা বাড়িটাকে, ধীরে মধুর রাগিনী একি গুঞ্জন। একি অন্তর্বেদনার নিগঢ় অভিব্যক্তি একি বাষ্পকুল ব্যাথা। বিলাস। দিকে দিকে ক্রন্দসী যেন হেমন্তের শিশির ঝরা আকাশে আবিল করে দিল অশ্রু পঙ্কিল করে তুললো। অন্তত প্রাণের আকুল দেবতা যেন আর্তহাহাকারে মুর্ছিত হয়ে পড়েছে। কোন এক নিষ্ঠুর দেবতার চরণমুলে ‘ওগো যন্ত্ৰী’ অসহনীয় আনন্দ আর ধরতে পারিনি থামাও তোমার মুরলী।

নিস্তব্ধ হয়ে গেছে বাড়িটা। মাধুরী কখন এসে একধারে নীরবে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখেনি। শেষ হবার পর প্রায় আধ মিনিট ঘরখানায় যেন রেশ রয়েছে। মিঃ আদিলিঙ্গম রসজ্ঞ শ্রোতা এতক্ষণে তিনি বললেন, উঠতে উঠতে এসো তোমাকে আলিঙ্গন করে ধন্য হই।

মহীনের দুই গণ্ডা অশ্রুপ্লাবিত, মানুষ যে বাজাতে বাজাতে এমন করে কাঁদে এ ওরা এর আগে কখনও দেখেনি। মিঃ আদিলিঙ্গম মহীনকে বুকে জড়িয়ে বললেন এই অন্তর্মুখিনতটা ভারতের নিজস্ব সাধনা এঁকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দাও বন্ধু মানুষের আত্মা আবার স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত হোক।

মহেন্দ্র মাথা নুইয়ে এই বয়োঃবৃদ্ধ খেলোয়াড়ের আশীর্বাদ গ্রহণ করলো।

বয়সে তুমি ঢের ছোট, কিন্তু যেখানে তুমি বড় বিরাট, সেখানে আমাদের শ্রদ্ধা অগাধ, অকুণ্ঠ হয়ে রইল।

মহীনের চোখ ছাপিয়ে আবার জল এল–কিছু সে বলতে পারলো না উত্তরে।

বাগান বাড়িটা কেনা হয়েছে, কিন্তু মাধুরী এখনো ওটা দেখেনি, আজ সকালে মহেন্দ্রকে বললো চলতো দমদমার বাগানটা দেখে আসি।

: আমার একটু কাজ ছিল মাধুরী। মহেন্দ্র সভয়ে বলল। জানি। ও গল্প উর্বশীতে’ না পাঠিয়ে। উত্তরায়ণে পাঠাতে ওদের অফিস দশটার পর খোলে। উর্বশী সিনেমার কাগজ। উত্তরায়ণ মাসিক কাগজ ভালো কাগজ।

তুমি কি করে জানলে আমার গল্পের ব্যাপার মাধুরী?

–জানলাম, না জেনে আমার চলে না যে। চৌদ্দ টাকা মনি অর্ডারের কথা জেনেছি রসিদ দেখে।

লজ্জায় মহেন্দ্র হয়তো মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইতো, কিন্তু মাধুরীই তাকে রক্ষা করলো বলল ভালো করছো, নিজের উপার্জনের টাকা যত কমই হোক, তার মূল্য হিসেবে হয় না এসো, উঠে পড়ো গাড়িতে।

মহেন্দ্র আর কিছু বলবার অবকাশ পেল না, কোটখানা গায়ে চড়াতে চড়াতে গাড়িতে উঠলো গিয়ে। মাধুরী তার আগেই উঠে বসে আছে, বললো গান গাওয়া আমি ছেড়ে দিলাম মহীনদা।

  : কেন? মহীন অতি বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো।

: এতাকাল আমার ধারণা ছিল যে গান শুধু গলার ব্যাপার। মিষ্টি গলা আর তাকে খেলিয়ে সুর বের করতে পারলেই গান হয় কাল জানলাম, তা নয়।

–কেন? ব্যাপারটা তো মূলতঃ ঐ গলারই কারসাজি। গলার অবশ্য শেষ শ্রুতি পর্যন্ত পৌঁছানো যায় না, তার জন্য দরকার যন্ত্রের, কিন্তু গলার মূল্য কম নয়।

–না’ গলায় কারসাজিকে গলাবাজি বলা যায় তাতে গান হয় সংগীত হয় না, গীত তো নয়ই ওর জন্য দরকার সে দুঃখানুভূতির যেটা গলাতে না মহীনদা; সে থাকে অন্তরে। সেখান থেকে সুর আহরণ করে যে অমৃতময় পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়, গলা তাকে পরিবেশন করে মাত্র।

–বেশ তো, অন্তর থেকেই সুর আহরণ করো। মহেন্দ্র হেসে বলল কথাটা।

–না আমার ক্ষমতা নাই। অতটা অনতমুখী নই আমি। গান তো আমি ভালোই গাইতে পারি মহীনদা, বিস্তর প্রশংসা পেয়েছি, কিন্তু ওগুলো গান নয়।

–তাহলে? মহেন্দ্র আবার হাসলো। কি তা জানি না তবে গান নয় গীতামৃত ওর থেকে উৎসারিত হয় না কিন্তু যাক ওগুলো মানুষকে চমক লাগানো ফুলঝুরি। না আছে আগুন না হয় আলো ওর দীপ্তি এততাই ক্ষণিকের যে ওর ক্ষীণ আয়ুর জন্য ওর নিজেরই লজ্জা হওয়া উচিত।

মাধুরী কোনদিন মহেন্দ্রর সঙ্গে এতো কথা একসঙ্গে বলে না, এমন দীনভাবে তো নয়ই তার সতেজ সগর্ব বাক্যস্রোত যেন আজ রুদ্ধ হয়ে গেছে, এ যেন অন্য মাধুরী মহেন্দ্র আধ মিনিট ওর দিনে তাকিয়ে বলল, তোমার এই দীনতা আমার ভালো লাগছে না মাধুরী, আমাকেই তুমি একদিন বলেছিলে অমৃতের সন্তান দীন কেন হবে? আজ তুমি কেন এভাবে কথা বলছো?

–আমি মোটেই দীন নই মহীনদা। মাধুরী হেসে উঠলো। দীনতাকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি, আমি ধনীকন্যা এবং স্বয়ং ধনী কিন্তু ওই সম্পূর্ণ পার্থিব। অপার্থিব ধনকে সম্ভোগ করার সৌভাগ্য আমার কম হয়েছে যে সৌভাগ্যবান তাকে নমস্কার জানাই।

মহেন্দ্র নীরব হয়ে রইল, মাধুরীর এই শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে আরো কি আছে কিনা খুঁজে দেখবার মত অবস্থা ওর নয়, হতদরিদ্র এক গ্রাম্য আরো কি আছে কিনা খুঁজে দেখবার মত অবস্থা ওর নয়, হতদরিদ্র এক গ্রাম্য যুবক রূপে গুণে শিক্ষায় আভিজাত্যে মহেন্দ্র এতোই খাটো যে আপনাকে কোন সময়ই সে বুইক গাড়িতে চড়ে বেড়াবার যোগ্য মনে করে না। প্রশংসা শুনলে লজ্জায় তার মাথা নীচ হয়ে পড়ে নিন্দা শুনলে ভাবে এটাই তার প্রাপ্য। মাধুরীর প্রশংসা ওকে আনন্দিত করলো যা এ পর্যন্ত মাধুরীরর কাছ থেকে পায়নি তা পেল আজ কিন্তু ওতেই তার হোত ওর বেশি সে আশা করে না, ওর থেকে ক, খ পেলেও সে সুখী হতে। না পেলেও কিছুই মনে করতো না।

–আমি ধনী তাই আমার গান পাঁচজনে শোনে, বাহবা দেয়, তুমি নির্ধন তাই তোমার গানের শ্রোতা খুব কম মহীনদা এটা কিন্তু সত্যি।

কেন?

কারণ, সোনা যতক্ষণ খনিতে থাকে, তাকে খুঁজতে যায় কম লোক আবার সে যখন গিনি হয়ে গহনা হয়ে মণিকারের শোকেসে বসে তখন রাস্তার পথচারীও তাকে দেখতে দাঁড়িয়ে যায়–তাতে খনির সোনার দাম কমে না মাধুরী।

–দাম কথাটা আপেক্ষিক মহীনদা মানুষের চাহিদা হিসাবে ওর মূল্য, কুকুরের কাছে হীরের দাম কতটুকু!

তোমার শ্রদ্ধাটা অশ্রদ্ধায় পরিণত হচ্ছে যে মাধুরী বলে মহিন হেসে উঠলো। না মহীনদা মাধুরীরর হাসিতে গাম্ভীর্য শ্রদ্ধার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই, এটা হচ্ছে জাগতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয় পদার্থ জগতে নরম সোনা ইস্পাত না হলে চলে না।

সোনার মূল্যটা কোথায় থাকে? মহেন্দ্র প্রশ্ন করলো। অন্তরের অন্তঃপুরে, ওকে হাটে কিনতে যাওয়া মুখতা ছাড়া কিছু নয় মাধুরী। উত্তরটা দেবার সময় মুখোনি গাড়ির বাইরে নিয়ে গেল মহীন কিছু দেখতে পেলো না।

পীচঢালা পথে গাড়ি চলছে দ্রুত। সরে যাচ্ছে দুপাশের বৃক্ষলতা প্রসাদ কুটির। গাড়িটা বাঁক ফিরলো, একটা ছোট পল্লী, কোণার একটা দোকানে এক জন শীর্ণদেহী নারী, বুকে একটা শিশু–

: দু’পয়সার এরারুট দাও তো?

: দু’পয়সার হয় না যুদ্ধের বাজারে অত সস্তায় এরারুট নেই।

গাড়িটা শ্লথগতি হয়েছে বাক ফেরার জন্য কথাগুলো শুনতে পাওয়া গেল। মহীন গলা বাড়িয়ে দেখলো মেয়েটিকে ওর কোলের কাছে আরেকটি শিশু শীর্ণ দুর্বল। মেয়েটা এরারুট না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরছে।

: থামো তো বলে মহীন গাড়ি থামতে বললো।

: দু’পয়সার এরারুট পেলে না মা? মহীন প্রশ্ন করলো মেয়েটিকে।

: না বাবা, হাতে আর পয়সা নেই বলে ছলছলে চোখে দাঁড়ালো সে গাড়ির কাছে।  

: একে দুটো টাকা দাও মাধুরী।  

: কেন? মাধুরী সাহাস্যে প্রশ্ন করলো মহেন্দ্রকে। টাকা কেন দিতে হবে।  

: ওকে কিছু দিয়ে তুমি ধন্য হও।  

: ধন্য হব। মানিব্যাগটা খালি হয়ে যাবে না।  

: হোক অন্তরের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ হবে মাধুরী একে দান মনে করো না।

: মনে করো সেবা।

মূর্তিগুলিতে সে রকম কিছু নেই, অধিকাংশ বাঘ, সিংহ বা অন্যান্য জন্তুর মূর্তি মানুষের মূর্তিও আছে। সুন্দর বীরত্বব্যঞ্জক গ্রীক মূর্তি এবং কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীর ক্ষোদিত নারী মূর্তিও ভাঙা অবস্থাতেও। বাগানটা যথেষ্ট সুন্দর। মহেন্দ্র আর মাধুরী ঘুরে ঘুরে দেখছিল, অকস্মাৎ ঝিলটার নামবার একটা বাঁধা ঘাটে মহেন্দ্র একটা মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে গেল।

 : কি দেখছো মহীনদা।

: না বলে মহীন সামনের মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল।

: বাঃ! বেশ তো?  

: হ্যাঁ খোকনটাকে নিয়ে বৌদি খিড়কী ঘাটে দাঁড়ালে ঠিক এক রকম দেখতো মাধুরী।

: বৌদির চেহারা বুঝি খুব সুন্দর এমনি সুন্দর। মাধুরীরর প্রশ্নে বিদ্রুপের ব্যঞ্জনা।

: ওর জন্য সুন্দর চেহারা তো দরকার নাই মাধুরী, বিশ্বের যেখানে যত মা আছে, সবারই এই এক রকম যে ছেঁড়া শাড়ি পরা মেয়েটিকে টাকা দিয়ে এলে ওরও?

ব্যঞ্জনার কাছ দিয়ে গেল না মহীন, নির্বাক মাধুরীর অন্তর জুড়ে তখন একটা কথাই গুঞ্জিত হচ্ছে অশিক্ষিত এই পল্লি যুবকের অন্তরটা কতখানি গভীর অতলস্পর্শ মাধুরীকে তা খুঁজে বের করতে হবে। হেসে বললো, এসো ওই ভাঙা নৌকাটায় বসা যাক মাধুরী কথা কাটিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলো।

মহেন্দ্র এলো, বসলো একধারে। নৌকাটা টলমল করছে ওদের ভারে কিন্তু পরে স্থির হলো। কেথায় একটি পাখি বৌ কথা কও’ ডাকছে। মাধুরী বললো তোমার খালি গলার গানও ভাল লাগে মহীনদা গাওনা একটা। গলা কোন সময়ই খালি নয় মাধুরী বিশ্ব জুড়ো অবিরাম যে শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে ঋষি তাকে বলছেন ওঙ্কার নাব্রহ্ম। ঐ গাছের পাখি শুধু নয়, এই বাতস এই বনমর্মর এই জলকল্লোল, সবই সেই বিরাট সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র শোন–

ওম, ও ও ও ও ও ম…।

সুরের গভীর ধ্বনি, যেন রূপ পরিগ্রহ করেছে আকাশে গিয়ে লয় হচ্ছে সেই ওঙ্কার নাদ অপূর্ব আশ্চর্য, কিন্তু অকস্মাৎ মহীন কেমন নীল হয়ে গেল। গানটা থামাতে ওর দেরী হচ্ছে কোন রকমে গান বন্ধ করে শ্বাস নিল।

–কি হল মহীনদা?

: কিছু না, দাদা ছোটবেলা শেখাতেন, অনেকদিন অভ্যাস নাই, বলে মহীন কয়েক আযলা জল তুলে মুখে দিল। সুস্থ হতে যেন সময় লাগছে ওর। মাধুরী বলল তোমার মাতৃত্বের রূপটা এতা প্রকট, মাধুরী আমি অবাক হয়ে যাই অনেক সময়। কি রকম? মাধুরী প্রশ্ন করলো।

–মেয়েরা মূলতঃ দুই জাতের। এক প্রণয়িনী স্বভাবা আর এক মাত্ররূপী, তুমি শেষেরটা?

: মোটেই না, আমি দারুণ প্রণয়িনী স্বভাবা, আমাকে ঘিরে সোসাইটতে অবিশ্রাম জলতরঙ্গ বাজে জানো তো কচু!

ওটা তোমার বাইরের খোলস অন্তরে তুমি মা! চল, ওঠো। মহীন উঠলো।

: হবে।

মাধুরী যেন নিবে গেছে, এতোটুকু প্রতিবাদ করলো না। নেমে লিচু গাছের তলায় মহীনের অঙ্গ ধরে বললো আচ্ছা, দুটোর মধ্যে কোনটা ভালো, মাতৃস্বভাবা নাকি প্রণয়িনী স্বভাবা?

 : প্রেম যদি সত্য হয়, তাহলে তার থেকে বড় কিছু নাই মাধুরী সে অন্তরের লীলা। বিলাসের চারণভূমি, সে তোমার ক্ষেত্র কিন্তু সে প্রেম সুদুর্লভ সে প্রেম সুপ্ত সে প্রেম খনির সোনা তাকে হাটে বাজারে পাওয়া যায় না। আর মাতৃরূপ পৃথিবীতে বড় দরকার, যেমন–

 : ইস্পাত হেসে ব্যঙ্গ করলো মাধুরী। না ইস্পাত আমি বেলতে চাই না। যেমন আকাশের বৃষ্টি মাটির শস্য মায়ের জন্য।

 : তাহলেও বড় কিন্তু প্রেমিকাই তোমার মতে?

 হ্যাঁ কিন্তু প্রেম অপার্থিব সে প্রেম অন্তরের সেখানে দেহ বিলাসে কোন প্রশ্ন নাই চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে। মাধুরী যেন গম্ভীর হয়ে কত কি ভাবতে লাগলো। মহীনের অন্তরঃস্থল খুঁজবার ব্যথা সে ভেবেছিল একটু আগে, এই চেষ্টা করে কি ফল হবে তার? একি অসীম একটা অনুভূতিময় প্রাণ মাধুরী যেন কুল পাচ্ছে না। এই পর্যন্ত এই ধরণের কথা কারো মুখে শোনেনি কথার ফুলঝুরি খেলে ওর দাদার বন্ধুগণ রাজনীতি, অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ সুর তরুণ পাশ্চাত্য উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের আইডিয়ায় ভরপুর, অশ্লীল আর অসুন্দর শিল্পের বিকৃত পুজকদের দল আসে।

যার আপনাকে প্রকাশ করার সহস্র ভঙ্গিমায় আবেদন জানায় যেন ভিক্ষুক। আর মহীনদা যেন অটল গম্ভীর হিমাচল, ওর প্রতি বন্দনে ঝঙ্কার ধ্বনি স্পন্দিত হচ্ছে।

–ওর আত্ম প্রকাশের প্রচেস্টা নেই, ও স্বতঃ প্রকাশমান সূর্য।

–এই যে, রাস্তা ভুল করছো? মহেন্দ্র ডাক দিল?

: না মহীনদা, এই ফুলটা তুলোম বোটা ছেঁড়া একটি ফুল মাধুরী এগিয়ে এলো দেখতে কি ফুল। আমি তো চিনি না–

 : আমিও না কিন্তু নামের কি দরকার। ও নিজেই ওর পরিচয়।

: তা কি হয়। দেখতে সুন্দর, গন্ধাটাও বেশ মিষ্টি একটি নাম হলে

: নামের মিষ্টিটা ততক্ষণ ওকে চেননি নাম না জানা ফুল আরো বেশী মিষ্টি মধুরী ওর রহস্যতেই ওকে থাকতে দাও

 : তাহলে মালীকে শুধোব নামটা।

: নাই বা শুধোলে ওর নাম জবা, কবরী অথবা ডালিয়া, ডায়স্থাস গোছের কিছু একটা হবে সেইটাকে অতবড় করে দেখছো কেন?

: এররূপ রস গন্ধের সঙ্গে নামটিও যোগ করতে চাইনি।  

: না ওর রহস্যকে অবগুণ্ঠিত করো না, হাজার ফুলের নাম তো জান ওর নাম নাই বা জানলে।

তাহলে এর নাম রইল নাম না ও শুধু রইল আমাদের আজকের বেড়ানোর সাক্ষী হয়ে আচ্ছা তাই বলে হাসলো মাধুরী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *