৩. ভাবতত্ত্ব

ভাবতত্ত্ব

 প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের মধ্যবর্তী অংশে, অর্থাৎ পঞ্চম পুস্তকের শেষাংশ থেকে সপ্তম পুস্তকের শেষ পর্যন্ত, রাজনীতি নয়, স্থান পেয়েছে প্রধানত মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নাবলি। এই প্রশ্নাবলি শুরু হয়েছে একধরনের আকস্মিক বিবৃতির মধ্যে দিয়ে : যতক্ষণ পর্যন্ত না দার্শনিকরা রাজা হচ্ছেন বা জগতের রাজারা ও রাজপুত্ররা দার্শনিক চেতনা ও দার্শনিক শক্তির অধিকারী হচ্ছেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক মহত্ত্ব ও প্রজ্ঞার মিলন ঘটছে আর তাদের বাধাদানকারী সাধারণ প্রকৃতির লোকেরা যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নগর রাষ্ট্রগুলো অমঙ্গলের হাত থেকে রেহাই পাবে না-মানবজাতির মুক্তি পাবে না বলে আমার বিশ্বাস। কেবল তখনই আমাদের এই রাষ্ট্রের বাস্তবায়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে এবং তা দেখতে পাবে আলোর মুখ।

এ কথা যদি সত্যি হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের সাব্যস্ত করতে হবে কিসের গুণে একজন মানুষ একজন দার্শনিক হতে পারেন এবং দর্শন বলতে আমরা কী বুঝব। এই প্রশ্নের অনুবর্তী আলোচনাটি রিপাবলিক গ্রন্থের সবচেয়ে সুবিদিত অংশ এবং তা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রভাবসম্পন্ন। এর কিছু অংশে অসাধারণ সাহিত্যিক সৌন্দর্য রয়েছে; বক্তব্যের সঙ্গে পাঠক ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, যেমনটা আমি করি) কিন্তু তা দ্বারা আলোড়িত না হয়ে পারা যায় না।

সত্তা ও অবভাসের মধ্যকার পার্থক্যের উপরে প্লেটোর দর্শন দাঁড়িয়ে আছে, এ ব্যাপারটি প্রথম উত্থাপিত হয় পারমিনাইডিস-এর মুখে। এ সম্পর্কে প্লেটোর আলোচনার আগাগোড়াই পারমিনাইডীয় বাক্যাংশ ও যুক্তির পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায়। তবে প্লেটোর আলোচনায় সত্তা সম্পর্কে একটি ধর্মীয় সুর আছে, যা পারমিনাইডীয় নয়, বরং পিথাগোরীয়। এতে গণিত ও সঙ্গীত সম্পর্কেও প্রচুর কথা আছে, যা সরাসরি পিথাগোরাসের শিষ্যদের কথা বলে মনে করা যায়। পারমিনাইডিসের যুক্তি আর পিথাগোরাস ও অর্ষিকদের পারলৌকিকতার সংমিশ্রণে এমন একটি মতবাদ তৈরি হয়েছে, যা একই সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মীয় অনুভূতি-উভয়ের কাছেই সন্তোষজনক হয়েছে বলে তখন মনে করা হয়। এই দুই প্রবণতার সংমিশ্রণের ফলে দেখা দিয়েছিল এক শক্তিশালী সংশ্লেষ, যা নানা রকম বিকাশের পর বড় বড় দার্শনিকদের অধিকাংশকেই প্রভাবিত করেছে-এই প্রভাবের বলয়ে হেগেলও পড়েছেন। শুধু দার্শনিকরাই প্লেটোর দ্বারা প্রবাবিত হয়েছেন তা কিন্তু নয়। পিউরিটানরা কেন সঙ্গীত, শিল্পকলা ও ক্যাথলিক চার্চের জাঁকজমকপূর্ণ আচার অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে রিপাবলিক গ্রন্থের দশম পুস্তকে। স্কুলে ছেলেমেয়েদের কেন পাটিগণিত শিখতে বাধ্য করা হয়? এর কারণ বলা আছে সপ্তম পুস্তকে। নিচের অনুচ্ছেদগুলো প্লেটোর ভাবতত্ত্বের (Theory of Ideas) সারমর্ম তুলে ধরবে–

আমাদের প্রশ্ন হলো : একজন দার্শনিক কী? শব্দতত্ত্ব অনুসারে এ প্রশ্নের প্রথম উত্তরটি হলো : একজন দার্শনিক হলেন প্রজ্ঞার অনুরাগী। কিন্তু এ কথা বলা মানে এই নয় যে, তিনি একজন জ্ঞান-অনুরাগী। যে অর্থে একজন কৌতূহলী মানুষকে জ্ঞানের অনুরাগী বলা যায়, সে অর্থে জ্ঞান-অনুরাগী ও প্রজ্ঞা-অনুরাগী এক কথা নয়। স্কুল কৌতূহলের অধিকারী হলেই একজন মানুষ দার্শনিক হয়ে উঠতে পারেন না। সে জন্য সংজ্ঞাটি সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় এই : দার্শনিক হলেন তেমনই একজন মানুষ যিনি সত্যের দূরদৃষ্টি ভালোবাসেন। কিন্তু কী এই দূরদৃষ্টি?

এমন একজন মানুষের কথা বিবেচনা করা যাক, যিনি সুন্দর জিনিস ভালোবাসেন। নতুন নতুন ট্র্যাজেডি দেখা, নতুন নতুন চিত্রকলা দেখা ও নতুন নতুন সঙ্গীত শোনা নিজের জন্য অপরিহার্য মনে করেন। এ রকম একজন মানুষ কোনো দার্শনিক নন, কারণ তিনি ভালোবাসেন শুধু সুন্দর জিনিস, আর একজন দার্শনিক ভালোবাসেন সৌন্দর্যকেই, সৌন্দর্যের সত্তাকে। যে মানুষ শুধু সুন্দর জিনিস ভালোবাসেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন, আর যে মানুষ পরম সৌন্দর্যকে জানেন, তিনি বিলক্ষণ জাগ্রত। পূর্ববর্তী জনের রয়েছে শুধু ধারণা বা অভিমত, পরবর্তী জনের রয়েছে জ্ঞান।

জ্ঞান ও অভিমতের মধ্যে পার্থক্য কী? যে মানুষের জ্ঞান রয়েছে তিনি কিছু একটি সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী, তার মানে তার রয়েছে এমন একটি কিছু সম্পর্কে জ্ঞান, যার অস্তিত্ব আছে; কারণ যার অস্তিত্ব নেই তা কিছু নয় (এ কথা পারমিনাইডিসকে স্মরণে আনে)। এভাবে জ্ঞান অভ্রান্ত, অমোঘ, কেননা যৌক্তিকভাবে তা ভুল হওয়া অসম্ভব। কিন্তু ধারণা বা অভিমত ভুল হতে পারে। কীভাবে তা হতে পারে? যা নেই তা সম্পর্কেও ধারণা হতে পারে না, কারণ তাহলে তা হয়ে যায় জ্ঞান। সুতরাং ধারণা অবশ্যই হবে এমন কিছু সম্পর্কে, যা একই সঙ্গে আছে এবং নেই। কিন্তু তা-ই বা কী করে সম্ভব? এর উত্তর হলো এই যে, একেকটা জিনিস সব সময়ই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে : যা সুন্দর, তা কিছু বিবেচনায় কুৎসিতও বটে; যা ঠিক তা কিছু বিবেচনায় বেঠিক ইত্যাদি। সব বিশেষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুরই এ রকম বিরোধপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে বলে প্লেটো মনে করেন। এভাবে তারা অস্তিত্ব এবং অনস্তি ত্বের মধ্যবর্তী এবং অভিমত বা ধারণার বিষয় হবার উপযুক্ত। কিন্তু এদের সম্পর্কে কোনো জ্ঞান সম্ভব নয়। কিন্তু যারা পরম, শাশ্বত ও নিত্যকে দেখতে পান, তাদের বেলায় বলা যায় যে, তারা জানেন, মানে তাদের জ্ঞান রয়েছে এবং তারা শুধুই ধারণার অধিকারী নন।

এভাবে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থিত জগৎ সম্পর্কে হয় অভিমত বা ধারণা, আর জ্ঞান হয় একটি অতীন্দ্রিয় শাশ্বত জগৎ সম্পর্কে। উদাহরণস্বরূপ, ধারণা বিশেষ বিশেষ সুন্দর বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু জ্ঞানের সম্পর্ক সৌন্দর্যের সত্তার সঙ্গে। এরপরের একমাত্র যুক্তিটি হলো, কোনো একটি জিনিসকে একই সঙ্গে সুন্দর এবং অসুন্দর বা একই সঙ্গে ঠিক ও বেঠিক মনে করা স্ববিরোধী, তথাপি বিশেষ বস্তুগুলোতে এ রকম বিরোধপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মিলন ঘটে। সুতরাং বিশেষ বিশেষ বস্তুগুলো বাস্তব নয়। হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, আমরা একই নদীতে পা দেই এবং দেই না; আমরা আছি এবং নেই। এর সঙ্গে পারমিনাইডিসকে যুক্ত করলে আমরা পৌঁছি প্লেটোর সিদ্ধান্তে।

প্লেটোর তত্ত্বে বিরাট গুরুত্ববহ এমন কিছু আছে যা তার পূর্বসূরিদের মধ্যে পাওয়া যায় না, আর তা হলো তার ভাব বা আকার-এর তত্ত্ব। এই তত্ত্ব আংশিক যৌক্তিক, আংশিক অধিবিদ্যাগত। যৌক্তিক অংশটির কাজ সাধারণ শব্দাবলির অর্থ নিয়ে। পৃথকভাবে অনেক প্রাণী আছে যাদের সম্পর্কে আমরা সত্যিকার অর্থেই বলতে পারি এটি একটি বিড়াল। বিড়াল শব্দটি দ্বারা কী বুঝি? অবশ্যই প্রত্যেকটি বিশিষ্ট বিড়াল থেকে ভিন্নতর একটি কিছু। একটি প্রাণী যে একটি বিড়াল, ওই প্রাণীটি সব বিড়ালের সাধারণ প্রকৃতির অংশীদার বলেই না সে একটি বিড়াল। বিড়াল-এর মতো সাধারণ শব্দাবলি ছাড়া ভাষা দাঁড়াতেই পারে না। আর এ রকম শব্দাবলি স্পষ্টতই অর্থহীন নয়। বিড়াল শব্দটি যদি কোনো অর্থ বহন করে তবে তা এই বা ওই বিড়ালটি নয়, বরং তা একধরনের সার্বিক বিড়ালত্ব। একটি বিশেষ বিড়ালের জন্মর সময় এই ধারণার জন্ম হয় না বা ওই বিড়ালটি মরে গেলেই সেটির বিলোপ ঘটে না। বস্তুত, দেশে বা কালে এর কোনো অস্তিত্ব নেই; এটি শাশ্বত। মতবাদটির এই হলো যৌক্তিক অংশ। এর পক্ষে যুক্তিগুলো চূড়ান্ত বিচারে জুতসই হোক বা না হোক, কিন্তু জোরালো এবং মতবাদটির অধিবিদ্যাগত অংশটি থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। মতবাদটির অধিবিদ্যাগত অংশটি অনুসারে বিড়াল শব্দটির অর্থ একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বিড়াল, ঈশ্বরের সৃষ্ট বিড়ালটি; এ বিড়ালটি অনন্য। বিশেষ বিশেষ বিড়ালগুলো এ বিড়ালটির প্রকৃতির অংশীদার, কিন্তু এই অংশ কমবেশি অপূর্ণ। শুধু এই অপূর্ণতার জন্যই অনেকগুলো বিড়ালের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। বিড়ালটি বাস্তব, বিশেষ বিড়ালগুলো শুধুই প্রতীয়মান।

রিপাবলিক গ্রন্থের শেষ পুস্তকে, চিত্রকরদের প্রতি প্রাথমিক নিন্দা হিসেবে, ভাব বা আকারের তত্ত্বের একটি খুব পরিষ্কার ব্যাখ্যান রয়েছে। এখানে প্লেটো ব্যাখ্যা করে বলছেন, যখন কিছুসংখ্যক আলাদা আলাদা বস্তু একটি সাধারণ নাম বহন করে, তখন তাদের একটি সাধারণ ভাব বা আকারও থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যদিও অনেকগুলো শয্যা আছে, তবু একটি শয্যার কেবল একটিই ভাব বা আকার রয়েছে। ঠিক যেমন আয়নায় একটি শয্যা শুধুই প্রতীয়মান এবং বাস্তবনয়, তেমনি বিভিন্ন বিশেষ শয্যাগুলোও অবাস্তব, সেগুলো ওই ভাব-এর নকল বা কপি মাত্র। এটাই একমাত্র বাস্তব শয্যা, একটি মাত্র এবং তা ঈশ্বরের তৈরি। ঈশ্বরের তৈরি এই একটি শয্যা সম্পর্কে জ্ঞান সম্ভব, কিন্তু কাঠমিস্ত্রিদের তৈরি শয্যাগুলো সম্পর্কে সম্ভব শুধুই অভিমত বা ধারণা। সত্যিকার অর্থে, একজন দার্শনিক কেবল একটি আদর্শ শয্যা সম্পর্কেই আগ্রহী হবেন, ইন্দ্রিয়জগতে দৃশ্যমান অজস্র শয্যা সম্পর্কে নয়। আটপৌরে পার্থিব ব্যাপার স্যাপারের প্রতি তার একটু উদাসীনতা থাকবে : যে মানুষের মনের চমৎকারিত্ব আছে এবং যিনি সব সময়ের ও সব অস্তিত্বের দ্রষ্টা তিনি কী করে মানুষের জীবন নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে পারেন? যে যুবকের দার্শনিক হবার সামর্থ্য রয়েছে সে তার সঙ্গীদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত হবে ন্যায়পরায়ণ ও নম্র হিসেবে; তার থাকবে শেখার আগ্রহ, সে হবে ভালো স্মৃতিশক্তি আর একটি স্বাভাবিক সাজানো-গোছানো মনের অধিকারী। এ রকম যুবককে দার্শনিক ও অভিভাবকরূপে শিক্ষিত করে তোলা হবে।

এই পয়েন্টে এসে এক আকস্মিক প্রতিবাদ নিয়ে হাজির হন অ্যাডিমেন্টাস। সক্রেটিসের সঙ্গে যখন তিনি তর্ক করার চেষ্টা করেন তখন তিনি বলেন, তার নিজের মনে হয় যে প্রত্যেকটা ধাপে একটু একটু করে তিনি ভিন্ন পথে সরে যাচ্ছেন এবং শেষে তার পূর্ববর্তী সব ভাবনা উল্টে যাচ্ছে। কিন্তু সক্রেটিস যা-ই বলুন না কেন, ব্যাপারটা এই থাকছে যে, যেসব মানুষ দর্শন নিয়ে লেগে থাকেন তারা একেজন অদ্ভুত দৈত্যে। পরিণত হন, তা যেকোনো লোকই দেখতে পায়। এমনকি তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠরাও দর্শনের কবলে পড়ে অপদার্থ হয়ে যান।

সক্রেটিস স্বীকার করেন, বাস্তব দুনিয়ায় এটি সত্যি। কিন্তু তিনি মনে করেন এর জন্য দার্শনিকরা দায়ী নন, দোষ অন্য লোকদের একটি জ্ঞানী সমাজে দার্শনিকদের নির্বোধ দেখাবে না, শুধু বোকাদের মধ্যেই জ্ঞানী লোকদের প্রজ্ঞাহীন বিবেচনা করা হয়। এই উভয় সংকটে আমাদের করণীয় কী? আমাদের রিপাবলিক উদ্বোধন করার দুইটি উপায় থাকার কথা ছিল : দার্শনিকদের শাসক হবার মধ্য দিয়ে, অথবা শাসকদের দার্শনিক হবার মধ্য দিয়ে। শুরু হিসেবে প্রথম উপায়টি অসম্ভব বলে মনে হয়, কারণ যে নগরী ইতোমধ্যে দার্শনিক প্রকৃতি অর্জন করেনি, সেখানে দার্শনিকরা। জনপ্রিয় নন। কিন্তু রাজপুত্র হিসেবে জন্ম হয়েছে এ রকম যে কেউ দার্শনিক হয়ে উঠতে পারেন। আর এ রকম একজনই যথেষ্ট। একজনকে অন্তত পাওয়া যাক, যার ইচ্ছার প্রতি অনুগত থাকবে একটি নগরী, তিনি হয়তো সেই আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে পারবেন, যে ব্যবস্থার প্রতি বিশ্ব এত সন্দিহান। প্লেটো আশা করেছিলেন তিনি এ রকম, একজন রাজপুত্রকে পেয়েছেন সিরাকুজের স্বৈরশাসক কনিষ্ঠ ডাইয়োনিসাসের মধ্যে কিন্তু এই যুবক শেষ পর্যন্ত তাকে হতাশ করেন।

রিপাবলিক গ্রন্থের ষষ্ঠ ও সপ্তম পুস্তকে প্লেটো ভাবিত দুইটি প্রশ্ন নিয়ে : প্রথম প্রশ্ন, দর্শন কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যথোপযুক্ত মানসিকতার একজন তরুণ বা তরুণীকে কীভাবে এমন শিক্ষা দেয়া যায়, যাতে সে দার্শনিক হয়ে উঠতে পারে?

প্লেটোর জন্য দর্শন হলো একধরনের দূরদৃষ্টি, সত্যের দূরদৃষ্টি। তা বিশুদ্ধভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক নয়; তা শুধু প্রজ্ঞা নয়, বরং প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ। স্পিনোজার ঈশ্বরের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুরাগ-এর সঙ্গে তা বেশ মেলে; মানে, তা হলো চিন্তা ও অনুভূতির এক ঘনিষ্ঠ মিলন। যেকোনো ধরনের সৃজনশীল কাজ করেছেন এ রকম যেকোন ব্যক্তি কমবেশি এমন একটি মানসিক অবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, যাতে দীর্ঘ পরিশ্রমের পর হঠাৎ এক ঝলকানি নিয়ে সত্য বা সুন্দর আবির্ভূত হয়, অথবা আবির্ভূত হয় বলে বোধ হয়-এটা কিছু ক্ষুদ্র বস্তু সম্পর্কে হতে পারে বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কেও হতে পারে। ওই অভিজ্ঞতা ওই মুহূর্তে খুবই বিশ্বাসযোগ্য বা প্রত্যয় উৎপাদক। সন্দেহ আসতে পারে পরে, কিন্তু ওই মুহূর্তে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত বলে মনে হয়। আমার মনে হয় শিল্পকলায়, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে এবং দর্শনে সর্বোৎকৃষ্ট সৃজনশীল কাজগুলোর অধিকাংশই এ রকম এক-একটি মুহূর্তের ফসল। আমার মতো অন্যদের বেলায়ও এমনটি হয় কি না আমি বলতে পারি না। আমার বেলায় আমি দেখেছি, যখন আমি কোনো বিষয়ে একটি বই লিখতে চাই তখন প্রথমেই আমাকে ওই বিষয়ের বিশদ খুঁটিনাটির মধ্যে আত্মভূত হতে হয়; বিষয়বস্তুর প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না জানা পর্যন্ত আমাকে ডুবে থাকতে হয়। তারপর কোনো একদিন, আমার ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন হয়, আমি বিষয়বস্তুর সব যৌক্তিকভাবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত অংশগুলোসহ পুরোটাকে হৃদয়ঙ্গম বা উপলব্ধি করি। এরপর আমার শুধু বাকি থাকে আমি যা দেখলাম তা লিখে ফেলা। এর সবচেয়ে কাছাকাছি একটি তুলনা দেয়া যায় এ রকম : একটি পাহাড়ে কুয়াশার মধ্যে প্রথমবারের মতো হাঁটতে যাওয়া, কুয়াশার মধ্যে পাহাড়ের প্রত্যেকটি পথ, প্রত্যেকটি সংযোগপথ ও উপত্যকা ঘুরে ঘুরে চেনা হয়ে যাবার পর দূর থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে সমগ্র দৃশ্যটাকে পরিষ্কারভাবে দেখা। ভালো সৃজনশীল কাজের জন্য এই অভিজ্ঞতা অপরিহার্য বলে আমার বিশ্বাস, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়; মনঃকল্পিত নিশ্চিত অবশ্যই মারাত্মকভাবে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। উইলিয়াম জেমস এক লোকের বর্ণনা দিয়েছেন, যার লাফিং গ্যাসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ওই ভদ্রলোক যখন লাফিং গ্যাসের ঘোরের মধ্যে থাকতেন তখন তিনি ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যটা জেনে যেতেন বলে দাবি করতেন, কিন্তু যখন ঘোর কেটে যেত তখন তিনি তা ভুলে যেতেন। শেষে বহু চেষ্টা করে তিনি একবার ঘোরটা কেটে যাবার আগেই ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যটা লিখে ফেললেন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে তিনি ছুটে গেলেন, দেখতে কী তিনি লিখেছেন। লিখেছেন : সব দিকে পেট্রোলিয়ামের গন্ধ। একটি আকস্মিক অন্তদৃষ্টির মতো যা মনে হয় তা বিভ্রান্তিকর হতে পারে এবং স্বর্গীয় মাদকতাটুকু কেটে যাবার পর তা অবশ্যই ঐকান্তিকভাবে যাচাই করা উচিত।

যে যুগে রিপাবলিক লেখা হয় তখন প্লেটো তার স্বপ্নকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। এই স্বপ্নটির শেষ পর্যন্ত একটি রূপকের সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল, সেটা সেই গুহার রূপক কাহিনি। প্রয়োজন হয়েছিল এর প্রকৃতিকে পাঠকের কাছে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু ভাব-এর জগতের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা পাঠকদের দেখাবার উদ্দেশ্যে ওই রূপক কাহিনি থেকে নানা রকম প্রাথমিক আলোচনায় যাওয়া হয়েছে।

প্রথমত, বুদ্ধিবৃত্তির জগৎকে আলাদা করা হয়েছে ইন্দ্রিয়ের জগৎ থেকে, তারপর বুদ্ধিবৃত্তি এবং ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণ-প্রত্যেকটিকে এক এক করে দুইটি প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণের প্রকার দুটি নিয়ে আমাদের ভাবার প্রয়োজন নেই। বুদ্ধিবৃত্তির প্রকার দুটিকে যথাক্রমে বলা হয় যুক্তি ও উপলব্ধি। এ দুয়ের মধ্যে যুক্তির স্থান উপরে, বিশুদ্ধ ভাবগুলোর সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং এর পদ্ধতি দ্বান্দ্বিক। উপলব্ধি হলো বুদ্ধিবৃত্তির সেই প্রকারটি, যা ব্যবহার করা হয় গণিতশাস্ত্রে। উপলব্ধি যুক্তির চেয়ে ন্যূন এই জন্যে যে উপলব্ধি এমন সব অনুমান বা প্রকল্প ব্যবহার করে যেগুলো উপলব্ধি নিজে যাচাই করে দেখতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, জ্যামিতিতে আমরা বলি : ধরা যাক A B C একটি ঋজুরেখ ত্রিভুজ। এখন আসলেই এটি ঋজুরেখ ত্রিভুজ কি না এই প্রশ্ন তোলা নিয়মবিরুদ্ধ, যদিও আমরা যে-চিত্রটি এঁকেছি তা যে একটি ঋজুরেখ ত্রিভুজ নয় তা আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, কারণ আমরা পরম সরলরেখা আঁকতে পারি না। এভাবে গণিত কখনোই আমাদের বলে দিতে পারে না কী হয়, বরং শুধু বলতে পারে কী হবে যদি…। ইন্দ্রিয়জগতে কোনো সরলরেখা নেই, সুতরাং গণিত যদি আনুমানিক সত্যের অধিক কিছু পেতে চায় তাহলে অতীন্দ্রিয় সরলরেখার অস্তিত্বের প্রমাণ আমাদের খুঁজতে হবে একটি অতীন্দ্রিয় জগতে। এটা উপলব্ধি দিয়ে করা যায় না, তবে প্লেটোর মতে, এটা যুক্তির সাহায্যে করা যায়, যে যুক্তি দেখায় যে স্বর্গে একটি ঋজুরেখ ত্রিভুজ আছে, যার জ্যামিতিক প্রতিজ্ঞাগুলো আনুমানিকভাবে নয়, প্রত্যক্ষভাবেই নিশ্চিত করা যায়। এই পয়েন্টে একটি জটিলতা আছে, তা প্লেটোর দৃষ্টি এড়ায়নি এবং আধুনিক ভাববাদী দার্শনিকদের কাছেও তা সহজবোধ্য। আমরা দেখেছি ঈশ্বর শুধু একটি শয্যা তৈরি করেছেন, আর এটা মনে করাও স্বাভাবিক হবে যে ঈশ্বর শুধু একটি সরলরেখা তৈরি করেছেন। কিন্তু যদি একটি ঐশ্বরিক ত্রিভুজ থাকে তাহলে অবশ্যই ঈশ্বরকে কমপক্ষে তিনটি সরলরেখা তৈরি করতে হয়। জ্যামিতির বিষয়গুলো যদিও আদর্শ তবু অবশ্যই সেগুলোর অনেকগুলো করে নমুনা থাকতে হবে। দুটি পরস্পরচ্ছেদী বৃত্ত বা ইত্যাদির সম্ভাবনা আমাদের প্রয়োজন। এ থেকে বলতে হয়, প্লেটোর তত্ত্বের ভিত্তিতে জ্যামিতি চূড়ান্ত সত্যের যোগ্য হতে পারে না। বরং তা অবভাস শিক্ষার একটি অংশ হিসেবে হীনমূল্য। এই পয়েন্ট সম্পর্কে প্লেটোর উত্তর কিছুটা দুর্বোধ্য বলে আমরা তা বাদ দিয়ে যাব। প্লেটো পরিষ্কার বুদ্ধিবৃত্তিক দেখা ও অস্বচ্ছ ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণের মধ্যকার তফাত্তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন দর্শনেন্দ্রিয়ের থেকে নেয়া একটি তুলনার দ্বারা। তিনি বলছেন, অন্যান্য ইন্দ্রিয় থেকে দৃষ্টি আলাদা, কারণ দৃষ্টির জন্যে শুধু চোখ ও বস্তুই যথেষ্ট নয়, এর জন্যে আলোরও প্রয়োজন। সূর্যালোকে উজ্জ্বল বস্তুগুলো আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই, গোধূলি আলোয় সেগুলো বিভ্রান্তি কর দেখায়, আর ঘনঘোর অন্ধকারে আমরা আদৌ কিছু দেখতে পাই না। এখন ভাবগুলোর জগৎ হচ্ছে তাই যা সূর্যালোকে উজ্জ্বল বস্তুগুলো দেখার সময় আমরা দেখি, আর ঘটমান জগৎ হচ্ছে একটি বিভ্রান্তিকর গোধূলি জগৎ। চোখকে তুলনা করা হয়েছে আত্মার সঙ্গে আর আলোর উৎস হিসেবে সূর্যকে তুলনা করা হয়েছে সত্য বা ভালোত্বের সঙ্গে।

আত্মা চোখের মতো, সত্য ও সত্তার বিভায় আত্মা অবহিত হয় আর উপলব্ধি করে; বুদ্ধিমত্তার আলোয় আত্মা জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে, কিন্তু যখন সৃষ্টি ও ধ্বংসের গোধূলি আলোর দিকে ফিরে চায় তখন আত্মা যা পায় তা শুধুই ধারণা, তখন আত্মা জ্যোতির্ময় হতে পারে না, মিটমিট করে জ্বলে। প্রথমে একরকম ধারণা পায়, পরে অন্য রকম ধারণা পায়, আর মনে হয় তাতে কোনো বুদ্ধিমত্তা থাকে না…। এখন জ্ঞাত বস্তু ও সত্য এবং জ্ঞাতা ও জানার ক্ষমতার মধ্যকার সমদর্শিতাকে আমি ভালোর ধারণা বলে আখ্যায়িত করতে বলব এবং আপনাদের মনে হবে এটাই বিজ্ঞানের দাবি।

এটা সেই গুহা বা বিবরের সুবিদিত উপমাটিতে গিয়ে ঠেকেছে, যে উপমা অনুসারে দর্শনবঞ্চিতরা একটি গুহায় আবদ্ধ কয়েদিদের সঙ্গে তুলনীয়। এই কয়েদিরা শুধু এক দিকেই তাকাতে সক্ষম, কারণ তারা বাঁধা। তাদের পেছনে রয়েছে একটি আগুন আর সামনে একটি দেয়াল। তাদের ও দেয়ালটির মধ্যবর্তী স্থানে আর কিছু নেই। তারা যা দেখতে পায় তা হলো তাদের নিজেদের আর তাদের পেছনের বস্তুগুলোর ছায়া, তাদের পেছনে অবস্থিত আগুনের আলোয় ছায়াগুলো তাদের সম্মুখস্থ দেয়ালে প্রক্ষিপ্ত হয়। এই ছায়াগুলোকে তারা অবধারিতভাবে বাস্তব মনে করে, যে বস্তুগুলো থেকে এই ছায়াগুলো উৎপন্ন হয় সেগুলো সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। অবশেষে একদিন কেউ একজন এই গুহা থেকে পালিয়ে সূর্যের আলোয় এসে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, তখন প্রথমবারের মতো সে বাস্তব বস্তুগুলো দেখতে পায় এবং জানতে পারে যে এত দিন পর্যন্ত সে ছায়াগুলো দ্বারা বিভ্রান্ত ছিল। যদি সে অভিভাবক হবার যোগ্য দার্শনিক ধরনের মানুষ হয় তাহলে সে অনুভব করবে যে ওই গুহার মধ্যে। রয়ে যাওয়া তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে সত্যটা জানানো ও গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখানো তার কর্তব্য। কিন্তু তাদের বিশ্বাস করানো তার কাছে। কষ্টকর মনে হবে, কারণ সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার পর থেকে সে ওই ছায়াগুলো। আর গুহাবাসীদের মতো পরিষ্কার দেখতে পাবে না এবং গুহাবাসীর কাছে মনে হবে যে সে পালিয়ে যাবার আগে যেমনটি ছিল, এখন তার চেয়ে বেশি বোকাটে হয়েছে।

আমি বললাম, এখন আমি তোমাদের দেখাব, একটি অবয়বে আমাদের প্রকৃতি কতটা ফুটে উঠেছে বা ফুটে ওঠে নাই; খেয়াল করো, মাটির নিচে একটি গুহায় বাস করছে মানুষ, এ গুহার একটি মুখ আলোর দিকে, সে আলো গুহাটির আগাগোড়ায় পৌঁছায়। এখানে তারা আছে তাদের শৈশব থেকে। তাদের পা এবং গ্রীবা এমনভাবে শিকলে বাঁধা যাতে তারা নড়াচড়া করতে না পারে, তারা শুধু তাদের সম্মুখটা দেখতে পায়, কারণ শিকল তাদের মাথা ঘোরাতে দেয় না। তাদের পেছনে, উপরের দিকে একটি দূরত্বে একটি আগুন জ্বলছে। ওই আগুন আর কয়েদিদের মধ্যে একটি খাড়া পথ। আছে, যদি তাকাও, ওই পথের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত একটি দেয়াল দেখতে পাবে, পুতুল নাচের প্লেয়ারদের সামনে যেমন একটি পর্দা থাকে, যার উপর থেকে তারা পাপেট দেখায়।

দেখতে পাচ্ছি।

আর তুমি কী দেখতে পাচ্ছ, আমি বললাম, দেয়ালের একদিক থেকে আরেক দিকে লোকেরা নানা ধরনের পাত্র, মূর্তি ও পশু বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো কাঠ পাথর আর নানা রকমের পদার্থে তৈরি। তাদের কেউ কেউ কথা বলছে, কেউ কেউ চুপচাপ।

তুমি আমাকে একটি অদ্ভুত ছবি দেখালে, তারা অদ্ভুত সব কয়েদি।

উত্তরে আমি বললাম, আমাদের মতো, তারা শুধু তাদের নিজেদের বা পরস্পরের ছায়া দেখতে পায়। আগুনটা গুহার বিপরীত দেয়ালে ছায়াগুলো ফেলছে।

প্লেটোর দর্শনে শুভর স্থানটি অদ্ভুত। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞান ও সত্য শুভর অনুরূপ, কিন্তু শুভর স্থানটা উপরে। শুভ সারসত্তা নয়, বরং মর্যাদায় ও ক্ষমতায় তা সারসত্তাকে বেশ ছাড়িয়ে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের দ্বান্দ্বিকতার সমাপ্তি ঘটে পরম শুভর উপলব্ধির মধ্যে। গণিতবিদের অনুমান পরিহার করেও ডায়ালেকটিক চলতে পারে শুভর সাহায্য নিয়ে। মূল অনুমানটি হলো, সত্তা অবভাসের বিপরীত, আর তা পরিপূর্ণভাবে এবং নির্ভুলভাবে শুভময়, সুতরাং শুভকে উপলব্ধি করা মানে সত্তাকে উপলব্ধি করা। পিথাগোরীয় মতবাদের মতো প্লেটোর দর্শনেরও আগাগোড়া বুদ্ধিবৃত্তি ও মরমিবাদের মধ্যে এই একই বিরোধ রয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত শীর্ষবিন্দুতে গিয়ে মরমিবাদ পরিষ্কারভাবে বিজয়ী হয়েছে।

প্লেটোর ভাবতত্ত্বে কতকগুলো স্পষ্ট ত্রুটি রয়েছে। তবে সেসব সত্ত্বেও এই তত্ত্ব দর্শনে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছে, কারণ সার্বিকের সমস্যার প্রতি প্রথম জোর দিয়েছে এই তত্ত্ব এবং তা নানারূপে বর্তমান কাল পর্যন্ত টিকে আছে। আরম্ভ কাঁচাই হয়ে থাকে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে তার মৌলিকতা অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। প্লেটোর বক্তব্যের সব প্রয়োজনীয় সংশোধনী করার পরও তার বক্তব্য সম্পর্কে আরো কিছু বলার থেকে যায়। এমনকি যারা প্লেটোর প্রতি সবচেয়ে বেশি শক্ৰমনোভাবাপন্ন, তাদের দৃষ্টিতেও। আর তা হলো পুরোপুরি সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য দ্বারা গঠিত ভাষার মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারি না। আমাদের অবশ্যই মানুষ, কুকুর, বিড়াল-এই ধরনের কিছু সাধারণ শব্দ চাই; অথবা অনুরূপ, আগে এই ধরনের সম্পর্কবাচক শব্দ থাকতে হবে ইত্যাদি। এ রকম শব্দাবলি অর্থহীন ধ্বনি নয় এবং এটা দেখতে পাওয়া কষ্টকর যে, বিশ্ব যদি আগাগোড়াই বিশেষ বিশেষ বস্তুগুলো দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে তাহলে এই শব্দগুলো কীভাবে অর্থ বহন করতে পারে, কীভাবে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যগুলোর জন্য নির্ধারিত অর্থগুলো তৈরি হতে পারে। এই তর্ক এড়িয়ে যাবার অনেক পথ থাকতে পারে, কিন্তু যাই হোক না কেন, সার্বিকগুলোর পক্ষে এটা আপাত পর্যাপ্ত। আমি আপাতত তা কিছুমাত্রায় কার্যকর বলে গ্রহণ করব। কিন্তু এই পর্যন্ত নিশ্চিত হলেও প্লেটো যা বলছেন তার অবশিষ্টটুকু আবশ্যিকভাবে সত্য নয়।

প্রথমত, দার্শনিক বাক্যপ্রকরণ প্লেটো বুঝতেন না। আমি বলতে পারি সক্রেটিস মানবিক, প্লেটো মানবিক ইত্যাদি। এই রকম সব বাক্যে, মনে হতে পারে, মানবিক শব্দটার অর্থ একই। কিন্তু সেটার অর্থ যাই হোক না কেন, সে অর্থ সক্রেটিস, প্লেটো বা মানবজাতির অবশিষ্ট আলাদা আলাদা ব্যক্তির একই ধরন বোঝায় না। মানবিক শব্দটা একটি বিশেষণ। এ কথা বলা অর্থহীন হবে যে মানবিক হচ্ছে মানবিক। প্লেটো মানবিক হচ্ছে মানবিক বলার মতো একটি ভুল করেছেন। তিনি মনে করেন সৌন্দর্য সুন্দর। তিনি মনে করেন সার্বিক মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি একধরনের মানুষের নাম। বাস্তব মানুষেরা ঈশ্বর-সৃষ্ট এই মানুষের খানিক অবাস্তব কপি এবং তারা অপূর্ণ। সার্বিক ও বিশেষের মধ্যকার দূরত্ব কতখানি তা উপলব্ধি করতে প্লেটো সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। তার ভাবগুলো আসলে ঠিক অন্যান্য বিশেষগুলোর মতোই। নৈতিক ও নান্দনিকভাবে সাধারণের চেয়ে উঁচুমানের, এই যা। পরে একসময় তিনি নিজেই এই জটিলতা দেখতে শুরু করেন, পারমিনাইডিস রচনায় তা উপস্থাপিত হয়েছে। এই রচনাটি একজন দার্শনিকের আত্মসমালোচনার ইতিহাসে একটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

ধারণা করা হয়, পারমিনাইডিস বর্ণিত হয়েছিল অ্যান্টিফোনের (প্লেটোর সত্তাই) মুখে। তিনি একাই কথাবর্তাগুলো মনে রেখেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তা নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তখন তার আগ্রহ শুধু ঘোড়া বিষয়ে। একদিন তাকে ঘোড়ার বলগা আর মাথার সাজ নিয়ে যেতে দেখা যায়। তাকে খুব কষ্টে রাজি করানো হয় পারমিনাইডিস, জেনো আর সক্রেটিসের মধ্যকার সেই বিখ্যাত কথোপকথন বর্ণনা করতে। আমাদের বলা হয়েছে এই ঘটনা ঘটেছিল যখন পারমিনাইডিস বৃদ্ধ (বয়স প্রায় ৬৫ বছর), জেনো মধ্যবয়সী (প্রায় ৪০) আর সক্রেটিস বেশ তরুণ ছিলেন। সক্রেটিস ভাবতত্ত্ব বিশদ ব্যাখ্যা করেন। তিনি নিশ্চিত যে সমধর্মিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সৌন্দর্য ও ভালোত্ব-এগুলোর ভাব আছে। কিন্তু মানুষ সম্পর্কে ভাব রয়েছে কি না তা তিনি নিশ্চিত জানেন না। চুল, কাদা বা ময়লা সম্পর্কে ভাব থাকতে পারে এ রকম বক্তব্য তিনি ক্রোধের সঙ্গে নাকচ করে দেন। যদিও তিনি আরো বলেন যে, এমন সময়ও আসে যখন তার মনে হয় যে ভাব ছাড়া আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পালিয়ে বাঁচেন, কারণ তার ভয় হয় যে তিনি অর্থহীনতার এক অতল গহ্বরে পড়ে যেতে পারেন।

পারমিনাইডিস বলেন, হ্যাঁ সক্রেটিস, তুমি এ কথা বলছ কারণ তোমার বয়স এখনো কম। সময় আসবে, যদি ভুল না বলে থাকি, যখন তোমার উপর দর্শনের থাবা আরো শক্ত হবে আর তখন তুমি তুচ্ছতম জিনিসটাকেও ঘৃণা করতে পারবে না।

সক্রেটিস একমত যে, তার দৃষ্টিতে এমন কতকগুলো ভাব আছে যে ভাবগুলোর মধ্যে অন্যান্য সব বস্তু অংশ নেয় এবং সেখান থেকেই বস্তুগুলোর নাম উৎপন্ন হয়। যেমন সমধর্মী বস্তুরা সমধর্মী হয় কারণ তারা সমধর্মিতায় অংশ নেয়, বড় বড় জিনিসগুলো বড় কারণ তারা বড়ত্বে অংশ নেয় (তাদের মধ্যে বড়ত্বের অংশ বিদ্যমান থাকে) এবং ন্যায্য ও সুন্দর জিনিস ন্যায্য ও সুন্দর হয়, কারণ তারা ন্যায্যতা ও সৌন্দর্যে অংশগ্রহণ করে।

পারমিনাইডিস জটিলতা তুলতেই থাকেন। (ক) পৃথক বস্তু কি সমগ্র ভাবটিতে অংশ নেয়, নাকি ভাবটির অংশবিশেষে অংশ নেয়? উভয় দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই আপত্তি আছে। যদি প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটি সত্য হয় তাহলে একই বস্তু একই সময়ে অনেক স্থানে অবস্থান করতে পারে। আর যদি দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি সত্য হয়, তাহলে ভাবকে বিভক্ত করা সম্ভব এবং একটি বস্তু, যার ক্ষুদ্ৰত্বের একটি অংশ আছে, তা হবে পরম ক্ষুদ্ৰত্বের চেয়ে ক্ষুদ্রতর, যা কিনা উদ্ভট। (খ) যখন একটি পৃথক বস্তু একটি ভাব-এ অংশ নেয় তখন ওই বস্তু ও ওই ভাব হয় সমধর্মী। সুতরাং তখন অন্য একটি ভাব থাকতে হবে, যে ভাব বিশেষ বিশেষ বস্তু এবং একটি মূল ভাব-উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। আবার তার পরও আরো একটি ভাব থাকতে হবে, যা বিশেষ বিশেষ বস্তু এবং ওই দুই ভাবকে অন্তর্ভুক্ত করে, আর এইভাবে অনাদি পরম্পরায়। এইভাবে প্রত্যেকটি ভাব একটি ভাব হয়ে হয়ে দাঁড়ায় ভাবগুলোর এক অসীম সারি। (এটা ঠিক অ্যারিস্টটলের তৃতীয় মানব সম্পর্কে যুক্তির মতো)। (গ) সক্রেটিস মনে করেন ভাব সম্ভবত শুধুই চিন্তা, কিন্তু পারমিনাইডিস দেখান যে চিন্তা অবশ্যই হয় কিছু একটি সম্পর্কে। (ঘ) ভাবগুলোতে অংশগ্রহণকারী বিশেষগুলো ওইসব ভাব-এর অনুরূপ হতে পারে না, এর কারণ উপরে (খ)-তে বলা হয়েছে। (ঙ) যদি কোনো ভাব-এর অস্তিত্ব আসলেই থেকে থাকে তবে তা অবশ্যই আমাদের কাছে অজ্ঞাত, কারণ আমাদের জ্ঞান পরম নয়। (চ) যদি ঈশ্বরের জ্ঞান পরম হয়ে থাকে তাহলে তিনি আমাদের জানতে পারেন না এবং সে কারণে আমাদের শাসনও করতে পারেন না।

তবু ভাবতত্ত্ব পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়নি। সক্রেটিস বলেন, ভাব না থাকলে মন ভর করতে পারে এমন কিছুই থাকবে না, তাই চিন্তন ধ্বংস হবে। পারমিনাইডিস তাকে বলেন, আগে কোনো প্রশিক্ষণ পাননি বলে তার (সক্রেটিসের) এইসব সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।

আমার মনে হয় না যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষগুলোর বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্লেটোর যৌক্তিক আপত্তিগুলো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। যেমন-তিনি বলেন, যা সুন্দর তা কিছু বিবেচনায় কুৎসিতও বটে, যা দ্বিগুণ তা অর্ধেকও ইত্যাদি। কিন্তু কোনো শিল্পকর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা যখন বলি যে কিছু দিক থেকে তা সুন্দর এবং অন্য কিছু দিক থেকে কুৎসিত, তখন সর্বদাই বিশ্লেষণ দ্বারা (অন্তত তাত্ত্বিকভাবে) আমরা এ রকম বলতে সক্ষম হই : (শিল্পকর্মটির) এই অংশ বা এই দিক সুন্দর আর ওই অংশ বা ওই দিক কুৎসিত। আর দ্বিগুণ ও অর্ধেকের ব্যাপারে বলতে হয়, এগুলো আপেক্ষিক শব্দ, ২ যে ১-এর দ্বিগুণ এবং ৪-এর অর্ধেক এতে কোনো বিরোধ নেই। আপেক্ষিক শব্দগুলো উপলব্ধি না করার মধ্যে দিয়ে প্লেটো পুনঃ পুনঃ সমস্যায় পড়েছেন। তিনি মনে করেন, যদি ক খ-এর চেয়ে বড় এবং গ-এর চেয়ে ছোট হয় তাহলে ক একই সঙ্গে বড় এবং ছোট। এটাকে তার কাছে একটি বিরোধ বা দ্বন্দ্ব বলে মনে হয়। দর্শনের শৈশবকালীন অনেক অসুখের মধ্যে এ রকম সমস্যাগুলো ছিল।

পারমিনাইডিস, প্লেটো এবং হেগেল সত্তা ও অবভাসের পার্থক্যের যে পরিণতি আরোপ করেছেন তা ওই পার্থক্যের মধ্যে থাকতে পারে না। যদি অবভাস আসলেই দৃশ্যমান হয়, তাহলে তা কিছু নয়, আর সে কারণেই তা সত্তার অংশ-এটা একটি যথার্থ পারমিনাইডীয় ধরনের যুক্তি। যদি অবভাস আসলে দৃশ্যমান না হয় তবে আর তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ কী? কিন্তু সম্ভবত কেউ বলবেন : অবভাস আসলে দৃশ্যমান হয় না, কিন্তু দৃশ্যমান বলে মনে হয়। এ কথা কোনো কাজে আসবে না, কারণ তখন আমরা আবার প্রশ্ন করব : আসলে কি তা দৃশ্যমান হয় বলে মনে হয়, নাকি শুধুই আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয় বলে মনে হয়? এমনকি অবভাস যদি দৃশ্যমান হয় বলে মনে হয়ও, তবু একটি সময় গিয়ে আমরা অবশ্যই এমন কিছুতে পৌঁছি যা প্রকৃতপক্ষেই দৃশ্যমান হয় এবং সে কারণেই তা সত্তার অংশ। অনেকগুলো শয্যা যে দৃশ্যমান হয় এ কথা অস্বীকারের কথা প্লেটো স্বপ্নেও ভাবতেন না, যদিও প্রকৃত শয্যা রয়েছে শুধু একটিই, যা ঈশ্বরের তৈরি সেই শয্যাটি। কিন্তু অনেকগুলো অবভাস রয়েছে এবং এই বহুত্ব যে সত্তার অংশ-এই সত্যের মুখোমুখি তিনি হয়েছেন বলে বোধ হয় না। জগৎকে বিভিন্ন খণ্ডে বা অংশে বিভক্ত করার যেকোনো উদ্যোগ এবং অংশগুলোর একটিকে অন্যটার চেয়ে বেশি বাস্তব বলে দেখবার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্লেটোর আরেকটা কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টিভঙ্গির যোগ আছে। তা হলো, জ্ঞান ও অভিমতের বিষয়বস্তুগুলো অবশ্যই হবে ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের বলতে হয় : যদি আমার মনে হয় তুষার ঝরতে যাচ্ছে, তাহলে এটা আমাদের একটি অভিমত; পরে আমি যদি দেখতে পাই তুষার ঝরছে, তাহলে তা হয় জ্ঞান, উভয় ঘটনায় বিষয়বস্তু একই। কিন্তু প্লেটো মনে করেন, কোনো বস্তু যদি অভিমতের বিষয় হয় তবে তা কখনোই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। জ্ঞান নিশ্চিত এবং অভ্রান্ত বা অমোঘ, কিন্তু অভিমত শুধু ভ্রমপ্রবণই নয়, বরং অনিবার্যভাবে ভ্রান্তও বটে, কেননা তা এমন কিছুর সত্তা ধারণ করে যা শুধুই অবভাস মাত্র। এসব কথার মধ্যে পারমিনাইডিসের বক্তব্যই বারবার প্রতিধ্বনিত হয়।

একটি প্রসঙ্গ আছে যাতে প্লেটোর অধিবিদ্যা স্পষ্টতই পারমিনাইডিসের অধিবিদ্যার চেয়ে আলাদা। পারমিনাইডিসের আছে শুধু সেই অদ্বিতীয়; প্লেটোর আছে অনেক ভাব। শুধু সৌন্দর্য, সত্য আর শুভ নয়, বরং আমরা যেমনটা দেখেছি-একটি ঐশ্বরিক শয্যা আছে, যা ঈশ্বরের তৈরি, একটি ঐশ্বরিক মানুষ আছে, আছে একটি ঐশ্বরিক কুকুর, একটি ঐশ্বরিক বিড়াল এবং এইভাবে নুহর নৌকায় যা কিছু ছিল, সবই একটি একটি করে আছে। অবশ্য এইসব নিয়ে রিপাবলিক গ্রন্থে যথার্থভাবে ভাবা হয়েছে বলে মনে হয় না। কোনো একটি প্লেটোনিক ভাব বা রূপ একটি চিন্তা নয়, যদিও তা একটি চিন্তার বিষয় হতে পারে। ঈশ্বর কীভাবে তা সৃষ্টি করতে পারেন তা বোঝা কঠিন, কেননা সেটার অস্তিত্ব সময়হীন এবং তিনি তার চিন্তা ছাড়া একটি শয্যা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন তিনি সেটার বিষয় হিসেবে পেয়ে গেছেন সেই প্লেটোনিক শয্যাটি, যেটাকে তিনি অস্তিত্ব দান করেছেন বলে আমাদের বলা হয়। যা সময়হীন তা অবশ্যই অসৃষ্ট। এখানে আমরা একটি জটিলতার সম্মুখীন হই, যা নেক দার্শনিক ধর্মতাত্ত্বিককে সমস্যায় ফেলেছে। কেবল সাপেক্ষ জগৎ, দেশ ও কালের জগৎ সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু এটা সেই প্রাত্যহিক জগৎ, যাকে বিভ্রান্তিময় এবং মন্দ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং মনে হবে স্রষ্টা শুধু বিভ্রম আর মন্দ সৃষ্টি করেছেন। কিছু জ্ঞেয়বাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি বেশ তুষ্টির সঙ্গে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু প্লেটোতে জটিলতাটি আরো গভীর এবং রিপাবলিক-এ মনে হয়, তিনি কখনো এ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেননি।

প্লেটোর কথা অনুযায়ী, যে দার্শনিক অভিভাবক হবেন, তাকে অবশ্যই সেই গুহায় ফিরে যেতে হবে; যারা কখনো সত্যের সূর্য দেখেনি তাদের মধ্যে বসবাস করতে হবে। মনে হবে ঈশ্বর যদি তার সৃষ্টিকে বদলাতে ইচ্ছা করেন, তাহলে তাকে নিজেকে এই মতো কাজ করতে হবে, একজন খ্রিস্টান প্লেটোবাদী এইভাবে যিশুরূপে ঈশ্বরের অবতরণের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু ঈশ্বর কেন তার ভাবের জগৎ নিয়ে তুষ্ট থাকলেন না, তা ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব থেকে যায়। দার্শনিক গুহাটিকে অস্তিত্বমান দেখতে পান এবং সেখানে ফিরে যাবার প্রেরণা লাভ করেন হিতসাধনের ইচ্ছা থেকে; কিন্তু স্রষ্টা যদি সবকিছুই সৃষ্টি করে থাকেন তবে তিনি গুহাটি পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারেন বলে যে কারুর মনে হবে।

সম্ভবত সমস্যাটির উৎপত্তি একজন স্রষ্টা সম্পর্কে খ্রিস্টীয় ভাবনাটি থেকে। এর জন্যে প্লেটো দায়ী নন, প্লেটো বলেন, ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেননি, কেবল যা কিছু ভালো তারই স্রষ্টা তিনি। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ইন্দ্রিয়জগতের প্রাচুর্যের উৎস ঈশ্বর ছাড়াও আরো কিছু এবং ভাবগুলো সম্ভবত ঈশ্বরের সত্তার অনুষঙ্গ হিসেবে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট নয়। এইভাবে ভাবগুলোর প্রাচুর্যের সঙ্গে জড়িত দৃশ্যমান অনেকত্ব চূড়ান্ত নয়। শেষ পর্যন্ত শুধু ঈশ্বর বা শুভই অস্তিত্বমান, ভাবগুলো তার বিশেষণ। সে যাই হোক, এটা প্লেটোর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।

অভিভাবক হবেন এ রকম একজন তরুণের জন্যে উপযোগী শিক্ষা-দীক্ষার একটি ইন্টারেস্টিং বর্ণনার দিকে এগিয়েছেন প্লেটো। তিনি দেখেছেন যে, এই তরুণ এই মর্যাদার জন্যে মনোনীত হয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক গুণাবলির এক সংমিশ্রণের ভিত্তিতে। তাকে অবশ্যই হতে হবে ন্যায়পরায়ণ ও ভদ্র, শিক্ষার অনুরাগী, উত্তম স্মরণশক্তি ও ছন্দময় মনের অধিকারী। যে তরুণ এইসব গুণের জন্যে মনোনীত হয়েছেন তাকে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত কাটাতে হবে চারটি পিথাগোরীয় শিক্ষার পেছনে : পাটিগণিত, জ্যামিতি (সরল ও ঘন), জ্যোতির্বিদ্যা ও সঙ্গীত। কোনো উপযোগবাদী প্রেরণা থেকে এইসব শিক্ষা অর্জন করা চলবে না, বরং আদর্শ স্বর্গীয় পদার্থগুলোর গতির গণিতই হবে তার প্রধান মনোযোগর বিষয়। আধুনিককালে এ কথা উদ্ভট শোনাতে পারে, তবু বলতে অদ্ভুত লাগে যে, প্রায়োগিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেলায় এটা একটি ফলদায়ী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করা পর্যন্ত গ্রহরাজির দৃশ্যমান গতিগুলো অনিয়মিত ও জটিল মনে হয়। একজন পিথাগোরীয় স্রষ্টা যেমনটি চাইতে পারেন, তা আদৌ সে রকম নয়। প্রত্যেক গ্রিক ব্যক্তির পরিষ্কার বিশ্বাস ছিল যে, আকাশ অবশ্যই গাণিতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টান্ত বহন করে, আর তা কেবল তখনই হতে পারে যদি গ্রহ-নক্ষত্রগুলো বৃত্তাকারে ঘোরে। এটা বিশেষভাবে প্লেটোতে স্পষ্ট দেখা যায়, যিনি শুভর ভাবনার ওপর জোর দিয়েছেন। এভাবে এই সমস্যাটি দেখা দেয়; এমন কোনো প্রকল্প কি রয়েছে যা শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও সরলতা প্রতিষ্ঠার জন্যে গ্রহরাজির গতিগুলোর বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারে? যদি থাকে, তাহলে শুভর ধারণা আমাদের এই প্রকল্পের গুরুত্বকে সপ্রমাণিত করে। স্যামোসের এরিস্টারচাসের এ রকম একটি প্রকল্প ছিল। তা হলো, পৃথিবীসহ সব গ্রহ সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘোরে। এই মত পরিত্যক্ত ছিল দুই হাজার বছর ধরে, অংশত অ্যারিস্টটলের দাপটের কারণে। আর একটি প্রকল্প ছিল যা পিথাগোরীয়দের প্রকল্পের খুব সদৃশ। স্যামোসের এরিস্টারচাসের প্রকল্পটির পুনরুজ্জীবন ঘটে কোপার্নিকাসের হাতে এবং এর সাফল্য দ্বারা জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি প্লেটোর নান্দনিক পক্ষপাতিত্ব সত্য বলে মনে হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত কেপলার আবিষ্কার করেন যে, এহরাজি বৃত্তাকারে নয়, উপবৃত্তাকারে ঘোরে, আর সূর্য কেন্দ্রে নয়, বরং ফোকাসে অবস্থান করে। তারপর নিউটন আবিষ্কার করেন গ্রহগুলোর গতিপথ সঠিক উপবৃত্তাকারও নয় এবং এইভাবে প্লেটো যে জ্যামিতিক সরলতা খুঁজেছিলেন এবং আপাতভাবে স্যামোসের এরিস্টারচাস যা পেয়েছিলেন, তা অবশেষে ভ্রমাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের এই সামান্য অংশটুকু সেই প্রচলিত প্রবচনেরই নিদর্শন, আর তা হলো : যে কোনো প্রকল্প বা অনুমান, তা সে যতই উদ্ভট হোক না কেন, বিজ্ঞানের জন্য উপকারী হতে পারে, যদি তা কোনো আবিষ্কর্তাকে বিষয়বস্তুগুলো নতুনভাবে ধারণ করতে সক্ষম করে তোলে। কিন্তু যখন তা ঘটনাক্রমে এই উদ্দেশ্য সাধন করে তখন তা পরবর্তী বিকাশের পথে একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। জগতের বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য শুভ বা মঙ্গল মূল চাবিকাঠি-এই বিশ্বাস জ্যোতির্বিদ্যায় একটি পর্ব পর্যন্ত উপকারী ছিল। কিন্তু পরবর্তী প্রতিটি পর্বে তা ছিল ক্ষতিকর। প্লেটোর এবং আরো বেশি মাত্রায় অ্যারিস্টটলের নৈতিক ও নান্দনিক পক্ষপাত গ্রিক বিজ্ঞানকে হত্যা করার কাজে বেশ ভূমিকা রেখেছে।

এখানে উল্লেখ করা উচিত, পাটিগণিত ও জ্যামিতির প্রতি প্লেটোর বিরাট গুরুত্বারোপের পরেও এবং এসবের ব্যাপক প্রভাব প্লেটোর দর্শনে থাকা সত্ত্বেও আধুনিক প্লেটোবাদীগণ, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে, অধিকাংশই গণিতে অজ্ঞ। এটা বিশেষীকরণের একটি দৃষ্টান্ত। যে ব্যক্তি তার তরুণ বয়সের অনেকটা গ্রিক ভাষা শেখার কাজে ব্যয় করেননি এবং যেসব বিষয়কে প্লেটো গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন সেসবের পেছনে ব্যয় করার মতো সময় করে উঠতে পারেননি, তার মোটেই উচিত নয় প্লেটো সম্পর্কে কিছু লেখা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *