৩. বদনামের ঢক্কানাদ

১১. বদনামের ঢক্কানাদ

যখন কয়েক দিন চলে গেলো, অথচ ওয়াং-এর কোনো সন্ধানই পাওয়া গেলো না, কিন-ফো তখন উপর চাপিয়ে-দেয়া এই নিষ্কর্ম বন্দীদশায় অত্যন্ত বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বিডুল্‌ফ নিজেও কিঞ্চিৎ উদ্বেগ ও অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। প্রথমটায় যদিও ভেবেছিলেন যে ওয়াং নিশ্চয়ই ওই ভীষণ কর্মটি কদাচ সম্পন্ন করবে না, তবু এখন ক্রমে-ক্রমে তার বিশ্বাস হতে লাগলো যে চিনদেশে এমনকী মার্কিন মুলুকের চেয়েও অনেক তাজ্জব ব্যাপার অনেক অদ্ভুত ঘটনা অনায়াসে ঘটে যায়; শেষকালে কিন-ফোর মতেই সায় দিলেন তিনিঃ ওয়াং-এর এই রহস্যময় অজ্ঞাতবাস আসলে তার মারাত্মক পুনরাবির্ভাবেরই পূর্বাভাস; আকস্মিক বজ্রাঘাতের মতো অবতীর্ণ হয়ে হঠাৎ সেই চরম আঘাতটি হেনেই সেন্টেনারিয়ানের আপিশে গিয়ে সে তার প্রাপ্য অর্থ দাবি করতে চাইবে বোধহয়।

প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, সব ভাবে বা কোনো বিশেষভাবে–যেমন করেই হোক তার এই ফন্দিকে ব্যর্থ করতে হবে, হবেই–ভাবলেন বিডুল। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন তিনি। শুধু-যে পেইচিং হরকরা, চিং-পাও ও হংকং আর শাংহাইয়ের সব খবরের কাগজেই যে বারবার বিজ্ঞাপন দিলেন তিনি তা নয়, ইওরোপ আমেরিকারও সব কাগজে তার করে বিজ্ঞাপন পাঠালেন তিনি। প্রথম বিজ্ঞাপনটির পাঠ ছিলো এ-রকম : শাংহাই-নিবাসী কিন-ফোর সঙ্গে ওয়াং-এর যে-চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিলো, কিন-ফো যেহেতু এখন একশো বছর বাঁচতে চান, সেহেতু তা এতদ্বারা খারিজ করা হলো।

এই বিজ্ঞাপনটির পরেই বেরুলো আরেকটি ঘোষণা :

দু-হাজার ডলার পুরস্কার

এতদ্বারা ঘোষণা করা যাচ্ছে যে শাংহাই-নিবাসী ওয়াং-এর বর্তমান গতিবিধি ও বাসস্থান সম্পর্কে নিম্নোক্ত ঠিকানায় যিনি খবর দিতে পারবেন, তাকে তেরোশো তায়েল বা দু-হাজার ডলার পুরস্কার হিশেবে দেয়া হবে।

উইলিঅম জে. বিডুল্‌ফ
সেন্টেনারিয়ান ইনশিওরেন্স কম্পানি, শাংহাই!

চুক্তি সম্পাদন করবার মাত্র অল্প কয়েক সপ্তাহ বাকি আছে বলে ওয়াং-এর পক্ষে কোনো দূর দেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম; আশপাশে কোথাও সে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে, এটাই বোধকরি বেশি সম্ভাব্য-সুযোগ পেলেই ঘাঁটি থেকে বেরিয়েই শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু বিডুল্‌ফ তাই বলে কোনো সম্ভাবনাকেই বাজিয়ে না-দেখে ছেড়ে দেবার পাত্তর নন।

বিজ্ঞাপনগুলো ক্রমেই চারদিকে চাঞ্চল্য আর সাড়া তুলতে লাগলো। একদিন সকালে একটা বিজ্ঞাপন বেরুলো, যার উপরে বড়ো-বড়ো হরফে ছাপা :

ওয়াং! ওয়াং! ওয়াং!

আর ঠিক তার পরের বিজ্ঞাপনের উপর ছাপা হলো :

কিনফো! কিন-ফো! কিন-ফো!

আর তার ফলে এই হলো যে অচিরেই ওয়াং আর কিন-ফো চিন-মুলুকে দুটি বিষম কুখ্যাত নামে পরিণত হয়ে গেলো।

ওয়াং কোথায় হে?

ওয়াং-এর মলবটা কী বলো তো?

কোনো পাত্তা পেলে ওয়াং-এর?

কারু সঙ্গে দেখা হলেই এই হাস্যকর কথা ছাড়া আর-কিছু শোনা যায় না। শেষকালে এমনকী ছোটোদের মধ্যেও উত্তেজনাটা ছড়িয়ে পড়লো, রাস্তায় ছুটোছুটি করতে করতে তারা শোর তুললো : ওয়াংকে কে দেখেছে, জানিস?

কিন-ফোর নামও কম কুখ্যাত হয়নি তাই বলে। একশো বছর বাঁচতে চায়, কথাটা প্রকাশ্যে ঘোষিত হবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে লোকের টিটকিরির পাত্র হয়ে উঠলো। বিশ বছর ধরে রাজার হাতিশাল-আলো-করে-থাকা হস্তী শাবকটির নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী জুটলো অবশেষে–লোকে বললো; রাজকীয় পীতবসনের নতুন আরেক দাবিদার গজালো তাহলে; মান্দারিন কি ব্যাবসাদার, ভবঘুরে কি নৌ-নিবাসী–সকলেই কিন-ফোর নাম করে ঠাট্টা করতে শুরু করে দিলো। উইলো বনের হাওয়া গানের এক লালিকা বা টিটকিরি তৈরি হলো তার নামে, শতবর্ষের বুড়ো নামে হাসির গানটা এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো যে তিন সাপেক দামে গানটা বেচে গীতিকারটি দু-দিনেই বড়োলোক হয়ে গেলো। চিনমুলুকের লোকেরা এমনিতেই আমোদ-আহ্লাদ খুব ভালোবাসে; ঠাট্টা টিটকিরিতে তাদের কখনো অরুচি জাগে না; ঠাট্টা করার সুযোগ পেলে এমনকী কারু ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও মন্তব্য করতে ছাড়ে না : কিন্তু এই বিজ্ঞাপনগুলো তাদের যেমন হাসির খোরাক জোগালো তার আর কোনো তুলনাই হয় না।

এই হৈ-চৈ আর চাঞ্চল্য দেখে অবশ্য বিড়লফ অত্যন্ত তুষ্ট হলেন; তার সব অভিপ্রায়ই এতে সার্থক হলো। অবশ্য ওয়াং-এর উপর তার প্রতিক্রিয়া কী হলো তা কেউ জানে না, কিন্তু বেচারা কিন-ফোর কাছে এই কুখ্যাতি অর্জন রীতিমতো অপ্রীতিকর ও বিরক্তিজনক হয়ে উঠলো। রাস্তা দিয়ে হাঁটা-চলাই মুশকিল হয়ে উঠলো তার পক্ষে : তাকে রাস্তায় দেখলেই বেকার আড্ডাখোরেরা চারপাশে ভিড় করে; এমনকী শহর ছাড়িয়ে শহরতলির রাস্তা দিয়ে অনেকদূরে চলে গেলেও ওই ভিড়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না; শেষকালে বিরক্ত হয়ে যখন ইয়ামেনে ফিরে আসে, তখন একপাল লোক তার পিছু-পিছু এসে ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে নানা রকম মন্তব্য হানে। রোজ সকালে তুলকালাম শোরগোল করে তার উদ্দেশে হাঁক পাড়ে শাংহাইবাসীরা : তারা স্বচক্ষে দেখে যেতে চায় যে রাতের অন্ধকারে কফিনে যাবার দশা হয়নি তার; রোজ খবরের কাগজে তার খবর বেরোয়, রাজাবাদশাদের স্বাস্থ্যপত্রের মতো; লোকের মনোযোগ এড়িয়ে কোনো-কিছু করার অবস্থা তার আর রইলো না। এই অসহনীয় পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারু যদি একটা মুহূর্তও নিজস্ব ও ব্যক্তিগত না-থাকে, তাহলে বেঁচে-থাকাই দুর্বহ হয়ে দাঁড়ায়। একুশ তারিখে সকাল বেলায় তাই সে হন্তদন্ত হয়ে বিডুলফের আপিশে গিয়ে হাজির হলো; গিয়েই কোনো ভূমিকা না-করে মূল কথাটি পেড়ে বসলো সে–এই মুহূর্তে সে শাংহাই ত্যাগ করে চলে যাবে।

কম্পানির স্বার্থের কথা ভেবে-ভেবে বিডুলফের তখন চোখে ঘুম নেই; কিন-ফোর সংকল্প শুনে তার চোখ কপালে উঠলো। এতে যে সে কী মহাবিপদের সম্মুখীন হবে, এটাই তিনি তাকে ভালো করে বোঝাতে চাইলেন।

বিপদে পড়তে হয় পড়বো–তার আর কী করবেন? বললে কিন-ফো, কিন্তু আমি এই ঝুঁকি নেবোই–আপনি না-হয় আরো সাবধান হবার ব্যবস্থা করুন।

কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, বিডুল্‌ফ আবেদন করলেন।

কিন-ফো বাধা দিয়ে বললে, আমি যাবোই!

কোথায়?

জানি না। যে-দিকে দু-চোখ যায়।

কোথায় উঠবেন? থামবেন কোথায়?

কোত্থাও না।

ফিরবেন কবে?

আর ফিরবোই না।

কিন্তু যদি ওয়াংকে খুঁজে বের করতে পারি আমরা?

গোল্লায় যাক ওয়াং!

কিন্তু আপনার চুক্তির কথাটা একবার ভেবে দেখুন!

যেমন এক আকাট উজবুক ছিলুম, আস্ত বোকা ছিলুম, তাই এই ফল ভোগ করছি এখন!

কিন্তু এখনো হয়তো ওয়াংকে পাকড়াও করতে পারবো আমরা।

জাহান্নামে যাক ও!

ভিতরে ভিতরে কিন-ফো যে তীব্রভাবে চাচ্ছিলো ওয়াং ধরা পড়ুক, এটা স্বীকার করে নেয়াই ভালো। তার জীবন যে অন্য লোকের মর্জির উপর সূক্ষ্ম তন্তুতে ঝুলে-বুলে দোল খাচ্ছে, এই জ্ঞানটাই এখন তার চিরযন্ত্রণার মূল কারণ। যুদ্ধ-বিগ্রহের অরাজক অবস্থার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থা এটা–আরো একমাস এমনি ভয়ংকর উৎকণ্ঠায় কাটাতে হবে ভাবলেই তার সর্বাঙ্গে হিম হয়ে আসে, বুকের রক্ত জল হয়ে যায়।

সত্যি যেতে চান আপনি? আবার গোড়া থেকে শুরু করলেন বিডুল্‌ফ।

আপনাকে তো বলেইছি আমি,বললে কিন-ফো।

ক্রেগ আর ফ্রাইকেও যে আপনার সঙ্গে যেতে হবে, তা জানেন নিশ্চয়ই?

সে আপনার মর্জি! আমি কেবল এটুকু জানিয়ে দিচ্ছি যে ওদের খুব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেড়াবার জন্যে তৈরি থাকতে হবে।

যেতে তাদের হবেই,আবারও জানালেন বিডুল, আপনি বললেই তারা তৈরি হয়ে নেবে।

ইয়ামেনে ফিরে এসেই কিন-ফো যাত্রার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলো। সুন যখন শুনলো যে তাকেও প্রভুর সঙ্গে এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরুতে হবে, তখন তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো; কুঁড়েমি করার চেয়ে ভালো জিনিশ কিছু আছে? হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করার চেয়ে জঘন্য বোধ হয় আর-কিছু নেই–অন্তত সুনের সুচিন্তিত অভিমত ছিলো তা-ই। কিন্তু সাধের সেই শূকরপুচ্ছ বা বেণীটির প্রতি মমতা তার কিঞ্চিৎ বেশি ছিলো বলেই বেচারি কোনো প্রতিবাদ বা গাঁইগুই করার সুযোগ পেলে না।

একটু পরেই খাঁটি মার্কিন ক্ষিপ্রতার নজির হিশেবে যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে ক্রেগ আর ফ্রাই এসে হাজির।

কোন দিকে–শুরু করলো ক্রেগ।

যেতে হবে আমাদের? শেষ করলো ফ্রাই।

প্রথমে তো নানকিং, তারপর সেখান থেকে গোল্লায় একটু যেন তীক্ষ্ণভাবেই বলে উঠলো কিন-ফো।

শুনে গোয়েন্দাযুগল পরস্পরের মধ্যে অর্থপূর্ণ হাস্য বিনিময় করলো। পরে যখন জানলো যে সন্ধের আগে কিন-ফোর পক্ষে আর রওনা হওয়া হবে না, তখন দুজনে বিডুল্‌ফের সঙ্গে কিঞ্চিৎ শলাপরামর্শ করে আসতে গেলো; তা ছাড়া চৈনিক পোশাক পরে নেবারও মলব ছিলো তাদের–মার্কিন পোশাক বড় সহজে চোখে পড়ে যায়। গেলো, আর এলোহাতে ব্যাগ, কোমরে রিভলবার খুঁজে একেবারে যেন উড়তে উড়তে ফিরে এলো দুজনে।

তখন সন্ধে হয়ে আসছে, ছোট্ট দলটি বেরিয়ে পড়লো। যতদূর সম্ভব লোকের চোখ এড়িয়ে মার্কিন বসতির বন্দরটায় গিয়ে হাজির হলো তারা। শাংহাই থেকে নানকিং পর্যন্ত স্টিমারে যাবে তারা; আবহাওয়া ভালো থাকলে এটুকু পথ যেতে তাহলে বারো ঘণ্টাও লাগবে না।

কিন্তু বেশিক্ষণ না-লাগলে কী হয়, ক্রেগ আর ফ্রাই কোনো সামান্য বিষয়কেও অবহেলা করতে রাজি নয়; তাদের জিম্মায় যে-চৈনিক যুবকটি রয়েছে, তার গায়ে যাতে আঁচড়টিও না-লাগে, সেই জন্য সব যাচিয়ে-বাজিয়ে না-দেখে কিছুতেই তুষ্ট হয় না। জাহাজের অন্য যাত্রীদের সবাইকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখা তারা কর্তব্য বলে মনে করলো। শাংহাইতে অনেক দিন আছে বলে ওয়াং-এর সৌম্য অমায়িক মূর্তি তাদের অচেনা ছিলো না; যতক্ষণ-না তারা নিশ্চিত হলো যে ওয়াং ছদ্মবেশে এসে এই জাহাজে ওঠেনি, ততক্ষণ তারা নিশ্চিন্ত হলো না। ওয়াং সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে তারা কিন-ফোর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার উপর কড়া নজর দিলো। কিন-ফো হেলান দিয়ে দাঁড়ালে যাতে ভেঙে পড়ে না-যায়, সেইজন্য রেলিংগুলো কেমন শক্ত, তা তারা পরখ করে দেখলো। পাটাতনের প্রত্যেকটা কাঠ যাচিয়ে নিলো তারা, যাতে কিন-ফো চলতে গেলে দুম করে ভেঙে না-যায়; এঞ্জিনের কাছে তো তাকে কিছুতেই যেতে দিলো না তারা, কখন বয়লার ফেটে যায় তার ঠিক কী! রাতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ডেকে এসে দাঁড়ালে তারা গজগজ করতে লাগলো-ঠাণ্ডা লাগিয়ে অসুখ করলেই হয়েছে। তার কামরার ঘুলঘুলিগুলো ভালো করে আঁটা আছে কিনা দেখে নিলো তারা এক-এক করে। নিজেরাই তার চা-জলখাবার বয়ে নিয়ে গেলো, যাতে কেউ তাতে বিষ মেশাতে না-পারে। আর সর্বময় প্রভুর কর্মে অবহেলা করার দরুন সুনকে একযোগে তারা ধমকাতে লাগলো। শেষকালে জামাকাপড় না-ছেড়েই, কোমরে লাইফ-বেলট বেঁধে দরজার কাছে শুয়ে রইলো তারা, যাতে ধাক্কা লেগে, বয়লার ফেটে বা অন্যকোনো কারণে জাহাজ চুরমার হয়ে গেলে কিন-ফোর জলে-ডুবে-মরার সম্ভাবনা হলে তারা সেই দৈব অভিপ্রায়ে বাদ সাধতে পারে।

নির্বিঘ্নেই অবশ্য নানকিং পৌঁছুলো তারা। এমন-কিছুই ঘটলো না, যাতে তাদের এত সাবধানতার সত্যিকার কোনো পরীক্ষা হয়। উয়ো-সুং পেরিয়ে এলো জাহাজ চট করে; ইয়াংসিকিয়াং বা নীল মোহানায় ঢুকে পড়লো নির্বিঘ্নে; সিং-সিং দ্বীপ পেরিয়ে, ও-সুং আর লাং-চানের আলো দূরে ফেলে রেখে পরদিন প্রাতঃকালে সেই প্রাচীন নগরের জেটিতে গিয়ে ভিড়লো জাহাজ।

কিন-ফো যে শাংহাই ছেড়ে প্রথমেই নানকিংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিলো, তার পিছনে একটা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিলো। এককালে এই পুরোনো নগর ছিলো চাং-মাও বিদ্রোহের প্রধান ঘাঁটি; এখনো হয়তো সেখানে বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত কেউ-কেউ গোপন ঘাঁটি বানিয়ে বসে আছে; কে জানে ওয়াং হয়তো শাংহাই ছেড়ে নানকিঙেই চলে আসার কথা ভেবেছিলো। নগরীর অতীত ইতিহাস যেন রক্তে দোলা জাগায়। এখানেই প্রাক্তন শিক্ষক রং-সিও-ৎসিন তাইপিংদের নেতৃত্ব দিয়ে মাঞ্চু শাসকদের দীর্ঘকাল প্রতিরোধ করেছিলেন : এখানেই ১৮৬৪ সালে শত্রুপক্ষের হাতে পড়ার ভয়ে বিষ খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন; এখানেই মহাশান্তির নব যুগ ঘোষিত হয়েছিলো একদা, পরে যেখান থেকে রং-সিও-ৎসিনের ছেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাতার শাসকরা পরে যাঁকে গ্রেপ্তার করে শিরচ্ছেদ করেছিলো। আর তাঁর সেই অস্থিচূর্ণ যে কবর থেকে তুলে এনে শেয়াল-কুকুরের মধ্যে শ্মশানে-মশানে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো–সে তো এখানেই। অর্থাৎ নানকিং কি আসলে তার ভগ্নস্তূপের মধ্যে ওয়াং-এর। শত-সহস্র বিপ্লবী বন্ধুদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেনি–তিন দিন সবল প্রতিরোধ করার পর ঠাণ্ডা মাথায় তাতাররা যাদের নির্দয়ভাবে নিধন করেছিলো? এটা তো অত্যন্ত স্বাভাবিক–কিন-ফো মনেমনে আলোচনা করলো–যে, ওয়াং প্রথমে এখানেই এসে আশ্রয় নিতে চাইবে। ঘরে ফেরার প্রবল আকুতি যদি হঠাৎ তাকে ছিঁড়ে খেতে থাকে, তাহলে এখানে কি সে অতীতের লুপ্ত ধূসর বিধুর সুগন্ধ নিতে চাইবে না বুক ভরে? তার ওই রক্তরাঙা প্রতিশ্রুতি পালন করার জন্য এই অতীতের স্মৃতি ও চিরপরিচিত পরিবেশের মধ্যে ফিরে এসেই কি সে শক্তি ও প্রেরণা লাভ করার চেষ্টা করবে, যাতে একদিন সাহসে বুক বেঁধে বজ্রের মতো শাংহাইতে নেমে পড়তে পারে?

কিন্তু অন্যকোথাও যাবার আগে প্রথমে নানকিং-এ আসাটা আরো-একটা কারণে ভালো হলো। এখানেই যদি ওয়াং-এর সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই, অত্যন্ত ভালো হবে; তক্ষুনি সব মুশকিলই আসান হয়ে যাবে। কিন্তু তা না-হলে কিন-ফো বরং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ক্রমাগত ঘুরেই বেড়াবে, যাতে নির্দিষ্ট সময়টা অতিক্রম করে নির্ভয় হয়ে যাওয়া যায়।

ডাঙায় নেমেই কিন-ফো তার দলবল নিয়ে শহরের অর্ধ-পরিত্যক্ত অঞ্চলের এক হোটেলে গিয়ে উঠলো। হোটেলটার আশপাশে প্রাচীন রাজধানীর ভগ্নস্তূপ পড়ে আছে–বন্য বিমর্ষ ও ভয়াবহ।

আগে থেকে তোমাদের একটা কথা বলে নিই, অনুচরদের বললে সে একসময়, এটা মনে রেখো যে-এখন আমি ছদ্মনামে ঘুরে বেড়াচ্ছি; কোনো কারণেই কেউ আমাকে কিন-ফো বলে ডাকতে পারবে না। এখন থেকে আমার নাম কি-নান।

তাই হবে, সুন জানালো।

কি-নান, ক্রেগ আর ফ্রাই নামটা ভাগাভাগি করে পুনরাবৃত্তি করে নিলো একবার।

ইদানীং লোকজন তাকে যেভাবে জ্বালাতন করেছে, তাতে সে যে উত্ত্যক্ত হয়ে তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য সব দিকেই নজর দেবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সে যে আসলে নানকিঙের রাস্তায় ওয়াং-এর দেখা পাবে বলে প্রত্যাশা করছে, ঘুণাক্ষরেও এ-কথা সে কারু কাছে প্রকাশ করলো না।

এটা সে বুঝেছিলো যে একবার যদি ক্রেগ আর ফ্রাই এ-কথা জানতে পারে। তাহলে নতুন করে আরো হাজারো বাধা-নিষেধের মধ্যে তাকে হাঁপিয়ে উঠতে হবে। ওই গোয়েন্দা দুজনের চোখে সে যেন সামান্য একটা মালের বস্তা ছাড়া আর-কিছু নয়–যে করেই হোক সব বিপদ-আপদের হাত থেকে রক্ষা করে নিরাপদে এই মাল যথাস্থানে পৌঁছে দিতে হবে–তাদের উপর যেন এই দায়িত্ব বর্তেছে, অন্তত এটাই তাদের ভাবভঙ্গি।

শহরে ঘুরে বেড়াতেই সারা দিন কেটে গেলো তাদের। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে–ভগ্নপ্রায় ও মুমূর্ষ শহরটাকে তারা আদ্যোপান্ত দেখে নিলো প্রথমে; তার হতশ্রী জীর্ণদশায় সেই প্রাচীন জাঁকজমক ও সমৃদ্ধির কিছুই আর নেই এখন। কিন-ফো তাড়াতাড়ি হাঁটলো সারাক্ষণ; কথা বললো খুব কম, সবসময় চোখকান খোলা রেখে কেবল যে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখতে-দেখতেই গেলো তা নয়, পথচারীদের ভাবভঙ্গি চলনবলন লক্ষ করতেও সে ভুললো না।

কিন্তু যে-অতিচেনা মুখটিকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাকে কোথাও দেখা গেলো না। খালে-বিলে নৌকোয়-শাম্পানে যারা থাকে, তাদের মধ্যে যেমন ওয়াং-এর কোনো হদিশ নেই, তেমনি অন্ধকারে গলি খুঁজিতেও সেই পলাতক মানুষটির চিহ্ন পাওয়া গেলো না। কিন-ফো যেন আশ্চর্য-কোনো বর্ম পরে এসেছে যার ফলে ক্লান্তি বা অবসাদ তাকে স্পর্শই করতে পারছে না। সুন বেচারা সারাক্ষণ ভারি ও অনিচ্ছুক পায়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে তাকে অনুসরণ করলো। আর ক্রেগ আর ফ্রাই যদিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, তবু তারা কোনো দ্বিরুক্তি না-করেই তার সঙ্গে-সঙ্গে গেলো। এককালে যেখানে রাজবাড়ি ছিলো, এখন সেখানে তারা দেখলো কেবল মারবেল পাথরের ভাঙা বাহিরবাড়ি আর আধ-পোড়া দেয়াল। দেখতে পেলো ক্যাথলিক মিশনারিদের ইয়ামেন–১৮৭০ সালের অভ্যুত্থানের সময় আরেকটু হলেই তাতার-বাহিনীর হাতে তাদের মরতে হতো। এককালে এখানে পোর্সেলেনের যে-তোরণটা ছিলো, এখন সেই পোর্সেলেনের চিরস্থায়ী ইট দিয়ে কামানের কারখানা বানানো হয়েছে : তাও তারা পেরিয়ে গেলো; তারপর অনেক ঘঘারাঘুরির পর তারা নগরীর পূর্বতোরণ পেরিয়ে গ্রামাঞ্চলে এসে পৌঁছুলো।

এখানে এসে কিন-ফোকে একবার থমকে গিয়ে চারপাশে তাকাতে হলো। শহর পেরুবার সঙ্গে-সঙ্গে মস্ত এক শান বাঁধা রাস্তায় এসে পড়েছে তারা–দু-পাশে গ্রানাইট পাথরের মস্ত সব মূর্তি চলে গেছে সারি-সারি-সব জন্তু-জানোয়ারের মূর্তি–অতিকায় হস্তীমুখ, বন্য মহিষ, উটের পাল, ভীষণ ড্রাগন–কিছুই ভাস্করদের কল্পনাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই পথ ধরে এগুতে-এগুতে দূরে সে দেখতে পেলো ছোট্ট একটা মন্দির-মস্ত একটা টিলা উঠে গেছে তার পিছনে–টিলা না-বলে পাহাড় বলাই বোধকরি সংগত। পাহাড়টা আসলে গোরস্থান। সমাধিটা আসলে পুরোহিতরাজ রং-ও-র, পাঁচশো বছর আগে যিনি বৈদেশিক জোয়ালের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। কিন-ফো তার মনোভাব আর চেপে রাখতে পারলে না। আবার নররক্তে হাত রাঙাবার আগে ওয়াং কি এই পুণ্য সমাধিতে তীর্থভ্রমণে না-এসে পারবে? কিন-ফোর মনে হলো এক্ষুনি বুঝি ওই ভগ্ন ও বনাকীর্ণ সমাধি ফুঁড়ে বেরিয়ে ওয়াং তার সামনে এসে দাঁড়াবে।

কিন্তু না–কেউ কোনোখানে নেই; বিজন মন্দিরটি খাঁ-খাঁ করছে : ওই অতিকায় পাথরের মূর্তিগুলোই শুধু মন্দিরের দ্বারী হিশেবে দাঁড়িয়ে আছে দু-পায়ে, আশপাশে জীবন্ত কোনো জনপ্রাণীর চিহ্নও দেখা যায় না।

ফিরে আসবে বলে ভাবছিলো কিন-ফো, হঠাৎ মন্দিরের দরজায় কী-সব লেখা আছে দেখে থমকে দাঁড়ালো; সাগ্রহে এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে কে যেন কতগুলি কথা খোদাই করে গেছে এখানে–একেবারে টাটকা এই লেখা, যেন এইমাত্র কেউ এই হরফগুলো খোদাই করে গেছে : ও, ক, ফ।

আর-কোনো সন্দেহই নেই। ওয়াং আর কিন-ফো, এই দুই নামের আদ্যক্ষর–হয়ে যায় না! এখানে এসেছিলো ওয়াং? হয়তো এখনো আশপাশে কোথাও আছে, মনে-মনে বললো সে। উৎকণ্ঠায় ভরে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে চারপাশে খুঁজে দেখলো সে, কিন্তু তার সব সন্ধানই ব্যর্থ হলো। শেষকালে ফিরে-আসা ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর রইলো না। আর তার পরেই হঠাৎ যেন বিষম অবসাদে ভরে গেলো সে। গোয়েন্দা দুজনও অবশেষে হোটেলে ফিরে যেতে পেয়ে খুশি হয়ে উঠলো।

পরদিন সকালেই তারা নানকিং ছেড়ে চলে গেলো।

.

১২. পথে বেরুবার নানান ফ্যাচাং

ঘোড়ায় জিন-দিয়ে-আসা অচেনা লোকটিকে যদি সব চিনেরই প্রহেলিকা ঠেকতো, তাহলে তেমন দোষ দেয়া যেতো না। কাল কোথায় যাবে আজ যে জানে না, এমন ভ্রমণকারী সহজেই বিস্ময় ও সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। হোটেলে গিয়ে ওঠে, কিন্তু ঘণ্টা কয়েকের বেশি থাকে না। রেস্তোরাঁয় গিয় বসে, কিন্তু তড়িঘড়ি কিছু গিলেই বেরিয়ে পড়ে। খরচ করে দু-হাতে, কিন্তু সবসময়েই লক্ষ রাখে যাতে এত টাকার বদলে তাড়াতাড়ি পথ চলতে পারে সে।

স্পষ্ট বোঝা যায় যে সে ব্যাবসা দেখতে বেরোয়নি; কিংবা কোনো জরুরি কাজের ভার নিয়ে বেরিয়ে-পড়া মান্দারিনও সে নয়; প্রত্নতাত্ত্বিকও নয় যে পুরোনো মন্দির থেকে প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ বের করে দেখতে চায়; এমনও নয় যে ডিগ্রিলাভের জন্য ব্যস্ত কোনো প্যাগোডা-শিক্ষার্থী সে; বৌদ্ধ শ্রমণও নয় যে বোধিমের শিকড়ের টুকরো যে-সব পূজাবেদীতে রয়েছে ঘুরে-ঘুরে তা দেখতে বেরিয়েছে; কিংবা পাঁচ পাহাড়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া তীর্থযাত্রী বলেও তাকে মনে হয় না। অদ্ভুত এই লোকটা, এই কি-নান–আগাগোড়াই তার কেমন যেন রহস্যে ছাওয়া।

সেন্টেনারিয়ানের এই মক্কেলটির যেন সবসময়েই শশব্যস্ত ভাবে ঘুরেবেড়ানো ছাড়া আর-কোনো অভিপ্রায় নেই। সদাসতর্ক ক্রেগ আর ফ্রাই, আর তিতিবিরক্ত ও অবসন্ন সুনকে নিয়ে সে হুড়মুড় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে : উদ্দেশ্য তার দুটি এবং পরস্পরবিরোধী : যেমন সে ওয়াং এর হাত থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছে, তেমনি আবার অনাবিষ্কৃত সেই মানুষটিকে সে খুঁজেও বের করতে চাচ্ছে। একদিকে যেমন তার এই উভয়সংকট থেকে সেউদ্ধার পেতে চায়, তেমনি আবার সবসময় ঘোড়ায় জিন দিয়ে থেকে ওই সমুদ্যত দুর্বিপাক থেকেও রক্ষা পাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে তার; ঝোঁপের পাখির চেয়ে উড়ে-যাওয়া পাখিকে মারা বেশি কঠিন বলেই সে কোথাও স্থির হয়ে থাকতে চায় না।

নানকিং থেকে দ্রুতগামী একটি মার্কিন জাহাজে করে নীল নদী দিয়ে এগিয়ে ইয়াং-সি-কিয়াং হান-কিয়াং-এর মোহনায় হান-কৌ পৌঁছুলো তারা, আর সেই ভাসমান সরাইখানায় করে সেখানে পৌঁছুতে সময় লাগলো মোটে ষাট ঘন্টা। এই রাস্তাতেই চোখে পড়ে স্রোতের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি আশ্চর্য ও অতিকায় পাথর, যার উপরে বৌদ্ধমন্দিরে ভিক্ষু ও শ্রমণদের যাতায়াতের কোনো বিরাম নেই। লোকে এই আশ্চর্য পাথরটিকে ছোট্ট অনাথ বলে ডাকে : এটাকে দেখে মুগ্ধ হওয়া দূরে থাক, তারা এমনকী এটার দিকে একবার তাকালোই না।

অবশেষে হান-কৌতে কিন-ফো অর্ধেক দিনের জন্য বিশ্রাম নিতে রাজি হলো। প্রাচীন তাইপিং বিভীষিকার চিহ্ন হিশেবে পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপ, চারদিকে ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি পথঘাটের ছড়াছড়ি; কিন্তু ওয়াং-এর কোনো খোঁজই কোথাও পাওয়া গেলো না-না পাওয়া গেলো হাং-ইয়াং-ফোর সংলগ্ন ডানতীরের ব্যাবসাকেন্দ্রে, না-বা তাকে পাওয়া গেলো হৌ-পে প্রদেশের রাজধানী, বামতীরের উয়ো-চাং-ফোতে। নানকিং-এর সমাধিভবনে কিন-ফো সেই-যে রহস্যময় কতগুলি অক্ষর দেখেছিলো, তারও কোনো পুনরাবৃত্তি কোথাও দেখা গেলো না।

ক্রেগ আর ফ্রাই যদি ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখবার উদ্দেশ্য নিয়ে চিনের এ-সব অঞ্চলের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের তথ্য লিপিবদ্ধ করতে চাইতো, তাহলে তাদের অত্যন্ত নিরাশ হতে হতো। কারণ কোনো জায়গাতেই তারা ততক্ষণ থাকতো না, যতক্ষণে ভালো করে সব দেখা-শোনা যায়। এটা অবশ্য বলা উচিত যে বাঁচাল বা অতিভাষী নয় বলে তাদের কৌতূহল কম ছিলো। নিজেদের মধ্যেই তারা কম কথা বলতো, কিন্তু বেশি কথা বলার দরকারও তাদের তেমন ছিলো না। দুজনের চিন্তার ভঙ্গিই একেবারে একরকম, ফলে তাদের সব কথাবার্তাই শেষ পর্যন্ত কোনো একজনের স্বগতোক্তি বলে মনে হতো। এ-অঞ্চলের ভাস্কর্য সম্বন্ধে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না; চওড়া রাস্তা, সুন্দর বাড়ি-ঘর, কি ইওরোপীয় বসতির ছায়াঘেরা পথঘাট-কোনো-কিছুকেই তারা তারিফ করতো না; বেশির ভাগ চিনে শহরেই যে শহরের ঠিক মাঝখানটাকে মরা, আর আশপাশকে জ্যান্ত বলে মনে হয়–এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটির দিকেও নজর দেবার মতো অবস্থা তাদের ছিলো না।

লাও-হো-কৌ পর্যন্ত আরো একশো মাইল পর্যন্ত নাব্য হান-কিয়াং; জাহাজটি সেই উদ্দেশে রওনা হবার উপক্রম করলো, কিন-ফোও অমনি বাকি পথটুকু চলে যাবে বলে ঠিক করে নিলো। তার দুই দেহরক্ষীও এই সিদ্ধান্তে বেশ খুশি হয়ে উঠলো, তার কারণ এই যে ডাঙার চেয়ে জলপথে বিপদ-আপদের সম্ভাবনা অনেক কম–আর জাহাজে গেলে তাদের পক্ষে আরো কড়া নজর রাখার সুবিধে হয়। সুন তো তাদের চেয়েও বেশি খুশি। তার মেজাজের সঙ্গে জাহাজের জীবন দিব্যি খাপ খায়। অন্তত, হাঁটতে তো হবে না, তাছাড়া কাজ-কর্মেরও দরকার হয় না জাহাজে–কারণ ক্রেগ আর ফ্রাই তার প্রভুর যাবতীয় ফাইফরমাশ খেটে দেয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিরেট করবার জন্য। জাহাজের একটা ছোট্ট কামরায় আরাম করে পড়ে পড়ে নাক ডাকায় সে সারাদিন, আর ঠিক কেমন করে যেন খাবার সময়গুলোতে জেগে যায় : সুখাদ্যকে তারিফ করার মতো আভিজাত্য ও সুরুচি তার আছে। দু-এক দিন সাধারণ খাদ্যতালিকায় ছোটোখাটো কিছু পরিবর্তন দেখে বোঝা গেলো তারা আরো উত্তরে এসে পৌঁছেছে। ভাতের বদলে খামিরহীন রুটির মতো গম খেতে হলো তাদের গরম-গরম খেলে বেশ ভালোই লাগে তা। খাঁটি দক্ষিণীরা অবশ্যি কাঠের চামচে দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যেস ভুলতে পারে না বলে সহজে তাদের এই নতুন খাদ্য মুখে রুচতে চায় না। সময় মতো তাকে চা আর ভাত জুগিয়ো, তাহলেই দেখবে দক্ষিণীর সন্তোষের শেষ নেই : জাহাজের ভালো রান্নার চেয়ে তার ওই অভ্যস্ত খাদ্য বেশি ভালো লাগে।

আসলে তারা এবার গম-প্রধান অঞ্চলে এসে প্রবেশ করেছে; এখানকার মাটি শুকনো, দিগন্তে দেখা যায় মিং রাজাদের তৈরি কালো-কানো দুর্গ-ওলা গিরিশ্রেণী। কৃত্রিম পাড়ের স্বাভাবিক খাতের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় জলস্রোত-নদী ক্রমশ চওড়া কিন্তু ঘোলাটে হয়ে আসে।

ইউয়েন-লো-ফুর বন্দরে শুল্ক বিভাগের পাশে কয়েক ঘণ্টা থেমে রইলো জাহাজ; জ্বালানির ব্যবস্থা হয় এখান থেকে–তাইতেই এত সময় নেয়; কিন-ফো কিন্তু তীরে নামলো না। কেন নামবে সে তীরে? এখানে তার দেখবার কিছু নেই; তার একমাত্র উদ্দেশ্য এখন হলো বিশাল চিন-দেশের মাঝখানে একেবারে হারিয়ে-যাওয়া, যেখানে সে যদি দৈবাৎ ওয়াং-এর মুখোমুখি না-পড়ে তো ওয়াং-এর পক্ষে তাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে।

ইউয়েন-লো-ফুর পরে নদীর দুইপাশে মুখোমুখি দুটো শহর আছে। তার একটা ফান-চেংমস্ত শহর, লোকসংখ্যা প্রচুর; অন্যটা সিয়াং-ইয়াং-ফু–সদর শহর, কর্তাব্যক্তিরাও থাকেন বটে, কিন্তু কেমন যেন মরা বলে মনে হয় একে। এখানে এসেই নদী উত্তরে মোড় বেঁকেছে লাও-হো-কৌর দিকে তার পরের অঞ্চল আর নাব্য নয়।

এখান থেকে ভ্রমণ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা চেহারা নিলে। নদীর সেই মসৃণসুন্দর প্রবহমানতার বদলে এবার বন্ধুর ও বনাকীর্ণ পথ দিয়ে যেতে হলো তাদের; দিব্যি ভেসে যাচ্ছিলো জাহাজে করে এতকাল, এখন আদিম যানবাহনের জন্য পদে-পদে ধাক্কা ও ঝাঁকুনি লাগলো। সুন বেচারার প্রায় যা-দশা। জাহাজের এই আরামের পর এই রাস্তা তার কাছে সর্বনাশের নামান্তর বলে মনে হলো। এই পথ দিয়েই ধুঁকতে-ধুঁকতে চলতে হবে তাকে, অবসাদ আর গালাগাল ছাড়া আর-কিছুই জুটবে না বরাতে।

সত্যি বলতে কিন-ফোর দুর্দান্ত ভ্রমণপথের সঙ্গী হওয়াটা কারু পক্ষেই মোটেই ঈর্ষণীয় নয়। কোথাও থামা চলবে না, এই একটা কথা সে মনে-মনে জেনে নিয়েছে; ব্যস, আর কোনো সুবিধে-অসুবিধে বাধা-বিপত্তির কথা সে ধর্তব্যেই আনে না। শহর থেকে শহরে গেলো সে হুড়মুড় করে, পেরিয়ে এলো প্রদেশের পর প্রদেশ। কখনো তার গাড়ি হলো খচ্চরে-টানা চাকা বসানো ছাত-খোলা এক বাক্স, উপরে একটা ক্যানভাসের ঢাকা নামেই আছে, তাতে রোদবৃষ্টি কিছুই আটকায় না; অন্য সময়ে তার যান হলো খচ্চরে-টানা চেয়ার–দুটি বাঁশের উপর ঝোলানো ক্যানভাসের চাদরে তাকে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হলো, আর সমুদ্রে টাইফুন উঠলে জাহাজ যেমন এ-কাৎ ও-কাৎ হয় তেমনিভাবে তাকে নিয়ে যেন লোফালুফি খেললো খচ্চরগুলি। ক্রেগ আর ফ্রাই দুটো হাড়জিরজিরে গাধার পিঠে চড়ে–তার গতি আবার এমন যে খচ্চরে-টানা চেয়ারের চেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক নয়–দু-পাশ দিয়ে গেলো রাজার দেহরক্ষীর মতো। আর সুন পিছনে এলো গোঙাতে-গোঙাতে গজরাতে গজরাতে পায়ে হেঁটে–যখনই মনে হয় যে এত জোরে হাঁটলে মরে যাবে তখনই গলায় ব্রাণ্ডির বোতল উপুড় করে খানিকটা সান্ত্বনা নেয়– আর অবশ্য তার টলটলায়মান অবস্থার জন্য কেবল রাস্তাকেই দোষ দিলে ভুল হবে।

পরে অবশ্য খচ্চর আর গাধা দুইই বাতিল করে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে কিন ফো তার অবসন্ন সঙ্গীদের নিয়ে প্রাচীন তাং রাজাদের রাজধানী সিন-গান-ফুতে ঢুকলো। পথে অবশ্য প্রচুর ফাঁকা সবুজের নামগন্ধহীন প্রান্তর পেরুতে হলো, সুদূর শেন-শি প্রদেশের এই নগরে প্রবেশ করার আগে তাদের কষ্ট ও ক্লান্তি অবশ্য সহ্যের সীমা ছুঁয়ে ফেললো। তার একটা কারণ ছিলো গরম–একে মে মাস, তায় জায়গাটার অক্ষরেখা দক্ষিণ স্পেনের মতো–গায়ে প্রায় ফোশকা পড়ার দাখিল। মেঘের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে হলুদ ধুলো ওড়ে বড়ো রাস্তায়, সব ঢেকে যায় কুয়াশার মতো, পা থেকে মাথা অব্দি ধুলোয় ভরে যায় পথিকদের। লু-ওঠা অঞ্চল এটা; ভূতাত্ত্বিক সংস্থান কেবল উত্তর-চিনের দ্বারাই সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত–লিয় রুসে বলেছেন, এখানে না আছে মাটি, না বা পাথর-বরং বলা ভালো নিরেট আর শক্ত হবার আগে পাথরের দশা যে-রকম হয়, সেই হবু-পাথরেই দেশটা গড়া। তাছাড়া প্রাণের ভয়ও এখানে তুষ্ট করার মতো নয়; পুলিশও গুণ্ডাবদমাশদের ছুরির ভয়ে থরথর কাপে; রাতে এ-সব জায়গায় বড়ো শহরেরও কেউ বাড়ি ছেড়ে এক পা বেরোয় না, কারণ পুলিশ। সব ভার যেন গুণ্ডাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। ফলে রাস্তায়-ঘাটে যে নিরাপত্তার নামগন্ধও নেই, এটা বোধহয় উল্লেখ না-করলেও চলে। বার কয়েক ওই ধুলোর ঝড় কুঁড়ে কয়েকদল সন্দেহ-জাগানো লোকের আবির্ভাব হয়েছিলো; কী কু-মলব ছিলো কে জানে, কিন্তু ক্রেগ আর ফ্রাই-এর কোমরবন্ধে রিভলভার দেখে তারা তেমন কিছু না-করেই সরে পড়েছে। তবু চারদিক দেখে শুনে ক্রেগ রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো; দস্যুই মারুক আর ওয়াংই মারুক–কিন-ফো প্রাণ হারালে সেন্টেনারিয়ানের হাল সেই একই হবে। কিন-ফোও যে একেবারে ভয় পায়নি, তা নয়, নিজের নিরাপত্তার জন্য তার দুশ্চিন্তার আর শেষ ছিলো না; জীবন সম্বন্ধে তার সব ধারণা আগাগোড়া বদলে গেছে, ফলে সে যেন জীবনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাচ্ছে এখন। তার দশা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে গিয়েই সে যেন এখন মরো-মরো-যুক্তির বালাই না-রেখে ক্রেগ আর ফ্রাই অন্তত তা-ই ভাবলে।

সিংনানফুতে ওয়াং-এর সঙ্গে দেখা হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কোনো তাই-পিং এখানে মাথা গোঁজার কথা ভাবতেই পারবে না। বিপ্লবের সময় তারা কখনোই এখানকার প্রকাণ্ড মাঞ্চু কেল্লাটির মস্ত দেয়াল বেয়ে উঠতে পারেনি। যদি অবশ্য এমন হয় যে দার্শনিকপ্রবর অবশেষে পুরাতাত্ত্বিক কৌতূহলে এখানকার রহস্যময় শিলালিপিগুলি দেখতে এসেছে–এখানকার জাদুঘরে শিলালিপির সংখ্যা এত যে লোক জাদুঘরটাকে প্রস্তরফলকের অরণ্য বলে ডাকে-এসে থাকলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা; না-হলে অন্তত এই অঞ্চলটি সে। সর্বাবস্থাতেই এড়িয়ে যেতে চাইবে।

মধ্য-এশিয়া, তিব্বত, মোঙ্গোলিয়া আর চিন–এই চারদেশের মধ্যে বাণিজ্য চালায় বলে শহরটির নানা দিক দিয়ে গুরুত্ব রয়েছে। ব্যাবসার জমজমাট অবস্থা দেখে অন্য লোক হলে হয়তো কিছুদিন এখানে থেকে যেতো, কিন্তু কিন-ফো পৌঁছুনো মাত্রই আবার যাবার জন্য পা বাড়ালো। উত্তর দিকেই এগুতে লাগলো সে, হোয়ে-হো নদীর অধিত্যকা দিয়ে সেই হলুদ নদীর স্রোত ধরে এগুলো তারা : শুকনো খটখটে ডাঙার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে নদী। কায়ো-লিন-সিয়েন আর নিং-তং-সিয়েন পেরিয়ে পৌঁছুলো হোয়-চুতে, ১৮৬০ সালে যেখানে মুসলমানরা এক ভীষণ রক্তরাঙা দাঙ্গাহ্যাঙামার সৃষ্টি করেছিলো। রাস্তা তারপরে আরো ক্লান্তিকর হয়ে উঠলো; কখনোবা নৌকোয় কখনো-বা হেঁটে শেষকালে তারা হোয়ে-হো আর হোয়াংহো নদীর মোহনায় অবস্থিত তং-কোনানের দুর্গে এসে পৌঁছুলো।

হোয়াং-হো হলো সুবিখ্যাত হলুদ নদী। উত্তর থেকে বেরিয়ে পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে সে অবশেষে পীত সমুদ্রে পড়েছে। পীত সমুদ্র অবশ্য তেমনি পীতবর্ণ, যেমন কৃষ্ণবর্ণ কৃষ্ণসাগর, বা যেমন আরক্ত লোহিত সাগর। হলুদ যেহেতু রাজবর্ণ বলে সম্মানিত, সেইজন্য নাম শুনে মনে হয় এই নদী বোধ করি স্বর্গ থেকেই বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু এর আরেক নাম চিনের দুর্দশা। প্রতি বছর এর জলস্রোত স্ফীত হয়ে যে-তাণ্ডব চালিয়ে যায়, তাতেই এই নাম হয়েছে তার।

তং-কোনান কোনো বাণিজ্যকেন্দ্র নয়, বরং একটি সামরিক শিবির সাধারণ মাঞ্চু তাতারদের একটা বাহিনী থাকে এখানে-চিনে ফৌজের কোনো নামকরা বাহিনী এটা নয়। সেই জন্য কিন-ফোর সঙ্গীরা এই আশা লালন করেছিলো যে কোনো ভালো হোটেল দেখলে কিন-ফো বুঝি এখানে কয়েকদিন জিরিয়ে নেবে; তা-ই হয়তো শেষ অব্দি হতো, যদি-না সুন বেচারা একটা মস্ত আহামুকি করে বসততা। সব সাবধানতা ভুলে গিয়ে শুল্কদপ্তরে বেমক্কা কিন-ফোর আসল নাম দিয়ে বসলো বোকারাম–ছদ্মনাম কি-নানের কথা সে একেবারে ভুলে গিয়েছিলো। এই ভুলের ফলে সাধের শূকরপুচ্ছের একটা মস্ত অংশ হারাতে হলো তাকে, কিন্তু খবরটা তক্ষুনি একেবারে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। কিন-ফো এসেছে–একশো বছর যে বাঁচতে চেয়েছে, সেই লোকটা কিনা সশরীরে এই শহরে বর্তমান! তক্ষুনি পথচারীটির চারপাশে মস্ত ভিড় জমে গেলো; ফলে অমনি চম্পট দেবার ব্যবস্থা করতে হলো তাকে আর তার সঙ্গে যেতে হলো ক্রেগ আর ফ্রাইকেও–যেন তার সঙ্গে তাদের নাড়ির যোগ আছে; কুড়ি মাইল দূরে একটা অজ পাড়াগাঁয়ে এসে যখন ক্লান্তিতে ও অবসাদে তারা আধমরা হয়ে পড়লো, কেবল তখন থামলো-মনে-মনে ভাবলো এখানে বুঝি আবার অপরিচয়ের অন্ধকারে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারবে।

ওই বেমক্কা ভুলটুকু করে আহাম্মক সুন নিজের উপর যে-দুঃখ ডেকে আনলো, তা নেহাৎ হেলাফেলার নয়। প্রিয় ভৃত্যের এই উজবুম্মুখখা কাণ্ডয় প্রভুটি এতই রুষ্ট ও বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি আর দৃপাত না-করে তার সাধের বেণীর একটা মস্ত অংশ কেটে দিলেন কচ করে; বেণীর ধ্বংসাবশেষ যতটুকু মাথায় রইলো, তা বেচারাকে সব লোকের উপহাস ও টিটকিরির পাত্র করে তুললো। রাস্তায় বেরুলেই ছেলের পাল তাকে ঘিরে আওয়াজ দেয়। ফলে বেচারা মনে-প্রাণে এই বিষম ভ্রমণের অবসানই কামনা করতে লাগলো শুধু।

কিন্তু অবসান কোথায়? বিডুলকে তো কিন-ফো বলেই ছিলো যে-দিকে দু-চোখ যায় নাক বরাবর সোজা সেই দিকেই যেতে থাকবে সে–আর এই জন্যই বুক বেঁধে পথে বেরিয়েছে সে।

যে-ছোট্ট অজ পাড়াগাঁয়ে তারা এসে আস্তানা গেড়েছে, সেখানে না-আছে ঘোড়া বা গাধা, না-আছে খচ্চরে-টানা গাড়ি বা খজুরে চেয়ার। অথচ শিগগিরই আবার বেরিয়ে-পড়া উচিত তাদের। গতিক দেখে মনে হলো পদব্রজে হন্টন ছাড়া আর-কোনো পথ বুঝি খোলা নেই। হন্টনে অবশ্য কিন-ফোর মোটেই রুচি নেই, কারণ নাক বরাবর যত পথই সে যেতে চাক না কেন, পদব্রজে বেশি দূর যাবার কথা সে কস্মিন কালেও ভাবেনি। এটা অস্বীকার করার জো নেই যে এ-ক্ষেত্রে সে আদৌ কোনো বিচক্ষণ দার্শনিকতার পরিচয় দিলে না। গজগজ করতে শুরু করলো সে, খেঁকিয়ে উঠলো বারে-বারে, মেজাজ তার চড়েই রইলো সপ্তমে। আস্ত জগৎকে দায়ী করলো সে নিজের এই দশার জন্য, সঙ্গীসাথীদের যে কত গালাগাল দিলে, তার তো কোনো হিশেবই নেই। যদিও এটা তার ভাবা উচিত ছিলো নিজের এই বিপত্তির জন্য নিজেই সে সম্পূর্ণ দায়ী। অতীতের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো অবিরাম–তখন কোনো চিন্তা বা দুশ্চিন্তা ছিলো না তার–দিব্যি ছিলো। ঘোষণা করলো যে যদি আমার স্বাচ্ছন্দ্যের পূর্ণ মর্যাদা দেবার জন্য দুঃখ-বিপত্তির অভিজ্ঞতা দরকার হয়, তাহলে ইহলোকের এই জীবনের উপযোগী দুঃখকষ্ট সে প্রচুর ভোগ করে ফেলেছে এর মধ্যেই। আর, কোন অভিজ্ঞতাই বা হয়নি তার এই ক-দিনে? সে কি দ্যাখেনি কানাকড়ি না-নিয়েও লোকে দিব্য তুষ্ট ও সুখী বেঁচে থাকে? সে কি সেই চাষীদের দ্যাখেনি, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু-মুঠো অন্ন জোগাড় করেও দিব্যি হাসিমুখে বেঁচে থাকে? গান গেয়ে-গেয়ে কাজ করতে দ্যাখেনি কি সে মিস্ত্রিদের? হয়তো শুধু কাজকর্মের মধ্যে দিয়েই লোকে সত্যিকার সুখ পেতে পারে। অন্তত এই ধারণায় তার সন্দেহ নেই যে, তার মতো পোড়া কপাল, আর-কারু নেই।

ক্রেগ আর ফ্রাই কিন্তু এর মধ্যে যানবাহনের জন্য সারা গাঁ তোলপাড় করে ফেলেছে। সহ্যের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছেছে তারা, মরিয়াদশা যাকে বলে; শেষকালে সারা গাঁ তছনছ করে অবশ্যি একটা শকট জুটলো-কিন্তু তাতে আবার মাত্র একজন লোক বসতে পারে; কিন্তু তাতেও অবস্থার কোনো হেরফের হলো না; শকট জুটলে কী হবে, সেটা চালাবার উপায় কী?

গাড়িটা হচ্ছে এক চাকার হাত-গাড়ি-পাড়াগাঁয়ের লোকরা মাল-পত্র আনা-নেয়ার জন্য ব্যবহার করে। প্যাম্পালের এই ঠেলাগাড়ি বোধকরি আদ্যিকালের, নাবিকদের নিদর্শক কি গোলন্দাজদের ভীষণ বারুদ আবিষ্কার হবারও আগের জিনিশ। চাকাটা সামনে বসানো নয়, মাঝখানে–পাটাতনের ঠিক তলায়। পাটাতনটা দু-ভাগে ভাগ করা, একদিকে বসে যাত্রী নিজে, অন্য দিকে তার মালপত্তর। পিছন থেকে ঠেলে-ঠেলে চালিয়ে নিয়ে যায় চালক–যাত্রীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখায় বিঘ্ন ঘটায় না। মাঝে-মাঝে একটা মাস্তুল দাঁড় করিয়ে চৌকো পাল তুলে দিলে অনেক কাজে আসে–হাওয়া অনুকূল থাকলে অধীর যাত্রীকে আশাতীত দ্রুতবেগে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়।

ঠেলাগাড়িটা ভাড়া দেবে কোন বোকচন্দ্র? দরকার হলে ওই পালমাস্তুল সবসমেত কিনে নিতে হবে। কেনাই হলো শেষ অব্দি–এবং কিন-ফো গিয়ে গাড়ির উপরে বসলো।

চল এবার, সুন, কিন-ফো বললো।

যাচ্ছি, বলে সুনও গাড়ির উপর উঠে বসবার উপক্রম করলো।

না, না, ওখানে মালপত্তর থাকবে, কিন-ফো চেঁচিয়ে বাধা দিলে।

আর আমি? সুন যেন পথেই বসে পড়ে।

গাড়ির পিছনে বামে গিয়ে দাঁড়া, কিন-ফো অধীর হয়ে নির্দেশ দিলো।

ক-কোথায়?–কেন… সুন তোলাতে থাকলো, কিন-ফোর কথা তার মাথায় ঢুকছে বলে মনে হলো না; রেসের পরে ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার হাঁটুর জোড় যেমন খুলে যেতে চায়, তারও দশা তখন সেই রকম।

শুনলি? কঁচির মতো আঙুল দিয়ে ঘ্যাচাং করার ইঙ্গিত করলো কিন-ফো, যার মর্মার্থ সুন মর্মে-মর্মেই অনুভব করতে পারলো।

আর-কোনো কথা না-বলে সুন পিছনে গিয়ে হাতল ধরে দাঁড়ালো। হাওয়া অনুকূল ছিলো তখন, পাল তোলা হয়েছিলো আগেই; ক্রেগ আর ফ্রাই দু-পাশে নিজেদের স্থান নিলে। জোর কদমে যাত্রা শুরু হলো। প্রথমে কোচবাক্সের ঘোড়ার স্থান নিতে হলো বলে সুন রেগে টং হয়ে গিয়েছিলো, গজরাতে-গজরাতে ঠেলছিলো গাড়িটাকে; শেষকালে যখন ক্রেগ আর ফ্রাইও মাঝে-মাঝে সাহায্য করতে এলো ধাক্কা দিয়ে, তখন তার জ্বলুনি খানিকটা হ্রাস পেলো। আসলে তখন অন্তত খুব-একটা বেশি পরিশ্রম হচ্ছিলো না তাদের। দক্ষিণের হালকা হাওয়ায় আপনা থেকেই যাচ্চিলো গাড়িটা-তাদের কাজ অনেকটা ছিলো শাম্পানের সারেং-এর মতো হাল ধরে বসে-থাকা।

যখন হাত-পায়ের আড়মোড়া ভাঙার দরকার হয়, তখন গাড়ি থেকে নেমে পড়ে কিন-ফো; আর যখন হাঁটতে কষ্ট হয়, তখন পাটাতনে উঠে বসে : আর এইভাবেই আরো উত্তর দিকে এগিয়ে গেলো তারা। হোনন-ফু আর কাফং এড়িয়ে, রাজাখালের পথ ধরে এগুলো সে; কুড়ি বছর আগে দুম করে যখন সব ছারখার করে হোয়াং-হো তার পুরোনো খাতে বইতে শুরু করে, তখন থেকে রাজাখাল রাজধানী থেকে চা-বাগান অঞ্চল অবধি মস্ত এক রাজপথে পরিণত হয়ে যায়। সিনান আর হো-কিয়েনের মধ্যে দিয়ে অবশেষে। পে-চিলি প্রদেশে পৌঁছোলো তারা, তারপর পেইচিঙের উদ্দেশে রওনা হলো।

রাস্তায় তিয়েন-সিন বলে মস্ত একটা শহর পড়লো–জনসংখ্যা তার চার লক্ষ, শহরের চারপাশে মস্ত প্রাচীর আর দুটো কেল্লা রয়েছে শত্রু প্রতিরোধ করার জন্য। পাই-হো আর রাজাখালের মোহনায় এই শহরের প্রধান বন্দর অবস্থিত-জাহাজ ভিড়তে পারে এই বন্দরে-বছরে কয়েক কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি চলে এখানে; কুল, জলপদ্ম, তাতারি তামাক এ-রকম নানা ধরনের প্রাচ্যদেশীয় জিনিশ চালান যায় এখান থেকে; আমদানি হয় আরো-সব বিচিত্র জিনিশচন্দন কাঠ, নানা ধাতুখণ্ড, পশম–আর ল্যাঙ্কাশিয়র থেকে আসে কলে-বোনা বসন।

জায়গাটা নানা দিক থেকে কৌতূহলোদ্দীপক–কিন-ফো অবশ্য তাই বলে এখানে থেমে-পড়ার কথাই ভাবলে না। যেমন সে নরককুণ্ডের প্যাগোডাটি দেখতে গিয়ে সময় নষ্ট করলো না, তেমনি লণ্ঠনসরণিতে গিয়ে বিখ্যাত ঝাড়লণ্ঠনগুলি দেখে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলে না। মুসলমান মালিক লিওন লাও-কির বিখ্যাত রেস্তোরাঁ সমতান ও মৈত্রীগৃহে গিয়ে আহার করা দূরে থাক, ওখানকার বিখ্যাত সুরা পর্যন্ত চেখে দেখলো না; এমনকী রাজ্যপাল লি-চোং-তাং এর প্রাসাদে গিয়ে নিজের নামাঙ্কিত লাল কার্ড পাঠাবার কথা পর্যন্ত সে বিবেচনা করলো না একবারও-১৮৭০ সাল থেকে ইনি এখানকার লাটসাহেব, অমাত্যসভার অন্যতম সদস্য; পীত বসন পরেন ইনি, খেতাব পেয়েছেন ফ্রাই-ৎজে-চাও-পাও। এ-সবের কিছুতেই কোনো আকর্ষণ বা কৌতূহল ছিলো না কিন-ফোর-চলা ছাড়া আর-কিছুই যেন সে এখন জানে না। লবণভরা বস্তা পড়ে আছে জেটির দু-পাশে, তার মধ্যে দিয়ে কোনোদিকে দৃপাত না-করেই এগিয়ে গেলো; পেরিয়ে গেলো মার্কিন ও ইংরেজ বসতি, বিখ্যাত ঘোড়দৌড়ের মাঠ, শহরতলির সুন্দর ভূদৃশ্য; আঙুর খেত আর ফলবাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়ে গ্রামের রাস্তায় এসে পড়লো সে। দু-পাশে মস্ত মাঠ গেছে দিগন্ত অব্দি–যব, তিল, আখের খেত পড়ে আছে পর পর মাঠ জুড়ে; সবুজ বনের কাছে খরগোশ, তিতির আর ঘুঘু পাখি ঘুরে বেড়ায়, আর বাজপাখির শিকার হয় হাজারে-হাজারে।

শান-বাঁধানো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে তারা এবার : ষাট মাইল ধরে এই রাস্তা চলবে; এক পাশে নানা ধরনের গাছপালা, অন্যপাশে নদীর তীর ঘেঁষে চলেছে জংলি জলা ঝোঁপঝাড়। সোজা পেইচিং পৌঁছে যেতেই তারা এই রাস্তা ধরে গেলে–কিন্তু পথে তং-চুতে একবার থামতে বাধ্য হলো তারা–কিন-ফো তার এই হুড়মুড় পলায়নে কাতর ও মোহ্যমান, ক্রেগ আর ফ্রাই ঠিক আগের মতো সতেজ ও অক্লান্ত; সুন–ধূলিমলিন ও খঞ্জ এবং মাত্র দু-এক ইঞ্চিতে পর্যবসিত তার বেণীর শোকে আকুল ও আর্ত।

জুন মাসের উনিশ তারিখ আজ। এই রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠার অবসান হতে আরো ছ-দিন বাকি। এ-পর্যন্ত অবশ্য কোথাও ওয়াং-এর বেণীর ডগাটিও দেখা যায়নি। কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে সে-কে জানে।

.

১৩. দৌড়! দৌড়! দৌড়!

কিন-ফো যখন তার ওই ঠেলাগাড়িতে করে পেইচিঙের মাইল দশেক আগে তং চু শহরে পৌঁছলো, তখন হঠাৎ ঘোষণা করে বসলো যে ওয়াং-এর সঙ্গে ওই বিষম চুক্তির মেয়াদ না-ফুরোনো অব্দি এখানেই সে থেকে যাবে।

চার লাখ লোক যে-শহরে থাকে, সেখানে বোধহয় আমি বেশ খানিকটা নিরাপদ, বললো কিন-ফো, কিন্তু সুন যেন এটা মনে রাখে যে সে শেন-সী প্রদেশের ব্যাবসাদার কি-নানের কাছে চাকরি করে; না-হলে–

সুন তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে জানালো যে দ্বিতীয়বার এই নির্দেশ ভোলবার পাত্তর সে নয়; একবার আহাম্মকি করেই যে-ফল পেয়েছে, তাতে আবার সেই একই-ভুল করার মতো বুকের পাটা তার নেই; তার আশা এবার তাকে যেন কিন-ফো (কি-নান, একযোগে বাধা দিয়ে বলে উঠলো ক্রেগ আর ফ্রাই) তার যোগ্য কাজে বাহাল করে–যেন ঘোড়ার মতো তাকে গাড়িতে জুতে না-দেয়; আরো ঘোষণা করলো যে তার সঙ্গে নাকি এখন কোনো। মৃতদেহের পার্থক্য নেই–এতই ক্লান্ত সে; আশা করে কিন-ফো (কি-নান, আবার ক্রেগ আর ফ্রাই একযোগে এমনভাবে তাকে শুধরে দিলো যে মনে হলো তাদের বাক্যন্ত্র বুঝি একটাই) তাকে অন্তত আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমুবার অনুমতি দিয়ে হৃত শক্তি ফিরে পেতে দেবেন।

যা, ইচ্ছে হলে এক হপ্তাই নাক ডাকা গে, তার প্রভু জানালেন, কারণ যত বেশি ঘুমুবি, তত কম আবোলতাবোল বকবি।

তং-চুতে হোটেলের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু সহজে আত্মগোপন করে থাকা যায়, এমন-একটা হোটেলই বেছে নিতে হবে কিন-ফোকে, তার অভিপ্রায়ের পক্ষে তেমন-কোনো হোটেলেই হবে সবচেয়ে বড়ো সহায়। শহরটা আসলে পেইচিঙেরই মস্ত এক শহরতলিশান-বাঁধানো যে-রাস্তাটি দিয়ে দুই শহরের যোগাযোগ ঘটেছে, তার দু-পাশ দিয়েই সারি-সারি ভিলা ও গোলাবাড়ি গেছে একটানা, আর শহর দুটি থেকে এত লোক নিত্য যাওয়া-আসা করে যে রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া লোকজনের স্রোত সবসময় অফুরানভাবে উপচে পড়ে।

জায়গাটা কিন-ফোর চেনা বলেই তাই-ওয়াং-মিয়ার উদ্দেশেই এগুলো সে। তাই-ওয়াং-মিয়া নামটির অর্থ যুবরাজের দেবালয়; এটি ছিলো ধর্ম প্রতিষ্ঠান, সম্প্রতি এটাকে হোটেল বানানো হয়েছে–একজন আগন্তুক যা-যা কাম্য বলে মনে করতে পারে, তার সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে এখানে। নিজের জন্য একটা কামরা ভাড়া করলো কিন-ফো; পাশের ঘরেই ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দিলো আর সুনের জন্যও যোগ্য ব্যবস্থা করা হলো–তারপরেই সুনের আর-কোনো পাত্তা নেই–মুহূর্ত মধ্য নিজের ডেরায় গিয়ে সে হাত-পা ছড়িয়ে দিলো।

ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে বেশ চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে তবে তিনজনে চারপাশে নজর দেবার অবসর পেলো। স্থানীয় একটা খবর-কাগজ জোগাড় করে প্রথমেই এটা দেখা দরকার তাদের কাজে লাগবার মতো কোনো খবর বেরিয়েছে কিনা; ফলে যথারীতি কিন-ফোকে মাঝে রেখে ক্রেগ আর ফ্রাই সরু ঘিঞ্জি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো; কেউ যাতে খুব-একটা কাছে ঘেঁষতে না-পারে, সেইজন্য দুজনে চেষ্টার ত্রুটি করলো না। বন্দরের কাছে সরকারি বার্তাবহ কাগজটির আপিশ; যথাকালে সেখান থেকে একটি চলতি সংখ্যা কিনে নেয়া হলো। কিন্তু ওয়াংকে খুঁজে বের করতে পারলে দু-হাজার ডলার ইনাম মিলবে, এই বিজ্ঞাপনটি ছাড়া তাদের আকর্ষণ করার মতো কোনো খবর পাওয়া গেলো না।

এখনো ওর পাত্তা মেলেনি তাহলে? বললো কিন-ফো, অবাক কাণ্ড! কোথায় গিয়ে লুকোলো ও?

সত্যিই কী আপনার মনে হয় তিনি চুক্তির শর্ত পালন করবেন? বাক্যটাকে দু-ভাগ করে জিগেশ করলো ক্রেগ আর ফ্রাই।

সন্দেহ করার অবকাশ কই? উত্তর দিলো কিন-ফো। আমার অবস্থা যে সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, তার তো বিন্দুবিসর্গও ও জানে না। তাই ও কী করে আন্দাজ করবে যে আমার মনোভাবও পালটে গেছে। এই ছ-দিনে বিপদের আশঙ্কা মোটেই কম নেই–বরং আগের চেয়ে আরো-বেশি সংকটজনক–বলা যায়।

খুব সাবধানে থাকবেন আপনি, তারা বললো। বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করবেন।

কিন-ফো জিগেশ করলো, সেটা কী?

এ-বিষয়ে ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের ঐক্যমত দেখা গেলো : ভিন্ন-ভিন্ন তিনটে পথ খোলা আছে তার সামনে; হোটেলে নিজের কামরার দরজা-জানলা বন্ধ করে বলা কোনোক্ষেত্রেই পাদমেকং ন গচ্ছামি, কিংবা কোনো ছোটোখাটো দুষ্কর্ম করে জেলে যাওয়া–জেলখানার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর কোথায় আছে? কিংবা এই গুজবটা ছড়িয়ে দেয়া যে তার মৃত্যু হয়েছে–তারপর বিপকাল উত্তীর্ণ হবার সময় পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকা।

কোনো প্রস্তাবই কিন-ফোর মনে ধরলো না। মুহূর্তমাত্ৰ ইতস্তত না-করেই সে প্রস্তাব তিনটেকে অগ্রাহ্য করে বসলো–এটা সে ভালো করেই জানে যে ওয়াং যদি একবার স্থির করে থাকে তার প্রতিশ্রুতি সে রাখবেই, তবে হোটেল, জেলখানা কি গোরস্থান কোনো কিছুই তার কাছে দুর্ভেদ্য বাধা বলে ঠেকবে না।

না, সে বললো, ও-সব হবে না। আমি কয়েদি বনে যেতে চাই না।

ক্রেগ আর ফ্রাইকে ঈষৎ সংশয়াকীর্ণ দেখলো; প্রতিবাদ করতে যাবে, এমন সময় কিন-ফোই আবার অত্যন্ত নিশ্চিত ভঙ্গিতে বললো, আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তা-ই করবো। কম্পানির যে দু-লাখ টাকা বাঁচাবার জন্য আপনারা এসেছেন, তা বিপন্নই থাকুক না-হয়।

কম্পানির প্রতি তো আমাদের একটা কর্তব্য আছে, তারা বললো।

আমিও আমার নিজের প্রতি কর্তব্য পালন করবো–আমার নিজের ধরনেই অবিশ্যি। এটা ভুলে যাবেন না যে এ-বিষয়ে আমার নিজের স্বার্থ আপনাদের চেয়ে বহু গুণ বেশি। যাই হোক, আমার পরামর্শ শুনুন–চোখ–কান খোলা রাখুন, যথাসাধ্য চেষ্টা করুন আমাকে বাঁচাবার জন্য, আর দয়া করে নিজেকে বাঁচাবার জন্য আমি যা-যা করি, তার উপর আস্থা রাখুন।

এর পরে আর-কীই বা বলার থাকে! সদাজাগ্রত সতর্কতা ছাড়া আর-কীই বা করার থাকে এর পর? যে-কাজের দায়িত্ব তারা নিয়েছে, পরের কয়েকদিনে তা যে চরম সংকটে পৌঁছুবে, এতে তাদের সন্দেহ ছিলো না।

তং-চু চিনদেশের প্রাচীন শহরগুলির অন্যতম বলেই তার জনসংখ্যাও বিপুল হয়ে উঠেছে। পাই-হো নদী থেকে কেটে-বের করা একটি খালের পাশে গড়ে উঠেছে এই শহর, আর সেই খালের গায়ে পেইচিং থেকে এসে-পড়া আরেকটি খাল এসে মিশেছে বলে তংচুর বন্দর পরিবহণ ব্যবস্থার একটা মস্ত কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরে কোনো নতুন লোক এসে কেবল-যে জেটির স্ফীত চঞ্চল জনসমুদ্র দেখে বিস্মিত হবে তা নয়, বন্দরে ভিড়-করে থাকা অগুন্তি শাম্পান আর পাল-তোলা জাঙ্ক দেখেও কিঞ্চিৎ অভিভূত হবে।

এত ভিড় দেখেই ক্রেগ আর ফ্রাই যেন একটু আশ্বস্ত ও নিরাপদ বোধ করলে। ওয়াং যদি সত্যি তার রক্তরাঙা প্রতিশ্রুতি পালন করবার জন্য আবির্ভূত হয়, তাহলে কর্মটি সম্পন্ন করার জন্যে সে একটু নিরিবিলিই পছন্দ করবে– নিহত মানুষটার পাশে ওই স্বীকারোক্তি সংবলিত চিরকুটটা ফেলে রেখে সে গোটা ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার চেহারা দিতে চাইবে–অন্তত ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের ধারণা তা-ই। সেইজন্য এই জনসমুদ্রে, বিপুল ভিড়ে, ভয়ের কিছু নেই–শহরের জনাকীর্ণ রাস্তাঘাটে তাই কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত; সেইজন্যই পথচারীদের দিকে আনমনে তাকিয়ে তারা পথ চলছিলো–গুরুতর কিছু ঘটবে বলে তারা আশা করেনি।

কিন্তু হঠাৎ কিন-ফো একেবারে পাথরের মূর্তির মতো থেমে দাঁড়ালো। বারেবারে উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনবার চেষ্টা করলো সে। না, তার কোনো ভুল হয়নি, কিমাকার ও উদ্ভট অঙ্গভঙ্গি করে একদল বালখিল্য রাস্তায় হুল্লোড় করছে, আর মাঝে-মাঝে তার নামই চীৎকার করে আওড়াচ্ছে তারা। নিজের নাম শুনে সে বিষম চমকে উঠলো, বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হতভম্ব দাঁড়িয়ে রইলো সে ঠায়, আর তার দেহরক্ষীরা আরো গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তাকে চিনে ফেলেছে তবে? এত ছদ্মবেশ, এই ছদ্মনাম–সব তবে ব্যর্থ। কিন্তু তা তো মনে হয় না। স্পষ্টই তো বোঝা যাচ্ছে এই ছেলের পালের আকর্ষণের বস্তু সে অন্তত নয়। কিন্তু বারেবারে তার নামই যে তবে আওড়াচ্ছে : কিন-ফো! কিন-ফো! শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে কিন-ফো এই পেল্লায় হেঁয়ালির মর্মার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করলে।

রাস্তায় গান গেয়ে-গেয়ে চলেছে এক গায়ক, আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আবালবৃদ্ধবনিতা, প্রচণ্ড করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহ জোগাচ্ছে তারা–এমনকী সে গান ধরার আগেই তাদের হাততালি সেই যে শুরু হলো, সহজে আর থামতেই চাইলো না।

ভিড় যত বাড়লো, লোকটা ততই খুশি হলো। তারপর যখন ভিড়ের আয়তন তাকে যথেষ্ট পরিমাণে তৃপ্ত করলো, তখন পকেট থেকে সে বার করলো একতাড়া রংচঙে ছোটো ছোটো প্রচারপত্র, আর খনখনে গলায় চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, শতজীবীর পাঁচপ্রহর! শতজীবীর পাঁচপ্রহর!

ও! সব হৈ-চৈ এর কারণ তবে তা-ই। কিন-ফোকে টিটকিরি দিয়ে লেখা সেই অতিবিখ্যাত ও জনপ্রিয় গানটা তবে ফিরি করে বেড়াচ্ছে এই গায়ক? ক্রেগ আর ফ্রাই ব্যাপারটা বুঝে কিন-ফোকে নিয়ে কেটে পড়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিন-ফো নট নড়নচড়ন নট কিছু; তাকে নিয়ে লেখা গান, অথচ সেই তা কোনোদিন শোনেনি! এবার, গানটা শুনবে বলেই মনস্থির করেছে; কেউ যখন এখানে তাকে চেনে না, তখন এখানে দাঁড়িয়ে গানটা শুনতে আর আপত্তি কোথায়?

নানা রকম প্রাথমিক অঙ্গভঙ্গিসহ গায়কটি আরম্ভ করলো :

নামিলো গোধূলিলগ্ন শাংহাই-আকাশে
বিবর্ণ তরুণ চাঁদ-লাবণ্যে ঢাকা সে,
উইলো গাছের চারা
দিলো সদ্য মাথাচাড়া,
কিন-ফো পৌঁছালো এবে বিংশতি বছরে।

যামিনী দ্বিতীয় দণ্ড : স্বচ্ছ অপরূপা
সোমেশ্বরী ইয়ামেনে ছড়াতেছে রুপা।
মিত্র পোষ্য স্বাস্থ্যবান
ধনে গড়াগড়ি যান,
কিন-ফো এখনো যুবা চল্লিশ
বছরে!

গায়কের মুখচোখের অভিব্যক্তি কিন্তু প্রত্যেক স্তবকের সঙ্গে-সঙ্গে বদলে যাচ্ছে; একটা করে স্তবক শেষ হয়, আর সে যেন আরো বুড়ো হয়ে পড়ে। আর তাই দেখে ভিড় আরো সহর্ষে হাততালি দিয়ে ওঠে।

শর্বরী তৃতীয় যামে : জ্যোৎস্না সমুজ্জ্বলা,
বর্তুল, পূর্ণ ও স্নিগ্ধ ষোলোচন্দ্রকলা।
কিন্তু হেমন্তের হাওয়া
এই বুঝি করে ধাওয়া,
কারণ কিন-ফো এবে ষষ্টিবর্ষে পড়ে।

নিশীথিনী চতুষ্পর্ণা : গগনমণ্ডলে
চন্দ্রমা পশ্চিমদিকে অন্তহীন চলে!
থলথলে, জবুথবু
খঞ্জ, ও ভোলা কভু,–
কিন-ফো অশীতিপর শাংহাই নগরে।

নক্তের পঞ্চম যাম : কনকনে, ভীষণ
হিমাংশু করুণ-কালো, নিস্তারা গগন।
কোনো দীর্ঘশ্বাস নয়,
এখন মরলেই হয়,–
কেননা পৌঁছেছে কিন-ফো একশো
বছরে

বিষম প্রতুষে : রুষ্ট সম্রাট ইয়েন
বুড়োহাবড়া বলে তাকে তাড়ায়ে দিলেন।
নরকে প্রবেশ তার
নিষিদ্ধ বলে আবার
ত্রিশঙ্কুর মতো ঝোলে কিন-ফো
চিরতরে।

গান শেষ হতেই হাততালির আওয়াজ এমন প্রবল আকার ধারণ করলে যে বুঝি-বা বধির করে ফেলবে। প্রত্যেকেই এমন হুড়মুড় করে এক-এক সাপেক দিয়ে রংচঙে কাগজে-ছাপা গানটা কিনে নিতে শুরু করলো যে মুহূর্তে লোকটার সব গান প্রায় শেষ হয়ে এলো।

গানটা কিনে না-নেবার কোনো যুক্তি দেখলো না কিন-ফো। পকেট থেকে কিছু খুচরো পয়সা বার করে গায়কের হাতে দিতে যাবে, এমন সময় ভিড়ের মধ্যে কার দিকে যেন চোখ পড়তেই সে এত চমকে উঠলো যে তার বিস্ময় অস্ফুট ধ্বনি হয়ে বেরিয়ে এলো। ক্রেগ আর ফ্রাই ভাবলে শেষ অবধি বুঝি-বা চরম আঘাতটিই সে পেয়েছে; আরো আঁটো করে তাকে চেপে ধরলো তারা।

কিন-ফো চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ওয়াং!

ওয়াং! ক্রেগ হতচকিত। কোথায়?

কোথায়? ফ্রাই পুনরাবৃত্তি করলো প্রশ্নটার।

কিন-ফো মোটেই ভুল করেনি। ওয়াং যে শুধু সেখানে ছিলো তা নয়, কিন-ফোকে সে চিনতেও পেরেছিলো। কিন্তু হুড়মুড় করে তার দিকে ধেয়ে এসে বিষম কর্মটি সাধন করার বদলে চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে তীরের মতো ছুটে গিয়েছে সে, প্রাণপণে দৌড়ে পালিয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কিন-ফোকে হঠাৎ দেখে সেও কম বিস্মিত বা বিচলিত হয়নি।

কিন-ফো আর এক মুহূর্তও ভাবলে না। তক্ষুনি তার পাছু নিলে সে, আর ক্রেগ আর ফ্রাইও তার সঙ্গ ছাড়লো না।

বারেবারে চেঁচিয়ে ডাক দিলো সে দার্শনিককে, কিন্তু কোনো ফল হলো না।

ওয়াং! ওয়াং! চীৎকার করে ডাকলো কিন-ফো, এখন আর কোনো গণ্ডগোল নেই–সম্পত্তি ঠিকই আছে! ওয়াং! ওয়াং, ফিরে এসো! আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই!

ওয়াং যাতে শুনতে পায় সেজন্য ক্রেগ আর ফ্রাই যথেষ্ট চেষ্টা করলো, কিন্তু সে ততক্ষণে এত দূরে চলে গিয়েছে যে তাদের হাঁকডাক তার কানে যাচ্ছিলো কিনা সন্দেহ।

জেটির পাশ থেকে বেরিয়ে, খালের পাড় ধরে এত জোরে সে ছুটছিলো যে খামকাই তারা তার পিছন নিলে–মধ্যেকার ব্যবধান এক চুলও কমলো না।

পাঁচ-ছটি চিনেম্যান আর দুটি চৈনিক পুলিশ প্রথমটায় তাদের পিছনে ধাওয়া করেছিলো, ভেবেছিলো বুঝি কোনো চোরকে তারা তাড়া করেছে; কিন্তু একটু পরেই তা আর ছ-সাত জনের ব্যাপার থাকলো না–পেল্লায় এক ভিড়ও ছুটতে শুরু করলো পিছনে-ওয়াং-এর নাম তাদের কানে গেছে : যাকে খুঁজে বার করতে পারলে মস্ত ইনাম মিলবে, সেই ওয়াং! উত্তেজনা মুহূর্তে চরমে পৌঁছুলো; চেঁচিয়ে হাঁক পেড়ে ডাক ছেড়ে এক বিপুল জনতা ওই ধাবমান ত্রিমূর্তির সঙ্গ নিলে।

প্রাণপণে দৌড়লো তারা; প্রত্যেকের দৌড়ের পিছনেই নিজস্ব কারণ রয়েছে। কিন-ফো দৌড়চ্ছে তার আটলাখ ডলারের সম্পত্তির লোভে প্রাণের মায়ার কথা না-হয় না-ই বললাম! ক্রেগ আর ফ্রাই দৌড়চ্ছে তাদের উপর দু-লাখ ডলার বাঁচাবার ভার আছে বলে! আর এই উচ্চকিত জনতার প্রত্যেকেই কি ওই দু-হাজার ডলার পুরস্কারের লোভে ছুটছে না?

ওয়াং! ওয়াং! হাঁকডাক ক্রমশ চড়ে যাচ্ছে সপ্তমে।

ওয়াং। এখন আমি বড়োনোক! কিন-ফো হাঁপাতে হাঁপাতে চীৎকার করলো।

ধরো ওকে, পাকড়ো! চীৎকার তুললো জনতা।

কিন্তু হয় কিছুই শুনতে পাচ্ছিলো না ওয়াং, নয়তো কিছুই শুনতে চাচ্ছিলো না। কনুই দুটি পাঁজরায় ঠেকিয়ে সে সামনে ছুটে চলেছে, ঘাড় ফিরিয়ে একবারও তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। শহরতলি পেরিয়ে একটা খোলা রাস্তায় এসে দ্বিগুণ জোরে ছুটলো সে, আর ধাওয়া-করা ভিড়কেও তাই সেই অনুপাতে ছুটতে হলো।

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে এই পেল্লায় দৌড় চললো–কেউ হাল ছাড়ছে না, কেউ থামবার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। কিন্তু শেষকালে পলায়মান ওয়াং অবসাদ ও ক্লান্তি অনুভব করতে পারলো ভিতরে-ভিতরে; বুঝতে পারলো যে তার আর জনতার ভিতর ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে। ছুটে তাদের হাত এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা বৃথা, তাতে একসময় ক্লান্ত হয়ে তাকে ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতে হবে সটান : একটা ফন্দিফিকির ছাড়া এই খ্যাপা জনতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনো উপায় নেই; তাই প্রথম সুযোগটাকেই সবলে আঁকড়ে ধরে সে ডাইনে মোচড় মেরে একটা ছোট্ট প্যাগোডার সবুজ গাছপালার মধ্যে মিলিয়ে গেলো।

যে-ওকে পাকড়াতে পারবে, তাকে দশ হাজার ডলার তায়েল ইনাম দেবো, কিন-ফো চাচালো।

দশ হাজার তায়েল বখশিশ, ক্রেগ আর ফ্রাই জনতাকে শোনাবার চেষ্টা করলে।

ইয়াহু! বলে ভিড়ের সামনে থেকে চীৎকার উঠলো, তারপর তারাও প্যাগোডার দেয়ালের কাছে এসে বাঁক ঘুরলো।

ওয়াংকে মুহূর্তের জন্যও কোথাও দেখা গেলো না। ধাবমান জনতা একটু থমকে গেলো যেন, কিন্তু পরক্ষণেই আবার আকাশফাটা ধ্বনি উঠলো, ওই-যে ওখানে!

সেচের জন্য কেটে-আনা সরু খালগুলির মধ্যে দিয়ে পথ করে চম্পট দেবার চেষ্টা করছে তখন ওয়াং; আঁকাবাঁকা পায়ে-চলা পথ গেছে খালগুলির মধ্য দিয়ে আরেকটা মোড় ঘুরলো ওয়াং, অমনি হা হতোস্মি! আবার খোলা রাস্তায় এসে পড়লো, যেখানে আপ্রাণ ছোটা ছাড়া কোনো উপায় নেই তার। তার হাঁটুর জোড় যে ক্রমেই খুলে যেতে চাচ্ছে, এত উত্তেজনাতেও এটা তার জানতে বাকি ছিলো না; সে বারেবারে ফিরে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিলো পশ্চাদ্ধাবকদের সঙ্গে কতটুকু ব্যবধান এখনো বজায় আছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো এই অভূতপূর্ব দৌড়ের পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে। শেষটায় তরুণ যুবকরাই যে জিতে যাবে, তাতে সংশয় নেই।

আরেকটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে সেই বিখ্যাত পালিকাও সেতু; শিল্পকর্ম হিশেবে জগৎজোড়া খ্যাতি এই সেতুর–মারবেল পাথরের থাম আর খিলান, আর দু-পাশে দুইসার অতিকায় সিংহমূর্তি। আঠারো বছর আগে পে-চি-লি প্রদেশে প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। অন্য ধরনের আরেকদল পলাতক রাস্তাটা আটকে থাকতো তখন। এখানেই ১৮৬০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর ফরাশি বাহিনীর কাছ থেকে ঘা খেয়ে রাজার খুড়ো সান-কো-লি-সিনকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছিলো, আর অসীম দুঃসাহস সত্ত্বেও মাথু তাতাররা ইওরোপীয় গোলন্দাজদের হাতে তখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো।

কিন্তু এখন যদিও সেতুটির উপরকার মূর্তিগুলোতে সেই ভীষণ যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে, তবু আজকাল কারু পক্ষেই সেতুপথে যাবার বাধা নেই। পা টলছে, বুঝতে পারছিলো ওয়াং; বুঝতে পারছিলো যে তার শক্তি ফুরিয়ে এসেছে : চট করে মুখ ঘুরিয়ে পিছন দিকে একবার দেখে নিলো সে। ব্যবধান একটু আগে ছিলো কুড়ি কদম, এখন তা দশ পাও হবে না; পিঠের উপর তাদের নিশ্বেস অনুভব করতে পারছিলো যেন সে, তারা অবশ্য চেঁচিয়ে তাদের দম ফুরোতে চাচ্ছিলো না আর; মিনিট খানেকের মধ্যেই তো তারা পাকড়ে ফেলবে তাকে। মৃগয়ার অবসান সন্নিকট, পাছুধাওয়া এখানেই এবারকার মতো শেষ।

উঁহু, মোটেই তা নয়। পরমুহূর্তেই ওয়াং সেতুর থামের উপর লাফিয়ে উঠলো–তারপরই ঝপাং করে পাই-হোর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

বিষম হকচকিয়ে গেলেও তক্ষুনি কিন-ফো মনস্থির করে ফেললো। এখন ওকে পাকড়ানো যেতে পারে, বলে চেঁচিয়ে উঠে সে নিজেও জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

দু-লাখ ডলার জলে গেলো! সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো ক্রেগ আর ফ্রাই-মরীয়া হয়ে তারাও তক্ষুনি পাই-হো নদীতে ঝম্প দিয়ে পড়লো।

আর সেই অদ্ভুত উত্তেজনার মধ্যে আরো কয়েকজনও নিজেদের শামলাতে না-পেরে ঝপঝপ করে লাফিয়ে পড়লো।

কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেলো। অনেকক্ষণ সন্ধান করলো তারা, কিন্তু খামকাই এত খোঁজাখুঁজি। বেচারা দার্শনিক তাহলে জলে ডুবেই মরলো–নিশ্চয়ই স্রোতে ভেসে গেছে সে! কিন্তু সে-ই বা হঠাৎ এমনভাবে জলে ডুবে মরতে গেলো? এই রহস্য ভেদ করবে কে?

ক্লান্ত, ভ্যাবাচ্যাকা, বিমূঢ়, হতাশ, নিরুৎসাহ ও আলুথালু কিন-ফো শেষকালে ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের সঙ্গে হোটেলেই ফিরে এলো! জামাকাপড় ছেড়ে শুকোতে দিয়ে কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা করলো তারা, তারপর সুনকে ডেকে পাঠালো। তারা যখন বললো যে আধ ঘণ্টাখানেক পরেই পেইচিং যেতে হবে সুনের বিরক্তি আর গজরানি একেবারে অসীমে পৌঁছুলো।

.

১৪. পেইচিং

চিনের আঠারোটি প্রদেশের মধ্যে যেটি সবচেয়ে উত্তরে, সেই পে-চি-লি ন-টা জেলায় বিভক্ত। সদর জেলা হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর একটি স্বর্গীয় শহর–ওরফে পেইচিং নগরী।

যদি কোনো চৈনিক হেঁয়ালির ছিন্ন টুকরোগুলো কোনো ১৩৫০০০ একর জমি-জোড়া নিখুঁত আয়তক্ষেত্রে সাজানো যায়, তাহলে এয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মার্কো পোলো যে অদ্ভুত বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেই রহস্যময় কামবালু ও চিন সাম্রাজ্যের বর্তমান রাজধানীর কিঞ্চিৎ আন্দাজ পাওয়া যাবে।

আসলে দুটো ভিন্ন শহর নিয়ে গড়ে উঠেছে পেইচিং-মস্ত একটা দুর্গপ্রাচীর দিয়ে শহরটা দু-ভাগে ভাগ করা; চিনে পল্লিটা একটা আয়তক্ষেত্রাকার সামন্তরিকের মতো; আর তাতার পল্লিটা যেন চৌকো একটা বর্গক্ষেত্র; এই তাতার পল্লিতেও দুটো মহল্লা রয়েছে : একটার নাম হোয়াং চিং, পীতনগর, অন্যটা সেন-কিন-চিং ওরফে লোহিত বা নিষিদ্ধ পল্লি।

আগে এখানে বিশ লাখের বেশি লোকের বাস ছিলো, কিন্তু চরম দুর্দশায় পড়ে অনেকে বাস্তুত্যাগ করে চলে গেছে। এখন লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে লাখ দশেক; বাসিন্দারা মূলত তাতার আর চৈনিক; তাছাড়া হাজার দশেক মুসলমান, আর কিছু মোঙ্গোল আর তিব্বতিও আছে। তাতার পল্লিটি একটি দুর্গপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা; ইট-পাথরের এই প্রাচীরটি চওড়ায় চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট হবে, উচ্চতাতেও তাই। দুশো গজ পরে-পরে রয়েছে পেল্লায় একেকটি পাটাতন, সবসময় সশস্ত্র পাহারা থাকে এখানে; পুরো প্রাচীরটা এক চমৎকার বেড়াবার জায়গা, দৈর্ঘ্যে পনেরো মাইল হবে। এই সুরক্ষিত, নগরীর মধ্যেই সম্রাট ওরফে দেবপুত্র বাস করেন।

তাতার পল্লির হলুদ শহর বা পীত নগরীর আয়তন প্রায় ১৫০০০ একর; আটটা তোরণ দিয়ে ঢোকা যায় হলুদ শহরে, তিনশো ফুট উঁচু, কালো স্ফটিক বা কয়লার তৈরি বিশাল এক পিরামিড এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য; আর আছে এক সুন্দর হ্রদ-মধ্যসাগর বলে তাকে লোকে; মারবেল পাথরের একটু সেতু আছে তার উপর; আছে বৌদ্ধ শ্রমণদের জন্য দুটি মহাবিহার ও প্যাগোডা; পাই-থা-সে নামে একটি ধর্মপ্রতিষ্ঠান আছে খালের স্বচ্ছ নির্মলজলে ঘেরা একটা ছোট্ট ব-দ্বীপে; ক্যাথলিক মিশনারিদের জন্য আছে পেং-তং, তাদের বাসস্থান। আছে এক রাজমন্দির, উজ্জ্বল-নীল টালি বসানো সেই ঘণ্টার গম্ভীর নিনাদ অনেক দূর থেকে শোনা যায়; আর আছে বর্তমান রাজবংশের উদ্দেশে সমর্পিত একটি বিপুল মন্দির, প্রেতাত্মার মন্দির, পবনদেবের মন্দির, বজ্রদেবতার মন্দির, রেশমের দেবতার মন্দির, দেবরাজের দেবালয়, ড্রাগনদের পঞ্চমণ্ডপ, চিরনির্বাণের মহাবিহার–এইগুলোও দ্রষ্টব্য বস্তুর তালিকায় শীর্ষস্থান নিতে পারে।

আর হলুদ শহরের ঠিক মাঝখানে তার বুকের কাছে, বলা যায় রয়েছে নিষিদ্ধনগরী। ১৮০ একর জমি জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই লোহিত নগর, চারপাশে পরিখাকাটা, সাতটি মারবেল পাথরের সেতু আছে তার উপর। এটা নিশ্চয়ই বলা বাহুল্য যে মাথুরাই যেহেতু বর্তমান শাসক, সেইজন্য পেইচিঙের এই অংশে মূলত কেবল মাধুদেরই বাস–পরিখার ওপারে, প্রাচীরের বাইরে, চৈনিকেরা তাদের নিজেদের পল্লিতেই কেবল থাকে।

নিষিদ্ধ নগরীর চারপাশে হলুদ রঙের টালিবসানো লাল ইটের দেয়াল; মহাশুদ্ধতার তোরণ দিয়ে প্রবেশ করা যায় এই পল্লিতে, আর তোরণদ্বার কেবল খোলে যখন সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞী যাতায়াত করেন। ভিতরে আছে তাতার রাজবংশের পূর্বপুরুষদের দেবালয় : রংচঙে টালি-বসানো ডবল ছাত তার; চি আর সি নামে উর্ব ও অধঃলোকের দুই অধীশ্বরের নামে দুটি মন্দির আছে এখানে; আর আছে খাশমহল : রাষ্ট্রীয় উৎসব ও ভোজসভা উপলক্ষে যেখানে অভিজাতগণ জমায়েৎ হন; তারপরেই মাঝমহল, এই দেবপ্রিয় দেবপুত্রগণের বংশলিপি সেখানে দেখা যায়; তারপরেই আম দরবার, যার বড় হলঘরটায় সম্রাট বসেন অমাত্যদের নিয়ে; নাই-কোর পটমণ্ডপে প্রাক্তন সম্রাটের খুল্লতাত যুবরাজ কং-এর সভাপতিত্বে সাম্রাজ্যের সচিবসভা বসে-যুবরাজ কং নিজে পররাষ্ট্র সচিব; তারপরে রয়েছে কলালক্ষ্মীর চন্দ্রাতপ, যার ছায়ায় সম্রাট বছরে একবার করে ধর্মগ্রন্থ পঠনপাঠনে নিয়োজিত থাকেন; তারপরেই হলো চুয়ান-সিন-তিয়েনের নাটমণ্ডপ, যেখানে কনফুসিয়সের উদ্দেশে বলিদান হয় : অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রাজার গ্রন্থাগার, প্রত্নতত্ত্বশালা, ভূ-ইগেন-তিয়েন বা মুদ্রণশালা, বসন-শিল্পালয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তারপরে কেউ ইচ্ছে করলে দুলোকশুদ্ধতার প্রাসাদ দেখতে যেতে পারে : রাজপরিবারের যাবতীয় জটিলতা এখানে আলোচনা করে মোচন করা হয়; ঐহিক ভবনে থাকেন তরুণী সম্রাজ্ঞী; সম্রাটের অসুখ হলে আশ্রয় নেন ধ্যানসদনে; রাজবংশের শিশুদের জন্য রয়েছে তিনটি অট্টালিকা; ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে হিয়েন-ফৎ যখন মারা যান, তখন তাঁর বিধবা ও তার সঙ্গীদের জন্য চতুরঙ্গভবনটি দিয়ে দেয়া হয়। চু-সিকু-কং হলো রানীমহল; সখিভবনে রানীর সখিরা রাজঅতিথিদের অভ্যর্থনা করেন; নির্বাণভবন নামটি আশ্চর্য, কারণ এখানে অভিজাত রাজপুরুষদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেখে। পরবর্তী দ্রষ্টব্য : অনশনভবন–যেখানে অনশন করে চিত্তশুদ্ধি করে নেয়া হয়; ক্লান্তিহরভবন-যেখানে রাজকুমাররা থাকেন। গতায়ু পূর্বসূরিদের উদ্দেশে নিবেদিত মন্দিরটির ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য। নগরদেবতার মন্দির ও তিব্বতি দেবালয়টিও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। তাছাড়া রাজভবন ও আপিশকাছারি আছে বহু; লাও-কংচুতে থাকে নপুংসকেরা–লোহিত নগরে তাদের সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম নয়- সব শুদু ৪৮টি অট্টালিকা রয়েছে। রাজভবনের চৌহদ্দির মধ্যে : তার মধ্যে অবশ্য হলুদ শহরের হ্রদের পাশে অবস্থিত জেন-কুয়াং-কো বা বেগুনি আলোর মণ্ডপের কথা ধরা হয়নি; এই মণ্ডপেই ১৮৭৩ সালের ১৯শে জুন ইংরেজ, রুশ, আলেমান, ওলন্দাজ ও মার্কিন রাজদূতেরা রাজসন্নিধানে যাবার অধিকার পেয়েছিলেন। এই তালিকা থেকে ওয়ান-চেয়ু-চানকেও বাদ দেয়া উচিত হবে না–এই গ্রীষ্মবাসটি পেইচিঙের মাইল পাঁচেক দূরে অবস্থিত। ১৮৬৩ সালে এই গ্রীষ্মবাসটি ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ভগ্নস্তূপের মধ্যে এখন আর অচঞ্চল শিখার বিতান, পান্নার ফোয়ারা, আর দশ সহস্র প্রাণের চূড়া ভালো করে চোখেই পড়ে না। আর-কোনো প্রাচীন শহরেই এমন অদ্ভুত ও বিচিত্র হর্মরাজি দেখা যায় না; ইওরোপের কোনো রাজধানী এমন আশ্চর্য ভাষায় তার প্রাসাদগুলির নামকরণ করেনি।

হলুদ শহরের চারপাশে যে-তাতার পল্লি রয়েছে, সেখানে রয়েছে ইংরেজ, ফরাশি ও রুশ দূতাবাস, লনডন মিশনের হাসপাতাল, একাধিক ক্যাথলিক মিশনভবন, আর একটি হস্তিশালা–যার বাসিন্দা এখন কেবল একটি থুরথুরে বুড়ো কানা হাতি। মস্ত একটা ঘড়িঘর সেখানে মাথা তুলেছে শূন্যে–তার লাল ছাতে সবুজ টালি বসানো। কনফুসিয়সের মন্দির, হাজার লামার বিদ্যাভবন, ফা-কুয়ার দেবালয়, মস্ত চৌকো স্তম্ভওলা জ্যোতিমন্দির, জেসুয়িট ও অধ্যাপকদের ইয়ামেন, পরীক্ষাগ্রহণকেন্দ্র–তাতার পল্লির প্রধান দ্রষ্টব্য এগুলোই। পুবে-পশ্চিমে আছে বিজয়তোরণ। উত্তরসাগর শৈবালসাগর নামে দুটি ছোটো খালে নীল পদ্ম ফুটে থাকে রাশি-রাশি–গ্রীষ্মবাস থেকে বেরিয়ে এসে এই খাল দুটি বড়ো খালটায় গিয়ে পড়েছে। অর্থ, উৎসব, সমর, পূর্ত ও পররাষ্ট্র সচিবদের প্রাসাদগুলো এখানেই অবস্থিত। মহাফেজখানা, জ্যোতিদপ্তর ও চিকিৎসাবিভাগের প্রধান কার্যালয়ও এই এলাকেই অবস্থিত। অদ্ভুত অঞ্চল এটা : দারিদ্রে আর জাঁকজমকে যেন মাখামাখি হয়ে আছে এখানে। একদিকে আছে সরু কানাগলি, আলো পৌঁছোয় না, হাওয়া ঢোকে না, ঘিঞ্জি জীর্ণ হতশ্রী বাড়ি সারে-সারে, আর তারই মাঝে-মাঝে গাছপালার আড়ালে ছায়ার ঘোমটা মুখে টেনে আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে মস্ত প্রাসাদ–কোনো সচিব বা অভিজাত পুরুষ হয়তো সেখানে থাকেন। গ্রীষ্মকালে রাস্তাঘাটগুলো ধুলোবালিতে অসহ্য হয়ে ওঠে, আর শীতকালে তারা শুকিয়ে-যাওয়া ছোট্ট ঝরনার চেয়ে বেশি ভালো নয়। যত রাজ্যের বেওয়ারিশ কুকুর, কয়লার বোঝা পিঠে মোঙ্গোলীয় উট, আট বেহারার টানা পাল্কি, খচ্চরে-টানা গাড়ি-ঘোড়ায় রাস্তাঘাটে সবসময়েই প্রচণ্ড ভিড় আর হৈ-হুঁল্লা লেগেই আছে। মঁসিয় শুংজের হিশেব মতো অন্তত ৭০,০০০ ভিখিরি থাকে এখানে, আর মঁসিয় আরে বলেছেন যে জীর্ণ খানাখন্দ-ওলা জলভরা খাদগুলি এতই গম্ভীর হয় যে কোনো অন্ধ লোক যে-কোনো মুহূর্তে জলে ডুবে মরে যেতে পারে।

চৈনিক পল্লি ওরফে হাই-চেং নানা দিক দিয়ে পেইচিঙের তাতার পল্লিরই আরেক সংস্করণ। দক্ষিণ মহল্লায় দ্যুলোকের আর কৃষির দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত দুটি মন্দির আছে, আর আছে দেবী কোআনাইনের দেবালয়, জগৎপ্রতিভার পুণ্যগৃহ, কালো ড্রাগনের মন্দির, ও ভুলোক-দ্যুলোকের আত্মার উদ্দেশে নিবেদিত পটমণ্ডপ। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সোনালি মাছের দিঘি, ফাই-ওয়ান-সের মঠ, বাজার ও নাট্যশালা উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে বড়ো রাস্তাটা যেন পল্লির ধমনী–উত্তর থেকে দক্ষিণে সমস্ত শহর জুড়ে এই গ্র্যাণ্ড অ্যাভিনিউ চলে গেছে তিয়েন তোরণ থেকে হুং তিং ফটক পর্যন্ত। আর একই সমকোণে ছেদ করে গেছে আরেকটি আরো-লম্বা রাস্তা–পূর্বপ্রান্তের চা-তোরণ থেকে পশ্চিমের কোয়ান-ৎসু ফটক পর্যন্ত। এই রাস্তার নাম চা-কোআ অ্যাভিনিউ-গ্র্যাণ্ড অ্যাভিনিউকে যেখানে এই চা-কোআ অ্যাভিনিউ ছেদ করেছে, সেইখানেই থাকে সুন্দরী লা-ও, কিন-ফো যাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করে আছে।

এটা নিশ্চয়ই মনে আছে যে দুঃসংবাদ বহন করে প্রথম চিঠি আসার পর এই তরুণী বিধবাটি কিন-ফোর অবস্থা পরিবর্তনের খবর পেয়েছিলো আরেকটি চিঠিতে, যাতে জেনেছিলো সপ্তম চাঁদ ডুবে যাবার আগেই তার প্রিয়তম তার কাছে ফিরে আসবে। সেই মাসের ১৭ তারিখের পর থেকে কিন-ফোর আরেকটা কথাও শোনেনি সে। শাংহাইতে বেশ কয়েক বার চিঠি লিখেছে লা-ও, কিন্তু কিন-ফো শূন্যে ঝাঁপ খেয়ে তার ওই খ্যাপা অভিযানে বেরিয়েছে বলে তার চিঠিগুলো সব নিরুত্তরই থেকে গেছে। ১৯শে জুন এসে গেলো, অথচ কিন-ফোর কোনো পাত্তা নেই-লা-ওর অস্বস্তি যে কী-পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিলো তার বর্ণনা দেয়ার চেয়ে বরং কল্পনা করা সহজ। এই দীর্ঘ ক্লান্তিকর জীর্ণ-করা দিনগুলোয় একবারও লা-ও বাড়ি ছেড়ে পা বাড়ালো না–তার উৎকণ্ঠা ক্রমেই বেড়ে চললো, আর তার বুড়ি-মা নানও তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্বহ হয়ে উঠতে লাগলো–সে মোটেই এই নির্জন যন্ত্রণার উৎফুল্ল সঙ্গী নয়।

যদিও লাওৎসের ধর্মই চিনের সবচেয়ে পুরোনো ধর্মমত (জিশুর জন্মেরও পাঁচশো বছর আগে তার সূচনা হয়েছিলো) আর কনফুসিয়ুসীয় ধর্ম যদিও তারই সমসাময়িক আর স্বয়ং সম্রাট, অভিজাতজন ও প্রধান মান্দারিনদের আরাধ্য, তবু বৌদ্ধ মতবাদ বা ফো-র ধর্মই অধিকাংশ লোককে আকৃষ্ট করেছিলো। পৃথিবীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাই সর্বাধিক–অন্তত ৩০০, ০০০,০০০ লোক বোধিসত্ত্বের পূজারী। আর চিনদেশে বৌদ্ধদের দুটো মত আছে–মঠে বা বিহারে যারা থাকে, তারা ধূসর আলখাল্লা আর লাল টুপি মাথায় দেয়–অন্য লামারা আপাদমস্তক পীত বসনে সজ্জিত থাকে। লা-ও এই প্রথম শ্রেণীর বৌদ্ধদের সমর্থকদেবী কোআনাইনের নামে নিবেদিত যে, কোআন-তি-মিআও মন্দির আছে, প্রায়ই সেখানে সে পুজো দিতে যায়। সেখানে পাথরের মেঝেয় সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে সে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেবীর পুজো দেয় আর কায়মনোবাক্যে তার প্রেমিকের সুখশান্তি কামনা করে।

আজ এই ১৯শে জুন তারিখে হঠাৎ তার মন কেন যেন যতরাজ্যের অলুক্ষুনে আশঙ্কায় ভরে গেলো। অমনি সে ঠিক করে ফেললো দেবীর কাছে গিয়ে সে কিন-ফোর মঙ্গলের জন্য ধন্না দেবো নানকে ডেকে সে গ্র্যাণ্ড অ্যাভিনিউর মোড় থেকে একটা পাল্কি ডেকে আনতে বললো। নান কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলে না, বিরক্তিভরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কত্রীর হুকুম পালন করতে চলে গেলো।

নান চলে যেতেই লা-ও করুণ-চোখে একবার তার গ্রামোফোনটির দিকে তাকালো। আহা! কতদিন এটা কোনো কথা কয় না–চুপচাপ পড়ে আছে, বিমর্ষ! আমি যে ওকে কখনো ভুলিনি, অন্তত এটা তো ও জানতে পারবে, মনে-মনে সে ভাবলে, আমার মনের কথা যদি ধরে রাখি, ও-তে ফিরে এসে তা শুনে নিতে পারবে। কলটা চালিয়ে দিয়ে লা-ও যেন তার হৃদয় ঢেলে দিলে তার মধ্যে। কতক্ষণ যে তার ওই আকুল গুঞ্জন চলতো ঠিক নেই, কিন্তু নান হঠাৎ দুমদাম করে ঘরে ঢুকে তাড়া লাগলো, পাল্কি হাজির! সেই সঙ্গে অবশ্য এ-কথাও বললো যে তার মতে এখন নাকি লা-ওর বাড়ি থাকাই উচিত। কিন্তু বুড়ি দাসীর আপত্তিতে কোনো ফল হলো না। লা-ও তাকে একা বসে যত খুশি গজগজ করতে দিয়ে পাল্কিতে গিয়ে উঠলো, বেহারাদের বললো তাকে কোআন-তি-মিআও নিয়ে যেতে।

মন্দিরের রাস্তায় কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই–সোজা গ্র্যাণ্ড অ্যাভিনিউ ধরে তিয়েন তোরণ পর্যন্ত যেতে হয়। কিন্তু যাওয়া বললেই কি যাওয়া হয়, এ-রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি যায় কার সাধ্যি! একে রাজধানীর সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল এটা–তার উপর এই সময়ই শহরের ব্যস্ততা চরমে পৌঁছোয়। কার সাধ্যি এই হৈ-হুঁল্লায় কান পাতে! আর ফিরিওলারা রাস্তার দুপাশে সারি বেঁধে পশরা সাজিয়ে বসে এ-সময়-দেখে মনে হয় মেলা বসেছে। যতরাজ্যের বক্তা, সরকারি ফতোয়া-ঘোষক, জ্যোতিষী, ছবি-আঁকিয়ে, কৌতুকশিল্পী (মান্দারিনদের অঙ্গভঙ্গি নকল করে তারা টিটকিরি দেয়)–সবাই এই হৈ-হল্লায় নিজেদের গলা যোগ করে দিয়েছে। একসময় আবার জমকালো এক শবযাত্রা রাস্তার গাড়িঘোড়া অচল করে দিলো, আরেক জায়গায় আবার একদল বরযাত্রী গেলো-শবযাত্রার লোকদের মতো ততটা ফুর্তি অবশ্য তাদের দেখা গেলো না কিন্তু রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া থামিয়ে দিতে তারা কশুর করলে না।কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের ইয়ামেনে হয়তো কেউ ঢাকে কাঠি দিয়ে বিচার প্রার্থনা করলে, অমনি রৈরৈ করে চারপাশে ভিড় জমে গেলো। লিও-পিং পাথরের কাছে এক অপরাধী হামাগুড়ি দিয়ে ঘাড় নিচু করে বসে অপেক্ষা করছে কখন জল্লাদের কুঠার নেমে আসে ঘাড়ে–আর চারপাশে লাল ঝাপ্পাওলা মাঞ্চুটুপি মাথায় কড়া পুলিশ পাহারা–কোমরে একই খাপে। তলোয়ার আর কৃপাণ রেখেছে তারা। আরেক জায়গায় দেখা গেলো একদল চৈনিক বদমাশের বেণী ধরে টানতে-টানতে শাস্তি দেবার জন্য নিয়ে-যাওয়া হচ্ছে। তারপরেই দেখা গেলো এক কাঠের খোপের মধ্যে বন্দী একটা লোকের ডান পা আর বাঁ হাত খোপের দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে বের করে রাখা হয়েছে : এক চোরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এক কাঠের বাক্সে, তার মাথাটাই কেবল বাক্সের বাইরে বেরিয়ে আছে : তারপরেই দেখা গেলো আরেকদল গুণ্ডাবদমাশকে জোয়ালে যেমন করে ষাঁড় জোতে তেমনি করে একসঙ্গে জুতে রাখা হয়েছে। আর তাছাড়া রাস্তার যেখানেই বেশি ভিড়, সেইখানেই অন্ধ, কানা, খঞ্জ, আতুর, বোবা, কালারা ভিক্ষে চাচ্ছে–কেউ তাদের মধ্যে আতুর সেজেছে, কেউবা আবার সত্যি বিকলাঙ্গ-কুসুমনগরীর চারপাশে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

মন্থরভাবে এগুচ্ছে লা-ওর পাল্কি, কারণ যতই তারা বহির্দেয়ালের দিকে এগুচ্ছে ততই গাড়ি-ঘোড়া লোকজনের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। অবশেষে দেবী কোআনাইলন-এর মন্দিরের দ্বারে এসে বেহারারা পাল্কি নামালো। পাল্কি থেকে নেমে মন্দিরে গিয়ে ঢুকলো লা-ও। প্রথমে নতজানু হয়ে প্রণাম করে পরে সে একেবারে দেবীপ্রতিমার পায়ে শুয়ে পড়লো। তারপর উঠে প্রার্থনা-চক্রের দিকে এগিয়ে গেলো সে। প্রার্থনা-চক্রটি অনেকটা চরকিকলের মতো, আটটা তার ডাল, প্রত্যেক ডালেই কোনো-না-কোনো পুণ্যলিপি খোদাইকরা। এক শ্ৰমণ ছিলেন তত্ত্বাবধানের জন্য-ভক্তদের পুজোআচ্চায় সাহায্য করেন, আর নৈবেদ্য গ্রহণ করেন তিনি। লা-ও তার হাতে কয়েকটি তায়েল তুলে দিলো, তারপর বাঁ-হাতে বুক ছুঁয়ে ডানহাতে প্রার্থনা-চক্রের হাতল ধরে ঘোরাতে লাগলো। প্রার্থনা যাতে সফল হয় সেজন্য বোধকরি বেশি খাটেনি সে, না-হলে শ্ৰমণটি কেন তাকে উৎসাহ দিয়ে আরো জোরে-জোরে চাকাটা ঘোরাতে বলবেন?

প্রায় পনেরো মিনিট অতি জোরে চক্রটা ঘোরাবার পর শ্রমণ তাকে জানালেন যে দেবী তুষ্ট হয়েই তার নিবেদন গ্রহণ করেছেন। আবার দেবীপ্রতিমাকে দণ্ডবৎ করে মন্দির থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে পাল্কিতে এসে বসলো লা-ও।

কিন্তু মন্দিরচত্বর থেকে বেরিয়ে এ্যাণ্ড অ্যাভিনিউতে পড়তেই তার পাল্কিবেহারাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হলো। নির্দয়ভাবে রাস্তা থেকে ভিড় হঠিয়ে দিচ্ছে সৈন্যরা, দোকানপাট সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হুকুম দিয়ে, আর তিপাওদর তত্ত্বাবধানে নীলঝালর ঝুলিয়ে সব চোরাগলিতে ঢোকবার পথ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

এর মধ্যেই শোভাযাত্রাটি ঢুকে পড়েছে রাস্তায়। সম্রাট কোয়াৎসিন ওরফে মহিমার নিঝর, তাতার পল্লিতে ফিরে চলেছেন এখন–তার উদ্দেশে মাঝখানের বড়ো তোরণটা এখন খুলে দেয়া হবে। শোভাযাত্রার পুরোভাগে রয়েছে দুটি অশ্বারোহী পুলিশ, তারপরে রয়েছে পদাতিক বাহিনী ও বল্লমধারীদের সারি; অভিজাত রাজপুরুষরা এলেন তারপর, ড্রাগন-আঁকা বিশাল এক হলদে ছাতা বহন করে–চিনদেশে ড্রাগন সম্রাটের প্রতীকচিহ্ন আর ফিনিক্স পাখি সম্রাজ্ঞীর। তার পরেই শাদা গোলাপ-আঁকা লাল আলখাল্লা পরা আর রেশমি কামিজ আঁটা ষোলোজন বেহারা বহন করে নিয়ে এলো মস্ত এক চতুর্দোলা, আর এই চতুর্দোলার পাশে-পাশে ঘোড়ায় চড়ে এলেন রাজপুত্র আর অন্যান্য অভিজাতগণ; ঘোড়ার পিঠে জিনের উপর থেকে ঝুলছে হলদে রেশমের ঝালর–তাদের আভিজাত্যের প্রতীক। চতুর্দোলার হলদে রঙের রেশমি-পদা একটু উঁচু-করা : দেখা যায় স্বয়ং দেবপুত্র হেলান দিয়ে বসে আছেন তাতে–প্রাক্তন সম্রাট তং-চির তিনি জ্ঞাতি ভ্রাতা, আর যুবরাজ কং-এর ভ্রাতুস্পুত্র। অতিরিক্ত একদল পরিচারক ও বেহারা এলো সবার পিছনে–দেখতে না-দেখতে গোটা শোভাযাত্রা ব্যাবসাদার, ভিখিরি, ফিরিওলা সবাইকে আশ্বস্ত ও নিশ্চিন্ত করে তিয়েন তোরণ পেরিয়ে চলে গেলো। দুম করে হঠাৎ যেমন সব কাজে বাধা পড়েছিলো, তেমনি হঠাৎ আবার একযোগে চ্যাঁচামেচি ও হৈ-হুঁল্লা শুরু হয়ে গেলো।

এবার লাওর পাল্কি ধীরে-ধীরে এগুতে পেলো। শেষকালে যখন সে বাড়ি পৌঁছুলো তখন দু-ঘন্টা কেটে গেছে। আর ফিরে এসেই দ্যাখে যে দেবী কোআনাইন তাকে চমকে দেবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

পাল্কি থেকে নামতে-না-নামতেই ধূলিধূসর একটি খচ্চরে-টানা গাড়ি হন্তদন্ত হয়ে তার বাড়ির সামনে এসে থামলো, আর দরজা খুলে ভিতর থেকে নেমে পড়লো কিন-ফো–আর তার পিছন-পিছন ক্রেগ, ফ্রাই আর সুন।

কিন-ফো, তু মি! সত্যি তুমি? আমি ভুল দেখছি না তো? চোখ খারাপ হয়নি তো আমার? বিস্মিত লা-ও বলে উঠলো।

বাঃরে, আমিই তো! কিন-ফো উত্তর দিলে, বোন, তুমি কি ভেবেছিলে আমি আর ফিরে আসবো না!

লা-ও আর একটাও কথা না-বলে হাত ধরে তাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তার গ্রামোফোনের সামনে দাঁড় করালো : তার সব গোপন উৎকণ্ঠা আর দুঃখের মুখর সাক্ষী এই গ্রামোফোন।

এই শোনো, লা-ও বললো, আমি যে সারাক্ষণ কেবল তোমারই কথা ভেবেছি, তা এখুনি বুঝতে পারবে। বলতে-বলতে সে গ্রামোফোনটা চালিয়ে দিলে। একটু আগেই ব্যাকুল লা-ও যে-কথাগুলো বলেছিলো স্নিগ্ধ গলায় সেই কথাগুলোই আবার মুখর হয়ে উঠলো : ফিরে এসো, ভাইটি আমার, ফিরে এসো! রাতের ওই যুগ্মতারার মতো এক হয়ে উঠুক আমাদের হৃদয়। তোমার ফিরে-আসার পথ চেয়ে আছি শুধু ব্যাকুল…

একটুক্ষণ চুপ করে রইলো গ্রামোফোন একটি মুহূর্তের জন্যই কেবল। তারপরে শোনা গেলো কাঁচকেঁচে গনগনে গলায় বিরক্তি :যেন কত্রীঠাকরুন একাই যথেষ্ট মন্দ নন–আবার এক কর্তাও এসে হাজির হবেন! যুবরাজ ইয়েন গলা টিপে মারুক দুটোকেই–তাহলেই হয়!

এর অর্থ খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য নয়। লা-ও পুজো দিতে চলে যাবার পর বুড়ি নান এ-ঘরে দাঁড়িয়ে গজগজ করেছিলো–স্বপ্নেও ভাবেনি যে তার কথাগুলো সব হুবহু ওই গ্রামোফোন-রেকর্ডে উঠে যাচ্ছে।

ওহে দাসদাসীগণ, অবধান করো। গ্রামোফোন সম্বন্ধে সাবধান! তক্ষুনি বুড়ি নানের চাকরি গেলোসপ্তম চাঁদ ডুবে-যাবার সময়টুকুও সে পেলে না, সেদিনই তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো।

.

১৫. কপাল যায় সঙ্গে

কিন-ফোর সঙ্গে লা-ওর বিয়ে হবার সব বাধাই এখন অপসৃত। সত্যি-যে ওয়াংকে যতখানি সময় দেয়া হয়েছিলো, তা এখনো সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়নি; কিন্তু দুর্ভাগা দার্শনিকটি তত শেষ পর্যন্ত অমন অদ্ভুতভাবে পালাতে গিয়ে জলে ডুবেই মরে গেলো–এখন আর তার কাছ থেকে অন্তত কোনো আশঙ্কা নেই। একদা কিন-ফো যে-তারিখে নিজের জীবনে ছেদ টেনে দিতে চেয়েছিলো, সেই পঁচিশে জুন তারিখেই বিয়ে হবে বলে ঠিক হলো।

প্রথম যেদিন কিন-ফো চিঠি লিখে লা-ওকে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছিলো যে তাকে সে তার দারিদ্র ও দুর্দশার অংশীদার করতে চায় না, কিংবা তাকে পুনর্বার বিধবা করে যাবার ইচ্ছে তার নেই, তারপর থেকে কিন-ফোকে যে কতবারই পরিহাসপ্রবণ ভাগ্যের উত্থান-পতন সহ্য করতে হয়েছে সে-সব লা-ও এবার জানতে পেলো; জানতে পেলো ভাগ্যের সেই আমূল পরিবর্তনের কথা, যার ফলে আবার উন্মুখ কিন-ফো এসে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে।

ওয়াং-এর মৃত্যুর বিবরণ শুনে লা-ও তার চোখের জল শামলাতে পারলে না। কত কাল ধরে জানে সে এই দার্শনিককে। ওয়াংকে সে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখতো চিরকাল; তাছাড়া লা-ও যখন প্রথম কিন-ফোর প্রেমে পড়েছিলো, তখন ওয়াংই ছিলো তার একমাত্র সহায় ও পরামর্শদাতা–তার কাছেই লা-ও প্রথম হৃদয় উদ্ঘাটন করেছিলো। আহারে! ধরা গলায় বললো লা-ও, বেচারা ওয়াং! বিয়ের সময় ওকে না-দেখে বড় মন কেমন করবে আমার!

সত্যি বেচারা! কিন-ফোও দুঃখ প্রকাশ করলো, কিন্তু এটা মনে রেখো, আমাকে বধ করবে বলে শপথ করেছিলো ও।

না, না, সুন্দর ছোট্ট মাথাটি নেড়ে বললো লা-ও, কিছুতেই ও-কাজ সে করতে পারতো না! এ-কথা আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই প্রতিশ্রুতিটা এড়াবার জন্যই সে পাই-হোয় ডুবে মরেছে।

তার অনুমানটি যে অসম্ভাব্য নয়, এটা কিন-ফোকে স্বীকার করতেই হলো। যৌবনের এই প্রিয় বন্ধুটিকে হারিয়ে তারও মনস্তাপের সীমা ছিলো না। তারা দুজনেই ওয়াংকে খুব শিগগির ভুলে যেতে পারবে বলে তো মনে হয় না।

এটা নিশ্চয়ই বলা বাহুল্য হবে যে পালিকাও সেতুর সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরে খবরকাগজে বিডুল্‌ফের ওই সাড়া-জাগানো বিজ্ঞাপন বেরুনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো–কিন-ফোর নাম যেমন উল্কাবেগে দেশসুদ্ধ কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলো, তেমনি উজ্জাবেগেই তা আবার বিস্মৃতিতে তলিয়ে গেলো। ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের চাকরি এখন আর তেমন ভীষণ জরুরি নয়। সত্যি-যে তিরিশ তারিখ অব্দি, বিমার মেয়াদ উত্তীর্ণ না-হওয়া পর্যন্ত, সেন্টেনারিয়ানের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তাদের কিন-ফোর উপর কড়া নজর রাখতে হবে। তবু এটা ঠিক ওয়াং-এর কাছ থেকে কোনো বিপদ আসার এখন আশঙ্কা নেই–কিন-ফো যে এখন আত্মহত্যা করতে চাইবে, এটা ঠিক সম্ভব বলে মনে হয় না বরং এখন সে যথাসম্ভব দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতেই চাইবে। কিন্তু কিন-ফো দুম করে তাদের হঠাৎ বরখাস্ত করে দিতে চাচ্ছিলো না। তারা অবশ্য নিঃস্বার্থভাবে তাকে বাঁচাবার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটেনি, কিন্তু তাহলেও তারা যথেষ্ট দরদ দেখিয়েছে, শত অসুবিধে সত্ত্বেও কর্মে অবহেলা করেনি; সেই জন্যেই কিন-ফো তাদের অনুরোধ করলো বিবাহ-উৎসব পর্যন্ত থেকে যেতে। বেশ খুশি হয়েই ক্রেগ আর ফ্রাই এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলো।

ফ্রাই ঠাট্টা করে তার তুতোভাইকে বললে, বিয়েটাও একধরনের আত্মহত্যাই।

আত্মহত্যা না-হোক, নিজের জীবন অন্যের কাছে সমর্পণ করে দেয়া তো বটে, ক্রেগ উত্তর দিলো।

বুড়ি নানের জায়গায় শিগগিরই সভ্যভব্য আরেকজনকে গৃহকর্মের জন্য নিয়োগ করা হলো লা-ওর বাড়িতে। তাছাড়া লু-তালু এসেছেন বাড়িতে; লা-ওর মাসি তিনি, যথেষ্ট বয়েস হয়েছে; বিয়ের সময় লা-ওকে তিনি সম্প্রদান করবেন। তিনি আসলে একজন নীল ফিতেওলা দ্বিতীয় শ্রেণীর মান্দারিনের স্ত্রী-(আগে তিনি ছিলেন সম্রাটের উপাধ্যায় আর হানলিন আকাঁদেমির সদস্য)–মনে হয় লা-ওর মা বেঁচে থাকলে যেভাবে বিবাহের কাজ চালাতেন, ঠিক সেইভাবেই সব কাজ তিনি সমাধান করলেন।

কিন-ফোর ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পরেই পেইচিং ত্যাগ করবে–প্রথমত রাজসভার ধারে-কাছে থাকার অভিরুচি তার ছিলো না, দ্বিতীয়ত তরুণী স্ত্রীকে তার ওই জমকালো ইয়ামেনের কত্রীরূপে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাচ্ছিলো সে। ইতোমধ্যে সে তিয়েনআনমেন দুর্গপ্রাচীরের কাছে তিয়েন-ফু-তাং ওরফে স্বর্গ সুখের সরাইখানা নামে একটি মস্ত ও ভালো হোটেলে আস্তানা গেড়েছিলো–চৈনিক ও তাতার পল্লির ঠিক মাঝখানে পড়ে হোটেলটা। ক্রেগ আর ফ্রাইও ওই হোটেলেই উঠেছিলো। সুনও গজগজ করতে-করতে তার কাজে লেগে গিয়েছিলো, কিন্তু আশপাশে কোনো ফোনোগ্রাফ আছে কি না, সেটা সে দেখে নিতে অবশ্য ভোলেনি। বুড়ি-মা নানের দুর্দশা দেখেই সে যথেষ্ট সাবধান হয়ে গেছে।

পেইচিঙে হঠাৎ কোয়াংতুঙের দুই বন্ধুর দেখা পেয়ে কিন-ফো খুব খুশি হয়ে উঠলো–ইন-পাং এখানে এসেছে ব্যাবসাসূত্রে, আর সাহিত্যিক হুআল বেড়াতে। তাদেরও আমন্ত্রণ করা হলো আসন্ন উৎসবে–রাজধানীর যে-সব অভিজাত রাজপুরুষ ও ব্যাবসাদারদের কিন-ফো চিনতো, তারাও নিমন্ত্রণ-তালিকা থেকে বাদ গেলো না।

অবশেষে ওয়াং-এর সেই চিরনিস্পৃহ অতি উদাসীন শিষ্যটিকে সত্যি সুখী দেখা গেলো; মাত্র দুটি মাস নানা বিপত্তি ও উদ্বেগে কাটিয়েই সে নিজের সৌভাগ্যকে অনুধাবন করতে পেরেছে। ওয়াং-এর দর্শন মোটেই ভুল ছিলো না–তা অনুমানই যে শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো এটা দেখবার জন্য সে-ই কি না এখন বেঁচে নেই–এটা সত্যি দুঃখের।

সারাক্ষণই কিন-ফো এখন এই তরুণী বিধবাটির সঙ্গে কাটায়। কিন-ফো পাশে থাকলেই লা-ওর সুখের সীমা থাকে না। শহরের সবচেয়ে অভিজাত দোকান থেকে কিন-ফো তার জন্য যে দামি উপহার নিয়ে আসে, কিন্তু সে সবের প্রতি লা-ওর নজর নেই। তার ধ্যানজ্ঞান কেবল কিন-ফোই; বারেবারে সে মনে-মনে বিখ্যাত পান-হোয়েই পান এর বিচক্ষণ বাণী আওড়ায় : মনের মতো স্বামী পেলে তাকে কখনো হারাতে হয় না। যে-মানুষটির নাম বহন করবে, তার প্রতি যেন কনের অসীম শ্রদ্ধা থাকে। ছায়া যেমন থাকে, প্রতিধ্বনি যেমন থাকে, তেমনি যেন পত্নী থাকে পতিগৃহে। স্ত্রীলোকের স্বর্গ স্বামীই।

এদিকে বিয়ের উদ্যোগ চলেছে পূর্ণোদ্যমে। কিন-ফোর ভীষণ ইচ্ছে বিয়েটা যেন খুব সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কোনো মহিলার বিয়ের যৌতুক হিশেবে তিরিশ-জোড়া চটিজুতো লাগে : এর মধ্যেই লা-ওর ঘরে জরির কাজ-করা বহুমূল্য চটি জুতোর মেলা বসে গেছে। তাছাড়া মিষ্টি-মেঠাই, শুকনো ফলমূল, চিনেবাদাম-ভাজা, চিনি, সিরাপ, কমলা ছাড়া যত রাজ্যের দামি রেশমি কাপড়, জড়োয়া গয়না, আংটি, বালা, কঙ্কন, অঙ্গুলিত্ৰাণ, চুলের কাটা–অর্থাৎ কোনো তরুণীর সাজগোজে যা-যা লাগে–সব পেইচিঙের দোকাপশার উজাড় করে আনা হয়ে গেছে।

আজব মুলুক এটা : বিয়ের সময় মেয়েরা এখানে পিতৃগৃহে থেকে কোনো যৌতুকই পায় না–আক্ষরিকভাবে বর বা বরের আত্মীয়স্বজন যেন তাকে তার পিতামাতার কাছ থেকে কিনে নেয়। ভাই না-থাকলেও পিতার সম্পত্তির কানাকড়িও মেয়েরা পায় না–অবশ্যি পিতা যদি কোনো ইষ্টিপত্র করে যান, তাহলে আলাদা কথা। বিয়ের আগেই এ-সব ব্যবস্থা করতে হয়–আর ঘটকালির সময় যারা এই ব্যবস্থা করে দেয় তাদের বলে মেই-জিন। অতঃপর সেই তরুণী কন্যাকে ভাবী স্বামীর পিতামাতার কাছে দেখানো হয়। বিয়ের আগে স্বামীদেবতাটিকে বেচারা দেখতেই পায় না–একটা ঢাকা পাল্কিতে করে। তাকে স্বামীগৃহে নিয়ে যাওয়া হয় অতঃপর। পাল্কির দরজা জানলা সব তালাবন্ধ। থাকে– স্বামীদেবতাটির হাতে চাবিটি শমঝে দেয়া হয়, এবং তিনি অতঃপর দুয়ার খুলে দেন–ভিতরের কন্যাটি যদি তার পছন্দ হয়, তাহলে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন কন্যার দিকে–আর তা না-হলে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেন তিনি মেয়েটির মুখের উপর; আর ঘটকালির সেখানেই ইতি ঘটে-কন্যার পিতামাতা অবশ্য ইচ্ছে করলে সেক্ষেত্রেও বায়নার টাকাটা রেখে দিতে পারেন।

কিন-ফোর বেলায় অবশ্যি এ-সব অনুষ্ঠানের কোনো দরকার হলো না। লা-ও আর সে–দুজনেই স্বাধীন ও অভিভাবকহীন-সুতরাং বিয়ের আগে আর-কারু পরামর্শ নেবার কথাই ওঠে না। কিন্তু অন্য কতগুলো রীতি অবশ্য অবহেলা করা চলে না–তা তাদেরও পালন করতে হবে।

বিয়ের তিন দিন আগে থেকেই লা-ওর বাড়ির অন্দরমহলে চব্বিশ ঘণ্টাই আলোয় আলোময় করে রাখা হলো। পর-পর তিন রাত্রি কন্যাগৃহের প্রতিনিধি হিশেবে লু-তালু নিদ্রা থেকে বঞ্চিত রইলেন-কন্যাকে চিরকালের মতো হারাতে বসে তার যে দুঃখের অবধি নেই, সেই বিচ্ছেদ-বেদনা প্রকাশ করার জন্যেই কন্যাকব্রীকে নিঘুম কাটাতে হয়। কিন-ফোর বাবা-মা বেঁচে থাকলে তারও বাড়ি শোক প্রকাশের জন্য আলোময় হয়ে থাকতো, কারণ হাও-খিএয়ু-চুয়েন অনুযায়ী ছেলের বিয়েকে নাকি পিতার মৃত্যুর প্রতীক বলেই গণ্য করা উচিত।

তাছাড়া নানারকম জ্যোতির্গণনাও করে নিতে হয়। ঠিকুজিকুষ্ঠি মিলিয়ে দেখে বর-কনের ঘোটক বিচার করতে হয়। তিথি, নক্ষত্র, ঋতু, সব মঙ্গলসূচক না-হলে চলে না। সব বিচার করে দেখা গেলো এমন রাজযোটক ও শুভ লক্ষণ নাকি কোনোকালে দেখা যায়নি।

অবশেষে সেই প্রত্যাশিত শুভদিন এলো। উৎসব শুরু হবে বলে সব ঠিকঠাক। চিনদেশে অবশ্য শ্ৰমণ, লামা বা নগরপালের সামনে কোনো সরকারি চুক্তি সম্পাদন করতে হয় না : ঠিক হলো যে সন্ধেবেলায় আটটার সময় মহা সমারোহ ও জাঁকজমকের সঙ্গে কনেকে স্বর্গসুখের সরাইখানায় নিয়ে যাওয়া হবে।

সাতটার সময় কিন-ফো অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়ন করার জন্য ক্রেগ আর ফ্রাইয়ের সঙ্গে তার কোঠার সামনে এসে দাঁড়ালো। লাল কাগজের উপর খুদে-খুদে হরফে লেখা যে-নিমন্ত্রণচিঠি কিন-ফো বিলি করেছিলো, তার বয়ান এই : শাংহাইর কিন-ফো যথাবিহিত সম্মান পুরঃসর অমুককে নিবেদন করছেন যে তিনি যেন দয়া করে অধমের অতি দীন বিবাহ-অনুষ্ঠানকে সফল করে তুলতে সাহায্য করেন।

একে-একে নিমন্ত্রিতরা সকলেই এসে পৌঁছুলেন। বরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এসেছেন তারা–যে-রাজকীয় ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে, তাতে তারা অংশ নেবেন; মহিলাদের জন্য আলাদা টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তারা সেখানেই বসবেন। অন্যান্য নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে-সঙ্গে ইন-পাং আর সাহিত্যিক হুআলও যথাকালে এসে পৌঁছেছে। কয়েকজন মান্দারিন তাদের সরকারি টুপির উপর তাদের উচ্চপদের স্মারক হিশেবে পায়রার ডিমের মতো লাল পাথর বসিয়েছেন। অন্য মান্দারিনদের টুপিতে শাদা বা নীল রঙের গোল পাথর বসানো–এঁরা যে তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের, শাদা আর নীল পাথর তাই বোঝাচ্ছে। অভ্যাগতদের অধিকাংশই কিন্তু খাঁটি চৈনিক ও রাজকর্মে লিপ্ত। কিন-ফো তাতারদের অপছন্দ করে বলে, সহজেই এর কারণ বোঝা যায়। অভ্যাগতরা সবাই জমকালো পোশাক পরে এসেছেন–আর ময়ূরপুচ্ছের মতো বর্ণবহুল জনসমাবেশ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বসে।

অভ্যাগতরা পৌঁছুবামাত্র কিন-ফো তাদের সমাদর করে হলঘরে নিয়ে গেলো : দুটো ঘর পেরিয়ে এই ঘরে পৌঁছুতে হয় : জমকালোভাবে সাজানো ঘর দুটির মধ্য দিয়ে যাবার সময় ভৃত্যেরা যখন দরজা খুলে দাঁড়ালো, সে নিজে সবিনয়ে অতিথিদের তার আগে যেতে অনুরোধ করলে। তার সম্ভাষণে বিনম্রবচনের একেবারে ছড়াছড়ি। মহান নাম ধরে তাদের সম্বোধন করলে সে, জিগেশ করলে তাদের মহান স্বাস্থ্যের কথা, জিগেশ করলে তাদের মহান পরিবারের কুশল। কোনো বিশ্বনিন্দুকও বোধকরি তার আচারব্যবহারে কোনো খুঁত বের করতে পারতো না।

সবিস্ময়ে ও যুগ্ম চোখে তার হাবভাব লক্ষ করলো ক্রেগ আর ফ্রাই! আরেকটা কারণেও তারা তার উপর নজর রাখছিলো। একটা কথা সম্প্রতি তাদের দুজনেরই মনে জেগেছে। এমনও তো হতে পারে যে ওয়াং জলে ডুবে মরেনি। তার চুক্তির মেয়াদ ফুরোতে আরো কয়েক ঘণ্টা বাকি নেই কি এখনো? হয়তো এখন সে অতিথিদের মধ্যে ছদ্মবেশে ঢুকে তার সেই চরম আঘাত হেনে যাবে। তার সম্ভাবনা অবশ্য নেই–তবে অসম্ভব বলে একে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। সেইজন্যই ক্রেগ আর ফ্রাই তীক্ষ্ণ চোখে প্রতিটি অভ্যাগতকে খুঁটিয়ে দেখছিলো। কিন্তু যে-মুখটিকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছিলো, তাকে মোটেই দেখা গেলো না।

এদিকে কনে তখন চা-কোআ অ্যাভিনিউএ তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধ পাল্কিটায় উঠে বসেছে। প্রাচীন শাস্ত্রে যদিও আছে যে বিয়ের সময় বর মান্দারিনের পোশাক পরে নিতে পারে, কিন-ফো কিন্তু তবুও তা গায়ে দেয়নি; লা-ও কিন্তু এদিকে অভিজাত মহলের রীতি অনুযায়ী নিখুঁতভাবে সেজেছে। সবচেয়ে মূল্যবান উজ্জ্বল-লাল ঢিলে জামা তৈরি; তার মুখের উপর রয়েছে এক ছোটো-ছোটো মুক্তো বসানো অতি স্বচ্ছ ওড়না, সোনার ঝালর তার কপালে; জড়োয়া গয়না আর পাথর বসানো ফুল পরেছে সে তার দীঘল কালো চুলে আর বেশভূষার মধ্যে আগাগোড়া রুচি ও আভিজাত্যের ছাপ; পাল্কির দরজা খুলে কিন-ফো তাকে দেখে যে অপছন্দ করার কিছু পাবে না, এটা বোধহয় নির্ভয়েই বলে ফেলা যায়।

শোভাযাত্রা বেরিয়ে পড়লো। শবযাত্ৰা হলে যে জাঁকজমক আরো বেশি হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এটাও বা কম কি? গ্র্যাণ্ড অ্যাভিনিউ ধরে যখন তিয়েনআনমেন দুর্গপ্রাচীরের দিকে শোভাযাত্রা চললো, কাতারে-কাতারে লোক দাঁড়িয়ে পড়লো জমকালো মিছিলটি দেখতে। লা-ওর সখিরা গেলো পাল্কির পিছন-পিছন, তাদের হাতে কনের সাজসজ্জার কত-যে উপাদান তার যেন লেখাজোখাই নেই। সবচেয়ে সামনে রয়েছে বাজনদারেরা, তাম্রনির্মিত নানা বাদ্যযন্ত্র তাদের হাতে, আর পাল্কির চারপাশ ঘিরে হাঁটছে দাসদাসীরা, হাতে তাদের মশাল আর রঙিন লণ্ঠন। কনেকে কিন্তু কিছুতেই তাকিয়ে দেখা যাবে না বাইরে থেকে : পতিদেবতাই প্রথম দর্শনের অধিকারী–অন্তত শাস্ত্রে নির্দেশ তা-ই।

রাস্তায় ভিড় বেশি বলে চতুর্দোলাটি যখন স্বর্গসুখের সরাইখানায় পৌঁছুলো, তখন আটটা বাজে। সরাইখানার দরজা জাঁকালোভাবে সাজানো হয়েছিলো, আর কিন-ফো নিজে দাঁড়িয়েছিলো দরজার কাছে। চতুর্দোলার দরজা খুলে দিয়ে কনেকে নামতে সাহায্য করবে সে হাত বাড়িয়ে, তারপর একটি বিশেষ কোঠায় তাকে নিয়ে গিয়ে দ্যুলোকের চার দিম্পতিদের প্রণতি জানাবে। তারপর দুজনে যাবে সেই ভোজসভায়, কনে প্রথমে চারবার নতজানু হয়ে সর্বসমক্ষে বরকে অভিবাদন করবে, আর বর তার বদলে দু-বার সেইভাবেই তাকে সম্মান জানাবে। এরপরে তারা দু-তিন ফোঁটা সুরা ছিটিয়ে দিয়ে পূর্বপুরুষদের তর্পণ করে নেবে, প্রেতলোকের উদ্দেশে তারপর কিঞ্চিৎ খাদ্য নিবেদন করবে, এবং অতঃপর তাদের মিলনের পবিত্রতা সম্পূর্ণ হবে যখন পরস্পরের হাতে একটি করে সুরাপাত্র তুলে দেয়া হবে : প্রথমে তারা আলাদা-আলাদাভাবে অর্ধপাত্র পান করে নেবে, তারপর দুজনেই অবশিষ্ট সুরা একই পেয়ালায় ঢেলে দেবে এবং দুজনেই এবার সেই পেয়ালা থেকে বাকি মদ্যটুকু পান করবে।

কনে এসে পৌঁছেছে দেখে কিন-ফো এগিয়ে গেলো। উৎসবপালিক তার হাতে চাবি তুলে দিলেন, কিন-ফো হাত বাড়িয়ে চতুর্দোলার দরজা খুলে দিলে : আর রূপসী লা-ও আস্তে একটু উত্তেজিত, মধুরভাবেই উত্তেজিত, হালকা পায়ে নেমে এলো, অভ্যাগতরা বুকে হাত তুলে তাকে সম্ভ্রম প্রদর্শন করলেন আর তাদেরই মধ্য দিয়ে লঘু পায়ে সে এগিয়ে এলো। কন্যা যেই সরাইখানার ভিতর পা দিলে, অমনি কে যেন সংকেত করলো আর সঙ্গে-সঙ্গে কত ফানুশ আর ঘুড়ি উড়ে গেলো আকাশে–কত রকম যে সেগুলো দেখতে–কোনোটা ড্রাগনের মতো, কোনোটা যেমন কিংবদন্তির ফিনিক্স পাখি, তাছাড়া আরো কত বিয়ের প্রতীক। ল্যাজে ঘুণ্টি-বাঁধা পায়রা ওড়ানো হলো, আর ঘুণ্টির শব্দে চারপাশ ভরে গেলো। সেই সঙ্গে তুবড়ি হাউই আর রংমশাল সোনালি বৃষ্টির মতো আকাশ থেকে ঝরে পড়তে লাগলো।

আচমকা এমন সময়ে দুর্গপরিখার ওপার থেকে এক তুমুল কোলাহল ভেসে এলো। আর, সব ছাপিয়ে, দূর থেকে ভেসে এলো শিঙার প্রবল শব্দ। কোলাহল যেন থেমে গেলো মুহূর্তের জন্য, তারপরেই আবার যখন শুরু হলো, তখন মনে হলো কলরোল যেন অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। বোঝা গেলো, এই রাস্তা দিয়েই কোলাহলটা এগিয়ে আসছে। কিন-ফো থমকে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়ালো : তার বন্ধুরা অপেক্ষা করতে লাগলো বধূকে স্বাগত জানাবার জন্য। আস্তে-আস্তে কোলাহল কাছে এসে পড়লো, শিঙার । শব্দ শোনা গেলো আরো প্রবল ও গম্ভীর।

কী ব্যাপার, বুঝছি না তো? কিন-ফো বিস্ময় প্রকাশ করলে।

পাণ্ডুর হয়ে গেলো লা-ও; কী-এক অলুক্ষুনে আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে উঠলো। আর তক্ষুনি রাস্তায় ছুটে এলো এক উত্তেজিত জনতা। আর এই শশারগোলের কারণ ঘোড়ার পিঠে করে যাওয়া রাজপোশাকপরা এক সরকারি ঘোষক, আর তার সঙ্গে যাচ্ছে একদল তি-পাও। ঘোষক শিঙার আওয়াজ করতেই চারপাশে স্তব্ধতা নেমে এলো, শোনা গেলো তার গম্ভীর স্বর : রানীমাতার মৃত্যু হয়েছে! সব কাজ বন্ধ করো–রাজার নামে নিষেধ জারি করা যাচ্ছে–

কিন-ফোর মুখ দিয়ে রোষ ও হতাশা-মিশ্রিত আওয়াজ বেরিয়ে এলো। নিষেধ জারি করার অর্থ সে খুব ভালো করেই জানে : ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গেই যতদিন পর্যন্ত রাজসভা শোক পালন করবে, ততদিন মস্তকমুণ্ডন নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ সর্বপ্রকার উৎসব বা অনুষ্ঠান, নাট্যশালা কি আদালত ততদিন বন্ধ থাকবে, সর্বোপরি কোনো বিবাহউৎসব অনুষ্ঠিত হতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়, রাজসভা যে কতদিন শোক পালন করবে কেউ জানে না–বিশেষ অধিবেশন করে দরবার তার স্থায়িত্ব নির্ধারণ করবে।

অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করলেও লা-ও একেবারে ভেঙে পড়েনি। কিন-ফোর হাত ধরে আস্তে একটি চাপ-দিলো সে, তারপর কোনোরকমে ধরা গলায় বললো, না-হয় আর কটা দিনই অপেক্ষা করবো!

সুতরাং আবার সেই রূপের ডালিকে নিয়ে চতুর্দোলা ফিরে চললো চা-কোআ অ্যাভিনিউএ; উৎসব স্থগিত হয়ে গেলো; টেবিল পরিষ্কার করে ফেলা হলো; বিদায় দেয়া হলো গীতবাদ্যের দলকে–আর অতিথিরা বিমর্ষ বরটিকে তাদের সমবেদনা জানিয়ে একে-একে বিদায় গ্রহণ করলেন।

শুধু ক্রেগ আর ফ্রাইকে সঙ্গে নিয়ে কিন-ফো তার পরিত্যক্ত ঘরে বসে রইলো, আর স্বর্গসুখের সরাইখানা নামটা তাকে যেন নীরবে পরিহাস করতে লাগলো। তার পোড়াকপাল তাহলে এখনো তার সঙ্গ ছাড়েনি। রাজার আদেশ অমান্য করার সাহস তার ছিলো না–সম্রাট এখন কতদিন শোক পালন করেন কে জানে। এতদিনে সে বুঝলো ওয়াং কেন তাকে এত তত্ত্বকথা শোনাতো।

ঘণ্টাখানেক পরে একটি চিঠি নিয়ে এক ভৃত্য এলো তার ঘরে। এক্ষুনি নাকি কে এক অচেনা লোক এসে চিঠিটা দিয়ে গেছে। চিঠিটা দেখেই কিন-ফো বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো। ওয়াং-এর হাতের লেখা চিনতে তার এক মুহূর্তও লাগেনি।

প্রিয় বন্ধু,

এখনো বেঁচে আছি বটে, কিন্তু চিঠিটা যখন তুমি পাবে, তখন আমি আর ইহলোকে নেই। তোমার সঙ্গে যে-চুক্তিটা আমি করেছিলুম কিছুতেই তা সম্পাদন করার ক্ষমতা পেলুম না বলে আমাকে মরতে হলো। কিন্তু মন খারাপ করে বোসো না যেন; তোমার ইচ্ছেই যাতে পূর্ণ হয়, আমি তার ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। লাও-শেন নামে আমার এক বন্ধু তাই-পিং-এর কাছে তোমার অভয়পত্র তুলে দিয়েছি। এ-কাজ করতে গেলে তার হাত অন্তত কাঁপবে না। সে-ই তোমাকে হত্যা করবে। তোমার মৃত্যুর পর আমি যে-টাকা পেতুম, সব আমি তাকেই দিয়ে গেলুম।

বিদায়, বন্ধু বিদায়। তোমার মৃত্যুর বেশি আগে অবশ্য আমি মরছি না, তবু বিদায়।তোমারই চিরবিশ্বস্ত

ওয়াং।