৩. প্রসিডা

১১. প্রসিডা

রওনা হওয়ার আগে লেডি জিয়ান্নার সঙ্গে প্রসপেরোর আর দেখা হলো না। ওকে এগিয়ে দিতে এসেছে লেডির ভূত্য অ্যামব্রোজিয়ে। প্রসপেরোর জন্য একটা ঘোড়া কিনে এনেছে সে। সেটার দাম আর টিপস হিসেবে অ্যামব্রোজিয়োর হাতে পাঁচ ডাকাট তুলে দিল ও। সঙ্গে দিল লেডির সঙ্গে ওর বিচ্ছেদ নিয়ে সদ্য লেখা একটা সনেট। তবে সেটা কোন হতাশার গান নয়।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রওনা হয়ে গেল প্রসপেরো। পিছনে ফেলে গেল ওর রিক্ত হৃদয়ের বড় একটা টুকরো। মনের গভীরে অনুভব করল ডোরিয়াকে এখন যে-কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা করছে ও। কারণ, আজ প্রসপেরোকে ব্যথিত হৃদয়ে এখান থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে, সেটার কারণও পক্ষান্তরে ডোরিয়াই।

জিয়ান্নাকে প্রসপেরো দোষ দেয় না। কারণ সে একজন নারী। সহজাতভাবেই নারীসুলভ কোমল মন তাকে রক্তপাত আর প্রতিশোধের বিরুদ্ধে কথা বলিয়েছে। এটাই তার জন্য স্বাভাবিক। যা হোক; প্রসপেরোর এবারের যাত্রায় কোন উত্তেজনা নেই। আগস্টের এক উষ্ণ বিকেলে ফ্লোরেন্সে পৌঁছুল ও। ফ্লোরেন্সের লং আর্নো অঞ্চলে স্ট্রোজ্জিদের বাড়িতে উঠেছে প্রসপেরোর মা। সে ওই পরিবারেরই মেয়ে। এখন ওখানে আছেও কন্যাস্নেহে।

ওখানে পৌঁছুতেই স্বাগত জানিয়ে প্রসপেরোকে ঘরে নিয়ে গেল ওর মা। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে প্রসপেরোর খবরের অপেক্ষায় উদ্বেগাকুল হয়ে বসে ছিল সে। প্রসপেরোর পলায়নের কথা চিঠি লিখে জানিয়েছে ডেল ভাস্টো। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রসপেরোর নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ওর মা। একসময় নিজেকেই এর জন্য দায়ী ভাবতে শুরু করে। স্বামীকে হারিয়েছে আর ছেলে যে থেকেও নেই। প্রসপেরোর বাবা ছিল দুর্ভাগ্যের শিকার। এখন প্রসপেরোকেও পদে পদে ওর বাবার মতই দুর্ভাগ্যের বোঝা বইতে হচ্ছে, ইত্যাদি।

নিজের ব্যাপারে কোন জবাব দিল না ও। কিন্তু বাবার কথা উঠতেই প্রতিবাদ করে বলল যে, তাকে নিয়ে কোন আজেবাজে কথা বলবে না ও। তখন ওর মা বলে যে, সে যা দেখেছে, যা ভাল মনে করেছে তা-ই বলেছে।

দুঃখিত কণ্ঠে প্রসপেরো তখন বলল, যারাই বলে যে, যা ভাল মনে করেছি, বলেছি, তারা আসলে সঠিক চিন্তা করতে পারে না। কথাটা বলেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর চেহারা।

সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া দেখাল ওর মা। ডোরিয়াদের উপর প্রসপেরো এখনো কেন প্রতিশোধ নেয়নি সেই কথা বলে ধমকাধমকি করতে থাকল ওকে। যতই ও বোঝানোর চেষ্টা করে যে কোন সুযোগ ও পায়নি, কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রসপেরোকে দোষারোপ করতে করতে মহিলা বলল, প্রসপেরোর মত জোয়ান একটা ছেলের উচিত সুযোগ তৈরি করে নেয়া, সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকা নয়। তারপর প্রসপেরোকে খোঁচা দিয়ে বলল, যেহেতু প্রসপেরো অতি কোমল হৃদয়ের মানুষ, তাই ও মোটেও অনুভব করে না যে, পতি বিয়োগব্যথায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে পা বাড়াচ্ছে ওর মা।

তবে প্রসপেরো চলে আসার সময় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মহিলা। কিন্তু আরো কয়েকদিন থেকে যাওয়ার জন্য একবারও অনুরোধ করেনি সে।

ফ্লোরেন্সে মাত্র দুই দিন থেকেই আবার রওনা হলো প্রসপেরো। এখন ওর উদ্যম আগের চেয়েও কম। প্রসপেরো খুব ভালভাবে জানে ওর মায়ের কথাবার্তা আপাত দৃষ্টিতে স্বার্থপর মনে হলেও তা অসত্য নয়। মায়ের দুঃখ খানিকটা হলেও লাঘব করতে চাইছে ও। কিন্তু কোন উপায় দেখতে না পেয়ে দিশেহারা বোধ করছে প্রসপেরো।

লেগহনে পৌঁছে একটা জাহাজ পেয়ে গেল ও। রাতের আঁধারে অবরোধ পার হয়ে নেপলসে ঢুকবে জাহাজটা। অবরোধকারীদের ফাঁকি দেয়াটা আসলে কোন কঠিন কাজ না। দিনে দিনে অবরোধের জোর কমে যাচ্ছে। লট্রেস হয়তো চাইছে যত বেশিদিন সম্ভব অবরোধ ধরে রাখতে। কিন্তু তার সেনাদলের মধ্যেও মহামারী ছড়িয়ে গেছে। ফলে চাইলেও এখন আর আগের মত কঠিন অবরোধ বজায় রাখা সম্ভব না। ওদিকে ল্যাণ্ডোর ভেনেশিয়ান গ্যালিগুলো দিয়ে উপকূল প্রহরা দেয়া এখন আর ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডারের কাছে ততটা উপকারী বলেও মনে হচ্ছে না। ফলে ওদের কাজের দিকেও তেমন নজর দিচ্ছে না কেউ। মোদ্দা কথা, সহজেই নেপলসে পৌঁছে গেছে প্রসপেরো।

নওভো দুর্গে বিস্ময়ের সঙ্গে প্রসপেরোকে স্বাগত জানাল অরেঞ্জ কাউন্টির প্রিন্স। আগেই বলেছি, বর্তমান ভাইসরয় সে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে বলল, বিরাট সৌভাগ্যবশত তাদের এই দুঃসময়ে হাজির হয়েছে প্রসপেরো। পিওমবিনোতে কতগুলো সাপ্লাই শিপ দাঁড়িয়ে আছে। ডন র‍্যামন ভারগাস নামের এক স্প্যানিশ ইম্পিরিয়াল ক্যাপ্টেন খুব গোপনে অল্প কিছু গ্যালি আর ওগুলোর জন্য লোক জড়ো করছে। দাস পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ায় বোনেভোগলে ভাড়া করা হয়েছে (ভাড়ায় আনা মাল্লাদেরকে বলা হয় বোনেভোগলে)। এমন পাঁচটা গ্যালি ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু সমুদ্র যাত্রায় অভিজ্ঞ কমাণ্ডারের অভাবে সেগুলো রওনা হতে পারছে না। আর ঠিক তখনই হাজির হয়েছে প্রসপেরো। কাজেই দায়িত্বটা তাকেই দিল প্রিন্স।

প্রসপেরোকে সে বলল, আপনি যদি অবরোধ ফাঁকি দিয়ে নেপলসে ওই সাপ্লাই পৌঁছে দিতে পারেন তাহলে নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠবে আমাদের সেনারা। একইসঙ্গে হয়তো ডোরিয়াকেও পুরোপুরি আমাদের দলে নিয়ে আসা যাবে। ফ্রেঞ্চদের তাড়ানো তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

আর কিছু বলার দরকার ছিল না। কাজ পেয়ে বরং খুশিই হয়েছে প্রসপেরো। এতে ওর মনের উপর চেপে বসা দুঃখগুলোকে ভুলে থাকার সুযোগ পাবে ও।

দুই দিন পর পিওমবিনোতে পৌঁছে ক্যাপ্টেন ভারগাসের সঙ্গে দেখা করল প্রসপেরো। সবকিছুই তৈরি, কেবল ওর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। প্রিন্স বলেছিল পাঁচটা গ্যালির কথা। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে আরো একটা গ্যালি যোগ করতে পেরেছে ভারগাস। উপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম আর লোকজন দিয়ে ভালমত এই জাহাজটাও প্রস্তুত করা হয়েছে। সঙ্গে খাবার-দাবারের জাহাজ ছয়টা। দুটো ব্রিগেন্টাইন আর একটা ফেলুকায় নেয়া হয়েছে। শস্যদানা। বিভিন্ন রসদের ভারে প্রায় উপচে পড়ছে আরো তিনটা পাল তোলা গ্যালিয়ন।

এসব নিয়ে বন্দর ছাড়ল প্রসপেরো। পালে বাতাস পেয়ে বেশ দ্রুতই ও পৌঁছে গেল প্রসিডা দ্বীপের উত্তর দিকের একটা নিরাপদ জায়গায়। নেপলস থেকে রওনা হওয়ার পর সপ্তম দিনের কথা। এখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে গেছে, বাতাসও থেমে গেছে। ফলে গ্যালিয়নগুলোকে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে আনতে হয়েছে বেশ খানিকটা পথ। প্রসপেরো অবশ্য আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে, রাতের অন্ধকারে ওই জায়গায় পৌঁছুবে ওরা। তখন ভেনেশিয়ান গ্যালিগুলো ওদের উপস্থিতি আর টের পাবে না।

প্রসিডা দ্বীপের অবস্থানের কারণেও এই পরিকল্পনা করেছে। প্রসপেররা। প্রসিডার পুবে মেইনল্যাণ্ড আর পশ্চিমে বড় আরেক দ্বীপ ইসিচা। ফলে প্রসিডার পূর্ব আর পশ্চিম দুদিকের সাগরেই তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক দুই চ্যানেল বা প্রণালী। দুটো চ্যানেলই দুই মাইল চওড়া। ফলে এখানে ভেনেশিয়ান গ্যালিগুলোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর সুন্দর সুযোগ রয়েছে ওর।

প্রসিডার চ্যানেলে লুকানোর পর জাহাজের দাঁড়িদের ঘুমানোর জন্য পাঁচ ঘণ্টা সময় দিল ও, যাতে দরকারের সময় ওরা সর্বশক্তি কাজে লাগতে পারে। সূর্য ওঠার পর প্রসপেরো নিজে চলে গেল দ্বীপের উপর। ওখান থেকে চারপাশের বিস্তীর্ণ সাগর ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করল ও।

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে মেইনল্যাণ্ডের পসিলিপো। এটার কারণেই ওর দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে যাচ্ছে নেপলস। আরো দূরবর্তী প্রান্তে নীল আকাশের পটভূমিতে দেখা যাচ্ছে ভিসুভিয়াস থেকে ওঠা ধোঁয়ার মেঘ। দ্বীপের যে পাহাড়টার উপর ও দাঁড়িয়ে আছে তার ডানে দেখা যাচ্ছে দুর্গের দিকে চলে যাওয়া পথ। আর দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে সদ্য ঘুমভাঙা প্রসিডার আঙুর বাগান।

পশ্চিম দিকে কয়েক মাইল দূরে দেখা যাচ্ছে ইসিচা দ্বীপের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা ছোট দ্বীপ ইপিওমা। ওই দ্বীপটা ওর বন্ধু ডেল ভাস্টোর জন্মভূমি। প্রসপেরোর আগ্রহ অবশ্য ইসিচা আর প্রসিডার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রণালীর উপর। ভেনেশিয়ানদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার জায়গা পেয়ে গেছে ও।

পাহাড়ের উপর থেকে ভোলা পানিতে চোখ পড়ল ওর। দেখতে পেল পসিলিপোর মেইনল্যাণ্ড ঘুরে এক সারিতে বেরিয়ে আসছে ভেনেশিয়ানদের দশটা গ্যালি। ভালমত দেখে ও অনুমান করল ওগুলোর গতি ঘণ্টায় দুই মাইলের সামান্য বেশি হতে পারে। পর্যবেক্ষণ শেষ হতেই দ্রুত নিচে নেমে এল প্রসপেরো। গ্যালি আর অন্যান্য জাহাজগুলো একটা গুহামত জায়গায় লতা পাতা দিয়ে ঢেকে ভালভাবে লুকিয়ে রাখা আছে। যা হোক, নিচে, নেমেই ভারগাসকে ডাকল ও। তার হাতে তিনটা গ্যালির দায়িত্ব দিয়ে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিল ওগুলো নিয়ে তাকে কী করতে হবে।

ঘণ্টাখানেক পরের কথা। অবাক বিস্ময়ে ভেনেশিয়ান ফ্লিটের এক ক্যাপ্টেন দেখল, প্রসিডার তিন মাইল সামনে তিনটা গ্যালির পাহারায় এগিয়ে চলেছে এক ব্রিগেন্টাইন। ক্যাপ্টেন মন্তব্য করল, ওগুলো নেপলসগামী স্প্যানিশ জাহাজ হলে বলতেই হবে ওদের সাহস আছে।

ফ্লিটের কমাণ্ডার ল্যাণ্ডোর মনেও তখন সম্ভবত একই ভাবনা চলছিল। ক্যাপিটানা থেকে তখন ট্রাম্পেট বাজিয়ে অন্য জাহাজগুলোকে সঙ্কেত দেয়া হলো, এগিয়ে যাও।

শত্রুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার জন্য বাঁকা চাঁদের মত ঘেরাটোপের আকারে এগুতে শুরু করল ভেনেশিয়ান ফ্লিট।

ওদিকে ব্রিগেন্টাইনের ক্যাপ্টেনের ভাল করেই জানা আছে তাকে কী করতে হবে। দৃশ্যত সে ফাঁদে পড়তে চলেছে। কিন্তু আসলে প্রসপেরো তাকে ব্যবহার করেছে ভেনেশিয়ানদের ধোকা দেয়ার জন্য। ব্রিগেন্টাইনটাকে সোজা পশ্চিমে না চালিয়ে সামান্য উত্তরমুখো করে নিল ক্যাপ্টেন। ফলে পালে আরো খানিকটা বেশি বাতাস পাচ্ছে সে। তবে তারপরও তার. গতি সামান্যই। আর ওটার পাহারাদার গ্যালিগুলো তখন ভাব দেখাল যে করণীয় নিয়ে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত তারা। যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রদর্শন করে ব্রিগেন্টাইনের রিয়ার গার্ড হিসেবে সেটার পিছনে অবস্থান নিল গ্যালিগুলো।

ওদের আচরণে ভেনেশিয়ানদের মনে হলো যে ছোট্ট বহরটা চাইছে ইসিচার পাশ ঘেঁষে পালিয়ে যেতে। ওদেরকে ওভাবে যেতে দেখে ভেনেশিয়ান কমাণ্ডার ল্যাণ্ডো প্রথমে চাইল ওদের ধাওয়া করতে। কিন্তু পরে কোন ট্রিক করা হয়ে থাকতে পারে ভেবে তার এক ক্যাপ্টেন ফেলিসিয়ানির কমাণ্ডে চারটা গ্যালিকে পাহারায় রেখে বাকি ছয়টা নিয়ে নিজেই ধাওয়া করা শুরু করল।

ল্যাণ্ডো-ধারণা করেছে ওগুলো ইসিচা ঘুরে সামনে যেতে যেতে ওগুলোর আরো সামনে চলে যেতে পারবে সে। তখন সামনে থেকেই ওগুলোকে অনায়াসে বাধা দিতে পারবে। বিপক্ষের পরিকল্পনা আন্দাজ করার আনন্দে নিজের উপরই খুশি হয়ে উঠল ল্যাণ্ডো। এবং খুশি মনেই রওনা হলো শিকার ধরতে।

ওদিকে দ্বীপ ঘুরে ব্রিগেন্টাইনটা দুই দ্বীপের মাঝের সরু চ্যানেলে ঢুকে পড়েছে। পালে শক্তিশালী হাওয়ার ধাক্কা নিয়ে পাখির মত ছুট দিয়েছে সামনে। গ্যালি তিনটাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে ওটার পেছন পেছন।

ওদিকে ল্যাণ্ডো তার বহর নিয়ে চ্যানেলে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রসপেরোর জাহাজগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ল্যাণ্ডো ধরে নিল, দ্বীপটাকে চক্কর দিয়ে পালাবার মতলব করেছে জাহাজগুলো। মনে মনে হেসে উঠল সে। আগেই বুদ্ধি করে পিছনে চারটা গ্যালি রেখে আসায় মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দিল। ভাবল ওগুলোর হাতেই ধরা পড়বে স্প্যানিশ জাহাজগুলো। তাই এদিক থেকে নতুন উদ্যমে ধাওয়া করা শুরু করল ল্যাণ্ডো।

ওদিকে চারটা গ্যালি নিয়ে পুব দিক দিয়ে চ্যানেলে ঢুকে পড়েছে ভেনেশিয়ান ক্যাপ্টেন ফেলিসিয়ানি। উদ্দেশ্য এদিক দিয়ে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে পলায়নপর জাহাজগুলোকে আটকে ফেলা। ঠিক তখনই যেন সাগর ছেদ করে উদয় হলো তিনটা গ্যালি। প্রায় গায়ে উঠে পড়ার আগে ফেলিসিয়ানিরা ওগুলো দেখতেই পায়নি। আবার পলায়নরত জাহাজগুলোর পক্ষেও এত দ্রুত এদিকে আসা সম্ভব না। সে বুঝতে পারল তার অ্যাডমিরাল যা ধারণা করেছিল বিপক্ষের কমাণ্ডার তার চেয়েও জটিল পরিকল্পনা করে এগিয়েছে। ওদিকে ফেলিসিয়ানি তখনও আশা করছিল সে ল্যাণ্ডোর সাহায্য পাবে বা পলায়নপর জাহাজগুলোকে ধরতে পারবে। কিন্তু সেই সুযোগ সে আর পেল না। অপরদিকে বিপক্ষের জাহাজ তিনটা এমনভাবে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে যে ভারি কামানগুলো ব্যবহার করাও এখন প্রায় অসম্ভব। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর চারটা জাহাজের মুখই তীরের দিকে ঘুরিয়ে নিল সে।

ভেনেশিয়ানদের মন্থর গতির দ্বিধাগ্রস্ত নড়াচড়া প্রসপেরোর জেতার সুযোগ আরো বাড়িয়ে দিল। প্রসপেরোর হুকুমে প্রায় একইসঙ্গে ওর তিন জাহাজ থেকে গর্জে উঠল সবগুলো কামান। মাত্র তিনশ গজ দূর থেকে ছোঁড়া কামানের গোলায় ফেলিসিয়ানির জাহাজের অবস্থা শোচনীয়। একটা গোলা গিয়ে পড়েছে ঠিক ওয়াটার লাইনের নিচে। আরেকটা পড়েছে আরাকুইবাসিয়ারদের ভিড়ের উপর।

ওদিকে আরেকটা গ্যালিতে সরাসরি হামলা চালিয়েছে প্রসপেরোর লোকেরা। ওরা এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যে অল্পক্ষণের মধ্যেই সেটা স্তব্ধ হয়ে গেল। বাকি দুই গ্যালি তখনও অক্ষত। ইতিমধ্যেই সেদিকে এগুতে শুরু করেছে ওরা। জাহাজের পেট দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে দিয়েছে ভেনেশিয়ান গ্যালির দাঁড়। ফলে জায়গায় জমে গেছে জাহাজগুলো। এরপর প্রসপেরোর আরাকুইবাসিয়ারদের নেতৃত্বে বিপক্ষের জাহাজে উঠে যায় ওর সেনারা। একই সময় দাঁড় ফেলে অস্ত্র তুলে নেয় ওর জাহাজের বোনেভোগলেরাও।

বেশ সময় ধরে চলতে থাকে লড়াই। দ্বীপবাসীরা ততক্ষণে মুফতে লড়াই দেখার মজা লুটতে দ্বীপের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন ভেনেশিয়ান গ্যালিগুলোর পেছন থেকে বেরিয়ে এল প্রসপেরোর পাঠানো গ্যালিগুলো। কিন্তু ওদের দিকে নজর দেয়ার সময় ফেলিসিয়ানির নেই। নিজের পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত সে। ফলে নির্বিঘ্নে নেপলসের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল সবগুলো রসদবাহী জাহাজ।

ডুবন্ত জাহাজটাকে রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারী কামানগুলো পানিতে ফেলার হুকুম করল ফেলিসিয়ানি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডুবতে শুরু করেছে তার জাহাজ।

ওদিকে আগের সেই তিন গ্যালি আর একটা ব্রিগেন্টাইনের পিছু ধাওয়া করে এগিয়ে আসছে ল্যাণ্ডোর ছয়টা গ্যালি। কিন্তু ততক্ষণে প্রসপেরোর সঙ্গেও যোগ দিয়েছে আরো দুই গ্যালি। ফলে বলা চলে লড়াইয়ের পাল্লা আগেই ওর দিকে হেলে গেছে। ল্যাণ্ডো তার ছয় জাহাজের বহর নিয়ে আসছে বটে; কিন্তু তখনও সে অকুস্থল থেকে দুই মাইল দূরে ও দ্বীপের পিছনে। তবে কামান-বন্দুকের শব্দ তার কানেও পৌঁছেছে। ওই শব্দ কানে যেতেই তার মুখ থেকে মুছে গেছে আত্মতুষ্টির হাসি। স্পষ্ট বুঝতে পারছে কোনভাবে তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। সর্বশক্তিতে দাঁড় টানিয়ে হলেও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছতে চাইল সে। দাঁড়িদের পিঠের মাংস কেটে বসে যাচ্ছে ওভারশিয়ারের চাবুক। দ্বীপের কোণ ঘুরে বেরিয়ে এল ল্যাণ্ডো। দেখল ছয় স্প্যানিশ গ্যালি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

ফেলিসিয়ানির চার গ্যালির মধ্যে তিনটা তখনও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো অনড় দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে পরাজিত হয়ে স্প্যানিশদের হাতে বন্দি হয়েছে ওগুলো। আরো পিছনে দেখা যাচ্ছে বিনা বাধায় নেপলসের দিকে ছুটে যাচ্ছে তিনটা গ্যালিয়ন আর তিনটা অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ।

ল্যাণ্ডো হুকুম জারি করল, পিছিয়ে যাও। একই হুকুম উচ্চারিত হলো ল্যাণ্ডোর বাকি গ্যালিগুলোতেও। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজগুলো নড়তে পারল না। কারণ দাড়িরা এতই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে যে আবার দাঁড়ে হাত দেয়ার শক্তি তাদের নেই। জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে সবাই। আর ওদের মধ্যে যারা আরেকটু বেশি শক্তিশালী তাদের কয়েকজনই কেবল দুই কদম এগিয়ে খাবার পানির বালতি তুলে গলায় ঢালতে পারল।

পরবর্তী হুকুমের জন্য ক্যাপ্টেনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দাসদের ওয়ার্ডেনরা। আর ক্যাপ্টেনরা তাকিয়ে রইল তাদের কমাণ্ডার ল্যাণ্ডোর জাহাজের দিকে। ওদিকে নরকের আগুনের জ্বালা বুকে নিয়ে গম্ভীর দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে ল্যাণ্ডো। দেখছে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আদৌ কোন উপায় আছে কিনা। এদিকে দাঁড় বেয়ে এগুনোর একটুও ক্ষমতা তার দাসদের আর নেই। মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে বাতাসও বইছে উল্টো দিক থেকে। ফলে পালও কোন কাজে আসছে না। ওদিকে তার ছয় গ্যালির বিপক্ষে প্রতিপক্ষও দাঁড় করিয়েছে ছয়টা গ্যালি। কাজেই বিনা লড়াইয়ে ওরা যে তাকে এক কদমও ছাড় দেবে না সেটা একেবারে স্পষ্ট। আর যতক্ষণে সে এদের সঙ্গে লড়াই করে সময় নষ্ট করবে ততক্ষণে রসদবাহী ওই ছয় জাহাজ নিশ্চিতভাবে নেপলস বন্দরে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ল্যাণ্ডোর মাথায় এখন শোধ নেয়া ছাড়া আর কিছুই নেই। কারণ স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন মুহূর্তেই তার সমরশক্তি অর্ধেকে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আক্রমণ করার আগে তাকে এটাও চিন্তা করতে হচ্ছে যে বিশ্রাম না নিয়ে আর এক গজ এগুবার ক্ষমতাও তার দাস বাহিনীর নেই। এবং এটাও সে বুঝতে পারছে যে বিপক্ষ দল আক্রমণ করলে লড়তে তাকে হবেই। তখন সে হুকুম করল দাসদেরকে ওয়াইন খেতে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে দাসদের জন্য ওয়ার্ডেন আর তাদের সহকারীরা ওয়াইন নিয়ে গেল।

কিন্তু প্রসপেরোর দিক থেকে আক্রমণের কোন নমুনা দেখা যাচ্ছে না। রসদবাহী জাহাজগুলো পসিলিপপার পিছনে চলে গেছে। ওর উদ্দেশ্য পূরণ তো হয়েছেই। সঙ্গে বাড়তি লাভ হিসেবে দখল করেছে তিনটা গ্যালি। কাজেই লড়াইয়ের ময়দান ছাড়তে প্রসপেরোর কোন আপত্তি নেই। অবশ্যই বিজয় হয়েছে। প্রসপেরোর। কাজেই ও হুকুম করল জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে নেপলসের পথ ধরতে। সঙ্গে নিয়ে নিল দখলকৃত তিন গ্যালি। সেগুলোতে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করল ও। আর দাসদের চালানোর জন্য দিল ওয়ার্ডেন।

 একবার পিছু ধাওয়া করার চিন্তা করলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই চিন্তা থেকে সরে এল ল্যাণ্ডো। বিকেল নাগাদ বহর নিয়ে বন্দরে পৌঁছে গেল প্রসপেরো। বন্দরে ও এমন জাকাল সংবর্ধনা পেল যা খুব কম নৌ-কমাণ্ডারের ভাগ্যেই জোটে। প্রিন্স অভ অরেঞ্জ বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল ওকে। কারণ মাত্র ছয়টা জাহাজ নিয়ে দশটা জাহাজের বিরুদ্ধে লড়ে জিতে আসা কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। আর জিতেছে তো বটেই, সঙ্গে দখল করে এনেছে বিপক্ষের তিন-তিনটা গ্যালি। প্রসপেরোর এই মহান কীর্তির কথা সে সম্রাটের কাছে অবশ্যই বলবে বলে কথা দিল প্রিন্স। রসিকতা করে সে আরো বলল, প্রসপেরোর এই বিজয়ে সে নিজেও খানিকটা কৃতিত্বের দাবিদার। কারণ কাজটা সারার জন্য সে-ই প্রসপেরোকে বেছে নিয়েছিল।

এদিকে সাধারণ জনতার কাছে নায়কে পরিণত হয়েছে প্রসপেরো। কারণ ওর এই জয়ের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘদিনের অনাহার-অর্ধাহারের অবসান হতে চলেছে।

.

১২.

 ভুল সংশোধন

 সেপ্টেম্বর পার হওয়ার আগেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল প্রসপেরোর অনন্য কীর্তিগাথা। ছোট্ট একটা নৌযুদ্ধে এত বড় বিজয় চাট্টিখানি কথা নয়। কাজেই সারা ইটালিময় ছড়িয়ে পড়ল এই গল্প। শেষ পর্যন্ত মাদ্রিদে সম্রাটের কানেও পৌঁছল এই গল্প। নানামুখী খারাপ খবরের ভিতর এমন একটা খবর শুনে যারপরনাই খুশি হলেন সম্রাট।

ফ্লোরেন্সে বসে প্রসপেরোর মাও গল্পটা শুনেছে। পুত্রগর্বে উদ্ভাসিত হলো সে-ও। গল্পটা জেনোয়ায় পৌঁছুতেও বেশি সময় লাগল না। ঘরের ছেলের অনন্য গৌরবে গর্বিত হলো তারাও। অ্যাড়র্নো পরিবারের নাম আবার চলে এল সবার মুখে মুখে। বিশেষ করে ডোরিয়াদের শাসনে যারা ক্ষিপ্ত তারা প্রকাশ্যেই বলতে থাকল যে অ্যাডর্নো পরিবারকে আবার ক্ষমতায় আনা দরকার।

প্রসপেরোর বিজয়ের খবর ডেল ভাস্টোর কানেও গেছে। বন্ধুর এমন কৃতিত্বে ভীষণ খুশি হয়েছে সে। খবরটা অবশ্য লেরিকিতে ফিলিপ্পিনো আর ডোরিয়ার কানেও পৌঁছুল। ওরা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারল এর ফলে ওদের ঋণের বোঝা আরো ভারী হয়েছে। কারণ যাদেরকে প্রসপেরো বন্দি করেছে তাদের ছাড়াতে হলে মুক্তিপণ ডোরিয়াদেরকেই পরিশোধ করতে হবে।

একটু পিছনে যাই।

প্রসপেরোকে বন্দি করে ফিলিপ্পিনো তাকে দাসদের সঙ্গে দাঁড় বাইতে বসিয়েছে শুনে ভাতিজার উপর ভীষণ রেগে গিয়েছিল ডোরিয়া। শাসিয়েছিল, আহাম্মক, কবে বুঝতে শিখবে, শত্রুতা বাড়িয়ে কোন লাভ হয় না? শত্রুতার বিনিময়ে কেবল শত্রুতাই পাওয়া যায়। খুবই জঘন্য ও নীচ কাজ করেছ তুমি।

জবাবে ফিলিপ্পিনো বলেছিল, দ্রাগুতকে দাঁড়ে বসিয়ে আপনিও কিন্তু একই কাজ করেছিলেন। আমি শুধু ওদেরকে পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছি।

হা, ঈশ্বর! তোমার চোখে এ দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই? দ্রাগুতের সঙ্গে আমাদের জাতিগত, ধর্মর্গত শত্রুতা। ও ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাস করে।

জবাবে ফিলিপ্পিনো বলে, জাতি-ধর্মের ব্যাপারটা বাদ দিলে প্রসপেরোর বেলায়ও তো একই ব্যাপার। ও-ও আমাদের শত্রু। তাই না?

না, ভাতিজা। ওকে আমাদের লাভের জন্য অনায়াসে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু তার সঙ্গে কঠিন শত্রুতা দাঁড় করিয়ে দিয়েছ তুমি। মনে রেখ, তোমার কৃতকর্মের ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে।

তখন ফিলিপ্পিনো প্রসিডার কথা তুলে চাচার সামনে গজগজ করতে থাকে। কিন্তু তাকে কোন সহমর্মিতা দেখায়নি ডোরিয়া।

বর্তমানে ফিরে আসি।

নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে তার গ্যালিগুলোতে লোকবল ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম তুলছে ডোরিয়া। কারণ ফ্রান্সের রাজা তার জন্য আর খরচ করতে রাজি না। ফলে তার কাছে থাকা মূল্যবান বন্দিদের মুক্তিপণের টাকা আদায় করে কাজটা করতে, হচ্ছে। এই মূল্যবান বন্দিদের ভিতর দ্রাগুতও আছে। তার মুক্তির বিনিময়ে তিন হাজার ডাকাট মুক্তিপণ দিতে রাজি হয়েছে খায়ের আদ-দীন।

খবরটা প্রসপেরোর কানেও গেছে। ডোরিয়ার মানসিকতা নিয়ে খুব একচোট হাসল ও। কারণ দ্রাগুতকে বন্দি করেছিল ও। সুতরাং দ্রাগুতের মুক্তিপণের টাকা ওর পাওনা। উপরন্তু আগে একবার দ্রাগুতের মুক্তিপণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল আন্দ্রে। অছিলা দিয়েছিল যে খ্রিস্টান জাতির এমন এক শত্রুকে আর কখনোই সাগরে নামতে দেয়া উচিত হবে না। কিন্তু নিজের লেজে পা পড়তেই সবার আগে ডোরিয়ার মনে পড়েছে দ্রাগুতের মুক্তিপণের কথা। কাজেই প্রসপেরোর কৌতুক বোধ করাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

প্রসিডার যুদ্ধে প্রসপেরোর জয় স্প্যানিশদের জন্য বিরাট সুযোগ নিয়ে এসেছে। বলতে গেলে নেপলসের উপর থেকে ফ্রেঞ্চ অবরোধ ভেঙেই দিয়েছে ওই লড়াই। ল্যাণ্ডোও অবরোধ তুলে নেয়ার পক্ষে। কারণ প্রসপেরোর দখল করা গ্যালিগুলো মেরামত করিয়ে যদি ওর বিরুদ্ধেই নামিয়ে দেয়া হয় তাহলে ল্যাণ্ডোর টেকার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। এখন হারবার আর অস্ত্রাগারের দায়িত্বে আছে প্রসপেরো। সুযোগ পেলে সে যে একমুহূর্তও সময় নষ্ট করার বান্দা না, সেটা ল্যাণ্ডোও খুব ভাল করে জানে।

অর্থাৎ প্রসিডার লড়াইয়ে প্রসপেরো জেতায় ফ্রেঞ্চ-স্পেন দ্বৈরথের পুরো সমীকরণটাই উল্টে গেছে। স্পেন সম্রাটের লোকেরা রসদ নিয়ে আসতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে আসছে প্রচুর সামরিক সাহায্য। ফলে অবরোধকারীরা আর ওখানে টিকতেই পারল না। ওদিকে মহামারীর প্রকোপে ফ্রেঞ্চদেরও ভীষণ ভুগতে হয়েছে। এমনকী মার্শাল ডি লট্রেসও আশা ছেড়ে দিয়েছে। কারণ সে-ও ভালভাবেই বুঝতে পারছে, এত কিছুর পরও অবরোধ ধরে রাখতে চাওয়ার অর্থ মহামারী আর স্প্যানিশদের তলোয়ারের নিচে স্বেচ্ছায় গলা পেতে দেয়া। ফলে সৈন্য প্রত্যাহারের হুকুম করল সে। কিন্তু ভুল পথে পশ্চাৎপসরণ করল লট্রেস। ফলে তার পিছু ধাওয়া করার সুযোগ পেয়ে গেল প্রিন্স অভ অরেঞ্জ।

ইটালির মাটিতে এটাই ছিল ফ্রেঞ্চদের শেষ অভিযান।

এরপর প্রসপেরোর কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ স্পেন সম্রাট প্রসপেরোকে প্রদান করেন নিয়াপলিটান ফ্লিটের ক্যাপ্টেন জেনারেল পদবিসহ এই বহরের সর্বময় কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব। মাদ্রিদ থেকে ডেল ভাস্টোর পাঠানো চিঠিও পৌঁছেছে প্রসপেরোর কাছে। চিঠিতে সে নিশ্চিত করেছে, সম্রাটের দরবারে প্রসপেরোর আসন এখন খুবই পোক্ত। এবং ওকে নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন সম্রাট।

জেনোয়া থেকেও সংবাদ এসেছে। সেটা হচ্ছে, ফ্রান্সের রাজার সঙ্গে চুক্তি খতম করে দিয়েছে ডোরিয়া। এরপরই জনসমক্ষে প্রকাশ পায়, ডোরিয়াকে নিজের অধীনে কাজের প্রস্তাব দিয়েছেন স্পেন সম্রাট। আর ডেল ভাস্টোর মত যে দুয়েকজন সম্রাটের খুবই ঘনিষ্ঠ কেবল তারাই জানত যে, সম্রাটের ইচ্ছা মেডিটেরানিয়ান ফ্লিটের সর্বময় কর্তৃত্ব ডোরিয়ার হাতে তুলে দেয়া। খবরটা দুকান হতেও অবশ্য বেশি সময় লাগল না। স্পেনের নানা মহল থেকে কথা উঠতে শুরু করল। সমালোচকরা রাজনীতির অলিগলিতে শোর তুলল যে, স্পেনের নিজেদের এত মেধাবী অফিসার থাকতে বাইরের একজন লোককে কেন এত ক্ষমতাশালী পদ দেয়া হবে। কিন্তু সমালোচকের সমালোচনায় দমে যাওয়ার পাত্র সম্রাট নন।

স্পেন সম্রাটের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লেরিকি দুর্গ থেকে বেরিয়ে জেনোয়ায় চলে গেল ডোরিয়া। একদল সেনা মোতায়েন করে জেনোয়া থেকে ফ্রেঞ্চ সৈন্যদের তাড়িয়ে জেনোয়ায় নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করল সে। মহামারী আক্রান্ত জেনোয়ার উপর থেকে অসুখের ছায়া সরানোর ব্যাপারেও পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তা করল। এরপরই জেনোয়ার শাসন ব্যবস্থা আবার ঢেলে সাজানোর কাজেও হাত দিল সে। কারণ স্পেন সম্রাটের ছত্রচ্ছায়ায় জেনোয়ার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। তারপর জনসমক্ষে সাফাই দিল যে, ফ্রেঞ্চ রাজা ফ্রান্সিস ওয়াদা ভঙ্গ করায় তার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে ডোরিয়া। এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ হচ্ছে মাতৃভূমি জেনোয়াকে যে-কোন বহির্শক্র বা বহির্শক্তির রাহুগ্রাস থেকে নিরাপদ ও মুক্ত রাখা।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জনসমর্থন পেয়ে গেল ডোরিয়া। জনসাধারণ আরেকবার তাকে গ্রহণ করল জেনোয়ার ত্রাতা হিসেবে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই জেনোয়ার ডিউকাল ক্রাউন গ্রহণের প্রস্তাব করা হলো তাকে। এতদিন তার নির্ধারিত লোকেরাই মুকুট মাথায় দিয়ে জেনোয়া শাসন করেছে। এবার সুযোগ এসেছে তার নিজের মাথায় মুকুট পরার।

কিন্তু মুকুট মাথায় তুলল না চতুর ডোরিয়া। বরং জেনোয়ার শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এল সে। ডজের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে পাঁচজন সেনসরের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিল ডোরিয়া। নিয়ম করে দিল যে, নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসবে সেনসররা। তবে এটা হবে চারজনের বেলায়। পঞ্চম সেনুসর হচ্ছে স্বয়ং ডোরিয়া। এবং সে আজীবনের জন্য সেনসরের পদ গ্রহণ করেছে। তবে স্কিপিওনি বা প্রসপেরো যেমনটা আশা করেছিল তেমন কিছুই হলো না। কোন দ্বন্দ্ব তৈরি না করেই ক্ষমতায় আরোহণ করল ডোরিয়া।

এরপরই শোনা গেল পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট-এর ভাস্তি ম্যাডোনা পেরেট্টা উসোডিমারে-কে বিয়ে করেছে ডোরিয়া। ওই মহিলা মারকুইস অভ ফেনারো-র বিধবা স্ত্রী। বিয়ে উপলক্ষে নেপলসেও জোর ধুমধামের সঙ্গে বিশাল উৎসবের আয়োজন করা হয়। বিয়ে উপলক্ষে ডোরিয়াকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সবাই, কিন্তু প্রসপেরোর মুখে একটুও হাসি নেই। কারণ ডোরিয়াকে মেডিটেরানিয়ানের অ্যাডমিরাল বানিয়ে দেয়া হয়েছে। মানে স্প্যানিশ নেভির সর্বাধিনায়ক এখন ডোরিয়া। আর প্রসপেরো হচ্ছে নিয়াপলিটান ফ্লিটের ক্যাপ্টেন জেনারেল। অর্থাৎ ডোরিয়ার অধীনেই আবার কাজ করতে হবে প্রসপেরোকে। কাজেই সামনে এখন একটাই বিকল্প দেখতে পাচ্ছে প্রসপেরো। সেটা হচ্ছে স্প্যানিশ নেভি থেকে পদত্যাগ করা।

কিন্তু প্রসপেরোর পদত্যাগপত্র পেয়ে ভীষণ রেগে গেল প্রিন্স। এমনকী নিজের অবস্থান ভালভাবে বোঝানোর পরও ওর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করল না সে। উল্টো প্রসপেরোকে সে বোঝাল, ডোরিয়ার হাত থেকে কেবল সম্রাটের নির্দেশই ওকে নিরাপত্তা দিচ্ছে না বরং জেনোয়ার নাগরিকদের জনমতও ওকে নিরাপত্তা দেবে।

অক্টোবরের এক বৃষ্টিঝরা ও কুয়াশাচ্ছন্ন দিন। ইসিচা হয়ে নেপলসের বন্দরে তিন গ্যালির ছোট্ট বহর ভেড়াল জিয়ানেট্টিনো। স্পেন সম্রাটের সেবায় যেহেতু তারা যোগ দিয়েছে তাই ভাইসরয়ের কাছে রিপোর্ট করতে এসেছে সে। তারপর দেখা করতে চাইল প্রসপেরোর সঙ্গে। খবর পেয়ে দেখা করতে রাজি হলো প্রসপেরো।

জিয়ানেটিনোর পরনে কটকটা লাল রঙের একটা ডাবলেট। আর পোশাকের উপর দিয়ে তার চওড়া বুকের উপর আড়াআড়ি করে বাঁধা স্বর্ণের লেস। যথারীতি গর্বোদ্ধত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করেই এল সে। তবে যখন কথা বলল কণ্ঠে ফুটে উঠল আন্তরিকতার ছোঁয়া। প্রসপেরো আসার পর এমনভাবে জিয়ানেট্টিনো এগিয়ে গেল যেন পুরানো বন্ধুর দেখা পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে সে। ঘোষণা দিল জেনোয়ার সন্তানের মহান কীর্তিতে সে নিজেও গর্বিত। আরো বলল, সে এসেছে শান্তির বার্তা নিয়ে। সেইসঙ্গে তার চাচা অ্যাডমিরালের তরফ থেকে ঘোষণা করল, নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রসপেরোর হাতে। লর্ড ডোরিয়া তাদের আবার একত্রিত হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন।

ঘোলাটে দৃষ্টিতে একবার জিয়ানেট্টিনোর দিকে তাকাল প্রসপেরো। তারপর বলল, শান্তি বজায় রাখার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে, আমার সিদ্ধান্ত ভাইসরয়কে জানিয়ে দিয়েছি।

জিয়ানেট্টিনো একবার দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে ভাইসরয়ের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিল। সন্দেহ নেই খুব ভালভাবে শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠানো হয়েছে ওকে। বলল, শ্রদ্ধার সঙ্গেই বলছি, স্যর প্রসপেরো, লর্ড আন্দ্রে ইম্পিরিয়াল ফ্লিটের প্রধান হয়েছেন সম্রাটের ইচ্ছায়, নিজের ইচ্ছায় না।

ভাইসরয় সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে বাতাস কোনদিকে বয়। অবস্থা বুঝে তাড়াতাড়ি সে বলল, প্রয়োজন পড়লে লর্ড ডোরিয়ার হুকুম অনুযায়ী কাজ করবে তুমি, প্রসপেরো। আর তার আন্তরিকতার নমুনা তো নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছ।

প্রসপেরো বলল, ইয়োর হাইনেস, আপনি জানেন, এই চাকরিতে আমি আর থাকতে চাচ্ছি না।

রাগে লাল হয়ে গেল জিয়ানেট্টিনোর চেহারা। কিন্তু ও কিছু বলে ফেলার আগেই কথা বলে উঠল ভাইসরয়। বলল, আমি এখনও আশা করি, তুমি শীঘ্রিই মত পরিবর্তন করবে। আশা করি তাতে মেসার জিয়ানেট্টিনোও সাহায্য করবে। হাসিমুখে কথাটা বলল প্রিন্স। তারপর বলল, তবে, মেসার জিয়ানেট্টিনো, আমি মনে করি, প্রসপেরোর এই কঠোর মনোভাবের দায় খানিকটা আপনাদের পরিবারেরও। কাজেই ওর মন গলাতে খানিকটা ধৈর্য তো ধরতেই হবে।

প্রসপেরো ধরেই নিয়েছিল যে, প্রিন্সের কথায় রাগে ফেটে পড়বে জিয়ানেট্রিনো। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে স্বভাবসুলভ ঘাড়ত্যাড়ামির বদলে একবার মাথা নাড়ল সে। বলল, হ্যাঁ, আমি মানি সেটা। তাই শুধু ধৈর্য ধরছি না, সঙ্গে ওই ভুলের জন্য অনুতাপও প্রকাশ করছি।

সঙ্গে সঙ্গেই জিয়ানেট্টিনোর কথাটা ধরে বসল প্রিন্স। উৎসাহব্যঞ্জক কণ্ঠে প্রসপেরোকে বলল, শুনলে তো?

প্রসপেরো শুনেছে অবশ্যই। তবে কোন মন্তব্য করল না ও। বরং অপেক্ষায় রইল, জিয়ানেট্টিনো আর কী বলবে। জিয়ানেট্টিনো অবশ্য ওকে অপেক্ষায় রাখেনি। আসলে সে থামেইনি। বলে চলেছে, তুমি নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছ যে, যেদিন… দ্বিধান্বিতভাবে থেমে গেল জিয়ানেনিনা।

তখন কথা জোগান দিল প্রসপেরো। বলল, …হ্যাঁ, যেদিন শেকলে বেঁধে তোমার ভাই আমাকে দাসদের সঙ্গে দাঁড় টানতে বসতে বাধ্য করল সেদিন থেকেই সব বদলে গেছে। এই তো বলবে? অথবা বলতে পারো যখন তোমার ভাই আমাকে পোপের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর নামে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে দেখতে চেয়েছিল তখন থেকেই সব বদলে গেছে। তাই না? নাকি এভাবে বলব যে, যেদিন লর্ড ডোরিয়া আমার বাবার বিশ্বাস ভঙ্গ করে ডিউকাল অফিস থেকে পালিয়ে আসতে তাকে বাধ্য করেছিল যাতে তার ইচ্ছামত কোন পুতুল শাসক বসাতে পারে…

কালো হয়ে গেছে জিয়ানেট্টিনোর চেহারা। এমনকী ভাইসরয়ও বিব্রত বোধ করছে। সে-ই তখন বলল, আহা, প্রসপেরো, আমরা তো সন্ধি করেছি, তাই না? তাহলে পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটার কী দরকার? তাতে কেবল দুর্গন্ধই ছড়াবে।

কেন ঘাঁটব না, আমাকে কি ওসব সহ্য করতে হয়নি?

হ্যাঁ, হয়েছে। কিন্তু এখন মেসার জিয়ানেট্টিনো এসেছে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে। তোমাকে আঘাত করতে নয়।

একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে হলেও তখন কথা বলল জিয়ানেট্টিনো। বলল, খালি হাতে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আসিনি। অতীতের সমস্ত ভুল আমরা স্বীকার করছি। কিন্তু একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখতে পারো তাহলে বলব, লর্ড ডোরিয়ার একমাত্র ইচ্ছা ছিল জেনোয়ার উন্নতি। তিনি তোমার সঙ্গে বেইমানি করেছে বলছ তুমি। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করতে পারবে যে তার সঙ্গেও বেইমানি করা হয়নি? তুমি নিজে একজন দেশপ্রেমী মানুষ। তোমার তো এই ব্যাপারটা অবশ্যই বোঝা উচিত।

জবাবে প্রসপেরো বলল, সন্দেহ নেই, ডোরিয়াদের মত করে দেশকে আমি এখনও ভালবাসতে শিখিনি।

এমনকী আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্যকেও তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না, বলল জিয়ানেট্টিনো।

হ্যাঁ, এমনকী সেটাও পারছি না, জবাব দিল প্রসপেরো।

তখন জিয়ানেট্টিনো বলল, আমাদের প্রস্তাব যে আন্তরিক তার কিছু নমুনা নিয়ে এসেছি। দ্রাগুতের কথা তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। ওকে পরাজিত ও বন্দি করার কৃতিত্ব তোমার।

প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, তোমাদের আন্তরিকতার নমুনা হচ্ছে, তিন হাজার ডাকাটের বিনিময়ে খায়ের-আদ-দীনের কাছে তাকে বিক্রি করে দিয়েছ। তোমাদের ওই লেনদেনের কথা আমাদের কানেও এসেছে।

এবার হেসে উঠল জিয়ানেট্টিনো। বলল, আহ, এত সহজেই যদি অন্য সবকিছুতেও আমাদের প্রতি তোমার অবিশ্বাসটা ভুল প্রমাণ করতে পারতাম…। ওই তিন হাজার ডাকাট ব্যাঙ্ক অভ সেইন্ট জর্জে তোমার নামে জমা করা হয়ে গেছে। এই নাও তার রসিদ। বলতে বলতে একটা কাগজ সে বাড়িয়ে ধরল প্রসপেরোর দিকে।

একমুহূর্তের জন্য থমকাল প্রসপেরো। ভাবল, টাকাটা গ্রহণ করলে তা হবে ডোরিয়াদের আন্তরিকতাকে স্বীকৃতি দেয়া। তারপর কোটা ওদের কূটনীতি আর কোন্টা রাজনীতি তা ধরা তো যাবেই না, এমনকী ও বললেও কেউ বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ। কাজেই এমন কিছু ঘটতে দেয়া উচিত হবে না। ওদিকে জিয়ানেট্টিনো কথা বলছে আর নীরবে রসিদটা দেখছে প্রসপেরো।

বলছে জিয়ানেনিনা, লর্ড ডোরিয়া বলতে বলেছে যে, এই লেনদেনটা আমাদের আন্তরিকতার নিদর্শন। তার আশা, অন্তত জেনোয়ার ভালর জন্য হলেও ব্যাপারটা তুমি বুঝবে বা মেনে নেবে। প্রসিডার লড়াইয়ের ঘটনাই বলে দেয় দেশের জন্য তুমি কত বড় সম্পদ। কোন দেশই চাইবে না তোমার মত একজন লোকের সেবা থেকে দেশকে বঞ্চিত করতে। সুতরাং বুঝতেই পারছ, জেনোয়ায় তোমার শূন্য ঘর তোমার পদার্পণের অপেক্ষায় রয়েছে। অ্যাডর্নোরা নিজেদেরকে জেনোয়ায় অবাঞ্ছিত ভাবুক তা আমরা কেউ চাই না। লর্ড ডোরিয়ার হয়ে বলছি, অ্যাডর্নোদের প্রত্যাগমনকে অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে।

তিক্ত একটু হেসে প্রসপেরো বলল, কসম খোদার, উপহারের পর উপহার দিয়ে রীতিমত স্তূপ করে ফেলছ।

জিয়ানেট্টিনোর চেহারাটা আবার কালো হয়ে গেল। বলল, আমার কাজটাকে তুমি কেবল কঠিন করে তুলছ।

ঠিক তখন এগিয়ে এল ভাইসরয়। প্রসপেরেরার কাঁধে হাত রেখে সে বলল, বন্ধু, একটু নরম হও। একটা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা, তোমাকে বিবেচনা করতে হবে। সেইসঙ্গে তোমার নিজ দেশ জেনোয়ার স্বার্থও দেখা লাগবে। রাগ সামলাও।-এখন ডোরিয়ারা আর তুমি উভয়ই একই জাহাজের সওয়ারি।

জবাবে প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, মেসার জিয়ানেট্রিনো আগেই এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। কিন্তু এই গ্যারান্টি তো কেউ আমাকে দিচ্ছে না যে, ডোরিয়ারা আবার পক্ষ পরিবর্তন করলে আমার সঙ্গে কী ঘটবে।

শুনে ধৈর্য প্রায় হারিয়েই ফেলল জিয়ানেট্টিনো। রীতিমত আর্তনাদ করে বলল, এ কেমন কথা? এমন উস্কানিমূলক কথার, অর্থ কী? তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সহজেই বুঝত যে, তোমার সঙ্গে ইচ্ছাকৃত বেইমানি করা হয়নি। আসলে আমার চাচার সঙ্গেই বেইমানি করেছে ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস। ফ্রেঞ্চ রাজের প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে তোমার বাবাকে জেনোয়ার গেট খুলে দিতে অনুরোধ করেছিলাম আমরা। সে বলেছিল জেনোয়ার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অবশ্যই রক্ষা করা হবে। কিন্তু পরে যা হয়েছে তার দায় ফ্রেঞ্চ রাজের। সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করলে এসব কিছুই ঘটত না।

শীতল কণ্ঠে তখন প্রসপেরো বলল, ওটা নিয়ে অনেক বিতর্কের অবকাশ আছে।

আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তুমি তো গ্যারান্টি চাও, বেশ গ্যারান্টিই দিচ্ছি। আমরা আগেই আশা করেছিলাম তুমি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। তাই সবকিছু একেবারে মিটমাট করে নেয়ার জন্য একটা বিশেষ প্রস্তাব এনেছি আমি। লর্ড আন্দ্রে তোমাকে আমাদের ঘরের মানুষ হিসেবে পেতে চায়। তার ভাতিজি মারিয়া জিয়োভান্নার সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব করছেন। তিনি। সঙ্গে বিয়ের উপহার হিসেবে থাকছে ত্রিশ হাজার ডাকাট আর প্যারাকোটির বিস্তীর্ণ উর্বরা জমি। মুহূর্তখানেক বিরতি নিল জিয়ানেট্রিনো.। তারপর কামানের গোলাবর্ষণের মত হুঙ্কার ছেড়ে বলল, এই প্রস্তাবটাকে যথেষ্ট গ্যারান্টি বলে মনে করো?

বিস্ময়ে বড়-বড় হয়ে গেছে প্রসপেরোর চোখ দুটো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো সে দুটো। ওর কাঁধ চাপড়ে দিল ভাইসরয়। তারপর হিসেব করতে লাগল প্রসপেয়োর বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য ডোরিয়া কত বড় প্রস্তাব দিয়েছে। মুখে বলল, দ্রাগুতের মুক্তিপণ। তিন হাজার ডাকটি, জেনোয়ায় অ্যাডোর্নিদের সম্পত্তির উপর পুনর্দখল প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আর বিয়ের প্রস্তাব, সঙ্গে রাজকন্যার উপযুক্ত যৌতুক। এবার হয়তো তোমার রাগ কমবে, কি বলো, প্রসপেরো?

প্রসপেরো একটু সরে দাঁড়াল। তারপর নীরবে হেঁটে চলে গেল জানালার কাছে। ধূসর সাগর আর গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টিতে বাইরের জগৎটাকে দারুণ রহস্যময় লাগছে। ও ভাবছে, সন্ধি করাটাকে অবশ্যই ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে ডোরিয়ারা। নইলে এমন মরিয়া প্রয়াস করত না। প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখছে ও। একদিকে ডোরিয়াদের প্রতি ওর ঘৃণা ও বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া। কিন্তু এর অবধারিত ফল লেডি জিয়ান্নাকে চিরতরে হারানো। অপরদিকে আছে ডোরিয়াদের প্রস্তাবের মূল্য।

প্রসপেরো ওর বাবাকে হারিয়েছে। বলা চলে লেডি জিয়ান্নাও ওর নাগালের অনেক বাইরে। কিন্তু তারপরও কথা থেকেই যায়। দুনিয়াবী সামান্য সুখ-শান্তির বিনিময়ে নিজের কর্তব্য কি ত্যাগ করা সম্ভব? কথায় আছে, সব মানুষেরই একটা মূল্য আছে। কিন্তু একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লোক কি স্রেফ অর্থ-কড়ির বিনিময়ে মান-সম্মান খোয়াতে পারে? এখন ও যদি ডোরিয়াদের প্রস্তাব গ্রহণ করে, তাহলে ঘটনা তো সেটাই দাঁড়ায়।

ঘুরে দাঁড়াল প্রসপেরো। অপেক্ষমাণ দুজনের দিকে ফিরে বিমর্ষ গলায় ধীরে ধীরে বলল, অনেক দিন আগে একটা তলোয়ারের গায়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। সেটা ছিল, উপযুক্ত কারণ ছাড়া আমাকে ব্যবহার কোরো না, আর অসম্মানের সঙ্গে আমাকে খাপবন্দি কোরো না। অমন একটা, তলোয়ার বের করেছ তোমরা। কারণটা উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত যা-ই হোক, এখন অসম্মানের সঙ্গে সেই তলোয়ারকে খাপে ঢোকানো সম্ভব না।

লম্বা একমুহূর্তের জন্য ঘরে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। ভাইসরয়ের চোখে বিব্রত দৃষ্টি। আর জিয়ানেট্টিনোর চোখে তীব্র রাগ। প্রথমে নীরবতা ভাঙল জিয়ানেট্টিনো। রীতিমত গর্জে উঠে সে বলল, খোদার কসম, তুমি বলতে চাইছ, আমাদের প্রস্তাবে (তামার উপযুক্ত সম্মান দেয়া হয়নি? বলছ কী এসব? এ তো রীতিমত আমাদেরকে অপমান করা। ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করছ তুমি, প্রসপেরো। এই কথাটা অবশ্যই সাধারণভাবে নেয়া সম্ভব না। তোমাকে আমি…।

জিয়ানেট্টিনোর হাত ধরে ফেলল ভাইসরয়। বলল, একটু অপেক্ষা করুন। প্রস্তাবটা হজম করার মত সময় প্রসপেরোরও দরকার আছে। এত দ্রুত আপনার প্রস্তাবের গুরুত্ব ও হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। কাজেই দ্রুত কোন সিদ্ধান্তে আসা প্রসপেরো বা আপনার-কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। তাই চাপাচাপি করার আগে ব্যাপারগুলো ভালভাবে বোঝার জন্য বেচারাকে একটু সময় দিন। আর এর মাঝে কী উচ্চারিত হয়েছে না হয়েছে তা ভুলে গেলেই সবার জন্য মঙ্গল। বলে জিয়ানেট্রিনো আর প্রসপেরো উভয়ের চোখের দিকে তাকাল। ভাইসরয়। তারপর প্রসপেরোকে সে বলল, আশা করি, চূড়ান্ত জবাব দেয়ার আগে অন্তত কিছুটা সময় চিন্তা করবে তুমি।

প্রসপেরো বলল, আপনি যখন বলছেন, চিন্তা আমি অবশ্যই করব। কিন্তু মনে হয় না তাতে আমার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসবে।

যতটুকু আশাও ছিল, প্রসপেরোর অনড় সিদ্ধান্তের কথায় তাও আর থাকল না। সেই রাতে জিয়ানেট্টিনো চলে যাওয়ার পর প্রসপেরোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সাধ্যমত সর্বোচ্চ চেষ্টা করল প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। একবার বন্ধুর মত, আবার ইম্পিরিয়াল বাহিনীর কর্তাব্যক্তি হিসেবে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল সে। বলল ইম্পিরিয়াল ক্যাপ্টেন হিসেবে কতটা উন্নতি প্রসপেরো করতে পারবে। তাছাড়া সম্রাট নিজেও প্রসপেরোর প্রতি প্রসন্ন। তার ছত্রচ্ছায়ায় উন্নতির শিখরে পৌঁছতে প্রসপেরোর খুব একটা সময় লাগবে না। কিন্তু ডোরিয়াদের প্রস্তাব পায়ে ঠেলে দিলে অনেক-অনেক সুবিধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে ও।

সেদিন ভাইসরয়ের এত নসিহতেও কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু পরদিন সকালে প্রসপেরো ঘোষণা করল যে, সারা রাত চিন্তা করে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মত পরিবর্তন করবে। শুনে একইসঙ্গে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে উঠল সবাই। আনন্দিত কণ্ঠে ভাইসরয় বলল, এর চেয়ে ভাল খবর শেষ কবে শুনেছি মনে পড়ছে না। আমি খুশি যে তুমি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আরো খুশি তোমার নিজের জন্য। আর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি, কারণ এখন তুমি দেখতে পাচ্ছ যে পিছুটান তোমাকে কীভাবে অন্ধ করে রেখেছিল।

ভাইসরয়ের শেষ কথাটায় প্রসপেরো বলল, আমি কিন্তু বলিনি যে অমন কিছু আমি দেখতে পেয়েছি।

দেখতেই হবে। নয়তো এত বড় সিদ্ধান্ত তুমি নিতেই পারতে না। যাক, শেষ পর্যন্ত ডোরিয়াদের তুমি বিশ্বাস করতে পেরেছ সেটাই আসল কথা। ডোরিয়ারা এই গ্যারান্টি ভাঙবে না বলেই মনে হচ্ছে।

এক চিলতে কুটিল হাসি খেলে গেল প্রসপেরোর মুখে। হাসিটা ধরে রেখেই ও বলল, আপনারও এই বিশ্বাস? একবারও কি মনে হয়নি, ডোরিয়া বংশে আমার বিয়ের অর্থ ওদের তরফ থেকে নিশ্চয়তা দেয়া নয়, বরং আমার কাছ থেকে ওদের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেয়া? আমি নিজেও এই ব্যাপারটা অনেক দেরিতে বুঝেছি।

শুনে প্রিন্সের মুখটা প্রথমে একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তারপর কথাটা উড়িয়ে দিয়ে সে বলল, অনেক লম্বা চিন্তা করে ফেলেছ। কিন্তু কথা হচ্ছে নিশ্চয়তা তো দুই পক্ষ থেকেই আসতে হবে।

ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে চিন্তিত কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, নাহ্, অত সহজ নয়। ওরা আসলে নিশ্চয়তা চাইছে যে আমার ৩লোয়ার খাপে ভরা থাকবে।

মুহূর্তখানেক চিন্তা করল প্রিন্স। তারপর একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কিন্তু শেষ কথা হচ্ছে, আপাতত হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এটাই আসল কথা।

.

১৩.

 মায়ের জেরার মুখে প্রসপেরো

 নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের কমাণ্ডারের পদ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই পদাধিকারী তার অধীনস্থ গ্যালিগুলোর রসদ সংগ্রহ, যাবতীয় মালামাল সরবরাহ, যন্ত্রপাতি ও অস্ত্র-গোলাবারুদে সজ্জিত করা, গ্যালি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল সংগ্রহ ও প্রয়োজনানুযায়ী তাদের বিন্যস্ত করা ইত্যাদির দায়িত্বে থাকে।

আসছে বসন্তে নেপলসে থাকতে হবে প্রসপেরোকে। তাই সমস্ত লটবহর আর লোকলস্কর জোগান দেয়াসহ দ্রুতগতিতে চলছে অন্যসব প্রস্তুতিমূলক কাজ। এরমধ্যেই কয়েকদিন সময় হাতে নিয়ে জেনোয়ায় যেতে মনস্থির করেছে প্রসপেরো। কারণ ওখানে সম্পদ পুনরুদ্ধারের একটা ব্যাপার আছে। সেইসঙ্গে বিয়ের অপেক্ষায় বসিয়ে রাখা ডোরিয়াদের নির্বাচিত পাত্রী বেচারির সঙ্গে দেখা করার ঝামেলা তো রয়েছেই।

এরই মধ্যে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর খানিকটা সময় বের করে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ফ্লোরেন্সে গেল প্রসপেরো। কিন্তু দেখা করতে এসে রীতিমত বিপদেই পড়ে গেল ও। প্রসপেরোকে দেখে ওর মা যতটা না খুশি হয়েছে, ওর ঘটনা শুনে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি খেপে গেছে সে। তখনই তার তীব্র মন্তব্য, আজকের পর থেকে তোমার নিজের রক্তের লোকেরা তোমাকে ডাকবে ইহুদি অ্যাডর্নো বলে। ওই খুনি আততায়ীদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছ তুমি! ওদের হাতে তোমার বাবার রক্তের দাগ লেগে আছে, অথচ ওদের সঙ্গেই শান্তিচুক্তি করেছ? তোমার সাহসের বলিহারি, এখানে আবার এসেছ আমাকে এই গল্প শোনাতে?

ঠিক এই রকম প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিল প্রসপেরো। দুর্বল গলায় একবার শুধু ও বলল, যা করেছি তার ব্যাখ্যাই তো দিলাম।

ব্যাখ্যা দিয়েছ? তোমার ব্যাখ্যা কি এই সত্য পরিবর্তন করতে পারবে যে ওদের হাতে তোমার বাবার রক্ত লেগে আছে?

মায়ের মুখের দিকে তাকাল প্রসপেরো। এই বয়সেও যেন তারুণ্যের দীপ্তি তাকে ছেড়ে যায়নি। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ও বলল, সত্য কী বলো তো, মা? কোন একটা ব্যাপারকে কেউ যেভাবে দেখে সেটাই তো, নাকি? তাহলে, একজনের কাছে যেটা সত্য, আরেকজনের কাছে ঠিক ওই একই ব্যাপার তো সত্য-ও হতে পারে।

কিন্তু এই কথাগুলো ওর মায়ের উপর একটুও প্রভাব ফেলল না। তার রাগ একবিন্দুও কমল না। সে বলল, আমার সামনে দর্শনের বুলি কপচিয়ো না। দর্শনের চাদরে নিজেকে আড়াল করে লাভ নেই। তাতে তোমার অসম্মান একটুও কমবে না। সত্যি হচ্ছে তুমি নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছ। আর এই একটা সত্যের ব্যাপারে কারো মধ্যেই দ্বিমত নেই। দ্রাগুতের দাম হিসেবে তিন হাজার ডাকাট আর ডোরিয়া ঘরের মেয়ের জন্য যৌতুক হিসেবে ত্রিশ হাজার ডাকাট, এই কয়টা টাকার বিনিময়ে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছ তুমি, ইহুদি অ্যাডর্নো। আজ থেকে সবাই তোমাকে এই নামেই জানবে।

বাদামি চুলগুলোর ভিতর একবার হাত চালিয়ে প্রসপেরো বলল, কিন্তু অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়েছে, মা।

হা, করেছই তো। নিজের লাভটা খুব ভালভাবে বিবেচনা করেছ।

আর কিছুই কি তোমার চোখে পড়ছে না? জেনোয়া থেকে অ্যাডর্নোদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। যে কোন সময় তার জেনোয়ায় ফিরে গিয়ে নিজেদের সম্পদের দখল নিতে পারবে। আমার চুক্তি থেকে ওরা যদি লাভবান হতে পারে, তো ক্ষতি কোথায়? এটাও তো মানবতা।

কৌতুক করছ?

তাছাড়া, মা, তোমাকে নিয়েও কিছু চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে।

আমাকে নিয়ে? মিথ্যা কথা বোলো না। এসবের ভিতর আমার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে? আর কে-ই বা কবে আমাকে নিয়ে ভেবেছে? সারা জীবন তো বোকার মত অন্যদের নিয়ে ভেবে গেছি আমি।

এখানে তুমি সবসময় একা থাকো। সময় হয়েছে তোমার একাকীত্বের যন্ত্রণা লাঘব করার।

একাকীত্ব? একাকীত্ব নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল কবে?

ছিল। খুব তিক্ততার সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে অভিযোগ করতে তুমি। এমনকী সেজন্যও আমাকেই দায়ী করতে।

তাই বুঝি বেশরমের মত ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ? বেইমান কোথাকার! আমি জন্মেছি এ দেশের গৌরবান্বিত স্ট্রোজ্জি পরিবারে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জেনোয়ায় জন্মাইনি। ডোরিয়াদের কারণে আমাকে এত ভোগান্তি, কষ্ট সহ্য করার পরও ডোরিয়াদের মেয়ে তোমার বউ হয়ে এলে মাবাই যাব আমি, বলতে বলতে কেঁদে ফেলল প্রসপেরোর মা।

একটু সামনে এগিয়ে গেল প্রসপেরো। মায়ের চেয়ারটার পাশে দাঁড়িয়ে মা বলে ডাক দিল তাকে।

নাটকীয় জবাব দিল মহিলা। বলল, ওই নামে আমাকে আর কখনো ডাকবে না। চলে যাও। লজ্জা আর যন্ত্রণায় আমি এখানেই ধুঁকতে ধুঁকতে মরব। তোমার পছন্দের জেনোয়ায় যাও। ওই অভিশপ্ত জেনোয়ার সাগরে না আছে মাছ, পাহাড়ে না আছে গাছ আর ওই দেশের মানুষদের না আছে লাজ। তবে হ্যাঁ, স্বীকার করছি, ওই দেশে নির্লজ্জ মেয়েমানুষের অভাব নেই। ওটাই তো তোমার দেশ। যাও, ওই দেশেই চলে যাও। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্লজ্জের মত ভোগ করো ডোরিয়াদের ঘুষ। সময় এলে পরে, তোমার বাবা যেমন মারা গেছে তেমনি তুমিও মারা যেয়ো।

বাবার নামে বাজে কথা প্রসপেরো কখনো সইতে পারে না। কাজেই প্রতিবাদ করল ও, তোমার যা যা অভিযোগ আছে সেগুলো আমাকে বললো। আমি তার জবাব দেব। কিন্তু বাবাকে এরমধ্যে টেনে না। শান্তিতে থাকতে দাও তার আত্মাকে।

তোমার ধারণা শান্তিতে আছে সে? যাও, চলে যাও, বলতে বলতে তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুর ফোঁটা।

প্রসপেরো দ্বিধাগ্রস্ত, ও আসলে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, কী বলবে। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, মা, আমার চিন্তাভাবনা বিবেচনা করছ না তুমি। বিবেচনা না করেই দোষারোপ করছ।

তোমার চিন্তা! হা, ঈশ্বর! রহম করো। এত কিছু শোনার পরও তোমার চিন্তাভাবনা আমাকে মানতে হবে? আর কিছুই আমি শুনতে চাই না।

কথাটা এড়িয়ে গেল প্রসপেরো। বলল, স্ট্রোজ্জি পরিবারের আতিথেয়তা ছাড়তে হবে, মা। তোমাকেও আমার সঙ্গে জেনোয়ায় তোমার নিজের বাড়িতে যেতে হবে।

অভিশাপ পড়ক জেনোয়ার উপর। ওই দেশ আর কখনো দেখতে চাই না। কিন্তু তুমি আমাকে নিয়েই ছাড়বে যাতে ডোরিয়াদের সঙ্গে তোমার নির্লজ্জ চুক্তির শর্ত পুরো করতে পারো। যাতে সবাই আঙুল তুলে আমাকে দেখিয়ে বলতে পারে, ওই যায় ইহুদি অ্যাডর্নোর মা, বলতে বলতেই বিকারগ্রস্তের মত হা-হা করে হেসে উঠল সে। তবে তার হাসিতে প্রকাশ পেল কেবল যন্ত্রণা আর আর তীব্র রাগ। তারপর সে বলল, আমি এখানেই থাকব। এখানে অন্তত অন্যদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে পারব। তোমার ভুলের কারণে তোমার বাবা মারা গেছে। এখন চাইছ আমাকেও মারতে। এর চেয়ে ভাল কিছু অবশ্য তোমার কাছে আমি আশাও করি না। যাও, চলে যাও। আমি জেনোয়ায় ফিরব না।

বিচার-বিবেচনা না করে আমাকে কেবল বকতেই থাকবে?

বকব না তো কি প্রশংসা করব? এই কাজের পরও প্রশংসা আশা করো তুমি?

আমি কেবল আশা করি, আমার বিচার-বিবেচনার উপর বিশ্বাস রাখবে তুমি।

ব্যঙ্গ করে প্রসপেরোর মা বলল, তা, আমাকে যা-যা বলেছ, তোমার জ্ঞানের আলো দিয়ে বিবেচনা করেই বলেছ, তাই না?

প্রসপেরো স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, সত্য কথাটা এবার মাকে জানাতেই হবে। কাজেই ও বলল, হ্যাঁ, চিন্তাভাবনা করেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু খুব ভালভাবে আমি বুঝতে পারছি যে আমি যা ভেবেছি তা তোমার নজরেই আসেনি। আমাকে ইহুদি নাম দিয়েছ, প্রতিবাদ করব না। কিন্তু তুমি যা দেখছ আমি তার চেয়ে আরেকটু বেশি ভেবেছি। আমি ওদের হাতে আত্মসমর্পণ করছি না। শুধু আত্মসমর্পণের ভান করেছি।

প্রসপেরোর কথায় ওর মায়ের কান্নাভেজা চেহারায় ফুটে উঠল বিহ্বলতা আর প্রশ্নবোধক দৃষ্টি। একটু হেসে তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির জবাব দিল প্রসপেরো। বলল, আমার মনের কথা তো জেনেছ। এখন এই কথাগুলো মনের ভিতর কবর দিয়ে ফেলল। একটা শব্দও যেন বাইরে প্রকাশ না পায়। তোমাকে কথাটা বলার জন্য আমাকে যাতে পস্তাতে না হয় সেটাও দেখো।

সব জেনেছি! কী জেনেছি? কিছুই তো বলোনি তুমি, প্রসপেরোর মা অবাক হয়ে বলল।

এখনো বোঝোনি? ডোরিয়ারা বিশাল উপহার নামের ঘুষের ডালি সাজিয়ে আমার কাছে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। অবশ্য ওই নির্লজ্জদের কাছে এটা কোন ব্যাপার না। আমিও আপাতদৃষ্টিতে ওদের শান্তি প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। যদিও আমার ব্যাপারটাও নির্লজ্জতার মতই দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রস্তাবটা আমি মেনেছি, কারণ, নইলে ওরা আমার বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থানে চলে যাবে। তখন ওদের ধারে-কাছেও আমি আর ঘেঁষতে পারব না। শোধ নেয়াও হবে না। এবার বুঝেছ?

প্রসপেরোর মা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আনমনেই পৌঁছে গেছে প্রসপেরোর সামনে। ওর কাঁধে হাত রেখে সে বলল, আমাকে ভোলানোর জন্য বানিয়ে বলছ না তো? সত্যি করে বলো।

একটু ভাবো না, তাহলেই তো সব বুঝতে পারবে। অন্য কিছু আমি কী করে ভাবব?

বুঝলাম, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কী করবে? বিয়ে না হলে ওদের বিভ্রান্ত করা যাবে না। আবার বিয়ে করাও সম্ভব না। কারণ বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। একবার হয়ে গেলে আর ফেরানো সম্ভব না।

মাকে নিয়ে গিয়ে তার চেয়ারে বসিয়ে দিল প্রসপেরো। নিজেও তার পাশে একটা হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর মাকে খুলে বলল ওর লেডি অভ দ্য গার্ডেন-জিয়ান্নার কথা। বলল ওকে বাঁচানোর কথা। তারপর বলল, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি আসলে নিজের আর বাবার নাম ডোবানোর জন্য এসব করিনি। কাজেই এখন একটু শান্ত হও। আর ওরা বেইমানি করতে পারে। পারে কী, অবশ্যই বেইমানি করবে। ওদের বিয়ে শাদীর বন্ধন-টন্ধনেও আমি বিশ্বাস করি না। বাইরে থেকে বোঝাচ্ছে ওরা আমাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। কিন্তু আসলে আমার কাছ থেকেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেতে চাইছে ওরা। কূটনীতির চাল চেলেছে। আমি কেবল ওদের বুদ্ধির একটুখানি ধার নিয়েছি। ডোরিয়া ঘরের মেয়েকে কখনোই আমি বিয়ে করব না। আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত একের পর এক অছিলা বের করে বিয়ে পিছাতেই থাকব। এবার তো বুঝেছ?

এসব আগে আমাকে বলোনি কেন?

কারণ, এসব বিপজ্জনক বিষয়ে কথা বলা উচিত না। এমনকী আমি নিজেও এসব নিয়ে বেশি ভাবব না। কারণ কী থেকে কী হয়ে যায় বলা যায় না। পরে ডোরিয়াদের কান পর্যন্ত কথাগুলো পৌঁছে গেলেই আমি শেষ। কাজেই, মা, এই সব চিন্তা তোমার মনের সবচেয়ে গহীন কোণে একদম কবর দিয়ে দাও। ভুলেও এসব নিয়ে ভেবো না।

আমাকে বিশ্বাস করতে পারো, প্রসপেরো। এর কিছুই কাউকে বলব না। কিন্তু চিন্তা করব না, তা হবে না। সারাক্ষণ কেবল এগুলো নিয়েই চিন্তা করব। ডোরিয়াদের ধ্বংসের চিন্তা আমাকে উষ্ণ রাখবে, উজ্জীবিত করবে আমাকে। বোকার দল। ওরা যে মেয়েটাকে তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে তাকেও তার উচিত পাওনা পরিশোধ করে দিয়ো।

একথার সঙ্গে প্রসপেরো একমত না। ও বলল, না, তা করব না। ওই বেচারি তো দোষ করেনি। যা করার ওকে বাঁচিয়েই করব। সে নিজের ইচ্ছায় আমাদের মধ্যে জড়ায়নি। তাকে বাধ্য করা হচ্ছে।

প্রসপেরোর মা বলল, কী বলছ এসব! তোমার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতেই তো ওই মেয়েকে ব্যবহার করছে ওরা। ওরও শাস্তি পাওনা। তোমার যা করার করবে। বাকিটা ডোরিয়াদের মাথাব্যথা।

জবাবে প্রসপেরো বলল, শুধু ওদের না, আমারও মাথাব্যথা। যতটা সম্ভব চেষ্টা করব মেয়েটাকে কষ্ট না দিতে। বিনা কারণে বাইরের একটা লোকের কাছ থেকে সে কেন শাস্তি পাবে? ওকে তো ডোরিয়ারা বলির বকরির মত স্রেফ ব্যবহার করতে চাইছে।

প্রসপেয়োর কাঁধে হাত রেখে ওর মা বলল, ওরা কি অ্যাডর্নোদের মেয়েদের ছেড়ে কথা বলেছে? আমাকে কি ওরা রেহাই দিয়েছিল? কী পরিমাণ যন্ত্রণা তোমার মাকে ভোগ করতে হয়েছে তা তুমিও জানো। তোমার বাবার সঙ্গে ক্যাস্টেলেট্টো থেকে পালিয়ে না এলে ওরা আমাকেও মেরে ফেলত। কাজেই ওই মেয়ের ভাল-মন্দ নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

কপাল কুঁচকে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রসপেরো। ওর মা তখন জিজ্ঞেস করল প্রসপেয়োর পরবর্তী পরিকল্পনা সম্বন্ধে। জবাবে প্রসপেরো বলল, এখনও বিশেষ কোন পরিকল্পনা করিনি। সময়ই সুযোগ এনে দেবে।

ওর মা বলল, তুমি তো দেখছি যতটা না জেনোয়িস, তার চেয়ে অনেক বেশি ফ্লোরেন্টাইন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রসপেরো বলল, কী জানি, হতেও পারে।

তখন ওর মা মন্তব্য করে, সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি।

.

১৪.

 স্কিপিওনি ডি ফিয়েসি

প্রসপেরো জেনোয়ায় যেতে যেতে গ্রীষ্মকাল চলে এল। নানা অজুহাত দেখিয়ে অনেক দেরি করেছে ও। কিন্তু তারপরও সমস্ত গ্যালির সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়াও শেষ হলো একসময়। ফলে আর দেরি করার উপায় রইল না। নয়তো ওর ইচ্ছাকৃত দেরি সবার নজরে পড়ে যাবে। তার উপর জেনোয়ায় পৌঁছনোর জন্য ওর উপর বিশেষ হুকুম এসেছে। অন্তত এই হুকুম এড়ানোর কোন উপায় ওর নেই। কারণ জেনোয়ায় আসছেন স্বয়ং সম্রাট। কাজেই সমস্ত ক্যাপ্টেনের সঙ্গে প্রসপেরোরও ডাক পড়েছে। সম্রাটের ইচ্ছা ওখানে বসেই ভূমধ্যসাগর থেকে প্রতিপক্ষ খায়ের আদ-দীনকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়নের হুকুম জারি করবেন।

খায়ের-আদ-দীনের বর্তমান অবস্থান আলজিয়ার্সে। পুরো আলজিয়ার্সই তার শাসনাধীন। কিন্তু তার উপকূলের একটা দ্বীপে পিনন নামের একটা দুর্গ দখল করে রেখেছে স্প্যানিশরা। খায়ের। আদ-দীনের কাছে এটা পায়ের পাতায় বিধে থাকা অস্বস্তিকর একটা কাঁটার মত। কিন্তু পর্যাপ্ত গোলাবারুদের অভাবে ওই দুর্গে সে আক্রমণ করতে পারছিল না। কিন্তু কিছুদিন আগে একটা অভিযান থেকে বেশ কিছু ফ্রেঞ্চ জাহাজ দখল করেছে খায়ের আদ-দীন। ওদিকে মুক্তি পেয়েই দ্রাগুত দখল করেছে প্রচুর গানপাউডার আর গোলাবারুদসহ পুরো একটা ভেনেশিয়ান ফ্লিট। এসব অস্ত্রশস্ত্র হাতে পেয়ে খায়ের-আদ-দীনের সাহস ও শক্তি দুটোই বেড়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে পায়ে ফুটে থাকা কাঁটাটাকে বিদায় করতে হবে।

দশ দিন ধরে ক্রমাগত গোলাবর্ষণের পর মূল আক্রমণ শুরু করল তুর্কি মুসলিম বাহিনী। লড়াইয়ে হেরে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল পাঁচশ স্প্যানিশ।

এ ঘটনার দিন কয়েকের মধ্যে দুর্গের স্প্যানিশদের সহায়তায় গোলাবারুদ, সৈন্য-সামন্ত ও অন্যান্য সাপ্লাই নিয়ে আসে নয়টা স্প্যানিশ জাহাজ। কিন্তু এসে ওরা দেখে দুর্গের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। হতাশ স্প্যানিশ ক্যাপ্টেনের ঘোর কাটতে কাটতেই ওদেরকে ঘিরে ফেলে মুসলিম তুর্কি সেনারা। সেটাও মুসলিম বাহিনীর বিরাট এক বিজয়। আগে ওরা পাঁচশ স্প্যানিশ, সৈন্য বন্দি করেছে, এবার উপরি হিসেবে পেল প্রায় তিন হাজার সৈন্যের বিরাট একটা দল।

এই ঘোর দুঃসংবাদ শুনে রাগে কেঁপে উঠল পুরো স্পেন। কাজেই এদিকেই পুরো মনোযোগ দিয়েছে স্পেন সম্রাট। তার এখন একটাই ইচ্ছা, খায়ের-আদ-দীন দেখুক, কার সঙ্গে সে টক্কর দিতে এসেছে।

সম্রাটের হুকুমে ডোরিয়ার অধীনে নতুন একটি অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হলো। এই অভিযানে ডোরিয়ার অধীনে অংশ নিতে হবে প্রসপেরোকেও। তাই ওর উপর হুকুম, নিয়াপলিটান ফ্লিট নিয়ে অনতিবিলম্বে জেনোয়ায় উপস্থিত হতে হবে।

কাজেই, যতই অনিচ্ছা থাকুক, জেনোয়ায় না এসে প্রসপেরোর আর উপায় নেই। এবং জেনোয়ায় এলে ডোরিয়া ঘরের মেয়ে মারিয়া জিয়োভান্না মোনাল্ডির সঙ্গে ওর বিয়ের চূড়ান্ত ঘোষণাও দিতেই হবে।

বিয়ের ব্যাপারটা খুব সামান্য হলেও ডোরিয়াদের পক্ষে গেছে। জেনোয়ার সাধারণ জনগণ ভেবে নিয়েছে ডোরিয়া আর অ্যাডর্নো পরিবারের মধ্যকার পারস্পরিক শত্রুতার অবসান ঘটাতে চায় ডোরিয়া। ফলে ডোরিয়ার মহত্ত্ব আর ভদ্রতাবোধ নিয়ে চর্চা করতে থাকে সবাই। ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিরসনের চেয়েও বড় কিছু বলে ভাবে তারা।

জেনোয়ার অঘোষিত প্রিন্স ডোরিয়ার জন্য এই জনমতের মূল্য মোটেও কম নয়। তার অঘোষিত প্রিন্সশিপ নিয়ে স্পেন সম্রাটের কোন মাথাব্যথা নেই। কারণ এজন্য তার কোন টাকাপয়সা ব্যয় হচ্ছে না। কিন্তু ডোরিয়া একটা বিষয়ে খুব সচেতন যে, এ ধরনের ক্ষমতা যে-কোন সময় আসতে বা যেতে পারে। তাই সম্রাটকে প্রভাবিত করে নিজের আনুষ্ঠানিক উপাধি ডিউক অভ মেলফি বাগিয়ে নিয়েছে সে।

ডোরিয়ার টাইটেল বাগানো আর ক্ষমতা পাওয়াকে অ্যাডর্নো ও তাদের শুভানুধ্যায়ীরা যেভাবেই দেখুক, সদ্য প্রাপ্ত ক্ষমতা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কাজে লাগাল ডোরিয়া। জনসাধারণের জন্য তার চিন্তা আছে বটে, কিন্তু নিজের স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে না। ওদিকে স্পেন সম্রাট আগেই কথা দিয়েছিল যে জেনোয়া কীভাবে শাসিত হবে সেটা জেনোয়িসদের ব্যাপার। স্পেন তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল ডোরিয়া। আগেই বলেছি, নিজের মনমত করে সরকার দাঁড় করিয়েছে সে।

ভেনেশিয়ানদের মত একটা গ্র্যাণ্ড কাউন্সিল আর একটা নিম্ন। কাউন্সিল তৈরি করল ডোরিয়া। নিয়ম করে দিল প্রতি দুই বছর পরপর ডজ নির্বাচিত হবে। কিন্তু শাসন ক্ষমতা থাকবে মূলত গ্র্যাণ্ড কাউন্সিলের হাতে। এই কাউন্সিলের সদস্যদেরকে বলা হয় সেনসর। পাঁচজন সেনসর মিলে গঠিত গ্র্যাণ্ড কাউন্সিল। সেনসর নির্বাচিত হবে চার বছর পরপর। আর এই গ্র্যাণ্ড কাউন্সিলের মধ্যমণি হলো ডোরিয়া নিজে। নামমাত্র লর্ডশিপ নেয়ার বদলে সে নিজেকে বানিয়ে নিল এই কমিটির আজীবন সদস্য সেনসর ও সুপ্রিম অ্যাডমিরাল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এরপর আর তথাকথিত লর্ডশিপ পেলেই বা কী আর না পেলেই বা কী। যদিও সেটাও ছিল তারই হাতে।

জেনোয়ায় ফিরে এসে কেবল এই ডিউক খেতাব নিয়েই বসে থাকল না আন্দ্রে। আদায় করে নিল প্রিন্সের প্রাসাদ ফসোলু-তে বসবাসের ক্ষমতা। প্রাসাদ হাতে পেয়েই সেটাকে নতুনভাবে বানাতে লেগে পড়ল সে। এমনভাবে প্রাসাদটাকে সে বানানোর পরিকল্পনা করল যে ফলসালু প্রাসাদকে যেন আলাদাভাবে সবাই চেনে। জেনোয়ার চমৎকার সব স্থাপনার মধ্যেও ওটাকে আলাদা করে উদ্ভাসিত করার পরিকল্পনা করল সে। মহান স্থাপত্যবিদ মাইকেল এঞ্জেলোর শিষ্য মনটরসল্লিকে নিয়ে এল স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের জন্য। প্রাসাদের জন্য পাথর আনাল লাভাঙ্গা থেকে আর কারারা থেকে আনাল মার্বেল। প্রাসাদের কেন্দ্রে তার নিজের খাস কামরার সামনে সাগরমুখী দিকটায় বানাল অত্যন্ত মনোরম এক বাগান। বাগানটা তৈরির কাজে এমনকী মনটরসল্লি নিজেও হাত লাগাল। কাজেই জেনোয়ার মাটিতে একটা রত্নের মত মাথা তুলল ফুসোলু প্রাসাদ।

প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও ছবি আঁকার জন্য প্রখ্যাত চিত্রকর রাফায়েলের ছাত্র পিয়েরিনো দেল্লা ভেগাকে নিয়ে এল ডোরিয়া। অন্দর সজ্জার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে অত্যন্ত নামীদামি জিনিস আনাল সে। যেমন, ইস্পাহান থেকে আনল সিল্কের দেয়ালপর্দা, বোখারা থেকে কার্পেট, স্মিরনা থেকে মুরিশ ডিজাইনের ডিভান আর মূল্যবান আসবাবপত্র সজ্জার জন্য গ্রিস থেকে আনাল ফুলদানি। এবং আসবাবপত্রের বেশিরভাগ কেনা হলো ফ্রান্স ও স্পেন থেকে।

এরই মধ্যে মে মাসের এক দিন জেনোয়ার মাটিতে পদার্পণ করল প্রসপেরো। তাকে স্বাগত জানিয়ে বরণ করল স্বয়ং ডোরিয়া। আর জেনোয়ার সাধারণ মানুষ সেদিন ওকে যেভাবে স্বাগত জানাল তাতে স্বয়ং প্রসপেরোই বিস্মিত হয়ে গেল। আসলে, প্রসিডার লড়াইয়ের বিজয়গাথা জেনোয়ার মানুষেরা খুব ভালভাবে মনে রেখেছে। ওর বিজয়কে নিজেদের বিজয় হিসেবে গ্রহণ করেছে তারা।

কিন্তু জেনোয়ায় পা রাখার আগে প্রসপেরো বুঝতেও পারেনি যে এমন সাড়ম্বর অভ্যর্থনা পাবে সে। বন্দর থেকে ডিউকাল প্রাসাদ পর্যন্ত পুরো রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে লোকেরা অভিনন্দন আর অভ্যর্থনা জানাল ওকে। আর প্রসপেরোকে এগিয়ে নিয়ে এল সদ্য নির্বাচিত ডজ সহ ডোরিয়ার কাউন্সিলের দুজন সদস্য। প্রসপেরো বুঝতে পারল, প্রসিডার সেই বিজয় জেনোয়িসদের কাছে ওকে জাতীয় বীর বানিয়ে দিয়েছে।

একসময় অভ্যর্থনাকারীদের হাত থেকে ছাড়া পেল প্রসপেরো। সাদা আর কালো মার্বেল পাথরে বানানো ওদের আগের সেই প্রাসাদে মায়ের কাছে গেল ও। প্রাসাদে পৌঁছে মায়ের সঙ্গে বন্ধু স্কিপিওনি ডি ফিয়েসির দেখা পেল প্রসপেরো। অধৈর্য হয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিল স্কিপিওনি।

এই কমাস অযথা বসে থাকেনি স্কিপিওনি। কূট পরিকল্পনা করতে পারা তার সহজাত একটা গুণ। এই গুণটাকে কাজে লাগিয়ে ডোরিয়াদের অজান্তে ওদের উৎখাতের নীল নকশা তৈরি করে রেখেছে সে। যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে ডোরিয়ারা ক্ষমতার প্রাসাদ তুলছে সেই মাটির নিচটাকেই সযত্নে কেটে ফাপা বানিয়ে তুলেছে সে। প্রসপেরো জেনোয়ায় পদার্পণ করার আগেই নিজের মত করে সমস্ত প্রস্তুতিও শেষ করেছে স্কিপিওনি। অপেক্ষা করছে কেবল উপযুক্ত সময়ের। যাতে সময় আসার সঙ্গে সঙ্গে ডোরিয়াদের সবাইকে প্রতিশোধের সাগরে ডুবিয়ে মারতে পারে।

ওদিকে পুরো জেনোয়াবাসীর মত স্কিপিওনিও শুনেছে যে ডোরিয়াদের শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে প্রসপেরো। স্থায়ী শান্তির প্রতীক হিসেবে ডোরিয়ার ভাতিজিকে বিয়েও করতে যাচ্ছে ও। কিন্তু একমুহূর্তের জন্যও স্কিপিওনি বিশ্বাস করেনি যে প্রসপেরো আসলেই শান্তিচুক্তি করেছে। ও ভেবেছে, হঠাৎ করেই জনগণের মাঝে প্রসপেরো খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় তার দিকে আপাত শান্তির হাত বাড়িয়েছে ডোরিয়ারা। এবং এই ব্যাপারটা প্রসপেরোও স্পষ্ট বুঝেছে। তাই ও-ও কৌশল হিসেবে ওদের শান্তি প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। এটাকে একটা কৌশলগত পশ্চাৎপসরণ ভেবে মেনেও নিয়েছিল স্কিপিওনি। ব্যাপারটা তাকে খুশিও করে তুলেছিল, কারণ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাশে আরেকজন বিশ্বস্ত মানুষ পাওয়া যাবে।

সেই বিশ্বস্ত মানুষটা, মানে প্রসপেরো এখন হেঁটে আসছে ওদেরই দিকে। খুশিতে চকচক করছে প্রসপেরোর চোখ। হাসিমুখে প্রসপেরোকে স্বাগত জানাল ওর মা। জিজ্ঞেস করল, খুশি হয়েছ?

মায়ের গালে একটা চুমু খেল ও। তারপর বলল, আড়ম্বর আরেকটু কম হলে ব্যাপারটায় সত্যিই মজা পেতাম।

মজা পেতে?

হ্যাঁ। আজ যে লোক আমাকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল, শেষবার যখন দেখি, সে-ই আমার রক্তে গোসল করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছিল আমাকে। ব্যাপারটা হাস্যকর নয়?

প্রসপেরো করমর্দনের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল স্কিপিওনির দিকে। ওর কথা শুনে নিজের বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেল স্কিপিওনি। বলল, বন্ধু, এ-ই সুযোগ। জেনোয়ার জনসমর্থন এখন পুরোপুরি তোমার পক্ষে। ওদের মানসিকতা পরিবর্তন হওয়ার আগেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার।

ভাবশূন্য হয়ে গেল প্রসপেরোর চেহারা। মাকে একটা আবলুশ কাঠের চেয়ারের দিকে নিয়ে গেল ও। এত বড় একটা প্রাসাদে নিজের জন্য এই ছোট্ট ঘরটা পছন্দ করেছে প্রসপেরোর মা। অদ্ভুত রুচিই বটে। ঘরে একটা ছোট্ট জানালা আছে। জানালায় বসানো আছে সেইন্ট মাইকেলের মূর্তি অঙ্কিত ঘোলাটে কাঁচ। সেই ঘোলা কাঁচ পাড়ি দিয়ে আসা মৃদু আলোয় আলোকিত হয়ে আছে ঘর। মাকে বসিয়ে তার পাশে একটা টুল টেনে নিয়ে বসল প্রসপেরো। তারপর স্কিপিওনির মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক স্বরেই বলল, কীসের সুযোগ?

কীসের সুযোগ মানে? আজ জনমত পুরোপুরি তোমার পক্ষে। ওদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ তোমার পায়ের সামনে গড়াগড়ি খাচ্ছে!

জবাবে প্রসপেরো বলল, হয়তো ঠিকই বলছ। কিন্তু আমার মতে এই কাজের উপযুক্ত সময় এটা না। দুদিনের মধ্যে এখানে আসছে সম্রাট। তার সামনে বিদ্রোহী হিসেবে হাজির করতে চাও আমাকে?

স্কিপিওনি বলল, কিন্তু যদি ঠিকভাবে বিদ্রোহ পরিচালনা করা হয়, তাহলে দুদিনেই সব ঠিকঠাক করা সম্ভব। আর এজন্য যা-যা দরকার তার সবই আমার হাতে আছে।

যা-যা দরকার মানে? কী বলতে চাইছ খুলে বলো তো!

ডোরিয়া শাসন অবসানের কথা বলছি। বলছি ওদেরকে তাড়িয়ে জাহান্নামে পাঠানোর কথা।

প্রসপেরো বলল, ডোরিয়াদের এত সহজে হটানো যাবে না। এই মুহূর্তে খুবই শক্ত জমিনের উপর দাঁড়িয়ে আছে ডোরিয়া। না, এখন কিছু ঘটানোর সময় নয়। কিছু করতে গেলে সেটা হবে অন্ধের মত অনিশ্চিত জুয়া খেলা।

স্কিপিওনি বিরক্ত হয়ে উঠছে। বলল, আমার প্রস্তুতিতে যদি ঘাটতি থাকত তাহলে সেটা হত জুয়া খেলা। ফ্রান্সের সমর্থন নিয়ে তবেই মাঠে নেমেছি আমি।

ফ্রান্সের সমর্থনই তাহলে তোমার ব্রহ্মাস্ত্র? কিন্তু আমি স্প্যানিশদেরই পছন্দ করি। স্পেন সম্রাটের সঙ্গে কাজ করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ আমি। সে কারণেই সম্রাট যখন এখানে আসবে, তার সামনে নিজেকে একজন বিদ্রোহী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই না।

খানিকটা যেন অবাক হয়েছে স্কিপিওনি। বিস্মিত কণ্ঠে সে বলল, স্পেন সম্রাট! তাহলে স্পেন সম্রাটের সেবা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি?

জবাবে প্রসপেরো বলল, দেখো, আমি ফ্রেঞ্চ রাজের সেবা করতে পারব না। কিন্তু ফ্রেঞ্চদের সাহায্য নিলে তা-ই করতে হবে। আমার প্রথম কাজ জেনোয়া আর জেনোয়াবাসীর সেবা করা। তারপর আসবে সম্রাট। সে যে-ই হোক।

তাহলে ডোরিয়াদের নিয়ে কী চিন্তা করেছ? সে-ও তো স্পেন সম্রাটের আনুকূল্য নিচ্ছে। পঞ্চম চার্লস কি ডোরিয়াদের কথাই বেশি শুনবে না?

হ্যাঁ। ঠিক এই কারণেই কোন কিছু করার আগে স্পেন। সম্রাটের চোখের সামনে থেকে ডোরিয়ার ঝোলানো পর্দাটা সরাতে হবে। সম্রাটকে বোঝার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে যে ডোরিয়ার সম্বন্ধে তার উচ্চ ধারণা হাওয়াই মিঠাই ছাড়া আর কিছু না। স্রেফ সুযোগসন্ধানী স্বার্থপর একটা মানুষ ডোরিয়া।

স্কিপিওনির রাগ উঠে যাচ্ছে। রাগত স্বরেই সে বলল, তোমার এই কাজ করতে কত সময় লাগবে?

জবাবে প্রসপেরো বলল, জানি না, স্কিপিওনি। বাস্তবে কাজ শেষ হওয়ার আগে সময়সীমা অনুমান করতে পারছি না। কাজেই এখন ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই। আর এখনই এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ছুটোছুটি করাও ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। তার উপর খুব শীঘ্রিই আমরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাগরে যাচ্ছি। যুদ্ধ সবসময়ই কাউকে ধ্বংস করার, আবার কাউকে উপরে তোলার সুযোগ এনে দেয়। গোইয়ালার যুদ্ধের কথাই ধরো। তখন আমি ডোরিয়াকে ছেড়ে এলে আজ সে কোথায় থাকত?

স্কিপিওনি বলল, কিন্তু তাতে ভাগ্যের উপর খুব বেশি ভরসা করা হয়ে যাচ্ছে। ধরো ওই লড়াইয়ে তুমি কোন সুযোগই পেলে না। অথবা ধরো তোমার নিজের নাম আর পদাধিকারই ডুবে গেল, তখন কী করবে?

আমি তো আর গণক নই যে এখনই ভবিষ্যৎ বলে দেব। তবে বর্তমানের কথা বলতে পারি। আমার মতে এখনই কিছু করার সময় আসেনি।

অধৈর্য হয়ে স্কিপিওনি বলল, তোমার তা-ই মনে হয়? কিন্তু একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না যে আমি কী প্রস্তুতি নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমার হাতে আছে তিনশ ফ্রেঞ্চ টুপ। লাভাঙ্গায় অপেক্ষা করছে তারা। যে-কোন মুহূর্তে কাজে নামতে তৈরি হয়ে বসে আছে সবাই। ডোরিয়া-বৃক্ষ কাটার কুঠারের ফলা হিসেবে ব্যবহার করব ওদের।

প্রসপেরো তখন জিজ্ঞেস করল, বুঝলাম। কিন্তু কুঠারটা কোথায়?

এখানে, তোমার হাতে। জেনোয়াবাসীরা নিজেরাই আজ ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে তোমাকে। এমন কেউ নেই যে তোমাকে অপছন্দ করে। তাদের সমর্থনই তোমার কুঠার। আরেকটা ব্যাপার, আজ সবাই তোমাকে সমর্থন করছে, কাল কিন্তু না-ও করতে পারে। এখন যদি তুমি ডোরিয়াদের সরিয়ে দিয়ে তোমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নাও, কেউ তোমাকে বাধা দেবে না। কারণ এখন তুমি তাদের কাছে মহা নায়ক।

আমার ফ্রেঞ্চ টুপ ফসোলু প্রাসাদে প্রথম আঘাত হেনে খুলে দেবে প্রবেশদ্বার। তারপর বাঁধভাঙা স্রোতের মত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সবাই ঢুকে পড়ব প্রাসাদে। জেনোয়ার মাটিতে ডোরিয়া শাসনের অবসান ঘটবে চিরতরে।

মৃদু কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, তারপর ডোরিয়ার মৃত্যুর শোধ নিতে আমাদের গলা কাটবে স্পেন সম্রাট। তুমি মুদ্রার একটা পিঠ দেখছ কেবল, স্কিপিওনি। ডোরিয়াকে কিছু করতে হলে আগে তার উপর থেকে স্পেন সম্রাটের ছত্রচ্ছায়া হটাতেই হবে।

মরিয়া হয়ে প্রসপেরোর মায়ের দিকে ফিরল স্কিপিওনি। বলল, সে যেন প্রসপেরোকে বোঝায়।

কিন্তু প্রসপেরোর মা প্রসপেরোকেই সমর্থন দিল। বলল, আমার মনে হয় প্রসপেরোর বক্তব্য আমি বুঝতে পারছি। বিশ্বাস রাখো, স্কিপিওনি। প্রসপেরো ভালভাবেই জানে ও কী করছে। ও একটু ধীরে এগুচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য যেন নিশানা একচুলও না ফসকায়। ওর উপর বিশ্বাস রাখো।

মুখটা কালো হয়ে গেল স্কিপিওনির। বলল, বিশ্বাস রাখব? সেইসঙ্গে এই চিন্তাও ওর মাথায় খেলল যে, যে বিশেষ অবস্থার উপর ভরসা রেখে ও পরিকল্পনা করেছিল সেটায় বিরাট একটা ফুটো দেখিয়ে দিয়েছে প্রসপেরো। তখন একটা সন্দেহ খেলে গেল স্কিপিওনির মাথায়। প্রসপেরোর সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন করল, আমাকে সব খুলে বলবে, প্রসপেরো?

কখনো তোমাকে গোপন করে কিছু করতে দেখেছ আমাকে, স্কিপিওনি?

দেখিনি। কিন্তু আগে হয়তো আমার কাছ থেকে কোন কিছু লুকানোর অবকাশ পাওনি।

কথাটা পছন্দ হলো না। যাক, অসুবিধা নেই। বলো, কী জানতে চাও।

শান্তিচুক্তির দোহাই দিয়ে ডোরিয়াদের ঘরে তোমার বিয়ের ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে জানতে চাই। এতদিন ভাবতাম আমি তোমাকে বুঝতে পারি। তাই ধরে নিয়েছিলাম ওদের ঘরে তোমার বিয়েটা একটা চাল। তাই মেনেও নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওটা তোমার সময় ক্ষেপণেরও একটা কৌশল। পিছনে পিছনে তুমি অস্ত্র শানাচ্ছ ওদের উপর আঘাত হানবে বলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে আমি বুঝতে তো পারিইনি, চিনতেও পারিনি। মনে হচ্ছে এখন কেবল নিজের লাভটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছ। নিজেকেই আমি প্রশ্ন করছিলাম, তোমাকে কি ভুল বুঝলাম… একমুহূর্ত থেমে রীতিমত হিংস্র গলায় স্কিপিওনি বলল, …নাকি আমাদের সঙ্গে দুই তরফা খেলা খেলছ?

দুই তরফা খেলা? বেইমানি? তোমার সঙ্গে? না, স্কিপিওনি। তোমার সঙ্গে কখনোই আমি বেইমানি করিনি বা দুই তরফা খেলা খেলিনি। আমি আমার নিজের নিয়মে খেলছি, এই যা। যারা আমার সঙ্গে আসতে চাইবে তাদের সবাইকে স্বাগত জানাব। আমি মনে করি এই দলে সবার আগে আছ তুমি। কিন্তু তাই বলে আমার দলের বা অন্য কারো ইচ্ছার দাস আমি হব না, হাসিমুখে কথাগুলো বলল প্রসপেরো। আরো বলল, তুমি আমাকে আজ কিছু জিনিস দেখিয়েছ, স্কিপিওনি। তবে তোমার অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের হাতিয়ার আমি হতে পারব না।

কথাটা শুনে সাপের মত ফণা তুলে দাঁড়াল স্কিপিওনি। ফেস ফেস করতে করতে বলল, এসব আমি তোমাকে দেখিয়েছি? কিন্তু তুমি আমাকে কী দেখালে বলো তো?

তুমিই না হয় বলো।

আগে আমার প্রশ্নটার উত্তর দাও, প্রসপেরো। জেনোয়ায় যেহেতু এসেই পড়েছ, সত্যিই কি ডোরিয়াদের ঘরে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছ?

বিয়ের কথাটা আজ রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে, বলল প্রসপেরো।

এটাই আশা করেছিলাম। এবং একথাটাই সবকিছুর ব্যাখ্যা দিচ্ছে, ভয়ানক দৃষ্টিতে প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল স্কিপিওনি। তারপর বলল, উন্নতি করার সবচেয়ে সহজ রাস্তাটা তুমি বেছে নিয়েছ। তাতে তোমার বাবার খুনিদের সাহায্য নিতেও তোমার বাঁধছে না। তোমার বাবার হয়ে প্রতিশোধ নেয়াটাকে তুমি দূরে সরিয়ে রাখছ, কারণ প্রতিশোধ নেয়া হোক সেটাই সম্ভবত তুমি চাও না। অথচ আমি এই তোমাকেই বন্ধু ভাবতাম আর আপন ভাইয়ের মত ভালবাসতাম। ভাবতাম সত্যিকারের পুরুষ মানুষ তুমি।

জবাবে প্রসপেরো শুধু বলল, দরকার পড়লে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে আমার এমুহূর্তও দেরি হবে না।

নতুন করে কিছুই আর প্রমাণ করার দরকার নেই। যা কিছু প্রমাণ করার ছিল, করে ফেলেছ। শত্রুর কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছ তুমি। একদিন অবশ্যই টের পাবে ওরা কেমন। স্বয়ং স্রষ্টা তোমাকে টের পাওয়াবেন, রাগত স্বরে কথাগুলো বলে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরল স্কিপিওনি।

সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রসপেরোর মা। বলল, দাঁড়াও, স্কিপিওনি।

মাকে বাধা দিয়ে প্রসপেরো বলল, ওকে যেতে দাও, মা।

প্রচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ হতে শুনল ওরা। রাগ নিয়ে ছেলের চোখের দিকে তাকাল প্রসপেরোর মা। বলল, দেখেছ? ঝড় শুরু হতে যাচ্ছে।

দরকার পড়লে এই ঝড়ও থামাব, মা, চিন্তা কোরো না, মাকে আশ্বস্ত করে বলল প্রসপেরো।

ওকে সব খুলে বললেই পারতে…।

ওকে বলা মানে সারা দুনিয়াকে ঢাক পিটিয়ে সবকিছু জানিয়ে দেয়া। রহস্যময় একটু হেসে ও বলল, এই একটা ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করা চলবে না, মা। তাছাড়া, খেয়াল করেছ, প্রতিশোধ নেব কি নেব না, সেটা আমাদের ব্যাপার। সেজন্য স্কিপিওনি কেন আমার উপর রাগ দেখাবে? ওর নিজের অবশ্যই ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল। সেটা বানচাল হওয়াতেই খেপেছে। ওর একমাত্র লক্ষ্য ছিল আমাকে ব্যবহার করে ফিয়েসিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। একটু হেসে তারপর ও বলল, আর ও নাকি আমার বন্ধু…

বসে পড়ল প্রসপেরোর মা। চিন্তায় পড়ে গেছে সে। প্রসপেরো অবশ্য দাঁড়িয়েই আছে। বলল, পৃথিবীর যা ভাবার ভাবতে দাও। শুধু তুমি আর আমি জানি, আমি কী করব। এ-ই যথেষ্ট। যার যা ইচ্ছা বলুক। আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একদম মুখ খোলা যাবে না।

সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ল প্রসপেরোর মা। তখনই প্রসপেরো তাকে মনে করিয়ে দিল যে ফলসালু প্রাসাদে সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিয়ের ঘোষণার জন্য ভোজের আয়োজনে ওদের উপস্থিত হতে হবে। শুনেই কেঁপে উঠল অরেলিয়া। সে কোনমতেই যাবে না। প্রসপেরোর এই অনুরোধ সে কোনমতেই রাখতে পারবে না। বলল, প্রসপেরো যেন তার অনুপস্থিতির জন্য কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে দেয়। ডোরিয়াদের সে সহ্য করতে পারবে না।

কাজেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল প্রসপেরো।

.

১৫.

অ্যাডর্নোদের সম্মান

প্রসপেরোর বিয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা উপলক্ষে জাঁকালো সাজে সাজানো হয়েছে পুরো ফলসালু প্রাসাদ। দাওয়াত দেয়া হয়েছে জেনোয়ার সমস্ত নামীদামি পরিবারের সদস্যদের। লোমেলিনি, গ্যাসপারি, গ্রিমানি, ফ্রেগোসি, ফিয়েসি-সবাই এসেছে দাওয়াত রক্ষা করতে। আসেনি কেবল অ্যাডর্নো পরিবারের কেউ। অ্যাডর্নো পরিবারের সঙ্গে ডোরিয়া পরিবারের আপাত শান্তি তারা সহ্য করতে পারবে। কিন্তু ডোরিয়াদের দাওয়াতে উপস্থিত হয়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়ার কথা ভুলে যাওয়া অ্যাডর্নোদের পক্ষে সম্ভব না।

তবে ওদের অনুপস্থিতি দাওয়াতে উপস্থিত বাকিদের উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। কারণ অ্যাডর্নো পরিবারের মাথা হিসেবে সবাই যাকে চেনে-জানে, স্বয়ং সে ডোরিয়াদের বাড়িতে এসেছে। শুধু যে এসেছে তা-ই না, ওদের ঘরে বিয়ের প্রস্তাব স্বীকার করতে যাচ্ছে। কাজেই বাকিদের গোনায় না ধরলেও চলে।

দাওয়াতের মেজবান ডিউক অভ মেলফি ডোরিয়া তার অভিজাত অতিথিদের নিয়ে অপেক্ষা করছিল প্রসপেরোর জন্য। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে প্রসপেরো।

প্রসপেরো সাধারণত যেমন পোশাক পরে তার চেয়ে অনেক মলিন পোশাক পরে অনুষ্ঠানে এসেছে। তবে এতটাও মলিন না যে অনুষ্ঠানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ওর পোশাকের রং জেনোয়ার পতাকার রঙের সঙ্গে মেলানো। লাল আর সাদা। ও হয়তো স্বীকার করবে না যে নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে চায়নি। কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে প্রসপেরো চায়নি যে, ডোরিয়ার ভাতিজি ওকে আকর্ষণীয় মনে করুক। তবে, কাঁধের খানিক উপর পর্যন্ত চুল, কামানো চোয়াল আর লম্বাটে আকর্ষণীয় চেহারা, সব মিলিয়ে তারুণ্যের ছটা লুকাতে পারেনি প্রসপেরো।

প্রসপেরোকে ঢুকতে দেখে ওকে এগিয়ে আনতে দুহাত মেলে এগিয়ে গেল ডোরিয়া। বলল, আমার ঘরে তোমায় স্বাগত, প্রসপেরো। সেইসঙ্গে আমার মনেও। এই বুড়ো মানুষটার আন্তরিক চাওয়া, আমাদের দুই ঘরের এই বন্ধন যেন চিরকাল অটুট থাকে আর আমাদের পিতৃভূমি জেনোয়ার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিতে আমরা দুই পরিবার যেন চিরকাল অবদান রেখে যেতে পারি।

ডোরিয়ার পর প্রসপেরোকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল জিয়ানেট্টিনো। যথারীতি সাড়ম্বরপূর্ণ উকটরঙা পোশাক তার গায়ে। অন্য সব পোশাকের উপর চড়িয়েছে কটকটা মেরুন রঙের একটা ক্লোক। হাসিমুখে সামনে বাড়ল সে। ওর পেছন পেছন এসেছে ফিলিপ্পিনো। ওর মুখেও হাসি। তবে সেটা নিষ্প্রাণ আর অস্বস্তির হাসি। সে বা প্রসপেরো কেউই ভুলে যায়নি যে ফিলিপ্পিনোই শেকল বেঁধে প্রসপেরোকে দাঁড়ে বসতে বাধ্য করেছিল। চাচার নজরে থাকা ফিলিপ্পিনো করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিল প্রসপেরোর দিকে। বলল, ভুল যা হওয়ার তো হয়েছেই। কিন্তু পুরানো স্মৃতি নতুন পাওয়া বন্ধুত্বকে ক্ষয় করুক তা চাই না।

একটু হেসে তার হাত ধরল প্রসপেরো। শুধু বলল, আজ থেকে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে।

আরেকজন এগিয়ে এল ওদের দিকে। ডাচেস অভ মেলফি (লর্ড ডোরিয়ার নব বিবাহিতা স্ত্রী)। নিজেকে সে ধরে রাখতে পারছে না। তার পেছন পেছন এল উজ্জ্বল চোখের এক বালক। একে নিজের ছেলে বলে ঘোষণা দিয়েছে ডোরিয়া। ওর নাম মার্কেন্টোনিয়ো ডেল ক্যারেট্টো। মহিলাটিকে একবার বাউ করে তার বাড়িয়ে দেয়া হাতের পিঠে ছোট্ট করে একবার চুমু খেল প্রসপেরো। এরপরই উপস্থিত অতিথিরা সবাই এগিয়ে আসে বিয়ের ঘোষণা উপলক্ষে করমর্দন করে ওকে অভিনন্দন জানাতে। ওই দলে এমনকী লোমেলিনো আর ফ্রেগোসিরাও আছে। কয়েক প্রজন্ম আগে থেকেই অ্যাডর্নো পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে মারাত্মক দ্বন্দ্ব ছিল এদের। আজ করমর্দন করছে সবাই। এমনকী ওদের পরিবারের মহিলাদের সঙ্গেও প্রসপেরোর পরিচয় করিয়ে দিল তারা।

স্পিনোলি আর গ্রিমালি পরিবারের লোকেরাও প্রসপেরোকে অভিনন্দন জানাল। এদের সঙ্গে অ্যাডর্নো পরিবার সবসময়ই বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলেছে। স্পষ্টতই সবাই এই এক উপলক্ষকে অতীত ভুলে নতুন করে সব শুরু করার একটা সুযোগ হিসেবে দেখছে।

গাম্ভীর্যের সঙ্গে সবার অভিনন্দন গ্রহণ করছে প্রসপেরো। কিন্তু গাম্ভীর্যের মুখোশের আড়ালে মনে মনে ভীষণ আমোদ পাচ্ছে ও। কারণ বাকি সবার মত ও-ও জানে, এই করমর্দন, অভিনন্দন-এসব স্রেফ লোক দেখানো। এখানে কোন আন্তরিকতা নেই। কেবল পরস্পরের প্রতি আপাত শান্তিমূলক একটা অবস্থান নিয়েছে সবাই। সবাই চাইছে প্রসপেরো আর ডোরিয়ার মাধ্যমে সম্রাটের সুনজরে আসতে। এবং প্রসপেরোর বিয়ের ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে সুযোগ থাকতে থাকতেই নিজের প্রতি জনসমর্থন বাড়িয়ে নিতে।

বলা বাহুল্য, ব্যাপারটায় দারুণ মজা পেলেও সেটা প্রসপেরোর চেহারায় প্রকাশ পায়নি। প্রসপেরোকে পাশে নিয়ে এগিয়ে চলছে ডোরিয়া। ওরা এগুতে শুরু করতেই অভ্যাগতদের ভিড়ের ভিতর ফাঁক তৈরি হলো। দেখা গেল ডাচেসের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন তরুণী। তার পরনে রূপালী রঙের গাউন। আর কণ্ঠদেশ থেকে ঝুলছে কোমর পর্যন্ত লম্বা মুক্তোর মালা। মেয়েটার চোখের দৃষ্টিতে বিষণ্ণতার আভাস। আর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, সেখানে লুকিয়ে আছে কান্না আর হাসির অদ্ভুত এক মিশ্রণ। কিন্তু হাসি বা কান্না কোনটাই এই মুহূর্তে সেখানে নেই। অথচ তারপরও মনে হচ্ছে এই দুই অভিব্যক্তির কোনটাই প্রকাশ পেতে বাদও নেই।

মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসপেরোর দম আটকে গেল। টের পাচ্ছে ওর মুখ থেকে সমস্ত রক্ত সরে যাচ্ছে। প্রথম দৃষ্টিতে প্রসপেরোর মনে আনন্দ বান ডেকেছিল। কারণ মেয়েটি আর কেউ না, লেডি অভ দ্য গার্ডেন জিয়ান্না। কিন্তু তাকে এখানে, দেখে মুহূর্তেই সেই আনন্দ হাওয়ায় উবে গেছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ব্যাপারটা আগে-ওর কাছে ছিল স্রেফ একটা কাজ। শত্রুর দিকে আরো এক কদম এগিয়ে তার বিশ্বস্ততা অর্জন। করা। কিন্তু এই মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটাই আমূল বদলে গেছে। পুরো ভিন্ন চেহারা নিয়েছে সবকিছু।

ডোরিয়া প্রসপেরোর দিকে খুব ভালভাবে নজর রেখেছিল। তার টাওয়ারের মত লম্বা মাথাটা প্রসপেরোর দিকে ঝুঁকিয়ে আনল। বলল, খুবই সুন্দরী একটা মেয়ে, তাই না?

যান্ত্রিক কণ্ঠে প্রসপেরো তখন উত্তর দিল, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী।

মৃদু হেসে ডোরিয়া বলল, তুমি সত্যি ভাগ্যবান, প্রসপেরো। এখনও যদি তোমার মনে হতে থাকে যে ডোরিয়াদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ, তাহলে বলব ও তার সবচেয়ে বড় ক্ষতিপূরণ। এসো, তোমার হবু স্ত্রী তোমাকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।

ডোরিয়াকে কিছু একটা বলার জন্য তার দিকে ঘুরে মুখ খুলল প্রসপেরো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার বন্ধ করে ফেলল। ততক্ষণে সকৌতুকে ওর হাত আঁকড়ে ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে ডোরিয়া। বলছে, চলো, চলো।

প্রসপেরো যেন ঘোরের ভিতর হাঁটছে। লেডির, এক গজের মধ্যে পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত ওর ঘোরই ভাঙল না। সামনে এসে প্রসপেরো নিশ্চিত হলো, স্বপ্ন দেখছিল না ও। মেয়েটি সত্যিই ওর জিয়ান্না।

ডোরিয়া জিয়ান্নাকে বলল, কথা দিয়েছিলাম প্রসপেরোকে এনে দেব। এই নাও তোমার প্রসপেরো।

কথাগুলো প্রসপেরোর কানে গেলেও এর মর্মার্থ ওর মাথায় পৌঁছেনি। তাই ডোরিয়ার কণ্ঠের অদ্ভুত সুরও ওর কানে বাজেনি। প্রসপেরো তখনও সম্মোহিত হয়ে আছে। যন্ত্রচালিতের মত লেডি জিয়ান্নার হাত ধরল ও। বুঝতে পারছে না যে হচ্ছেটা কী! ওর মনের একটা অংশ বলছে এখনই কিছু না করতে। অন্তত যতক্ষণ না সব পরিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষণ কিছু করা উচিত হবে না। ওদিকে প্রসপেরো কিছু একটা বলবে সেই আশায় ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ান্না। কিন্তু কিছু বলার মত অবস্থায় প্রসপেরো তখন নেই।

ওর সঙ্গিন অবস্থা দেখে নীরবতা ভাঙল ডোরিয়ার স্ত্রী প্যারো। স্বামীর হাত স্পর্শ করে বলল, ওদের দেখা করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে কি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? চলো, সরো এখান থেকে। ওদেরকে একাকী কথা বলতে দাও, বলে কেবল নিজের স্বামী নয়, বাকি সবাইকেও ওখান থেকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল প্যারো। ওদের আশপাশ নীরব হয়ে গেছে। অন্তত ওদের কথা কেউ শুনে ফেলবে এই ভয় পেয়ে কথা বলার সুযোগ পেল ওরা।

প্রথম কথা বলল লেডি। বলল, কতদিন আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছ জানো, প্রসপেরো? আমি কেবল ধৈর্য ধরে ছিলাম। কেবল ধৈর্য। যাক, শেষ পর্যন্ত তুমি এসেছ… একমুহূর্ত থেমে সে প্রসপেরোর গম্ভীর হয়ে থাকা মুখটা যাচাই করল। তারপর বলল, তোমার কি কিছুই বলার নেই?

একটু যেন কম্পিত কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, এক জীবনেও কথা শেষ হবে না।

তুমি খুশি হওনি? দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল জিয়ান্না।

এভাবে আমাদের মুখোমুখি হওয়াটাকে ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলা ছাড়া আর কী বলব। কে বিশ্বাস করবে যে এটা কাকতালীয় একটা ঘটনা? গম্ভীর নিস্তেজ কণ্ঠে বলল প্রসপেরো।

নিঃসন্দেহে কেউ কাকতাল বলে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমাদের দেখা হয়েছে ভাবছ কেন? এটা ভাগ্যের খেলা নয়, আমার খেলা। তুমি অনুমান করতে পারোনি? নাকি তোমার প্রতি আমার বিশ্বস্ততা নিয়ে কোন দ্বিধা ছিল? নাকি ভাবছ ওরা তোমার কাছে ওদের ঘরের কোন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, সেটা স্রেফ কাকতাল?

প্রসপেরোর চোখে ভেসে উঠল ওর মা, স্কিপিওনি আর ডোরিয়ার চেহারা। প্যারেট্টাকে বিয়ে করে তার ছেলের গায়ে নিজের নামের তকমা তো ডোরিয়া লাগিয়েছেই, সঙ্গে তার ভাতিজির উপাধিও পরিবর্তন করে দিয়েছে। এতক্ষণে ওর মনে পড়ল যে প্যাঁরেট্টার আগের স্বামী ছিল মারকুইস অভ ফেনারো।

মূল দৃশ্যটা ততক্ষণে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। এবং বাস্তবতা রীতিমত হতভম্ব করে দিয়েছে ওকে। ভাবছে, ডোরিয়াদের পক্ষ থেকে কাকে ওর স্ত্রী করার প্রস্তাব দেবে, সে বিষয়ে প্রসপেরো একেবারেই মাথা ঘামায়নি। কিন্তু তারপরও, ঘটনা যেভাবে মোড় নিয়েছে তা রীতিমত অকল্পনীয়।

প্রসপেরোকে নীরব থাকতে দেখে কথা বলে উঠল লেডি অভ দ্য গার্ডেন। বলল, বুঝেছি, এ বিষয়ে তুমি ভাবোনি। হয়তো আমাকে একটু বেশি সরল ভেবে বসেছিলে। তবে সময়মত দেখবে, আমিও ধুরন্ধর হয়ে উঠতে জানি। ভাগ্যদেবীর হাত থেকে উপহার হিসেবে আমাকে পেতে যাচ্ছ তুমি। সব খুলে বললেই বুঝবে কেন একথাটা বলেছি। তারপর হয়তো তোমার এখনকার নির্লিপ্ততার মুখোশ খসবে। এখন তো তোমাকে চিনতেই পারছি না। বাগানে দেখা আমার ভালবাসার মানুষটিকে খুঁজেই পাচ্ছি না আমি।

প্রসপেরোকে একটু সামনের একটা জানালার কাছে টেনে নিয়ে গেল জিয়ান্না। ওখান থেকে চোখে পড়ছে বন্দরে নোর করিয়ে রাখা জাহাজের সারি। জাহাজের ভিড়ের ভিতর প্রসপেরোর গ্যালিও দেখা যাচ্ছে। জানালার পাশেই রাখা আছে স্প্যানিশ মুরদের বানানো নকশাদার চেয়ার। চেয়ারটায় বসে পড়ল জিয়ান্না। শুরু করল তার গল্প বলা।

জিয়ান্নর ভাষায়, ওদের সুখী হওয়ার সুযোগ খোদ ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবে স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে। এবং সুযোগটা চিনতে জিয়ান্নার ভুল হয়নি।

একটা সময় লর্ড আন্দ্রের প্রতি জেনোয়িসদের তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল সে। ঠিক ওই সময় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে ঘটে প্রসপেরোর প্রসিডা বিজয়। তখন জেনোয়া থেকে অ্যাডর্নোদের বিতাড়িত করার জন্য ডোরিয়াকে দোষারোপ করতে থাকে সবাই। আসলে আড়ালে দোষারোপ তো আগে থেকেই করত। তখন সেটা প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। ওদিকে জিয়ান্নার আন্টি প্যারেট্টা ততদিনে ডোরিয়ার স্ত্রী হয়ে গেছে। ফলে জিয়ান্নাকেও তার সঙ্গে ফসোলু প্রাসাদে গিয়ে উঠতে হয়েছে। লর্ড আন্দ্রে জিয়ান্নাকে তার ধর্মকন্যা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। ডোরিয়া তাকে যথেষ্ট স্নেহ করত। এবং তার মাধ্যমেই জিয়ান্না জানতে পেরেছিল, অ্যাডর্নোদের সঙ্গে ডোরিয়াদের এই বিরোধ শুরু হয়েছিল ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিসের দায়িত্বহীনতা ও ডোরিয়ার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের কারণে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনার সত্যিরূপ প্রকাশ পায়নি। বরং এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ভিন্ন। দৃষ্টিকোণ থেকে। তার উপর প্রসপেরোর সঙ্গে ফিলিপ্পিনো যে আচরণটা করেছে তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য।

ডোরিয়া যখন এসব বলছিল তখনই নিজের সুযোগটা দেখতে পায় জিয়ান্না। জিয়ান্নাই তাকে বুদ্ধি দেয় যে প্রসপেরোর সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমেই কেবল এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এবং সন্ধি প্রস্তাবের আন্তরিকতা বোঝাতে ডোরিয়া ঘরের কারো সঙ্গে প্রসপেরোর বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হোক। তাহলেই ব্যাপারটা পূর্ণাঙ্গ চেহারা পাবে। তখন জিয়ান্নাকে ডোরিয়া সরাসরি প্রশ্ন করেছিল, তুমি কি বোকা, নাকি আমার পয়সায় শ্রাদ্ধ করতে চাইছ? তাছাড়া আমার নিজের তো মেয়ে নেই! আমার জন্য কে এই আত্মত্যাগ করবে?

তখন আমি তাকে বলি, কন্যা না থাক, ধর্মকন্যা তো আছে। আমি আপনার ধর্মকন্যা। আপনার জন্য খুশির সঙ্গে কাজটা করতে রাজি আছি আমি। তারপর ডোরিয়াকে সে খুলে বলে, প্রসপেরোর বিপদের সময় ওকে আশ্রয় দেয়ার কথা, অসুস্থ হওয়ার পর ওর সেবা, পরস্পরের প্রেমে পড়ার কথাও ডোরিয়াকে বলেছে জিয়ান্না। সেইসঙ্গে বলেছে কীভাবে ডোরিয়াদের কারণে আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে ওরা। তারপর ডোরিয়াকে সে বুঝিয়ে বলেছে যে, ডোরিয়ার নিজের স্বার্থেই বিয়ের মাধ্যমে হলেও অ্যাডর্নো আর ডোরিয়া পরিবারের ঝগড়া থামাতে হবে।

গল্পটা শুনতে শুনতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল প্রসপেরো। বুঝল অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে প্রসপেরোকে প্রতিশোধের পথ থেকে ফেরানোও ছিল জিয়ান্নার অন্যতম প্রচেষ্টা। আর জিয়ান্নার পরিবার ও ডোরিয়ার পরিবারের মধ্যে সদ্য তৈরি হওয়া বন্ধনের কারণে খানিকটা হলেও লর্ড ডোরিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে সে।

প্রসপেরো বলল, রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হলে তাহলে, প্রসপেরোর কণ্ঠে ফুটে উঠেছে তিক্ততার আভাস।

তবে জিয়ান্না বুঝতে পারেনি, কেন প্রসপেরোর ভিতর তিক্ত অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।

এদিকে অজান্তেই নিজের উপর রেগে যাচ্ছে প্রসপেরো। তারপরই ওর মনে হলো ডোরিয়াকে নিজের ঘটনা জিয়ান্না খুলে বলেছে বটে, কিন্তু ডোরিয়ার কার্যকলাপ তারচেয়েও বেশি কিছুর ইঙ্গিত করছে।

প্রসপেরো এসব আকাশ-পাতাল চিন্তা করছে আর জিয়ান্না তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। তার চোখে দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি। বলল, তুমি এত নীরব হয়ে আছ যে, প্রসপেরো? ভুল হয়েছে। কোন? ভেবেছিলাম আমার প্রশংসা করবে। অথচ একবারও বলোনি যে তুমি খুশি হয়েছ।

জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে প্রসপেরো তখন বলেছিল, তুমি নজে খুশি, জিয়ান্না?

হ্যাঁ, অবশ্যই খুশি। কেবল আমার জন্য না। তোমার জন্যও। কারণ, তুমি আর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলবে না বলে ওদের কথা দিয়েছ। তোমার ভিতরের আগুন নিভেছে, তাতেই আমি খুশি।

তোমার তা-ই মনে হচ্ছে?

এমনটা মনে করাই তো স্বাভাবিক, তাই না? আর, কথা রাখার ইচ্ছা না থাকলে তুমি নিশ্চয়ই ওদের প্রস্তাবে সম্মত হতে না?

হা, সেটা ঠিক বলেছ। কথা দিলে তো রাখতেই হবে।

লর্ড আন্দ্রেও একই কথা বলেছিল। বলেছিল এটা একটা পরীক্ষা হতে যাচ্ছে।

প্রসপেরোর মুখে আবার ফুটে উঠল সেই অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। হাসিমুখেই ও বলল, হ্যাঁ, অরেঞ্জের প্রিন্সকে আমিও একই কথা বলেছি। ডোরিয়াদের বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তা আছে এই বিয়েতে। আর আমার তরফ থেকেও সন্ধির গ্যারান্টি হিসেবে বিয়েটাকে দেখছে ওরা।

তা-ই তো হওয়ার কথা। দ্বিপাক্ষিক সম্মতির ভিত্তিতে সমঝোতা। আর সমঝোতার নিশ্চয়তা হিসেবে ও আমাদের সুখের জন্য বিয়ে।

একটু এগিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল প্রসপেরো। সাগরের পানিতে ডুবন্ত সূর্যের লালচে আলোর খেলা দেখা যাচ্ছে। সেই আলোর আভা প্রসপেরোর মুখেও এসে পড়ছে। ভিতরের অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো লুকানোর চেষ্টা করছে প্রসপেরো। তবে খুব যে সফল হচ্ছে তা বলা যাবে না। এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়াল জিয়ান্না। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কোন ভুল করেছি, প্রসপেরো? আকুল হয়ে ওর চেহারায় প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে থাকল জিয়ান্না।

জোর করে হেসে প্রসপেরো বলল ভুল? না, না, ভুল হবে কেন?

কিন্তু প্রসপেরোর শান্ত, আবেগহীন চেহারায় প্রথমে কিছু না ফুটলেও চোখের কোণের ভাজ বেইমানি করে বসল।

জিয়ান্না বলল, খুব অদ্ভুত লাগছে তোমাকে। কেমন নীরব, গম্ভীর! আর, আর…একদম শীতল।

না, জিয়ান্না। আমি শীতল হয়ে যাইনি। একটু চিন্তা করছিলাম, এই আর কী। তবে এই আয়োজনটাও গম্ভীর। একটু থেমে আশপাশে দেখে নিয়ে বলল, তাছাড়া আমরা অনেক লোকজনের ভিতর আছি।

ছোট্ট করে একবার শ্বাস ফেলল জিয়ান্না। তারপর হালকা একটু হেসে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমাদের দেখা হওয়া নিয়ে অনেক কিছু কল্পনা করেছিলাম। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। কী আর করা। আন্দ্রের বাড়ি, তার পরিকল্পনা মোতাবেকই সব করতে হয়েছে। বলে প্রসপেরোর হাত ধরল জিয়ান্না।

ওর স্পর্শে শিহরিত হয়ে উঠল প্রসপেরো। জিয়ান্না বলল, কাল আবার এসো। সাজানোর নাম করে মনটরসল্লি আমার বাগানটার কী বেহাল অবস্থা করেছে দেখাব।

বলছ কী তুমি! ওই বাগান আমার কাছে ছিল স্বর্গের মত!

এই তো, এতক্ষণে আমার প্রসপেরো কথা বলছে। আমার রোবটা খেয়াল করেছ, প্রসপেরো? প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি, সেদিন যে রোবটা পরে ছিলাম সেটার মত করেই এটা বানিয়েছি। সেদিনের মত করে নিজেকে তোমার সামনে উপস্থাপন করার ইচ্ছা ছিল আমার। তোমার জন্য আমার ছোট্ট উপহার। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল জিয়ান্না। ওর প্রতিটা পলক তখন খুঁজছে আগের সেই প্রাণবন্ত প্রসপেরোকে, যাকে সে তার বাগানে দেখেছিল, যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু প্রসপেরোর শীতল চেহারায় প্রাণের কোন আভাস খুঁজে পেল না ও। প্রসপেরোর গম্ভীর নীরবতা দেখে ও ভাবল, নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, যার কারণে প্রসপেরোর এতটা পরিবর্তন হয়েছে।

ওদিকে ডোরিয়া ততক্ষণে অস্থির হয়ে গেছে। ভাবছে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে ওদেরকে। অতিথিরাও একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ওরাও চাইছে প্রসপেরোরা ওদের কাছাকাছি আসুক।

ডোরিয়ার ডাক পেয়ে স্বস্তি পেল প্রসপেরো। কারণ যেভাবে যা হবে বলে ও আশা করেছিল, তার কিছুই হয়নি। জিয়ান্নার দেখা পেয়ে খুশিতে ওর পাগল হওয়ার কথা, কিন্তু এই ঘটনাই মাটিতে আছড়ে ফেলেছে ওকে। বিয়ের ঘোষণা দেয়ার কথা থাকলেও, ডোরিয়া ঘরের মেয়েকে যে-কোন অছিলায় প্রত্যাখ্যানের মানসিকতা নিয়ে এসেছিল প্রসপেরো। কিন্তু তাই বলে জিয়ান্নাকে নয়। পুরো ব্যাপারটাই ওর অসহ্য লাগছে। জিয়ান্নার সামনে অমন গম্ভীর শীতল হয়ে থাকার ইচ্ছা ওর ছিল না। কিন্তু তা না করেও উপায় ছিল না। এখন প্রশ্ন একটাই: এই শীতল গাম্ভীর্যের আড়ালে ও নিজেকে ঢেকে রাখবে, নাকি জিয়ান্নার কাছে কটু সত্যটা স্বীকার করবে?

কথা হচ্ছে, সত্যটা জানিয়ে দিলে ভগ্ন হৃদয়ে ওর কাছ থেকে চিরতরে দূরে সরে যাবে জিয়ান্না। এমন না যে শত্রু ঘরের কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রসপেরোর আদৌ নেই। না, তা নয়। বরং জিয়ান্না এজন্য সরে যাবে যে ডোরিয়াদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা পুষে রাখার মানে জিয়ান্নার সঙ্গে প্রতারণা করা। সেজন্যই দূরে সরে যাবে সে। সেইসঙ্গে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে প্রসপেরোকে। শুধু জিয়ান্নার কথাই বা বলি কেন? আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন যে কেউই ওকে এই দৃষ্টিতেই দেখবে। পুরো ব্যাপারটাকে জিয়ান্নার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করল প্রসপেরো। বুঝতে পারল ওর সমস্ত চিন্তা চলছে কেবলমাত্র প্রতিশোধকে কেন্দ্র করে। কাজেই তা জিয়ান্নার পছন্দ হওয়ার কোন কারণ নেই। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলল প্রসপেরো।

বিশাল হল ঘরের লম্বা দুই দেয়াল ঘেঁষে একইরকম বিরাট লম্বা দুটো টেবিল ফেলা হয়েছে। এবং মেঝে থেকে কয়েক ধাপ উপরে আরেকটা মঞ্চের উপর আড়াআড়িভাবে ফেলা হয়েছে। আরেকটা লম্বা টেবিল। আকৃতিটা হয়েছে অনেকটা ইংরেজি ক্যাপিটাল ই অক্ষরের মত। তবে ই-এর মাঝের বাহুটা ছাড়া অবশ্যই। অভ্যাগত অতিথির সংখ্যা একশ। তাদের সার্ভ করার জন্য অপেক্ষা করছে একজন, স্টুয়ার্ডের অধীনে বেয়ারাদের রীতিমত একটা বাহিনী। তাদের সবার পরনে লাল আর সাদার মিশেল দেয়া ইউনিফর্ম! প্রত্যেকের ইউনিফর্মের বুকে ঝুলছে ডোরিয়া পরিবারের প্রতীক সোনালি ঈগল।

ওপরের মঞ্চে বসেছে ডিউক অভ মেলফি ডোরিয়া, পাশে ডাচেস জিয়োভান্না মারিয়া আর ডাচেসের বামপাশের আসনে বসেছে প্রসপেরো। যন্ত্রণায় ভিতরটা দুমড়ে যাচ্ছে প্রসপোেের। তবুও মেকি একটা সুখী-সুখী হাসি ধরে রেখেছে ও। হাসিমুখেই কথা বলছে ডাচেস আর পালার্মোর আর্চ বিশপের সঙ্গে। ব্যাপারটা আসলেই কষ্টকর। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়ে গেছে প্রসপেরো।

পরের দিনের কথা। প্রসপেরোকে ডেকে পাঠিয়েছে জিয়ান্না। উদ্দেশ্য, মনটরসল্লি তার সাধের বাগানের কী অবস্থা করেছে, দেখানো। তবে প্রসপেরো ভাল করেই জানে, বাগান দেখানো অছিলা। একান্তে কথা বলাটাই আসল উদ্দেশ্য। আর ঠিক এ কারণেই প্রসপেরো ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে না। আগের পুরো রাত নির্ঘম কাটিয়েছে ও। কিন্তু এই সমস্যার কোন সমাধান বের করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে জিয়ান্নার সঙ্গে দেখা করার জন্য উঠতে যাচ্ছে প্রসপেরো আর ঠিক তখনই হাজির হলো ডোরিয়া। স্বস্তির শ্বাস ফেলল ও।

প্রসপেরোর মনে হলো আন্দ্রে একটু বেশিই কথা বলছে। মানে সাধারণত সে যেমনটা বলে তার চেয়ে বেশি আরকী। সকালেই সে নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন পরিদর্শন করেছে। প্রসপেরোর প্রস্তুতি দেখে যারপরনাই খুশি সে। যেভাবে ও লোক লস্কর, মলামাল আর অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়েছে, এর চেয়ে ভালভাবে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব না। খুব খুশি হয়ে আন্দ্রে ভেবেছে খায়ের। আদ-দীনের বিরুদ্ধে অভিযানে দারুণ এক সংযোজন হয়েছে প্রসপেরোর নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন।

প্রসপেরোকে সে জানাল, দূত মারফত জানতে পেরেছে, শনিবার জেনোয়ায় পৌঁছুবেন সম্রাট। আজ বৃহস্পতিবার, সময় নেই। তবে সৌভাগ্যবশত সম্রাটের উপযুক্ত স্বাগত জানানোর আয়োজন প্রায় শেষ। কথা বলতেই থাকল আন্দ্রে। উষ্ণ, আন্তরিকতার সঙ্গে, কিন্তু অতি লম্বা সময় ধরে। একসময় প্রসপেরোর সন্দেহ হতে থাকল, এই বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন অকারণে না। নিশ্চয়ই গুরুগম্ভীর কিছু একটা বলার ইচ্ছা আছে তার। কথাটা ভাবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আসল কথায় এল ডোরিয়া। একবার গলা খাকারি দিয়ে তার লম্বা দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলল, এবার তোমার মনের কথা আমি বলতে যাচ্ছি। দেখতেই পাচ্ছ, খুব শীঘ্রিই সম্রাট আসছেন। সময় একদমই নেই বলা যায়। হয়তো আগামী এক সপ্তাহের ভিতরই আমরা সাগরে নেমে পড়ব। কাজেই তোমাদের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই হচ্ছে। বুঝতে পারছি, তোমারও তর সইছে না, বলে একগাল হাসল সে।

শুনে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল প্রসপেরো। ওদিকে জিয়ান্নার চিবুকেও রং ধরল। তবে আগ বাড়িয়ে কথা বলল না কেউ। বলা হয়নি, কিছুক্ষণ আগেই ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে জিয়ান্না।

তখন নীরবতা ভেঙে আন্দ্রেই আবার তাড়া দিয়ে বলল, বললো, বলো। তুমি তো কিছু একটা অবশ্যই ভেবেছ।

একটু নড়েচড়ে বসে প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, ভেবেছি। তবে আরেকটু বোঝার দরকার আছে।

শুনে ওদের দিকে আরেকটু ঘুরে টেরেসের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল ডোরিয়া। বলল, কোন ব্যাপারে তোমার মনে দ্বিধা নেই তো? বা মন খারাপ হওয়ার মত কিছু আমাকে শুনতে হবে তো?

সঙ্গে সঙ্গেই প্রসপেরো বলল, না, না, দ্বিধা করার প্রশ্নই আসে না। তবে, সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব কিছু কারণে আরো কয়েকটা দিন কাটার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাইছি না।

একথা তো আগেও বলেছ। এখন তাহলে কী করবে?

এভাবে কথা বলার পরিকল্পনা প্রসপেরোর মোটামুটি আগে থেকেই নেয়া ছিল। ওর দৃষ্টিতে জিয়ান্নার সঙ্গে এভাবে দেখা হওয়াটা স্রেফ ভাগ্যের নিষ্ঠুর ক্রুরতা ছাড়া আর কিছু নয়। ওর মনে হচ্ছিল দৃশ্যপটের পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে ওর সঙ্গে এমন করছে স্বয়ং শয়তান। যা হোক, বিষাদ মাখা স্বরে ও বলল, মাই লর্ড, যদি সামনের অভিযানটা থেকে আমি ফিরতে না পারি, তাহলে…জিয়ান্নার উপর স্রেফ একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে এই বন্ধন।

প্রসপেরোর হাতটা ধরে ফেলল জিয়ান্না। মৃদু আওয়াজে ভালবাসাপূর্ণ অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে সে বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। অন্য কারো ঘরে যাওয়ার চেয়ে তোমার বিধবা স্ত্রী হয়ে বাঁচাও আমার জন্য অনেক ভাল।

এভাবে বোলো না। কোন মানুষই এতটা মূল্যবান না।

জবাবে জিয়ান্না বলল, কিন্তু আমি যদি ভাবি আমার জন্য একজনই নির্ধারিত, তাহলে?

প্রসপেরো বলল, প্রমাণ করতে পারব যে, ঠিক সেই মানুষটি আমি নই।

তখন কথা বলল আন্দ্রে, তাহলে, কী করতে চাও? বলে দুজনের দিকেই তাকাল সে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু হাসল জিয়ান্না। বলল, প্রসপেরোর যা ইচ্ছা, তা-ই হবে। ও যেটাকে ঠিক মনে করছে তা আমি পরিবর্তন করতে চাই না।

প্রসপেরোর ক্ষতের উপর আবার আঘাত করল কথাটা। যদিও ওর মনের সব চেহারায় প্রকাশ পেল না।

তবে এত সহজেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলার ইচ্ছা ডোরিয়ার নেই। সে বলল, শুধু প্রসপেরো বলেছে বলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। আমি সবাইকে বলেছি, যে এখনই তোমাদের বিয়ে হবে। আমি ধারণা করেছিলাম, এতদিন আমার ভাতিজিকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এটাই তুমি করবে।

তখন প্রসপেরো বলল, কিন্তু, লর্ড, আমি মনে করি আমার ফিরে আসাটা হবে ওর জন্য আরো বড় প্রাপ্তি। আপনি বরং এভাবে ভাবুন যে, ওকে পাবার আশা আমাকে আরো ভাল যোদ্ধা করে তুলবে। ফিরে আসার জন্য সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকব আমি। বিশ্বাস করুন, এই ব্যাপারটা আমাকে অবশ্যই আরো লড়াকু সেনায় পরিণত করবে।

প্রসপেরোর কথায় স্পষ্ট অসন্তুষ্টি ফুটে উঠল ডোরিয়ার চোখে। একবার ওর দিকে, আরেকবার জিয়ান্নার দিকে তাকাতে লাগল ডোরিয়া। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলল, বোকামি করছ। তবে যেহেতু তোমরা দুজনে একমত, তাহলে এটাই হোক। কিন্তু আমি কোনমতেই বুঝতে পারছি না, তোমরা তরুণ, অথচ তোমাদের রক্ত এতটা শীতল হয় কী করে?

স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রসপেরো। তবে ও ভালভাবেই জানত, এখানেই ঘটনার শেষ নয়। সেদিন বিকেলেই ঘরে ফিরে এল প্রসপেরো। ঘরে ঢুকেই টের পেল সেখানে একটা বড়সড় ঝড়ের মেঘ পুঞ্জীভূত হচ্ছে কারণ ঘরে ঢোকার আগেই শুনতে পেল উঁচু কণ্ঠের বাদানুবাদ। কণ্ঠ শুনে বুঝল ওর চাচা জিয়োভাচ্চিনো অ্যাডনে উপস্থিত। সে সান্টা বারবারার কার্ডিনাল। সঙ্গে আরেক চাচা রেইনাল্ডো অ্যাডর্নো ও তার দুই ছেলে অ্যানিবাল আর তাদ্দিও-ও আছে।

ওরা কী নিয়ে আলাপ করছে তা আন্দাজ করা মোটেও জটিল কোন ব্যাপার নয়। সেজন্য প্রস্তুতি নেয়াই আছে প্রসপেরোর। সত্যি বলতে ইতিমধ্যেই ওর একটা পরীক্ষা হয়েও গেছে। গতদিন ফসোলু প্রাসাদে ওর অভিবাদনের জবাবে ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল গ্রিমানি পরিবারের একজন। অগাস্টিনো স্পিনোলাও ওকে যথাযথ খোঁচা মারতে ছাড়েনি। বলেছে, বাহ, তোমার বাবাকে ভুলে যাওয়া হলো। তার ভুলগুলোও ওরা ক্ষমা করে দিল। ভাল। যখন স্বার্থ মাথাচাড়া দেয়, সবাই আসলে এমনই হয়ে যায়। তবে, তুমিও যে এভাবে বদলে যাবে তা কখনো ভাবিনি, প্রসপেরো।

জবাবে প্রসপেরো বলেছিল, না, আমি বদলাইনি। আর সম্পদ বা স্বার্থ যা-ই বলেন, তার পিছনেও আমি ছুটছি না।

তোমার বাবা তোমার জন্য অঢেল সম্পদ রেখে গেছে। কাজেই শত্রু ঘরের একজনের হাতে শান্তির চুমু খাওয়ার দরকার কী?

তখন প্রসপেরো বলেছিল, ওরা কি আসলেই শত্রু? নাকি, আমরা ওদেরকে শত্রু বলে ভাবছি? ফ্রান্সের রাজাই তো প্রথম তার শপথ ভেঙেছিল, তাই না?

ডোরিয়ারা তা-ই বলে বটে। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই। হয়তো কোনভাবে তুমি নিশ্চিত হয়েছ, বলে চলে যায় স্পিনোলা। আলাপের ওখানেই ইতি ঘটে।

রাগে কাঁপতে থাকে প্রসপেরো। তবে সময়মত নিজেকে সামলে নেয়। অপমানটা স্রেফ হজম করে ফেলে। কারণ ওর বাবার একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল স্পিনোলা। কাজেই তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা বোকামি।

এখন ঘরে এসেও ওকে আবার একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। অসুবিধা নেই। নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে ও। দরজা খোলা মাত্রই ওর দিকে তাকাল প্রসপেরোর মা। রাগে তার মুখ লাল হয়ে আছে। বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি এসেছ। নাও, সামলাও ওদের। তোমার হয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার পাগল হওয়ার দশা।

দরজা বন্ধ করতে করতে প্রসপেরো বলল, আর তা দরকার হবে না। আমিই সবার প্রশ্নের উত্তর দেব।

প্রসপেরোর চাচা রেইনাল্ডো তখন রীতিমত চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, তোমার জবাব তোমাকেই দিতে হবে।

রেইনাল্ডো বিশালদেহী লোক। গাল ঢাকা দাড়িতে তাকে আরো বিশাল মনে হয়। তবে প্রসপেরোর প্রয়াত বাবার সঙ্গে কোনদিক থেকেই তার মিল নেই।

তাকে ওভাবে চেঁচাতে দেখে তার ভাই হাত বাড়িয়ে দিল তাকে একটু শান্ত করতে। কিন্তু ঝাঁকি দিয়ে তার হাতটা সরিয়ে দিল সে। বলল, কোন মহিলা বা প্রিস্টের এসব সামলানোর ক্ষমতা নেই। তারপর প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ডোরিয়াদের ঘরে বিয়ে করতে যাচ্ছ শুনলাম?

প্রসপেরো বলল, এখনই শুনলেন নাকি?

আগেই শুনেছি, কিন্তু এখন বিশ্বাস করেছি।

বিশ্বাস তো করেছেনই। তাহলে আর জিজ্ঞেস করা কেন? জিয়োভান্নার সঙ্গে আমার বাগদান হয়েছে। সম্ভবত এটাই আপনি স্পষ্টভাবে জানতে চাইছিলেন, তাই না?

আর কী জানতে চাইব?

প্রসপেরো বলল, আপনি খুশি হননি?

খুশি হব? মস্করা করছ, ছোকরা? আমার ভাইয়ের ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে আমার ভাইয়েরই খুনির ঘরে, আর আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি খুশি কিনা!

তখন দুঃখিত কণ্ঠে তাকে বাধা দিয়ে কার্ডিনাল বলল, রেইনাল্ডো, এভাবে বলছ কেন? অন্তত…

তুমি থামো, ভাইকে রীতিমত হুঙ্কার দিয়ে বলল সে।

প্রসপেরো বলল, মেয়েটি মোনাল্টি ঘরের। ডোরিয়া রক্তের না।

শুনে কার্ডিনাল বলল, এটা অবশ্যই বিবেচ্য বিষয়, রেইনাল্ডো।

উত্তরে পাশের টেবিলের উপর ধুম করে এক কিল বসিয়ে দিল রেইনাল্ডো। বলল, তুমি থামবে? ওই মেয়ের চাচিকে বিয়ে করেছে আন্দ্রে। এখন সে আন্দ্রের ভাতিজি। এমনকী আন্দ্রের নামও গ্রহণ করেছে সে।

প্রসপেরোর মা বলল, আমি ঘরে আছি সেটা মনে রেখো সবাই। আর ওভাবে টেবিল পিটিয়ো না। আমার মাথাব্যথা করছে।

মাথা, ম্যাডাম? কেন ওর কাজে আপনার মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে না? আপনার হৃদয়ও কি প্রসপেরোর মতই নির্দয় হয়ে গেছে?

জবাবে প্রসপেরোর মা বলল, ধৈর্য দাও, ঈশ্বর। আমার নিজের ঘরে আমাকে তোমার ধমক শুনতে হবে?

কার্ডিনাল তখন বলল, ঠিক। এভাবে কথা বলা উচিত না, রেইনাল্ডো। ওঁর কথা অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত।

জবাবে হুঙ্কার দিয়ে রেইনাল্ডো বলল, আমি কেবল আমাদের অ্যাডর্নো পরিবারের সম্মান বিবেচনা করছি এখন।

প্রসপেরো বলল, আপনি আসলে আমার সম্মানের কথা বলছেন। কিন্তু আমার সম্মান নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে কেন? এর কোন প্রয়োজন তো আমি দেখছি না।

শুনে বাক্যহারা হয়ে গেল রেইনাল্ডো। তারপর বলল, নির্লজ্জতার জন্য তোমাকে বিরাট পুরস্কার দেয়া উচিত।

লজ্জা, লজ্জা, বলল প্রসপেরোর চাচাত ভাই অ্যানিবাল।

তোমাদের যা ইচ্ছা বলো। কিন্তু আমার মত বদলাবে না। আমি কী করব না করব তা বলে দেয়ার অধিকার তোমাদের কারো নেই, জবাব দিল প্রসপেরো।

তখন রেইনাল্ডো বলল, আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে। আমরা অবশ্যই ব্যাপারটা বিচার করে দেখব।

না, না, এসব বিচার করার দায়িত্ব আমাদের না, বলল কার্ডিনাল।

জবাবে রেইনাল্ডো বলা শুরু করল, হয়তো তোমার না, কিন্তু…

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কার্ডিনাল বলল, আমার কাজের সূত্রে এই দায়িত্ব তোমার চেয়ে অনেক বেশি আমার। কিন্তু আমি অনুমান করে কাজ করি না। তাছাড়া স্বর্গ থেকে যা নির্ধারিত হয়ে আছে তাতে নাক গলাবার আমরা কে? তোমার সামান্য জ্ঞান দিয়ে তুমি সব বিচার করতে চাও, রেইনাল্ডো? কিন্তু এমন কিছু কোরো না যা ধর্মদ্রোহিতা হয়ে যায়। তাই বলছি, না জেনে বুঝে কোন ঘটনার বিচার করার দায়িত্ব তোমার নয়।

বক্তৃতা থামাও। বলছ বিবেচনা করার অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমাদের পরিবারের সুনাম আর সম্মান রক্ষার অধিকারও কি

আমার নেই? প্রসপেরো যা করেছে বা করতে যাচ্ছে তার দায় অ্যাডর্নো ঘরের সবার উপর পড়ে।

কিন্তু আমার এই কাজের ফলে প্রাপ্ত সুবিধা নিতে আপনাদের কারো বাঁধছে না, চাচাকে খোঁচা মারল প্রসপেরো।

জবাবে ওর দিকে ফিরে গর্জে উঠল রেইনাল্ডো আর তার দুই সুপুত্র। ওদের হুঙ্কারের জবাবে উপহাস ফিরিয়ে দিল প্রসপেরো। বলল, ছয় মাস আগে আপনারা সবাই অভাবে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন আপনারা কেউ কি জেনোয়ায় আপনাদের সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দাঁড়াতে সাহস করেছিলেন? না, তা করেননি। ডোরিয়াদের সঙ্গে আমার সন্ধি হওয়ার পরই এখানে পা ফেলতে পেরেছেন আপনারা। আপনারা অবশ্যই এর মূল্য সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। অথবা খোঁজ নিয়ে জেনে নিতে পারতেন যে কোন্ কোন্ শর্তের ভিত্তিতে আপনারা জেনোয়ায় ঢুকতে পেরেছেন। আর, পরিবারের মান-সম্মান ইত্যাদি ইত্যাদি…কই এই মাটিতে পা দেয়ার আগে কেউ কি একবারও ভেবেছেন যে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবেন? একটা কুটোও তো নাড়েননি কেউ। উল্টো আমি যখন আপনাদেরকে এদেশে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তখন আমার উপরই দোষ চাপাতে চাইছেন।

ঠোঁট টিপে হাসছে কার্ডিনাল। তারপর ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওর কথা বিবেচনার দাবি রাখে, ভাই আমার। চিন্তা করে। দেখো।

কিন্তু তার কথায় ভ্রূক্ষেপ করল না রেইনাল্ডো। ভয়ানক দৃষ্টিতে প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর নিজের দুই পুত্রধনের দিকে ফিরে ঘোষণা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, এই ছেলে উন্মাদ হয়ে গেছে।

তখন তার ছেলে তাদ্দিও বলল, তোমার কি মনে হয় প্রসপেরোর বক্তব্য ঠিক? ও এসব বলছে স্রেফ তর্কের খাতিরে। তারপর প্রসপেরোর দিকে ফিরে বলল, আমাদের ফেরার উপর থেকে কখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে তা কি কাউকে জানানো হয়েছিল?

প্রসপেরো বলল, জানতে না? তাহলে বলতে হয়, তোমাদের ভিতর কৌতূহল নেই। তবে এখন তো জানলে, এখন কী করবে? এর সুযোগ নেবে না? ঘরহীন ভবঘুরের মত-আবার ঘুরতে বের হবে? নাকি আমার প্রতারণা তোমাদের জন্য রুটিরুজির যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা গ্রহণ করবে? নাকি ভাবছ তোমাদের জন্য নায়কোচিত কোন কাজ অপেক্ষা করছে, তা-ই করতে যাবে? যা-ই করো, মনে রেখো, বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধের দায় তোমাদেরও ছিল। কিন্তু তোমরা কেউ কিছুই করনি। কাজেই এখনও আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। আমারটা আমি ভালই বুঝি।

প্রসপেরোর দিকে ঘৃণামাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওরা। তখন আবার কথা বলল কার্ডিনাল। ওদেরকে বলল, তোমাদের জবাব পেয়ে গেছ আশা করি।

ঘুরে তার হ্যাট তুলে নিল রেইনাল্ডো। ছেলেদের বলল, চলো, এখানে আর কিছু বলার বা করার নেই। একটু সরে ওদেরকে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিল প্রসপেরো। দোরগোড়ায় পৌঁছে ভাইয়ের দিকে ফিরে নাক উঁচু করে রেইনাল্ডো বলল, তুমি মনে হয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।

অল্প কিছুক্ষণ; হ্যাঁ, অপেক্ষা করব। আমাকে ফেলে আবার জেনোয়া ছেড়ে চলে যেয়ো না যেন।

রাগতভাবে ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে গেল রেইনাল্ডো।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রসপেরোর মা। ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ভাল জবাব দিয়েছ। কিন্তু এর মূল্য কী? তাদিও ভুল বলেনি। তুমি ভাল বলেছ বটে, কিন্তু সেটা স্রেফ আত্মরক্ষা। আর ওরা তোমার কথার জবাব দিতে পারেনি।

অন্তত ওরা চুপ করেছে, বলল প্রসপেরো।

প্রসপেরোর কথা সমর্থন করল কার্ডিনাল। বলল, ওরা জবাব দেয়নি তা নয়, জবাব দিতে পারেনি। আরেকটা ব্যাপারও ভাবতে হবে, যে-কোন কিছু পেতে গেলে তার জন্য মূল্য দিতেই হয়। রেইনাল্ডোর সঙ্গে কথোপকথনেই তা প্রমাণ হয়ে গেছে। ওকেই এখন ওর অভিযোগ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। ও যেটাকে বলছে প্রতারণা, তা থেকে মুনাফা লুটতে কী ওর বাধবে? না, একটুও বাধবে না।

প্রসপেরোর মা বলল, কিন্তু তাতে সত্য ধুয়ে যাচ্ছে না। প্রতারণা রয়েই যাচ্ছে।

এগিয়ে এসে প্রসপেরোর মায়ের হাত ধরে কার্ডিনাল বলল, ক্ষোভ থেকে কথাগুলো বলছেন আপনি। কিন্তু ক্ষোভ আর প্রতিশোধস্পৃহার কী মূল্য? খ্রিস্ট ধর্ম এ ব্যাপারে কী বলে আপনিও জানেন। ভুল তো মানুষই করে। কিন্তু ক্ষোভের আগুন যারা ক্ষমার শক্তিতে নেভাতে না পারে, তারা নিজেদের স্থান অন্তিম গন্তব্য নরক।

তারপর প্রসপেরোর দিকে তাকাল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ইচ্ছা কী তা জানি না। জানতে চাইও না। এমনকী একজন অ্যাডর্নো হওয়া সত্ত্বেও ডোরিয়া ঘরে বিয়ে করলে তোমাকে আমি দোষারোপ করব না। আমার দৃষ্টিতে একজন সম্মানিত লোককে শত্রু এলাকায় চলার সময় অবশ্যই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ ফেলতে হবে। প্রিস্ট হিসেবে আমি যে-কোন জায়গায় যেতে পারি। এবং প্রিস্ট হিসেবেই বলছি, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ না করলে সেটা আমার ধর্ম আর পেশার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। কারণ যে-কোন ঘটনাকে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক গভীরভাবে দেখতে হয় একজন প্রিস্টকে। যা হোক, তোমার বিবেক যা বলে তা-ই কোরো। লোকে যা বলার বলুক। তারপর আশীর্বাদ করল, ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।

সে চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল প্রসপেরোর মা। তারপর দরজা বন্ধ হতেই বলল, ওর কথাগুলো প্রিস্টসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা। তবে ওই ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাস্তবে তুমি পথ চলতে পারবে না।

মায়ের কথার জবাব দিল না প্রসপেরো। কারণ কার্ডিনাল চাচার কথাগুলো ওর মনে ধরেছে। সেগুলো নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করছে সে। প্রসপেরোকে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অরেলিয়া বুঝল কোন কারণে কষ্ট পেয়েছে। প্রসপেরো। সে বলল, রেইনাল্ডোকে সব খুলে বললেই পারতে।

মাথা তুলল প্রসপেরো। বলল, হ্যাঁ, তাকে বলি, আর সারা দেশে ওসব বলে বেড়াক সে।

ও অন্তত তোমাকে বিশ্বাস করত।

ওদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছুই এসে যায় না! কার্ডিনাল চাচার কথা তো তুমিও শুনলে। উনি কি ভুল বলেছেন? না। রেইনাল্ডো চাচা আর তার দুই ছেলে আশা করেছিল ডোরিয়াদের উপর কঠোর প্রতিশোধ নেব আমি। কিন্তু, বাবা যখন মারা যায় তখন তারা কি কিছু করেছে? অ্যাডর্নো পরিবারের সম্মান রক্ষার কথা বলে গেল ওরা। কিন্তু ওদের আত্মসম্মানবোধটা গেল কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *