৩. পরদিন সকালে আবার

পরদিন সকালে আবার যখন রওনা হলো ওরা, ট্রেইলটা বেশ কিছুদূর নদীর পাড় ঘেঁষে থাকলো। মাইলখানেক পর স্রোতের গতি খুব বেড়ে গেল, তারপর উঁচু ও লাল পাহাড়-প্রাচীরের মধ্যবর্তী সরু ফাঁকের ভেতর ঢুকে পড়লো, সেখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছে অর্থাৎ এখানে আরেকটা জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে।

বহুল ব্যবহৃত ট্রেইল ছেড়ে জলপ্রপাতের কিনারায় এসে দাঁড়ালো নিকোলাস। দুশো ফুট গভীরে পাথরের একটা ফাটলে তাকালো ও, আক্রোশে সংকুচিত ভয়াল প্রবাহকে কোনো রকমে গলে বেরিয়ে যেতে দেয়ার মতো চওড়া। ফাঁকটার ওপারে একটা পাথর ছুঁড়ে দিতে পারে নিকোলাস। নিচের ওই গহ্বরে কোনো পথ বা পা ফেলার জায়গা নেই। ফিরে এসে ক্যারাভ্যানের সঙ্গে যোগ দিল ও, ঘুরপথ ধরে নদীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওরা, ঢুকে পড়েছে আরেকটা গভীর জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকায়।

এটা বোধহয় এক সময় ডানডেরা নদীর কোর্স ছিল, ফাটলটার ভেতর নতুন পথ তৈরির আগে। পথের দু পাশে উঁচু জমিনের দিকে হাত তুললাম রোয়েন, তারপর ইঙ্গিতে ট্রেইলের উপর ছড়িয়ে থাকা মসৃণ বোল্ডারগুলো দেখালো।

নদীর গতি পথ বারবার বদলে যাওয়ায় গোটা এলাকায় ক্ষয় আর কাটাছেঁড়ার প্রচুর নমুনা দেখতে পাবেন। নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন, লাইমস্টোনের পাঁচিলগুলোয় গুহা আর ঝরনা গিজগিজ করছে।

ট্রেইল এখন দ্রুত নীল নদের দিকে নামছে, শেষ কয়েক মাইলে প্রায় পনেরোশো ফুট নিচে চলে এসেছে ওরা। উপত্যকার সাইডগুলো গাছপালায় ঢাকা, বহু জায়গায় দেখা গেল লাইমস্টোনের গা থেকে খুদে ঝরনার পানি অলসভঙ্গিতে পুরানো নদীর তলায় পড়ছে।

নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে গরমও বাড়ছে। আজ শার্ট পরেছে রোয়েন, ঘামে ওর শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানটা ভিজে গেছে।

এ জায়গায় দেখা গেল ঘন জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে স্বচ্ছ পানি নেমে আসছে, স্রোতটা চওড়া হয়ে রীতিমত ছোট একটা নদী হয়ে উঠেছে। তারপর উপত্যকার একটা কোণ ঘুরলো ওরা দেখতে পেল ওদের সঙ্গে এখানে স্রোতটাও মিলিত হয়েছে ডানডেরা নদীর মূল প্রবাহে। খাদের পেছন দিকে তাকিয়ে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে একটা অকৃত্রিম সরু খিলান দেখতে পেল ওরা, ফাটলের ভেতর দিয়ে ওই খিলান হয়ে বেরিয়ে এসেছে নদী। ফাটল ও খিলানের চারধারে পাথরের রঙ অদ্ভুত লালচে-গোলাপি, পালিশ করা মসৃণ, ভজের উপর ভাঁজ খেয়ে আছে, ফলে রঙ ও আকৃতিতে মানুষের জোড়া ঠোঁটের মতো দেখতে হয়েছে।

যেন কোনো দৈত্যের মুখ থেকে নর্দমা বেরিয়েছে, ফিসফিস করলো রোয়েন, তাকিয়ে আছে খিলান, ফাটল আর অদ্ভুত দর্শন পাথরের দিকে। ভাবছি টাইটা আর প্রিন্স মেমননের নেতৃত্বে প্রাচীন মিশরীয়রা এখানে যদি এসে থাকে, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাদের। প্রকৃতির এ অদ্ভুত খেয়াল নিশ্চয়ই তাদেরকে খুব নাড়া দিয়েছিল।

নীরবে রোয়েনের মুখ পরীক্ষা করে নিকোলাস। পবিত্র দৃষ্টিতে, বড়ো বড়ো গাঢ় চোখে তাকিয়ে মেয়েটা। হঠাৎ করেই কুয়েনটন পার্কে রাখা একটা পোর্টেটের কথা মনে পড়ে যায় নিকোলাসের। ভ্যালি অব দ্য কিংস থেকে উদ্ধার করা একজন রামেসিস আমলের রাজকুমারীর অবয়ব সেটা।

তাদের রক্ত আপনার শিরাতেও বইছে, বলল নিকোলাস। অবশ্যই তারাও আপনার মতো মুগ্ধ হয়েছিল।

নিকোলাসের হাত ধরল রোয়েন। আপনি আমাকে ভরসা দিন, নিকোলাস। বলুন এখানে আমার উপস্থিতি স্বপ্নের ভেতর ঘটছে না। বলুন আমরা যা খুঁজতে এসেছি তা অবশ্যই পাব। আমাকে নিশ্চয়তা দিন, হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ডুরেঈদের আত্মাকে শান্তি দিতে পারব আমরা।

নিকোলাসের দিকে মুখ তুলে রেখেছে রোয়েন, উদ্ভাসিত মুখে চকচক করছে শিশির কণার মতো ঘাম। ওকে আলিঙ্গন করার প্রবল একটা ঝোঁক চাপল, ইচ্ছে হলো ভেজা ও ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ায় চুমো খায়। তার বদলে ঘুরে দাঁড়ালো নিকোলাস, ট্রেইল ধরে নেমে যাচ্ছে।

নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই নিকোলাসের, রোয়েনের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। খানিক পর পেছনে শব্দ হলো, পিছু নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে রোয়েন। নিঃশব্দে নিচে নামছে ওরা, অন্যমনস্ক থাকায় ওদের সামনে হঠাৎ উন্মোচিত প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না নিকোলাস।

ওরা দাঁড়িয়ে আছে উপখাদের অনেক উপরে, একটা কার্নিসে। ওদের নিচে লাল পাথর ভর্তি বিশাল এক কড়াই, পাঁচশো ফুট গভীর। কিংবদন্তীর অ্যাবের মূল্য প্রবাহ সবুজ খরস্রোত, লাফ দিয়ে পড়ছে ছায়াময় অতল গহ্বরে। সেটা এতো গভীর যে সূর্যের আলো নাগালো পায় না। ওদের পাশ থেকে ডানডেরা নদীর বিক্ষিপ্ত পানিও একই ভঙ্গিতে লাফ দিয়েছে, পানির পতনটা বকের সাদা পালকের মতো লাগছে দেখতে, খাদের ভেতরকার বাতাসে মোচড় খাচ্ছে ও ফুলছে। অতল গহ্বরে মিলিত হচ্ছে দুই প্রবাহ; বিপুল জলরাশি টগবগ করে ফুটছে, বিশাল ঢেউগুলো চুরমার হয়ে ফেনা তৈরি করছে, অবশেষে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পেয়ে সেদিকে ছুটে চলেছে অনিয়ন্ত্রিত প্রচণ্ড শক্তিতে।

বোট নিয়ে আপনি ওখানে গিয়েছিলেন? নিকোলাসের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোয়েন।

কম বয়েসে কত রকম বোকামি করে মানুষ, ক্ষীণ বিষণ্ণ হাসি নিকোলাসের ঠোঁটে, পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় হাতের রোম দাঁড়িয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। এক সময় মৃদু গলায় রোয়েন বলল, উজানের দিকে আসার সময় টাইটা আর মেমনন কী ধরনের বাধার সামনে পড়েছিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। নিজের চারদিকে তাকালো ও। তারপর খাদের নিচের অংশটা দেখালো, পশ্চিম দিকটা। ওদের পক্ষে অবশ্যই উপখাদ ধরে আসা সম্ভব ছিল না। পাহাড়-প্রাচীরের চূড়াগুলো যে রেখা তৈরি করেছে, নিশ্চয়ই সেই রেখা ধরে আসে তারা সরাসরি এখান পর্যন্ত, যেখানে এ মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। চিন্তাটা ওর গলায় উত্তেজনার ভাব এনে দিল।

জোর করে কিছুই বলা যায় না। তারা হয়তো নদীর ওপারে পৌঁছেছিল।

নিকোলাস ঠাট্টা করে বললেও রোয়েনের চেহারা ঝুলে পড়লো। এটা তো ভাবি নি। হ্যাঁ, তা সম্ভব বৈকি। নিকোলাস, এপারে যদি কোনো সূত্র না পাই ওপারে আমরা পৌঁছব কীভাবে?

যখনকার সমস্যা তখন দেখা যাবে।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ওরা। যে কাজ নিয়ে এখানে আসা হয়েছে তার ব্যাপকতা ও বিশালত্ব কল্পনা করছে দু জনেই, উপলব্ধি করছে অনিশ্চয়তার মাত্রা। খানিক পর রোয়েনই আবার নিস্তব্ধতা ভাঙল, নিকোলাস, মঠটা কোথায়? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

সরাসরি আমাদের পায়ের নিচে যে, দেখবেন কীভাবে।

ওখানে আমরা ক্যাম্প ফেলব?

সন্দেহ আছে। চলুন দেখি বোরিসকে ধরি, দেখি সে কী ভাবছে।

খাড়াইয়ের কিনারা ধরে ট্রেইল অনুসরণ করলো ওরা, খচ্চরগুলোকে ধরে ফেললো যেখানে দু ভাগ হয়ে ট্রাক। একটা পথ নদীর উল্টোদিক ধরে জঙ্গল ঢাকা নিচু জমিনে নেমে গেছে, অপরটা আগের মতোই কিনারার পাথরে ঝুলে আছে। ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল বোরিস, হাত তুলে নিচু জমিনে নেমে যাওয়া ট্র্যাকটা দেখালো সে। ওদিকে জঙ্গলের ভেতর ভালো একটা ক্যাম্পসাইট আছে। শেষবার শিকার করতে এসে ওখানে ছিলাম আমরা।

জঙ্গলে ঢুকে ফাঁকা একটা জায়গা পাওয়া গেল। কয়েকটা বুনো ডুমুর গাছ। থাকায় ছায়ার অভাব নেই। এক কোণের ছোট্ট একটা ঝরনা রয়েছে নির্মল পানি। বোঝা হালকা করার জন্য তাঁবুগুলো খাদে বয়ে আনে নি বোরিস। খচ্চরের পিঠ থেকে মালপত্র নামানো শেষ হতেই নিজের লোকদের তিনটা ছোট কুঁড়েঘর বানাবার হুকুম দিল সে। ঝরনার কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে একটা ল্যাট্রিনও তৈরি করা হবে।

এ সব কাজ যখন চলছে, রোয়েন আর টিসেকে ডেকে নিল নিকোলাস, তিনজন রওনা হয়ে গেল মঠ দেখার জন্য। দুই ট্রাকের মুখে এসে দাঁড়ালো ওরা, তারপর টিসের নেতৃত্বে পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ঘেঁষা ট্রেইল ধরে এগুলো। খানিক পরই চওড়া এক প্রস্থ পাথুরে সিঁড়ি পাওয়া গেল, পাহাড়-প্রাচীরের মুখ বেয়ে নিচে নেমে গেছে।

সাদা আলখেল্লা পরা একদল সন্ন্যাসী ধাপ বেয়ে উঠে আসছিল, অল্প কিছুক্ষণ থেমে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলো টিসে। তারা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে উঠে যেতে সে বলল, তিমকাত উৎসবের আগের রাতটাকে কাটেরা বলা হয়। কাল উৎসব তো, আজ তাই সবাই খুব ব্যস্ত। তিমকাত খুব বড় ধর্মীয় উৎসব।

কিন্তু মিশরের চার্চ ক্যালেন্ডারে তো এ ধরনের কোনো উৎসবের উল্লেখ নেই, বলল রোয়েন।

এটা আসলে ইথিওপিয়ান ইপিফানি, যিশুর ব্যাপ্টিজম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়, ব্যাখ্যা করলো টিসে। উৎসব চলার সময় নদীতে গিয়ে কিছু ধর্মীয় আচার অনুশীলন করা হবে, সমস্ত পাপ ধুয়ে-মুছে পবিত্রকরণের পর ব্যাপ্টিজমে দীক্ষা দেওয়া হবে তরুণ উপাসকদের, ঠিক যেভাবে ব্যাপ্টিস্টের হাতে দীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং যিশু।

খাড়া পাহাড় প্রাচীরের অবয়ব বেয়ে নেমে গেছে সিঁড়ির ধাপ, আবার ওরা সেটা ধরে নামতে শুরু করলো। শত শত বছর ধরে নগ্ন পা ফেলায় প্রতিটি ধাপ মসৃণ ডিশ-এ পরিণত হয়েছে। ওদের কয়েকশো ফুট নিচে নীল নদ হিসহিস আওয়াজ তুলে টগবগ করে ফুটছে, চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিপুল জলকণা।

হঠাৎ করেই চওড়া একটা চাতালে বেরিয়ে এলো ওরা, কঠিন পাথর কেটে মানুষই এটা তৈরি করেছে। মাথার উপর লাল পাথর ঝুলে আছে, তোরণশোভিত উদ্যানের উপর ছাদ হিসেবে কাজ করছে; খিলান আকৃতির পাথরের তোরণগুলো প্রাচীন মিস্ত্রীরা ছাদের অবলম্বন হিসেবে তৈরি করেছিল। ঢাকা ও লম্বা চাতালের ভেতর দিকের দেয়ালে অসংখ্য প্রবেশপথ, সামনের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড় প্রাচীরের গা কেটে অসংখ্য হল, সেল, চেম্বার, চার্চ ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। নির্জনতা প্রিয় সন্ন্যাসীরা এখানে বসবাস করছেন হাজার বছরেরও বেশি দিন ধরে।

চাতালের দৈর্ঘ্য জুড়ে দলে দলে ভাগ হয়ে বসে আছেন সন্ন্যাসীরা একদিকে কিছু সন্ন্যাসী যাজকের ধর্মশাস্ত্র পাঠ শুনছেন।

এদের মধ্যে বেশিরভাগই নিরক্ষর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিসে বলে। এমন কী বাইবেল পর্যন্ত পড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়!

এই হলো চার্চ অব কনস্ট্যানটিন, বাইজেন্টিয়াম সময়ের, নিকোলাস হাত উঁচু করে দেখায়। বাগানের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আরেক দল সন্ন্যাসীকে দেখা গেল, সুর করে ধর্মীয় সঙ্গীত গাইছেন, অ্যামহ্যারিক ভাষায় লেখা। নানা গন্ধে ভারি হয়ে আছে বাতাস। জ্বালানি কাঠ আর ধূপের ধোঁয়া তো আছেই, আরো আছে ঘাম গরম নিঃশ্বাস, শোক, অসুস্থতার গন্ধ। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে বসে রয়েছে তীর্থে আসার সাধারণ মানুষ। দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা, অনেককেই অসুস্থ আত্মীয়-স্বজনকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। সেইন্টের কাছে অনেক কিছু চাওয়ার আছে তাদের। কেউ তার ভোগান্তির অবসান চায়, কেউ ফিরে পেতে চায় সুস্থতা, আবার কেউ এসেছে পাপের শাস্তি মওকুফ করার আবেদন নিয়ে।

মায়ের কোলে অনেক অন্ধ ছেলেকে দেখা গেল। হাড় থেকে মাংস খসে পড়ছে এমন রোগীর সংখ্যাও কম নয়। তাদের আহাজারি ও গোঙানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সন্ন্যাসীদের সুর করে গাওয়া প্রার্থনা সঙ্গীত আরো মিশছে প্রকাণ্ড কড়াইয়ের নিচ থেকে ভেসে আসা নীলনদের ফোঁসফোসানি।

এক সময় ওরা সেন্ট ফুমেনটিয়াস ক্যাথেড্রালের প্রবেশমুখে এসে পৌঁছালো। মাছের হাঁ করা মুখের মতো গোল একটা ফাঁক, তবে দরজার চারদিকের গায়ে চওড়া বর্ডারের উপর আঁকা হয়েছে নক্ষত্র, ক্রসচিহ্ন ও সেইন্টদের মাথা।

প্রবেশপথে সবুজ ভেলভেটের আলখেল্লা পরা একজন যাজক পাহারায় দাঁড়িয়ে আছেন। টিসে তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন তিনি। চওড়া হলেও, দরজাটা নিচু, ঢোকার সময় মাথা নিচু করতে হলো নিকোলাসকে। ভেতরে ঢোকার পর মাথা উঁচু করে চারদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল।

বিশাল গুহার ভেতর ছাদ এতো উপরে যে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। পাথুরে দেয়াল। দেয়ালচিত্রে ঢাকা, ডানাবিশিষ্ট পরী আর দেব-দেবীদের ছবি আঁকা হয়েছে, মোমবাতি আর ল্যাম্পের কাঁপা কাঁপা আলো পড়ায় যেনো মনে হলো নড়াচড়া করছে। ছবিগুলো আংশিক ঢাকা পড়েছে পাঁচিলের উপর কারুকাজ করা লম্বা ব্যানার বা পর্দা ঝুলে থাকায়, কিনারার ঝালর জট পাকিয়ে গেছে, ছিঁড়েও গেছে কোথাও কোথাও। এরকম একটা ব্যানারে সেইন্ট মাইকেলকে দেখা যাচ্ছে, সাদা একটা ঘোড়া ছোটাচ্ছেন তিনি। আরেকটায় দেখা গেল ক্রস-এর পাদদেশে হাঁটু গেড়ে রয়েছেন ভার্জিন, তার উপরে যিশুর স্নান শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে, পাঁজরে গাঁধা রোমান বর্শা।

গির্জার এটা বাইরের অংশ।.দূর প্রান্তের দেয়ালে মিডল চেম্বারে ঢোকার দরজা। দরজা আসলে একজোড়া খোলাই রয়েছে। পাথরের মেঝে ধরে হেঁটে এলো ওরা তিনজন, হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত তীর্থযাত্রীদের পাশ কাটিয়ে। সবাই তারা হয় গান গাইছে, নয়তো কান্নাকাটি করছে, অনেককেই দেখা গেল যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। ধূপ-ধুনোর নীলচে ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হয়ে আছে জায়গাটা।

তিনটি ধাপ পেরিয়ে ভেতরের দরজাগুলোর সামনে পৌঁছতে হয়, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আলখেল্লা পরা দু জন দীর্ঘদেহী যাজক, মাথায় লম্বা হেট, হেঁটের মাথা সমতল। তাঁদের একজন রাগের সঙ্গে কী যেনো বললেন টিসেকে।

ওরা এমন কি কিড়ি বা মিডল চেম্বারেও ঢুকতে দেবেন না, জানালো টিসে। ওই চেম্বারের সামনে মাকডাস–হোলি অব হোলিস।

উঁকি দিয়ে প্রহরী যাজকদের পেছনে তাকালো ওরা, মিডল চেম্বারের ভেতর দিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ পবিত্র স্থানটার দরজাই শুধু দেখা গেল।

মাকডাসে শুধু ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা ঢুকতে পারেন কারণ, ওখানে ট্যাবট আছে, আর আছে সেইন্টের সমাধিতে ঢোকার দরজা।

মন খারাপ করে, গুহা থেকে বেরিয়ে চাতাল ধরে নেমে এলো ওরা।

*

তারা ভরা আকাশের নিচে বসে রাতের খাবার খেলো দলটা। বাতাসে এখনো দম আটকানো গরম। নাগালের ঠিক বাইরে মেঘের মতো ঝুলে আছে ঝক ঝক মশা। কাপড়ের বাইরে চামড়ায় রিপেলন্ট মেখেছে ওরা, তা না হলে রক্ষা ছিল না।

এবার বলুন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যেখানে আসতে চেয়েছিলেন সেখানে আপনাকে আমি পৌঁছে দিয়েছি। অত দূর থেকে যে প্রাণীর সন্ধানে এলেন, বলুন সেটা কোথায় খুঁজবেন।

ভোরে ট্র্যাকারদের ভাটির দিকে পাঠাবেন, জবাব দিল নিকোলাস। সব ডিক-ডিকের পায়ের ছাপ একই রকম বলে আমার ধারণা। ছাপ চোখে পড়লে কাছাকাছি লুকিয়ে থাকতে হবে। ডিক-ডিক নিজেদের এলাকা ছেড়ে কোথাও যায় না। অপেক্ষা করলে দেখতে পাবে। আর দেখতে পেলে আমাকে খবর দেবে।

মায়ের কাছে মাসির গপ্পো–আমাকে শেখায়, কী করতে হবে! একটা গ্লাসে ভদকা ঢেলে নেয় বোরিস।

ঠিক আছে, ট্র্যাকারদের পাঠালাম। কিন্তু আপনি কী করবেন? মেয়েদের নিয়ে ক্যাম্পে থাকবেন? তির্যক দৃষ্টি হেনে হাসলো বোরিস। মেয়েরা আপনার সেবা-যত্ন করলে আমার কোনো আপত্তি নেই।

চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়ালো টিসে, রান্নাবান্নার তদারক করার কথা বলে কিচেনের দিকে চলে গেল। বোরিসের ইঙ্গিতটা গায়ে মাখল না নিকোলাস। বলল, ডানডেরার পাশে ঝোঁপের ভেতর কাজ করব আমরা। ওদিকে ডিক-ডিক থাকতে পারে। আপনার লোকদের নদীর ওদিকে যেতে নিষেধ করে দেবেন। আমি চাই না শিকারের সময় কেউ ডিসটার্ব করুক।

পরদিন ভোরের আলো ভালো করে ফোঁটার আগেই ক্যাম্প ত্যাগ করলো ওরা, সঙ্গে রাইফেল ও হালকা খাবার নিয়েছে। ডানডেরার পাশে এসে ঝোঁপের ভেতর দিয়ে হাঁটছে নিকোলাস, পেছনে রোয়েন। কয়েক পা এগিয়ে একবার করে থামলো, কান পেতে শুনছে। ডালে ডালে প্রচুর পাখি; ঝোঁপের ভেতর খুদে প্রাণীদের সংখ্যাও কম নয়। ইথিওপিয়ানরা শিকারে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, বলল নিকোলাস। আর খাদের ভেতর সন্ন্যাসীরাও বোধহয় অভ্যস্ত নয়, বলল নিকোলাস। তারাও বোধহয় ওয়াইল্ডলাইফকে বিরক্ত করে না। হাত তুলে হরিণের পায়ের ছাপ দেখালো। এগুলো বুশবাকের ছাপ। ট্রফি হিসেবে সাংঘাতিক লোভনীয়।

আপনি কি সত্যি সত্যি ডোরাকাটা ডিক-ডিক পাবেন বলে আশা করেন?

আরে না। নিকোলাস হাসে। মনে হয়, বুড়ো দাদা ডিক-ডিকের গপ্পোটা বানিয়ে বলেছিল। আমরা, হারপার পরিবার মাঝে মধ্যে সত্যের অপলাপ করি বৈকি।

উঁচু গাছের ডালে একটা সানবার্ডকে বসে থাকতে দেখলো ওরা, পালকগুলো পান্না বসানো টায়রার মতো ঝলমল করছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনটা দেখে নিল নিকোলাস, তারপর পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়িতে বসে রোয়েনকেও বসতে ইঙ্গিত করলো। ডিক-ডিক খোঁজার অজুহাতে সবার চোখের আড়ালে এভাবেই পালিয়ে আসতে হবে। এখন বলুন, আসলে ঠিক কী খুঁজব আমরা।

একটা সমাধির অবশিষ্ট, কিংবা কোনো গোরস্থানের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে ফারাও মামোসের সমাধি তৈরি করার সময় শ্রমিকরা বসবাস করত।

ইট বা পাথরের যে কোনো কাজ, সায় দিল নিকোলাস। বিশেষ করে স্তম্ভ বা মনুমেন্ট।

টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট। মাথা ঝাঁকালো রোয়েন। গায়ে হায়ারোগ্লিফিকস খোদাই করা থাকবে। হয়তো রোদ-বৃষ্টিতে ম্লান হয়ে গেছে, খসে পড়েছে, কিংবা ঢাকা পড়েছে ঝোঁপের ভেতর আমি জানি না।

এখানে আমরা বসে আছি কেন? চলুন মাছ ধরি।

বেলা এগারোটার দিকে নদী তীরে একটা ডিক-ডিকের ছাপ দেখলো নিকোলাস। বড় একটা গাছের বেরিয়ে থাকা শিকড়ের তলায় লুকাল ওরা, নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পর খুদে প্রাণীগুলোর একটাকে দুএক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেল। ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল সেটা, গাছের গুঁড়ির মতো গুঁড়টা নাড়ছে, মানবশিশুর টলমল করা পায়ের মতো খুব ফেলছে জমিনে, নিচু একটা ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ল, ব্যস্তভাবে চিবাল। তবে গায়ের ইউনিফর্মটা ধূসর, কোনো রকম দাগ নেই।

ওটা অদৃশ্য হতে উঠে দাঁড়ালো নিকোলাস। বিস্ময়কর কিছু নয়, বিড়বিড় করলো। চলুন অন্যদিকে যাই।

দুপুরের খানিক পর এমন একটা জায়গায় পৌঁছল ওরা, পাহাড় প্রাচীরের রঙ যেখানে গোলাপি-লালচে মাংসের মতো। এরকম একজোড়া প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে গহ্বরের ভেতর বেরিয়ে এসেছে নদী। জায়গাটা যতদূর সম্ভব পরীক্ষা করলো ওরা, তারপর বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। পাথর এখানে সোজা নেমে এসেছে পানিতে, পানির কিনারায় এমন একটা গর্ত নেই যেখানে পা রাখা যায়।

ভাটির দিকে ফিরে এলো ওরা, আদ্যিকালের একটা ঝুলন্ত ব্রিজ ধরে নদী পেরুল। শুকনো লতানো গাছ আর শণ দিয়ে ব্রিজটা সম্ভবত সন্ন্যাসীরাই বানিয়েছেন। এপারে এসেও আরেকবার গহ্বরের ভেতর দিয়ে এগোবার চেষ্টা করলো ওরা। লালচে-গোলাপি পাঁচিল পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে এড়িয়ে এগুতে চেষ্টা করায় দেখা গেল স্রোত এতো জোরালো যে নিকোলাসকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হলো ওকে।

আমরা যখন এগুতে পারছি না, ধরে নিতে হবে টাইটাও পারে নি।

ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে ফিরে এসে একটা ছায়া খুঁজে নিল ওরা, ওখানে বসে লাঞ্চ খেলো। গরমে সেদ্ধ হবার অবস্থা। নদীর পানিতে রুমাল ভিজিয়ে মুখ মুছলো রোয়েন। চিৎ হয়ে শুয়ে লালচে-গোলাপি প্রাচীর দেখছে নিকোলাস, চোখে আঁটা বাইনোকুলার। মসৃণ চকচকে সারফেসে কোনো ফাটল আছে কিনা খুঁজছে। চোখ থেকে বাইনোকুলার না নামিয়েই কথা বলছে ও। রিভার গড পড়ে জানা যায়, মিশরের সাহসী সিংহ অর্থাৎ ট্যানাস আর ফারাও-এর লাশ অদলবদল করার জন্য লোকজনের সাহায্য নিতে হয়েছিল টাইটাকে। বাইনোকুলার সরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো। ব্যাপারটা আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। কারণ ওই যুগে মানুষ এ ধরনের কাজ করতে ভয় পেত। ভাবছি, স্ক্রোলের অনুবাদে কোনো ভুল হয় নি তো? টাইটা কি সত্যি লাশ বদলাবদলি করেছিল?

হেসে উঠে নিকোলাসের দিকে কাত হলো রোয়েন। আপনার প্রিয় লেখক উইলবার স্মিথ এখানে কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। গল্পের এ অংশটুকু তিনি একটা মাত্র বাক্যের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন। বাক্যটি হলো, আমার কাছে সে ছিল যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে মহান নেতা। আবার চিৎ হলো রোয়েন। সেজন্যই বইটার এতো সমালোচনা করি। আমি যতটুকু জানি বা বিশ্বাস করি, ট্যানাস তাঁর নিজের সমাধিতে আছেন, তেমনি ফারাও-ও আছেন নিজের সমাধিতে।

দুত্তোর! হতাশ গলায় নিকোলাস বলে। ওই রোমান্টিক অংশটা সত্যি আমার খুব প্রিয় ছিল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, চলুন, উপত্যকার বাকি অংশেও একটু খুঁজে দেখতে চাই। গতকাল বেশ চমৎকার একটা জায়গা দেখলাম।

শেষ বিকেলের দিকে ক্যাম্পে ফিরল ওরা। কিচেন থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালো টিসে। হাঁপাচ্ছে সে। কখন ফিরবেন তার অপেক্ষায় ছিলাম। জালি হোরা তিমকাতে উৎসবে দাওয়াত দিয়েছেন আমাদের। ওইজিরো রোয়েন তাঁর প্রধান অতিথি। গরম পানি রাখা আছে, এখুনি গোসল করে তৈরি হয়ে নিন। তা না হলে মঠে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।

*

ভোজের কক্ষে ওদেরকে নিয়ে যাবার জন্য প্রধান পুরোহিত একদল তরুণ উপাসককে পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা এলো গোধূলি পার করে, প্রত্যেকের হাতে একটা করে জ্বলন্ত মশাল। তাদের মধ্যে তামেরও আছে, প্রথমে চিনতে পারলো রোয়েন। তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিতে লজ্জায় জড়সড় ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো সে, নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে আনা বুনো ফুলের একটা গোছা বাড়িয়ে ধরল রোয়েনের দিকে। প্রস্তুত ছিল না রোয়েন, কিছু না ভেবেই আরবিতে ধন্যবাদ দিল তাকে। 

শুকরান!

তাফাদ্দালি! 

রোয়েনকে অবাক করে দিয়ে তামেরও পাল্টা ধন্যবাদ জানালো ওই আরবিতেই। 

তুমি এতো ভালো আরবি বলো কী করে? রোয়েন জানতে চায়। আমার মা লোহিত সাগরের ওদিক থেকে এসেছে। আরবি আমার মায়ের ভাষা। 

মঠের উদ্দেশে ওরা যখন রওনা হলো, ভক্ত কুকুরছানার মতো রোয়েনের পিছু নিল তামের। 

পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে আরেকবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো ওরা, বেরিয়ে এলো জ্বলন্ত মশাল ঘেরা চাতালে। গাছপালায় ছাওয়া সরু উদ্যান-পথ লোকজনে ঠাসা, ভিড় সরিয়ে ওদের জন্য পথ তৈরি করলো তরুণ উপাসকরা। তীর্থযাত্রীরা কি ভাবল কে জানে, অ্যামহ্যারিক ভাষায় স্বাগত জানালো ওদেরকে, হাত লম্বা করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। 

নিচু প্রবেশপথ পেরিয়ে গির্জার বাইরের অংশে পৌঁছল ওরা। আজো মনে হলো মশাল আর ল্যাম্পের অনিশ্চিত আলোয় দেয়ালচিত্রের চরিত্রগুলো নাচছে। মেঝেতে নলখাগড়া দিয়ে তৈরি কার্পেট ফেলা হয়েছে, পায়ের উপর পা তুলে তাতে বসে আছেন সন্ন্যাসীরা, মনে হলো সবাই তারা এখানে উপস্থিত। গলা চড়িয়ে তারাও ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। বসা সন্ন্যাসীদের প্রত্যেকের পাশে একটা করে বোতল, তাতে মধু মিশিয়ে তৈরি করা স্থানীয় মদ তেজ। হাসিখুশি সন্ন্যাসীদের চকচকে চেহারা দেখে বোঝা যায়, এরই মধ্যে ভালো সার্ভিস দিয়েছে বোতলগুলো। 

নিকোলাসের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করলো টিসে, আমি চেখে দেখবো, তারপর আপনি খাবেন। স্থান বিশেষে এ মদের রঙ, স্বাদ ও শক্তি বদলে যায়। বড় গামলা বা পিপে থেকে পরিবেশন করা হচ্ছে, একেকটার ধরন একেকরকম। নিজের বোতল থেকে সরাসরি পান করলো সে। এটা ভালোই। বেশি না খেলে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। 

ওদের চারপাশে বসা সন্ন্যাসীরা পান করা জন্য সাধাসাধি করছে, বাধ্য হয়েই নিজের বোতলটা ধরতে হলো নিকোলাসকে। হালকা ও মিষ্টি একটা স্বাদ পেল ও, মধুর পরিমাণ খুব বেশি বলেই হয়তো মদ বলে মনে হলো না। ভালোই তো! 

কিন্তু সাবধান, বলল টিসে। তেজের পর নিশ্চয়ই ওরা আপনাকে কাটিকালা সাধবে। কাটিকালা চোলাই করা কড়া মদ, খেলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না, ওটা আপনার ঘাড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলবে। 

সন্ন্যাসীরা এবার রোয়েনের যত্ন-আত্তির দিকে নজর দিয়েছেন। ও যে কপটিক খ্রিস্টান, এটা তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। সন্দেহ নেই, ওর রূপ-যৌবনও পবিত্র ও 

সংযমী চিরকুমারদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়েছে কিছুটা। 

রোয়েনের কানে কানে নিকোলাস বলল, বোতলটা ঠোঁটে তুলে ভান করুন খাচ্ছেন। তা না হলে ওঁরা আপনাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। 

রোয়েন বোতলটা মুখের সামনে তুলতেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন সন্ন্যাসীরা। বোতল নামিয়ে নিকোলাসকে রোয়েন বলল, স্বাদটা তো দারুণ। মদ কোথায়, এতো মধু। 

মদ না খাবার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেললেন? হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। 

মাত্র এক ফোঁটা, স্বীকার করলো রোয়েন। তাছাড়া কে বলল আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম খাব না? 

অতিথিদের সামনে গরম পানি ভর্তি একটা করে পাত্র রাখা হলো, হাত ধোয়ার জন্য। ভোজন পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। হঠাৎ ড্রামের শব্দ শোনা গেল, তারপর ভেসে এলো নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। কিড্ডির খোলা দরজা ভরাট করে তুললো বাদ্যযন্ত্রীদের একটা দল। চেম্বারের একদিকের দেয়াল ঘেঁষে আসন গ্রহণ করলো তারা। 

অবশেষে প্রাচীন প্রধান পুরোহিত জালি হোরা ধাপের মাথায় উদয় হলেন। রক্তলাল সাটিনের লম্বা আলখেল্লা পরে আছেন, দুই কাঁধে সোনালি সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারির কাজ করা। মাথায় পরেছেন প্রকাণ্ড এক মুকুট। সোনার মতো চকচক করলেও নিকোলাস জানে ওটা আসলে পালিশ করা পিতল, আর বহুরঙা পাথরগুলো কাঁচ। 

হাতের দণ্ড উঁচু করলেন প্রধান যাজক, সেটার মাথায় রুপোর কাজ করা ক্রস। সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে বিশাল গুহার ভেতর অটুট নিস্তব্ধতা নেমে এলো। 

দীর্ঘ সময় নিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন জালি হোরা। প্রার্থনা শেষ হতে দু জন তরুণ উপাসক ধাপের নিচে নামতে সাহায্য করলো তাঁকে। বয়োবৃদ্ধ পুরোহিতরা হৃৎপিণ্ড আকৃতির একটা বৃত্ত রচনা করে বসেছেন, সেই বৃত্তের মাথায় তিনি তাঁর প্রাচীন জিম্মেরা চৌকিতে বসলেন। এরপর চাতাল থেকে মিছিল নিয়ে ভেতরে ঢুকলো তরুণ উপাসকরা, প্রত্যেকের মাথায় নলখাগড়ার তৈরি ঝুড়ি, আকারে গরুর গাড়ির চাকার মতো। অতিথিদের প্রতিটি বৃত্তের সামনে একটা করে নামিয়ে রাখা হলো। 

প্রধান যাজকের সঙ্কেত পেয়ে সব কয়টা ঝুড়ির ঢাকনি একযোগে ভোলা হলো। আনন্দে হৈ-চৈ করে উঠলেন সন্ন্যাসীরা। প্রতিটি ঝুড়িতে একটা করে পিতলের গামলা রয়েছে, হাতে বেলা গোল ময়দার ইনজেরা রুটি, গভীর গামলার কিনারা পর্যন্ত ভরাট হয়ে আছে। আরো একদল উপাসক ঢুকলো, ভারি পিতলের গামলা বয়ে আনতে বারোটা বাজছে তাদের, টলমল করছে পা। মরিচ আর এলাচের গন্ধে ভারী হয়ে উঠলো বাতাস। এ গামলাগুলো থেকে ধোয়া উঠছে, ভেতরে রান্না করা খাসীর মাংস। 

পুরোহিত আর সন্ন্যাসীরা রুটি ও মাংসের উপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, দেখে মনে হলো হিংস্র কোনো প্রাণী শত্রু নিধনে মেতে উঠেছে। আহার পর্ব মাত্র শুরু হয়েছে, উপাসকরা পরিবেশন করলো ড্রাম ভর্তি তেজ। খাবে কি, হাঁ করে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। পুরোহিত ও সন্ন্যাসীরা মুখ খোলার পর তা আর বন্ধ করছে না, এক হাতে যতটুকু ধরে ভেতরে ভরছে মাংস আর রুটি, না চিবিয়ে ঢক ঢক করে তেজ ঢেলে নামিয়ে দিচ্ছে গলা দিয়ে, এভাবে বিরতিহীন চালিয়ে যাচ্ছে। মাংসের গামলা খালি হয়ে আসায় নিকোলাস ভাবল এবার বোধহয় নোংরা দৃশ্যটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, তরুণ উপাসকরা এরপর নিয়ে এলো আস্ত মুরগির রোস্ট। 

নিকোলাস নির্দেশে কিছুই না খেয়ে রোয়েন ভান করছিল প্রচুর খাচ্ছে, হঠাৎ ম্লান গলায় বলল, আমার অসুস্থ লাগছে।

চোখ বন্ধ করে ইংল্যান্ডের কথা ভাবুন, পরামর্শ দিল নিকোলাস। এ উৎসবের আপনিই স্টার। ওরা আপনাকে পালাতে দেবে না। 

তারপর শুরু হলো চিৎকার, কাটিকালা! কাটিকালা! পুরোহিত বা সন্ন্যাসী, কেউ থামছেন না। উপাসকরা ছুটে বেরিয়ে গেল চাতালে, খানিক পর ফিরে এলো ডজন ডজন বোতল আর চায়ের কাপ নিয়ে। স্থানীয় লোকজনকে অবজ্ঞা যতোই করুক, খাওয়া-দাওয়া শুরু হওয়ার পর দেখা গেল খাদ্যগ্রহণের প্রতিযোগিতায় পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের সঙ্গে জোর পাল্লা দিচ্ছে বোরিস। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতায় সে-ই জিতছে বলে মনে হলো। ওরা দেখলো তরুণ উপাসকরা তার পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিচ্ছে। কাটিকালা আসার পর দেখা গেল, চোখের পলক না ফেলে বোতলের পর বোতল খালি করে ফেলছে বোরিস। 

তারপর এক সময় প্রধান পুরোহিতের চোখে নিকোলাস আর রোয়েনের ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে গেল। তেজ আর কাটিকালা খেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তিনি, দাঁড়াবার পর টলছেন, এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে আসছেন সরাসরি রোয়েনের দিকে, হাতে মাংস ভরা বিশাল এক রুটি টকটকে লাল ঝোল ঝরছে তা থেকে। 

তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ভয়ে কুঁকড়ে গেল রোয়েন। উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিকোলাসের বাহু খামছে ধরল রোয়েন। না! প্লিজ, না। বাঁচান আমাকে, নিকোলাস। আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, প্লিজ… 

প্রধান অতিথি হওয়ার মাসুল দিতে হবে না? হাসলো নিকোলাস।

নাটকীয় আবহ তৈরি হলো। হঠাৎ করে ব্যান্ড পার্টির সদস্যরা একযোগে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করায়। পবিত্র উপহার হাতে নিয়ে রোয়েনের সামনে হাজির হলেন মোহন্ত। উপস্থিত পুরোহিত আর সন্ন্যাসীরা রুদ্ধদ্বাসে অপেক্ষা করছেন। নিয়তির অমোঘ বিধান কী করে এড়ায় রোয়েন, অগত্যা চোখ বুজে হাঁ করতে হলো ওকে। 

উৎসাহদায়ক গর্জন, করতালি ও বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত ঐকতানের মধ্যে প্রাণপণে চিবিয়ে যাচ্ছে রোয়েন। ওর মুখ গোলাপি হয়ে উঠলো, চোখ বেয়ে দর দর করে পানি ঝরছে। এক পর্যায়ে নিকোলাসের মনে হলো পরাজয় মেনে নিয়ে সবটুকু উগরে দেবে ও। তবে না, ধীরে ধীরে, সাহসের সঙ্গে, প্রতিবার একটু একটু করে, গিলে ফেললো মুখের খাবার। তারপর নেতিয়ে পড়লো। 

দর্শকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো, তাদের উল্লাসধ্বনিতে কান পাতা দায়। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ওর সামনে নিচু হলেন মোহন্ত, হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ঝুঁকলেন, আলিঙ্গন করলেন ওকে। তারপর আলিঙ্গন ঢিলে না করেই রোয়েনের পাশে নিজের জন্য জায়গা করে নিলেন তিনি। খেয়াল নেই, মাথার মুকুট পাশে গড়াচ্ছে। 

মনে হচ্ছে আপনি ওঁর হৃদয় জয় করেছেন, শুকনো গলায় বলল নিকোলাস। আমার ভয় করছে, দৌড়ে না পালিয়ে যে কোনো মুহূর্তে উনি আপনার কোলে চড়ে বসতে পারেন। 

দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো রোয়েনের। খপ করে কাটিকালার একটা বোতল তুলে নিয়ে মোহন্তের ঠোঁটে ঠেকালো। পান করুন! চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন জালি হোরা, তবে ওর হাত থেকে পান করার জন্য ওকে তাঁর ছেড়ে দিতে হলো। বোতল থেকে সরাসরি খানিকটা কাটিকালা পান করে ইঙ্গিত করলেন জালি হোরা, অর্থাৎ তিনি রোয়েনের হাত থেকে রুটি মাংস খেতে চাইছেন। 

রোয়েন ইতস্তত করছে দেখে নিকোলাস বলল, বুড়োকে খুশি রাখতে পারলে ভবিষ্যতে কিছু সুবিধে পাওয়া যেতে পারে। 

রুটি আর মাংস হাতে নিয়ে তাঁকে খাওয়াতে যাবে রোয়েন, হঠাৎ এমন চমকে উঠল যে হাতের রুটির-মাংস জালি হোরার কোলের উপর পড়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে রোয়েন, যেনো প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত; তাকিয়ে আছে পাশে পড়ে থাকা মুকুটটার দিকে।

কী হলো? দ্রুত জানতে চাইলো নিকোলাস, তবে গলাটা চড়তে দেয় নি। হাত বাড়িয়ে রোয়েনের বাহু ধরে ফেললো। উপস্থিত কেউই ওর চমকে ওঠা লক্ষ্য করে নি। অপর হাতে বোতল ছেড়ে দিয়ে রোয়েনও নিকোলাসের বাহু খামচে ধরল, ওর আঙুলের শক্তি অনুভব করে বিস্মিত হলো নিকোলাস। শার্ট ভেদ করে ওর নখ চামড়া ছিঁড়ে ফেলছে। মুকুটটা দেখুন! ফিসফিস করলো রোয়েন, হাঁপাতে শুরু করেছে। পাথরটা। নীল পাথরটা! 

কাচ ও স্ফটিকের পাথরগুলো সস্তাদরের, তবে ওগুলোর সঙ্গে মুকুটে অল্পদামী কিছু পাথরও আছে। একটা পাথর নীল, আকারে সিলভার ডলারের মতো, আসলে নীল সিরামিকের তৈরি সীল, পুরোপুরি গোল, তাপ দিয়ে কঠিন করা হয়েছে। চাকতির মাঝখানে একটা মিশরীয় রথ খোদাই করা ঘোড়া টানা রথ, সামরিক শকট। রথের উপর খোদাই করা হয়েছে ডানা ভাঙা বাজপাখি। চাকতির বৃত্তাকার কিনারা জুড়ে হায়ারোগ্লিফিক্স-এ লেখা হয়েছে দুটো বাক্য, পড়তে মাত্র কয়েক মুহূর্ত লাগলো নিকোলাসের, 

আমি দশ হাজার রথের নেতৃত্ব দিই।
আমি টাইটা, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক। 

এখান থেকে এ মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচে রোয়েন। খাবার, তেজ আর ঘামের গন্ধে বমি পাচ্ছে ওর। ইতোমধ্যেই অনেক সন্ন্যাসী ঢলে পরেছে নিজ নিজ স্থানে। 

কিন্তু এখনো মোহন্তের মূল আকর্ষণ ওর ওপর। অ্যামহারিক ভাষায় অনর্গল বলে যাচ্ছে, রোয়েনের খোলা হাতে চাপড় দিচ্ছে থেকে থেকে। এখন আর তার বক্তব্য অনুবাদ করে শোনাচ্ছে না টিসে। সাহায্যের আশায় নিকোলাসের উদ্দেশ্যে তাকালো রোয়েন; কিন্তু সেও মনে হচ্ছে ধ্যানমগ্ন। সম্ভবত, মুকুটটার কথাই ভাবছে। 

চোখ ইশারায় বার্তা বিনিময় হলো, কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা চলবে না। ব্যাপারটা নিয়ে এখুনি আলোচনা করা দরকার, কিন্তু এখান থেকে পালাবে কীভাবে? এ সময় ওদেরকে সাহায্য করলো বোরিস, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো মাতালটা, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়লো। টলতে টলতে এগিয়ে এলো টিসে, সে-ও মাতাল হতে চলেছে, নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো, অল্টো নিকোলাস, এখন আমি কী করব? 

কথা না বলে দাঁড়ালো নিকোলাস, এগিয়ে এসে বোরিসকে কাঁধে তুলে নিল। পালাবার এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ! বলল ও, যদিও পুরোহিত বা সন্ন্যাসীদের মধ্যে সাড়া দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। চাতালে বেরিয়ে এলো নিকোলাস, ওর পিছু নিয়ে মেয়ে দু জনও। কোথাও না থেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ওরা। 

আমার ধারণা ছিল না অল্টো নিকোলাসের শরীরে এতো শক্তি! হাঁপাচ্ছে টিসে, কারণ ধাপগুলো খুব উঁচু আর সিঁড়িটাও খুব লম্বা। 

আমারও তো ধারণা ছিল না, বলল রোয়েন, নিজেও বলতে পারবে না কথার সুরে কী কারণে গর্ব প্রকাশ পেল। ছেলেমানুষি কোরো না, নিজেকে চোখ রাঙাল, তোমার কেউ হয় না ও! 

কুঁড়েঘরে ঢুকে বোরিসকে তার বিছানায় ছুঁড়ে দিল নিকোলাস, হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে, ঘামছে দরদর করে। তার কাছে টিসেকে রেখে রোয়েনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলও। 

আপনি দেখেছেন…? উত্তেজিত গলায় শুরু করলো রোয়েন, তবে ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দিল নিকোলাস। রোয়েনের ঘরে চলে এলো ওরা। দেখেছেন আপনি? আবার জানতে চাইলো রোয়েন। পড়তে পেরেছেন? 

আমি দশ হাজার রথের নেতৃত্ব দিই, বলল নিকোলাস। 

আমি টাইটা, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক, বাকিটুকু পূরণ করলো রোয়েন। সে এখানে এসেছিল! ওহ্ নিকোলাস! টাইটা এখানে এসেছিল। এ প্রমাণটাই খুঁজছিলাম আমরা। এখন আমরা জানি অযথা সময় নষ্ট করছি না! নিজের বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। আপনার কী ধারণা, প্রধান পুরোহিত সীলটা পরীক্ষা করতে দেবেন?

মাথা নাড়লো নিকোলাস। মনে হয় না। মুকুটটা মঠের মূল্যবান ধর্মীয় সম্পদ। আপনাকে তার খুব ভালো লাগলেও, দেখতে দেবেন বলে মনে হয় না। তবে, বেশি আগ্রহ দেখানো চলবে না। ওটার তাৎপর্য সম্পর্কে জালি হোরার কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া, আমরা চাই না বোরিস কিছু টের পাক। 

ঠিক বলছেন। সরে গিয়ে বিছানায় নিজের পাশে জায়গা করলো রোয়েন। বসুন এখানে। 

বসলো নিকোলাস। 

রোয়েন জানতে চাইলো, বলুন, সীলটা কোত্থেকে এল? কে পেয়েছিল? কবে, কোথায়? 

ধীরে, সুন্দরী, ধীরে। একের ভেতর চারটে প্রশ্ন, কোনটারই উত্তর আমার জানা নেই। 

কল্পনা করুন! তাগাদা দিল রোয়েন। আঁচ করুন। আইডিয়ান দিন। 

বেশ, রাজি হলো নিকোলাস। সীলটা তৈরি করা হয়েছে হঙকঙে। ওখানে ছোট্ট একটা কারখানা আছে, হাজারে হাজারে তৈরি করা হয়। মিশরে বেড়াতে গিয়ে জালি হোরা একটা কিনে এনেছেন? 

নিকোলাসের বাহুতে চিমটি কাটল রোয়েন, জোরে। সিরিয়াস হোন? চোখ রাঙিয়ে নির্দেশ দিল। 

আমার চেয়ে ভালো আইডিয়া থাকলে শোনান, বাহুটা অপর হাতে ডলছে নিকোলাস। 

বেশ, আমি বলি। ফারাও-এর সমাধি নির্মাণের কাজ চলছে, এ-সময় সীলটা এখানে খাদের ভেতর পড়ে যায় টাইটার হাত থেকে। তিন হাজার বছর পর বুড়ো এক সন্ন্যাসী, মঠে যারা প্রথম বসবাস করতে আসে তাদের একজন, এটা কুড়িয়ে পান। না, হায়ারোগ্লিফিক্স পড়তে পারেন নি। সীলটা তিনি তখনকার প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যান, প্রধান পুরোহিত ওটাকে সেন্ট ফুমেনটিয়াস-এর একটা অলঙ্কার বলে ঘোষণা করেন, এবং সেট করেন মুকুটে। 

তারপর সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগলো-আইডিয়াটা মন্দ নয়, বলল নিকোলাস।

আপনি কোনো ফুটো দেখতে পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, উত্তরে মাথা নাড়লো নিকোলাস। তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে টাইটা সত্যিসত্যি এখানে ছিল এবং তাতে প্রমাণ হয় আমাদের থিওরি মিথ্যে নয়? 

প্রমাণ খুব কঠিন শব্দ। আসুন বলি, সব মিলিয়ে ওদিকটাই নির্দেশ করছে। 

বিছানার উপর শরীরটা মুচড়ে পুরোপুরি নিকোলাসের দিকে ফিরলো রোয়েন। ওহ্, নিকোলাস, উত্তেজনায় কাঁপছি আমি! যিশুর কিরে, আজ রাতে আমি এক মিনিটও ঘুমাতে পারব না। এই, আমরা আবার সার্চ শুরু করব কখন? 

রোয়েনের চোখ জোড়া উত্তেজনায় চকচক করছে, রক্তিম মুখে গোলাপি আভা। ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট দুটো, ভেতরে লালচে জিভের ডগা দেখতে পাচ্ছে। নিকোলাস। এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না ও। ধীরে ধীরে রোয়েনের দিকে ঝুঁকলো, ইচ্ছে করেই, এড়িয়ে যেতে চাইলে যাতে সুযোগ পায় রোয়েন। নড়লো না রোয়েন, কিন্তু কিন্তু ধীরে ধীরে কোমল আভায় বদলে গেল। যেনো নিকোলাসের চোখের তারায় কিছু একটা খুঁজে দেখতে চাইছে। এক ইঞ্চি মতো দূরে ওদের ঠোঁট, আর এগুলো না নিকোলাস। ঠোঁট দুটো এক হলো রোয়েনের অভিপ্রায়ে। প্রথমটায় নরম, ধীরে; কেবল আলতো শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, এরপর ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠলো ওদের অধীর কামনা। যেনো টসটসে পাকা ফলের মতো, উন্মত্তের ভঙ্গিতে পরস্পরের মুখের স্বাদ নিল ওরা। এরপর আচমকা, যেনো জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রোয়েন। দ্বিধাগ্রস্থ চোখে চেয়ে রইলো পরস্পরের চোখে। 

না, নিজেকে সরিয়ে দিল রোয়েন। প্লিজ, না। আমি…আমি এখনো তৈরি নই!

সোজা হয়ে বসলো নিকোলাস, রোয়েনের একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের তালুর উপর রাখলো। তারপর ওর হাতে ঠোঁট ছোঁয়াল, মাত্র একবার। কাল সকালে দেখা হবে, বলে হাতটা ছেড়ে দিল ও, দাঁড়িয়ে পড়লো। খুব ভোরে, কেমন? তৈরি থাকবেন। মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ও। 

*

পরদিন ভোরে কাপড় পরার সময় পাশের ঘরে রোয়েনের নড়াচড়ার আওয়াজ পেল নিকোলাস। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু শিস দিতে বেরিয়ে এলো রোয়েন, তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল, রওনা হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছে। 

বোরিস এখনো জাগে নি, ওদেরকে নাস্তা পরিবেশনের সময় জানালো টিসে। 

অবাক কাণ্ডই বলব আমি। নিজের প্লেটে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। কাল রাতের ঘটনা মনে থাকায় ওর মতো রোয়েনও আড়ষ্ট হয়ে আছে। তবে রাইফেল আর প্যাক-কাঁধে ঝুলিয়ে উপত্যকা ধরে রওনা হতে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো ওরা, চোখে মুখে উত্তেজনা ও প্রত্যাশা ফুটে উঠলো। 

ঘণ্টাখানেক হলো হাঁটছে, এ সময় ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকালো নিকোলাস, তারপর রোয়েনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে সাবধান করে দিল, পেছনে ফেউ লেগেছে। 

কজি চেপে ধরে স্যান্ডস্টোনের বড় একটা বোল্ডারের আড়ালে রোয়েনকে টেনে নিয়ে এলো নিকোলাস। আড়ালে পৌঁছে শুয়ে পড়লো ওরা। লাফ দেয়ার ভঙ্গি নিল নিকোলাস, ডাইভ দিয়ে পড়লো নোংরা জোব্বা পরা রোগা-পাতলা একটা মূর্তির উপর। উপত্যকা ধরে ওদের পিছু পিছু উঠে এসেছে সে। চিৎকার দিয়ে জমিনে হাঁটু গাড়ল মূর্তিটা, ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করলো। 

নিকোলাস তাকে হঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করালো। তামের! পিছু নিয়েছ কেন? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? আরবিতে জানতে চাইলো ও। 

চোখ ঘুরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো তামের। না, মাফ চাই! দয়া করুন, মারবেন না! আমি কোনো ক্ষতি করতে চাই নি। 

ছেড়ে দিন ওকে, নিকোলাস। তা না হলে আবার খিচুনি শুরু হবে। 

নিকোলাস ছেড়ে দিতেই ছুটে এসে রোয়েনের পেছনে লুকাল তামের, ভয়ে ওর : একটা হাত আঁকড়ে ধরল, উঁকি দিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে নিকোলাসের দিকে। 

মারব না, সত্যি কথা বললে মারব না, তাকে অভয় দিল নিকোলাস। কিন্তু সত্যি কথা না বললে গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে গাছে ঝোলার। কে তোমাকে পাঠিয়েছে? 

আমি নিজে থেকে এসেছি। কেউ আমাকে পাঠায় নি, কাঁপতে কাঁপতে বলল তামের। ওই জায়গাটা দেখাব আপনাদের, যেখানে পবিত্র ডিক-ডিক আমাকে দেখা দিয়েছিল। ওটার চামড়ায় ব্যাপ্টিস্টের আঙুলের ছাপ ছিল। 

হেসে ফেললো নিকোলাসও। ও সত্যি কথা বলছে কিনা সন্দেহ আছে আমার। আমি যতটুকু বুঝি, ডোরাকাটা ডিক-ডিকের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তামেরের দিকে তাকালো ও। যদি বুঝি যে মিথ্যে বলছ, সত্যি সত্যি তোমাকে গাছে ঝোলানো হবে, মনে থাকে যেন। 

আমি মিথ্যে কথা বলছি না, বলে ফোঁপাতে শুরু করলো কিশোর ছেলেটা।

নাক গলাল রোয়েন। কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন ওকে! ও আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তামেরের মাথায় আদর করে হাত বুলালো। 

ঠিক আছে, তোমাকে একটা সুযোগ দেওয়া হলো, বলল নিকোলাস। নিয়ে চলো আমাদের, দেখি কোথায় দেখেছিলে পবিত্র ডিক-ডিক।

আবার রওনা হলো ওরা। তামের হাঁটছে না, বলা চলে রোয়েনের পাশে নাচছে, হাতটাও সে ছাড়তে রাজি না। একশো গজও পেরোয় নি, চেহারা থেকে ভয়-ডর সব উধাও হয়ে গেল, আহ্লাদে আটখানা অবস্থা। চোখে-মুখে লাজুক ভাব নিয়ে খিকখিক করে হাসছে। 

এক ঘণ্টা ওদেরকে পথ দেখালো তামের, ডানডেরা নদী থেকে দূরে সরিয়ে আনল। উপত্যকার অনেক উপর, উঁচু জমিতে উঠে আসার পর লাইমস্টোনের রিজ দেখতে পেল ওরা, হুকের মতো কাটা নিয়ে ঘন ঝোঁপগুলো গোটা এলাকাটাকে দুর্গম করে রেখেছে। ঝোঁপগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো, দেখে মনে হচ্ছে। এগোবার কোনো পথ নেই। তবে আঁকাবাঁকা একটা সরু পথ ঠিকই খুঁজে বের করলো তামের, এতো কম চওড়া যে দুপাশের কাঁটাঝোঁপ এড়াতে ধীর পায়ে সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো তামের, রোয়েনের কব্জিতে টান দিয়ে ওকেও নিজের পাশে দাঁড় করালো। হাত দিয়ে নিচের দিকটা দেখালো সে, প্রায় নিজের পায়ের আঙুলগুলো।

নদী! বলল তামের, গলায় উল্লাস। তার পাশে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস, অবাক হয়ে শিস দিল মৃদু। বিশাল এক বৃত্ত তৈরি করে তামের ওদেরকে পশ্চিমে নিয়ে এসেছে, তারপর ফিরিয়ে এনেছে ডানডেরা নদীর এমন একটা পয়েন্টে যেখানে প্রবাহটা এখনো বয়ে চলেছে গভীর নালার তলায়। 

এ মুহূর্তে সেই গহ্বরের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। একবার তাকিয়েই নিকোলাস লক্ষ্য করলো, পাথুরে নালার মাথার দিকটা একশো ফুটের কম চওড়া হলেও, রিম-এর নিচে গহ্বরটা প্রসারিত হয়েছে। বহু নিচের পানির সারফেস থেকে উঠে আসা পাথরের পাঁচিল মাটির তৈরি তেজ বোতলের মতো ক্রমশ ফুলে উঠেছে। আবার ওটা সরু হয়েছে মাথা কাছাকাছি যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে। ওখানে দেখেছি, গহ্বরের অপরদিকটা দেখালো তামের। ওখানে কাটাঝোঁপের ভেতর থেকে একটা ঝরনার বেরিয়ে এসেছে। ধনুকের মতো বাঁকা পাথুরে পাঁচিলে ঝুলে আছে সবুজ শ্যাওলার জাল, তা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরে পড়ছে দুশো ফুট নিচের নদীতে। 

ওপারে যদি দেখে থাকো, আমাদেরকে এপারে আনলে কেন? 

চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে তামের। এদিকে আসাটা সহজ। ওপারের জঙ্গলে কোনো পথ নেই। ঝোঁপের কাঁটা লাগবে মেমসাহেবকে। 

তামেরের কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল রোয়েন। গহ্বরের ঠোঁটে ঝুলে থাকা একটা গাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত হলো। ইতোমধ্যে দুপুর পেরিয়ে গেছে, গরমে ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে শরীর। রোয়েনকে নিকোলাস ইংরেজিতে বলল, মুকুটে টাইটার সিরামিক সম্পর্কে তামের কিছু জানলেও জানতে পারে, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। 

প্রথমে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ জুড়ল রোয়েন, মাঝে মধ্যে তামেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ওটা কী, প্রধান পুরোহিতের মুকুটে নীল পাথরটা? 

সেইন্টের পাথর ওটা, সেন্টফুমেনটিয়াসের প্রধান পুরোহিত বলেন, যিশুর মতোই পুরানো ওটা। 

কোত্থেকে এলো ওটা, জানো তুমি? 

মাথা নাড়লো তামের। বোধহয় আকাশ থেকে পড়েছে। তারপর হয়তো সেন্ট ফুমেনটিয়াস মারা যাবার সময় প্রধান পুরোহিতকে দিয়ে যান। কিংবা তার কফিনে ছিল, কবরে ঢোকানোর আগে বের করে নেওয়া হয়। 

হ্যাঁ, হয়তো। তামের, তুমি সেন্ট ফুমেনটিয়াসের কবর দেখেছ?

ভয়ে ভয়ে চারদিকে চোখ বুলাল তামের, যেনো কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। শুধু অধিকারী পুরোহিতদের মাকডাসে ঢোকার অনুমতি আছে, মাথা নিচু করে বিড়বিড় করলো সে। 

তুমি দেখেছ, নরম সুরে অভিযোগ করলো রোয়েন, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। তামেরের সন্ত্রস্ত ভাব লক্ষ্য করে উৎসাহ বোধ করছে ও। আমাকে বলতে পারো, আমি কাউকে বলব না। 

মাত্র একবার, স্বীকার করলো তামের। আমার বয়সী কয়েকটা ছেলে টাবট পাথরটা ছোঁয়ার জন্য জোর করে পাঠায় আমাকে। না গেলে ওরা আমাকে মারধর করত। প্রিস্টের সহকারী সব ছেলেকেই পাঠায় ওরা। ঘটনাটার কথা মনে পড়ে 

যাওয়ায় তার চেহারা শুকিয়ে গেল। সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। কেউ ছিল না, আমি একা। তখন মাঝরাত, পুরোহিতরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চারদিক অন্ধকার। মাকডাসে তো সেইন্টের আত্মা ঘুরে বেড়ায়, তাই না? ওরা আমাকে বলে দিয়েছিল, আমি যদি অযোগ্য বা অপবিত্র হই তাহলে সেইন্ট আমার মাথায় বাজ ফেলবেন। 

সেইন্টের কবর পর্যন্ত গেলে তুমি? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। সমাধির ভেতরে ঢুকলে? 

মাথা নাড়লো তামের। ঢোকার মুখে বার আছে। সেইন্টের জন্মদিনে শুধু প্রধান পুরোহিত ওখানে ঢুকতে পারেন। 

তুমি তাহলে বারের ভেতর দিয়ে তাকালে?

হ্যাঁ, কিন্তু ভেতরটা অন্ধকার। সেইন্টের কফিন অবশ্য দেখা যাচ্ছিল। কাঠের কফিন, গায়ে পেইন্টিং আছে–সেইন্টের মুখ। 

তিনি কি কালো? 

না, ফর্সা। লাল দাড়ি আছে। পেইন্টিংটা খুব পুরানো। ঝাপসা হয়ে গেছে। কফিনের কাঠ পচে গেছে, গুঁড়ো হয়ে ঝড়ে পড়ছে। 

সমাধির মেঝেতে শোয়ানো কফিনটা? 

না। পাথরে একটা শেলফে খাড়া করা। 

আর কিছু মনে করতে পারো তুমি? তামের মাথা নাড়তে রোয়েন অন্য প্রশ্ন করলো তাকে, কফিনটা কি মাকডাসের পেছনের দেয়ালে? 

হ্যাঁ। বেদি আর টাবট পাথরের পেছনে।

বেদিটা কী দিয়ে তৈরি? পাথর দিয়ে? 

কাঠের বেদি। মোমবাতি আছে, বড় একটা ক্রস আছে, কয়েকটা মুকুটও আছে। আর আছে পানপাত্র। 

বেদির গায়ে কি ছবি আঁকা আছে? 

না, খোদাই করা ছবি আছে। মুখগুলো কেমন যেনো, কাপড়-চোপড়ও অন্য রকম। ঘোড়া আছে। 

টাবট সম্পর্কে বলুন, নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। আমাদের চার্চে টাবট স্টোন বলে কিছু নেই। 

আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ কী। ইহুদিদের তাবেরনাক জাতীয় কিছু নাকি ওটা? আপনি জানার কথা। 

ওর উদ্দেশ্যে ফিরলো রোয়েন। হ্যাঁ, অন্তত, মিশরীয় গির্জায় ব্যাপারটা তাই। এমব্রয়ডারি করা স্বর্ণের কাপড়ে মুড়ে একটা মণিমুক্তা খচিত বাক্সে রাখা হয়। বলা যেতে পারে, একটা গির্জার প্রাণ হলো তা। 

রোয়েনের প্রশ্ন শুনে টাবট সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলো না তামের, শুধু জানালো, পাথরটা কাপড়ে মোড়া। সবাই বলে, শুধু সেইন্টের জন্মদিনে প্রধান পুরোহিত ওটা খোলেন। 

নিকোলাস ও রোয়েন দৃষ্টি বিনিময় করলো, তারপর নিকোলাস বলল, চিন্তা করে বের করুন আমরা কীভাবে দেখতে পারি। 

সেইন্টের জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আপনাকে হতে হবে ভারপ্রাপ্ত পুরোহিত… হঠাৎ সচকিত দেখালো রোয়েনকে, ফিসফিস করে জানতে চাইলো, আপনি কি… না, তা আপনি ভাবতে পারেন না। 

আরে না, তা কি আমি ভাবতে পারি! 

মাকডাসে আপনি ধরা পড়লে ওরা আপনাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।

উত্তরটা হলো, ধরা না পড়া।

আপনি গেলে আমিও যাব। কীভাবে ম্যানেজ করবেন? 

ধীরে। নিকোলাস ঠোঁটে অলস হাসি। মাত্র দশ সেকেন্ড হলো আইডিয়াটা মাথায় এসেছে। প্ল্যান করার জন্য অন্তত দশটা মিনিট সময় দিন। 

দু জনেই ওরা গহ্বরের ওপারে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো। নিস্তব্ধতা ভাঙল রোয়েন, কাপড়ে মোড়া একটা পাথর। টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট? 

জোরে বলবেন না, শয়তান শুনছে। 

হঠাৎ চিৎকার দিল তামের। ওই দেখুন! ওদিকে তাকান! রোয়েনের হাত ধরে ঝকালো সে। বলেছি না! অপর হাতে নদীর ওপারটা দেখাচ্ছে। কাটাঝোঁপের কিনারায়! দেখতে পাচ্ছেন না? 

কী? কী দেখবো?

ডোরাকাটা ডিক-ডিক। জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের ডিক-ডিক। গায়ে পবিত্র ছাপ… 

ওপারের ঝোঁপের গায়ে নরম, খয়েরি একটা অস্পষ্ট প্রলেপ দেখতে পেল রোয়েন। কি জানি। এতো দূর থেকে…। 

প্যাক হাতড়ে বাইনোকুলার বের করলো নিকোলাস। কিছুক্ষণ দেখার পর হেসে উঠলো। মাই গড! বুড়ো দাদার রেপুটেশন এতোদিনে নিরাপদ হলো! এ তো সত্যি সত্যি ডোরাকাটা ডিক-ডিক! বাইনোকুলারটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিল। 

আগের দিন সাধারণ যে ডিক-ডিকটা ওরা দেখেছিল, আকারে এটা তার অর্ধেক হবে। গায়ের রঙও ধূসর নয়, উজ্জ্বল লালচে খয়েরি। তবে প্রথমেই চোখে লাগে কাঁধে ও পেছন দিকের গাঢ় চকলেট রঙের ডোরাগুলো পাঁচটা দাগ, পরস্পরের সঙ্গে সমান দূরত্বে, দেখে সত্যি সত্যি মনে হবে পাঁচ আঙুলের ছাপ। 

ডিক-ডিকের অর্ধেক গায়ে ছায়া পড়েছে, বাতাস শোঁকার সময় নাক কোঁচকাচ্ছে। মাথা উঁচু করে আছে, সন্দিহান ও সতর্ক। ম্যাডোকোয়া হারপারি কোনো সন্দেহ নেই, ফিসফিস করে রোয়েনের কানে কানে বলল কী। দুঃখিত, গ্রান্ড পা- তোমাকে জোচ্চোর ভাবার জন্য! 

রাইফেলটা হাতে নিল সে, বোল্ট টেনে চেম্বারে একটা রাউন্ড ঢোকালো। রোয়েন জানতে চাইলো, গুলি করবেন নাকি? 

এখুনি না। ছোট টার্গেট, তিনশো গজ দূরে। মাথা নাড়লো নিকোলাস। আরো কাছে আসার অপেক্ষায় থাকব। 

কেমন করে পারবেন এটা করতে? এতো সুন্দর একটা প্রাণী? 

সুন্দর বা কুৎসিত- কী আসে যায়? এখানে আসার পেছনে ডিক-ডিক শিকার একটা কারণ! 

কথা না বলে চোখে আবার বাইনোকুলার তুললো রোয়েন। পালিয়ে যা, পালিয়ে যা, মনে মনে বলছে। কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে. গহ্বরের দিকে এগিয়ে আসছে ডিক-ডিক। 

দুশো গজ, বিড়বিড় করলো নিকোলাস, শুয়ে পড়েছে ও, টেলিস্কোপ সাইটে চোখ। এ সময় হঠাৎ উত্তেজনায় টান টান হলো খুদে হরিণ, ফেলে আসার পথ ধরে ছুটলো, অদৃশ্য হয়ে গেল কাঁটা ঝোঁপের ভেতর।

ভয় পেল কেন? বলার পর মুখের ভাব বদলে গেল নিকোলাসের বাতাসে কিসের যেনো একটা গুঞ্জন, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। হেলিকপ্টার! রোয়েনের হাত থেকে বাইনোকুলার নিয়ে আকাশের দিকে তাক করলো। আকাশে মেঘ নেই, একটু পরই যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখা গেল। কাঠামোটা চিনতে পারলো নিকোলাস। 

বেল জেট রেঞ্জার। এদিকেই আসছে। আসুন, লুকিয়ে পড়ি। 

কাটাঝোঁপের ভেতর গা ঢাকা দিল ওরা। হেলিকপ্টারটাকে এখনো বাইনোকুলার ধরে রেখেছে নিকোলাস। সম্ভবত ইথিওপিয়ান এয়ার ফোর্স অ্যান্টি শুফতা টহলে বেরিয়েছে। না, দেখে তো সামরিক বলে মনে হচ্ছে না। সবুজ আর লাল ফিউজিলাজ, লাল ঘোড়া। লাল ঘোড়া তো পেগাসাস এক্সপ্লোরেশনের লোগো। 

কাছাকাছি চলে আসায় রোয়েন এখন খালি চোখেই লোগোটা দেখতে পাচ্ছে। ওদের সামনে আধ মাইল দূরে রয়েছে কপ্টার, উড়ে যাচ্ছে নীল নদের দিকে। 

জ্যাক হেলম্ ভালো একটা বাহন পেয়েছে, বলল নিকোলাস। যখন খুশি আমাদের উপর নজর রাখতে পারবে। 

কপ্টারটা উপখাদের কুঁজ পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, সম্ভবত মঠের দিকে যাচ্ছে। 

বসের নির্দেশে ওরা সম্ভবত আমাদের ক্যাম্প খুঁজছে, আন্দাজ করলো নিকোলাস। চলুন, ফিরি। না, সবুর! ইঞ্জিনের আওয়াজ আবার বাড়তে শুরু করেছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁকে আবার কপ্টারটাকে দেখা গেল, ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। নদীটাকে অনুসরণ করছে ওরা, বলল নিকোলাস। কিছু খুঁজছে। বলে মনে হয়। 

আমাদের? 

এ সময় ওদেরকে চমকে দিয়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটলো তামের। বাঁচাও! তার স্বরে চিৎকার করছে। কে কোথায় আছ বাঁচাও আমাকে! শয়তান তাড়া করেছে! যিশু তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বাঁচাও! ফাঁকা জায়গায় বেরিয়েও থামছে না, ছুটছে এখনো। 

পাইলট তাকে দেখে ফেলেছে, কপ্টার ঘুরে গেছে ওদের দিকে। খুব নিচু দিয়ে এলো ওটা, গহ্বরের ঠোঁটের কাছে স্থির হলো শূন্যে। ফরওয়ার্ড কেবিনের উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর দুটো মাথা দেখতে পাচ্ছে ওরা। আরো নিচে নামছে পাইলট। নদীর উপর ঝুলে থাকলো। ঝোঁপের ভেতর কুঁকড়ে আছে ওরা, নিকোলাসকে দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে রোয়েন। কানে ভারী রেডিও এয়ারফোন আর গাঢ় চশমা থাকলেও জ্যাক হেলকে চিনতে পারলো ওরা। পাইলট কালো। দু জনেই গলা লম্বা করে নিচে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরা পড়ে যাওয়ায় এখন আর লুকিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। হাত-পা ছড়িয়ে পেছনের গাছে হেলান দিল নিকোলাস, হ্যাঁটা মাথার পেছনে ঠেলে দিয়ে হাত নাড়লো হেলমের উদ্দেশে। 

ফোরম্যান সাড়া দিল না। নিকোলাসের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দিয়াশলাই জ্বাললো, ঠোঁটে ঝোলা আধ পোড়া চুরুটে ধরালো আগুনটা। কাঠিটা ফেলে দিয়ে এক মুখ ধোয়া ছাড়লো নিকোলাসকে দিকে, তারপর কী যেনো বলল পাইলটকে। উপরে উঠলো কপ্টার, বাঁক ঘুরে উত্তর দিকে চলে গেল। 

শুধু আমাদেরকে নয়, আমাদের ক্যাম্পটাও দেখে গেল ওরা, বলল রোয়েন।

চলুন, ফিরি, বলল নিকোলাস। কাল আবার আসা যাবে। 

ওদেরকে আমার ভয়ই লাগছে, বলল রোয়েন, তবে নিকোলাস চুপ করে আছে দেখে প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলো, তামেরের আবার খিঁচুনি শুরু হয় নি তো? 

পথের ধারেই পাওয়া গেল তাকে। কাঁপছে সে এখনো, কাঁদছে, তবে খিচুনি ওঠে নি। রোয়েন গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে শান্ত হলো সে। ওদের পেছন পেছন অনেক দূর এলো, তারপর কখন এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল মঠের দিকে। 

*

সন্ধ্যের আগে আরেকবার মঠ দেখতে এলো ওরা। পাথুরে ক্যাথেড্রালের প্রবেশমুখে থামলো, তারপর আউটার চেম্বারে ঢুকে তরুণ উপাসকদের ভিড়ে মিশে গেল। 

খোলা দরজা দিয়ে মিডল চেম্বারের ভেতর তাকিয়ে ফিসফিস করলো রোয়েন, তামেরের কথা থেকে বোঝা যায়, ডিউটিতে থাকা পুরোহিত কখন ঘুমিয়ে পড়বে তার অপেক্ষায় থাকে শিক্ষানবিস তরুণরা।

কিন্তু ভেতরের সম্পর্কে আমাদের তো তেমন করে কিছু জানা নেই, নিকোলাস বলে। 

দেখা গেল পুরোহিতরা বিনা বাধায় ভেতরে আসা-যাওয়া করছেন, কারো অনুমতির জন্য কোথাও থামছেন না। তবে দরজায় পাহারায় দাঁড়ানো পুরোহিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় নাম ধরে সম্বোধন করছেন সবাই। পরস্পরকে সবাই তারা চেনেন। নিকোলাস বলল, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, তারপর ধরা পড়ে গেলাম। পবিত্র এলাকায় অনুপ্রবেশের সাজাটা যেনো কী?

নীলনদের বুভুক্ষু কুমীরের খোরাক বানানো হয় না তো? হেসে উঠলো রোয়েন। তবে আমাকে না নিয়ে ওখানে আপনি ঢুকছেন না। 

এ নিয়ে এখুনি তর্ক করতে রাজি নয় নিকোলাস। খোলা দরজা দিয়ে যতটুকু পারা যায় দেখে নিতে চাইছে ও। আউটার চেম্বারের চেয়ে মিডল চেম্বারটা আকারে ছোট বলে মনে হলো। ভেতরে ছায়ার ভেতর দেয়ালচিত্র দেখা যাচ্ছে। মুখোমুখি দেয়ালে আরেকটা দরজা। তামেরের বর্ণনা অনুসারে ওটা মাকডাসে ঢোকার পথ। পাঁকটা বন্ধ করা হয়েছে গ্রিলের গেট বসিয়ে। গেটের ফ্রেমটা গাঢ় রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি, তবে বারগুলো লোহার। 

দরজার দু পাশে পাথুরের সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত এমব্রয়ডারি করা পর্দা ঝুলছে, তাতে সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের জীবন কাহিনী থেকে নেওয়া দৃশ্য ফুটে উঠেছে। একটা দৃশ্যে নতমস্তকে সমবেত শিষ্যদের ধর্মীয় বাণী শোনাচ্ছেন তিনি, এক হাতে বাইবেল, অপর হাতটা আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে উপরে তোলা। আরেকটা পর্দায় ফুটে উঠেছে একজন সম্রাটকে ব্যাপ্টিজমে দীক্ষিত করার দৃশ্য। জালি হোরার মতোই মাথায় উঁচু আর সোনালি মুকুট পরে আছেন সম্রাট, সেন্টের মাথার চারপাশে একটা বলয়। সম্রাটের মুখ কালো, তবে সেইন্টের মুখ সাদা। 

ইতিহাস কি এখানে বিশুদ্ধ? বিড়বিড় করে নিজেকেই প্রশ্নটা করলো নিকোলাস। 

কী ভেবে হাসছেন আপনি? জানতে চাইলো রোয়েন। ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় পেয়ে গেছেন? 

না, ভাবছি ডিনারের কথা। চলুন, ফিরি। 

ডিনারে বসে দেখা গেল বোরিস ঢক ঢক করে শুধু মদই খাচ্ছে। সারাদিন কে কী করলো বা দেখলো আলোচনা হচ্ছে। দুপুরে তারই শিকার করা কবুতরের রোস্ট খাচ্ছে সবাই মজা করে। 

তো, ইংরেজ সাহেব, কেমন শিকার করলেন আজ? ভয়ঙ্কর ডিক ডিক আবার আপনাকে আক্রমণ করে বসে নি? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল বোরিস। 

আপনার ট্র্যাকারদের কী খবর? কোনো চিহ্ন মিললো? নিকোলাস শুধায়। 

পায় নি আবার! কুড়ু, বুশবাক, বাফেলো- কি নেই এখানে? এমনকি, ডিক ডিক পর্যন্ত পেয়েছে ওরা, কিন্তু আফসোস, ডোরাকাটা নয়! 

মুখ খুলতে যাচ্ছিল রোয়েন, চোখ ইশারায় নিষেধ করলো নিকোলাস, নিচু গলায় আরবিতে বলল, জানলে কাল ওরা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইবে। 

মিস্টার নিকোলাস, স্যার, মা জননী কি আমাকে ভদ্রতা বলে কিছু শেখান নি? সবাই না বুঝলে, সে ভাষায় কথা বলতে নেই। নিন, খানিকটা ভদকা খান। 

আমার ভাগটুকুও আপনি খেয়ে ফেলুন, বলল নিকোলাস। 

ডিনারের সময় প্রায় কোনো কথাই বলছে না টিসে। করুণ আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। রোয়েন লক্ষ্য করলো, স্বামীর দিকে ভুলেও সে তাকাচ্ছে না। ডিনার শেষ হতে নিকোলাস আর রোয়েন উঠে পড়লো, আগুনের ধারে স্ত্রীকে বসিয়ে রাখলো বোরিস। 

নিজেদের কুঁড়ের দিকে যাবার সময় নিকোলাস বলল, যেভাবে গিলছে বোরিস, আজ রাতেও না বউকে ধরে পেটায়। 

আজ সারাদিন টিসের উপর অত্যাচার করেছে লোকটা, বলল রোয়েন। আমাকে টিসে বললেন, আদ্দিসআবাবায় ফিরেই স্বামীকে ছেড়ে দেবেন। 

এরকম একটা জানোয়ারের সঙ্গে বিয়ে হলো কী করে? দেখতে তো খুবই সুন্দর, ভালো একজনকে বেছে নিতে পারলেন না? 

সব মেয়ে সমান নয়, জবাব দিল রোয়েন। কিছু মেয়ে জানোয়ার দেখলে আকৃষ্ট হয়। বিপদের মধ্যে রোমাঞ্চ থাকে, সেটাই বোধহয় কারণ। সে যাই হোক, টিসে জানতে চাইছেন কাল আমাদের সঙ্গে বেরুতে পারবেন কিনা। স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বেচারি। 

অন্তত ওঁকে রেহাই দেওয়ার জন্য সঙ্গে নেওয়া দরকার, রাজি হলো নিকোলাস। 

পরদিন ভোর হওয়ার আগেই রওনা হলো ওরা। রিগবি হাতে নিকোলাস সামনে থাকলো, পেছনে মেয়ে দু জন কথা বলতে বলতে আসছে। ডোরাকাটা ডিক-ডিক সম্পর্কে জানানো হলো টিসেকে, ওদের প্ল্যানটাও ব্যাখ্যা করা হলো। আগের দিন তামের যে পথ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই পথটাই অনুসরণ করছে ওরা।

সূর্য বেশ অনেকটা উপরে উঠে আসার পর ফাটলটার ঠোঁটে, কাটা-ঝোঁপের নিচে পৌঁছলো ওরা। ওত পেতে বসে থাকা ছাড়া আজ কোনো কাজ নেই ওদের। খানিক পর রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, বেচারি ডিক-ডিককে যদি গুলি করতে পারেন, ওপার থেকে সেটাকে আনবেন কীভাবে?

ক্যাম্প ছাড়ার আগেই ব্যবস্থা করেছি, বলল নিকোলাস। হেড ট্র্যাকারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। গুলির শব্দ হলে রশি নিয়ে হাজির হবে সে, ওপারে পৌঁছতে সাহায্য করবে আমাকে। 

ওদের নিচে ফাটলটার দিকে তাকালো টিসে।

এর উপর দিয়ে ওপারে যেতে কোনোদিনই রাজি হব না আমি। 

টিসে আর রোয়েন নিকোলাসের কাছাকাছি শুয়ে পড়লো। নিচু গলায় গল্প করছে হাতে রিগবি নিয়ে অপেক্ষা করছে নিকোলাস, কাটা গাছে হেলান দিয়ে। দুপুর পেরিয়ে গেল। ডিক-ডিকের দেখা নেই। 

গরমে সিদ্ধ হচ্ছে মেয়েরা আগেই মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের। ঝিমুনি এসে যাচ্ছে। 

আরো প্রায় আধঘণ্টা পর কী একটা শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল নিকোলাসের। ওর পেছনের কাটাঝোঁপ থেকে আওয়াজটা এসেছে বলে মনে হলো। খুবই অস্পষ্ট, তবে পরিচিত। এমন একটা শব্দ, এক নিমেষে পুরোপুরি স্রোত নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে। একে-ফরটিসেভেনের সেফটি ক্যাচ সামনে টেলে ফায়ার পজিশনে আনা হয়েছে। 

এক ঝটকায় কোল থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে দু বার গড়ান দিল নিকোলাস, শরীর মুচড়ে পাশে শুয়ে থাকা মেয়ে দুটোকে আড়াল দেওয়ার চেষ্টা একই সঙ্গে রিগবিটা কাঁধে তুলে ফেলেছে, তাক করেছে পেছনের ঝোঁপ।

মাথা তুলবেন না, হিসহিস করলো নিকোলাস। নিচে রাখুন মাথা! ট্রিগারে আঙুল,পাল্টা গুলি করার জন্য প্রস্তত। টার্গেট দেখতে পেয়েই ব্যারেল ঘোরালো সেদিকে। 

বিশ কদম দূরে এক লোক গুঁড়ি মেরে বসে আছে, হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল সরাসরি নিকোলাসের মুখে তাক করা। চকচকে কালো লোকটা, ভেঁড়া-ফাঁড়া ক্যামোফ্লেজ ফেটিগ পরে আছে, মাথার নরম ক্যাপটাও তাই। ওয়েবিং বেল্টে একটা বুশনসাইফ, গ্রেনেড, পানির বোতল ও গেরিলাযোদ্ধার অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে। প্রফেশনাল শুফতা, চিন্তা করছে নিকোলাস, ঝুঁকি নেওয়া যায় না। একই সঙ্গে উপলব্ধি করলো, ইচ্ছে থাকলে এতোক্ষণে মেরে ফেলতে পারতো ওকে। 

রিগবি তাক করলো নিকোলাস অ্যাসল্ট রাইফেল মাজলের এক ইঞ্চি উপরে, ওটার পেছনে গেরিলার রক্তলাল ডান চোখে। 

অচল বা চালমাত অবস্থা; চোখ সরু করে জানান দিল লোকটা। তারপর আরবিতে নির্দেশ দিল, সলিম, মেয়ে দুটোকে কাভার দাও লোকটা নড়লে গুলি করবে ওদের। 

খসখস আওয়াজ শুনে একপাশে তাকালো নিকোলাস। ঝোঁপের আড়াল থেকে আরেকজন গেরিলা বেরিয়ে এলো। একই ড্রেস, তবে কোমরের কাছে ধরে আছে রাশিয়ান আরপিডি লাইট মেশিন গান। সাবধানে এগিয়ে এসে পয়েন্ট-ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মেয়েদের উপর মেশিন গান তাক করলো সে। 

ওদের চারপাশের ঝোঁপ থেকে আরো আওয়াজ আসছে। দু জন নয়, গেরিলাদের গোটা একটা গ্রুপ, বুঝতে পারলো নিকোলাস। জানে, মাত্র একটা গুলি করার সুযোগ পাবে ও। ফলাফল যা-ই হোক, রোয়েন আর টিসে ততক্ষণে লাশে পরিণত হবে। 

মাজলটা ধীরে ধীরে নিচু করলো নিকোলাস। তারপর মাটিতে রাইফেল নামিয়ে মাথার উপর হাত তুললো। ওরা যা বলে শুনুন। 

সোজা হলো গেরিলা লীডার, নিজের লোকদের সঙ্গে দ্রুত কথা বলছে। ওর রাইফেল আর প্যাক নিয়ে নাও। 

আমরা ব্রিটিশ নাগরিক, বলল নিকোলাস সাধারণ ট্যুরিস্ট। যোদ্ধা বা সরকারি লোক নেই। 

কথা নয়, একদম চুপ! কঠিন সুরে খেঁকিয়ে উঠলো লিডার। আরবি ভাষা শুনে চমকে গেছে। আড়াল থেকে গেরিলারা বেরিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে পাঁচজনকে দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তবে অনেকেই হয়তো সামনে বেরোয় নি নড়াচড়ার ধরনই বলে দেয় প্রফেশনাল, গুলি পথে বাধা হচ্ছে না, সুযোগ দিচ্ছে না পালানোর ঝটপট সার্চ করা হলো ওদেরকে, তারপর ধমক দিয়ে পথে এনে তোলা হলো। 

কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জানতে চাইলো নিকোলাস। 

কোন প্রশ্ন নয়! ওর শোল্ডার রেডের মাঝখানে একে-ফরটিসেভেনের বাঁট দিয়ে আঘাত করলো একজন গেরিলা। পড়েই যাচ্ছিল, কোনোরকমে তাল সামলালো। 

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে ওদেরকে। সূর্যের অবস্থান লক্ষ করছে নিকোলাস, সুযোগ পেলেই দেখে নিচ্ছে পাহাড়-প্রাচীরের চূড়াগুলো। পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা, নীলনদের কোর্স ধরে সুদান সীমান্তের দিকে। শেষ বিকেলের দিকে আন্দাজ করলো দশ মাইল পেরিয়েছে। ইতোমধ্যে উপত্যকার একটা পাশে পৌঁছেছে ওরা, ডালটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। আরো মাইলখানেক এগোবারপর গেরিলাদের ক্যাম্পটা দেখা গেল। কয়েকটা মাত্র একচালা, সেন্ট্রিরা লাইট মেশিন গান নিয়ে সর্তক হয়ে আছে। 

ক্যাম্পের মাঝখানের একটা একচালার সামনে দাঁড় করানো হলো ওদেরকে। ভেতরে নিচু ক্যাম্প টেবিলের উপর ঝুঁকে ম্যাপ দেখছে তিনজন অফিসারদের মধ্যে কমান্ডারকে আলাদাভাবে চেনা গেল। গেরিলা গ্রুপের লীডার তার কাছে গিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কিছু বলল, ইঙ্গিতে বন্দিদের দেখালো। 

সোজা হলো কমান্ডার, বেরিয়ে এলো রোদে। লোকটা বেশি লম্বা নয়, তবে চেহারায় এতো বেশি গাম্ভীর্য ও কর্তৃত্ব যে সেটা প্রথমে চোখে পড়ে না। কাঁধ দুটো চওড়া, কাঠামোটা চৌকো ও নিরেট। মুখে কোঁকড়ানো কালো দাড়ি, অল্প দুয়েকটা শাদা। চেহারায় মার্জিত একটা ভাব স্পষ্ট, সুদর্শনও বলতে হবে। চোখ দুটো চঞ্চল ও বুদ্ধিদীপ্ত, দৃষ্টি নিক্ষেপে ক্ষিপ্রতা লক্ষ্য করার মতো। আমার লোক বলছে তুমি নাকি আরবি জানো, নিকোলাসকে বলল সে। 

তোমার চেয়ে ভালো জানি, মেক নিমুর, জবাব দিল নিকোলাস। তা, এ তোমার শেষ পরিণতি? একদল ডাকাতের সর্দার? কিডন্যাপারদের লীডার?

এক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে থাকলো মেক নিমুর। নিকোলাস? ওহ্ গড! তোমাকে আমি চিনতে পারি নি? তোমাকে? হাসছে সে। দুই হাত মেলে দিল, ভঁজে আটকে বুকে টেনে নিল নিকোলাসকে। নিকোলাস! নিকোলাস! দু গালে দু বার চুমো খেলো, তারপর বাহু সমান দূরে ঠেলে দিয়ে মেয়ে দূটোর দিকে তাকালো। এ ব্যাটা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল ওদেরকে। দু জনেই ওরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এদিকে গেরিলা দল ততক্ষণে হাওয়া। 

লজ্জা দিচ্ছ, মেক।

নিকোলাসকে আবার চুমো খেলো মেক নিমুর। তাও একবার নয়, দু বার। 

না একবারই, প্রতিবাদ করলো নিকোলাস। দ্বিতীয়বার ভুলে। ওদের গুলিতে তোমাকে মরতে দেওয়া উচিত ছিল আমার। 

গলা ছেড়ে হেসে উঠলো গেরিলা কমান্ডার মেক। প্রায় পনেরো বছর আগের কথা, তাই না? তুমি কী এখনো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে আছো? এতোদিনে নিশ্চয়ই জেনারেল হয়ে গেছ! 

থাকলে হতাম, কিন্তু থাকি নি।

মেয়ে দুটোর মধ্যে কে জানে কেন টিসেকে মনে ধরেছে মেকের, অন্তত ঘন ঘন তার দিকেই তাকাচ্ছে সে। তোমাকে আমি চিনি। কয়েক বছর আগে আদ্দিসে দেখেছি। তখন কিশোরী ছিলে। তোমার বাবা অল্টো জিমেন, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। মেনজিসটু তাকে খুন করে। 

আমিও আপনাকে চিনি, বলল টিসে। আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস, মেনজিসটুর বদলে আপনারই ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত ছিল। সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো সে। 

সোজা হয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। কারো সামনে মাথা নিচু করো না। নিকোলাসের দিকে তাকালো কমান্ডার মেক। আমার লোকেরা একটু বেশ উৎসাহী, খারাপ ব্যবহার করায় দুঃখিত। তবে আমরা খবর পেয়েছি যে মঠে কিছু লোকজন। এসেছে, প্রশ্ন করছে নানা রকম। এসো, নিকোলাস, ভেতরে এসো। 

ক্যাম্প ফায়ার থেকে কেটলিতে কফি বানিয়ে আনা হলো, মগে ভরে ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। পুরানো দিনের কথা স্মরণ করলো নিকোলাস ও মেক। ফকল্যান্ড যুদ্ধের আগে মেনজিস্টুর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে ওরা দু জন।

কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ, মেক, নিকোলাস বলে, হারজিত হয়ে গেছে। এখন কেন বনে-জঙ্গলে দলবল নিয়ে ঘুরে ফিরছো? কেন আদ্দিসে গিয়ে আরাম-আয়েশে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছ না, অন্যদের মতো? 

এখনো আদ্দিসে মেনজিন্টুর মতো শত্রু আছে আমার। শত্রুমুক্ত ইথিওপিয়া না হলে কেমন করে লড়াই ছেড়ে দিই? মেক নিমুর জানায়। 

এরপর ইথিওপিয়ার রাজনীতি নিয়ে গভীর আলাপে মগ্ন হয়ে যায় নিকোলাস ও মেক। কী নিয়ে কথা বলছে তারা, আলোচ্য চরিত্রই বা কারা কিছুই বুঝতে পারলো না রোয়েন। তবে, বিভিন্ন বিষয়ে নিকোলাসের প্রজ্ঞা দেখে অবাক হলো সে। এমন কী মেক নিমুর পর্যন্ত নিকোলাসের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ চাইছে! 

তার মানে, এখন ইথিওপিয়ার সীমান্তের বাইরে, সেই সুদান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তোমার যুদ্ধ? নিকোলাস শুধালো নিমুরকে। 

সুদানে তো বিশ বছর ধরেই আগুন জ্বলছে, একমত হয়ে বলে মেক। উত্তরের মুসলমানদের সঙ্গে দক্ষিণের খ্রিস্টানদের লড়াই চলছে ওখানে। 

আমি সেটা জানি, মেক। কিন্তু তা হলো সুদানে- তোমার যুদ্ধ নয় ওটা! 

অবশ্যই এটা আমার যুদ্ধ। মেক একরোখা স্বরে বলে। আমি সৈনিক এবং খ্রিস্টান। 

চোখে সম্মতি নিয়ে সায় দেয় টিসে। গোগ্রাসে মেক নিমুরের কথা গিলছে সে। 

অল্টো মেক যিশুর পথের সৈনিক। সাধারণ লোকের অধিকারের জন্য কাজ করছে সে। অভিভুত স্বরে নিকোলাসকে বলল টিসে। 

হুম। লড়াই ওর রক্তে। নিকোলাস হাসে।

তো, নিকি, এখানে কী করছো তুমি? যদি সৈনিক না হয়, যদি লড়াই ভালো না-ই বাসো, তবে কী করছো এ জঙ্গলে? মেকের কণ্ঠে কৌতূহল। 

এসেছি অ্যাবে গিরিখাদে, নিকোলাসের জবাব। ডিক-ডিক শিকার করব? 

কী বললে? ডিক-ডিক? মেকের চোখে অবিশ্বাস। তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠলো। তুমি? ডিক-ডিক শিকার করবে? তুমি? নাহ্, বিশ্বাস করলাম না। তোমার অন্য কোনো মতলব আছে। 

প্রশ্ন হলো, প্রয়োজনে তোমার সাহায্য পাব কিনা।

চাইলেই পাবে। দু দু বার জান বাঁচিয়েছ।

একবার, শুধরে দিল নিকোলাস।

এমন কি একবারও যথেষ্ট। 

*

কাল সকালে সেন্ট ফুমেনটিয়াস মঠে ওদেরকে পৌঁছে দিবে মেক। তিমকাত উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য গেরিলাদের নিয়ে তারও সেখানে যাবার কথা। প্রধান পুরোহিত জালি হোরা তার বন্ধু। নিকোলাস আন্দাজ করলো, মঠটা আসলে মেকের ডীপ কাভার বেস। সম্ভবত সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে প্রতিপক্ষ বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তথ্যও পায় সে। 

একটা একচালার অর্ধেকটা চট দিয়ে ঘিরে ছেড়ে দেওয়া হলো নিকোলাস আর রোয়েনকে, বিছানা তৈরি হলো শুকনো ঘাস বিছিয়ে। মশা তাড়াবার জন্য ধূপ জ্বালা হলো। রোয়েন আর নিকোলাস কাছাকাছি শুয়েছে, রোয়েনের শরীর চাদরে ঢাকা। ঘরের দরজা খোলা, বাইরে ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল মেক আর টিসেকে। 

সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় রোয়েন বলল, ইথিওপিয়ার মেয়েরা মনে হচ্ছে। আরবের মতো নয়। আরবের কোনো মেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত একা বসে থাকবে না। বিশেষ করে সে যদি বিবাহিতা হয়।

যা-ই বলেন, ওদের দুজনকে একসঙ্গে মানিয়েছে বেশ। নিকোলাস নিজের মত দেয়। ওদের জন্য আমার শুভকামনা রইলো!

এরপর রোয়েনের দিকে ফিরে ও জানতে চাইলো, আপনি কেমন, রোয়েন? একজন আড়ম্বরপূর্ণ, লাজুক আরব মেয়ে নাকি প্রগতিশীল পশ্চিমা নারী?

এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সময় মনে হয় এখনো আসে নি; অথবা হয়তো অনেক দেরী হয়ে গেছে! বলেই, পাশ ফিরে নিকোলাসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল রোয়েন। 

আহ্! শুভরাত, ওইজিরো রোয়েন। 

শুভরাত, অল্টো নিকোলাস, মুখ না ঘুরিয়েই বলল রোয়েন, যেনো ওর ঠোঁটে জেগে ওঠা হাসিটা নিক দেখতে না পায়। 

*

পরদিন ভোর হওয়ার আগেই রওনা হয়ে গেল গেরিলারা। মার্চ শুরু হলো পুরোপুরি সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে, মূল দলের সামনে ও দু পাশে থাকলো স্কাউটরা। নিকোলাসকে মেক জানালো, গিরিপথের এদিকে খুব কমই আসে আর্মি, তবু তারা সারাক্ষণ সতর্ক থাকে। 

চলার পথে টিসের উচ্ছ্বাস আর আবেগ হলো দেখার মতো। তার মুগ্ধ দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও মেকের উপর থেকে নড়ছে না। রোয়েনের কানে কানে বলল, পারলে একমাত্র উনিই আমাদের দেশটাকে এক করতে পারবেন, হাজার বছরেও যে কাজ কেউ পারে নি। ওকে দেখে আমি যেনো আমার কৈশোর ফিরে পেয়েছি। আনন্দ আর আশা জা ছে বুকে। 

মঠের কাছাকাছি পৌঁছতে সারাটা সকাল লেগে গেল। ডানডেরা নদীকে দেখামাত্র গেরিলাদের নিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লো মেক মঠে পাঠানো হলো মাত্র চারজন স্কাউকে। এক ঘণ্টা পর মাথায় বড় আকারের বান্ডিল নিয়ে একদল তরুণ উপাসক এলো মঠ থেকে। মেককে সমীহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালো তারা, বান্ডিলগুলো রেখে আবার নেমে গেল সরু পথ ধরে গিরিখাদে। 

বান্ডিল থেকে বেরুল শিক্ষানবিস সন্ন্যাসীদের উপযোগী ঢোলা আলখেল্লা। গেরিলাদের মধ্যে শুধু যারা খ্রিস্টান, তারা পারবে। দেখা গেল আলখেল্লার ভেতর শুধু সাইডআর্মস ভরলো গেরিলারা। বাকি সব অস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাহাড় প্রাচীরের গুহায় রেখে যাওয়া হচ্ছে, পাহারায় থাকবে কয়েকজন সেন্ট্রি। 

সন্ন্যাসী সেজে রওনা হয়ে গেল গেরিলারা, মঠ আর মাত্র কয়েক মাইল দূরে। পথ থেকেই বিদায় নিল নিকোলাস, মেয়ে দু জনকে নিয়ে ফিরে এলো ক্যাম্পে। 

রাগে ও হতাশায় ফাঁকা জায়গাটায় পায়চারি করছিল বোরিস। তুমি একটা খারাপ মেয়েমানুষ! টিসেকে দেখেই মারমুখো হয়ে ছুটে এলো সে। সারারাত দেহদান করে এলে! 

কাল সন্ধ্যায় আমরা পথ হারিয়ে ফেলি, বলল নিকোলাস, গেরিলাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বোরিসকে বলার জন্য এ মিথ্যে গল্পটা ওকে শিখিয়ে দিয়েছে মেক। আজ সকালে একদল সন্ন্যাসী আমাদের দেখতে পেয়ে ফিরিয়ে আনে। 

হারিয়ে তো যাবেনই, মিস্টার! খেঁকিয়ে উঠলো বোরিস। গাইড হিসেবে আমাকে ভাড়া করেছেন, অথচ আমাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা উঠলে আপনার অ্যালার্জি হয়! খারাপ মেয়েমানুষ, তোমার সঙ্গে আমার পরে বোঝাঁপড়া হবে। যাও, কী খাওয়া হবে দেখো। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছতলায় দুপুরের খাবার পরিবেশন করলো টিসে। ওরা খাচ্ছে, রোয়েনের হাতে টোকা দিয়ে নিকোলাস বলল, আপনার সেই ভক্ত হাজির!

চুপিচুপি কখন এসেছে, কেউ দেখে নি তামেরকে। একটা কুঁড়ের পাশে গুঁড়ি মেরে বসে আছে। রোয়েন তার দিকে তাকাতেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল মুখ, বোকার সলজ্জ হাসি হাসছে। 

আপনার সঙ্গে বিকেলে আমি বের হচ্ছি না, বোরিসের কান বাঁচিয়ে নিকোলাসকে বলল রোয়েন। আশঙ্কা করছি টিসে উপর আবার আজ অত্যাচার হবে। আপনি তামেরকে নিয়ে যান। 

রওনা হওয়ার সময় রোয়েনের খোঁজে চারদিকে তাকালো তামের, কিন্তু রোয়েন তার কুঁড়ে থেকে বেরুল না। অগত্যা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিকোলাসের পিছু নিল সে। তুমি আমাকে নদীর ওপারে নিয়ে যাবে, বলল নিকোলাস। যেখানে পবিত্র প্রাণীটা থাকে। 

উত্তেজনার নতুন খোরাক পেয়ে নিকোলাসের সামনে চলে এলো তামের, ফুর্তিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।

ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে এসে আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে এক ঘণ্টা এগুলো ওরা। ক্ষয়ের কারণে এবড়ো থেবড়ো হয়ে থাকা পাথরেরমাঝখানে হারিয়ে গেছে পথটা, চেনাই মুশকিল। কোনো দিকে খেয়াল নেই, লাফিয়ে একের পর এক কাঁটাঝোঁপের ভেতর ঢুকে পড়ছে তামের। এ পাথুরে জমিন আর কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে আরো প্রায় দুঘণ্টা এগুলো ওরা। এ পথে রোয়েনকে কেন আনতে চায় নি তামের, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নিকোলাস। নগ্ন হাত দুটো কাঁটায় চিরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, ট্রাউজারের পায়া ছিঁড়ে গেছে অন্তত দশ জায়গায়। তবে পথটা চিনে রাখছে ও, পরে খুঁজে নিতে পারবে। 

অবশেষে আরেকটা রিজের মাথায় চড়ে থামলো তামের, হাত তুলে ওপারটা দেখালো। ওদের নিচে ফাঁক বা গহ্বরের পাঁচিল দেখতে পেল নিকোলাস। সেই ফাঁকা জায়গাটাও চোখে পড়লো, ডোরাকাটা খুদে ডিক-ডিক যেখানে বেরিয়ে আসে। ডানডেরা নদীর ওপারে কাঁটাগাছটাও চিনতে পারল, ওটার আড়ালে বসে থাকার সময় মেকের গেরিলারা বন্দি করেছিল ওদের। 

তামেরকে বোতল থেকে পানি খেতে দিল নিকোলাস, তারপর নিজে খেলো। ঢাল বেয়ে নামার আগে রিগবি রাইফেলটা চেক করলো, লেন্স থেকে ধুলো মুছলো। চেম্বারে এক রাউন্ড গুলি ভরে সেট করলো সেফটিক্যাচ। আমার পেছনে থাকবে, নির্দেশ দিল ছেলেটাকে।

ঢাল বেয়ে নামছে নিকোলাস, কয়েক কদম পরপর সামনের ও দু পাশের কাঁটা ঝোঁপ পরীক্ষা করার জন্য থামছে। এভাবে ঝরনারটার মাথায় পৌঁছে গেল ওরা। এদিকের জমিন নরম ও ভেজা ভেজা। পশু-পাখিরা এখানে পানি খেয়েছে। কুডু আর বুশবাক-এর পায়ের ছাপ চিনতে পারলো নিকোলাস। তবে ওগুলোর মাঝখানে খুদে হৃৎপিণ্ড আকৃতির ছাপও আছে।

ঝোঁপ লক্ষ্য করে নিঃশব্দ পায়ে এগুলো নিকোলাস। ভেতরে ঢুকতেই বিষ্ঠার একটা তূপ দেখতে পেল, ডিক-ডিক তার নিজস্ব এলাকার সীমানা চিহ্নিতকরণের জন্য বাউন্ডারি পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করে। খুদে বুলেট আকৃতির বিষ্ঠা, ডিক-ডিক এদিকে এলেই স্যুপটা আকারে আরেকটু বড় হয়। 

শিকারের খোঁজে মগ্ন হয়ে পড়লো নিকোলাস, মনোযোগের মাত্রা দেখলে মনে হবে মানুষখেকো সিংহের পিছু নিয়েছে। প্রতিবার কয়েক ইঞ্চি এগুচ্ছে, পা ফেলার আগে দেখে নিচ্ছে সামনে শুকনো পাতা বা ডাল আছে কিনা, চোখের চঞ্চল দৃষ্টি দ্রুত বেগে আশপাশের ঝোঁপের ভেতর ঘোরাফেরা করছে। 

একটা কান সামান্য একটু নাড়তে ধরা পড়ে গেল ডিক-ডিক। শরীরের অর্ধেকে ছায়া পড়েছে, গায়ের লালচে রঙ পেছনের শুকনো ডালের সঙ্গে মিশে এক হয়ে আছে, এমন স্থির যেনো মেহগনি খোদাই করে বানানো একটা মূর্তি। ওই একবার শুধু কান নড়ে ওঠায় ধরা পড়লো অস্তিত্ব। তারপর অবশ্য নাকটাও একটু কোঁচকাল, যেনো অস্বস্তিবোধ করছে। সম্ভবত বিপদ সম্পর্কে সচেতন, তবে জানে না। কোনোদিক থেকে আসবে। 

ধীরে ধীরে রাইফেলটা কাঁধে তুললো নিকোলাস। লেসের ভেতর দিয়ে দুই শিং-এর মাঝখানের প্রতিটি রোম দেখতে পাচ্ছে। গলা আর মাথার মাঝখানে ক্রস হেয়ার সেট করলো, চামড়াটার ক্ষতি করতে চায় না।

ওই তো, ওই তো! নিকোলাসের কনুইয়ের কাছ থেকে তার স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল তামের! সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্টকে অভিনন্দন, পবিত্র প্রাণী দেখা দিয়েছে!

বাদামী ধোঁয়ার মতো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ডিক-ডিক, লেন্স থেকে চোখ সরাবার পর নিকোলাস শুধু ঝোঁপের দু একটা ডাল সামান্য নড়তে দেখলো। কাঁধ থেকে রাইফেলটা ধীরে ধীরে নামিয়ে তামেরের দিকে তাকালো ও। এটা কি করলে তুমি? 

ধমক খেয়ে মাথা নিচু করলো তামের। 

এরপর একাই এগুলো নিকোলাস, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলো। ক্যাম্পে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল ওদের। ক্যাম্পফায়ারের কাছে থামতেই ছুটে এলো রোয়েন। কী ঘটল? ডিক-ডিককে দেখা গেছে? 

আপনার ভক্তকে জিজ্ঞেস করুন। ওই ভাগিয়ে দিয়েছে।

তামেরের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর শুরু করলো রোয়েন। 

তোমাকে নিয়ে সত্যি আমি গর্বিত, তামের। শুনে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করলো ছেলেটা, কুকুরছানার মতো লাফাতে লাফাতে মঠের পথ ধরল। 

নিকোলাসের জন্য কফি নিয়ে এলো রোয়েন, আগুনের সামনে ওর পাশে বসলো। বার দুয়েক তাকিয়েই কিছু একটা সন্দেহ হলো নিকোলাসের, জিজ্ঞেস করলো, কিছু একটা হয়েছে। কী? 

আগুনের ওদিকে বসে রয়েছে বোরিস, চট করে তাকে একবারের দেখে নিল রোয়েন, তারপর নিকোলাসের আরো কাছে সরে এসে গলা খাদে নামাল, মেকের সঙ্গে দেখা করার জন্য টিসেকে নিয়ে মঠে গিয়েছিলাম। টিসে অনুরোধ করাতেই যেতে হয়েছিল। কী বলছি বুঝতে পারছেন তো? টিসে একা গেলে বোরিস সন্দেহ করবে, তাই। 

বুঝব না কেন। 

ওদের দু জনকে নিরিবিলিতে কথা বলার সুযোগ করে দিই, বলল রোয়েন। তবে তার আগে ওদের সঙ্গে তিমকাত উৎসব সম্পর্কে আলাপ হয় আমার। উৎসবের পঞ্চম দিনে প্রধান পুরোহিত টাবট নিয়ে অ্যাবেতে নামেন। মেক আমাকে বললেন, পাহাড়-প্রাচীরের গা বেয়ে পানির কিনারা পর্যন্ত নামার একটা পথ আছে। 

হ্যাঁ, জানি আমরা। 

যেটা আপনি জানেন না-নদীতে নামার মিছিলে সবাই থাকে। সবাই মানে, সব্বাই। প্রধান পুরোহিত, সব কয় জন পুরোহিত, শিক্ষানবিস উপাসকরা, প্রতিটি সত্যিকার বিশ্বাসী, এমন কি মেক আর তার লোকজনও। শুধু যে নদীতে নামে তাই নয়, রাতটা ওরা ওখানে কাটায়। সারাটা দিন ও রাত মঠ একদম খালি পড়ে থাকে। 

হাসি ফুটল নিকোলাসের মুখে। ইন্টারেস্টিং তো! 

ভুলবেন না, আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, হিসহিস করে বলল রোয়েন। ভুলেও আমাকে ফেলে যাবার কথা ভাববেন না! 

*

সেদিনের রাতের খাবারের পর রোয়েনের তাঁবুতে গেল নিকোলাস। ওখানে ছাড়া আর কোথাও একা কথা বলার উপায় নেই। এবারে, অবশ্য রোয়েনের বিছানায় বসার মতো বোকামি করলো না সে। রোয়েন বসলো একপ্রান্তে, নিকোলাস একটা মোড়ায় ওর দিকে মুখ করে। 

যে কোনো রকম পরিকল্পনা করার আগে একটা বিষয়ে বলে নিতে চাই। আপনি জানেন, ধরা পরলে কী ঘটবে? 

মানে সন্ন্যাসীরা যদি হাত নাতে ধরে ফেলে? রোয়েন জানতে চায়। 

সবচেয়ে কম কিছু করলেও এ উপত্যকা থেকে আমাদের বের করে দেবে ওরা। প্রধান পুরোহিতের দারুণ ক্ষমতা। আর খারাপ কিছু হলে ধরে পেটাবে আর কি। নিকোলাস বলে চলে, তাদের ধর্মে এটা সবচেয়ে পবিত্র স্থান; ব্যাপারটা হালকা করে দেখবেন না। বিপদের পরিমাণ কম নয়। এমনও হতে পারে ছুরি খেলাম, না হয় খাবারে বিষ দিয়ে মারলো। 

আমরা টিসেকেও হারাবো। সে তো ধার্মিক মেয়ে, রোয়েন বলে। 

আর মেক নিমুর তো খেপে যাবেই। মনে হয় না এর পরে আমাদের বন্ধুত্ব আর টিকে থাকবে। 

চুপচাপ বসে রইলো ওরা দু জন। শেষমেষ নিকোলাস নীরবতা ভাঙে। 

তো, বুঝলেন তো কি অবস্থা। আপনি একনিষ্ঠ খ্রিস্টান- আপনাদের গির্জাতেই তো আমরা চুরি করে ঢুকছি। এ বিষয়ে কী বলেন?

আমি ভেবেছি এ নিয়ে, রোয়েন স্বীকার করে। তবে এটা ঠিক আমার চার্চ নয়। কপটিক খ্রিস্টানদের। 

মানে শুধু বিভেদ। 

মিশরীয় কোনো চার্চে এমনকি সবচেয়ে পবিত্র স্থানেও কারোর ঢুকতে বাধা নেই। কাজেই, প্রধান পুরোহিতের নিষেধাজ্ঞা আমি কেয়ার করি না। একজন একনিষ্ঠ খ্রিস্টান হিসেবে গির্জার যে কোথাও যাবার অধিকার আমার আছে বৈকি। 

মৃদু শিষ দিয়ে ওঠে নিকোলাস। আপনিই না বলেছিলেন, আমার ল ইয়ার হওয়া উচিত!

দেখুন, এসব নিয়ে তামাশা করবেন না। একটাই কথা- ওখানে আমাকে যেতেই হবে। এমনকি, টিসে, মেক কিংবা পুরোহিত রুষ্ট হোক- কিছু যায় আসে না।

এমনও হতে পারে, আপনার হয়ে আমি করলাম কাজটা। নিকোলাস পরামর্শ দেয়। আমি হলাম গিয়ে পাপী বান্দা। কাজেই আমার পরিত্রাণের কোনো ব্যাপার তো নেই। 

না, সজোরে মাথা নাড়ে রোয়েন। কোনো ধরনের খোদাই করা বাণী থাকতে পারে- আমাকে তা দেখতেই হবে! আপনি ভালো হায়ারোগ্লিফিক পারেন না। আপনি অ্যামেচার, আমি প্রফেশন্যাল। আমাকে ওখানে থাকতেই হবে। 

ঠিক আছে। তাহলে আপনি যাবেন। আত্মসমর্পণের সুরে বলে নিকোলাস। এবারে পরিকল্পনার পালা। কিছু জিনিস লাগবে আমাদের ফ্ল্যাশলাইট, ছুরি, পোলারয়েড ক্যামেরা, বাড়তি ফিল্ম 

আর্ট পেপার, আর নরম পেন্সিল- ছাপ নেওয়ার জন্য, রোয়েন যোগ করে।

ওহ্ হো! ওগুলো তো আনি নি!

দেখলেন তো- আপনি অ্যামেচার! 

গভীর রাত পর্যন্ত আলাপ করে চললো ওরা। শেষমেষ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিক। 

অনেক রাত হয়েছে। ঘুম আসছে আমার। শুভরাত্রি।

এখনো দু দিন বাকি উৎসবের। এ সময়ে কী করার প্ল্যান আপনার? 

আগামীকাল আবারো সেই অ্যান্টিলোপ ডিক-ডিকের পেছনে ছুটছি আমি, নিক বলে। 

আমিও আসছি আপনার সাথে, দৃঢ়তা নিয়ে বলে রোয়েন, এ বিষয়ে আর আপত্তির কোনো সুযোগ নেই। 

শুধু যদি তামেরকে রেখে আসেন, তবেই, বলে, তবু ছেড়ে বেরিয়ে এলো নিকোলাস। 

*

ঘন কাঁটাঝোঁপের গাঢ় ছায়া থেকে খুদে হরিণটা বেরিয়ে আসতেই সকালের নরম রোদ লেগে রোমগুলো মসৃণ সিল্কের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সরু ফাঁকা জায়গাটা ধরে দ্বিধাহীন হেঁটে আসছে। 

রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে তৈরি নিকোলাস। রিগবিতে মেটাল জ্যাকেট বুলেট ভরেছে, লাগলে ক্ষতটা চওড়া হবে না, বের হওয়ার সময় বড় গর্ত তৈরি করবে না। 

ফাঁকা জায়গাটার পাশের কয়েকটা ঝোঁপের দিকে এগিয়ে এলো ডোরাকাটা ডিক-ডিক। নিচু একটা ঝোঁপের উপরের কুচি পাতা ছিঁড়ছে দাঁত দিয়ে। নিস্তব্ধ সকালে বিকট আওয়াজ করলো রাইফেল। ঝোঁপ থেকে শূন্যে লাফ দিল খুদে হরিণ, মাটিতে পড়ার আগেই ছোটার ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে পা ছুঁড়ছে। সলিড বুলেট এতো জোরে আঘাত করে নি যে ছিটকে পড়ে যাবে ডিক-ডিক। হৃৎপিণ্ডে বুলেট নিয়ে ছুটলো ওটা। মারা গেছে এরই মধ্যে, ছুটছে রিফ্লেক্সের বশে, রক্তস্রোতে অবশিষ্ট অক্সিজেনের জোরে। 

সর্বনাশ! না, ওদিকে না! লাফ দিল নিকোলাস। খুদে প্রাণীটি সোজা খাদের কিনারা লক্ষ্য করে ছুটছে। অন্ধের মতো শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, পতনের সময় ডিগবাজি খেলো, অদৃশ্য হয়ে গেল ওদের দৃষ্টিপথ থেকে, নেমে যাচ্ছে প্রায় দুশো ফুট গভীর ডানডেরা নদীর গহ্বরে। ছুটে এসে কিনারায় দাঁড়ালো নিকোলাস, পিছু নিয়ে এলো রোয়েনও। 

হাত দিয়ে রোয়েনই দেখালো, ওই যে, ওই যে, দেখতে পাচ্ছি।

ডিক-ডিক সরাসরি ওদের নিচে পড়ে রয়েছে। করুণ চোখে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস। তবে এক সেকেন্ড পরই ওর চেহারায় জেদ ফুটে উঠলো। মারতে যখন পেরেছি, তুলে আনতেও পারব। চলুন, আপাতত আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাই। 

*

বিকেলে আবার ফিরে এলো ওরা, সঙ্গে বোরিস, দু জন ট্র্যাকার ও দু জন স্কিনার। সঙ্গে করে ওরা নাইলনের চারটে কয়েল নিয়ে এলো। প্রথমইে খাদের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে ডিক-ডিককে দেখে নিল নিকোলাস, ভয় হচ্ছিল স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেল কিনা। তারপর কয়েলের রশি ফাঁকা জায়গাটায় লম্বা করে ফেলে সাজাবার কাজে সাহায্য করলো ট্র্যাকারদের। দুটো কয়েলের রশি জোড়া লাগিয়ে গিটটা খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করলো নিকোলাস। খাদের নিচে রশি ফেলা হলো, প্রান্তটা পানির সারফেস ছুঁতে তুলে আনা হলো আবার। 

একশো আশি ফুট, মাপ শেষ করে বলল ও। ত্রিশ ফ্যাদম। বোরিসের দিকে তাকালো। রশি বেয়ে এতোটা উপরে ওঠা সম্ভব নয়, আপনারা আমাকে টেনে তুলবেন। 

মোটা একটা কাঁটাগাছে বাঁধা হয়েছে রশিটা। পরনে শুধু শার্ট আর খাকি শর্টস। খাদের ঠোঁটে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে হেলান দিল নিকোলাস, রশিটা কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলে আছে, লেহের অংশটুকু ফিরিয়ে আনা হয়েছে দু পায়ের মাঝখানে। পেছন ফিরে গহ্বরে লাফ দিল, পতন নিয়ন্ত্রণ করছে কাঁধের উপর দিয়ে রশি ছেড়ে, ব্রেক করার প্রয়োজন হলে উরুতে পেঁচিয়ে নিচ্ছে। পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে নিকোলাস, দু পায়ের সাহায্যে পাথুরে পাঁচিল থেকে দূরে রাখছে। নিজেকে। দ্রুত নেমে এলো নিচে, পা দুটো ডুবে গেল তীব্র স্রোতে, রশির মাথার লাটিমের মতো ঘুরছে শরীরটা। যে পাথরটার উপর পড়ে আছে ডিক-ডিক, সেটার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে রয়েছে ও কাজেই পানিতে নামতে বাধ্য হলো। রশির শেষ প্রান্ত দাঁত দিয়ে ধরে থাকলো, দূরত্বটুকু পেরিয়ে এলো সতরে। 

খুদে পাথুরে দ্বীপটায় উঠে এসে খানিক দম নিল নিকোলাস। তারপর ডিক ডিকের চার পা এক করে বাঁধলো। পিছিয়ে এসে মুখ তুলে তাকালো উপরে। গহ্বরের মাথা থেকে উঁকি দিয়ে ওকে দেখছে বোরিস। টানুন! চিৎকার করলো নিকোলাস, রশিটা তিনবার ঝাঁকালো। টান টান হলো নাইলন, ঝাঁকি খেয়ে দ্বীপটা থেকে শূন্যে উঠে পড়লো ডিক-ডিক, গহ্বরের পাঁচিল ঘেঁষে দ্রুত উঠে যাচ্ছে ওপরে। তিন ভাগের দুই ভাগ উঠে গেছে, এ সময় কোথাও আটকাল রশিটা, তবে একটু পর নিজেই মুক্ত হলো, সাপের মতো এঁকেবেঁকে খাদের কিনারায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

বেশ খানিক পর নিচে নেমে এলো রশিটা, বুদ্ধি করে বড় তরমুজ আকৃতির একটা পাথর বেঁধে দিয়েছে বোরিস। খাদের কিনারা থেকে নিচে তাকিয়ে রশির নামাটা দেখছে সে, ইঙ্গিতে নির্দেশ দিচ্ছে নিজের লোকজনকে। রশিটা ধরে একটা লুপ তৈরি করলো নিকোলাস, বগলের তলায় ঢুকিয়ে নিল সেটা, মুখ তুলে ইঙ্গিত দিল বোরিসকে। টান টান হলো রশি, পাথরের উপর থেকে শূন্যে উঠে পড়লো ওর পা। ঝাঁকি খেতে খেতে উঠে যাচ্ছে উপরে। খাদের কিনারা থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে পৌচেছে, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল রশি। পাথরের গায়ে অসহায়ভাবে ঝুলছে ও। কি ঘটেছে? বোরিসকে জিজ্ঞেস করলো। 

শালার রশি কোথাও আটকে গেছে, পাল্টা চিকা রকরলো বোরিস। কোথায় আটকেছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন? 

নিকোলাসের দৃষ্টি রশি অনুসরণ করলো। সরু ও লম্বা একটা ঠাটলে ঢুকেছে রশিটা, সম্ভবত ডিক-ডিককে তোলার সময়ও এটাতেই আটকে ছিল। তবে ডিক ডিকের তুলনায় নিকোলাসের ওজন বহুগুণ বেশি, ফলে ফানেলের ভেতর রশিটা অনেক বেশি সেঁধিয়ে গেছে। শূন্যে ঝুলে রয়েছে ও, প্রায় একশো ফুট নিচে নদী আর পাথরের দ্বীপ। 

দোল খান, ঝাঁকি দিন, উপর থেকে চিৎকার করলো বোরিস। 

সে চেষ্টাই করছে নিকোলাস। গহ্বরের গায়ে পায়ের ধাক্কা দিয়ে রশিটাকে যতটা সম্ভব নাড়াচাড়া করছে, পাক খেয়ে মোচড়াচ্ছে। এক সময় ঘাম ছুটে গেল, বগলের তলায় রশির ঘষা লাগায় জ্বালা করছে চামড়া। লাভ হচ্ছে না, বোরিসকে জানালো।টেনেই তুলতে হবে। জোর লাগান, যতটা পারা যায়। 

কয়েক সেকেন্ড পর ঠাটলটার উপরের রশি লোহার মতো শক্ত ও টান টান হলো, পাঁচজন লোক যত জোরে পারা যায় টানছে। ফাটলের নিচের রশি এক চুল নড়ছে না। বজ্র আটুনি একেই বলে, বের করে আনা সম্ভব নয়। নিচে তাকিয়ে চিন্তা করছে নিকোলাস। একটা মানুষের পতনের গতি ঘণ্টায় একশো পঞ্চাশ মাইল। এ গতিতে পানিতে নামা আর নিরেট কংক্রিটে নামা একই কথা। 

আবার উপরে তাকালো নিকোলাস। লোকগুলো এখনো সর্বশক্তি দিয়ে রশি টানছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফাটলার ধারালো কিনারা রশির একটা রোয়া কেটে দিল, রশির গা থেকে লম্বা সবুজ পোকার মতো আলগা হয়ে আসছে। আঁতকে উঠে চিৎকার দিল নিকোলাস, থামুন, টানবেন না! কিন্তু বোরিসকে দেখা যাচ্ছে না, ট্র্যাকারদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে নিজেও রশি টানছে সে। 

দ্বিতীয় রোয়াও ছিঁড়ে গেল। এখন মাত্র একটা রোয়ায় ঝুলছে নিকোলাস। ওটাও যে কোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে, বুঝতে পারলো ও। রুশ কুত্তা, কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস-থাম, শালা! টানবি না! থাম! কিন্তু ওর গলা বোরিসের কানে পৌঁছায় নি। শ্যাম্পেনের ছিপি খোলার মতো পপ করে একটা শব্দ হলো, রশির তৃতীয় ও শেষ ব্লোয়াটা ছিঁড়ে গেল। 

খসে পড়ছে নিকোলাস। পাথুরে দ্বীপটার কথা ভাবছে। ওটার উপর পড়বে নাকি? শরীরের একটা হাড়ও তাহলে আস্ত থাকবে না। আর যদি পানিতে পড়ে, নির্ঘাত পাঁজর আর শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে। 

পানিতে পা দিয়ে পড়লো নিকোলাস, তার আগে বুক ভরে বাতাস নিয়ে ফেলেছে। আঘাতটা প্রচণ্ড, শরীরের প্রতিটি হাড় যেনো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খেলো। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেলো, বন্ধ চোখের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো উজ্জ্বল আলো। নদী ওকে ঢেকে ফেলেছে। তলিয়ে গেল গভীরে। গতিটা এখনো এতো বেশি, তলায় পৌঁছে যে ধাক্কাটা খেলো, মনে হলো পা ও কোমর ভেঙে শরীরের বাকি অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। 

তলায় বাড়ি খেয়ে উপরে উঠছে নিকোলাস, উপলব্ধি করলো পা ও কোমর অটুটই আছে। ইতোমধ্যে ফুসফুস খালি হয়ে গেছে, বাতাসের অভাবে ছটফট করছে ও। পানির উপর মাথা তুললো কাশতে কাশতে। 

প্রবল স্রোতের মধ্যে গা এলিয়ে দিল নিকোলাস, মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ থেকে পানির সরালো। গহ্বরের পাঁচিল দুটো দ্রুতবেগে পিছিয়ে যাচ্ছে, আন্দাজ করলো দশ নট গতিতে ভেসে যাচ্ছে ও। এ গতিতে কোনো পাথরে বাড়ি খেলে হাড়গোড় 

ভাঙার কোনো কারণ নেই। কথাটা যখন ভাবছে, আরেকটা পাথুরে দ্বীপ পাশ কাটালো ওকে, হাত বাড়ালে ছুঁতে পারতো। চিৎ হলো নিকোলাস, পা দুটো মেলে দিল সামনে। পাথর দেখলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে। 

মনে মনে একটা হিসাব পাবার চেষ্টা করছে নিকোলাস, গহ্বরের সরু ও লালচে পাথরের খিলান হয়ে নিচে লাফ দিয়েছে নদী, সে জায়গা থেকে ঠিক কতটা দূরে রয়েছে ও। তিন কি চার মাইল তো হবেই, আন্দাজ করলো। আর নদী ওখানে প্রায় এক হাজার ফুট লাফ দিয়েছে। সামনে নদীর তলায় ঢাল ও উতরাইও না থেকে পারে না, ফলে তীব্র জলাবর্ত আর আলোড়নের মধ্যে পড়তে হবে ওকে একটু পরেই।

উপরে তাকালো নিকোলাস। দু দিকের পাঁচিল পরস্পরের দিকে কাত হয়ে পড়েছে। ফলে কোথাও কোথাও সরাসরি ওর মাথার উপর প্রায় এক হয়ে গেছে। শুধু এক ফালি সরু নীল আকাশ দেখা যায়, গহ্বরের ভেতরটা প্রায়-অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। ভাগ্য ভালো যে এটা বর্ষার মরশুম নয়। ওর মাথা থেকে পনেরো কি বিশ ফুট ওপরে। পাথরের গায়ে গতবারের বন্যা তার চিহ্ন রেখে গেছে। 

কিছুক্ষণ পর ক্যানিয়নে নদীর কলকল ছলছল ছাড়াও নতুন একটা আওয়াজ শুনতে পেল নিকোলাস। ভোতা, গুরুগম্ভীর একটা শব্দ, যতই এগুচ্ছে, ততই বাড়ছে। গহ্বরের পাঁচিল পরস্পরের দিকে সরে এসেছে, সেই সঙ্গে নদীর স্রোতও এখন সংকীর্ণ একটা পথ দিয়ে ছুটছে, ফলে স্বভাবতই গতিও অনেক বেড়ে গেল। পানির আওয়াজ দ্রুত বজ্রপাত বা কামান দাগার বৈশিষ্ট্য অর্জন করছে, সমস্ত শব্দ পতিধ্বনিত হচ্ছে ক্যানিয়নের ভেতর। উপুড় হলো নিকোলাস, সবটুকু শক্তি কাজে লাগিয়ে স্রোতের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে কাছাকাছি পাথুরে পাঁচিলে পৌঁছল। কিন্তু লাভ হলো না, হাত দিয়ে ধরা যায় এমন কিছু নেই, পাথরের গা পিচ্ছিল ও মসৃণ করে রেখেছৈ নদী। স্রোতের দুর্বার টানে ভেসে চলেছে নিকোলাস, তাকিয়ে দেখলো চারপাশের পানি নিরেট কাঁচের মতো সমতল ও মসৃণ। নদী যেনো জানে সামনে কি অপেক্ষা করছে, এ তারই প্রস্তুতি।

পাঁচিলের কাছ থেকে সরে এলো নিকোলাস, আবার ভাটির দিকে পা করলো। অকস্মাৎ ওর নিচে বাতাস ভরা একটা জগৎ উন্মোচিত হলো, শরীরটা নিক্ষিপ্ত হলো শূন্যে। ওর চারপাশের বাতাস সাদা ফেনাময় পানিতে ভরে উঠলো। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, বিপুল জলরাশির অবিরাম পতন ঝরা একটা পাতার মতো কোথায় কে জানে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। 

পতনটা মনে হলো অনন্তকাল ধরে চলছে। তারপর এক সময় আরেকবার পানিতে পড়লো নিকোলাস, ডুবে গেল সারফেস থেকে অনেক গভীরে। ওঠার সময় পানির সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হলো, বাতাসে চোখ খোলার পর দেখলো জলপ্রপাতের নিচে একটা ঘূর্ণির গভীর গর্তের ভেতর রয়েছে ও। ঘূর্ণির ভেতর পনি ঘুরছে, এটা একটা গতি, আরেকটা গতি স্রোতের টানে ঘূর্ণির ছুটে চলা। 

ঘুরপাক খাচ্ছে নিকোলাস। ওপরে তাকাবার সুযোগ হলে এ প্রথম জলপ্রপাতের সাদা পানি দেখতে পেল, মেলে দেওয়া বিশাল চাদরের মতো লাগলো দেখতে। আর সামনে তাকাতে দেখতে পেল সরু একটা নির্গমণ পথ, বেসিন থেকে ওই পথ দিয়েই উন্মত্ত নদী ভাটির দিকে ছুটে চলেছে। স্রোতের টানে যতই সামনে এগুচ্ছে, ঘূর্ণিটার গভীরতা ততই কমে আসছে। আপাতত নিরাপদ মনে হলো নিজেকে ওর। ঘূর্ণি নিস্তেজ হয়ে আসায় বেসিনের কিনারায় সরে এলো, পাঁচিলের ফাটলে বেড়ে ওঠা ঝোঁপের ডাল ধরে বিশ্রাম নিচ্ছে। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো নিকোলাস। পাঁচিল বেয়ে পাহাড়ের মাথায় ওঠার কোনো উপায় নেই। বাঁচার চেষ্টা করতে হবে নদীর গতিপথ ধরে ভাটির দিকে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে। পাহাড়ী নদীর তলায় চড়াই-উত্রাই থাকাটা স্বাভাবিক, ফলে স্রোতের গতি বেড়ে যেতে পারে, কোথাও হয়তো পানিতে তুমুল আলোড়ন উঠবে। আরো জলপ্রপাত থাকাও বিচিত্র নয়। 

পাহাড় বেয়ে ওঠার কি কোনো উপায়ই নেই? পাঁচিল ধরে আরেকবার নিকোলাসের দৃষ্টি উপরে উঠে গেল। অনেক উপরে একটা পাথর ঝুলে আছে, দেখতে ক্যাথেড্রা-এর উঁচু ছাদের মতো। পাঁচিলের গায়ে চোখ বুলাচ্ছে, কিছু একটা ধরা পড়লো চোখে। ছকে বাঁধা ও সাজানো মনে হলো, প্রাকৃতিক হতে পারে না। 

দু সারি গাঢ় দাগ, পাথুরে পাঁচিল ধরে পানির সারফেস থেকে উপর দিকে উঠে গেছে, একেবারে সেই দুশো ফুট উপরের কিনারা পর্যন্ত। ঝোঁপের ডালপালা ছেড়ে দিয়ে সাবধানে ও ধীরগতিতে পানি কেটে এগুলো নিকোলাস, পৌঁছল যেখানে দাগগুলো পানির নাগাল পেয়েছে। কাছে এসে বুঝতে পারল, এগুলো দাগ নয়, পাথর কেটে তৈরি করা প্রতিটি চার বর্গইঞ্চি কুলুঙ্গি বা ফোকর। সারি দুটোর মাঝখানে বারো ফুটের মতো ব্যবধান, তবে প্রতি সারির কুলুঙ্গি অপর সারির কুলুঙ্গির সঙ্গে একই সরল রেখার উপর তৈরি। একটার ভেতর হাত গলালো নিকোলাস, কনুই পর্যন্ত ঢোকানো যায়। ওয়াটার মার্কের নিচের ফোকরগুলো ক্ষয়ে গেছে, ফলে হাতের ছোঁয়ায় মসৃণ লাগলো কিনারাগুলো। তবে পাঁচিলের উপর দিকে, ওয়াটার মার্ক ছাড়িয়ে, আকৃতিগুলো স্পষ্ট, পুরোপুরি চৌকো আর ধারালো। 

একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করলো মাথায়। কতদিনের পুরনো ওগুলো? পাথর কাটার জন্য এখানে কাউকে নামতে হয়েছে, কীভাবে নামলো? এতো কষ্ট করে এগুলো তৈরি করার কারণই বা কী? নিচে এখানে কী আছে? 

তারপর হঠাৎ নিকোলাসের চোখে আরো একটা জিনিস ধরা পড়লো। পাথরে বৃত্তাকার একটা খাঁজ, দুই সারি কুলুঙ্গির ঠিক মাঝখানে, বর্ষা বা বন্যার পর থেকে যাওয়া জলচিহ্নের অনেকটা ওপরে। নিচে থেকে সম্পূর্ণ গোল দেখাচ্ছে, প্রাকৃতিক নয় এমন আরো একটা আকৃতি। 

সাঁতার দিয়ে বার কয়েক জায়গা বদল করলো নিকোলাস, বিভিন্ন কোণ থেকে জিনিসটাকে দেখছে। পাথর খোদাই করে তৈরি বলে মনে হলো, তবে আলো খুব কম থাকায় মানুষের হাতের কাজ কিনা নিশ্চিত হতে পারলো না। ডিজাইনটার মধ্যে ছবি বা সংকেত যদি থাকেও, এখান থেকে দেখার উপায় নেই। কুলুঙ্গিতে পা রেখে খানিকটা ওঠার চেষ্টা করলো নিকোলাস, কিন্তু পারলো না। একটার সঙ্গে আরেকটার দূরত্ব এতো বেশি যে একটয় পা রাখার পর হাত দিয়ে দ্বিতীয়টার নাগাল পাওয়া কঠিন। চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিবার নদীতে পড়ে গেল ও। 

নদীর পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা, নিকোলাসের দাঁত পরস্পরের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে। তীব্র স্রোতের টানে সরু নির্গমন পথের দিকে এগুচ্ছে, ওই পথ ধরে জননী নীলনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সমস্ত ব্যাকুলতা নিয়ে ছুটে চলেছে ডানডেরা। 

নদীর তলা এখানে সাংঘাতিক ঢালু, পানির গতি ক্রমশ বাড়ছে। একের পর এক তীব্র আলোড়নের মধ্যে পড়লো নিকোলাস, নদী যেনো এখানে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচে নেমেছে। তারপর এক সময় খানিকটা শান্ত হলো পানি, চিৎ সাঁতার দিচ্ছে নিকোলাস। বিশ্রাম নেওয়ার এ সুযোগ ছাড়া যায় না, তাকিয়ে আছে উপরে। 

উপরে আলো খুব কম। কারণ, মাথার উপর পাথরের পাঁচিল প্রায় এক হয়ে মিশে আছে। বাতাসে ভ্যাপসা গন্ধ, ডানা ঝাঁপটাচ্ছে অসংখ্য বাদুড়। তবে চারদিকটা ভালো করে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না, সামনে থেকে আবার নদীর গর্জন ভেসে আসছে। ঢাল বেয়ে নিচের দিকে ছুটে চলেছে ডানডেরা, খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিকোলাসকে। খানিক পর দিশেহারা করে তুললো ওকে, কত দূর বয়ে নিয়ে এলো হিসাব নেই, হিসাব নেই সব মিলিয়ে মোট কয়টা জলপ্রপাত পার হলো। 

অকস্মাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল চারদিক। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসায় মনে হলো কেউ যেনো সরাসরি ওর চোখে সার্চলাইট তাক করেছে। রোদ লাগায় চোখ কোঁচকাল নিকোলাস, তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো ফ্যাকাসে লাল পাথরের খিলানের নিচ দিয়ে ভেসে এসেছে ও। পাহাড়ের এ অংশটুকু ওর চেনা, রোয়েনের সঙ্গে দেখে গেছে। ওর সামনে রয়েছে রশি দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত ব্রিজ। ক্লান্ত শরীরটা কোনো রকমে ছোট্ট সৈকতের সাদা বালির দিকে তাকালো। ক্রল করে এগুবে, সে শক্তিও অবশিষ্ট নেই। বমি করলো নিকোলাস, শরীরের অর্ধেকটা এখনো নদীতে। 

অন্তত বেঁচে আছি, বলে জ্ঞান হারালো নিক। 

*

কাঁধে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙল নিকোলাসের। সুন্দরী মেম সাহেব আপনার নাম ধরে ছুটোছুটি করছেন আর কাঁদছেন! জেগে উঠুন, সাহেব, উঠুন! চোখ মেলে তাকালো নিকোলাস, তামেরকে দেখে বালির উপর উঠে বসলো। একই সঙ্গে কেউ হাসতে ও কাঁদতে পারে, তামেরকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না ও। বেঁচে আছে মনে পড়ে যাওয়ায় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলো, দ্রুত পরীক্ষা করে দেখে নিল হাড়গোড় সব ঠিক আছে কিনা। সন্তুষ্ট হয়ে চোখ তুললো, দেখলো পাহাড়ের ঠোঁটের কাছে মোটাসোটা আর লাল দেখাচ্ছে সূর্যটাকে। তার মানে সময়টা শেষ বিকেল।

উঁচু পাড় বেয়ে ওঠার পর সরু পথ পাওয়া গেল, ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে পৌঁছল ওরা। ছুটে আসছিল রোয়েন, উল্লাসে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিকোলাসকে। বেঁচে আছেন! আপনি বেঁচে আছেন! হাসছে বটে, তবে চোখে জল।

আমাকে চেনেন না? দশ ফুট লম্বা, বুলেটপ্রুফ। তবে সত্যি কথা বলতে কী, বেঁচে আছি শুধু আপনার এ আলিঙ্গনের লোভে। 

তাড়াতাড়ি নিকোলাসকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল রোয়েন। অন্য কোনো অর্থ করবেন না আবার! 

রোয়েনের কাছ থেকে জানা গেল, ভাটির দিকে নিকোলাসের লাশ খুঁজছে বোরিস আর তার ট্র্যাকারেরা। আর নিকোলাসের ডিক-ডিকটাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে স্কিনাররা। 

ছাল ছাড়াবার সময় ওখানে আমার থাকা দরকার! বলল নিকোলাস, তামেরের কাঁধে হাত রেখে ছুটলো। দেখা যাক সময়মতো পৌঁছতে পারি কি না! 

*

সন্ধ্যার অন্ধকারে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। দু জন স্কিনার, কিফ আর সালিন, খেতে বসেছে। ওদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নিল নিকোলাস, তারপর গোসল সেরে কাপড়চোপড় পাল্টাল, ক্যানভাস রোল থেকে ছুরি বের করে চলে এলো স্কিনিং শেডে। ইতোমধ্যে ওখানে একটা গ্যাস লণ্ঠন জ্বালা হয়েছে। স্কিনাররা দাঁড়িয়ে থাকলো, নিকোলাস নিজেই ডিক ডিকের ছাল ছাড়াচ্ছে।

ভাবছি বাঁচলেন কীভাবে! দরজায় উদয় হলো বোরিস। নিকোলাস জবাব দিল না, একমনে কাজ করছে। এ আপনার ডোরাকাটা ডিক-ডিক? হঁদুর বললেই হয়! তবু নিকোলাস তাকাচ্ছে না। ইঁদুর শিকার শেষ হলো, এবার আমরা তাহলে আদ্দিস আবাবায় ফিরে যেতে পারি, কী বলেন? জানতে চাইলো সে। 

নিকোলাস তাকে মনে করিয়ে দিল, এটা ওর সাফারি, আর চুক্তি করা হয়েছে তিন সপ্তাহের জন্য। ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ ছেড়ে দরজার সামনে থেকে সরে গেল বোরিস। 

কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে নিকোলাস, দরজায় আরেকজনকে দেখা গেল। পরে আছে. পুরোহিতদের ঢোলা আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি, কথা বলা আগে তাকে . নিকোলাস চিনতে পারলো না। মঠে ওরা বলাবলি করছে, তুমি নাকি মনের গেছ, দোস্ত। যদিও বিশ্বাস করি নি, তবু নিশ্চিত হতে এলাম, বলে হাসলো কমান্ডার মেক। 

মুখ তুলে হাসলো নিকোলাস। ভেতরে এসো। 

ভেতরে ঢুকে নিকোলাসের পাশে বেঞ্চের উপর বসে পড়লো মেক। বোরিস সিলভকে কতদিন থেকে চেনো তুমি?

প্লেন থেকে নামার পর, জবাব দিল নিকোলাস। এক বন্ধু ওর নাম সুপারিশ করে। 

তোমার বন্ধু ভুল করেছে, বলল মেক। তোমাকে আমার সাবধান করা উচিত, দোস্ত। কেন সাবধান করা উচিত ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করলো সে। বছর দশেক আগে মেনজিসটুর গুণ্ডাপাণ্ডারা তাকে বন্দি করে আদ্দিসের কাছাকাছি কার্ল মার্ক্স কারাগারে রেখেছিল। ওখানে ইন্টারোগেটরদের একজন ছিল বোরিস। তখন কেজিবি-তে ছিল সে। কথা আদায় করার জন্য বন্দি বা বন্দিনীর পায়ুপথে প্রেশার হোস ঢুকিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিত। বন্দিরা ফুলতে থাকত, যতক্ষণ না তাদের নাড়িভূড়ি বিস্ফোরিত হয়। মেক পালিয়ে আসায় সে-যাত্ৰা বোরিসের হাত থেকে বেঁচে যায়। মেনজিসটু ক্ষমতা হারাবার পর কেজিবি থেকে অবসর নেয় বোরিস, সাফারি গাইড হিসেবে কাজ শুরু করে। 

প্রসঙ্গ বদলে মেক জানালো, দিনকাল খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিনা নোটিশে এ এলাকা ছাড়তে হতে পারে তাকে। আদ্দিসে এক ভদ্রলোক আছেন, নাম কর্নেল মরিয়ম কাদের, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন, তাঁকে নিকোলাস মেসেজ দিলে মেক পেয়ে যাবে। কোডনেম সোয়লো বললে মেককে চিনবেন তিনি। 

বিদায়ের সময় আগের প্রসঙ্গে আবার ফিরে এলো মেক। তোমাকে জানিয়ে রাখি, বোরিসকে আমার খুন করতে হতে পারে। 

বেশ কিছুসময় কেউ কোনো কথা বলল না। এরপর মেক নিমুর বলে, জীবন খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আজকাল, নিকোলাস। কখন যে কোথায় চলে যেতে হয়। কাজেই, আগে ভাগে বিদায় বলে নিচ্ছি। আদ্দিসে একজন লোক আছে আমার কখনো কিছু দরকার হলে তার কাছে খবর পাঠিও। কর্নেল মরিয়াম কাদের তার নাম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছেন। আমার জানের দোস্ত। আমার কোড হলো সোয়ালো। ওটা উচ্চারণ করলে ও তোমাকে চিনে নেবে। 

এরপর আলিঙ্গন করে বিদায় নিল মেক নিমুর। 

*

পরদিন সকালে ব্যথায় আড়ষ্ট শরীর নিয়ে স্কিনিং শেডে চলে এলো নিকোলাস। ছাড়ানো চামড়াটা পরীক্ষা করলো, নতুন করে লবণ মাখালো, তারপর কিফ আর সালিনকে নির্দেশ দিল ডিক-ডিকের খুলি পিঁপড়ের ঢিবিতে পুঁতে ফেলতে হবে, পিঁপড়েগুলো যাতে অবশিষ্ট মাংস খেয়ে ওটাকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে। 

ওখান থেকে ডাইনিং কুঁড়েতে চলে এলো নিকোলাস, ব্রেকফাস্ট সেরে রোয়েনকে নিয়ে বের হল মাছ ধরতে। ঝুলন্ত ব্রিজের কাছাকাছি ছিপ ফেললো ওরা। ব্রিজের উপর ফেকাসে লাল পাথরের খিলানটার দিকে হাত তুলে রোয়েনকে বলল, আপনাকে আসলে বোরিসের সামনে থেকে সরিয়ে আনার জন্য মাছ ধরতে। চেয়েছি। কাল ওদিকে কী দেখে এসেছি শুনুন। 

নিকোলাসের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো রোয়েন। ও থামতে জানতে চাইলো, ফোকরগুলো কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা? 

কি হতে পারে বুঝতে পারছি না। তবে বহু বছরের পুরানো ওগুলো। 

রাজমিস্ত্রীদের জন্য মাচা বা ভারা তৈরি করতে হলে এ ধরনের ফোকর দরকার হতে পারে, বলল রোয়েন। 

আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়! ব্যঙ্গ নয়, নিকোলাসের চোখে প্রশংসা।

দু একটা আইডিয়া আপনিও দিন। 

ধর্মীয় কোনো প্রতীক? কোনো সংকেত? রোয়েনের চেহারায় সন্দেহ দেখতে পেয়ে আবার বলল নিকোলাস, মানলাম, গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। 

একটা ঘাস ছিঁড়ে ডগাটা দাঁত দিয়ে কামড়ালো রোয়েন। ধরুন ফোকরগুলো কাটা হয় মাচা তৈরির জন্য। নদীর পাশে, পাহাড়ের গায়ে, মাচা কেন দরকার হবে? 

মাছ ধরার জন্য।

কিন্তু এ নদীতে মাছ খুব বেশি নেই, বলল রোয়েন। আর কিছু দেখেছেন?

দু সারি কুলুঙ্গির মাঝখানে গোল একটা আকৃতি। পাথর খোদাই করে তৈরি।

শিরদাঁড়া খাড়া করলো রোয়েন। লিপি, নাকি নকশা? 

মাথা নাড়লো নিকোলাস। আলো কম, অত উঁচুতে পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না, বলল ও। কাল তিমকাত উৎসব, মাগডাস-এ ঢোকার একমাত্র সুযোগ। এ কাজটা শেষ করার পর খাদে নেমে আরেকবার দেখতে হবে এগুলো। 

সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, নিকোলাস, বলল রোয়েন। 

আমিও তাই বলি.. ফিসফিস করে বলে নিকোলাস। কথাটার উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে ধুপধাপ পা ফেলে ওর পাশ থেকে উঠে চলে গেল রোয়েন। রাগ করেছে ভীষণ। 

*

ওদের জন্য দু জন তরুণ উপাসককে এসকর্ট হিসেবে পাঠিয়েছেন বিশপ, ভিড় সরিয়ে পথ তৈরি করবে তারা। কিন্তু দেখা গেল সিঁড়ির গোড়ায়। পৌঁছবার আগেই এসকর্ট দু জন সচল জনারণ্যে হারিয়ে গেল। কাছাকাছি থাকুন, বলে ইমার একটা বাহু খামচে ধরল নিকোলাস, কাঁধ দিয়ে ভিড় তো নয় যেনো পাহাড় ঠেলছে। 

দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে চাতাল দাঁড়িয়ে থাকা অনেকগুলো পাথুরে স্তম্ভের একটার গায়ে পিঠ ঠেকাতে পারলো ওরা। এখান থেকে ক্যাথেড্রালে ঢোকার পথটা পরিষ্কারই দেখা যায়। রোয়েন যথেষ্ট লম্বা নয়, সামনে জনসমুদ্র থাকায় প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তাই ওকে সিঁড়ির নিচের ছোট একটা স্তম্ভের মাথায় তুলে দিল নিকোলাস। অবলম্বন হিসেবে নিকোলাসের একটা কাঁধ আঁকড়ে ধরল রোয়েন, কারণ ওর পেছনেই গভীর খাদ, নিচে বয়ে চলেছে নীলনদ। 

উপাসকরা একঘেয়ে সুরে ভক্তিগীত গাইছে। বাদ্যযন্ত্রীদের বারোটা দল ড্রাম সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। প্রতিটি ব্যান্ডকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ভক্তরা, তাদের পরনে বিচিত্র বাহারি আলখেল্লা, মাথার উপর বহুরঙা ছাতা। 

প্রচণ্ড গরম আর উৎকট দুর্গন্ধের মতোই জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিপুল উত্তেজনা আর প্রত্যাশা। গান ও বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে উন্মাদনা ক্রমশ বাড়ছে; হাজার হাজার উপাসক, ভক্ত পূজারি, যেনো একটিমাত্র জ্যান্ত প্রাণীতে পরিণত হয়ে বিশেষ একটা ছন্দে দোল খাচ্ছে। 

হঠাৎ করে ক্যাথড্রালের ভেতর থেকে পিতলের অনেকগুলো ঘণ্টা একযোগে। বাজতে শুরু করলো, পরমুহূর্তে সেই কান ঝালাপালা করা আওয়াজের সঙ্গে যোগ দিল কয়েক শো হর্ন আর ট্রামপিট বা ভেরী। সিঁড়ির মাথায় গোত্রপ্রধানদের দেহরক্ষীরাও বসে থাকলো না, অটোমেটিক রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলিবর্ষণ শুরু করলো বিরতিহীন। মহিলারা শুরু করলো উলুধ্বনি, সে আওয়াজ যেমন রোমহর্ষক তেমনি রক্ত পানি করা। ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো পুরুষদের চেহারা। মেঝেতে হাঁটু গাড়ল তারা, আকুল আবেদন জানাবার ভঙ্গিতে মাথার উপর দু হাত তুলে ঈশ্বরের কৃপা ভিক্ষে চাইছে। মহিলারা তাদের শিশুসন্তানকে মাথার উপর তুলে ধরল, কৃঞ্চবর্ণ গাল বেয়ে অনর্গল নেমে আসছে চোখের পানি।

ভূগর্ভস্থ চার্চ থেকে গেট হয়ে বেরিয়ে এলো পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের একটা বিশাল মিছিল। প্রথমে এলো সাদা আলখেল্লা পরা ভক্তরা, তাদের পিছু নিয়ে এলো তরুণ উপাসকদের দল, আজ নদীর কিনারায় তারা ব্যাপ্টাইজড হবে। তামেরকে চিনতে পারলো রোয়েন, আশপাশের কিশোরদের চেয়ে যথেষ্ট লম্বা সে, চোখাচোখি হতে লজ্জা পেয়ে হাসলো। 

ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কড়াই আকৃতির জায়গাটা ছায়ার ভেতর অস্পষ্ট দেখাচ্ছে, মাথার উপর ঝুলে আছে দু একটা রূপালি তারা নিয়ে রক্তবর্ণ শামিয়ানার মতো সরু আকাশ। 

তরল লাভা স্রোতের মতো মশার মিছিল কুণ্ডলি ছড়াতে শুরু করলো পাহাড় প্রাচীরের গা থেকে, পুরোহিতরা সুর করে গান করছেন, ড্রামের গুরুগম্ভীর আওয়াজ পাহাড়ে লেগে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ব্যাপ্টিজম প্রার্থীদের পিছু নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা, তাঁদের আলখেল্লায় পিতলের তৈরি রূপালি ক্রস সঁটা, মাথায় জড়ানো সিল্ক পট্টি, অনেকেই ব্যানার বহন করছেন। তাঁদের পেছনে দু জন পুরোহিতকে দেখা গেল, ট্যাবট বহন করছেন। পুরোহিত দু জন অস্বাভাবিক লম্বা, মাথায় রত্নখচিত পাগড়ি, পরনে বহুরঙা আলখেল্লা। আর্ক অভ ট্যাবারন্যাকল বা চন্দ্রাতাপ আবৃত আসন লাল কাপড়ে মোড়া, সেটা জমিনে লুটিয়ে পড়েছে। কাপড়ে মোড়ার কারণ অপবিত্র বা পাপীরা যাতে চামড়ায় চোখে ওটাকে সরাসরি দেখার সুযোগ না পায়। 

মিছিলের শেষ দিকে যোগ দিলেন জালি হোরা। আজ তিনি নীল পাথর লাগানো মুকুটটা পরেন নি। পরেছেন ইপিফানি ক্রাউন। চকচকে ধাতু-খণ্ড আর বহুমূল্য পাথর দিয়ে সাজানো। মুকুটটা এতো ভারী, প্রধান পুরোহিতের প্রাচীন ঘাড় ওটার ভারে নুয়ে পড়েছে। দু জন তরুণ ভক্ত তার কনুই ধরে গাইড করছে। অনিশ্চিত পা ফেC সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। এ সিঁড়িপথই নীল নদীর দিকে নেমে গেছে। 

মিছিল এগুচ্ছে, সেই সঙ্গে সিঁড়ির মাথায় বসে থাকা লোকজন সোজা হলো নিচে নামার জন্য। চাতাল খালি হয়ে আসছে দেখে রোয়েনকে স্তম্ভের উপর থেকে নামিয়ে মিছিলে যোগ দিল নিকোলাস, জায়গাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবার আগেই গির্জার ভেতর ঢুকে পড়তে হবে ওদেরকে। জনস্রোত সামনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তারই মধ্যে একপাশে সরে আসছে ওরা, উদ্দেশ্য গির্জার প্রবেশমুখে পৌঁছনো। সামনে বোরিস আর টিসেকে দেখতে পেল ওরা, তবে তারা ওদেরকে দেখতে পায় নি। 

গির্জার আউটার চেম্বারে ঢোকার গেটে এসে মাথা নিচু করলো নিকোলাস, ভেতরে ঢুকে আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেল না। ভেতরের গেটগুলোয় কোনো প্রহরী নেই দেখে সাইড ওয়াল ঘেঁষে এগুলো ও, এক হাতে রোয়েনের কব্জি ধরে আছে, অপর হাতে ব্যাগটা। সামনেই ঝুলছে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা পর্দা। ভারী পর্দা তুলে ভেতরে গা ঢাকা দিল ওরা।

পর্দার কাঁপন তখনো পুরোপুরি থামেনি, সবেমাত্র দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে ওরা, কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো কানে। পর্দা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকালো নিকোলাস। সাদা আলখেল্লা পরা চারজন পুরোহিত গির্জার ভেতর দিক থেকে এগিয়ে আসছেন, আউটার চেম্বার পার হয়ে গেটের সামনে থামলেন, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিলেন মেইন গেট। 

আজ রাতে আর ওই গেট খোলা হবে না, ফিসফিস করলো নিকোলাস। ভেতরে আটকা পড়েছি আমরা। 

কেউ আমাদেরকে বিরক্ত করবে না, জবাব দিল রোয়েন। চলুন, এখুনি কাজ শুরু করি। 

পা টিপে টিপে পর্দার আড়াল থেকে বেরুল ওরা, আউটার চেম্বার পার হয়ে একটা দরজার দিকে এগুলো। রোয়েনকে নিয়ে মিডল চেম্বারে পা রাখলো নিকোলাস। 

প্রথম চেম্বারের তুলনায় আকারে ছোট আর নিচু এটা। দেয়ালচিত্রগুলোয় সম্ভবত নিয়মিত রঙের প্রলেপ লাগানো হয়। মেঝে খালি, শুধু বাঁশ দিয়ে পিরামিড আকৃতির একটা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তাতে দাঁড়িয়ে আছে পিতলের তৈরি প্রদীপ, প্রতিটি প্রদীপে তেলের উপর ভাসছে সলতে। আলোর অন্য কোনো উৎস চোখে পড়লো না। সিলিং আর চেম্বারের কুলুঙ্গিগুলোয় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। 

মেঝে পেরিয়ে আরেকটা দরজার দিকে এগুলো নিকোলাস, মাকডাসে ঢুকতে হলে এ তালামারা দরজা পেরুতে হবে ওদেরকে। টর্চ বের করে দরজাটা পরীক্ষা করলো ও। দুটো কবটেই সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের প্রতিকৃতি খোদাই করা হয়েছে, মাথার চারধারে আলোর একটা বৃত্ত, ডান হাত আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে উপরে ভোলা।

তালাটা কয়েকশো বছরের পুরানো, ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে খুলতে বিশ সেকেন্ডের বেশি লাগলো না। তালা খোলার পর একটা কবাটে কাঁধ ঠেকিয়ে চাপ দিল নিকোলাস। কজায় তেল দেওয়া হয় না, কাঁচকাঁচ করে প্রতিবা। জানালো। ভেতরে ঢোকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ফাঁক হলো কবাট, ভেতরে ঢোকার পর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। 

মাকডাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বোবা বিস্ময়ে চারদিকে তাকালো ওরা। হোলি অব হোলিজ খুব ছোট একটা চেম্বার, এতো ছোট হবে বলে ওরা ধারণা করে নি। দশ-বারো কদম ফেললে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পৌঁছনো যায়। গম্বুজ আকৃতির ছাদ এতো নিচু পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে হাত উঁচু করলে ছোঁয়া যাবে। 

মেঝ থেকে ছাদ পর্যন্ত সারি সারি শেলফ, ভক্তদের দেওয়া উপহারসামগ্রী সাজানো রয়েছে-ট্রিনিটি ও ভার্জিন আইকন, বাইজেনটাইন স্টাইলে গড়া, অলংকৃত রূপোয় মোড়া। সেইন্ট আর সম্রাটদের খুদে মূর্তিও আছে। আর আছে পালিশ করা মেটাল দিয়ে তৈরি পাত্র, গহনার বাক্স, মেডেল, মালা, শাখা-প্রশাখাসহ মোমদানি– প্রতিটিতে মোমবাতি জ্বলছে। 

মেঝের মাঝখানে সিডারউডের অলটার, প্যানেলে বিশ্ব সৃষ্টির ছবি খোদাই করা-স্বর্গ থেকে আদমের পতন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত সবই দেখানো হয়েছে। সিল্কে মোড়া অলটার, ক্রসটা রূপোর তৈরি। প্রধান পুরোহিতের মুকুট মোমবাতির আলোয় চকচক করছে, টাইটার নীল সিরামিক সীল মুকুটটার ঠিক কপালের মাঝখানে। 

নিঃশব্দে এগিয়ে এসে বেদীর সামনে হাঁটু গাড়ল রোয়েন। প্রার্থনার বসে মাথা নত করলো ও। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো নিকোলাস, মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না। 

রোয়েনের প্রার্থনা শেষ হতে ওর পাশে চলে এলো নিকোলাস। ট্যাবট পাথর। ইঙ্গিতে বেদীর সামনেটা দেখালো। একসঙ্গে সেদিকে এগোলে ওরা। মাকডাসের পেছনে কাপড় মোড়া একটা কাঠামো দেখা যাচ্ছে। রূপো আর সোনার তৈরি সুতোয় এমব্রয়ডারি করায় কাপড়টা ভারী বলে মনে হলো। কাঠামোটা মানুষের মতোই লম্বা। ওটাকে ঘিরে ঘুরছে দু জন ছুঁতে ভয় পাচ্ছে-যদি প্রত্যাশা পূরণ না হয়! উত্তেজনা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য উপাসনালয়ের পেছন দিকের দেয়ালে তাকালো নিকোলাস, ওদিকে বার লাগানো একটা গেট রয়েছে। সেইন্ট ফ্রমেনটিয়াসের সমাধি। বলে গ্রিলের দিকে এগুলো। ওর পাশে চলে এলো রোয়েন। কাঠের গায়ে চৌকো ফোকর, সেগুলোর একটা দিয়ে ভেতরে তাকালো। ভেতরটা অন্ধকার। ফোকরের ভেতর টর্চ ঢুকিয়ে বোতামে চাপ দিল নিকোলাস। 

টর্চের আলোয় রঙধনুর সব কয়টা রঙ ওদের চোখ যেনো ধাধিয়ে দিল। আলোটা চোখে সয়ে আসতে চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন, ওহ, সুইট হেভেন! এমন কাঁপুনি শুরু হলো, যেনো প্রবল জ্বরে ভুগছে ও। মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে যাওয়ায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা। 

সেলের মতো দেখতে সমাধি কক্ষে পেছনের দেয়ালে, একটা পাথুরে শেলফের উপর, সেট করা হয়েছে কফিনটা। কফিনের গায়ে একটা মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা, ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটার আদলে। ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে, অনেক জায়গাতেই রঙ নেই, তা সত্ত্বেও মানুষটার স্নান চেহারা, লালচে দাড়ি ইত্যাদি আলাদাভাবে চেনা যায়। 

রোয়েনের বিস্ময় বোধ করার এটাই একমাত্র কারণ নয়। কফিন শেলফটার উপরে এবং দুপাশে তাকিয়ে আছে ও। ওখানে যেনো বিভিন্ন রঙের দাঙ্গা বেধে গেছে, দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে সূক্ষ্ম ও দৃষ্টিনন্দন পেইন্টিং সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়। ভাবতে আশ্বর্য লাগে, এতো কালো পরও পেইন্টিংগুলো অক্ষত ও অম্লান রয়েছে কীভাবে। 

ওগুলোর উপর টর্চের আলো ঘোরাল নিকোলাস, যেনো পড়ে যাবার ভয়ে নিকোলাসের একটা বাহু আঁকড়ে ধরে থাকলো রোয়েন। ওর আঙুল নিকোলাসের মাংসে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, অথচ নিকোলাস কোনো ব্যথা অনুভব করছে না। 

বড় বড় যুদ্ধের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, নীলনদের পানিতে যুদ্ধজাহাজগুলো পরস্পরের মুখোমুখি। আছে শিকারের দৃশ্য, সিন্ধুঘোটক আর বিশাল সব হাতিকে ধাওয়া করছে শিকারীরা, লম্বা গজদন্ত রোদ লেগে চকচক করছে। কোথাও রক্তপিপাসু পদাতিক বাহিনী উন্মত্ত আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষ বাহিনীর উপর। শত শত রথ নিয়ে বীর যোদ্ধারা ছুটে চলেছে রণক্ষেত্র অভিমুখে, গিরিখাদের তলায় ধুলো উড়ছে, ঘোড়সওয়ারদের অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।

প্রতিটি দেয়ালচিত্রের নিচের দিকে দীর্ঘদেহী এক যোদ্ধার মূর্তি দেখা যাচ্ছে। একটা দৃশ্যে সে তার ধনুক পুরোপুরি টেনে ধরেছে, আরেকটায় ব্রোঞ্জের তৈরি তলোয়ার ঘোরাচ্ছে। শত্রুরা মাথা নোয়াচ্ছে তার সামনে, সে তাদেরকে পায়ের নিচে পিষছে, কিংবা অনেকগুলো মাথা একহাতে ধরে অট্টহাসি হাসছে। 

টর্চের আলো সেন্ট্রাল প্যানেলের উপর স্থির করলো নিকোলাস। কফিনের উপর দেয়ালটা কাভার করছে এ প্যানেল। এখানে দেবতুল্য সেই মূর্তি রথের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে ধনুক, অপর হাতে বল্লম। মাথায় পাগড়ি বা হেলমেট নেই, চুলগুলো তার পেছনে পতাকার মতো উড়ছে-সিংহের সোনালি কেশর যেন। চেহারায় আভিজাত্য ও গর্ব, দৃষ্টিতে অদম্য স্পর্ধা। 

তার নিচে ধ্রুপদী মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা কয়েকটা লাইন। গলা খাদে নামিয়ে অনুবাদ করলো রোয়েন : 

মিশরের সাহসী সিংহ
এক হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত
প্রশংসার স্বর্ণশেকলে ভূষিত
ফারাও-এর চিরকালীন বান্ধব 
সমস্ত দেবতার সৈনিক
আপনি চিরজীবী হোন! 

প্রবল আবেগে ফুঁপিয়ে উঠলো রোয়েন তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এই শিল্পীকে আমি চিনি। তার শিল্পকর্ম নিয়ে পাঁচ বছর গবেষণা করেছি। আমি যিশুর কসম খেয়ে বলতে পারি, এ দেয়ালচিত্র চার হাজার বছর আগে ক্রীতদাস টাইটার আঁকা। আর এ সমাধির ডিজাইনও তারই করা। হাত তুলে কফিন রাখা শেলফের খানিক উপরে আথরে খোদাই করা নামটা দেখালো। না, এটা কোনো খ্রিস্টান সেইন্টের কফিন নয়। কয়েক শো বছর আগে কোনো একজন প্রাচীন পুরোহিত হঠাৎ এটা দেখতে পান, নিজ ধর্মের নামে দখল করে নেন। কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস ফেললল ও। ওদিকে তাকান! ওটা ট্যানাস-এর সীল-লর্ড হেরাব, সমগ্র মিশরীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি, রানী লসট্রিস-এর প্রেমিক, প্রিন্স মেমনন এর প্রকৃত পিতা, যিনি পরে ফারাও টামোস হয়েছিলেন। 

অনেকক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভাঙল নিকোলাস, সবই তাহলে সত্যি। সপ্তম স্ক্রোলের সমস্ত রহস্যই দেখা যাচ্ছে এখানে। এখন শুধু চাবিটা পেলেই হয়। 

হ্যাঁ, চাবি-টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট! ধীরে ধীরে ঘুরলো রোয়েন, চেহারায় শ্রদ্ধা আর ভয় ফুটে রয়েছে, এগুচ্ছে ট্যাবট স্টোনটার দিকে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো ও। নিকোলাস, আমার ভয় করছে। যা ভেবেছি ওটা হয়তো তা নয়। প্লিজ, আপনি দেখুন। 

লম্বা কাঠামোটার সামনে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস, কাপড়টা সরিয়ে নিল। ফ্যাকাসে লাল একটা এ্যানিট পিলার দেখতে পাচ্ছে ওরা, গায়ে বহুরঙা চিত্রবিচিত্র দৃশ্য খোদাই করা। পিলারটা প্রায় ছয়ফুট লম্বা, গোড়ার দিকে এক বর্গফুটের মতো হবে। ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়ায় চ্যাপ্টা বা সমতল চূড়ার কাছে আধ বর্গমিটার। দাঁড়িয়েছে। এ্যানিট প্রথমে পালিশ করা হয়েছে, খোদাই করা হয়েছে পরে। এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা পাথরটা ছুঁলো রোয়েন, হায়ারোগ্লিফিক্সের উপর হাত বুলাচ্ছে। 

আমাদেরকে লেখা টাইটার চিঠি, ফিসফিস করলো ও। খোদাই করা লিপির ভিড় থেকে একটা প্রতীকচিহ্ন খুঁজে নিল-ডানাভাঙা একটা বাজপাখি। ওটা স্পর্শ করার সময় আঙুলগুলো কাঁপতে শুরু করলো। লেখা হয়েছে প্রায় চার হাজার বছর আগে। প্রতীক্ষায় আছে, এতো বছর পর আমরা পড়ব, অর্থ উদ্ধার করব। দেখুন কীভাবে সে সই করেছে। এ্যানিট পিলারটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে রোয়েন, পালা করে চার। দিকেই পরীক্ষা করছে হেসে উঠে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কখনো বা ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ছে, তারপর আবার হাসছে, যেনো একটা প্রেমপত্র পড়ছে ও। 

পড়ে শোনান আমাকে, বলল নিকোলাস। ক্যারেক্টরগুলো বুঝতে পারি, তবে সেন্স বা মিনিং সহজে ধরতে পারি না। আপনি ব্যাখ্যা করুন।

নিখাদ টাইটা! হেসে উঠলো রোয়েন, উত্তেজনায় লালচে হয়ে উঠেছে চেহারা। বরাবরের মতো অস্পষ্ট ভাষায়, ধাঁধার সাহায্যে মেসেজ দিয়েছে এখানেও। এ সম্ভবত তার নিজস্ব কোনো কোড। একটা হায়ারোগ্লিফিক্স লাইনে আঙুল দিয়ে। প্রকাণ্ড ডানা মেলে শকুনরা উঠলো সূর্যকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। ডেকে উঠে লেজের দিকে ঘুরে গেল শেয়ালরা। নদী বয়ে চলল জমিনের দিকে। পবিত্র স্থানের অমর্যাদাকারীরা সাবধান! সমস্ত দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে তোমাদের উপর! 

অর্থহীন প্রলাপ নয় তো? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। 

না, অর্থহীন নয়! টাইটা কখনো অর্থহীন কথা বলে না। নিজেকে সে দুর্লভ প্রতিভা বলে দাবি করে, কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি একটু হয়তো ছিটগ্রস্ত। তাকে বুঝতে হলে তার চিন্তাধারা বুঝতে হবে। সে আমাদের জন্য কিছু ধাঁধা রেখে গেছে, অর্থ বের করতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। সেজন্যই আমরা ক্যামেরা নিয়ে এসেছি। ছবি তোলার পর ওই পাথর থেকে ছাপ নিব আমরা। পরে যাতে স্টাডি করা যায়। 

ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করলো নিকোলাস। প্রথমে দুই রোল কালার ফটো তুলি, তারপর পোলারয়েড ব্যবহার করব-কালার ফটোগুলো ডেভেলপ করতে সময় লাগবে, তার আগেই যাতে কাজ শুরু করতে পারি। একে একে পিলারটার চারদিকেরই ফটো তুললো ও। ছবি তোলা শেষ হতে গ্রিল গেটের সামনে এসে তালাটা পরীক্ষা করলো। এ তালাটা একটু জটিল, খুলতে হলে তালার ক্ষতি হতে পারে। তার মানে পুরোহিতরা জানবেন এখানে কেউ ঢুকছিল। 

তাহলে ভেতরে ঢোকার দরকার নেই, বলল রোয়েন। গ্রিলের এদিক থেকেই ছবি তুলুন। 

গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ক্যামেরা ঢোকালো নিকোলাস, বেশ কয়েকটা ফটো তুললো। এবার পোলায়েড। ক্যামেরা বদল করে আরেক দফা ছবি তোলা হলো। নিকোলাস প্রতিটি প্লেট এক্সপোজ করার পর রোয়েনকে দিল ডেভেলপমেন্ট চেক করার জন্য। 

প্রায় দু ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর ফটো তোলার পর্ব শেষ হলো। ক্যামেরা রেখে দিয়ে আর্ট পেপারের একটা রোল বের করলো নিকোলাস। পিলারের গায়ে সাঁটা হলো কাগজটা, তারপর টেপ দিয়ে আটকানো হলো। দু জন দুদিক থেকে কাজ শুরু করলো-নিকোলাস উপর থেকে, রোয়েন নিচ থেকে। দু জনের হাতে একটা করে কালো আর্ট ক্রেয়ন, খোদাই করা প্রতিটি হরফ ওই পেন্সিল দিয়ে ঘষে ফাঁকা কাগজে হুবহু তুলে নিল ওরা। টাইটা এখন যেখানেই থাকুক, আমি জানি আমাদের কাজ দেখে খিকখিক করে হাসছে সে, বলল রোয়েন। ভাবছে, যতই চালাক হও তোমরা, আমার হেঁয়ালি ধরতে পারা এতো সহজ কাজ নয়! 

ডিজাইনের আউটলাইন কাগজে তোলা পরিশ্রমসাপেক্ষ ও একঘেঁয়ে কাজ, তবু সময় যে কীভাবে বয়ে গেল দু জনের কেউই টের পেল না। কাজ শেষ হতে রোয়েন জানতে চাইলো, কয়টা বাজে বলুন তো? 

ভোর চারটে। আসুন, জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলি। 

আর একটা কাজ বাকি আছে, বলে আর্ট পেপারের একটা কোণ ছিঁড়ে বেদির দিকে এগুলো রোয়েন, ওখানে প্রধান পুরোহিতের মুকুটটা পড়ে রয়েছে। মুকুটটার মাঝখানে নীল, সিরামিক সীলটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো ও, তারপর আর্ট পেপারে ডানা ভাঙা বাজপাখির একটা ছাপ নিল। ইতোমধ্যে পিলারটাকে কাপড়ে মুড়ে দিয়েছে নিকোলাস, নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। 

মিডল চেম্বারে ফিরে এসে তালটা আবার লাগিয়ে দিল নিকোলাস। রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, মেইন দরজা দিয়ে বের হবে কীভাবে? 

খানিক চিন্তা করে নিকোলাস বলল, মিডল চেম্বার থেকে বের হওয়ার আরো রাস্তা থাকতে বাধ্য। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো ও। পুরোহিতরা মেইন গেট খুব কমই ব্যবহার করেন। এখান থেকে ওদের কোয়ার্টারে যাবার কোনো না কোনো পথ নিশ্চই আছে…. হঠাৎ থেমে হাত তুলে দেখালো রোয়েনকে। ….ওদিকে তাকান! দেয়াল ঘেঁষে একটা মসৃণ লম্বা দাগ দেখা গেল মেঝেতে, শত শত বছর ধরে আশা-যাওয়া করায় মেঝে ওখানে ক্ষয়েও গেছে। পর্দার দিকে তাকান, ওদিকে, হাত দিয়ে ধরায় কেমন কালচে হয়ে গেছে। দ্রুত এগিয়ে এসে পর্দাটা সরাতেই গোপন একটা দরজা দেখা গেল। যা ভেবেছি! পিছু নিন। 

পাথুরে একটা টানেল ধরে এগুলো ওরা। ডান দিকে বাঁক নেওয়ার পর সামনে ম্লান আলোয় আভাষ পাওয়া গেল। টর্চ নিভিয়ে ফেললো নিকোলাস। 

বাসি খাবার আর ঘামের গন্ধ ঢুকলো নাকে। সন্ন্যাসীদের একটা পাথুরে সেলকে পাশ কাটালো ওরা, দরজা নেই। টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল ভেতরটা ফাঁকা। কোনো ফার্নিচার নেই, দেয়ালে শুধু একটা কাঠের ক্রস, তার নিচে চাকা লাগানো বিছানা। এরকম আরো দশ-বারোটা সেলকে পাশ কাটালো ওরা, একই রকম দেখতে। পরবর্তী বাঁক ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। মুখে সামান্য বাতাস লাগছে। কেউ কোথাও নেই দেখে আবার এগুলো ওরা। কিছু দূর যাবার পর পেছন থেকে নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরল রোয়েন। 

কী? জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নিকোলাস, রোয়েন ওর কাঁধে চাপ দেওয়ার চুপ করে গেল। তারপর শুনতে পেল আওয়াজটা। মানুষের গলা, গোলক ধাঁধার ভেতর অস্পষ্টভাবে প্রতিধ্বনি তুলছে।– তারপরই ভেসে এর বুকের রক্ত ছলকান একটা আর্তচিৎকার, যেনো তীব্র ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে কেউ। সাবধানে এগুলো ওরা, কাও চোখে ধরা পড়তে চায় না। তবে আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে।

এতোক্ষণে ওরা আলো দেখতে পাচ্ছে। গলিপথের একধারে একটা সেল থেকে বের হচ্ছে আলোটা। আরো একটা রক্ত হিম করা আর্তচিৎকার শোনা গেল, এটা একটা নারীকণ্ঠ। চিৎকারটা প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসছে, গলিপথে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ওদেরকে। 

কী ঘটছে বলুন তো? নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফিসফিস করলো রোয়েন। 

জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লো নিকোলাস, রোয়েনের হাত ধরে আবার এগুলো। আলোকিত সেলের দরজাটাকে পাশ কাটাতে হবে ওদের। উল্টো দিকের দেয়ালে পিঠ ঘষে একটু একটু করে এগুচ্ছে নিকোলাস। ওর পাশেই রয়েছে রোয়েন, ওর একটা বাহু ধরে আছে। 

সেলের ভেতর তাকালো ওরা, নারীকণ্ঠের চিৎকারটা আবার শুনতে পেল। তবে এবার চিৎকারের সঙ্গে মিশে আছে একটা পুরুষকণ্ঠ। 

দৃশ্যটা ওদের চেখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। চাকা লাগানো বিছানার উপর সম্পূর্ণ নগ্ন ওরা, ঘামে চকচকে দুটো শরীর এক হয়ে আছে। শক্তিশালী শরীরে আদিম কোনো পুরুষের মতোই নারীর অভ্যন্তরে নিজেকে প্রবেশ করিয়ে ভালোবাসছে একটা জোড়া। 

কেঁপে কেঁপে উঠে শিকার করে উঠলো মেয়েটা। চরম পুলকে শিউড়ে উঠছে বারবার। 

প্যাসেজ থেকে ফাঁকা চাতালে বেরিয়ে এলো ওরা, থামলো সিঁড়ির গোড়ায়, নীলনদের গন্ধ মেখে উঠে আসা তাজা বাতাসে ভরে নিল নিজেদের ফুসফুস। 

টিসে ওর কাছে চলে গেছে, নরম সুরে ফিসফিস করলো রোয়েন। অন্তত আজ রাতের জন্য তো বটেই, মন্তব্য করলো নিকোলাস। 

না, প্রতিবাদ করলো রোয়েন। শুধু আজ রাতের জন্য নয়, চিরকালের জন্য। আপনি ওর মুখ দেখেন নি? টিসে এখন মেকের মেয়ে মানুষ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *