৩. দীর্ঘ বারোদিনের জন্যে নিরুদ্দেশ

কিরীটী যে দীর্ঘ বারোদিনের জন্যে নিরুদ্দেশ হয়েছিল, সে-সময়টায় সে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেনি। সে ইতিমধ্যে ঢাকায় গিয়েছিল সচ্চিদানন্দের বন্ধু যতীন চাটুয্যে সম্পর্কে যাবতীয় খুঁটিনাটি ইতিহাসটা সংগ্রহ করতে ও সাধ্যমত আত্মগোপন করে মণিকাদেবীর পূর্ব-ইতিহাসটা যদি সংগ্রহ করতে পারা যায় তারও চেষ্টায়। কিন্তু খুব বেশী যে একটা আশা বা উৎসাহ নিয়ে ফিরতে পেরেছে, সেটা তার কথাবার্তা শুনে মনে হল না।

সুদীর্ঘ মোল বৎসর আগে যতীন চাটুয্যের মৃত্যু হয়েছে।

শহর-স্কুলের যে দু-একজন সহকর্মী শিক্ষক ভবতারিণী স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, তার মধ্যে সুধীরবাবু ও মণিবাবুর মুখে যেটুকু কিরীটী সংবাদ পেয়েছে, তাও যেমন অস্পষ্ট, তেমনই যেন অসম্পূর্ণ। যতীন চাটুয্যে লোকটি যেমন চিরদিন স্বল্পভাষী, তেমনি অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির ও ঘরকুনো ছিলেন।

শহরের কারো সঙ্গেই বড় একটা মিশতেন না।

সংসারে তাঁর স্ত্রী ও একটি মেয়ে ছাড়া কেউই ছিল না। যতীনবাবুর মত তাঁর স্ত্রীও অত্যন্ত মিতবাক ছিলেন, পাড়া-প্রতিবেশী কারও সঙ্গেই বড় একটা মিশতেন না। পাড়া-প্রতিবেশী সেটা বুঝত না, বলত অহঙ্কার–দেমাক।

মধ্যে মধ্যে যতীনবাবুর নামে একটা রেজেস্ট্রি চিঠি আসত স্কুলের ঠিকানাতেই।

চিঠিটা আসলে তিনি সই করে নিয়ে নিঃশব্দে পকেটে রেখে দিতেন। কেউ কোনদিন তাঁকে চিঠিটা খুলে পড়তে দেখেনি।

মণিবাবু বলেছিলেন, চিঠিটা আসত নাকি কলকাতা থেকে।

যতীনবাবুর মৃত্যুর পরও একবার চিঠি এসেছিল, কিন্তু চিঠির মালিক মৃত বলে চিঠিটা ফিরে যায়। তারই দিন আট-দশ পরে কলকৃাতা থেকে এক ভদ্রলোক আসেন শহরে যতীনবাবুর খোঁজে। কিন্তু তাঁকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়! কারণ তারই দিনতিনেক আগে এক রাত্রে যতীনবাবুর স্ত্রী তাঁর একটিমাত্র মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে যান শহর ছেড়ে কেউ তা জানত না।

সেই ভদ্রলোকের নাম সুধামাধব সান্যাল। সুধামাধব কয়েকদিন শহরে থেকে যতীনবাবুর স্ত্রী ও কন্যার অনেক অনুসন্ধান করে তাদের কোন সংবাদ না পেয়ে অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।

যতীনবাবুর স্ত্রী ও কন্যার কোন সংবাদ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যতীন চাটুয্যে, তাঁর স্ত্রী ও কন্যার সংবাদ ঐটুকুর বেশি সংগ্রহ করতে পারা যায়নি! আর অভিনেত্রী মণিকা সম্পর্কেও কিরীটী বিশেষ কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেনি।

মাস ছয়েক আগে একটা বই শেষ হবার পর হঠাৎ একদিন এক ভদ্রলোক তাঁর নতুন বইয়ের নায়িকার ভূমিকার জন্য মণিকাদেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তার কলকাতার বাসায় শুনতে পান, মণিকাদেবী অসুস্থ। কোথায় যে সে চেঞ্জে গিয়েছে, দরোয়ান বলতে পারে না।

অনেক খুঁজেপেতে কিরীটী মণিকার পুরাতন দরোয়ান অযোধ্যা সিংকে কলুটোলার এক ধনীগৃহে ধরে।

অযোধ্যা সিং প্রথমটায় মণিকাদেবী সম্পর্কে কোন কথাই বলতে চায় না।

অবশেষে অনেক কায়দা করে জপিয়ে এটুকু সংবাদ সংগ্রহ করেছে কিরীটী: মাস আষ্টেক আগে একদিন সন্ধ্যার সময় স্টুডিও থেকে সুটিং সেরে একটি জেনানাকে নিয়ে ফিরে আসে মণিকা। সেই জেনানাটি তারপর থেকে মণিকাদেবীর বাড়িতেই ছিল। তাকে কেউ কখনও দেড় মাসের মধ্যে ঐ বাড়ি থেকে একবারের জন্যেও বের হতে দেখেনি। এমন কি বাইরের ঘরেও কখনো তাকে দেখা যায় নি। দরোয়ান অবিশ্যি সেই জেনানার নাম বলতে পারেনি। তারপর একটি সন্ধ্যার পর ট্যাক্সিতে চেপে মণিকা ও ঐ জেনানা চলে যায়। দেড় মাস পরে মণিকাদেবী ফিরে আসে বটে, কিন্তু সেই জেনানা আর ফিরে আসেনি। কলকাতায় ফিরে আসবার দিন সাতেক বাদেই দরোয়ান ও সোফারকে চার মাসের করে মাইনে দিয়ে বিদায় দেয়, গাড়িও বেচে দেয়, বাড়িও ছেড়ে দেয় মণিকাদেবী।

এত চেষ্টা করেও তাহলে বিশেষ কোন ফল হয়নি বল? প্রশ্ন করলাম আমি।

তাই তো মনে হচ্ছে। মৃদু কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।

তাহলে সচ্চিদানন্দের হত্যা-রহস্য যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছে?

কিরীটী অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল, আমার কথার জবাব পাওয়া গেল না। সিঁড়িতে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

কিরীটী জুতোর শব্দ শুনে কৃষ্ণাকে লক্ষ্য করে বললে, কৃষ্ণা, পাশের ঘরে যাও। আর তিন কাপ চা পাঠিয়ে দিও। ডাঃ হরপ্রসন্ন ভট্টাচার্য এদিকে আসছেন।

সত্যি, ডাঃ হরপ্রসন্ন ভট্টাচার্যই ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।

কিরীটী সাদর আহ্বান জানাল, আসুন ডাক্তারবাবু, বসুন।

প্রৌঢ় ডাক্তার হরপ্রসন্ন একটা খালি সোফা অধিকার করে বসলেন। কিরীটী সামনের টীপয়ের উপরে রক্ষিত সিগার-কেসটা থেকে একটা সিগার নিয়ে কেসটা ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিলে।

দুজনে নিঃশব্দে সিগারে অগ্নিসংযোেগ করল।

প্রথম দর্শনেই ডাঃ হরপ্রসন্ন ভট্টাচার্যকে চিনেছিলাম, সচ্চিদানন্দর গৃহে ওঁকে দেখেছিলাম। সচ্চিদানন্দের দীর্ঘদিনের পারিবারিক চিকিৎসক। কিন্তু ভাল করে আলাপ হবার সুযোগ তখন হয়নি। কিন্তু ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, কিরীটীর ইতিপূর্বে আলাপ-পরিচয় হবার আরো সুযোগ হয়েছে আমার অজ্ঞাতেই।

তারপর বলুন ডাক্তারবাবু, আপনার রোগিনীর সংবাদ কি? কিরীটী ডাক্তারকে প্রশ্ন করে।

সেই পূর্ববৎ। চোখে তেমনি Vacant look, indifferent—পারিপার্শ্বিকের উপরে কোন স্পৃহা নেই।

আহারাদির ব্যাপার?

না, তাতেও কোন interest নেই। খাদ্যবস্তু একেবারে মুখে তুলে না দিলে খেতেও চায় না। সর্বদাই কেমন চুপচাপ থাকেন। তবে শিবানী মেয়েটিকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। হাজার হলেও পর, অনাত্মীয়-বন্ধুর মেয়ে, কিন্তু সে যা করছে মিসেস সান্যালের জন্য, এমনটি আর চোখে কখনো পড়েনি আমার।

বাড়ির আর সকলে?

আপনার নির্দেশমত আমি যতক্ষণ প্রত্যহ ও-বাড়িতে থেকেছি, যথাসাধ্য নজর দিয়ে দেখবার চেষ্টা করেছি।

কোন প্রকার আলোচনাই হয়নি সচ্চিদানন্দবাবুর মৃত্যু সম্পর্কে?

না। দুর্ঘটনাটা যেন ওরা প্রত্যেকেই সযত্নে এড়িয়ে চলে বলেই আমার মনে হয়।

উইল সম্পর্কে কোন আলোচনা শোনেননি?

না। উইল তো শুনলাম, একদিন মহিমারঞ্জনবাবু বলছিলেন, একমাস বাদে পড়া হবে সর্বসমক্ষে। উইল সম্পর্কে কারো কোন interest আছে বলেও মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, একটা কথা যা আমার কানে এসেছে গতকাল এবং যে জন্য আপনার ফোন পেয়ে এসেছি

কি বলুন তো?

মহিমাবাবু বলছিলেন, শিবানীদেবী নাকি দু-চারদিনের মধ্যে চলে যাবেন স্থির করেছেন।

কিরীটী যেন ডাক্তারের কথায় চমকে উঠে প্রশ্ন করে, চলে যাবেন! হঠাৎ–

তা বলতে পারি না। তবে শুনলাম তো তাই। তাছাড়া মহিমাবাবু নিজেও মনে হল শিবানীর উপরে যেন সন্তুষ্ট নন।

সন্তুষ্ট নন! কেন?

তা বলতে পারি না। তবে কথাবার্তায় আগেও তাই মনে হয়েছে। বলে ডাক্তার ভট্টাচার্য চুপ করে গেলেন। বোঝা গেল, ও ব্যাপার নিয়ে আর বেশি আলোচনা করতে তিনি যেন ইচ্ছুক নন।

কিন্তু ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার হয়ে গেল পরের দিন–যখন আমি আর কিরীটী সচ্চিদানন্দ সান্যালের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলাম।

বাইরের ঘরে ফরাস বিছিয়ে ইতিমধ্যেই দেখলাম বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন মহিমারঞ্জন। একজন অপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে মহিমারঞ্জন কথা বলছিলেন তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আরাম করে ফরসির নল হাতে ধূমপান করতে করতে।

আমাদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই সাদর আহ্বান জানালেন মহিমারঞ্জন, আসুন, আসুন রায় মশাই!

আমরা ফরাসের একাংশেই আসন গ্রহণ করলাম।

মহিমারঞ্জন যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলেন, এবার তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, তাহলে ঐ কথাই রইল নরেনবাবু। আর দিন কুড়ি বাদেই উইল পড়া হবে। তারপর যা ব্যবস্থা হয় করা যাবে।

আচ্ছা তাহলে আমি উঠলাম। নমস্কার।

হ্যাঁ নমস্কার, আসুন।

নরেনবাবু একবার আড়চোখে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

ভদ্রলোকটি কে? কিরীটী প্রশ্ন করে।

ওঃ, উনি নরেন শীল। আমাদের উকিল।

ওঃ!

দু-একটাকুশলাদি প্রশ্নের পর মহিমারঞ্জনই আবার কথাশুরু করলেন, করোনার্সের ব্যাপারটা শুনেছেন বোধ হয় রায় মশাই? তারা রায় দিয়েছে হত্যাই!

হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু হত্যা বললেই তো হবে না! কে হত্যা করল তাকে? আর কেনই বা হত্যা করতে গেল বলুন?

হত্যা যে তাঁকে করা হয়েছে, সে তো আপনিও নিশ্চিত জানেন মহিমাবাবু। অবিশ্যি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে—হত্যা তাঁকে কে করল, কেন করল?

কিন্তু যাই বলুন আপনি রায় মশাই, আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই একেবারে অসম্ভব, অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথাই যদি বলেন মহিমাবাবু তো এমন অনেক কিছুই কি পৃথিবীতে ঘটে না, যা যুক্তি-তর্ক দিয়ে না বিশ্বাসযোগ্য হলেও আসলে সত্যি? কিন্তু সে কথা থাক। একটা কথা জানবার জন্যে এসেছিলাম–

কি বলনু তো?

শুনলাম মণিকাদেবী নাকি দু-একদিনের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাচ্ছেন, তা তিনি পুলিসের অনুমতি পেয়েছেন কি এ-বাড়ি ছেড়ে যাবার?

মুখটা গম্ভীর করেই জবাব দিলেন মহিমারঞ্জন, কার কাছে শুনলেন কথাটা?

শুনেছি। জিজ্ঞাসা করছি, কথাটা সত্যি নাকি?

হ্যাঁ, সত্যি।

কিন্তু পুলিসের অনুমতি পেয়েছেন কি তিনি?

জানি না। তিনি তো বাড়িতেই আছেন, তাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন না। আমি ওসবের মধ্যে নেই।

যেতে অবশ্য তিনি পারবেন—এ হত্যা-রহস্যের একটা মীমাংসা হয়ে গেলেই। কিন্তু সেটা না হওয়া পর্যন্ত তাঁর এ-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়া তো চলবে না—পুলিসের এই নির্দেশ আছে।

কিন্তু এও তো আপনাদের অন্যায় জুলুম রায় মশাই! মহিমারঞ্জন বলে ওঠেন।

অন্যায় জুলুম?

তাছাড়া কি বলব, অন্যায় নয়? কারণ আপনারা কি মীমাংসা করবেন, সেই জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্যে এ-বাড়ির প্রত্যেককে গতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকতে হবে, এই বা কেমন যুক্তি!

যুক্তি আছে বলেই আদেশ জারী করা হয়েছে। কিন্তু দেখুন রায় মশাই, সচ্চিদানন্দের অবর্তমানে এই পরিবার ও বাড়ির ভালমন্দের ভার আমার ঘাড়েই এসে পড়েছে। এক্ষেত্রে সে ব্যবস্থার দিকেও আমাকে নজর রাখতে হবে বৈকি।

তা তো ঠিকই, কিন্তু–

এর মধ্যে কোন কিন্তুই নেই। পারিবারিক মঙ্গলের জন্য মণিকার চলে যাওয়াটাকে আমি বাঞ্ছনীয়ই মনে করি সব দিক থেকে।

কি ব্যাপার! আপনি যেন মণিকাদেবীর উপরে বিশেষ সন্তুষ্ট নন বলেই মনে হচ্ছে? চাপাআক্রোশযেন মহিমারঞ্জনের কণ্ঠস্বরে এবারে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশপেল,কোথাকার কে এক অভিনেত্রী মাগী! চরিত্রহীনা কুলটা নটী—ও আপদ বাড়ি থেকে যত তাড়াতাড়ি  বিদেয় হয় আমি তাই চাই। আর যাই করি না কেন, সমাজে দশজনকে নিয়ে বাস করে সমাজকে অস্বীকার করব কেমন করে বলতে পারেন?

কিন্তু উনি তো ঠিক সে পর্যায়ে পড়েন না। তাছাড়া সচ্চিদানন্দবাবু নিজে তাঁকে যখন বাড়িতে এনে স্থান দিয়েছিলেন, সব জেনেশুনেই–

আরে মশাই, সেই তো হল কাল! জানা নেই, শোনা নেই, কোথায় কে কি বলল, আর সেও অমনি নেচে উঠল!

আপনি দেখছি মণিকাদেবীর উপরে ভয়ানক চটে উঠেছেন।

চটব না মশাই, বলেন কি? এতদিন নজরে পড়েনি, বাড়ির মধ্যে বড় একটা থাকতাম না তো। সেই সকালে চারটি ভাত মুখে দিয়ে অফিসে ছুটতে হত, আর ফিরতাম সেই রাত্রি আটটায়। এখন তো আর তা নয়, দিনে-দুপুরেও বাড়িতে থাকতে হয়। সবই চোখে পড়ে—

কিন্তু সত্যিসত্যিই ব্যাপারটা কি বলুন তো মহিমাবাবু?

ব্যাপার আর বিস্তারিত করে কি বলব বলুন! মাগীটা এখন ঐ আনন্দ ছোকরার মাথা খাওয়ার জন্যে লেগে পড়েছে। আর মশাই, তোকেও বলি, কি বংশের ছেলে তুই, কোথাকার

কে একটা বাজারের নষ্টা মেয়েমানুষ—তার সঙ্গে তোরই বা এত কি

হঠাৎ কিরীটীর সজাগ সতর্ক কণ্ঠস্বরে যেন চমকে উঠলাম।

সদর ও অন্দরের মধ্যবর্তী দরজার ওপরে ঝোলানো পদাটার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিরীটী বলে উঠল, কৈ? কে ওখানে?

এবং কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চমকে সেই দিকে তাকাতেই মনে হল, একজোড়া খালি পা চট করে পদার তলায় ওধারে সরে গেল।

দরজার কাছাকাছি আমি বসেছিলাম, চট করে এগিয়ে গিয়ে পর্দার ওপাশে মুখ বাড়াতেই দেখি, মণিকার সেই ভৃত্য নন্দন।

এ কি, নন্দন! কি করছিলি রে তুই এখানে দাঁড়িয়ে?

নন্দন যেন আমার কথায় কেমন একটু থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আজ্ঞে ঐ মামাবাবুর অফিসে যাবার সময় হল তাই বলতে এসেছিলাম—

.

কিরীটী ও মহিমারঞ্জন ইতিমধ্যে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

মহিমারঞ্জনই এবারে যেন ফেটে পড়লেন, হতচ্ছাড়া, পাজি! ডাকতে এসেছিলি, না আড়ি পেতে কি কথা হচ্ছে এখানে তাই শুনছিলি! যেমন মনিব, তেমনি তার ছুঁচো চাকর!

মহিমারঞ্জনের কথায় নন্দনের চোখ দুটো যেন ধক্ করে বারেকের জন্যে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। এবং শান্ত বিনম্র কণ্ঠে বললে, আজ্ঞে, কি আপনি বলছেন বাবু? আড়ি পেতে আমি আপনাদের কথা শুনতে যাব কেন?

তা ডাকতে এসে ঘরে না ঢুকে দরজার পাশে অমন করে দাঁড়িয়েই বা ছিলে কেন? জিজ্ঞাসা করলে এবার কিরীটীই।

ডাকতেই তো যাচ্ছিলাম বাবু। হঠাৎ আপনি কে কে করে উঠলেন, তাই চমকে দুপা পিছিয়ে গিয়েছি

আমি নন্দনের মুখের দিকেই কিন্তু একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিলাম। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের বেশি হবে না। বাহারে করে সেলুনে ছাঁটা তেল-চকে চুলের মধ্যে বিশেষ করে রগের পাশ দিয়ে দুচারটে চুলে পাক ধরেছে। গায়ের রঙ কালো, কিন্তু অটুট স্বাস্থ্যের জন্যে চেহারাটা মন্দ নয় দেখতে। ছোট কপাল, নাকটা একটু চাপা। ছোট ছোট চোখ দুটিতে যেন একটা সতর্ক ধূর্ততা।

পরিধানে সেদিনকার মতই ধোপদুরস্ত ধুতি ও গায়ে একটা ছিটের হাফ-শার্ট। ভৃত্য না বলে দিলে চট্ করে ভৃত্য বলে লোকটাকে ভাবাও মুশকিল এবং ভৃত্য হলেও সৌখীন ধনী লোকের সৌখীন ভৃত্য বলে বুঝতে ভুল হয় না!

সেদিন কিরীটী নন্দনের সঙ্গে বিশেষ কথা বলেনি। আজ তাকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে এল।

তোমার নাম তো নন্দন, তাই না? কিরীটী প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে।

বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে মেদিনীপুরে।

মণিকাদেবীর কাছে কতদিন আছ?

তা বাবু আট-দশ বছর হয়ে গেল।

তোমার মনিব লোক কেমন নন্দন? দে

বতা বাবু, অমন মন কারও হয় না। যেমন দয়া-মায়া, তেমনি ব্যবহার।

হুঁ। কত মাইনে পাও?

মাইনের কথা আর কি বলব বাবু! ধরা-বাঁধা তো কিছু নেই। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, চাইলেই পেয়েছি। দরকার হলে পাঁচশো টাকাও পাওয়া যায়।

বুঝলাম নন্দনের শেষের কথাতেই তার মনিব সম্বন্ধে কোন কথা তাকে কেটে ফেললেও পাওয়া যাবে না। কিরীটীও বুঝেছিল, তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে মহিমারঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার বললে, চলুন মহিমাবাবু। একবার ওপরটা ঘুরে আসা যাক।

চলুন। যেন একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই কিরীটীর প্রস্তাবে সায় দিলেন মহিমারঞ্জন। আচ্ছা, তুমি যেতে পার নন্দন। নন্দনের দিকে তাকিয়ে বললে কিরীটী।

অনুমতি পেয়ে নন্দন আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। সোজাসিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। আমরাও মহিমারঞ্জনের পিছনে পিছনে সিঁড়ি-পথে দোতলায় উঠতে লাগলাম।

হ্যাঁ, ভাল কথা।—সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একসময় কিরীটী মহিমারঞ্জনের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলে, সচ্চিদানন্দবাবুর চাবির গোছাটা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে?

না।

আপনার ভগ্নী রাধারাণীদেবী কেমন আছেন?

সেই রকমই।

পূর্ব-স্মৃতি তাঁর কিছুই মনে পড়ছে না এখনও?

না। আর ফিরে আসবে বলেও ডাক্তার ভট্টাচার্য তো বলছেন না।

একজন ভাল সিকিয়াট্রিস্টকে ডেকে এনে দেখান না একবার ওঁকে!

তাই দেখাব ভাবছি। আর আমার তো মনে হয়, এ একপক্ষে শাপে বরই হয়েছে রাধারাণীর পক্ষে।

কেন বলুন তো? সোৎসুক কষ্ঠে কিরীটী জিজ্ঞাসা করে কথাটা মহিমারঞ্জনকে।

তাছাড়া আর কি! এতবড় একটা শোক! নইলে ও হয়তো সামলাতেই পারত না।

তা অবশ্য কতকটা সত্যি বটে। কিন্তু—তবে ওর একটা অন্য দিকও তো আছে!

বুঝলাম না ঠিক। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কথাটা বলেন মহিমারঞ্জন কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে। মানে বলছিলাম, হঠাৎ যে স্মৃতি মস্তিষ্কের কোষে নিদারুণ কোন মানসিক আঘাতে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, আবার একদিন হঠাৎ ফিরেও তো আসতে পারে সেটা।

তাও সম্ভব নাকি?

কোন কোন ক্ষেত্রে সেরকম কথা শোনা গেছে বৈকি—তাছাড়া ডাক্তার ভট্টাচার্যও তো তাই বলেন।

কিন্তু আমার যেন মনে হল মহিমারঞ্জন কিরীটীর বক্তব্যের সঠিক তাৎপর্যটা না ধরতে পারলেও জবাবটা সে ঠিক দেয়নি। সে তার আসল বক্তব্যকে কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে অন্য জবাবের মধ্যে দিয়ে পরিস্থিতিটা বাঁচিয়ে গেল। এবং সেটা বুঝতে পেরেই কিরীটীর মুখের দিকে আমি তাকিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবলেশহীন একান্তভাবে নির্লিপ্ত সে মুখাবয়বের মধ্যে কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতেই কিরীটীর খেয়াল হল, সে আজ আর একবার তিনতলার ছাদের অর্কিড-ঘর বা কাঁচঘরটা দেখবে।

কাঁচঘরের দরজায় পৌঁছে দিয়ে মহিমাবাবু আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তাঁকে অফিসে একবার বেরুতে হবে। স্নান আহার সেরে তাঁকে প্রস্তুত হতে হবে।

যেতে যেতে মহিমাবাবু বললেন, বলেন তো আনন্দকে আমি পাঠিয়ে দিতে পারি কিরীটীবাবু।

না না—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। নিজেরাই আমরা দেখাশোনা করে নিতে পারব।

মহিমাবাবু চলে গেলেন।

কাঁচঘরের দরজা ঠেলে আমি আর কিরীটী ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাহিরে ঐ সময় প্রখর রৌদ্র ও তার তাপ থাকলেও কাঁচঘরের মধ্যে তার বিন্দুমাত্রও ছিল না। নিবিড় শান্ত একটা ছায়াস্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ যেন মুহূর্তে মনকে স্পর্শ করে।

চারিদিকে নানা জাতীয় লতাগুল্ম কোথাও সোজা উঠে গিয়েছে, কোথাও এঁকেবেঁকে, কোথাও লতিয়ে লতিয়ে চলেছে। তার মধ্যে পুষ্প ও পত্রের বহুবিধ বর্ণ-বৈচিত্র্য যেন কোন নিপুণ শিল্পীর তুলির টানে টানে রঙের আলপনা বুনেছে।

মনে পড়ল, মাত্র দিন তেরো-চোদ্দ আগে এই শান্ত সুন্দর পরিবেশের মধ্যেই হত্যার পাশবিক লিন্স দেখেছিলাম।

অসাড় প্রাণহীন দেহটি যেন এখনও চোখের ওপরে ভাসছে। অন্যমনস্কের মত কিরীটী এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এবং তাকাতে তাকাতেই সে অর্কিড-ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমিও তাকে অনুসরণ করছিলাম।

হঠাৎ একসময় কাঁচঘরের মধ্যস্থলে কাঠের সেই বেঞ্চটার উপরে নজর পড়তেই উভয়ে থমকে দাঁড়ালাম।

বেঞ্চের হেলান দেবার জায়গাটায় ডান হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে এক নারী-মূর্তি।

নারী-মূর্তিকে দেখামাত্রই তাকে চিনতে আমাদের কষ্ট হয়নি।

শিবানী!

পরিধানে সাদা মিলের চওড়া ভায়োলেট-পাড় শাড়ি। গায়ে আদির হাতকাটা ব্লাউজ। মাথায় পর্যাপ্ত এলানো কেশভার কিছুটা হাতের উপর দিয়ে মুখের একাংশ ঢেকে ও কিছুটা পিছন দিক দিয়ে ঝুলছে।

আমার মত কিরীটীও বোধ হয় একটু বিব্রত হয়ে পড়েছিল।

নির্জন কাঁচঘরের মধ্যে সকলের চোখের আড়ালে হয়তো ভদ্রমহিলা একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। উনি হয়তো ভাবতেও পারছেন না যে, তাঁর এই নির্জন নিরালা বিশ্রামের অবসরে আমরা অতর্কিতে এখানে এসে পড়েছি বা এসে পড়তেও পারি।

সামান্যতম ভদ্রতা বা রুচি যার আছে, ঐ অবস্থায় ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আমরাও তাই ফিরবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই মণিকা মুখ তুলে তাকাল। এবং হঠাৎই ঐসময় আমাদের সামনে দেখে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, কে? কে আপনারা?

গলার স্বরটা কিছুটা অস্বাভাবিক। কেমন যেন একটু ধরা-ধরা। শুধু তাই নয়, চোখ দুটোও যেন মনে হল কেমন ভেজা-ভেজা ও লাল।

আমরা বিশেষ দুঃখিত মণিকাদেবী। বুঝতে পারিনি যে আপনি এখানে থাকতে পারেন। এ সময়ে!

কিন্তু আকস্মিক সেই বিহ্বলতা মণিকা ততক্ষণে কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মৃদু সলজ্জ কণ্ঠে বলে, কিরীটীবাবু?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি উঠলেন কেন? বসুন!

না, আমি যাই।

আপনার যদি নীচে এখন কোন কাজ না থাকে তো একটু বসুন মণিকাদেবী। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।

নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই যেন মণিকা কিরীটীর অনুরোধে বেঞ্চটার উপরে আবার বসে পড়ল।

আপনি তো জানেন মণিকা দেবী—

কিরীটীর কথায় বাধা দিয়ে এবার মণিকা বললে, কিছু মনে করবেন না মিঃ রায়, আপনি আমাকে ঐ নামে না ডাকলেই সুখী হব। আপনি বোধ হয় জানেন, আমার আসল নাম ও নয়। আসল নাম আমার শিবানী চট্টোপাধ্যায়। ঐ শিবানী নামেই আমাকে এবার থেকে সম্বোধন করবেন দয়া করে।

বেশ, তাই হবে। হ্যাঁ, আমি যা বলছিলাম—আপনি তো জানেন, এখনও সচ্চিদানন্দবাবুর হত্যার ব্যাপারটার কোন একটা সঠিক মীমাংসাতেই আমরা আসতে পারিনি। তাই আবার এ বাড়িতে আমাদের আসতে হয়েছে।

আমরা ভুলতে চাইলেও, দেখছি আপনারা ভুলতে দেবেন না। কিন্তু সত্যিই কি আপনারা মনে করেন কিরীটীবাবু, এই কুৎসিত নিষ্ঠুর ব্যাপারটাকে মিথ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করে আর কোন লাভ আছে?

নিশ্চয়ই। আসল হত্যাকারীকে যতক্ষণ না আমরা চিহ্নিত করে তার একটা ব্যবস্থা করতে পারি, ততক্ষণ কেবল আমরা কেন, আপনারাও কি দায়মুক্ত হতে পারবেন শিবানীদেবী? অন্যায় যে করে আর অন্যায়কে যে সহ্য করে, দোষ তো উভয়েরই।

কিরীটীর শেষের কথায় কেন জানি না মণিকা আর কোন জবাব দিতে পারল না। চুপ করেই রইল।

আর শুধু কি তাই! যতক্ষণ প্রকৃত দোষী না ধরা পড়ছে, ততক্ষণ আপনারা কেউই ততা সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। আর এক্ষেত্রে সন্দেহটা কতখানি গুরুতর, তা তো আপনার অজানা নেই–হত্যার সন্দেহ!

এবারেও মণিকা কিরীটীর কথার কোন জবাব দেয় না।

যাক সে-কথা। প্রথম দিনের আলাপের সময়ে আপনার সঙ্গে ভাল করে আলাপের সুবিধা। হয়নি। আজ যখন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গিয়েছে, সেই অসমাপ্ত আলাপটা শেষ করে নিতে চাই। নিশ্চয়ই আপনার দিক থেকে কোন আপত্তি নেই?

মণিকা কিরীটীর শেষের কথায় বারেকের জন্য চোখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি নামিয়ে নিলে। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, না বলুন কি জানতে চান?

দেখুন শিবানীদেবী, আপনার সঙ্গে সামান্য আলাপেই বুঝতে পেরেছি, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আপনি। অযথা ভূমিকা করে মিথ্যে সময় নষ্ট করা আমার অভিপ্রেত নয়। অভিনয়ের জগতে আপনি একজন যথেষ্ঠ সুপরিচিতা। তাই আপনার সেই অভিনয়ের পাঁচ বছরের জীবন সম্পর্কে আমার কোন প্রশ্ন নেই—একটিমাত্র প্রশ্ন ছাড়া।

স্থির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মণিকা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

মাস আষ্টেক আগে স্বপনপুরী স্টুডিওতে সেতুবন্ধ বইতে আপনার রোলটি ছিল এক অভাগিনী জননীর। এবং আপনার কন্যার রোলের জন্য একটি নবাগতা তরুণী অভিনেত্রী মনোনীতা হয়েছিলেন—তাঁর নাম বনলতা। কথাটা কি সত্য?

অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে মণিকা জবাব দিল, হ্যাঁ।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বনলতা সে রোলে অভিনয় করেননি, তাই না?

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন বলুন তো?

তা আমি কি করে জানব?

কিন্তু জানবার কথাও আপনারই, কারণ তিনি আপনারই আবিষ্কার এবং আপনিই contract করিয়ে দিয়েছিলেন ও বনলতা শেষ পর্যন্ত অভিনয় না করায় আপনিই প্রডিউসারকে বনলতার কনট্রাক্ট-এর দরুন compensation দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছিলেন কেন ব্যাপারটা আমি শুনেছি।

কিরীটীর কথায় প্রথমটায় মণিকা কোন জবাব দিতেই যেন পারে না। কিন্তু মুহূর্ত-পরেই, পূর্ববং ধীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়, হ্যাঁ দিয়েছিলাম। তার কারণ, যখন অভিনয় করতে নেমে দেখলাম, বনলতা আদপেই আমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার পার্ট অভিনয় করতে পারছে না। আমার পার্টও ঐ সঙ্গে বাজে অভিনয়ের জন্যে নষ্ট হয়ে গিয়ে আমাকে না দুনামের ভাগী হতে হয়, তাই আমি বনলতাকে সরাই এবং সেই কারণেই আমি Compensation-টাও দিই।

সত্যিই কি তাই?

তাই।

কিন্তু আর দশজনের ধারণা কিন্তু অন্য।

তা সেরকম হলে আমি নাচার।

আচ্ছা, বনলতাকে আপনি প্রথম দিন শুটিংয়ের পরই নিজের ক্যামাক স্ট্রীটের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলেন—কথাটা কি সত্যি?

কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে ওঠে সহসা মণিকাদেবী। বলে, কে বললে সেকথা?

আমি জানি।

না। আপনি যদি তাই জেনে থাকেন, তাহলে জানবেন সেটা ভুল।

ভুল!

হ্যাঁ, সম্পূর্ণ ভুল। কারণ বনলতাকে কোনদিনই আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাইনি।

শুধু নিয়ে যাওয়াই নয়, এক মাস সে আপনার ওখানে ছিলও।

এসব আজগুবী কথা কার কাছে আপনি শুনেছেন মিঃ রায়, জানি না। সর্বৈব মিথ্যা–

শুধু তাই নয়, এক মাস আপনার ওখানে বনলতাদেবীকে, সাদা কথায় কতকটা বন্দিনীর মত রেখে, তারপর একদিন তাঁকে সঙ্গে করেই ট্যাক্সিতে চেপে কিছু মালপত্র নিয়ে চেঞ্জে যাবার নাম করে কোথায় যেন যান। ফিরে আসেন আরও মাসখানেক পরে। ফিরে আসেন অবশ্য আপনি একাই। এবং ফিরে এসে তার হপ্তাখানেকের মধ্যে বাড়ি তুলে দিয়ে, দোয়ান ও সোফারকে বিদেয় দিতে চার মাসের মাহিনা দিয়ে এখানে এসে ওঠেন।

এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানানো গল্প।

মিথ্যাও নয়, বানানোও নয় শিবানীদেবী। এবং সেকথা আপনি আমার চাইতে ভালই জানেন। এখন আমার জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, কে ঐ বনলতা মেয়েটি? কোথায় তাকে রেখে এলেন?

কি বলব বলুন? গল্পের কি কোন জবাব আছে?

ভুলে যাচ্ছেন শিবানীদেবী, আপনার সেই দরোয়ান অযোধ্যা সিং আজও বেঁচে আছে। প্রয়োজন হলে কোর্টে দাঁড়িয়ে সব কথাই সে বলবে।

তাকে দিয়ে ঐসব কথা বলাতে চান আপনারা বলতে পারেন—অযযাধ্যা সিং ভুল করেছে। আমার বাড়িতে একটি মেয়ে ছিল। একদিন স্টুডিও থেকে ফেরবার পথে পথের ধারে তাকে হেঁড়া জামা-কাপড় পরে ভিক্ষা করতে দেখে বলি, আমার বাড়িতে যদি সে কাজ করে, তাহলে তাকে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারি। খাওয়া-পরা সব দেব। সে রাজী হওয়ায় তাকে বাড়িতে এনে আমি রেখেছিলাম। তার নাম ছিল বুনো। আমার ভৃত্য নন্দনকে আপনি জিজ্ঞাসা করুন। সে-ই সব কথা বলবে। দেরাদুনে চেঞ্জে যাবার সময় বুনোকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাই। এবং দেরাদুনের বাড়ি থেকে এক রাত্রে সে কোথায় পালিয়ে যায়, আর তার সন্ধান পাইনি।

অবাক হয়েই মণিকাদেবীর কথা শুনছিলাম। কিরীটীর কথা যদি সত্যিই হয়, এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক, তাহলে বলতেই হবে, মণিকাদেবী সত্যিই একজন উচ্চশ্রেণীর অভিনেত্রী। অপূর্ব তাঁর অভিনয়-শৈলী! একেবারে নিখুঁত!

অতঃপর কিরীটীও আর কোন প্রতিবাদ জানাল না। কেবল দেখলাম, কি এক চাপা কৌতুকেতার চোখের তারা দুটো চকচক করছে। ওষ্ঠপ্রান্তেও একটা চাপা হাসির ঈষৎ বঙ্কিম কুঞ্চন।

যাক, বনলতাদেবীকে যখন আপনি চেনেনই না, তখন তো আর কোন কথাই নেই। আচ্ছা, এবার আপনার অভিনয়-জগতে আসবার পূর্বে এবং এ-বাড়ি ছাড়বার পর হতে মাঝখানের তিন বছরের মোটামুটি একটা ইতিহাস আমাকে জানাবেন কি?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, একটু ইতস্তত করে মণিকা বললে, সে আর কি শুনবেন—বিতাড়িত, আশ্রয়চ্যুত, সহায়-সম্বলহীন একটি তরুণীর দুঃখ ও কষ্টের ইতিহাস! এদেশে তো তার অভাব নেই কিরীটীবাবু, নতুন করে তার কি শুনবেন, আর শোনবার আছেই বা কি?

বাঃ, চমৎকার! মনে মনে অভিনেত্রী মণিকার প্রশংসা না করে পারলাম না।

যেমনি ধূর্ত এ পক্ষ, ততোধিক ধূর্ত অন্য পক্ষ। দুটি ধারালো তরবারির মুলাকাত যেন! কিরীটী বলে, দুঃখ তো আছেই। দুঃখকে বাদ দিয়েই বা কার জীবন বলুন, মণিকাদেবী? দুঃখের ইতিহাসের মধ্যে সত্যিই নতুন করে কিছু শোনবার নেই যে তাও আমি জানি। তা নয়, শুনতে চাইছি, কেমন করে হঠাৎ আপনি অভিনেত্রীর লাইনে এলেন? আর এ বাড়ি ছেড়ে যাবার পর ঐ তিনটে বছর কোথায়-কোথায়ই বা আপনি ছিলেন?

ছিলাম তো অনেক জায়গাতেই। সব কি আর মনে আছে! মানুষের জীবনে দশ দশার সে এক দশা আমারও কেটেছে কোনমতে।

মনে মনে সত্যিই কিরীটীর অবস্থা দেখে না হেসে পারছিলাম না। এমন শক্ত পাল্লায় কিরীটী বোধ করি ইতিপূর্বে খুব কমই পড়েছে।

সহসা কিরীটী প্রশ্নের ধারাটা একেবারে অন্য খাতে নিয়ে গেল।

আচ্ছা শিবানীদেবী, অসুস্থ রোগগ্ৰস্তা মাকে ঐভাবে অন্যের আশ্রয়ে ফেলে চলে গেলেন—একবারও তাঁর কথা কি আপনার মনে হয়নি? বা একবারও কি ইচ্ছা যায়নি, অসুস্থ মাকে একবার এসে দেখে যেতে?

মা! চমকিত কষ্ঠে যেন শব্দটা মণিকার কষ্ঠ হতে উচ্চারিত হল।

হ্যাঁ, আপনার মা। যাঁকে সেরাত্রে জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান জেনেও সচ্চিদানন্দবাবুর স্ত্রীর তাড়া খেয়ে এ বাড়ি থেকে আপনাকে চলে যেতে হয়েছিল।

মণিকাদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ঐ মুহূর্তে যেন জমে একেবারে সে পাথর হয়ে গিয়েছে। দেহে প্রাণের কোন চিহ্নমাত্রও নেই।

কিরীটীর সেদিকে যেন ভূক্ষেপও নেই। তেমনি পূর্ববৎ কঠিন শ্লেষভরা কণ্ঠে বলে চলেছে, আশা করতে পারি নিশ্চয়ই, বিশেষ করে কোন মেয়ে তার বিধবা মায়ের অসুখ হলে তাঁর জন্য উৎকণ্ঠিত হবে?

ওঃ, আমার মার কথা বলছেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, মার জন্য আমার উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না বৈকি, কিন্তু যে বাড়ি থেকে গলাধাক্কা খেয়ে মিথ্যে কলঙ্কের বোঝা কাঁধে নিয়ে আমাকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল, সে-বাড়িতে পুনঃপ্রবেশের দুঃসাহস আর আমার ছিল না। তাছাড়া ঐ মুহূর্তে নিজের অপমানের জ্বালাতেই আমি জ্বলেপুড়ে মরছিলাম, তাঁর কথা আমার ভাববারও অবকাশ ছিল না।

কিন্তু তার পর? নিজেকে যখন একটু গুছিয়ে নিলেন, তখনও কি অভাগিনী মায়ের কথা একটিবারও আপনার মনে পড়েনি?

পড়েছে বৈকি। মাকে চিঠিও দিয়েছিলাম, কিন্তু মা আমার চিঠির কোন জবাবই দেননি।

হঠাৎ এমন সময় আমাদের কানে প্রবেশ করল মচমচ একটা জুতোর শব্দ।

আমি আর কিরীটী দুজনেই যুগপৎ আমরা ফিরে তাকালাম, অফিসে যাবার জন্য বোধ হয় একেবারে প্রস্তুত হয়েই এসেছেন মহিমারঞ্জন।

.

মহিমারঞ্জন এগিয়ে এলেন।

মণিকাকে ঐ সময় কাঁচঘরে দেখবেন ভদ্রলোক বোধ হয় আশা করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম ভূ-দুটো তাঁর কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বুঝলাম, ভদ্রলোক মণিকার উপরে বিশেষভাবেই বিরক্ত হয়ে উইছেন।

তুমি এখানে রয়েছ মণিকা, ওদিকে রাধারাণীর নাওয়া-খাওয়ার সময় হল। বেলা কটা বাজে খেয়াল আছে কি?

যাচ্ছি এখুনি।

ওঁর কোন দোষ নেই। আমরাই ওঁকে আটকে রেখে কথা বলছিলাম। কিরীটী বললে।

মণিকা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে নাম ধরে ডেকে যেতে বাধা দিল, দাঁড়ান শিবানীদেবী, আমার আর কয়েকটি কথা ছিল—

আপনাকে তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে কিরীটীবাবু। আপনি বরং কিছুক্ষণ এই কাঁচঘরেই বসুন, আমি কাজ সেরেই আসছি। মণিকা কাঁচঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

বেশ, তাই আসুন। এখানে আমরা রইলাম।

ওঃ, আপনারা তাহলে বসুন মিঃ রায়। আমি অফিসে চলি। মহিমারঞ্জন বললেন।

আচ্ছা। কিরীটী সম্মতিসূচক মাথা দোলায়।

মহিমারঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল, তাঁর অবজ্ঞানে এ-বাড়িতে আমাদের থাকাটা তিনি বিশেষ প্রীতির সঙ্গে যেন নিলেন না। কিন্তু মুখেও কিছু বলতে পারলেন না। বিরক্তিতে মুখটা অন্ধকার করে কাঁচঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

ক্রমে মহিমারঞ্জনের জুতোর শব্দ কাঁচঘরের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।

এতক্ষণ জ্ঞরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মণিকার সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলাম। কিরীটী এবারে এগিয়ে গিয়ে খালি বেঞ্চটার উপরে বসতে বসতে বললে, বোস্ সুব্রত।

পাশে বসলাম।

কিরীটী নিঃশব্দে পকেট থেকে চামড়ার সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগার টেনে নিয়ে ওষ্ঠপ্রান্তে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করলে।

কিরীটী ধূমপান করতে থাকে। নিঃশব্দে কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়।

ইংরাজীতে যে একটা প্রবাদ আছে hard nut-অভিনেত্রীটির বেলায় কথাটা একেবারে সুবৰ্ণ প্রয়োগ বলা চলে। আমি মৃদু কণ্ঠে কিরীটীকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

তা হয়তো চলে, তবে আমি ভাবছি, মণিকাদেবী নির্জনে বসে কার জন্য শোক করছিলেন নিঃশব্দে গোপনে চোখের জল ফেলে।

সত্যিই তো! কথাটা আদপেই আমার মনে ছিল না। এই কাঁচঘরে প্রবেশ করে মণিকাদেবীর সঙ্গে আচমকাচোখাচোখি হতেই তো জলে-ছলছল দুটিরক্তবর্ণ চক্ষু আমাদের নজরে পড়েছিল।

অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রঙ্গমঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে যে হাসে-কাঁদে, তাকে আমরা অভিনয়ই বলি। এবং তাদের হাসি-কান্নার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও হাসি-কাঁদি, তারপর অভিনয়-শেষে সেটা ভুলেও যাই। ভাবি, ও তো অভিনয়ই মাত্র। কিন্তু সাজঘরের মধ্যে সকলের আড়ালে আত্মগোপন করে যদি তাকে হঠাৎ আমরা হাসতে বা কাঁদতে দেখি, সেটাকে কি ঠিক অভিনয় বলা চলে?

কি তুই বলতে চাস কিরীটী?

বলতে আমি এইটুকুই চাই, মণিকাদেবী যে একজন সত্যিকার উঁচুদরের পাকা অভিনেত্রী, তাতে নিঃসন্দেহে কোন মতদ্বৈধই নেই আমার। কিন্তু আজ কিছুক্ষণ আগে এই কাঁচঘরে প্রবেশ করে তার যে অশু-ছলছল রাঙা দুটি চোখ দেখেছিলাম, সেটা যে অভিনয় নয়, সে সম্পর্কেও আমি নিঃসন্দেহ ও আমার কোনরূপ মতদ্বৈষ নেই। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো শেষ করলে।

জবাব দেবার মত আমিও কিছু খুঁজে পেলাম না। কিরীটীর যুক্তিটা যে নেহাতই অকাট্য, সে-সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশও নেই।

নারীচরিত্র দুজ্ঞেয়, কিন্তু তার চাইতেও ঢের বেশী দুয়ে বুঝি অভিনেত্রী-চরিত্র।

আপাতত ঘটনাপরম্পরায় সচ্চিদানন্দের হত্যার ব্যাপারে যা কিছু সন্দেহযুখে না প্রকাশ করলেও, অভিনেত্রী মণিকাদেবীকে ঘিরেই যেন জমাট বেঁধে উঠেছিল। তথাপি কেন জানি না, মনের মধ্যে অভিনেত্রী মণিকাকে আমি হত্যাকারিণী বলে চিহ্নিত করতে পারছিলাম না। সামান্য পরিচয়ের মধ্য দিয়ে কেন জানি না বার বার ঐ একটা কথাই মনের মধ্যে এসে আমার গোলমাল বাধাচ্ছিল, মণিকার সবটুকুই অভিনয় নয়। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ সংশয় অসংশয়ে আমাকে সমস্ত যুক্তি মেনে নিতে দিচ্ছিল না।

হঠাৎ কিরীটীর প্রশ্নে আবার চমক ভাঙল, আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস সুব্রত, প্রথম দিনের সেই দাঁড়োপবিষ্ট বাকপটু লালমোহন পাখীটিকে তোকই নীচের দালানে সিঁড়ির কাছে আজ দেখলাম না!

লালমোহন পাখী!

হ্যাঁ রে, মনে নেই তোর? সেই প্রথম দিন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠবার মুখে যে পাখীটি বলে উঠেছিল, কে রে সুধা?

সত্যিই তো! মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে সেই পাখীটার কথা।

পাখীটা সিঁড়ি দিয়ে আমাদের উঠতে দেখে সতর্ক প্রহরীর মত প্রশ্ন করেছিল: উপরে যাও কেন? কে গা?….মনে হয়েছিল জব্বর পাহারা। সেখ এড়াবার উপায় নেই।

সত্যিই তো! পাখীটা দেখলাম না তো নীচে!

অনভিপ্রেত সতর্ক পাহারার জন্যে তাকে হয়তো ইচ্ছা করেই কোথাও সরানো হয়েছে। কিরীটী কতকটা স্বগতোক্তির মতই যেন কথাগুলো বললে।

.

চুপ করে আমি বেটার উপরে বসেছিলাম। কিরীটী অন্যমনস্কভাবে অর্কিডঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ এক সময়ে চোখে পড়ল, একটা মাটির টবের পাশে নীচু হয়ে বসে কি যেন সে কুড়িয়ে নিল।

কি রে কিরীটী?

কিরীটী আমার ডাকে কোন সাড়া না দিয়ে আবার যেন টবটার আশেপাশে কি খুঁজতে লাগল। আমিও উঠে পড়ে এগিয়ে গেলাম।

কি খুঁজছিস?

কাঁচের সিরিঞ্জের একটা অংশ। সিরিঞ্জের ভাঙা খোলটা পেয়েছি, কিন্তু এখনো পিস্টনটা পাইনি। দেখ তো খুঁজে পাস কিনা! বলতে বলতে কিরীটী ক্ষণপূর্বে প্রাপ্ত কাঁচের সিরিঞ্জের অংশটা আমাকে দেখালে।

আরও কিছুক্ষণ দুজনে খোঁজাখুজি করে সিরিঞ্জের প্রার্থিত পিস্টনটি পাওয়া গেল না বটে, তবে একটা সরু নিক্স পাওয়া গেল।

আরও কিছুক্ষণ হয়তো জিনিসটা খুঁজতাম, কিন্তু অদূরে পদশব্দ পেয়ে দুজনেই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মণিকাদেবী ফিরে আসছে এবং তার পশ্চাতে ঐ বাড়িরই ভৃত্য রঘুর হাতে ট্রের উপরে দুকাপ ধূমায়িত চা।

এ কি! আবার চা আনতে গেলেন কেন কষ্ট করে আপনি শিবানীদেবী? আমি বললাম।

না না—বেশ করেছেন—অসংখ্য ধন্যবাদ ব্যাপারটার জন্যে পূর্বাহ্নে প্রস্তুত না থাকলেও এখন দেখছি সত্যিই চায়ের পিপাসা পেয়েছিল।

বলতে বলতে সহাস্যে কিরীটী ট্রের উপর থেকে একটা কাপ তুলে নিলে। আমিই বা

তবে বাদ যাই কেন, আমিও বাকি কাপটি হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম।

ভৃত্য রঘু শূন্য ট্রে-টা নিয়ে প্রস্থানোদ্যত হতেই কিরীটী তাকে সম্বোধন করে ডাকল, তোমার নাম তো রঘু তাই না?

রঘু কিরীটীর ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

আচ্ছা রঘু, তোমাদের এ বাড়িতে নীচের দালানে দাঁড়ে যে একটি চমৎকার লালমোহন পাখী সেদিন দেখেছিলাম, সেটা তোকই দেখলাম না আজ?

রঘু কেমন যেন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকালে। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, পাখীটাকে বিড়ালে একদিন প্রায় শেষ করে দিয়েছিল, তাই আজকাল আর দালানে না রেখে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখেছি। কতবাবুর বড় প্রিয় ছিল পাখীটা। নিজের হাতে সকালে বিকেলে পাখীটাকে ফল খাওয়াতেন। রোজ তিন-চার টাকার আপেল, কলা প্রভৃতি ফল মার্কেট থেকে আসত পাখীটার জন্যে, কিন্তু এখন তাকে ছোলা খেয়েই থাকতে হয়।

আহা! কেন রঘু, হঠাৎ তার ফল বন্ধ হল কেন?

মামাবাবুর হুকুম। পাখী আবার তিন-চার টাকার বোজ বোজ ফল খাবে কি?

কিরীটী মণিকাদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, এ বাড়িতে এখন কতা বুঝি মহিমাবাবুই?

মণিকা কিরীটীর কথার কোন জবাব দিল না। কেবল নিঃশব্দে একটা হাসির বঙ্কিম রেখা মণিকার চাপা ওষ্ঠপ্রান্তে চকিতে বিদ্যুৎ-চমকের মত দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। এবং সেই নিঃশব্দ চকিত হাসির মধ্য দিয়েই ব্যাপারটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় আর কোন প্রশ্নের প্রয়োজন রইল না।

সচ্চিদানন্দর অবর্তমানে এখন তাহলে মহিমারঞ্জনই এ বাড়ির মালিকানা স্বত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন।

কিন্তু ঐ সঙ্গে মনে পড়ল আর একটা কথা। সচ্চিদানন্দর উইল সম্পর্কে কি মহিমারঞ্জন জ্ঞাত? তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির তিনের-চার অংশের মালিকই তো ঐ শিবানীদেবী!

তবে কি তাই? মহিমারঞ্জন কি উইলের রহস্য জানতে পেরেছেন? তাই কি তিনি মণিকার উপরে এতটা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন ইদানীং?

ইতিমধ্যে চা-পান শেষ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। রঘু চায়ের শূন্য কাপ দুটি নিয়ে কাঁচঘর থেকে চলে গেল।

কিরীটী এবারে মণিকাকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করলে, আপনি নাকি শুনলাম শীগগির এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শিবানীদেবী?

কে বললে?

শুনেছি। কথাটা কি সত্যি?

মৃদু কণ্ঠে একটু ইতস্তত করে মণিকা জবাব দিলে, হ্যাঁ।

কিন্তু সচ্চিদানন্দবাবুকে লেখা আপনার সে-চিঠি পড়ে তো মনে হয় না তা?

কিরীটীর কথায় চমকে যেন তার মুখের দিকে তাকাল মণিকা। এবং নিয় কণ্ঠে বললে, সে চিঠির কথা আপনি-আপনি জানলেন কি করে?

স্বয়ং চিঠির মালিকই আমাকে চিঠিটা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে-কথা যাক। কিন্তু কই আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না তো?

কি জবাব দেব?

এখান থেকে আপনি চলে যাবেন বলে তো সেদিন আসেননি?

না, তা আসিনি বটে, তবে ইতস্তত করে মণিকা চুপ করে যায়। তার বক্তব্য শেষ করে না।

তবে?

অনেক আশা নিয়েই এখানে এসেছিলাম সত্য, মিঃ রায়। কিন্তু তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, সমস্ত আশা আমার এমনি করে ভাগ্যদোষে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে! শেষের দিকে মণিকার গলাটা যেন কেমন ধরে আসে। মনে হল, চোখের কোণেও বুঝি জল এসে গেছে।

দুর্ঘটনার উপরে তো মানুষের কোন হাত নেই শিবানীদেবী!

তা জানি। তবু যেন মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। আমি এ-বাড়িতে পা দেবার পর দেড় মাসও গেল না, কোথা থেকে কি যেন হয়ে গেল! সেই কথাটাই যেন বার বার মনে হচ্ছে।

আচ্ছা আপনি সচ্চিদানন্দবাবুর উইল সম্পর্কে কিছু জানেন, শিবানীদেবী?

না।

উইল সম্পর্কে কোন আলোচনাও হয়নি আজ পর্যন্ত?

না। তবে মামাবাবুর মুখেই একবার শুনেছিলাম এর মধ্যে কবে যেন, সামনের শনিবার উইল পড়া হবে।

আচ্ছা, ধরুন উইল যদি বলে, এ-বাড়ির সম্পত্তির উপরে আপনার অনেকখানিই দাবি আছে, তাহলে?

না মিঃ রায়, টাকাকড়ি, ধন-দৌলতের উপরে কোন লোভ বা আকর্ষণই নেই আমার। আপনি হয়তো জানেন, অভিনেত্রী-জীবনে প্রচুর উপার্জন আমি করেছি। তারপর একটু থেমে মণিকা আবার বললে, চলে আমি অনেক আগেই যেতাম, কিন্তু কাকীমার কথা যখনই ভাবি, মনে হয় তাঁকে কার হাতে দিয়ে যাব! লুপ্তস্মৃতি এক শিশুর চাইতেও বুঝি তিনি অসহায়।

কেন, আনন্দবাবু তো আছেন? কিরীটী বলে।

আনন্দবাবু! হ্যাঁ, তিনি আছেন বটে। কিন্তু তিনি পুরুষ না হয়ে যদি স্ত্রীলোক হতেন তবে কোন ভাবনাই তো আর আমার থাকত না! স্বচ্ছন্দে তাঁর হাতে সব তুলে দিয়ে যেতে পারতাম!

আচ্ছা, মিসেস সান্যাল কি এখনও তেমনিই আছেন? কোন পরিবর্তনই হয়নি?

না। যদিও কথাটা শুনতে ভাল নয়, তাহলেও আমার কি মনে হয় জানেন, বাকি জীবনটা তাঁর যদি স্মৃতিভ্রংশ হয়েই কেটে যেত, তাহলে হয়তো তাঁর পক্ষে সত্যিই মঙ্গল হত।

এ কথা কেন বলছেন শিবানীদেবী? কিরীটী প্রশ্ন করে।

মঙ্গল নয়? এই বয়সে অত বড় শোক তিনি সামলাবেন কেমন করে বলুন তো!

জবাবে এবারে কিরীটী আর বিশেষ কোন কথা বললে না। বুঝলাম, যে কোন কারণেই হোক, প্রসঙ্গটাকে সে আর বেশী টানতে চায় না।

অতঃপর কিরীটী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলুন শিবানীদেবী, নিচে যাওয়া যাক।

চলুন।

আগে আগে মণিকা ও পশ্চাতে আমি ও কিরীটী দরজার দিকে অগ্রসর হলাম। এদিক-ওদিক দু পাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলেছি। মাথার মধ্যে তখনও সেই সিরিঞ্জের পিস্টনটা ঘোরাফেরা করছে। হঠাৎ নজরে পড়ল, একটা চৌকো কাঠের বাক্সতার মধ্যে বিচিত্র এক চওড়া পাতাওয়ালা অর্কিড গাছ, তার পাশেই পড়ে আছে কি যেন একটা।

এগিয়ে গিয়ে সামনে ঝুঁকে দেখতেই বুঝলাম, একটা চাবির গোছা। নীচু হয়ে নিঃশব্দে চাবির গোছাটা তুলে নিলাম। অযত্নে, অবহেলায় মাটিতে পড়ে থেকে ইতিমধ্যেই বেশ মরচে ধরতে শুরু করেছে।

কি রে সুব্রত? কিরীটী প্রশ্ন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

একগোছা চাবি।

চাবি! দেখি—

চাবির গোছাটা দেখালাম।

রিং সমেত চাবিগুলোর দিকে তাকিয়েই মণিকা বলে ওঠে সহসা, ঐ তো কাকাবাবুর চাবির রিংটা! আরে–

চারি গোছাটা কিরীটী হাতে নিল।

নানা আকারের ছোট-বড়-মাঝারি প্রায় উনিশ-কুড়িটা চাবি রিংটার মধ্যে রয়েছে।

এইটাই সচ্চিদানন্দবাবুর চাবির গোছা, আপনি ঠিক জানেন শিবানীদেবী? কিরীটী মণিকাদেবীর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রশ্নটা করে।

হ্যাঁ। কতদিন দেখেছি তাঁর হাতে ঐ চাবির রিংটা। কখনো কারও হাতে তিনি ভুলেও চাবির গোছা দিতেন না।

.

প্রথমেই আমরা দোতলায় এসে মিসেস্সান্যাল যে-ঘরে ছিলেন সেই ঘরে প্রবেশ করলাম।

একটা সোফার উপরে মিসেস সান্যাল বসে ছিলেন চুপচাপ। মাথার অবগুণ্ঠন শিথিল হয়ে কাঁধের উপরে খসে পড়েছে। সদ্য-স্নানের পর ভিজে চুলের রাশ ছড়িয়ে আছে পিঠের উপরে।

পরিধানে একটা সাদা থান। হাতে অবশ্য একগাছি করে সোনার চুড়ি আছে।

আমাদের পদশব্দে মুখ তুলে তাকালেন। চোখে কেমন যেন অসহায় শূন্য দৃষ্টি।

নমস্কার! চিনতে পারছেন আমাকে? কিরীটী এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল।

মৃদুভাবে মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ।

কে বলুন তো আমি?

কিরীটীবাবু।

কিরীটী বোধ হয় এতটা আশা করেনি। আনন্দে চোখ-মুখের চেহারা তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

আপনার স্নান-আহার হয়েছে?

হ্যাঁ। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।

আমরা উভয়ে পাশের খালি সোফাটা অধিকার করে বসলাম।

.

ভাবছিলাম এক স্মৃতিভ্রষ্ট নারীর সঙ্গে কি কথাই বা কিরীটী বলতে চায়, আর কি ভাবেই বা শুরু করতে চায় তার বক্তব্য। যাঁর সমস্ত অতীত একেবারে ধুয়ে-মুছে, একাকার হয়ে গিয়েছে এবং যে অতীতও বিকৃত অনুভূতির মধ্যে অস্পষ্ট ধোঁয়াটে বর্তমান নিয়ে, তাঁর সঙ্গে কি আলোচনাই বা হতে পারে? বিশেষ করে, যখন বর্তমানের চাইতে তাঁর সেই অতীতটাই আমরা জানতে চাই, তখন বর্তমান নিয়ে আলোচনা চালাবার সার্থকতাই বা কী এবং কতটুকু!

কিরীটী কিন্তু ততক্ষণে কথা শুরু করেছে, আচ্ছা মিসেস সান্যাল, এ বাড়িতে আপনারা অনেক দিন আছেন, না?

বোধ হয় আছি। জবাব দিলেন রাধারাণী। ঠি

ক কতদিন আছেন বলে মনে হয়? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল।

তা তো ঠিক জানি না।

এ বাড়ির কোথায় কি আছে বলতে পারেন?

না। এ ঘর থেকে তো আমি বের হই না।

কেন?

আমাকে যে কেউ এ ঘর থেকে বের হতেই দেয় না।

আমরা অদূরে উপবিষ্ট মণিকার মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল, তার দু চোখে যেন কি এক করুণ মিনতি। সে যেন নীরব কাকুতিভরা দৃষ্টি নিয়ে বলতে চায়, ও সব থাক্।

কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না।

হঠাৎ এমন সময় রাধারাণীদেবী নিজেই প্রশ্ন করলেন, আমার স্বামী কবে ফিরবেন বলতে পারেন কিরীটীবাবু?

রাধারাণীদেবীর প্রশ্নে দুজনেই আমরা চমকে উঠেছিলাম। প্রশ্নটা যেমনি অপ্রত্যাশিত তেমনি আকস্মিক। তাই কয়েকটা মুহূর্ত যেন আমাদের কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না।

রাধারাণী আবার বললেন, ওরা বলছিল, তিনি নাকি কোথায় বিদেশে গিয়েছেন। কিন্তু এ কিরকম বিদেশ যাওয়া বলুন তো! স্ত্রীকে কোন কিছু না জানিয়ে এমনি করে বিদেশে চলে গেলেন। আর গেলেন যদি বা, আসছেন না কেন? এই পর্যন্ত বলে শেষে আবার কতকটা আত্মগতভাবেই যেন বলতে লাগলেন, ওরা বলে, স্বামী আমার বিদেশে গেছে। তা যাক, কিন্তু লোকটাকে চিনি বলে তো মনে হয় না! মুখটাই মনে পড়ে না।

কি জানি কেন, অন্যের শুতিগোচর না হলেও আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়িয়ে যায়নি শেষের একটি কথাও তাঁর এবং সহসা দুচোখের কোলে আমার জল এসে যায়।

হায় নারী! তুমি জানলেও না, কত বড় ক্ষতি তোমার হয়েছে। যে স্বামীকে তুমি আজ আর মনেও করতে পারছ না, সত্যিই সে আর ইহজগতে নেই!

আচ্ছা মিসেস্ সান্যাল, আগের কোন কথাই কি আপনার মনে পড়ে না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

কোন্ কথা?

আপনার স্বামীর কোন কথা?

না। আশ্চর্য, লোকটাকে যেন মনেও করতে পারি না। এরাও কেউ কিছু বলে না। আপনি নিশ্চয় চিনতেন তাঁকে, অন্তত আপনার কথা শুনে তাই মনে হয়। কি রকম দেখতে ছিলেন তিনি বলুন তো।

হ্যাঁ, আমি তাঁকে চিনতাম। কিন্তু আজ আমাকে এখুনি যেতে হবে। আবার কাল পরশু আসব। তখন বলব ওসব কথা। আজ উঠি, কেমন? বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী উঠে দাঁড়ায়।

বেশ! রাধারাণীদেবী বলেন।

নমস্কার!

রাধারাণীদেবীও দুহাত তুলে নমস্কার জানালেন।

আমরা অতঃপর ও-ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

.

আমরা অতঃপর কিরীটীর ইচ্ছামত দোতলায় সচ্চিদানন্দের বসবার ঘরে এসে প্রবেশ করলাম।

মণিকাও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো।

চাবির গোছর মধ্যেই ঘরের সেক্রেটারিয়েট ড্রয়ারের চাবি ছিল। তারই সাহায্যে কিরীটী ড্রয়ারগুলো এক এক করে খুলে, ভিতরকার কাগজপত্র সব উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

একটা ফ্ল্যাট-ফাইলের মধ্যে সেই প্রথম দিনকার পরিচয়ের সময় মণিকাদেবী লিখিত যে চিঠিটা সচ্চিদানন্দ দেখিয়েছিলেন, সেটা পাওয়া গেল।

কিরীটী চিঠিটা নিয়ে নিজের পকেটে রাখল।

আর একটা ফাইলের মধ্যে কতকগুলো বিভিন্ন সময়কার রেজেস্ট্রি চিঠির একনলেজমেন্ট রসিদ পাওয়া গেল।

পর পর তারিখ অনুসারে একনলেজমেন্ট রসিদগুলো একটা ক্লিপ দিয়ে একসঙ্গে আঁটা।

দেখলাম প্রত্যেকটা রসিদেই যতীন্দ্রনাথ চাটুয্যের নাম সই করা রয়েছে। প্রত্যেকটা রসিদই তিনি রিসিভ করেছেন।

প্রথম রসিদের প্রাপ্তির যে তারিখ সই করা আছে, সেটা আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগেকার একটা দিন—৭ই জুলাই। এবং শেষ রসিদ এগারো বছর আগেকার তারিখ ৭ই জানুয়ারী। অর্থাৎ মোল বৎসর ধরে প্রত্যেক মাসের নিয়মিত ৭ই যতীন চাটুয্যের নামে একটি করে রসিদযুক্ত রেজেস্ট্রি চিঠি গিয়েছে। এবং সেই চিঠি তিনি রসিদে সই করে নিয়েছেন।

কি এমন চিঠি, যতীন চাটুয্যের নামে সচ্চিদানন্দ দীর্ঘ যোল বছর ধরে প্রত্যেক মাসের ঠিক সাত তারিখে যাতে পান, সেই ভাবে পাঠিয়েছেন?

কিই বা থাকতো সেই চিঠির মধ্যে? এবং কিরীটীর মুখেই শুনেছিলাম, যতীন চাটুয্যে মরবার পরও পত্রপ্রেরক তাঁর মৃত্যু-সংবাদ না জানায় ঐভাবে রেজেস্ট্রি করে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু সে-চিঠি গ্রহীতা জীবিত না থাকায় ফিরে আসে প্রেরকের কাছে ঠিক এগারো বছর আগে। তারপর অবিশ্যি আর চিঠি যায়নি।

চকিতে তখন একটা কথা মনে পড়ল।

তাই যদি হয় তাহলে প্রথম রাত্রে পরিচয়ের সময় সচ্চিদানন্দ যে বলেছিলেন, তিনি তাঁর বন্ধুর মৃত্যু-সংবাদ তাঁর বিধবা স্ত্রী নারায়ণীদেবীর মুখেই বন্ধুর মৃত্যুর তিন বৎসর পরে প্রথম শুনতে পান, সেটা মিথ্যে? তিনি পূর্বেই জানতেন তাঁর বন্ধুর মৃত্যুর কথা!

তবে তিনি আমাদের কাছে সে-রাত্রে মিথ্যা বলেছিলেন কেন? আর যতীনের স্ত্রী নারায়ণী যখন তাঁর স্বামীর এতবড় একজন সত্যিকারের বন্ধুর কথা জানতেনই, তখন স্বামীর মৃত্যুর পরই সচ্চিদানন্দর কাছে চলে এলেনই বা না কেন কন্যাকে নিয়ে?

হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীর দিকে তাকিয়ে দেখি, লাল ফিতেয় বাঁধা খানকয়েক চিঠি খাম থেকে উল্টে-পাল্টে দেখছে সে গভীর মনোেযোগের সঙ্গে।

চিঠির বাণ্ডিলটা কিরীটী আবার লাল ফিতেটা দিয়ে বেঁধে, সেগুলো ও রসিদগুলো পকেটস্থ করল। সেদিনকার মত ড্রয়ারে চাবি দিয়ে মণিকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ও বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম।

সঙ্গে এনেছিলাম আমরা কয়েকটা জিনিস।

একটা গ্লাস-সিরিঞ্জের ভাঙা অংশ, একটা হাইপোডারমিক নি, খানদশেক চিঠি নিয়ে একটা বাণ্ডিল, একগোছা একনলেজমেন্ট রসিদ ও সচ্চিদানন্দর হারানো চাবির গোছাটা।

একটা টেবিলের উপর একে একে জিনিসগুলো দ্বিপ্রহরের দিকে সাজিয়ে রাখছিল কিরীটী। এবং আরও রাখল প্রথম দিনে প্রাপ্ত দুমড়ানো ফটোটা ও একগাছি চাল-সাদা সূতত, যেটা মৃতের মুঠি থেকে সে উদ্ধার করেছিল।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একসময় কিরীটী প্রশ্ন করল, চিঠিগুলো পড়েছিস সুব্রত?

না।

পড়ে দেখ—

চিঠিগুলো হাতে তুলে নিলাম।

প্রথম চিঠিখানি খুলে মনঃসংযোগ করলাম। মেয়েলী হাতের গোটা গোটা আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা চিঠি।

চিঠির উপরে কোন জায়গার নাম নেই; কিন্তু বছর আঠারো আগেকার লেখা চিঠিটা কেবলমাত্র তারিখ দেখে বোঝা যায়।

আমি তোমার আশ্রয় ছেড়ে আজ রাত্রেই চলে যাচ্ছি এবং চিরদিনের মতই চলে যাচ্ছি। কেননা পরশু রাত্রে যা হয়ে গেল, তারপর অনেক ভেবেই আমাকে এই পথ নিতে হল। ভেবে দেখো, এতে তোমার আমার উভয়েরই মঙ্গল। কিন্তু এও তুমি জেনো, আমার কাছ থেকে তুমি তাকে ছিনিয়ে নিলেও সে আমারই। এবং তা যদি সত্য হয় তো একদিন না একদিন তাকে আমি খুঁজে বের করবই। আজ যাবার আগে জানিয়ে যাই, তোমার সমস্ত প্রতারণা, সমস্ত ধাপ্পাবাজি আমি ধরতে পেরেছি।

শেষ কথা, তুমি আমাকে খোঁজবার চেষ্টা করো না। আর করলেও সফল হবে না জেনো। সুধা আজ থেকে তোমার কাছে মৃত। এবং এও বলে যাচ্ছি, একদিন বুঝবে, আমার সঙ্গে তুমি কত বড় প্রতারণা করেছ। ভগবান বলে যদি কেউ থাকেন তো এর বিচারের ভার আমি তাঁর হাতেই তুলে দিয়ে গেলাম। ইতি–

সুধা

.

দ্বিতীয় পত্র: চিঠিটা লিখেছেন যতীন চাটুয্যে তাঁর বন্ধু সচ্চিদানন্দকে। চিঠির তারিখ প্রথম রসিদের তারিখের মাসখানেক আগেকার।

প্রিয় নন্দ,

তোমাকে তো সেদিনও বলেছি, আজও বলছি, তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পার। স্বেচ্ছায় যে দায়িত্ব আমি আমার কাঁধে তুলে নিয়েছি, জীবনে কখনও তা থেকে আমি বিচ্যুত হব না। ছোটবেলা থেকে তো তুমি আমাকে জানো। কথার খেলাপ কখনও আমি করি না। আর সেও কখনও আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না। বেশি কথা আমি বলি না এবং বেশি কথা আমি লিখতেও ভালবাসি না, তাই এইখানেই ইতি করছি। ভালবাসা জেনো।

তোমার চিরদিনের অভিন্নহৃদয় যতীন।

তৃতীয় পত্র যতীন-চাটুয্যেরই লেখা।

তারিখ আরও বৎসরখানেক পরের।

প্রাপ্তি-সংবাদ নিশ্চয়ই তুমি পেয়েছ। কিন্তু কেন এভাবে আমাকে বিব্রত করছ বল তো? আমি গরীব স্কুল-মাস্টার, কিন্তু তাই বলে পোলাও-কালিয়া না জুটলেও শাকান্ন জোটে। এবং তাতেই আমি তৃপ্ত। এই কথাটা বুঝলে বড় খুশি হব। ভালবাসা নিও–

তোমার যতীন।

.

চতুর্থ পত্র: এখানিও যতীন চাটুয্যের লেখা তৃতীয় পত্রের ঠিক এক বৎসর পরের তারিখের লেখা।

প্রিয় নন্দ,

তোমার পত্র পেলাম। গতবার তোমার সঙ্গে দেখা হলে সাক্ষাতেই তো জানিয়ে দিয়েছিলাম আমার মতামত স্পষ্টাস্পষ্টি। আবার কেন তবে সে-কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছ? দেখ পূর্বেও তোমাকে বলেছি, এখনও বলছি, ঐ সম্পর্কে কোন পত্রের লেন-দেন করা আমার আর আদৌ অভিপ্রেতও নয়। তুমি যদি মনে করো, আমার দ্বারা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না, অনায়াসেই তুমি নিজের হাতে সেটা তুলে নিতে পার। দেখ ভাই, আবার বলি, একান্ত বিশ্বাস ও নির্ভর না থাকলে কারও দ্বারা কোন গুরু-দায়িত্বই পালন করা সম্ভব হয় না। আর একটা কথা। কিছু মনে করো না ভাই। তুমি যে মধ্যে মধ্যে এখানে আসো, সেটা আমি পছন্দ করি না। আমি চাই না, জটিলতা আরও বৃদ্ধি হোক। বুদ্ধিমান তুমি, আমার কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। ভালবাসা নিও–

তোমার যতীন

.

পঞ্চম পত্র: যতীন চাটুয্যের লেখা। আরও বৎসর তিনেক বাদে।

তোমার পত্র পেয়েছি সবগুলিই। পত্রের জবাব দেব দেব করেও দিতে পারিনি। জান ততা চিরদিন এই পত্রের জবাব দেওয়ার ব্যাপারে আমি একটু শিথিল। তার উপর ইদানীং কিছুদিন ধরে আবার আমার স্ত্রী নারায়ণী ও শিবানীর শরীর ভাল যাচ্ছে না। অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। এদিককার চিরপরিচিত পালা-জ্বর। ডাক্তার চক্রবর্তীই দেখছেন। তুমি লিখেছ, এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে তোমার রাণীগঞ্জের কলিয়ারীতে গিয়ে থাকতে। ধন্যবাদ সেজন্য। প্রয়োজন আমার অল্প। তাই এখানে যা পাই, তিনটি প্রাণীর আমাদের কোন কষ্ট হয় না। তাছাড়া আমার কি মনে হয় জানো সত্যিকারের যে বন্ধু, তার কাছে হাত পাতার মত লজ্জা ও বেদনা বুঝি আর নেই। জানো তো মানুষ বড় স্বার্থপর। স্বার্থে এতটুকু আঘাত লাগলেই সইতে পারে না। তাই বিশেষ করে স্বার্থের ব্যাপারে আমাদের এতদিনকার বন্ধুত্বকে পীড়িত করবার আমার এতটুকু ইচ্ছা নেই। তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার প্রস্তাবে সম্মত হতে পারলাম না বলে। আজ না বুঝলেও একদিন হয়ত আমার কথাটার তাৎপর্য বুঝতে পারবে। সেদিন হয়ত আমি থাকব না। ভয় নেই তোমার ভাই, বন্ধু বলে যে কর্তব্য আমার মাথায় বিশ্বাস করে তুলে দিয়েছ, বিন্দুমাত্রও তার চ্যুতি বা ত্রুটি প্রাণ থাকতে হতে দেব না। তোমার স্ত্রীর অবস্থা পূর্ববৎ জেনে দুঃখ হল। ভগবান করুন, তিনি শীঘ্র সুস্থ হয়ে উঠুন। ভালবাসা নিও।

তোমার যতীন

.

ষষ্ঠ পত্র : পত্রের লেখিকা শিবানী। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা।

শ্ৰদ্ধাস্পদেমু কাকাবাবু,

বাবা আপনার চিঠি যথাসময়েই পেয়েছে। তাঁর শরীরটা কিছুদিন যাবৎ ভাল যাচ্ছে না। তাই আমি চিঠি দিচ্ছি, তাঁর ইচ্ছামত তাঁর হয়ে। আমরা একপ্রকার ভাল আছি। আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না। বাবা বললেন, আপনার এখানে আসবার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি ও কাকীমা কেমন আছেন? আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম নেবেন আপনারা।

প্রণতা
শিবানী

.

চিঠিগুলো পড়া হলে পূর্ববৎ আবার একে একে ভাঁজ করে খামে ভরে খামগুলো লাল ফিতেটা দিয়ে বাণ্ডিল বেঁধে রাখলাম।

চিঠির বাণ্ডিলটা যথাস্থানে রাখতে রাখতে কিরীটীর দিকে তাকালাম। কিরীটী সোফার উপরে অলসভাবে গা এলিয়ে পড়ে আছে। চক্ষু দুটি মুদ্রিত।

বুঝলাম কোন কিছু সে গভীরভাবে চিন্তা করছে। সামনের টীপয়ের উপরে কাঁচের অ্যাসট্রের উপরে সিগারটা রাখা। কখন এক সময় সেটা নিভে গিয়েছে, সে খেয়ালও তার নেই।

কিরীটী?

উঁ! চোখ মেলে তাকাল কিরীটী। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, ছিন্ন সূত্রগুলোর সাহায্যে আপাতত একটা জায়গায় পৌঁচেছি, কিন্তু মাঝখানে একটা ছোট্ট ফাঁক থেকে যাচ্ছে, জোড়া সেইখানেই লাগছে না।

কোথায়?

শ্ৰীমতী সুধাকে খুঁজে পাচ্ছি না ঘটনাগুলোর মধ্যে। একটিবার মাত্র উঁকি দিয়ে সেই যে তিনি অন্তরালে গা-ঢাকা দিলেন, তারপর আর দেখা নেই তাঁর। কেন, কেন—

তাহলে তুই বলতে চাস–

হ্যাঁ, She is the missing link! অতএব তাঁকে যেমন করে হোক আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।

আর শিবানী?

তাঁকে খুঁজে পেয়েছি। নির্বিকার কষ্ঠে জবাব দিল কিরীটী।

পেয়েছিস্?

হ্যাঁ। শিবানীকে পেয়েছি, এখন সুধাকে পেলেই রহস্যের ফাঁকটা ভরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ সচ্চিদানন্দের হত্যার বীজ ওখানেই ছিল।

তাহলে ধরতে পেরেছিস, হত্যাকারী কে?

না। তবে কারণটা বোধ হয় অনুমান করতে পেরেছি।

আমার কিন্তু মনে হয় মণিকাই হত্যা করেছে সচ্চিদানন্দকে।

বেশ মানলুম, কিন্তু উদ্দেশ্য কি? হত্যা সে যখন করেছে, নিশ্চয়ই কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়েই? অথচ ভেবে দেখলে দেখতে পাবে, মণিকার শিবানী পরিচয়টা যদি সত্য হয়, তাহলে কোনমতেই সে সচ্চিদানন্দকে হত্যা করতে পারে না। She would be the last person to touch even Sacchidananda.

কথাটা মিথ্যে নয়। এবং যুক্তির দিক দিয়ে তাই মনে হয়।

চিঠিগুলো তো পড়লি। কোন কিছু খুঁজে পেলি ওর মধ্যে? কারও কোন গুপ্ত পরিচয়?

গুপ্ত পরিচয়!

হ্যাঁ। Some ones identity?

চিঠির লেখাগুলো আর একবার মনে মনে আলোচনা করে নিলাম। কিন্তু তেমন কিছুই তো কই মনে আসছে না! কোন্ কথা ও বলতে চায়?

বুঝতে পারছি, খুঁজে পাসনি। বলতে বলতে মণিকার লেখা চিঠিটা এবারে কিরীটী ইঙ্গিত করে দেখিয়ে বললে, চিন্তার সঙ্গে তোর ঐ চিঠিটাও জুড়ে নে। তারপর ভাল করে ভেবে দেখ। পড় না–ঐ চিঠিটা আর একবার!

চিঠিটা তুলে নিয়ে আবার আগাগোড়া সবটা পড়লাম, কিন্তু তবু যেন কোন হদিশ পেলাম না–—কিরীটী যা বলতে চায় তার।

কি রে, পেলি কিছু?

না।

না কেন রে! ব্যাপারটা তো এখন জলের মত পরিষ্কার লাগছে। দুটো চিঠির মধ্যে তারিখের ব্যবধান কত?

কোন্ দুটো চিঠির মধ্যে?

শিবানীর শেষ চিঠি ও প্রথম চিঠির মধ্যে।

এগারো বছরের। তারিখ দুটো দেখে বললাম।

কিন্তু কথাটা আমাদের শেষ পর্যন্ত আলোচনা করা হল না। বলীন সোম ও সুশীল রায় এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

মণিকাদেবী যে চলে যেতে চাইছেন! সুশীল রায় বললেন।

তাই নাকি! আপনাদের জানিয়েছেন বুঝি?

হ্যাঁ, বিকেলে ফোন করে বলেছেন। বলীন সোম জবাব দিলেন কিরীটীকে।

বলে দিন, আর সাতদিন পরে যেতে পারেন। কিরীটী জবাব দিল সোমকে।

কিন্তু এদিককার ব্যাপার? সুশীল রায় প্রশ্ন করলেন।

সাত দিনের মধ্যেই যাহোক একটা মীমাংসা হয়ে যাবে মনে হয়।

সত্যি?

হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে। অবশ্য দুএকদিন আগেও হয়ে যেতে পারে।

কিরীটী জবাব দিল। হত্যাকারী কে বুঝতে পেরেছেন তাহলে?

হত্যাকারী তো আপনাদের চোখের সামনেই রয়েছে! চেয়ে দেখুন ভাল করে, তাহলেই খুঁজে পাবেন।

কিরীটীর কথায় এবারে আমরা সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম।

.

কিরীটীর কথায় যেন সকলের মনেই একসঙ্গে কয়েকটা পরিচিত মুখ ভেসে ওঠে পাশাপাশি আমাদের। মহিমারঞ্জন, আনন্দ সান্যাল, নন্দন, মণিকাদেবী ও রাধারাণীদেবী।

কিন্তু এদের মধ্যে কে, কে হত্যাকারী।

বলীন সোমই আমাদের মধ্যে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, মহিমারঞ্জন, আনন্দ সান্যাল, নন্দন, মণিকাদেবীও রাধারাণীদেবী—এঁরাই তো আমাদের চোখের সামনে আপাতত ভাসছেন। এঁদেরই মধ্যে নিশ্চয় কেউ মনে হচ্ছে তাহলে—

অবশ্যই, লেন সন্দেহ নেই তাতে। মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়।

এদেরই মধ্যে একজন তাহলে হত্যাকারী?

নির্ভুলভাবে। পূর্ববৎ হেসে কিরীটী জবাব দেয়।

কে?

কে হত্যা করতে পারে—আপনিই বলুন না সোম, এঁদের মধ্যে কে? হাসতে হাসতে : কিরীটী যেন সোমকে পাল্টা-প্রশ্ন করলে।

এবারে যেন সত্যিসত্যিই কেমন বিব্রত দেখালো সোমকে।

সত্যিই তো! কে? মহিমারঞ্জন, আনন্দ, নন্দন ও মণিকা, রাধারাণী—তিনজন পুরুষ ও দুজন নারীর মধ্যে কে? এঁদের মধ্যে কে সচ্চিদানন্দকে হত্যা করল?

মনে পড়ে কিরীটীর একটা কথা। কতদিন তাকে বলতে শুনেছি, পৃথিবীতে কোন কিছুই বিচিত্র নয়। এমন কি একজনের একজনকে হত্যা করাটার মধ্যেও বিচিত্র কিছু নেই। মানুষের বুকের মধ্যে ভালবাসা, প্রেম, ঘৃণা, আক্রোশ, দ্বেষ ও তুচ্ছতার মত হত্যা-লিপ্সাটাও একটা অনুরূপ প্রবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। যে কোন মানুষের পক্ষেই জীবনের কোন না কোন সময়ে কাউকে হত্যা করার মধ্যে এমন কিছু একটা বৈচিত্র্যই নেই। অতি শান্ত-শিষ্ট, ধীর-স্থির, সজ্জন প্রকৃতির লোকের মধ্যেও কোন না কোন সময় যদি হত্যা-লিন্স জাগেই, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেবল যে গভীর কোন উদ্দেশ্য নিয়েই সর্বক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তা নয়। তুচ্ছতম কারণেও মানুষ মানুষকে হত্যা করতে পারে এবং তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই।

হঠাৎ কিরীটীর কথায় আবার চমক ভাঙল।

কিন্তু হত্যাকারী কে? সেই কথাটা স্থির করবার পূর্বে ভেবে দেখা যাক, সে-রাত্রে সচ্চিদানন্দবাবু ও-বাড়িতে ফিরে যাবার পর কি ঘটতে পারে। এবং সেটা ভাবতে গেলে স্বভাবতই কয়েকটা সূত্র আমাদের মনে পড়ে। হত্যা ব্যাপারটা একসঙ্গে জানাজানি হবার পর ও-বাড়িতে ইতস্তত যে সব ছিন্ন সূত্রগুলো আমরা খুঁজে পেয়েছি, সেগুলো যদি একত্রিত করি তাহলে আমরা দেখতে পাই—কিরীটী ধীর মৃদু কণ্ঠে তার বিশ্লেষণ বলে যেতে লাগল। আমরা সকলেই মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনে যেতে লাগলাম।

বাড়িতে ফিরবার পর, যতদূর আমরা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি, একমাত্র সে রাত্রে মণিকাদেবীর সঙ্গেই তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের সে-সময় কেউ দেখেছে কি না এখনও পর্যন্ত আমরা সেটা জানতে পারিনি, জানা যায়নি। তবে না দেখলেও তাঁদের সে-রাত্রে কথাবার্তা বলতে অন্তত যে একজন শুনেছিলেন, সেটা আমরা জানি আর তিনি হচ্ছেন আমাদের মহিমারঞ্জন। তিনি তখনও জেগে ছিলেন। সচ্চিদানন্দকে খাবার কথা বলতে এসেছিলেন মণিকা, কিন্তু তিনি কিছু খাবেন না সে-রাত্রে, সেই কথাই জানিয়ে দেন তাঁকে। তারপর ধরে নিতে পারি, নিশ্চয়ই মণিকা চলে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের ঘরে। সচ্চিদানন্দ হয়ত তারপর নিজের ঘরে যান, বাইরের পোশাক ছাড়েন এবং নিশ্চয়ই সেখান থেকে অত রাত্রে আবার তাঁর স্টাডি-রুম বা অফিস-রুমে গিয়ে প্রবেশ করেন। টেবিলের উপরে মদের Vat 69-এর বোতল ও ভাঙা কাঁচের গ্লাসটাই তার স্বাক্ষ্য দেয়। কিন্তু শুধু কি অত রাত্রে মদ্যপান করবার জন্যেই সচ্চিদানন্দ সে-ঘরে প্রবেশ করেছিলেন, না অন্য কোন বিশেষ কাজ ছিল তাঁর? কারণ অত রাত্রে কেবলমাত্র দু-এক পেগ ড্রিংক করবার জন্যই সে-ঘরে তিনি যাবেন কেন! এখন কথা হচ্ছে, ঐ ঘরে তাঁর থাকাকালীন সময় কেউ প্রবেশ করেছিল কিনা? নিশ্চয়ই সে-ঘরে কেউ রাত্রে প্রবেশ করেছিল বলেই আমার ধারণা। কিন্তু কে? এবং তাঁর সঙ্গে নিশ্চয়ই কোন কারণে শেষ পর্যন্ত হয়তো কথা-কাটাকাটি হয়েছিল, যার ফলে সচ্চিদানন্দ নেশার আক্রোশে তাঁর হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে মারেন তাঁকে। এবং এ সব। কিছু মহিমারঞ্জনের অগোচরে ঘটেনি। কেন না তিনি ঠিক পাশের ঘরেই ছিলেন। সেদিক দিয়ে মহিমারঞ্জন তাঁর জবানবন্দিতে যা বলেছেন, সবটুকুই তার বিশ্বাসযোগ্য কিনা সেটা আপনারাই বিচার করবেন। আমার ধারণা, মহিমারঞ্জন সব কথা সত্যি বলেননি। ঘরের মধ্যে যে কাগজের টুকরোগুলো কুড়িয়ে পাই, সেগুলো জোড়া দিয়ে দেখেছি সেটা একটা উইলের খসড়া। নতুন একটা উইল করবার ইচ্ছা জাগে সম্ভবত সচ্চিদানন্দর সে-রাত্রে। কিন্তু সে খসড়াটা ছিন্ন-ভিন্ন করে ঘরের মধ্যে ছড়িয়েই বা দিয়েছিলেন কেন তিনি? খুব সম্ভবত তাঁর মত শেষ পর্যন্ত সে-রাত্রেই বদলে গিয়েছিল, তাই শেষ পর্যন্ত সেটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলেন পূর্ববং নেশার ঘোরেই। তারপর তিনি নিশ্চয়ই আবার ঘর থেকে বের হয়ে যান ঘরের দরজা খোলা রেখেই, যা বড় একটা তিনি করতেন না। সেখান থেকে তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, শোবার ঘরে না সোজা কাঁচঘরে? মৃতদেহ কাঁচঘরে পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি শেষ পর্যন্ত তিনি কাঁচঘরেই গিয়েছিলেন সে-রাত্রে। কিন্তু আবার এখানেও প্রশ্ন জাগে—অতরাত্রে কি জন্য তিনি কাঁচঘরে গিয়েছিলেন? এমনিই কাঁচঘরে গিয়েছিলেন, না কারও সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে কাঁচঘরে গিয়েছিলেন, না কেউ তাঁকে কাঁচঘরে ঐ রাত্রে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? আমার মনে হয়, কোন কারণে মন বিক্ষিপ্ত হওয়ার জন্যই তিনি সে-রাত্রে কাঁচঘরে গিয়েছিলেন। কারণ কাঁচঘরটি ছিল তাঁর অতি প্রিয় স্থান। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন তার বেশির ভাগ সময়ই নাকি তাঁর ঐ কাঁচঘরে কাটত—এ সংবাদ আমরা পেয়েছি। যাই হোক, তাঁর কাঁচঘরে যাবার পরই শেষ ঘটনা ঘটে। এখানেও একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে—তিনতলার কাঁচঘরটা ঠিক একেবারে মহিমারঞ্জনের ঘরের উপরেই অবস্থিত, সেটা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে আপনাদের কারও কষ্ট হবে না। সেক্ষেত্রে ঘরে শুয়ে উপরের ছাদে কোন প্রকার শব্দ হলে সেটা জানতে পারা বিশেষ কিছু কষ্টকর নয়। অথচ মহিমারঞ্জন জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি ঘুমিয়েছিলেন—কিছুই জানেন না। আবার চিন্তা করতে হবে আপনাদের, তাঁর কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য কিনা। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন তো পূর্বের মতই বলব, না। তার কারণ, যে ব্যক্তি রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত মাথার কষ্টে জেগেছিলেন, তিনি ঘুমিয়ে পড়লেও তাঁর ঘুম এত গাঢ় হতে পারে না, যাতে করে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কাঁচ ভাঙার শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙবে না। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে আসা যাক পরবর্তী ঘটনায়। অবশ্য একটা কথা আপনারা ভুলবেন না, সব কিছু আমি আমার অনুমানের উপর ভিত্তি করেই বলে যাচ্ছি, বিচার বিশ্লেষণ করে। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাঁর ঘাড়ে একটা কালো দাগ ছিল এবং তার মধ্যে ছিল ছোট একটা puncture point. আর পাওয়া গিয়েছে আজ কাঁচঘরের মধ্যে ঐ কাঁচের সিরিঞ্জের একটা অংশ ও hypodermic needleটা এবং মৃতের ওষ্ঠপ্রান্তে ছিল ক্ষীণ একটা লালা ও রক্তমিশ্রিত দাগ। শরীরের মধ্যে ছিল একটা নীলাভা। ময়না তদন্তের ফলে জানা গিয়েছে, স্টমাকে ছিল অ্যালকোহল, সম্পূর্ণটা absorption হবার সময় পায়নি,যা সে-রাত্রে তিনি শেষবার পান করেছিলেন।

এই সময় বাধা দিলেন ইন্সপেক্টর সুশীল রায়, তাছাড়া আরও একটা কথা মিঃ রায়, যা পরের দিন পুলিস-সার্জন আমাকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরে জানান। তাঁর ধারণা, মৃত্যুর কারণ combined action of অ্যালকোহল ও মরফিন হাইড্রোক্লোর ছাড়াও অন্য কোন একটা মারাত্মক বিষ, যা তিনি ধরতে পারেননি!

সেই কথা আমিও বলতে যাচ্ছিলাম। কোন তীব্র বিষাক্তজাতীয় বিষাক্ত orchid-এর রস শরীরের মধ্যে তাঁর সংক্রামিত হয়েছিল। আপনাদের কারও নজরে পড়েনি, কিন্তু আমার নজরে পড়েছিল—কিরীটী বলতে লাগল, কাঁচঘরের বেঞ্চটার ঠিক বাঁ-দিকেই টবের মধ্যে একটা অর্কিড গাছ থেঁতলে ছিল। সে অর্কিডটার নাম আমি জানি না, কিন্তু গাছটা দেখেই আমার মনে পড়েছিল, কোথায় কবে যেন একটা ম্যাগাজিনে ঐ বিষাক্ত অর্কিডের একটা ছবি দেখেছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে ঐ অর্কিড জন্মায় এবং ঐ গাছের পাতার রস ভয়ানক বিষাক্ত। গায়ে একবার কোনক্রমে প্রবেশ করলে আর রক্ষা নেই। আধ ঘণ্টা থেকে তিন কোয়াটারের মধ্যে মৃত্যু অনিবার্য। অবশ্য জানি না, ঐ অর্কিড সম্পর্কে সব কথা জানতেন কিনা সচ্চিদানন্দ নিজেও। সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ, আমার মনে হয়, বিষাক্ত অর্কিডই, মরফিন হাইড্রোক্লোর নয়। তথাপি একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না, দেহের মধ্যে মরফিন হাইড্রোক্লোর সংক্রামিত করা হয়েছিল এবং কাঁচঘরের মধ্যে ভগ্ন সিরিঞ্জটা পাওয়া গিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে কোন একটা সিদ্ধান্তে উপস্থিত হবার পূর্বে যে হারানো সূত্রটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, সেটা হচ্ছে সচ্চিদানন্দের অতীত জীবনের একটা অধ্যায়। যে অধ্যায়টির মধ্যে জড়িয়ে আছেন তাঁর মৃত বন্ধু যতীন চাটুয্যে, তাঁর কন্যা শিবানী, সচ্চিদানন্দবাবুর স্ত্রীর মস্তিষ্ক-বিকৃতি ও সুধা নাম্নী কোন স্ত্রীলোক।

সুধা? সুধা কে? আর যতীন চাটুয্যেই বা কে? প্রশ্ন করে সুশীল রায়।

সংক্ষেপে কিরীটী সুশীল রায়ের জবাবে যতীন চাটুয্যের কথা ও পত্ৰকাহিনী বিবৃত করে গেল।

কাল বাদে পরশু আমরা যাব আবার সচ্চিদানন্দের বাড়িতে এবং এবারে আমরা সকলে গিয়ে মিলব রাত্রি দশটায় কাঁচ ঘরে। ছোট্ট একটা অভিনয় করবার ইচ্ছা আছে আমার সেই কাঁচঘরে।

কিরীটীর কথায় সকলেই আমরা ওর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু তার আসল মতলবটা ঠিক বোঝা গেল না।

.

পরের দিন বিকালের দিকে কিরীটীর ওখানে গিয়ে দেখি, নাট্যালয় থিয়েটারের বিখ্যাত মেকআপম্যান রতিকান্তের সঙ্গে কিরীটী গভীরভাবে কি সব আলোচনা করছে। তার পাশে বসে আছেন, এ-যুগের অন্যতম বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতা সরল মজুমদার।

আমাকেদেখেও যেন কিরীটীদেখলনা। রতিকান্তকেবলছিল, বুঝলেনততরতিবাবু—হুবহু ঐভাবে মেকআপ দিতে হবে। সরলবাবু শুধু বসে মূক অভিনয় করে যাবেন। বলতে বলতে একটা অয়েল-পেপার-মোড়া ফটো রতিকান্তের দিকে এগিয়ে দিল, এই ফটোটা নিয়ে যান। যতটা সম্ভব খুঁটিনাটি study করে নেবেন।

অতঃপর নমস্কার জানিয়ে রতিকান্ত ও সরল মজুমদার উঠে দাঁড়ালেন।

তবে চলি—

হ্যাঁ, আসুন। রাত্রি পৌনে দশটায় ঠিক আমি দরজায় থাকব আপনাদের অপেক্ষায়।

ওঁরা দুজনে চলে গেলেন।

ব্যাপার কি কিরীটী?

রিহার্সাল দিচ্ছিলাম!

রিহার্সাল! কিসের?

আগামী কালের অভিনয়ের।