৩. তৃতীয় লম্বক

তৃতীয় লম্বক

প্রথম তরঙ্গ

ওরা নবীনপুরে এসে প্রবেশ করে। বুঝতে পারে মাইকের বিশাল ও ভয়াবহ থাবার নীচে ঢাকা পড়ে গেছে গ্রামখানি * কানের পর্দা নয় খোলও কাঁপছে * সঙ্গত কারণের মাইকের বিশাল ধ্বনিমালার উৎসের কাছে গিয়ে থামে ওরা * হ্যাঁজাকের আলো জ্বলছে যে বাড়ীতে খুব ধনী গেরস্তবাড়ী। গাছের কালো কালো ছায়ায় শাদা কুয়াশা তুল্য আলো * চাঁদের আলো বেশী বলে দূর থেকে হ্যাঁজাকের আলো ভালো বোঝা যায় না।

একেবারে কাঁচারী বা বাঙলা ঘরের সামনে এসে থামে গাড়ি * হ্যাঁজাকের তীক্ষ্ম আলোয় সঁড়েদের চোখ বিস্ফারিত হয় * কেবলই ঠুন ঠুন করে ঘণ্টা বাজে মাথা নাড়ে।

বিরাট উঠান * একপাশে বেঁকী কোটার শব্দ * সারারাত গায়ে হলুদের গান। টিনের ছাউনি দালান বারান্দায় একদল মেয়ে * বাহের ভাবে আহা খোদা না করেন এই লাশটি যদি এ বাড়ীর কারু হয় * হয়ত কনেবাড়ী * মেয়েটির ভাই। সঙ্গী যারা রাতের ক্লান্তি ঠেলে আলপনা আর গায়ে হলুদ নিয়ে ব্যস্ত তারা সরাসরি পশ্চিমে কাঁচারী ঘরের দিকে গাড়ির চাকার শব্দে তাকায়।

তবে বলি মেয়েটির নাম হাঁসুলী * সে দেখতে কালো * সমস্ত দোষ ছাপিয়ে থুতনী আর চোখ অপূর্ব লাবণ্যে টলটল করে। সে সুন্দরী নয় কিন্তু সুন্দর * হলুদ মেখেছে বলে শ্যামলী * যেন নিত্যকার সৌন্দর্যকে অতিক্রম করে প্রথম বিবাহের আশা আনন্দ ভয়ের আভায় জ্বলজ্বল করে।

উঠোনের এক কোণে জনাকয় পুরুষ হুঁকো পানে ব্যস্ত * তিন চারটে খাসী কুলগাছের তলায় বাধা দূরে তিনটি কি চারটি ছুরি চাপাতি কলা পাতার উল্টো পিঠের উপর সারাক্ষণ জ্বল জ্বল করে। হ্যাঁজাকের তীব্র আলোয় পুরো দৃশ্যটা ঠেসে ধরা হয়েছে * এর দৃশ্য আর পরিণাম কিছুতেই বদলাবার নয়।

নানান ধরনের তেলে ভাজা পিঠার গন্ধে শেষ রাতের বাতাস ভারী হয়ে থাকে * প্রৌঢ় খবর দিতে গিয়ে চমকে উঠে। মাইকে দূর থেকে যে গান ভেসে এসেছিল তাতে তার চারপাশে অজস্র মানুষের ভিড় থাকবে সে ভেবেছিল * এখন সে দেখে জনশূন্য উঠান ছুরি চাপাতির ঔজ্জ্বল্য সব কিছু স্তব্ধ হয়ে আছে। এমনকি মেয়েগুলিকে পর্যন্ত বোবা কালা মনে হয়।

 কুত্তিটা ঢুকে দুটো কুকুরের তাড়া খেয়ে বহুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়। কেউ কেউ কেউ * মুহূর্তে লাশের খবর উঠোনে বারান্দায় ভেতরের ঘরে ছাড়িয়ে পড়ে। বাড়ীর মালিক হুঁকো খাচ্ছিল * তিনজন লোক * প্যান্টপরা এক যুবক।

লাশ?

বাজান কার?

লাশ এলংজানি হাসপাতালে থিকে

 আবার হ্যারিকেন তিন ব্যাটারী টর্চ লাশের মুখ দেখাদেখি।

কার লাশ?

 নয়ানপুরের লোকজন বুলছে নবীনপুরের

নাম?

হোসেনালি পিতা আজাফর

সবাই পরখ করে। কিন্তু লাশের মুখ দেখে বাহের চমকে উঠে * কি আশ্চর্য এত ফোলা মুখ সন্ধ্যারাতে ছিল না * তখন চোখ ছিল বন্ধ এখন খুলে গেছে।

না গো এ লাশ হামাকের চিনাজানার মদিনা * তবে অন্যদিকে সোজা উত্তর পশ্চিমে রাস্তার পাশে মক্তবঘর যাকের সন্দ হয় ভোরে এসে দেখবু * জলদী চইলে যাও বলে মালিক ভেতরে চলে যান * প্যান্টপরা যুবকটি একটা সিগারেট ধরায় এবং তর্জনী বৃদ্ধাঙ্গুলে মিলে অনাবশ্যক চুটকী তুলে।

তা হঠাৎ এই বিয়া বাড়িটা পছোন্দ হল ক্যান? ভেবেছ নয়ানপুর লাশ নবীনপুরে চালিয়ে দিবু এ্যা… শুন এটা বকশী বাড়ী * লাশ নিয়ে একটা ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে দু পসা লুটবে সেহবু না।

তবে কী আশ্চর্য খায় খাটনীর লোকজন চুপ করে দেখে * দীর্ঘশ্বাস ফেলে * যুবকটি আরও একবার সিগারেট ঝাড়ে। জানা নেইক শুনা নেইক একেবারে সদর দরজায় লাশ নিয়ে এসে হাজির * বিয়ে বাড়ী খুশখোশালের মদ্যি এট্টু চোনার গন্ধ দিয়ে গেলে * যাও ভাগো।

তিনজনের একজনও বলতে পারে না এ লাশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ডাক পিওনের চেয়ে বেশী কিছু না * তবু টিটকারী আর গালমন্দ খেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে ওদের চোয়াল * গাভোয়ানের বুক ফেটে ক্রোধ বেরিয়ে আসতে চায় * ঠিক আছে না চিন না চিন এ লাশ হামাকের স্বজনের লাশ * ব্যাস জিরয়ে লিবার লিগে এসেছিলাম … ব্যাস।

মৃত্যুর পর মৃতের সঙ্গে জীবিতের পরিচয় একক ও প্রত্যুত্তরবিহীন * তবু কি আশ্চর্য ওদের তিনজন এরই মধ্যে ভুল ঠিকানায় লাশটিকে নিজেদের সঙ্গী করে তুলেছে। মাইলের পর মাইল এক সঙ্গে চলেছে ওরা কাজেই এই মৃতকে আর অপরিচিত ঠেকেনা * চাকার আবর্তনে আবর্তনে অপরিচিতি থেকে পরিচয় ক্রমে গাঢ় ও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠে। চাকা যত পথের ভেতরে প্রবেশ করেছে লাশটিও ওদের অন্তরের ততদূরে ভেতরে চলে গেছে * সঙ্গে থাকতে থাকতে সঙ্গী হয়ে উঠে এই মৃত।

আবার যেতে যেতে গাড়োয়ান বিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে থুতু ফেলে*

দেখ দেখ সকালে বন্ধ দুটা চোখ যহন বেরয়ে এইসছে চোখের পাতা ঠেইলে নিয়ে যহন দুটা মুণি বেরয়ে পইড়েছে তবে দেখ মানুষ কত সীমার এজিদ হবার পারে।

মক্তবের কাছে এসে গরু ছেড়ে দেয় জোয়াল থেকে। এদিকে শেয়ালের ভয় * তবে ঠেকা দিয়ে উচ্চে রাখে জোয়াল ফলে খানিকটা হলেও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তিন জনেই সিদ্ধান্ত নেয় নিদ যাবে না সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত * কিন্তু তিনজনই কখন ঘাসের উপর ঘুমিয়ে পড়ে টেরও পায় না * যখন জাগে আরেক দিনের সূর্য এসে বেধে তাদের চোখে। বাহের লাফিয়ে উঠে * দেখে গাড়ির চার পাশের অজস্র মানুষের ভিড় * সবাই যার যার ভঙ্গীতে লাশের মুখ দেখছে সরছে আবার ভিড়ের মধ্যে থেকে যাচ্ছে। লাশ পচে উঠেছে বাতাসের বিপরীতে যারা বেশ অস্বস্তি বোধ করে * এক বৃদ্ধ কাছে এসে বলে

লাশ পচায়ে শুনা নিবেক ক্যান? এলা কয়বরের ব্যবস্থা কর

হু হু করতে করতে প্রৌঢ় বলে তালে এহানে কোথাও এট্টা সরকারী জায়গা দেখায়ে দেন * আমরা একজন হুজুর পালে পর জানাজা পড়ায়ে লিমো দশ টাকা দেমো হ

সঙ্গে সঙ্গে দু তিনজন ক্রুদ্ধ বিরক্ত হয় * না না এক থানের লাশ অন্যথানে দাফন হলি পরে পুলিশ কেছু হয়ে যাবু।

কথাটা সমবেত গ্রামবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ক্রমেই * ক্রমেই তারা অপমানিত ক্রুদ্ধ শঙ্কিত হয়ে উঠে * কারণ এই তিনটি অপরিচিত লোক তাদের গ্রামে বলা নেই কওয়া নেই ইচ্ছে মতন লাশ দাফন করে যাবে? ক্রমে সবাই তিনজন মানুষ গরু গাড়ির অবস্থান এবং গাড়ির পাটাতনে পচন্ত লাশ সম্পর্কে কঠোর হয়ে উঠে।

তবে চইলে যাও * না না হামাকের গেরামে এইসব অন্যায় চলবু না

বাহেরের চোখ জ্বালা করে অপূর্ণ ন্দ্রিায় * চোখ মেলে ভয়ে ভয়ে তাকায় সবার দিকে যেন এরা অবিলম্বে নতুন কোন হত্যাকাণ্ডে নামবে * তবু সে অনুনয় করে বলে * আমরা এট্টু ওই গাছের ছেমায় ভাত আইন্ধে খামো এট্টুক্ষণ * আমরা তিনজন মানুষ গতকাল থিকে পেরায় না খেয়ে আছি।

সবাই শুনে কথাটা * একটুক্ষণের জন্য গুঞ্জন থামে * এ কোন নতুন ফন্দি নয়ত অপরিচিত তিনজনের?

না না অন্যখানে রেন্ধে খাও। এখানে না এখান থিকে একমাইল দূরে বাজার আছে সিখেনে যাও।

তাইলে মহা অন্যায় হয়েছে হামাকের লাশের কেরায়া কইরে * সরকারী লাশ হ।

সেজন্যি বুঝি লাশটির কুন ঠিকানা নেই * হেসে উঠে সবাই।

এর মধ্যে তড়িৎ এক ঘটনা ঘটে। কোন এক দিনমজুর সঁড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জমি থেকে বাছ ভোলা কচি ঘাস এক আঁটি দিয়ে যায় * দুই বঁড় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একটু পরে দূরে দূরে মক্তবের মাঠে দুটি আবাল ও দুটি ষাঁড় এর মধ্যে প্রথমে একটি কালো ষাঁড় দড়ি ছিঁড়ে এসে লড়াই বাধিয়ে দেয়।

সবাই হৈ হৈ করে উঠে। ঠাক ঠাক ষাড়ের খুলিতে খুলি * শিঙ এর আগায় মাটি * কেউ কাউকে ছাড়বে না * চারটি লড়াকু ষাড় শক্ত নিঃশ্বাসে ধূলি ওড়ে। ঠাক ঠাক হৈ হৈ * ঠাক ঠাক *

গাড়োয়ান শঙ্কিত হয়ে উঠে। যদি পা ভাঙে কোনটার * চাকা বন্ধ হয়ে যাবে * এদিকে কালো ষাড়ের মালিক মন্ত্র পড়ে মাটিতে থাপড় দেয়। আর বলে ল’ ল ল’ ল’ * কিন্তু তাতে কিছু কাজ হয় না। সেই ষাঁড় দুটির কাছে প্রথমে আবাল ও পরে কালো বঁড় পরাজিত হয় * সবাই তাতে খুব ক্ষেপে যায় * একজন যুবক এসে একটা ভাঙা ইট প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে দেয় হলাঙ্গ ফকিরের ষাড়েদের দিকে * আঘাত খেয়ে সরে যায় একটি। সহসা অন্য একজন চীৎকার দিতে দিতে আসে

শুওরের পো হামাকের গোরু মারিবাক চায় মার মার

ধমাধম ইট পড়ে। বাহের আর্তনাদ করে আমাকের ষাড়ের কুন দোষ নাই * আল্লার ওয়াস্তে মাপ করেন দোহাই আল্লা দোহাই রসুল।

শুকর চান দৌডে মক্তবে আশ্রয় নেয় * বুড়ো ছোট্ট একটা ইটের আঘাতে বসে পড়ে * বাহের চীৎকার দেয় আপনাকের কি দয়া নাই?

তবে মারেন আরও মারেন মারেন সে আহবানে আক্রমণকারীরা থমকে যায় * তবে তখনও গজরায় কেউ কেউ * তাদের গাঁয়ের অহঙ্কার বাইরের অতীব সুন্দর দুটি ষাঁড় এসে এভাবে ভূমিস্মাৎ করে দেবে এ তারা সইতে পারে না।

দ্রুত গরু জুতে গাড়িতে উঠে বসে বাহের।

শালাগরে মাথায় ষাঁড়ের পেচ্ছাব * চল শুকর চান দূরে গাঙ এর পাড়ে বাজার আছে * ভাত রান্ধি খামো

গাড়ির পেছনে একজন আসছিল তাকে লক্ষ্য করে বাহের বলে হামাকের গোরু এমনি ক্ষেপেনিক আপনাকের মনটা কালো তাই।

যুবক শুকুরচান বলে অবলা জানোয়ারে লড়ে বুঝি কিন্তু সে জানোয়ারের নগে মানুষও কিবা কইরে যোগ দেয় * জন্তু জানোয়ারের গাও মানুষের বাচ্চা না তারা।

আল্লায় বাঁচিয়ে দেছে * মাথাডা আরেটু হলে ফেইটে যেত।

শুকুরচান বলে হে চাচা দেখেক ডাই পিঁপড়ে শতে শতে * কখন ধইরেছে?

হ বাহের গাড়ি থামা * ঝাইড়ে লিমো। বাহের বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে * অজস্র দাঁড়অলা পাছাতোলা ডাই * সবার মুখে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মাংসের কণা।

ক্রুদ্ধ গাড়োয়ান লাফিয়ে নামে * ক্রোধে চোখ লাল হয়ে উঠে বাঁশের কাঠে চাটাইতে যেখানে পিঁপড়ে দু হাতের তালুতে পিষতে থাকে। খানকীরপুরা তোমাকের খওনের লিগে লাশ বয়ে বেড়াচ্ছি?

যুবক চেঁচায় হাতে আমের শাখা

এ চাচা তোমাকের হাত না লাশের মাংসে নাল হয়ে উঠেছে। দাঁড়ের ফাঁকে ফাঁকে ধরা মানব মাংসে লাল হয়ে উঠেছে বাহেরের হাত * শুকুর চান ওয়াক ওয়াক করে * হাত ধুয়ে ফেলে। তারপর প্রৌঢ় আর যুবক লাশে থেকে ডাই ঝাড়তে থাকে আমের শাখায় * পিঁপড়ে তার কর্ম করে * কণাকণা নিয়ে গর্তে যাবে হাজার পাঁড়ে এক লাশ * কতক্ষণ লাগে।

মানষের নজ্জা মানষে লিবে পিঁপড়েরে লিতে দেমো ক্যা? বালু পানিতে হাত ঘষতে ঘষতে বাহের বলে।

যেতে যেতে বাহের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করে সব কিছু ভাবার চেষ্টা করে * আহা গতকালকের সঙ্গে আজকের কত মিল রোদে রোদে ঝিলমিল * ঘরবাড়ীর পাশে পাশে গাছের ছায়ায় ছায়ায় যেতে যেতে সে ভাবার চেষ্টা করে কবে গোপালভোগ আমগাছে চোখগেল পাখী ডেকেছিল শেষরাতে বউটা উঠে ভর্তা ভাত করেছিল কাকেশ্বরীর পাড় ধরে আলো অন্ধকারে শাদা ষাঁড় দুটো কেমন করে দৌড়ে চলেছিল। আজ উঠতি সূর্যের সব আলো যেন কালকের অতীত দিনটিতে গিয়ে পড়ে * তার ভাড়া করা ষাড় দুটোর জিতে যাওয়া কুঁদের ছন্দিত ওঠানামা শিঙে শিঙে ভোরের লালচে রোদ তাকে যেন বেপরোয়া করে তুলে।

প্রৌঢ় যেতে যেতে শুরু করে উপাখ্যান * সীমার বসেছে ছাতির উপর নবীর দৌহিত্রের * পবিত্র আয়াতের ওপর নোংরা কাকের পা * তারপর হায় ইমামের মস্তক বহুত কোছেছ করে কেটে লিল। তার পর দুলদুল কিভাবে এজিদের সৈন্যবাহিনী ভেদ করে শক্র দলন করে সহস্র তীরের ঘায়ে রক্তসিক্ত মদীনার পথে চলে। দুই ষাঁড়ের মাথা শরীরের এখানে ওখানে ইটের আঘাতে ফুলে উঠেছে এরই মধ্যে * কোন কোন ফোলার উপর হালকা রক্তাভা দেখা যায়। পীরের থানের সেবাইতের ষাড় * এই ষাঁড়ের বীজ মানত করে নেয় গেরামের মানুষজন * চোখ ফেটে কান্দন। আসে।

হঠাৎ চাকার গানে মন ভরে যায় * দিল সোহাগী বিলের যে ধানে তার পরিবারের পেট বাঁধা তাকে তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় চাকার কোন পক্ষাবলম্বন নেই * শস্য ও মৃত তার কাছে সমান * এমনকি শূন্য গাড়িকেও তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া তার কাজ। চাকার প্রতি তার অন্তরে যে বিশাল সম্ভম জাগে তা বর্তুল নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় ও প্রগাঢ় হবার মত।

বাঁক ঘুরতেই বাঁকা বিশুক প্রায় নদী চকচক করে উঠে * অইতো বাজার। গাড়ি বাজারের দক্ষিণ প্রান্তে নদী ভাঙা অংশে একটা ছাতিম গাছের নীচে থামে * যুবক কয়েকটি কলাপাতায় ঢাকে মৃতদেহ * কুত্তিটি এসে ছাতিম গাছের ছায়ায় বসে।

চাল আলু কিনে ডেকচি পাতিল দা খন্তা বের করতে গিয়ে চমকে উঠে গাড়োয়ান। গত পরশু সন্ধ্যা বেলায় নিজের হাতে পালান থেকে প্রায় এক দেড় পোয়া কাঁচা মরিচ তুলেছিল * অর্ধেক মরিচ লাল ও হলুদ রঙ ধরেছে * কখন কিভাবে সে বুঝেও নি * এই বদলের আকস্মিক দৃশ্য তাকেও বদলে দেয়।

দ্বিতীয় তরঙ্গ

যখন ভাত ফুটে বিন্নিপোড়া চালের সুগন্ধে আত্মা ভরে যায়। কি একটা কাজে শুকুর চান দোকানে যায় * গিয়ে বুঝতে পারে দোকানে দোকানে এবং হাটবার নয় বলে প্রায় জনশূন্য বাজারে খবর রটে গেছে লাশের। কেউ কেউ লাশের কাছেও চলে আসে।

কার লাশ গো

হামাকের ভাই ঠাটা পইড়ে মরেছিল

একরাতে বোকা ও বাঁচাল লোকটি আমূল পাল্টে গেছে গাড়োয়ানের চোখ পাথর চোয়ালে চোয়াল চাপে জনতার ঔৎসুক্যে।

যাবু কোঠে?

এই তো দক্ষিণে * একদম না তাকিয়ে জবাব দেয়

এ ভাই সিদিক তো রাস্তা ভাঙা

কি করমো হামকের মানত আছে * ষাঁড় দেখতিছ না মানিক পীরের দরগার ষড়

গা গোসল ধুয়ে এসে খেতে বসে ওরা তিনজন। এই প্রথম তারা অনুভব করে যে সঙ্গী হলেও খেজুর পাতার চাটাই মোড়া লাশ কোনদিন পৃথিবীর অন্ন ছোঁবে না * লাশের চারপাশে মাছি আর জীবিতের চারপাশে সেদ্ধ গরম ভাতের ভাপ।

বাজার কমিটির এক মেম্বার আসে * চোখ তীক্ষ্ম মণি নড়ে না * পরণে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী হাতে চামড়ার বেল্টে উল্টো করে ঘড়ি পরা।

হে ভাই লাশটা আসে কুত্থিকে?

 উ ই দিক থিকে * উত্তরের গর্জ নেই।

যাবু কোই

উই দিকে

কী বেয়াদব হয়েছে গাড়োয়ান হাতটা নেড়েও দেখায় না * প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলে না।

পচে গন্ধ বেরুছে লাশের উঁহু থানায় খবর দিমো?

 সরকারী হুকুমে যাচ্ছে লাশ

তবে জলদী পৌঁছে কয়বরটা দিয়ে দেও

লাশের ঠিকানা ভুল করেছে সরকার * জায়গা দেন এখানেই জানাযা কয়বর দিয়ে দেই

কি এই বাজারে কয়বর? তোমাকের মাথায় কি গুলমাল আছে? এখানে এসবের ঠাই হবে না।

সে জানি ঠাঁই হবেক না তা হলে এট্টু আরাম করতে দেন * বলে প্রৌঢ়ের দিকে তাকায়।

বাহের তখন গান ধরে।

মাথায় রঙিন টুপী ব্যাধের জাম্বিল*
হাতে লয়ে আসা বাড়ি ফেরে মানিকপীর।

গান শেষে না করেই চেঁচিয়ে বলে

শালা তুমাকের মাথায়ও ষাঁড়ের পেচ্ছাপ * বলে দাঁত বের করে হাসে।

অ শুকুর চান জগতের যত মানুষ মুই বিচারি দেখলু তার বাড়ি হয় নয়ানপুর নয় নবীনপুর * এই শালার বাড়ীটাও দু গেরামের এক গেরামে হবু। বাহের কেশে নেয় * মানব বিচারের নবাবিস্কৃত দশনে সে বেশ আত্ম প্রত্যয়ী হয়ে উঠে।

পড়ন্ত বিকেলে গাছের ছায়ায় ঘুম দিয়ে জাগে ওরা তিনজন। এক টাকার শাদা কেরোসিন ছোট্ট হ্যারিকেনটাতে ভরে প্রৌঢ় বিড়ি কেনে এক বাণ্ডিল * তারপর নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করে।

মানব মুখের এক বিশাল বিস্ময় প্রত্যক্ষ করে তারা মৃত যুবকের মুখে * গতকাল ভোরে যে কোমল প্রশান্তি তার মুখে ছিল তা এখন আর নাই। একরাতে দীর্ঘ পথে মৃতের শয়ানে থেকে সে মুখ ফুলতে ফুলতে অতি মানবের চেহারা লাভ করেছে * চোখ খুলে বেরিয়ে এসেছে পাতলা কালো ঠোঁটদ্বয় আরও কালো এবং পুরু হয়েছে। চিবুকও প্রসারিত সমান তালে * সহস্র কালো মাছি তার চোখে এবং অট্ট হাসিতে ফেটে যতদূর দাঁত দেখা যায় সেখানে এমনকি আরও ভেতরে * মুখ মণ্ডলের চামড়ায় মিহি ফাটল ধরে। পৃথিবীতে অন্যায় মৃত্যুর বিরুদ্ধে কোন মৃতের যদি ক্রোধ ও ধিক্কার কোনদিন প্রকাশ পায় তবে তার আকৃতি নিশ্চিতই এরকম হবে * মানবিক মুখের আকার ও প্রকার অতিক্রম করে এই মুখ পশ্চিমাকাশে বিশুষ্ক প্রায় গাঙের ওই পাড়ে ধূ ধূ চরের মাথায় টুকরো মেঘের রূপ ধারণ করে। কিংবা পুরাণে বর্ণিত দেবতার ক্রোধের যদি কোন আকার আঁকা যায় তবে হয়ত তা এ মুখের রূপ পাবে।

সন্ধ্যার অন্ধকারে মাছি উড়ে যায়। মুখের উপর এসে পড়ে এই মর্ত জন্মের শেষ আলো * লেখা ঠিকানায় যে পরিচয় কূল পায় না অনিশ্চিত পথের বাঁকে সে পরিচয় নিশিথ নিবিড় হয়।

শ্ৰোতৃমন্ডলি * এখন করুণা জাগে তাদের জন্য যারা তাকে হত্যা করেছে যারা তাকে ভুল ঠিকানায় দিকে দিকে প্রেরণ করেছে * করুণা জাগে তাদের জন্য যারা পেট চিরেছে হত্যার কারণ গোপন করেছে * যারা অন্যায়ভাবে মানব কষ্টের সহস্র সহস্র বর্ষের সঙ্গী যুদ্ধ জয়ী বঁড়কে অন্যায়ভাবে আঘাত করেছে।

নয়ানপুর নবীনপুর জাতের মানুষের কান ও চোখ কর্দমে থুতুতে ভরুক * কেবল বৃদ্ধাটি ছাড়া যে হয়ত আজ সন্ধ্যা পর্যন্তও ভাবছে এ তারই সোনাফর।

লালচে চাঁদ ওঠে পূর্বে * পনর রাতের চাঁদ * এবড়ো খেবড়ো গাঙের পাড় ধরে চলে লাশের সঙ্গে ওরা। পূবের ছায়া পশ্চিমের চরে পড়ে। শান্ত জলে কীসের আভা? ভাঙা পাড় বেয়ে নেমে আসে ওরা বরফ গলে লাশ হালকা হয়ে এসেছে * গাড়িটি ও ষড়দ্বয় উঁচু পাড়েই দাঁড়ানো থাকে।

একটি খন্তায় বালুর চরে পালাকরে কবর খোঁড়া হয় * দোয়া কলমা শেখেনি কিছুই ঐ এক সরল পথ দেখাবার আয়াতটি ছাড়া। গাঙের জলে গা গোসল করে উঠে পাক সাফ হয় * প্রৌঢ় জানাজা পড়াতে গিয়ে হু হু করে কাঁদে। গর্তে লাশ নামানো হয় * কুত্তিটি বসে থাকে মাঝে মধ্যে নখে নখে আঁচড়ে নেয় শরীর।

মাটি চাপা দেয়া হলে সবাই পিছনে দীর্ঘ ছায়া সমেত পাড়ে উঠে। হঠাৎ কি ভেবে গাড়োয়ান দৌঁড়ে যায় * হাটু গেড়ে বসে কবরের পাশে! ঝুরঝুর বেলে মাটি প্রচণ্ড আবেগে খামচে ধরে। আহা আহা করে কাঁদে * কেন? সে জানে না * এই মৃতের প্রতি দুর্ব্যবহার পরিচয়হীন করুণ কবর কিংবা তারই পথ চলার এক সঙ্গী চিরকালের জন্য ধূলি মাটির নীচে চলে যাওয়া।

বাহের এবং সঙ্গীরা উঁচু পাড়ের দিকে তাকায়।

কে বসে আছে উইখেনে?

ধরমরাজ * পাড়ের ওপর উঁচু মত টিবি সেখানে বসে আছে * পায়ের কাছে মদের বোতল * কেউ জানে না কখন এসে বসেছিল হু হু করে উঠে সে

হো জিয়ো ভুগমান তোর এত সাধের হড় সিনসাদুম এইসে খেয়ে লিলো? ক্যানে জিয়ো ক্যানে ধরমঠাকুর সিনসাদুমরে তুমি না সাগর ফেনা কইরে দিছিলে?

গাড়োয়ান গামছায় মুখ মুছে নেয় * চল ভাই। নির্মেঘ আকাশে চাঁদের উদয়কালের লালচে আভা তখনও মিলায়নি * হলাঙ্গা ফকিরের বীর্যবান সঁড়েদের গলায় পেতলের ঘুণ্টিধ্বনি মিলায় দূরে দীর্ঘ পথের বাঁকে * চাকাদ্বয় নিশ্ৰুপ কাঁদে না আর ঝিঁঝির গান ধরেছে * দিল সোহাগীর বিলে যেতে যেতে গায়ক শুকুর চান যে গান গাইবে নিশ্চিতই থাকবে তাতে চিলিমারি বন্দরের নাম।

ইতি
তৃতীয় লম্বক চাকা কথানাট্য
 রচনা ১৭ই এপ্রিল ১৯৯০
পরিমার্জনা
১৩ই জুন ১৯৯০
 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাভার
ঢাকা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *