৩. টেলিফোন অপারেটরের ফোন

এগার

টেলিফোন অপারেটরের ফোন। মেয়েটি জানাল, একমাত্র অ্যানি ব্লেক ছাড়া আর সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। জুড ধন্যবাদ জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।

তার মানে অ্যানি আসছে। মনটা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রথম দিনের কথাবার্তার টেপটা বের করলেন তিনি।

–আরাম করে বসেছেন মিসেস ব্লেক?

–হ্যাঁ। ধন্যবাদ।

–কোনো অসুবিধা নেই?

–না-না।

–আপনি হাত মুঠো করে আছেন কেন?

–ও কিছু নয়। আমার স্নায়ু সামান্য চড়ে আছে তো তাই।

–কী বললেন?

দীর্ঘ নীরবতা।

–পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বলুন। ছমাস আপনার বিয়ে হয়েছে।

–হ্যাঁ।

–বেশ বলে যান।

–যাকে বিয়ে করেছি সে খুব ভালো। বাড়িটাও সুন্দর।

–বাড়িটার বর্ণনা দিন।

–কান্ট্রি ফ্রেঞ্চ বাড়িটার নাম। ভালো জায়গা। আমাদের ছাদে ব্রোঞ্জের একটা অদ্ভুত ধরনের মোরগ আছে, তার লেজ নেই। প্রায় পাঁচ একর জমি আমাদের বলতে গেলে গাছ পালায় ভর্তি। ওর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে। মনে হয় আমি যেন গ্রাম্য পরিবেশের মধ্য ফিরে গেছি।

–গ্রাম আপনার ভালো লাগে?

–ভীষণ।

–আর আপনার স্বামীর?

–মনে হয় ওর ভালো লাগে।

–ভালো না লাগলে শহরের বাইরে কেউ পাঁচ একর ফাঁকা জায়গা কেনে বলুন?

–ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। হয়তো আমার জন্য কিনেছে। ভীষণ দয়ালু মন ওর।

–বলুন, ওঁর কথা কিছু শোনা যাক। নীরবতা।

–দেখতে কেমন ওঁকে? ভালো?

–অ্যান্টনির অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারা।

–শারীরিক দিক থেকে ওঁর সঙ্গে মোকাবিলায় আপনি অক্ষম?

–হ্যাঁ।

জুড প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন।–আপনি সন্তান চান না?

–নিশ্চয়ই।

–আপনার স্বামী?

–সেও নিশ্চয় চায়।

আবার দীর্ঘ নীরবতা।

–মিসেস ব্লেক, কোন্ সমস্যায় পড়ে আপনি আমার শরণাপন্ন হয়েছেন? সমস্যাটা কি আপনার স্বামীকে নিয়ে?

জবাব নেই।

–বেশ তাহলে সেটাই ধরে নিলাম। আপনি এতক্ষণ যা যা বললেন তা শুনে বুঝতে পারছি, আপনারা পরস্পরকে ভালোবাসেন। একে অন্যকে বিশ্বাস করেন। দুজনেই সন্তান চান। যে বাড়িটায় থাকেন, সেটাও খুব সুন্দর। আর্থিক অসঙ্গতি নেই। মাত্র ছমাস আপনারা বিয়ে করেছেন। মিসেস ব্লেক আপনার কথা শুনে একটা প্রাচীন রসিকতা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার সমস্যাটা তা হলে কী ডাক্তারবাবু? এটাই বোধ হয় আপনার আসল সমস্যা। তাই নয় কি?

কিছুক্ষণ টেপে যান্ত্রিক শব্দ তারপর অ্যানির গলা।

–এ সম্পর্কে কিছু বলা আমার পক্ষে শক্ত। ভেবেছিলাম, অচেনা কারোর কাছে সবকিছু খুলে বলতে পারব। কিন্তু এখন সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

জুডের মনে পড়ল, ঠিক এই সময় অ্যানি দেহটা বেঁকিয়ে তার আয়ত চোখ দুটি মেলে ধরেছিল। অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিল। বলেছিল–বুঝতেই পারছেন, তারপর দ্বিধার প্রাচীরটা হুড়মুড় করে ভেঙে দিল সে–হঠাৎ কিছু কথা আমার কানে এসে যায়।

–ব্যাপারটা কি আপনার স্বামীর কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে, মানে মেয়েছেলে সংক্রান্ত?

–না।

-ব্যবসা সংক্রান্ত।

–হ্যাঁ।

–আপনি কি মনে করেন উনি কিছু চেপে গেছেন?

–অনেকটা তাই।

–ও তাহলে বিশ্বাসে আঘাত করেছে। সম্ভবত ওর এই ধরনের আচরণ আপনি দেখেন নি।

–আমি এ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমার মনে হয় এখানে আসাটা উচিত হয়নি। আমি বোধহয় বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করলাম। দয়া করে এ নিয়ে আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না ডাক্তার স্টিভেন্স।

সাক্ষাতকার শেষ। জুড টেপ বন্ধ করে দিলেন।

তাহলে অ্যানির স্বামী রহস্যজনক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে? দেউলিয়া করেছে কাউকে অ্যানি এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে? হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনিতে অ্যানি স্পর্শকাতর, স্বামীর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার এটাও একটা কারণ হতে পারে।

জুড কোনোদিন লোকটাকে দেখেননি। যত রহস্যময় কারবারই সে করুক না কেন, জন হ্যানসেন অথবা ক্যারল রবার্টসের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

আর অ্যানি? অ্যানির পক্ষে এই কাজ করা কি সম্ভব? চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তিনি আবার ভাবতে শুরু করলেন।

অ্যানি যতটা বলেছে, সেটাই কি তার সব কথা? অ্যানির নানা ভঙ্গিমা স্মরণ করলেন ডাক্তার জুড। কিন্তু কোনো বদ অভিপ্রায় খুঁজে পেলেন না।

উদ্দেশ্যহীনভাবে টেপ বাজতে গিয়ে টেরি ওয়াশ বার্নেরটা বেছে নিলেন।

–আপনার বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। আপনি মোট পাঁচবার বিয়ে করেছেন?

–ছবার।

–আপনার প্রাক্তন স্বামীরা প্রত্যেকেই কি আপনাকে খুশি করতে পেরেছে?

খিলখিল করে হাসি।

–আমাকে হাসালেন। পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ নেই যে আমাকে খুশি করতে পারে। আমার খুশি হওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে আমার দৈহিক পরিতৃপ্তির ওপর নির্ভর করছে।

–দৈহিক পরিতৃপ্তি বলতে?

–মানে বুঝলেন না। আমার শরীরে এমন একটা জায়গা আছে, সেটা সবসময় উত্তপ্ত থাকা দরকার।

–আপনার কি ধারণা দৈহিক দিক থেকে আপনি অন্য মেয়েদের থেকে একদম আলাদা?

–নিশ্চয়ই, স্টুডিও ডাক্তার বলেছেন, আমার ওখানে কীসব গ্রন্থি ট্ৰন্থি নাকি অন্য ধরনের। একটু থেমে, লোকটার সঙ্গে শুয়ে আরাম আছে।

–আমি আপনার দৈহিক চার্ট দেখেছি। মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে আপনার শরীর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

–পাছায় লাথি মারি ওই চার্টের। আপনি নিজে একবার যাচাই করে নিচ্ছেন না কেন?

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। তবু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার। বলেছিলেন আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন মিসেস ওয়াশবার্ন?

–আপনাকে ভালোবাসা যেত, সামান্য নীরবতা, কী করব বলুন। বলেইছি তো আমার দেহটাকে ভগবান একেবারে অন্যভাবে সৃষ্টি করেছেন। আমার যৌন খিদে কোনো সময় মেটে না।

–আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি না। কিন্তু মিসেস ওয়াশবার্ন আমার যা ধারণা দেহ আপনার ক্ষুধার্ত নয়। আপনি একটা অদ্ভুত আবেগের তাড়নায় ভুগছেন।

–আবেগের তাড়নায় আমি কোনো দিন কারো সঙ্গে যৌন সংযোগ করিনি। আপনি আমাকে কীসব উল্টোপাল্টা বলে চলেছেন। আমি কি দশ বছরের খুকি নাকি?

–আপনাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে আমার কী লাভ?

–তাহলে উদ্দেশ্যটা কী আপনার?

–আমার একমাত্র উদ্দেশ্য আপনাকে সাহায্য করা।

–তাহলে বসুন দেখি আমার পাশে।

–আজকে এই পর্যন্ত থাক। সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে জুডের একটা কথা মনে পড়ে গেল। নোরা হ্যাডলি চলচ্চিত্র জগতের পোকা। চলচ্চিত্র বিষয়ক এমন কোনো পত্রিকা নেই, যা সে পড়ে না। সব সময় এই নিয়েই কাটায়। ফোন তুলে ডায়াল ঘোরালেন তিনি।

নোরা ফোন ধরলেন।

কিছুক্ষণ একথা সেকথার পর জুড আসল প্রসঙ্গ তুললেন।

–নোরা, তুমি টেরি ওয়াশ বার্নের নাম শুনেছ?

–টেরি ওয়াশ বার্ন, মানে যে সিনেমা করত? হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞাসা করছেন?

–না এমনি। আজ সকালে ওকে ম্যাডিসন এভিনিউতে দেখলাম।

–সামনা সামনি! সত্যি নোরা যেন শিশুর মতো কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন, বলুন না কেমন দেখাচ্ছিল ওকে? বয়সের ছাপ পড়েছে, নাকি আগের মতোই মিষ্টি চেহারা? রোগা না মোটা?

–খুব ভালো দেখাচ্ছিল। এককালে ও খুব বড়ো অভিনেত্রী ছিল তাই তো।

–বড়ো মানে? কী বলছেন কী? টেরি ওয়াশবার্ন আমার মতে সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী।

–যাই হোক, ওকেও হলিউড ছাড়তে হয়েছে তো।

–ও তো নিজের থেকে ছাড়েনি, ওকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আপনাদের মতো ডাক্তারদের নিয়ে এই হয়েছে এক মুশকিল। আপনারা বাইরের জগতের কোনো খবর রাখতে চান না কেন? জানেন না টেরি কত বড়ড়া একটা কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে?

–আহা, কী হয়েছিল বলো তো?

–টেরি ওর বয়ফ্রেন্ডকে খুন করেছিল।

.

বার

আবার তুষার পড়তে শুরু হয়েছে। পনেরো তলার ওপরে থেকেও রাস্তায় যানবাহন চলাচলের শব্দ পাচ্ছিলেন জুড।

–নোরা, তুমি ঠিককার সঙ্গে কথা

–জানেন আপনি, কার সঙ্গে কথা বলছেন? আমি হচ্ছি হলিউডের একটা জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া। শুনুন তাহলে ঘটনা। টেরি তখন কন্টিনেন্টাল স্টুডিওতে কাজ করছে। একজন সহকারী পরিচালক ওকে দেখাশোনা করত। হঠাৎ একদিন ও আবিষ্কার করল, লোকটা ওকে প্রতারণা করেছে। ক্ষেপে গিয়ে ও ছুরি চালিয়ে দিল। লোকটা মরে গেল। কন্টিনেন্টালের মালিক অনেক কলকাঠি নেড়ে অনেক লোককে টাকা খাইয়ে ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে এলেন যেন ওটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা শর্তে তাকে রাজি হতে হয়েছিল। সেটি হল, টেরিকে চিরদিনের জন্য হলিউড ছেড়ে চলে যেতে হবে। টেরি কিন্তু ওই কথার অমান্য করেনি।

জুড বোবার মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–হ্যালো, হ্যালো আপনি আমার কথা শুনছেন তো?

–হ্যাঁ, বলে যাও, আমি শুনছি তোমার কথা।

–আপনার কথাগুলো বড় অদ্ভুত শোনাচ্ছে।

–এসব তুমি কোথাথেকে শুনেছ?

–শুনেছি কী? আপনি আবার আমাকে অবাক করলেন। সমস্ত খবরের কাগজের ম্যাগাজিনে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। সকলে এই ঘটনাটা জানে।

–ধন্যবাদ নোরা, পিটারকে বলল আমি ফোন করেছিলাম।

রিসিভার রেখে চিন্তান্বিত অবস্থায় ডাইরিটা টেনে নিয়ে জুড লিখলেন–টেরি ওয়াশবার্ন।

ফোন বেজে উঠল।

–ডাঃ স্টিভেন্স?

অ্যাঞ্জেলির গলা–আপনি কেমন আছেন জানতে ফোন করেছি। নতুন কিছু ঘটেছে। নাকি?

জুডের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। বোমার ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার যুক্তি খুঁজে পেলন না।

–ওরা আবার চেষ্টা করেছিল, মুডি এবং গাড়িতে বোমা রাখার ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন।

অ্যাঞ্জেলির গলায় উত্তেজনা–বোমাগুলো কোথায়?

–ওগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

অ্যাঞ্জেলি হতভম্ব কী করা হয়েছে? কে করল এ কাজ? 

–মুডি। উনি আমাকে বলেছেন, এতে নাকি কিছু এসে যাবে না।

–কিছু এসে যাবে না? পুলিশ ডিপার্টমেন্টটা ঘাস কাটার জন্য রাখা হয়েছে নাকি? ওগুলো দেখেই আমরা বলে দিতাম কার কাজ?

–সেটা কীরকম?

–প্রত্যেক লোকের কিছু না কিছু অভ্যেস থাকে। অভ্যেসবশত কেউ একবার কোনো কাজ করলে দ্বিতীয়বার সেই কাজ করার সময় একই পদ্ধতিতে অনুসরণ করে থাকে। যাই হোক, লোকটার সন্ধান আপনাকে কে দিল?

–টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে নাম পেয়েছিলাম।

নিজের কানেই কেমন যেন ঠেকল জুডের।

অ্যাঞ্জেলি ঢোক গিলল। শব্দটা তিনি শুনতে পেলেন। ওঃ, তার মানে ওর সম্পর্কে আপনার কিছু জানা নেই।

–কিন্তু ওর ওপর আমার বিশ্বাস জন্মেছে।

–জানেন তো এইরকম ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।

–কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কী করে জড়িত থাকবেন? আমি তো নিজেই তাকে ডেকেছি।

–আমি যদি বলি, আপনার মনে আস্থা জাগানোর জন্য নিজেই বোমাটা গাড়িতে লাগিয়ে রেখেছিল।

–সেদিক থেকে ব্যাপারটা আপনি চিন্তা করতে পারেন। আপনি আমাকে কী করতে বলছেন?

–কিছুদিনের জন্য শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বলছি।

–পেশেন্টদের ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় স্যার।

–ডাঃ স্টিভেন্স।

–এতে সমস্যা সমাধান হবে না। আমি নিজেই জানতে পারলাম না কীসের ভয়ে পালাচ্ছি। ফিরে আসার পর আবার একই ঘটনা ঘটবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?

কিছুক্ষণ নীরবতা। অ্যাঞ্জেলি কথা বলতে শুরু করল। তার গলা ধরে গেছে ঠিকই বলেছেন। মুডির সঙ্গে এরপর কবে আপনার দেখা হচ্ছে?

–বলতে পারি না, উনি বলছিলেন, কে এ সব করছে, সে সম্বন্ধে ওনার ধারণা জন্মেছে।

–একথা একবারও ভেবে দেখেছেন কিনা, যেসব লোক আপনার পেছনে লেগেছে, তারা মুডির পেছনে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে পারে। শুনুন ডাঃ স্টিভেন্স, যদি সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলে, তাহলে আমাকে খবর দেবেন। দুদিন আমি বাড়িতেই আছি। অফিস যাচ্ছি না। আর যাই করুন, একা তার সঙ্গে কখনও দেখা করবেন না।

–আপনি কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে অনর্থক চিন্তা করছেন। যেহেতু তিনি আমার গাড়ি থেকে বোমা আবিষ্কার করেছেন–

–না-না, শুধু সেই কারণে নয় ডাঃ স্টিভেন্স। আমার ধারণা আপনি একটা ভুল লোককে বাছাই করেছেন।

–বেশ ওর সঙ্গে কথা হলেই আপনাকে জানাব।

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন জুড।

অ্যাঞ্জেলি কি অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ হয়ে উঠেছে? তবে মুডি এই কাজটা করেও থাকতে পারেন। এর পরের কাজটা আরও সোজা। নতুন প্রমাণ সংগ্রহ করা গেছে, এই অজুহাত দেখিয়ে তাকে নির্জন কোনো জায়গাতে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর? জুড কেঁপে উঠলেন। তিনি লোকটার চরিত্র সম্পর্কে আগাগোড়া ভুল ধারণা করে এসেছেন? বাইরের ঘরে পায়ের আওয়াজে তাঁর চিন্তা ছিন্ন হল। ঘড়ির দিকে তাকালেন। অ্যানি নাকি? 

হ্যাঁ, অ্যানি। নিখুঁত ছাঁদের একটা নীল পোশাক পরেছে। মাথার ছোট্ট টুপিতে মুখের অর্ধেকটা ঢাকা। ও এত আত্মনিমগ্ন ছিল যে, ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সত্বেও খেয়াল করল না।

–হ্যালো, জুড অবশেষে বললেন।

অ্যানি চমকে তাকাল। বলল–হ্যালো।

–আসুন।

ভেতরে ঢোকার সময় ক্ষণিকের জন্য জুড অ্যানির পেলব শরীরের স্পর্শ অনুভব করলেন।

ঘুরে দাঁড়াল অ্যানি। অবিশ্বাস্য রকম বেগুনি চোখ দুটি মেলে ধরল যে লোকটা আপনাকে গাড়ি চাপা দিয়ে পালাল, তার সন্ধান পাওয়া গেছে?

জুড তার মুখে চিন্তার ছায়া লক্ষ্য করলেন। এই কৌতূহলী ভাবটা খুবই স্বাভাবিক ঠেকল তার কাছে।

বললেন–না, এখনও পাইনি।

–আপনাকে বড়ো ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কাজ শুরু না করলেই পারতেন।

–না-না, আমি ঠিক আছি। আজ সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে দিয়েছি। শুধু আপনাকে যোগাযোগ করতে পারিনি।

অস্বস্তি ফুটে উঠল–ও ক্ষমা করবেন। তাহলে বরং আজ আমি যাই।

–আরে না-না, জুড কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলেন। ওরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় বরং আমি খুশিই হয়েছি। বলুন কেমন আছেন?

একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত অ্যানি নিজেকে সামলে নেয়। একটু চিন্তায় পড়েছি।

–ইওরোপ ভ্রমণের দিন কবে স্থির হল?

–বড়োদিনের দিন সকালে।

–কোথায় কোথায় যাচ্ছেন?

–স্টকহোম, প্যারিস, লন্ডন, রোম–আপাতত এই।

–কতদিন ঘোরার পরিকল্পনা। মলিন একচিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে ওসব জানি না। অ্যান্টনির এসব ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা থাকে না।

–ও আচ্ছা, জুড প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইলেন, মিসেস ব্লেক, আপনাকে কিন্তু আমি মিথ্যে অজুহাত পেয়ে ডেকে এনেছি। আমার ইচ্ছে হল আপনার কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নেব।

–জানি, আমিও আপনার কাছ থেকে বিদায় চাইতে এসেছি। অ্যানির গলায় অদ্ভুত পরিবর্তন। জুড, বলেই তার দিকে সরাসরি চোখ মেলে দিল অ্যানি।

এক অদম্য আকর্ষণে অ্যানির দিকে এগিয়ে আসতে গিয়েও জুড নিজেকে থামিয়ে রাখলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, রোমে পৌঁছে আমার নামে একটা পোস্টকার্ড ফেলে দিও কিন্তু?

অ্যানি বেশ কিছুক্ষণ জুডের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিল–নিজের দিকে খেয়াল রেখো জুড।

জুড মাথা নাড়লেন। কথা বাড়াতে সাহস পেলেন না।

অ্যানি বেরিয়ে গেল।

টিং টিং শব্দে তিনবার ফোন বেজে উঠল। জুড ফোন তুললেন–হ্যালো।

–ডাক্তার, একা আছেন?

–হ্যাঁ।

–ডাক্তার, আপনার কি মনে আছে আমি আপনাকে বলেছিলাম কে এসবের পেছনে আছে?

–মোটামুটি আন্দাজ করেছি আমি।

–হ্যাঁ।

–সেটা পুরোপুরি ঠিক।

জুডের মনে হল তার সমস্ত মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল প্রবাহ নেমে যাচ্ছে।

–আপনি তা হলে জানেন, কে হ্যানসেন আর ক্যারলকে হত্যা করেছে?

–হ্যাঁ ডাক্তার সাহেব, জানি। কেন ওরা খুন হয়েছে তাও বলতে পারি। বলুন আর কী প্রশ্ন আছে?

–বলুন তো।

–না-না, ডাক্তার সাহেব, টেলিফোনে নয়। বরং আমরা কোথাও গিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু একা আসবেন আপনি। জুড চমকে উঠলেন একা!

–শুনেছেন তো?

–হ্যাঁ-হ্যাঁ।

তিনি তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন। তারপর অ্যাঞ্জেলির কথা মনে পড়ে গেল। আমার–এখানে আলোচনাটা করলে কেমন হয়?

–না, মনে হচ্ছে ওরা আমাকেও অনুসরণ করছে। আপনাকে ফোন করছি। তেইশ স্ট্রিটের ফাইভ স্টার মিট প্যাকিং কোম্পানি থেকে।

–আমি তাহলে অ্যাঞ্জেলিকে সঙ্গে নিচ্ছি।

মুডির গলা হঠাৎ তীক্ষ্ণ–না-না, কাউকে সঙ্গে আনবেন না। একদম একা চলে আসুন।

ব্যাস, আর সন্দেহ নেই। দৈনিক পঞ্চাশ ডলার দক্ষিণা আর রাহা খরচ দিয়ে তিনি নিজেই এক ঘাতককে নিযুক্ত করেছেন। গলার স্বর সংযত রেখে বললেন–ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। কিন্তু আপনি সত্যি জানেন, কে আছে এসবের পেছনে?

–তিলমাত্র সন্দেহ নেই। ডাক্তার সাহেব, ডন ভিন্টনকে আপনি চেনেন?

মুডি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

ডন ভিন্টন। সমস্ত দেহ আর মনের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল কি? বেশ কিছুক্ষণ জুড কোনো কিছু ঠিক করতে পারলেন না। হঠাৎ সজাগ হয়ে অ্যাঞ্জেলির বাড়ির নম্বর ডায়াল করলেন।

–হ্যালো।

–ডাঃ স্টিভেন্স বলছি। মিস্টার মুডি এই মাত্র ফোন করেছিলেন।

–আচ্ছা! কী বলছে সে?

–আমাকে উনি তেইশ স্ট্রিটের ফাইভ স্টার মিট প্যাকিং কোম্পানিতে দেখা করতে বলছে। আর বিশেষ ভাবে বলে দিয়েছে একা আসতে।

শুকনো হাসি হেসে উঠল অ্যাঞ্জেলি–সে তো আমি আগেই জানতাম। শুনুন ডাঃ স্টিভেন্স, অফিস ছেড়ে এক পাও নড়বেন না। আমি ম্যাকগ্রেভির সঙ্গে যোগাযোগ করছি। একসঙ্গে আপনার কাছে যাব।

জুড ফোন নামিয়ে রাখলেন।

.

তেরো

কুড়ি মিনিটের মধ্যে ম্যাকগ্রেভি আর অ্যাঞ্জেলি পৌঁছে গেল। অ্যাঞ্জেলির চোখ দুটো লালচে ভেজা ভেজা। গলার স্বর ভারী। এই অবস্থায় সে বিছানা ছেড়ে এসেছে। জুড অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন।

–মুডির ফোনের কথা আমি লেফটেনান্টকে জানিয়েছি।

–হ্যাঁ, এবার দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। ম্যাকগ্রেভির গলায় তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গ। চলুন যাওয়া যাক।

পুলিশের গাড়ি চেপে ওঁরা রওনা হলেন। চালক অ্যাঞ্জেলি। এখন আর ঝিরঝির করে তুষার পড়ছে না। বিকেলের ম্লান সূর্যরশ্মিকে মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছে ঝোড়ো মেঘের স্তূপ। হঠাৎ তরবারির আকারে বিদ্যুতের রেখা ফুটে উঠল। মেঘের গুরু গুরু গর্জন শোনা গেল। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের ওপর বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটার আলিঙ্গন।

তেইশ নম্বর স্ট্রিটের কাছাকাছি টেনথ এভিনিউর কাছে এসে ম্যাকগ্রেভি গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিল।

–আমরা এখানে নামব। সে ঘুরে তাকাল জুডের দিকে। মুডি আপনাকে বলেছে, কেউ। সঙ্গে থাকবে না?

–না।

–খাপ থেকে রিভলবারটা বের করে ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিল ম্যাকগ্রেভি। অ্যাঞ্জেলিও তাই করল।

ম্যাকগ্রেভি জুডকে বলল–আমাদের পেছনে পেছনে আসুন।

প্রচণ্ড হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে মাথা নীচু করে ওরা হাঁটতে থাকলেন। ব্লকের মাঝ বরাবর আসার পর বাড়িটা নজরে পড়ল। চুন বালি খসে গেছে। ইট বেরিয়ে পড়েছে। সদর দরজার মাথায় একটা সাইনবোর্ড। তাতে আবছা অক্ষরে লেখা আছে ফাইভ স্টার মিট প্যাকিং কোম্পানি।

সামনে কোনো গাড়ি নেই। মানুষ নেই। পাল্লা ঠেলতে গিয়ে ম্যাকগ্রেভি দেখল তালা বন্ধ। ঘণ্টির বোতাম দেখতে পেল না। কোনোরকম সাড়া শব্দ নেই ভেতরে।

অ্যাঞ্জেলি বিড়বিড় করে বলে সবই তো বন্ধ দেখছি।

–ক্রিস্টমাসের কিছুদিন আগে সব কোম্পানি দুপুরের পর বন্ধ হয়ে যায়। ম্যাকগ্রেভি জবাব দিল।

–মালপত্র ঢোকানোর জন্য নিশ্চয়ই একটা গেট আছে।

ওদের অনুসরণ করে জুড বাড়ির পেছনে এলেন। অনেকখানি জায়গা জুড়ে কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। জন মানুষের চিহ্ন নেই।

জুড গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন–মি. মুডি?

জবাবে ভেসে এল হুলো বেড়ালের ক্রুদ্ধ গর্জনের আওয়াজ।

পাটাতনের ওপরে কাঠের দরজা। ওখানে কোনো সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই। ম্যাকগ্রেভি অদ্ভুত দক্ষতায় বিশাল দেহটা নিয়ে সেখানে লাফিয়ে পড়ল। অ্যাঞ্জেলি আর জুড সেখানে উঠলেন। তালা দেওয়া ছিল না। ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঘন অন্ধকার।

–টর্চ এনেছ? ম্যাকগ্রেভি জিজ্ঞাসা করল অ্যাঞ্জেলিকে।

–না।

–রাবিশ। অন্ধকার ঘরেই ওরা ঢুকে পড়লেন। জুড হাঁক দিলেন–মি. মুডি, আমি ডাঃ স্টিভেন্স। কোনো জবাব নেই। কাঠের মেঝের ওপর তিন জোড়া জুতোর শব্দ।

ম্যাকগ্রেভি পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করল–সুইচটা কোথায় গেল দেখ তাড়াতাড়ি। এটাই আমার শেষ কাঠি।

অ্যাঞ্জেলিব দেওয়াল হাতড়ানোর শব্দ জুড শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু ওদের কাউকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। এগিয়ে গিয়ে মুডির নাম ধরে ডাকলেন। সাড়া পেলেন না। অ্যাঞ্জেলির গলা ভেসে এল, এই যে সুইচ। ক্লিক করে একটা শব্দ, কিন্তু আলো জ্বলল না।

জুড দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। দেহের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে হাত ঠেকল দরজার হাতলে। টানতেই দরজাটা খুলে গেল। আমি দরজা খুঁজে পেয়েছি। চৌকাঠের ওপর পা রাখলেন।

–মি. মুডি?

থমথমে নীরবতা। জুড ভাবলেন, লোকটা নিশ্চয়ই এখানে আছে। যদি না থাকে তাহলে সর্বনাশ। ম্যাকগ্রেভি আবার এটাকে একটা রাখাল বালকের চিৎকার বলে ধরে নেবে।

আর এক পা এগোতেই ঠান্ডা শরীর তার মুখের সঙ্গে ঘষটে গেল। চমকে পিছিয়ে এলেন। মুহূর্তের মধ্যে ঘাড়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। রক্তের গন্ধ নাকে এসেছে। একটা বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখতে হবে। মনটাকে সজাগ করলেন। সামনে নিকষ কালো

অন্ধকার। আতঙ্কে মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। হৃৎপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে গেছে। কাঁপা হাতে ওভারকোটের পকেট থেকে দেশলাই বের করলেন। পরক্ষণেই প্রচণ্ড একটা আক্ষেপের পর অনুভব করলেন, হুকে ঝোলানো বিশাল একটা গোরুর কাটা মাথার দিকে, তাকিয়ে আছেন। কাঠিটা নেভার আগে আরও কিছু ঝোলানো পশুর লাশ দেখতে পেলেন। আবছা একটা দরজার দিকে তাঁর নজর গেল। দরজার ওপাশে হয়তো কোনো অফিস ঘর আছে। মুডি সেখানে অপেক্ষা করে আছে তার জন্য?

ঘুটঘুঁটে অন্ধকার গুহাটার আরও গভীরে এগিয়ে চললেন। ঝোলানো পশুদেহগুলো শরীরে ঘষা দিচ্ছিল। অ্যাঞ্জেলি আর ম্যাকগ্রেভি এখনও আসছে না কেন বুঝতে পারলেন না। অন্ধকারে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন মি. মুডি?

এবারও জবাব নেই। পা ফেলতে গিয়ে ঝুলন্ত দেহের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেলেন। আঘাতটা সামলে পকেট থেকে দেশলাই বের করলেন। আর একটি মাত্র কাঠি অবশিষ্ট আছে। সেটা জ্বালতেই তার চোখ কপালে উঠে গেল।

ছাদের সিলিং থেকে হুকের সঙ্গে ঝোলানো আছে নরম্যান জেড মুডির প্রাণহীন দেহ। অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি ফুটেছে তার মুখে। মনে হচ্ছে মৃত্যু বুঝি হো-হো করে উল্লাসে হাসছে।

চোদ্দো

করোনারের কাজ শেষ হয়ে গেল। মুডির মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়া হল। থাকলেন শুধু জুড, ম্যাকগ্রেভি আর অ্যাঞ্জেলি। ওই বাড়ির একটা ছোটো দপ্তরে তারা বসেছিলেন। এর আগে ওই দপ্তরের ম্যানেজার মি. পল মোরেডিকে প্রাক বড়ো দিনের জমজমাট পার্টি থেকে ডেকে আনা হয়। তিনি জানান, পরের দিন ছুটি থাকায় কর্মচারীদের দুপুরের পরই কাজ থেকে অব্যহতি দিয়েছিলেন। সাড়ে বারোটার সময় বাড়ির ফটকে তালা লাগানো হয়। তার ধারণা, সেই সময় কেউ ভেতরে ছিল না। প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় তার কাছ থেকে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

এখন প্রায় রাত বারোটা। জুড এই নিয়ে দশবার মুডির ফোন করার ঘটনাটা বললেন। মোটা একটা চুরুট ঠোঁটের ফাঁকে নাচাতে নাচাতে ম্যাকগ্রেভি সব কিছু লক্ষ্য করছিল। এবার বলল সে–আপনার গোয়েন্দা গল্প পড়ার অভ্যেস আছে ডাঃ স্টিভেন্স?

–এ প্রশ্নের অর্থ?

–বোঝেন নি? বেশ তা হলে শুনুন। এই ব্যাপারটায় আমার প্রথম থেকে আপনার ওপর সন্দেহ হয়েছিল। কথাটা আপনাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। আর তাতে ফলটা কী হল বলুন তো? আপনি হঠাৎ নিজেই হত্যাকারীর শিকার হয়ে উঠলেন। প্রথমে দাবী করলেন, একটা গাড়ি আপনাকে চাপা দিতে চেয়েছিল, তাই তো?

অ্যাঞ্জেলি মাঝপথে বলে ওঠে–গাড়িটা কিন্তু সত্যি ওকে ধাক্কা মেরেছিল।

ম্যাকগ্রেভি দাবড়ে দেয় মূখের মতো কথা বলো না। ডাক্তার তার কোনো সহযোগীকে দিয়ে এই কাজটা অনায়াসে করাতে পারে। এরপর আপনি অ্যাঞ্জেলিকে ফোন করে আষাঢ়ে গল্প শোনালেন। বললেন, দুজন লোক আপনার অফিসে চড়াও হয়ে আপনাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে।

জুড বললেন এটা সম্পূর্ণ সত্যি।

–না, ম্যাকগ্রেভির গলা থমথম করে উঠল। ওরা চাবি খুলে ঢুকেছিল। এর আগে আপনি বলেছিলেন, আপনার অফিসের দরজায় দুখানা চাবি আছে। তার একটা থাকত আপনার কাছে, অন্যটা ক্যারল রবার্টসের কাছে।

–হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম। ওরা ক্যারলের চাবিটা নকল করেছে।

–মনে আছে আমার। সেই কারণেই চাবিটা আমাকে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হয়েছিল। ওখানকার রিপোর্ট বলছে, চাবিটার নকল ছাপ নেওয়া হয়নি। সুতরাং ওটাকে বাদ দিলে বাকি থাকছে আপনার চাবিটা। তাই তো?

এই খবর শুনে জুড নির্বাক।

–উন্মাদ খুনির তথ্যটা তেমন আমল না দেওয়াতে আপনি রাস্তা থেকে একটা গোয়েন্দাকে খুঁজে আনলেন। সে আপনার গাড়ির ভেতর থেকে বোমা আবিষ্কার করে ফেলল। সেই বোমাটা অবশ্য আপনি আমাদের দেখাতে পারেননি। তার বদলে হুকে টাঙানো যে বস্তুটা আমরা দেখলাম, সেটাও কম চমকপ্রদ নয়।

জুড উত্তেজিত–এর কোনোটির জন্যই আমি দায়ী নই।

ম্যাকগ্রেভি বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে জানেন কি কেন আমি এখনও পর্যন্ত আপনাকে গ্রেপ্তার করিনি? এর একমাত্র কারণ, আমি আপনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে দেরী হলে একদিন নিশ্চয়ই পারব। পারতে আমাকে হবেই।

জুড হাত তোলেন এক মিনিট, ডন ভিন্টনের ব্যাপারটা তা হলে কী? ভুরু কুঁচকে ম্যাকগ্রেভি–সেটা কে?

মুডি বলছিল, এই লোকটা নাকি এসবের পেছনে আছে।

–ও নামে কাউকে আপনি চেনেন?

–না, ভেবেছিলাম পুলিশ হয়তো চিনতে পারে।

–আমি অন্তত চিনি না। ম্যাকগ্রেভি অ্যাঞ্জেলির দিকে ফিরতে সেও ঘাড় নাড়ে। বেশ ডন ভিন্টনের খোঁজটা তুমি নাও। এফ বি আই, ইন্টারপোল, আমেরিকার বড়ো বড়ো শহরে পুলিশ চিফদের সঙ্গে যোগাযোগ করো।

পরের দিন সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় মুডির খুন হবার খবর ছাপা হল। অফিসে আসার পথে জুড একটা কাগজ কিনলেন। পুলিশের সঙ্গে তার নামটাও স্বাক্ষী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইস, অ্যানি কী ভাবছে কে জানে।

বাইরের ঘরে পায়ের শব্দ শুনলেন। অ্যাঞ্জেলি ভেতরে ঢুকল। তাকে আরও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল।

–ডন ভিন্টনের খোঁজ পাওয়া গেল? জুডের ব্যাকুল প্রশ্ন।

–না। আরাম কেদারায় গা এলিয়ে অ্যাঞ্জেলি, এফ বি আই, ইন্টারপোল থেকে শুরু করে সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। টেলিফোন গাইড থেকে আমরা এগারো জন ডন ভিন্টনের নাম পেয়েছি। এর মধ্যে পাঁচজনের নামের উচ্চারণ ভিন্টন, চারজনের ভিন্টেন আর দুজনের ভিন্টিন। তবু আমরা একই উচ্চারণ করে নিয়ে পাঁচজনকে বিশেষ সন্দেহের তালিকায় ফেলে দিলাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওদের একজন পঙ্গু, একজন পুরুতমশাই, একজন ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর একজন ফায়ারম্যান। খুনের সময় সে ডিউটিতে ছিল। আর শেষের জন একটা দোকান চালায়। যার বয়স কম করে ধরলেও আশি। আপনি নামটা ঠিক শুনেছিলেন তো?

জুড বললেন–হ্যাঁ, এতে কোনো ভুল নেই।

অ্যাঞ্জেলি–তাহলে বাঁচবার কোনো রাস্তা নেই।

–আপনার কি ধারণা, ম্যাকগ্রেভি শেষ পর্যন্ত আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে?

–সম্ভবত। আচ্ছা চলি।

–মনে হয় আমি একটা সূত্র পেয়েছি।

অ্যাঞ্জেলি ঘুরে দাঁড়িয়ে–বলুন।

জুড টেরির পূর্ব ইতিহাস খুলে বললেন। অ্যাঞ্জেলি ঘাড় নেড়ে বলল–নাঃ, এটা মেনে বিশেষ সুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না। যাই হোক, নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। দেখা যাক, চেষ্টা করে।

হঠাৎ কী ভেবে পকেট থেকে রিভলবার বের করে বলল–এটা আপনার কাছে রাখুন। দরকার হতে পারে। সাবধানে রাখবেন। গুলি ভরা আছে।

–ধন্যবাদ মিস্টার অ্যাঞ্জেলি। ওটা আমার দরকার নেই। তেমন প্রয়োজন পড়লে নিজের কাছে যা আছে তাই দিয়ে লড়াই করব।

বাইরের ঘরের দরজা. খোলার শব্দ হতে অ্যাঞ্জেলি ফিরে তাকাল কারোর কি আসার কথা ছিল?

–না, আজ সকলকে আসতে বারণ করে দিয়েছি।

রিভলবার হাতে অ্যাঞ্জেলি দরজার কাছে এগিয়ে গেল। চৌকাঠের ওপাশে পিটার হ্যাডলি। তার চোখে মুখে বিভ্রান্তির স্পষ্ট ছাপ।–কে আপনি?

জুড় তাড়াতাড়ি অ্যাঞ্জেলির পাশে এসে দাঁড়ালো–ও, ঠিক আছে, ঠিক আছে। উনি আমার বন্ধু।

–এসব কী হচ্ছে? পিটার জানতে চাইলেন।

–এসো, আলাপ করিয়ে দিই। ডিটেকটিভ অ্যাঞ্জেলি আর উনি আমার বন্ধু পিটার হ্যাডলি। ।

করমর্দন করার পর অ্যাঞ্জেলি বলল আচ্ছা, এখন আমি যাই। তাহলে আপনার। এসব পছন্দ হবে না, তাই তো?

রিভলবারটা ইঙ্গিত করল সে।

জুড মাথা নাড়লেন–না, ধন্যবাদ।

–সাবধানে থাকবেন, অ্যাঞ্জেলি বেরিয়ে গেল।

.

পনেরো

পিটার হ্যাডলির সঙ্গে লাঞ্চ সেরে অফিসে ফিরে এসে জুড আবার টেপ নিয়ে বসলেন। একের পর এক টেপ শুনতে লাগলেন। কাগজে মন্তব্য লিখলেন। বিতৃজ্ঞা, শূন্যতাবোধ একাকীত্বের যন্ত্রণা, আত্মগরিমা, আত্মবেদনা, আতঙ্ক, বিকৃত কাম।

তিনঘণ্টা পরে একটি নতুন নাম তিনি তালিকায় যোগ করতে পারলেন। ব্রুস বয়েড, জন হ্যানসেনের সর্বশেষ সহচর। কী ভেবে হ্যানসেনের টেপটা আরও একবার চালিয়ে দিলেন।

–আমার মনে হয় ব্রুসকে প্রথমবার দেখেই আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অত সুন্দর পুরুষ এর আগে কখনও দেখিনি।

–ওর স্বভাব কী রকম ছিল? আপনার কথাবার্তা উনি শুনতেন কি? নাকি আপনার ওপর জোর করতেন?

–ও সব সময় কর্তৃত্ব করতে চাইত। লোকটার গায়ে প্রচণ্ড জোর। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হত।

-কী রকম?

–নিজের শক্তি সম্পর্কে ব্রুসের কোনো ধারণাই ছিল না। মাঝে মাঝে ও আমার পিঠে এমনভাবে চাপড় মারত, মনে হত, আমার শিরদাঁড়াটা বোধ হয় ভেঙে গেল। অথচ, এটাই ওর সোহাগ দেখানোর নমুনা। তারপর ধরুন হাত নাড়ানোর ব্যাপার। মনে হবে, আঙুলগুলো গুঁড়িয়ে ফেলতে চায়। আসলে ব্যথা দেওয়াতেই ওর আনন্দ।

জুড টেপ বন্ধ করলেন। সমরতি ব্যাপারটা.যদিও তার কল্পনায় হত্যাকারী মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু জন হ্যানসেনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় ব্রুস বয়েডের নামটা উপেক্ষা। করা যাচ্ছে না। আর টেরি ওয়াশ বার্ন? হলিউডে ফোন করার ব্যাপারটা সে কেন চেপে গেছে? জন হ্যানসেন আর ক্যারল রবার্টসের হত্যাকারী কি এরা কেউ?

***

সার্টন প্লেসে টেরি ওয়াশবার্নের ফ্ল্যাটের বৈঠকখানাতে জুড বসে আছেন। সমস্ত ঘরে গোলাপির বাড়াবাড়ি। দেওয়াল, আসবাব, পর্দা সব কিছু। একটু বাদে টেরি ঢুকল। পরনে গোলাপি রঙের স্বচ্ছ রাত্রিবাস। তার আড়াল থেকে প্রকটিত যৌবন উচ্ছ্বাস। তলাতে আর কিছু পরেনি সে।

–শেষ অব্দি তুমি তাহলে এলে। আনন্দে ঝলমল করছে টেরির মুখ।

–আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।

–সব শুনেছি। কিন্তু আপনি, আজ্ঞেগুলো আজকের মতো বিদায় দাও তো। ছোট্ট একটা ড্রিঙ্কস বানিয়ে নিই।

–না, ধন্যবাদ।

–বেশ তো, তুমি নিজে না যাও, আমি নিজের জন্য এক কাপ বানাব।

ঘরের একপ্রান্তে একটা আলমারির কাছে সে এগিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি একটা পানীয় নিয়ে আবার ফিরে এসে জুডের গা ঘেঁষে বসল।–আর সামলাতে পারলে না তো। আমি জানতাম, তুমি একদিন আসবে।

বলতে বলতে ডাক্তারের প্যান্টের ওপর হাত রাখল।

জুড দুহাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরলেন–টেরি, আমি তোমার সাহায্য চাই।

–সে তো হবে আমি জানি গো। দেখ না, এমন কায়দা দেখাব, তুমি সারা জীবন আমাকে মনে রাখবে।

–টেরি শোনো, আমাকে একজন খুন করতে চায়।

টেরির চোখ দুটো বিস্ময়ে বড়ো বড়ো–অ্যাঁ, কী বলছ? তোমাকে খুন করতে চায়? কে সে?

–আমার রোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কেউ।

–কিন্তু কেন?

–সেটাই তো আমি খুঁজতে চেষ্টা করছি। টেরি, আচ্ছা, তোমার বন্ধুবান্ধবী কখনও খুন-টুন নিয়ে আলোচনা করে? খেলাচ্ছলে? অনেক সময় এরকম হয় তো।

টেরি মাথা নাড়ল–কই নাতো।

–ডন ভিন্টন নামে কাউকে তুমি চেনো?

–ডন ভিন্টন? নাতো।

-আচ্ছা খুনের ব্যাপারে তোমার নিজের অভিমত কী? মানে ব্যাপারটা তোমার কাছে কেমন লাগে?

জুড অনুভব করলেন, মেয়েটির শরীরটা সামান্য কেঁপে উঠল। নাড়ির গতি বেড়ে গেল। বলতে পারব না।

–ভেবে বলল। হত্যা করার কথা চিন্তা করলে তুমি কি উত্তেজনা অনুভব করো?

–না, মোটেই না।

–আচ্ছা, হলিউডে তুমি যে একজনকে খুন করেছিলে, একথা কোনদিন আমাকে বলোনি কেন?

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে টেরি গলা চেপে ধরতে গেল। জুড তাড়াতাড়ি ওর হাত চেপে ধরলেন।

–হ্যারামজাদা ইতর শুয়োরের বাচ্চা। সেটা কুড়ি বছর আগের ঘটনা, তাহলে এই মতলবেই এখানে আসা। বেরিয়ে যান। এখুনি বেরিয়ে যান আমার সামনে থেকে।

টেরি কান্নার আবেগে তখন ভেঙে পড়েছে।

–আমি দুঃখিত। জুড বেরিয়ে গেলেন।

***

গ্রিন উইন ভিলেজে একটা গোটা বাড়ির মালিক ব্রুস বয়েড। সাদা পোশাক পরা একজন ফিলিপাইন পরিচারক দরজা খুলে দিল। জুডকে বৈঠকখানায় বসিয়ে সে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট কেটে গেছে। তার পাত্তা নেই। জুড বিরক্তিবোধ করছিলেন। তিনি ভাবলেন, অ্যাঞ্জেলিকে খবর দেওয়া উচিত ছিল।

শেষ পর্যন্ত চাকরটি হাজির হল। জানাল, সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। আসুন।

জুড তাকে অনুসরণ করলেন। দোতলার একটা সাজানো গোছানো ঘরে ঢুকলেন। বয়েড টেবিলে লেখায় ব্যস্ত। ভারী সুন্দর চেহারা। যেন পাথরে খোদাই করা মূর্তি। টিকলো নাক, তুলি দিয়ে আঁকা চোখ। পাতলা সুন্দর দুটি ঠোঁট। মাথার সোনালি চুলগুলো কোঁকড়ানো আর ঢেউ খেলানো।

জুডকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। অন্তত ছফুট তিন ইঞ্চি। চওড়া কাঁধ আর বুক। প্রথম দর্শনে মনে হয়, সে একজন ফুটবল খেলোয়াড়। তার পক্ষে খুন করা কি সম্ভব? হ্যাঁ, খুবই সম্ভব। অ্যাঞ্জেলিকে খবর না দিয়ে আসার জন্য জুড আরও একবার অনুতপ্ত হলেন।

বয়েডের গলা নরম এবং মার্জিত আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য ক্ষমা চাইছি ডাঃ স্টিভেন্স।

রয়েডের বাড়ানো হাতটা ধরতে যেতেই জুডের মুখের ওপর একটা সজোর আঘাত এসে পড়ল।

অপ্রত্যাশিত এ আঘাতটা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। একটা বাতি দানের ওপর পড়ে গেলেন।

–মাফ করবেন আমাকে। উঠুন, একটা ড্রিঙ্কস দেব?

জুডের তখনও মাথা ঘুরছে। কোনোরকমে মেঝে থেকে দেহটা টেনে তুলতে গেলেন। পরক্ষণেই একটা বুটের লাথি তাকে আবার ধরাশায়ী করে দিল।

–আমি আপনার ডাকের অপেক্ষাতেই ছিলাম। বয়েড বলল, না-না, কৈফিয়তের প্রয়োজন নেই। আমি জানি, কেন আপনি এসেছেন। জনির বিষয়ে আমার কাছে কিছু শুনতে চান, তাই তো?

জুড মাথা নাড়বার চেষ্টা করলেন। আবার বুটের লাথি এসে পড়ল তার মাথায়। –আমাদের ভালোবাসার সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছেন আপনি। আপনি বুঝিয়েছেন, এ ভালোবাসা নোংরা। আমাদের সম্পর্ক অবৈধ। বলুন, কে দিয়েছে আপনাকে এই অধিকার? নিজেকে কি আপনি ভগবান ভাবতে শুরু করেছেন? জনিকে আমি হারিয়েছি। আপনি তাকে খুন করেছেন। এবার আমার হাতে আপনার মৃত্যু হবে।

আবার একটা সবুট লাথি আছড়ে পড়ল কানের পাশে। রঙিন ফুলঝুড়ির ফোয়ারা দেখতে দেখতে জুড জ্ঞান হারালেন।