০৩. আবার এলোমেলা চলতে-চলতে

আবার এলোমেলা চলতে-চলতে যে-কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তার থেকে কতদূরে চলে এলাম! এই রকমই ঘটতে থাকবে ঠাকুরপো। মৃত্যুর এত কাছে দাঁড়িয়ে কখনও তো কিছু লিখিনি—যেই সে-কথা ভাবছি অবশ হয়ে আসছে দেহ-মন। মনের মধ্যে সব কিছু অগোছালো, শিথিল হয়ে। যাচ্ছে। তোমাকে যে এ-চিঠি পড়তেই হবে, তাও নয়। চিঠিটা আমার সঙ্গে চিতায় জ্বালিয়ে দিও।

ঠাকুরপো, আমার একটি দুঃখের জায়গা—আমার চোখের সামনে আমার বাবার অপমান–দিনের পর দিন। আমি ঢুকলাম তোমাদের বাড়ির অন্দরমহলে—কিন্তু বাবা থেকে গেলেন বারমহলে, সামান্য বেতনের শ্যাম গাঙ্গুলি হয়ে। যদিও তিনি ঠাকুরবাড়ির বেয়াই, কোনও সম্মান পাননি কোনওদিন। সেই উদারতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছিল না ঠাকুরপো। ছিল শুধু তোমার মধ্যে–কিন্তু তুমি তো আলাদা, সবার থেকে অন্যরকম।

আমার বাবা যে সারা জীবন ঠাকুরবাড়ির অসম্মানের মধ্যেই থাকতে বাধ্য হলেন, তার কারণ, তোমাদের দাক্ষিণ্যেই আমাদের পরিবার চিরকাল খেতে পরতে পেয়েছে। তোমাদের দাক্ষিণ্যেই। তো আমি ঠাকুরবাড়ির বউ হতে পেরেছিলাম।

কিন্তু তবু ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় আমিও তো দ্বারকানাথের পরিবারের সঙ্গে জড়িত। তোমার ঠাকুরদা দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণিকেই তো বিয়ে করেন আমার ঠাকুরদা। জগন্মোহন। দ্বারকানাথের মামা অথাৎ শিরোমণির বাবার নাম ছিল কেনারাম রায়চৌধুরী। আমার অসন্মানটা কোথায় জানো ঠাকুরপো? হাড়কাটা গলির বাড়িটা কিন্তু শিরোমণি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাননি। পেয়েছিলেন কাকিমা রামপ্রিয়ার কাছ থেকে।

কে এই রামপ্রিয়া? তুমি হয়তো জানো না, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, রামপ্রিয়া ছিলেন। দ্বারকানাথের ঠাকুরদা নীলমণি ঠাকুরের ভাই গোবিন্দরামের স্ত্রী। রামপ্রিয়া কেন কুখ্যাত বণিতাপাড়া হাড়কাটা গলিতে একখানি বাড়ি দিতে গেলেন শিরোমণিকে? বারে, আমার ঠাকুরদা জগন্মোহন, যাকে তোমাদের বাড়ির সবাই জগমোহন বলে ডাকেন, তিনি তো গরিব মানুষ–বিয়ের পরে বউকে নিয়ে থাকবেন কোথায়? তাই খারাপপাড়ার একখানা গেরস্তবাড়ি দেওয়া হল তাঁর বউকে–দিলেন বউয়ের কাকিমা রামপ্রিয়া। আমার ঠাকুরদা আর ঠাকুমা ওই হাড়কাটা গলিতেই থাকতেন। এমন একটা মানুষকে ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্য কী চোখে দেখবে তা তো তোমাকে বলে বোঝাতে হবে না ঠাকুরপো।

আমার বাবা শ্যাম গাঙ্গুলির কাজ জুটল তোমাদের বাড়িতেই। বাজারসরকারে কাজ। আর নানারকম ফরমাশ খাটার কাজ। আমার বিয়ের পরেও সেকাজ তাঁকে করতে হয়েছে— বারবাড়ির ফরমাশই তিনি বেশি খাটতেন। অন্দরমহলে তাঁকে কদাচিৎ দেখতে পেতাম। স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী আমি—অথচ জ্যোতিরিন্দ্রিনাথ তাঁর জামাই, তিনি এবাড়ির বেয়াই, এসব কথা তাঁর পক্ষে স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব হয়নি।

হঠাৎ ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্যের টনক নড়ল। কেউ-কেউ ভাবতে শুরু করলেন, শ্যাম গাঙ্গুলিকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে না রাখাই ভালো—দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিলে সামাজিক লজ্জা থেকে দু পক্ষেরই মুক্তি। সামান্য বেতনে আমার বাবাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল তোমাদের গাজিপুরের। বাড়িতে। সেখানে তোমাদের বিশাল জমিদারি। অনেক বড় বাড়ি। দায়িত্বও অনেক। আমার বাবা আমার চোখের সামনে থেকে সরে গেলেন। আমি বাঁচলাম। এও তো ঠাকুরবাড়িরই দান। আমি কৃতজ্ঞ।

ঠাকুরপো, সবে তখন বিয়ে হয়েছে আমার। ন’বছরের বালিকা আমি। একদিন মেজবউঠাকরুণের ঘরের পাশে যেতেই শুনতে পেলাম মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠস্বর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলছেন—

‘এ কাকে নিয়ে এলে বাড়িতে? ওই মেয়েটা জ্যোতির যোগ্য পাত্রী! কোনদিক থেকে সে জ্যোতির মতো ছেলের উপযুক্ত? এটা একটা বিয়ে হল?’

ঠাকুরপো, আমার খুব ভয় করল কথাটা শুনে। আর খুব দুঃখও হল। ভয় করল, যদি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় সবাই মিলে? আমি কোথায় যাব?

মেজবউঠাকরুণ বললেন, ‘ওকে আমরা মেজেঘষে তৈরি করে নেব। তাছাড়া, জ্যোতি ঠাকুরপোরও কিছুটা দায়িত্ব আছে ওকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলার। ‘

মেজবউঠাকরুণের কথায় যেন আগুনে ঘি পড়ল। জ্বলে উঠলেন সত্যেন্দ্রনাথ। বললেন, ‘ও মেয়ে কোনওদিন ভালো মেয়ে হবে না, তোমরা দেখে নিও। বাজার সরকার শ্যামের মেয়ে হয়ে উঠবে জ্যোতির যোগ্য স্ত্রী? তোমরা মেজেঘষে কাকে তৈরি করবে? জ্যোতির এ বিয়েতে আপত্তি করা উচিত ছিল। ‘

আমার হাত-পা সব কাঁপতে লাগল। খুব কান্না এল বুকের মধ্যে। কিন্তু চোখ শুকনো। মেজবউঠাকরুণকে বলতে শুনলাম, ‘বাবামশায়ের ইচ্ছে এ-বিয়ে হোক। জ্যোতি ঠাকুরপো বাবামশায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে, এ-কথা তুমি ভাবতে পারলে!’

‘এটা বাবামশায়ের জেদ। অন্যায় জেদ। জ্যোতি মেনে নিল বটে, কোনও প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না—এ বিয়েতে কারও মঙ্গল হবে না। ‘

ঠাকুরপো, ওই কথাটা আজও আমার কানে লেগে আছে—’এ বিয়েতে কারও মঙ্গল হবে না। ‘ তোমাদের সংসারে সবথেকে বড় অমঙ্গল আমি। তোমাকে ভালোবেসে আমি অসতীও। আজ সেই অমঙ্গলের, অসতীর বিদায়। আমি চাই তোমাদের সংসারে সুখ-শান্তি ফিরে আসুক। তোমার নতুন দাদা আমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে মনে হয় না একদিনের জন্যেও সুখী হয়েছিলেন। মনেরই তো মিল হল না আমাদের। সত্যিই আমি ওঁর যোগ্য স্ত্রী হতে পারলাম না। উনি সারাজীবন থেকে গেলেন অনেক দূরের মানুষ। ঠাকুরপো, তুমি আমাকে এত ভালোবাসলে। ভালোবাসলেন কবি। বিহারীলাল চক্রবর্তী। আমার প্রতি বিহারীলালের ভক্তি, অনুরাগ—সত্যিই আমাকে লজ্জা দিত।

কিন্তু তোমার নতুনদাদার প্রেম–না, পেলাম না কোনওদিন। কোনওদিন তাঁর কাছের মানুষ হয়ে ওঠার সম্মানটুকুও পাইনি। ঠাকুরপো, তোমার কাছে লুকোবার কিছু নেই। তুমি অন্তত অনুভব। করতে পেরেছ, আমার সঙ্গে তোমার নতুনদাদার সম্পর্কটা বড় বেশি সাজানো। আমাদের সম্পর্কে কোনও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি ঠাকুরপো। সম্পর্কের ভেতরটা একেবারে শীতল। ঠাকুরপো, আমার মনে আছে, একদিন ঘোর বৃষ্টির মধ্যে তুমি আমি দু’জনেই ভিজছি আমাদের বড় সখের নন্দনকাননে। এদিকটা শুধুই আমাদের। এদিকে কেউ বড় একটা আসতেন না। বৃষ্টির মধ্যে। মালতীলতার আড়ালে তুমি হঠাৎ আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলে। সেই টানের মধ্যে তোমার অন্তরের উজান ছিল ঠাকুরপো। আমি বাধা দিতে পারিনি। চাইওনি। কোনও-কোনও অন্যায়ের গলায় দুলে ওঠে হৃদয়ের বরমাল্য। সেই অন্যায়কে বরণ করে নেয় সমস্ত মন প্রাণ। ঠাকুরপো, তোমার আলিঙ্গন ছিল তেমন অন্যায়।

বৃষ্টিতে ভিজছ তুমি। কী সুন্দর দীর্ঘ শরীর তোমার। তোমার দীর্ঘ সিক্ত কেশদাম নেমে এসেছে বলিষ্ঠ গ্রীবা পর্যন্ত। তোমার আয়ত দুটি চোখে মেঘলা আকাশের মায়া। তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে :

‘ঠাকুরবাড়িতে একটি উপবাসে আমরা সবাই কষ্ট পেয়েছি। চিরকাল, আদরের উপবাস। ‘

‘আদরের উপবাস’—মাত্র দুটি শব্দ, অথচ আমার সমস্ত শরীরের মধ্যে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে বয়ে গেল ওই শব্দ দুটি—তোমার কণ্ঠস্বর স্পর্শ করল আমার সমস্ত শরীর। আমি স্থানকাল ভুলে গেলাম। মনে হল প্রবল বৃষ্টির মধ্যে তোমার শরীর গলে যাচ্ছে আমার শরীরের মধ্যে। মনে হল আমার শরীর মিশে যাচ্ছে তোমার শরীরে। কোনও তফাত নেই আর।

তোমার দিকে মুখ তুলে বললাম, ‘আমাকে একটু আদর করবে ঠাকুরপো?–কতদিন কতদিন কোনও আদর পাইনি আমি। ‘

তুমি যেন জলদেবতা। সামান্য নীচু হলে তুমি। আমার মুখখানি তুলে নিলে কত আদরে—চুমু খেলে আমার ঠোঁটে। এক ঝলকের আলতো চুমু। মনে হল, এই প্রথম আদর পেলাম আমি। হতে পারে অন্যায়। তবু মনে হল, জীবনে এরচেয়ে বেশি কিছু, বড় কিছু, পবিত্র কিছু আমি পাইনি। যেন এতকাল বেঁচে ছিলাম এই মুহূর্তটির জন্যেই। আমার ঠোঁটে তোমার সেই প্রথম চুমু আজও ফুরিয়ে যায়নি ঠাকুরপো। আমার জীবন ফুরিয়ে যেতে চলল।

আবার খেই হারিয়ে ফেলেছি। তোমার মতো গুছিয়ে যদি লিখতে পারতাম। অথচ না লিখেও উপায় নেই। অনেক কথা যে বলার আছে তোমাকে। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে সব সব সব কথা বলে যেতে চাই—উজাড় করে। যদি একবার কাছে পেতাম তোমাকে খুব আদর করতাম। তখন আর এত কথা বলতাম না হয়তো।

কিন্তু তোমাকে আজকাল শুধু দূর থেকে দেখি। গত চারমাস তোমার বিয়ে হয়েছে। গত চারমাসে ঠাকুরপো, কতদূরে সরে গেছ তুমি? কী করে পারলে গো!

তুমি কি জানো ঠাকুরপো, নন্দনকাননের সব গাছ মরে গেছে এই ক’মাসে। জল না পেয়ে, যত্ন পেয়ে, আদর না পেয়ে মরে গেল তারা। আমাদের সাধের নন্দনকানন আদরের উপবাসে মরল ঠাকুরপো।

ঠাকুরপো, গত চারমাস তুমি তোমার নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত। তোমার নতুনবউঠান এখন পুরাতন। আজকাল তুমিও তোমার জ্যোতিদাদার মতো বাড়ি ফের না। মাঝেমধ্যেই রাত কাটাও মেজবউঠাকরুণের বাড়িতেই। সেখানে যে চলছে তোমার বালিকাবধূর মাঝাঘষা, মেজবউঠাকরুণের নিজের হাতে। তোমার বন্ধ ঘরের দিকে তাকিয়ে কত বিকেল-সন্ধে-রাত কেটে যায় আমার। সব থেকে অসহ্য একলা আমার দুপুরবেলা। তোমার পায়ের শব্দ শুনতে পাই সারাক্ষণ। মনে হয়, এই বুঝি এলে তুমি, ‘নতুন বউঠান, চলে এলাম তোমার কাছে’, এ-কথা বলে আমার পাশে শুয়ে পড়লে।

ক’দিন আগে আর পারলাম না। ঢুকে পড়লাম তোমার ঘরে। ঢুকে দেখলাম পাথরের টেবিলে তোমার কবিতার খাতাটি উপুড় করে রেখে গেছ তুমি। যেন কোনও কবিতা লিখতে লিখতে উঠে গেছ।

বুকের ভিতরটা টনটন করে উঠল। তোমার বিয়ের পরে এ ক’মাস আর একটি কবিতা পড়ে শোনাওনি আমাকে। ঠাকুরপো, তুমি তো বলেছিলে, আমার জন্যেই তুমি লেখো তোমার সব লেখা—তোমার লেখার মধ্যে লুকোনো থাকে অন্য লেখা, যা শুধু আমি পড়ব, আমি বুঝব—সে লেখা আর কারও জন্যে নয়। কেন মিথ্যে বলেছিলে ঠাকুরপো? এই ছলনার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? প্রাণের রবি, আমি তোমাকে কখনও কোনও মিথ্যে বলিনি। আমার মধ্যে কোনও ছলনার আশ্রয় নেই। আমি পেয়েছি তোমার ভালোবাসা। ঠাকুরপো, আর কোনও মেয়ে এভাবে তোমার ভালোবাসা কখনও পাবে না হয়তো। আমার জীবন সার্থক। সেই ভালোবাসা হারিয়ে আমার বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না।

ঠাকুরপো, বলতে লজ্জা করছে—তবু, না বলেও পারছিনা। আমি কখনও-কখনও লুকিয়ে-চুরিয়ে তোমার কবিতার খাতা পড়ি। আর তখন খুব কান্না পায় আমার। সবে বিয়ে করেছ তুমি। খুব। স্বাভাবিক তোমার কবিতায় এখন অত আদর, এত শরীর ছড়িয়ে থাকবে। তবু…আমার খুব কান্না পায়, কষ্ট হয়, বুকের শিরায় টান ধরে, মনে হয় আমার অপমান এতদিনে সম্পূর্ণ হল।

তোমার একটি কবিতার নাম ‘স্তন’। চমকে উঠলাম নাম দেখে। এ তো তোমারই হাতের লেখা। ’স্তন’ শব্দটি ফুলের মতো ফুটে আছে তোমার অনিন্দ্যসুন্দর হস্তাক্ষরে। তুমি লিখেছ :

সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে—
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।

এই লাইন দুটি আমার গলা চেপে ধরল। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। একটি প্রশ্ন অসুখের মতন ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে কোথাও কি ভাবনি তুমি আমার কথাও? একবারও না? আর একটি কবিতায় চোখ গেল আমার। কবিতার নাম ‘চুম্বন’। তুমি লিখেছ :

দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আদরে
অধরেতে থরে থরে চুম্বনের লেখা।

ঠাকুরপো, সত্যি কথা বলো, তোমার কি একবারও মনে পড়েনি নন্দনকাননে সেই বৃষ্টির আড়াল, সেই আদর, সেই নিবিড় আলিঙ্গন আর চুম্বন? এই লাইনগুলোর মধ্যে কি তোমার-আমার আদর এতটুকুও নেই ঠাকুরপো? বলো-বলো-বলো।

প্রাণের রবি, পাথরের টেবিলে তোমার খাতাটি উপুড় করা আছে দেখে মনে হল, না থাক, আবার তোমার লেখা পড়ে যদি কষ্ট পাই আমি। যদি আবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে বুকের শিরা ছিড়ে যায়। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আর নেই রবি। পরক্ষণেই মনে হল, হয়তো এমনকিছু লিখেছ যা আমার মন ভালো করে দেবে, যে-লেখার মধ্যে লুকোনো আছে অন্য লেখা, যে-লেখা শুধু তুমি আমি পড়ব, সেই লেখা আর কেউ বুঝবে না।

আমি খাতাটি খুলতেই চোখে পড়ল এই দুটি লাইন :

হেথা হতে যাও পুরাতন!

হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে!

পরের ঘটনা আমার কিছু মনে নেই। রবি, আমি কী করে তোমাদের ঘর থেকে আমার ঘরে এসেছিলাম, আজও মনে পড়েনি আমার। শুধু মনে আছে, যখন চেতনা ফিরল তখন রাত্তির হয়ে গেছে। আমি আমার বিছানায়। ঘর অন্ধকার।

ঠাকুরপো, কে ছিলেন আমার মা? তোমরা তাঁকে কখনও কোথাও দেখেছ? কখনও কি আমি পেয়েছি মায়ের আদর? চার কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন আমার মা-বরদা আর মনোরমা, আমার দুই দিদি, আর শ্বেতাম্বরী, আমার ছোটবোন। আমি শ্যাম গাঙ্গুলির তিন নম্বর মেয়ে—শুধু বাবার নামেই আমার পরিচয়। কোথায় হারিয়ে গেলেন আমার মা? তাঁকে আমার মনেই পড়ে না। তোমার নতুনদাদাকে আমার মায়ের কথা কোনওদিন জিগ্যেস করতে সাহস হয়নি।

আমার বাবা, তাঁর সব অপমান সত্বেও এক অর্থে তো ঠাকুরবাড়িরই ছেলে। তাই এ-বাড়িতেই আমার জন্মের আগে তাঁর স্থান হয়েছিল। তাঁর বাসা ছিল জোড়াসাঁকোর বিরাট বাড়িটার নীচের তলায়, পায়রার খোপের মতো একটি ঘরে। আমার জন্ম কোথায় ঠাকুরপো? হাড়কাটা গলিতে? কি তোমাদের বাড়ির নীচের তলায়, যেখানে তোমরা আশ্রয় দিয়েছিলে গরিব আত্মীয়স্বজনদের?

ঠাকুরপো, আমি তোমাকে দেখতাম দূর থেকে। তুমি নামতে নানীচের তলায়। কোনওদিন আসনি আমাদের বাড়ি। কেনই বা আসবে। কত বড় ধনী পরিবারের ছেলে তুমি। তুমি তখন। বছর ছয়টয় হবে। আমি আট। তোমাকে দেখতাম দুর থেকে। দক্ষিণের বারান্দায় রেলিং ধরে তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে। তোমার দৃষ্টি থাকত আকাশ পানে। মাঝে-মাঝে তুমি খেলা করতে। বাগানে। ইচ্ছে করত তোমার সঙ্গে গিয়ে খেলা করি।

একদিন তখন তুমি আমার খুব বন্ধু, সেই যখন নন্দনকানন করছি দু’জনে মিলে, তুমি বিলেত থেকে ফেরার পরেই, তখন তোমাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ঠাকুরপো, আমাকে মনে পড়ে। তোমার, কেমন ছিলাম আমি এ-বাড়ির বউ হওয়ার আগে, তোমাদের নীচের তলায়?

কথাটা শুনেই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলে তুমি। কুঁকড়ে গেলে ভিতর থেকে। শুধু বললে, ‘মনে তো পড়ে না কিছু।’

আমি বললাম, ‘কিছু মনে পড়ে না? আমি নীচের তলা থেকে দেখতাম তোমাকে, তুমি যখন এসে দাঁড়াতে দক্ষিণের বারান্দায়। একদিন তোমাকে দেখে হাত নেড়েছিলাম। মনে পড়ে তোমার?

তুমি বললে, ‘নীচের দিকে দেখতামই না আমি। আমি তো আকাশ দেখতাম। তোমার আকাশ দেখতে ভালো লাগত না?’ আমি বললাম, ‘আমার ঘর থেকে আকাশ দেখা যেত না। আমার তো তোমার মতো বারান্দা ছিল না ঠাকুরপো। ‘

হয়তো আমার কথা শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল তোমার। কোনও কথা বললে না। নন্দনকাননের চাঁপা গাছ থেকে একটা স্বর্ণচাঁপা তুলে হঠাৎ গুঁজে দিলে আমার খোঁপায়।

প্রাণের ঠাকুরপো, যে-অবস্থার মধ্যে কেটেছিল আমার শৈশব সেখানে কোনওদিন পৌঁছয়নি তোমাদের বড় বাড়ির কোনও রোশনাই। হাসি, গান, আনন্দ। ঠাকুরবাড়ির ফরমাশ খাটা বাজার সরকারের কালো রোগা মেয়েটার জীবনের সঙ্গে তোমার জীবনের কোনও মিল ছিল না, তোমার নতুনদাদার সঙ্গে আমার বিয়ের আগে।

হঠাৎ ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এসে পড়েছিলাম তোমাদের অন্দরমহলে। এসে দেখলাম কী এলাহি ব্যাপার! ছেলেমেয়ে জামাই-বউ, নাতি-নাতনি, দাসদাসীতে বাড়িটা গমগম করছে। কে কার কী, কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, এ বুঝে উঠতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। একটা কথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি–ঠাকুরবাড়িতে প্রতিদিনই যেন উৎসব। বাড়ির রান্নাঘরে দশ-বারোজন। বামুনঠাকুর ভোর থেকে রান্না চড়ায় গনগনে উনুনে। রান্নার ব্যবস্থাও দু-রকমের। একটা ‘সরকারি’। একটা ‘বেসরকারি’। ঘরে-ঘরে যে-রান্না বামুনঠাকুরেরা পৌঁছে দেয়, সেটা ‘সরকারি’। রান্না। কিন্তু প্রতি মহলে ঘরে-ঘরে তো লোক! প্রত্যেকের রুচি আলাদা। সুতরাং প্রতি মহলের। জন্যে তোলা উনুনে স্বামী ও স্ত্রীদের ফরমাশ অনুসারে কিছু বিশেষ রান্নাও হয়। সেটা। ’বেসরকারি’ রান্না। এসব দেখে আমি তো তাজ্জব। তোমার নতুন দাদার খাওয়ার রুচি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার ওপর ভার পড়ল তাঁর রুচি অনুসারে রান্না করার। রান্নার তখন আমি কিছুই জানতাম না। ধীরে ধীরে শিখতে হল সবই। আমার একেবারেই ভালো লাগেনি ঠাকুরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরে বৈঠকি আড্ডা। তরকারি কোটার আসরে সবাইকে থাকতে হত। আমিও থাকতাম। আমার মন পড়ে থাকত তোমার কাছে ঠাকুরপো। সেই ভাঁড়ার ঘরের আড্ডাতেই ঠাকুরবাড়ির। মহিলামহলের কত খোঁটা কত গঞ্জনা যে আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম আমার সন্তান হল না বলে গঞ্জনা—আমি বাঁজা, এই বাঁজা বউকে বিয়ে করে তোমার নতুন দাদার কত হতাশা, কত যন্ত্রণা, এসব কথা যে কতভাবে আমি শুনেছি। তারপর এল তোমার-আমার সম্পর্ক নিয়ে। গুঞ্জন—তোমাকে সাহস করে যে-কথা কেউ বলতে পারতেন না, বলতেন আমাকে। আমিই নাকি তোমাকে নষ্ট করছি, তোমার মাথা খাচ্ছি!

প্রাণের ঠাকুরপো, দেখলে তো গুছিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভবই নয়, বিশেষ করে মনের এই অবস্থায়। যত বেলা বাড়ছে, ততই যে এগিয়ে আসছে আমার চিরবিদায়ের মুহূর্ত, আরও বিপন্ন, বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে মন, দিশেহারা হয়ে যেকথা বলতে চাই, তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি বারবার। আমার তো আর বেশি সময় নেই। অথচ সব কথা যে বলতেই হবে তোমাকে হে আমার। প্রিয়তম পুরুষ, প্রিয়তম বন্ধু, আমার চিরসখা, তোমাকে না বলে যে আমি মরতে পারব না।

আমার রবি, কতই বা তখন বয়েস হবে তোমার। তখন তো তুমি একরত্তি বালক, বয়েস এই সাতটাত হবে। আমার কিন্তু তখন বেশ বয়েস, আমার বিয়ের দিনেই তো আমি নয়ে পড়লাম। ১৮৬৮-র ৫ জুলাই ছিল আমার ন’বছরের জন্মদিন। হিন্দুরা বলে, জন্মদিনের দিন বিয়ে করতে নেই। তা, তোমরা তো হিন্দুনও, ব্রাহ্ম। ওসব কুসংস্কার তোমাদের নেই। তবে আসল কথাটা। হল, সেদিন যে আমার জন্মদিন, সে কথাটা কেউ মনেও রাখেনি। ওই দ্যাখো, এবার মনে পড়ল। আমার মায়ের কথা, ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি, আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক কোণে, বলছেন জন্মদিনে বিয়ে দিলে সে-বিয়ে শুভ হয় না। ঠাকুরপো, এবার সব মনে পড়েছে আমার মায়ের নাম ত্রৈলোক্যসুন্দরী। যাঁর কথা কেউ শুনল না, আমার বিয়েতে যাঁর কোনও ভূমিকাই নেই, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে যাঁর কোনও পরিচয় নেই তাঁর কত বড় নাম—ত্রৈলোক্যসুন্দরী। কোথায় হারিয়ে গেলেন চারকন্যার সেই জননী, আমার মা। আমার ঠাকুরদা জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ঠাকুরবাড়ির দারোয়ান। তোমাদের বাড়ির ফটকেই তাঁর চিরস্থায়ী আসন ছিল পাতা। আমার দাদামশাইয়ের নাম শশিভূষণ মুখোপাধ্যায়। ঠাকুরবাড়িতে তাঁর কোনও পরিচিতিই নেই।

এই দ্যাখো! আবার পিছলে গেছে আমার লেখা। যেকথা বলছিলাম, ১৮৬৮-র ৫ জুলাই, আমার জন্মদিনে তোমার উনিশ বছরের নতুনদাদার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কী দুর্লভ সৌভাগ্য। আমার, ঈশ্বরের কত বড় আশীর্বাদ আমার ওপর, আমি, যার বিদ্যে তখন প্রথম ভাগও পেয়নি, আমি এক গরিবের কালো রোগা মেয়ে, হয়ে গেলাম ঠাকুরবাড়ির বিদ্বান, অপূর্ব রূপবান, অভিজাত যুবক, গানে-বাজনায়-লেখায় সরস্বতীর বরপুত্র স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী!

প্রায় প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে গেল আমাকে তোমার নতুনদাদার যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা। আমার জন্যে কেনা হল প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, ধারাপাত। আমাকে ঘষেমেজে তৈরি করার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন মেজবউঠাকরুণ জ্ঞানদানন্দিনী। আমার মোটেই ভাল্লাগতো না এসব। ভাল্লাগতো শুধু তোমার সঙ্গে ধারাপাত পড়তে। তোমার সঙ্গে প্রথম বাঁধা পড়েছিলাম ধারাপাতের সুরে।

প্রাণের রবি, আমি ক্রমশ হয়ে উঠলাম তোমাদের বাড়ির বউ। আমার একমাত্র পরিচয়, আমি তোমার নতুনদাদার স্ত্রী। তুমি আমাকে কী মিষ্টি করে ডাকলে নতুনবউঠান। আমার জীবনে সারা দিনরাত ধরে একটাই চেষ্টা—কী করে হয়ে উঠব জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগ্য স্ত্রী!

আমার বাবা-মা পড়ে থাকলেন, আমার দৃষ্টিপথ থেকে অনেক দূরে, তবু একই বাড়ির বারমহলে—আমি যে-বাড়ির বউ! খবর পেতাম, বাবা কখনও খাটছেন তোমাদের বাগানে পাঁচিল তোলার। ফরমাশ, কখনও বা ‘দুরস্ত’ করছেন আমার শাশুড়িঠাকরুণ, তোমার মায়ের বিছানা। আমার মা যে ক্রমশ কোথায় হারিয়ে গেলেন, আমি অন্তত জানি না। ক্রমেই বুঝতে পারলাম ঠাকুরপো, আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, মেজবউঠাকরুণের চোখে আমি এ-বাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নই। এই পরিচয় থেকে, এই সামান্যতা থেকে আমার মুক্তির কোনও উপায় নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যোগ্য স্ত্রী হওয়া এ-জীবনে আমার পক্ষে যে সম্ভব নয়, এ কথাটা ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল এতদিন ধরে ক্রমাগত আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সারা ঠাকুরবাড়িতে আমি একটিই প্রাণের মানুষ পেয়েছিলাম রবি। সে-মানুষ তুমি! তুমি বুঝেছিলে আমার দহন। আমার সকল কষ্ট সহ্য হয়। তোমার দেওয়া কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না কেন তুমি লিখলে :

চেয়োনা চেয়ো না ফিরে ফিরে,
হেথায় আলো নাহি, অনন্তের পানে চাহি
আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে।

তোমার কথাই আমি মাথা পেতে মেনে নিলাম রবি। আমার সামনে অনন্ত আঁধার। রবিহীন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আমি তোমারই নির্দেশে সেই দিকে পা বাড়ালাম।

রবি, তখন তুমি বিলেতে। মনে হচ্ছে কত বছর তোমাকে দেখিনি। তোমার ফিরে আসার দিন। গুনে কাটছে আমার রাতদিন। একদিন কুটনোকোটার আসরে মেজবউঠাকরুণ বললেন—

‘নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কী যে একটা বিয়ে হল ওর। কোথায় নতুন আর কোথায় তার বউ! এ বিয়েতে মনের মিল হওয়া সম্ভব নয়। স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায় এতটাই নীচু হয়, সেই স্ত্রী। নিয়ে ঘর করা হয়তো যায়, সুখী হওয়া যায় না। নতুন তো আমার কাছেই সারাক্ষণ পড়ে থাকে। গান-বাজনা-থিয়েটার নিয়ে আছে, তাই সংসারের দুঃখটা ভুলে আছে। ‘

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেলেন মেজবউঠাকরুণ। তারপর কেউ একজন ফোড়ন কাটলেন। এবার মেজবউঠাকরুণ বললেন আমাকে নিয়ে তাঁর আসল হতাশার কথা—

‘আমি তোনতুনের যোগ্য পাত্রী দেখেছিলাম। আমার স্বামীর বন্ধু ডাক্তার সূর্যকুমার চক্রবর্তীর বিলেতফেরত মেয়ে। নতুনের পছন্দও হয়েছিল। কিন্তু সে-বিয়ে হল কোথায়? নতুনের ভাগ্যে নেই, হবে কোথা থেকে!’

মেজবউঠাকরুণের এ-কথাটা ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে রটে গেল হু-হু করে। ডাক্তার সূর্যকুমার চক্রবর্তীর বিলেতফেরত মেয়ের গুণাবলির কথা কতভাবে যে আমার কাছে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে শুনতে লাগলাম আমার জন্যে ঠাকুরবাড়ির হতাশার নিশ্বাস। সত্যিই তো ঠাকুরপো, কোথায় সূর্যকুমারের বিলেতফেরত মেয়ে, আর কোথায় ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে। আমি ক্রমশ হয়ে উঠলাম ঠাকুরবাড়ির করুণার পাত্রী।

ঠাকুরপো, ঠাকুরবাড়ির রূপকুমার, সত্যিই রূপেগুণে জ্যোতির্ময় স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই ছিল না আমার কোনওদিন সেই যোগ্যতা অর্জন করতেও পারিনি, তবু কেন তাঁর সঙ্গে বিয়ে হল আমার? সেই কথাটা কেউ কিন্তু ভেবেও দেখল না। ঠাকুরপো,। আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে তোমার নতুনদাদার বিয়েই যে হত না। আমিই ছিলাম তোমাদের সবচেয়ে সহজ মুক্তির উপায়, হাতের কাছেই ছিলাম আমি, তোমাদেরই বাড়ির গরিবমহলে, নীচের তলায়। কে বাবামশায়ের কানে আমার কথাটা তুলেছিল জানি না। আমার ভাগ্য, আমার নিয়তি। বাবামশায়ের আদেশ গেল তোমার নতুনদাদার কাছে, আমাকে বিয়ে করার জন্যে। তখন যে সূর্যকুমারের মেয়ের কথা তাঁকে জানানো হয়নি, তা হয়তো নয়। কিন্তু তিনি কান দিলেন না। আমার মতো সহজলভ্য আর কে ছিল বলো?

ঠাকুরবাড়ির পুরুষ—সে-পুরুষ যতই হোক রূপবান, গুণবান, যেমন তোমার জ্যোতিদাদা, যেমন তুমি নিজে,—সেই পুরুষের বউ পাওয়া খুব সহজ নয়। ঠাকুরপো, মাত্র চারমাস তোমার বিয়ে হয়েছে। এখন তুমি তোমার নতুন বউ নিয়ে বেশ আচ্ছন্ন—তাই তো স্বাভাবিক। পুরাতনকে বিদায় জানিয়েছ তুমি। নতুনই তোমার সব। কিন্তু একদিন তোমারও মনে হবে ঠাকুরপো, তুমি সেই বাবামশায়ের নির্দেশেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছ অনেক নীচের তলায়। তোমার স্ত্রীর বাবা ঠাকুরবাড়িরই কর্মচারী, তোমার যোগ্য স্ত্রী কি তুমি পেলে ঠাকুরপো?

অর্থ, আভিজাত্য, রূপ-গুণ কোনও কিছুর জন্যেই হিন্দু ঘরের তেমন মেয়ে তোমাদের ঘরে আসবে না—যে মেয়ে বংশ-মর্যাদায়, শিক্ষাদীক্ষায় তোমাদের সমান-সমান। কারণ তোমরা তো হিন্দুনও। ব্রাহ্ম। যে-শালগ্রাম শিলা সাক্ষী রেখে হিন্দু বিয়ে হয়, সেই শালগ্রাম শিলাই তোমরা মানো না! তার ওপর তোমরা আবার মুসলমানের জল খাওয়া একঘরে পিরালি ব্রাহ্মণ! এক কথায়, তোমাদের কোনও হিন্দুব্রাহ্মণ পরিবারইব্রাহ্মণ ভাবে না। সুতরাং সেই পরিবার তোমাদের চট করে মেয়ে দেবে কেন?

আমার পরম সৌভাগ্য কিংবা অমোঘ নিয়তি, আমাকে তোমরা পেয়ে গেলে হাতের কাছে। আমার বাবার তো আর না বলার ক্ষমতা নেই। স্বয়ং বাবামশায়ের আদেশ—তোমার জ্যোতিদাদারই প্রতিবাদ করার সাহস হল না। আমার বয়েস তখন মাত্র নয়। তিনি উনিশ। বিদ্যায়-বুদ্ধিতে কত এগিয়ে আমার চেয়ে। সত্যিই তো, কত বড় ভাগ্য আমার—বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়ল, কোনও যোগ্যতা ছাড়াই ঠাকুরবাড়ির বউ, স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী হয়ে গেলাম আমি—শুধুমাত্র আমার সহজলভ্যতার যোগ্যতায়, শুধুমাত্র তোমাদের কনে খোঁজার পরিশ্রম সহজে মিটিয়ে দিতে।

রবি, আমার প্রাণের রবি—আমার সব দুঃখ, সব পরাজয় আর অপমান একদিকে। আর একদিকে তুমি। ঠাকুরবাড়িতে আমার একমাত্র পাওয়া তুমি, তুমি ঠাকুরপো, শুধু তুমি। ন’বছর বয়সে এ-বাড়িতে এসে তোমাকে পেলাম আমার খেলার সাথি, আমার দোসর। বালিকাবেলা থেকে যখন পৌঁছলাম কৈশোরে, যখন আমার শরীর-মন হয়ে উঠল অন্যরকম, যখন বদলে গেল আমার ইচ্ছের রং, তোমাকে তখন পেলাম আমার বন্ধু। আমার একমাত্র বন্ধু। আমার প্রতি। ঠাকুরবাড়ির সমস্ত অবহেলা, সব চাপা ঘেন্নার যেন প্রতিশোধ নিলে তুমি আমার পরম পুরুষ। যদি কেউ কখনও বুঝে থাকে আমার দহন, সে তুমি। আমার মনে আছে, নন্দনকাননে অন্ধকার রাত্তিরবেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি বললে, নতুন বউঠান, কী তোমাকে দহিছে, আমি জানি। তোমার মতন করে কথা বলতে এ-বাড়িতে কেউ পারে না। তোমার কথা শুনে, তোমার বুকের আশ্রয়ের মধ্যে সে-রাতে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই আমার অন্তরের সব জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়িয়ে বৃষ্টি এল। মনে হয়েছিল—তুমি আমার চিরকালের। মনে হয়েছিল, না না বিশ্বাস হয়েছিল ঠাকুরপো-তোমার ওই মন, যেমন বোঝে আমার অপমান, যে মন অনুভব করে আমার একাকিত্ব, যে মন সব সময়ে ছুঁয়ে থাকে আমার মন—সেই মনটাকে আমি চিরকালের জন্যে পেয়েছি। সেই মনের ওপর আর কোনও অধিকার নেই—এই বিশ্বাসের জোরেই আমি বেঁচেছিলাম।

ঠাকুরপো, মনটা আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিনা। কখন যে আমার জীবনের শেষ দিনের এতটা সময় কেটে গেল! এখন দুপুরবেলা, আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম বামুনঠাকুর তোমাদের ঘরে দিয়ে গেল মধ্যাহ্নের খাবার—তুমি আজকাল তোমার নতুন বউকে নিয়ে নিজের ঘরেই খাও। তোমার নতুন জীবন এই চারমাসে কত বদলে দিয়েছে তোমাকে। আগে আমার হাতের রান্না ছাড়া তোমার মন ভরত না। কিছু না কিছু রাঁধতেই হত তোমার জন্যে। এখন বামুনঠাকুরের রান্নাতেই তুমি খুশি। তোমার জ্যোতিদাদা অবিশ্যি এবাড়ির রান্না মুখে দেন না। তিনি থাকেনই বা কখন যে খাবেন? ভুলেই গেছি কবে তাঁকে। দেখেছি। তিনি মেজবউঠাকরুণের বাড়িতে বেশি আরাম পান—ওঁদের বাড়ির সাহেবি রান্নাতেই তাঁর তৃপ্তি বেশি।

ঠাকুরপো, আমার আজ উপোস। রান্নাঘরে সে-খবর পাঠিয়ে দিয়েছি সকালবেলা। আজ আমার দরজা বন্ধ। এ-দরজা আমি বন্ধ করেছি। খুলব না আমি। তোমরা খুলো—আমার মৃত্যুর পরে। সেই রুদ্ধদুয়ার খোলার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তোমার মধ্যে জন্ম হবে কোনও লেখা। কোনওদিনকে বলতে পারে! আমি থেকে যাব তোমার সেই লেখার আড়ালে।

ঠাকুরপো, আজ আমার ঘরে কেউ আসবে না। কেউ না। আজ মৃত্যুব্রত পালন করছি আমি। একই সঙ্গে বেদনা আর আনন্দ বাজছে হৃদয়ে আমার। আজ আমার নির্জলা উপবাস—যাতে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ি আমি, যাতে মরতে তেমন কষ্ট না হয়।

আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ভাবনা। ঝিমঝিম করছে মাথার মধ্যে। তবু লিখছি। আমি যে লিখছি তা ঠিক নয়। কেউ একজন লিখিয়ে নিচ্ছে এসব কথা আমাকে দিয়ে। মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের কথা। কিন্তু তার আগে অন্য একটা কথা তোমাকে বলি। খুব তেষ্টা পাচ্ছে। আমার। ঘরের কোণে পাথরের টেবিলটার ওপর কুঁজো ভরতি জল। কিন্তু এক ফোঁটাও জল খাব নাযতই তেষ্টা পাক। জল খেলেই আমার ব্রত যে ভেঙে যাবে। বরং টেবিলের ওপর মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নিই ঠাকুরপো-মাথাটা এত ঝিমঝিম করছে কেন বলো তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *