1 of 2

৩৯. টাউনের বড়ো রাস্তা জুড়ে

টাউনের বড়ো রাস্তা জুড়ে লাল নীল সবুজ বেগুনি হলুদ রঙের কাগজের তেকোণা নিশান টাঙানো মাথার ওপরে; বাড়িঘরের ছাদে কাপড়ের নিশান, সাদা চাঁদ তারা হাসছে সবুজ রঙের জমিতে। মানুষ খুশিতে টইটম্বুর। খুশি তো তমিজও, তার ট্র্যাকে দুই টাকা বারো আনা পয়সা। জেল থেকে খালাস দেওয়ার সময় জেলের ছোটোবাবু একটা কাগজে তার টিপসই নিয়ে বললো, সরকার থেকে রাহাখরচ বাবদ তোমাকে দেওয়া হলো। তা সেই বাবুটিও খুশি, কাল স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। এই উপলক্ষে কিছু কয়েদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই খালাস করার হুকুম পাওয়া গেছে। ইসমাইল হোসেন সাহেব ডি এমকে বলে তোমার নাম পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেও।

কিন্তু ইসমাইল সাহেবের বাড়িতে যা ভিড়! ভালো ভালো কাপড়পরা মানুষের মধ্যে অবশ্য গ্রামের মাতব্বর মানুষও কিছু কিছু আছে। কিন্তু তমিজের চেনা কাউকে পাওয়া গেলো না। ঐ বাড়িতে তমিজ ঢোকে কোন সাহসে?

রেল স্টেশনের কাছে পুরো তিন আনা পয়সা খরচ করে ভাত আর গোরুর গোশত খেয়ে স্টেশনের পাকা মেঝেতে শুয়েই ঘুমে তমিজের চোখ জড়িয়ে আসে। কিন্তু ভোর হবার অনেক আগে অনেকগুলো ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলে সে জেগে ওঠে। লোকজন সব ছুটছে বড়ো রাস্তার দিকে। সকাল হলে দোকানপাট খুললে বাজানের জন্যে একটা লুঙি আর কুলসুমের জন্যে রুটি বেলার চাকি বেলুন কিনতে তমিজ। কুলসুম রুটি খেতে না চায় খুব, রুটি নাকি বানাতেও শিখেছে মণ্ডলবাড়িতে। কিন্তু দোকানপাট তো আর খোলে না। রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করে। থানার কাছে আকবরিয়া হোটেলের সামনে সে কয়েকবার ঘুরঘুর করে, পোলাও, গোশত, পরোটার কী সুন্দর ঘেরান। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহস তার হয় না। কল্পনা সিনেমার পাশের গলিতে উড়ে ঠাকুরের দোকানেও পাজামা পাঞ্জাবি, ধুতি শার্ট, ধুতি পাঞ্জাবিপরা লোকদের ভিড় দেখে সেখানেও তার ঢোকা হলো না। সিনেমা হলের সামনে দুই পয়সার বাদাম ভাজা কিনতে কিনতে জিগ্যেস করলে জানতে পায়, আজ তো সব বন্ধু। এখুনি মিছিল বেরুবে।

তা বাপু মিছিলও বেরোলো একখান! মানুষে মানুষে সয়লাব। মিছিলের মধ্যে নাই কী? হুড-খোলা মোটরগাড়িই তো গোটা দুয়েক। একটা গাড়িতে সায়েবদের পোশাকপরা কয়েকটা ছেলে সায়েব সেজে ভারতবাসীর কাছে বিদায় চাইছে, হামরা দুইশো বছর টোমাডের শাসন করিয়াছে। এখন আবার নিজেডের ডেশে ফিরিয়া যাইটেছি। লোকজন তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখে হেসেই অস্থির। মিছিলের মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে পুলিসের মতো ঢাকনি-দেওয়া পকেটওয়ালা শার্ট পরে পুলিসের মতো সমান তালে পা ফেলতে ফেলতে চলছে কয়েকজন জোয়ান ছেলে। তমিজের পাশের লোকটি বলে, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড। আরে এদের সঙ্গে তো আবদুল কাদেরকেও দেখা যাচ্ছে। কাদের ভাই কি পুলিসে নাম লেখালো? কাদের পুলিসে যদি বছরখানেক আগে ঢোকে তো তমিজের এই হেনস্থাটা হতো না। কয়েকটা টমটমে পাকিস্তানের নিশান হাতে নিয়ে কয়েকজন খুব জোরে জোরে স্লোগান দেয়, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। খোলা গোরুর গাড়িতে কয়েকটা ছেলে হেলেদুলে নাচে আর রাস্তার দুই পাশের মানুষকে সালাম দেয়। মিছিল এগিয়ে চলে। এরপর আসে মস্ত উঁচু একটা হাতি। হাতির ওপর উল্টো করে রাখা তক্তপোষ, তার চার পায়ায় পাকিস্তানের চারটে নিশান। মাঝখানে গদির ওপরে বসে রয়েছে কয়েকজন। আরে ঐ তো ইসমাইল হোসেন। কিন্তু এই ভিড় ঠেলে তমিজ কি আর ইসমাইলের হাতির কাছাকাছিও যেতে পারবে? তবু না হয় একটু চেষ্টা করা যেতো। কিন্তু এই সময় থানার মোড়ে হঠাৎ সোরগোল ওঠে।-কী গো?-আঠারো বিশ বছরের একটা ছেলে, লুঙি আর গেঞ্জিপরা, আটকা পড়েছে উঁচু লাইট পোস্টে। লোকটা আঁ আঁ করে চিৎকার করছে আর হাতের মুঠিতে ধরা পাকিস্তানের নিশান, নিশানটা সবচেয়ে উঁচুতে টাঙাবে বলে সে উঠে পড়েছে বিজলি বাতির পোলে। নিচে থেকে সবাই চায়, আরে পিছনের দোতলায় লাফায়া পড়ো, নিচে লাফ দাও। সবার পরামর্শ ও অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ছেলেটা পড়ে যায় রাস্তায়। তবে তাকে জায়গা দিতে ঐ জায়গাটুকুর লোকজন ভিড়ের চাপ সহ্য করেও সরে গিয়েছিলো। খোয়া বিছানো রাস্তায় পড়ে ছেলেটা মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। নিশানটা সে ছাড়ে নি, তার গায়ের রক্তে নিশানের সবুজ ও সাদা জায়গার অনেকটা ফুটে ওঠে লাল টকটকে রঙে।

ছেলেটির লাশ নিয়ে কয়েকজন লোক থানার ভেতর চলে গেলে মিছিল এগিয়ে চললো সামনের দিকে। রেল লাইন পার হয়ে ঝাউতলা না বাদুড়তলা কি বলে,-টাউনের জায়গাগুলোর নাম তমিজের মনে থাকে না,—মিছিল চলে যায় সেই দিকে। তমিজের আর এগুনো হয় না। নিশান অনেক উঁচুতে ওঠাতে গিয়ে ছেলেটি মরলো, নিশানটিকেও ছাপিয়ে দিলো লালরঙে। এটা কেমন হলো গো?-জেলখানায় তার সঙ্গে খাতির হয়েছিলো লাল নিশানের কয়েকটা মানুষের সঙ্গে। বড়ো ভালো ভালো মানুষ গো। বলতো, জোতদারি জমিদারি আর মহাজনি যদি থেকেই যায় তো পাকিস্তান। বলো আর স্বাধীনতা বলো, এসবের মানে হয় না। এই মিছিলে এসে তমিজ বুঝতে পারে পাকিস্তানে তেভাগা তো হবেই। এতোগুলো মানুষ কি আর বেকুব নাকি? পাকিস্তানের নিশান ওড়াতে বিজলির ধাক্কায় মানুষটা মরলো, সে তো তমিজের মতোই গরিব গরবা মানুষ। সে কি এমনি এমনি নিশান ওড়াতে উঠেছিলো? তমিজ ভরা গলায় স্লোগানের জবাব দেয়, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদ আজম জিন্দাবাদ।

আকাশে মেঘ দেখে কুলসুম উঠানের ডালপাতা সব উঠিয়ে রাখছিলো তমিজের ঘরে। তমিজকে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তমিজ সামনে গিয়ে বলে, ভালো আছে? কুলসুম কিছু না বললে সে ফের বলে, কাল খালাস পালাম।

কুলসুম শাড়ির আঁচলে নিজের মুখ ঢাকে। তমিজ অবাক হয়ে দেখে। কুলসুমকে তো সে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখেনি। এটা দেখে তার নিজের চোখও ভারি হয়ে ওঠে। হয়তো সেটা সামলাতেই তমিজ জিগ্যেস করে, বাপজান কোটে?

তমিজের গলার স্বর ভারী, কথাবার্তা ধীরস্থির। চোখ মুছে তার দিকে তাকিয়ে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। ছোঁড়াটার গায়ের গন্ধও পাল্টে গেছে। অনেকক্ষণ পর কুলসুম বলে, শুক্যা গেছে। গাওত গোশত নাই।

জেলখানায় নিয়মিত খেয়ে তমিজ বরং একটু মোটাই হয়েছে। কুলসুমের কথা মেনে নেওয়ার ভঙ্গি করে সে হাসে, খিদা নাগিছে। ভাত চড়াও।

তমিজ খেতে বসলে শুরু হয় কুলসুমের অবিরাম কথা। তমিজের বাপ আজকাল ঘরেই থাকে না, দিনরাত ঘুরে বেড়ায় বিলের উত্তর সিথানে। কয়েক দিন পর পর কালাম মাঝির কাছ থেকে সে টাকা নিয়ে আসে, এই বাড়িঘর তার কাছে বেচেই দিলো কি-না কে জানে? কালাম মাঝি আজকাল খুব বড়ো মানুষ, বিলে মাঝিদের হক নাকি সে আদায় করে ছাড়বে।-তা কথা তো ঠিকই, তমিজও জানে পাকিস্তানে সবার হক ঠিকই আদায় হবে। অনেক রাত পর্যন্ত কুলসুম কথা বলে এবং এক বছরের বৃত্তান্ত সবই বয়ান করে।

ঘুমাতে নিজের ঘরে ঢুকে তমিজ দেখে ঘরের চাল একেবারে পাতলা। মেঝে ভর্তি পাতা আর গাছের ডাল। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, ঘরের মেঝে কাদাকাদা। একটা বছর জেলখানায় পাকা ঘরে থেকে অভ্যাস অন্যরকম হয়ে গেছে তার। তবে নিজের মাচায় পিঠ ঠেকাতেই কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ে। * ভোরবেলা দুই পা ভরা কাদা নিয়ে ঘরে ফেরে তমিজের বাপ। আর একটু বেলা হলে তমিজ তার ঘরে এসে দুটো টাকা তুলে দেয় বাপের হাতে, জেলখানা থ্যাকা বারাবার সময় দিলো।

তমিজের বাপের চোখ থেকে ঘুম ঝরে পরে,সোম্বাদ শুনিছিস?

কালাম ভায়ের কাছ থ্যাকা ট্যাকা লিয়া ঘরখান বেচিছো।

বেচমু কিসক? বন্দুক দিছি। কী করমু, তোর মামলার খরচ দেওয়া লাগে। তো সোম্বাদ সিটা লয়।

আফসার চাচার খবর? শুনিছি। যুধিষ্ঠিরের বাপের খবর শুনিছি আগেই।

আরে না। খবর সিটা লয়। সব্বোনাশ হয় গেছে।

বৈকুণ্ঠদার হাতের আঙুল–।

আরে দূর। সব্বোনাশ হছে। বিলের উত্তর সিথানত পাকুড়গাছ খুঁজ্যা পাই না। পাকুড়গাছ নাই।

নাই। গাছ কাটিছে। তমিজের কাছে এ তো সোজা হিসাব, মণ্ডলরা ইটখোলা করলো না?

মুনসির গাছ কাটা অতোই সোজা কার হাতে এংকা জোর আছে রে?

মুনসি গাছেত চড়া উড়াল দিছে। বেপরোয়া হয়ে বললেও তমিজের একটু ভাবনা হয়, গাছ মনে হয় ক্যাটাই ফালাছে, দিশা পায় নাই। তবে এই নিয়ে কথা বলার মতো সময় কোথায় তার? দেখি, কামকাজ তো কিছু দেখা লাগে।

তমিজকে দেখেই ফুলজান হাউমাউ করে এক পশলা কাঁদে, তুমি আসিছছা গো মাঝির বেটা? হামার বেটাক তুমি ডাক্তোরের কাছে লিয়া গেলা না গো? এখন হামার বেটা নাই, তুমি অ্যাসা আর কী করবা?

ফুলজানের বেটার মরার খবর তমিজ পেয়েছে কুলসুমের কাছে। ফুলজানের পুত্রশোক অবশ্য কুলসুমের প্রধান বিবেচনা নয়। সে বলছিলো, বেটাটাক তো মাগী খালো। ভাতারও আসে না। ঘেগি মাগী এখন লিকা বসবি কার সাথে? কুলসুমের এইসব দুশ্চিন্তা শোনার পর থেকেই তমিজের খুব ইচ্ছা হয়, ফুলজানের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।

ফুলজানের মা মেয়েকে ধমক দেয়, লে বাপু হছে। জাত নাই বিচার নাই, মানুষ দেখলেই কান্দন আরম্ভ হলো! তারপর সে নিজেই শুরু করে তার স্বামী হুরমতুল্লার গপ্পো। বুড়া তো জমি ছাড়া কিছু বোঝে না কিন্তু সারাটা জীবন তার কাটলো বর্গাচাষ করে। এবার মণ্ডলের আরো জমি বর্গা পেয়েছে, এখন আউশ কাটার মানুষ পাওয়া মুশকিল। মজুরি বেড়ে গেছে, খিয়ারে আরো বেশি মজুরির লোভে লোকজন অনেকেই গ্রামছাড়া। কিছু কিছু জমিতে আউশ কাটা হয়েছে, সেখানে আমন বোনার পাঁয়তারা কষছে বুড়া। এদিকে নিজের জমিতে কি বুনবে না বুনবে এখনো ঠিক করতে পারছে না। মণ্ডলের জমিতেই দিনরাত খাটে, নিজের জমির যত্ন নেয় কম।

যে জমিতেই হোক, হুরমতুল্লার ফসল কাটা আর ফসল বোনার গুঞ্জনে তমিজের সারা শরীরেই কোলাহল ওঠে; সেই কুয়াশায় পাকা আমনের জমির পাশে ফুলজানের সঙ্গে কাটানো। ফুলজানকে জড়িয়ে ধরতে না লাঙল ধরতে, না-কি দুটোর তাগিদেই তার হাত নিশপিশ করে বোঝা মুশকিল।

মোষের দিঘির পূর্ব ঢালের নিচে থেকে সন্ন্যাসীর ভিটার উত্তর সীমা প্রায় চার বিঘা জমি মণ্ডল নতুন পত্তন নিয়েছে। ক্যা গো বুড়ার বেটা, চিনবার পারো? দিঘির ঢালে জমিতে মই দিতে দিতে হুরমতুল্লা জবাব দেয় তমিজের দিকে না তাকিয়েই, না চেনার কি হলো? জেল খাটা কয়েদি, চিনা তো রাখাই লাগে।

তমিজের চোখমুখ গরম হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, জেলে পাঠালা তো তোমরাই। মণ্ডলের চাকর। মণ্ডল হুকুম দিছে, তোমরা নাঠি লিয়া গেলা। উগলান দিন শ্যাষ। কাৎলাহার তো আর রাখবার পারিচ্ছে না। মাঝিগোরে বিল, মাঝিরাই পাবি।

এবার হুরমতুল্লা একটু ঘাবড়ায়, ছোঁড়ার তেজ তো আরো বেড়েছে! একবার জেলের ভাত খেয়ে এসেছে, এদের কোনো বিশ্বাস আছে? হুরমতুল্লার ভয়-পাওয়া বুঝতে পেরে তমিজ প্রস্তাব করে, জমি তো শুনলাম মেলা বর্গা লিছো।কামলা লাগলে কয়ে।

মইয়ের ওপর শমশের পরামণিকের ভাগ্নেকে উঠিয়ে দিয়ে হুরমতুল্লা বলে, মণ্ডল তো তোক জমি বর্গা দিবি না। এখন তারই জমিত যদি তোক কামলা লেই তো তাই কোদ্দ করে যদি?

উগলান ভয় এখন মাচাত তুল্যা রাখে। শোনো, মণ্ডলের বেটা ঘোরে ইসমাইল সাহেবের পাছে পাছে। ইসমাইল হোসেনের নাম শুনিছো?

ভোট দিলাম না?

হুঁ, ভোট দিয়া তাক কাউন্সিলে পাঠাছো না? ঐ মানুষ নিজে মটোর লিয়া জেলখানাত যায়া হামাক খালাস করা আনিছে। এখন বোঝো! তুমি জমি বর্গা লিছো, হামি জমিত খাটমু, পয়সা দিবা। মণ্ডলের কী?

 

হুরমতুল্লার আউশ কাটলো সে মজুরি নিয়ে। কিন্তু প্রায় পাশাপাশি আমনের জমি তৈরি করতে কামলা দেওয়ার শর্তে তমিজ একটু অন্যরকম করতে চায়। মজুরি দিলে চলতি হারেই দেবে। কিন্তু হুরমতুল্লা ইচ্ছা করলে অন্যভাবেও দিতে পারে। ধান উঠলে মণ্ডলের গোলায় তুলে হুরমতুল্লা বর্গাচাষী হিসাবে যা পাবে তার একটা ভাগ দেবে তমিজকে।-এটা কেমন কথা?–তমিজ জোর দিয়ে বলে, ততোদিনে তেভাগা হয়া যাচ্ছে। জোতদার পাবি এক ভাগ, তোমার ভাগ দুইটা। তার দুই আনিও যদি হামাক দাও তো তোমার কতো ধান থাকে হিসাব করিছো?

হুরমতুল্লা ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। আবার নিজে দুই ভাগ পাবে—এই ভরসায় তমিজের প্রস্তাব মেনে নিতেও তার আপত্তি নাই। হ্যা না কিছুই না করে বলে, দেখা যাক। কাম কর তো।

ছোঁড়াটার কাম তার খুব পছন্দ। দেখো না, একে মাঝির বেটা, তাতে আবার এক বছর ছিলো জেলে, ধানের জমি চোখেও দেখেনি তখন। অথচ তার আমন বোনার হাতটা দেখে। চারা লাগায় এমন সোজা সারিতে যে তাই দেখতে দেখতে হুরমতুল্লার সারিগুলো আরো এলোমেলো হয়ে যায়। আবার ছোঁড়াটা আসার পর ফুলজানও জমিতে আসতে শুরু করেছে। মাঝখানে কেরামতের ধমকে এদিকে ভিড়তে সাহস করে নি। শালা জামাই একটা!-মাসের পর মাস উধাও হয়ে হাটেবাজারে ঘুরে বেড়ায়, এর বাড়িতে ওর ঘরে গিয়ে থাকে, আবার একেক দিন হুমকি ছেড়ে যায়, মেয়েমানুষ আবার জমিতে যাবে কেন?-ঐ জামাইকে পরোয়া করার দরকারটা কী?

আমনের শীষে দুধ আসতে শুরু করেছে, তমিজ এখন রাত্রিবেলায় এসেও জমি দেখে যায়। ফুলজান অকারণে খবরদারি করে। হুরমতুল্লা মেয়ের ওপর বিরক্ত হয়; তমিজকে কাজ অতোটা না দেখালেও তো তার চলে। সে পারে না কোন কাজটা? তবে হাজার বাকাচোরা কথা বললেও জমিতে তমিজ থাকলে ফুলজানের মেজাজটা থাকে ভালো।

হাটে তমিজের সঙ্গে দেখা হলে কেরামত তার সঙ্গে খুব গল্প করে। জেলখানায় তেভাগার যেসব নেতার সঙ্গে তমিজের আলাপ হয়েছে, আরে তারা সবাই তো কেরামতের বন্ধুমানুষ। তার বাঁধা গান শুনেই তো চাষারা রুখে দাঁড়িয়েছিলো। তেভাগা তো হয়েই যাচ্ছে, কেরামতের তখন কদর আরো বাড়বে। কেরামতের বেশির ভাগ কথা তমিজ যে বিশ্বাস করে তা নয়, আবার সেসবকে মিছে কথা বলেও মনে হয় না। গানও বাঁধে সে ভালো। পাকিস্তান হয়ে পড়ায় তার লীগ কংগ্রেসের হিংসা কেন গেলো না, বইটার বিক্রি পড়ে গেছে। ইসমাইলের কথায় সে এখন নয়া ওয়াতন পাকিস্তান নামে একটা গান বাঁধার কথা খুব ভাবছে। ঠিক জুত হচ্ছে না।

মানুষটা এমনিতে তো ভালোই। কিন্তু ফুলজানের সঙ্গে সে এমন করে কেন? ফুলজানকে কেরামতের কথা একদিন জিগ্যেস করতেও চেয়েছিলো তমিজ। আজ বলি কাল বলি করতে করতে মেলা দিন হয়ে গেলো। ধানের শীষ ততোদিনে বেশ জমে এসেছে। এবার শীত পড়ছে একটু তাড়াতাড়ি, ধানের কি হয় কে জানে—এই ভাবতে ভাবতে মোষের দিঘির পুবের জমিতে নিড়ানি দিচ্ছে, এমন সময় হুরমতুল্লার বাড়ি থেকে মেয়েলি গলায় সমবেত কান্না শুনতে পেয়ে তমিজ সেদিকে ছোটে।

গফুর কলু এসেছে তার বৌকে নিয়ে। আবিতনের হাতের কাগজটা নিয়েই এতো কান্নাকাটি। পড়তে না পারলেও গম্ভীর মুখে হুরমতুল্লা কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে। তার হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে তমিজও দেখলো। তবে কাগজে লেখা বিষয়টি বলেছে। আবিতন নিজেই। হুরমতুল্লা মেয়েকে ধমক দেয়, কুত্তার বাচ্চাটা থাকার চায় না থাকাই তো ভালো। তালাক দিছে, হামাগোরে শনি বিদায় হলো। আপদ গেলো।

মাচায় শুয়ে ফুলজানকে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে দেখে তমিজের কষ্ট হয়। কেরামত আলি তালাক দিলে ফুলজানের এতে ভেঙে পড়ার কী হলো? তো ফুলজানের দুঃখ দেখেই সে কষ্ট পায় কি-না তাই বা কে জানে? জমিতে ফিরে গিয়ে তমিজের নিড়ানি দেওয়া সেদিন ভালো হয় না। এই ফুলজানই তো তমিজকে কয়েকবার বলেছে, কেরামত বাইরে এতো ভালো সাজলে কী হয়, ওটা কোনো মানুষের পয়দা নয়। শালা একটা শয়তানের বাচ্চা। ফুলজান বলেছে, শয়তানটা তাকে ইচ্ছা করেই তালাক দেয় না। হুরমতুল্লার তিন মেয়ে ছাড়া আর কে আছে? তার জমি যা আছে সব পাবে তো তার মেয়েরাই। শয়তানটা জমির লোভেই ফুলজানকে তালাক দিচ্ছে না। শরিয়তে নিয়ম থাকলে তালাকনামা পাঠাতে ফুলজানই।—তা এখন বাপু তালাক পেয়ে অমন কাঁদো কেন? কেরামতেরও কি জমির মায়া ছিলো? এখন ফুলজানের ভাগের জমিটা পাবে যে তাকে বিয়ে করবে সে-ই তো? তমিজকে বিয়ে করতে ফুলজানের এখন আর আপত্তি কি থাকতে পারে। তুমি বরং ফুলজানের জমি আরো কতো বাড়িয়ে দিতে পারে। ফুলজানকে বিয়ে করলে, বেশি না, কেবল তার জমিটুকুও যদি হুরমতুল্লা তাকে দেয় তো তিন বছরের ফসল বেচে তমিজ নিজের বাড়ির পালানটা কিনে ফেলতে পারে শরাফতের কাছ থেকে। তার আগে কালাম মাঝিকে টাকা শোধ করে উদ্ধার করতে হবে তার ঘর আর ভিটা। মোষের দিঘির পুবের জমিটা তো পত্তন নিলো হুরমতুল্লা, পশ্চিমের জমি নেবে তমিজ। জমিদারি তো উঠেই যাচ্ছে, তখন জমিদারদের এইসব খাস জমি : পাবে তো তারাই। তখন জমিতে নামো, লাঙল বাও আর ফসল তোলো। ফুলজানকে জমিতে অতোটা না খাটলেও চলবে। চাষবাস নিয়ে সে যদি তমিজকে একটা মুখ ঝামটা দেয় তো তাতেই ফসল যা হবে তাই খাবে কে? এক দাগে ছয় বিঘা জমির মালিক হতে তার তিন বছরও লাগবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *