৩৭. রাজেন্দ্রলাল ইটের সেই বাড়ি

রাজেন্দ্রলাল ইটের সেই বাড়ি!

কত জন্মমৃত্যুর সাক্ষী, কত উৎসব শার উক্তনা, আলোড়ন আর আয়োজনের হিসেবক, ঝুত সুখদুঃখের নীরব দর্শক। তার এই চারখানা দেওয়ালের আড়ালে তিনপুরুষ ধরে যে জীবনযাত্রা প্রবহমাণ, তার ধারা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো স্তিমিত নিরুচ্চার, তবু মাঝে মাঝে সেখানে ঘূর্ণি ওঠে।…হয়তো এ-বাড়ির প্রতিষ্ঠাতার সেই চিরবিদ্রোহী গৃহিণী সুবর্ণলতার আত্মার নিস্ফল বেদনা এর প্রতিটি ইটের পাজরে পাজরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে বলেই সেই রুদ্ধশ্বাস বিকৃত হয়ে দেখা দেয়। তবু এদের নিত্যদিনের চেহারা বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন স্তিমিত। নিত্যদিন ঘড়ির একই সময়ে এদের রান্নাঘর থেকে উনুন ধরানোর চিহ্ন বহন করে ধোঁয়া ওঠে, একই সময়ে চাকর যায় বাজারে, রান্নার শব্দ, বাসন মাজার শব্দ, বাটনা বাটার শব্দ আর মহিলাদের অসন্তোষ এবং অভিযোগে মুখর করে শব্দ জানান দেয়, এরা আছে, এরা থাকবে।

হয়তো পৃথিবীতে এরাই থাকে, যাদের দিন-রাত্রিশুলো একই রকম।

শুধু এদের উৎসবের দিনগুলো অন্যরকম, মৃত্যুর দিনগুলো অন্যরকম।

সেই অন্যরকমের ছায়া নেমেছে আজ এ-বাড়ির আকাশে।

বাড়ির এদিকের ঘরে যখন বহু দুঃখ বহু যন্ত্রণা আর বহু প্রত্যাশার শেষে একটি পুনর্মিলনের নাটক অভিনীত হচ্ছে, আর এক ঘরে তখন বিচ্ছেদের মর্মান্তিক দৃশ্য।

মর্মান্তিক, বড় মর্মান্তিক!

এ-বাড়ির সেই ছটফটে ঝলমলে বেপরোয়া উদ্দাম মেয়েটা একেবারে স্থির হয়ে গিয়ে শুয়ে আছে নীল মুখ আর মুদ্রিত চোখ নিয়ে। তার ঘরের মধ্যে শরাহত বাঘের মত যে মানুষটা এ-দেয়াল থেকে ও-দেয়াল অবধি এলোমেলো পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, তার চোখের আগুন নিভে এসেছে, বোঝা যাচ্ছে একটু পরে ঘাড় লটকে পড়বে ও।

আর ওই নিথর-হয়ে-যাওয়া মেয়েটার বিছানায় লুটোপুটি করে বিছানাটাকে আর নিজেকে বিধ্বস্ত করে যে মানুষটা কান্না চাপার ব্যর্থ চেষ্টায় বেশী করে কেঁদে উঠছে, তার আর এখন মনে পড়ছে না হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, আমি কী কাজ করে ফেলেছি! তার এখনকার মন তীব্র আর্তনাদে বলে উঠতে চাইছে, আমার খুকু, আমার বেবি, আমার কৃষ্ণা, আমার সর্বস্বই যদি চলে গেল, তবে আর আমার মিথ্যার জাল বুনে বুনে মুখরক্ষার চেষ্টার দরকার কী দায়?

ওই নিষ্ঠুর হৃদয়হীন লোকটা অলকাকে শাসন করতে এসেছিল, বলেছিল, চুপ! একদম চুপ করে থাক! এতদিন আমি চুপ করে থেকেছি, এবার থেকে তোমার পালা!

কিন্তু পারেনি অলকা নামের ওই অতি আধুনিকা হবার চেষ্টায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষটা। যে নাকি ওই সুবর্ণলতার বংশধরের বৌ। রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের এই বাড়িটার খানিকটা অংশে যার আইনসঙ্গত অধিকার।

হ্যাঁ, সেই আইনসঙ্গত অধিকারের বলেই অলকা তার পেন্ট-করা মুখ আর রং লাগানো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলত, আমার ঘরে আমি যা খুশি করবো, কারুর কিছু বলতে আমার অধিকার নেই। বেশ করবো আমার মেয়েকে আমি নাচাবো গাওয়াব, সমাজে ছেড়ে দেবো..এ বাড়ির এই ঘূণ-ধরা দেওয়ালের খাজে খাজে যে সনাতনী সংস্কার এখনো বসে আছে আর এ সংসারের জীবনযাত্রার ওপর চোখ রাঙাতে আসছে, তাকে আমি মানি না, মানবো না। তোমরা হচ্ছে কূপমণ্ডুক, তোমাদের কাছে অগ্রসর পৃথিবীর খোলা হাওয়া এসে ঢোকে না। …তোমাদের বাড়িতে নাকি এক প্রগতিশীল লেখিকা আছেন, আন্ততঃ শুনতে পাই বাইরের জগতে পাঠকসমাজে তার নামের ওই বিশেষণ, কিন্তু আমি তো তার প্রগতির কোনো চিহ্নই দেখি না। তিনি তোমাদেরই মত সংস্কারে আচ্ছন্ন।…না হলে আমাকে এত লড়তে হতো না, আমি একটু অনুকূল বাতাস পেতাম।…আমি কোনো আনুকূল্য পাইনি কারো কাছে, সারাজীবন। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে নৌকাকে কূলের দিকে নিয়ে চলেছি। এমন কি তুমি স্বামী, তুমিও আমার প্রতেকটি কাজ প্রত্যেকটি বাপার অপছন্দর দৃষ্টিতে দেখে এসেছে। কোনোদিন সাহায্য সহায়তা করনি। তবু দেখো, আমি কি হেরে গেছি? না হার মেনেছি?.না, হার আমি মানাবো না। আমার জীবনে যা পাইনি, আমি যে জীবন পাইনি, সেই জীবন, সেই পাওয়া আমার মেয়েকে আমি দেবো।

প্রায় এইরকম নাটকীয় ভাষাতেই কথা বলে এসেছে অলকা এযাবৎ অপূর্ব চুপ করে। থেকেছে, চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবাদ তুললেই অলকা এমন ঝড় তোলে যে বাড়িতে মানসম্মান বজায় থাকে না।

অথচ আজকালকার দিনে এই রাস্তার ওপরকার বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিয়ে মানসম্মান নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়াও সহজ নয়।

তাই চুপ করে থাকতে হয়েছে অপূর্বকে। এবং অলকা ওই চুপ করিয়ে রাখার আত্মপ্রসাদে ডগমগ করতে করতে একটা অজানা জগতের দিকে অন্ধের মত ছুটেছে। সেই ছোটাটার বাহন তার মেয়ে। যে মেয়েটা এখন জবাব দিয়েছে।

নয়া, আর কোনোদিন তাকে নিয়ে ছুটতে পারবে না অলকা।

এখন তাই অপূর্বর দিন এসেছে।

কথা বলার দিন।

আগুনের ডেলার মত দুই চোখে ওই শোকাহতার দিকে তাকিয়ে নির্মায়িকের মত বলেছে চুপ! চুপ! চুপ করে থাক! টু শব্দ নয়।

কিন্তু সে শব্দ তো করেই বসে আছে তার আগে অলকা। মাতৃহৃদয় কি একবারও হাহাকারে ফেটে না পড়ে পারে?

অলকা আত্মগ্লানিতে হাহাকার করে উঠে বলেছে, আমি কী করলাম! আমি কী করলাম আমি লোকলজ্জার ভয়ে আমার সোনার খুকুকে হারালাম! ওরে খুকু, কেন আমি তোর নিষ্ঠুর বাপকে ভয় করতে গোলাম! কেন তোকে নিয়ে এদের সংসার ছেড়ে চলে গেলাম না!

তারপর আর বলতে পায়নি অলকা।

চিরদিনের মুখরা ওই মেয়েটাকে চিরদিন চুপ করে থাকা মানুষটা চুপ করিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তাতে আর কী লাভ হলো?

ওই একবারের হাহাকারেই তো সংসারসুদ্ধ নোক জেনে ফেলেছে ঘটনাটা কী। জেনে ফেলেছে ঝি-চাকরেরাও। অতএব পাড়ার লোকেও জেনে ফেললো বলে।

এ সংসারের অন্য সদস্যরা সাধ্যপক্ষে অলকার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াত না। অলকার ঔদ্ধত্য, অলকার স্বেচ্ছাচার, অলকার বিশ্বনস্যাৎ ভাব সকলকেই দূরে সরিয়ে রাখতে।

কিন্তু আজ আর অলকার সে গৌরব নেই। আজ অলকার মুখের রং গেছে মুছে, চোখের কাজল গেছে ধুয়ে, উদ্ধত উচ্চচূড়া খোঁপাটা গেছে ভেঙে লুটিয়ে, অলকা পরাজিতের চেহারা নিয়ে পড়ে আছে।

তবে আর আসতে বাধা কি?

একটি বিধবা কন্যার আর একটি মৃত কন্যার সন্তানসন্ততিকুল নিয়ে এবং বাতের যন্ত্রণা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন মেজ জেঠি স্বয়ং, যিনি অলকার মুখই দেখতেন না। এসেছেন বড়গিন্নী তার জ্বালাভরা প্রাণ নিয়ে। ছেলের বৌ কোনোদিনই তাকে মানুষ বলে গণ্য করতো না, গুরুজন বলে সমীহ করতো না, তিনিও তাই ওই ভিন্ন হয়ে যাওয়া ছেলে, ছেলের বৌয়ের ছায়াও মাড়াতে আসতেন না।

কিন্তু আজকের কথা স্বতন্ত্র।

আজ ওই প্রতিপক্ষের সকল দর্প চূর্ণ।

যাকগে নিজের প্রাণ ফেটে, তবু তিনি মনের অগোচরে নিরুচ্চার উচ্চারণে বলে বসেছেন, হে নারায়ণ, দেখলাম “দর্পহারী” নামই তোমার আসল নাম!

ঘরের একাংশে কোণের দিকে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে শম্পা আর তার মা-বাবা…যে শম্পা বহুদিন পরে আজই প্রথম আবার এ-বাড়িতে এসে আহ্লাদে বেদনায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছিল। সহসা উঠলো ওই আর্তনাদ বাতাস বিদীর্ণ করে।

আমি কী করলাম! আমি কী করলাম!

ভগবান, তুমি কী করলে! তুমি কী করলে! এ শোকের সান্ত্বনা আছে! আমি কী করলাম! এ শোক সান্ত্বনার বাইরের।

শম্পা অবাক হয়ে যেন নিজের ভাগ্যও দেখছিল। এতদিন কিছু হলো না, ঠিক আজই ঘটলো এই দুর্ঘটনা!

শম্পা একটা অদ্ভুত বিষাদ-বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই নীল-হয়ে-যাওয়া মেয়েটার স্তব্ধ দেহটার দিকে তাকিয়ে।

ওই মেয়েটা শম্পার আশৈশবের সঙ্গিনী নয়, চিত্তজগতের সখী নয়, এমন কি সম্পর্কসূত্রে যে বন্ধনটুকু থাকা উচিত সে বন্ধনেরও গ্রন্থি ছিল না পরস্পরের মধ্যে। তবু তারা দুজনে প্রায় সমবয়সী, দুজনে একই ছাদের নীচে থেকেছে জন্মাবধি …

যখন অপূর্ব তার স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে রান্নাঘর আলাদা করে ফেলেনি তখন শম্পা আর ওই মেয়েটা একসঙ্গে খেয়েছে, একত্রে বসেছে।

এতদিন শম্পা অনুপস্থিত ছিল, জানতে পারেনি ওদের ওই কাঁচের পার্টিশান দেওয়া ঘরের আড়ালে কী ঘটেছে, সে ঘটনা কোন্ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে।…আজ এইমাত্র এসে চরম পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু ভাববার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে শম্পা, শুধু আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে।

আর এ-বাড়ির আর একজন সদস্যা?

অলকা নামের ওই প্রগতিশীল মহিলাটির কাছে যে নাকি চিরদিন ব্যঙ্গের পাত্রী?

 সেই লেখিকা বকুল?

এ-বাড়িতে যে বেমানান, এ-বাড়িতে যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার ভূমিকাতেই অভ্যস্ত?

তা তাকেও এখানে আসতে হয়েছে বৈকি।

সম্পর্কের দায়ে নয়, হৃদয়ের সায়েই।

বকুলেরও মনের মধ্যে কোনটায় যেন চিনচিন করছে।

আমরা মেয়েটাকে তাকিয়ে দেখিনি। আমরা আমাদের কর্তব্য করিনি। ওকে ওর ওই নির্বোধ আর আধুনিকতার বিকারগ্রস্ত মায়ের হাতে সমর্পণ করে রেখে দিয়েছি। ওর এই পরিণামের ভয়াবহ আশঙ্কা কি আমাদের মনের মধ্যে উঁকি মারেনি?

মেরেছে।

তবু আমরা ওর ছাগল ও যেদিকে ইচ্ছে কাটুক বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বসে থেকেছি। সেই ভয়াবহতাই এসে চিলের মত ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটাকে।

আর কিছু করার নেই। ভুল সংশোধনের আর কোনো উপায় নেই।

না আমাদের, না ওর মার। কিন্তু ওর বাপই কি নির্দোষ?

সে কি তার কর্তব্য করেছে? নাকি একটা নিষ্ঠুর হিংস্রতায় বসে বসে অপেক্ষা করেছে কবে ওর মার দর্পচূর্ণ হয়?

অসম্ভব…এ হয়তো অসম্ভব, তবু চুপ-করিয়ে দেওয়া অলকা মাঝেমাঝেই বাঁধ ভেঙে কথা বলে উঠেছে। তীব্র অভিযোগের কথা, জানি জানি, খুব আহ্লাদ আজ তোমার! আজ তোমার শত্রুর হার হয়েছে। বরাবর তুমি আমায় শাসিয়েছে, এত বাড়াবাড়ির প্রতিফল একদিন পাবে। পেলাম সে প্রতিফল। এখন আহ্লাদ হবে না তোমার? লড়াইয়ে জেতার আহ্বাদ?

বকুল এগিয়ে আসে।

যে বৌটা চিরদিনই ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তার কথাকে নস্যাৎ করে এসেছে, তাকেই দৃঢ়স্বরে বলে, এসব কী কথা হচ্ছে অলকা?…শুধু তোমারই কষ্ট হচ্ছে? অপুর হচ্ছে না?

অলকা মুখ তুলে লাল-লাল চোখে বলে, উপদেশ দিতে এসেছেন? দিন পেয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করছেন? করবেন বৈকি। তবে এ দিন আপনাদের পেতে হতো না। ওই যে নিষ্ঠুর লোকটা, যার দুঃখে সহানুভূতি আসছে আপনার, তার জন্যেই এই “দিন” পাওয়া আপনাদের। আমি আপনাদের ওই পচা সমাজকে মানতাম না, আমি কলঙ্ককে কেয়ার করতাম না, শুধু ওর ভয়ে–হ্যাঁ, শুধু ওর ভয়েই খুকু আমার

বকুল আস্তে আস্তে সরে গেল।

ওই অনুতাপে জর্জরিত বিকারগ্রস্ত মানুষটা এখন প্রায় পাগলের সামিল। ওর কথায় কান দেওয়া চলে না।

এখন উদ্ধার হতে হবে এই বিপদ থেকে। এ মৃত্যু শোকের পবিত্রতা নিয়ে আসেনি, এসেছে বিপদের ভয়াবহতা নিয়ে।

বকুল বাইরে এসে ডাকল, ‘ছোড়দা!’

 যা করবার ওই ছোড়দাকেই করতে হবে।

তারপর বকুল দালানের এধারে, যেখানে উঁচু দেয়ালে এ-বাড়ির প্রাক্তন কর্তা প্রবোধচন্দ্র আর তার গৃহিণী সুবর্ণলতার ছবি টাঙানো আছে, সেধারে চলে এল।

সেদিকে তাকিয়ে রইল না, অন্য আর এক দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, মা, তুমি কি অহরহ এই মুক্তিই চেয়েছিলে? এই শৃঙ্খলমুক্তি? তোমার প্রাণ কুড়ে চাওয়ার ফল কি এই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *