৩৩. নাম ছিল সত্যবতী দেবী

আমাদের মাতামহী–যাঁর নাম ছিল সত্যবতী দেবী, তিনি নাকি একদা এই প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনের ঘর ছেড়ে পৃথিবীর আলোয় বেরিয়ে পড়েছিলেন, বিয়েটা কেন ভাঙা যায় না?

বলেছিলেন, এই কথারই জবাব খুঁজতে বেরিয়েছি আমি।

পারুল আর বকুল দুজনে যেন একই সঙ্গে একই কথা ভাবে, এই একটা আশ্চর্য!

পারুল তার খেয়াল-খুশির ডায়েরিতে লিখে চলে, কিন্তু সে কি আজকের এই বিয়ে? যে বিয়ে “ভালবাসা”র পতাকা উড়িয়ে লোকলোচনের সামনে জয়ের গৌরব নিয়ে নিজেদেরকে মালাবন্ধনে বাঁধে?

সত্যবতী দেবীর নয় বছরের মেয়ে সুবর্ণলতাকে নাকি লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর এই মহৎ কর্মের নায়িকা ছিলেন সুবর্ণলতার পিতামহী, সত্যবতীর শাশুড়ী। সত্যবতী বলেছিলেন, এ বিয়ে বিয়ে নয়–পুতুল খেলা

কিন্তু আজকের এই সভ্য সমাজের ভালবাসার বিয়ে! এরই বা পুতুল খেলার সঙ্গে তফাৎ কোথায়? খেলতে খেলতে পুরনো হয়ে গেলে, বৈচিত্র্য হারালে, আবার অন্য পুতুল নিয়ে খেলা শুরু, এই তো–আর যদি নতুন করে শুরু না-ও করো, খেলাটাই ত্যাগ করলে। খেলাটা ভাঙলে পুতুলটা আছড়ে ফেলে দিলে।

আমাদের বিদ্রোহিণী মাতামহী কি এই চেয়েছিলেন? তিনি কি আজ শোভনের এই মুক্তি দেখে উল্লসিত হভেন? বলতেন, যে বিয়ে মিথ্যে যে বিয়ে অর্থহীন, তার বোঝা বয়ে চলা মূঢ়তা মাত্র? শোভন ঠিক করেছে?

কিন্তু তাহলে সত্যি বিয়ে কোনটা?

আজ যা সত্য, আগামী কালই তো তা মিথ্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কলমটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পারুল, বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গঙ্গার ধারের সেই বারান্দা। পড়ন্ত বিকেলে গঙ্গার সেই অপূর্ব শোভা, জলে বাতাসের কাপন, তিরতির করে বয়ে চলেছে! অথচ গতকালই কালবৈশাখীর ঝড়ে কী তোলপাড়ই হচ্ছিল।

প্রকৃতি শক্তিময়ী, প্রকৃতি ঝড়ের পর আবার স্থির হতে জানে।

মানুষ মোচার খোলার নৌকোর মত ভেসে যায়, ডুবে তলিয়ে যায়।

রাজা চলে গেছে। মার কাছেও নয়, বাপের কাছেও নয়, চলে গেছে আসানসোলের এক বোর্ডিং স্কুলে।

অদ্ভুত অনমনীয় ছেলে!

কিছুতেই কলকাতায় থাকবে না সে।

অবশেষে রামকৃষ্ণ মিশনের ওই আসানসোল শাখায় ব্যবস্থা করতে হয়েছে শোভনকে।

পারুল হতাশ হয়ে বলেছিল, কী দিয়ে গড়া রে তোর ছেলে শোভন? পাথর না ইস্পাত?

শোভন শুকনো গলায় বলেছিল, অথচ শুধু আবদেরে আহ্লাদে ছেলে ছাড়া কোনোদিনই অন্য কিছু ভাবিনি ওকে।

পারুল মনে মনে বলেছিল, তার মানে তোমরাই গড়লে ওকে পিটিয়ে ইস্পাত করলে?

আশ্চর্য, চলে গেল যখন একটুকু বিচলিত ভাব নেই। সেই বালগোপালের মত কোমল সুকুমার মুখে কী অদ্ভুত কাঠিন্যের ছাপ! এরপর থেকে হয়তো এই একটা জাতি সৃষ্টি হবে, যারা মা-বাবাকে অস্বীকার করবে, বংশপরিচয়কে অস্বীকার করবে, হৃদযবৃত্তিকে অস্বীকার করবে। কঠিন মুখ নিয়ে শুধু নিজেদেরকে তৈরী করবে, পৃথিবীর মাটিতে চরে বেড়াবার উপযুক্ত ক্ষমতা আহরণ করে। আর সে ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে বাপকে বলবে, আমাকে লেখাপড়া শেখাতে তোমার যা খরচ হয়েছে তা শোধ করে দেব।…অথবা বলবে, যা করেছে, করতে বাধ্য হয়েই করেছে। পৃথিবীতে এনেছিলেন আমাদের তার একটা দায়িত্ব নেই?

হয়তো ওইটুকুই তফাত থাকবে মানুষের জীবজগতের সঙ্গে। পশুপক্ষীরা তাদের জন্মের জন্যে মা-বাপকে দায়ী করতে জানে না, মানুষ সেটা জানে।

পারুল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ঘরে চলে এলো। কলমটা নিয়ে আবার লিখলো- কিন্তু এটাই কি চেয়েছিলেন সত্যবতী দেবী? তার সব কিছুর বিনিময়ে এই জবাবটা খুঁজে এনেছিলেন পরবর্তীকালের জন্যে?

পারুলের মনে পড়তে থাকে শোভনের সেই সমারোহময় জীবনের ছবিটি! বৌ ছেলে মেয়ে আর অগাধ জিনিস নিয়ে হয়তো একদিন কি একবেলার জন্যে মার কাছে এসে পড়া। একদিনের জন্যেও কত জিনিস লাগে ওদের ভেবে অবাক হতে পারুল। বৌ হেঁটে গেলে বোধ হয় বুকে বাজতো শোভনের, বৌয়ের এতটুকু অসুবিধা দূর করতে মুঠো মুঠো টাকা খরচ করতে দ্বিধা করতে না, আর অভিমানিনীর মুখটি এতটুকু ভার হলে যেন নিজে চোর হয়ে থাকতো, কাটা হয়ে থাকতো, মা পাছে তার বৌয়ের সূক্ষ্ম সুকুমার অনুভূতির মর্মটি বুঝতে পেরে ভোঁতা কোনো কথা বলে বসেন!

শোভনের জীবনে বৌয়ের প্রসন্নতা ছাড়া আর কিছু চাইবার আছে তা মনে হতো না। শোভনের হৃদয়ে বৌ ছাড়া আর কোনো কিছুর ঠাই আছে কি না ভাবতে হতো।

পারুল আবার লেখে, ভাবতাম অন্যদিকে যা হোক তা হোক, এই হচ্ছে প্রকৃত বিয়ে। একটা ভালবাসার বিয়ের সুখময় দাম্পত্যজীবনের দর্শক হয়েছি আমি, এ ভেবে আনন্দ বোধ হত।…দেখেছি আমাদের মায়ের জীবন, দেখেছি নিজেদের আর সমসাময়িকদের। কেউ ফাঁকিটা মেনে নিতে না পেরে যন্ত্রণায় ছটফটিয়েছে, কেউ ফাঁকির সঙ্গেই আপোস করে ঠাট বজায় রেখে চালিয়েছে।…তবে সত্য বলে কি কোথাও কিছু ছিল না? তা কি হয়? কি জানি! আমার ভাই-ভাজেদের তো দেখেছি, মনে তো হয়নি এরা ফকির বোঝা বয়ে মরছে! বাইরে থেকে কি বোঝা যায়? মোহনের কথা মনে পড়তে থাকে।

বহুকাল আসেনি ছেলেটা, সেই নাসিকে বদলি হবার পর থেকে আর এদিকে আসেনি। মনে তো হয় সুখী সমৃদ্ধ জীবনের স্বাদে ভরপুর হয়ে দিন কাটাচ্ছে সে। তাই পরিত্যক্ত আত্মীয়স্বজনদের একটা চিঠি লিখে উদ্দেশ করতেও মনে থাকে না। কিন্তু কে জানে-মোহনের জীবনেও তলে তলে কোথাও ভাঙন ধরবে কিনা!

ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তো বাইরে থেকে কিছুই ধরা পড়ে না।

মোহনের জন্যে হঠাৎ ভারী মন কেমন করে উঠল। হয়তো শোভনের ব্যর্থ বিধ্বস্ত মুখোনাই মনটাকে উদ্বেল করে তুলেছে। রেখার জন্যেও খুব মন কেমন করে উঠেছে।

কতবার মনে হয়েছে, আমি কি রেখার কাছে যাবো? তাকে বলবো–কিন্তু কী বলবে ভেবে পায়নি পারুল। ওদের জীবনের ভার ওদেরই বহন করতে হবে। আর কারো কোনো ভূমিকা নেই সেখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *