৩২. এ এক আশ্চর্য সকাল

এ এক আশ্চর্য সকাল!

যেন এই সকালের আকাশের কোন লুকনো পৃষ্ঠপটে নিথর হয়ে আছে অনেক রহস্য, অনেক আনন্দ, অনেক ভয়। সেই রহস্য আস্তে আস্তে উন্মোচিত হবে, সেই আনন্দ ধীরে ধীরে প্রসন্ন হাসি হাসবে, অথচ সেই ভয়মুঠোয় চেপে রাখরে সমস্ত সত্তাকে। তাই উচ্ছ্বসিত হতে বাধবে, উল্লসিত হতে বাধবে যতটা জুটছে তার সবটা গ্রহণ করতে বাধবে।

এই আশ্চর্য নতুন সকাল সেই অজানিতের ইশারা নিয়ে তাকিয়ে রইল সত্যবতীর মুখোমুখি।

সত্যবতী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। ভাবল, আকাশটা কি রকম অন্যরকম!

অথচ সত্য যে এইমাত্র এই স্বপ্ন-শহরের মাটিতে পা ফেলল, আর তার আকাশে চোখ মেলল তাও নয়। গতকাল বিকেলে এসে উঠেছে সে পাথুরেঘাটার এই একতলা বাসাবাড়িটায়।

তবু ভোর সকালে ঘুম ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ খানিকক্ষণ দাওয়ায় দাঁড়িয়ে রইল সত্য বিমূঢ়ের মত।

মনে পড়ল না, ঠিক এই মূহুর্তে ওর কোন কাজ আছে।

যে জীবনটা অভ্যস্ত ছিল, তার কাজগুলো যেন নিজেরাই সজীব হয়ে পর পর সামনে এসে দাঁড়াত, কিন্তু চিরপরিচিত গণ্ডির সেই নিত্য কাজগুলো ঝাঁপসা হয়ে গেছে। এলোকেশীর হাতের কাটা খাল দিয়ে আর ডোঙা ভাসবে না সত্যর। এবার সত্যকে নিজে হাতে খাল কাটতে হবে।

.

কোথায় যেন ভোরের পাখীরা ডাকছিল, সত্যর মনে হল ওরা আর কি নিত্যেনন্দপুর থেকে উড়ে উড়ে সত্যর সন্ধান করতে এসেছে, না বারুইপুরের কোন এক অজানা গাছের ডালে বসে সত্যকে ডাক দিচ্ছে! বলছে, সত্য, তুমি ভুল করতে বসেছ! দ্যাখ বিবেচনা কর, এখনও হয়তো সময় আছে ফেরবার!

সত্য কি সত্যই ভুল করল?

নইলে বুকের ভেতরটায় এমন ভয়-ভয় করছে কেন? কেন নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছে?

দাঁড়িয়ে থাকতে বল পাচ্ছে না সত্য, তাই বসে পড়ল দাওয়ার ধারে। ভাবল হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে এসে বোধ হয় মাথাটা হালকা লাগছে। একটুক্ষণ বসে নিয়ে স্নান করতে গেলেই হবে। আজকের দিনটা পর্যন্ত ইচ্ছেমত, কাল থেকে নবকুমার কাজে লাগবে।

পাড়াগাঁয়ের কাছারী-বাড়ি’র চাকরি নয়, এ একেবার কলকাতা শহরের অফিসের চাকরি। ভাত দিতে এক পলক এদিক ওদিক করলে চলবে না। সত্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে এলোকেশীর এক বান্ধবী অবহিত করিয়ে দিয়েছিলেন, বুঝবেন ঠ্যালা! স্বাধীন সংসার করার মজা বুঝবেন! আপিসের ভাত যে কী বউ জানেন না তো! দেখে এসেছিলাম সেবার কালীঘাটে আমার পিসতুতো ভায়েদের বাড়ি গিয়ে। একটা মানুষের ভাত যোগাতে তিন-তিনটে বৌ হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। তোমার বৌ অবিশ্যি করিকম্মা, তবে শাশুড়ী-ননদের তলায় তলায় কাজ, আর এক হাতে হরিদ্বার গঙ্গাসাগর’– অনেক তফাৎ!

এলোকেশী বলেছিলেন, পারবে। বুকের পাটার জোরেই পারবে। তবে খোয়ার হতে আমার ছেলেটারই হবে। বাছা আমার জগতের কিছু জানে না, তাকে গলায় গামছা বেঁধে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে জুততে গেল। যাক–ভগবান দেখছেন!

বান্ধবী বলেছিলেন, তা তো সত্যি। যে অন্যায় পথে সুখ করতে যাবে, তার বিচার ভগবান অবিশ্যিই করবেন সংসার করা মানে তো আর মাছের ল্যাজা ভাত খাওয়া নয়, তার অনেক হ্যাঁপা। কথাতেই আছে–একলা ঘরে চতুর্ভুজে খেতে বড় সুখ, মারতে এলে ধরতে নেই ওইটাই যা দুখ।

এর পর আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল, ঠ্যালা বুঝলেই নবুর বৌ পালিয়ে আসতে পথ পাবেন না!

সত্য সেদিন মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল। কিন্তু আজ সত্য একটু যেন ভয় পাচ্ছে। ভাবছে এই শহরকে আমি বুঝতে পারব তো? আপনার করতে পারব তো? এ শহর আমাকে “আয়” বলে কাছে টানবে তো? এখানে আমাকে নিষ্পরের মত, বেচারীর মত, থাকতে হবে না তো?

না আপিসের ভাত’কে ভয় সত্যর, ভয় করে না একা হাত’কে। সত্যর ভয় অপরিচয়ের ভয়।…

মা!

বড় থোকা তুড়ু এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। নীলাম্বর নাম দিয়েছিলেন তুড়ুক সোয়ার, সেই থেকে তুড়ু। ভাল নাম সাধন। প্রথম সন্তানটি নষ্ট হয়ে গেছে, তাই এটি সাধনার ধন। অতএব সেই ঘেঁষা নাম।

তুড়ুর ফোলা ফোলা চোখে অগাধ বিস্ময়।

সত্য তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে বলে, উঠে পড়েছিস! ভাই ওঠে নি?

না।

আর তোদের বাবা?

না।

তা উঠবেন কেন? আয়েসটি যে নবাবী! কাল থেকে বুঝবেন মজা!

আলিস্যি ভেঙে উঠে দাঁড়ায় সত্য।

কী বোকার মত বসেছিল এতক্ষণ! কী ভাবছিল আবোলতাবোল! নতুন জায়গায় সব ব্যবস্থা করে নিতে কম তো দেরি হবে না!

গতকাল সন্ধ্যায় রান্না হয় নি।

ভবতোষ মাস্টার ঘর-দোর দেখিয়ে-শুনিয়ে ওদের সরিয়ে রেখে বলেছিলেন, তুমি তা হলে এদের সামলে-সুমলে নিয়ে বসো নবকুমার, বৌমাকে বলো বেলা থাকতে প্রদীপ জ্বালাবার ব্যবস্থা করে ফেলতে, নতুন জায়গা। আমি তোমাদের জন্যে কিছু খাবার নিয়ে আসছি। এখন আর রান্নাবান্নায় কাজ নেই

সত্য ঘরের ভিতর থেকে দরজার শিকল নেড়েছিল।

নবকুমার সেদিক থেকে ঘুরে এসে হাত কচলে বলেছিল, আপনি আবার বৃথা কষ্ট করবেন কেন? ইয়ে মানে–যাহোক করে দুটো ভাত ফুটিয়ে নেবে অখন।

ভবতোষ মাস্টার একবার সেই দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে সরাসরি অন্তরালবর্তিনীকেই উদ্দেশ করে বলে উঠেছিলেন, যাহোক করে করতেও অনেক ল্যাঠা বৌমা, কাল সকাল থেকেই একেবারে নতুন করে পত্তন করো। কাল আমি একটা বাসনমাজার ঠিকে-ঝি যোগাড় করে নিয়ে আসব। আজ বাজার থেকে পুরী-তরকারি মিষ্টি এনে….

নবকুমার হঠাৎ বলে উঠেছিল, বাজারের পুরী-তরকারি? কলকাতায় পা দিতে দিতেই ভাতটা খোয়াব?

হেসে উঠেছিলেন ভবতোষ মাস্টার।

বলেছিলেন, নাঃ, তুমি একেবারে মান্ধাতার আমলেই আছ নবকুমার! জাতটা খোয়াচ্ছ কিসে? আমি কি ম্লেচ্ছ হোটেলের খানা এনে খাওয়াতে চাইছি তোমায়? দেশে তোমরা ময়রার ঘরের জিলিপি মেঠাই ফুলুরি বেগুনি খাও না? এও সেই ময়রার দোকানের।

নবকুমার মাথা চুলকেছিল…।

ইয়ে মানে, ওই তরকারি-টরকারি বলছিলেন তাই বলছি। একটা দিনের জন্যে কেন আর…

ভবতোষ মাস্টার জোর দিয়ে বলেছিলেন, শুধু একটা দিন কেন, এমন অনেক দিনই হতে পারে নবকুমার। বৌমা একা মানুষ। শরীর-অশরীর আছে। কোনদিন যদি ভাতের হাঁড়ি নামাতে না পারলে! তা ছাড়া জলখাবার বলে কথা আছে। কলকাতায় এত হরেক খাবার, খাবে না ছেলেপুলে? তোমায় তো আমি দোকানের ভাত খেতে বলছি না। তবে যদি বৌমার তেমন আপত্তি থাকে…

আর একবার শেকল নড়ে উঠেছিল।

নবকুমার ঘুরে এসে বলেছিল, না, ইয়ে মানে ওদিকে আপত্তির কিছু নেই। বলছে, আপনি যা বলবেন তাই শিরোধার্য। আপনি হিতৈষী বন্ধু গুরু। আপনার…

হয়েছে হয়েছে। অত ভাল ভাল কথা বেশী খরচ করবার দরকার নেই নবকুমার। তোমরা খেয়েদেয়ে একটু সুস্থ হও, আমি দেখে বাসায় যাই।

নিজের পয়সায় একরাশ খাবার এনেছিলেন ভবতোষ মাস্টার। পুরী তরকারি চমচম রাবড়ি। সাজা পানও এনেছিলেন। বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল ছোট ছেলে দুটো। কী সোনার দেশে এল তারা!

নিতাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু এদের সঙ্গে একসঙ্গে এসে উঠতে পারে নি নিতাই। কদিন পরে আসবে। রাত্রে তাই একবার প্রস্তাব করেছিলেন ভবতোষ, একা ভয় পাবে না তো নবকুমার? নতুন জায়গা। বল তো যে কদিন না নিতাই আসে, রাতে আমি তোমাদের পাহারা দিই?

নবকুমার হাতে চাঁদ পাচ্ছিল।

কিন্তু সে চাঁদ মুঠোয় পেতে দিল না সত্য। শেকল নেড়ে জানাল, মাস্টার মশাইয়ের কষ্ট পাবার দরকার নেই, দরজার হুড়কো লাগিয়ে বেশ থাকবে তারা।

ভবতোষ চলে গিয়েছিলেন।

আর চলে যাবার পর সত্যকে এক হাত নিয়েছিল নবকুমার। চিরকাল যেটা বলে সেটা বলেই বসেছিল।

সব তাতেই দুঃসাহস প্রকাশ! ভগবান যে কেন তোমাকে বেটাছেলে না করে মেয়েছেলে গড়েছিল তাই ভাবি!

সত্যর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে নি। সত্য হেসে ফেলেছিল। গলা খুলে। নিজের এই খোলা হাসির শব্দ নিজের কানেই অপরিচিত ঠেকেছিল সত্যর।

তবু খোলা গলাতেই বলেছিল, ভাববার কি আছে? তোমাকে ভগবান বেটাছেলে করে গড়েছে। অপরের পিত্যেশ করলে চলবে কেন? বারো মাস তো অপরে করবে না? তবে? গোড়া থেকেই মনের জোর করে পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করা উচিত।

সন্ধ্যার অন্ধকারে মিটমিটে প্রদীপের ছায়ায় এ বল খুঁজে পেয়েছিল সত্য, আর সকালের হীরে ঝকঝকে আলোয় দুর্বল হয়ে পড়বে?

না, পড়বে না। সত্য আঁচল কোমরে জড়িয়ে নেমে পড়েছে কাজে। নেমে পড়ল নতুন জীবনসংগ্রামে।

এ সংসার সত্যর নিজের। নিজের ছাঁচে, নিজের ভাবে, নিজের স্বপ্নে একে গড়ে তুলবে সত্য।

.

ভবতোষ বাসার ঘরদোর সব ধুইয়ে মুছিয়ে রান্নাঘরে উনুন পাতিয়ে রেখেছিলেন। আনিয়ে রেখেছিলেন ঘুঁটে কয়লা। কাল নবকুমারের মাধ্যমে কয়লার উনুন জ্বালার পদ্ধতিটাও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন সত্যকে। সেই পদ্ধতিতে উনুনে আগুন দিতে দিতে হঠাৎ ভারি অবাক লাগল সত্যর। যেভাবে ইচ্ছে কাজ করতে পারে সত্য, কেউ কোথাও চোখ দেবার নেই, ছল ধরবার কি খুঁত ধরবার নেই। এ কী অদ্ভুত অনুভূতি।

এ কী অপূর্ব সুখ!

এই সুখটার ধারণা নিয়েই তো মুক্তির লড়াই করে নি সত্য। ও শুধু চেয়েছিল তেমন দেশে চলে আসতে, যেখানে রোগে ডাক্তার আছে, ছেলেদের জন্য ভাল ইস্কুল আছে, পুরুষদের জন্যে কাজ আছে।

নিজের জন্যে ভাল কি আছে, সে কথা ভেবে দেখে নি সত্য। শুধু জেনেছিল নিন্দে আছে, ধিক্কার আছে। এখন দেখছে আরো অনেক আছে। স্বাধীনতার সুখ মানে তা হলে এই? মাথার ওপর সর্বদা উদ্যত খাড়ার বদলে অনেক উঁচুতে আলো-ঝকঝক আকাশ থাকা?

শহরের মেয়েরা যে কেন বিদ্যেয়-বুদ্ধিতে অনেক উঁচু, তার মানে বুঝতে পারে সত্য। যারা এত পাচ্ছে, তারা তার প্রতিদান দেবে বৈকি!

হঠাৎ একটু স্তব্ধ হয়ে গেল সত্য।

সেও তো অনেক পাবে, তার বদলে দিতে পারবে তো কিছু!

রান্নাঘর থেকে বেরোতে গিয়ে থতমত খেয়ে ফের ঘরে ঢুকে পড়তে হল সত্যকে! ভবতোষ উঠোনে দাঁড়িয়ে। উঠোন বলতে সত্যর পরিচিত জিনিস নয়। শানবাঁধানো চারচৌকো খানিকটা জায়গা মাত্র। পাড়াগাঁয়ে একে চাতাল বলে।

সে যাই হোক, ভবতোষ সেখানে দাঁড়িয়ে গলাখাকারি দিলেন, তারপর বললেন, নবকুমার আছ নাকি?

বাবা ঘুমুচ্ছে।

সাড়া দিল খোকা।

ভবতোষ গলা চড়ালেন, এখনো ঘুমুচ্ছে? কাল থেকে যে দশটায় অফিস যেতে হবে। আমি এই একজন লোক ঠিক করে আনলাম, মেয়েলোক। খোকা, তোমার মাকে তা হলে বল, কথাবার্তা কয়ে নিতে। আমি অবশ্য মোটামুটি বলে নিয়ে এসেছি। বাসন মাজা, ঘর মোছা, ছাড়া কাপড় কাঁচা, কয়লা ভাঙা, উনুন ধরানো, মশলা পেষা এইসব করতে হবে। মাইনে মাসে বারো আনা, জলপানি চার আনা। তবে মাথায় মাখতে তেল একটু দিতে হবে। চান না করলে তো আর মশলা পেশা চলবে !

নবকুমারের সাড়া পাওয়া যায় না। ঘরের মধ্যে বিঘল সত্য এই সকালেও ঘামতে থাকে।

সব কাজই যদি ঝি করবে, সত্য তা হলে কী করবে?

শুধু বাসন মাজার জন্যেই হলে তো হত।

ভবতোষ সঙ্গের স্ত্রীলোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কই গো বাছা, এগিয়ে এস। ওই ওদিকে মা রয়েছেন, তার সঙ্গেই বলা-কওয়া করে নাও। এখন থেকেই লেগে যাও তা হলে। এই তো রাতের শকড়ি ঘটিবাটি পড়ে রয়েছে।

আর বেশীক্ষণ লজ্জাবতীর ভূমিকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখা সম্ভব হল না সত্যর। মাথায় কাপড়টা টেনে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে নম্র গলায় বলে ফেলল, এত সবের জন্যে বলার দরকার ছিল না। ঘরের কাজ নিজেই চালিয়ে নিতে পারব–

ভবতোষ প্রথমটা একটু থতমত খেলেন, কারণ সত্য এসে কথা বলবে, আশা করেন নি। তারপর সামলে উঠে বললেন, কেন? লোক যেক্ষেত্রে রাখাই হচ্ছে, সবই করবে। এমনিতে শুধু বাসন মাজলেও তো আট আনার কম রাজী হচ্ছে না। আর গণ্ডা চারেক পয়সা দিলেই

পয়সার জন্যে না– সত্য এবার প্রায় স্পষ্ট গলায় বলে ওঠে, নিজের অব্যেস খারাপের জন্যে বলছি। সব কাজ লোক দিয়ে করালে আয়েস এসে যাবে। সময়ই বা কাটবে কিসে?

ভবতোষ মিনিটখানেক হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে এ সময়টুকু লেগে যায় তার।

শ্বশুরবাড়িতে খেটে খেটে হাড়কালিকরা কোন মেয়ে যে বাসায় এসে “আয়েস” করতে চায় না, এ তাঁর অভিনব মনে হল। ছাত্র নবকুমারের স্ত্রীটি সম্পর্কে অবশ্য তিনি বরাবরই একটু সমীহ ভাবাপন্ন, তবু আজ যেন তার সম্পর্কে আরও বেশি অবহিত হলেন।

হয়তো বা কিঞ্চিৎ অভিভূতও।

তার পর ধীরস্বরে বললেন, মেয়েছেলেদের জন্যে আরো অনেক ভাল ভাল কাজ আছে বৌমা, তাতেও সময় কাটবে। তা ছাড়া অবকাশকাল ঘরে বসে বসে লেখাপড়ার চর্চা করলেও

কথা শেষ হল না, নবকুমার বেরিয়ে এল ঘর থেকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে। তটস্থ হয়ে বলল, মাস্টার মশাই আবার সক্কালবেলাই কষ্ট করে

না, কষ্ট আর কি! এই কাজের লোক ঠিক করে আনলাম। দেখিয়ে শুনিয়ে দাও একে। এবার একটা গোয়ালা ঠিক করে দিতে পারলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যায়।

আপনি আর কত কষ্ট করবেন? সত্য বলে ওঠে।

আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে নবকুমার।

দরজার শেকল নাড়া পর্যায়টা কখন পার হল? এভাবে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা! অবাক কাণ্ড!

ভবতোষ বলেন, আমাকে যদি তোমরা পর ভাবো নবকুমার, তবেই কুণ্ঠা বোধ করবে। আমি কিন্তু তোমাদের পর ভাবছি না।

না না, সে কি? পর মানে?

নবকুমার কথার খেই হারায়। এবং বোধ করি আপনি ভাবার প্রমাণ দেখাতেই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আমি তো এই ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে হাটটা ঘুরে আসি। কোন্ কোন্ বারে হাট বসে এখানে?

ভবতোষ হাসেন।

বলেন, কলকাতায় রোজই হাট।

ও! প্রত্যেক দিন বাজার বসে?

তা বসে। একটা নয়, অনেক বাজার। তা আজ আর তোমাকে যেতে হবে না, আমিই ব্যবস্থা করছি। তুমি বরং বাড়ির কাজে, মানে কি সুবিধে অসুবিধে–

বাড়ির কাজে কিছু আটকাবে না–, সত্যর ধীর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়। তার পর ঘরের মধ্যে থেকে একটা ধামা বার করে এনে নবকুমারের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় সত্য।

.

এমনি করেই আরম্ভ হয় সত্যর শহরে সংসার।

নিজের সংসার।

কদিন পরে নিতাই আসে।

নবকুমার বলে, ওকে আর তোমার লজ্জা করলে চলবে না। একসঙ্গে থাকা, ভাইয়ের মত, বাড়িতে আর দ্বিতীয় মেয়েছেলে নেই, ভাত বেড়ে দেবে তুমি

সত্য মৃদ্যু হেসে বলে, অত বলবার কি আছে? আমাকে কি তোমার খুব লজ্জাবতী মনে হয়?

আহাহা, ইয়ে তা নয়। মানে লজ্জা আর কোথা? মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গেই তো তুমি দিব্যি কথা চালাচ্ছ… বুঝলি নিতাই, প্রথম দিন আমি তো তাজ্জব! যদি ভাগ্যিস মা নেই সামনে। খুব সাহসী, বুঝলি? মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আমারই তো–

নিতাই এক নজর সত্যর দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে, বৌঠানকে এতদিন দেখেও চিনতে পারলে না নব? তোমার আমার মাটি দিয়ে গড়া উনি নন। তোমার অনেক ভাগ্য তাই..

হঠাৎ ওদের চমকে দিয়ে হেসে ওঠে সত্য, নাও, নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে এখন দুই বন্ধুতে ভাগ্যবিচার শুরু হয়ে গেল! আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমিই বল, মাস্টার মানে হল গিয়ে গুরু, কেমন কিনা? তা গুরুকে লজ্জা করলে চলবে কেন? ভক্তি করব, ছেদ্দা করব, মান্য করব, ভয়-লজ্জা করব কেন? আমি তো ওনার কাছে ইংরিজি পড়ব ঠিক করেছি।

কী বললে?

নবকুমার জ্যা-মুক্ত ধনুকের মত ছিটকে ওঠে, কি শিখবে?

বললাম তো।

পাগলামি করো না। বেশী বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। যা রয় সয় তাই ভাল। কলকেতায় এসেছ, বাসার সংসার করছ, এ পর্যন্ত একরকম, তা বলে

তা ইংরিজি শিখব বলেছি বৈ তো গাউন পরে হোটেলে খানা খেতে যাব বলি নি? কৌতুকের হাসিতে জোড়া ভুরু নেচে ওঠে সত্যর, উফুল মুখ লাল হয়ে ওঠে, নিতাইয়ের দিকে সরাসরি তাকিয়েই বলে, তোমার বন্ধুর সবতাতেই ভয়! ঘরে বসে বসে বই পড়ে যদি একটু জ্ঞান-বিদ্যে অর্জন করা যায়, তাতে দোষটা কি বল তো? নাকি মেলেচ্ছ অক্ষর ছুঁলেও জাত যাবে?

নবকুমার গম্ভীরভাবে বলে, তা একরকম তাই বৈকি। যতই হোক হিন্দুর মেয়ে!

আর নিজে হিন্দুর ছেলে নও?

বেটাছেলের কথা আলাদা।

আলাদার কিছু নেই। ধর্মের কাছে সব সমান। আর যদি জাত যাওয়ার কথাই বল– আর একবার কৌতুকের আলো ফুটে ওঠে সত্যর মুখে, সে তা হলে অনেক দিনই গেছে।

অ্যাঁ!

অ্যাঁ!

যুগপৎ দুই বন্ধুরই মুখবিবর হাঁ হয়েই থেকে যায় বুজতে ভুলে।

সত্য মৃদু মৃদু হাসতেই থাকে।

একটু চৈতন্য লাভ করে নবকুমার বলে, ইংরিজি পড়েছ তুমি?

সামান্য সামান্য। নিজের চেষ্টায় যা হয়। তোমার বই দুটো তো ছিল ঘরে।

তাজ্জব!

নিতাইয়ের কণ্ঠ থেকে শুধু এইটুকু স্বর নির্গত হয়।

কিগো ঠাকুরপো, আমার হাতে চলবে তো? নাকি জাত যাওয়ার হাতে খাবে না?

কথা নেই বার্তা নেই সহসা নিতাই এক হাস্যকর কাজ করে বসে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সত্যর পায়ের কাছে সাষ্টাঙ্গে এক প্রণাম করে।

সত্য অবশ্য এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। দু পা পিছিয়ে যায়। তারপর ধীরস্বরে বলে, যাক ঠাকুরপো, গুরুজন বলে মানলে তাহলে? বেশ। নাও এবার বাধ্যতা কর। তোমার তো এখনো দুদিন ছুটি, চান করে খেয়ে ভাইপোদের নিয়ে ইস্কুলে ভর্তি করতে যাও দিকিন। কদিন এসেছে, কেবল খেয়ে খেলিয়ে বেড়াচ্ছে। যার জন্যে এত কাণ্ড করে কলকাতায় আসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *