৩১-৩৫. সৈয়দ সাহেব

সৈয়দ সাহেব যেদিন সালেহাকে বরিহাটী হইতে লইয়া আসেন, সেদিন আবদুল্লাহ্ অন্তরে অন্তরে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হইলেও মুখে কোনো কথাই কহে নাই। সালেহা যখন বিদায়ের জন্য কদমবুসি করিয়াছিল, তখন আবদুল্লাহ হতভম্বের মতো দাঁড়াইয়াই ছিল। সালেহা একবার সজল করুণ-দৃষ্টি তুলিয়া আবদুল্লাহর মুখপানে চাহিতেই আবদুল্লাহর চোখ দুটি ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল। গও বাহিয়া দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়াইয়া পড়িয়াছিল। সালেহা তাহা দেখিয়া আর সেখানে দাঁড়াইতে পারে নাই। ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। একটু পরেই নিজেকে কঞ্চিৎ শান্ত করিয়া সে আবার সেই ঘরে ঢুকিয়াছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ্ তখন বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। কাজেই আর সাক্ষাতের সুবিণ হয় নাই।

এই করুণ বিদায়ে সালেহার বুকের ভিতরটায় যেন একবার কাপিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু সে-কম্পন আসন্ন বিরহের ব্যথার কম্পন নহে। তাহার অপেক্ষাও গভীর অজ্ঞাত অকল্যাণের একটা আতঙ্ক-কম্পন। স্বতঃই তাহার মনে হইয়াছিল, কোথায় কী যেন বাকি রহিয়া গেল। কী যেন প্রাণের বস্তুকে এইখানেই বিসর্জন দিয়া গেল। বরিহাটীতে কিছুদিন একসঙ্গে বাস করার ফলে সালেহা যেন একটু বদলিয়া গিয়াছিল। পিতার আদেশ অমান্য করার মতো শিক্ষা বা মন তাহার ছিল না; তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাহাকে পিতার অনুবর্তিনী হইতে হইয়াছিল।

যাহা হউক, ১০০ টাকা বেতনে হেডমাস্টার হওয়ার সংবাদ পাইয়া আবদুল্লাহ্ মনে মনে ঠিক করিয়া ফেলিল যে, রসুলপুর পৌঁছিয়াই সে সালেহাকে তথায় আনিয়া তাহার মনোমতো করিয়া শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিবে। বরিহাটীতে সালেহার কথাবার্তায় এবং চলাফেরায় আবদুল্লাহর বেশ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, হয়তো শিক্ষা দিলে সালেহা তাহা গ্রহণ করিতে পারিবে।

স্কুলের কাজকর্ম ভালোরূপে বুঝিয়া পড়িয়া লইয়া আবদুল্লাহ্ এ সম্বন্ধে মীর সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আগামী বড়দিনের বন্ধে সালেহাকে লইয়া আসাই সাব্যস্ত করিয়া ফেলিল।

আবদুল্লাহর মা মীর সাহেবের বাড়িতে থাকিতে কখনই রাজি হইলেন না, কারণ মীর সাহেব সুদের সংস্রবে আছেন। অতএব সাব্যস্ত হইল যে মীর সাহেবের একটি রায়তের। বাড়ির সীমানায় বিঘাখানেক জমি আবদুল্লাহকে দেওয়া হইবে। শীঘ্রই সেখানে ঘর-দরজা তৈয়ার করিয়া একটি ছোট বাসা নির্মিত হইল।

মায়ের অনুমতি ব্যতিরেকে কিছুই করা উচিত হইবে না, তাই স্কুল বন্ধ হইবার দিনই সন্ধ্যায় রওয়ানা হইয়া পরদিন দ্বিপ্রহরে আবদুল্লাহ আসিয়া পীরগঞ্জে পৌঁছিল। পুত্র বি-এ পাস। করিয়া এখন ১০০ টাকা বেতনের চাকরি পাইয়াছে, ভবিষ্যতে ৪০০-৫০০ টাকা বেতনের আশা আছে। আজ আবদুল্লাহ্ বাড়ি পৌঁছায় তার মুখচন্দ্রের পানে চাহিয়া আবদুল্লাহর মার প্রাণ আহ্লাদে নাচিয়া উঠিল, তার বুক গর্বে ও আনন্দে স্ফীত হইয়া উঠিল। আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেও বুঝি কোনো মানুষের এতখানি হয় না। আজীবন অভাব-অনটনে কাটিয়াছে। কত সাধ, কত আশা অঙ্কুরেই শেষ হইয়াছে। শৈশবের, কৈশোরের, যৌবনের কত অপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি জ্বলন্ত চিত্র চকিতে তাহার মানসপটে ফুটিয়া উঠিয়া সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর কথা মনে পড়িল। তার আজিকার এই আনন্দের অংশীদার কোথায় কোন অজানা দেশে চলিয়া গিয়াছেন। ভাগ লইতে আসিতেছেন না। আবদুল্লাহর জননীর দুই চোখ ছাপাইয়া দরূদ করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। যথাসাধ্য নিজকে সংযত করিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে তিনি কহিলেন, ভালো আছ তো বাবা, বউমাকে আর হালিমাকে নিয়ে এলে না কেন?

আবদুল্লাহ উত্তর করিল, সে পরামর্শ হবে এখন পরে।

সম্মুখে বসিয়া আদর করিয়া, আহার করাইয়া, নিজ হাতে বিছানা পাতিয়া আবদুল্লাহকে বিশ্রাম করিবার অবসর দিয়া জননী নাশতা ইত্যাদির বন্দোবস্তে লাগিয়া গেলেন।

পরদিন অপরাহ্নে আবদুল্লাহ্ মাকে বলিল, তা হলে এক কাজ করলে হয় না–চলুন না আম্মা, আপনাদিগকে রসুলপুরে নিয়ে যাই।

মা কহিলেন, তাই তো ভাবছি, তোমার সেখানে খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে, তা আমার তো যেতেই মন চায়, তবে গেলে ঘরদোর দেখবে কে, সেই কথাই ভাবছি। গেলে তো করিমনকেও নিয়ে যেতে হয়।

আবদুল্লাহ্ কহিল, সেই তো কথা, তবে যদি বলেন তো আপনাদের বউকে সেখানে নিয়ে যাই।

আবদুল্লাহর জননী কহিলেন, বউমা তো ছেলেমানুষ, একলা থাকবে কেমন করে! তবে এক কাজ করলে হয়; ওই যে গোপালের মা, ওকে বাড়ি রেখে গেলে ও দেখাশুনা করবে।

শেষ এই কথাই সাব্যস্ত হইল।

যথাসময় মাতাসহ একবালপুর পৌঁছিয়া সালেহা ও হালিমাকে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করা হইল।

সৈয়দ সাহেব হালিমার যাওয়া সম্বন্ধে বিশেষ কিছু আপত্তি করিলেন না, তাহার প্রথম কারণ হালিমা অন্য বংশের মেয়ে। দ্বিতীয় কারণ আবদুল কাদেরকে তো তিনি ভালো করিয়াই জানিতেন। হয়তো শেষ পর্যন্ত আবদুল কাদের তাহার মর্যাদা রক্ষা করিবে না। কিন্তু সালেহার সম্বন্ধে তিনি ঘোর আপত্তি করিয়া বসিলেন। প্রথম কারণ সৈয়দ সাহেব মীর সাহেবের সংস্রবে আসাটা শুধু অপমানজনক নয়, ধর্মবিরুদ্ধ বলিয়া মনে করিতেন এবং আবদুল্লাহ্ এখন মীর সাহেবেরই একজন ভক্ত এবং সদাসর্বদা মীরের সঙ্গে ওঠা-বসা, মীরের পরামর্শে সব কাজকর্ম করিয়া থাকে। সৈয়দ সাহেবের আন্তরিক বিশ্বাস যে মীর সাহেব মুসলমান হইতে খারিজ হইয়াছেন এবং শরীফ ঘরের মুসলমানদের উচিত অন্ততপক্ষে তার সঙ্গে তরুকে মাওয়ালাত (নন্-কো-অপারেশন) করা।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা বাদ মগরেব আবদুল্লাহকে ডাকিয়া লইয়া সৈয়দ সাহেব বেশ গম্ভীরভাবে বলিলেন, বস বাবা। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সৈয়দ সাহেব বলিলেন, তা বাবা, আমি একটা খোলাসা কথা বলব। তোমরা যে যাই বল না কেন আমি ওসব কারবারে নেই। আমি সালেহাকে রসুলপুর যেতে দেব না। ওর আখেরাতের দিকে আমার তো দেখা চাই। তোমরা সব আজকাল শরা-শরীয়ত একদম উড়িয়ে দিয়েছ। হারাম-হালাল মান না। তা যাই হোক, সব চুলোয় যাক। ওদিকে, বাবা ওই যে মীর সাহেব লোকটার সঙ্গে তোমাদের অত মাখামাখি কেন? বলি, তোমরাও কি সুদ খাবে নাকি! আস্তাগফেউল্লাহ্, কী মুশকিলেই যে আমি পড়েছি! এইসব আমার কিসমতে ছিল! তা ছাড়া আরো একটা কথা বাবা, নিয়ে যেতে চাচ্ছ, যাবে কেমন করে? এখন তো নৌকা চলবে না।

আবদুল্লাহ্ মৃদুকণ্ঠে কহিল, ওদের রেলগাড়িতেই নিয়ে যাব। স্টেশন থেকে পালকির বন্দোবস্ত আছে, এতে কোনো কষ্ট হবে না। তা ছাড়া সময়ও লাগবে কম। সৈয়দ সাহেব রেলগাড়ির কথা শুনিয়া একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, তা বাবা সবই বলতে পার, কিন্তু আমাদের খানদানে কোনো জানানা কখনো এ পর্যন্ত রেলে চড়ে নি, আর আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন চড়তে দেবারও আমার ইচ্ছা নাই। সে হবে না বাবা, হাজার লোক স্টেশনে, তার মধ্যে দিয়ে রেলে চড়িয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে যাবে? এ কথা মুখে আনতেই যে আমাদের বাধে। তোমরা ইংরেজি শিখেছ, ইংরেজের চালচলন অনুকরণ করতে চাও। তা আমি আর কদিন! এই কটা দিন সবুর কর, পরে যা হয় কোরো।

আবদুল্লাহ্ বুঝিল কথা কাটাকাটিতে ফল হইবে না। সে রণে ভঙ্গ দিয়া বলিল, তা হলে হালিমাকে…।

সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, বউমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা, আবদুল কাদের মিয়া তো বাড়িই আছেন, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে যা হয় কর, আমি ওর মধ্যে নেই! সেবারে বরিহাটীর কত কী কাণ্ড-কারখানা, সে সবই তো সয়েছি।

আবদুল্লাহ কহিল, আবদুল কাদের সম্মত আছে। আপনার তো কোনো আপত্তি নাই?

সৈয়দ সাহেব, না, আমার আর কী আপত্তি! সে রাজি যখন তখন আমার আপত্তির কারণ কী?

মসজিদে আযানের সঙ্গে সৈয়দ সাহেব নামায পড়ার জন্য উঠিয়া পড়িলেন, আবদুল্লাহ্ পিছনে পিছনে নামায পড়িবার জন্য মসজিদে ঢুকিল।

নামায বাদ আবদুল্লাহ্ বাড়ির ভিতর গিয়া মাকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিল, মা একটু দুঃখিত হইলেন; কহিলেন, তবে কাল সকালেই হালিমাকে নিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত।

সৈয়দ সাহেব মসজিদের রোয়াকে বসিয়া আবদুল কাদেরকে বলিলেন, ওরা কবে যাচ্ছেন?

আবদুল কাদের, তা তো ঠিক জানি না।

সৈয়দ সাহের, তা হলে বউমাও যাচ্ছেন রসুলপুরে?

আবদুল কাদের, জি হ্যাঁ, তাই তো ওঁদের ইচ্ছা।

সৈয়দ সাহেব একটু উষ্ণভাবে বলিলেন, ওঁদের ইচ্ছা, তোমার কী? তোমারও ইচ্ছা না! এখন নৌকা চলে না জানা আছে তো, রেলে চড়িয়ে নিয়ে যাবে!

আবদুল কাদের, আমার তো কোনো আপত্তি নাই।

সৈয়দ সাহেব একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, বেশ।

কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ–একটু পরে সৈয়দ সাহেব দহলিজে চলিয়া গেলেন। আবদুল কাদের বাড়ির ভিতর আবদুল্লাহর কাছে সমস্ত বিষয় শুনিল।

পরদিন প্রত্যুষেই আবদুল্লাহ্ মাতা, ভগ্নী হালিমা এবং করিমনকে লইয়া রসুলপুর যাত্রা করিল।

.

৩২.

মজিলপুর একটি পুরাতন ও বিখ্যাত স্থান। এখানকার রেজিস্ট্রি আপিসটিও বেশ বড়। এখানে। বহু দলিল রেজিস্ট্রি হয়। যে সময়ের কথা বলা হইতেছে তখন সবুরেজিস্ট্রারগণ রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের সংখ্যা হিসাবে কমিশন পাইতেন। আবদুল কাদের বরিহাটী জয়েন্ট অফিসে বেশ যোগ্যতার সহিত কাজ করিয়া ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রারের সুনজর আকর্ষণ করিতে সক্ষম হইয়াছিল। এক্ষণে মজিলপুরে সব্‌রেজিস্ট্রারের পদোন্নতি হওয়ায় তিনি অন্যত্র চলিয়া গেলে আবদুল কাদের মজিলপুরে বদলি হইয়া আসিল। হালিমাও সঙ্গে আসিল। এখানে তাহার মাসিক আয়। ২৫/৩০ টাকা বাড়িয়া গেল। তা ছাড়া এখানে একটি মাদ্রাসা ছিল। একমাত্র শিক্ষার অভাবই যে সমাজের সমস্ত দুরবস্থার কারণ, ইহা আবদুল কাদের মর্মে মর্মে অনুভব করিয়াছিল। মজিলপুরে আসিয়া মাদ্রাসার সাহায্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাহার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার সুযোগ পাইবে মনে করিয়া তাহার প্রাণ হর্ষে নাচিয়া উঠিল।

আবদুল মালেকের খালাতো ভাই ফজলর রহমানের পিতা মজিলপুর মাদ্রাসার সেক্রেটারি ছিলেন। সম্প্রতি তাহার মৃত্যু হওয়ায় আবদুল কাদের মাদ্রাসার সেক্রেটারি নির্বাচিত হইল।

পীর সাহেবের দোয়া, তাবিজের বরকতে যখন ফজলু মিঞা ডিপুটিগিরির স্বপ্ন দেখিতেছিল, তখন হঠাৎ একদিন দি বেঙ্গলীতে প্রবেশনারি ডিপুটির লিস্টে ফজলু মিঞার নাম না পাইয়া ফজলু মিঞার চমক ভাঙিয়া গেল। ফজলু মিঞা দমিবার পাত্র নয়! সে ভাবিল হিন্দু কাগজওয়ালা বদমাইশি করিয়া তাহার নামটি ছাপে নাই। তারপর সে কলিকাতা গেজেটেও নাম পাওয়া গেল না। ব্যাপার কী? তবে কি পীর সাহেব দোয়া করেন নাই? না, তাও কি সম্ভব? ফজলু ছুটিয়া পীর সাহেবের খেদমতে হাজির হইল। পীর সাহেব ইতোমধ্যেই খবর পাইয়াছিলেন যে ফজলু ডিপুটি কি সব্‌ডিপুটি কিছুই হইতে পারে নাই। কদমবুসি সম্পন্ন করিয়া ফজলু একপাশে বিষণ্ণমনে বসিয়া পড়িল। পীর সাহেব কহিলেন, আয় লাড়কা আবৃ তক্ তু গাফেল হায়। ফজলুর হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল পীর সাহেব তাকে যে এশার নামাযের বাদ ১১০০০ বার একটি দোয়া পড়িতে বলিয়াছিলেন, কয়েকদিন যাবৎ সেটা ফজলু পড়িতে পারে নাই। তা ছাড়া অনেক দিনই ঘুম ভাঙিতে বিলম্ব হওয়ায় ফজরের নামাযও তার কাযা পড়িতে হইয়াছে। ফজলু মনে মনে পীর সাহেবকে সন্দেহ করিয়াছিল। তার দরুন তার মনে ভীষণ অনুশোচনা জন্মিল। সে উঠিয়া গিয়া আবেগভরে পীর সাহেবের পায়ের উপর পড়িল। সে মনে মনে আশা করিতেছিল পীর সাহেব ইচ্ছা করিলে তখনো তার চাকরির উপায় হইতে পারে।

পীর সাহেব মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, সব করুনা চাহিয়ে, আয় লাড়কা, এক শরীফজাদী বহুত হাসীন, আরো নেহায়েত নেখত; উত্সকে সাত তোমহারী শাদি মোবারক মায় ঠিক কিয়া। এই ওজর করনে কা মোকাম নেহি হায়। আগার পছন্দ হো তো মুঝসে ছেপানা নেহি। আলাওয়া ওকে জেমিদারি ভী খুব হায়। জেমিদারিসে দস্ বারা হাজার রুপায় কী আমদানি হয়।

পীর সাহেবের প্রতি ফজলুর ভক্তি অচল। পীর সাহেবের আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইয়া ফজলু যখন সত্য সত্যই এই বিবাহের জন্য বাপ-মায়ের অনুমতি লইয়া আসিল, তখন বিবাহে আর কোনো বাধাই রহিল না। যথাসময়ে শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। ফজলু মিয়ার এখন আর্থিক কোনো কষ্টই রহিল না। পীর সাহেবের মেহেরবানিতে খাওয়া-পরার ভাবনা পার হইয়া ফজলু দশগুণ উৎসাহে পীরের খেদমতে নিযুক্ত হইল। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, দোয়া দরুদ, মহফেলে-মৌলুদ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কোনো ত্রুটি নাই। যাকাতের হিসাবের জন্য একজন মুহুরিই নিযুক্ত হইয়া গেল। এসব বিষয়ে কোনো দিকে ত্রুটি রহিল না বটে কিন্তু আদায়পত্র ইত্যাদি সমস্তই কর্মচারীদের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হইল।

কয়েক মাস পরের কথা। পিতৃবিয়োগের সংবাদ পাইয়া ফজলু মিঞা সস্ত্রীক পিতার ফাতেহার জন্য বাড়ি আসিয়াছে। এই উপলক্ষে পীর সাহেবকেও দাওয়াদ করা হইয়াছিল। আবদুল কাদেরকে দাওয়াদ করার জন্য যখন ফজলু মিঞা আবদুল কাদেরের বাসায় আসিয়াছিল, তখন মাদ্রাসা সম্বন্ধে তাহার সঙ্গে বহু আলাপ হইয়াছিল। আবদুল কাদের মাদ্রাসার ছাত্রদিগকে কিছু ইংরেজি, বাংলা ও অঙ্ক শিক্ষা দিবার প্রস্তাব করিলে ফজলু মিঞা একেবারে যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। সে কী কথা, তাও কি হয়! যেখানে দীনী এলেম শেখানো হয়, সেখানে এইসব দুনিয়াদারি একদম অপ্রাসঙ্গিক। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ফজলু মিঞা কহিলেন, আচ্ছা, কালই পীর সাহেব আসছেন, তার সঙ্গে একবার আলাপ। করলেই আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারবেন। ওসব খেয়াল আপনি মন থেকে দূর করে ফেলুন। এই দেখুন না হাতে হাতে। আমি একবার চাকরির জন্য মত্ত হয়ে পড়েছিলাম। অনেক সময় আমার নামায কাযা হয়েছে। এখানে দৌড়, ওখানে লাফ এইসব করে আমার যে কী সর্বনাশ হচ্ছিল, তা খোদাই জানেন। কিন্তু পীর সাহেবের শরণাপন্ন হয়ে আমার এখন কোনো চিন্তাই নাই। খোদার কাজ কল্লে খোদা রুজি জুটিয়ে দেবেই। আমি দেখুন ইংরেজি পড়তে গিয়ে কী ভুলই করেছি! আগে থেকে যদি পীর সাহেবের শরণাগত হতাম তা হলে আমার কেসমত আরো ভালো হত। যাক এখন আসি, একবার মেহেরবানি করে গরিবখানায়। তশরীফ আনবেন। ওয়ালেদ মরহুমের কথা মনে হলে আর কিছু ভালো লাগে না। তার শেষ কাজটা যাতে সুসম্পন্ন হয় তার জন্য আপনাদের পাঁচজনের সাহায্য চাচ্ছি। আশা করি নাওম্মেদ হব না।

এই লম্বা বক্তৃতা দিয়া আবদুল কাদেরকে স্তম্ভিত করিয়া যথারীতি সালাম-সম্ভাষণপূর্বক ফজলু বিদায় গ্রহণ করিল।

পরদিন মজিলপুরে মহা ধুম পড়িয়া গেল। এক প্রকাণ্ড বজরা নদীবক্ষ বাহিয়া মৃদু মন্থরগতিতে মজিলপুরের দিকে অগ্রসর হইতে দেখা গেল। প্রায় একশত লোক ঘাটে উপস্থিত।

এহেন ভাগ্য মজিলপুরের কোনোদিন ঘটিয়াছিল কি না সে সম্বন্ধে বহুবিধ আলোচনায় বাধা জন্মাইয়া যখন ঘণ্টাখানেক পরে পীর সাহেবের বজরা ঘাটে ভিড়িল তখন সমস্বরে মাহাবা মারহাবা রবে উপস্থিত জনমণ্ডলী গগনমণ্ডল মুখরিত করিয়া তুলিল।

ফজলুর পরলোকগত পিতার ফাতেহা উপলক্ষে লক্ষ্ণৌ হইতে একজন বাবুর্চি আনা হইয়াছিল। কলিকাতা হইতে কয়েকজন মেট এবং বাবুর্চির সঙ্গেও দুই জন মেট আসিয়াছিল। আশপাশের গ্রামের মধ্যে যারা পাকপ্রণালীর সঙ্গে পরিচিত ছিল ফজলু মিঞা তাদেরও আনাইয়াছিলেন। ফাতেহার দাওয়াদ আত্মীয়স্বজন যে যেখানে ছিল সকলেই পাইয়াছিল। গরিব দুঃখী সংবাদ পাইয়া যে যেখানে ছিল আসিয়া জুটিতেছিল। ফাতেহা উপলক্ষে জেয়াফত শেষ হইয়া গেলেও পীর সাহেব যে কয়দিন মজিলপুরে ছিলেন ও অঞ্চলের বহু ভক্ত নানা কাজ ফেলিয়া পীর সাহেবের সহিত কেহ দেখা করিতে, কেহ মুরীদ হইতে, কেহ পানি পড়াইয়া লইতে, কেহ তাবিজের জন্য আসিয়া গ্রামের রাস্তাঘাট ভরিয়া ফেলিয়াছিল। এমন বিরাট আয়োজন এবং এত জনকোলাহল দেখিয়া পীর সাহেবের বুজরগী সম্বন্ধে কোনো সংশয় রহিল না।

সেদিন রাত্রে পীর সাহেবের বজরায় একটু উত্তেজনার আভাস পাইয়া কয়েকজন খাদেম একটু বিচলিত হইয়া উঠিলেন। ব্যাপার কী জানিবার জন্য উদ্গ্রীব জনমণ্ডলী এ ওর মুখের দিকে তাকাইতে আরম্ভ করিলেন। পীর সাহেব ফজলু মিঞার কয়েকজন আত্মীয়াকে মুরীদ করিবার জন্য বজরা হইতে নামিয়া পালকি করিয়া ফজলু মিঞাদের বাড়ি গিয়াছিলেন। তথা হইতে এইমাত্র ফিরিয়া আসিয়াছেন। ফজলু মিঞা অদূরে মস্তক অবনত করিয়া বসিয়া আছেন। সকলে চুপ। কিছুক্ষণ পরে পীর সাহেব একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, উওহ্ সব মিস্ত্রিয়ো কা কাম হায়, শরীফোঁ কা কাম নেহী।

ফজলু মিঞা পীর সাহেবের মন্তব্য শিরোধার্য করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, জি হ্যাঁ। হুজুর, উওহ্ সব সে আখেরাত কা ফায়দা নেহী হোগা।

ব্যাপার আর কিছুই নয়, পীর সাহেব যখন ফজলু মিঞাদের বাড়িতে গিয়াছিলেন সেই সুযোগে ফজলু মিঞার সাহায্যে আবদুল কাদের পীর সাহেবের খেদমতে হাজির হইয়াছিল। যথাবিহিত কদমবুসি সম্পন্ন করিয়া আবদুল কাদের বিনয়-নম্র বচনে পীর সাহেবের খেদমতে মাদ্রাসার সংস্কারের কথা পাড়িয়াছিল। পীর সাহেব আবদুল কাদেরের প্রস্তাবে মর্মাহত হইয়া শুধু বলিলেন, ইয়ে সব দুনিয়াদারি মামলা সে হামলোগ ফারেগ রত্না চাতে হায়। মেরা খেয়াল মে মাদ্রাসা দীনী এলেম কা ওয়াস্তে হায়। আংরেজী আওর বাংলা, আওর হেসাব ইয়ে সব তো আংরেজী স্কুল মে পড় হায়ি জাতি হায়, বাচ্চা।

আবদুল কাদের বিনয়-নম্র বচনে আরজ করিল, হুজুর, লোগ সব গোরাহ্ হোতে চলা হায়। আওর জারা-সা হেসাব না জানে সে মহাজন আওর জমিনদার লোক গরিবো পর বড়া জুলুম করতে হয়। লোগ্ সব্‌ ভুকা মর্‌ রহে হ্যাঁয়। এনলোগঁ কী জেন্দেগীকে ওয়াস্তে কুছ্‌ আংরেজী আওর বাংলা আওর হেসাব জানা জরুরি হায়।

পীর সাহেব ঊর্ধ্বে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক কহিলেন, দীন ইসলাম কো আগে বাঁচানা চাহিয়ে। জেন্দেগীকে ওয়াস্তে খোদাও করিম পর তওয়াল করনা ওয়াজেব হায়! রাজ্জাক কো ভুলকে রোজীকা বন্দোবস্ত হো নেহী সান্তা। খায়ের, ইয়ে সব তার সে কুছ হী ফায়দা নেহী নেক্‌লেগা।

আবদুল কাদের রণে ভঙ্গ দিয়া পীর সাহেবের কদমবুসি সম্পন্ন করিয়া বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। পীর সাহেব বড়ই নারাজ হইয়া বজরায় চলিয়া গেলেন এবং পরদিনই মজিলপুর গ্রাম পরিত্যাগপূর্বক চলিয়া গেলেন।

পীর সাহেব চলিয়া যাওয়ার পর আবদুল কাদের একটি মিল মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য চেষ্টা করিয়াছিল। চারিদিকে ঘোর আপত্তি হওয়ায় অবশেষে মাদ্রাসার জনকতক ছাত্রকে নিয়া একটু একটু ইংরেজি শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত করিতে সক্ষম হইয়া নিজেকে ধন্য মনে করিল।

.

৩৩.

নৌকা চলে না, রেলগাড়িতে চলাফেরায় বেপরদা–এই অজুহাতেই আবদুল্লাহর শ্বশুর সালেহাকে রসুলপুরে পাঠান নাই। গ্রীষ্মের বন্ধেও নৌকা চলিবে না। কাজেই তখনো তিনি সেই অজুহাত ধরিয়া বসিবেন। অতএব আবদুল্লাহ্ স্থির করিয়া লইল গ্রীষ্মের বন্ধে একবার শ্বশুরবাড়ি যাইয়া দেখাশুনা করিয়া আসিবে। তাহার পর পূজার বন্ধে নৌকা চলাচল আরম্ভ হইলে সালেহাকে লইয়া আসিবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার্যত তাহা ঘটিয়া উঠিল না। কারণ স্কুলের লাইব্রেরির পুস্তকগুলি বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল, সেগুলিকে শৃঙ্খলামতো সাজাইতে গিয়া গ্রীষ্মের বন্ধে তাহার পক্ষে আর রসুলপুর ত্যাগ করা ঘটিয়া উঠিল না।

দিনের পর দিন কাটিতে লাগিল। পূজার বন্ধও ঘনাইয়া আসিল। এযাবৎ একবালপুরের কোনো খবর না পাওয়ায় আবদুল্লাহর মন কেমন একটি অজানা আশঙ্কায় অস্থির ও চঞ্চল হইয়া উঠিল। চিঠিপত্র লিখিয়া উত্তর পাওয়াও সহজ ব্যাপার নয়। কারণ ও-বাড়িতে এক আবদুল কাদের ভিন্ন প্রায় সকলেই দোয়াতে কলম দান ব্যাপারটাকে গর্হিত মনে না করিলেও সহজ মনে করিতে শেখে নাই। প্রায় ৬ মাস পরে ভাদ্রমাসের ৪ঠা তারিখে একখানা পত্র আসিল। কালো কালির লেখা দুঃসংবাদ আবদুল্লাহর হৃদয়ে কালো দাগ আঁকিয়া দিল। আসন্নপ্রসবা সালেহার আসন্ন মৃত্যুর সংবাদে আবদুল্লাহর হৃদয়ে শেল বিধিল।

আহার ও নিদ্রা ত্যাগ করিয়া, গরুর গাড়ির কঁকানি সহ্য করিয়া, কাদা ও বৃষ্টি তুচ্ছ করিয়া, আকাশের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করিয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া জুতা হাতে নগ্নপদে আবদুল্লাহ্ যখন একবালপুরে পৌঁছিল তখন সব শেষ হইয়া গিয়াছে। সাদা লংক্লথে মোড়া খট্টাশায়ী কাষ্ঠখণ্ডবৎ দেহখানির মস্তকাবরণ উঠাইয়া তাহাকে দেখানো হইল। সেই মুখ–কিন্তু কী পরিবর্তন! শীর্ণ পাণ্ডুর রক্তলেশ পরিশূন্য, আঁখিপল্লব নিমীলিত, ঈষদুদ্ভিন্ন অধরোষ্ঠ–কী যেন বলিতে চায়, অথচ বলিতে পারে না। আবদুল্লাহর মমতলে মৃত্যুশেল বিধিল। তাহার মুখে কথা ফুটিল না। কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে বুক-ফাটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। তাহার পর ধীরে ধীরে দাফন-ক্ষেত্রের দিকে চলিয়া গেল।

.

৩৪.

ভগ্নহৃদয় লইয়া আবদুল্লাহ্ কর্মস্থলে ফিরিল। মীর সাহেব আদ্যোপান্ত সকল সংবাদই শুনিলেন। আবদুল্লাহর মনে একটা যে বৈরাগ্যের ভাব জাগিয়া উঠিয়াছে; তাহা তিনি সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু সে-ভাবকে আদৌ তিনি প্রশ্রয় দিলেন না। নানা প্রকারে সান্ত্বনা দিয়া তিনি আবদুল্লাহকে পুনরায় কর্মক্ষেত্রের মাঝে টানিয়া আনিলেন।

আবদুল্লাহ্ মীর সাহেবের আদেশ-অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারিল না। সে আবার যথারীতি স্কুলের কার্যে মনঃসংযোগ করিল। এই সময়ে হঠাৎ একদিন একবালপুর হইতে সৈয়দ সাহেবের এক পত্র আসিয়া পৌঁছিল। পত্রে সৈয়দ সাহেব মোহরানার দাবি করিয়াছেন।

আবদুল্লাহর পিতা ওলিউল্লাহর সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে সৈয়দ সাহেব নারাজই ছিলেন। শুধু মাতার অনুরোধেই তিনি সম্মত হইয়াছিলেন। এদিকে সৈয়দ সাহেব যখন ২৫০০০ টাকা মোহরানা দাবি করিয়া বসিলেন, বড় ঘরে বিবাহ দিবার আগ্রহে আবদুল্লাহর পিতা রাজি হইয়া গেলেন। আবদুল্লাহও তখন এ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিতে পারে নাই। কারণ সাধারণত এই মোহরানা একটা অর্থশূন্য প্রথা বলিয়া বিবেচিত হয় এবং বাস্তবিকপক্ষেই যদি সৈয়দ সাহেবের অবস্থার পরিবর্তন না হইত তবে এ সম্বন্ধে তারাও যে কোনো দাবি করিতেন এরূপ মনের ভাব বোধহয় সৈয়দ সাহেবেরও ছিল না। কিন্তু নানা কারণেই সৈয়দ সাহেবের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হইয়াছিল। এমন অবস্থায় হকের দাবি ছাড়িয়া দিবেন এমন অবিবেচক বলিয়া সৈয়দ সাহেবকে দোষারোপ করা চলে না।

পিতার বর্তমানে কন্যার মৃত্যু হইয়াছে সুতরাং সম্পত্তির কোনো ভাগ কন্যাতে বর্তায় নাই। এমন অবস্থায় মোহরানার টাকার দাবি ন্যায্য দাবি। কন্যার অবর্তমানে জামাতা যে শ্বশুরকে ঠকাইবার চেষ্টা করিতে পারে এ ভয়ও সৈয়দ সাহেবের ছিল; তাই তিনি চিঠিতে জানাইয়াছিলেন যে সহজে টাকা না দিলে আদালতে নালিশ করা হইবে; তিনি হক্কের দাবি ছাড়িয়া দিতে কিছুতেই পারিবেন না। তিনি আরো লিখিয়াছিলেন যে, যদি আদালতে নালিশ করেন তবে ডিক্রি নিশ্চয়ই হইবে এবং আবদুল্লাহর মোকদ্দমা খরচ বাবদ কিছু টাকা অনর্থক দণ্ড দিতে হইবে।

এই পত্রের উত্তরে আবদুল্লাহ সবিনয়ে জানাইল যে, একসঙ্গে অত টাকা দেওয়া তার সাধ্যাতীত কিন্তু সে কিস্তি করিয়া টাকা পরিশোধ করিতে সম্মত। প্রত্যুত্তরে সৈয়দ সাহেব জানাইলেন যে, তার এত টানাটানি যে তা বলিবার নয়; টাকার বড় দরকার। সুতরাং তিনি বিলম্ব করিতে অক্ষম।

অগত্যা আবদুল্লাহ্ তাহার পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দিয়া টাকা পরিশোধের কথা ভাবিতে লাগিল! কিন্তু সম্পত্তি কী আর ছিল! দেখা গেল যে বন্ধক কেন, বিক্রি করিলেও সে অত টাকা সংগ্রহ করিতে অক্ষম। আবদুল্লাহ বড়ই বিচলিত হইয়া পড়িল।

চাকরি করিয়া আবদুল্লাহ্ মোট ১০০০ টাকা জমাইয়াছিল। অনেক চিন্তার পর সেই টাকা এবং সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক দিয়া আরো ৮০০ টাকা সগ্রহ করিয়া একত্রে ১৮০০ টাকা সে সৈয়দ সাহেবকে পাঠাইয়া দিল। কিন্তু ইহাতে সৈয়দ সাহেব একটুও সন্তুষ্ট হইলেন না।

মীর সাহেব ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলেন। মাঘ মাসের পূর্বে বাড়ি ফিরিবেন না। আবদুল্লাহ্ বড়ই চিন্তায় দিন কাটাইতে লাগিল। যাহা হউক মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহেই মীর সাহেব বাড়ি ফিরিলেন এবং সমস্ত সংবাদ জানিয়া অগত্যা তিনিই আবশ্যক টাকা কর্জ দিতে চাহিলেন। আবদুল্লাহ্ অগত্যা তাহাতেই স্বীকৃত হইল এবং বিনা দলিলে ১০০০০ টাকা কর্জ করিয়া স্বয়ং একবালপুরে গিয়া সৈয়দ সাহেবের হস্তে দিয়া আসিল। সৈয়দ সাহেব তখনই একখানা রসিদ লিখিয়া দিলেন। আবদুল্লাহ মীর সাহেবের নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে এ-কথা সৈয়দ সাহেব অবগত ছিলেন। সুদের টাকা লওয়া জায়েজ কিংবা না জায়েজ এ সম্বন্ধে তর্ক উঠিতে পারে এবং সৈয়দ সাহেব উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া জানিয়াছিলেন যে ২৫০০০ টাকা দেওয়া আবদুল্লাহর পক্ষে একেবারে অসম্ভব, সুতরাং আদালত। হয়তো অত টাকা ডিক্রি দিবে না। এতদ্ভিন্ন সংসারে আজকাল টানাটানি একটু বেশিই হইয়াছে। সৈয়দ সাহেব যা টাকা পাইলেন তাহাতেই রাজি হইয়া সম্পূর্ণ টাকার রসিদ লিখিয়া দিলেন। টাকা প্রাপ্তির পর সৈয়দ সাহেব আবদুল মালেককে ডাকিয়া আনিয়া বলিলেন, তোমার ওই ছেলেটার খানার কথাই ভাবছি। আবদুল্লাহর নিকট যে টাকাটা পাওয়া গেছে তার কিছুটা হাত-কর্জ শোধ দিতে যাবে। আর কিছু টাকা দিয়ে খাৎনার খরচটা চলে যাবে!

আবদুল মালেক মনে মনে ভাবিয়াছিল ওই টাকাটা দিয়া রসুলপুর ও মাদারগঞ্জের তালুকটার–যা ভোলানাথবাবুর নিকট বন্ধক ছিল, সেটা খালাস করিয়া লওয়া যাইবে। সে বলিল, তা আব্বাজান ধরুনগে আপনার ওই তালুক দুটো খালাস করে নেওয়া তো দরকার।

সৈয়দ সাহেব বলিলেন, বাবা, আমি আর কদ্দিন যে কদিন আছি খোদা এদের দেছেন, এদের নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করে যাই, তোমরা তো রইলে।

আবদুল মালেকের পুত্রের খান্নার দিন স্থির হইয়া গেল। খাত্না উপলক্ষে সৈয়দ সাহেব কিছু ধুমধামই করিয়া বসিলেন। তার শারীরিক অবস্থা আজকাল ভালো ছিল না। এই হয়তো তার জীবনের শেষ কাজ। সুতরাং যাতে বংশমর্যাদা বজায় থাকে এরূপভাবে লোকজনকে খাওয়াইবার ভাগ্য হয়তো তার আর জুটিবে না মনে করিয়া কয়েক গ্রামের লোককেও দাওয়াদ দিলেন এবং আত্মীয়-বন্ধু যে যেখানে ছিল সবাইকে দাওয়াদ দেওয়া হইল। বরিহাটী হইতে সওদা আনা হইল। বাবুর্চি খানসামা বাড়িতে যারা ছিল তাদের দ্বারাই পাকের বন্দোবস্ত হইল। নির্দিষ্ট দিনে বহু লোক তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করিয়া বলিল এমন খানা তারা জীবনে কখনো খায়ও নাই, খাইবেও না। অবশ্য ঠিক এই ভাবের কথা তারা এই সৈয়দ সাহেবের বাড়িতে আরো বহুবার বলিয়াছে। সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া ভোলানাথবাবু। বলিলেন, হবে না কেন? সৈয়দদের মতো বড় বংশ তো আর এ অঞ্চলে নাই। এঁরাই তো। এককালে নবাব ছিলেন।

এই উপলক্ষে আত্মীয়-বন্ধুদের সওয়ারিও আনা হইয়াছিল, সুতরাং ধুমধামের জের আরো দশ-পনের দিন চলিল। আরো কিছুদিন হয়তো চলিত–কিন্তু দেখা গেল যে টাকাগুলা কেমন করিয়া ফুরাইয়া গিয়াছে। এতগুলা টাকা কেমন করিয়া যে গেল তার হিসাবই পাওয়া গেল না। সৈয়দ সাহেব কিন্তু বলিলেন, তা বৈকি–কতই আর টাকা!

.

৩৫.

মীর সাহেবের সাহায্যে আলতাফ যথাসময়ে বি-এ ও ল পাস করিয়া বরিহাটীতে ওকালতি করিতেছে। বাদশা মিঞা এখন আলতাফের বিবাহ সম্বন্ধে বেশ একটু উৎসুক হইয়া পড়িয়াছেন। এদিকে আলতাফের মালেকার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সংবাদে বাদশা মিঞা চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। কৃতবিদ্য ছেলের পিতা হওয়া যেমন গৌরবের তেমন দায়িত্বপূর্ণও বটে। যদিও মুসলমান সমাজের নিয়মানুসারে বিবাহের ভার বহন সাধারণভাবে ছেলের পক্ষেই করিতে হয় তথাপি শিক্ষিত ছেলের সংখ্যা কম। মেয়েকে সৎপাত্রে দান হিন্দু সমাজের পক্ষে জটিল বটে কিন্তু মুসলমান সমাজে উহা জটিলতর। শরীফ খানদানের সঙ্গে সম্বন্ধ করিতে হইবে; কিন্তু সাধারণত পুরোনো ঘরানাদের অবস্থা আজকাল প্রায়ই সচ্ছল নয়। লেখাপড়া শিখিয়া যাহারা চাকরি বা ওকালতি বা ওইরূপ কোনো স্বাধীন ব্যবসায়ের। দ্বারা নিজের স্ত্রী-পরিবার প্রতিপালন করিতে সক্ষম তাহাদেরও সংখ্যা কম। সুতরাং বি-এল পাস ছেলের আদর যথেষ্ট। বাদশা মিঞা মনে বহু আশা পোষণ করিতেছিলেন। কিন্তু মীর সাহেবের প্রতি ছেলের অত্যধিক ভক্তির পরিচয় পাইয়া তিনি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন। তথাপি পিতার কর্তব্যপালনে তিনি কিছুতেই পরাঙ্মুখ হইবেন না।

সেদিন লালমিঞা আসরের নামায বাদ খড়ম পায়েই আসিয়া বাদশা মিঞার বাটী উপস্থিত। যথারীতি সালাম-সম্ভাষণ বাদ বাদশা মিঞা বলিলেন, মীরের পো এবার সৈয়দ সাহেবের বাড়িতে যে দাওৎ খেয়ে এল। আজকাল আর বাছ-বিচার কিছুই রইল না।

লালমিঞা, যা বলেছেন, সব একাকার হয়ে গেল। লোকটা বড় ফন্দিই জানে। কি জানেন, সহজে কি সৈয়দ সাহেবের বাড়ি দাওৎ পেয়েছেন! নগদ ১০০০০ টাকা ঘুষ।

১০০০০ টাকা ঘুষ! এ্যাঁ, বলেন কী?

তা বুঝি জানেন না। কত তালেই যে উনি আছেন! ছাপোষা মানুষ যদি হত তা হলে আর এতটা হত না। ওই যে আবদুল্লাহর দেনমোহরের টাকা; টাকাটা তো উনিই দিলেন কিনা? না হলে আবদুল্লাহ অত টাকা কোথায় পেত?

এ্যাঁ, দশ দশ হাজার টাকা দিলে? এত টাকা? হ্যাঁ, তা আর কি? পরের টাকা পরেই খাবে। আবদুল্লাহ্ কি আর কখনো ওই টাকা শোধ দিতে পারবে! ও যেমন এসেছে তেমনই যাবে সে কথা মীরের পো বেশ ভালোই জানে। মাঝখান থেকে সৈয়দের বাড়ি দাওৎ খেয়ে এই যে সমাজে একটু আটকা-আটুকি ছিল সেইটে খসিয়ে নিল। এখন তো মীরের পোর পোয়াবারো। আরো টাকার জোরে সব কতকগুলি ছেলেকে এমন হাত করেছে, এই দেখুন না আমার আলতাফ। সে তো আমার কোনো তওয়াক্কাই রাখে না। আর ও লোকটা এমন জাদু জানে! ওই যে একটা বিধবা মেয়ে মালেকাকে জুটিয়েছে। ছেলেটাকে এমনি সলাহ পরামর্শ দিয়েছে যে সে বলে যে ওই মালেকা না হলে সে আর বিয়েই করবে না। কী সব বেহায়াপনা দেখুন না। ছেলে নিজমুখে বলে কিনা সে ওখানে ছাড়া আর কোথাও বে করবে না।

লালমিঞা বলিলেন, শুনেছি মালেকা নাকি তার স্বামীর জীবনবীমার দরুন ৫০০০ টাকা পেয়েছে।

টাকার কথায় বাদশা মিঞা একটু নরম হইয়া কহিলেন, হ্যাঁ, সেও একটা কথা। আবার শুনেছি যে মীর সাহেব নাকি আরো ৫০০০ টাকা তাকে দান করেছেন। তা একত্রে দশ হাজার টাকা একটা মোটা টাকা বৈকি!

লালমিঞা বলিলেন, তা তো বটে, মেয়েটা কিন্তু বিধবা।

তা ছেলে নাকি বলে, বিধবা হলে কী হয়, আমরা তো আর হিন্দু নই। আমাদের বিধবা-বিবাহে তো কোনো আপত্তি নেই।

লালমিঞা, তা তো বটে, তবে কিনা একটা খুঁত।

সমাজে একটু নিন্দার কথা তো বটেই। মেয়েটি নাকি বেশ সুন্দরী। আর দেখুন না, টাকারও কিছু দরকার হয়ে পড়েছে। ছোকরাকে তখন বললাম ল পড়ে কাজ নেই, ডিপুটিগিরির চেষ্টা কর, কিছুতেই:শুনলে না; এখন বুঝ। ওকালতি তার আর ভালো লাগছে না। পয়সা-কড়ি বিশেষ কিছু পাচ্ছে বলে মনে হয় না। তা আমি আর কী করি! মীরের পোর পরামর্শ বিনে তো কোনো কাজেই সে হাত দেবে না। যাক, একবার মীরের পোর সঙ্গে পরামর্শ করেই দেখা যাক। দেখি কী বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *